This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ
রবীন আহসান
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস
[প্রথম প্রকাশ ৮ জানুয়ারি, ১৯৬৮
পুনর্লিখিতভাবে পরিবর্ধিত পুনঃপ্রকাশ ১ ডিসেম্বর, ১৯৬৮]
ভূমিকা
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা আমরা কিভাবে প্রয়ােগ করবাে, আমাদের দেশের বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে? মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা হবে ‘তীর’ যা আমাদের নিক্ষেপ করতে হবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবকে লক্ষ্য করে। যারা আজ লক্ষ্যহীনভাবে তীর ছোঁড়েন, এলােপাথারী তীর ছোঁড়েন, তারা সহজেই বিপ্লবের ক্ষতি করতে পারেন। মার্কসবাদী নামধারী বহু ব্যক্তিই ‘এলােপাথারী’ তীর ছুড়ে সুবিধাবাদী ও প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পালন করছেন।
সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন, “অতীতের ভুলগুলাে অবশ্যই প্রকাশ করে দিতে হবে। অতীতের খারাপ বস্তুকে বৈজ্ঞানিক মনােভাব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ও সমালােচনা করা প্রয়ােজন যাতে ভবিষ্যতের কাজ আরাে সতর্কভাবে সম্পন্ন করা যায়। এটাই হচ্ছে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানাের অর্থ।”
প্রাক স্বাধীনতাকালে১ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কেন ব্যর্থ হলাে উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে এবং উপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক শােষণের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে?
স্বাধীনতা উত্তরকালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি কেন ব্যর্থ হলাে উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী সংগ্রাম পরিচালনা করে সমাজতন্ত্রের পথ তৈরী করতে? এ ব্যর্থতার কারণগুলাে ক্ষমাহীনভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উদ্ঘাটন করতে হবে। যাতে একই ভুল ভবিষ্যতে না হয় এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারীরা সক্ষম হন তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে।
সারা দুনিয়ার সর্বহারা এক হও!
প্রাক স্বাধীনতা কাল
বৃটিশ শাসনকালে ভারতের সামাজিক বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত মূল দ্বন্দ্বগুলাে দায়ী ছিলঃ
১। ভারতীয় জনগণের সাথে বৃটিশ উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব।
২। ভারতের বিশাল কৃষক জনগণের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব।
৩। ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।
৪। ভারতের মুসলিম বুর্জোয়া, সামন্তগােষ্ঠী ও শ্রমিক-কৃষকের সাথে অমুসলিম বিশেষতঃ হিন্দু বুর্জোয়া, সামন্তগােষ্ঠী ও শ্রমিক-কৃষকের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব।
…………………………………………………………………….
১. এখানে ‘৪৭-পূর্ব অবিভক্ত ভারতবর্ষের সময়কালের কথা বলা হয়েছে -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৫
ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণী (মুসলিম ও অমুসলিম বুর্জোয়া) নিজস্ব শ্রেণীস্বার্থেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার দাবী করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম বিকশিত মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্ত গােষ্ঠী অখণ্ড স্বাধীন ভারতে অপেক্ষাকৃত বিপুলভাবে বিকশিত অমুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগােষ্ঠী কর্তৃক বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখতে পায়। তারা নিজেদের বিকাশের জন্য কিছু সুযােগ-সুবিধা দাবী করে। এভাবে শ্রেণীস্বার্থ তাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তােলে। একটা পর্যায়ে এ দ্বন্দ্ব বৈরীরূপ নেয় এবং মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগােষ্ঠী নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগ গঠন করে এবং নিজেদের অবাধ বিকাশের জন্য পৃথক স্বাধীন ভূখণ্ড পাকিস্তানের দাবী করে।
মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগােষ্ঠী তাদের দাবীর পিছনে মুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার জন্য অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সুযােগ নেয় এবং তাদের মাঝে জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্ররােচনা ও ষড়যন্ত্র চালায়। অমুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগােষ্ঠী অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার মানসে এবং ভারতের মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগােষ্ঠীর পাকিস্তান আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য অমুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের মাঝে জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র চালায় যাতে তারা অমুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়।
বৃটিশ উপনিবেশবাদীরাও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের শাসন ও শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র চালায়।
এ সকল কারণে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয় এবং অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বৈরী রূপ নেয়। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিধাবিভক্তিতে বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের শাসন ও শােষণ অব্যাহত রাখার সুবিধা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের অংশগ্রহণ এবং শ্রমিক-কৃষকদের চেতনার বিকাশ উপনিবেশবাদীদের বাধ্য করে তাদের সমর্থক ও সহযােগী বুর্জোয়া শ্রেণীর (মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস) নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে, যাতে তারা এ নয়া শাসকগােষ্ঠীর মাধ্যমে এ উপমহাদেশকে আধা উপনিবেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়। এভাবেই পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি হয়।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অবিভক্ত ভারতকে মুক্ত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ
প্রাক স্বাধীনতাকালে ভারতের সামাজিক অবস্থা ছিল উপনিবেশিক, সামন্তবাদী ও আধাসামন্তবাদী। উপনিবেশিক শক্তি সামন্তবাদকে জীবিত রেখে সামন্ত শ্রেণীর মাধ্যমে বিশাল কৃষক শ্রেণীকে শােষণ ও নিপীড়ন করতাে। কাজেই উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয় বিপ্লব এবং সামন্তবাদবিরােধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়া উচিত ছিল এ দেশের বিপ্লবের চরিত্র। এ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পন্ন করতে অক্ষম। কাজেই ঐতিহাসিকভাবে সর্বহারা শ্রেণী ও তার পার্টির দায়িত্ব এ বিপ্লব সম্পন্ন করা। কাজেই এ বিপ্লব হওয়া উচিত ছিল জাতীয় গণতান্ত্রিক অথবা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যার লক্ষ্য সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম। বিশ্ব বিপ্লবের ইহা একটি অংশ।
পৃষ্ঠা: ১৬
এ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির নিম্নলিখিত শর্ত পালনের প্রয়ােজন ছিলঃ
ক) “সুশৃঙ্খলিত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্বে সুসজ্জিত, আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী ও জনগণের সাথে সংযুক্ত এমন একটি পার্টি;
খ) এমন একটি পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সৈন্যবাহিনী;
গ) এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সমস্ত বিপ্লবী শ্রেণী ও বিপ্লবী দলের একটি যুক্তফ্রন্ট।”
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি উপরােক্ত শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়। ফলে বুর্জোয়া ও সামন্ত বাদীরা জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীকে নিজেদের পিছনে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ভারতকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন, “বিপ্লবী পার্টি হচ্ছে জনসাধারণের পথ প্রদর্শক; বিপ্লবী পার্টি যখন তাদেরকে ভ্রান্তপথে চালিত করে তখন কোন বিপ্লবই সার্থক হতে পারে না।”
স্বাধীনতাউত্তর কাল
পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত মূল দ্বন্দ্বগুলাে বিদ্যমানঃ
১) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব;
২) পূর্ব বাংলার বিশাল কৃষক জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব;
৩) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে
ক) সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের,
খ) সংশােধনবাদ বিশেষতঃ সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের,
গ) ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব;
৪) পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।
দ্বন্দ্বসমূহের বিশ্লেষণ
প্রথম ও পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ
মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তবাদের মাঝে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, বোম্বাই প্রভৃতি স্থানের বৃটিশ সমর্থক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা, বাঙালী বুর্জোয়া ও সামন্ত বাদীদের (যারা খুবই সংখ্যাল্প) চেয়ে বহুগুণ বিকশিত থাকায় স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্ত নি আন্দোলনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে।
পূর্ব বাংলার হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী ও সামন্তবাদীরা মুসলিম বুর্জোয়া, সামন্তবাদী, কৃষক-শ্রমিকের ওপর অর্থনৈতিক শােষণ ছাড়াও ধর্মীয় নিপীড়ন চালাতাে। বঙ্গভঙ্গ আইনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা একটি আলাদা প্রদেশ হলে অর্থনৈতিক শােষণ ও ধর্মীয় নিপীড়নের কিছুটা লাঘব হবে জেনে বাঙালী মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্ত বাদীরা তা সমর্থন করে। কিন্তু নিজ বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে হিন্দু বুর্জোয়া ও সামন্ত বাদীরা এ বিভাগের বিরােধিতা করে; ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। কাজেই মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্ত শ্রেণীর বিকাশের দুটি বাধা ছিল, একটি হলাে বৃটিশ উপনিবেশবাদ আর একটি হিন্দু বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ধর্মীয় নিপীড়ন। কাজেই স্বাধীনতা আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত না হওয়ায় পূর্ব বাংলার সৃষ্টি ঐতিহাসিকভাবে প্রয়ােজন ছিল।
পৃষ্ঠা: ১৭
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা পাকিস্তানের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেণী বিকাশ ঘটাতে সক্ষম মনে করে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে এবং মুসলিম শ্রমিক-কৃষকের পাকিস্তান দাবীর পিছনে ঐক্যবদ্ধ করে। তারা পাকিস্তানে যােগ দেয় এবং এভাবে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের প্রদেশে পরিণত হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব অবাঙ্গালী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের হাতে থাকায় বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের নিকট হস্তান্তর করে। কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচীতে স্থাপন, বৃটিশ উপনিবেশবাদের। সামরিক আমলা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের উপাদান সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং বেসামরিক আমলা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অংশ চালু করা (এই সকল সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অধিকাংশই বৃটিশ উপনিবেশবাদ সমর্থক অবাঙালী ছিল) প্রভৃতির মাধ্যমে এই অবাঙালী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের একচ্ছত্র মালিকানা লাভ করে এবং নিজেদের শ্রেণী বিকাশের অবাধ সুযােগ পায়।
এ শাসক শ্রেণী পূর্ব বাংলার স্বতন্ত্র জাতীয় ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য স্বায়ত্তশাসন কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রদানের পরিবর্তে একে অবাধ শােষণের জন্য প্রথম থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসে। এ শাসকশ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া প্রভৃতির অর্থ দ্বারা বিকাশ লাভ করে এবং এ বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে সিয়াটো, সেন্টো প্রভৃতি সামরিক চুক্তি ও বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করে। এভাবে পাকিস্তান আধাউপনিবেশে পরিণত হয়। সম্প্রতি এ শাসক শ্রেণী সংশােধনবাদ বিশেষতঃ সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে নানা প্রকার অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করেছে।
পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া, কাগজ প্রভৃতির অর্থ দ্বারা, সস্তা শ্রম শক্তি দ্বারা, প্রায় সাত কোটি মানুষের বাজার এবং সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যে পাকিস্তানী বুর্জোয়া শ্রেণী একচেটিয়া পুঁজিপতিতে পরিণত হয়। তারা পূর্ব বাংলাকে শাসন ও শােষণের একটি স্থায়ী ক্ষেত্রে পরিণত করে।
পূর্ব বাংলাকে শাসন ও শােষণের একটি বিরাট বাধা হলাে তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তা এবং ভাষা এ স্বাতন্ত্রের প্রধান উপাদান। জাতি হিসাবে পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র মুছে দেয়ার জন্য এ পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রচলনের হীন প্রচেষ্টা চালায়। এ হীন প্রচেষ্টাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করে দেয়। বর্তমানেও এ শাসক শ্রেণী বাংলা ভাষা পরিবর্তনের হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এ পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শ্রেণীর বিকাশের জন্য ক্রমশঃ পূর্ব বাংলার সম্পদ, সস্তা শ্রমশক্তি ও প্রায় সাত কোটি মানুষের বাজার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এভাবে বৃটিশ উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশ থেকে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসাবে কিছু কালের জন্য আধা উপনিবেশে পরিণত হলেও এখানে প্রথম থেকেই পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শাসকগােষ্ঠীর জাতীয় নিপীড়ন ও শােষণ বিদ্যমান ছিল। এ শাসকশ্রেণী নিজেদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার ওপর জাতীয় নিপীড়ন বৃদ্ধি করে এবং তাদের বিকাশ একচেটিয়া রূপ গ্রহণের পর্যায়ে এলে তারা শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য তাদের শাসন ব্যবস্থাকে ক্রমেই অধিকতর সমরবাদী করে এবং এভাবে পূর্ব বাংলার ওপর জাতীয় নিপীড়ন উপনিবেশিক শােষণের রূপ নেয় এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর উপনিবেশে পরিণত হয়। এ উপনিবেশিক শাসকশ্রেণী
পৃষ্ঠা: ১৮
নিজেরাই সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এ কারণে পাকিস্তান নিজেই একটি আধা উপনিবেশিক ও আধা সামন্তবাদী দেশ।
এই পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী পূর্ব বাংলার পাকিস্তানবাদী দালাল বুর্জোয়াদের মাধ্যমে এবং গ্রামে সামন্তবাদকে জীবিত রেখে এদেশে শাসন ও শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এ উপনিবেশিক শােষণের ফলে পূর্ব বাংলার মাঝারী ও ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ব্যাহত হয়েছে এবং গ্রামে সামন্তবাদী শােষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষতঃ বর্তমানে বিদেশী ঋণ পরিশােধের জন্য, বিদেশী ঋণ হ্রাসের ফলে কলকারখানার পুঁজি সংগ্রহের জন্য গ্রাম্য শােষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। কাজেই পূর্ব বাংলার শ্রমিক, কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া ও মাঝারী বুর্জোয়া শ্রেণীর এক অংশ তথা সমগ্র পূর্ব বাংলার জাতি এ শােষণে শােষিত। এ পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী অখণ্ড পাকিস্তান, ধর্মের ভিত্তিতে এক জাতি, তথাকথিত ইসলামী সংস্কৃতি, পূর্ব বাংলা একটি প্রদেশ প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে শােষণের উপনিবেশিক চরিত্র গােপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন উপনিবেশিক শক্তি শােষণের উপনিবেশিক চরিত্র গােপন করার জন্য এক দেশ, এক জাতি প্রভৃতি প্রচারে প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ইতিহাস তার ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হতে বাধ্য।
দ্বিতীয়ঃ পূর্ব বাংলার বিশাল কৃষকজনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বঃ
গ্রামে সরকারী কর্মচারী (পুলিশ, সার্কেল অফিসার), মৌলিক গণতন্ত্রী (বি.ডি), জমিদার, ধনীচাষী, অসৎ ভদ্রলােক (টাউট) ও মাঝারী চাষীর ওপরের স্তর গ্রামের ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী ও মাঝারী চাষীর ব্যাপক অংশের ওপর সামন্তবাদী শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শ্রেণী গ্রামের সামন্তবাদীদের জিইয়ে রেখেছে। এবং তাদের বিকাশের সর্বময় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ শাসক শ্রেণী তাদের বিকাশের নিমিত্তে পুঁজি ও সস্তা শ্রমশক্তি সংগ্রহের জন্য সামন্তবাদী শােষণ তীব্রতর করছে।
গ্রামে সামন্তবাদী শােষণের প্রকাশ হলাে ভূমিকর ও অন্যান্য খাজনা বৃদ্ধি, গ্রামে রেশন চালু না করা, বুনিয়াদী গণতন্ত্র সৃষ্টি করা, মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রদান করা, বর্গা, পত্তনি, ঠিকা ও সুদ ব্যবস্থার অবসান না করা, ঋণ প্রভৃতির মাধ্যমে চাষীদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ না করা, সেচ প্রকল্প কার্যকরী না করা, বিভিন্ন ধরনের ইজারাদারী প্রথা, পােকা ধ্বংসের ব্যবস্থা না করা, অবৈতনিক সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু না করা, বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা প্রভৃতি।
তৃতীয়ঃ ক) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একদিকে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযােগিতা বজায় রাখছে, অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়াদের এক অংশের সাথে আঁতাত রাখছে এবং এদের মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসকশ্রেণীর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা ঋণ, প্রত্যক্ষ ব্যবসায় প্রভৃতির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণকে শােষণ করছে। তারা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিয়ে চীন বিরােধী১, কমিউনিস্ট বিরােধী ঐক্যজোট গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীরা নিজস্ব শ্রেণী স্বার্থেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে বর্তমানে আঁতাত
…………………………………………………………………….
১. সে সময়ে চীন মাও সেতুঙ-এর নেতৃত্বে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল -প্রকাশক
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৯
করতে পারছে না এবং নিজেদের শ্রেণী বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে সমাজতান্ত্রিক দেশ বিশেষতঃ চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পূর্ব বাংলার উপনিবশিক শাসন ও শােষণের সুযােগ নিয়ে তাদের সমর্থক পূর্ব বাংলার বুর্জোয়াদের সাহায্য ও সমর্থন করছে। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক এ দালাল বুর্জোয়ারা উপনিবেশিক শাসন বিরােধী আন্দোলন করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এ আন্দোলনকে মূলধন করে দুইভাবে ব্যবহার করছে-একদিকে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে চীন বিরােধী পাক-ভারত যৌথ চুক্তি সম্পাদন করার জন্য; অন্যদিকে এই দালাল বুর্জোয়াদের দ্বারা পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে চীন বিরােধী পূর্ব বাংলা-ভারত যৌথ চুক্তি সম্পাদন ও পূর্ব বাংলাকে প্রত্যক্ষ মার্কিন উপনিবেশে পরিণত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন সমর্থক পূর্ব বাংলার দালাল বুর্জোয়ারা ছয় দফা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব করছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এদেশের সামন্তবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী ধর্মীয় পার্টিগুলােকে সাহায্য ও সমর্থন করছে। এরা সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র।
খ) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে সংশােধনবাদ, বিশেষতঃ সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ
পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের নিয়ে চীন বিরােধী, কমিউনিস্ট বিরােধী ঐক্যজোট প্রতিষ্ঠার জন্য তারা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম তারা সমর্থন করবে না। কারণ পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের সাথে আঁতাত রেখে পাকিস্তানসহ তার উপনিবেশকে শােষণ করাই তাদের লক্ষ্য। এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নস্যাৎ করার জন্য তারা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের সাহায্য করবে যাতে পূর্ব বাংলাকে শােষণের একটা ভাগ তারা পায়।
প্রসঙ্গক্রমে বায়াফ্রা, বার্মা, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের কথা উল্লেখযােগ্য। বায়াফ্রার জনগণ সংগ্রাম করছে জাতীয় অত্যাচার, নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা নাইজেরীয় সামরিক সরকারকে অস্ত্র, অর্থ ও লােক সরবরাহ করে বায়াফ্রার জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তারা সমগ্র নাইজেরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে শােষণ চালাতে পারে। তারা বার্মার মুক্তি সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখার, ভিয়েতনামের মহান সংগ্রামকে মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
গ) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ
ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী সরকার সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমর্থন করবে না। কারণ তার উদ্দেশ্য হলাে বুর্জোয়ার নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ব বাংলাকে শােষণ করা এবং চীন বিরােধী, কমিউনিস্ট বিরােধী একটি মিত্র পাওয়া। কিন্তু সর্বহারার নেততে মক্ত পর্ববাংলা সহায়ক হবে আসাম পশ্চিমবাংলা বিহার, ত্রিপুরা তথা সমগ্র ভারতের শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির। এ কারণে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ শ্রমিক-কৃষকের পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বানচাল করার চেষ্টা করবে।
চতুর্থ ও পূর্ব বাংলার বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্বঃ
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিকদের শােষণ করে এবং এদের মাঝে একটি অংশ পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের দালাল হয়ে পূর্ব বাংলাকে শােষণ করছে, অপর অংশ সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল। একটি অংশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ উভয়েরই বিরােধী, যারা সত্যিকার জাতীয় বুর্জোয়া। পূর্ব বাংলার
পৃষ্ঠা: ২০
বুর্জোয়াদের প্রথম অংশ দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক। দ্বিতীয় অংশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল যারা ভারতের সাথে আঁতাত রেখে নিজস্ব শ্রেণী বিকাশের জন্য যতটুকু জাতীয় অধিকার প্রয়ােজন তার জন্য সংগ্রাম করতে ইচ্ছুক। পূর্ব বাংলার বুর্জোয়াদের ব্যাপক অংশ বর্তমানে এদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ। এদের নেতৃত্বে জাতীয় সংগ্রাম কখনাে সম্পূর্ন হতে পারে না। এদের সাথে জনগণের শত্রুতার সম্পর্ক ছাড়াও তারা যতক্ষণ পাকিস্তানী। উপনিবেশবাদের বিরােধিতা করে ততক্ষণ জনগণের সাথে একটা মিত্রতার সম্পর্কও রয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণীর তৃতীয় অংশ জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে জনগণের শত্রুতার সম্পর্ক ছাড়াও তারা যতক্ষণ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম করে ততক্ষণ একটা মিত্রতার সম্পর্কও রয়েছে।
বর্তমানে জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক দালাল বুর্জোয়াদের হাতে। এ নেতৃত্বের অবসান তিন প্রকারে হওয়া সম্ভব। (ক) সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি দৃঢ়ভাবে জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে কৃষক-জনতাকে উপনিবেশবাদ ও সামন্ত -বাদ বিরােধী সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করলে; (খ) উপনিবেশিক শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পন করে চীন বিরােধী, কমিউনিস্ট বিরােধী জোট স্থাপন করলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাহায্য ও সমর্থনে দালাল বুর্জোয়াদের জাতীয় সংগ্রাম ধ্বংস করতে সক্ষম হবে; (গ) উপনিবেশিক শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুর্জোয়াদের সাথে। আপােষে আসলে এই দালাল বুর্জোয়াদের আসল বিশ্বাসঘাতকতা ও গণবিরােধী চরিত্র প্রকাশ পাবে।
প্রধান দ্বন্দ্ব
উপরােক্ত দ্বন্দ্বগুলাে ছাড়াও পূর্ব বাংলার সমাজে আরাে বহু দ্বন্দ্ব রয়েছে, কিন্তু এই চারটি মূল দ্বন্দ্ব। সভাপতি মাও বলেছেন, “কোনাে প্রক্রিয়াতে যদি কতকগুলাে দ্বন্দ্ব থাকে। তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটা প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে। অন্যগুলাে গৌণ ও অধীনস্ত স্থান নিবে। তাই দুই বা দু’য়ের অধিক দ্বন্দ্ব বিশিষ্ট কোন জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালােচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলে সব সমস্যাকেই সহজে মীমাংসা করা যায়।”
পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয় সংগ্রামে শ্রমিক-কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া, মাঝারী বুর্জোয়ার এক অংশ এবং দেশপ্রেমিক ধনী চাষী ও জমিদারদের অর্থাৎ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। কাজেই বর্তমান সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব।
কিন্তু উপনিবেশবাদ বিরােধী জাতীয় সংগ্রাম একটা নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছলে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শ্ৰেণীকে রক্ষার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ একযােগে অথবা আলাদাভাবে নিজেদের সৈন্য দ্বারা পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে নস্যাৎ করার প্রচেষ্টা চালাবে। এ অবস্থায় পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ গণসংগ্রাম বিরােধী প্রধান ভূমিকা থেকে গৌণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিংবা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ পূর্ব বাংলার গণবিরােধী সংগ্রামের গৌন ভূমিকা থেকে ক্রমশঃ
পৃষ্ঠা: ২১
মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবে। এভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিংবা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে নতুন করে ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে সঠিক মুক্তি সংগ্রামের পথে পরিচালিত করতে হবে।
পূর্ব বাংলার বিপ্লব ও তার চরিত্র
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা নিজেদের বিকাশের জন্য পাকিস্তানে যােগ। দেয়। কিন্তু পাকিস্তানী উপনিবেশিক শ্রেণী পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া বিকাশের জন্য যে সুবিধা প্রয়ােজন তা নিজেদের বিকাশে ব্যবহার করে। ফলে এদেশে বুর্জোয়া বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই বুর্জোয়া বিকাশের প্রয়ােজনীয় অবস্থার সৃষ্টি অর্থাৎ সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদের অবসান প্রয়ােজন।
সামন্তবাদের অবসান সম্ভব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এবং উপনিবেশিক শাসনের অবসান সম্ভব জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লব হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।
বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের যুগে বুর্জোয়ারা এ বিপ্লব সম্পূর্ণ করতে পারে না। নিজেরাই কিছুদিন পরে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালাল হয়ে যায়। এ বিপ্লব সম্পূর্ণ করার মত একটি শক্তিই রয়েছে তা হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণী ও তার পার্টি। সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবের লক্ষ্য ধনতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র। বিপ্লব সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত বলে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে পরিচিত হবে যা বিশ্ব বিপ্লবের একটি অংশ।
এ বিপ্লবের একটি চরিত্র হলাে সশস্ত্র বিপ্লব। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল উপাদান সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও আইন এবং এদের সাহায্যে উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী পূর্ব বাংলাকে শাসন ও শােষণ করছে। এ নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরের সমন্বয়ে নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। সভাপতি মাও-এর ভাষায় বন্দুকের নলের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হবে।
এ বিপ্লবের আর একটা চরিত্র হলাে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম। এ বিপ্লবে দ্রুত বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণগুলাে হচ্ছে পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক-জনগণের অনৈক্য অবস্থা, সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ও মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী পার্টির অভাব, সংশােধনবাদী ও নয়া-সংশােধনবাদী পার্টি কর্তৃক জনগণকে বিপথে পরিচালনা, জনগণের মাঝে প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের প্রভাব।
পক্ষান্তরে উপনিবেশিক শক্তি একত্রিত, শাসনক্ষমতা সুদৃঢ়, বি.ডি. প্রথার মাধ্যমে গ্রাম পর্যন্ত তাদের শাসন ব্যবস্থা বিস্তৃত এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সম্প্রসারণবাদ তাদের সাহায্য করবে। তাই বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের পক্ষে। এ অবস্থা পরিবর্তন করতে সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়ােজন; কাজেই পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী দুরূহ যুদ্ধের মাধ্যমেই সম্পন্ন হবে।
পৃষ্ঠা: ২২
এ বিপ্লবের আর একটি চরিত্র হলাে গ্রাম্য এলাকা দ্বারা শহর ঘেরাও এবং পরে শহর দখল। সভাপতি মাও বলেন, “নিয়ম অনুসারে বিপ্লব আরম্ভ হয়, গড়ে ওঠে এবং জয়ী হয় ঐ সকল স্থানে যেখানে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলাে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কাজেই গ্রাম্য এলাকায় গিয়ে কৃষকদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য জাগ্রত করে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে গ্রাম্য এলাকা দখল করতে এবং ঘাঁটি এলাকা স্থাপন করতে হবে। শহরগুলাে দখলকৃত গ্রাম্য এলাকা দ্বারা ঘেরাও করতে হবে এবং পরে শহর দখল করতে হবে।
এ বিপ্লবের আর একটি চরিত্র হলাে ঐক্যফ্রন্ট গঠন।
জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে, জাতীয় সংগ্রামের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা অপরিহার্য।১
শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে, সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ বিরােধী সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের মাঝে সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি অবশ্যই আদর্শগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে এবং স্বাধীনতা ও উদ্যোগ গ্রহণের নীতিতে অটল থাকবে এবং নিজের নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য জিদ ধরবে।
কাজেই ঐক্যফ্রন্টে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব, স্বাধীনতা ও উদ্যোগ গ্রহণ থাকতে হবে, আর তা থাকার একটি মাত্র গ্যারান্টি হচ্ছে সর্বহারার পার্টির নেতৃত্বে একটি গণফৌজ। সভাপতি মাও বলেছেন, “গণফৌজ না থাকলে জনগণের কিছুই থাকবে না। কাজেই ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে গণফৌজ।
জাতীয় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাধারণ কর্মনীতি
১। সর্বহারার পার্টির নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক এমন স্থানে অর্থাৎ জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য গ্রামাঞ্চলে যেতে হবে।
২। গ্রাম্য মজুর, গরীব চাষী ও মাঝারী চাষীকে উজ্জীবিত করতে হবে সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরােধী গেরিলা যুদ্ধে।
৩। কৃষি বিপ্লব ও উপনিবেশবাদ সমর্থক জমিদার, ধনী চাষীদের জমি দখল করে তা ক্ষেতমজুর ও গরীব চাষীদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। সরকারী (পুলিশ, সার্কেল অফিসার) এবং বি.ডি.-দের মাঝে উপনিবেশবাদ সমর্থকদের ধ্বংস করতে হবে।
দেশপ্রেমিক জমিদার, ধনী চাষী ও অন্যান্যদের বর্গা বদলানাে বাতিল, পত্তনি বদলানাে বাতিল, বর্গা শােষণ ও পত্তনি শােষণ কমানাে প্রভৃতি কার্যকরী করতে হবে। সুবিধাজনক অবস্থায় দৃঢ়ভাবে ভূমি সংস্কার করতে হবে।
৪। গেরিলা বাহিনী থেকে নিয়মিত বাহিনী সৃষ্টি ও ঘাটি এলাকা তৈরী করতে হবে।
৫। ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬। গ্রাম্য এলাকা দখল করে তা দিয়ে শহর ঘেরাও ও শেষ পর্যন্ত শহর দখল করতে হবে।
…………………………………………………………………….
১. এখানে লিন পিয়াও সংক্রান্ত একটি বক্তব্য ছিল। পূর্বে প্রকাশিত রচনা সংকলনে সেটি বাদ দেয়া হয়েছিল। সে অংশটি সগ্রহ করা যায়নি বিধায় এখানে সংযুক্ত করা গেল না। উল্লেখ্য, কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে ‘৭৩ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দশম অধিবেশনে পার্টির সংবিধান থেকে লিন পিয়াও সংক্রান্ত সমস্ত অধ্যায় বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৩
৭। পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ ও তার দালাল পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, অন্য যে সকল বৈদেশিক শক্তি উপনিবেশিক শ্রেণীকে সমর্থন করে (যদি তাদের সম্পত্তি এ দেশে থাকে) এবং বৈদেশিক শক্তিসমূহের দালালদের (যখন তারা জাতীয় বিপ্লবের বিরােধিতা করে) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৮। দখলকৃত এলাকায় জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকার। গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের মাধ্যমে, সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরের সহযােগিতায় শত্রুর ওপর একনায়কত্ব ও জনগণের মাঝে গণতন্ত্র কায়েম করবে।
৯। বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিকে স্বায়ত্তশাসন ও বিভিন্ন উপজাতিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে।
১০। সকল অবাঙালী দেশপ্রেমিক জনগণের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিকাশের পূর্ণ সুযােগ দেয়া হবে।
১১। জনগণের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
বিপ্লবী যুদ্ধের সাধারণ কর্মনীতি
১। নিয়মিত বাহিনী গড়ে না ওঠা পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ বিপ্লবী যুদ্ধের প্রধান রূপ;
২। প্রধানতঃ চাষীদের নিয়ে গঠিত লালফৌজ প্রধান সংগঠন;
৩। গেরিলা যুদ্ধের গতিপথে নিয়মিত বাহিনী গড়ে উঠবে;
৪। দীর্ঘস্থায়ী দুরূহ যুদ্ধ চলবে।
প্রধান কাজ ও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ও মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা।
অনুপূরক কাজঃ (১) সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরােধী সংগ্রামে কৃষকদেরকে গেরিলা যুদ্ধে উজ্জীবিত করা; (২) প্রধানতঃ চাষীদের নিযে গেরিলা বাহিনী করা ও গেরিলা যুদ্ধ করা; (৩) কৃষি বিপ্লব করা; (৪) নিয়মিত বাহিনী ও ঘাঁটি এলাকা তৈরী করা।
আন্তর্জাতিক বক্তব্য
বর্তমান বিশ্বের মূল দ্বন্দ্বগুলাে নিম্নরূপ : ১। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের দ্বন্দ্ব;
২। একদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব ও সংশােধনবাদীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও সংশােধনবাদের মাঝে দ্বন্দ্ব;
৩। সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণীর সাথে নিজেদের দেশের জনগণের দ্বন্দ্ব;
৪। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত জনগণের দ্বন্দ্ব।
পৃষ্ঠা: ২৪
দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণঃ
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদের সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের দ্বন্দ্বঃ
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী তাদের শাসন ও শােষণ অব্যাহত রাখার পথে এবং বিশ্বকে নিজেদের শােষণের ক্ষেত্র হিসাবে পুনর্বণ্টনের পথে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহকে বিশেষতঃ সমাজতান্ত্রিক চীনকে প্রধান বাধা বলে মনে করে। কারণ, চীন সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তিতে সর্বদা সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী শােষণের স্বরূপ তুলে ধরছে। এ শাসন ও শােষণের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বিপ্লবের পতাকাকে চীন উধ্বে তুলে ধরছে। চীনের বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণী বিশ্বের দেশ ও জাতিসমূহের শাসন ও শােষণ বিরােধী সংগ্রামকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। ও বাস্তব সাহায্য করছে। চীন বিশ্বের শাসন ও শােষণ বিরােধী সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
কাজেই সাম্রাজ্যবাদ ও সংশােধনবাদ এ প্রতিবন্ধককে ধ্বংস করতে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অবস্থা বিপ্লবের পক্ষে, জনগণের পক্ষে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদ, সংশােধনবাদ ও সকল প্রতিক্রিয়ার বিপক্ষে। বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সমাজতন্ত্রের পক্ষে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদীরা ও সংশােধনবাদীরা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দ্বন্দ্বের অবসান করতে অক্ষম। সভাপতি মাও বলেছেন, “আজকের দিনে দু’ধরনের বাতাস প্রবাহিত, পূবালী বাতাস ও পশ্চিমী বাতাস। চীনে একটি প্রবাদ আছে, ‘হয় পূবালী বাতাস পশ্চিমী বাতাসকে দাবিয়ে রাখে, না হয় পশ্চিমী বাতাস পূবালী বাতাসকে দাবিয়ে রাখে। আমাদের মতে বর্তমান পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পূবালী বাতাস পশ্চিমী বাতাসকে দাবিয়ে রাখছে। এর অর্থ এই যে, সমাজতান্ত্রিক শক্তি সামাজ্যবাদী শক্তির ওপর। অত্যাধিক প্রাধান্য লাভ করেছে। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদীরা ও সংশােধনবাদীরা বাইরে থেকে চাপ প্রয়ােগ, ব্লাকমেইল এবং আভ্যন্তরীণ দালালদের সাথে যােগাযােগ প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তন ঘটিয়ে ধনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এবং সে অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
সভাপতি মাওসেতুঙ কর্তৃক সূচিত ও পরিচালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদী, সংশােধনবাদী ও আভ্যন্তরীণ পুঁজিবাদী দালালদের চীনে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার রঙীন স্বপ্নকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছে। এ সাংস্কৃতিক বিপ্লব পথ দেখিয়েছে কিভাবে বিপ্লবীরা সংশােধনবাদী দেশসমূহে পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণীকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। কাজেই সমাজতন্ত্রী দেশসমূহের সাথে সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী দেশসমূহের দ্বন্দ্ব বর্তমান। কিন্তু এ দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব নয়।
২. একদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের নিজেদের মাঝে ও সংশােধনবাদী দেশগুলাের মাঝে দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী দেশগুলাের মাঝে দ্বন্দ্বঃ
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহকে কমিউনিজমের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সামরিক জোটে আবদ্ধ করছে এবং এভাবে তাদেরকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শােষণ করছে। এ কারণে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের দ্বন্দ্ব
পৃষ্ঠা: ২৫
রয়েছে। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণীগুলাের সাথে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অন্যান্য সংশােধনবাদী দেশগুলােকে শাসন ও শােষণ করছে এবং যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন জোটে আবদ্ধ রেখেছে যাতে তার খপ্পর থেকে কেউ বেরুতে না পারে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের স্বার্থে সংগ্রাম ও সহযােগিতা করে। তারা নয়া-উপনিবেশিক ও উপনিবেশিক শাসন ও শােষণের জন্য ক্রমশঃ পৃথিবীকে নিজেদের প্রভাবের এলাকা হিসাবে ভাগ করে নিচ্ছে। এ এলাকা বণ্টনের বিষয় নিয়ে তাদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আবার নিজেদের সাধারণ স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা সহযােগিতা করে।
কাজেই এ দ্বন্দ্ব বর্তমান। কিন্তু এটা প্রধান দ্বন্দ্ব নয়।
৩. সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণীর সাথে নিজেদের দেশের জনগণের দ্বন্দ্বঃ
সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণী নিজেদের দেশের আপামর জনসাধারণকে শােষণ করছে। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শাসন ও শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ কারণে তাদেরকে বিশাল সামরিক বাহিনী গঠন করতে হয়েছে। এ সামরিক ব্যয়ভার আসে দেশের জনগণের কাছ থেকে, ফলে জনগণের ওপর শাসন ও শােষণ তীব্রতর হচ্ছে। কোনাে কোনাে সাম্রাজ্যবাদী ও সংশােধনবাদী দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু জাতির ওপর শাসন ও শােষণ অধিকভাবে চালানাে হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আফ্রো-আমেরিকান (নিগ্রো)-দের ওপর জাতিগত শােষণ করছে। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ গুটিকয় বিশ্বাসঘাতক দালালদের সহায়তায় সংখ্যালঘু জাতিগুলােকে শােষণ করছে।
কাজেই এ দ্বন্দ্ব বর্তমান। কিন্তু ইহা প্রধান দ্বন্দ্ব নয়।
৪. মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত জাতিসমূহের দ্বন্দ্বঃ
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ শাসন ও শােষণ করছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহকে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশে পরিণত করে। এ শােষণের ওপর নির্ভর করছে তাদের বিকাশ। এ কারণে আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলাে হচ্ছে পৃথিবীর গ্রামাঞ্চল। তাদের লুণ্ঠন করে বেঁচে আছে পৃথিবীর শহরাঞ্চল ইউরােপ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাে। এই গ্রামাঞ্চলে যেখানে ইউরােপ ও আমেরিকার মত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সুদৃঢ় নয় এবং অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল, সেখানেই বিপ্লবের সূচনা করতে হবে এবং কালক্রমে সমগ্র গ্রামাঞ্চল দখল করে শহর অবরােধ করা এবং শেষে শহর দখল করা মাওসেতুঙের চিন্তানুসারী নীতি।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশের বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদ
পৃষ্ঠা: ২৬
ও উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ শাসন ও শােষণ থেকে নিজেদের দেশ ও জাতিগুলােকে মুক্ত করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরােধী সংগ্রামের এটা একটা বিরাট বিজয়। কিন্তু এই বুর্জোয়া শ্রেণী, শ্ৰেণী বিকাশের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযােগিতার সম্পর্ক স্থাপন করে নিজ দেশকে নয়া-উপনিবেশে পরিণত করেছে। এ অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শর্ত তৈরী করা সর্বহারা শ্রেণীর ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
ভিয়েতনামের বীর জনগণের মহান মুক্তিযুদ্ধ যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করার পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধঃপতিত দোসর সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ শান্তি আলােচনার প্রহসনের ভেতর দিয়ে এ মহান মুক্তি সংগ্রামকে মুছে দেয়ার জঘন্য ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
তবু ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়, বার্মা, নক্সালবাড়ী, বিহার, কঙ্গো, মােজাম্বিক, এ্যাঙ্গোলা, আজানিয়া, প্যালেস্টাইন, বায়াফ্রা, রােডেশিয়া, নিউজিল্যান্ড, বলিভিয়া প্রভৃতি স্থানে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বর্তমান বিশ্বপ্রতিক্রিয়ার কেন্দ্র। ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ার জনগণের প্রধান শত্রু।
এ দ্বন্দ্ব বর্তমান এবং ইহাই প্রধান দ্বন্দ্ব।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান বিপদ হলাে সংশােধনবাদ ও নয়া-সংশােধনবাদ। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদ বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি দ্বারা কু-দেতা ঘটিয়ে ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে কয়েকটি সমাজতন্ত্রী দেশে। যে সকল কমিউনিস্ট পার্টির এখনাে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়নি সেগুলাের মাঝে বুর্জোয়া দালালদের সহায়তায় প্রতিবিপ্লবী কাজ পরিচালনা করছে এবং কোনাে কোনাে পার্টির ক্ষমতা এই দালালরা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যে আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জঘন্য চক্রান্ত করছে।
কোনাে কোনাে পার্টি সংশােধনবাদীদের এ চক্রান্তের খপ্পরে পড়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে স্বাধীন পথ অনুসরণ করছে ঘােষণা করে প্রকৃতপক্ষে সুবিধাবাদী পথ অনুসরণ করছে, সংশােধনবাদীদের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা আর সংশােধনবাদের মাঝে কোনাে মাঝারী পথ নেই।
বর্তমান দুনিয়ায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও আলবেনিয়ার শ্রমিক পার্টি সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হয়ে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। সভাপতি মাওসেতুঙ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, বর্তমান দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতা ও পরিচালক।১
…………………………………………………………………….
১. এখানে লিন পিয়াও সংক্রান্ত বক্তব্য ছিল। বক্তব্যটি পূর্বে প্রকাশিত রচনা সংকলন থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। দেখুন, এই রচনা সংগ্রহের পৃষ্ঠা-২৩এর ফুটনােট -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৭
“সভাপতি মাওসেতুঙ প্রতিভার সঙ্গে, সৃজনশীলভাবে ও সামগ্রিকভাবে মার্কসবাদলেনিনবাদকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন, রক্ষা করেছেন ও বিকাশ করেছেন, মার্কসবাদলেনিনবাদকে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।” মার্কস ও এঙ্গেলস মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা। লেনিন মার্কসবাদকে সাম্রাজ্যবাদী যুগে সর্বহারা বিপ্লব পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান করেন, সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠা করেন, মার্কসবাদলেনিনবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। স্তালিন লেনিনবাদকে রক্ষা করেন ও সর্বহারা বিপ্লবের কতকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান করেন। সভাপতি মাওসেতুঙ সাম্রাজ্যবাদের সামগ্রিক ধ্বংসের যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে বিকাশ করেছেন। তিনি সমাধান করেছেন, কিভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশে ধনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রতিরােধ করা যায় এবং যে সকল দেশে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানকার সর্বহারা বিপ্লবীরা কীভাবে পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। তিনি প্রতিভার সঙ্গে দুনিয়ার প্রথম মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা ও পরিচালনা করেন। এভাবে তিনি মার্কসবাদকে এক সম্পূর্ণ নতুন স্তরে উন্নীত করেন, যে স্তর হলাে মাওসেতুঙ চিন্তাধারার স্তর।
‘বিশাল সাগর পার হবার জন্য নির্ভর করি কর্ণধারের ওপর, বিপ্লব করার জন্য নির্ভর করি মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ওপর। কাজেই বর্তমান যুগের বিপ্লবীদের চেনার উপায়মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন, অনুশীলন ও তার ভাল সৈনিক হওয়ার ওপর।
বর্তমান আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক নতুন ধরনের সংশােধনবাদ দেখা দিয়েছে। এরা মুখে মাওসেতুঙ-এর বুলি ঝাড়ে এবং কাজে তার বিরােধিতা করে; কথায় ও কাগজে মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী ও অনুশীলনে সংশােধনবাদী পথ অনুসারী। মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মুখােশ এটে জনগণকে ও বিপ্লবীদের ধােকা দেয়ার বুর্জোয়া দালালদের এ এক অভিনব কারসাজি ও ইহাই নয়া-সংশােধনবাদ।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরাট পুনর্গঠন-পুনর্বিন্যাসের সময়। বিভিন্ন দেশে যেখানে সংশােধনবাদী ও নয়া-সংশােধনবাদীরা নেতৃত্ব কুক্ষিগত করছে, সেখানে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারীরা নতুন পার্টি সৃষ্টি করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণকে বিপ্লবের পথে পরিচালনা করছে।
নয়া মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি গঠনের প্রয়ােজনীয়তা
সভাপতি মাও বলেছেন, “যদি বিপ্লব করতে হয় তাহলে অবশ্যই একটি বিপ্লবী পার্টি থাকতে হবে। বিপ্লবী পার্টি ছাড়া, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী তত্ত্বে ও বিপ্লবী রীতিতে গড়ে ওঠা একটি বিপ্লবী পার্টি ছাড়া, শ্রমিক শ্রেণী ও ব্যাপক জনসাধারণকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের পরাজিত করতে নেতৃত্ব দান করা অসম্ভব।” আমাদের দেশে গতানুগতিক যে মার্কসবাদী নামধারী পার্টি ছিল তা মস্কোপন্থী’ ও ‘পিকিংপন্থী’ নামধারী দুই উপদলে বিভক্ত হয়। তাদেরকে, তাদের থেকে বেরিয়ে আসা অথবা বিতাড়িত এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্ন দল ও উপদলগুলােকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা প্রয়ােজন।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী সংশােধনবাদী পার্টি
এই পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সকল মূল তত্ত্বকে সংশােধন করে প্রকৃতপক্ষে শােষক শ্রেণী অর্থাৎ উপনিবেশবাদী, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও সােভিয়েট
পৃষ্ঠা: ২৮
সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল হয়ে পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষকদের বিপথে পরিচালিত করছে। এই অধঃপতিত দলদ্রোহী গােষ্ঠী অর্থনীতিবাদ, বার্নস্টাইনবাদের অনুসারী। শ্রমিক-কৃষক জনগণকে বিভ্রান্ত করে শােষক শ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধি এদের লক্ষ্য। এরা ‘মস্কোপন্থী’ নামে পরিচিত। এরা পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক জনগণের জাতীয় শত্রু।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নামধারী নয়া-সংশােধনবাদী পার্টি
এরা কথায় ও কাগজে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী ও অনুশীলনে সংশােধনবাদী। অর্থাৎ এরা লাল পতাকা ওড়ায় লাল পতাকা বিরােধিতা করার জন্য। এরা পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানী উপনিবেশিক শােষণ স্বীকার করে না এবং জাতীয় সংগ্রাম না করায় এরা পূর্ব বাংলার জনগণের নিকট উপনিবেশিক সরকারের দালাল হিসাবে পরিচিত। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি না নিয়ে তারা একদিকে উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর হাত শক্ত করছে এবং অন্যদিকে ব্যাপক জনগণকে উপনিবেশিক শােষণ বিরােধী সংগ্রামে লিপ্ত মার্কিনের দালাল বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে ঠেলে দিচ্ছে। পিকিংপন্থী’ নাম ধরে তারা বিশ্ববিপ্লবের কেন্দ্রকে অবমাননা করছে। এরা নয়াসংশােধনবাদী।
নতুন দল, উপদল ও বিচ্ছিন্ন বিপ্লবী।
পূর্ব বাংলায় বিপ্লবের ফুটন্ত অবস্থা হওয়ায় বর্তমানে দেশীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। মার্কসবাদী নামধারী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিবিপ্লবী চরিত্র, দালালী ক্রমশঃ পার্টি কর্মী ও বিপ্লবীদের সামনে প্রকাশ হওয়ায় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারীরা দৃঢ়ভাবে বিদ্রোহ করছে। এ অবস্থায় কিছু সুযােগ সন্ধানী প্রতিক্রিয়াশীলচক্র ঘােলা পানিতে মাছ ধরতে নেমেছে।
মােটামুটি অনুসন্ধানের ফলে তাদের নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
নয়া-সংশােধনবাদী পার্টির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে বিতাড়িত একটি চক্র নিজেদেরকে সঠিক মার্কসবাদী, নক্সালবাদী অনুসারী বলে জাহির করে। তবে এ গ্রুপটি সকল কর্মী ও জনসাধারণের নিকট উপনিবেশিক শক্তির দালাল বলে প্রকাশ্যভাবে পরিচিত।
অপর গ্রুপ বর্তমানে নয়া-সংশােধনবাদীদের সাথে আঁতাত করছে। এরা অধঃপতিত ভাগ্যান্বেষী বুর্জোয়া গােষ্ঠীর একটি ভগ্নাংশ। সচেতন কর্মীদের গ্রুপটি একটি ঘােট বা সুবিধাবাদী, নেতৃত্বলােভী ও হীনমনা গ্রুপটি সুযােগসন্ধানী ও পদলােভী, মেরুদণ্ডহীনদের একটি প্রতিক্রিয়াশীল আঁতাত।
অন্য একটি উল্লেখযােগ্য দল মার্কসবাদী নামধারী পার্টির অভ্যন্তরে ভ্রণ-পার্টি সৃষ্টির দায়ে বিতাড়িত। বক্তব্যের দিক দিয়ে তারা নয়া-সংশােধনবাদী পার্টি থেকে অভিন্ন। জাতীয় বক্তব্যে এরা অস্পষ্ট, তত্ত্বগতভাবে দুর্বল।
আরেকটি গ্রুপ বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের নামে প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদে বুর্জোয়াদের একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরা ধার করা বক্তব্য, এলােপাথারী মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার কথা বলে তাদের সত্যিকার ক্ষুদে বুর্জোয়া চরিত্র গােপন করার প্রয়াস পায়। এরা শিশু অবস্থায় পার্টির মাঝে কোনাে দ্বন্দ্ব থাকবে না বলে স্ট্যালিন ও মাওসেতুঙ কর্তৃক বহুপূর্বে ধিকৃত ভাববাদী ডেবরিন তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছিল। যাতে আন্দোলন কয়েকজন ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর পকেটস্থ হয়। এ ছাড়া রুদ্ধদ্বার
পৃষ্ঠা: ২৯
নীতি, মনগড়া মনােলিথিজম, মার্কসবাদ- লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে ঐক্যে আতংকবােধ কিন্তু সংশােধনবাদী, নয়া সংশােধনবাদী ও প্রমাণিত দালালদের সাথে নীতিহীন সুবিধাবাদী পবিত্র আঁতাত রাখতে উৎসাহী, বহুকেন্দ্রের তত্ত্বে বিশ্বাস, বিপ্লবী যুবকদের হাতে পার্টির নেতৃত্ব থাকবে এই তত্ত্ব, সভাপতি মাওসেতুঙ-এর গেরিলা যুদ্ধের নীতির পাশে চে-র মার্কসবাদ বিরােধী গেরিলা যুদ্ধের তত্ত্বের স্থান প্রদান প্রভৃতি জঘন্য মার্কসবাদ বিরােধী ক্ষুদে বুর্জোয়া তত্ত্বে বিশ্বাসী। কিছু কিছু বিপ্লবী এদের খপ্পরে পড়লেও অচিরেই তারা এদের সঠিক রূপ আবিষ্কার করে বেরিয়ে আসবে। সম্প্রতি তারা মার্কসবাদী নয়া সংশােধনবাদী পার্টির অভ্যন্তরে জ্বণ পার্টির সৃষ্টির দায়ে বিতাড়িত যে পার্টির কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সে পার্টিতে যােগ দিয়েছে।
এ ছাড়া জ্ঞাত ও অজ্ঞাতভাবে বহু বিপ্লবী বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন। তারা কেউ সমঝােতা রেখে, কেউ সমঝােতাহীনভাবে কাজ করছেন, আবার কেউ এলােপাথারী তীর ছুঁড়ছেন।
কাজেই প্রতিটি বিপ্লবী যারা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী ও সে অনুযায়ী অনুশীলনকারী তাদেরকে অবশ্যই সংশােধনবাদ, নয়া সংশােধনবাদ ও অন্যান্য মার্কসবাদ বিরােধী আদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত”-এ পতাকা উর্ধে তুলে ধরে এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। সভাপতি মাও বলেছেন, “ধ্বংস ব্যতীত কোনাে প্রকার গঠনকার্য সম্ভব নয়। ধ্বংস বলতে সমালােচনা ও বর্জন বুঝায় এবং ইহাই বিপ্লব। যুক্তি সহকারে সত্য বের করা তার সাথে জড়িত, যা হলাে গঠনমূলক কাজ।”
কাজেই প্রতিটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারীদের উচিত নিজেদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশব্যাপী সর্বহারা শ্রেণীর একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করা। সভাপতি মাও বলেছেন, “সুশংখলিত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্বে সুসজ্জিত, আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী ও জনগণের সাথে যুক্ত এমন একটি পার্টি; এমন একটি পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সৈন্য বাহিনী; এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সকল বিপ্লবী শ্রেণী ও বিপ্লবী দলের একটি যুক্তফ্রন্ট-এ তিনটি হচ্ছে আমাদের শত্রুকে পরাজিত করার প্রধান অস্ত্র।”
এই বিপ্লবী তত্ত্বে ও বিপ্লবী রীতিতে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য, উপরের কর্মসূচী ও বক্তব্য বাস্তবায়ন করার জন্য একটি সক্রিয় সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন।
* চেয়ারম্যান মাও-দীর্ঘজীবী হােন!
* মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা-জিন্দাবাদ!
পৃষ্ঠা: ৩০
পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের বর্তমান পর্যায়ে
প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ণয়ের প্রশ্নে
নয়া-সংশােধনবাদী হক-তােয়াহা, ট্রটস্কি-চেবাদী দেবেন-মতিন ও
ষড়যন্ত্রকারী কাজী-জাহিদ বিশ্বাসঘাতক চক্রের সাথে
পূর্ব বাংলার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী
সর্বহারা বিপ্লবীদের পার্থক্য
(১৯৭০-এর প্রথম দিক)
সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন, “কোন প্রক্রিয়াতে যদি কতকগুলাে দ্বন্দ্ব থাকে তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটা প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে, যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে। তাই, দুই বা দুয়ের বেশী দ্বন্দ্ব বিশিষ্ট কোন জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালােচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলে সব সমস্যাকেই সহজে মীমাংসা করা যায়।”১
কাজেই প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করা পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক লাইন নির্ণয়ের প্রধান সমস্যা।
কিন্তু নয়া সংশােধনবাদী হক-তােয়াহা, ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-মতিন ও কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র ১৯৬৯ সালেও সর্বহারার রাজনৈতিক লাইন নির্ণয়ে প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করার প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করেছে এবং সকল দ্বন্দ্বকে এক ও অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করেছে।২
ভারতীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের বিশেষ সামাজিক অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করে সর্বহারার রাজনৈতিক লাইন নির্ণয় করার পর্যায়ে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসাবে সামন্তবাদের সাথে কৃষক-জনতার দ্বন্দ্বকে উল্লেখ করেন এবং এই বিশেষ দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করেন।
পূর্ব বাংলার নয়া সংশােধনবাদী হক-তােয়াহা, ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-মতিন, কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র নিজেদেরকে “নক্সালপন্থী” হিসাবে জাহির করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসাবে বিনা আত্ম-সমালােচনা সহকারে রাতারাতি তাদের বক্তব্য [“আমাদের দেশের প্রধান ও মৌলিক বিরােধ হইল একদিকে জনগণ আর অন্যদিকে এই তিনশক্তির (সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ-লেখক) অবিভাজ্য প্রকাশ”] পাল্টিয়ে ভারতীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির রাজনৈতিক লাইন অর্থাৎ সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এর সমাধান হিসাবে কৃষি বিপ্লবের লাইন গ্রহণ করে। তারা সকলেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা নির্ণিত রাজনৈতিক লাইন পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর জাতীয় দ্বন্দ্ব এবং তা সমাধানের জন্য জাতীয় বিপ্লবের লাইন, অর্থাৎ, পূর্ব বাংলাকে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে পাকিস্তান
পৃষ্ঠা: ৩১
থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করাকে প্রতিনিয়ত বিরােধিতা করছে।
কাজেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের নির্ণিত প্রধান দ্বন্দ্ব ও বিশ্বাসঘাতক নয়াসংশােধনবাদী হক-তােয়াহা, ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-মতিন ও ষড়যন্ত্রকারী কাজী-রণাে নির্ণিত প্রধান দ্বন্দ্বের মাঝে কোনটি পূর্ব বাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা মার্কসবাদী তত্ত্বমালার সাহায্যে বিশ্লেষণ করা ও খুঁজে বের করা পূর্ব বাংলার বিপ্লবের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিকভাবে সমস্যাটির বিশেষ উত্থাপন
“কোন একটি সামাজিক সমস্যা অধ্যয়ন করার সময় মার্কসবাদী তত্ত্ব স্পষ্টভাবে দাবী করে যে, প্রশ্নটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সীমার মধ্যে অধ্যয়ন করতে হবে এবং যদি ইহা একটি বিশেষ দেশ সম্পর্কিত হয় (উদাহরণ স্বরূপ একটি নির্দিষ্ট দেশের জাতীয় কর্মসূচী) তবে যথাযথ মনােযােগ দিতে হবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ণয় করতে যা একই ঐতিহাসিক যুগে ঐ দেশকে অন্যান্য দেশ থেকে পৃথক করে।” ৬
পূর্ব বাংলা সামাজিক বিকাশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ঐতিহাসিক সীমার মধ্যে অবস্থান করছে। সামাজিক বিকাশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তরে অভ্যন্তরস্থ সামন্তবাদ এবং বৈদেশিক বুর্জোয়াদের উৎখাত করে পুঁজিবাদ বিকাশের শর্তের সৃষ্টি হয়। লেনিন বলেছেন, “সমগ্র বিশ্বব্যাপী সামন্তবাদের উপর পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয় জাতীয় আন্দোলনের সাথে জড়িত। এ সকল আন্দোলনের ভিত্তি হলােঃ পণ্য উৎপাদনের সম্পূর্ণ বিজয় অর্জনের জন্য বুর্জোয়ারা অবশ্যই দেশীয় বাজার দখল করবে, অবশ্যই তাদের থাকবে একই ভাষাভাষী লােক অধ্যুষিত, রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একটি ভূখণ্ড এবং এর ভাষা বিকাশ ও এর সাহিত্যের সুসংবদ্ধতার পথে সকল বাধা অবশ্যই দূর করতে হবে।” ৭
এ কারণে “সকল জাতীয় আন্দোলনের ঝোক হলাে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের দিকে, যার মাধ্যমে আধুনিক পুঁজিবাদের সকল প্রয়ােজনসমূহ পূর্ণ হয়।” ৮
অতএব “……. জাতীয় রাষ্ট্র হচ্ছে পুঁজিবাদের নিয়ম ও ধর্ম। বহুজাতি বিশিষ্ট রাষ্ট্র হচ্ছে পশ্চাদপদ অথবা ব্যতিক্রম। জাতীয় সম্পর্কের ভূমিকা থেকে পুঁজিবাদ বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ শর্ত হলাে জাতীয় রাষ্ট্র।”৯
পূর্ব বাংলার বর্তমান পুঁজিবাদী সামাজিক বিকাশের পথে বাধা হলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাষক গােষ্ঠী, যারা পূর্ব বাংলার উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে জাতীয় নিপীড়ন চালাচ্ছে।
এ কারণে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বর্তমান স্তরে পুঁজিবাদ বিকাশের সকল অন্তরায় দূর করার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রয়ােজন।
লেনিন বলেছেন, “ ……. জাতীয় আন্দোলনের ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসন্ধান করে আমরা অবশ্যম্ভাবীভাবেই এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে বুঝায় বৈদেশিক জাতিসমূহের থেকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র গঠন।”১০
তিনি আরও বলেছেন, “জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বলতে রাজনৈতিক অর্থে একমাত্র বুঝায় স্বাধীনতার অধিকার, অত্যাচারী জাতি থেকে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অধিকার।”১১
পৃষ্ঠা: ৩২
তিনি আরও বলেছেন, “…… আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বলতে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্যতীত অন্য কিছু বুঝা ভুল হবে।”১২
কাজেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের বস্তুগত নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচীতে পূর্ব বাংলার সমাজের বর্তমান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তরে, পুঁজিবাদ বিকাশের সকল অন্তরায় দূর করে তার বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ শর্ত সৃষ্টির জন্য, পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ, পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক গােষ্ঠী যারা পূর্ব বাংলাকে পরাধীন করে তার উপর জাতীয় নিপীড়ন চালাচ্ছে, তাদের পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব বাংলার জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের লাইন গ্রহণ করেছে।
জাতীয় সংগ্রামের সাথে শ্রেণী সংগ্রামের সম্পর্ক
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “চূড়ান্ত বিশ্লেষণে জাতীয় সংগ্রাম হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামেরই একটি সমস্যা।”১৩
তিনি আরও শিক্ষা দেন, “একটি সংগ্রামে, যার চরিত্র হলাে জাতীয়, শ্রেণী সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রামের রূপ নেয়, যা দুটোর মধ্যে একত্ব বিধান করে।”১৪
কাজেই পূর্ব বাংলার জনগণের পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক গােষ্ঠী বিরােধী জাতীয় সংগ্রাম চূড়ান্ত বিশ্লেষণে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণীর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শাসনকারী পাকিস্তান উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ও তাদের সহযােগী ও সমর্থক পূর্ব বাংলার বিশ্বাসঘাতক বুর্জোয়া সামন্ত-জমিদার গােষ্ঠী বিরােধী শ্রেণী সংগ্রাম।
কিন্তু নয়া সংশােধনবাদী হক-তােয়াহা, ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-মতিন ও ষড়যন্ত্রকারী কাজী-রণােরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রাম নয় বলে ঘােষণা করছে এবং সামন্তবাদ বিরােধী শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনার মুখােশ এঁটে জাতীয় সংগ্রামকে বিরােধিতা করছে।
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “… শ্রেণী সংগ্রামকে বর্তমান জাতীয় সংগ্রামের অধীন করার জন্য।১৫ তিনি আরও বলেছেন, “একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ক্ষণে বিভিন্ন শ্রেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবীসমূহ একদিকে এমন হবে না যে (শ্রেণীসমূহের মাঝে- লেখক) সহযােগিতাকে ধ্বংস করবে, অন্যদিকে জাতীয় সংগ্রামের দাবীসমূহ হবে সকল শ্রেণী সংগ্রাম পরিত্যাগের যাত্রাবিন্দু।”১৬
পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের বর্তমান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তরে জাতীয় বিপ্লব পরিচালনা করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব বাংলায় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লবের একটি চরিত্র হলাে জাতীয়। এ কারণে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণীসমূহের সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রামের রূপ নেবে, শ্রেণী সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রামের অধীন হবে এবং জাতীয় সংগ্রামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার সমাজের কোন শ্রেণীর দাবী দাওয়া এমন হবে না যা জাতীয় সংগ্রামের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর সহযােগিতা ধ্বংস করবে।
নয়া সংশােধনবাদী, ট্রটস্কী-চেবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্ররা স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা বলেও পূর্ব বাংলার সমাজের অভ্যন্তরস্থ সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান বলছে। এভাবে তারা স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা
পৃষ্ঠা: ৩৩
প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় বিচ্ছিন্নতা, জাতীয় স্বাধীনতা, জাতীয় মুক্তির কর্তব্য, অর্থাৎ জাতীয় বিপ্লবকে গৌণ করছে এবং অভ্যন্তরস্থ শ্রেণী সংগ্রাম প্রধান বলে শ্রেণীসমূহের সহযােগিতার পরিবর্তে শ্রেণীসমূহের মধ্যকার সহযােগিতা ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এভাবে জাতীয় সংগ্রামকে প্রাধান্য না দিয়ে, জাতীয় সংগ্রামের পতাকাকে ঊর্ধে তুলে না ধরে, তা পরিত্যাগ করে পূর্ব বাংলার ছয় দফা বুর্জোয়াদের নিকট তুলে ধরেছে। এভাবে জাতীয় স্বাধীনতাকামী লক্ষ লক্ষ জনতাকে আওয়ামী লীগের পিছনে ঠেলে দিয়েছে।
লিন পিয়াও বলেছেন, “আমরা যদি জাতীয় পতাকাকে ত্যাগ করি, দরজা বন্ধ রাখার নীতি অনুসরণ করি এবং এভাবে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি, তাহলে কোন প্রশ্ন ওঠে না বিপ্লবী উদ্দেশ্যে নেতৃত্ব প্রদান করা এবং তা বিকাশ করার। বাস্তবে ইহা বুঝায় শত্রুকে সাহায্য করা এবং নিজেদের প্রতি পরাজয় ডেকে আনা।”১৭
লেনিন বলেছেন, “আমরা যদি আমাদের প্রচারে বিচ্ছিন্নতার অধিকারের শ্লোগান উত্থাপন ও তা অনুসরণ না করি, তবে আমরা শুধু বুর্জোয়াদেরই নয়, সামন্তগােষ্ঠী ও অত্যাচারী জাতীয় স্বৈরাচারীদের হাতের খেলনা হবাে।”
এভাবে নয়া সংশােধনবাদী, ট্রটস্কী-চেবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক দালালদের সামন্তবাদের সাথে কৃষক-জনতার প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে রচিত আকৃতিগতভাবে বাম কর্মসূচী চূড়ান্ত বিশ্লেষণে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী, পূর্ব বাংলায় তাদের সহযােগী ও সমর্থক বুর্জোয়া ও সামন্ত-জমিদার গােষ্ঠী, পূর্ব বাংলার ছয়দফা বুর্জোয়া, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সসাভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে সহায়তা করছে। এ কারণে এই কর্মসূচী সারবস্তুগতভাবে ডান। এটা বাম দিক থেকে ট্রটস্কীবাদী বিচ্যুতি।
জাতীয় সংগ্রাম মূলতঃ কৃষকদের সংগ্রাম
পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকাংশই কৃষক। কাজেই তাদের অংশগ্রহণ ব্যতীত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিজয় সম্ভব নয়। পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের বর্তমান। পর্যায়ে কৃষকদের মৌলিক সমস্যা হলাে পূর্ব বাংলার ভূমি পূর্ব বাংলার কৃষকদের হাতে। থাকবে, না পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী ও তাদের দালাল বিশ্বাসঘাতক জমিদারজোতদারদের হাতে থাকবে।
কাজেই পূর্ব বাংলার ভূমি থেকে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ও তাদের দালাল জমিদার-জোতদারদের উৎখাত করে কৃষকদের ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের উপর থেকে উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ও তাদের দালাল জোতদারজমিদার এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সকল প্রকার অত্যাচার, অবিচার দূর করার নিমিত্তে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে কৃষকরা অংশগ্রহণ করবে এবং বিপ্লবের সবচাইতে বৃহৎ মৌলিক পরিচালক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
এদেরকে জাগ্রত করে, এদের অংশগ্রহণসহ এবং এদের উপর নির্ভর করে জাতীয় মুক্তির জন্য গণযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্পূর্ণ সম্ভব।
লেনিন বলেছেন, “প্রথম যুগের (বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগ—লেখক) বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ হলাে জাতীয় সংগ্রামের জাগরণ এবং জনসমষ্টির সবচেয়ে অধিক ও পশ্চাদপদ অংশ কৃষক জনতাকে এ সকল আন্দোলনে টেনে আনা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।”১৯
পৃষ্ঠা: ৩৪
এ কারণে স্ট্যালিন যথার্থই বলেছেন, “আমরা প্রায়ই বলে থাকি জাতীয় প্রশ্নের সারবস্তু হলাে কৃষক প্রশ্ন।”২০ তিনি একই সাথে বলেছেন, “কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জাতীয় প্রশ্ন কৃষক প্রশ্নের আওতায় পড়ে, কৃষক প্রশ্ন জাতীয় প্রশ্নের মত সমান ব্যাপ্তি বিশিষ্ট, কৃষক প্রশ্ন ও জাতীয় প্রশ্ন অভিন্ন। কোন প্রকার প্রমাণের প্রয়ােজনই হয় না যে, জাতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাপ্তির দিক দিয়ে ব্যাপকতর এবং সারবস্তুর দিক দিয়ে অধিকতর সমৃদ্ধশালী।” ২১
অর্থাৎ, জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে শুধু কৃষকদেরই নয়, পূর্ব বাংলার শ্রমিক, ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়া, বিভিন্ন উপজাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, দেশপ্রেমিক গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এবং আলােকপ্রাপ্ত ভদ্রলােকদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব যা কৃষক প্রশ্নে সম্ভব নয়।
এ কারণে জাতীয় যুদ্ধে মাতৃভূমিকে উদ্ধার ও মুক্ত করার জন্য ব্যাপক জনতাকে অংশগ্রহণ করানাে যায়, কিন্তু কৃষক প্রশ্ন হলাে আভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ যা মূলতঃ কৃষকদের অংশগ্রহণেই হয়।
কাজেই জাতীয় প্রশ্ন অধিকতর সারবস্তু ও ব্যাপ্তি বিশিষ্ট।
ভারতীয় সমাজের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সর্বহারাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং পূর্ব বাংলার সমাজের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার সর্বহারাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী
লেনিন বলেছেন, “কোন এক বিশেষ সামাজিক সমস্যা অধ্যয়ন করার সময় মার্কসবাদী তমালা অবশ্যই দাবী করে যে, প্রশ্নটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সীমার মধ্যে অধ্যয়ন করতে হবে এবং যদি ইহা একটি বিশেষ দেশ সম্পর্কিত হয় (উদাহরণ স্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট দেশের জাতীয় কর্মসূচী) তবে যথাযথ মনােযােগ দিতে হবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ণয় করতে যা একই ঐতিহাসিক যুগে ঐ দেশকে অন্যান্য দেশ থেকে পৃথক করে।”২২
লিন পিয়াও বলেছেন, “বিশেষ অবস্থার বিশ্লেষণ, বিশেষ দ্বন্দ্বের বিশেষ সমাধান হচ্ছে মার্কসবাদের জীবন্ত আত্মা।” ২৩
পূর্ব বাংলার সর্বহারাদের পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের বস্তুগত নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হলে নির্ণয় করতে হবে পূর্ব বাংলার সমাজ কোন ঐতিহাসিক যুগে অবস্থান করছে, আরও নির্ণয় করতে হবে এ একই ঐতিহাসিক যুগে পূর্ব বাংলার সমাজের সাথে অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে ভারতের সমাজের কী কী পার্থক্য রয়েছে।
…………………………………………………………………….
সম্প্রতি আবদুল হক ১নং সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক একটি প্রবন্ধে (আধা-উপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী প্রসঙ্গে) স্ট্যালিনের এই উদ্ধৃতির প্রথম অংশ, অর্থাৎ, “জাতীয় প্রশ্ন মূলতঃ কৃষক প্রশ্ন” দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, পূর্ব বাংলার সমাজে কৃষকদের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব প্রধান। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক চক্র উদ্ধৃতির পরের অংশটি চেপে গেছে। এমনকি উদ্ধৃতিটি স্ট্যালিনের কোন রচনা ও কত পাতা থেকে সংগৃহীত তাও এই বিশ্বাসঘাতক চক্র উল্লেখ করেনি যাতে কেউ উদ্ধৃতিটির পরের অংশ “কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জাতীয় প্রশ্ন কৃষক প্রশ্নের আওতায় পড়ে, কৃষক প্রশ্ন জাতীয় প্রশ্নের মত সমান ব্যাপ্তি বিশিষ্ট, কৃষক প্রশ্ন ও জাতীয় প্রশ্ন অভিন্ন। কোনাে প্রকার প্রমাণের প্রয়ােজনই হয় না যে, জাতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাপ্তির দিক দিয়ে ব্যাপকতর এবং সারবস্তুর দিক দিয়ে অধিকতর সমৃদ্ধশালী।”- এই অংশ না দেওয়ার কারণ, যে-কেউ এই অংশ পাঠ করলে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় প্রশ্নের প্রাধান্যকে স্বীকার করবেন এবং আবদুল হক বিশ্বাসঘাতক চক্রের ভাওতাবাজি বুঝতে পারবেন।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩৫
পূর্ব বাংলা ও ভারত সামাজিক বিকাশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ঐতিহাসিক সীমার মধ্যে অবস্থান করছে।
বহুজাতি অধ্যুষিত ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে কার্যরত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)’র কর্মসূচী ভারতের সকল জাতির বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তর অতিক্রমণের কর্মসূচী।
যেহেতু সাম্রাজ্যবাদ বা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ভারতকে আক্রমণ করেনি এবং সাম্রাজ্যবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা ও ভারতের দালাল আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতিরা সামন্তবাদের উপর ভিত্তি করে ব্যাপক কৃষক জনতাকে শােষণ ও লুণ্ঠন করছে, এ কারণে ভারতে সামন্তবাদের সঙ্গে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান। যেহেতু বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র পুঁজিবাদ বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ শর্ত নয় এবং পশ্চাদপদ, এ কারণে অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেখানে জাতীয় নিপীড়ন ও তার বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম (সেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে গেছে) চলবে।
ভারতীয় সর্বহারারা সামাজিক বিকাশের এই বস্তুগত নিয়মকে স্বীকার করেই তাদের কর্মসূচীতে প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ, বিচ্ছিন্ন স্বাধীন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার গ্রহণ করেছে। এ কারণেই তারা নাগা ও মিজো জাতির ও অন্যান্য নিপীড়িত জাতি-উপজাতির মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করেন।
অন্যদিকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হচ্ছে পূর্ব বাংলার জন্য, যা জাতিগতভাবে নিপীড়িত লাঞ্ছিত। এ কারণে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ, জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব বাংলায় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন ও সামন্তবাদকে উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া বিকাশের অন্তরায় দূর করা, পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তরে সামাজিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য।
কাজেই জাতিগতভাবে নিপীড়িত পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ না করে ভারতের বহুজাতিক বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে তারা দ্বান্দ্বিক ঐতিহাসিক বস্তুবাদী সামাজিক বিশ্লেষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়েছে।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী, দেবেন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র পূর্ব বাংলার সমাজের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করে বিশেষ দ্বন্দ্বসমূহ ও তার বিশেষ সমাধান নির্ণয় না করে ভারতের বিশেষ সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ণিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচী থেকে সামন্তবাদের সাথে কৃষক-জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে নিয়ে যে কর্মসূচী প্রণয়ন করেছে তা পূর্ব বাংলার সমাজের বস্তুগত অবস্থার সথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কারণে এ কর্মসূচী পূর্ব বাংলার জনগণের নিকট গ্রহণযােগ্য নয়।
শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় সংগ্রাম এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় সংগ্রাম
পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণী কেবলমাত্র বর্তমান জাতীয় বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, ইহা পরিচালনা ও সম্পন্ন করার মাধ্যমেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে।
পৃষ্ঠা: ৩৬
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব “বিপ্লবের সমগ্র চেহারাটাই পাল্টে দেয়, শ্ৰেণীসমূহকে নতুনভাবে সন্নিবেশিত করে, কৃষক বিপ্লবের প্রচণ্ড জোয়ারের সৃষ্টি করে, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বিপ্লবে সম্পূর্ণর্তা আনে, গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণের সম্ভাবনার সৃষ্টি করে।”২৪
কিন্তু বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে এ বিপ্লব সম্পন্ন হতে পারে না, কেননা সাম্রাজ্যবাদী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী যুগে বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের সাথে শত-সহস্র বন্ধনে আবদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদ তাদেরকে লুণ্ঠন ও শােষণ করে নিজস্ব শৃংখলে আবদ্ধ করে। এ কারণে বুর্জোয়ারা ঐতিহাসিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের সাথে আঁতাত করে এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
কাজেই পূর্ব বাংলার স্বাধীন ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব ও বুর্জোয়াদের নেতৃত্বকে পৃথক করে না দেখে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বুর্জোয়ারাও দাবী করে বলে উহা পরিত্যাজ্য, একথা বলে আবদুল হক-ততায়াহা নয়া সংশােধনবাদী, দেবেনমতিন ট্রটস্কী-চেবাদী ও কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র প্রমাণ করে যে, তারা সর্বহারা ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে।
উপসংহার
উপরােক্ত মার্কসবাদী বিশ্লেষণ থেকে আমরা পাই, পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির সমস্যা প্রধান সমস্যা অর্থাৎ, পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব।
নয়া সংশােধনবাদী হক-ততায়াহা, ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-মতিন, ষড়যন্ত্রকারী কাজী-রণাে বিশ্বাসঘাতক চক্র কৃষক-জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বকে প্রধান (অল্প। কিছুদিন যাবত) বলে জাতীয় প্রশ্নে মার্কসবাদী তত্ত্বমালার বিরােধিতা করেছে যা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান, অর্থাৎ, বাম দিক থেকে ট্রটস্কীবাদী তত্ত্ব এবং এভাবে পূর্ব বাংলার জাতীয় বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণকে জাতীয় সংগ্রাম থেকে দূরে শত্রুর পিছনে ঠেলে দিচ্ছে এবং বিশ্বস্ত পদলেহী কুকুর হিসেবে কাজ করছে পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সপ্রাসরণবাদ, পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া, জমিদার ও প্রতিক্রিয়াশীল দৈত্য-দানবের।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা-জিন্দাবাদ!
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন-জিন্দাবাদ!
পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র-জিন্দাবাদ!
সংশােধনবাদ, নয়া সংশােধনবাদ, ট্রটস্কী-চেবাদ ও অন্যান্য সকল বিকৃতি ও সংশােধন খতম কর!
নােট
১। সভাপতি মাওসেতুঙ-এর উদ্ধৃতি-পৃঃ ২৫৫
২। ক) নয়া সংশােধনবাদী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর কর্মসূচী দ্রষ্টব্য।
খ) ট্রটস্কী-চেবাদী পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতি ও কর্মসূচী (খসড়া) দ্রষ্টব্য।
গ) ১নং নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র আবদুর হক তার প্রকাশিত “পূর্ব বাংলা আধা উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী” পুস্তকে লিখেছে (৫৮ পাতা) “এই তিন শক্তি (সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ- লেখক) হইল এক ও অবিচ্ছিন্ন শক্তি। এই তিন শক্তির অবিচ্ছিন্ন সত্তাকে পৃথকভাবে বিচার করার অর্থই হল ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হােক ইহাদের স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করা এবং ইহাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করা। আজ। আমাদের দেশের প্রধান ও মৌলিক বিরােধ হইল একদিকে জনগণ আর অন্যদিকে এই তিন শক্তির অবিভাজ্য প্রকাশ।”
পক্ষান্তরে সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “… একটি প্রক্রিয়ার সকল দ্বন্দ্বকে একজন অবশ্যই সমান গুরুত্ব দেবেন না, অবশ্যই তিনি পার্থক্য করবেন প্রধান ও গৌণ দ্বন্দ্বের মাঝে এবং বিশেষ গুরুত্ব দেবেন প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরতে।”৩
কেননা “প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলেই সব সমস্যাকেই সহজে মীমাংসা করা যায়।”৪
কাজেই পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জটিল প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দ্বন্দ্বসমূহ বিশ্লেষণ করে (প্রধান) দ্বন্দ্ব নির্ণয় করার সর্বহারার দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের একটি মূলনীতি। কিন্তু ১নং নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র আবদুল হক সকল দ্বন্দ্বকে ‘এক ও অবিচ্ছিন্ন শক্তি’ বলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে অস্বীকার করেছে এবং তাকে সংশােধন করেছে। সভাপতি মাও এদের সম্পর্কে বলেছেন, “হাজার হাজার পণ্ডিত ও কাজের লােক রয়েছেন যারা এটা বুঝেন না এবং ফলে কুয়াশায় ডুবে যান, সমস্যার মূলে যেতে পারেন না এবং স্বাভাবিকভাবেই দ্বন্দ্বগুলাের মীমাংসার পদ্ধতি পান না।”৫
এভাবে বিশ্বাসঘাতক চক্র সচেতনভাবে মার্কসবাদকে বিকৃত ও সংশােধিত করছে শ্ৰেণীশত্রুর দালালীর জন্য।
৩। Mao; Four Essays On Philosophy—P-54 ৪। Do : P- 53
৫। Do : P- 54
৬। V.I. Lenin; Critical Remarks On The National Question. The Right of Nations to Self Determination P-74
৭। Do: P- 66
৮। Do: P-67
৯। Do: P- 67
১০। Do: P- 67
১১। Do: P- 175
১২। Do P- 68
১৩। সভাপতি মাওসেতুঙের উদ্ধৃতি : পৃ-১১
১৪। Selected Works of Mao Tse Tung Vol-11, P-215.
১৫। Do: P- 215
১৬। Do: P- 215
১৭। Lin Piao; Long Live the Victory of Peoples War, P-42
১৮। V.I. Lenin; Critical Remarks On The National Question, The Right to Nations to Self Determination P-93
পৃষ্ঠা: ৩৮
১৯। DO : P – 75
২০। J.V. Stalin; Problems of Leninism, P-141
২১। Do: P- 141
২২। V.I. Lenin; Critical Remarks on The National Question, Right of Nations To Self Determination, P-74.
২৩। Lin Piao; Long Live the Victory of Peoples War, P-23
৩৪। Mao, Four Essays on Philosophy, P-44
তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি১
(যে পার্টি আকৃতিগতভাবে ‘বাম’ কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান)-এর খসড়া রণনীতি ও কর্মসূচীর স্বরূপ উদঘাটন
(মার্চ, ১৯৭০। সংশােধিত আকারে পুনর্লিখিত, এপ্রিল, ১৯৭২)
বর্তমান যুগের বিশ্ব সর্বহারার মহান নেতা, মহান শিক্ষক, মহান সর্বাধিনায়ক ও মহান কর্ণধার সভাপতি মাওসেতুঙ আমাদের শিক্ষা দেন, “আমরা নানা প্রকারের ভ্রান্ত চিন্তাধারাকে অবশ্যই সমালােচনা করব। সমালােচনা না করা ও সর্বত্র ভ্রান্ত চিন্তাধারাকে বন্যার মতাে ছড়িয়ে পড়তে দেয়াটা এবং অবাধে তাদের বাজার দখল করতে দেয়াটা নিশ্চয়ই চলবে না। ভুল থাকলে অবশ্যই সমালােচনা করতে হবে, বিষাক্ত আগাছা থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।” আসুন আমরা বর্তমান দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর সবচাইতে শক্তিশালী মতাদর্শগত অস্ত্র, এ যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্বরূপ উদঘাটন করি।
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মনােযােগ দাবী করে।” তিনি আরও শিক্ষা দেন, “এর অতীতের দিকে তাকাও তাহলে এর বর্তমান বলতে পারবে, এর অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকাও তাহলে এর ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।” উপরের শিক্ষা অনুসারে আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি যারা সৃষ্টি করেছেন তাদের অতীতের দিকে তাকাই। এরা সংশােধনবাদী, নয়া সংশােধনবাদী পার্টিতে ছিলেন। এখানে থাকাকালীন তারা পূর্ব বাংলার গ্রামে ধনতান্ত্রিক শশাষণ’-এই মার্কসবাদ বিরােধী তত্ত্ব। হাজির করেন এবং এর জন্য সংগ্রাম করেন কয়েক বছর পর্যন্ত।
এ জঘন্য মার্কসবাদের পরিপন্থী তত্ত্ব আত্মসমালােচনা সহকারে বর্জন না করে, নয়া সংশােধনবাদী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত’-এ পতাকা উর্ধে তুলে না ধরে, নীতিগত সংগ্রাম না করে, তারা ষড়যন্ত্র, ক্লিক ও পার্টির অভ্যন্তরে ভ্রণ পার্টি সৃষ্টি করেন এবং নয়া সংশােধনবাদীদের দ্বারা বহিস্কৃত হন।
বর্তমানে সংশােধনবাদী ও নয়া সংশােধনবাদী পার্টির মুখােশ বিপ্লবীদের সামনে উন্মোচিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নয়া সংশােধনবাদীদের এই ভগ্নাংশ ঘােলা পানিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নামে মাছ ধরতে নেমেছে। এই উদ্দেশ্যে তারা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ নয়া সংশােধনবাদী, পেটিবুর্জোয়া রােমান্টিকতাবাদী, চেপন্থী, ট্রটস্কীপন্থী ও ক্ষুদে বুর্জোয়া দালাল এবং এজেন্ট, ভাগ্যান্বেষী, হটকারী ষড়যন্ত্রকারীদের অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।
…………………………………………………………………….
১. দেবেন-বাসার, মতিন-আলাউদ্দিন, মাহবুবুল্লাহ-আ.কা.ম. ফজলুল হক ১৯৬৮ সালে এ পার্টিটি গঠন করেন। পরে এ পার্টি ভেঙে দেবেন-বাসার উপদল ও মতিন-আলাউদ্দিন উপদলে পরিণত হয়। মাহবুবুল্লাহ ও আ.কা.ম. ফজলুল হক বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী জীবনে চলে যান -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪০
সভাপতি মাও বলেছেন, “বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ হচ্ছে মার্কসবাদের একান্ত সারবস্তু এবং মার্কসবাদের জীবন্ত আত্মা।” কিন্তু তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তাদের খসড়া রণনীতি ও কর্মসূচীতে স্বাধীনতার পূর্বে (বৃটিশ আমলে-প্রকাশক) ভারতের সমাজের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হন। প্রাক স্বাধীনতাকালে (বৃটিশ আমলে-প্রকাশক) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালিত না হওয়ার কারণ নির্ণয় করতে তারা ব্যর্থ হন।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে পূর্ব বাংলার সমাজের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করলে আমরা নিম্নলিখিত মূল দ্বন্দ্বগুলাে পাই।
১। পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব।
২। পূর্ব বাংলার বিশাল কৃষক-জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব।
৩। পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে
ক) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের; খ)সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের;
গ) ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের
জাতীয় দ্বন্দ্ব।
৪। পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।
উপরােক্ত মূল দ্বন্দ্বগুলাের মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্ব হলাে পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসক গােষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব।
এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে তারা সংশােধনবাদী, নয়া সংশােধনবাদীদের বক্তব্য হুবহু হাজির করেন। এই তত্ত্বে পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর উপনিবেশিক শাসন ও শােষণ অস্বীকার করে সংশােধনবাদী, নয়া সংশােধনবাদীদের তিন বােয়াল, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বৃহৎ ও একচেটিয়া ধনিকদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
তারা পূর্ব বাংলার জনগণের উপর উপনিবেশিক শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে জাতীয় বিপ্লবের পতাকা উর্ধে তুলে না ধরে উপনিবেশবাদীদের হাত শক্তিশালী করেছেন এবং লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী জনতাকে সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক ছয়দফাপন্থী আওয়ামী লীগের পিছনে ঠেলে দিচ্ছেন। এভাবে তারা সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা করছেন।
তারা উল্লেখ করেছেন, “পাকিস্তানের দুই অঞ্চল মধ্যখানে হিন্দুস্থান কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দু’অংশের দূরত্ব স্থল পথে প্রায় বারশ’ মাইল ও জলপথে প্রায় ১৪শত মাইল … সুতরাং পাকিস্তানের অন্যান্য নিপীড়িত জাতির সাথে একই সঙ্গে একাত্ম হয়ে লড়াই করা, আন্দোলন ও অবস্থা উপলব্ধি এবং পরিচালনা সম্ভব নয়। … এ কারণে আমাদের বিপ্লবের ক্ষেত্র হলাে পূর্ব পাকিস্তান।” তারা ভৌগলিক কারণে পূর্ব বাংলাকে বিপ্লবের ক্ষেত্র হিসেবে নেন। এভাবে তারা পূর্ব বাংলায় বিপ্লব সীমাবদ্ধ থাকার কারণ বাহ্যিক (ভৌগলিক) বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়, “বস্তুর বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ বাহ্যিক নয় বরং আভ্যন্তরীণ, বস্তুর অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যেই এটা নিহিত। যেকোন বস্তুর ভিতরে এই ধরনের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। অতএব এটাই বস্তুর গতি ও বিকাশ লাভের উদ্রেগ করে। বস্তুর ভিতরকার এ ধরনের দ্বন্দ্বই হচ্ছে বস্তুর বিকাশ লাভের মৌলিক কারণ।” দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের আরও শিক্ষা দেয়, “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে বাহ্যিক কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের শর্ত, আভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি। কাজেই পূর্ব বাংলার সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রাম পূর্ব বাংলায়
পৃষ্ঠা: ৪১
সীমাবদ্ধ থাকার কারণ পূর্ব বাংলার সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ভৌগলিক কারণ অন্যান্য বাহ্যিক কারণের একটি মাত্র। কিন্তু তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নয়া সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলায় বিপ্লব সীমাবদ্ধ থাকার কারণ হিসেবে ভৌগলিক কারণের উল্লেখ করে “…বাহ্যিক কারণ ও যান্ত্রিকতার অধিবিদ্যক তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছেন। সভাপতি মাও এদের সম্বন্ধে বলেছেন, “(এরা) সমাজের বিকাশের কারণ সমাজের বাইরে, যেমন ভৌগলিক অবস্থা ও আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল বলে মনে করে। ইউরােপে এ ধরনের চিন্তাধারা যান্ত্রিক বস্তুবাদরূপে সতের শতকে এবং আঠার শতকে এবং বাজে বিবর্তনবাদরূপে উনিশ শতকের শেষের দিকে বিদ্যমান ছিল।” পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এই পুরানাে তত্ত্বকে হাজির করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
তারা এই অনুচ্ছেদে ভারতকে “হিন্দুস্থান” বলে উল্লেখ করেন। হিন্দুস্থান বলে (যা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করে থাকে) তারা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের মত সাম্প্রদায়িক মনােভাবের পরিচয় দেন।
তারা এ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেন, “নিজেদের বাংগালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম পূর্ব বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।” বাঙালী জাতি বলতে কি তারা পশ্চিম বাংলার জনগণকেও অন্তর্ভুক্ত করেন? এভাবে তারা পশ্চিম বাংলার সাথে নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে যুক্ত বাংলার স্বপ্ন দেখেন। তারা ব্যক্তিগত আলাপে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার জনগণকে একজাতিভুক্ত করেন এবং বিপ্লবের পরে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তৈরী করার স্বপ্ন দেখেন। এ তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে মার্কসবাদ বিরােধী। পাকিস্তানে যােগদানের পরবর্তী ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়ে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি জাতিতে পরিণত হয়। বর্তমান পর্যায়ে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মানসিকতা প্রভৃতি দিক দিয়ে পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। যেহেতু মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হওয়ার পরও সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম থাকবে এবং যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন রাষ্ট্র থাকবে, সে কারণে বর্তমান পর্যায়ে বা সমাজতান্ত্রিক পর্যায়েও পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা যুক্ত হওয়ার তত্ত্ব মার্কসবাদ বিরােধী। কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণী বিলুপ্ত হবে এবং রাষ্ট্রও বিলুপ্ত হবে এবং তখনই পূর্ব বাংলা ও সমস্ত পৃথিবী একত্রিত হতে পাবে।
‘শত্রু শিবিরে তিন শত্রু’-এ অধ্যায়ে তারা নতুন বােতলে পুরাতন মদ পরিবেশনের পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। সংশােধনবাদী মনি সিং-মােজাফফর চক্র এবং আবদুল হকতােয়াহা চক্রের তিন বােয়াল সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বৃহৎ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদকে পূর্ব বাংলার জনগণের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা পাকিস্তানী একচেটিয়া পুঁজিপতি ও সামন্তবাদীদের (যারা বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিক) সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের কথা দ্বন্দ্বসমূহের মাঝে স্বীকার না করলেও তাদের বক্তব্যে নিজেদের অজ্ঞাতেই নিম্নভাবে স্বীকার করেন। “আসলে এই শােষণ ও নিপীড়ন বৃটিশের উপনিবেশিক আমলের থেকে কমতাে নয়ই বরং অনেক বেশী।” যখন একটি জাতি উপনিবেশিক উপায়ে শােষণের চাইতেও বেশী শােষিত হয় তখন ইহা অবশ্যই উপনিবেশিক উপায়ে শােষিত ও নিপীড়িত। এভাবে তারা নিজেদের অজ্ঞাতে আমাদের বক্তব্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
তারা পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শােষণ চাপা দেওয়ার জন্য একে বিশেষ শােষণ বলে উল্লেখ করেন।
পৃষ্ঠা: ৪২
মার্কসবাদীরা এইরূপ বিমূর্তভাবে কখনও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে প্রকাশ করে না। আমরা তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করছি, এই বিশেষ শােষণ বলতে তারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন?
তারা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব স্বীকার করেননি। আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্যে উল্লিখিত এবং কমরেড লিন পিয়াও কর্তৃক ঘােষিত বক্তব্য- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে। সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশ ও জাতিসমূহের দ্বন্দ্ব, প্রধান দ্বন্দ্ব থেকে আমরা পাই, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতই বিশ্ব জনগণের প্রধান শত্রু।১
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের নিয়ে চীন বিরােধী, ক্যুনিজম বিরােধী, জনগণ বিরােধী ঐক্যজোট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সমর্থন করবে না। পূর্ব বাংলাকে শােষণ ও লুণ্ঠন করাই তাদের লক্ষ্য। পূর্ব বাংলায় তাদের দালাল সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলার বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে। সংশােধনবাদীরা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, বুর্জোয়া ও সকল প্রতিক্রিয়াশীলদের এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল। কাজেই সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদকে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় শত্রু বলে উল্লেখ না করে, সংশােধনবাদ মার্কসবাদী আন্দোলনের প্রধান শত্রু এবং সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্ব জনগণের প্রধান শত্রু এ তত্ত্ব অস্বীকার করে তারা নিজেদের সংশােধনবাদী চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন।
সভাপতি মাও বলেছেন সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে অবশ্যই সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু তারা সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চান। এ কারণে তারা সত্যিকারভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধীও নন। পেটি বুর্জোয়া মার্কসবাদ বিরােধী রােমান্টিক বিপ্লবী চে-বাদীরা সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রাম ব্যতিরেকেই সামাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম পরিচালনার কথা প্রচার করে। কাজেই তারা চে-বাদী।
তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের উল্লেখ করেননি। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা সাম্রাজ্যবাদের মত পুঁজি বিনিয়ােগ দ্বারা শােষণ করতে অক্ষম বিধায় সীমানা সম্প্রসারণ করে তাদের পণ্যের বাজার তথা শােষণের ক্ষেত্র লাভ করতে চায়। তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বুর্জোয়া নেতৃতু সমর্থন করবে কেননা বুর্জোয়া নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ব বাংলাকে শােষণ করা এবং চীন বিরােধী, কমুনিজম বিরােধী ও জনগণ বিরােধী একটি মিত্র পাওয়া সম্ভব, কিন্তু সর্বহারার নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ব বাংলা সহায়ক হবে আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিম বাংলা তথা সমগ্র ভারতের সর্বহারার মুক্তির। কাজেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা সর্বহারার নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সর্বতােপায়ে বানচাল করার প্রচেষ্টা চালাবে। কাজেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার জনগণের শত্রু। কিন্তু তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট
…………………………………………………………………….
১. লিন পিয়াও-এর এ বক্তব্য ছিল মাও নেতৃত্বাধীন চীনা পার্টির বক্তব্য। পরবর্তীতে লিন পিয়াও সংশােধনবাদী চক্র হিসেবে উন্মােচিত হলে কমরেড সিরাজ সিকদার লিন পিয়াওকে প্রত্যাখ্যান করেন -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪৩
পার্টির সৃষ্টিকর্তারা পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ না করে সম্প্রসারণবাদের দালালীর পরিচয় দিয়েছেন।
তারা উল্লেখ করেছেন, “এরা (তিন শত্রু) একে অন্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, পরস্পর ওতােপ্রােতভাবে জড়িত, একে অপরের রক্ষক ও সহায়ক। কোনটাকে বিচ্ছিন্ন করে আঘাত করা যায় না। তারা অন্যত্র বলেছেন, “এই তিন শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া উচিত না।” অর্থাৎ, তারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, বড় ধনী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের মধ্যে কোনটা প্রধান কোনটা গৌণ তা নির্ণয় করতে চান না। আবদুল হক ও তােয়াহা চক্রের মত এক ও অবিচ্ছেদ্য বলে উল্লেখ করেন। তারা আরাে উল্লেখ করেন, “প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ধারণের বিষয়টি রণনীতি সংক্রান্ত নয়, ইহা রণকৌশলের অন্তর্গত বিষয়। প্রথম ও দ্বিতীয় তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পরিপন্থী। সভাপতি মাও বলেছেন, “কোন প্রক্রিয়াতে যদি অনেকগুলাে দ্বন্দ্ব থাকে তাহলে তাদের মধ্যে একটি প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে, অন্যগুলাে গৌণ ও অধীনস্থ ভূমিকা নেবে।” তাই দুই বা দুয়ের বেশী দ্বন্দ্ব বিশিষ্ট কোন জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালােচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলে সব সমস্যা সহজেই মীমাংসা করা যায়। তিনি আরও বলেছেন, “হাজার হাজার পণ্ডিত ও কাজের লােক রয়েছেন যারা এটা বুঝেন না এবং ফলে তারা কুয়াশায় ডুবে যান, সমস্যাটির মূলে যেতে পারেন না এবং স্বাভাবিকভাবেই দ্বন্দ্বগুলাের মীমাংসার পদ্ধতি পান না।” তিনি আরও বলেছেন, “কিন্তু যাই হােক না কেন সন্দেহ নাই যে একটি প্রক্রিয়ার বিকাশের সকল স্তরে কেবলমাত্র একটিই দ্বন্দ্ব থাকে যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।”
কাজেই বিভিন্ন দ্বন্দ্বকে বিশ্লেষণ করে অবশ্যই প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে বের করতে হবে, সর্বহারার আঘাতের প্রধান শত্রুকে নির্ণয় করতে হবে-ইহা মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের একটি মূলতত্ত্ব। কমরেড স্ট্যালিন বলেছেন, “রণনীতি হচ্ছে বিপ্লবের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সর্বহারার প্রধান আঘাতের দিক নির্ণয় করা, তদনুযায়ী বিপ্লবী শক্তিসমূহের (প্রধান ও গৌণ) প্রয়ােগের বিশদ পরিকল্পনা রচনা করা, বিপ্লবের নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।”
কাজেই প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করার প্রশ্ন সর্বহারার বিপ্লবের একটি মূল প্রশ্ন, ইহা রণনীতির প্রশ্ন। কিন্তু তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সৃষ্টিকর্তারা প্রধান দ্বন্দ্বকে রণকৌশলের প্রশ্ন বলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মূলতত্ত্বকে বিকৃত করেছেন। সভাপতি মাও বলেছেন, “মার্কসবাদের মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করা ও মার্কসবাদের সার্বিক সত্যকে অস্বীকার করাই হচ্ছে সংশােধনবাদ।” তথাকথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্বরূপ উদঘাটন করে আমরা দেখতে পাচ্ছি এ পার্টির সৃষ্টিকর্তারা মার্কসবাদের বহু মৌলিক তত্ত্বকে সংশােধন ও বিকৃত করেছেন। এ কারণে তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মুখােশ এঁটে যতই চেষ্টা করুন না কেন, নিজেদের বুর্জোয়া চরিত্রকে গােপন করতে পারবেন না, তারা প্রকৃতপক্ষে সংশােধনবাদী যা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান।
* মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা-দীর্ঘজীবী হােক!
* সংশােধনবাদ-নয়া সংশােধনবাদ-খতম হােক!
পৃষ্ঠা: ৪৪
পূর্ব বাংলার সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ
[দলিলটি ১৯৭০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘৭২ সালে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সংশােধিত আকারে পুনঃপ্রকাশিত হয় -প্রকাশক]
কারা আমাদের শত্রু, কারা আমাদের মিত্র? এটাই হলাে বিপ্লবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অতীতের সমস্ত বিপ্লবী সংগ্রামগুলাে কেন এত অল্প সাফল্য অর্জন করেছে তার মূল কারণ হলাে, প্রকৃত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রকৃত বন্ধুদের ঐক্যবদ্ধ করতে না পারা।
বিপ্লবী পার্টি হচ্ছে জনসাধারণের পথ প্রদর্শক। বিপ্লবী পার্টি যখন তাদের ভ্রান্ত পথে চালিত করে তখন কোন বিপ্লবই সার্থক হতে পারে না। পূর্ব বাংলার বিপ্লবের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ভারতীয় বিপ্লবের ৪৬ বৎসরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে সংশােধনবাদী, নয়া সংশােধনবাদী, ট্রটস্কী ও চেবাদীরা জনগণকে বিপথে চালিত করেছে এবং এ কারণে ভারত ও পূর্ব বাংলার বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়নি।
আমরা অবশ্যই এ সকল বিশ্বাসঘাতক নেতিবাচক উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবাে এবং বিপ্লবকে সঠিক পথে পরিচালনা করে জনগণের মুক্তি বাস্তবায়িত করবাে। প্রকৃত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রকৃত বন্ধুদের ঐক্যবদ্ধ করতে মনােযােগী হবাে।
প্রকৃত শত্রু ও প্রকৃত বন্ধুদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য পূর্ব বাংলার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিপ্লবের প্রতি তাদের মনােভাবের সাধারণ বিশ্লেষণ করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থা কি রকম?
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণী
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণী চারভাগে বিভক্ত।
এক ভাগ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের তাবেদার, এক ভাগ সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার, অপর এক ভাগ মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার। এক ভাগ জাতীয় বুর্জোয়া।
সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার বুর্জোয়া পূর্ব বাংলার সামন্ত গােষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এই শ্রেণী পূর্ব বাংলার সবচাইতে পশ্চাদপদ প্রতিক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে এবং উৎপাদন শক্তির বিকাশ ব্যাহত করে। পূর্ব বাংলার বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে এদের অবস্থান অসঙ্গতিপূর্ণ। এরা সামন্তবাদ এবং বৈদেশিকদের পক্ষ নেয়, এবং সর্বদাই অতিমাত্রায় প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পালন করে।
এরা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী।
পৃষ্ঠা: ৪৫
পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় শিল্প, ব্যবসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের বড় বড় কর্মচারীরাও এ শ্রেণীর মাঝে পড়ে।
বুর্জোয়াদের চতুর্থ অংশ
এরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তাবেদারদের দ্বারা নিপীড়িত এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদ কর্তৃক শৃঙ্খলবদ্ধ। এ কারণে উভয়ের সাথেই এদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এদিক দিয়ে এরা বিপ্লবী শক্তিগুলির একটি।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদ কর্তৃক নিপীড়িত বলে উপরােক্ত শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বুর্জোয়াদের এ অংশ কিছুটা উৎসাহ প্রদর্শন করে।
কিন্তু অন্যদিকে এ সংগ্রামকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে তারা সক্ষম নয় যেহেতু তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অদৃঢ় এবং এখনাে সামন্তবাদ ও বৈদেশিক শােষকদের সাথে তাদের অর্থনেতিক সম্পর্ক রয়ে গেছে। তাদের এ দিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন জনগণের বিপ্লবী শক্তি জোরদার হয়ে উঠে।
জাতীয় বুর্জোয়াদের দ্বিমুখী চরিত্র থেকে পাওয়া যায় যে, কোন কোন সময় এরা। বৈদেশিক শােষণ ও সামন্তবাদী শােষণ বিরােধী সংগ্রামে কিছুটা অংশগ্রহণ করতে পারে এবং এভাবে বিপ্লবী শক্তি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। কিন্তু অন্য সময়ে এরাই আবার দালাল, বিশ্বাসঘাতক বুর্জোয়াদের অনুসরণ করতে পারে।
জাতীয় বুর্জোয়াদের কখনাে নিজস্ব রাজনৈতিক পার্টি ছিল না এবং বর্তমানেও নেই।
বর্তমানে তারা যে শুধু দালাল বিশ্বাসঘাতক বুর্জোয়া ও জমিদারদের থেকে পৃথক তাই নয় তারা বিপ্লবের মিত্রও। এ কারণে এটা অবশ্যই প্রয়ােজন, জাতীয় বুর্জোয়াদের সম্পর্কে একটি সঠিক নীতি থাকা।
এই নীতি হচ্ছে তাদের ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি, সর্বহারারা নিজস্ব স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রতা এবং উদ্যোগ বজায় রেখে জাতীয় বুর্জোয়াদের ঐক্যবদ্ধ করবে, একই সাথে তাদের দোদুল্যমানতা, বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকবে এবং সংগ্রাম পরিচালনা করবে।
ক্ষুদে বুর্জোয়া
কৃষক ব্যতীত যারা এই শ্রেণীতে পড়ে তারা হচ্ছে- ক) বিশাল বুদ্ধিজীবী খ) ক্ষুদে ব্যবসায়ী গ) হস্তশিল্পী। ঘ) পেশাদার লােক।
এদের সামাজিক অবস্থা মাঝারী চাষীদের সাথে মিলে। তারা সকলেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের শােষণে শােষিত হচ্ছে এবং দেউলিয়া ও ধ্বংসের পথে চালিত হচ্ছে। এ কারণে এই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিভিন্ন স্তর বিপ্লবের একটি পরিচালক শক্তি এবং সর্বহারার বিশ্বস্ত মিত্র। কেবলমাত্র সর্বহারার নেতৃত্বেই এরা মুক্তি অর্জন করতে পারে। এবার আমাদের এই শ্রেণীর বিভিন্ন স্তর বিশ্লেষণ করা যায়।
পৃষ্ঠা: ৪৬
প্রথমতঃ বুদ্ধিজীবী
ছাত্র-যুবক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, নিম্নস্তরের সরকারী কর্মচারী, ক্ষুদে কেরানী প্রভৃতি। এরা একটি আলাদা শ্রেণী বা স্তর নয়। বর্তমান পূর্ব বাংলার সামাজিক অবস্থায় এদের পারিবারিক উৎপত্তি, জীবন ধারণের অবস্থা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বিচার করে এদের ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীতে ফেলা যায়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের সাথে যােগসাজশে লিপ্ত বুদ্ধিজীবী ছাড়া অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও ছাত্ররা নিপীড়িত এবং সর্বদাই চাকুরী হারাবার বা পড়াশুনা বন্ধ হবার ভয়ে থাকে। এ কারণে তারা বিপ্লবী হয়। তারা মােটামুটি বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে পরিচিত, তীক্ষ রাজনৈতিক চেতনা রয়েছে এবং কোন কোন সময় অগ্রগামী ভূমিকা গ্রহণ করে অথবা বর্তমান বিপ্লবের পর্যায়ে জনগণের সাথে সংযােগকারীর ভূমিকা পালন করে। বিশাল দরিদ্র বুদ্ধিজীবীরা। শ্রমিক-কৃষকের সাথে হাত মিলাতে পারে বিপ্লবের অংশগ্রহণ করার জন্য।
অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশে মার্কসবাদ প্রথম প্রচার লাভ করেছে। বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এবং তারাই প্রথম মার্কসবাদ গ্রহণ করে। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ব্যতীত বিপ্লবী শক্তিসমূহকে সাফল্যের সাথে সংগঠিত করা এবং বিপ্লবী কার্য সাফল্যের সাথে। পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীরা যতক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লবী গণসংগ্রামে মনেপ্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথবা মনস্থির করে জীবন প্রাণ দিয়ে জনগণের সেবা করার এবং তাদের একজন হওয়ার, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রায়ই আত্মগত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অদৃঢ় এবং অবাস্তববাদী হয়।
এ কারণে যদিও পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীরা একটি অগ্রগামী ভূমিকা বা জনগণের সাথে সংযােগকারী হিসেবে কাজ করতে পারে কিন্তু এদের সকলেই শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী থাকবে না। কেউ কেউ সংকটপূর্ণ সময়ে বিপ্লবী সারি থেকে ঝরে পড়বে এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে, আবার কেউ হয়তাে বিপ্লবের শত্রুতে পরিণত হবে। বুদ্ধিজীবীরা তাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারে কেবলমাত্র দীর্ঘদিনের গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
দ্বিতীয়তঃ ক্ষুদে ব্যবসায়ী
সাধারণতঃ এরা ছােট দোকান চালায় এবং এক-আধজন কর্মচারী রাখে। তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তাবেদারদের শােষণের চাপে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে।
তৃতীয়তঃ হস্তশিল্পী
এদের সংখ্যা প্রচুর, এদের নিজেদের উৎপাদনের উপায় রয়েছে এবং এরা বেতনভুক্ত কোন কর্মচারী রাখে না, রাখলেও একজন দু’জন সাহায্যকারী বা শিক্ষানবীশ। রাখে। এদের অবস্থা মাঝারী চাষীদের মত।
চতুর্থঃ পেশাদার লােক
এদের মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, উকিল ও অন্যান্য পেশাদার লােক। তারা অন্যলােককে শােষণ করে না, করলেও সামান্য করে। এদের অবস্থা হস্ত শিল্পীদের মতই।
ক্ষুদে বুর্জোয়াদের এই অংশগুলাে বিশাল জনতা নিয়ে গঠিত যাদেরকে অবশ্যই আমরা আমাদের পক্ষে আনবাে এবং তাদের স্বার্থ আমরা অবশ্যই রক্ষা করবাে। কেননা।
পৃষ্ঠা: ৪৭
সাধারণভাবে তারা বিপ্লবে যােগ দিতে পারে বা সমর্থন করতে পারে এবং এরা আমাদের ভাল মিত্র। তাদের দুর্বলতার দিক হলাে তাদের কেউ কেউ সহজেই বুর্জোয়া প্রচারে প্রভাবান্বিত হয়। আমরা অবশ্যই এদের সাথে বিপ্লবী প্রচারণা চালাবাে এবং সাংগঠনিক কাজ করবাে।
ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নিম্নলিখিত স্তরে বিভক্ত করা যায়ঃ
ক্ষুদে বুর্জোয়াদের উচ্চ স্তরঃ
এই স্তরে পড়ে যাদের কিছু উদ্বৃত্ত অর্থ ও খাদ্য আছে অথবা যারা শারীরিক অথবা মানসিক শ্রম দ্বারা নিজেদের ভরণ-পােষণের জন্য প্রতি বছর যতটুকু প্রয়ােজন তার অধিক উপার্জন করে। এ ধরনের লােক ধনী হতে অত্যন্ত আগ্রহী। বিপুল অর্থ সঞ্চয়ের ইচ্ছা না থাকলেও এরা বুর্জোয়াদের স্তরে উন্নীত হতে সর্বদাই ইচ্ছুক। লােকের নিকট সম্মান পায় এমন টাকাওয়ালা লােক দেখলেই তাদের মুখ দিয়ে লালা নির্গত হয়। এই ধরনের লােক ভীরু। তারা সরকারী অফিসারকে ভয় করে এবং বিপ্লবকে ভয় করে। যেহেতু এদের অর্থনৈতিক অবস্থা বুর্জোয়া শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থার অত্যন্ত কাছাকাছি, তাই তারা বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রচারকে খুবই বিশ্বাস করে এবং বিপ্লবের প্রতি সন্দেহের মনােভাব পােষণ করে। ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে এ অংশ সংখ্যালঘু এবং এরা ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর দক্ষিণপন্থী।
ক্ষুদে বুর্জোয়াদের মাঝারী স্তরঃ
এরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মােটামুটি নিজেদের ভরণপােষণ করতে পারে। এ শাখার লােক প্রথম শাখার লােক থেকে অনেক ভিন্ন। এরা ধনী হতে চায়, কিন্তু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তাবেদার কর্তৃক শােষিত হয়ে তারা। অনুভব করে যে অধিক পরিশ্রম করলেও বেঁচে থাকা কষ্টকর। আন্দোলন সম্পর্কে তারা সন্দেহ পােষণ করে ইহা বিজয় অর্জন করবে কিনা, তারা আন্দোলনে ঝুঁকি সহজে নিতে চায় না এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু কখনাে বিপ্লবের বিরােধিতা করে না। এ শাখায় লােকসংখ্যা খুব বেশী, ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রায় অর্ধেক।
ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নিম্ন স্তরঃ
এই শ্রেণীতে রয়েছে তারা যাদের জীবন যাত্রার ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটছে। এ শাখার লােক অনেকেই পূর্বে হয়তাে কোন অবস্থাপন্ন পরিবারভূক্ত ছিল, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তারা এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, কোন মতে জীবিকা নির্বাহ করাও তাদের পক্ষে কষ্টকর। তাদের জীবনযাত্রার মানের ক্রমশঃই অবনতি হচ্ছে। এ ধরনের লােক অধিক মানসিক যন্ত্রণায় ভােগে, কারণ তাদের অতীত ও বর্তমানের মাঝে একটা বৈপরিত্যের তুলনা রয়েছে। বিপ্লবী আন্দোলনে এ ধরনের লােক অতি গুরুত্বপূর্ণ। এদের সংখ্যাও কম নয়। এরাই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বামপন্থী অংশ।
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর উপরােক্ত তিনটি শাখাই স্বাভাবিক সময়েই বিপ্লবের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন মনােভাব পােষণ করে, কিন্তু যুদ্ধের সময় অর্থাৎ যখন বিপ্লবী উত্তাল জোয়ার বৃদ্ধি পায়, বিজয়ের আলাে চোখে পড়ে, তখন শুধু ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বামপন্থী নয়, মধ্যপন্থীও বিপ্লবে যােগদান করতে পারে। এমনকি সর্বহারা শ্রেণী ও ক্ষুদে বুর্জোয়া
পৃষ্ঠা: ৪৮
শ্রেণীর বামপন্থীদের বিরাট বৈপ্লবিক স্রোতে ভেসে দক্ষিণপন্থীরা বিপ্লবের সঙ্গে যেতে বাধ্য হয়।
ক্ষুদে হস্তশিল্পী
ক্ষুদে হস্তশিল্পীদেরকে আধা সর্বহারা শ্রেণী বলা হয়, কারণ যদিও তাদের উৎপাদনের সরল উপকরণ আছে এবং স্বতন্ত্র পেশা রয়েছে তবু তারা প্রায়শঃই আংশিকভাবে শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা গ্রামাঞ্চলের গরীর কৃষকদের মতােই। তাদের সংসার খরচের ভারী বােঝা উপার্জন ও জীবন নির্বাহের ব্যয়ের ব্যবধান এবং প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের জ্বালা ও বেকারত্বের আশংকার থেকে বিচার করলে গরীব কৃষকদের সঙ্গে তাদের মােটামুটি সাদৃশ্য আছে।
দোকান কর্মচারী
দোকান কর্মচারী হচ্ছে ভাড়াটে কর্মী, নিজেদের সামান্য বেতন দিয়েই তাদের। পরিবার চালাতে হয়। যদিও প্রতি বছরই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তবু তাদের বেতন একবার মাত্র বাড়ে। আপনি যদি কখনাে তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ করেন তাহলে তখনই তারা তাদের অন্তহীন দুঃখ-দুর্দশার কথা শােনাতে থাকবে। তাদের অবস্থা গরীব কৃষক ও ক্ষুদে হস্তশিল্পীদের থেকে বেশী পৃথক নয়, বিপ্লবী প্রচারণাকে তারা অতি সহজেই গ্রহণ করে।
ফেরিওয়ালা
ফেরিওয়ালারা পণ্যদ্রব্য নিজেরা বহন করুক বা রাস্তার উভয় পার্শ্বে দোকান খুলে বিক্রয় করুক, তাদের মূলধন অল্প এবং উপার্জিত অর্থও কম। এতে তাদের খাওয়াপরার খরচ কুলায় না। তাদের অবস্থা গরীব কৃষকদের থেকে বেশী পৃথক নয়। তাই তাদেরও গরীব কৃষকদের মত বিপ্লবের প্রয়ােজন হয় যা তাদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করবে।
জমিদার শ্রেণী
জমিদারের জমি আছে কিন্তু সে নিজে শ্রমে অংশগ্রহণ করে না (সামান্য করতেও পারে) এবং চাষীদের শােষণ করে বেঁচে থাকে। জমি পত্তনির টাকা, বর্গা ও ভাগা আদায়ই তাদের শােষণের প্রধান ধরন। সে কারখানা ও ব্যবসা করতে পারে।
[সুদখাের-যাদের আয়ের প্রধান অংশ সুদ খাওয়া এবং যাদের অবস্থা গড়পড়তা। মাঝারী চাষীর চাইতে ভাল তাদেরকেও জমিদারের শ্রেণীভুক্ত করা হবে]।
ওয়াকফ সম্পত্তি, স্কুল ও অন্যান্য সম্পত্তির তত্ত্বাবধানও এই শােষণের আওতায় পড়ে।
একজন দেউলিয়া জমিদার যদি শ্রমে অংশগ্রহণ না করে, অন্যদের ঠকিয়ে তা লুট করে অথবা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সাহায্যে গড়পড়তা মাঝারী চাষীর চাইতে ভাল অবস্থায় থাকে তাহলে সেও জমিদারের পর্যায়ে পড়ে।
পঞ্চায়েত সদস্য, সরকারী কর্মচারী (তহশীলদার, সি.ও, পুলিশ-দারােগা), মুজিববাদী, মস্কোপন্থী স্থানীয় জালিম ও টাউট ভদ্রলােকেরা জমিদার শ্রেণীর রাজনৈতিক
পৃষ্ঠা: ৪৯
প্রতিনিধি ও অতিশয় নিষ্ঠুর লােক। ধনী চাষীদের মধ্যে প্রায়শঃই ক্ষুদে স্থানীয় জালিম ও টাউট ভদ্রলােক দেখা যায়।
যে সকল ব্যক্তিরা জমিদারকে বর্গা-পত্তনি ইত্যাদিতে সাহায্য করে এবং তার সম্পত্তি দেখাশুনা এবং জমিদার কর্তৃক চাষী শােষণের উপর যাদের আয়ের প্রধান অংশ নির্ভর করে, যদি তারা গড়পড়তা মাঝারী চাষীর চাইতেও ভাল অবস্থায় থাকে তাহলে তাদেরকেও জমিদারের পর্যায়ভুক্ত করা হবে।
এই শ্রেণী বিদেশী শােষণের একটি প্রধান স্তম্ভ। এরা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে বাধা হিসেবে কাজ করে এবং এদের কোন প্রগতিশীল ভূমিকা নেই। এ কারণে শ্ৰেণী হিসেবে এরা বিপ্লবের পরিচালক শক্তি তাে নয়ই, বরঞ্চ বিপ্লবের লক্ষ্য। বর্তমানে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এ শ্রেণীর এক অংশ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল হিসেবে কাজ করছে, আর এক অংশ দোদুল্যমান। কিন্তু বেশ কিছুসংখ্যক মাঝারী ও ছােট জমিদার রয়েছে যারা কিছুটা পুঁজিবাদী উৎপাদনের সংস্পর্শে এসেছে এবং যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন করতে পারে। এদেরকে আমরা অবশ্যই আমাদের নেতৃত্বে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালাবাে। এরাই হলাে গ্রামের আলােকপ্রাপ্ত দ্রলােক।
ধনী চাষী
সাধারণ নিয়মেই ধনী চাষীর জমি আছে। কোন কোন ধনী চাষীর কিছুটা জমি বর্গা। বা পত্তনী নেওয়া, বাকীটা নিজের। আবার কোন কোন ধনী চাষীর নিজের কোন জমি নাই, সবটাই বর্গা বা পত্তনী নেয়া। সাধারণতঃ ধনী চাষী গড়পড়তার বেশী চাষের যন্ত্রপাতি (লাঙ্গল, গরু) আছে এবং বেশী নগদ টাকা আছে। সে নিজে শ্রমে অংশগ্রহণ করে, তার শােষণের প্রধান ধরন কামলা বা মজুর খাটানাে (দীর্ঘমেয়াদী মজুর)। এ ছাড়াও সে জমির কিছু অংশ বর্গা পত্তনী দিতে পারে এবং বর্গা বা পত্তনীর মাধ্যমে শােষণ চালাতে পারে। সে টাকা কর্জ দিতে পারে বা ব্যবসা বাণিজ্যও করতে পারে। যে ব্যক্তি তার উর্বর জমির কিছুটা মজুর না খাটিয়ে নিজেই চাষ করে কিন্তু বাকীটা পত্তনী দিয়ে শােষণ করে, কর্জ দিয়ে বা অন্য উপায়ে শােষণ করে তাকে ধনী চাষী ধরা হবে। ধনী চাষী নিয়তই শােষণ করে এবং ইহা তার আয়ের প্রধান উৎস।
সাধারণভাবে বলতে গেলে তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে কিছুটা ভূমিকা পালন করতে পারে এবং জমিদার বিরােধী ভূমি বিপ্লবী সংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকতে পারে। এ কারণে আমরা ধনী চাষীদের জমিদার শ্রেণীভূক্ত করবাে না এবং অপরিপক্কভাবে তাদের ধ্বংস করার নীতি নেব না।
মাঝারী চাষী
অনেক মাঝারী চাষীর জমি আছে। কারাে কিছুটা জমি নিজের, বাকীটা বর্গা অথবা পত্তনী নেয়া। এদের সকলেরই বেশ কিছু চাষের যন্ত্রপাতি আছে। একজন মাঝারী চাষীর আয়ের সম্পূর্ণ বা প্রধান অংশ আসে নিজের শ্রম থেকে। সাধারণতঃ সে অন্যকে শােষণ করে না। বরং বছর শেষে বর্গা (বর্গার অংশ দেওয়া), পত্তনীর টাকা, কর্জের সুদ, সরকারের ক্রমবর্ধমান খাজনা, উন্নয়নকর, শিক্ষাকর, চৌকিদারীকর প্রভৃতি দিয়ে নিজেই। শােষিত হয়। কিন্তু সাধারণতঃ সে শ্রম বিক্রয় করে না (মজুরী বা কামলা খাটে না)।
পৃষ্ঠা: ৫০
কিছু কিছু (স্বচ্ছল) মাঝারী চাষী কিছু শােষণও করে, কিন্তু তা তাদের নিয়মিত কিংবা আয়ের প্রধান উৎস নয়।
মাঝারী চাষীরা জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কেবল অশগ্রহণই করে না, তারা সমাজতন্ত্রও গ্রহণ করবে। এ কারণে সমগ্র মাঝারী চাষীরাই সর্বহারাদের নিকটতম মিত্র এবং বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক শক্তি। মাঝারী চাষীদের সমর্থন বা বিরােধিতা বিপ্লবের বিজয় বা পরাজয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা বিশেষভাবে সত্য কৃষি বিপ্লবের পর যখন তারাই লােকসংখ্যায় সংখ্যাগুরু হয়।
গরীব চাষী
গরীব চাষী কারাে কারাে নিজের কিছু জমি ও অল্প কয়টা চাষের যন্ত্রপাতি আছে। সাধারণতঃ গরীব চাষীকে বর্গা বা পত্তনী নেয়া জমিতে কাজ করতে হয়। গরীব চাষীকে। বর্গায় (ফসলের ভাগ দেয়া), পত্তনীর টাকা, কর্জের সুদ, সরকারের ক্রমবর্ধমান খাজনা, উন্নয়ন কর, শিক্ষা কর, চৌকিদারীকর, সরকারী কর্মচারীদের দুর্নীতি ও সর্বোপরী মজুরী খাটায় শােষিত হয়।
সাধারণতঃ মাঝারী চাষীর শ্রম শক্তি বিক্রয় করতে হয় না (অর্থাৎ মজুরী বা কামলা খাটতে হয় না), অন্যদিকে গরীব চাষীকে তার শ্রম শক্তি বিক্রয় করতে হয়। ইহাই মাঝারী চাষী ও গরীব চাষীকে পার্থক্য করার প্রধান উপায়।
গরীব চাষীরা সহজেই বিপ্লবী প্রচারণা গ্রহণ করে। শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি অবশ্যই গরীব চাষীর উপর নির্ভর করে মাঝারী চাষীদের ঐক্যবদ্ধ করবে, জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে ও ভূমি সংস্কার করবে। “বিপ্লবের গােড়ার দিকে মাঝারী কৃষকগণ দোটানায় ছিলেন। যখন তারা ঘটনা প্রবাহের সাধারণ ধারা স্পষ্টভাবে দেখতে পান এবং বিপ্লবের বিজয় আসন্ন হয়, শুধু তখনই তারা বিপ্লবের পক্ষে আসেন”- বলেছেন সভাপতি মাওসেতুঙ।
সর্বহারার নেতৃত্বেই গরীব চাষী ও মাঝারী চাষীরা মুক্তি পেতে পারে। কেবলমাত্র সর্বহারাই গরীব চাষী ও মাঝারী চাষীদের ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবকে বিজয়ের দিকে পরিচালনা করতে পারে। কৃষক বলতে আমরা ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী ও মাঝারী চাষীকে বুঝি।
সর্বহারা শ্রেণী
পূর্ব বাংলার আধুনিক শিল্প সর্বহারারা প্রধানতঃ চটকল, চিনিকল, বস্ত্র, শিল্প, রেলওয়ে, ডক, পরিবহন ইত্যাদিতে কর্মরত। এদের মধ্যে অধিকাংশ পুঁজির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, প্রতিষ্ঠানের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ। শিল্পীয় সর্বহারা যদিও সংখ্যায় অল্প, তবুও তারা পূর্ব বাংলার নতুন উৎপাদন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। আধুনিক পূর্ব বাংলায় তারাই সবচাইতে প্রগতিশীল শ্রেণী এবং বৈপ্লবিক আন্দোলনের পরিচালক শক্তি। কেন তারা এই ভূমিকা দখল করে? এর প্রথম কারণ হচ্ছে তারা কেন্দ্রীভূত। অন্য যে কোন অংশের লােক এদের মত কেন্দ্রীভূত নয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিম্নমানের। উৎপাদনের উপকরণ হতে তারা বঞ্চিত, নিজের হাত দু’টি ছাড়া তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ধনী হবার কোন আশা নেই এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তাবেদাররা তাদের সঙ্গে অতিশয় নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। সুতরাং সংগ্রামে তারা অগ্রবর্তী। শহরের কুলি,
পৃষ্ঠা: ৫১
মুটে-মজুর, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, ঝাড়দার, মেথর, ঠেলাওয়ালা, ঠিকা ঝি, হােটেল বয়, বিড়ি শ্রমিক প্রভৃতিদেরও নিজেদের হাত দু’টি ছাড়া আর কোন সম্বল নেই। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শিল্প শ্রমিকদের মতই। কিন্তু শিল্প শ্রমিকদের চেয়ে এরা কম কেন্দ্রীভূত এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রাম্য সর্বহারা বা গ্রাম্য শ্রমিক বা ক্ষেতমজুর
পূর্ব বাংলার কৃষিতে এখনাে পুঁজিবাদী কৃষিকর্ম খুব কম। গ্রাম্য সর্বহারা শ্রেণী বলতে বার্ষিক, মাসিক অথবা দৈনিক ভাড়াটে কৃষকদের বুঝায়। এই ধরনের ভাড়াটে কৃষকদের শুধু যে জমি এবং কৃষির যন্ত্রপাতি নেই তা নয়, এমনকি তাদের কোন মূলধনও নেই। শুধু নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করেই বেঁচে থাকতে হয়। তাদের কাজের সময় এত দীর্ঘ, বেতন এত কম, শ্রমের অবস্থা এত শােচনীয় এবং কাজ এত নিরাপত্তাহীন যে অন্য সকল শ্রমিকদের তুলনায় তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের লােকেরাই সবচেয়ে কষ্ট ভােগ করছে এবং কৃষক আন্দোলনে এদের অবস্থান গরীর চাষীদের মতােই গুরুত্বপূর্ণ।
ভ্রষ্ট সর্বহারা
গ্রাম ও শহরে বহু বেকার রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত বলে তারা অবৈধ উপায় অবলম্বন করে। এ কারণেই সৃষ্টি হয়েছে ডাকাত, চোর, ভিক্ষুক, পতিতা এবং বহু লােক যারা ফকিরালী, ওঝা, তাবিজ বিক্রি প্রভৃতি করে বেঁচে থাকে। এই সামাজিক স্তর অস্থায়ী। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃক ক্রীত হতে পারে। অন্যরা বিপ্লবে যােগ দিতে পারে। এ ধরনের লোেকদের গঠনমূলক গুণের অভাব রয়েছে এবং সহজেই ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠে। বিপ্লবে যােগদানের পর বিপ্লবী সারিতে তারাই হয় ভ্রাম্যমান বিদ্রোহীবাদের এবং নৈরাজ্যবাদের উৎস। অতএব আমাদের জানতে হবে কিভাবে তাদেরকে পরিবর্তিত করতে হয় এবং তাদের ধ্বংসাত্মক প্রবণতাকে ঠেকানাে যায়।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখি আমাদের শত্রু হলাে ভারতীয় সম্প্রসারণ ও তাদের শাসক গােষ্ঠী, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের উপর নির্ভরশীল দালাল বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী এবং তাদের উপর নির্ভরশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ।
বিপ্লবের নেতা হলাে শ্রমিক শ্রেণী ও তার পার্টি, নিকটতম মিত্র হলাে কৃষক ও ক্ষুদে বুর্জোয়া। জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতি আমাদের ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি থাকবে। যতক্ষণ তারা জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্র সমর্থন করবে এবং সর্বহারার পার্টির বিরােধিতা করবে না, ততক্ষণ তাদেরকে আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যখন তারা। সর্বহারার পার্টির বিরােধিতা করবে এবং জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের বিরােধিতা করবে তখন তাদেরকে সমালােচনা করতে হবে এবং তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫২
বিভিন্ন স্তরের সাংগঠনিক এককের নিরাপত্তামূলক দায়িত্ব
(রচনাটি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন-এর প্রথমদিকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এটি আগস্ট,’৭৪-এ প্রকাশিত ক. সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলীর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয় -প্রকাশক।]
সাংগঠনিক একক বলতে পাঠচক্র, কোষ, কমিটি, বিভাগ ও সংস্থা, মিলিশিয়া ও গেরিলা গ্রুপ বা অন্য কোন সাংগঠনিক একক বুঝায়।
১. সাংগঠনিক এককের প্রতি সদস্য নিজের বা সংগঠনের অন্য কারাে সাংগঠনিক সম্পর্ক, তাদের নাম, ঠিকানা, পেশা বা অন্য কোন প্রকার পরিচয় সংগঠনের অভ্যন্তরে ও বাইরে কারাে নিকট প্রকাশ করবেন না।
২. সাংগঠনিক এককের সদস্যদের সংগঠন কর্তৃক যে সকল দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হবে তা অপ্রয়ােজনীয়ভাবে সংগঠনের অভ্যন্তরে বা বাইরে কারাে কাছে প্রকাশ না করা। দায়িত্ব পালনকালে অপ্রয়ােজনীয়ভাবে সংগঠনের অভ্যন্তরস্থ বা বহিস্থঃ কাউকে সংগে না নেওয়া।
৩. যৌথভাবে একটি সাংগঠনিক একককে যে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হবে তা অপ্রয়ােজনীয়ভাবে সাংগঠনিক এককের বাইরে প্রকাশ না করা।
৪. সাংগঠনিক এককের যে সকল সদস্য যে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন তা নির্দিষ্ট একক ব্যতীত অন্য কোথাও প্রকাশ না করা।
৫. সাংগঠনিক এককের সভার স্থান, তারিখ, সময়, আলােচ্যসূচী, সভায় অংশগ্রহণকারীদের পরিচয়, সিদ্ধান্ত (সিদ্ধান্তের মাঝে যতটুকু জনগণকে জানানাে প্রয়ােজন তা ব্যতীত) সাংগঠনিক এককের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা।
৬. সাংগঠনিক এককের কেউ উক্ত একক-বহির্ভূত কাউকে সভায় নিয়ে আসবেন না।
৭. সাংগঠনিক এককের কেউ অন্য সদস্য বা সংগঠনের অন্য কারাে সাথে রাস্তায় বা অন্য কোন জনসমাবেশপূর্ণ স্থানে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা, ব্যক্তিগত আলাপপরিচয়, কুশলবার্তা বিনিময় করবেন না।
৮. সদস্যগণ দলিল-পত্রাদি গােপনে রাখবেন। দলিল-পত্রাদি সংগঠন বহির্ভূত কাউকে দেওয়ার সময় যথাযথ অনুসন্ধান করে দিতে হবে।
৯. সাংগঠনিক এককের সদস্যগণ কোন জনসমাবেশপূর্ণ স্থানে পার্টির পরিচয়ে নিজেদের মাঝে বা বাইরের লােকের সাথে আলাপ-আলােচনা করবেন না।
১০. অপ্রয়ােজনীয়ভাবে অন্য সাংগঠনিক এককের বা সংগঠনের অন্য কারাে পরিচয় জানতে না চাওয়া। অপ্রয়ােজনীয়ভাবে কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দেওয়া।
১১. অপ্রয়ােজনীয়ভাবে সাংগঠনিক বিষয় জিজ্ঞেস না করা। অপ্রয়ােজনীয়ভাবে কেউ জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দেওয়া।
১২. সাংগঠনিক এককের কোন সদস্যের বা সংগঠনের অন্য কারাে কার্যকলাপ, গতিবিধি বা পরিচয় সন্দেহজনক হলে বা সংগঠনের নিরাপত্তার পক্ষে বা সংগঠনের
পৃষ্ঠা: ৫৩
স্বার্থের পরিপন্থী হলে অতিসত্ত্বর নির্দিষ্ট এককের সম্পাদক, নেতা বা পরিচালক বা উচ্চস্তরে রিপাের্ট করবেন।
১৩. সাংগঠনিক এককের প্রতিটি সদস্যের দুই বা অধিক ছদ্মনাম থাকবে। তারা কখনাে পিতা প্রদত্ত নামে সংগঠনের কোথাও পরিচিত হবেন না। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ছদ্মনামে পরিচিত হতে চেষ্টা করতে হবে।
১৪. সংগঠনের কোন কর্মীর নিকট সংগঠনের অন্য কর্মী অজ্ঞাতে যদি লাইন দিতে আসে তবে পূর্বোক্ত কর্মী শেষােক্ত কর্মীর নিকট সাংগঠনিক গােপনীয়তা প্রকাশ করবেন না এ বিষয়ে রিপাের্ট করতে হবে।
১৫. সাংগঠনিক এককের সদস্যগণ অপ্রয়ােজনীয়ভাবে নিজেদের বাসস্থান বা অন্য কোন কমরেডের বাসস্থান চিনবেন না বা চিনাবেন না।
১৬. ঘটনাক্রমে যদি কোন একজন লােককে রাজনৈতিক লাইন দিতে সংগঠনের একাধিক কর্মী যান, তখন সংগঠনের কর্মীদের দায়িত্ব হলাে উপরের স্তরে রিপাের্ট করা যাতে উপরের স্তর একজনকে দায়িত্ব প্রদান করতে পারে।
১৭. শত্রু সম্পর্কিত কোন খবর পেলে অতিসত্ত্বর তা উচ্চস্তরে রিপাের্ট করতে হবে।
১৮. অপ্রয়ােজনীয়ভাবে কমরেডদের পরিচয়, ব্যক্তিগত জীবন, ‘অমুক ঘটনায় তিনি ছিলেন কিনা?’ এ কমরেড অমুক না?’ ইত্যাদি জানার জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ না করা। জানলে তা অন্যের নিকট গল্পচ্ছলে বা সবজান্তা হিসেবে জাহির করার জন্য প্রকাশ না করা।
১৯. ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুজব, অপবাদ, ব্যক্তিগত কুৎসা, খারাপ উদ্দেশ্যে পিছনে সমালােচনা-অভিযােগ করা, সাংগঠনিক সিদ্ধান্তকে বিকৃত করে বলার খবর পেলে তা সাথে সাথে উচ্চস্তরে রিপাের্ট করা।
২০. চক্রগঠন, উপদল গঠন, অর্থ-অস্ত্র চুরির বিষয় বা অর্থ-অস্ত্র নিয়ে দলত্যাগের খবর পেলে তা সাথে সাথে উচ্চস্তরে জানানাে।
২১. গুপ্তহত্যা, চক্রান্ত, ধরিয়ে দেওয়া, ষড়যন্ত্র, কোন প্রতিবিপ্লবী সংস্থা, প্রতিক্রিয়াশীল সরকার, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্ৰুচরের সাথে যােগসাজশের খবর পেলে তা সাথে সাথে উচ্চস্তরে জানানাে।
২২. অসাংগঠনিক, অবৈধ গােপন বৈঠক, ষড়যন্ত্র-চক্রান্তমূলক বৈঠকে অংশগ্রহণ না করা, এ সম্পর্কে উচ্চস্তরে রিপাের্ট করা।
২৩, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী বা অন্য কারাে দলিলপত্র পেলে তা জমা দেওয়া।
২৪. ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, দলত্যাগী, বিশ্বাসঘাতকদের বিষয়ে সতর্ক থাকা, তাদের পরিচিত স্থানে না যাওয়া, তারা আত্মসাৎ করতে পারে এরূপ স্থানে অর্থ, অস্ত্র, মূল্যবান দ্রব্যাদি না রাখা। তাদের নিকট সাংগঠনিক গােপনীয়তা বজায় রাখা।
২৫. ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের সাথে যুক্ত হতে পারে এ ধরনের কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা।
২৬. পার্টি, বিপ্লব ও জনগণ বিরােধী অন্যান্য সকল তৎপরতায় অংশগ্রহণ না করা, তার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা, তার খবর পেলে সাথে সাথে সংগঠনে জানানাে।
কথা বলতে সতর্ক হওয়া যাতে গােপনীয়তা প্রকাশ না হয়ে পড়ে; কথা শুনতেও সতর্ক হওয়া যাতে সবকিছু শােনা যায়।
পৃষ্ঠা: ৫৪
একটি সাংগঠনিক একক কর্তৃক সভা পরিচালনার উপায়
(দলিলটি প্রণীত ও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সময়ে১৯৭০ সালে। পরে এটি আগস্ট ‘৭৪-এ প্রকাশিত ক. সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলীর সংকলনে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
সভাপতি মাও নির্দেশ দিয়েছেন সভা পরিচালনার কৌশল উত্তমরূপে আয়ত্ব করতে। নিম্নে সভা পরিচালনার উপায় ধারাবাহিকভাবে প্রদত্ত হলাে।
১. সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বা নেতা বা উচ্চস্তরের প্রতিনিধি সভা আহ্বান করতে পারেন।
২. সাংগঠনিক এককের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ দাবী করলে সম্পাদক বা নেতা সভা আহ্বান করতে বাধ্য থাকবেন।
৩. সভার পূর্বে সম্পাদক বা নেতা লিখিতভাবে বিজ্ঞপ্তি দেবেন। লিখিত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া সম্ভব না হলে মৌখিকভাবে জানাতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে থাকবে।
(ক) সাংগঠনিক এককের নাম, (খ) তারিখ, সময়, (গ) সভার ক্রমিক নং, (ঘ) সভার স্থান, (ঙ) আলােচ্যসূচী, (চ) সভায় আমন্ত্রিতদের নাম, (ছ) সভা আহ্বানকারীর পদসহ স্বাক্ষর।
৪. আলােচ্যসূচীতে পূর্বেকার সভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলীর পুনরােনুমােদনের বিষয় থাকবে।
৫. সভার খসড়া প্রস্তাব, রিপোের্ট, প্রস্তাব ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দলিলপত্র সম্পাদকসহ অন্যান্য আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ সভার পূর্বেই পেশ করার জন্য তৈরী করবেন।
৬. সাংগঠনিক এককের সহ-সম্পাদক বা সহকারী নেতা অথবা একজন সদস্য সভায় আমন্ত্রিত উপস্থিতিদের স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন। সভায় আমন্ত্রিত নয় এইরূপ অপ্রয়ােজনীয় কেউ থাকলে তাদেরকে চলে যেতে বলতে হবে। তাদের অপসারণ সম্ভব হলে সভা স্থগিত রাখতে হবে।
৭. সভার কোরাম হলে (সাংগঠনিক এককের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য উপস্থিত হলে) সহ-সম্পাদক সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য সম্পাদককে অনুরােধ করবেন। সহসম্পাদকের অনুপস্থিতিতে একজন সদস্য এ দায়িত্ব পালন করবেন।
৮. সম্পাদক বা নেতা সভাপতির আসন গ্রহণ করবেন এবং সভার উদ্বোধনী ঘােষণা করবেন।
৯. সভাপতি সভার আলােচ্যসূচী পাঠ করবেন এবং সভায় অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা এ আলােচ্যসূচী অনুমােদন করাবেন।
১০. সহ-সম্পাদক বা একজন সদস্য সভার ধারাবাহিক বিবরণী লিখে রাখবেন।
১১. সভায় কোন পূর্ণাঙ্গ সদস্য অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প সদস্য পূর্ণাঙ্গ সদস্যের। দায়িত্ব পালন করবেন।
১২. এক বৈঠকে সভার কাজ শেষ না হলে সভা কয়েকটি বৈঠকে বিভক্ত করতে হবে।
১৩. সভাপতি আলােচ্যসূচীর ভিত্তিতে আলােচনা, রিপাের্ট, প্রস্তাব ইত্যাদি আহ্বান করবেন।
১৪. সভায় সভাপতির অনুমতি নিয়ে আলােচনা করতে হবে বা সভাকক্ষ ত্যাগ করতে হবে।
১৫. সভাপতি সভাকক্ষের বাইরে গেলে অন্য কাউকে সভার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে যাবেন।
১৬. সভাপতি সভায় গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করবেন। সভাপতি সভায় সকল অংশগ্রহণকারীদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন। তিনি সভায় অংশগ্রহণকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করবেন।
১৭. কোন সদস্যের কোন প্রস্তাব, সমস্যা, সমালােচনা বা আত্মসমালােচনা সভায় করতে হবে। সভার বাইরে একজনের সমালােচনা অপরের কাছে করা উচিত নয়।
১৮, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সভায় স্থির করতে হবে। সদস্যদের মতপার্থক্য সভায় স্থির করতে হবে।
১৯. সংখ্যাগুরুকে সংখ্যালঘু মেনে নেবে। যখন সংখ্যালঘুর মতামত বাতিল করা হয় তখন সংখ্যাগুরুর গৃহীত সিদ্ধান্তকে তাদের অবশ্যই সমর্থন করতে হবে। প্রয়ােজন হলে পরবর্তী সভায় তা আলােচনার জন্য পেশ করা যেতে পারে, তা ছাড়া কার্যকলাপে কোনরকম আপত্তি প্রকাশ করা উচিত নয়।
২০. সভায় অংশগ্রহণকারী সকলকেই মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্ত করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বিতর্কের প্রশ্নে কোটা ঠিক, কোনটা বেঠিক তা পরিষ্কার করে দিতে হবে। সেখানে কোন প্রকার আপােষ বা যেন-তেন করা চলবে না। সুস্পষ্ট সমাধানে একবারে যদি পৌঁছতে না পারা যায় তাহলে আবার তা আলােচনা করতে হবে (অবশ্যই কাজ ব্যাহত না করে)।
২১. সভায় কথাবার্তা, বক্তৃতা, প্রবন্ধ, প্রস্তাব সবই সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ হবে।
২২. কোন কর্মী অবৈধ সভায় বা অনির্ধারিত আলােচনা সভায় গৃহীত কোন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করবে না।
২৩. সভায় প্রস্তাবাবলীর উপর ভােট গ্রহণ করতে হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কর্তৃক সমর্থিত প্রস্তাব গৃহীত বলে বিবেচিত হবে।
২৪. কোন প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে সমান ভােট পড়লে সভাপতি যে পক্ষে ভােট প্রদান করবেন ঐ পক্ষের প্রস্তাব গৃহীত হবে।
২৫. সভাপতি সভা শেষের পূর্বে ধারাবাহিক বিবরণীর শেষে স্বাক্ষর দেবেন।
২৬. তিনি সভার সমাপ্তি ঘােষণা করবেন।
সভার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে
১. সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত কোন প্রকার অনির্ধারিত আলােচনায় কেউ বাতিল করবেন। কোন বিশেষ অবস্থায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আবশ্যক হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থার সভায় উহা বাতিল হবে। সম্পাদক বা নেতা উহা কার্যকরী করা স্থগিত রাখতে পারেন এবং পরবর্তী সভায় তা অনুমােদনের জন্য পেশ করবেন। উচ্চতর স্তর নিম্নতর স্তরের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিতে পারে।
২. যে সকল কর্মীদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হবে, তারা তা পুংখানুপুংখভাবে আলােচনা করবেন তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি বের করার জন্য। কিন্তু তারা কখনাে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেবেন না।
৩. সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে কোন প্রকার নিমরাজী মনােভাব থাকলে চলবে না। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ইহা উগ্রগণতন্ত্রের প্রকাশ।
পৃষ্ঠা: ৫৭
কোষ ও পাঠচক্র সদস্যপদের যােগ্যতা, তাদের করণীয়,
শৃংখলা, পরিচালকের দায়িত্ব
[রচনাটি প্রণীত ও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন-এর প্রথম দিকে। পরে এটি সংশােধিত আকারে সেপ্টেম্বর ‘৭১-এ পেশকৃত সর্বহারা পার্টির খসড়া সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। জানুয়ারী ‘৭২-এ অনুষ্ঠিত পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে সংবিধানটি গৃহীত হয়েছিল। রচনাটি আগস্ট ‘৭৪-এ প্রকাশিত ক, সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলীর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয় -প্রকাশক।]
সদস্যপদ
পূর্ব বাংলার শ্রমিক, গরীব চাষী, নিম্ন মাঝারী চাষী, বিপ্লবী সৈনিক বা অন্যান্য বিপ্লবী ব্যক্তি যারা পার্টির সংবিধান স্বীকার করেন, পার্টির কোন একটি সংগঠনে যােগ দেন এবং সেখানে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন, পার্টি-শৃংখলা মেনে চলেন, পার্টির চাদা দেন, তারা সকলেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্য, প্রার্থী সদস্য হতে পারেন।
পার্টিতে ভর্তির নিয়মাবলী
পাঠচক্র, গেরিলা গ্রুপ বা পার্টির অধীন কোন গণসংগঠনে সাফল্যজনক কাজের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পুংখানুপুংখ কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও পর্যালােচনার ভিত্তিতে জেলা কমিটি কর্তৃক প্রার্থী সদস্যপদ প্রদান করতে হবে। প্রার্থী-সদস্য পদের আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে, কমপক্ষে একজন সদস্য দ্বারা সুপারিশকৃত হতে হবে।
কমপক্ষে তিনমাস প্রার্থী-সদস্য পদে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের পর সদস্যপদ প্রদান করতে হবে। প্রার্থী-সদস্যপদ ও সদস্যপদ জেলা কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত হবে।
প্রার্থী-সদস্যপদ বা সদস্যপদ যারা লাভ করেছেন তাদের মধ্যে তিন বা পাঁচজনকে নিয়ে একটি কোষ গঠিত হবে।
প্রতিটি কোষের একজন নেতা গণতান্ত্রিক পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালকের অনুমােদনসহ নির্বাচিত হবে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করা এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যােগদানে ইচ্ছুকদের নিয়ে প্রথমে পাঠচক্র গঠন করতে হবে।
পাঠচক্রে তিন বা পাঁচজন সদস্য থাকবে। তাদের মাঝ থেকে গণতান্ত্রিক পরামর্শের ভিত্তিতে একজন নেতা নির্বাচিত করতে হবে।
কোষ ও পাঠচক্রসমূহ ও তাদের সদস্যদের দায়িত্বসমূহ
১. প্রতিনিয়ত মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা সৃজনশীলভাবে অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করা।
২. পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের বিরাট সংখ্যাধিক লােকের জন্য সর্বান্তঃকরণে কাজ করা।
পৃষ্ঠা: ৫৮
৩. প্রতিনিয়ত শ্রমিক-কৃষকের (ক্ষেতমজুর, গরীব ও নিম্ন মাঝারী চাষী) সাথে একীভূত হতে হবে।
৪. পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ (আধুনিক সংশােধনবাদ, নয়া সংশােধনবাদ, ট্রটস্কী-চেবাদ ও অন্যান্য সকল বিকৃতি ও সংশােধন) ও তার প্রকাশ এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম। করা ও বর্জন করা।
৫. বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শপূর্ণ ব্যক্তিদের দ্বারা পার্টির ক্ষমতা দখল ও নীতি নির্ধারণ ঠেকানাে।
৬. তাদের অবশ্যই বিনয়ী ও সতর্ক হতে হবে, অহংকার ও অসহিষ্ণুতার প্রতি সজাগ থাকতে হবে, আত্মসমালােচনার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিজেদের কাজের ভুল-ক্রটি শােধরানাের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অন্যান্য কমরেডদের প্রতি যথাযথ সমালােচনা চালাতে সাহসী হতে হবে।
৭. তাদের অবশ্যই বিপুল সংখ্যাধিক লােকের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একত্রে কাজ করতে সক্ষম হতে হবে। কেবলমাত্র যারা তাদের সঙ্গে একমত পােষণ করেন, সেইসব লােকের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হলেই চলবে না বরং যারা তাদের সঙ্গে ভিন্নমত পােষণ করেন, সেই সব লােকের সঙ্গে, এমনকি পূর্বে যারা তাদের বিরােধিতা করেছিলেন এবং বাস্তব কাজে ভুল প্রমাণিত হয়েছেন এমন সব লােকের সঙ্গেও ঐক্যবদ্ধ হতে নিপুণ হতে হবে।
৮. তাদেরকে অবশ্যই গণসংগ্রামের এবং বিপ্লবের প্রবল ঝড়তরঙ্গে পরীক্ষিত হয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে হবে।
৯. তাদেরকে অবশ্যই পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা অনুসরণে আদর্শ হতে হবে। ‘জনসাধারণ থেকে আসা এবং জনসাধারণের নিকট যাওয়া’-এই নেতৃত্বের পদ্ধতিকে। অবশ্যই আয়ত্ব করতে হবে এবং জনসাধারণের মতামত শুনতে নিপুণ হতে হবে। গণতান্ত্রিক রীতিকে আয়ত্ব করতে হবে।
১০. তাদেরকে অবশ্যই সর্বদা শ্রেণী বিশ্লেষণ ও শ্রেণী অনুসন্ধানের পদ্ধতি অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। অনুসন্ধান ব্যতিরেকে কথা বলা বন্ধ করতে হবে।
১১. তারা সমালােচনা, রিপাের্ট করা, পরিস্থিতির মূল্যায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অন্যান্য সকল কাজে আত্মগতভাব, ভাসাভাসাভাব ও একতরফাবাদকে পরিহার করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হবেন, একঘেঁয়ে লেখা পরিহার করবেন।
১২. এভাবে তারা সভাপতি মাও-এর কেডার চরিত্র অর্জন করবেন। এই কেডার ও নেতারা অবশ্যই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বুঝেন, তারা রাজনীতিতে দূরদর্শী, কাজে দক্ষ, আত্মবলিদানের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, স্বাধীনভাবে সমস্যা সমাধানে সক্ষম; বাধাবিপত্তিতে অবিচলিত এবং জাতি, শ্রেণী ও পার্টির জন্য নিষ্ঠার সাথে কর্মরত। … এই ধরনের স্বার্থপরতা থেকে এবং হামবড়াভাবের সংকীর্ণতাবাদ থেকে মুক্ত হতে হবে, তাদের অবশ্যই নিঃস্বার্থ জাতীয় ও শ্রেণীর বীর হতে হবে।’
১৩. তিনি আরাে বলেছেন, একজন কমিউনিস্টের মুক্তমন, বিশ্বস্ত ও সক্রিয় হতে হবে। বিপ্লবের স্বার্থকে নিজের প্রাণের চেয়েও উর্ধে স্থান দিতে হবে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের বশে রাখতে হবে, তাকে সর্বদা এবং সর্বক্ষেত্রে সঠিক নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে এবং সমস্ত ভুল চিন্তাধারা ও আচরণের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করতে হবে, যাতে করে পার্টির যৌথ জীবনকে সুসংবদ্ধ এবং পার্টি ও জনসাধারণের
পৃষ্ঠা: ৫৯
মধ্যকার সংযােগকে সুদৃঢ় করা যায়; ব্যক্তি বিশেষের চাইতে পার্টির ও জনসাধারণের সম্বন্ধে এবং নিজের চেয়ে অপরের সম্বন্ধে তাকে বেশী যত্নশীল হতে হবে।
১৪. তাদেরকে ‘তিনটি বৃহৎ শৃংখলা’, মনোেযােগ দেবার আটটি ধারা’, ‘তিন-আট কর্মপদ্ধতি এবং ‘চার প্রথম’ রপ্ত করতে হবে।১
তিনটি বৃহৎ শৃংখলা
১. সকল কার্যক্রিয়ায় আদেশ মেনে চলুন।
২. জনসাধারণের কাছ থেকে একটি সূচ কিংবা সুতােও নেবেন না।
৩. দখলকৃত সমস্ত জিনিস জমা দেবেন।
মনোযােগ দেবার আটটি ধারা
১. দ্রভাবে কথা বলুন।
২. ন্যায্য মূল্যে কেনাবেচা করুন।
৩. ধার করা প্রতিটি জিনিস ফেরত দিন।
৪. কোন জিনিস নষ্ট করলে তার ক্ষতিপূরণ করুন।
৫. লােককে মারবেন না, গাল দেবেন না।
৬. ফসল নষ্ট করবেন না।
৭. নারীদের সঙ্গে অশােভন ব্যবহার করবেন না।
৮. বন্দী সৈন্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না।
তিন-আট কর্মপদ্ধতি
দৃঢ়, সঠিক রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ, একটি সহজ জীবনযাত্রা, কঠোর কাজ করার অভ্যাস, রণনীতি ও কৌশলে নমনীয়তা, সতর্কতা, মনােযােগিতা, সজীবতা।
চার প্রথম
১. মানুষ ও অস্ত্রের মধ্যে প্রথম স্থান দিতে হবে মানুষকে।
২. রাজনৈতিক কাজ ও অন্যান্য কাজের মধ্যে প্রথম স্থান দিতে হবে রাজনৈতিক কাজকে।
৩. দৈনিক নির্ধারিত রাজনৈতিক কাজ ও মতাদর্শগত কাজের মধ্যে প্রথম স্থান দিতে হবে মতাদর্শগত কাজকে।
৪. মতাদর্শগত কাজের মধ্যে বই-এর চিন্তাধারার চাইতে মানুষের মনে যে সকল জীবিত ধারণা রয়েছে তাকে প্রথম স্থান দিতে হবে।
০ অর্থাৎ মানুষকে, রাজনৈতিক কাজকে, মতাদর্শগত কাজকে এবং জীবিত ধারণাকে প্রথম স্থান দিতে হবে।
কোষ সদস্যদের নিম্নলিখিত শৃংখলা পালন করতে হবে
পার্টির সাংগঠনিক নীতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা।
…………………………………………………………………….
১. এগুলাে মাওসেতুঙ-এর রচনা ও সূত্রায়ন -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৬০
পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় সংস্থাসমূহ গণতান্ত্রিক পরামর্শের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন।
সমগ্র সংগঠনের অবশ্যই একক শৃংখলা মানতে হবে; ব্যক্তি সংগঠনের অধীন, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন, নিম্নস্তর উচ্চস্তরের অধীন ও সমগ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন থাকবে।
কংগ্রেস অথবা পার্টি-কর্মীদের সাধারণ সভায় পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় সংস্থার নিজের কার্যাবলীর নিয়মিত রিপোের্ট পেশ করবে।
নেতৃস্থানীয় সংস্থাকে সর্বদা পার্টি-অভ্যন্তরের ও বাইরের জনসাধারণের মতামত শােনা ও তাদের তদারকি মেনে নিতে হবে।
পার্টির সংগঠনকে ও বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে সমালােচনা করার ও তাদের নিকট প্রস্তাব পেশ করার অধিকার পার্টি-সদস্যদের রয়েছে।
পার্টি-সংগঠনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ সম্পর্কে পার্টি-সদস্যদের যদি ভিন্নমত থাকে, তাহলে সেটা সে পােষণ করতে পারে এবং তার এমন অধিকার রয়েছে যে স্তর অতিক্রম করে কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সভাপতির নিকট রিপাের্ট করতে পারবে।
এমন রাজনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি করা উচিত যার মধ্যে থাকবে যেমনি কেন্দ্রীকতা তেমনি গণতন্ত্র, যেমনি শৃংখলা তেমনি স্বাধীনতা, যেমনি একক সংকল্প তেমনি থাকবে ব্যক্তির মনের প্রফুল্লতা ও সজীবতা।
জাতীয় মুক্তি ফৌজ এবং অন্যান্য বিপ্লবী গণসংগঠন সকলে অবশ্যই পার্টির নেতৃত্ব মানবে।
পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃস্থানীয় সংস্থা হচ্ছে জাতীয় কংগ্রেস ও তার দ্বারা নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি। স্থানীয় সৈন্যবাহিনীর ও বিভিন্ন বিভাগগুলাের পার্টির নেতৃস্থানীয় সংস্থা হচ্ছে তাদের সমস্তরের পার্টি-কংগ্রেস অথবা পার্টি-সদস্যদের সাধারণ সভা ও তার দ্বারা নির্বাচিত পার্টির কমিটি।
পার্টির বিভিন্ন স্তরের কংগ্রেস বিভিন্ন স্তরের পার্টির কমিটি কর্তৃক আহুত হয়।
স্থানীয় সৈন্যবাহিনীর পার্টির কংগ্রেস আহ্বান করাটা এবং নির্বাচিত পার্টি-কমিটির সদস্যদের অবশ্যই উচ্চতর স্তরের সংগঠনের অনুমােদিত হতে হবে।
একীভূত নেতৃত্ব, জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযােগ ও প্রশাসন ব্যবস্থা সহজতর করার নীতির ভিত্তিতে পার্টির বিভিন্ন স্তরের কমিটিগুলাে প্রয়ােজনীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে বা নিজেদের প্রতিনিধি সংস্থা প্রেরণ করবে।
সাংগঠনিক শৃংখলা ভঙ্গ করলে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
পার্টি-সদস্য পার্টির শুংখলা লংঘন করলে পার্টির বিভিন্ন স্তরের সংগঠনের নিজেদের ক্ষমতার আওতাধীনে, বাস্তব অবস্থা অনুসারে পৃথক পৃথকভাবে শাস্তি দিতে হবে, সতর্ক করতে হবে, গুরুতরভাবে সতর্ক করতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে, পার্টির মাঝে যাচাই করে দেখতে হবে অথবা পার্টি থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
পার্টি-সদস্যকে পার্টির মাঝে রেখে যাচাই করার কাল খুব বেশী হলেও ছয় মাসের বেশী হতে পারে না, এই সময় তার ভােটদান, নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার থাকবে না।
পৃষ্ঠা: ৬১
পার্টি-সদস্যদের মধ্যে যারা উৎসাহ-উদ্দীপনাহীন এবং শিক্ষাদানের পরেও পরিবর্তিত হয় না তাদেরকে পার্টি থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেওয়া উচিত।
পার্টি-সদস্য পার্টি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে পার্টিশাখার অনুমােদনক্রমে তার নাম কেটে দিতে হবে এবং পরবর্তী উচ্চস্তরে পার্টি-কমিটির কাছে রেকর্ড রাখার জন্য রিপাের্ট পেশ করতে হবে।
প্রয়ােজন হলে ইহা সমগ্র সংগঠন ও জনসাধারণের নিকট জানাতে হবে।
অকাট্য প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ বিশ্বাসঘাতক, গুপ্তচর, একেবারে অনুশােচনাবিহীন পুঁজিবাদের পথগামী কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি, অধঃপতিত ব্যক্তি, শ্রেণীগতভাবে বৈরী ব্যক্তিদেরকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করতে হবে, এবং এদেরকে পার্টিতে পুনরায় যােগদান করতে অনুমতি দেওয়া হবে না।
কোষ ও পাঠচক্র পরিচালকের দায়িত্ব।
১. যিনি পাঠচক্র ও কোষ পরিচালনা করবেন তিনি পরিচালক নামে পরিচিত হবেন।
২. পরিচালক কোষ বা পাঠচক্রের নিকট ছদ্মনামে পরিচিত হবেন।
৩. পরিচালক কোষ বা পাঠচক্রের নিকট নিজের নাম, ঠিকানা, পেশা, সাংগঠনিক সম্পর্ক ও পরিচয় বা সংগঠনের অন্য কারাে পরিচয় বা সাংগঠনিক কার্যাবলী (অপ্রয়ােজনীয়ভাবে প্রকাশ করবেন না।
৪. পরিচালক পাঠচক্র ও কোষের সভায় অপ্রয়ােজনীয় কাউকে নিয়ে যাবেন না।
৫. তিনি অপ্রয়ােজনীয়ভাবে কোষ ও পাঠচক্রের সভার সময়, স্থান, তারিখ অন্য কারাে নিকট প্রকাশ করবেন না।
৬. পরিচালক অপ্রয়ােজনীয়ভাবে কোষ ও পাঠচক্র সদস্যদের নাম, ঠিকানা বা অন্য কোন পরিচয় কারাে নিকট প্রকাশ করবেন না বা এক কোষ, পাঠচক্রকে অন্য কোষ ও পাঠচক্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন না।
৭. তিনি পাঠচক্র ও কোষ এমনভাবে পরিচালনা করবেন যাতে এককোষ বা পাঠচক্র সদস্য অন্য কোষ বা পাঠচক্র সদস্যদের চিনতে সক্ষম না হয়।
৮. পরিচালক পাঠচক্রের নিজ পরিচালনাধীন অগ্রসর ব্যক্তি যারা সংগঠনের প্রার্থী সদস্য হওয়ার যােগ্য তাদের দ্বারা নির্দিষ্ট কমিটিতে কোষ সদস্য পদের জন্য আবেদন করাবেন। আবেদনপত্র কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত হলে তিনি আবেদনকারীদের নিয়ে। কোষ গঠন করবেন।
প্রার্থী সদস্যদের মাঝে যারা যথাযথভাবে প্রার্থী সদস্যপদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং কমপক্ষে তিনমাস প্রার্থী সদস্য ছিলেন, তাদেরকে সদস্যপদ প্রদানের জন্য উপরস্থ কমিটির নিকট সুপারিশ করবেন।
উপরস্থ কমিটি কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ প্রদত্ত হলে তিনি তা নির্দিষ্ট কর্মীদের জানিয়ে দেবেন।
৯. পরিচালক তার পরিচালনাধীন কোষ বা পাঠচক্র সদস্যদের সাথে গণতান্ত্রিক আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত করবেন।
১০. পরিচালক নেতার মাধ্যমে কোষ বা পাঠচক্র সদস্যদের সভা আহ্বান করবেন।
১১. প্রয়ােজনবোধে তিনি নিজে কোষ বা পাঠচক্রের সভা আহ্বান করবেন।
পৃষ্ঠা: ৬২
১২. প্রতি সভা শেষে পাঠচক্র ও কোষের কার্যাবলীর লিখিত রিপাের্ট তৈরী করে তা সংশ্লিষ্ট কমিটিতে নিয়মিত পেশ করবেন।
১৩. কোষের যে সকল সদস্য নিজে পাঠচক্র পরিচালনা করবেন তার কার্যাবলীর রিপাের্ট নিজ কোষের সভায় পেশ করবেন।
১৪. পরিচালক কোষ বা পাঠচক্রকে সংখ্যাভিত্তিক নামকরণ করবেন।
১৫. পরিচালক তার অধীন কোষ, পাঠচক্র এবং সহানুভূতিশীলদের নিকট থেকে নিয়মিত ফি ও চাঁদা সংগ্রহ করবেন।
১৬. পরিচালক তার অধীন কোষের নিকট সাংগঠনিক নির্দেশাবলী অতি দ্রুত পৌঁছে দেবেন এবং তা সভায় পুংখানুপুংখভাবে আলােচনার জন্য পেশ করবেন, যাতে সবাই এর তাৎপর্য বুঝতে পারেন এবং তা বাস্তবায়নের পন্থা নির্ণয় করতে পারেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন।
১৭. কোন কোষ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে তা নির্দিষ্ট স্তরের কমিটির মাধ্যমে করতে হবে।
১৮. কোষকে পুনর্গঠিত করলে তা কমিটির অনুমতি নিয়ে করতে হবে এবং পুনর্গঠিত করার পর কমিটিকে জানাতে হবে।
১৯. পরিচালক নিজের অবর্তমানে যিনি কোষ ও পাঠচক্র সমূহকে পরিচালনা করবেন তার নাম, ঠিকানা কোষ ও পাঠচক্রের কাছে দেবেন এবং উচ্চতর কমিটিকে জানাবেন।
২০. পরিচালক কোন প্রশ্নে বা বিষয়ে কোষ বা পাঠচক্রকে বুঝাতে অক্ষম হলে উচ্চতর স্তর থেকে জেনে নিয়ে বা অধ্যয়ন করে বুঝাবেন। কিন্তু অপ্রয়ােজনীয়ভাবে উচ্চতর স্তরের কর্মীদের পাঠচক্রের সভায় নিয়ে আসবেন না।
২১. পরিচালক কোষ সদস্যদের এমনভাবে শিক্ষিত করবেন যাতে তারা প্রত্যেকে পাঠচক্র পরিচালনা করতে পারেন।
২২. পরিচালক তার পরিচালনাধীন কোষ ও পাঠচক্রের সমালােচনা, আত্মসমালােচনা, প্রস্তাব উচ্চস্তরে যথারীতি পাঠিয়ে দেবেন।
২৩. পরিচালক পাঠচক্র ভেঙ্গে দিতে চাইলে বা কোন পাঠচক্র সদস্যকে বাতিল করতে চাইলে উচ্চস্তরের অনুমতি লাগবে।
পৃষ্ঠা: ৬৩
নেতৃত্বের পদ্ধতি
(রচনাটি প্রণীত ও প্রথম প্রকাশিত হয় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন-এর সময়-সম্ভবতঃ ১৯৭০ সালে। পরে কিছুটা সংশােধিত আকারে এটি অন্তর্ভুক্ত হয় আগস্ট ‘৭৪-এ প্রকাশিত কমরেড সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলীর সংকলনে প্রকাশক।]
১. যে কোন কাজই করি না কেন আমরা দুটো বিষয় সর্বদাই প্রয়ােগ করবাে। একটি হলাে সাধারণের বিশেষের সাথে সংযােগ; অন্যটি হলাে নেতৃত্বের জনসাধারণের সাথে সংযােগ।
২. সাধারণ ও সর্বব্যাপী আহ্বান না জানালে একটি কর্তব্য সম্পাদন করার জন্য ব্যাপক জনসাধারণকে সমাবেশ করা যায় না। কিন্তু যদি নেতৃস্থানীয় কর্মীরা কেবলমাত্র সাধারণ আহ্বানে সীমাবদ্ধ থাকেন, যে কাজের জন্য আহ্বান করা হয়েছে যদি তারা বাস্তবভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে কিছু সংখ্যক সংগঠনে তা গুরুত্বের সাথে কার্যকরী না করেন, একটা নির্দিষ্ট বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশ না করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন না করেন এবং সে অভিজ্ঞতাকে অন্যান্য ইউনিটগুলাে পরিচালনা করতে প্রয়ােগ না করেন, তাহলে নিজের ডাকা সাধারণ আহ্বান নির্ভুল কিনা তা পরীক্ষা করার উপায় থাকে না এবং সাধারণ আহ্বানের বিষয়বস্তুকেও পরিপূর্ণ করার উপায় থাকে না। এর ফলে এই সাধারণ আহ্বানের শূন্যে হারিয়ে যাওয়ার বিপদ রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ-ঢাকা জেলা কমিটি সাধারণ আহ্বান জানিয়েছে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা এবং বিপ্লবী দেশপ্রেমিকরা পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি বাহিনীর গেরিলা ও মিলিশিয়া দলে যােগ দিন এবং জাতীয় শত্রু ও তাদের দালালদের উপর হামলা করুন।
ঢাকা জেলা নেতৃত্ব এই সাধারণ আহ্বানের ভিত্তিতে কয়েকটি গেরিলা ও মিলিশিয়া ইউনিট গঠন করবেন। এই সকল ইউনিটের কিছু সংখ্যক প্রতিনিধিদের সামরিক বিকাশের প্রক্রিয়া (অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক, মতাদর্শগত মান, সামরিক শিক্ষা গ্রহণ ও তা প্রয়ােগে উৎসাহ, পড়াশুনা, কাজের শক্তিশালী ও দুর্বল দিক) সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীর অনুসন্ধান করতে হবে। অধিকন্তু এ সকল ইউনিটের দায়িত্বে যে সকল কমরেড রয়েছেন তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করতে হবে এবং এ সকল ইউনিটে যে বাস্তব সমস্যা দেখা দিবে তার সমাধান দিতে হবে। সকল সংগঠন, স্কুল বা সামরিক বাহিনীর সংগঠন এভাবে কাজ করবেন, এর কারণ তাদের অধীনস্থ অনেক ইউনিট রয়েছে। অধিকন্তু এটাই হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি যার মাধ্যমে নেতারা নেতৃত্ব প্রদানের সাথে শিক্ষাকে সংযােগ করতে পারেন। নেতৃস্থানীয় কেউই সাধারণ পরিচালনার আহ্বান দিতে পারবেন না যদি তারা নিম্নস্তরের বিশেষ ইউনিটের, বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন না করেন। এ পদ্ধতি সকল স্তরে প্রয়ােগ করতে হবে যাতে নেতৃস্থানীয় কর্মীরা ইহা প্রয়ােগ করতে শেখেন।
পৃষ্ঠা: ৬৪
৩. যে কোন স্থানের জনসাধারণই সাধারণতঃ তিনভাগে বিভক্ত-অপেক্ষাকৃত সক্রিয়, মধ্যবর্তী, পশ্চাদপদ। তাই পরিচালক এই অল্প সংখ্যক সক্রিয় ব্যক্তিদেরকে নিজের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করতে নিপুণ হবেন। এই নেতৃত্ব গ্রুপের উপর নির্ভর করে মধ্যবর্তী ব্যক্তিদেরকে উন্নত করতে হবে, পশ্চাদপদ ব্যক্তিদেরকে তাদের পক্ষে টেনে আনতে হবে।
যদি শুধুমাত্র নেতৃত্ব গ্রুপে সক্রিয়তা থাকে, তা ব্যাপক জনসাধারণের সক্রিয়তার সাথে যুক্ত না হয় তাহলে সক্রিয়তা হয়ে উঠবে অল্পসংখ্যক লােকের নিস্ফল প্রয়াস। পক্ষান্তরে যদি শুধু ব্যাপক জনসাধারণের সক্রিয়তা থাকে এবং এই সক্রিয়তাকে যথাযথভাবে সংগঠিত করার জন্য যদি একটি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গ্রুপ না থাকে তাহলে জনসাধারণের সক্রিয়তা বেশীদিন টিকে থাকতে পারে না, সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে না এবং উচ্চস্তরে উন্নীত হতে পারে না।
একটি নেতৃত্ব গ্রুপ যা জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংযুক্ত, কেবলমাত্র গড়ে উঠতে পারে গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, এর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়।
একটি সংগ্রামের প্রক্রিয়ার প্রথম, মধ্যবর্তী ও চূড়ান্ত পর্যায়ে নেতৃত্ব গ্রুপের গঠনপ্রকৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকে না বা থাকতে পারে না; যে সকল কর্মীরা সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসছে তাদেরকে প্রতিনিয়ত প্রমােশন দিয়ে ঐ সকল পুরােনাে সদস্য যারা তুলনামূলকভাবে নিকৃষ্ট অথবা অধঃপতিত হয়েছে, তাদের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। অনেক স্থানে সাংগঠনিক ও অন্যান্য কাজ সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না তার একটি মৌলিক কারণ হলাে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ ও সংযুক্ত এবং স্বাস্থ্যকর একটি নেতৃত্ব গ্রুপের অভাব।
একশত লােকের একটি স্কুল অবশ্যই ভালাে চলবে না যদি বাস্তব অবস্থার সাথে সংগতি রেখে (কৃত্রিমভাবে একত্রিত নয়) কিছু সংখ্যক লােকের নেতৃত্ব গ্রুপ বা শিক্ষক, অন্যান্য কর্মচারী ও ছাত্রদের মাঝে সবচেয়ে বেশী সক্রিয়, উদ্যমী এবং সজাগ লােকদের নিয়ে গঠিত নেতৃত্ব গ্রুপ না থাকে।
বড় হােক, ছােট হােক প্রতিটি সংগঠন, স্কুল, সামরিক ইউনিট, ফ্যাক্টরী অথবা গ্রামে আমরা পার্টির বলশেভিকীকরণ সম্পর্কিত স্ট্যালিনের বারটি শর্তের মধ্যে নবম শর্ত অর্থাৎ নেতৃত্ব গ্রুপ প্রতিষ্ঠার বিষয় প্রয়ােগ করবাে। এই নেতৃত্ব গ্রুপের চারটি মাপকাঠি থাকবে যা ডিমিট্রভ কেডার সম্পর্কিত নীতিতে আলােচনা করেছেন-উদ্দেশ্যের প্রতি সম্পূর্ণ উৎসর্গিত, জনগণের সাথে সংযুক্ত, স্বাধীনভাবে সমস্যা সমাধানে সক্ষম এবং যথাযথভাবে শৃংখলা পালন করেন।
যুদ্ধ, উৎপাদন, শিক্ষা, শুদ্ধিকরণ অথবা কাজ তদারক করা, কেডারদের ইতিহাস পর্যালােচনা করা প্রভৃতি কেন্দ্রীয় কাজ অথবা অন্য কোন কাজ করি না কেন, সাধারণ আহ্বানের সাথে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সংযােগ ছাড়াও প্রয়ােজন নেতৃত্বের জনসাধারণের সাথে সংযােগ।
৪. আমাদের পার্টির সমস্ত বাস্তব কাজ-কর্মে নির্ভুল নেতৃত্ব অপরিহার্যভাবেই হচ্ছে জনসাধারণ থেকে আসা এবং জনসাধারণের মধ্যে যাওয়া। এর অর্থ হচ্ছে জনসাধারণের মতামত (ইতস্ততঃ ছড়ানাে ও অব্যবস্থিত) সংগ্রহ করে কেন্দ্রীভূত করা (গবেষণার মাধ্যমে তাদের কেন্দ্রীভূত ও সুব্যবস্থিত মতে রূপান্তরিত করা), তারপর তা জনসাধারণের কাছে গিয়ে প্রচার করা, এই মত জনসাধারণের নিজস্ব মতে পরিণত করা,
পৃষ্ঠা: ৬৫
যাতে জনসাধারণ এই মত কার্যকরী করেন এবং এইভাবে জনসাধারণের কাজের ভিতর দিয়েই এই মত ভুল কি নির্ভুল তা যাচাই করে নেওয়া। পুনর্বার জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ করা এবং জনসাধারণের কাছে গিয়ে তা কার্যকরী করা।
এমনি চলে বারবার, চলে সমাপ্তিহীন ঘূর্ণাবর্ত, ফলে প্রতিবারই এই মত হয়ে ওঠে। আরাে বেশী নির্ভুল, আরাে বেশী প্রাণবন্ত, আরাে বেশী সমৃদ্ধ। এই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব।
৫. একটি সংগঠনে বা সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রুপের সাথে জনসাধারণের সঠিক সম্পর্ক বিষয়ক সঠিক ধারণা, নেতৃত্বের সঠিক ধারণা (Ideas) কেবলমাত্র “জনসাধারণ থেকে আসা এবং জনসাধারণের নিকট নিয়ে যাওয়া থেকে আসতে পারে এ ধারণা। (Concept); নেতৃত্বের ধারণাকে (Ideas) অনুশীলনে প্রয়ােগ করার কালে সাধারণ আহ্বানকে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সাথে অবশ্যই সংযুক্ত করার ধারণা। (Concept)-প্রভৃতি ধারণাসমূহ (Concept) প্রতিনিয়ত সর্বস্তরে প্রচার করতে হবে, যাতে আমাদের কর্মীদের এগুলাে সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর হয়। অনেক কমরেড এর গুরুত্ব বুঝেন না বা ভালাে মতাে পারেন না সক্রিয় কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি নেতৃত্ব। গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে, তারা গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না বা ভালমত পারেন না এই নেতৃত্ব গ্রুপকে জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করতে। এ কারণে তাদের নেতৃত্ব হয় আমলাতান্ত্রিক এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন।
বহু কমরেড বুঝেন না বা ভালমত পারেন না গণসংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে। কিন্তু নিজেদেরকে অতিবুদ্ধিমান ভেবে তারা আত্মগত মতামত পেশ করতে ভালবাসেন। এ কারণে তাদের মতামত হয় ফাকা এবং অবাস্তব।
অনেক কমরেড একটি কাজ সম্পর্কে সাধারণ আহ্বান দিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন কিন্তু গুরুত্ব বুঝেন না বা ভালমত পারেন না এই সাধারণ আহ্বানের সাথে নির্দিষ্ট ও বিশেষ পরিচালনার লাইন দিতে। এ কারণে তাদের আহ্বান রয়ে যায় মুখে মুখে অথবা কাগজে বা সভাকক্ষে এবং এ কারণে তাদের নেতৃত্ব হয়ে পড়ে আমলাতান্ত্রিক।
বর্তমান পর্যায়ে আমরা আমাদের শিক্ষায়, কাজ তদারকিতে এবং অন্যান্য সকল কাজে এ সকল ত্রুটি শুধরে নেব এবং নেতৃতুকে জনসাধারণের সাথে সংযুক্ত করা ও সাধারণকে বিশেষের সাথে সংযুক্ত করার পদ্ধতি শিখে নেবাে।
৬. জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ করা এবং তা কেন্দ্রীভূত করা, আবার তা জনসাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়া ও তা কার্যকরী করতে লেগে থাকা যাতে করে নেতৃত্বের নির্ভুল লাইন গড়ে উঠে। এটাই হচ্ছে নেতৃত্বের মৌলিক পদ্ধতি। জনসাধারণের মতামত কেন্দ্রীভূত করা ও তা কার্যকরী করার প্রাক্কালে প্রয়ােজন সাধারণ আহ্বানকে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সাথে সংযােগ করা এবং এটাই হলাে নেতৃত্বের মৌলিক পদ্ধতির একটি উপাদান।
থকে সাধারণ মতামত (সাধারণ আহ্বান) তৈরী করা এবং তা বিভিন্ন ইউনিটে পরীক্ষার নিমিত্ত প্রয়ােগ করা (শুধু যে একজন নিজে করবে তা নয় অন্যকেও করতে বলবে), তারপর নতুন অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্রীভূত করা (সারসংকলনের মাধ্যমে) এবং জনসাধারণকে সাধারণভাবে পরিচালনার জন্য নতুন নির্দেশাবলী প্রদান করা। কমরেডরা প্রতিটি কাজে ইহা প্রয়ােগ করবেন। ভাল নেতৃত্ব অধিকতর নিপুণতার সাথে গড়ে উঠে এ পদ্ধতি কার্যকরী করার মাধ্যমে।
পৃষ্ঠা: ৬৬
৭. কোন অধীনস্থ ইউনিটে কোন প্রকার কাজ (বিপ্লবী যুদ্ধ, উৎপাদন অথবা শিক্ষা, শুদ্ধি আন্দোলন, কাজ তদারক করা অথবা কেডারদের ইতিহাস অনুসন্ধান, প্রচার, সাংগঠনিক কাজ, গােয়েন্দা বিরােধী তৎপরতা বা অন্য কাজ) প্রদানের সময় উপরস্থ সংগঠন এবং এর সংস্থাসমূহ সকল ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট নিম্নস্তরের সংগঠনের নেতার মাধ্যমে যাবেন যাতে নেতা দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। এভাবে শ্রম বিভাগ ও ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব অর্জন করা যায়। উচ্চস্তরের একটি বিভাগ (উদাহরণ স্বরূপ-সংগঠন, প্রচার অথবা গােয়েন্দাবিরােধী উচ্চস্তরের বিভাগসমূহ) নিম্নস্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিকটই যাবেন না। নিম্নস্তরের সামগ্রিক দায়িত্বে যিনি রয়েছেন (যেমন, সম্পাদক, সভাপতি, পরিচালক বা স্কুল প্রধান) তাকে না জানিয়ে বা তাকে বাদ দিয়ে শুধু নিম্নস্তরে একই বিভাগের কর্মকর্তার নিকট যাবেন না। সামগ্রিক দায়িত্ব ও বিশেষ দায়িত্ব সম্পন্ন উভয় ব্যক্তির নিকট যেতে হবে এবং দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের সাথে শ্রম বিভাগের সংযােগের এই কেন্দ্রীভূত পদ্ধতি সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন। কমরেডদের মাধ্যমে সম্ভব হবে। একটি বিশেষ কাজ করার জন্য ব্যাপক সংখ্যক কর্মীর, এমনকি সংগঠনের সকল কর্মীর সমাবেশ এবং এভাবে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীর স্বল্পতা অতিক্রম করা যায় এবং বেশ কিছু সংখ্যক লােককে হাতের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সক্রিয় করা যায়। ইহাও হচ্ছে নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে সংযুক্ত করার উপায়।
উদাহরণ স্বরূপ, কেডারদের ইতিহাস অনুসন্ধানের বিষয় ধরা যাক। যদি কাজটি বিচ্ছিন্নভাবে করা হয়, এ কাজের দায়িত্বে সংগঠনের যে বিভাগ রয়েছে তার অল্প সংখ্যক কর্মীরাই যদি ইহা করে, তবে অবশ্যই কাজটি ভালভাবে সম্পন্ন করা যায় না। কিন্তু কাজটি যদি একটি বিশেষ সাংগঠনিক স্তরের বা স্কুলের প্রধান প্রশাসকের মাধ্যমে করা হয় তবে তিনি উক্ত কাজের জন্য অনেক বা প্রায় সকল ছাত্রদের সমাবেশিত করতে পারেন, একই সাথে উচ্চস্তরের নির্দিষ্ট বিভাগের নেতৃস্থানীয় কর্মীরা সঠিক পরিচালনার নির্দেশ অধিকতর সুচারুরূপে প্রদান করতে পারেন। এভাবে নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে সংযােগের মাধ্যমে কেডার ইতিহাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব আরাে সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন করা যায়।
৮. যে কোন অঞ্চলে অনেকগুলাে কেন্দ্রীয় কাজ থাকতে পারে না, একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেবলমাত্র একটা কেন্দ্রীয় কাজ থাকতে পারে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের কাজ পরিপূরক হিসেবে থাকতে পারে। তাই একটা অঞ্চলের সামগ্রিক দায়িত্ব সম্পন্ন কমরেড অবশ্যই সেখানকার সংগ্রামের ইতিহাস, সংগ্রামের সমগ্র অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন কাজকে উপযুক্ত স্থানে সাজিয়ে রাখবে, নিজে কোন পরিকল্পনা তৈরী না করে শুধু উচ্চস্তরের নির্দেশানুসারে এক একটা কাজ করা উচিত নয়, এমনি করলে অসংখ্য কেন্দ্রীয় কাজ এলােমেলাে বিশৃংখলার সৃষ্টি করবে। উচ্চস্তরের সংস্থার পক্ষেও কাজের হাল্কা ও গুরু এবং মন্থর ও জরুরী প্রভৃতি নির্বিশেষে কোনটা কেন্দ্রীয় কাজ তার উল্লেখ না করে নিম্নস্তরের সংস্থাকে একই সময় অনেক কাজ করতে নির্দেশ প্রদান করা উচিত নয়। এমনি করলে নিম্নস্তরের কাজের বিন্যাস এলােমেলাে হবে এবং নির্ধারিত ফলও পাওয়া যাবে না।
প্রতিটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পারিপার্শ্বিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানুসারে সমগ্র পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে প্রতিটি বিশেষ সময়ের জন্য কাজের ভারকেন্দ্র ও কাজের ক্রম সঠিকভাবে স্থির করা এবং তা অবিচলিতভাবে পালন করা যাতে করে নির্দিষ্ট
পৃষ্ঠা: ৬৭
ফলার্জন নিশ্চিত হয়। এটাই হচ্ছে নেতৃত্বের অন্যতম কৌশল। ইহাও নেতৃত্বের পদ্ধতির একটি সমস্যা এবং নেতৃত্বকে জনসাধারণের এবং সাধারণকে বিশেষের সাথে সংযযাগের নীতিমালা প্রয়ােগের সময় যত্ন সহকারে সমাধান করতে হবে।
৯. নেতৃত্বের পদ্ধতি বিষয়ক বিশদ আলােচনা এখানে করা হয়নি। আশা করা হচ্ছে। সকল স্থানের কর্মীরা এ সকল নীতির ভিত্তিতে নিজেরা কঠোরভাবে চিন্তা করবেন এবং নিজেদের সৃজনশীলতাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাবেন। সংগ্রাম যত তীব্র হবে, কমিউনিস্টদের জন্য ততই প্রয়ােজন হবে ব্যাপক জনতার প্রয়ােজনের সাথে নেতৃত্বকে সংযােগ করা এবং সাধারণ আহ্বানকে বিশেষ পরিচালনার লাইনের সাথে সংযােগ করার মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক ও আত্মগত নেতৃত্বের পদ্ধতিকে চূর্ণবিচূর্ণ করা।
আমাদের সংগঠনের সকল নেতৃস্থানীয় কর্মীরা সকল সময় অবশ্যই মার্কসবাদী নেতৃত্বের পদ্ধতি দ্বারা আত্মগত আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের পদ্ধতিকে বিরােধিতা করবেন এবং প্রথমটাকে পরেরটি দ্বারা অতিক্রম করবেন। আত্মগতবাদীরা ও আমলাতান্ত্রিকেরা নেতৃত্বকে জনসাধারণের সাথে এবং সাধারণকে বিশেষের সাথে সংযােগের নীতিকে বুঝে না; তারা পার্টির কাজকে ব্যাহত করে। আত্মগত ও আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের পদ্ধতিকে দূর করার জন্য আমরা সর্বদাই মার্কসবাদী নেতৃত্বের পদ্ধতি ব্যাপকভাবে এবং গুরুত্ব সহকারে সর্বস্তরে প্রবর্তন করবাে।
[সভাপতি মাও-এর নেতৃত্বের পদ্ধতি সম্পর্কে কতিপয় প্রশ্ন”র ভিত্তিতে রচিত]
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত পরিচালনায় গণতান্ত্রিক জীবন সুনিশ্চিত করার লাইন১
১. পার্টির নেতৃস্থানীয় সংস্থায় নির্ভুল পরিচালনার লাইন থাকতে হবে, যাতে করে নিজেদেরকে নেতৃত্বের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
২. উচ্চতর সংস্থাকে নিম্নতর সংস্থার অবস্থা ও জনসাধারণের জীবনের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে যাতে করে সঠিক পরিচালনার বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে।
৩. পার্টির সকল স্তরের সংস্থারই বিবেচনাহীনভাবে সমস্যার সমাধান করা উচিত নয়। একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, অবশ্যই তা দৃঢ়তার সাথে পালন করতে হবে।
৪. উচ্চতর সংস্থার যে সব সিদ্ধান্ত কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ, তা অবশ্যই নিম্নতর সংস্থায় এবং পার্টি সদস্য সাধারণের কাছে দ্রুত পৌঁছে দিতে হবে। তার পদ্ধতি হলাে সক্রিয় কর্মীদের সভা অথবা পার্টি শাখার সভা করতে হবে, সে সকল সভায় রিপাের্ট প্রদানের জন্য লােক পাঠাতে হবে।
৫. পার্টির নিম্নতর সংস্থাগুলােকে ও পার্টিসদস্য সাধারণকে উচ্চতর সংস্থার নির্দেশাদির পুংখানুপুংখরূপে আলােচনা করতে হবে, যাতে করে এর তাৎপর্য তারা পুরােপুরি উপলব্ধি করতে পারেন এবং তা পালন করার পদ্ধতি স্থির করতে পারেন।
[সভাপতি মাও সেতুঙ-এর পাঁচটি প্রবন্ধ। পৃঃ ৪১-৪৩]
…………………………………………………………………….
১. পয়েন্টগুলাে মাও সেতুঙ-এর পাঁচটি প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কমরেড সিরাজ সিকদার নেতৃত্বের পদ্ধতি” শীর্ষক নিবন্ধের শেষে এ পয়েন্টগুলি যুক্ত করেছিলেন প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৬৮
পূর্বোক্ত সাধারণ নিয়মাবলী ব্যতীতও সম্পাদক বা নেতা নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ পালন করবেন
১. প্রতিটি সাংগঠনিক এককের একজন সম্পাদক বা নেতা থাকবেন।
২. সম্পাদক বা নেতা নির্দিষ্ট ইউনিটের সদস্যদের গণতান্ত্রিক পরামর্শের ভিত্তিতে উচ্চস্তরের অনুমােদনসহ নির্বাচিত হবেন।
৩. সম্পাদক বা নেতা অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বা নেতা সভা আহ্বান করবেন। সংখ্যাগুরু দাবী করলে সম্পাদক বা নেতা সভা আহ্বান করতে বাধ্য থাকবেন।
৪. নির্দিষ্ট সাংগঠনিক এককের সংখ্যাগুরু সদস্যগণ সম্পাদক বা নেতার অপসারণ চাইলে উচ্চতর স্তরের নিকট জানাবেন। উচ্চতর স্তর সম্পাদক বা নেতাকে অপসারণ করে নতুন সম্পাদক বা নেতা নির্বাচিত করে দেবেন।
৫. উচ্চস্তর নিম্নতর স্তরের সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতাকে পরিবর্তন, বদলী, অপসারণ করতে পারেন।
৬. প্রতিটি সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতা কাজের রিপাের্ট নির্দিষ্ট সময় অন্তর উচ্চস্তরে ও উক্ত এককের কর্মীদের জানাবে (কোষের জন্য সাতদিন অন্তর, জিলা কমিটির জন্য একমাস অন্তর)।
৭. প্রতিটি সাংগঠনিক একক উচ্চতর স্তরের নির্দেশাবলী পালন, নিজেদের কার্যাবলী পর্যালােচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদির জন্য নিয়মিত সভা আহ্বান করবে (কোষের জন্য একবার সাত দিনে)।
৮. সম্পাদক বা নেতা কোন বিষয় অজ্ঞ থাকলে সদস্যদের জিজ্ঞেস করবেন। তার সম্মতি বা আপত্তি অবিবেচিতভাবে ব্যক্ত করবেন না। সদস্যদের মতামত শুনতে তাকে নিপুণ হতে হবে, তাকে শিক্ষক হওয়ার পূর্বে ছাত্র হতে হবে। আদেশ জারী করার পূর্বে সদস্যদের কাছ থেকে শিখতে হবে।
কাজের মধ্যে কোটা প্রধান, কোটা গৌণ তা বের করতে হবে এবং প্রধান কাজ সম্পন্ন করার জন্য অনুরূপ কাজ নির্ণয় করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করতে হবে।
৯. সমস্যার পরিমাণগত হিসেব রাখতে হবে। কোনটা কখন সম্পন্ন করতে হবে তাও গুছিয়ে রাখতে হবে।
১০. সাংগঠনিক এককের সম্পাদক বা নেতা সদস্যদের দায়িত্ব দেবেন এবং সময়মত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করবেন।
১১. সম্পাদক বা নেতা সংগঠনে গণতান্ত্রিক জীবন সুনিশ্চিত করবেন।
১২. সম্পাদক বা নেতা সদস্যদের সাথে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবহার করবেন না।
১৩. সম্পাদক বা নেতা সদস্যদের কথা শুনবেন। এ বিষয়ে নিম্ন মনােভাব থাকবেঃ
(ক) যা জানেন বলুন, যদি বলেন সবটাই বলুন।
(খ) বক্তাকে দোষ দেবেন না, তার কথাকে সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণ করুন। ১৪. নেতা বা সম্পাদক সদস্যদের কাজের বিবেচনার সময় বাস্তবভিত্তিক হবেন এবং সাফল্য প্রধান না ভুল প্রধান তা নির্ণয় করবেন।
১৫. নেতা বা সম্পাদক অহংকার করবেন না, বিনয়ের সাথে ব্যবহার করবেন।
পৃষ্ঠা: ৬৯
১৬. নেতা বা সম্পাদক সদস্যদের মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক শিক্ষা দেবেন।
১৭. ভিন্নমত পােষণকারী সদস্যদের সাথে কাজ করতে সম্পাদক বা নেতা নিপুণ হবেন।
নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যসূচী
– বর্তমানে আমাদের সংগঠনে প্রথম প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব, দ্বিতীয় প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব, তৃতীয় প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব।
– যােগ্য নেতৃত্বের সমস্যা মূলতঃ মতাদর্শগত পুনর্গঠনের সমস্যা।
– আমাদেরকে উন্নত নেতৃত্ব সম্পর্কিত মার্কসবাদী পদ্ধতি প্রয়ােগ করে উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট নেতৃত্বস্বল্পতা দূর করতে হবে; নেতৃত্বের কলাকৌশল কর্মীদের বিশেষ করে সম্ভাবনাময়দের শেখাতে হবে। নেতৃত্ব সম্পর্কিত দলিলাদি পাঠ ও প্রয়ােগ করতে হবে। এভাবে নেতৃত্বের সংকট দূর করতে হবে।
– এ কারণে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের সময় নেতৃত্বসংকট সমাধানের পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।
০ সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি প্রবন্ধঃ
– পার্টির ভিতরকার ভুল চিন্তাধারা সংশােধন করা প্রসঙ্গে।
– উদারতাবাদ বিরােধিতা।
০ উদ্ধৃতিঃ
– পার্টি-কমিটির নেতৃত্ব।
– জনসাধারণের লাইন।
– কেডার।
– চিন্তাধারার পদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি।
– অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা।
– সমালােচনা-আত্মসমালােচনা।
– জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের মীমাংসা।
০ কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠন ও স্ট্যালিন, কাগানােভিচ, দিমিত্রভ, মাওসেতুঙ।
০ লাল ঝাণ্ডাঃ
বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা।
সাংগঠনিক কার্যপ্রসঙ্গে দলিলঃ
০ নেতৃত্বের পদ্ধতি এবং অন্যান্য প্রবন্ধ।
০ মতাদর্শগত পুনর্গঠন সংক্রান্ত কতিপয় রচনা।
০ ইশতেহারসমূহ (কেন্দ্রীয় কমিটি ও ব্যুরাে)।
পৃষ্ঠা: ৭০
০ ইহা ব্যতীত সাংগঠনিক কাজের উপর প্রকাশিত অন্যান্য দলিলঃ
– সমালােচনা-আত্মসমালােচনা সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট।
– একটি কাজ করার উপায়। ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়াদের সাথে আলােচনার পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক উপায়ে কথা বলার পদ্ধতি।
– নেতৃত্বের কতিপয় গাইড।
– সাংগঠনিক কাজের উপর কতিপয় গাইড।
– কর্মীস্বল্পতা ও তা সমাধানের কতিপয় উপায়।
পৃষ্ঠা: ৭১
নিরাপত্তা সংক্রান্ত
[ আগস্ট ‘৭৪-এ প্রকাশিত ক. সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলীর সংকলনে রচনাটি অন্তর্ভুক্ত হয় প্রকাশক।]
কোন কমরেড গ্রেফতার হলে
নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
– ঐ কমরেডের পরিচালনাধীন ও তার সাথে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা।
– ঐ কমরেডের বাসস্থান এবং সে যে সকল স্থান চেনে এমন সব স্থান থেকে দলিলপত্র, অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান ও নিরাপত্তার সাথে যুক্ত দ্রব্য অন্যত্র সরানাে।
– তার পরিচিত স্থানে বসবাসকারী কমরেডগণ অন্যত্র সরে যাবেন।
– গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে দ্রুত উচ্চস্তরে রিপাের্ট করা।
– প্রথমেই গ্রেফতার সম্পর্কে প্রচার না করা।
কোন কমরেড গ্রেফতার হলে কি কি করবেন
– তার সাথে কাগজপত্র, দলিলাদি ও অস্ত্রাদি নষ্ট করবেন।
– কোন প্রকারেই পার্টি বা সংশ্লিষ্ট ঘটনার সাথে জড়িত থাকা, প্রমাণ সম্ভব হবে না এরূপ অবস্থা থাকলে, অস্বীকার করা।
– সংগঠন, কমরেড সম্পর্কে বা অন্য কোন তথ্য প্রকাশ না করা।
– অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পার্টি বা ঘটনার সাথে যুক্ত ইহা স্বীকার করলেও ভালভাবে অবস্থা পর্যালােচনা করে স্বীকার করা।
নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার (কোর্ট, আইন, আদালত, ঘুষ) সুযােগ গ্রহণ করা।
– রাজসাক্ষী হওয়া, স্বীকারােক্তি করা, বন্ড দেওয়া থেকে বিরত থাকা।
পৃষ্ঠা: ৭২
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত কর্মীদের শিক্ষার পদ্ধতি
(সম্ভবতঃ ১৯৭০ সাল)
১. পূর্ব বাংলার সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ শিক্ষা দেওয়া এবং বিপ্লবের শত্রু ও মিত্র এবং নেতা নির্ণয় করে দেওয়া।
তাদের নিজেদের শ্ৰেণীও নির্ণয় করে দেওয়া। এ পর্যায়ে শ্রেণী বিশ্লেষণ বিষয়ক দলিলাদি পড়াতে হবে।
২. মতাদর্শ ক্ষেত্রেঃ
(ক) ব্যক্তিস্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে সর্বহারার মতাদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা (যা জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত) দ্বারা সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করা। এ পর্যায়ে সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি প্রবন্ধের তিনটি প্রবন্ধ সর্বদা পড়ানাে এবং তা প্রয়ােগ করতে উৎসাহিত করানাে।
(খ) ক্ষুদে বুর্জোয়া ও সর্বহারা মতাদর্শের চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে, সামরিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকাশ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যাতে করে কর্মীরা এ সকল ক্ষেত্রে সর্বহারার শ্রেণী লাইন ও বুর্জোয়া লাইন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করেন।
এ পর্যায়ে পাঁচটি প্রবন্ধ’, ‘গণযুদ্ধ’, ‘উদ্ধৃতি’, ‘দর্শনের ওপর চারটি প্রবন্ধ (Four Eassays on Philosophy) পড়াতে হবে।
৩. শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত করানাে।
শ্রমিক-কৃষকের সাথে প্রতিনিয়ত একীভূত করানাে, তাদের দুঃখ-কষ্ট ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থার পুংখানুপুংখ তদন্ত করতে শেখানাে। তাদের নিয়ে অভিযােগসভা করানাে। এর ফলে কর্মীদের সর্বহারা ও গরীব জনগণের প্রতি মমত্ববােধ জাগবে এবং নিজেদের শ্রেণী চেতনাবােধ উন্নত হবে এবং তাদের সর্বহারাকরণ ত্বরান্বিত হবে।
– ক্ষুদে বুর্জোয়া জনগণকে পার্টির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে নিপুণ হন।
– পার্টি অভ্যন্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের সাথে সর্বহারার মতাদর্শ ও তার প্রকাশের স্পষ্ট ও কাঠোর পার্থক্য-রেখা টানুন।
– পার্টি অভ্যন্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম জোরদার করুন।
– ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিজয় অর্জন করুন।
পৃষ্ঠা: ৭৩
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে
[“পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন”-এর সময়কালে মতাদর্শগত পুনর্গঠন সংক্রান্ত কয়েকটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। এগুলাের সবগুলাে বা কয়েকটি তখন সাইক্লো করা তাত্ত্বিক পত্রিকা “লাল ঝাণ্ডা”য় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘৭২ সালে দু’একটি ছােটখাট সংশােধন করে এগুলাে একত্রে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়। এ পুস্তিকার নাম ছিল “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্ৰেণীউদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে”। সেই পুস্তকের প্রারম্ভিক বক্তব্য হিসেবে নিচের নিবন্ধটি লেখা হয়েছিল। পরে ‘৭৪ সালে “নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলী”তে প্রবন্ধগুলাে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি
সাংগঠনিকভাবে বিষয়গুলি ঠিক করতে হলে প্রথম প্রয়ােজন মতাদর্শগতভাবে সব ঠিক করা, প্রয়ােজন সর্বহারা মতাদর্শ দ্বারা অসর্বহারা মতাদর্শের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করা।
আমরা অবশ্যই নিপুণ হবাে পার্টির অভ্যন্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শপূর্ণ লােকদের সর্বহারা বিপ্লবের পথে পরিচালনা করতে।
ঔপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকাংশই ক্ষুদে বুর্জোয়া, অর্থাৎ কৃষক, বুদ্ধিজীবী, ক্ষুদে চাকুরীজীবী, দোকানদার, হস্তশিল্পী প্রভৃতি। ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন”কে শুধু-যে ঘিরে আছে তা নয়, এর অধিকাংশ সদস্যই এই শ্রেণী উদ্ভূত। এর কারণ ক্ষুদে বুর্জোয়া গণতন্ত্রমনা বিপ্লবীরা নিজেদের অর্থনৈতিক অসুবিধা থেকে মুক্তির আর কোন পথ না পেয়ে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার বিশ্বব্যাপী বিজয়ে প্রভাবান্বিত হয়ে সর্বহারার নেতৃত্ব গ্রহণ করছে। অধিকন্তু পূর্ব বাংলার বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় শ্রমিক জনতা ও শ্রমিক শ্রেণী থেকে আগত পার্টি সদস্যদেরও ক্ষুদে বুর্জোয়া ছাপ রয়েছে। এ কারণে এটা মােটেই আশ্চর্যজনক নয় বরং অবশ্যম্ভাবী যে, ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ সংগঠনে বিভিন্ন আকৃতি ও রূপ নিয়ে প্রকাশ পাবে।
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি মৌলিক পরিচালক শক্তি, কেননা এরা বিভিন্নভাবে শােষিত হয়ে প্রতিনিয়ত দ্রুততর গতিতে
পৃষ্ঠা: ৭৪
গরীব, দেউলিয়া বা বেকার হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অতিসত্বর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রয়ােজন। কিন্তু পরিবর্তনশীল শ্রেণী হিসেবে এর দ্বিমুখী চরিত্র রয়েছে। এর ভালাে ও বিপ্লবী দিক হলাে যে, এই শ্রেণীর অধিকাংশ সদস্যই সর্বহারার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক এমন কি মতাদর্শগত প্রভাবকেও সহজেই গ্রহণ করে। বর্তমানে তারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব চায় এবং এর জন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংগ্রাম করতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতেও তারা সর্বহারার সাথে সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করতে পারে।
তাদের খারাপ ও পশ্চাদপদ দিক হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর তুলনায় এ শ্রেণীর শুধু-যে বহু দুর্বল দিক রয়েছে তাই নয়, যখন তারা সর্বহারার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তখন তারা প্রায়ই বিগড়ে যায় এবং উদারনৈতিক বুর্জোয়া, এমন কি বড় বুর্জোয়াদের প্রভাবে পড়ে এবং তাদের স্বার্থ উদ্ধারের শিকারে পরিণত হয়। অতএব বর্তমান পর্যায়ে সর্বহারা ও তাদের অগ্রগামী সংগঠন “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” নিজেকে পার্টি বহির্ভূত ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে একটি সুদৃঢ় এবং ব্যাপক মিত্রতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করবে এবং একদিকে তাদের সাথে ব্যবহারে নমনীয় হবে, তাদের উদারনৈতিক ধারণা এবং কর্মপদ্ধতিকে সহ্য করবে যতক্ষণ তা শত্রুবিরােধী সংগ্রাম বা জনগণের সাধারণ জীবনযাত্রার ক্ষতি না করে এবং অন্যদিকে তাদেরকে প্রয়ােজনীয় শিক্ষা প্রদান করবে যাতে তাদের সাথে মিত্রতা দৃঢ় হয়।
কিন্তু ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত লােক যারা স্বেচ্ছায় তাদের শ্রেণী ত্যাগ করেছেন এবং সর্বহারার সংগঠনে যােগ দিয়েছেন, পার্টি তাদের বেলায় সংগঠন বহির্ভূত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের তুলনায় অন্য ধরনের নীতি গ্রহণ করবে। যেহেতু এ ধরনের লােক শুরু থেকেই পার্টির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং স্বেচ্ছায় পার্টিতে যােগ দিয়েছেন, তারা ধীরে ধীরে পার্টির মাঝে মার্কসবাদী শিক্ষার মাধ্যমে এবং বিপ্লবী গণসংগ্রামে পােড় খেয়ে মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সর্বহারা হতে পারেন এবং সর্বহারার স্বার্থের ভাল সেবা করতে পারেন।
আমাদের সংগঠনের বহু ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মী পার্টি ও জনগণের জন্য বীরত্বের সাথে সংগ্রাম করেছেন, তারা বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং মতাদর্শগতভাবে ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হয়েছেন।
এটা অবশ্যই জোর দেওয়া প্রয়ােজন যে, সর্বহারাকরণ হয়নি এইরূপ ক্ষুদে বুর্জোয়াদের বিপ্লবী চরিত্র সর্বহারার বিপ্লবী চরিত্র থেকে মূলগতভাবে পৃথক এবং এ পার্থক্য বৈরীরূপ গ্রহণ করতে পারে। ক্ষুদে বুর্জোয়া বিপ্লবী চরিত্রসম্পন্ন পার্টি সদস্য যারা পার্টিতে যােগ দিয়েছেন সাংগঠনিকভাবে কিন্তু মতাদর্শগতভাবে নয়, অথবা সম্পূর্ণভাবে নয়, তারা প্রায়ই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মুখােশ নিয়ে উদারতাবাদী, সংস্কারবাদী, নৈরাজ্যবাদী, সংশােধনবাদী, ট্রটস্কী-চেবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী ও প্রতারকে পরিণত হয়। এইরূপ অবস্থায় তাদের দ্বারা আগামী দিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা শুধু-যে অসম্ভব তাই নয় বর্তমানের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনাও অসম্ভব।
সর্বহারার অগ্রগামী কর্মীগণ যদি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের সাথে কিছু কিছু পার্টি সদস্যদের ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শের একটি দৃঢ় ও তীক্ষ পার্থক্যরেখা না টানেন এবং তাদের শিক্ষিত না করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গুরুতররূপে কিন্তু
পৃষ্ঠা: ৭৫
যথাযথভাবে ও ধৈর্যের সাথে সংগ্রাম না করেন তবে অসম্ভব হবে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে অতিক্রম করা। আরাে গুরুত্বপূর্ণ হলাে এ সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া সদস্য অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রচেষ্টা চালাবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনীকে নিজ প্রতিকৃতি অনুযায়ী পরিবর্তিত করতে এবং পার্টির নেতৃত্ব দখল করতে। এভাবে তারা প্রচেষ্টা চালাবে পার্টি ও জনগণের উদ্দেশ্যের ক্ষতি সাধন করতে। পার্টির বাইরে যত বেশী ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত সদস্য থাকবে, তত কঠোরভাবে পার্টি অবশ্যই বজায় রাখবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে তার পবিত্রতা। এতে ব্যর্থ হলে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ পার্টিকে তীব্রভাবে আঘাত করবে এবং পার্টি ও জনগণের অধিক ক্ষতি সাধিত হবে।
কাজেই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা অবশ্যই নিজেদের বিপ্লবের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং অবগত হবেন কি কি বিশেষরূপে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ও সামরিক ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। তারা মতাদর্শগত ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ-বিরােধী শ্রেণীসংগ্রামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবেন এবং প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালাবেন মার্কসবাদলেনিনবাদ, বিশেষ করে এ যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে রপ্ত করতে, তা প্রয়ােগ করতে এবং অধিকতরভাবে শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী জনগণের সাথে একীভূত হতে। এভাবে অধ্যয়ন, প্রয়ােগ ও গণসংগ্রামের বিপ্লবী চুল্লিতে পােড় খেয়ে তারা সক্ষম হবেন নিজেদের মতাদর্শের বিপ্লবীকরণ করতে এবং পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের নিপীড়িত জনগণকে অধিকতর নিঃস্বার্থভাবে সেবা করতে।
পৃষ্ঠা: ৭৬
ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রকাশ সম্পর্কে
(১৯৭০)
(নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
সভাপতি মাও সেতুঙ-এর “পার্টি ইতিহাসের প্রশ্নে প্রস্তাব” রচনার ভিত্তিতে
প্রথমঃ চিন্তার ক্ষেত্রে
ক্ষুদে বুর্জোয়া চিন্তার পদ্ধতি প্রকাশ পায়- আত্মগত এবং একতরফাভাবে সমস্যা দেখার মাঝে অর্থাৎ এটা শ্ৰেণীসমূহের শক্তির ভারসাম্যের চিত্র বস্তুগতভাবে এবং সামগ্রিকভাবে না দেখে আত্মগত ইচ্ছা, ধারণা এবং ফাঁকা বুলিকে বাস্তব বলে গ্রহণ করে, একটি দিককে সকল দিক, অংশকে সমগ্র এবং বৃক্ষকে অরণ্য বলে ধরে নেয়। বাস্তব উৎপাদনের পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের শুধু বইয়ের জ্ঞান রয়েছে কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং এ কারণে তাদের চিন্তার পদ্ধতি গােড়ামীবাদ রূপে প্রকাশ পায়। উৎপাদনের সাথে জড়িত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের যদিও কিছু ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান রয়েছে কিন্তু তবুও তারা ক্ষুদে বুর্জোয়া উৎপাদনের সীমাবদ্ধতার চরিত্রসংকীর্ণতা, ভাসাভাসাভাব, বিচ্ছিন্নতা এবং গােড়ামীবাদ প্রভৃতিতে ভােগে এবং এ কারণে তাদের চিন্তার পদ্ধতি প্রায়ই সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ হিসেবে প্রকাশ পায়।
দ্বিতীয়ঃ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়াভাব প্রায়ই বাম এবং ডানের মধ্যে দোদুল্যমানতায় প্রকাশ পায়। এর কারণ তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি ও তা থেকে সৃষ্ট আত্মগত ও একতরফাবাদী চিন্তাধারার পদ্ধতি। বহু ক্ষুদে বুর্জোয়া বিপ্লবী বিপ্লবের দ্রুত বিজয়ের আশা পােষণ করে যাতে তাদের জীবনযাত্রার মানের একটি আশু পরিবর্তন হয়। এ কারণে তারা দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী কাজে ধৈর্যের অভাবে ভােগে এবং বামপন্থী’, ‘বিপ্লবী বুলি’ ও শ্লোগানকে পছন্দ করে এবং মানসিকতায় ও কাজে তারা রুদ্ধদ্বারনীতি বা হঠকারীতাবাদের শিকারে পরিণত হয়। পার্টির মাঝে এই ক্ষুদে বুর্জোয়া মনােভাব বহু প্রকার বাম বিচ্যুতির লাইন হিসেবে প্রকাশ পায়; যেমন নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ও বিপ্লবের লক্ষ্য, বিপ্লবী ঘাটি, কৌশল এবং সামরিক লাইন প্রভৃতি। পূর্বের ক্ষুদে বুর্জোয়া বিপ্লবীরা। বা বিপ্লবীদের অপর অংশ যখন অন্য ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে তখন তারা হতাশ এবং নিরাশ হয়ে যেতে পারে এবং দক্ষিণপন্থী মনােভাব এবং মতামত প্রকাশ করে। বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি করতে পারে। চীনে ১৯২৪-২৭ সালের শেষের দিকে চেন তুশিউবাদ রূপে, কৃষি বিপ্লবের শেষের দিকে চেনকাওতাবাদ রূপে এবং লং মার্চের
পৃষ্ঠা: ৭৭
প্রথম দিকে যুদ্ধবাদ রূপে ক্ষুদে বুর্জোয়া দক্ষিণপন্থী চিন্তাধারা প্রকাশ পায়। জাপানবিরােধী প্রতিরােধ যুদ্ধের সময় আপােষপন্থী মনােভাব পুনরায় প্রকাশ পায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যখন বুর্জোয়া ও সর্বহারাদের বিচ্ছেদ ঘটে তখন বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটার বিশেষ সম্ভাবনা থাকে। উদাহরণস্বরূপ চীনা পার্টিতে কৃষি বিপ্লবের সময় তিনবার পার্টির নেতৃত্বসংস্থায় বামপন্থী লাইন প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি ঘটার অধিক সম্ভাবনা থাকে যখন বুর্জোয়া ও সর্বহারাদের মাঝে মৈত্রী হয়। যেমন চীনে ১৯২৪-২৭ সালে বিপ্লবের শেষের দিকে এবং জাপানবিরােধী প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রথম দিকে। বাম বা ডান যাই হােক না কেন এই বিচ্যুতি বিপ্লবকে সাহায্য করে না বরং প্রতিবিপ্লবকে সাহায্য করে। বাম বা ডানে দোদুল্যমানতা, চরমে যাওয়ার ইচ্ছা, সারবস্তুহীন অথচ নিজেকে কেউকেটা বলে প্রকাশ করা, জঘন্য সুবিধাবাদ এগুলি সবই প্রকাশ পায় পরিবর্তনশীল অবস্থার চাপে। ক্ষুদে বুর্জোয়া। মতাদর্শের এগুলাে খারাপ দিক। এগুলাে সকলই ক্ষুদে বুর্জোয়াদের অদৃঢ় অর্থনৈতিক অবস্থার মতাদর্শগত ক্ষেত্রের উপর প্রভাব।
তৃতীয়ঃ সাংগঠনিক ক্ষেত্রে
সাধারণভাবে ক্ষুদে বুর্জোয়াদের জীবনধারণের ক্ষেত্রে এবং চিন্তার পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধতা এবং বিশেষভাবে দেশে পশ্চাদপদ অবস্থা এবং গােষ্ঠী ও পরিবারের বিকেন্দ্রিক সামাজিক অবস্থা সাংগঠনিক জীবনে ক্ষুদে বুর্জোয়া চিন্তাধারা, ব্যক্তিতাবাদ এবং বিভেদপন্থীবাদ প্রভৃতি রূপে প্রকাশ পায়। পার্টিকে ইহা জনগণ থেকে বিচিছন্ন করে ফেলে। এই মনােভাব সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বামপন্থী বিচ্যুতিপূর্ণ সাংগঠনিক লাইন হিসেবে প্রকাশ পায়। এই মনােভাব নিঃস্বার্থভাবে জনগণ ও পার্টির জন্য কাজ না করে পার্টি ও জনগণের শক্তির সুযােগ গ্রহণ করে এবং পার্টি ও জনগণের স্বার্থকে নিজস্ব বা দলগত স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই কারণে ইহা জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা এবং পার্টির শৃংখলার নীতির পরিপন্থী। এই মনােভাব প্রায়ই প্রকাশ পায় নিম্নরূপে-আমলাতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, দমননীতি, হুকুমবাদ, ব্যক্তিবিশেষের বীরত্ববাদ, আধানৈরাজ্যবাদ, উদারতাবাদ, উগ্রগণতন্ত্র, স্বাতন্ত্র্য দাবী করা, গিল্ড মনােভাব, শক্তিশালী দুর্গের মনােভাব, নিজ শহরের লােক এবং সহপাঠির জন্য পক্ষপাত (Favouritism), উপদলীয় গােলমাল এবং বদমাইশি কৌশল প্রভৃতি। ঐ সকলই জনগণের সাথে পার্টির সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং অভ্যন্তরস্থ ঐক্য বিনষ্ট করে।
ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের এগুলি হচ্ছে তিনটি দিক-মতাদর্শের ক্ষেত্রে আত্মগতভাব, রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও বাম বিচ্যুতি এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ যা সকলই বিভিন্ন সময়ে পার্টিতে প্রকাশ পায়। পার্টির ক্ষমতা দখল করা এবং একটি সুসংবদ্ধ লাইন যে ভাবেই প্রকাশ পাক না কেন এগুলি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিরােধী ক্ষুদে বুর্জোয়া মনােভাবের প্রকাশ। পার্টি ও জনগণের স্বার্থে অবশ্যই প্রয়ােজন শিক্ষার পদ্ধতি দ্বারা পার্টির মধ্যকার ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে বিশ্লেষণ করা ও তা অতিক্রম করা এবং একে পরিবর্তন করে সর্বহারার মতাদর্শে রূপান্তরিত করার জন্য সাহায্য করা।
পৃষ্ঠা: ৭৮
বিভেদপন্থীবাদ
(১৯৭০)
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল-প্রকাশক।]
সভাপতি মাও সেতুঙ-এর “পার্টির কর্মপদ্ধতির শুদ্ধিকরণ করাে” রচনার ভিত্তিতে।
“শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যের মাধ্যমেই সমগ্র শ্রেণী ও সমগ্র জাতির ঐক্য অর্জন করা যায়…। যা-কিছু ঐক্যের ক্ষতি করে সে সব কিছুকে অবশ্যই দূর করতে হবে।”
– মাওসেতুঙ
পার্টির আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ প্রকাশ পায়। পার্টির আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ কমরেডদের বিচ্ছিন্ন। করে ফেলে এবং পার্টি-অভ্যন্তরস্ত ঐক্য এবং সংহতির ক্ষতি সাধন করে, অন্যদিকে বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ পার্টি-বহির্ভূত জনগণ থেকে পার্টিকে বিচ্ছিন্ন। করে ফেলে এবং সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পার্টির কর্তব্যের ক্ষতিসাধন করে। এই খারাপ বস্তুর দুটো দিককেই সমূলে উৎপাটিত করে পার্টি কমরেডদের এবং দেশের সকল জনগণের ঐক্যের মহান লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে পার্টি বাধাহীনভাবে অগ্রসর হতে পারে।
পার্টি অভ্যন্তরস্ত বিভেদপন্থীবাদ নিম্নভাবে প্রকাশ পায়ঃ
প্রথমঃ স্বতন্ত্রতার দাবী
কিছু কিছু কমরেড কেবল অংশের স্বার্থকে দেখেন কিন্তু সমগ্রের স্বার্থকে নয়; তারা সর্বদাই অপ্রয়ােজনীভাবে জোর দেন কাজের ঐ অংশের প্রতি, যা তাদেরকে করতে দেওয়া হয়েছে এবং সর্বদাই চান সমগ্রের স্বার্থকে নিজের অংশের অধীন করতে। তারা পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার পদ্ধতি বােঝেন না; তারা উপলব্ধি করেন না যে, কমিউনিস্ট পার্টির শুধু যে গণতন্ত্রই প্রয়ােজন তা নয়, কেন্দ্রীকতা প্রয়ােজন আরাে অধিক; তারা ভুলে যান গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার পদ্ধতি যেখানে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন, নিম্নস্তর উচ্চস্তরের অধীন, অংশ সমগ্রের অধীন এবং সমগ্র সদস্যগণ ‘বিপ্লবী পরিষদ’ (কেন্দ্রীয় কমিটি)-এর অধীন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে চেংকাওতাে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে এ ধরনের স্বতন্ত্রতা দাবী করেছিল যার ফলে সে পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় নিজেকে ঠেলে দেয় এবং কুয়ােমিনটাং-এর এজেন্টে পরিণত হয়। আমরা অবশ্যই কমরেডদের উৎসাহিত করবাে সমগ্রের স্বার্থকে বিবেচনা করতে। সকল পার্টি সদস্য ও সকল বিভাগের কাজ, সকল ঘােষণা এবং কার্যকলাপ অবশ্যই সমগ্র পার্টির স্বার্থ থেকে শুরু হবে; এই নীতিকে লংঘন করা সম্পূর্ণভাবে অননুমােদনীয়।
পৃষ্ঠা: ৭৯
এ ধরনের স্বতন্ত্রতার ধান্দায় ঘুরছেন এমন লােক সর্বদাই আমি প্রথম’ নীতির সংগে অবিচ্ছেদ্য এবং তারা ব্যক্তিবিশেষ ও পার্টির মধ্যকার সম্পর্কের প্রশ্নে প্রায়ই ভুল করে থাকেন। তারা যদিও বুলিতে পার্টিকে সম্মান করেন কিন্তু কার্যতঃ নিজেদেরকেই প্রথম স্থান দেন এবং পার্টিকে দেন দ্বিতীয় স্থান। এ ধরনের লােক কিসের ধান্দায় ঘুরছেন? তারা খ্যাতি, পদ ও আত্মপ্রচারের জন্য ঘুরছেন। কাজের কোন এক অংশের দায়িত্ব তাদের দিলে তারা নিজেদের স্বতন্ত্রতার ধান্দায় থাকেন। এই উদ্দেশ্যে তারা কিছু লােককে পক্ষে টেনে আনেন, আর কিছু লােককে ঠেলে সরিয়ে রাখেন এবং কমরেডদের মধ্যে পরস্পরকে তােষামােদ ও টানাটানি করেন, তারা বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির ইতর রীতিকে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে নিয়ে আসেন। তাদের অসততাই তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই আমাদের সভাবে কাজ করা উচিত। কারণ পৃথিবীতে কোন কাজ সম্পন্ন করতে হলে অসৎ মনােভাব দ্বারা তা করা একেবারে অসম্ভব। সৎ লােক কারা? মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুঙ হলেন সৎ লােক। বৈজ্ঞানিক মনােভাবাপন্ন লােকই সৎ। অসৎ লােক কারা? ট্রটস্কী, বুখারিন, চেনতাও শিও, ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভ, লিউশাওচি, জ্যোতি বসু, নম্বােদ্রিপদ, মণি সিংহ, মােজাফফর, আবদুল হক-ততায়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাশার, কাজী-রণে প্রভৃতি হলাে অসৎ লােক। এরা ব্যক্তি বা চক্রের স্বার্থের ‘স্বতন্ত্রতা দাবী করে। সকল খারাপ লােক এবং যাদের কাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নেই, নিজেদেরকে যারা খুব বুদ্ধিমান ও চালু বলে জাহির করে, আসলে কিন্তু এরা সকলে অতিশয় বােকা এবং তারা কোন ভাল কাজই করতে পারবে না। আমরা অবশ্যই একটি কেন্দ্রীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ পার্টি গঠন করবাে এবং সকল প্রকার নীতিহীন উপদলীয় সংগ্রামকে সম্পূর্ণরূপে দূর করবাে। আমরা অবশ্যই ব্যক্তিতাবাদ এবং বিভেদবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবাে যাতে আমাদের সংগঠন একযােগে এগুতে পারে এবং লক্ষ্যের জন্যে সংগ্রাম করতে পারে।
বাইরের এবং স্থানীয় কেডারগণ অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং বিভেদপন্থী ঝোকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। খুব গভীর মনােযােগ প্রদান করতে হবে বাইরের এবং স্থানীয়। কেডারদের সম্পর্কের বিষয়ে। আমাদের কমরেডদের অবশ্যই বুঝতে হবে পার্টিকে গভীরভাবে শেকড় গাড়তে হলে স্থানীয় ও বাইরের কেডারদেরকে একত্র হতে হবে, ব্যাপকসংখ্যক স্থানীয় কেডারদের শিক্ষিত করতে হবে এবং পদোন্নতি করতে হবে। অন্যথায় এ কাজ করা অসম্ভব। বাইরের এবং স্থানীয় কেডার উভয়েরই শক্তিশালী ও দুর্বল দিক রয়েছে এবং কোনাে উন্নতি করতে হলে তারা অবশ্যই একে অপরের শক্তিশালী দিক থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং নিজেদের দুর্বল দিকগুলাে দূর করবেন। বাইরে থেকে আগত কেডারগণ স্থানীয় অবস্থা ও জনগণের সাথে সম্পর্কের বিষয় স্থানীয় কেডারদের মত অতটা অবগত নন। অধিকন্তু একই অঞ্চলের মধ্যে কোন অংশ দ্রুত এগিয়ে যায়, কোনটা পশ্চাতে পড়ে রয় বলে একস্থানের কেডারদের সাথে অন্যস্থানের কেডারদের পার্থক্য দেখা দেয়। অধিক উন্নত অংশ থেকে আগত কেডারগণও অনুন্নত অংশের স্থানীয় কেডারদের তুলনায় বাইরের কেডার। তাঁরাও মনােযােগ দেবেন স্থানীয় কেডারদের উন্নত করতে এবং বিকাশ ঘটাতে। সাধারণভাবে যে সকল স্থানে বাইরের কেডারগণ দায়িত্বে রয়েছেন সেখানে যদি স্থানীয় কেডারদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় তবে প্রধানতঃ তারাই দায়ী থাকবেন। প্রধান কমরেডগণ যারা দায়িত্বে আছেন তারাই অধিকতর দায়িত্ব বহন করবেন। কোন কোন স্থানে এ বিষয়ে যে নজর দেওয়া হচ্ছে তা
পৃষ্ঠা: ৮০
প্রচুর নয়। কেউ কেউ স্থানীয় কেডারদের ছােট করে দেখেন এবং তাদেরকে বিদ্রুপ করেন এই বলে, “এই সকল স্থানীয়রা কি জানে? যত সব বােকার দল।” এই ধরনের লােক স্থানীয় কেডারদের গুরুত্ব বুঝতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন; তারা স্থানীয় কেডারদের শক্তিশালী দিক বা নিজের দুর্বল দিক কোনটাই দেখেন না এবং একটা বিভেদপন্থী ভুল দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহন করেন। বাইরের সকল কেডার অবশ্যই স্থানীয় কেডারদের ভালবাসবেন এবং তাদেরকে সর্বদাই সাহায্য করবেন এবং তারা অবশ্যই অনুমতি পাবেন না। তাঁদেরকে আক্রমণ বা বিদ্রুপ করতে। নিশ্চয়ই স্থানীয় কেডারগণ তাদের দিক থেকে বাইরের কেডারদের শক্তিশালী দিক থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং অপ্রয়ােজনীয় সংকীর্ণ মনােভাব দূর করবেন, যাতে তারা এবং বাইরের কেডারগণ এক হতে পারেন। এবং আমাদের’ ও ‘তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকে এবং এভাবে বিভেদপন্থী মনােভাব দূর হয়।
একইভাবে এটা প্রয়ােগ করতে হবে বাহিনীর কেডার এবং অন্যান্য কেডার, যারা স্থানীয়ভাবে কাজ করছেন তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। তারা অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন এবং বিভেদপন্থী ঝোককে দূর করবেন। বাহিনীর কেডারগণ অবশ্যই স্থানীয় কেডারদের সাহায্য করবেন, আবার স্থানীয় কেডারগণ বাহিনীর কেডারদের সাহায্য করবেন। যদি তাদের মাঝে গােলমাল বাধে তবে তারা একে অপরের জন্যে কিছুটা ছেড়ে দেবেন এবং প্রয়ােজনীয় আত্মসমালােচনা করবেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে যে সকল স্থানে বাহিনীর কেডারগণ নেতৃত্বে আছেন তারাই প্রধানতঃ দায়ী হবেন যদি স্থানীয় কেডারদের সাথে সম্পর্ক ভাল না হয়। যখন বাহিনী কেডাররা তাদের দায়িত্ব ভালভাবে বােঝেন এবং স্থানীয় কেডারদের প্রতি তারা সঠিক মনােভাব পােষণ করেন, কেবলমাত্র তখনই আমাদের কাজের সুন্দর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
একই বিষয় প্রয়ােগ করা যায় বিভিন্ন বাহিনী ইউনিট, বিভিন্ন স্থান এবং বিভাগের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আমরা অবশ্যই স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদের বিরােধিতা করবাে, যা দ্বারা নিজস্ব ইউনিটের স্বার্থকে দেখা হয় অন্যান্য ইউনিটের স্বার্থকে উপেক্ষা করে। যারাই অন্যের অসুবিধার প্রতি উদাসীন, অন্য ইউনিটের অনুরােধে কেডার বদলি করতে নারাজ অথবা বদলি করলেও নিম্নমানের কেডারদের বদলি করেন, যারা প্রতিবেশীর জমিকে উদ্বৃত্ত জল নিষ্কাশনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেন এবং অন্য বিভাগ, স্থান বা ললাকের প্রতি সামান্যতম মনােযােগও প্রদর্শন করেন না-এ ধরনের লােক হলাে স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদী যারা কমিউনিজমের সামান্যতম মনােভাবও হারিয়েছে। সমগ্রকে বিবেচনা না করা এবং অন্য বিভাগ বা স্থান এবং জনগণের প্রতি সম্পূর্ণ অমনােযােগ প্রদর্শন করা প্রভৃতি হলাে স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদীদের চরিত্র। আমরা অবশ্যই আমাদের প্রচেষ্টাকে তীব্রতর করবাে এ ধরনের লােকদের শিক্ষিত করার জন্য এবং তাদেরকে বুঝাবার জন্য যে, স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদ হচ্ছে বিভেদমূলক মনােভাব যা খুবই ভয়াবহ পরিণতির সৃষ্টি করবে যদি তাকে বাড়তে দেওয়া হয়।
অপর এক সমস্যা হলাে নতুন ও পুরাতন কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক। সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) অষ্টম কংগ্রেসে কমরেড স্ট্যালিন বলেছেন, “… কখনই প্রচুর পরিমাণে পুরােনাে কেডার ছিল না; যা রয়েছে তা প্রয়ােজনের তুলনায় কম এবং এদের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই প্রকৃতির নিয়মের প্রক্রিয়ায় বাতিল হয়ে গেছে। এখানে তিনি কেডারদের অবস্থার কথা বলেছিলেন, শুধু প্রকৃতির কথাই নয়। যদি আমাদের পার্টিতে
পৃষ্ঠা: ৮১
প্রচুর পরিমাণে নতুন কেডার না থাকে যারা পুরােনােদের সাথে সহযােগিতার সঙ্গে কাজ করছে, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য থেমে যাবে। তাই সমস্ত পুরােনাে কেডারদেরকে পরম উৎসাহের সঙ্গে নতুন কেডারদেরকে স্বাগত জানাতে হবে, তাদের যত্ন নিতে হবে। সত্যি নতুন কেডারদের ত্রুটি রয়েছে, বিপ্লবে তারা যােগ দিয়েছেন বেশী দিন হয়নি, তাদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ অপরিহার্যভাবেই পুরােনাে সমাজের অস্বাস্থ্যকর মতাদর্শের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে এসেছেন, এটা ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যক্তিবাদী চিন্তাধারার অবশিষ্টাংশ, কিন্তু এই ত্রুটিগুলাে শিক্ষা আর বিপ্লবের অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে দূর করা যেতে পারে। যেমন স্ট্যালিন বলেছেন, তাঁদের সদগুণ হচ্ছে যা-কিছু নতুন সে-সব বিষয়ের প্রতি তাদের বােধশক্তি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, তাই তাঁরা অত্যন্ত বেশী উদ্দীপ্ত ও সক্রিয়।” কিন্তু কোনাে কোনাে পুরােনাে কেডারদের মধ্যে রয়েছে ঠিক সেই গুনেরই অভাব। নতুন ও পুরনাে কেডারদের পরস্পরকে সম্মান করা, পরস্পর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, অন্যের সদগুণ থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রটি অতিক্রম করা উচিত যাতে করে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অভিন্ন কার্য সাধন করতে পারেন এবং বিভেদপন্থী ঝোঁককে ঠেকাতে পারেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে যেখানে পুরােনাে কমরেডরা দায়িত্বে রয়েছেন সেখানে যদি নতুন কেডারদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় তবে প্রধানতঃ তারাই দায়ী হবেন।
উপরের সবগুলাে অংশ এবং সমগ্রের মধ্যকার সম্পর্ক, ব্যক্তি এবং সংগঠনের মধ্যকার সম্পর্ক, বাইরের এবং স্থানীয় কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক, সামরিক কেডার এবং স্থানীয় কার্যরত কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক, এক সামরিক ইউনিটের সাথে অন্য সামরিক ইউনিটের সম্পর্ক, এক স্থানের সাথে অন্য স্থানের, এক বিভাগের সাথে অন্য বিভাগের এবং নতুন ও পুরােনাে কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক হলাে পার্টির অভ্যন্তরস্ত সম্পর্ক। এ সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিউনিজমের মনােভাবকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়ােজন এবং বিভেদপন্থী ঝোকের বিরুদ্ধে পাহারা দেওয়া দরকার, যাতে আমাদের বাহিনী ভাল অবস্থায় থাকে, একই সঙ্গে এগােয় এবং ভালভাবে যুদ্ধ করে। বিভেদপন্থীবাদ হলাে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আত্মগতভাবের প্রকাশ। যদি আমরা আত্মগতভাব দূর করতে চাই এবং বাস্তব থেকে সত্য খুঁজে বের করার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মনােভাবকে এগিয়ে নিতে চাই তবে আমরা অবশ্যই পার্টি থেকে বিভেদপন্থীবাদকে ঝেটিয়ে দূর করবাে এবং পার্টির স্বার্থকে ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র দলের স্বার্থের উর্ধে স্থান দেওয়ার নীতি সামনে রেখে অগ্রসর হবাে, যার ফলে পার্টির মাঝে সম্পূর্ণ একতা ও সংহতি স্থাপিত হয়।
বিভেদপন্থীবাদ পার্টির অভ্যন্তরস্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রের মত পার্টির সাথে বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও দূর করতে হবে। এর কারণ, আমরা শত্রুকে পরাজিত করতে সক্ষম হবাে না কেবলমাত্র সমগ্র পার্টির কমরেডদের একত্রিত করে; সমগ্র দেশের জনগণকে একত্রিত করেই আমরা শত্রুকে পরাজিত করতে পারবাে। কিছুকাল ধরে আমরা পার্টির নেতৃত্বে জনগণকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এ সময়ের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি আমাদের অনেক কমরেডের মাঝেই বিভেদপন্থী ঝোঁক রয়ে গেছে। আমাদের অনেক কমরেডেরই পার্টির বাইরের লােকদের সাথে ব্যবহারে ঔদ্ধত্য (overbearing) প্রকাশ পায়, তাদেরকে তারা হেয় ভাবেন, ঘৃণা করেন বা সম্মান প্রদর্শন করেন না অথবা
পৃষ্ঠা: ৮২
তাদের শক্তিশালী দিককে প্রশংসা করেন না। এটা সত্যিই বিভেদপন্থী ঝোক। কয়েকটা মার্কসবাদী বই পড়ে এই কমরেডরা আরাে বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে অহংকারী হন এবং অন্যকে খারাপ বলে বাতিল করে দেন; কিন্তু একবারও চিন্তা করেন না যে তাদের নিজেদের চিন্তাই আধা কাঁচা। আমাদের কমরেডদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যরা সর্বদাই সংখ্যালঘু। কাজেই আমাদের কি কারণ থাকতে পারে পার্টি বহির্ভূত লােকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার? ঐ সকল লােক যারা আমাদের সাথে সহযােগিতা করেন বা ভবিষ্যতে করতে পারেন, আমাদের একমাত্র কর্তব্য হলাে তাদের সঙ্গে একত্রিত হওয়া; কোন অধিকারই নেই তাদেরকে বাদ দেওয়ার। কিন্তু কিছু কিছু পার্টি সদস্য এটা বােঝেন না এবং যারা আমাদের সাথে সহযােগিতা করতে চান তাদেরকে নীচুভাবে দেখেন বা তাদেরকে বাদ দেন। এইরূপ করার কোন কারণই নেই। মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুঙ কি আমাদের এইরূপ করার কোন যৌক্তিকতা দিয়েছেন? না, তারাও দেননি। উপরন্তু তারা বারবার আমাদের বলেছেন জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ সৃষ্টি করতে এবং নিজেদেরকে তাদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে। আমাদের প্রস্তাবাবলীর একটিতেও নেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা; উপরন্তু, কেন্দ্রীয় সংস্থা আমাদের সর্বদাই বলেছেন জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপন করতে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হতে। এভাবে যে কোন কাজ যা আমাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার কোন যৌক্তিকতা নেই এবং এটা আমাদের কিছু কমরেড-সৃষ্ট বিভেদপন্থী মনােভাবের ফল। যেহেতু এই বিভেদপন্থীবাদ। আমাদের কিছু কিছু কমরেডের মাঝে রয়েছে এবং এটা পার্টি লাইন প্রয়ােগে বাধা সৃষ্টি করে, এ কারণে আমরা পার্টির অভ্যন্তরে তীব্রভাবে শিক্ষা চালাবাে এই সমস্যার মােকাবেলা করতে। সবচাইতে বড় কথা হলাে, আমরা আমাদের কেডারদের বােঝাবাে সমস্যাটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং পার্টি বহির্ভূত কেডার ও জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ না হলে শত্রুদের উৎখাত করা ও বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন করা কতখানি অসম্ভব।
সকল বিভেদপন্থী ধারণা হলাে আত্মগতভাব এবং এগুলাে বিপ্লবের প্রয়ােজনের পরিপন্থী। এ কারণে বিভেদপন্থীবাদের বিরুদ্ধে ও আত্মগতভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একযােগে চলবে।
আত্মগতভাব দূর করার জন্য আমরা অবশ্যই বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতার প্রচার করবাে। আমাদের সংগঠনের কিছু লােক রয়েছেন যারা বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতার প্রচারে কোন গুরুত্ব দেন না, তারা ভাবেন যে, তারা মার্কসবাদে বিশ্বাসী কিন্তু তারা কোন প্রচেষ্টা চালান না। বস্তুবাদ বুঝতে অথবা যখন তারা কোন আত্মগত কিছু দেখেন বা পড়েন তখন তারা কোন মতামত পেশ করেন না বা সমালােচনা করেন না। এটা কমিউনিস্টদের চরিত্র নয়। এটা আমাদের কমিউনিস্টদের মন আত্মগতভাব দ্বারা বিষাক্ত করে ফেলে এবং মনের স্পর্শকাতরতাবােধকে ভোতা করে দেয়। এ কারণে আমরা সংগঠনের মাঝে একটি শিক্ষার আন্দোলন পরিচালনা করবাে যা আমাদের কমরেডদের মন থেকে আত্মগতভাবের এবং বিভেদপন্থীবাদের কুয়াশা দূর করবে। আমরা অবশ্যই আত্মগতভাব ও বিভেদপন্থীবাদ অকেজো মাল হিসেবে বর্জন করবাে এবং তাদের প্রসার বন্ধ করবাে এবং পার্টির কর্মীদের তাত্ত্বিক নিম্নমানের সুযােগ প্রদান রােধ করবাে। আমাদের কমরেডগণ এ কারণে একটি ভাল নাক তৈরী করবেন। সকল বিষয়ের ঘ্রাণ
পৃষ্ঠা: ৮৩
নেবেন এবং বিষয়টিকে স্বাগত জানাবেন না বর্জন করবেন তা নির্ণয়ের জন্য খারাপ ও ভালর মধ্যে পার্থক্যরেখা টানবেন। কমিউনিস্টরা সর্বদাই প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, কেন’ ও ‘কোথা থেকে’ বলে। তাদের নিজেদের মাথা খাটাবেন এবং সতর্কতার সাথে চিন্তা করবেন, এটা বাস্তবের সাথে খাপ খায় কিনা এবং এটা বাস্তবের উপর সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠিত কিনা; কোন অবস্থায়ই অন্ধভাবে তারা অনুসরণ করবেন না বা দাসত্ববাদের উৎসাহ দেবেন না। শেষ করতে যেয়ে বলা যায়, আত্মগতভাব এবং বিভেদপন্থীবাদ বিরােধিতার সময় আমাদের দুটো লক্ষ্য থাকবে। প্রথম হলাে-“অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন ভবিষ্যতের ভুল এড়ানাের জন্য এবং দ্বিতীয় হলাে-“রােগ সারিয়ে রােগীকে বাঁচান”।
মুখ না দেখে অতীতের ভুলগুলাে অবশ্যই প্রকাশ করে দিতে হবে; অতীতের খারাপ বস্তুকে বৈজ্ঞানিক মনােভাব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ও সমালােচনা করা প্রয়ােজন, যাতে করে ভবিষ্যতের কাজ আরাে সতর্কতার সংগে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়। এটাই হচ্ছে। “অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানাের” অর্থ। কিন্তু ভুল উদঘাটন করার ও ক্রটি সমালােচনা করার আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যেমন চিকিৎসক রােগীর চিকিৎসা করেন। সম্পূর্ণভাবে রােগীকে বাঁচানাের জন্য তাকে মেরে ফেলার জন্য নয়। একজন এপেন্ডিসাইটিস’ রােগে ভুগছে এমন ব্যক্তির উপাংগটি চিকিৎসক যদি কেটে দেন তখনই সে বাঁচে। কোন লােক ভুল করার পর যদি চিকিৎসার ভয় না করে, রােগকে গােপন না রাখে, ভুলকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে না ধরে, চিকিৎসার সাধ্যাতীত অবস্থায় না পড়ে এবং সত্যি সত্যি আন্তরিকভাবে চিকিৎসা করতে চায় ও ভুল শােধরাতে ইচ্ছুক থাকে তবে আমাদের উচিত তাকে স্বাগত জানানাে ও তার রােগ সারানাে, যাতে সে একজন ভাল কমরেড হয়ে উঠে। যদি ক্ষণিক আত্মতুষ্টির জন্য তখনই তীব্র কশাঘাত করা হয়, তাহলে এ কাজ কখনও সফল হবে না। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ব্যাধির চিকিৎসায় কখনাে রুক্ষ ও বেপরােয়া মনােভাব গ্রহণ করা উচিত নয়, বরং “রােগ সারিয়ে রােগীকে বাঁচাননা”, এই মনােভাব অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত-শুধু এটাই নির্ভুল ও ফলপ্রদ পদ্ধতি।
পৃষ্ঠা: ৮৪
উপদলবাদ ও সুবিধাবাদ সম্পর্কে
(১৯৭০)
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
স্ট্যালিনের রচনাবলী’র ভিত্তিতে
পার্টি হচ্ছে ইচ্ছার, কাজের, ঐক্যের প্রতিনিধি যা যে কোন প্রকার উপদলের বিরােধী। সর্বহারার একনায়কত্ব অর্জন ও তা বজায় রাখা অসম্ভব-সংহতি ও লৌহ-কঠিন শৃঙ্খলায় শক্তিশালী একটি পার্টি ব্যতীত। কিন্তু লৌহ-কঠিন শৃঙ্খলা সকল পার্টি সদস্যদের সম্পূর্ণ ও সামগ্রিক ইচ্ছার ঐক্য, কাজের ঐক্য ব্যতীত চিন্তা করা যায় না। কিন্তু ইহা অবশ্যই বুঝায় না যে, পার্টির মধ্যে কোন প্রকার মতের সংঘাত থাকবে না। লৌহ-কঠিন শৃঙ্খলা স্বীকার করে নেয় পার্টির অভ্যন্তরে সমালােচনা ও মতের সংঘাতকে। ইহা মােটেই বুঝায় না যে শৃঙ্খলা হবে অন্ধ শৃঙ্খলা। লৌহ-কঠিন শৃংখলা হবে সচেতন এবং স্বেচ্ছা আনুগত্যমূলক, কেননা কেবলমাত্র সচেতন শৃঙ্খলাই লৌহ-কঠিন হতে পারে। কিন্তু যখন একটি মতের উপর সংঘাত শেষ হয়, সমালােচনা সমাপ্ত হয় এবং একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখন সকল সদস্যের ইচ্ছা ও কাজের ঐক্য প্রয়ােজন। এ ছাড়া পার্টির ঐক্য বা লৌহ-কঠিন শৃংখলা কোনটাই অর্জন করা যায় না। লেনিন বলেছেন, “বর্তমান গৃহযুদ্ধের যুগে কমিউনিস্ট পার্টি তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে যদি ইহা কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে গঠিত হয়, যদি এর শৃংখলা সামরিক শৃংখলার মত হয় এবং যদি পার্টির কেন্দ্র শক্তিশালী ও নেতৃত্বদাতা সংস্থা হয়-যা ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী এবং পার্টি সদস্যের বিশ্বাসভাজন হয়।” লেনিন অন্যত্র বলেছেন, “ যে কেউ সর্বহারার পার্টির শৃংখলাকে সামান্যতম দুর্বল করে সে-ই বাস্তবে সর্বহারার বিরুদ্ধে বুর্জোয়াকে সাহায্য করে।”
এ থেকে আমরা পাই যে উপদলের অবস্থিতি পার্টির ঐক্য অথবা লৌহ-কঠিন শৃংখলা কোনটার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা প্রমাণের সামান্যই প্রয়ােজন রয়েছে যে, উপদলের অবস্থান কয়েকটি কেন্দ্র সৃষ্টি করে এবং কয়েকটি কেন্দ্রের সৃষ্টি পার্টির সাধারণ একটি কেন্দ্রের অনুপস্থিতি, এর ঐক্যের ভাঙ্গন, শৃংখলাকে দুর্বল ও ছিন্ন করা, সর্বহারার একনায়কত্বকে দুর্বল ও ছিন্ন করা বুঝায়। সংশােধনবাদী ও ট্রটস্কীবাদী পার্টিগুলাে-যারা সর্বহারাদের ক্ষমতা দখলের দিকে পরিচালিত করে না, তারাই কেবল উপদলীয় কার্যকলাপের স্বাধীনতা অনুমােদন করার উদারতাবাদ স্বীকার করতে পারে। কিন্তু যে পার্টি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের এবং তা বজায় রাখার সংগ্রামে সর্বহারাদের পরিচালিত করে তা উপদলীয় কার্যকলাপের প্রতি উদার হতে পারে না বা তা চলার স্বাধীনতা দিতে পারে না।
পার্টি ইচ্ছার ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব করে যা সকল প্রকার উপদলবাদ এবং নেতৃত্বের বিভক্তিকরণকে বিরােধিতা করে।
পৃষ্ঠা: ৮৫
এ কারণেই লেনিন সাবধান করেছেন, “পার্টির ঐক্য এবং সর্বহারা একনায়কত্বের সাফল্যের মৌলিক শর্ত হিসেবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনীর ঐক্যের দৃষ্টিকোণ, যা উপদলবাদ দ্বারা বিপদগ্রস্ত হতে পারে তার সম্বন্ধে।
এ কারণেই লেনিন দাবী করেছেন, “সকল প্রকার উপদলবাদকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করার জন্য” এবং “কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়া সকল গ্রুপ যা বিভিন্ন প্লাটফরমের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে তা অতি সত্তর ভেঙ্গে দিতে”, “এমনকি শর্তহীনভাবে এবং দ্রুতগতিতে পার্টি থেকে। বহিষ্কার করতে।”
পার্টি শক্তিশালী হয় সুবিধাবাদী উপদলকে বর্জন করে
পার্টির মধ্যে উপদলবাদের উৎস হচ্ছে সুবিধাবাদী উপাদানসমূহ। সর্বহারা একটি বিচ্ছিন্ন শ্রেণী নয়। এটা সর্বদাই বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিয়ত আগমণের জন্য। একই সাথে সর্বহারার উপরের অংশ বিশেষ করে ট্রেডইউনিয়ন নেতারা এবং পার্লামেন্টের সদস্যরা-যারা বুর্জোয়াদের উপনিবেশ থেকে লুণ্ঠিত অগাধ মানাফার একটা অংশ পায় তারা প্রতিনিয়ত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। লেনিন বলেছেন, “এই বুর্জোয়া বনে যাওয়া শ্রমিক বা শ্রমিক আমলাতন্ত্র-যারা তাদের জীবনযাত্রায়, তাদের জীবিকা অর্জনে, তাদের সামগ্রিক দৃষ্টিকোণে অন্ধ তারাই হলাে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রধান প্রণেতা এবং বুর্জোয়াদের প্রধান সহায়ক, কেননা এরাই হলাে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে সত্যিকার বুর্জোয়া দালাল, পুঁজিবাদী শ্রেণীর শ্রমিক লেফট্যানেন্ট সংস্কারবাদ ও বৃহৎ জাতীয়তাবাদের প্রধান রাস্তা।”
কোন না কোনভাবে এই সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া গ্রুপ পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং পার্টির মধ্যে দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদ, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মনােভাব সৃষ্টি করে। প্রধানতঃ এরাই উপদলবাদ বা বিচ্ছিন্নতার উৎস, ভিতর থেকে পার্টি ভেঙ্গে দেওয়া ও ক্ষতিসাধন করার উৎস। নিজের পিছনে এই ধরনের মিত্র নিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করার অর্থ হলাে দু’দিক থেকে গােলাবর্ষণের মধ্যে পড়া অর্থাৎ সম্মুখ থেকে এবং পেছন থেকে। অতএব এইসব উপাদানের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক সংগ্রাম একটি বিশেষ প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ।
সুবিধাবাদী উপদলকে পার্টির অভ্যন্তরে রেখে মতাদর্শগত সংগ্রাম দ্বারা পরাজিত করার তত্ত্ব, এ সকল উপাদানকে একই পার্টির ভিতরে রেখে তাদেরকে অতিক্রম করার তত্ত্ব-একটা বাজে এবং বিপজ্জনক তত্ত্ব, যা হুমকি প্রদর্শন করে পার্টিকে সুবিধাবাদের শিবিরে পরিণত করতে, হুমকি প্রদর্শন করে সর্বহারার একটি বিপ্লবী পার্টিহীন করতে, হুমকি প্রদর্শন করে সর্বহারাদের শত্রু বিরােধী সংগ্রামে প্রধান অস্ত্রচ্যুত করতে।
পার্টি শক্তিশালী হয় সুবিধাবাদী উপাদানকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে
পৃষ্ঠা: ৮৬
উপদলবাদের শ্রেণী বিশ্লেষণ
(১৯৭০)
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল-প্রকাশক।]
হংকির প্রবন্ধ “উপদলবাদের শ্রেণী-বিশ্লেষণ কর” (পিকিং রিভিও, নং ১৯, ১৯৬৮সাল)-এর ভিত্তিতে
শ্রেণী সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী রয়েছে। প্রতিটি শ্রেণীর অভ্যন্তরে স্তর রয়েছে। রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রতিটি শ্রেণী এবং স্তর অবশ্যই বাম, মাঝারি ও দক্ষিণ উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এটা মানুষের ইচ্ছার বাইরে সার্বজনীন নিয়ম।
সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম প্রতিটি শ্রেণী ও স্তরকে সংগ্রামে অবতীর্ণ করায়। প্রতিটি শ্রেণী ও রাজনৈতিক স্তরের শক্তিসমূহ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করে, আরও প্রকাশ করে নিজস্ব দলীয় কার্যকলাপ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে উপদলবাদের শ্রেণী-বিশ্লেষণ করা একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
লেনিন বলেছেন, “শ্রেণী বিভাগ অবশ্যই চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক দলের ভিত্তি; চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অবশ্যই এটা নির্ণয় করে রাজনৈতিক দলকে।”
শ্রেণী সমাজে সকল শ্রেণীসংগ্রাম হলাে রাজনৈতিক সংগ্রাম যা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায় বিভিন্ন দল ও উপদলের মধ্যকার সংগ্রামের মাধ্যমে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “একটি পার্টির বাইরে রয়েছে অন্যান্য পার্টি এবং একটি পার্টির অভ্যন্তরে রয়েছে উপদল; সর্বক্ষেত্রেই এইরূপ ঘটে থাকে।” পুঁজিবাদী সমাজে বিভিন্ন দল ও উপদল রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমােক্রাট পার্টি এবং রিপাবলিকান পার্টি হলাে একচেটিয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দুটো উপদল। একইভাবে শ্রমিক শ্রেণীর। আন্দোলনেও বিভিন্ন দল ও উপদল রয়েছে। প্রথম আন্তর্জাতিকে সর্বহারার আত্মরক্ষাকারী মার্কসবাদীদের সাথে সংগ্রাম চলেছে বুর্জোয়া ও ক্ষুদে বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রুধাে, বাকুনিন, লাসাল এবং অন্যান্য উপদলের বিরুদ্ধে। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে লেনিনের প্রতিনিধিত্বে বামপন্থীরা বার্নস্টাইন এবং অন্যান্য সংশােধনবাদী উপদলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। কাউটস্কি কিছুকালের জন্য মাঝামাঝি থেকে যুদ্ধের সময় দক্ষিণপন্থী হয়ে যায়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সময় লেনিন ও স্ট্যালিন ছিলেন সত্যিকারের বামপন্থী, বুখারিন ছিল দক্ষিণপন্থী এবং ট্রটস্কী ছিল আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান এবং সে পরবর্তী পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে প্রতিবিপ্লবীতে পরিণত হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে সুবিধাবাদী উপদল হলাে দক্ষিণপন্থী; শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলনের মধ্যে এরা হলাে
পৃষ্ঠা: ৮৭
বিশেষ বাহিনী। এবং এদের ভিত্তি হলাে শ্রমিক আমলাতন্ত্র। এদের মতাদর্শ হলাে সত্যিকারভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শ যা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে প্রকাশ পায়। এরা শ্রমিক শ্ৰেণীকে দুর্নীতিপরায়ণ করার চেষ্টা করে।
পূর্ব বাংলার মার্কসবাদী আন্দোলনে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিনিধিত্ব করে সত্যিকার বামপন্থী বিপ্লবীদের এবং মণিসিংহ মােজাফ্ফর প্রতিনিধিত্ব করে প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থীদের এবং হক-তােয়াহা, কাজী-রণা, নানা-মতিন প্রতিনিধিত্ব করে আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডানপন্থীদের।
সভাপতি মাও উল্লেখ করেছেন, “মানুষের বসবাসহীন মরুভূমি ব্যতীত অন্য যেখানেই মানবগােষ্ঠী রয়েছে সেখানেই তারা বাম, মাঝারী ও দক্ষিণে বিভক্ত, হাজার বছর পরেও এমনি হবে।”
পার্টি মনােভাব সর্বহারা শ্রেণী চরিত্রের কেন্দ্রীভূত প্রকাশ। কেবলমাত্র সর্বহারার সব চাইতে সচেতন এবং অগ্রগামী শক্তিই সম্পূর্ণভাবে এবং সত্যিকারভাবে সর্বহারা শ্রেণী স্বার্থ এবং অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এইরূপ হলেই সর্বহারা বিপ্লবীরা সর্বহারার পার্টি মনােভাবের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যাকে আমরা সাধারণভাবে সর্বহারা পার্টি মনােভাব এবং বুর্জোয়া উপদলীয় মনােভাবের সংগ্রাম বলি তা সর্বহারার পার্টি মনােভাবের সাথে বুর্জোয়া পার্টি মনােভাবের সংগ্রাম ব্যতীত আর কিছুই নয়।
সভাপতি মাও বলেছেন, “শিক্ষার প্রতিটি লাইনে বিভিন্ন ধারা এবং বিভাগ রয়েছে; বিশ্বদৃষ্টিকোণের বিষয়ে অবশ্য আজকাল মৌলিকভাবে কেবলমাত্র দুটো দিক রয়েছে ও সর্বহারা ও বুর্জোয়া। হয় এটা, নয় অপরটা; হয় সর্বহারা অথবা বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিকোণ।” আমাদের সংগঠনে বিভিন্ন ধরনের যে দৃষ্টিকোণ দেখা যায় তারা মূলতঃ দু’ভাগে বিভক্ত; তারা দু’টি বৃহৎ শ্রেণীর প্রতিনিধি।
প্রতিটি উপদল এবং প্রতিটি উপদলীয়বাদের প্রকাশ বিভিন্ন শ্রেণী এবং স্তরের স্বার্থ, চিন্তা এবং দাবীর প্রতিনিধিত্ব করে। জটিল শ্রেণী সংগ্রামে জনগণের কাজ অনুযায়ী শ্রেণী অনুসন্ধান করা প্রয়ােজন যাতে করে সার্বিক অর্থে সত্যিকার বিপ্লবী, বুলিতে বিপ্লবী এবং প্রতিবিপ্লবীদের মধ্যে পার্থক্যরেখা টানতে পারা যায়। অর্থাৎ, আমরা তাদের শ্লোগান ও বক্তৃতা দ্বারাই বিচার করবাে না, যা আরাে গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে তারা কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, কোন শ্রেণী লাইন অনুসরণ করে এবং কোন শ্রেণী তাদের কাজ থেকে উপকৃত হয়।
সভাপতি মাও সেতুঙের চিন্তাধারা এবং মাওয়ের সর্বহারা বিপ্লবী লাইনের প্রতি আনুগত্য, ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার সর্বহারা দায়িত্ব গ্রহণ, সংশােধনবাদী, নয়া সংশােধনবাদী ও ট্রটস্কীবাদীদের বিরুদ্ধে অনমনীয়ভাবে সংগ্রাম করা, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক লাইন দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করা, নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জনগণের সেবা করা প্রভৃতি হলাে সর্বহারার পার্টির মনােভাব।
একগুঁয়েভাবে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল লাইনকে আঁকড়ে ধরা, দক্ষিণ দিক থেকে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ, দক্ষিণপন্থী আপসবাদ এবং দক্ষিণপন্থী বিভেদপন্থীবাদ দ্বারা সভাপতি মাওয়ের সর্বহারা বিপ্লবী লাইনের বিরােধিতা করা অথবা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান অর্থাৎ অতি বাম দিক থেকে সভাপতি মাওয়ের বিপ্লবী লাইনের ক্ষতি করা—এগুলাে হলাে বুর্জোয়া পার্টি বা উপদলীয় মনােভাবের একগুয়ে প্রকাশ।
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী সর্বহারার মিত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি উল্লেখযােগ্য পরিচালক শক্তি। আমাদের সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য এই ক্ষুদে বুর্জোয়া
পৃষ্ঠা: ৮৮
শ্রেণী থেকে আগত। বিপ্লবী দৃঢ়তার অভাবে ভােগে বলে এরা সহজেই বুর্জোয়া উপদলবাদে প্রভাবান্বিত হয়। এই কারণে সভাপতি মাওয়ের বিপ্লবী লাইন দ্বারা ক্ষুদে বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতা দূর করা প্রয়ােজন। এটা অবশ্যই প্রয়ােজন সভাপতি মাওয়ের সর্বহারা বিপ্লবী লাইন দ্বারা সর্বহারা ও ব্যাপক বিপ্লবী জনগণের ঐক্যকে সুদৃঢ় করা, বিপ্লবী বাহিনীকে সুসংবদ্ধ করা এবং পূর্ব বাংলার জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া।
বুর্জোয়া উপদলবাদকে দৃঢ়ভাবে ধিকৃত করতে হবে। যারা বুর্জোয়া উপদলবাদে প্রভাবান্বিত এবং তা বজায় রাখতে একগুঁয়েমি প্রদর্শন করে, তাদের ভুল পথ গ্রহণ করার এমন কি শত্রু দ্বারা ব্যবহৃত হবার সমূহ বিপদ রয়েছে। এই সকল ক্ষুদে বুর্জোয়াদের শিক্ষিত করবার প্রচুর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “আমরা অবশ্যই ভালাে হবাে … আমাদের বাহিনীর ক্ষুদে বুর্জোয়া ভাবধারাসম্পন্ন লােকদের সর্বহারা বিপ্লবী লাইনে পরিচালিত করতে।”
পৃথিবীতে শ্রেণীর উর্ধে কোন পার্টি মনােভাব বা উপদলীয় মনােভাব নাই। শ্রেণীহীন দৃষ্টিকোণ হলাে বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ যা শ্রেণীর উর্ধে বলে দাবী করে। উপদলীয় সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামেরই প্রকাশ। উপদলবাদের শ্রেণীভিত্তি যদি সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে অসম্ভব হবে সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্যরেখা টানতে এবং এটা সর্বহারা বিপ্লবীদের ও বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যকার পার্থক্যকে মুছে দেবে। দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীরা সর্বদাই সর্বহারা বিপ্লবীদের বিরােধিতা করতে যেয়ে এই কৌশল অবলম্বন করে।
আমরা বুর্জোয়া উপদলবাদকে বিরােধিতা করি সর্বহারা বিপ্লবীদের উপদলবাদ অর্থাৎ সর্বহারা অগ্রগামীদের পার্টি মনােভাবকে জোরদার করার জন্য। লেনিন বলেছেন, “কঠোর পার্টিনীতি বিকাশের জন্য প্রকাশ্য এবং ব্যাপক শ্রেণী সংগ্রাম দাবী করা।” আমরা আরাে কঠোরভাবে বিকাশ ঘটাবাে সর্বহারার পার্টি মনােভাবকে এবং অধিকতর প্রচেষ্টা চালাবাে মাওসেতুঙের চিন্তাধারায় সুসজ্জিত সর্বহারা বিপ্লবী হতে। আমরা অবশ্যই দৃঢ়ভাবে বিরােধিতা করবাে বুর্জোয়া দক্ষিণপন্থীদের এবং অতিবামপন্থীদেরও যারা আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান, দুই লাইনের সংগ্রামকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবাে এবং উপদলবাদকে নির্মূল করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবাে।
পৃষ্ঠা: ৮৯
অভিজ্ঞতার সারসংকলনের উপায়
(১৯৭০)
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
পিকিং রিভিউ-এর একটি প্রবন্ধের ভিত্তিতে রচিত
ভুল এবং বিপর্যয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা অধিকতর জ্ঞানী হয়েছি ও আমাদের কার্যাবলী আরাে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করছি। কোন রাজনৈতিক পার্টির পক্ষে ভুল এড়ানাে সহজ নয়, তবে আমাদের যথাসম্ভব কম ভুল করা উচিত। একবার ভুল হলে তা শােধরানাে উচিত, এবং তা যত শীঘ্র ও সার্বিকভাবে হয় ততই ভাল।
– মাওসেতুঙ
নেতৃস্থানীয় কর্মীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলাে মাতসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে ন্যায়পরায়ণতার সাথে অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা এবং অধিকতরভাবে নিজেদের বিশ্বদৃষ্টিকোণকে পরিবর্তন করা যাতে তারা সক্ষম হন বিপ্লবের আরাে ভালােভাবে নেতৃত্ব দিতে।
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “একজন নেতার দায়িত্ব সংগ্রামের পথ এবং লক্ষ্যসমূহ উল্লেখ করাই নয়, সে অবশ্যই বিশেষ অভিজ্ঞতার সারসংকলন করবে এবং দ্রুত জনগণের মাঝে তা ছড়িয়ে দেবে যাতে যা সঠিক তা অনুসরণ করা হয় এবং যা ভুল তার পুনরাবৃত্তি না হয়। এর মাঝে দুটো দিক রয়েছে। পুংখানুপুংখভাবে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ক্ষণের সর্বহারা বিপ্লবের মূল অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা এবং বর্তমান সংগ্রামের বিশেষ অভিজ্ঞতার সময়মত সারসংকলন করা।
প্রতিটি সংগ্রামে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থাকবে, উভয়ই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সর্বদাই স্মরণ রাখা প্রয়ােজন।
সভাপতি মাওসেতুঙ সম্প্রতি আমাদের শিখিয়েছেন, “ন্যায়পরায়ণতার সাথে অভিজ্ঞতার সারসংকলন প্রয়ােজন। যখন কেউ একটি সাংগঠনিক এককে অবস্থা অবগত হবার জন্য যায়, সে অবশ্যই গতির সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হবে-এর উৎপত্তি, এর বিকাশ এবং এর বর্তমান অবস্থা, জনগণের মাঝে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, এবং নেতৃত্বের মাঝে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, কি কি দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের উদ্ভব হয়েছে এবং এ সকল দ্বন্দ্বের কি কি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং জনগণ তাদের জ্ঞানের কি উন্নতি করেছে, যাতে করে এর নিয়মবিধি বের করা যায়।”
সকল স্তরের নেতৃস্থানীয় কর্মীরা অবশ্যই সভাপতি মাও-এর নির্দেশের প্রতি নজর দেবেন এবং একে ন্যায়পরায়ণতার সাথে পালন করবেন।
পৃষ্ঠা: ৯০
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “আমরা অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবাে।” ইহা। বুঝাবার জন্য আমরা অবশ্যই নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করবাে এবং জনগণের ছাত্র হবাে। বিজয়ের সময় নেতৃস্থানীয় কর্মীরা বিনয়ী ও নম্র হবেন এবং অহংকার ও রুক্ষতার বিরুদ্ধে নজর রাখবেন। তারা অবশ্যই শ্রমিক-কৃষক ও জনতা কর্তৃক উত্থাপিত মতামত মনােযােগের সাথে শুনবেন ও সর্বহারার বিপ্লবী উৎসাহ এবং জনগণ থেকে বিনয়ের সাথে শিক্ষার সুন্দর পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাবেন।
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা গতির সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সাথে অবশ্যই পরিচিত হবাে। এটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কেবলমাত্র গতির সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হয়েই ইহার প্রকৃত অবস্থা সার্বিকভাবে বুঝতে পারি। কেবলমাত্র এভাবেই আমরা বুর্জোয়া ও তার দালাল বিরােধী সর্বহারার সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বুঝতে পারি, কেবলমাত্র এভাবেই আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন অবস্থায় সর্বহারার। শত্রুরা কি কি কৌশল অবলম্বন করেছে এবং কিভাবে শক্রর ষড়যন্ত্রকে আমরা উন্মােচিত করতে পারি; এ প্রক্রিয়ায় শত্রু ও আমাদের এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও রাজনৈতিক শ্রেণীসমূহের কি কি পরিবর্তন এসেছে; নেতৃত্ব ও জনগণের মাঝে কি কি পরিবর্তন এসেছে এবং কি কি বিপর্যয় ঘটেছে; কেবলমাত্র এভাবেই আমরা জনগণের মাঝে দ্বন্দ্বের সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সংগ্রামের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পর্যায়ে কি কি সমস্যার সমাধান করতে হবে তা বের করতে পারি এবং তা সমাধান করার উপায় নির্ণয় করতে পারি। সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন, “আমরা দেশের অভ্যন্তরের ও বাইরের প্রদেশের, থানা বা জেলার বাস্তব অবস্থা থেকে অগ্রসর হবাে এবং এগুলাে থেকে আমাদের কাজের উপায় হিসেবে নিয়মবিধি রচনা করবাে যা এর ভিতরে রয়েছে, কাল্পনিক নয়; অর্থাৎ আমাদের চতুর্দিকে সংঘটিত ঘটনার আভ্যন্তরীণ যােগসূত্র বের করবাে।”
সভাপতি মাও ইতিহাসের প্রক্রিয়াকে বুঝবার নির্দেশ দিয়েছেন; মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সংশােধনবাদ এবং দুনিয়ার সকল প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে বােঝা অতিশয় প্রয়ােজন। “কুওমিনটাং-এর ব্যাপারটা কি? এর অতীতের দিকে তাকাও, তাহলে এর বর্তমান বলতে পারবে, এর অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকাও তাহলে এর ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।”
শ্রেণী সংগ্রাম একটি বস্তুগত বাস্তবতা। সঠিক ধারণা সর্বদাই ভুল ধারণা থেকে পৃথক থাকবে এবং ভুল ধারণার সাথে সংগ্রামের মাঝ দিয়ে বিকাশ লাভ করবে। সভাপতি মাওয়ের সর্বহারা লাইনের প্রতি আনুগত্যের সাথে এর বিরােধী লাইনের সংগ্রাম, সর্বহারার বিশ্বদৃষ্টিকোণের সাথে বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণের সংঘাত এবং সঠিক ধারণার সাথে ভুল ধারণার সংঘাত-এ দ্বন্দগুলাে সর্বদাই রয়েছে। গতির প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ এবং সময়মত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা প্রয়ােজন যাতে বিভিন্ন স্তরের অগ্রসর ব্যক্তিদের মাঝে এবং জনগণের মাঝে যে সকল মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে তার মীমাংসা হয় এবং চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ আমরা অবশ্যই মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে ব্যবহার করবাে আমরা যে কাজ করেছি তা পরীক্ষা করার জন্য; বিকাশের সময় যে সকল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে তার সার্বিক বিশ্লেষণ করবাে, সঠিক ও ভুলের। মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করবাে, ন্যায়পরায়ণতার সাথে সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করবাে, বিশেষ করে আত্মসমালােচনা করবাে এবং সত্যিকারভাবে মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাথে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা আঁকড়ে ধরবাে এবং মাওসেতুঙ চিন্তাধারার যা পরিপন্থী তা ধিকৃত ও বর্জন করবাে। অভিজ্ঞতার সারসংকলন দ্বারা আমাদের ও শত্রুর
পৃষ্ঠা: ৯১
মাঝের দ্বন্দ্ব, জনগণের মাঝের দ্বন্দ্ব অধিকতর ভালােভাবে বুঝতে পারবাে, এ দু’ধরনের দ্বন্দ্বের মাঝে পরিষ্কার পার্থক্যরেখা টানতে পারবাে, মােটামুটি বাস্তব অবস্থার সাথে খাপ খায় এরূপ উপযুক্ত বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবাে।
বাস্তব অবস্থা হলাে আমাদের প্রত্যেকের কাজের সঠিকতা ও ভুল-ভ্রান্তি, অবদান (achievement) এবং সীমাবদ্ধতা (shortcomings)। আমরা সঠিক ধারণাকে এগিয়ে নেবাে এবং ভুলকে অতিক্রম করবাে। এটা আমাদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে সহায়তা করবে-যে ঐক্যের ভিত্তি হলাে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা। অহঙ্কার ও আত্মতুষ্টি করার খারাপ অভ্যাস, নিজের সদগুণের গর্ব করা, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, নিজের মত থেকে স্বতন্ত্র মতকে উড়িয়ে দেওয়া, মুখে এক কথা বলা, কাজে অন্য করা ও সবকিছুর উর্ধে নিজের স্বার্থকে স্থান দেওয়ার খারাপ অভ্যাস, সব কিছুতেই একগুঁয়ে মনােবৃত্তি নিয়ে চলা, এগুলাে হলাে বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিকোণের প্রকাশ ও সঠিক অভিজ্ঞতার সারসংকলনের পথে বিরাট বাধা এবং এ কারণে এগুলােকে সমালােচনা ও বর্জন করতে হবে।
সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন, “আমরা অবশ্যই একটি স্থানের জনগনের অগ্রসর অভিজ্ঞতাকে সাবধানতার সাথে খুঁজে নেবাে, এর সারসংকলন করবাে এবং তাকে জনপ্রিয় করবাে। সকল স্থানেই মােটামুটি অগ্রসর সাংগঠনিক একক রয়েছে। আমরা অবশ্যই গভীরভাবে ভাসাভাসা নয়, অনুসন্ধান ও অধ্যয়ন করবাে, নিজ হাতে তথ্য সংগ্রহ করবাে, ন্যায়পরায়ণতার সাথে বারবার অনুসন্ধান করবাে, তথ্য সংগ্রহ করবাে এবং সভাপতি মাও-এর নির্দেশ পালনের উদাহরণ স্থাপন করবাে। বিশেষ অগ্রসর অভিজ্ঞতা সার্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ এবং বুঝবার পক্ষে খুবই সহায়ক।”
সভাপতি মাও বলেছেন, “যে কোন সমাজ যেখানে শ্ৰেণী আছে সেখানে শ্রেণী সংগ্রাম। শেষ হবে না। শ্রেণীহীন সমাজে নতুন ও পুরাতনের মাঝের দ্বন্দ্ব এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝের দ্বন্দ্ব শেষ হবে না।”
“উৎপাদন ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সংগ্রামে মানবজাতি এবং প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, তারা কখনাে একই স্তরে নিশ্চল থাকে না। অতএব মানবজাতিকে সর্বদাই অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে হয় এবং আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সৃষ্টি ও অগ্রগতি সাধন করতে হয়। নিশ্চলতা, হতাশা, নিষ্ক্রিয়তা এবং অহঙ্কার সবই ভুল।” -সভাপতি মাও-এর এ দূরদর্শী বৈজ্ঞানিক থিসিস যা মানব সমাজের ও প্রকৃতির ইতিহাসের সাধারণ গতিধারার নির্দেশ করেছে, তা বিপ্লবী অনুশীলন পরিচালনার জন্য বিপ্লবী অভিজ্ঞতার সারসংকলনের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে।
পৃষ্ঠা: ৯২
মতাদর্শগত পুনর্গঠনের জন্য দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়ােগ
(১৯৭০)
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল প্রকাশক।]
একটি নিবন্ধের ভিত্তিতে
আমাদের একটা মহান দায়িত্ব হলাে কর্মীদের মাঝে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কাজ করে তাদের মতাদর্শগত দিক এগিয়ে নেয়া। এটা করা যায় তাদেরকে মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত করে, সর্বদাই সর্বহারার মতাদর্শকে সুসংবদ্ধ ও বৃদ্ধি করে এবং সকল প্রকার অসর্বহারা মতাদর্শকে বর্জন করে। এভাবে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা কর্মীদের মাঝে আরও দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়বে এবং পশ্চাদগামী কমরেডগণ অগ্রসর কমরেডে পরিণত হবেন, অগ্রসর কমরেডগণ আরও বেশী অগ্রসর হবেন। এই কাজ ভালভাবে করতে গেলে একজনের সর্বপ্রথম বিপ্লবী সংগঠন এবং কর্তব্যের জ্ঞান থাকতে হবে, সর্বদাই পার্টির কথা মনে রাখতে হবে, পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে এবং কর্মীদের আজীবন বিপ্লবীতে পরিণত করতে সচেষ্ট হতে হবে। এ ছাড়াও একজনকে সঠিক চিন্তাধারা ও কাজের পদ্ধতি অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরতে হবে।
আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি যে, যখন আমরা আমাদের কাজে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রয়ােগ করি তখন আমরা ভাল ফল পাই। আর যখন আমরা অধিবিদ্যা এবং আত্মগত একতরফাবাদের শিকারে পরিণত হই তখন আমরা নিজেদেরকে একটি ঘােরপাকে ফেলি; আমরা যত কঠোরভাবেই কাজ করি না কেন কিছুতেই আশান্বিত ফল পাই না।
অনগ্রসর কর্মীদের সঠিক বিশ্লেষণ করুন
অনগ্রসর কমরেডদের প্রতি অন্ধকার মনােভাব পােষণ করলে চলবে না। সচেতনভাবেই হােক আর অচেতনভাবেই হােক তাদের প্রতি অমনােযােগ প্রদর্শন করলে, অতিশয় সমালােচনামুখর হলে তারা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে এবং অন্যান্য কমরেডও তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়বে। “এক নিজেকে দুইয়ে বিভক্ত করে”-এই তত্ত্বের ভিত্তিতে তাদের মূলগত বিশ্লেষণ করতে হবে। তাদের ক্রটিকে বাড়িয়ে দেখলে এবং তাকে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ, শােধরানাে যাবে না মনে করলে, গৌণ ক্রটিকে প্রধান এবং ছােটখাট বিষয়কে আসল বিষয় মনে। করলে তাদের শােধরানাের ব্যাপারে আমরা হতাশ হয়ে যাবাে।
আমরা তার খারাপ ও ভাল দিক খুঁজে বের করবাে এবং তাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ
পৃষ্ঠা: ৯৩
করবাে। এটা কর্মীদের কাছে স্পষ্ট করে তুলবে যে তার ভাল দিকগুলাে বেশী, খারাপ দিকগুলাে কম। এইরূপ বিশ্লেষণ দ্বারা তার প্রতি কর্মীদের জন্য ধারণার সৃষ্টি হবে এবং তারা অন্য মনােভাব গ্রহণ করবে।
আমরা বারবার তার ভাল দিকগুলাের উল্লেখ করে প্রশংসা করবাে এবং তার ত্রুটিগুলাে দূর করার জন্য একটি একটি করে শত্রু ধ্বংস করার পদ্ধতি অনুসরণ করে এক সময় একটির বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের অভিযান পরিচালনা করবাে। এভাবে উৎসাহ এবং সাহায্য পেয়ে অনগ্রসর কর্মীরা উদ্দীপিত ও উৎসাহিত হবে এবং অনেক উন্নতি করবে।
এ থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি যে, আমাদের কমরেডদের সম্পর্কে মূলগত বিশ্লেষণ করতে হবে। সকল কমরেডদের চিন্তাধারাকে দুটি দিকে ভাগ করা যায়, তাদের ইতিবাচক দিকও আছে এবং নেতিবাচক দিকও আছে, শক্তিশালী দিকও আছে, দুর্বলতার দিকও আছে। এ দিকগুলাে কখনও সমান নয়। সাধারণতঃ ইতিবাচক দিকগুলাে সর্বদা প্রধান ও আসল। অগ্রসর কমরেডদের তুলনায় পশ্চাদপদ কমরেডদের বেশী দুর্বল দিক রয়েছে এবং তাদের উন্নতি ধীরগতিতে হয়। কিন্তু এতে এটা বুঝা যায় না যে, তাদের নিষ্ক্রিয় দিক আসল বা প্রধান দিক।
পশ্চাদপদ কমরেডদের মূলগত বিশ্লেষণের পর তাদের প্রতি একটা শ্রেণী সমতাবোেধ জাগবে এবং অগ্রসর হবার জন্য তাদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় জন্মাবে। এ প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়া, বিষয়গুলাে আতাগত এবং একতরফাভাবে দেখলে একজন অবশ্যই তাদের ক্রটিকে বিরাট করে দেখবে ও হতাশার শিকারে পরিণত হবে এবং সাহায্য করার স্পৃহা হারাবে।
পশ্চাদপদ কমরেডদের মূলগত বিশ্লেষণ করলে তারা নিজেদের সম্বন্ধে একটি সঠিক পরিমাপ করতে পারবেন। এ সকল কমরেড অনেক সময় হতাশ হয়ে নিজেদের সম্বন্ধে একতরফা মনােভাব গ্রহণ করেন এবং অগ্রসর হওয়ার বিশ্বাসের অভাবে ভােগেন। নেতৃত্ব এসব কমরেডদের প্রতি বিশ্বাস রাখলে তাদের নিজেদের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসবে, তারা বেশী উৎসাহ লাভ করবে এবং অতিমাত্রায় উন্নতি লাভ করবে। কিন্তু নেতৃত্ব যদি তাদের প্রতি আস্থা হারায় তাহলে তারা হতাশ হয়ে পড়বে এবং তাদের উন্নতি আরাে ধীর গতিতে হবে।
অনগ্রসর কর্মীদের অগ্রসর হবার প্রাক্কালে তাদের মনােবলের যে উঠানামা হয় তা আমাদের বিবেচনা করতে হবে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও কাজের পদ্ধতি নির্ণয় করার সময়।
মতাদর্শগত পুনর্গঠনের জন্য পশ্চাদপদ কমরেডদের নিজেদের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা
সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন যে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে “বাহ্যিক কারণ পরিবর্তনের শর্ত, আভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি; আভ্যন্তরীণ কারণের মাধ্যমে বাহ্যিক কারণ সক্রিয় হয়।” পশ্চাদপদ কমরেডদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে তাদের নিজেদের মনে যুদ্ধ করার এবং নিজেদের ইচ্ছায় পরিবর্তিত করার প্রেরণা দেয়া। এভাবে কেবলমাত্র নিজেদের উদ্যোগে এ প্রকার যুদ্ধ করে তারা তাদের মনের সর্বহারা মতাদর্শ দ্বারা অসর্বহারা মতাদর্শকে ধ্বংস করতে পারবে এবং তারা নিজেদেরকে পশ্চাদপদ স্তর থেকে অগ্রবর্তী স্তরে উন্নীত করতে পারবে। যদি তারা এ ধরনের যুদ্ধ নিজেদের বিরুদ্ধে
পৃষ্ঠা: ৯৪
করে এবং কেবলমাত্র তাদের বিরুদ্ধে অন্য কর্তৃক পরিচালিত সংগ্রামের মােকাবেলা করে তাহলে শুধুমাত্র-যে যুদ্ধ বিফলে যাবে তাই নয় কমরেডদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হবে এবং সকল বিষয়টি একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থায় পরিণত হবে।
অন্যদিকে বাহ্যিক কারণ বস্তুর বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেতৃত্ব এবং কমরেডদের প্রদত্ত সাহায্য একটি পশ্চাদপদ কমরেডের পরিবর্তনে বিরাট প্রভাব ফেলে। কোন অবস্থায়ই আমরা বাহ্যিক অবস্থাকে বাদ দিয়ে আভ্যন্তরীণ কারণকে অতিমাত্রায় জোর দেব না, যাতে আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি অথবা পশ্চাদপদ কমরেডদের সাহায্যের জন্য আমাদের চেষ্টায় ঢিল দিতে পারি। কাজেই আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে বাহ্যিক কারণ সক্রিয় হতে পারে আভ্যন্তরীণ কারণের মাধ্যমে। এ সকল কমরেডদের সাহায্য করার সময় তাদের সমস্যাকে আমরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবাে, খুঁজে বের করবাে কোনটা তাদেরকে সবচেয়ে বেশী অসুবিধায় ফেলছে। তাদেরকে উৎসাহিত করবাে বুর্জোয়া ভাবধারার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম করতে এবং বুর্জোয়া ভাবধারা দূর করে সর্বহারা মতাদর্শ গ্রহণ করতে এবং তাদের রাজনৈতিক চেতনা উন্নত করতে।
পশ্চাদপদ কমরেডদের মতাদর্শগত সংগ্রামে সাহায্য করতে গিয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে মূল সমস্যাকে আঁকড়ে ধরবাে, যা হলাে তাদের বিশ্বদৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করা। এটা বুঝায় যে আমরা সর্বপ্রকার চেষ্টা করবাে এ সকল কমরেডদের মাঝে অল্প অল্প করে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা ঢােকাতে। আমরা অবশ্যই তাদের সাহায্য করবাে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা শেখাতে এবং জীবন্তভাবে প্রয়ােগ করতে, যাতে তারা তাদের প্রধান সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমরা তাদের উৎসাহিত করবাে যখন তারা মাওসেতুঙের বই পড়ে, তাদের প্রশংসা করবাে যখন তারা যতটুকু শিখেছে তা প্রয়ােগ করতে চেষ্টা করে। আমরা তাদের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করবাে যাতে তারা তাদের শিক্ষাকে ভালভাবে প্রয়ােগ করতে পারে। আমরা তাদের সর্বদাই উৎসাহিত করবাে তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সংযুক্ত করতে। বিশেষ করে বেশী জোর দেব প্রয়ােগ করতে এবং সর্বদাই মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে তাদের অসর্বহারা চিন্তাকে সমালােচনা ও বর্জন করতে। এভাবে ধীরে ধীরে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা তাদের মাঝে শেকড় গাড়বে এবং তাদের মাঝে প্রধান দিকে পরিণত হবে এবং তারা পশ্চাদপদ থেকে অগ্রবর্তী কমরেডে পরিণত হবে।
পশ্চাদপদ কমরেডদের তাদের মনের মধ্যে যুদ্ধ করতে সাহায্য করার সময় আমরা অবশ্যই তাদের প্রত্যেকের বৈশিষ্টসমূহ অনুধাবন করবাে। কারাে হয়ত বেশী সমস্যা রয়েছে, কারাে বা কম। এভাবে কমরেডদের পার্থক্যকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তাদের প্রত্যেকের বিষয়কে আলাদা করতে হবে। যদি আমরা সকলকে সম্পূর্ণ এক রকম মনে করি তাহলে কোন কাজ হবে না। যদি আমরা প্রতিটি বিষয় তার গুরুত্ব অনুযায়ী অনুধাবন না করি এবং “চাউল ও ভূট্টা একই পাত্রে সেদ্ধ করি তার ফল হবে। অর্থহীন। অর্থাৎ চাউল হবে বেশী সেদ্ধ, ভূট্টা হবে কম সেদ্ধ।
পশ্চাদপদ কমরেডদের সাহায্য করার সময় সাংগঠনিক এককের উপর নির্ভর করাও প্রয়ােজন। জনগণকে জাগরিত এবং একককে লাল স্কুলে পরিণত করতে হবে। এভাবে একটা সুবিধাজনক অবস্থা হবে, যেখানে অনগ্রসর কমরেডরা অগ্রসর হবার সুযােগ পায়। অর্থাৎ কমিটিতে একটি সুন্দর অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যেখানে সবাই অধ্যবসায়ের সাথে সভাপতি মাওয়ের রচনাবলী পাঠ করে এবং সবাই সকল কাজে রাজনীতিকে সামনে
পৃষ্ঠা: ৯৫
রাখে এবং সমস্যা সমাধানের নীতির প্রতি অটল থাকে। একজনের ক্রটি ও সমস্যা সকলের চিন্তার বিষয় হবে এবং কমরেডদের সাহায্য করার জন্য সব দিকেই হাত প্রসারিত থাকবে। আমরা যদি এককের সদস্যদের উপর নির্ভর না করি এবং তাদের জাগরিত না করি তা হলে আমরা পশ্চাদপদ কমরেডদের পরিবর্তন করতে ভাল ফল পাবাে না।
অনগ্রসর থেকে অগ্রসরে রূপান্তরিত হওয়া একটি বারংবার সংগ্রামের প্রক্রিয়া
পশ্চাদপদ থেকে অগ্রবর্তী হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার নয়। এটা সর্বদাই একটি দীর্ঘস্থায়ী দুরূহ প্রক্রিয়া। সর্বহারার দৃষ্টিকোণ লাভ করতে হলে একজনকে অবশ্যই অসর্বহারা মতাদর্শ দূর করতে হবে। একটি কঠোর কর্মপদ্ধতি রপ্ত করতে হলে একজনকে অবশ্যই বিলাসিতা দূর করতে হবে এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ গড়ে তুলতে হলে একজনকে অবশ্যই অধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ ত্যাগ করতে হবে।
যদিও এ সকল পশ্চাদপদ কমরেডদের পুরােনাে ধারণা ও অভ্যাস এদের চরিত্রের প্রধান দিক নয় তবুও তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তাদের কিছু কিছু অনেক আগের সৃষ্টি এবং তা তাদের মাঝে গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। পুরােনাে ধারণা ও অভ্যাসকে পরিবর্তন করে নতুন ধারণা ও অভ্যাস রপ্ত করা একটি কষ্টকর বিষয়। মার্চ করার কথাই ধরা যাক; সামরিক বাহিনীতে এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার। কিন্তু যে সব কমরেড সামরিক বাহিনীতে যােগ দেওয়ার পূর্বে সামান্য দূরত্বও বাসে যেতেন তাদের জন্য তিরিশ মাইল হাঁটা বাস্তবিকই কষ্টকর। এই হঠাৎ পরিবর্তন মুত্যুর মতাে তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে একটি বড় রকমের অন্তর্দ্বন্দ্বে। এটা আশ্চর্য নয়। কিছু কমরেড অভিযােগ করবে এবং পশ্চাতে পড়ে রবে। কেবলমাত্র বাধাবিঘ্নের সাথে বারংবার সংগ্রাম করে এবং অনুশীলনে অভিজ্ঞ হয়ে তারা কষ্ট বা পরিশ্রমকে ভয় না করার মনােবৃত্তি লাভ করতে পারে। পরিবর্তনের এই দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও দূরূহতা সম্বন্ধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। অকারণে দ্রুত বিজয় অর্জনের ইচ্ছা করলে চলবে না। এটা আশা করলে হবে না যে অনগ্রসর কমরেডদের সব ত্রুটি দূর করে এক রাতেই প্রথম শ্রেণীর কমরেডে পরিণত হবে। একজন পাচক যে অতি সত্বর রান্নার জন্য চুলােয় কেবল আগুন দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু লক্ষ্য করছে না পাতিলের ভাত এ আগুন সহ্য করতে পারবে কিনা, আমরা তেমনি তাড়াহুড়াে করে কিছুই অর্জন করতে পারবাে না এবং পশ্চাদপদ কমরেডগণ আরাে হতাশ হয়ে যাবে। অনগ্রসর থেকে অগ্রসরে পরিবর্তন পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। দ্রুত উন্নতি, দ্রুত অতিক্ৰমণ সম্ভব হয় পরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌঁছলে।
প্রথম দিকে পশ্চাদপদ কমরেডগণ অগ্রসর কমরেডদের তুলনায় পরিষ্কারভাবে দেখতে পারে না অথবা সঠিকভাবে সমস্যার মােকাবেলা করতে পারে না। কোন কোন সময় তাদের চিন্তা ও কাজের অসংলগ্নতা প্রকাশ পায়। কোন কোন কমরেড কাজ করতে। যেয়ে অন্যকে কেবল অনুসরণ করেন।এর কারণ তাদের পূর্ণ রাজনৈতিক সজাগতার অভাব রয়েছে। কোন কোন কমরেড তাদের বুঝবার ক্ষমতার উন্নতি করেছেন, কিন্তু তাদের কাজ তাদের চিন্তার চেয়ে পশ্চাদপদ। যদিও পশ্চাদপদ কমরেডদের এ পরিবর্তন
পৃষ্ঠা: ৯৬
এমন একটা বড় কিছু নয় কিন্তু তবুও এটা তাদের অগ্রসর হওয়ার লক্ষণ। অগ্রগতির এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলােকে তাদের পরিবর্তনের সূচনা বলে ধরে নিয়ে আমরা অবশ্যই কষ্টকর ও পদ্ধতিগত কাজ করবাে এবং তাদের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য উৎসাহিত করবাে। যখন তারা অপর্যাপ্ত উপলব্ধি ছাড়া একটা ভাল কাজ করে তখন আমরা তাদেরকে অবহেলা করবাে না। আমরা তাদের রাজনৈতিক মানকে উন্নত করার চেষ্টা করবাে। ওই সকল কমরেড যাদের রাজনৈতিক মান উন্নত হয়েছে কিন্তু যাদের কাজ এখনও তাদের উপলব্ধির চেয়ে পশ্চাদপদ, তাদেরকে আমরা এই বলে দোষারােপ করবাে না যে তাদের কথায় ও কাজে মিল নেই। বরঞ্চ তাদেরকে উৎসাহিত করবাে সঠিক চিন্তাধারা দ্বারা তাদের কাউকে পরিচালিত করার জন্য। যদি আমরা এর উল্টো করি তবে আমরা সঠিকভাবে সময়মত তাদেরকে অগ্রগতির পথে চালিত করতে পারবাে না। সাধারণভাবে বলতে গেলে পশ্চাদপদ কমরেডগণ তাদের অগ্রগতির পথে বিপর্যয় অনুভব করবে। তাদের চিন্তার স্ত রের উঠানামা হবে। এটা সাধারণ যে কয়েকটি বিপর্যয় ব্যতীত পুরােনাে ধারণা ও অভ্যাস সম্পূর্ণরূপে মীমাংসা করা যায় না এবং সভাপতি মাওসেতুঙের চিন্তাধারা গভীরভাবে তাদের মনে শিকড় গাড়তে পারবে না। কেবলমাত্র তাদের এই বিপর্যয় স্বীকার করে এবং তাদেরকে বুঝে, তাদের পিছনের কারণ খুঁজে বের করে এবং মানুষের মতাদর্শগত পরিবর্তনের নিয়মাবলী আবিষ্কার করে আমরা বিপর্যয়সমূহ খুবই কমাতে পারি।
মতাদর্শগত পুনর্গঠন খুবই জটিল। আমাদের চিন্তায় ও কাজে আমরা অবশ্যই তাকে খুবই সহজভাবে গ্রহণ করবাে না। আমরা দৃঢ়ভাবে পশ্চাদপদ কমরেডদের সাহায্য করার কাজ আঁকড়ে ধরবাে এবং লেগে থাকবাে শেষ পর্যন্ত। আমরা অবশ্যই একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করবাে এবং চিন্তা করবাে না যে সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে একরাতে। শুরুতে তাদের উৎসাহিত করবাে পুরােনাে ধারণার বিরুদ্ধে বিক্রমের সাথে লড়াই করতে; যখন তারা বিজয় অর্জন করবে তখন আমরা অবশ্যই তাদেরকে আহ্বান জানাবাে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। যখন তাদের মধ্যে প্রগতিশীল ধারণা প্রধান দিকে পরিণত হয়েছে তখন তাদেরকে আহ্বান জানাবাে ঢিলে না দিতে। আমরা তাদেরকে অবশ্যই উৎসাহিত করবাে এবং শিক্ষা দেব যাতে তারা নেতিবাচক দিক প্রধান হলে হতাশ না হয়ে যায়। আমরা সকল অবস্থায় পশ্চাদপদ কমরেডদের সাথে এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে” এ তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যবহার করবাে। আমরা তাদেরকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মনে করবাে না যদি তারা কিছুটা উন্নতি করেন, আমরা বিশ্বাসও হারাবাে না যে তাদের ক্রটি রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত তাদেরকে উৎসাহিত করবাে তাদের মতাদর্শকে বিপ্লবী করতে।
অগ্রসর কমরেডদের প্রতি এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে” এ পদ্ধতি প্রয়ােগ করে তাদেরকে আরাে অগ্রসর করা
অগ্রসর এবং অনগ্রসর হলাে বিপরীতের একত্ব এবং আপেক্ষিক ও পরস্পর রূপান্তরযােগ্য। পশ্চাদপদ কমরেডগণ অগ্রসর হতে পারেন এবং অগ্রসররা আরাে অগ্রসর হতে পারেন অথবা পশ্চাদপদ হয়ে যেতে পারেন। সে কারণে আমরা অগ্রসর কর্মীদের “এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে” এ তত্ত্ব দ্বারা বিচার করবাে যাতে তাদেরকে আমরা আরাে অগ্রসর হতে সাহায্য করতে পারি এবং তাদের পশ্চাতে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারি।
পৃষ্ঠা: ৯৭
অগ্রসর কর্মীদের মূল্যায়ন করার সময় আমরা এই ধরনের একতরফাবাদী ভুল করবাে না। প্রথম হলাে তাদেরকে পূর্ণ সঠিক ভেবে দেখলে চলবে না, তাদের দুর্বলতাকেও দেখতে হবে। দ্বিতীয়টি হলাে আমরা এক-আধটি ত্রুটিপূর্ণ কমরেডদের পশ্চাদপদ বলে চিন্তা করবাে না।
কমরেডদের মূল্যায়নে এ প্রকারে ক্রটি হবে না যদি আমরা “এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে” এ পদ্ধতি প্রয়ােগ করি। অগ্রসর কর্মীদের বেশী শক্তিশালী দিক আছে এবং তাদের শ্রেণী চেতনা অনেক উঁচু। কিন্তু তাদেরও অসর্বহারা চিন্তাধারা এবং ক্রটি রয়েছে। যেটা আরাে গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে তারা সহজেই আত্মতুষ্টি লাভ করে এবং মতাদর্শগত পুনর্গঠনের কাজে ঢিল দিতে পারে। আমাদের অবশ্যই তাদের শক্তিশালী ও দুর্বল দিক, উভয়ই জানতে হবে এবং তাদেরূ প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখাবাে না এবং তাদের ত্রুটিকে এড়িয়ে যাবাে না; আমরা তাদেরকে শিক্ষা দেব নিজের প্রতি এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে”-এ মনােভাব গ্রহণ করতে। আমরা তাদেরকে শিক্ষা দেব যাতে তারা অবিচ্ছিন্নভাবে বিপ্লব করে যেতে পারে। আমরা আমাদের দায়িত্ব গুরুত্ব সহকারে নেব এবং তাদের জন্য শক্ত মাপকাঠি প্রয়ােগ করবাে এবং তাদেরকে সাহায্য করবাে তাদের দুর্বল দিকগুলাে কাটিয়ে উঠতে। আমরা তাদেরকে বলবাে সভাপতি মাওয়ের রচনাবলীর প্রতি আরাে বেশী নজর দিতে, তা পাঠ করার জন্য অধিকতর সময় ব্যয় করতে, তা আরাে গভীরভাবে বুঝতে এবং ভালােভাবে প্রয়ােগ করতে। তাদের সাহায্য করতে যেয়ে আমরা তাদের মূল বিষয়গুলাে আঁকড়ে ধরবাে। যদি আমরা ছােটখাট ব্যক্তিগত ত্রুটির জন্য তাদের দোষ ধরি, তারা মনােবল হারাবে এবং অতি সাবধানী হয়ে যাবে এবং প্রধান বিষয়ের প্রতি মনােনিবেশ করতে পারবে না।
বাস্তব অনুশীলনে আমাদের এ ধরনের একতরফাভাব থাকলে চলবে না অর্থাৎ অগ্রসর কমরেডদের সর্বদা সম্পূর্ণ সঠিক হিসেবে চাইলে চলবে না। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বাে না যখন তাদের এক-আধটি ক্রটি দেখতে পাই। এই একতরফাভাব বিশেষভাবে প্রকাশ পেতে পারে যারা পূর্বে পশ্চাদপদ কমরেড ছিল তাদের প্রতি। এক-আধটি ত্রুটির জন্য তাদের সম্পূর্ণ রেকর্ড খারাপ লিখে দিলে চলবে না এবং তাদের উৎসাহ নিভিয়ে দিলে চলবে না।
এটা অবশ্যই সঠিক যে অগ্রসর কর্মীদের জন্য একটি শক্ত মানদণ্ড ঠিক করা, কিন্তু এই মানদণ্ড অর্জনসাপেক্ষ হতে হবে, যুক্তিযুক্ত হতে হবে এবং সীমার বাইরে নয়। আমরা তাদের ক্রটির বিশ্লেষণ করবাে। কিন্তু আমরা ছােটখাটো ত্রুটিকে গভীর নীতিগত ত্রুটি বলে ভুল করবাে না; দুর্ঘটনাবশতঃ ক্রটিকে গভীর শিকড়বিশিষ্ট ক্রটি বলে মনে করবাে না, বাস্তব অসবিধাকে মতাদর্শগত সমস্যা বলে মনে করবাে না। কেবলমাত্র যখন। আমরা বিষয়গুলাে এভাবে মীমাংসা করবাে তখনই তাদের উৎসাহকে জাগানাে যায় এবং তাদের দুর্বল দিকগুলাে দূর করা যায়।
অগ্রসরদের আরাে বেশী অগ্রসর হতে সাহায্য করতে যেয়ে আমরা শুধু তাদের দুর্বল দিকগুলাের প্রতি গভীর নজর দেব তাই না, তাদের মাঝের শক্তিশালী দিকগুলাের প্রতি নজর দেব। আমরা তাদের সাহায্য করবাে এ সকল শক্তিশালী দিকগুলাে বিকাশ লাভ করাতে এবং তা যাতে অধিক প্রাধান্য লাভ করে।
যখন তারা তাদের শক্তিশালী দিকের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং সভাপতি মাওয়ের লাল পতাকাকে আরাে উর্ধে তুলে ধরেছে তখন তাদের নেতিবাচক দিকগুলাে দূর করার জন্য তারা তাদের উদ্যোগ এবং শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে।
পৃষ্ঠা: ৯৮
সর্বহারা মতাদর্শ আয়না হিসেবে ব্যবহার করে আমরা অসর্বহারার মতাদর্শকে অবশ্যই চিনতে সক্ষম হবাে এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করে আমরা ভাববাদী চিন্তাধারাকে পরিষ্কারভাবে চিনতে সক্ষম হবাে। অগ্রসর কর্মীদের প্রগতিশীল দিকগুলােকে যদি আমরা অবহেলা করি এবং আমাদের মনােযােগ কেবল তাদের খারাপ দিকের দিকে দেই তবে তারা বিভ্রান্ত হবে এবং দিশা হারিয়ে ফেলবে-দুর্বল ও অতি সাবধানী হয়ে যাবে। তারা তাদের সবল দিকগুলাের বিকাশে বাধাগ্রস্ত হবে, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারবে না।
অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখি যে, যখন আমরা অগ্রসর কমরেডদের ত্রুটি দূর করতে সাহায্য করি, তখন আমরা একই সঙ্গে তাদের ভালাে দিকের বিকাশ ঘটাবাে। আমরা তাদের শিক্ষা দেব, তাদের ভাল দিকগুলােকে আরাে বিকাশ ঘটাতে, চেষ্টা করবাে তাদের বিপ্লবী সৃজনশীলতাকে পূর্ণভাবে বের করতে এবং তারা যাতে আরাে অগ্রসর হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা ত্রুটিমুক্ত হয়। এভাবে একটি শক্তিশালী আন্দোলনের সূচনা হয়। অগ্রগামীদের অনুকরণের জন্য, তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য, তাদের সমকক্ষতা অর্জন করার জন্য।
অনগ্রসর কমরেডদের অগ্রসর কমরেডে পরিণত করতে এবং অগ্রসরদের আরাে অগ্রসর করতে গেলে আমরা বুঝতে পারবাে যে, এটা অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং বুঝবার। স্তর উন্নত করার অবিরাম প্রক্রিয়া। সভাপতি মাওয়ের রচনাবলী অধ্যয়ন এবং প্রয়ােগ করে নিজেদের মতাদর্শকে আরাে বিপ্লবী করতে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে এবং সর্বান্তকরণে প্রচেষ্টা চালাতে হবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিকোণ অধিকতর ভালভাবে লাভ করতে এবং অধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণ দূর করে কর্মীদের মতাদর্শগতভাবে উন্নত করতে।
পৃষ্ঠা: ৯৯
কমিউনিস্ট হওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয়
সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি দানদণ্ড
(১৯৭০)
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
“Communist should be the Advanced Elements of the pro-letariat”. Foreign Language Press, Peking- প্রবন্ধ অবলম্বনে
সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “পার্টি সংগঠন গঠিত হবে সর্বহারার অগ্রসর ব্যক্তিদের নিয়ে; একে হতে হবে প্রাণপূর্ণ অগ্রগামী একটি সংগঠন যা সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবী জনগণকে শ্ৰেণী শক্র বিরােধী সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম।” পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি গঠনের যে মহান ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমরা পালন করছি তা বলতে বুঝায় সর্বহারা বিপ্লবী অগ্রগামীদের তৈরী করা এবং সুসংবদ্ধ করা, বাকিটা বর্জন করা, টাটকাটা গ্রহণ করা, সকল স্তরের পার্টি সংগঠনকে সংগ্রামের দুর্গ হিসেবে সুসংবদ্ধ করা এবং ব্যাপক পার্টি কর্মীদের বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পরীক্ষিত করে তােলা।
সর্বহারা অগ্রসর লােকদের কি কি মানদণ্ড রয়েছে? তা হলাে সভাপতি মাওয়ের। পাঁচটি মানদণ্ড যা সভাপতি মাও উল্লেখ করেছেন এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সংবিধানে গ্রহণ করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিও এটা গ্রহণ করেছে তার সংবিধানে। এ সকল মানদণ্ড অর্জনের জন্য কর্মীরা অবশ্যই প্রচেষ্টা চালাবেন যাতে তারা ভাল কমিউনিস্ট হয়ে জনগণের অধিকতর সেবা করতে পারেন।
প্রথমঃ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা সৃজনশীলভাবে অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করা।
এটা উল্লেখ করেছে আমাদের চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক লাইনের পথ নির্দেশের। ভিত্তিতে। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “কেডারদের শিক্ষিত করতে হবে যাতে তারা কিছুটা মার্কসবাদ রপ্ত করে, এটা আরাে ভালাে হবে যদি তারা আরাে অধিক রপ্ত করে। অর্থাৎ তারা মার্কসবাদের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে, সংশােধনবাদের জন্য নয়।” মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার সৃজনশীল অধ্যয়ন ও প্রয়ােগের উপর নির্ভর করেই সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রসর ব্যক্তিগণ পরিপক্ক হয়ে উঠবেন। নতুন পার্টি সদস্যগণ এবং সক্রিয় ব্যক্তিগণ যারা পার্টিতে যােগদান করতে উৎসাহী তারা অবশ্যই মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন করবেন। পুরােনাে কর্মীরাও একইভাবে কাজ করবেন,
পৃষ্ঠা: ১০০
বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কেডাররা অধ্যয়ন করবেন ন্যায়পরায়ণতার সাথে এবং অধ্যবসায়ের সাথে। তারা শিখবেন, তা প্রয়ােগ করবেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সারবস্তু হলাে বিপ্লব করা, শ্রেণী সংগ্রাম করা (বর্তমান পর্যায়ে জাতীয় ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রামের রূপ নিয়েছে, যেহেতু জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান-লেখক) এবং সর্বহারার একনায়কত্ব (সমাজতান্ত্রিক সমাজের জন্য প্রযােজ্য, বর্তমানে সর্বহারার নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক শ্রেণীসমূহের যৌথ একনায়কত্ব-লেখক) ব্যবহার করা।
সৃজনশীল অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ বলতে আমরা বুঝি তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সংযুক্ত করা, সর্বদা সভাপতি মাওয়ের বিপ্লবী লাইনের প্রতি অনুগত থাকা, শ্রেণী শত্রু (বর্তমানে জাতীয় ক্ষেত্রে জাতীয় শত্রু-লেখক), বাম ও ডানা বিচ্যুতি এবং নিজের মধ্যকার অসর্বহারা মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সাহসী হওয়া।
দ্বিতীয়ঃ
পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের জন্য কাজ করা। সভাপতি মাও আমাদেরকে শিক্ষা দেন, “আমরা অবশ্যই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ … … লােকদের স্বার্থে এবং বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের স্বার্থে কাজ করবাে, আমরা অবশ্যই অল্পসংখ্যক লােকদের স্বার্থে, বুর্জোয়াদের স্বার্থে, জমিদার, ধনী চাষী, প্রতিবিপ্লবী, খারাপ লােক বা দক্ষিণপন্থীদের স্বার্থে কাজ করবাে না।” ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে কমিউনিস্টরা অবশ্যই জাতীয় সংগ্রাম চালাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সকল প্রতিক্রিয়াশীল। পদলেহী কুকুরদের উৎখাত করার জন্য। তাদের সর্বশক্তি এমন কি জীবনও উৎসর্গীকৃত করবে বুর্জোয়া এবং অন্যান্য শােষক শ্রেণীসমূহ উৎখাত করা এবং মানবগােষ্ঠীর মুক্তির জন্য।
কিছু কিছু লােক জনগণের সেবার কথা প্রচার করে কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের নিজেদের শক্তিশালী দুর্গ, তাদের ছােট চক্র, বা তাদের নিজেদের সেবা করে। এরা সত্যিকার কমিউনিস্ট নয়। এদেরকে নেতার পদ দূরের কথা, নেতৃত্ব দানকারী সংস্থার সদস্য হতেও অনুমতি দেয়া উচিত নয়।
তৃতীয়ঃ
যারা ভুল করে বিরােধিতা করেছিলেন, কিন্তু আন্তরিকতার সাথে ভুল সংশােধন করেছেন এদেরকে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে ভাগ্যান্বেষী, ষড়যন্ত্রকারী এবং দুমুখখাদের বিরুদ্ধে যাতে করে এ ধরনের খারাপ লােকদের পার্টি ও রাষ্ট্রের যে কোন স্তরের ক্ষমতা দখল ঠেকানাে যায় এবং পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বদা মার্কসবাদী বিপ্লবীদের হাতে থাকে। পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের বিজয় অর্জন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন, সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও সুসংবদ্ধকরণের জন্য প্রয়ােজন ব্যাপক সংখ্যাধিক জনসাধারণের সাথে ঐক্য এবং “খারাপ লােকদের পার্টি ও রাষ্ট্রের যে কোন স্তরের ক্ষমতা দখল প্রতিহত করা।” সভাপতি মাও আমাদেরকে শিক্ষা দেন, “ব্যাপক জনসাধারণের সাথে এবং কেডারদের পঁচানব্বই ভাগের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়ােজন।”
পৃষ্ঠা: ১০১
কমিউনিস্টদের, বিশেষ করে পার্টির নেতৃস্থানীয় কেডারদের অবশ্যই সর্বহারার মনের প্রসারতা থাকবে। তারা অবশ্যই সাধারণ স্বার্থ এবং সামগ্রিক অবস্থাকে মনে রাখবে। তারা অবশ্যই উপলব্ধি করবে যে, “মানুষ বদলাতে পারে। যারা ভুল করেছে তাদেরকে আমরা উৎসাহিত করবাে ভুল সংশােধন করার জন্য এবং তাদেরকে সাহায্য করবাে। একবার যখন একজন তার ক্রটি ন্যায়পরাণয়তার সাথে সংশােধন করেছে, এর পরেও তার বিরুদ্ধে আমরা বিরামহীনভাবে সমালােচনা অবশ্যই চালিয়ে যাবাে না।
চতুর্থঃ
কোন সমস্যা দেখা দিলে জনসাধারণের সাথে পরামর্শ করুন। সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “কমিউনিস্টদের অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি নয় গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি থাকবে। যখন সমস্যা দেখা দেবে কমরেডদের সাথে পরামর্শ কর, পুরােপুরি আলােচনা কর, বিভিন্ন মতামত শােন, এমনকি যাদের বিরুদ্ধে মতামত রয়েছে তাদেরও বলতে দাও।” অর্থাৎ আমরা অবশ্যই “সবাইকে বলতে দাও”-এ অভ্যাস রপ্ত করবাে এবং “আমি যা বলি তাই একমাত্র সঠিক”- এ পদ্ধতিকে বিরােধিতা করবাে। “একটি সভায় হ্যা বলা এবং পরে কথা পাল্টিয়ে না বলা-এরূপ করবাে না।” কমিউনিস্টরা অবশ্যই জনগণের নিকট থেকে শিখতে ইচ্ছুক এরূপ ছাত্র হবে। জনগণের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করবে এবং “জনসাধারণের নিকট থেকে আসা-জনসাধারণের নিকট যাওয়া”-এ নীতিতে দৃঢ় থাকবাে।
পার্টি কেডারদের জন্য এটা আরাে অধিক প্রয়ােজন জনসাধারণের গভীরে যাওয়া, অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা করা, বিশেষ উল্লেখযােগ্য উদাহরণকে আঁকড়ে ধরা এবং সম্পূর্ণ কাজের এক-তৃতীয়াংশ প্রথমে আঁকড়ে ধরে কাজকে ভালভাবে সম্পন্ন করা।
অনেক জিনিস যা জনগণ কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে তা আমরা বুঝি না, আমরা তাদের। কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবাে এবং তাদের অগ্রসর অভিজ্ঞতাকে জনপ্রিয় করবাে।
পঞ্চমঃ
সমালােচনা-আত্মসমালােচনা চালাতে সাহসী হও। কেবলমাত্র সমালােচনা ও আত্মসমালােচনার মাধ্যমেই কমিউনিস্টরা নিজেদেরকে শুধরাতে পারে এবং নিজেদেরকে বিকশিত করতে পারে। সভাপতি মাও বলেছেন, “তুমি ভেবাে না যে তুমি একাই সবকিছু করতে পার, আর অন্যেরা কিছুই করতে পারে না, পৃথিবী তােমাকে ব্যতীত ঘুরা বন্ধ করে দেবে।” সর্বদাই কমিউনিস্টরা জনগণের নিকট নিজেদের মন খুলে দেবে এবং তাদের মতামতকে অভিনন্দন জানাবে; যদি একজন লােক ভুল করে থাকেন কিন্তু তৎক্ষণাৎ আত্মসমালােচনা করেন, অন্যের সমালােচনা আহ্বান করেন এবং ভুল সংশােধন করেন তাহলে তিনি একজন ভাল কমরেড।
এই পাঁচটি মাপকাঠি যা পার্টি সদস্যরা অবশ্যই অর্জন করবে তা সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়
প্রথমটি হলাে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং সভাপতি মাও-এর বিপ্লবী লাইনের প্রতি অনুগত হওয়া।
দ্বিতীয়টি হলাে জনগণের প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং তাদের উপর নির্ভর করা। তৃতীয়টি হলাে নিজেকে কঠোরভাবে যাচাই করা।
পৃষ্ঠা: ১০২
এই তিনটি প্রশ্নের সমাধান করা বলতে বুঝায় একজনের বিশ্বদৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করা এবং মতাদর্শগতভাবে পার্টিতে যােগদান করা। কেবলমাত্র সর্বহারার বিশ্বদৃষ্টিকোণ অর্জন করে এবং নিজেদের প্রতি পার্টি সদস্যদের অবশ্যই অর্জনীয় পাঁচটি মানদণ্ড মাপকাঠি হিসেবে কঠোরভাবে ব্যবহার করে তারা সর্বহারার অগ্রসর ব্যক্তিদের সারির যােগ্য হতে সক্ষম হবে। যত অধিক এ ধরনের অগ্রসর ব্যক্তিদের সংখ্যা হবে তত ভালভাবে পার্টি সংগঠন তাদের সংগ্রামী দুর্গের ভূমিকা পালন করবে এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হবে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এৰং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জিত হবে।
পৃষ্ঠা: ১০৩
সর্বহারার সর্বোচ্চ শ্রেণী সংগঠন হিসেবে পার্টি
[নিবন্ধটি ‘৭২ সালে প্রকাশিত “ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে” সংকলন-পুস্তিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটা অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]
স্ট্যালিনের রচনাবলী’র ভিত্তিতে
পার্টি হলাে শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিত বাহিনী। কিন্তু পার্টিই শ্রমিক শ্রেণীর একমাত্র সংগঠন নয়। সর্বহারার আরাে সংগঠন রয়েছে যা ব্যতীত তারা পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে না; ট্রেড ইউনিয়ন, সমবায়, কারখানা সংগঠন, পার্লামেন্টারী গ্রুপ, (পার্টি বহির্ভূত) মহিলাদের সমিতি, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা সংগঠন, যুবলীগ, বিপ্লবী সামরিক সংগঠন, সর্বহারার রাষ্ট্র প্রভৃতি। এ সকল সংগঠনের অধিকাংশ লােকই পার্টি বহির্ভূত। এদের মধ্যে সামান্য অংশই পার্টির সদস্য। বিশেষ অবস্থায় এ সকল সংগঠন শ্রমিক শ্রেণীর একান্ত প্রয়ােজন। কেননা এদের ছাড়া বুর্জোয়াদের উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা নিজের অবস্থাকে সুসংহত করতে পারে না এবং নিজেদের শক্তিকে সুদৃঢ় করতে পারে না। কিন্তু এত প্রচুর সংগঠনের উপর কি করে একক নেতৃত্ব স্থাপন করা যায়? এর কি গ্যারান্টি রয়েছে যে এত বিভিন্ন প্রকার সংগঠন নেতৃত্বকে বিভক্ত করবে না? এটা বলা যায় যে এদের প্রত্যেকটি (…. অস্পষ্ট) কাজ করছে এবং এর ফলে একে অপরের বাধা হবার সম্ভাবনা কম। এটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে প্রতিটি সংগঠন একটি লক্ষ্যের জন্য কাজ করছে, কারণ তারা একটি শ্রেণীরই সেবা করে, সে শ্রেণী হলাে সর্বহারা। তখন প্রশ্ন উঠে কে নির্ণয় করবে লাইন, সাধারণ লক্ষ্য যার ভিত্তিতে সকল সংগঠনের কার্য পরিচালিত হবে। কোথায় সেই কেন্দ্রীয় সংগঠন যা প্রয়ােজনীয় অভিজ্ঞতার জন্য কেবলমাত্র সক্ষমই নয় সাধারণ লাইন নির্ণয়ে, অধিকন্তু এর যথেষ্ট সম্মান রয়েছে এ সকল সংগঠনকে নিজস্ব লাইনে অনুসরণ করানাের যাতে নেতৃত্বের ঐক্য স্থাপিত হয় এবং গােলমাল অসম্ভব হয়। সে সংগঠন হলাে সর্বহারা পার্টি।
পার্টির সকল প্রকার প্রয়ােজনীয় শিক্ষা রয়েছে, কেননা প্রথমতঃ ইহা শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মিলন স্থান যাদের সরাসরি যােগাযােগ রয়েছে পার্টি বহির্ভূত সংগঠনের সাথে, অনেক সময় এরাই এ সকল সংগঠনকে পরিচালিত করে। দ্বিতীয়তঃ শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মিলন ক্ষেত্র হিসেবে পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর নেতাদের শিক্ষাকেন্দ্র, যার ফলে তারা সক্ষম হয় তাদের বিভিন্ন সংগঠন চালাতে। তৃতীয়তঃ শ্রমিক শ্রেণীর নেতাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পার্টি তার অভিজ্ঞতা ও সম্মানের জন্য একমাত্র কেন্দ্র যা সর্বহারাদের সংগ্রামের নেতৃত্ব হিসেবে কাজ করে, যার ফলে শ্রমিক শ্রেনীর প্রতিটি পার্টি বহির্ভূত সংগঠন সহযােগী শক্তি এবং জনগণের সাথে পার্টিকে যুক্ত করছে এইরূপ প্রচার ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে।
পৃষ্ঠা: ১০৪
পার্টি হলাে সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠনের সর্বোচ্চ রূপ।
কিন্তু এটা অবশ্যই বুঝায় না যে পার্টি বহির্ভূত সংগঠনসমূহ, ট্রেড ইউনিয়ন, সমবায় প্রভৃতি অফিসগতভাবে পার্টির অধীন থাকবে। এটা কেবলমাত্র বুঝায় যে পার্টি সদস্যগণ যারা ঐ সকল সংগঠনে কাজ করছেন, বিনা সন্দেহে সেখানে প্রভাবশালী, যতখানি সম্ভব চেষ্টা করবেন পার্টি বহির্ভূত সংগঠন সমূহকে তাদের কাজে সর্বহারার পার্টির নিকটতম করতে এবং যাতে তারা স্বেচ্ছায় পার্টির নেতৃত্ব মেনে নেয়।
এ কারণেই লেনিন বলেছেন যে, “পার্টি হলাে সর্বহারার শ্রেণী সংগঠনের সর্বোচ্চ রূপ।” যার রাজনৈতিক নেতৃত্ব অবশ্যই প্রসারিত হবে সর্বহারার অন্যান্য ধরনের সংগঠনের উপর।
এ কারণে পার্টি বহির্ভূত সংগঠনের ‘স্বতন্ত্রতা’ যা পার্লামেন্ট স্বতন্ত্র সদস্য এবং পার্টি বিচ্ছিন্ন সাংবাদিক, সংকীর্ণমনা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং অন্ধ সমবায় কর্মচারীব জন্ম। দেয়, সম্পূর্ণরূপে লেনিনবাদী তত্ত্ব ও অনুশীলনের পরিপন্থী।
পৃষ্ঠা: ১০৫
স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েম করুনঃ সিরাজ সিকদার
(৮ জানুয়ারি, ১৯৭১)
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, একটি স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রূপ দিন; স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন!!
৮ই জানুয়ারী ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে কমরেড সিরাজ সিকদার কর্তৃক পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক ও বিপ্লবী জনগণ এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত আহ্বান!
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে প্রয়ােগের মূল্যবান অভিজ্ঞতা নিয়ে পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের প্রতি দৃষ্টি প্রসারিত রেখে দৃঢ় পদক্ষেপে তার প্রতিষ্ঠার চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করছে।
এই তিন বৎসর পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা আত্মবলিদান ও কঠোর সংগ্রাম দ্বারা আনন্দ ও বেদনার মহা উপাখ্যানের সৃষ্টি করেছে এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে মহান গৌরবময় অধ্যায়ের সংযােজনা করেছে।
সভাপতি মাওয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবীদের সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামের প্রভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত, এ পতাকাকে উর্ধে তুলে ধরে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে আপােষহীন সংগ্রাম পরিচালনা করছে এবং বিপ্লবী অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় প্রণয়ন করেছে-সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির সঠিক রাজনৈতিক লাইন, দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের বর্তমান পর্যায়ে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনার সঠিক সামরিক লাইন এবং গােপনভাবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তােলার সঠিক সাংগঠনিক লাইন।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ, কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া এবং বিপ্লবী ঝড়তরঙ্গে পােড় খেয়ে অধিকতর পরিপক্ক হয়েছেন এবং অধিকতর দক্ষতার সাথে বিপ্লবীকার্য পরিচালনা করছেন।
পৃষ্ঠা: ১০৬
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী অনুশীলনের এই তিন বৎসর সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনা ও পরিচালনা করার আত্মগত প্রস্তুতির সৃষ্টি করেছে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা সাফল্যজনকভাবে পাকিস্তান কাউন্সিল কেন্দ্র, অফিস ও মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে কমান্ডাে হামলা পরিচালনা করে এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে সশস্ত্র প্রতিরােধের সূচনা করে।
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক শাসকগােষ্ঠী একটি পাতা নড়ার শব্দেই আঁতকে উঠে এবং পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য পাগলা কুকুরের মত হন্যে হয়ে উঠে। তাদের এ জঘন্য প্রচেষ্টায় শামিল হয় পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী দালালরা এবং পূর্ব বাংলার দক্ষিণপন্থী ও আকৃতিগতভাবে বামপন্থী কিন্তু সারবস্তুগতভাবে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলরা।
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে কার্যরত পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অনেককে গ্রেপ্তার করেছে, আরাে অনেকের বিরুদ্ধে ঘােষণা করেছে গ্রেপ্তারী পুরস্কার।
পূর্ব বাংলার জনগণের রক্তের রক্ত, মাংসের মাংস পূর্ব বাংলার এ সকল শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আজ কারার অন্তরালে অশেষ নির্যাতন ও কষ্টে ভুগছেন। তাদের কথা মনে পড়ে আমাদের হৃদয় বেদনায় ভরে উঠে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা বেদনাকে শক্রর প্রতি তীব্র ঘৃণায় এবং অশ্রুকে শত্রু ধ্বংসের বজ্রকঠিন শপথে রূপান্তরিত করে নিজেদের শক্তিকে সুসংবদ্ধ ও পুনর্গঠিত করে, বিপ্লবী কাজ দ্বিগুণভাবে জোরদার করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে গ্রাম্য এলাকায় সম্প্রসারিত করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা সাফল্যজনকভাবে পূর্ব বাংলার বুকে সর্বপ্রথম সূর্যসেনের দেশ চট্টলায় এবং সন্যাস বিদ্রোহের দেশ ময়মনসিংহে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলাযুদ্ধের সূচনা করেছে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে।
১৯৭০-এ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার বিকাশের সশস্ত্র সংগ্রামের ঐতিহাসিক স্তরে প্রবেশ করেছে।
পাকিস্তানী অবাঙ্গালী শাসকগােষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব প্রতিদিনই তীব্রতর হচ্ছে। স্মরণাতীতকালের প্রচণ্ডতম ঘূর্ণীঝড় ও জলােচ্ছাসের তাণ্ডবলীলায় লক্ষ লক্ষ লােকের প্রাণ বলিদান প্রমাণ করেছে পূর্ব বাংলার পরাধীনতার চরিত্রকে। পাকিস্তানের উপনিবেশিক সামরিক শাসকগােষ্ঠী, পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা, মুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার সংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের কানাগলিপথে পরিচালনার ষড়যন্ত্র করছে এবং এ উদ্দেশ্যে সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় এবং আইনগত কাঠামাের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে।
আওয়ামী লীগ জনতাকে এর বিরুদ্ধে পরিচালিত না করে এ ষড়যন্ত্রে হাত মিলিয়েছে এবং পূর্ব বাংলার উপরস্ত শােষণ নিপীড়ন সমাধানের জন্যে শান্তিপূর্ণ ও সংস্কারবাদী পথ এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।
পাকিস্তানের অবাঙ্গালী শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতার প্রধান উপাদান হলাে সামরিক বাহিনী। পূর্ব বাংলার জনগণের কোন উপকারই করা সম্ভব নয় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ভূমিকা গণবিরােধী এ সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত ও ধ্বংস করা ব্যতীত।
পৃষ্ঠা: ১০৭
শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক, সংস্কারবাদী সকল প্রচেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি হলাে আপােষ ও আঁতাত এবং জনগণের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কাজেই আওয়ামী লীগের সামনে সশস্ত্র সংগ্রাম ও আপােষের দুটো পথ খােলা রয়েছে। আওয়ামী লীগের শ্রেণীভিত্তি প্রমাণ করে ইহা শেষােক্ত পথ অনুসরণ করেছে যার পরিণতি হলাে জনগণের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
আওয়ামী লীগ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়। সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টি ও তার মাধ্যমে পরিচালিত সর্বহারার একনায়কত্ব ব্যতীত অন্য সকল প্রকার সমাজতন্ত্রের সারবস্তু হলাে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। ইহা জনগণের পরিবর্তে দুর্নীতিপরায়ণ আমলা-ম্যানেজার প্রভৃতিদের স্বার্থ রক্ষা করে। এর পরিণতি হলাে লােকশানের প্রতিষ্ঠান ই.পি.আর.টি.সি, বা ই.পি.আই.ডি.সি এবং অন্যান্য সরকারী সংস্থা।
তথাকথিত মুক্ত পৃথিবীর প্রধান মােড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের কমিউনিজম প্রতিহত করার ইহা একটি নতুন কৌশল। বার্মার নে-উইন, সিঙ্গাপুরের লি-কান-উয়ে, ভারতের ইন্দিরা গান্ধি নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র গঠনের নামে পুরানাে শােষণকে নতুন শােষণের রূপে তীব্রতর করছে এবং কমিউনিস্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কমিউনিজম প্রতিহত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম প্রচণ্ড রােষে ফেটে পড়ছে।
শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র ও শােষণের অবসানের কথা বলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক জনতা ও তাদের নেতৃত্বকে জ্যান্ত কবরস্থ করা এবং পূর্ব বাংলার চিয়াংকাইশেক, নে-উইন, ইন্দিরা, লি-কান-উইয়ের ভূমিকা পালন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক শাসকগােষ্ঠী এ কারণেই তাদেরকে কিছুটা সুবিধা প্রদান করে পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের পরিচালিত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালীদের দ্বারা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে।
ইতিহাস সকল ভাড় ও ভাওতাবাজদের, আগে হােক পরে হােক চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করবেই। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনতার পরিচালিত ইতিহাসের চাকা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে উচ্চ শিখরে উত্তোলিত করেছে; ইহা নিজস্ব গতিপথে অনিবার্যভাবেই তাদেরকে গুঁড়িয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করবে।
আমরা অবশ্যই এ সত্য প্রতিনিয়ত জনতার সামনে তুলে ধরবাে এবং বিভিন্ন। আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে উঠতি বুর্জোয়াদের মােহগ্রস্ত জনগণকে আমাদের পিছনে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা জোরদার করবাে। এ উদ্দেশ্যে আমরা গ্রাম্য এলাকায় কৃষকদের জাতীয় শত্রু বিরােধী খতম অভিযান জোরদার করবাে। এভাবে পূর্ব বাংলার ৮০ ভাগ জনতার নেতৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে শহুরে বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক শ্রেণী ও জাতীয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব অর্জন করতে সক্ষম হবাে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক অবস্থা বিপ্লবের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক। মহান নেতা সভাপতি মাও যথাযথভাবে বর্তমান দুনিয়ার বিপ্লবী সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করেছেন, “বিপ্লব হলাে বর্তমান বিশ্বের প্রধান প্রবণতা।” বিশ্বের বিপ্লবীরা দ্রুতগতিতে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, থাইল্যান্ড, বার্মা,
পৃষ্ঠা: ১০৮
ভারত, প্যালেস্টাইন এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত দেশ ও জাতিসমূহের মুক্তি সংগ্রাম দাউদাউ করে জ্বলছে।
খােদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মর্মস্থলে কালাে অধিবাসীদের হিংসাত্মক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদী দেশসমূহে গণঅসন্তোষ এবং নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে। তারাও নিজের খতমের দিন গুণছে।
পক্ষান্তরে সভাপতি মাওয়ের নেতৃত্বে গণচীন বিরাটকায় দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব দিগন্তে, ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক আলােকস্তম্ভ আলবেনিয়া উজ্জ্বল কিরণ বিচ্ছুরিত করছে।
এ যুগ সম্পর্কে সভাপতি মাও দূরদর্শিতার সাথে যথার্থই উল্লেখ করেছেন, “আজ থেকে আগামী ৫০ বৎসর থেকে ১০০ বৎসর অথবা তার পরের সময়টা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সমাজ কাঠামোের আমূল পরিবর্তনের মহান যুগ। পূর্ববর্তী যে কোন ঐতিহাসিক পর্যায় নজীরবিহীন একটি বিশ্ব কাঁপানাে যুগ।”
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী, আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ১৯৭০-এ পূর্ব বাংলার জনগণের যে গণযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা দাবানলের রূপ নেবে ১৯৭১-এ পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে দাউ দাউ করে জ্বলবে গণযুদ্ধের দাবাগ্নি, আর তাতে পুড়ে মরবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার শত্রুরা, তাদের দালাল, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা। এই প্রবল ঝড়-তরঙ্গে থর থর করে কাঁপবে পুরােনাে দুনিয়া, গড়ে উঠবে জনগণের গেরিলা বাহিনী, সমাপ্ত হবে পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সংগঠন হিসেবে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা, প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি।
টীকাঃ
১. বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও মনি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী, হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী, দেবেন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণা ষড়যন্ত্রকারী, অগ্নিপ্রভ মাইতি প্রভৃতিকে বুঝানাে হয়েছে, যারা আকৃতিতে পৃথক কিন্তু সারবস্তুগতভাবে সংশােধনবাদী।
২. পূর্ব বাংলার দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও মুসলিম লীগের সকল অংশ, পিডিপি, জামাত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক পার্টিসমূহ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ।
৩. আকৃতিগতভাবে বামপন্থী কিন্তু সারবস্তুগতভাবে দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল ন্যাপ উভয় অংশ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ব্যাপক অংশ।
পৃষ্ঠা: ১০৯
কয়েকটি শ্লোগান প্রসঙ্গে
(জানুয়ারি, ১৯৭১)
১. সঠিক রাজনীতি হচ্ছে পার্টির প্রাণ। ইহা নিজেকে প্রকাশ করে রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশলের মাধ্যমে। রণনীতি ও রণকৌশল শ্লোগানের মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে উত্থাপন করা হয় এবং এর ভিত্তিতে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামে নামানাে হয়।
দু’ধরনের শ্লোগান রয়েছে-রণনীতিগত ও রণকৌশলগত। রণনীতিগত শ্লোগান হলাে একটি রণনীতির প্রতিফলন; একটি রণকৌশলগত শ্লোগান হলাে একটি রণকৌশলের প্রতিফলন। রণনীতি হলাে একটি মৌলিক দ্বন্দ্বের সমাধান এবং একটি রণকৌশল হলাে একটি দ্বন্দ্বের স্তরের সমাধান। রণনীতি মৌলিক দ্বন্দ্বের মীমাংসার সামগ্রিককাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে, এ কারণে ইহা দীর্ঘস্থায়ী। পক্ষান্তরে রণকৌশল অধিক পরিবর্তনশীল, কেননা একটি দ্বন্দ্বের বিকাশের প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত মীমাংসার পূর্ব পর্যন্ত বহু স্তর অতিক্রম করে এবং স্তর অনুযায়ী রণকৌশল রচিত হওয়ায় ইহাও পরিবর্তিত হয়।
২. সর্বহারারা বর্তমান পূর্ব বাংলার সমাজে শ্রেণীগতভাবে সংখ্যালঘু এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজেও একটি পর্যায় পর্যন্ত সংখ্যালঘু থাকবে। এ অবস্থায় সর্বহারারা কিভাবে দেশের সকল জনসাধারণকে নেতৃত্ব দেবে? “প্রথমতঃ ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মৌলিক রাজনৈতিক শ্লোগান উত্থাপন করে (রণনীতিগত-লেখক) এবং বিকাশের প্রতিটি স্তর ও ঘটনার প্রতিটি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ম বিষয়ক শ্লোগান (রণকৌশলগত-লেখক) উত্থাপন করে, যাতে রাজনৈতিক শ্লোগানগুলােকে বাস্তবায়িত করা যায়। কাজেই পূর্ব বাংলার সর্বহারাদের পূর্ব বাংলার সমাজের সকল জনসাধারণকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করতে হলে পূর্ব বাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল এবং রণনীতি ও রণকৌশলের প্রতিফলন রণনীতিগত ও রণকৌশলগত শ্লোগান রচনা করতে ও তা কার্যকরী করতে হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে অধ্যয়ন করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের শ্লোগান পূর্ব বাংলার সমাজ ও তার বিকাশকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে কিনা।
জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী সর্বহারা বিপ্লবীদের বিশ্লেষণ থেকে এ শ্লোগান সঠিক; ইহা পূর্ব বাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পৃষ্ঠা: ১১০
ইহা দুটো দ্বন্দ্বের সমাধান-একটি হলাে, বৈদেশিক শােষকদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব; অপরটি হলাে সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব। প্রথমটির সমাধান হচ্ছে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে, পরেরটির সামাধান হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বন্দ্বের দুটো দিক-জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝে প্রধান দিক হলাে জাতীয় বিপ্লব; এর কারণ পূর্ব বাংলা একটি উপনিবেশ, সমগ্র জাতি উপনিবেশিক শােষণ ও শাসনে নিপীড়িত ও এর অবসান চায়। এই জাতীয় বিপ্লবের সমাধান হলাে স্বাধীন, সার্বভৌম পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করা এবং ইহা সম্ভব জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
কৃষক জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বের সমাধান হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ, সামন্তবাদকে উৎখাত করে কৃষকের হাতে জমি প্রদান করা। সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব গৌণ। এ কারণে ঐ সকল সামন্ত শক্তিকে খতম করতে হবে যারা জাতীয় বিপ্লবের শত্রু এবং এর বিরােধিতা করে।
আমাদের রণনীতি হলাে জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান-পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল প্রকার জাতীয় নিপীড়নের অবসান করা; সামন্তবাদকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে কৃষকের হাতে জমি প্রদান করা।
আমাদের রণকৌশলগত লাইন হলাে জাতীয় স্বাধীনতা বিরােধী সামন্ত শক্তিকে খতম করা।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা শ্লোগানের বিশ্লেষণ হিসেবে যা উত্থাপন করে তার সাথে এ শ্লোগানের কোন সামঞ্জস্য নেই। এর ফলে ইহা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তারা এ শ্লোগান ব্যবহার করেছে সর্বহারা বিপ্লবী ও জনসাধারণকে ভাওতা প্রদানের জন্য এবং আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া (সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ) ও তার দালাল (আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া) এবং দেশীয় বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের বিশ্বস্ত পদলেহী কুকুর হিসেবে কাজ করছে।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানের উপনিবেশিক সামরিক শাসকগােষ্ঠীর জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এর সমাধান হিসেবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ না করে পূর্ব বাংলার জমিদার শ্রেণীর সাথে কৃষক-জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান হিসেবে কৃষি। বিপ্লবের লাইন গ্রহণ করেছে। কৃষি বিপ্লব হলাে পূর্ব বাংলার সামন্ত জমিদার শ্রেণীর সাথে কৃষক জনতার গৃহযুদ্ধ, ইহা শ্রেণী সংগ্রাম। এভাবে তারা পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরস্থ শ্রেণী সংগ্রাম, গৃহযুদ্ধ, কৃষি বিপ্লবের কথা বলে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অর্থাৎ, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে পূর্ব বাংলার জনগণকে দূরে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে তারা আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া দালাল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের টিকিয়ে রাখার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে।
সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান হলে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ইহা অধিকতর সত্য। কাজেই পাকিস্তান ভিত্তিক সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষকের গৃহযুদ্ধ হওয়া। উচিত ছিল “সামন্তবাদ প্রধান দ্বন্দ্ব”-এ বক্তব্যের প্রবক্তাদের কর্মসূচী। সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান শ্রেণী যুদ্ধের প্রাক্কালে জাতীয়
পৃষ্ঠা: ১১১
বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন গৌণ এবং এই গৌণ সংগ্রাম পরিচালনা করে প্রধান শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী যুদ্ধকে ক্ষতিগ্রস্থ করা মার্কসবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইহা বুর্জোয়া কৌশল। এ কারণে ভারতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা কোন একটি বিশেষ জাতির বিচ্ছিন্নতার জন্য লড়াই করছে না। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, অর্থাৎ, সকল জাতির নিপীড়নের অবসান, অর্থাৎ, গৌণ জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে বীরত্বের সাথে শ্রেণীসংগ্রাম আভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব, এর সমাধান কৃষিযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি বলছে, একই সাথে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা অর্থাৎ, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কোন এক পর্যায়ে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলছে। ইহা প্রমাণ করে, তাদের শ্লোগান তাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। একটি অপরটির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
মার্কসবাদীরা সর্বদা জাতিসমূহের শােষণ-নিপীড়নের ভিত্তিতে সংযুক্তির বিরােধিতা করে, পক্ষান্তরে শােষণ-নিপীড়নহীন সমতার ভিত্তিতে সংযুক্তিকে স্বাগত জানায়। ইহা উৎপাদনের বিকাশ, সামাজিক অগ্রগতি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতার জন্য সহায়ক। এ কারণে সামন্তবাদ প্রধান দ্বন্দ্ব হলে এ থেকে আসে পাকিস্তানভিত্তিক বিপ্লব, পাকিস্তানের প্রতিটি জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদানের ভিত্তিতে জনগণতান্ত্রিক পাকিস্তান গঠন করা। সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে উপরােক্ত কর্মসূচী ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করা মার্কসবাদের পরিপন্থী এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের প্রকাশ। কাজেই সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা বলা ভুল। “জনগণতান্ত্রিক পাকিস্তান”-এ বিশ্লেষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার শ্লোগান কেন উত্থাপন করছে? এর কারণ, এরা স্বাধীন পূর্ব বাংলার কথার টোপ ফেলে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদেরকে গেঁথে তােলার জঘন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তারা বিপ্লবীদের চেতনাকে হত্যা করে আজ্ঞাবহ পুতুল তৈরী এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নয়া সংশােধনবাদের ধারক-বাহক হিসেবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র স্বাধীনতার কথা বলে। স্বাধীনতা কার কাছ থেকে? তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সামন্তবাদ প্রধান শত্রু। অতএব স্বাধীনতা হচ্ছে সামন্তবাদের নিকট থেকে, অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার জমিদাররা পূর্ব বাংলাকে পরাধীন করে রেখেছে। এই হাস্যস্পদ যুক্তি একটি স্কুল ছাত্রও গ্রহণ করবে না। ইহা প্রমাণ করে দালালী করতে করতে তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
আবার কখনও বলে তারা স্বাধীনতা চায় সাম্রাজ্যবাদের নিকট থেকে। সাম্রাজ্যবাদ পূর্ব বাংলাকে শােষণ করছে, পশ্চিম পাকিস্তানকেও শােষণ করছে। যে কোন সর্বহারা সাম্রাজ্যবাদের নিকট থেকে স্বাধীনতা চায়, সাম্রাজ্যবাদী শােষণের অবসান চায়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের নিকট থেকে স্বাধীন করে, অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদী শােষণের অবসান করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা কেন? স্বাধীন পাকিস্তান না করে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা কেন? ইহা কি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ নয়?
হক-ততায়াহা নয়া সংশােধনবাদী, দেবেন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র এ সকল প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উত্থাপন করে ভৌগলিক
পৃষ্ঠা: ১১২
দূরত্বকে অর্থাৎ, বাহ্যিক কারণকে (পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা ১২শত মাইল দূর)। বাহ্যিক কারণ ভৌগলিক ব্যবধানের ফলে যােগাযােগের অসুবিধা, আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে ইহার সমাধান সম্ভব। পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরস্থ উত্তরবঙ্গ, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলের সাথে যােগাযােগ করতে বার ঘণ্টার অধিক সময় লাগে। ভৌগলিক দিক দিয়ে এ সকল অঞ্চলের ব্যবধান পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে অনেক কম হলেও যােগাযােগের দিক দিয়ে অনেক অসুবিধাজনক। হক-তােয়াহাদের যুক্তি মত এ সকল অঞ্চলসহ পূর্ব বাংলার অন্যান্য দুর্গম অঞ্চলের স্বাধীন হওয়া প্রয়ােজন। ইহা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের চিন্তাধারা নয়, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার প্রতিফলন যখন যােগাযােগের কারণে বিভিন্ন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাে।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়, “বস্তুর বিকাশের কারণ বাহ্যিক নয়, আভ্যন্ত রীণ। ইহা নিহিত রয়েছে বস্তুর অভ্যন্তরস্থ দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে।” ইহা আরাে শিক্ষা দেয়, “সামাজিক বিকাশের মৌলিক কারণ হলাে সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব।” অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার সমাজের বিকাশের পরিণতি স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা হওয়ার মৌলিক কারণ পূর্ব বাংলার সমাজের অভ্যন্তরস্থ; ইহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র অন্যান্য সংশােধনবাদীদের সাথে পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের পরিণতি স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা হওয়ার কারণকে বাহ্যিক, অর্থাৎ, ভৌগলিক দূরত্বকে উল্লেখ করে নিজেদের আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণের প্রকাশ করেছে। সভাপতি মাও এদের সম্পর্কে বলেছেন, “এরা (অধিবিদ্যকরা-লেখক) সামাজিক বিকাশের কারণ হিসেবে সমাজের বাইরের শক্তিকে উল্লেখ করে যেমন ভৌগলিক অবস্থা (ভৌগলিক দূরত্ব তার মাঝে একটি)”। এদের সম্পর্কে তিনি আরাে বলেছেন, “…….. ইহা (আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণ-লেখক) বহুদিন ধরে সমর্থন পেয়ে আসছে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী শাসকগােষ্ঠী দ্বারা, বর্তমানে সমর্থন পাচ্ছে বুর্জোয়াদের…।” অর্থাৎ, এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী বিশ্বদৃষ্টিকোণ আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া ও তাদের দালাল এবং দেশীয় বুর্জোয়া ও সামন্ত জমিদার গােষ্ঠীর সেবা করছে। হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র কৃষকের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, তার সমাধান শ্রেণী যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি সংগ্রামের নামে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় বিচ্ছিন্নতার সংগ্রামকে বিরােধিতা করছে এবং পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর প্রধান সমস্যা পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতা ঠেকানাের প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছে। তারা পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর ঝটিকা বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। তারা বিপ্লবী শ্লোগানের আড়ালে প্রতিক্রিয়ার প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করছে। এ কারণে তাদের পত্রিকা পুস্তকাদি প্রকাশ্য বাজারে বিক্রির জন্য সরকারী আনুকূল্য পাচ্ছে।
এভাবে পাকিস্তানের উপনিবেশিক সরকার যা পারছে না তাই তারা করছে। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনগণকে উপকারী সেজে ভাওতা দিচ্ছে। এভাবে তারা পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী যাদের শ্রেণীভিত্তি হলাে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, তাদের পদলেহী কুকুর হিসেবে কাজ করছে।
তারা পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শাসন ও নিপীড়নের বিরােধিতা না করে পূর্ব বাংলার জনগণকে ছয়দফা বুর্জোয়াদের পিছনে ঠেলে দিচ্ছে।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র কিছুদিন পূর্বেও সর্বহারার রাজনৈতিক লাইন নির্ণয়ের প্রশ্নে প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করার প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার
পৃষ্ঠা: ১১৩
করেছে এবং সকল দ্বন্দ্বকে এক ও অবিচ্ছেদ্য বলেছে। নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক হক তার “আধা উপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক পূর্ব বাংলা” পুস্তকে লিখেছে (৫৮ পাতা-লেখক) “এই তিন শক্তি (সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ-লেখক) হইল এক ও অবিচ্ছিন্ন শক্তি।…… আজ আমাদের দেশের প্রধান ও মৌলিক বিরােধ হইল, একদিকে জনগণ আর অন্যদিকে এই তিন শক্তির প্রকাশ।” সে আরাে বলেছে, “এই তিন শক্তির অবিচ্ছিন্ন সত্তাকে পৃথকভাবে বিচার করার অর্থই হলাে ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হউক ইহাদের স্বার্থের ওকালতি করা, ইহাদের স্বার্থে কাজ করা।”
সহজ ও সাধারণ কথায় ইহা অধিবিদ্যা ও ভাববাদ, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পরিপন্থী যা আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া, এদেশীয় বুর্জোয়া ও সামন্তবাদের সেবা করে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়-বস্তু আমাদের চেতনা থেকে স্বাধীনভাবে বিরাজ করে। বস্তু প্রাথমিক, চেতনা হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মষ্কিস্কে বস্তুর প্রতিফলন। চেতনা বস্তুসৃষ্ট, গৌণ। ইহা আরাে শিক্ষা দেয় যে, বস্তু গতিশীল, এ গতির নিজস্ব নিয়মবিধি রয়েছে। বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় যদি অনেকগুলাে দ্বন্দ্ব থাকে তবে প্রতিটি দ্বন্দ্বের আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে, আবার পরস্পর সম্পর্কও রয়েছে এবং বস্তু বিকাশ লাভ করে পর্যায়ক্রমে দ্বন্দ্বসমূহের প্রধান দ্বন্দ্ব মীমাংসার মাধ্যমে। বস্তু বিকাশের এই নিয়মের প্রতিফলনই সন্নিবেশিত হয়েছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও প্রধান দ্বন্দ্বের নিয়মে।
নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক হক বস্তুর বিকাশের নিয়মকে প্রতিফলিত না করে তার মাথা থেকে বস্তু বিকাশের নিয়ম নির্দেশ করেছে, এভাবে সে চেতনাকে দিচ্ছে। প্রাথমিক ভূমিকা এবং বস্তুকে অধিনস্থ ভূমিকা। ইহা পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাববাদ। এভাবে তারা শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে এক এক করে ধ্বংস করা থেকে জনগণকে বিরত করে। শত্রুকে রক্ষা করছে। সর্বহারার মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রাক্কালে সকল কেডারকে আক্রমণ কর’-এ শ্লোগান দ্বারা লিউশাউচি, তাউচু প্রভৃতি সংশােধনবাদী প্রতিবিপ্লবীরা সর্বহারা বিপ্লবীদের বিভ্রান্ত করে মুষ্টিমেয় সংশােধনবাদীদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল। ইহা একটি অতিশয় পুরােনাে কৌশল।
এক পর্যায়ে তারা জনগণতান্ত্রিক পূর্ব পাকিস্তান বলত। অকস্মাৎ তারা সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা বলা শুরু করে।
প্রধান দ্বন্দ্ব ও জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কথা বলে তারা কি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হয়েছে? না। অতীতে তাদের ভাববাদ ও অধিবিদ্যা ছিল প্রকাশ্য ও স্থূল, তাই সহজেই। ধরা পড়ত। কিন্তু বর্তমানে তা হয়েছে অধিকতর গােপন ও সূক্ষ্ম। কী কী অবস্থার উদ্ভব হয়েছে যার ফলে হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদীদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে, তাদের বদমাইশীকে অধিকতর সূক্ষ্ম ও গােপন করেছে?
ইহা হলাে ভারতীয় বিপ্লবে চারু মজুমদার, কানু সান্যালের নেতৃত্বে মার্কসবাদীলেনিনবাদীদের বিজয় এবং নাগীরেড্ডি, জ্যোতি-নামুদ্রিপদের পরাজয় এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের ওপর তার প্রভাব, পূর্ব বাংলার জাতীয় চেতনার তীব্রতা।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র প্রথমে নকশালবাড়ী কৃষক বিদ্রোহকে বিরােধিতা করে একে সি.আই.এ-র ষড়যন্ত্র (জ্যোতি-নামুদ্রিপদের বক্তব্য -লেখক) বলে আখ্যায়িত করে। জ্যোতি-নামুদ্রিপদের পরাজয়ের পরে তারা রাতারাতি তাদের বক্তব্য পাল্টিয়ে নাগীরেড্ডিকে প্রকৃত নক্সালপন্থী হিসেবে সমর্থন করে। কিন্তু নাগীরেড্ডীর প্রকৃত নয়া সংশােধনবাদী চরিত্র প্রকাশ হওয়ায় তারা নিজেদেরকে রক্ষা ও
পৃষ্ঠা: ১১৪
জনগণকে ভাওতা প্রদানের জন্য নিজেরা নক্সালপন্থী বনে যায়। এরা মার্কসবাদলেনিনবাদের জীবন্ত আত্মা, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণকে বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের ভারতীয় বিশেষ অবস্থার জন্য রচিত কর্মসূচী- সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান কৃষি বিপ্লব গ্রহণ করে। তারা নিভৃতে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব পাকিস্তান বিসর্জন দিয়ে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা গ্রহণ করে।
অতীতে তারা তিন শত্রুকে এক ও অবিচ্ছেদ্য বলে পর্যায়ক্রমে একটি একটি শক্রকে ধ্বংস করা থেকে জনগণকে বিরত করেছে। বর্তমানে তারা গৌণ শত্রু সামন্ত বাদকে প্রধান শত্রু হিসেবে আক্রমণের কথা বলে শেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে প্রধান শত্রু পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য।
স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা
ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-মতিন বিশ্বাসঘাতক চক্রের এই শ্লোগান প্রমাণ করে তারা। জনগণতন্ত্রের অর্থ বুঝে না এবং স্বাধীনতার সাথে জনগণতন্ত্রের সম্পকের বিষয়েও। তাদের কোন জ্ঞান নেই। তত্ত্বের দিক দিয়ে এরা বুদ্বু, এ কারণে এদের ভাওতা নয়া সংশােধনবাদীদের তুলনায় স্কুল ও প্রকাশ্য।
অতীতে তারা জোতদার-মহাজনদের জমিদার শ্রেণীভূক্ত না করে তাদেরকে ধনী চাষীর পর্যায়ে ফেলেছে এবং সরকারী খাজনা-ট্যাক্সের সামন্তবাদী শােষণ অস্বীকার করেছে এবং পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর শােষণকে জাতীয় বুর্জোয়া শােষণ বলেছে, সাম্রাজ্যবাদী শােষণকে কমিয়ে দিয়ে পূর্ব বাংলার সমাজকে ধনতান্ত্রিক সমাজে পরিণত করেছিল। তাদের এই আত্মগত বিশ্লেষণ প্রমাণ করার জন্য পচা গলিত আবর্জনা দ্বারা তারা পুস্তকের পর পুস্তক ভরে তুলেছিল এবং মানুষের ধৈর্যের ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল।
অতীতের মত বর্তমানেও তারা সবকিছু তালগােল পাকিয়ে নিজেদেরকে হাস্যস্পদ করেছে এবং নিজেদের যে মার্কসবাদের ক-খ-গ-এর জ্ঞান নেই তা প্রমাণ করেছে।
জনগণতন্ত্র হলাে নয়া গণতন্ত্র, অর্থাৎ, সামন্তবাদী বা আধা সামন্তবাদী, উপনিবেশিক বা আধা উপনিবেশিক সমাজে বুর্জোয়া বিকাশের বাধা বৈদেশিক বুর্জোয়াদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের প্রতিবন্ধকতা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে উৎখাত করে পুঁজিবাদ বিকাশের শর্ত সৃষ্টি করা। ইহা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবকে যদি আমরা দ্বন্দ্ব ধরি তবে এর দুটো দিক রয়েছে-একটি হলাে জাতীয় বিপ্লব, অন্যটি হলাে গণতান্ত্রিক বিপ্লব। জাতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য হলাে বৈদেশিক বুর্জোয়াদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করা এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য হলাে সামন্তবাদকে উৎখাত করা।
কাজেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন অন্তর্ভূক্ত। জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার আগে স্বাধীন শব্দটির ব্যবহার ট্রটস্কী-চেবাদীদের তাত্ত্বিক অজ্ঞতার পরিচয়।
জনগণতান্ত্রিক তথা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটো দিক-জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝে সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় কখনাে জাতীয় বিপ্লব প্রধান দিক হয়, আবার কখনও গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান হয়।
পৃষ্ঠা: ১১৫
চীনদেশে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান দিক ছিল। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিপ্লব প্রধান দিক ছিল, ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পুনরায় গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান দিক ছিল। ভারতের সামাজিক বিকাশের পর্যায়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান দিক হলাে গণতান্ত্রিক বিপ্লব, অর্থাৎ, সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব। পক্ষান্তরে, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে ভারতীয় জনগণের দ্বন্দ্ব গৌণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
মতিন-দেবেন ট্রটস্কী-চেবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র যারা জন্মলাভ করেছে নয়া সংশােধনবাদীদের গর্ভ থেকে, তারা বজায় রেখেছে নয়া সংশােধনবাদীদের ভাববাদী অধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণ। পূর্ব বাংলা ভিত্তিক বিপ্লব করা, সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা বলে তারা তাদের ভাববাদী অধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণের পরিচয় প্রকাশ করছে। যদিও নয়া সংশােধনবাদীদের সাথে এদের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু তাহলাে মূলতঃ তাত্ত্বিক দেউলিয়াত্বের পার্থক্য, মৌলিকতার নয়। তারা একই পালের ষাড় যদিও রঙের দিক দিয়ে তাদের মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র হলাে অতিশয় চতুর, মুখােস আঁটতে অতিশয় দক্ষ এবং তাদের সংশােধনবাদ হচ্ছে অতিশয় সুসংবদ্ধ। পক্ষান্তরে দেবেন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদীদের ভাওতা হচ্ছে প্রকাশ্য ও স্কুল এবং তাত্ত্বিক বুদ্বুতার প্রকাশ।
জয় সর্বহারা
এই শ্লোগান উত্থাপিত হয়েছে ট্রটস্কী-চেবাদীদের দ্বারা। এই শ্লোগান পুনর্বার প্রমাণ করছে তাদের ট্রটস্কী-চেবাদী চরিত্র।
সর্বহারার ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সমাপ্ত করে; কমিউনিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
সর্বহারারা বর্তমান মুহূর্তে শ্রেণীগতভাবে সংখ্যালঘু, এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজেরও একটি পর্যায় পর্যন্ত সংখ্যালঘু থাকবে। এ অবস্থায় তাকে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করতে হবে ধাপে ধাপে সমগ্র জনতাকে মুক্ত করার মাধ্যমে; অন্য কথায় “সর্বহারারা নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারবে না মানবগােষ্ঠীকে মুক্ত করা ব্যতীত।”
বর্তমান পূর্ব বাংলার সমাজ যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তর অতিক্রম করেনি, সেখানে জয় সর্বহারা শ্লোগান বলে তারা তাদের পুরােনাে ট্রটস্কী-চেবাদী তত্ত্ব অর্থাৎ, এক ধাক্কায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত করার কথা প্রকাশ করছে।
ইহা পুরােপুরি ও সম্পূর্ণরূপে ট্রটস্কী-চেবাদ। আমরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করতে পারি, একতলা (জনগণতন্ত্র) অতিক্রম করেই দোতলায় (সমাজতন্ত্র) উঠতে পারি। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শ্লোগান “জয় সর্বহারা” উত্থাপন করে তারা তাদের ট্রটস্কীচেবাদী চরিত্র প্রকাশ করেছে।
এই শ্লোগান যদিও আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান। কারণ ইহা বর্তমান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে বুর্জোয়া ও তাদের ব্যক্তি মালিকানার
পৃষ্ঠা: ১১৬
উৎখাতের কথা বলে ব্যাপক জনতার (যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে জমির মালিক হতে চায় এবং বৈদেশিক পুঁজি উৎখাত করে জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটাতে চায়) বিরােধিতা করা হয়, জনতা থেকে বিপ্লবীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং বিপ্লবের পরাজয় ডেকে আনে; জনতাকে বড় বুর্জোয়াদের পিছনে ঠেলে দেয়।
জয় বিপ্লবী
এই শ্লোগান ষড়যন্ত্রকারী কাজী-রণাে বিশ্বাসঘাতক চক্র কর্তৃক উত্থাপিত।
এই চক্র এ শ্লোগানের মাধ্যমে কোন সামাজিক দ্বন্দ্বের বা দ্বন্দ্বের স্তরের সমাধান করতে চায় তা বােঝা মুশকিল। এই শ্লোগান একটি বিভেদপন্থীমূলক শ্লোগান যা বিপ্লবীদেরকে ব্যাপক জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাদের ধ্বংস নিয়ে আসে।
জয় বাংলা না জয় পূর্ব বাংলা
বর্তমান সামাজিক অবস্থায় জয় বাংলা শ্লোগান ব্যাপক জনসাধারণের কণ্ঠে শােনা যায়। এটা একটা জনপ্রিয় শ্লোগান।
জয় বাংলা শ্লোগান দ্বারা ৬-দফা আওয়ামী লীগ বৃহত্তর বাংলা অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম বাংলাকে সংযুক্ত করে বৃহত্তর বাংলা জয়ের সুখ কল্পনা প্রকাশ করছে। এই কল্পনা কখনও বাস্তবায়িত হবে না। ইহা একটি অলীক কল্পনা মাত্র।
পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ এই শ্লোগান প্রদানের সময় পূর্ব বাংলার নিপীড়িত লাঞ্ছিত জনগণের শােষকদের উপর বিজয় কামনা করে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে।
আমরা পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সংগ্রামকে সমর্থন করে তাকে নেতৃত্ব প্রদান করি ও পরিচালনা করি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বৃহত্তর বাংলার স্বপ্নকে আমরা দৃঢ়ভাবে বিরােধিতা করি, আরাে বিরােধিতা করি স্বাধীন পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের অনুপ্রবেশ।
আমরা পক্ষান্তরে ব্যাপক জনতার সাথে সমর্থন করি পূর্ব বাংলার জাতীয় বিজয়, তার স্বাধীনতা এবং বিশ্বের জাতিসমূহের মাঝে সগৌরবে মাথা তুলে দাড়াবার অধিকার। আমরা সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবােধ স্বদেশপ্রেমকে সমর্থন করি, কিন্তু তাকে বুর্জোয়াদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহারের বিরােধিতা করি।
কাজেই আমরা উত্থাপন করতে পারি “জয় পূর্ব বাংলা” শ্লোগান। ইহা পূর্ব বাংলার বর্তমান সামাজিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইহা বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন তথা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের অনুপ্রবেশকে স্পষ্টভাবে বিরােধিতা করে এবং পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয়তাবােধ, দেশপ্রেম এবং বিজয়কে প্রকাশ করে। এ কারণে এ শ্লোগান যে কোন প্রকার দ্বিধার অবসান করে। এটা পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির প্রশ্নের সমাধান, জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান। আমাদের রাজনীতির সাথে ইহা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণে ইহা সঠিক।
স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল
পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন!
এই শ্লোগান পূর্ব বাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের বর্তমান পর্যায়ের সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বর্তমান পর্যায়ের প্রােগ্রাম। এ কারণে ইহা সঠিক।
পৃষ্ঠা: ১১৭
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটো দিকের মাঝে পূর্ব বাংলার বর্তমান সামাজিক বিকাশের পর্যায়ে প্রধান দিক হলাে জাতীয় বিপ্লব; অর্থাৎ, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন ও মুক্ত করে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা, এবং গৌন দিক হলাে সামন্তবাদকে উৎখাত করা; বর্তমান পর্যায়ে এ কারণে জাতীয় মুক্তি বিরােধী সামন্ত বাদীদেরকে উৎখাত করা।
জাতীয় বিপ্লবের প্রশ্ন প্রধান থাকায় পূর্ব বাংলার বুর্জোয়াসহ সমগ্র জাতি পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করবে এবং এতে অংশগ্রহণ করবে। এ কারণে তাদের অংশগ্রহণ সহজতর করার জন্য পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের শ্লোগান উত্থাপন করা হয়েছে।
এ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া (মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ এবং সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ) এবং বাঙালী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শাসকগােষ্ঠীর শােষণের অবসান করা।
এই প্রজাতন্ত্র বাস্তবায়িত করবে পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের মহান কর্মসূচী, অপসারিত করবে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া বিকাশের বাধা, সমাপ্ত করবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সােপান বেয়ে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির সৃষ্টি করবে।
কাজেই পূর্ব বাংলার বর্তমান সামাজিক বিকাশের পর্যায়ে এ শ্লোগান সঠিক।
নােটঃ
১. Mao, selected works, Vol-1, P-274.
২. কানু সান্যাল পরবর্তীতে সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন পরিত্যাগ করেন। এভাবে কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী রাজনীতিকে পরিত্যাগ করেন ও সুবিধাবাদী রাজনীতি গ্রহণ করেন -প্রকাশক।
৩. লেখা “জাতীয় অর্থনীতির চরিত্র-ধনতান্ত্রিক” পুস্তক দ্রষ্টব্য।
পৃষ্ঠা: ১১৮
শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের খােলা চিঠি
(২ মার্চ, ১৯৭১)
আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবীসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে।
আপনাকে ও আপনার পার্টিকে পূর্ব বাংলার সাত কোটি জনসাধারণ ভােট প্রদান করেছে পূর্ব বাংলার উপরস্থ পাকিস্তানের অবাঙালী শাসকগােষ্ঠীর উপনিবেশিক শাসন ও শােষণের অবসান করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েমের জন্য।
পূর্ব বাংলার জনগণের এ আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন আপনার প্রতি ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিম্নলিখিত প্রস্তাবাবলী পেশ করছে।
১। পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে এবং সংখ্যাগুরু জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘােষণা করুন।
২। পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গােপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন।
প্রয়ােজনবােধে এ সরকারের কেন্দ্রীয় দফতর নিরপেক্ষ দেশে স্থানান্তর করুন।
৩। পূর্ব বাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান।
এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি বাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান।
৪। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং প্রকাশ্য ও গােপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে “জাতীয় মুক্তি পরিষদ” বা “জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট” গঠন করুন।
৫। প্রকাশ্য ও গােপন, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
৬। পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র নিম্নলিখিত কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করবেঃ
(ক) পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা এবং পূর্ব বাংলাস্থ তাদের সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ করা। উপনিবেশিক সরকারের সকল প্রকার শােষণ ও অসম চুক্তির অবসান করা। এদের দালালদের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ করা। এদের মধ্যে ঘৃণ্যতমদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা।
পৃষ্ঠা: ১১৯
(খ) পূর্ব বাংলার জাতীয় বিশ্বাসঘাতকদের সকল নাগরিক অধিকার বাতিল করা। সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে শ্রমিক-কৃষক দেশপ্রেমিকদের জাতীয় সরকার গঠন করা।
(গ) গ্রাম্য এলাকায় উপনিবেশিক সরকারের ভূমি শােষণের অবসান করা। সরকারী খাস ভূমি এবং বিশ্বাসঘাতক জমিদার, জোতদার ও অন্যান্য দেশদ্রোহীদের ভূ-সম্পত্তি ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা। দেশপ্রেমিক জমিদার-জোতদারদের পরিচালিত শােষণ হ্রাস করা।
(ঘ) শ্রমিকদের আটঘণ্টা শ্রম সময়, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, ন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সমর্থন করা।
(ঙ) গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যােগাযােগ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করা।
(চ) ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া প্রতিষ্ঠা করা।
(ছ) ধর্মীয়, ভাষাগত ও উপজাতীয় সংখ্যালঘুদের সকল ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা।
(জ) পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের অসম উন্নতির সমতা বিধানের ব্যবস্থা করা।
(ঝ) বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছাস, খরা ও পােকা এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।
(ঞ) জাতীয় সংস্কৃতি, শিল্পকলা, শিক্ষা, গবেষণা, খেলাধুলা ও শরীর গঠনের ব্যবস্থা করা।
(ট) পঞ্চশীলার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করা।
(ঠ) বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তি ও সামাজিক অগ্রগতির সংগ্রাম সমর্থন করা।
(ড) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পূর্ব বাংলাস্থ তৎপরতার বিরুদ্ধে সজাগ করা।
ইয়াহিয়া-ইয়াকুবের বেয়নেট-বুলেটের নিকট আত্মসমর্পন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য উপনিবেশিক শাসন ও শােষণ মেনে নেওয়া বা সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার দুটো পথ পূর্ব বাংলার জনগণের সামনে খােলা রয়েছে।
পূর্ব বাংলার জনগণ রক্তের বিনিময়ে প্রমাণ করেছে স্বাধীনতার চাইতে প্রিয় তাদের নিকট আর কিছুই নেই।
আপনি ও আপনার পার্টি অবশ্যই উপরােক্ত প্রস্তাবের ভিত্তিতে জনতার এ আশাআকাক্ষা প্রতিফলন করবেন। অন্যথায় পূর্ব বাংলার জনগণ কখনই আপনাকে ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করবে না।
পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা-জিন্দাবাদ!।
পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র-জিন্দাবাদ!।
পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ও তার দালালদের খতম করুন!
গ্রামে শহরে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করুন!।
সমস্ত দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করুন!
পৃষ্ঠা: ১২০
শেখ মুজিব ও তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে ভারতে গঠিত
পূর্ব বাংলার জনগণের প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রসঙ্গে
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন
(২০ এপ্রিল, ১৯৭১)
পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় স্বত্বাকে ধ্বংস করে এক স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করার জন্য তার ফ্যাসিবাদী সামরিক বাহিনী দ্বারা সবাইকে হত্যা করছে, সবকিছু পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং সবকিছু লুট করছে। পূর্ব বাংলার বীর জনগণ এই চরম ফ্যাসিবাদী বর্বরতার নিকট আত্মসমর্পন না করে বীরত্বের সাথে প্রতিরােধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিকট স্বাধীনতার চাইতে প্রিয় আর কিছুই নেই। এর জন্য যে কোনাে ত্যাগ স্বীকার করতে তারা প্রস্তুত।
পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ফ্যাসিবাদী হামলা পরিচালনা করার যখন পায়তারা করছিল তখন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ২রা মার্চ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নিকট একটি খােলা চিঠি প্রেরণ করে। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উল্লেখ ছিলঃ
* পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করা ব্যতীয় ছয় দফা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করা সম্ভব পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সৈন্যবাহিনীকে পূর্ব বাংলার ভূমিতে পরাজিত ও ধ্বংস করে তার রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার মাধ্যমে।
* মিটিং-মিছিল-অহিংস অসহযােগের ভুল পথ পরিত্যাগ করে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের পথ গ্রহণ করে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলার প্রজাতান্ত্রিক সরকার ঘােষণা করা এবং পূর্ব বাংলার প্রকাশ্য, গােপনে কার্যরত সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, ব্যক্তি, ধর্মীয়-ভাষাগত ও উপজাতীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী বিপ্লবী কোয়ালিশন সরকার গঠন করা।
* এ সরকার পূর্ব বাংলাব্যাপী কায়েম করার জন্য সংগ্রামের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য ও গােপনে কর্মরত পূর্ব বাংলার সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, ব্যক্তি, ধর্মীয়ভাষাগত-উপজাতীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট স্থাপন করা। এই সাথে পূর্ব বাংলার সরকারের সর্বনিম্ন কতকগুলি সুনির্দিষ্ট কর্মনীতির কথা। উল্লেখ করা হয়। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, অহিংস অসহযােগের ভুল পথে লেগে থাকে, স্বাধীনতা ঘােষণা, সরকার। গঠন ও মুক্তিফ্রন্ট গঠনে বিরত থাকে। এভাবে জনসাধারণকে তারা ফ্যাসিবাদী হামলার মুখে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও নেতৃত্বহীন করে রাখে।
পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী জনসাধারণের ওপর পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে এবং হত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু করে। লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র-নিরপরাধ জনসাধারণ নিহত হয়, আহত হয় ও প্রাণভয়ে সর্বস্ব পরিত্যাগ করে গ্রামে যেতে বাধ্য
পৃষ্ঠা: ১২১
হয়। তবুও তারা অসীম আত্মত্যাগ ও বীরত্বের সাথে প্রায় নিরস্ত্রভাবে প্রতিরােধ সংগ্রাম। চালিয়ে যাচ্ছে, রক্তের ঋণ তারা তুলবেই।
এ পর্যায়ে শেখ মুজিব ও তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠনের কথা ভারতের বেতারে শােনা যায়।
পূর্ব বাংলার জনগণ ও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মনে করে, পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থের সত্যিকার প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন সুনির্দিষ্ট নীতিসমূহ পালন করতে হবে।
* এই সরকার অবশ্যই একটি কোয়ালিশন সরকার হবে যেখানে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার বিভিন্ন প্রকাশ্য ও গােপনে কর্মরত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, ব্যক্তি,। ধর্মীয়-ভাষাগত-উপজাতীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
* পূর্ব বাংলার সর্বস্তরে এ সরকার স্থাপনের নিমিত্ত পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদানের জন্য পারস্পরিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যতার ভিত্তিতে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট স্থাপন করা; এতে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার সকল প্রকাশ্য ও গােপনে কার্যরত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, ব্যক্তি, ধর্মীয়ভাষাগত ও উপজাতীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি গ্রহণ করা।
* এ সরকার ও মুক্তিফ্রন্ট কর্তৃক পূর্ব বাংলার পরিপূর্ণ মুক্তির জন্য গণযুদ্ধের পথ গ্রহণ করা ও তাতে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকা।
* বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ সরকার ও মুক্তিফ্রন্ট নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন নীতিসমূহ পালন করবে
– ভারতসহ অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হবে পরস্পরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পরস্পর অনাক্রমণ, পরস্পরের আভ্যন্ত রীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক সহায়তা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চশীলা নীতির ভিত্তিতে।
– পূর্ব বাংলার মুক্তির জন্য পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের ওপর নির্ভর করা। ভারত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বা অন্য কোনাে দেশের সৈন্য, সশস্ত্র ব্যক্তিকে পূর্ব বাংলার মুক্তির সহায়তার নামে পূর্ব বাংলার ভূমিতে প্রবেশ করতে অনুমতি প্রদান না করা। এর বিরােধিতা করা। তাদের বেসামরিক বা সামরিক ব্যক্তির পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কোনাে সাহায্য গ্রহণ না করা, তাদের হস্তক্ষেপ বিরােধিতা করা।
– পশ্চিম বাংলার সাথে সংযুক্ত হয়ে যুক্তবাংলা স্থাপন বা ভারতের সাথে ফেডারেশন স্থাপনের বিরােধিতা করা।
– ভারত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বা অন্য কোন দেশের সাথে কোন প্রকার সামরিক জোট স্থাপন না করা, এদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান না করা, এ সকলের বিরােধিতা করা।
– এদেরকে পূর্ব বাংলায় কোনাে প্রকার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং কোনাে প্রকার সামরিক তৎপরতায় পূর্ব বাংলার ভূমি ব্যবহারের বিরােধিতা করা।
– পূর্ব বাংলায় সরকারের কার্য পরিচালনায় এবং নীতি নির্ধারণে ভারত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বা অন্য কোনাে দেশের কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপ বা প্রভাবের বিরােধিতা করা।
পৃষ্ঠা: ১২২
পূর্ব বাংলার মুক্তির বিষয়ে শর্তহীনভাবে সকল প্রকার বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করা। কিন্তু শর্তযুক্ত বা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত সকল প্রকার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা ও তার বিরােধিতা করা।
ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, প্যালেস্টাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের নিপীড়িত জাতি, দেশ ও জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী মুক্তি সংগ্রাম এবং সামাজিক অগ্রগতির সংগ্রামকে সমর্থন করা এবং সহায়তা করা।
* এ সরকার ও মুক্তিফ্রন্ট দেশের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন নীতিসমূহ পালন করবে।
– গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা এবং জনগণ থেকে আসা ও জনগণের নিকট নিয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করা।
– পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সরকার ও বেসরকারী সমস্ত পুঁজি ও প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা।
– ব্যক্তিগত জাতীয় পুঁজি রক্ষা করা।
– পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজি (একচেটিয়া ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা ও কারখানা) বাজেয়াপ্ত করা।
– মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট ইউনিয়নের পূর্ব বাংলাস্থ সকল পুঁজি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, তাদের ঋণ পরিশােধ বন্ধ করা।
– পর্যায়ক্রমে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার করে যে জমি চাষ করে তার হাতে জমি প্রদান করা।
– শ্রমিকের আট ঘণ্টা সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করা।
– দেশপ্রেমিক প্রতিটি রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, ব্যক্তি বা সংগঠনের কার্য পরিচালনার অবাধ অধিকার প্রদান করা। তাদের বিরুদ্ধে গােয়েন্দা তৎপরতা, গ্রেফতার ও বিনা বিচারে বন্দী রাখার পদ্ধতি বিরােধিতা করা।
উপরােক্ত সর্বনিম্ন নীতিসমূহের অন্তর্ভুক্তি ব্যতীত কোনাে সরকার বা সংস্থা পূর্ব বাংলার জনগণের সত্যিকার রাজনৈতিক মুক্তি আনয়ন করতে পারে না। উপরন্তু এসকল বিষয় ব্যতীত মুক্তি সংগ্রাম হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্রে পরিচালিত প্রতিবিপ্লবী সংগ্রাম এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে পূর্ব বাংলা হবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের উপনিবেশ এবং এ সরকার হবে এদের পুতুল সরকার।
পূর্ব বাংলার জনগণ এক উপনিবেশিক শােষণের পরিবর্তে অপর এক উপনিবেশিক শােষণের জালে আবদ্ধ হতে চায় না।
কাজেই উপরােক্ত শর্তসমূহ ব্যতীত পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন শেখ মুজিব ও তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে সমর্থন করে না এবং এ সরকার বাস্তবায়নে কোনাে প্রকার সহযােগিতা বা সংগ্রাম করে না। উপরােক্ত শর্তসমূহ ব্যতীত এ সরকারকে পূর্ব বাংলার জনগণ ও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মনে করে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্রের ফল, যার উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত
পৃষ্ঠা: ১২৩
করা, একে লুণ্ঠন ও শােষণ করা। পূর্ব বাংলার জনগণ ও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন একে বিরােধিতা করে।
পূর্ব বাংলার সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, ব্যক্তি, ধর্মীয়, ভাষাগত এবং উপজাতীয় সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগের সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের প্রতি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন আহ্বান জানাচ্ছে উপরােক্ত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্ত করে একটি কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করুন, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতন্ত্রের গণযুদ্ধে লেগে থাকুন, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করুন।
পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি পয়েন্ট
১। পাকিস্তানের ফ্যাসীবাদী উপনিবেশিক সামরিক চক্রের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
২। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রাম প্রগতিশীল নয়। এ কারণে পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের সর্বহারারা ইহা সমর্থন করে না (থিসিস দ্রষ্টব্য)।
৩। শেখ মুজিব ও তার সমর্থকদের স্বতস্ফূর্ত প্রতিরােধ পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে পারবে না।
৪। ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন ও সহায়তায় পূর্ব বাংলার সত্যিকার মুক্তি আসতে পারে না, আসতে পারে নতুন শৃঙ্খল ও পরাধীনতা।
৫। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অর্জিত হবে।
৬। দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের পথ পূর্ব বাংলার মুক্তির পথ।
৭। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল কর। জাতীয় শত্রু খতম কর।
৮। পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ কর।
৯। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক লাইন সঠিক।
পৃষ্ঠা: ১২৪
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা
সাহসী হােন, দৃঢ়ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করুন,
জাতীয় শত্রু খতম করুন, জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলুন,
কর্মসূচী বাস্তবায়িত করুন
(২৩ এপ্রিল, ১৯৭১)
পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী ও তার পদলেহী কুকুর পূর্ব বাংলার বিশ্বাসঘাতকরা পূর্ব বাংলার অধিকাংশ জেলা, মহকুমা শহর দখল করেছে এবং সেখানে নিজেদের দখল বজায় রেখেছে। যে কয়টি জেলা বা মহকুমায় তাদের অধিকার কায়েম হয়নি তা অচিরেই তারা দখল করবে। শহরে আওয়ামী লীগ, বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর, পুলিশের প্রতিরােধ ভেঙ্গে পড়ছে। শহরে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী তাদের ফ্যাসিবাদী বর্বরতা অব্যাহত রেখেছে এবং ভেঙ্গে যাওয়া বেসামরিক প্রশাসন পুনরায় চালু করার জন্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্য-লুণ্ঠন চালাবার চেষ্টা করছে।
পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলের থানা, ফাড়িসমূহ নিষ্ক্রিয়। তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, জনগণের বিরুদ্ধে, বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে কোনাে তৎপরতা চালাচ্ছে না এবং কারও ইচ্ছে থাকলেও সাহস করছে না। এদের অনেকেই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সমর্থন। করে আওয়ামী লীগের সাথে সহযােগিতা করছে।
থানাসমূহের বেসামরিক প্রশাসন কোনাে কোনাে এলাকায় চলছে, কোনাে কোনাে এলাকায় নিষ্ক্রিয়। তারাও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, জনগণ ও বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে কিছু করছে।
বা কেউ করতে চাইলে সাহস পাচ্ছে না।
স্থানীয় টাউট, জুলুমবাজ, জাতীয় শত্রুরা নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে এবং অনেকে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক রেখে বেঁচে আছে। তারাও জনগণ ও বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু করতে সাহস করছে না।
আওয়ামী লীগের অবস্থা ধ্বংসসানুখ। কোথাও কোথাও তাদের নেতৃত্ব পালিয়েছে। বা নিষ্ক্রিয় হয়েছে। সাধারণ কর্মীরাও নেতৃত্বশূন্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়েছে। তারা আভ্যন্তরীণ কোন্দল, উপনিবেশিক সরকারের চাপ, জনগণের ওপর নির্ভরতা ও বিপ্লবী কাজে অক্ষমতার জন্য ভারতীয় সমর্থন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর, পুলিশের সহায়তা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার সুযােগ পেয়েও তা যথাযথভাবে দখল করে জনগণের উপকারে লাগায়নি। উপরন্তু তারা অর্থ আত্মসাৎ, মুনাফাখাের, কালােবাজারী, টাউট, জাতীয় শত্রুদের ছত্রছায়া দিয়েছে। তাদের ব্যর্থতা ও দেউলিয়াত্ব জনসাধারণের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের দ্বারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সম্ভব নয়।
জনগণের রয়েছে উঁচু রাজনৈতিক চেতনা, কালােবাজারী-মজুতকারী ও
পৃষ্ঠা: ১২৫
মুনাফাখাের, জাতীয় শত্রু ও উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর উৎখাতের তীব্র আকাঙ্খ; তারা মুক্তিযুদ্ধ চালাতে, এতে শরীক হতে এবং তাতে সহায়তা করতে চায়।
মুনাফাখাের, কালােবাজারী, মজুতদারদের কারণে গ্রামে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্য প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। শহর থেকে গ্রামে শ্রমিকরা চলে আসায় এবং গ্রামে কর্মস্বল্পতাও এর কারণ।
উপরােক্ত অবস্থা থেকে দেখা যায় উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর কর্তৃত্ব শহর এলাকায় স্থাপিত হয়েছে, এবং তা সুদৃঢ় হচ্ছে, এতে তারা সক্ষম। কিন্তু বিস্তীর্ণ গ্রাম্য এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব নেই। ইহা পূর্বের মত স্থাপন করতেও এদের বহু সময় লাগবে। বিশেষ করে প্রশাসনিক কর্মচারীদের পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজে লাগানাে, পুলিশ বাহিনী থানায় মােতায়েন করে তাদের দ্বারা স্বাধীনতা বিরােধী কাজ করানাে সময়সাপেক্ষ।
সৈন্যবাহিনীর নিজেদের পক্ষে থানায় ঘাঁটি করা, সেখান থেকে গ্রাম দখল করা, তাদের সৈন্যস্বল্পতা, জনগণ এবং বিপ্লবীদের সশস্ত্র প্রতিরােধের জন্য বর্তমানে সম্ভব। নয়। তারা বহুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে (অল্প সৈন্য নিয়ে যাবে না কারণ তাহলে তারা ধ্বংস হবে, এ সম্ভাবনা রয়েছে বলে) এক এক এলাকায় “খোজ কর ও ধ্বংস কর”, “ঘেরাও কর ও দমন কর” অভিযান চালাবে এবং সবাইকে হত্যা করবে, সবকিছু পুড়িয়ে দিবে। এবং লুট করবে। এবং পুনরায় শহরের ঘাটিতে ফিরে যাবে।
এ অবস্থায় পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রাম্য এলাকায় পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের সরকার কায়েম করা, জাতীয় শত্রুদের খতম করা, জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তােলা এবং আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করা সম্ভব।
ক্ষমতা দখল
গ্রাম্য এলাকায় পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের গ্রাম, থানা ভিত্তিক কমিটি কায়েম করতে হবে, কমিটি জনগণের সভা আহ্বান করে নির্বাচিত হবে। কমিটিতে ক্ষেতমজুর, গরীব। চাষী, শ্রমিক, মাঝারী চাষী, দেশপ্রেমিক জমিদার ও বুর্জোয়া ও আমাদের প্রতিনিধি থাকবে।
কমিটিতে সভাপতি-সহসভাপতি ও সদস্য থাকবে (৫ বা ৭ জন)।
এই কমিটির মাধ্যমে আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে হবে। কালােবাজারীমজুতদারী, অতিরিক্ত মুনাফাখােরদের শাস্তি দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের অর্থের হিসেব নিতে হবে। অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি দিতে হবে।
এই কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে হবে জনসাধারণ, গেরিলা, সশস্ত্র জনসাধারণ (গ্রামরক্ষী বাহিনী ইত্যাদি) দ্বারা।
গ্রামের জাতীয় শত্রুদের বিচার ও শাস্তি বিধান করা, তাদের ভূমি বিতরণ করা, সুদ বাতিল করা, অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবিধান করা; গ্রাম্য বিচার করা, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি বন্ধ করা।
জাতীয় শত্রুদের নিকট থেকে বলপূর্বক চাঁদা নিতে হবে। জনসাধারণের নিকট থেকে তার সামর্থ অনুযায়ী চাদা নিতে হবে।
জনসাধারণের মাঝে প্রতিরােধের প্রচার চালাতে হবে, জনতাকে গ্রামরক্ষী বাহিনীতে সংগঠিত করতে হবে, তাদের মধ্য থেকে সৈন্যবাহিনীতে যােগদানে ইচ্ছুকদের সংগ্রহ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, হসপিটাল ও অন্যান্য জনগণের প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে।
পৃষ্ঠা: ১২৬
জাতীয় মুক্তিবাহিনী
গ্রাম্য এলাকায় জনসাধারণের মধ্য থেকে সৈন্যবাহিনীতে লােক সংগ্রহ করা সম্ভব। তাদের ভাতার ব্যবস্থা করা সম্ভব জাতীয় শত্রুদের অর্থ ও খাদ্য দ্বারা। তাদেরকে সশস্ত্র করা। যায় থানাসমূহে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে তাদের অস্ত্র দ্বারা, জাতীয় শত্রুর অস্ত্র দখল করে এবং জনসাধারণের মধ্যে যুদ্ধ করছে না এরূপ ব্যক্তিদের অস্ত্র সংগ্রহ করে তার দ্বারা এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা। সৈন্যবাহিনীকে খতম করে তার নিকট থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা যায়।
সাত বা নয় জনকে নিয়ে একটি সেকশন, তিনটি সেকশন নিয়ে একটি স্কোয়াড, তিনটি স্কোয়াড নিয়ে একটি প্লাটুন গঠন করা। প্রতিটি ইউনিটের নেতা, সহকারী নেতা থাকবে। এদেরকে উদ্ধৃতির শৃংখলা, তিনটি প্রবন্ধ, গণযুদ্ধ পড়াতে হবে।
দীর্ঘ হাঁটা, অতর্কিত আক্রমণ, বােমাবর্ষণ, তীর, ল্যাজা, ছুরি, তরওয়াল ব্যবহার শেখানাে, বেয়নেট মারা শেখানাে উচিত।
এদের মধ্য থেকে পার্টি সদস্য সংগ্রহ করতে হবে এবং পার্টি কমিটি গঠন করতে হবে।
এই সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন গ্রাম, ছােট শহর দখল করবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম করবে, স্থানীয় জনসাধারণকে সশস্ত্র করবে। পার্টি-সংগঠন গড়ে তুলবে, প্রচার করবে, সৈন্য সংগ্রহ করবে।
মুক্তি বাহিনীর স্কোয়াডসমূহ স্থানীয় পার্টিকর্মীর সহায়তায় এক এক গ্রামে প্রবেশ করবে এবং জাতীয়শত্রু খতম করবে। জনসমর্থন ও সহায়তার জন্য, অবস্থা বিরাজ করলে জনসভা করবে এবং উপরের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে।
এই সৈন্যবাহিনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পক্ষে বর্তমান পর্যায়ে টিকে থাকা ও বিকাশ লাভ করা সম্ভব।
গ্রাম্য এলাকায় পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর স্থানীয় প্রশাসন ও দালাল জাতীয় শত্রুদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে সেখানে বিপ্লবীদের গােপন কাজ করা এবং বিকাশ করা কষ্টকর হবে, ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণে বিপ্লবী কাজে ভাটা আসবে।
কাজেই আসুন, আমরা বর্তমান বিপ্লবী জোয়ারের সুবিধাজনক অবস্থায় পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রাম দখল করি, রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করি, জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলি, কর্মসূচী বাস্তবায়িত করি।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন-জিন্দাবাদ
পূর্ব বাংলা প্রজাতন্ত্র কায়েম কর!
গ্রাম্য এলাকা-দখল কর!
রাজনৈতিক ক্ষমতা-কায়েম কর!
জাতীয় শত্রু খতম কর!
জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তােল!
কর্মসূচী-বাস্তবায়িত কর!
পাকিস্তানের উপনিবেশিক ফ্যাসিস্টদের ধ্বংস অনিবার্য। এরা কাগুজে বাঘ!
পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবী জনগণ-ঐক্যবদ্ধ হােন!
সংশােধনবাদ, নয়া সংশােধনবাদ, ট্রটস্কী-চেবাদ, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত খতম করুন!
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সঠিক। এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হােন!।
আমাদের বিজয় অনিবার্য। ইয়াহিয়া-টিক্কার ধ্বংস অনিবার্য।
পৃষ্ঠা: ১২৭
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির
খসড়া সংবিধান
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির আহ্বায়ক কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত
[প্রতি সাংগঠনিক একক এবং কর্মীর খসড়া সংবিধান সম্পর্কে অভিমত ও প্রস্তাব থাকলে তা আহ্বায়ক কমিটির নিকট প্রেরণ করবেন]
প্রথম অধ্যায়ঃ
সাধারণ কর্মসূচী
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি হচ্ছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রগামী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত, ইহা হচ্ছে সজীব ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি অগ্রগামী সংগঠন যা জাতীয় ও শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবী জনসাধারণকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে গ্রহণ করেছে এর চিন্তাধারার পথ নির্দেশের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে। মাওসেতুঙ চিন্তাধারা হচ্ছে এমন একটা যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ সামগ্রিক ধ্বংসের মুখে চলেছে আর সমাজতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিশ্বব্যাপী বিজয়ের পথে।
অর্ধ শতাব্দী ধরে কমরেড মাওসেতুঙ চীনের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান সংগ্রামে নেতৃত্বদানে, চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক গঠনের মহান সংগ্রামে নেতৃত্বদানে, সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিক সংশােধনবাদ ও বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহান সংগ্রামে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সার্বজনীন সত্যকে বিপ্লবের বাস্তব অনুশীলনের সাথে সমন্বয় সাধন করেছেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে উত্তরাধীকার সূত্রে লাভ করেছেন, রক্ষা করেছেন ও বিকাশ করেছেন এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে এক সম্পূর্ণ নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। কমরেড লিন পিয়াও সর্বদাই মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মহান লাল পতাকাকে উর্ধে ধারণ করে আসছেন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও অটলভাবে কমরেড মাওসেতুঙের সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী লাইনকে কার্যকরী ও রক্ষা করছেন। কমরেড লিন পিয়াও হচ্ছেন কমরেড মাওসেতুঙের ঘনিষ্ঠ সহযােদ্ধা ও উত্তরাধীকারী।১
…………………………………………………………………….
১. লিন পিয়াও সংক্রান্ত এ অধ্যায়টি পরবর্তীতে ক. সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে ‘৭৩ সালে সংবিধান থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১২৮
২. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মসূচী হচেছ পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহের সমাধান করা এবং কমিউনিজম বাস্তবায়িত করা।
পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহ নিম্নরূপ :
১) পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব,। ২) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব, ৩) সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব, ৪) বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।
উপরােক্ত দ্বন্দ্বসমূহের মাঝে প্রধান দ্বন্দ্ব হলাে পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলার বিশ্বাসঘাতক আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের অধিকাংশের উপর নির্ভর করে পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করেছে এবং একে শােষণ ও লুণ্ঠন করছে। পূর্ব বাংলার সমাজ তার বিকাশের নিজস্ব নিয়মেই জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে বৈদেশিক শােষণের অবসান এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদকে উৎখাত করে পূর্ব বাংলায় বুর্জোয়া বিকাশের শর্ত সৃষ্টির লক্ষ্য সামনে রেখে এগুচ্ছে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য হলাে পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী, তাদের সহযােগী ও সমর্থক বিশ্বাসঘাতক আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে পূর্ব বাংলা থেকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে বিরােধিতা করা; সামন্তবাদ ব্যতীত অন্যান্যদের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ করা; সামন্তবাদীদের ভূ-সম্পত্তি ক্ষেতমজুর-গরীব চাষীদের মাঝে বিতরণ করা।
পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য হলাে সামন্তবাদকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা, সামন্তবাদীদের ভূ-সম্পত্তি ক্ষেতমুজর-গরীব চাষীদের মাঝে বিতরণ করা। সামন্ত বাদীদের মাঝে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থীদেরকে জাতীয় বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় উৎখাত করা, জাতীয় বিপ্লব সমর্থক সামন্তবাদীদের শােষণ কমানাে, তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকতে দেওয়া, শেষ পর্যন্ত যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের ভূমিও কৃষকদের মাঝে বিতরণ করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিপ্লব পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করা।
পূর্ব বাংলার বর্তমান সামাজিক বিপ্লবের চরিত্র হলাে জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব। জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরস্পর যুক্ত এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব কেবলমাত্র সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব।
এ যুদ্ধ হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী ও নির্মম যুদ্ধ। ইহা পরিচালনা ও সম্পন্ন করা যাবে কেবলমাত্র গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়ােগ করে। জাতীয় মুক্তির গণযুদ্ধের
পৃষ্ঠা: ১২৯
বর্তমান রূপ হচ্ছে পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সহযােগী ও সমর্থক অর্থাৎ তাদের চোখ ও কান- জাতীয় শত্রুদের খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা ও পরিচালনা করা।
জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে সূচিত ও পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় জনসাধারণকে জাগরিত করা, সংগঠিত করা এবং তাদের শক্তিকে শত্রুর। বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করা যায়; পার্টিকর্মী ও গেরিলারা যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধ শেখে, বিপ্লবী অনুশীলনে পােড় খায়; অস্ত্র-অর্থ সংগৃহীত হয়, সংগঠন বিকশিত ও সুসংবদ্ধ হয়, গ্রামসমূহ জাতীয় শত্রুমুক্ত হয়, সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম করা যায়।
এভাবে গ্রাম দখল করে ঘাঁটি স্থাপন করা, শহর ঘেরাও করা, গেরিলা বাহিনী থেকে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলা, গেরিলা যুদ্ধকে সচল যুদ্ধে উন্নীত করা, যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করা, শত্রুর মনােবল ভেঙ্গে দেওয়া, তার শক্তিকে দুর্বল করা, দেশীয়-আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করা সম্ভব হয়।
জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে সূচীত গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসঘাতক সামন্তবাদীদের উৎখাত করা এবং জাতীয় মুক্তি সমর্থক সামন্তবাদীদের শােষণ হ্রাস করার ফলে কৃষক-শ্রমিক মৈত্রী গড়ে উঠে ও দৃঢ়তর হয়। এই দৃঢ় মৈত্রীর ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা, একে টিকিয়ে রাখা ও বিকশিত করা যায়।
পূর্ব বাংলার সমাজের বিপ্লবী অনুশীলনের অগ্নিপরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এ সকল রাজনৈতিক, সামরিক ও ঐক্যফ্রন্টের লাইন সমগ্র পার্টি অবশ্যই কার্যকরী করবে।
পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর জাতীয় শশাষণ ও লুণ্ঠন বিরােধী পূর্ব বাংলার জনগণের মহান সংগ্রামের সুযােগ গ্রহণ করে পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের এক অংশ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় পূর্ব বাংলাকে দখল করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ এই ছয় পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠন কায়েমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্ৰেণী সাম্রাজ্যবাদ-সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদের সাথে শত-সহস্র বন্ধনে যুক্ত এবং শ্ৰেণী হিসেবে দুর্বল এবং দোদুল্যমান। তাদের অনেকেই আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদীদের ছয় পাহাড়ের শােষণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় শামিল হয়েছে।
এ কারণে এদের দ্বারা পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন। করা সম্ভব নয়।
কাজেই একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষেই পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব। পরিচালনা ও সম্পন্ন করা সম্ভব। সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে এ বিপ্লব হবে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এর পরিণতি হবে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করার মাধ্যমে সমাধান করা এবং চূড়ান্তভাবে কমিউনিজম বাস্তবায়িত করা। এ বিপ্লব বিশ্ববিপ্লবের অংশ।
পৃষ্ঠা: ১৩০
৩. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা বারংবার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। সভাপতি মাওসেতুঙের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লবীদের আধুনিক সংশােধনবাদ ও বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহান সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও দীক্ষিত হয়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা মনি সিং-মােজাফ্ফর সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এ মহান বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বুর্জোয়া উপদল প্রতিষ্ঠা করে এবং লাল পতাকাকে নেড়ে লাল পতাকার বিরােধিতা করে। সর্বহারা সাধারণ বিপ্লবীদের নয়া সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামের সুযােগ গ্রহণ করে দেবেন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারীরা সর্বহারার সংগঠনের নামে বিভিন্ন বুর্জোয়া উপদল গঠন করে। এ সকল বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা প্রতিনিয়ত সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তাদেরকে বিপথে পরিচালনা করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর একটি সত্যিকার রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা ১৯৬৮ সালের ৮ই জানুয়ারী পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে এবং বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক, মতাদর্শগত ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও অনুশীলন উভয়ভাবেই মহান সংগ্রাম পরিচালনা করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মাত্র সাড়ে তিন বৎসর সময়ের মধ্যে মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে সাফল্যের সাথে সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও মতাদর্শগত ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও অনুশীলনে বিরাট বিজয় অর্জন করেছে।
পাকিস্তানী উপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গােলার শব্দের মাঝে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে অতি অল্প সময়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় গেরিলা ফ্রন্ট, পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর পরিপূর্ণ নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি বাহিনী ও জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ে উঠেছে, পার্টিকর্মী ও গেরিলারা তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সংযােগ সাধন করে অধিকতর পরিপক্ক হয়েছে। এভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার যথাযথ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সমগ্র পার্টিকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মহান লাল পতাকাকে উর্ধে তুলে ধরতে হবে, পার্টির সঠিক মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক লাইন প্রতিনিয়ত অনুশীলনের সাথে সমন্বয় সাধন করতে হবে, পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে; সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে লেগে থাকতে হবে এবংসমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনে লেগে থাকতে হবে। এভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, এর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি বাহিনী ও জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে।
পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর চরমতম ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের পরিস্থিতিতে পার্টি গােপনভাবে কার্য পরিচালনা করবে। গেরিলা অঞ্চলসমূহেও গােপনভাবে পার্টির কার্য পরিচালিত হবে। কেবলমাত্র ঘাঁটি এলাকায় প্রকাশ্য পার্টি তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব।
পৃষ্ঠা: ১৩১
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, সর্বহারা শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতাবাদে অটল থেকে দৃঢ়তার সাথে সারা দুনিয়ার প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি ও সংগঠনের সংগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমগ্র দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণী, নিপীড়িত জনগণ ও নিপীড়িত জাতির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিক সংশােধনবাদ যার কেন্দ্র হলাে সােভিয়েট সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র, বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য, পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা মানুষ শােষণ করার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য এবং সমগ্র মানব জাতির মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম চালাচ্ছে।
কমিউনিজমের জন্য সারা জীবন কঠোর সংগ্রাম করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্যদের অবশ্যই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আত্মবলিদানে নির্ভয় হতে হবে, সমস্ত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বিজয় অর্জন করতে হবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়
পার্টি সদস্য
প্রথম ধারাঃ আঠারাে বছর বয়স হলেই পূর্ব বাংলার শ্রমিক, গরীব কৃষক, নিম্নমাঝারী কৃষক, বিপ্লবী সামরিক লােক ও অন্যান্য বিপ্লবী ব্যক্তি যারা পার্টির সংবিধান স্বীকার করে, পার্টির কোন একটি সংগঠনে যােগ দেয় এবং সেখানে সক্রিয়ভাবে কাজ করে, পার্টির সিদ্ধান্ত পালন করে, পার্টির শৃঙ্খলা মেনে চলে, পার্টির চাঁদা দেয়, তারা সকলেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্য হতে পারে।
দ্বিতীয় ধারাঃ পার্টির সদস্য পদপ্রার্থীর অবশ্যই পার্টিতে ভর্তির নিয়মাবলী পালন করতে হবে, সুপারিশের জন্য একজন সদস্য থাকতে হবে, পার্টিতে যােগদানের আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে এবং পার্টি শাখার দ্বারা পরীক্ষিত হতে হবে, আর পার্টি শাখাকে অবশ্যই ব্যাপকভাবে পার্টির ভেতরের (ও) বাইরের জনসাধারণের মতামত শুনতে হবে। তার কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে। এ সকল তথ্যের ভিত্তিতে তাকে পার্টিতে গ্রহণের সিদ্ধান্ত পার্টি শাখার সাধারণ অধিবেশনের দ্বারা গৃহীত ও পরবর্তীতে উচ্চতর পার্টি কমিটির দ্বারা অনুমােদিত হতে হবে।
তৃতীয় ধারাঃ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্যদের অবশ্যকরণীয় কাজ হচ্ছে ?
১) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে সজীবতার সাথে অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করা।
২) পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের বিরাট সংখ্যাধিক লােকের স্বার্থে কাজ করা।
৩) যারা ভুল করে তাদের বিরােধিতা করেছিল কিন্তু ভুল সংশােধনে মনােযােগী তাদেরসহ বিরাট সংখ্যাধিক লােকের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে সক্ষম হওয়া, কিন্তু মতলববাজ, ষড়যন্ত্রকারী ও দুমুখাে ব্যক্তিদের সম্পর্কে অবশ্যই বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। এ ধরনের খারাপ লােকদের দ্বারা পার্টির ও পার্টির নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সংস্থার নেতৃত্ব চিরকালই মার্কসবাদী বিপ্লবীদের হাতে থাকে, তা সুনিশ্চিত করতে হবে।১
…………………………………………………………………….
১. সম্ভবতঃ এই বাক্য গঠনে কোন সমস্যা ছিল বা পাণ্ডুলিপিতে কোন ত্রুটি হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে খারাপ লােকেরা যেন পার্টির নেতৃত্ব দখল করতে না পারে তা সুনিশ্চিত করার কথা এখানে বলা হয়েছে -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৩২
৪) কোন বিষয় থাকলে জনসাধারণের সাথে পরামর্শ করা
৫) সাহসের সাথে সমালােচনা ও আত্মসমালােচনা করা।
চতুর্থ ধারাঃ পার্টি সদস্য পার্টির শৃংখলা লংঘন করলে পার্টির বিভিন্ন স্তরের সংগঠনের নিজেদের ক্ষমতার আওতাধীনে বাস্তব অবস্থা অনুসারে পৃথক পৃথকভাবে শাস্তি দিতে হবে; সতর্ক করতে হবে, গুরুতররূপে সতর্ক করতে হবে, পার্টির পদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে, পার্টির মধ্যে রেখে যাচাই করে দেখতে হবে অথবা পার্টি থেকে বহিস্কার করতে হবে।
পার্টি সদস্যকে পার্টির মধ্যে রেখে যাচাই করে দেখার মেয়াদকাল খুব বেশী হলে এক বছরের বেশী হতে পারবে না। পার্টির মধ্যে রেখে যাচাই করে দেখার মেয়াদকালে তার ভােট দানের, নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার থাকবে না।
পার্টি সদস্যদের মাঝে যারা উৎসাহ-উদ্দীপনাহীন এবং শিক্ষা দানের পরেও পরিবর্তিত হয় না, তাদেরকে পার্টি থেকে বেরিয়ে যেতে উপদেশ দেওয়া উচিত।
পার্টি সদস্য পার্টি থেকে বেরিয়ে যেতে দরখাস্ত করলে পার্টি শাখার সাধারণ অধিবেশনের অনুমােদনক্রমে তার নাম কেটে দিতে হবে এবং পরবর্তী উচ্চতর পার্টি কমিটির কাছে রেকর্ড রাখার জন্য রিপাের্ট পেশ করতে হবে। প্রয়ােজন হলে, ইহা পার্টি বহির্ভূত জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করতে হবে।
অকাট্য প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ বিশ্বাসঘাতক, গুপ্তচর, একেবারে অনুশােচনাবিহীন পুঁজিবাদের পথগামী কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি; অধঃপতিত ব্যক্তি, শ্রেণীগতভাবে বৈর ব্যক্তিদেরকে পার্টি থেকে বহিস্কার করতে হবে এবং তাদেরকে পার্টিতে পুনরায় যােগদান করতে অনুমতি দেওয়া হবে না।
তৃতীয় অধ্যায়ঃ
পার্টির সাংগঠনিক নীতি
পঞ্চম ধারাঃ পার্টির সাংগঠনিক নীতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা। পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় সংস্থা গণতান্ত্রিক পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়।
সমগ্র পার্টির অবশ্যই একক শৃংখলা মানতে হবেঃ ব্যক্তি সংগঠনের অধীন, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন, নিম্নস্তর উচ্চতর স্তরের অধীন ও সমগ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন থাকবে।
কংগ্রেস অথবা পার্টি সদস্যদের সাধারণ সম্মেলনের নিকট পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় সংস্থার নিজের কাজ-কর্ম সম্বন্ধে নিয়মিতভাবে রিপাের্ট পেশ করতে হবে, সব সময়ে পার্টির ভেতরের ও বাইরের জনসাধারণের মতামত শােনা ও তাদের তদারকি মেনে নিতে হবে।
পার্টির সংগঠনকে ও বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে সমালােচনা করার ও তাদের নিকট প্রস্তাব পেশ করার অধিকার পার্টি সদস্যদের রয়েছে।
পার্টি সংগঠনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ সম্পর্কে পার্টি সদস্যদের যদি ভিন্নমত থাকে, তাহলে সেটাকে সে পােষণ করতে পারে এবং তার এমন অধিকারও রয়েছে যে, স্তর ছাড়িয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির নিকট পর্যন্ত রিপাের্ট পেশ করতে পারে। এমন রাজনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি করা
পৃষ্ঠা: ১৩৩
উচিৎ, যার মধ্যে থাকবে যেমনি কেন্দ্রীকতা তেমনি গণতন্ত্র, যেমনি শৃংখলা তেমনি স্বাধীনতা, যেমনি একক সংকল্প তেমনি থাকবে ব্যক্তির মনের প্রফুল্লতা ও সজীবতা।
জাতীয় মুক্তি ফৌজ, সর্বহারা যুবলীগ, পাঠচক্র, শ্রমিক, গরীব ও নিম্নমাঝারী কৃষক ও অন্যান্য বিপ্লবী জনসাধারণের সংগঠন সকলকে অবশ্যই পার্টির নেতৃত্ব মানতে হবে।
ষষ্ঠ ধারাঃ পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃস্থানীয় সংস্থা হচ্ছে জাতীয় কংগ্রেস ও তার দ্বারা নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি। স্থানীয়, সৈন্যবাহিনীর ও বিভিন্ন বিভাগগুলাের পার্টির নেতৃস্থানীয় সংস্থা হচ্ছে তাদের সমস্তরের পার্টির কংগ্রেস অথবা পার্টি সদস্যদের সাধারণ সম্মেলন ও তার দ্বারা নির্বাচিত পার্টির কমিটি। পার্টির বিভিন্ন স্তরের কংগ্রেস পার্টির কমিটি কর্তৃক আহুত হয়।
স্থানীয় ও সৈন্যবাহিনীর পার্টির কংগ্রেস আহ্বান করাটা এবং নির্বাচিত পার্টি কমিটির সদস্যদের অবশ্যই উচ্চতর স্তরের অনুমােদিত হতে হবে।
সপ্তম ধারাঃ কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব, জনসাধারণের সংগে ঘনিষ্ট যােগাযােগ, সহজ ও কার্যকরী কাঠামাের নীতির ভিত্তিতে পার্টির বিভিন্ন স্তরের কমিটিগুলাে কর্মসংস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে বা নিজেদের প্রতিনিধি সংস্থা প্রেরণ করবে।
চতুর্থ অধ্যায়ঃ
পার্টির কেন্দ্রীয় সংগঠন
অষ্টম ধারাঃ পার্টির জাতীয় কংগ্রেস প্রতি তিন বছরে একবার অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের আগে অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে অথবা স্থগিত রাখা যেতে পারে।
নবম ধারাঃ কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনই কেন্দ্রীয় কমিটির স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত করে।
যখন কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন হয় না, তখন কেন্দ্রীয় কমিটির স্থায়ী কমিটিই কেন্দ্রীয় কমিটির ক্ষমতা পালন করে। স্থায়ী কমিটি দ্বারা কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন আহত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির বা স্থায়ী কমিটির যখন পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় না তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির ক্ষমতা পালন করবেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পার্টির সৈন্য বাহিনী ও পার্টির নেতৃত্বাধীন সংস্থাসমূহের কার্য পরিচালনার জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় কর্মীর নেতৃত্বে প্রয়ােজনীয়, সহজতর ও ক্ষমতাশীল সংস্থা গঠন করে নেবেন।
পঞ্চম অধ্যায়ঃ
পার্টির স্থানীয় ও সৈন্যবাহিনীর মধ্যকার সংগঠন
দশম ধারাঃ আঞ্চলিক, ফ্রন্ট, জেলা ও জেলার উপরকার স্থানীয় পার্টিসংগঠনগুলাের কংগ্রেস প্রতি দেড় বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের আগে অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে বা স্থগিত রাখা যেতে পারে।
স্থানীয় পার্টি কমিটিই সম্পাদক, সহ-সম্পাদক এবং প্রয়ােজনবােধে স্থায়ী কমিটি নির্বাচন করে।
পৃষ্ঠা: ১৩৪
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ
পার্টির প্রাথমিক সংগঠন
একাদশ ধারাঃ কল-কারখানা, খনি ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান, অফিস-কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান, শহর-পাড়া, জাতীয় মুক্তি বাহিনীর প্লাটুন ও অন্যান্য প্রাথমিক ইউনিটে সাধারণতঃ পার্টি শাখা (নয় থেকে উনিশ জন বা অধিক সদস্য) প্রতিষ্ঠিত করা। হয়; যেখানে অপেক্ষাকৃত কম সদস্য রয়েছে সেখানে পার্টি গ্রুপ গঠন করা যায়; সদস্য
থাকলে পার্টি প্রতিনিধি নিয়ােগ করা যায়। যেখানে পার্টি সদস্য অপেক্ষাকৃত বেশী। রয়েছে অথবা বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য প্রয়ােজন হলে সংযুক্ত পার্টি শাখা বা প্রাথমিক পার্টি কমিটি প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
প্রতি বছর পার্টির প্রাথমিক সংগঠন একবার নির্বাচিত হয়। বিশেষ অবস্থায় নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ের আগে অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে অথবা স্থগিত রাখা যেতে পারে।
দ্বাদশ ধারাঃ পার্টির প্রাথমিক সংগঠনকে অবশ্যই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মহান লাল পতাকাকে উর্ধে তুলে ধরতে হবে, সর্বহারা শ্রেণীর রাজনীতিকে উর্ধে স্থান দিতে হবে এবং তত্ত্ব ও অনুশীলনের সংযােজনের রীতিকে, জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযােগের রীতিকে, সমালােচনা ও আত্মসমালােচনার রীতিকে বিকশিত করতে হবে।
এর প্রধান কর্তব্য হচ্ছেঃ
১) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে সজীবতার সাথে অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করার জন্য পার্টি সদস্য ও ব্যাপক বিপ্লবী জনসাধারণকে নেতৃত্ব দান করা।
২) সব সময় পার্টি সদস্য ও ব্যাপক বিপ্লবী জনসাধারণকে প্রধান ধরনের সংগ্রাম। হিসেবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দান করা, পার্টির নেতৃত্বে প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তােলা।
৩) কৃষক-শ্রমিক মৈত্রীর ভিত্তিতে সকল দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করা, জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ে তােলা, একে বিকশিত ও সুসংবদ্ধ করা।
৪) পার্টির নীতি প্রচার করা ও তা বাস্তরে রূপায়িত করা, পার্টির সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা, পার্টি ও দেশের দ্বারা অর্পিত প্রতিটি কর্তব্য সম্পন্ন করা।
৫) জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যােগাযােগ স্থাপন করা, সব সময়ে জনসাধারণের মতামত ও দাবীদাওয়া শােনা, পার্টির ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও ক্ষুদে বুর্জোয়া এবং শােষক শ্রেণীর মতাদর্শ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে। সক্রিয় মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানাে, যাতে করে পার্টির জীবন সজীব ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠে।
৬) নূতন সদস্যদের পার্টিতে গ্রহণ করা, পার্টির শৃংখলা পালন করা, সব সময় পার্টির সংগঠনকে শুদ্ধিকরণ করা, বাসীটা বর্জন ও টাটকাটা গ্রহণ করা এবং পার্টির সংগঠনের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা।
(অসম্পূর্ণ)১
…………………………………………………………………….
১. দলিলটির শেষ দিকের কিছু অংশ পাণ্ডুলিপিতে না থাকায় একে অসম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হলাে- প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৩৫
দেশপ্রেমিকের বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল
(অক্টোবর, ১৯৭১)
১. পূর্ব বাংলার জনগণের রক্তের বিনিময়ে উপলব্ধি করছেন যে, পূর্ব বাংলার সকল রাজনৈতিক পার্টি, মুক্তি বাহিনী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চাকুরীজীবী, শিশু, নারী, কৃষক, বৃদ্ধ, ধর্মীয়, ভাষাগত, উপজাতীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতির ঐক্য ব্যতীত পাকিস্তানের উপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্ট খুনীদের পূর্ব বাংলা থেকে পরিপূর্ণরূপে উৎখাত করা সম্ভব নয়। এ কারণে তারা আন্তরিকভাবে সকলের ঐক্য কামনা করে।
জনগণের এ আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন স্বরূপ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বর্তমানে সর্বহারা পার্টি এ উদ্দেশ্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সর্বপ্রথম ১৯৬৮ সালে উল্লেখ করে-পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার জন্য পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালায়।
কর্মীস্বল্পতা, আর্থিক অসুবিধা এবং নতুন সংগঠন হওয়ার জন্য ব্যাপক জনতাকে সংগঠিত করা ও তাদের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে প্রচার করা সম্ভব হয়নি। তবুও গত সাড়ে তিন বৎসর সময়ের মাঝে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় গােপনভাবে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তােলা হয় এবং পূর্ব বাংলার বুকে সর্বপ্রথম সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করা হয়। আমাদের গেরিলা ও কর্মীরা পাকিস্তান কাউন্সিল কেন্দ্র, মার্কিন তথ্যকেন্দ্র, বি.এন.আর এবং ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানে বােমা বর্ষণ করে।
আমাদের সংগঠন সর্বপ্রথম তুলে ধরে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে, জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করার সঠিক সামরিক লাইন। আমাদের সংগঠনের বিপ্লবী কর্মী ও গেরিলারা সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে জাতীয় শত্রু খতম করে।
গত নির্বাচন, পরবর্তীকালে অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সময় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন এ পথের ভুল ও ব্যর্থতা তুলে ধরে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার করার জন্য বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানে বােমাবর্ষণ করে এবং কর্মীদের গ্রামে গ্রামে গেরিলাযুদ্ধ সূচনার নির্দেশ দেয়।
পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের বাঘের মত ভয় পায় এবং বহু কর্মীকে গ্রেফতার করে। তারা পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের তৎপরতা শ্বেতপত্রে স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
পৃষ্ঠা: ১৩৬
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নিকট প্রকাশ্য পত্র প্রেরণ করে। একই সময় বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রকাশ্য আহ্বান জানায়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন নিজস্ব উদ্যোগেই ছাত্রলীগের রবগ্রুপ, কমান্ডার মােয়াজ্জেম গ্রুপ, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির দেবেন-বাসার গ্রুপের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ সকল প্রচেষ্টায় সাড়া না দিলেও স্থানীয় ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ও মুক্তি বাহিনীর দেশপ্রেমিকদের অনেকেই আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়।
ইতিমধ্যে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সমাপ্ত করে ৩রা জুন প্রতিষ্ঠিত করে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি”। গত মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মাঝে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পাঁচটিরও বেশী জেলায় গেরিলা যুদ্ধ চলছে: জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে।
পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এভাবে সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র বাহিনী ও ঘাটি এলাকা গড়ে ওঠে।
সর্বত্রই আমাদের গেরিলা ও কর্মীরা জাতীয় ঐক্যের নীতিতে দৃঢ় থেকেছে, দেশপ্রেমিক জনসাধারণের, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্যদের রক্ষা করেছে, ঐক্যে ইচ্ছুকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের ২৫শে মার্চের পরবর্তীকালীন আক্রমণের ফলে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর প্রতিরােধ ভেঙ্গে পড়ে। তখন আওয়ামী লীগ ও মুক্তি বাহিনীর বহু নেতা ও কর্মীকে সর্বহারা পার্টির কর্মী ও গেরিলারা আশ্রয় দেয়। তাদের ও তাদের পরিবারকে অর্থ, বাসস্থান, খাদ্য, নিরাপত্তা ও কাজের সুযােগ প্রদান করে।
পরবর্তীকালে ভারত থেকে সশস্ত্র হয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনী পূর্ব বাংলায় ফিরে এলে সর্বহারা পার্টির কর্মীরা ঐক্যের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আওয়ামী লীগ ও তার মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্ব আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করার পরিবর্তে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আমাদের রক্তে হাত কলঙ্কিত করেছে এবং আমাদেরকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
তারা এ জঘন্য অন্তর্ঘাতি কাজ করার জন্য সাধারণ দেশপ্রেমিক সৈনিক ও কর্মীদের বাধ্য করেছে। কিন্তু তবু প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অনেক কর্মী এদের নীতির স্বরূপ উপলব্ধি করে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। এরূপ ঐক্যের ফলে ঢাকায় সর্বপ্রথম জাতীয় শত্রু ব্যারিস্টার মান্নানকে খতম করা হয়।
অতীতে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্বের যতটুকু স্বাধীন ভূমিকা ছিল তাও তারা ভারত ও তার মাধ্যমে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রদত্ত আশ্রয়, অস্ত্র, অর্থ ও সমর্থনের বিনিময়ে বিসর্জন দেয়, নিজেদেরকে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ- এই ছয় পাহাড়ের দালালে পরিণত করে। পূর্ব বাংলাকে তারা ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের নিকট বন্ধক দেয়, তারা ভারতের ও সাম্রাজ্যবাদীদের তাবেদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। পূর্ব বাংলায় ছয় পাহাড়ের দালাল হতে ইচ্ছুক নয় এরূপ আমাদেরসহ
পৃষ্ঠা: ১৩৭
অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের ধ্বংসের কাজকে প্রাধান্য দেয়, পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বার্থ বিক্রয়কারী জাতীয় শত্রুদের পয়সার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়; জনগণের ওপর অত্যাচার করে।
২. ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারত ও সাম্রাজ্যবাদীদের তাবেদার মুক্তি বাহিনী বরিশালের স্বরূপকাঠিতে আমাদের চারজন কর্মী ও গেরিলাকে হত্যা করে, অন্যান্যদের খুঁজে বেড়ায়। মাদারীপুরে তাদের সাথে ঐক্যব্ধ হয়ে কার্যরত আমাদের সমর্থকদের খতমের ষড়যন্ত্র করলে তারা বেরিয়ে আসে। এই তাবেদার বাহিনী আমাদের কর্মীর বাড়ীতে হানা দেয় এবং নারীদের নির্যাতন করে, বাড়ী লুট করে।
সম্প্রতি টাঙ্গাইলে তারা আলােচনার কথা বলে আমাদের দু’জন কর্মীর সাথে। বৈঠকে মিলিত হয় এবং সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদেরকে গ্রেফতার করে। তারা গ্রেফতারকৃত কর্মীদের বন্দুকের ডগায় সমস্ত গেরিলাদের নিকট থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার জন্য পাঠায়। আমাদের গেরিলারা এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। একজন নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়, কিন্তু অপরজনকে তারা বন্দী করে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ এলাকার এক জাতীয় শত্রুর নির্দেশে তারা আমাদের দু’জন গেরিলাকে কেটে লবণ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তারা বরিশাল জেলার ঝালকাঠি, কাউখালি, স্বরূপকাঠি অঞ্চলে আমাদের তিনটি গেরিলা ইউনিটকে ঘেরাও ও নিরস্ত্র করে এবং গেরিলাদের বন্দী করে, আমাদের গেরিলাদের কেউ কেউ পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়, বাকীদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারনা করা হচ্ছে তাদেরকে মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্ট খুনীরা হত্যা করেছে।
এ এলাকায় তারা আমাদের হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে এবং আমাদের দ্বারা মুক্ত বিরাট অঞ্চল দখল করে নেয়।
তারা আমাদের নারী গেরিলা শিখাকে বন্দী করে, তার পরিবারের সকলকে নির্দয়ভাবে নির্যাতন করে, শিখার উপর নির্মম পাশবিক অত্যাচার চালায়, তাকে ধর্ষণ করে। তার খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি।
তারা আরাে কয়েকজন নারী গেরিলা ও কর্মীকে খতমের জন্য খোজ করে।
তাদের এই ঘৃণ্য, বর্বর, ফ্যাসিবাদী তৎপরতায় অংশগ্রহণ করে ভারতীয় শিখ, গুর্খা সৈন্য ও অফিসাররা।
তারা ফরিদপুরের কালকিনী অঞ্চলে আলােচনার কথা বলে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের দু’জন গেরিলাকে বন্দী ও নিরস্ত্র করে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়। তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হলে জনসাধারণ বুক পেতে দেয়, “আমাদের আগে হত্যা কর, তারপর এদেরকে হত্যা কর।” জনগণের হস্তক্ষেপে তারা আমাদের কর্মীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কুখ্যাত ডাকাত-নারী নির্যাতনকারী কুদুস মােল্লার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্ট দস্যুরা মেহেদিগঞ্জেও আমাদের একাধিক গেরিলা ইউনিটকে নিরস্ত্র করে, মূল্যবান দ্রব্যাদি লুট করে এবং গেরিলাদের গ্রেপ্তার করে। তাদের ওপর অশেষ নির্যাতন চালায়।
গৌরনদী অঞ্চলে তারা আমাদের দ্বারা মুক্ত বিরাট অঞ্চল দখল করে নেয় এবং কর্মীদের খতম করার প্রচেষ্টা চালায়।
মঠবাড়িয়া অঞ্চলে এই ফ্যাসিস্ট দস্যুরা আমাদের মুক্ত অঞ্চল আক্রমণ করে ও
পৃষ্ঠা: ১৩৮
দখল করে নেয়। গেরিলাদের সামনাসামনি ধ্বংস করতে না পেরে বিশ্বাসঘাতকতা ও অন্তর্ঘাতকতার পথ গ্রহণ করে। একসাথে কাজ করার ভাওতা দিয়ে আমাদের সাথে যুক্ত হয় এবং যৌথ আক্রমণের সময় পিছন থেকে গুলি করে প্রতিভাবান কর্মী হাসানকে হত্যা করে। এর সাথে শহীদ হয় হিমু নামক অপর এক কর্মী।
বরিশালের পাদ্রিশিবপুর অঞ্চলে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ভান করে তারা সুযােগ সন্ধান করে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের খতম করার জন্য। শেষ পর্যন্ত রাতের অন্ধকারে ডেকে নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে মাসুম ও অপর এক গেরিলাকে তারা হত্যা করে।
ঢাকার নরসিংদি অঞ্চলে আমাদের গেরিলাদের তারা অস্ত্র জমা দিতে এবং যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বলে, অন্যথায় খতম করবে বলে হুমকি দেয়। আমাদের গ্রেপ্তারকৃত কর্মীদের নিকট বেত দেখিয়ে এ ফ্যাসিস্টরা বলে, “তােমাদের নেতা সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করে বেত দিয়ে মারতে মারতে ভারতে নিয়ে যাব।”
পূর্ব বাংলার সর্বত্র মুক্তি বাহিনীর এই ফ্যাসিস্টরা সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের গােলাম হতে ইচ্ছুক নয় এরূপ দেশপ্রেমিকদের খতম করার জন্য। পাক-সামরিক দস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেয়ে আমাদেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের খোজ করা-খতম করার ওপর তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে।
৩. পঁচিশে মার্চের পূর্বে ক্ষমতার দম্ভে ভুলে এই প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্টরা কমিউনিস্টদের জ্যান্ত কবরস্ত করা, নকশাল ধ্বংস করার জন্য গ্রামে গ্রামে সভা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রথমেই বামপন্থীদের খতম করবে। কিন্তু তারও ধৈর্য তাদের ছিল না, অনেক স্থানেই দেশপ্রেমিকদের তারা খতম শুরু করে। অহিংস-অসহযােগ আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে তাদের দখলকৃত এলাকার জেলখানায় আমাদের কর্মীদের মুক্তি দিতে তারা অস্বীকৃতি জানায়।
তারা উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে হিটলারের ইহুদী নির্মূলের পথ অনুসরণ করে। অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে অবাঙ্গালী উর্দু ভাষাভাষী শিশু, নারী, যুবক, বৃদ্ধ অর্থাৎ সবাইকে হত্যা করার ফ্যাসিস্ট তৎপরতা চালায়। শত শত নিরপরাধ নারীদের তারা ধর্ষণ করে, উলঙ্গ করে হাঁটায়, নির্মম অমানুষিক অত্যাচার চালায়, শিশুদের মায়ের সামনে হত্যা করে, মাকে শিশুর রক্ত পানে বাধ্য করে, বৃদ্ধ-যুবকদের সারি বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। এ জঘন্য কাজে তারা মেশিনগান, কামান পর্যন্ত ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা আগুন দিয়ে হত্যা করে। অনেক ক্ষেত্রে শিশু-নারীদের তারা নদীর মাঝে নির্জন দ্বীপে ফেলে আসে অভুক্ত অবস্থায় তাদের মারার জন্য। নিরীহ নারী-শিশুরা আশ্রয়ের জন্য গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে বেড়ায়। এই ফ্যাসিস্টদের ভয় উপেক্ষা করে কেউ কেউ তাদের আশ্রয় ও খাদ্য দেয়। এ সকল আশ্রয়হীন নারী-শিশুদের তারা পথিমধ্যে হত্যা করে, নারীদের ধর্ষণ করে ও অপহরণ করে।
এভাবে বহু দেশপ্রেমিক শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, কর্মচারী প্রাণ হারায়।
এদের অপরাধ এরা উর্দু ভাষায় কথা বলে। এভাবে এরা পূর্ব বাংলার উর্দু ভাষাভাষী জনগণের সাথে বাঙ্গালীদের সম্পর্ক তিক্ত করে তােলে।
তাদের এসকল কার্যকলাপের সাথে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কার্যকলাপের কোন পার্থক্য নেই।
পৃষ্ঠা: ১৩৯
৪. পাক সামরিক দস্যুদের শীতকালীন অভিযান শুরু হওয়ার পূর্বেই আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টরা আমাদেরকে উৎখাত করতে চায়। শীতকালীন অভিযানে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, টিকে পারবে না, বাধ্য হয়ে তাদেরকে ভারতে পালাতে হবে। পরবর্তী বর্ষাকাল আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাদের ভয় হলাে আমাদেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের ধ্বংস করতে না পারলে আমরা তাদের পরিত্যাক্ত এলাকায় গেরিলা যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবাে। ফলে তাদের ফিরে আসা অসুবিধাজনক হয়ে উঠবে।
পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পথে তারা আমাদেরকে প্রধান বাধা বলে মনে করে। বর্তমানে তারা অস্ত্র, অর্থ, আশ্রয় ও সমর্থনের বিনিময়ে ভারত ও সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট পূর্ব বাংলাকে বন্ধক দিয়েছে। যুদ্ধ করে পূর্ব বাংলাকে দখল করতে ব্যর্থ হলে ভারত ও সাম্রাজ্যবাদীরা এবং তাদের তাবেদার আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টরা পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সাথে আপােষ করবে, পূর্ব বাংলাকে একসাথে ভাগ করে লুট করার চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে।
পূর্ব বাংলাকে যত্রতত্র বিক্রির ষড়যন্ত্রকে আমরাই জনগণের সামনে তুলে ধরি, জনগণ তাদের চরিত্র বুঝে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে কবরস্থ করবে।
৫. আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন। হলে তা ভারতের কলােনীতে রূপান্তরিত হবে। এতে পূর্ব বাংলার কোন উপকার হবে কি?
ভারতের শাসকগােষ্ঠী হলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ এবং সামন্তবাদের প্রতিনিধি। পূর্ব বাংলায় নেমে আসবে এই চার পাহাড়ের শােষণ, এর সাথে যুক্ত হবে চার পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠনের উচ্ছিষ্ট ভােগের জন্য পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ অর্থাৎ দুই পাহাড়। পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের দ্বারা মুক্ত হলে এভাবে ছয় পাহাড়ের শােষণ জনগণের ওপর চেপে বসবে।
চার পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে ভারত আজ দুর্ভিক্ষ, অভাবের দেশে পরিণত হয়েছে। সেখানে পাঁচ টাকা সের চাল, আট টাকা একটা ইলিশ মাছ, একটা ডিম এক টাকা। জনগণ সারাদিন দেড় ছটাক চালও খেতে পায় না। অনাহার, বেকারী, অসুস্থতার ফলে জনগণ উপলব্ধি করছে, বৃটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে লাভবান হয়েছে বিড়লা, টাটা, ভারতের জমিদার-জোতদার এবং সাম্রাজ্যবাদীরা। ভারতীয় শাসকগােষ্ঠী বিভিন্ন জাতি, উপজাতিকে শােষণ করছে। তারা গণতন্ত্রের নামে কায়েম করেছে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, তারা পাক সামরিক দস্যুদের মত রাজপথে, বাড়ীতে বিনাবিচারে জনগণকে গুলি করে হত্যা করে, বন্দী করে, গ্রাম লুট করে, পুড়িয়ে দেয়, সেখানে জনগণকে হত্যা করে।
শােষণ-নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ভারতের কৃষক-জনতা আজ বিদ্রোহ করছে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে চার পাহাড়ের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। এরাই আজ নক্শাল নামে জমিদার, পুঁজিপতি আর সাম্রাজ্যবাদীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
পৃষ্ঠা: ১৪০
ভারত পূর্ব বাংলায় তার কলােনী স্থাপন করে তার আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট কিছুটা দূর করার চেষ্টা করছে। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতের এই কলােনীতে লুণ্ঠন ও শােষণের বখরা নেয়া এবং চীন ও কমিউনিজম প্রতিহত করার ঘাঁটি স্থাপনের স্বপ্ন দেখছে।
পূর্ব বাংলার সীমান্ত বন্ধ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার মাছ, মাংস, ধান, পাট ও অন্যান্য দ্রব্যাদি কালােবাজার হয়ে ভারতে যায়। এর ওপর রয়েছে পাক সামরিক দস্যুদের লুণ্ঠন ও শােষণ। তবুও পূর্ব বাংলার জনগণ দেড় টাকা বা তার কম সের চাল, এক টাকা দেড় টাকা দর ইলিশ মাছ, ছােটোখাটো ব্যবসায়-বাণিজ্য, কিছু কিছু চাকুরী পায়।
ভারতের কলােনী হলে পূর্ব বাংলার মাছ-মাংস-চাল-সজি চলে যাবে কোলকাতা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, মেঘালয়ে। পূর্ব বাংলার জনগণকে তখন খেতে হবে পাঁচ টাকা সের চাল, আট টাকায় একটি ইলিশ মাছ, সাধারণ শিক্ষিত দূরের কথা, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মাঝে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারীদের চাকুরীর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে ভারতের প্রায় লাখ খানেক বেকার ইঞ্জিনিয়ার এবং কয়েক লাখ বেকার ডাক্তারদের সাথে। একশ দেড়শ টাকার চাকুরী তাদের জন্য সৌভাগ্য হবে।
পূর্ব বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প চলে যাবে ভারতের বিড়লা, টাকা এবং অন্যান্য দক্ষ পুঁজিওয়ালা মারােয়ারী, সাহা, বসাকদের হাতে।
পূর্ব বাংলা থেকে ১৯৪৭ সাল ও তার পরবর্তীকালে বিতাড়িত হিন্দু জমিদারজোতদাররা পুনরায় ফিরে আসবে গ্রামসমূহে, দখল করবে তাদের পরিত্যাক্ত ভূ-সম্পত্তি, কৃষকদের ওপর শুরু করবে নির্যাতন।
সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর নেমে আসবে ধর্মীয় নির্যাতন, রায়ট, দাঙ্গা।
পূর্ব বাংলার জনগণ পৃথক ভূখণ্ড চেয়েছিল কেন? সুদীর্ঘকাল থেকেই পূর্ব বাংলা ছিল হিন্দু জমিদার আর ব্যবসায়ীদের লুণ্ঠনক্ষেত্র। জমিদার-ব্যবসায়ীদের কেন্দ্র ছিল কলিকাতা, পূর্ব বাংলা ছিল কলিকাতার পশ্চাদভূমি। পূর্ব বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভূমি একচেটিয়াভাবে হিন্দুদের হাতে ছিল। হিন্দু জমিদারদের নির্মম মুসলিম বিরােধী নির্যাতনের কাহিনী শরৎচন্ত্রের ‘মহেশ’ গল্পে মর্মস্পর্শীভাবে বর্ণিত হয়েছে।
মুসলিম জনগণের ওপর এ নির্মম নির্যাতন ও শােষণের কারণেই তারা পৃথক ভূখণ্ড পূর্ব বাংলা দাবী করে।
পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের কলােনীতে পরিণত হলে পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্য হবে তপ্ত ভােলা থেকে চুলায় পড়ার সামিল।
৬. ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার আওয়ামী লীগ মুক্তিবাহিনীর দস্যুরা এখনও পূর্ব বাংলার ক্ষমতা দখল করেনি, এর মাঝে তারা ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার হতে ইচ্ছুক নয় এরূপ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের সহ্য করছে না, ফ্যাসিস্ট হিটলারের মত পূর্ব বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ করছে এরূপ অন্যান্য দেশপ্রেমিক পার্টি ও ব্যক্তিদের অস্তিত্ব ধ্বংস করার জন্য বন্দুক ব্যবহার করছে। পূর্ব বাংলা এদের নেতৃত্বে মুক্ত হলে সেখানে এরা কায়েম করবে হিটলারের এক পার্টির একনায়কত্বের শাসন ও লুণ্ঠন।
অসংখ্য ঘটনা প্রমাণ করছে এরা যে গণতন্ত্র চায় তা হলাে হিটলারের এক পার্টির
পৃষ্ঠা: ১৪১
ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, এরা যে সমাজতন্ত্র চায় তা হচ্ছে ছয় পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠন এবং এরা যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চায় তা হচ্ছে ভারতের ও সাম্রাজ্যবাদীদের কলােনী হিসেবে পূর্ব বাংলাকে পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ করা।
৭. পূর্ব বাংলার জনগণকে এরা ভাওতা দিতে সক্ষম হচ্ছে কারণ, হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী, দেবেন-বাসার, মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণাে। ষড়যন্ত্রকারী এবং মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতকচক্র পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে বামপন্থীদের ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। এদের অনেকে। পাক-সামরিক দস্যুদের দালালী করে।
৮. ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্ট দস্যুরা ব্যাপক হারে ভারত থেকে পূর্ব বাংলায় অনুপ্রবেশ করছে। তারা আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত। তারা দম্ভভরে বলে বেড়াচ্ছে পূর্ব বাংলা তারা এবার দখল করবে, একে ভারতের কলােনীতে পরিণত করবে।
এরা পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে ভারতের তাবেদার হতে ইচ্ছুক নয় এরূপ আমাদেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের আক্রমণ করছে বা বিশ্বাসঘাতকতা করে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে, পাট পুড়াচ্ছে, জনগণকে চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উৎখাত করছে, যত্রতত্র মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে, জনগণকে হত্যা করছে, বলপূর্বক অর্থ সংগ্রহ করছে। পানাহার, নারী নিয়ে মত্ত রয়েছে। পাক সামরিক দস্যু ও তাদের দালালদের আক্রমণ করা তাদের গৌণ কাজ।
এদের অধিকাংশই ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, ভারতে কয়েকদিন ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। এরা ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে থাকে, নৌকায় অবস্থান করে, অনেক সময় সামন্ত-জমিদারজোতদারদের বাড়ীতে থাকে। কয়েকটি দলের একজন কমান্ডার থাকে। এ সকল দলের নিজেদের মাঝে ঐক্য বা হৃদ্যতা, শৃংখলা খুবই নিম্নমানের। মাদারীপুর মহকুমার ডামুডিয়ায় পাক সামরিক দস্যুদের আক্রমণের সময় দেখা যায় তাদের মাঝে কোন সমন্বয় নেই। ফলে এরা মার খায়।
এরা মুখে বলে গেরিলা যুদ্ধ করছে, নিজেদের গেরিলা বলে পরিচয় দেয়। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে এরা প্রয়ােগ করছে সামনা-সামনি অবস্থান যুদ্ধ, ঘেরাও যুদ্ধের কৌশল। ডামুড়িয়া এলাকায় তারা বাংকার থেকে পাক সামরিক দস্যুদের আক্রমণ করে। পাক দস্যুদের একদল পিছন দিয়ে তাদের ঘিরে ফেলে খতম করে। ডামুড্যিয়ার নিকট ভেদরগঞ্জ থানা পনেরাে ঘণ্টা ধরে আক্রমণ করে, বহু মর্টার-গােলা বর্ষণ করে তা ধ্বংস করে।
অস্ত্রের ওপর অতি নির্ভরতা, দখলকৃত ভূমি হাতছাড়া হতে না দেয়া, নিজেদের শক্তির ওপর অতিবিশ্বাস, শত্রু শক্তির ওপর অবিশ্বাস, জনগণের ওপর অনির্ভরতা প্রভৃতি নিজেদের ও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে না শেখার ফলে উদ্ভূত হয়েছে তাদের উপরােক্ত যুদ্ধনীতি ও কৌশল।
পৃষ্ঠা: ১৪২
শত্রুকে তাদের গেটের বাইরে ঠেকাবার জন্য তারা তাদের শক্তি একত্রিত করে, পাক দস্যুদের বাধা দেয়, সামনা-সামনি যুদ্ধ করে এবং ধ্বংস হয়।
তারা জাতীয় শত্রুদের খতম করা, জাতীয় শত্রুদের ভূমি কৃষকদের মাঝে বিতরণ, দেশপ্রেমিক সামন্তবাদীদের শােষণ কমানাে, দেশপ্রেমিক অন্যান্য শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, জনগণকে সশস্ত্র করা, তাদের সংগঠিত করা, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম। করা, জনগণের ওপর নির্ভর করার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে না; উপরন্তু জনগণকে করে অত্যাচার, দেশপ্রেমিকদের হত্যা। একারণে পূর্ব বাংলার কোটি কোটি জনতা তাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না, তাদের নিয়মিত বাহিনী একার পক্ষে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
সর্বোপরি তারা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে প্রগতি বিরােধী যুদ্ধ করছে। একারণে তারা ব্যর্থ হচ্ছে গণযুদ্ধের নীতি ও কৌশল প্রয়ােগ করতে।
অতীতেও তারা এই যুদ্ধনীতি ও কৌশল প্রয়ােগ করেছে। তারা শহর দখল করার দিকে প্রথম নজর দেয়, শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটি কেন্টনমেন্ট আক্রমণ করে, নিজেদের দখলকৃত এলাকা বজায় রাখার জন্য শহর-বন্দরে সামরিক দস্যুদের বাধা দেয়। তাদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র-লােকজন এবং দখলকৃত শহর-বন্দর থাকতেও তারা পরাজিত ও উৎখাত হয়।
চট্টগ্রামে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর, পুলিশ, ছাত্র, ভারতীয় সৈন্য সমেত হাজার হাজার যােদ্ধা প্রতিরােধ তৈরী করে, টেলিফোন লাইন বসায়, অস্ত্র, সৈন্য আনার জন্য ভারতের সাথে ট্রাক যােগাযােগ স্থাপন করে, তারা কামান, মর্টার, মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অর্থাৎ বিমান ও ট্যাঙ্ক ব্যতীত সবকিছু ব্যবহার করে। কিন্তু সম্মুখ অবস্থান যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয় এবং ভারতে বিতাড়িত হয়।
মেজর জিয়া দম্ভভরে চট্টগ্রামে ঘােষণা করেছিল ঢাকা কয়েকদিনের মাঝে দখল করবে। মেজর জলিল ঘােষণা করেছিল বরিশাল আর পরাধীন হবে না। এদেরসহ আরাে। অনেক মেজর-ক্যাপ্টেন-লেফটেনান্টের মাথা শেষ পর্যন্ত দেয়ালে ঠেকে, তারা ভারতে বিতাড়িত হয় বা প্রাণ হারায়। এদের ভুলের জন্য লক্ষ লক্ষ লােক প্রাণ হারায়, তাদের ধন-সম্পত্তি বিনষ্ট হয় এবং তারা ভারতে যেতে বাধ্য হয়।
ভারত ও তার মাধ্যমে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ যদি তাদের আশ্রয় না দিত, পুনরায় সশস্ত্র না করতাে তবে তাদের এই বিদ্রোহ জুন-জুলাই মাসেই শেষ হয়ে যেতাে।
ভারত থেকে সশস্ত্র হয়ে পুনরায় তাদের পূর্ব বাংলায় অনুপ্রবেশ করার প্রক্রিয়ায় তাদের চরিত্রের বিরাট পরিবর্তন হয়। অতীতে তাদের যতটুকু স্বাধীন ভূমিকা ছিল তাও তারা ভারত ও সাম্রাজ্যবাদ প্রদত্ত আশ্রয়, অর্থ, অস্ত্র ও সমর্থনের বিনিময়ে বিসর্জন দেয়, তারা ছয় পাহাড়ের দালালে পরিণত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের নিকট বন্ধক দেয়।
এভাবে তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে প্রগতি বিরােধী যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধে পরিণত হয়। পূর্ব বাংলাসহ পৃথিবীর কোনাে প্রগতিশীল শক্তিই তাদের এ প্রগতিবিরােধী পশ্চাদগামী যুদ্ধ সমর্থন করে না।
আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের যুদ্ধনীতি ও কৌশল এবং কার্যকলাপ এবং প্রগতিবিরােধী যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানী দস্যুরা তাদের সবল দিকসমূহ ব্যবহার করার সুযােগ পাচ্ছে। তারা তাদের সৈন্যদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা, উন্নত সৈন্যসংস্থান (কোম্পানী,
পৃষ্ঠা: ১৪৩
ব্যাটেলিয়ান, রেজিমেন্ট ইত্যাদি), শৃংখলা, ধর্মীয় মনােবল, উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, আধুনিক অস্ত্র, আন্তর্জাতিক দেশসমূহের সমর্থন বা নিরপেক্ষতা ব্যবহার করছে।
এ কারণে ২৫শে মার্চের পরবর্তী সময় বিরাট এলাকা ও শক্তি এবং গণসমর্থন থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টরা পরাজিত হয়।
বর্তমানেও তারা একই কারণে পরাজিত হবে যত অস্ত্র-শস্ত্র, সৈন্য তাদের থাকুক না কেন। তাদের লােকজন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, অনেকে ভারতে পালিয়ে যাবে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র কিছু অংশ পাক-সামরিক দস্যুদের হাতে যাবে, কিছু অংশ নদী-খাল-পুকুর-মাটির তলে আশ্রয় নেবে, কিছু অংশ আমাদের হাতে আসবে, বাকীটা ভারতে ফেরত যাবে। তাদের ভুলের জন্য পুনরায় লক্ষ লক্ষ লােক প্রাণ হারাবে, তাদের ধন-সম্পত্তি বিনষ্ট হবে।
পাক সামরিক দস্যুদের পরাজিত করে পূর্ব বাংলা দখল করতে হলে বিরাট সংখ্যায় অর্থাৎ হাজারে হাজারে তাদেরকে একে একে যুদ্ধে খতম করতে হবে; তাদের ঘাটি ও শহর দখল করতে হবে। এজন্য উচ্চ পর্যায়ের ঘেরাও যুদ্ধ ও অবস্থান যুদ্ধও করতে হবে। এজন্য যে সৈন্য-সংস্থান, শংখলা, যুদ্ধ অভিজ্ঞতা, মনােবল ও যুদ্ধনীতি এবং কৌশল প্রয়ােজন তা এ মুক্তি বাহিনীর দস্যুদের নেই।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ দ্রুত পূর্ব বাংলা দখল করার আরেকটি পথ অবলম্বন করতে পারে। অর্থাৎ ভারতীয় সৈন্যবাহিনী দ্বারা পূর্ব বাংলা বা গােটা পাকিস্তান আক্রমণ করা এবং তাদের। তাবেদার মুক্তি বাহিনী দ্বারা পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান ঘটানাে। অর্থাৎ সীমান্ত আক্রমণ করে পাক দস্যুদের সেখানে ব্যপৃত রাখা ও তাদের ধ্বংস করা এবং তাবেদার বাহিনী কর্তৃক পূর্ব বাংলা ভেতর থেকে দখলের সুযােগ করে দেয়া।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাতে সৈন্য আসতে না পারে তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত আক্রমণ করা, সমুদ্র দিয়ে যাতে পূর্ব বাংলায় সামরিক দস্যুরা আসতে না পারে তার জন্য সমুদ্রপথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
এতে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যাবে। চীনসহ বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী শক্তিসমূহ ভারতের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট পূর্ব বাংলা দখলের এ আগ্রাসী যুদ্ধকে বিরােধিতা করবে। পূর্ব বাংলার জনগণেরও একটা বিরাট অংশ এ যুদ্ধকে বিরােধিতা করবে। ভারত নিজেও অধিকতর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পড়বে।
ভারতের আগ্রাসী বাহিনী এবং পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরস্ত তাবেদার মুক্তি বাহিনীর একযােগে আক্রমণের ফলে কয়েকটি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।
একটি পরিস্থিতি হতে পারে-পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর সম্পূর্ণ পরাজয়, পূর্ব বাংলা ভারত ও সাম্রাজ্যবাদীদের কলােনীতে রূপান্তর, মুক্তিবাহিনীর ফ্যাসিস্টদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় একটি পুতুল সরকার গঠন।
অন্য পরিস্থিতি হতে পারে-পাকিস্তানী ফ্যাসিস্ট দস্যুরা আভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ও ভারতীয় হামলা মােকাবিলা করতে সক্ষম হবে, তখন আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনার পথ গ্রহণ করা ব্যতীত আর কোন পথ থাকবে না। এর ফলে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র হবে, আপােষ-টেবিলে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ স্বীকার করে সমাধানে আসার জন্য ভারত, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তাবেদার মুক্তি বাহিনী প্রচেষ্টা চালাতে পারে। ফলে অনিবার্যভাবেই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টির হাতে এসে পড়বে।
পৃষ্ঠা: ১৪৪
পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের কলােনীতে রূপান্তরিত করলে পূর্ব বাংলার জনগণ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে সক্ষম হবে তাদের রক্তদান বৃথা হয়েছে; ছয় পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠন উপড়ে ফেলার জন্য তারা প্রচণ্ড সংগ্রাম শুরু করবেন। সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টি ব্যতীত এ সংগ্রামে নেতৃত্বদানের আর কেউ থাকবে না।
যে পরিস্থিতিরই উদ্ভব হােক না কেন শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টির হাতে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের নেতৃত্ব আসবেই।
ভারত যুদ্ধ বাধিয়ে পূর্ব বাংলাকে তার কলােনীতে রূপান্তরিত করবে এ সম্ভাবনা কম, ভারতের পক্ষে সীমান্তে উস্কানী সৃষ্টির সম্ভাবনাই অধিক। এর কারণ ভারতের এই আগ্রাসী যুদ্ধ চীনসহ বিশ্বের প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী শক্তিসমূহ বিরােধিতা করবে। এ যুদ্ধে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে, এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হয়ে পড়বে। ভারতের জনগণের বিপ্লবী যুদ্ধ তীব্রতর হয়ে উঠবে। প্রথম মহাযুদ্ধে জন্মলাভ করেছে সােভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জন্মলাভ করেছে চীনসহ আরাে বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ। কাজেই পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ফলে পাকিস্তান, ভারত, পূর্ব বাংলা যে কোন স্থানেই সর্বহারা শ্রেণীর দ্রুত ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা দেখা দেবে। সাম্রাজ্যবাদীরা এজন্য প্রচেষ্টা চালাবে যুদ্ধকে রােধ করতে।
৯. ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার আওয়ামী লীগ ও মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের দ্বারা জাতীয় মুক্তির নামে প্রগতি বিরােধী জাতীয় পরাধীনতার যে প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ চলছে তা পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারে না। যুদ্ধক্ষেত্র বা আপােষ-টেবিল কোনােটার মাধ্যমেই এরা পূর্ব বাংলাকে সকল বৈদেশিক শােষণমুক্ত এবং দেশের অভ্যন্তরে সামন্তবাদীদের উৎখাত করে কৃষকের মুক্তি আনতে সক্ষম হবে না।
পূর্ব বাংলার জনগণ অনেকেই এদের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছে না। কিন্তু আজ হােক কাল হােক জনগণ এদের ছদ্মবেশ ছুঁড়ে ফেলে এদের প্রকৃত ছয় পাহাড়ের দালালীর চরিত্র বুঝতে পারবে এবং অনিবার্যভাবেই জনগণ এদেরকে কবরস্থ করবে।
ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার হতে ইচ্ছুক নয়, এরূপ আমাদেরসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধরত দেশপ্রেমিকদের এবং নিরীহ শিশু, নারী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধের রক্তে এরা হাত কলংকিত করেছে, আজ হােক কাল হােক, রক্ত দিয়েই তাদেরকে এ রক্তের ঋণ শােধ করতে হবে। সমাজ নিজস্ব নিয়মেই এগিয়ে যাচ্ছে। যত প্রচেষ্টাই চালাক না কেন তারা। পূর্ব বাংলাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারবে না, পূর্ব বাংলার জনগণ ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের জাতীয় পরাধীনতার প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধকে জাতীয় স্বাধীনতার বিপ্লবী যুদ্ধ দ্বারা বিরােধিতা করবে, পাকিস্তানের উপনিবেশিক সামরিক শাসকগােষ্ঠী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে পূর্ব বাংলা থেকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করবে, সামন্তবাদকে উৎখাত করে কৃষক-জনতাকে মুক্ত করবে, এবং স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করবে। পূর্ব বাংলার জনগণের বিজয় অনিবার্য।
পৃষ্ঠা: ১৪৫
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে কৃষকের ওপর নির্ভর করুন
পাক-সামরিক দস্যুদের শীতকালীন অভিযান এবং ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্ট প্রতিক্রিয়াশীলদের
জনগণবিরােধী তৎপরতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করুন
গেরিলা যুদ্ধকে বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিন
(অক্টোবর, ১৯৭১)
পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী তাদের শীতকালীন অভিযান শুরু করে দিয়েছে। পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এ অভিযান তীব্রতর ও নির্মম হয়ে উঠবে। ১৯৭২ সালের জুন-জুলাই পর্যন্ত এ অভিযান চলবে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের এ শীতকালীন অভিযানের লক্ষ্য হলাে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি বাহিনীর গেরিলা এবং আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট মুক্তি বাহিনীকে গ্রাম থেকে উৎখাত করা, গ্রামসমূহকে পরিষ্কার করা, ডিসেম্বরের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা।
পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের শীতকালীন অভিযানে যুক্ত হয়েছে ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের সমস্যা। এরা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও তার নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি বাহিনীকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
কাজেই একদিকে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের শীতকালীন অভিযান, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্ট প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের টিকে থাকা ও বিকাশ লাভ করার সমস্যার সমাধান প্রয়ােজন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট মুক্তি বাহিনীকে গ্রামাঞ্চলে ধ্বংস করার জন্য পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা ঘেরাওদমন অথবা ‘খোজ কর, ধ্বংস কর’ অভিযান পরিচালনা করবে।
প্রথমটিকে তারা প্রয়ােগ করে ঐ সকল এলাকায় যেখানে মুক্তি বাহিনীর তৎপরতার কেন্দ্র রয়েছে বলে তারা মনে করে। যেমন ১নং ফ্রন্ট এরিয়া।১ প্রথমে সমগ্র অঞ্চলকে তারা ঘেরাও করে, এ অঞ্চল থেকে বেরুবার পথসমূহের গুরুত্বপূর্ণ সংযােগস্থলে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে, কারফিউ জারী করে, প্রতি ক্যাম্পের মধ্যকার অঞ্চলে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করে। এ সকল প্রধান ক্যাম্পের সাথে নিকটবর্তী বড় সামরিক ঘাঁটির সাথে প্রতিনিয়ত যােগাযােগ রক্ষা করে।
…………………………………………………………………….
১. বরিশালের পেয়ারাবাগান এলাকাটি ছিল ১নং ফ্রন্ট এরিয়া প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৪৬
এরপর তারা ঘেরাওকৃত অঞ্চলের মাঝে কয়েকটি উপক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পগুলাে সাধারণতঃ তারা স্কুলবিল্ডিং বা পাকা বাড়ীতে স্থাপন করে। এ সকল ক্যাম্প থেকে তারা ঘেরাও-এর মধ্যকার ও আশেপাশের প্রতিটি গ্রামে খোঁজ কর, ধ্বংস কর’ অভিযান পরিচালনা করে এবং সবকিছু লুট করে, পুড়িয়ে দেয় এবং সবাইকে হত্যা করে।
অনেক ক্ষেত্রে তারা বন্দুক দেখিয়ে এবং জাতীয় শত্রুদের সহায়তায় আশেপাশের অঞ্চল থেকে হাজার হাজার জনসাধারণকে গেরিলাদের খোঁজ করা, লুট, অগ্নিসংযােগ, হত্যার কাজে লাগায়। অনেক সময় তারা ধর্মের পার্থক্য বা ভাষা, জাতীয়তার পার্থক্যকে কাজে লাগায় এবং জনগণের এক অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
গেরিলারা ধ্বংস হয়েছে বা নেই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত বা নিজেদের পরাজয় বরণ পর্যন্ত এ অভিযান তারা অব্যাহত রাখে। এর পর তারা ঘেরাও উঠিয়ে চলে যায়।
‘খোজ কর, ধ্বংস কর’ অভিযান সাধারণতঃ দিনে শুরু হয়, গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করা হয়, কয়েক দিক থেকে ধ্বংসকারী বাহিনী একস্থানে মিলিত হয়, সারাদিন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দস্যুবাহিনী দিন থাকতেই শহরের ঘাঁটিতে ফিরে যায়।
ঘেরাও-দমন বা ‘খোজ কর, খতম কর অভিযানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাক সামরিক দস্যুদের ইউনিটসমূহ ঝােপঝাড়, মাঠ-ঘাট লক্ষ্য করে এলােপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হয়। এর কারণ, তারা অজানা-অচেনা গ্রামের প্রতিটি ঝােপ-ঝাড়, মাঠঘাট, বাড়ী-ঘরকে শত্রু বলে ভয় করে, যে কোন স্থান থেকে অতর্কিতে হামলার সম্ভাবনায় তটস্থ থাকে। এর ফলে তাদের অবস্থান সহজেই জানা যায়।
শহরে পালিয়ে আসা জাতীয় শত্রু, আশে-পাশের জাতীয় শত্রু ও তাদের গ্রামস্থ গােপন ও প্রকাশ্য চররা সামরিক ফ্যাসিস্ট দস্যুদের সাথে আসে, পথ দেখিয়ে দেয়; লুট, হত্যা, অগ্নিসংযােগ করে; খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করে, খবর সরবরাহ করে, গেরিলাদের খোঁজ করে, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ধরিয়ে দেয়।
২. আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্ট প্রতিক্রিয়াশীলরা যথাযথ খবরের ভিত্তিতে আমাদের কোন কোন ইউনিটকে ঘেরাও করে, নিরস্ত্র করে কিছুসংখ্যক কর্মীকে হত্যা করে। টাঙ্গাইলের জাতীয় শত্রু চেয়ারম্যানের খবরের ভিত্তিতে তারা আমাদের দুজন গেরিলাকে কেটে কেটে লবণ দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বহু স্থানে আমাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করেছে।
আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল এরূপ কিছু বুদ্ধিজীবী, ভ্রষ্ট সর্বহারাদের আমরা সরল বিশ্বাসে আমাদের গেরিলা বাহিনীতে নিয়েছিলাম, পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। কিন্তু ভারতপ্রত্যাগত মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে যােগাযােগ হলে তারা প্ররােচিত হয়ে দলত্যাগ করে এবং বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করে আমাদের কর্মীদের ও ইউনিটের অবস্থান জানিয়ে দেয়, তাদের সাথে যােগদান করে। অনেকক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল কিন্তু আমাদের আশ্রয়ে বেঁচেছিল এরূপ কিছু সংখ্যক সামন্তবাদী, বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবী সহানুভূতিশীলরা ভারত-প্রত্যাগত মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের খবর সরবরাহকারী হয়।
পৃষ্ঠা: ১৪৭
কয়েক ক্ষেত্রে ঐক্যের আলােচনার কথা বলে তারা ঐক্য-বৈঠকে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের কর্মীদের গ্রেফতার ও নিরস্ত্র করে, মৃত্যুদণ্ড দেয়। এক্ষেত্রে জনসাধারণ। হস্তক্ষেপ করে; তারা বুক পেতে বলে আমাদের আগে হত্যা কর, তারপর একে হত্যা কর; জনসাধারণের হস্তক্ষেপে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমাদের কর্মীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। হয়। কয়েক ক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃত আমাদের কর্মীরা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
৩. আমাদের গেরিলা বাহিনী শূন্য থেকে গড়ে উঠেছে, তাদের সংখ্যা কম, বন্দুক এবং পুরানাে রাইফেল দ্বারা সজ্জিত। অস্ত্রের স্বল্পতার জন্য সকল গেরিলা সশস্ত্র নয়। পাকসামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে লড়াইয়ে তারা অভ্যস্ত নয়। এগুলাে হচ্ছে তাদের দুর্বলতা। পক্ষান্তরে তাদের শক্তিশালী দিক হলাে, তাদের শৃংখলা উন্নত, তারা নিজেদের দেশে ন্যায় যুদ্ধ করছে। জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে পােড় খাওয়া, রাত্রি-অভিযানে অভ্যস্ত, বিভিন্ন ইউনিট ও উচ্চস্তরের সাথে দৃঢ় সংযােগ রয়েছে, গেরিলাদের পরিচালনাকারী একটি সঠিক রাজনৈতিক পার্টি রয়েছে, রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে তারা আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ, জনসাধারণের সাথে তারা অনেকখানি যুক্ত।
পাক-সামরিক দস্যুদের শক্তিশালী দিক হলাে তাদের হাতে রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা, আধুনিক অস্ত্র, সামন্তবাদী ধর্মীয় মনোেবল, উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, কষ্টসহিষ্ণুতা। কিন্তু তাদের দুর্বল দিক হলাে তারা বিদেশে অন্যায় বর্বর যুদ্ধ করছে, তাদের জনসমর্থন নেই। তাদের সংখ্যাস্বল্পতা, অজানা-অচেনা গ্রামে তারা লড়াই করছে।
আওয়ামী লীগের মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের সবল দিক হলাে তাদের আধুনিক অস্ত্র রয়েছে, লােকবল রয়েছে, ভারত তাদেরকে সহায়তা ও সমর্থন করছে, ভারতের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ তাদেরকে সাহায্য ও সহায়তা করছে, তাদের কিছুটা গণসমর্থনও আছে। তাদের দুর্বল দিক হলাে তারা জনগণের ওপর অত্যাচার করে, তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্ব নেই, ছয় পাহাড়ের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে, ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের কলােনী স্থাপনের জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে প্রগতি বিরােধী যুদ্ধ করছে, তাদের নিজেদের মাঝে সংযােগ কম, নিজেদের মাঝে সংঘর্ষ হয়, তারা জনগণের সাথে যুক্ত নয়।
আমাদের দুর্বলতা ও শক্রর সবলতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে আমাদের আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করতে হবে, এ যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের সবলতা এবং শত্রুর দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে আমরা শত্রুর আক্রমণকারী দুর্বল অংশকে পাল্টা ঘেরাও আক্রমণ করে দ্রুত ধ্বংস করতে পারি। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের দুর্বলতা কেটে যাবে, শক্রর দুর্বলতা বৃদ্ধি পাবে। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের হাতে ধ্বংস হবে।
৪. পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা সংখ্যাস্বল্পতার কারণে ঘেরাও-দমন বা ‘খোজ কর, ধ্বংস কর’ অভিযানে নিজেদেরকে ছােট ছােট ইউনিটে (২ জন, ৪ জন, ৬ জন) ভাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে সমগ্রের তুলনায় কোন কোন ক্ষুদ্রদল দুর্বল হয়ে পড়ে।
জনসমর্থন নেই এবং জনগণ তাদের সাথে সহযােগিতা করে না বলে তারা গেরিলাদের অবস্থান সম্পর্কে যথাযথ খবর পায় না, অজানা-অচেনা এলাকায় যুদ্ধ করছে।
পৃষ্ঠা: ১৪৮
বলে তারা পথ-ঘাট চেনে না, ফলে তাদের অগ্রসরমান ইউনিটসমূহের মাঝে ফাঁক রয়ে যায়, ঘেরাও বলয়েও ফাঁক রয়ে যায়।
আমাদের গেরিলারা অগ্রসরমান পাক-সামরিক দস্যুদের বিভিন্ন ইউনিটের ফাকের মাঝে অবস্থান করতে পারে, সবচাইতে দুর্বল ইউনিটকে অনুসন্ধান করে তাকে অনুসরণ করতে পারে, সুবিধামত স্থানে দস্যুদলটিকে কয়েকজন গেরিলা সমাবেশ করে অতর্কিতে হামলা করে ধ্বংস করতে পারে। আক্রান্ত ইউনিটের সহায়তায় অন্য কোন নিকটস্থ ইউনিট যাতে আসতে না পারে সেজন্য তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য গেরিলা নিয়ােগ করা যায়। গেরিলারা দস্যুদলটিকে পরিপূর্ণভাবে ঘিরে ফেলবে, গুলির জাল তৈরী করবে, একটিও দস্যু যেন বেরিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে, দ্রুত শত্রুদের খতম করে আহত, বন্দী, অস্ত্র, পােশাক নিয়ে সরে পড়তে হবে। সম্ভব হলে ও সুযােগ থাকলে অন্য দস্যু ইউনিটকে আক্রমণ করতে হবে।
চলমান শত্রুকে এভাবে আক্রমণের জন্য আমাদের শক্তিকে একত্রিত করতে হবে। আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গােপন থাকতে হবে, প্রয়ােজন হলে ডাল-লতা-পাতা দিয়ে ছদ্মাবরণ তৈরী করতে হবে, ঝােপ-ঝাড়, বাঁশবন-কলার ঝাড়, জঙ্গল, শক্রর পথে পড়বে এরূপ বাড়ীতে লুকিয়ে ওৎ পেতে থাকতে হবে।
অনুসন্ধানের ভুলের জন্য বড় শত্রুকে আক্রমণ করে ফেললে বা অন্য কারণে দ্রুত খতম করা সম্ভব না হলে শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখার জন্য অল্পসংখ্যক গেরিলা রেখে গেরিলাদের প্রধান অংশকে সরে পড়তে হবে। বাকীরা শেষে সরে পড়বে। পাকসামরিক দস্যুরা যখন কোন বিল্ডিং-এ ক্যাম্প করে বা বেশী সংখ্যায় অবস্থান করে তখন আমরা আক্রমণ করবাে না। কেবলমাত্র চলমান শত্রুকে আমরা পূর্ব থেকে ওৎ পেতে অতর্কিতে আক্রমণ করবাে।
শত্রু খতম নিশ্চিত হলেই আমরা আক্রমণ করবাে। শত্রুদের খতম করা, তাদের অস্ত্র দখল করা যায় না এরূপ অবস্থায় আমরা একটিও বুলেট নষ্ট করবাে না, অর্থাৎ ক্ষয়কারক যুদ্ধ করবাে না। শত্রু সম্পূর্ণ খতম হলেই তাদের অস্ত্র-গােলাবারুদ আমরা দখল করতে পারি, তাদের শক্তি কমিয়ে দিতে পারি, তাদের মনােবল ভেঙ্গে দিতে, জনগণ ও গেরিলাদের সাহস বাড়াতে পারি, শত্রুর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমরাও শক্তিশালী হতে পারি।
“শত্রু এগােয় আমরা পিছুই, শত্রু শিবির ফেলে আমরা হয়রান করি, শত্রু ক্লান্ত হয় আমরা আক্রমণ করি, শত্রু পালায় আমরা পিছনে ধাওয়া করি।” “যখন আমরা জিততে পারি তখন লড়ি, জেতার আশা না থাকলে সরে পড়ি। তারা (শত্রু) যখন আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে চায়, আমরা তখন লড়বাে না, এমনকি, আমাদের খুঁজেও পায় না। কিন্তু আমরা যখন তাদের বিরুদ্ধে লড়তে চাই তারা যেন পালাতে না পারে এবং সঠিকভাবে আঘাত হানি ও নিশ্চিহ্ন করি। যখন আমরা তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে পারি তখন করি, যখন পারি না তখন আমাদের নিশ্চিহ্ন করার সুযােগ দেই না।” প্রভৃতি নীতিসমূহ আমাদের প্রয়ােগ করতে হবে।
আমাদের আক্রমণের সাথে যুক্ত করতে হবে জনসাধারণের প্রতিরােধ। সমস্ত রাস্তা উপড়ে ফেলে ক্ষেত বানিয়ে ফেলা, শত্রুর আগমন পথে খাদ কেটে বাঁশের বা সুপারী গাছের বিষাক্ত শলা পুঁতে রেখে ঠিক রাস্তার মত বানিয়ে রাখা, শত্রুর চলার পথে পড়ে এরূপ খালের মধ্যে বিষাক্ত শলা পুঁতে রাখা, রাস্তায় গর্ত করে পায়ের মাপমত কাঠে লােহার শলা মেরে পুঁতে রাস্তার সমান করে ঢেকে রাখা, গ্রামের ঝােপ-ঝাড় থেকে। বিষাক্ত তীর, ল্যাজা, বল্লম মারার ব্যবস্থা করা, রাস্তায় গ্রেনেডের ফঁাদ বানানাে, মাইন
পৃষ্ঠা: ১৪৯
পােতা, সম্ভব হলে ভীমরুল ট্রেইন করে তার ফাঁদ পেতে রাখা প্রভৃতি কাজ জনসাধারণের সাহায্যে করা যায়।
এভাবে গেরিলা ও জনগণের সমন্বিত যুদ্ধের ফলে পাক দস্যুদের ব্যাপকভাবে ক্ষতি করা সম্ভব। এ ধরনের সমন্বিত যুদ্ধ সম্ভব জাতীয় শত্রুমুক্ত আমাদের স্থায়ী বা অস্থায়ী ঘাটি এলাকায়, যেখানে জনগণ আমাদের পক্ষে এবং শত্রুর নিকট খবর যাবে না। এ কারণে সামরিক দস্যুদের ভুলিয়ে মুক্ত অঞ্চলের গভীরে নিয়ে আসতে হবে, তাদেরকে জনগণ ও গেরিলাদের সমন্বিত যুদ্ধের সমুদ্রে ফেলতে হবে।
এভাবে যদিও আমাদের অস্ত্র, সৈন্য-সংখ্যা কম, ও তাদের মান নীচু, কিন্তু অধিকাংশ গেরিলাদের একত্রিত করার পদ্ধতি, জনগণের যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিপ্লবী রাজনীতিতে দীক্ষিত, আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ গেরিলাদের একত্রিত করলে তা পাক-সামরিক দস্যুদের দুর্বল অংশের তুলনায় অনেকগুণ শক্তিশালী হয়। এভাবে সমগ্রের তুলনায় নিকৃষ্ট হলেও অংশের তুলনায় আমরা উৎকৃষ্ট, এভাবে তাদের ঘেরাও-দমনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গ্রহণ করি আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের নীতি। কিন্তু তাদের দুর্বল অংশকে পাল্টা ঘেরাও ও ধ্বংস করে আমরা প্রয়ােগ করি আত্মরক্ষার মাঝে আক্রমণের রণকৌশল।
যখন পাক-সামরিক দস্যুরা প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে, গেরিলাদের অঞ্চল ছােট, জনসাধারণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না, পাক-সামরিক দস্যুদের বিভিন্ন ইউনিটসমূহের শক্তি ক্ষমতা আমাদের আক্রমণের ক্ষমতার চেয়ে বেশী, তখন আমাদেরকে গ্রুপে ভাগ হয়ে ঘেরাও বলয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। আশেপাশের শত্রু-অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধকে বিস্তৃত করে দিতে হবে। অনেক সময় নিকটবর্তী। আমাদের অন্য অঞ্চল থাকলে সেখানে সরে যাওয়া যায়। শত্রু অঞ্চলে ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিক, সহানুভূতিশীল, তাও সম্ভব না হলে ঝােপ-ঝাড়, জঙ্গল, সবুজ শস্যের যবনিকার মাঝে আশ্রয় নেওয়া যায়।
ঘেরাও-দমন অভিযানে টিকতে না পারলে কোথায় স্থানান্তরিত করতে হবে সে বিষয়ে পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি থাকা উচিত। বাধ্য হয়ে স্থানান্তরিত হলে বিপর্যয়ের ও অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। ১নং ফ্রন্ট এরিয়া থেকে পাক-সামরিক দস্যুদের চাপের ফলে প্রত্যাহার এর উদাহরণ।
ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিকদের বাড়ীতে গেরিলাদের থাকতে হবে (শত্রু এলাকায়, মুক্ত এলাকায়ও), তাদের মধ্য থেকে গেরিলা সংগ্রহ করতে হবে, পার্টি গড়ে তুলতে হবে, তাদের ওপর সর্ববিষয়ে নির্ভর করে জাতীয় শত্রু খতম অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। শত্রু-এলাকায় উদ্যোগ, নমনীয়তা ও পরিকল্পনার সাথে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হবে।
বিভিন্ন গেরিলা ইউনিটসমূহকে যােগাযােগের স্থান, উপায়, দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে। দিতে হবে। ঘেরাও-দমনের বাইরের শত্রু-এলাকায় কাজ করার জন্য প্রয়ােজন প্রতিটি ইউনিটের স্বাধীনভাবে কার্যপরিচালনার ক্ষমতা।
ঘেরাও উঠে গেলে গেরিলা বাহিনী পুনরায় তাদের ঘাঁটি এলাকায় ফিরে আসবে।
এজন্য সমভূমিতে অস্থায়ী চরিত্রের ঘাঁটিতে বিরাট বিরাট স্টোর করা উচিৎ নয়, বহন করে নিয়ে যাওয়া যায় এরূপ মালপত্র রাখা উচিত। দখলকৃত দ্রব্যাদির মাঝে যা বিক্রয় করা যায় তা বিক্রি করতে হবে, যা জনগণের মাঝে বিতরণ করা যায় তা বিতরণ করতে হবে।
এ সকল অস্থায়ী ঘাঁটি এলাকায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে পার্টির নেতৃত্বে এক বা একাধিক শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে। এর মাঝেই নিহিত রয়েছে ঘাঁটি এলাকা স্থাপনের চাবিকাঠি। স্থানীয় অনিয়মিত গেরিলাদের মধ্য থেকে উন্নমানের
পৃষ্ঠা: ১৫০
গেরিলাদের নিয়ে নিয়মিত গেরিলাপ গঠন, নিয়মিত গেরিলাপ নিয়ে প্লাটুন, কয়েকটি প্লাটুন নিয়ে কোম্পানী-এভাবে সৈন্যসংস্থান গড়ে তুলতে হবে। এ সেনাবাহিনীর মাঝে পার্টি-সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, রাজনৈতিক কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, যুদ্ধের মাধ্যমে একে পরিপক্ক করে তুলতে হবে, জনগণের মাঝে যুদ্ধ ছাড়াও প্রচার চালানাে, তাদের মাঝে পার্টি-সংগঠন গড়ে তােলা, তাদের সশস্ত্র করা, তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েমে সহায়তা করা, তাদেরকে গণসংগঠনে সংগঠিত করা প্রভৃতি কাজে দক্ষ করে। তুলতে হবে। এভাবে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ, জনগণের সাথে যুক্ত, পার্টির নেতৃত্বে। পরিচালিত একটি অজেয় বাহিনী গড়ে উঠবে।
অস্থায়ী বা স্থায়ী মুক্ত অঞ্চলে আমাদেরকে প্রকাশ্য কাজের সাথে গােপন কাজের সমন্বয় করতে হবে। ঘেরাও-দমন বা অন্য কোন কারণে আমাদের সেনাবাহিনী ও প্রকাশ্য কার্যরত কর্মীরা অন্যত্র চলে গেলেও গােপন কার্যরত কর্মীরা পার্টি-সংগঠন, গ্রামরক্ষী বাহিনী, স্থানীয় গেরিলাপ, গ্রাম পরিচালনা কমিটি এবং অন্যান্য গণসংগঠন। তৈরী ও পরিচালনা করতে পারবে, উচ্চতর স্তরের সাথে যােগাযােগ রাখতে পারবে। স্থায়ী বা অস্থায়ী মুক্ত এলাকায় এ কারণে পার্টি-সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। পার্টি-কাজ কিছুটা প্রকাশ্য হলে মূল অংশ গােপন থাকবে। শত্রু এলাকার পার্টি-কাজ সম্পূর্ণ গােপনে হবে। এর ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে ঘেরাও-দমনের ফলে নতুন জাতীয় শত্রুরা আমাদের ক্ষতি করতে না পারে বা আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট মুক্তি বাহিনী আমাদের এলাকা দখল করলেও যেন আমাদের কাজ চলতে পারে।
আমাদের নেতৃত্বে জাতীয়-শত্রুমুক্ত এলাকা বিস্তৃত হলে এক অংশে ঘেরাও-দমন হলে আমরা অন্য অংশে সরে যেতে পারি। ১নং ফ্রন্ট এরিয়ায় আমাদের মুক্ত এলাকার এক অংশ পাক-সামরিক দস্যুরা ঘেরাও করলেও কিছু অংশ ঘেরাও-দমনের বাইরে ছিল। এ কারণে সভাপতি মাও বলেছেন, গেরিলাদের সমভূমিতে টিকে থাকার প্রধান শর্ত হলাে ঘাটি এলাকার বিস্তৃতি।
কোন একটি এলাকায় গেরিলা তৎপরতা শুরু করার সাথে সাথেই বিস্তৃতির সমস্যার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। গেরিলা তৎপরতার সময় দূর-দূরান্ত থেকে জনগণ জাতীয় শত্রু খতমের তালিকা নিয়ে আসে এবং গেরিলাদের আমন্ত্রণ জানায়। গেরিলারা অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে, প্রথমে অল্পদূরে এক-দুই দিনের জন্য যাবে, তারপর অধিক দিনের জন্য অধিক দূরে যাবে। এভাবে দূর-দূরাঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ বিস্তৃত হবে, গেরিলা গ্রুপসমূহ স্বাধীনভাবে কাজ করতে শিখবে।
যে সকল অঞ্চল থেকে আমন্ত্রণ আসেনি কিন্তু আমাদের স্বার্থে গেরিলা যুদ্ধকে বিস্ত ত করা প্রয়ােজন সেখানে প্রথমে প্রেরণ করতে হবে সন্ধানী অগ্রগামী দল বা কর্মী। এর কাজ হবে গােপনে ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিক ও সহানুভূতিশীলদের মাঝে কাজ করে জাতীয় শত্রুদের বিষয় অনুসন্ধান করা, গেরিলাদের থাকার ব্যবস্থা করা, স্থানীয় লােক সংগ্রহ করা। এই কাজের ভিত্তিতে আসবে গেরিলা দল। তারা জাতীয় শত্রু খতম করবে, সন্ধানী দল এগিয়ে যাবে। তার পিছনে যাবে গেরিলা দল, গেরিলা দলের পিছনে আসবে সংগঠক দল। সংগঠক দল বা ব্যক্তির কাজ হবে জাতীয় শত্রু খতম হয়েছে বা হচ্ছে এরূপ এলাকায় ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিকদের মাঝে পার্টি, গ্রামরক্ষী বাহিনী, স্থানীয় গেরিলা গ্রুপ, বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিকদের মাঝে পার্টিতে যােগদানে ইচ্ছুকদের মাঝে গড়ে তুলবে পাঠচক্র।
পৃষ্ঠা: ১৫১
বিস্তৃতি উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনাহীনভাবে কাজ করা উচিত নয়। বিস্তৃতির গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত বিভিন্ন গেরিলা অঞ্চল, ঘাটি এলাকা বা ফ্রন্ট এরিয়ার সাথে সংযােগ সাধন করা, মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের বড় সমাবেশ এড়িয়ে অগ্রসর হওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য সুবিধাজনক অঞ্চলের দিকে এগুনাে ইত্যাদি।
আমাদের গেরিলা অঞ্চলগুলাের সাথে নদী-খাল যুক্ত। কাজেই নদী-খালে মাঝি, জেলে, চরের লােকদের মাঝে কাজ করে গেরিলা সংগ্রহ করতে হবে বা নৌকাসহ গেরিলাদের নদীতে নৌ-গেরিলা যুদ্ধের জন্য নিয়ােগ করতে হবে। তারা নদীতে নৌকা ভাড়া খাটবে বা মাছ ধরে গেরিলা তৎপরতা চালাবে। নদী-খাল সংলগ্ন সমভূমির গেরিলারা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সহজেই এ সকল নৌকায় যেতে পারবে। নৌগেরিলারা চরাঞ্চল, নদী-খালের উভয় পার্শ্বে, নদী-খালে স্বাধীনভাবে এবং সমভূমির সাথে সমন্বিত করে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে পারবে। শত্রুর যাতায়াত ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে সক্ষম হবে। এভাবে পূর্ব বাংলার বিশেষতঃ সমভূমি আর নদী খাল, উভয় অংশে সমন্বিতভাবে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা হলে এক নূতন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে।
শহরের গেরিলারা গ্রাম এবং নদীর গেরিলাদের অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা জাতীয় শত্রুদের খতম করবে। এভাবে গ্রামের বিপ্লবী যুদ্ধের সাথে শহরের কাজকে সমন্বিত করতে হবে।
৫. আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিশেষ কতকগুলাে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিক, যুবলীগ, পার্টির নেতৃত্বে গণসংগঠনের লােক ব্যতীত সরাসরি কাউকে গেরিলা দলে রিক্রুট না করা, গ্রাম্য বুদ্ধিজীবী, প্রাক্তন আওয়ামী লীগ, মুক্তি বাহিনী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের মাঝে ইচ্ছুকদের প্রথমে যথাযথ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পাঠচক্রে সংগঠিত করতে হবে, সেখানে তারা কৃষকদের মাঝে কাজ করবে, পার্টির লাইনে শিক্ষা গ্রহণ করবে, গেরিলাদের সাথে অপারেশনে যাবে। এ প্রক্রিয়ায় যারা পার্টিতে যােগদানের যােগ্য তাদেরকে গেরিলা বাহিনীতে সংগ্রহ করা যায়। পাঠচক্র বা পার্টিতে যােগদানে ইচ্ছুক নয় এরূপ বুদ্ধিজীবী, জমিদার, ধনী চাষী, মাঝারী চাষী ও অন্যান্য শােষক শ্রেণী থেকে আগতদের গেরিলা হিসেবে সরাসরি সংগ্রহ করা বন্ধ করতে হবে, সংগৃহীত হয়ে থাকলে বের করে দিতে হবে। আলােচনার বিষয়ে আলােচনা সংক্রান্ত নীতি কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
যে সকল এলাকায় আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা রয়েছে সেখানে গেরিলা ও পার্টি-কর্মীরা কঠোরভাবে গােপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করবে। প্রধানতঃ শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষীদের ওপর নির্ভর করবে, তাদের বাড়ীতে ছড়িয়ে থাকবে, তাদের মাঝে পার্টি গেরিলা সংগঠন গড়ে তুলবে, তাদের ওপর নির্ভর করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাজ করবে।
কৃষকরাই হচ্ছে গ্রামের সবচাইতে বিপ্লবী শ্ৰেণী। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ মূলতঃ এদেরই যুদ্ধ। আমরা কতখানি এদের ওপর নির্ভর, এদেরকে জাগ্রত ও সংগঠিত করি তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের অস্তিত্ব ও বিপ্লবের বিজয়।
গ্রাম্য এলাকায় ক্ষেতমজুর, গরীব চাষীদের মাঝে জাতীয় শত্রুদের ভূমি বিনামূল্যে বিতরণ এবং দেশপ্রেমিক জমিদার-জোতদার-সুদখােরদের শােষণ কমানাে দৃঢ়ভাবে
পৃষ্ঠা: ১৫২
কার্যকরী করতে হবে। ভূমি বিতরণ ও সামন্তবাদী শােষণ কমানাের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে কৃষক জনতা একচেটিয়াভাবে আমাদের সমর্থন করবে। আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলরা এ কর্মসূচীর বিরােধিতা করে কৃষকের শত্রু বলে পরিচিত হবে। ইহাই হবে তাদের সাথে আমাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।
এদের ওপর নির্ভর করে ছয় পাহাড়ের দালালদের গেরিলা তৎপরতা পরিচালনা করে ধ্বংস করা যায়। জনগণের ওপর নির্ভর করে আমাদের সতেরজন গেরিলা এই প্রতিক্রিয়াশীলদের দুইশত সাতাশি জনকে আক্রমণ করে, পাঁচজনকে হত্যা করে, বাকিরা প্রাণভয়ে পালায়। শেষ পর্যন্ত তারা পাক-সামরিক দস্যুদের হাতে নিহত হয়।
আমাদের মুক্ত এলাকায় ঢুকে পড়া আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ওপরে উল্লিখিতভাবে গেরিলা তৎপরতা চালাতে পারি এবং তাদেরকে উৎখাত ও বিতাড়িত করে আমাদের এলাকায় আমাদের অধিকার কায়েম রাখতে পারি।
৬. সম্প্রতি আমাদের গেরিলাদের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সমভূমিতে গেরিলা যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা যাবে কিনা, আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলার মােকাবেলা করা এবং তাদের উপস্থিতি রয়েছে এরূপ অঞ্চলে কাজ করা যাবে কিনা।
সমভূমিতে গেরিলা যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা যাবে কিনা এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে ১নং ফ্রন্ট এরিয়ায় পাক-সামরিক দস্যুদের ঘেরাও-দমন অভিযানের তীব্রতা ও নির্মমতা এবং কর্মীদের বই পড়ে সৃষ্ট, পার্বত্য অঞ্চল গেরিলা যুদ্ধের জন্য সুবিধাজনক এ ধারণা থেকে। শেষােক্ত প্রশ্নটি উদ্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের সর্বত্র। উপস্থিতি, তাদের নকসাল’ পেলেই খতম কর নীতি এবং ১নং ও অন্যান্য ফ্রন্ট এরিয়ায় আমাদের ইউনিটসমূহকে ঘেরাও ও নিরস্ত্র করা, কর্মীদের বন্দী ও হত্যা করা, শেষ পর্যন্ত গেরিলাদের বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে প্রত্যাহারের কারণে।
পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলই সমভূমি এবং নদীমাতৃক। পূর্ব বাংলার বিপ্লবের জয়-পরাজয় নির্ভর করছে এ সমভূমি ও নদীসমূহে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করা, টিকিয়ে রাখা, বিকশিত করার সমস্যার সমাধানের ওপর।
গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে সমভূমিতে অস্থায়ী ঘাঁটি এলাকা বা পরিবর্তনশীল মুক্ত এলাকা স্থাপন করা যায়। ১নং, ২নং, ৫নং* পাবনা এবং টাঙ্গাইলের ফ্রন্ট এরিয়াসমূহ তার প্রমাণ।
এ সকল এলাকা জাতীয় শত্রু মুক্ত, গেরিলারা অবাধে বিচরণ করে, রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম হচ্ছে বা হয়েছে।
১নং ফ্রন্ট এরিয়া ও অন্যান্য ফ্রন্টের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে পাক-সামরিক দস্যুদের ঘেরাও-দমন আমাদের ধ্বংস করতে পারে না, ঘেরাও-দমন পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে না পারলেও, ঘেরাও-দমনের বলয় অতিক্রম করে নূতন অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত করা ও টিকে থাকা যায়। এভাবে ১নং ফ্রন্ট এরিয়ার ঘেরাও-দমনের
…………………………………………………………………….
* ২নং ও ৫নং ফ্রন্ট এরিয়াগুলাে ছিল বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৫৩
পরবরিশাল জেলার কয়েকটি অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ বিস্তৃতি লাভ করে, গেরিলারা টিকে থাকে।
কিন্তু গেরিলাদের মাঝে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলরা ছিল যারা ভারত-প্রত্যাগত মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে যােগ দেয় এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে, আমাদের গেরিলাদের অবস্থান জানিয়ে দেয়। কোন কোন এলাকায় প্রতিক্রিয়াশীল। জোতদার-জমিদার, বুদ্ধিজীবীরা আমাদের খবর আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের দিয়ে দেয়। এর ফলে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়।
গেরিলা গ্রুপসমূহে পার্টি-সংগঠন না করা, গেরিলাদের রাজনৈতিক শিক্ষা না দেওয়া, নেতৃত্বের সমরবাদ, কমান্ডার-রাজনৈতিক কমিসারদের উচ্চস্তর ও সদস্যদের সাথে ভাল সম্পর্ক না থাকা, জনসাধারণের মাঝে কাজ না করা, কৃষকের ওপর সর্ববিষয়ে নির্ভর না করা, গেরিলাদের অবস্থানের বিষয় এবং উচ্চস্তর-নিম্নস্তরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথাযথ গােপনীয়তা বজায় না রাখা প্রভৃতি এ বিপর্যয়ের কারণ। কাজেই উপরােক্ত কারণসমূহ দূর করলেই আভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা ও দলত্যাগী বন্ধ হবে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেউ আমাদের খতম করতে পারবে না।
উপরন্তু সরাসরি গেরিলা সংগ্রহ করতে হবে ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিক, যুবলীগ ও পার্টির নেতৃত্বাধীন গণসংগঠনের বিপ্লবীদের মধ্য থেকে। বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের মাঝে যারা পাঠচক্রে যােগদানের মাধ্যমে পার্টিতে যােগদানের যােগ্যতা অর্জন করে তারাই গেরিলা বাহিনীতে যেতে পারে।
গেরিলা ও পার্টি-কর্মীদের ক্যাম্প করে থাকার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে, ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিকদের বাড়ীতে ছড়িয়ে থাকতে হবে, তাদের সাথে শ্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে, তাদেরকে সংগঠিত করতে হবে, এভাবে কর্মীদের পুনর্গঠন এবং কৃষকদের ওপর নির্ভরতা জন্মাবে এবং জনগণের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
এভাবে কৃষক-শ্রমিক-বিপ্লবীদের সমন্বয়ে জনগণের সাথে যুক্ত একটি অপরাজেয় বাহিনী গড়ে উঠবে।
আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলরা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা নৌকায় থাকে বা জোতদার-মহাজনদের বাড়ীতে থাকে। তারা গেরিলা সংগ্রহ করে কমপক্ষে অষ্টমশ্রেণী পাশ বুদ্ধিজীবী থেকে। অর্থাৎ জোতদার, মহাজন, ধনী চাষী, বুর্জোয়াদের ছেলেদের থেকে।
গ্রাম্য এলাকায় ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিকদের সমাজ জোতদার-জমিদার-ধনী চাষীদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এ অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করে। আমাদের পক্ষে সহজেই ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিকদের মাঝে গােপন কাজ করা, গেরিলা সংগ্রহ করা, জাতীয় শত্রু খতম করা, পার্টি-সংগঠন গড়ে তােলা, আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের খতম ও নিরস্ত্র করা সম্পূর্ণ সম্ভব।
আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনী রয়েছে এরূপ অঞ্চলে কঠোরভাবে গােপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে হবে, একজন একজন করে গেরিলা সংগ্রহ করতে হবে। গােপনে থাকতে হবে, প্রয়ােজনবােধে থাকার স্থান গােপন রাখার জন্য প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করে থাকা যায়; থাকার স্থানে রাতে প্রবেশ করা আবার শেষ রাতে বেরিয়ে আসা, দিনে প্রয়ােজন হলে মাচার ওপর থাকা প্রভৃতি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। গেরিলাদের গােপনীয়তা সম্পর্কে ট্রেনিং দেওয়া, ফিসফিস করে প্রচার, পােস্টার, লিফলেট মারফত প্রচার চালানাের পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ১৫৪
এক গ্রামের ক্ষেতমজুর-গরীব চাষীদের সাথে অন্য গ্রামের ক্ষেতমজুর-গরীব চাষীদের আত্মীয়তা, পরিচয় রয়েছে। এভাবে এক গ্রামে কৃষকের মাধ্যমে গ্রামের পর গ্রামে গেরিলা গ্রুপ গঠন, পার্টি-সংগঠন গড়ে তােলা, জাতীয় শত্রু খতম করা, গেরিলা তৎপরতাকে বিস্তৃত করা যায়।
এ সকল কাজে ঐ ধরনের বুদ্ধিজীবী লাগাতে হবে যারা সহজেই ক্ষেতমজুর, গরীব চাষীদের মত জীবন ধারণ করতে পারে ও কঠোর গােপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে পারে।
যে সকল অঞ্চলে মুক্তি বাহিনী স্থায়ীভাবে থাকে না কিন্তু আনাগােনা করে সেখানেও ওপরের পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। ঢাকার নিকটে তিনটি অঞ্চলে এভাবে কাজ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের নাকের ডগায় আমাদের কাজ হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আমাদের সহানুভূতিশীল বা কর্মীদের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। এদের নিরস্ত্র ও উৎখাত করার কাজ অচিরেই শুরু হচ্ছে।
অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে রিক্রুটমেন্ট এবং কাজের বেলায় উপরােক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করলে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের এলাকায়, তারা আনাগােনা করে এরূপ এলাকায় আমাদের গেরিলা যুদ্ধকে বিস্তৃত করা ও টিকিয়ে রাখা এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে বিতাড়িত করে তাদের এলাকা দখল করা যায়।
আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলরা সাধারণতঃ নৌকায় অবস্থান করে, চলমান অবস্থায় থাকে। তারা সাধারণতঃ সামন্ত জমিদার, ধনী চাষীদের বাড়ীতে ওঠে, বেপরােয়া পান-ভােজ চালায়, অর্থের বিনিময়ে জাতীয় শত্রু ছেড়ে দেয়, তাদের বাড়ীতে থাকে, জোর করে অর্থ সংগ্রহ করে, কখনও কখনও গরীব লােকদের বাড়ীতে উঠে মাংসভাত খেতে না পেলে মারধাের করে, বন্দুকের ডগায় গরীব মাঝিদের বিনাপয়সায় কাজে লাগায়, জনগণকে অস্ত্র বহনে বাধ্য করে, মেয়েদের ওপর নির্যাতন করে, ডাকাতি করে, জনগণের ধন-সম্পত্তি নষ্ট করে, বিশেষ করে পাট পুড়িয়ে দেয়, ফসল নষ্ট করে।
প্রায় ক্ষেত্রেই মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা হচেছ জমিদার-জোতদার-ধনী চাষী, বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ শশাষক শ্রেণীর সন্তান। তারা স্থানীয় ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী, নিম্নমাঝারী চাষী, শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখার জন্য বন্দুক ব্যবহার করে।
তারা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে যাকে খুশি তাকেই হত্যা করে, এমনকি নিজেদের লােকদেরও হত্যা করে।
তারা জনসাধারণের মাঝে প্রচার, তাদেরকে সশস্ত্র করা, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি কাজ করে না।
তারা দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে নিরস্ত্র ও খতম করার পথ গ্রহণ করেছে। এ উদ্দেশ্যে তারা তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীলদের নির্দেশে ছয় পাহাড়ের স্বার্থে কাজ করছে।
এ সকল কারণে জনসাধারণ অধিকাংশ এলাকায় তাদের উপর ক্ষুব্ধ এবং তাদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। কোন কোন এলাকায় জনগণ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীলদের খতম করলে পুরস্কার দিতে ইচ্ছুক। তারা পাক-সামরিক দস্যু ও মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল দস্যুদের উভয়কেই উৎখাত করতে চায়।
এ প্রতিক্রিয়াশীল দস্যু বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মাঝে প্রায় ক্ষেত্রেই কোন সংযােগ
পৃষ্ঠা: ১৫৫
নেই। তারা নিজেদের মাঝে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে নিরস্ত্র করে বা হত্যা করে।
পাক-সামরিক দস্যুদের ঘেরাও-দমন বা খােজ কর, ধ্বংস কর’ অভিযান মােকাবিলা করার জন্য যে সামরিক নীতি ও কৌশল, মনােবল, জনগণের ওপর নির্ভরতা প্রয়ােজন তা তাদের নেই, যদিও তাদের আধুনিক অস্ত্র ও লােকবল রয়েছে।
যে সকল জাতীয় শত্রুদের বাড়ীতে তারা থাকে বা যাদেরকে তারা ছেড়ে দেয় তারাই সামরিক দস্যুদের ডেকে এনে তাদেরকে খতম করবে। কোন কোন এলাকায় জনসাধারণও তাদের বিরুদ্ধে সামরিক দস্যুদের সাথে সহযােগিতা করবে।
পাক-সামরিক দস্যুদের শীতকালীন অভিযানের মুখে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল দস্যু বাহিনীর বড় বড় ইউনিটসমূহের টেকা সম্ভব হবে না। তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বে, অনেকেই ধ্বংস হয়ে যাবে, ভারতে চলে যাবে। ইতিমধ্যেই পরবর্তী বর্ষায় আসবে বলে অনেকেই ভারতে চলে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে এভাবে গ্রেফতারের ফলে বিভিন্ন ইউনিট-সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এর ফলে মুক্তি বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল দস্যু বাহিনীর সৃষ্ট আমাদের উপর চাপ কমে যাবে।
এরূপ অবস্থায় এ দস্যুবাহিনীর সদস্যদের নিকট থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা, তাদের পরিত্যক্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আমাদের পুরােনাে এলাকায় পুনরায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে।
৮. উপরােক্ত বিষয়সমূহ গভীরভাবে পর্যালােচনা করা এবং সৃজনশীলভাবে প্রয়ােগ করা হলে আমরা অবশ্যই সক্ষম হবাে আমাদের বিকাশ ও গতিকে বজায় রাখতে, আরাে জটিলতর সমস্যার মােকাবিলা করে বিজয় অর্জন করতে।
নােট : আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনীর ফ্যাসিস্টদের পক্ষে শীতকালে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হামলার মুখে টেকা সম্ভব ছিল না। পূর্ব বাংলার গ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ উৎখাত হয়ে গেলে একমাত্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি থাকতাে মুক্তিযুদ্ধ চালাতে এবং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে শেষ পর্যন্ত সর্বহারা শ্ৰেণী জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের নেতৃত্বে চলে আসতাে, দেশপ্রেমিকরা সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টে যােগদান করতাে, পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী জনগণের প্রকৃত মুক্তি আনয়নকারীরা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বে এসে পড়তাে। অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে অনিবার্যভাবেই মুক্তিযুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব পরাজিত হতাে। বিপ্লবী নেতৃত্ব কায়েম হতাে। এ সত্য উপলব্ধি করে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা যুদ্ধ দ্রুত মীমাংসা করার জন্য পূর্ব বাংলা আক্রমণ করে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব তার দালালদের হাতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাতে সৈন্য, অস্ত্র, রসদ আনতে না পারে তার জন্য ভারতীয়
পৃষ্ঠা: ১৫৬
লেখসম্প্রসারণবাদীরা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার জলপথ ও আকাশপথ বন্ধ করে দেয়। পূর্ব বাংলায় যাতে কোন বৈদেশিক সাহায্য না আসতে পারে তার জন্য সমুদ্র অবরােধ করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য সেখানেও আক্রমণ চালানাে হয়। যৌথ কমান্ড গঠনের নামে মুক্তি বাহিনী প্রকৃতপক্ষে ভারতের অধীনস্থ সহায়ক বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। মুক্তি বাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর কামানের খােরাকের কাজে, রাস্তাঘাট, পুল নষ্ট করা, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ ও টানার কাজে ব্যবহার করে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বিমান বাহিনী পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিমানসহ যুদ্ধে অভ্যস্থ সৈন্যদের মনােবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়। শেষ পর্যন্ত তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। কাজেই ভারতীয় আক্রমণ ও সরাসরি পূর্ব বাংলা দখল লেখকের বিশ্লেষণ-মুক্তি বাহিনীর পক্ষে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের শীতকালীন অভিযানের মুখে টেকা সম্ভব নয় এসত্য প্রমাণ করছে। লেখক ও পার্টির যথাযথ বৈদেশিক যােগাযােগের অভাবে ভারতের সরাসরি আক্রমণের বিষয় অবগত হওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে ভারতীয় আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক পরিস্থিতি কি হবে তা বিশ্লেষণ করা কের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পৃষ্ঠা: ১৫৭
বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্যে
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির খােলা চিঠি
(জানুয়ারি, ১৯৭২)
পূর্ব বাংলার সত্যিকার স্বাধীনতার জন্য পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ জনগণ আত্মবলিদান করেছেন। তাদের আকাংক্ষিত প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হতে পারে নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন দাবীসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
১। পূর্ব বাংলার ভূমি থেকে অনতিবিলম্বে শর্তহীনভাবে সকল ভারতীয় সৈন্য, সামরিক ও বেসামরিক উপদেষ্টাদের ভারতে ফেরত পাঠানাে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, স্থিতিশীলতা আনয়ন, পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন বা অন্য কোন কাজে সহায়তা করার জন্য ভারত বা অন্য কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের সামরিক বা বেসামরিক নাগরিকদের উপদেষ্টা বা অন্য কোন পদে নিয়ােগ না করা, নিয়ােজিত হয়ে থাকলে তাদেরকে অনতিবিলম্বে নিজ দেশে ফেরত পাঠানাে।
ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকদের পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব, হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের অবসান করা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা যাতে জনগণের উপর অত্যাচার করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২। পূর্ব বাংলার স্থিতিশীলতা আনয়ন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজের জন্য পূর্ব বাংলার সম্পদ এবং কষ্টসহিষ্ণু, পরিশ্রমী ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ, সাহসী ও দেশপ্রেমিক জনগণের উপর সর্বতােভাবে নির্ভর করা।
৩। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্য থেকে নিয়মিত স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী গড়ে তােলা এবং জনগণকে সামরিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে সশস্ত্র করে স্থানীয় বাহিনী গড়ে তােলা। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষার জন্য এই সামরিক বাহিনী ও জনগণের উপর নির্ভর করা।
পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষার জন্য ভারত বা অন্য কোন দেশের উপর নির্ভর না করা। পূর্ব বাংলার নিয়মিত বাহিনী ও স্থানীয় বাহিনী গড়ে তােলার দায়িত্ব মুক্তি বাহিনীর পক্ষেই সম্ভব। মুক্তি বাহিনীকে নিরস্ত্র করা থেকে ভারতীয় বাহিনীকে বিরত করা। মুক্তি বাহিনীর মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা জনগণের উপর অত্যাচার বন্ধ করা।
ভারত বা অন্য কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে প্রকাশ্য বা গােপন কোন প্রকার প্রতিরক্ষা চুক্তি, সামরিক চুক্তি বা বন্ধুত্বের চুক্তির আবরনে সামরিক চুক্তি না করা।
৪। পূর্ব বাংলার জামাত, পিডিবি, মুসলীম লীগ (তিন অংশ), নিজামে ইসলাম এবং পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে সহযােগিতা করেছে এইরূপ অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী, দল ও ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়া, ভােট প্রদানের অধিকার, মিটিং, মিছিল ও সংগঠিত হওয়া এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার অধিকার বাতিল
পৃষ্ঠা: ১৫৮
করা। তাদের ভূমি গ্রামের ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা। ভূমি ব্যতীত তাদের শিল্প-ব্যবসা ও অন্যান্য সম্পত্তি ক্ষতিপূরণ ছাড়াই রাষ্ট্রীয়করণ করা।
এদের মধ্যকার গোঁড়া জনগণ-বিরােধীদের বিচার করা ও শাস্তি প্রদান করা।
৫। আদমজী, দাউদ, ইস্পাহানী, বাওয়ানী, গান্ধারা, করিম, হাবিব ও অন্যান্য অবাঙালীদের পূর্ব বাংলাস্থ বৃহৎ শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই রাষ্ট্রীয়করণ করা। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জাতীয় পুঁজিকে রক্ষা ও তার বিকাশে সাহায্য করা।
৬। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে সহযােগিতা করেনি-এরূপ পূর্ব বাংলার সামন্ত-জমিদার-জোতদারদের ভূমি ক্ষতিপূরণসহ ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা। মহাজনী প্রথা, সুদ গ্রহণের প্রথা ও বন্ধকী প্রথা বাতিল করা এবং এর ফলে হারানাে ভূমি কৃষকদের মাঝে বিনা ক্ষতিপূরণে ফেরত দেয়া। গ্রাম-পঞ্চায়েত ও গ্রাম রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে গ্রামে জমিদার, জোতদার, মহাজন, টাউট, অত্যাচারী, জুলুমবাজদের শাসন কায়েম ও তাদের রক্ষা না করা। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে ও যুদ্ধে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।
৭। ২৫শে মার্চের পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের তৎপরতার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে নিহত, যুদ্ধকালে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষতিগ্রস্ত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্য শুরু করার জন্য সাহায্য করা।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দ্বারা আটককৃত সকল রাজবন্দীদের মুক্তি প্রদান করা।
৮। শর্তহীন ও স্বল্প সুদে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ঋণ গ্রহণ করা। প্রকাশ্য বা গােপনে ভারত বা অন্য কোন দেশের সাথে কোন প্রকার স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী অসম বাণিজ্য চুক্তি, পণ্য বিনিময় চুক্তি না করা। গােপনে সম্পাদিত সকল প্রকার চুক্তি জনসাধারণের বিবেচনার জন্য প্রকাশ করা। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারী, শাক-সবজি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি ভারতে রপ্তানী বন্ধ করা।
ভারত কর্তৃক সরাসরি পূর্ব বাংলা থেকে পাট, চা, চামড়া ইত্যাদি ক্রয়ের অধিকার, বাতিল করা, অন্যথায় পূর্ব বাংলার জনগণ শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হারাবেন।
৯। পূর্ব বাংলার শিল্প ব্যবস্থা, বাণিজ্য, ব্যাংকিং, কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবহন, যােগাযােগ এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে ভারত বা অন্য কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের পুঁজির অনুপ্রবেশ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব প্রতিরােধ করা। পূর্ব বাংলা থেকে ভারত বা অন্য কোন রাষ্ট্রে পুঁজি পাচার বন্ধ করা।
পূর্ব বাংলার সীমান্তে কাস্টম ব্যবস্থা চালু করা। পূর্ব বাংলা থেকে ভারত বা ভারত থেকে পূর্ব বাংলায় চোরাকারবারী বা অননুমােদিত উপায়ে দ্রব্যাদি পাচার রােধ করা।
১০। পূর্ব বাংলায় ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা, হালকা শিল্প ও কুটীর শিল্প বিকাশ সাধন করা। এদেরকে বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে রক্ষা করা। এ উদ্দেশ্যে ভারত বা অন্য দেশের পণ্যে পূর্ব বাংলার বাজার দখল প্রতিহত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দ্বারা বরখাস্তকৃত, ছাটাইকৃত, ছুটি প্রদত্ত, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী এরূপ সকল কর্মচারীদের পুনরায় কাজে বহাল করা। বেকারদের চাকুরীর ব্যবস্থা করা।
পৃষ্ঠা: ১৫৯
চাকুরীকালীন অবস্থায় মৃতদের পেনশন ও অন্যান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। ভারত বা অন্য কোন বৈদেশিক নাগরিকদের সরকারী বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে নিয়ােগ না করা। নিয়ােজিত হয়ে থাকলে তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানাে।
সরকারী, বেসরকারী, সামরিক এবং অন্যান্য সকল চাকুরীতে নিয়ােগ, পদোন্নতি ও ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, পার্টিগত, গােষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত প্রভাবের বিরােধিতা করা, যােগ্যতাকে নিয়ােগ, পদোন্নতি ও ছাটাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা।
১২। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ চালু করা, ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, জাতি ও দেশ গঠনমূলক গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা।
১৩। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক শিল্পকলা-চলচ্চিত্র, সাহিত্যসহ সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রের অবাধ বিকাশের ব্যবস্থা করা। ভারত বা অন্য দেশের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দেশীয় সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা।
১৪। বেতার, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্রকে একক পার্টির প্রচারযন্ত্র বা বৈদেশিক প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরােধিতা করা।
১৫। দেশে সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিপীড়নের বিরােধিতা করা, উপাসনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা প্রদান, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগােডা রক্ষা করা। ধর্মীয় সমতার ব্যবস্থা করা।
১৬। বিভিন্ন মতাবলম্বী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, গােষ্ঠী ও ব্যক্তিদের রাজনৈতিক তৎপরতা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা, বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার ও সমাবেশের স্বাধীনতা, বিক্ষোভ প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করা। প্রকাশ্যে বা গােপনে বিনা বিচারে গ্রেফতার, হত্যা, আটক রাখার বিরােধিতা করা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা ভারতে না গিয়ে নিজেদের ও জনগণের শক্তির উপর নির্ভর করে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির মহান গেরিলা যুদ্ধ চালায়, মুক্ত অঞ্চল গড়ে তােলে, একে স্বাগত জানাবার পরিবর্তে মুক্তিবাহিনীর মধ্যকার ফ্যাসিস্টরা এ সকল অঞ্চল আক্রমণ ও দখল করে নেয়, সর্বহারা পার্টির বহু দেশপ্রেমিক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও জনগণকে নকসাল অভিহিত করে হত্যা করে।
বর্তমানেও প্রকাশ্যে বা গােপনে আওয়ামী লীগ থেকে ভিন্ন মতাবলম্বী, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের নকসাল অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে খতম অভিযান পরিচালনা বন্ধ করা। যে সকল ফ্যাসিস্ট খুনীরা এ ধরনের জঘন্য কাজ করেছে তাদের বিচার করা ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা জনগণের নিকট প্রকাশ করা। শহীদদের পরিবারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দান করা।
প্রমাণিত আল-বদর, রাজাকার ও পাক-সামরিক দস্যুদের অন্যান্য দালালের কঠোর শাস্তি বিধান করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে স্বতন্ত্র বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিকদেরকে আল-বদর, রাজাকার বা পাক-সামরিক গােষ্ঠীর দালাল বলে খতম করার ঘৃণ্য কার্যকলাপের বিরােধিতা করা।
পৃষ্ঠা: ১৬০
১৭। পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অনাক্রমণ, পরস্পরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক সহায়তা এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, এই পঞ্চশীলার নীতির ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। অন্য দেশের সামরিক তৎপরতায় শরীক না হওয়া, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা।
১৮। ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ কর্তৃক পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তু জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। তাদের দ্বারা প্রদত্ত সাহায্য সুদসহ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
১৯। ভারত বা অন্য কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের পূর্ব বাংলায় আগমন বা পূর্ব বাংলা থেকে ভারত ও বৈদেশিক রাষ্ট্রে গমনের জন্য প্রচলিত আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রবর্তন করা। অবাধ চলাচল প্রতিহত করা।
২০। মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক পাকিস্তানের স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি অগ্রাহ্য করা। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদের ঋণ পরিশােধের যে অংশ পূর্ব বাংলার ওপর পড়ে তা প্রদান না করা।
মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীর পূর্ব বাংলাস্থ সকল সম্পত্তি ও পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা।
২১। সকল ক্ষেত্রে নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও কর্মের সুযােগ প্রদান করা।
২২। সকল প্রকার শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রম সময় নির্ধারণ করা এবং প্রগতিশীল শ্রম আইন প্রণয়ন করা। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে ও যুদ্ধে নিহত শ্রমিকদের পরিবারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা, বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থান করা।
২৩। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে ও যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কর্মে অক্ষম ও তাদের ওপর নির্ভরশীলদের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা।
২৪। আত্মসমর্পণকারী পাক-সামরিক দস্যুদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি পূর্ব বাংলার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার জন্য ব্যবহার করা। এ সকল দ্রব্যাদি ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক দখল ও ভারতে প্রেরণ বন্ধ করা।
২৫। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালীদের পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসা ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
২৬। পূর্ব বাংলায় চালু মুদ্রার মান কমানোের ফলে ভারত লাভবান হচ্ছে। পূর্ব বাংলার বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ভারত অর্জন করছে। ইহা প্রতিরােধ করা এবং মূল্যমান বাড়িয়ে পূর্বের মূল্য ধার্য করা, বাজারে ভারতীয় মুদ্রা চালু বন্ধ করা।
পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে স্বর্ণ, রৌপ্য পাচার বন্ধ করা।
২৭। ফারাক্কা বাঁধজনিত সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান করা।
উপরিউক্ত দাবীসমূহ বাস্তবায়িত না করার অর্থ পূর্ব বাংলার সত্যিকারের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার আবরণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খল।
পূর্ব বাংলার জনগণ আশা করে বাংলাদেশ সরকার উপরিউক্ত দাবীসমূহ বাস্তবায়িত করে তাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রমাণ দেবেন। অন্যথায় এ সরকার হবে ভারতের পুতুল সরকার এবং পূর্ব বাংলা হবে ভারতের উপনিবেশ।
পৃষ্ঠা: ১৬১
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির
প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোের্ট
(জানুয়ারি, ১৯৭২)
কমরেডগণ,
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেস পূর্ব বাংলার বিপ্লব এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন এক সময় যখন পূর্ব বাংলার সমাজের গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা আত্মবলিদান ও নির্ভীকতার মহান উপাখ্যানের সৃষ্টি করেছেন এবং রক্তের বিনিময়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
এ কারণে কংগ্রেস অনুষ্ঠান খুবই সময়ােচিত হয়েছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির
প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া
শ্রেণী সমাজের উদ্ভবের পর থেকে নিপীড়িত শ্রেণীসমূহ শােষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করে। তাদের এই বিদ্রোহ ও সংগ্রামই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মীরজাফর কর্তৃক ক্ষমতার লােভে বৃটিশ দস্যুদের ডেকে এনে বাংলা ও ভারতকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর এ দেশের জনগণ বৈদেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করে। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় এ সকল বিদ্রোহ সফলতা অর্জন করেনি।
বৃটিশ দস্যুরা তাদের পুঁজির স্বার্থে আমলাতান্ত্রিক পুঁজির সৃষ্টি করে। তারা সামন্তবাদকে জিইয়ে রাখে। তারা সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও তাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্ভর করে এ দেশকে শােষণ ও লুণ্ঠন করে।
এ সময় এ দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয় সর্বহারা পার্টি। এ শ্ৰেণীকে সংগঠিত করা ও শ্রমিক-কৃষক জনতাকে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বিশ শতকের ত্রিশ দশকের প্রথম দিকে গড়ে উঠে পাক-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এ পার্টি গঠনের প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা পার্টির ক্ষমতা দখল করে এবং পার্টিকে বিপথে পরিচালিত করে।
সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা উপনিবেশিক সামন্তবাদী ভারতবর্ষের উপরিকাঠামাের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র দখল করেছিল।
সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষাকারী গান্ধী উপরিকাঠামোের রাজনৈতিক ক্ষেত্র দখল করেছিল।
পৃষ্ঠা: ১৬২
এরা অহিংস-অসহযােগ এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে আপােষের রাজনীতির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে, যার প্রভাব থেকে সর্বহারা শ্রেণীতে আগত বুদ্ধিজীবীরা কখনও মুক্ত হতে পারেনি। এ সকল অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবীদের অমার্কসীয় চিন্তাধারা মার্কসবাদের বুলির আবরণে সংশােধনবাদ ও সুবিধাবাদ হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করে। তারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের লেজুড়ে পরিণত হয়।
তেলেঙ্গানার কৃষকদের গেরিলা সংগ্রাম, কৃষকদের তেভাগা সংগ্রাম, ১৯৪৫-৪৬এর দেশব্যাপী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানে এরা ব্যর্থ হয়।
ফলে বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যরা তাদের দালাল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী। এবং প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী যারা ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাদের হাতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যু ও তাদের দালাল প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু-ধর্মাবলম্বী বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানে যােগদান করে।
পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদী শােষণ টিকিয়ে রাখে, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ অব্যাহতভাবে বিকাশ লাভ করতে দেয় এবং সামন্তবাদের সাথে আপােষ করে একে টিকিয়ে রাখে। এভাবে তারা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রাখে।
পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে যােগদান ও সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসানজনিত কারণে যে সামাজিক অগ্রগতি সাধিত হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিকে সংশােধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তাকে সামাজিক অগ্রগতি বলে স্বীকার করেনি।
তারা সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে পরিপূর্ণরূপে উৎখাত করা, পূর্ব বাংলার জাতীয় বিকাশের সকল প্রকার অন্তরায় দূর করার কর্মসূচী গ্রহণ করেনি, বরং সামাজিক বিকাশের স্তরকে অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দেয় এবং ট্রটস্কীবাদী বিচ্যুতি ঘটায়।
পরবর্তীকালে এই সংশােধনবাদীরা নিয়মতান্ত্রিকতা ও শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারী পথ অনুসরণ করে। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘােষণার পর তারা ন্যাপে যােগদান করে।
যুবলীগ গঠন ও তার বিকাশ, মহান ভাষা আন্দোলন, পরবর্তীকালে ছাত্র ইউনিয়ন গঠন ও তার বিকাশ, ন্যাপ প্রভৃতির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী বামপন্থী প্রভাবে পড়ে।
কিন্তু সংশােধনবাদী নেতৃত্ব ও সকল বুদ্ধিজীবীদের শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত করা, মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ এবং বিপ্লবী শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে পােড় খাইয়ে, মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠিত করে সর্বহারা বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়। পূর্ব বাংলার উপর জাতীয় নিপীড়নের বিরােধিতা, সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ উৎখাতের জন্য গ্রামে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু না করার ফলে লক্ষ লক্ষ বুদ্ধিজীবীদের পার্টিতে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সােভিয়েট আধুনিক সংশােধনবাদীদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সভাপতি মাওয়ের নেতৃত্বে খাটি মার্কসবাদী বিপ্লবীদের বিরাট তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে চীন থেকে সভাপতি মাওয়ের রচনাবলী পূর্ব বাংলায় আসে।
এর ফলে অতি সত্বর সংশােধনবাদীদের মুখােশ সর্বহারা বিপ্লবীদের সামনে উন্মােচিত হয় এবং সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতাদর্শগত প্রস্তুতির সৃষ্টি হয়।
পৃষ্ঠা: ১৬৩
অবশেষে সংশােধনবাদীদের উৎখাতের জন্য সভাপতি মাও মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আহ্বান জানালেন “প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত।” এ মহান আহ্বানে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের মাকর্সবাদী-লেনিনবাদীরা নকলবাড়ীতে কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করে, গড়ে তােলে ভারতের সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা মণি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদের এ বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে হক-তায়াহা নয়া সংশােধনবাদীরা জ্যোতি বসু-নামুদ্রিপদের অনুসরণে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে এবং জ্যোতি বসু-নামুদ্রিপদের সংশােধনবাদী লাইন অনুসরণ করে। তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
বিশ্বাসঘাতক নয়া সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ কর্মীরা বিদ্রোহ করে। এ বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে ট্রটস্কী-চেবাদী দেবেন-বাসার, আলাউদ্দিন-মতিন, কাজীরণাে ষড়যন্ত্রকারীরা সাধারণ বিপ্লবীদের প্রতারিত করে। ইতিমধ্যে হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদীরা নিজেদের নাম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রেখে পূর্ব বাংলার ও ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতারিত করার চেষ্টা চালায়।
এ সকল বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সর্বহারা বিপ্লবীরা বিদ্রোহ করে এবং সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতি সংগঠন “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” ১৯৬৮ সালের ৮ই জানুয়ারী প্রতিষ্ঠা করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া, তাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিচালনার জন্য গ্রামে যায়, তাদের কাছ থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করে মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠিত হওয়ার সঠিক পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বামপন্থী ছাত্র ও অন্যান্যদের মাঝে কাজ করার জন্য কিছু সংখ্যক ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের শহরে রাখা হয়। এদের মাঝে একাংশ নেতৃত্বের লােভে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে শ্রমিক আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের গণসংগঠনের নেতৃত্ব হারায়। এই বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিনিধি নুরুল হাসান, আ.কা.ম. ফজলুল হক, মাহবুবুল্লা শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীতে পরিণত হয়।
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলার জাতীয় নিপীড়নের বিরােধিতা না করে পূর্ব বাংলার জনগণকে নেতৃত্বহীন রাখে। পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা এ সুযােগ গ্রহণ করে জাতীয় প্রশ্নের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়ােগ করার জন্য, যাতে সে চীন বিরােধী কমিউনিস্ট-বিরােধী পাক-ভারত যৌথ সামরিক জোট স্থাপন করে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের পঁচিশে মার্চের পরবর্তী সময়কার ফ্যাসিস্ট তৎপরতার ফলে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন পরাজিত হয়। তারা অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এশিয়ায় প্রভুত্ব স্থাপন, ভারত পূর্ব বাংলায় তার নয়া উপনিবেশ কায়েম, ভারত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রণের জন্য সােভিয়েট
পৃষ্ঠা: ১৬৪
সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ভারতের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন। ব্যবহার করে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সমর্থন ও সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে এবং পূর্ব বাংলা দখল করে নেয়; পূর্ব বাংলায় তারা উপনিবেশ স্থাপন করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন। করা এবং পূর্ব বাংলার জাতীয় সমস্যা সমাধানের সঠিক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে। এই সঠিক রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে গড়ে তােলা হয় জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনার সঠিক সামরিক লাইন।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কাজ দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করে এবং পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে সংগঠন গড়ে উঠে।
সভাপতি মাও বলেছেন, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই পার্টি গড়ে উঠে, বিকাশ লাভ করে ও সুসংবদ্ধ হয়। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তারা পূর্ব বাংলার বুকে সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান কাউন্সিল ও মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে বােমা বর্ষণ করে। আমাদের গেরিলারা সর্বপ্রথম ফটিকছড়িতে জাতীয় শত্রু খতম করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সর্বপ্রথম মুন্সিগঞ্জ, ঝালকাঠি ও অন্যান্য স্থানে পূর্ব বাংলার বর্তমান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এ জাতীয় পতাকার নক্সা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক তৈরী। বাংলাদেশ পুতুল সরকার শেষ পর্যন্ত এ পতাকা গ্রহণ করে।
পঁচিশে মার্চের পরবর্তীকালীন নির্যাতনের ফলে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা অস্থায়ীভাবে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু কর্মীরা এ অসুবিধা কাটিয়ে উঠে পুনরায় একত্রিত হয় এবং পূর্ব বাংলার জনগণকে সঠিক পথে সংগ্রামে পরিচালনা করে।
পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম পেয়ারা বাগানে গড়ে উঠে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নিয়মিত সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি বাহিনী। এই অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার সময় পার্টি নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলা, সামরিক বাহিনীর মধ্যকার রাজনৈতিক-সামরিক, পার্টি কাজ, রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম, ভূমিহীন কৃষকের মাঝে জাতীয় শত্রুর ভূমি বিতরণ করা, জনগণের সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলা, ঘেরাও-দমনজনিত সমস্যা, সশস্ত্র বাহিনীকে বিকশিত করা, গেরিলা যুদ্ধকে সম্প্রসারিত করা এবং অন্যান্য বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করে। এর ফলে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম গড়ে উঠে ঘাটি এলাকা। এ সকল অভিজ্ঞতা বিপ্লবী পার্টির জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
সমগ্র পূর্ব বাংলায় ও ভারতে পেয়ারা বাগানের সংগ্রাম একটি রূপকথার সৃষ্টি করে।
এ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক লাইন সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের পুরােপুরি দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয়, সংগঠনের কর্মীরা বিপ্লবী অনুশীলনে পােড় খায়, সশস্ত্র বাহিনী ও ঐক্যফ্রন্ট গড়ে উঠে। এভাবে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিকভাবে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার বস্তুগত অবস্থার সৃষ্টি হয়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের সভায় গ্রহণ করা হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি
পৃষ্ঠা: ১৬৫
প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। এভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ৩রা জুন, সমাপ্ত হয় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা।
পূর্ব বাংলার এই বিপ্লবী পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছেন শত-সহস্র বিপ্লবী, অবশেষে সার্থক হলাে তাদের স্বপ্ন।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা এবং পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও তার কর্মীদের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা, অপবাদ ও গুজব রটায়। কখনও কখনও এরা পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বহু কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের গ্রেফতার করে, আরও অনেকের বিরুদ্ধে বিরাট আকারে অর্থ পুরস্কারসহ গ্রেফতারী পরােয়ানা জারী করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সংক্রান্ত তদন্ত সরাসরি পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রেসিডেন্টের অধীন কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয়। এমন কি তারা কানাডা ও আমেরিকা থেকে বিশেষজ্ঞ ও যন্ত্রপাতি আনয়ন করে।
জেলের মধ্যে গ্রেফতারকৃত কর্মীদেরকে কথা বের করা, নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বিশেষ করে কমরেড সিরাজ সিকদারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়; অনেককে নির্দয়ভাবে সকল প্রকার অত্যাচার করা হয়; ক্যান্টনমেন্টে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্যাতন ও শাসানাে হয়। এ সকল নির্যাতন যশাের ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার দুররানীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
গ্রেফতারকৃত কমরেডদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের সেলে একা রাখা হয়, নিজেদের মধ্যে যাতে দেখা-সাক্ষাৎ না হয় তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা করা হয়। এমন কি এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে বিভিন্ন জেলে ছড়িয়ে রাখা হয়।
সংগঠনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তারা নানাবিধ প্রলােভন দেখায়।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা বামপন্থীদের মাঝে কেবলমাত্র আমাদেরকেই একমাত্র শত্রু বলে গণ্য করে এবং আমাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে। বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের ও পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরমতম বিরােধিতা ও নির্যাতন এবং প্রলােভন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন টিকে থাকে, তার অগ্রগতি অব্যাহত রাখে এবং বিরাট বিজয় অর্জন করে, সমাপ্ত করে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কার্যাবলী
অতি অল্প সময়ের মাঝে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ সময় পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা বরিশাল জেলার সমস্ত শক্তি ও আশেপাশের সাহায্য নিয়ে পেয়ারা বাগানে প্রচণ্ড ঘেরাও-দমন অভিযান চালায়। তারা বন্দুকের ডগায় শত-সহস্র মুসলিম জনগণকে এ হামলায় শরীক করায়।
এ প্রচণ্ড চাপের মুখে পেয়ারা বাগান থেকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের। প্রত্যাহার করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৬৬
আমাদের গেরিলা ইউনিটের নেতৃত্বে অচিরেই গৌরনদী, মাদারীপুর, পেয়ারা বাগানের আশেপাশে, মঠবাড়িয়া, খেপুপাড়া, পাথরঘাটা, পাদ্রীশিবপুর, ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা জেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে।
পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, বুদ্ধিজীবী ও সামন্তবাদীরা পূর্ব বাংলাকে ভারত ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নিকট বিক্রি করে। ভারত পূর্ব বাংলা দখল ন্যায়সঙ্গত করার জন্য তাদের দিয়ে একটি পুতুল সরকার কায়েম করে এবং তাদেরকে কামানের খােরাক হিসেবে ব্যবহার করে। তারা পূর্ব বাংলায় উপনিবেশ স্থাপনের একমাত্র বাধা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও তার কর্মীদের খতম করার কাজকে প্রাধান্য দেয়। তারা আলােচনার কথা বলে বা গােপনে অনুপ্রবেশ করে বা আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ফ্রন্টসমূহ ধ্বংস করার পদক্ষেপ নেয়। তারা তাদের গণসমর্থন এ কাজে ব্যবহার করে।
আমাদের কর্মীরা আমাদের গণসমর্থনকে প্রকাশ্য গণসংগ্রামে লাগাতে এবং জনগণকে সংগঠিত করতে ও শিক্ষিত করতে, নিজেদের সারি সর্বদা পরিষ্কার রাখতে, জনগণের সাথে একীভূত হয়ে কাজ করতে, কর্মীদের পার্টিগত লাইনে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রায় সকল স্থানেই আমাদের ঘাঁটিসমূহ উৎখাত হয়, বহু কর্মী নিহত ও নিখোঁজ হয়, অস্ত্র হারানাে যায়।
এভাবে আমাদের আক্রমণ করে তারা প্রমাণ করে যে, বুর্জোয়াদের সাথে যখন সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয় তখন তারা কমিউনিস্টদের ধ্বংস করতে সাহসী হয় না, বরঞ্চ নিজেদেরকে রক্ষার জন্য কমিউনিস্টদের সহায়তা নেয়। পক্ষান্তরে যখন সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকে তখন তারা কমিউনিস্ট ধ্বংস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হওয়া সত্ত্বেও কর্মীদেরকে পুনরায় কাজে বিন্যাস ও নিয়ােগ সম্ভব হয়।
ইতিমধ্যে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে সহায়তার নামে পূর্ব বাংলা আক্রমণ ও দখল করে নেয়, পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ স্থাপন করে এবং পূর্ব বাংলায় তার পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাবেদার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, তাদের তাবেদার ছয় পাহাড়ের দালালরা পূর্ব বাংলাকে কমিউনিস্ট বিরােধী, চীন বিরােধী ঘাঁটিতে পরিণত করে।
এভাবে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে যায়।
মনি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীদের পার্লামেন্টের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের ভাওতা সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া বলে প্রমাণিত হয়। তারা ভারতে যেয়ে আশ্রয় নেয়, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আওয়ামী লীগের লেজুড় হিসেবে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র তুলে ধরে।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদীরা শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের লাইন অনুসরণ করে জনগণকে খতম করে এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে হাত মিলায়।
মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদীরা জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শ্রেণীশত্রু খতমের কথা বলে মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদীরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালালী করে। দেবেন-বাসার, ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারীরা শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের বক্তব্য প্রত্যাহার করে, কোন প্রকার
পৃষ্ঠা: ১৬৭
আত্মসমালােচনা ব্যতিরেকেই জাতীয় সংগ্রামকে প্রধান সংগ্রাম বলে। তারা ভারতে জ্যোতি বসু-নামুদ্রিপদের পৃষ্ঠপােষকতায় ‘তথাকথিত সমন্বয় কমিটি গঠন করে। সমন্বয় কমিটির বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী উপদলগুলো পূর্ব বাংলায় ভারতের উপনিবেশ স্থাপনকে স্বাগত জানায়, তারা ভারতের পুতুল বাংলাদেশ সরকারকে স্বাগত জানায়। চীনকে তারা প্রকাশ্যে বিরােধিতা করে এবং ছয় পাহাড়ের দালাল এবং সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত হয়। পূর্ব বাংলায় তারা। নাম্বুদ্রিপদ-জ্যোতি বসুর অন্ধ অনুকরণ করছে। তারা পূর্ব বাংলার জ্যোতি বসু-নামুদ্রিপদ।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও পরে সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত সর্বহারা বিপ্লবীরা চার বৎসরের বিপ্লবী অনুশীলনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সাথে অধিকতর সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়েছে এবং মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
রাজনৈতিক
একটি সংগঠনের সঠিক রাজনীতি হচ্ছে পার্টির প্রাণ, পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভিকরণের মৌলিক শর্ত। দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নিয়ে সমাজকে বিশ্লেষণ করা, তার বিকাশের জন্য দায়ী দ্বন্দ্বসমূহ ও নিয়মবিধি আবিষ্কার করা, তা সমাধানের পথ নির্দেশ করা ও তা বাস্তবায়িত করার জন্য লেগে থাকা প্রভৃতি একটি সংগঠনের রাজনৈতিক কর্তব্য। সঠিক রাজনীতি থেকে উদ্ভূত হয় সঠিক সামরিক, সাংগঠনিক লাইন, পার্টির নেতৃত্বে সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়, তাদের বিজয় নিশ্চিত হয়।
আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, একটি রাজনৈতিক পার্টি তা প্রথমে যত ছােটই হােক না কেন, সঠিক রাজনৈতিক লাইন থাকলে তা অবশ্যই বিকাশ লাভ করে, বিরাট হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করে। অভিজ্ঞতা আরাে প্রমাণ করেছে যে সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রচণ্ড বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও অন্যান্য সুবিধাবাদের মুখােশ উন্মােচিত হয় ও তাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয় এবং তারা পরাজিত ও ধিকৃত হয়।
রাজনৈতিক রণনীতি হচ্ছে মৌলিক দ্বন্দ্বের সমাধান ও রণকৌশল হচ্ছে দ্বন্দ্বের স্তরের সমাধান। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহ, প্রধান দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বসমূহের সমাধান, পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের স্তর, এই স্তরের দ্বন্দ্বের সমাধান, সমাধানের পদ্ধতি; বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরে এবং সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করে এবং তা প্রয়ােগ করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক লাইন বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের ডান ও অতি বাম যা আকৃতিতে বাম কিন্তু সারবস্তুতে ডান-এই দুই লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অগ্রসর হয় এবং অনুশীলনের অগ্নি পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
মনি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে বুর্জোয়াদের। লেজুড়বৃত্তি করে এবং তার নিকট আত্মসমর্পণ করে। পক্ষান্তরে হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদীরা, দেবেন-বাসার, আলাউদ্দিন-মতিন ট্রটস্কী-চেবাদী, কাজী-রণা ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন পরিত্যাগ করে, সামন্তবাদের সাথে কৃষকের।
পৃষ্ঠা: ১৬৮
দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে অতি বাম অর্থাৎ সমাজের বিকাশের স্তর অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে টেনে এনে ট্রটস্কীবাদী ভুল করে এবং পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নের নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নিকট তুলে দেয়। এভাবে এরা জনগণকে বিপথে পরিচালনা করে এবং পূর্ব বাংলাকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করতে সহায়তা করে।
ভুল ও বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি থেকে উদ্ভূত হয় তাদের সাংগঠনিক বিশ্বাসঘাতক পদক্ষেপসমূহ। হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদী, মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদীরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে গােপনে আঁতাত করে, তাদের সহায়তা করে, তাদের গােয়েন্দা বিভাগের খবর সরবরাহকারী হয়, তারা রাজাকারে পরিণত হয়। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা এর বিনিময়ে তাদের গ্রেফতার করতাে না, গ্রেফতার হলে ছেড়ে দিত, বাড়ীঘর পােড়ায়নি, প্রকাশ্য পুস্তিকা প্রকাশ ও বিক্রয়, চলাফেরা ও থাকার অন্যান্য সুযােগ দেয়।
দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদী কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী ও অন্যান্য সংশােধনবাদী উপদলসমূহ ভারতে আশ্রয় নেয়, জ্যোতি বসু-নাম্বুদ্রিপদের সাথে আঁতাত করে, সমন্বয় কমিটি গঠন করে, জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান বলে, ছয় পাহাড়ের লেজুড়ে পরিণত হয়।
পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে কেবলমাত্র আমাদের সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। পাকিস্তানের সামরিক ফ্যাসিস্টদের শ্বেতপত্রে এবং আমাদের বিরুদ্ধে তাদের। কার্যকলাপে এর প্রমান রয়েছে। আমরা প্রতিনিধিত্ব করেছি সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী পূর্ব বাংলার জনগণ ও প্রগতিশীলদের।
আমাদের ক্ষুদ্র সংগঠন, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, কর্মীস্বল্পতা, অনভিজ্ঞতা নিয়েও যেখানে আমরা কাজ করেছি সেখানেই কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, দেশপ্রেমিক জনগণের সমর্থন পেয়েছি।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হামলার ফলে আওয়ামী লীগ পঁচিশে মার্চের পর সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে ও পূর্ব বাংলার জনগণকে সংগ্রামে নেতৃত্ব দানে নিজের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। পূর্ব বাংলার জনগণের এই দুর্দিনে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন অতি অল্প সময়ের মাঝেই পাঁচটিরও বেশী জেলায় আটটিরও বেশী গেরিলা ফ্রন্ট গড়ে তােলে, বিস্তৃত অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে জাতীয় প্রশ্নে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করে।
আওয়ামী লীগ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সশস্ত্র হয় এবং প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে। তারা পূর্ব বাংলার সত্যিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্মূল করার কাজকে প্রধান বলে গ্রহণ করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি মুক্তি বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের শ্রেণী বিশ্লেষণ করে, এদেরকে ছয় পাহাড়ের দালাল হিসেবে সঠিকভাবে তুলে ধরে, “আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের প্রসঙ্গে আমাদের নীতি”, “দেশপ্রেমিকের বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল” শীর্ষক দলিলে; এতে আরাে তুলে ধরে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট এবং ছয় পাহাড়ের দালাল উভয়কে বিরােধিতা করার সঠিক নীতি।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার নামে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, পূর্ব বাংলা দখল করে, একে তার উপনিবেশে পরিণত করে।
পৃষ্ঠা: ১৬৯
মহান গণচীনের নেতৃত্বে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য ন্যায়পরায়ণ দেশ ও জাতি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উস্কানিতে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পাকিস্তান আক্রমণ ও পূর্ব বাংলা দখলের বিরােধিতা করে। ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও দখলের ফলে আমাদের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব বাংলার জনগণের মহান সংগ্রাম ব্যাহত হয়।
পূর্ব বাংলায় ভারতীয় দখল কায়েম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার রণনীতি ও রণকৌশল, অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন, বর্তমান করণীয়’, ‘খােলা চিঠি’র মাধ্যমে যথাযথভাবে তুলে ধরে।
পূর্ব বাংলার বর্তমান সামাজিক অবস্থায় মণি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলার পরাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে আওয়ামী লীগ, সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বত্তি করছে।
আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিভক্ত পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল নয়া সংশােধনবাদী হক-তােয়াহা পূর্ব বাংলাকে সােভিয়েটের উপনিবেশ, সােভিয়েটের সাথে পূর্ব বাংলার দ্বন্দ্ব। প্রধান বলে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করে পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের সর্বহারা ও জনগণকে প্রতারিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদীরা অতিমাত্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। তারা মার্কসবাদীলেনিনবাদী নামধারী বুর্জোয়া উপদল গঠন করে এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা হক-তােয়াহাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
দেবেন-বাসার, কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারীরা মার্কসবাদের নামাবলী গায় দিয়ে পূর্ব বাংলার জ্যোতি বসু-নামুদ্রিপদের ভূমিকা পালন করছে, চীনের বিরােধিতা করছে এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের দালালী করছে।
পূর্ব বাংলার বর্তমান জাতীয় সংগ্রামে আমাদের বিশেষ শক্তিশালী কোন বুর্জোয়া প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক অংশ পূর্ব বাংলার সাথে ভারতের জাতীয় দ্বন্দ্বের এবং মুসলিম ও হিন্দু জনগণের মধ্যকার অবৈরী ধর্মীয় দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে পূর্ব বাংলায় একটা প্রতিবিপ্লবী জাতীয় ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে। (পূর্বের তুলনায় এ ধরনের প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র খুব দুর্বল হবে)। এ ধরনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। অতএব আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে জাতীয় পতাকা উর্ধে তুলে ধরে ব্যাপক জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং জনতার নেতৃত্ব অর্জন করে পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে।
সামরিক
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বিপ্লবী অনুশীলনের মাধ্যমে সামরিক ক্ষেত্রে বহু মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছে যে “জনগণের সেনাবাহিনী ব্যতীত জনগণের কিছুই নেই”, “রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্দুকের নলের মধ্য দিয়েই জন্মলাভ করে”,“সশস্ত্র সংগ্রাম হচ্ছে বিপ্লবের সর্বোচ্চ রূপ”, “সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভীকরণ সম্ভব”, “সশস্ত্র বাহিনী হচ্ছে পার্টির অধীন প্রধান ধরনের গণসংগঠন।”
পৃষ্ঠা: ১৭০
শ্রমিক আন্দোলন আরাে উপলব্ধি করে যে, “গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণকে জাগরিত, সংগঠিত ও জনগণের শক্তিকে শক্রর বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করা যায়।”
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া ও তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধে পরিচালনার জন্য টেকনাফ যায়। এর কারণ ছিল পাহাড়-জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ সুবিধাজনক-এ ধারণা। কিন্তু কিভাবে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা যায় সে সম্পর্কে সঠিক অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাদের কর্মীরা পাহাড়-জঙ্গলে ভ্রষ্ট সশস্ত্র দলকে রাজনীতিতে শিক্ষা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করার ভুল পদক্ষেপ নেয়।
পরবর্তীকালে পার্টি ভারত ও ভিয়েতনামের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব। এই সঠিক রাজনীতি থেকে নির্ণীত হয় গ্রাম্য এলাকায় কৃষকের শ্রেণী-শত্রুর একাংশ, যারা জাতীয় শত্ৰু-সরকারের চোখ ও কানদের খতম করার মাধ্যমে অর্থাৎ জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করার সঠিক সামরিক লাইন। এই প্রকার গেরিলা যুদ্ধ নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে দেশীয় অস্ত্র দ্বারা শুরু করা যায়।
আমাদের কর্মীরা শহর ও গ্রামে গেরিলা গ্রুপ গঠন শুরু করে, অতি অল্প সময়ের মাঝেই পাকিস্তান কাউন্সিল, মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে দেশীয় বােমা বর্ষণ করে। এর ফলে জনগণকে জাগরিত করা, তাদেরকে সংগঠিত করা, কর্মীদের পােড় খাওয়ানাে সম্ভব হয়, শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে বিকাশ থেকে পার্টি সংগ্রামের মাধ্যমে বিকাশের পথে প্রবেশ করে। এ হামলাকে নিয়মতান্ত্রিক পথে কার্যরত সংকীর্ণ ট্রেড ইউনিয়নপন্থী আরাম-আয়েশের সাথে বিপ্লব করার মােহগ্রস্ত ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা ও গােড়ামীবাদীরা বাম বিচ্যুতি বলে অভিযােগ করে।
আমাদের কর্মীরা চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চা বাগানের শ্রমিক ও স্থানীয় কৃষকদের গেরিলা গ্রুপে সংগঠিত করে এবং প্রথম জাতীয় শত্রু হারু বাবুকে হামলা করে। স্থানীয়। গেরিলাদের দিয়ে হারু বাবুর উপর অপারেশন করার সুযােগের সদ্ব্যবহার না করে আমাদের বুদ্ধিজীবী কর্মী ও গেরিলা এ হামলা করে। তবুও এ হামলা জনগণের ইচ্ছা ও উদ্যোগের বিরুদ্ধে ছিল না। এ কারণে ইহা বাম বিচ্যুতি হয়নি। হারু বাবুর হামলায় জনগণ খুবই জাগরিত হয়। তারা ব্যাপক সমর্থন দেয়, জনগণ ব্যাপক হারে সংগঠিত হতে থাকে। শত্রুর প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও আমাদের কাজ চলতে থাকে।
ফটিকছড়িতে অপর এক জাতীয় শত্রুকে আমাদের একজন কর্মী ও স্থানীয় গেরিলারা দেশীয় অস্ত্র দ্বারা খতম করে। পঁচিশে মার্চের পর সেখানকার সকল শ্রমিক ভারতে আশ্রয় নেয়। ফলে তাদের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়।
ঢাকায় আমাদের কর্মীরা বি.এন.আর১ হামলার মাধ্যমে ব্যাপক গণসমর্থন অর্জন করে।
আমাদের সংগঠন সর্বাধিক সামরিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে পঁচিশে মার্চের পর। পেয়ারা বাগানে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলা হয়, জাতীয় শত্রু খতম অভিযান চালানাে হয়, কয়েক শত জাতীয় শত্রু খতম করা হয়, জাতীয় শত্রু খতমের প্রক্রিয়ায় ®
…………………………………………………………………….
১. বি.এন.আর (B. N. R.)-ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকস্ট্রাকশন। এটা ছিল পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর। একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৭১
জনগণকে জাগরিত, সংগঠিত ও তাদের মাঝে ব্যাপক প্রচার সম্ভব হয়, অস্ত্র-অর্থ সংগৃহীত হয়। কয়েক লক্ষ লােক বসবাসকারী প্রায় আটচল্লিশটি গ্রামে পার্টি অস্থায়ী প্রকৃতির মুক্ত এলাকা গঠন করে। সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা, গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়, নিয়মিত বাহিনী, গ্রাম-রক্ষীবাহিনী, স্থানীয় গেরিলা গ্রুপ গঠন করা হয়, জনগণকে কৃষক মুক্তি সমিতি, নারী মুক্তি সমিতি প্রভৃতি গণসংগঠনে সংগঠিত করা, এদের মাঝে অগ্রসরদের নিয়ে সর্বহারা পার্টি ইউনিট এবং সামরিক বাহিনীতে পার্টি ইউনিট গঠন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত গেরিলা ইউনিট সাতজন সদস্য নিয়ে হয়। একজন পার্টি প্রতিনিধি যিনি রাজনৈতিক কমিশার নামে পরিচিত, কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার, দুইজন স্কাউট এবং দুই বা চার সদস্য নিয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ গঠন করা হয়। তিন থেকে পাঁচটি গেরিলা গ্রুপ নিয়ে একটি প্লাটুন, তিন থেকে পাঁচটি প্লাটুন নিয়ে একটি কোম্পানী গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্লাটুন কমান্ড গঠন করা হয় একজন রাজনৈতিক কমিশার, একজন কমান্ডার, দুইজন সহকারী কমান্ডার, তিনজন স্কাউট দ্বারা।
আমাদের মুক্ত এলাকার পার্টি, সামরিক সংগঠন, গণসংগঠন, রাজনৈতিক ক্ষমতার নেতৃস্থানীয় সংস্থা ছিল ১নং ফ্রন্ট এরিয়া কমিটি যা উচ্চতর নেতৃস্থানীয় সংস্থা ২নং ব্যুরাের অধীন ছিল।
এভাবে সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণকে যখন অসহায় রেখে ছয় পাহাড়ের দালালরা ভারতে পলায়ন করে, তখন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি জনগণের প্রতিরােধ সঠিক পথে পরিচালনা করে। “সব কিছুই বন্দুকের নলের মাধ্যমে গড়ে উঠে” -এ সত্য আমরা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রকাশ্য কাজের সাথে গােপন পার্টি-কাজ সমন্বিত করেনি অর্থাৎ গােপনে পার্টি-কাজ করার জন্য কিছুসংখ্যক কর্মী নিয়ােগ করেনি, জনগণের মাঝে পার্টি ইউনিট গড়ে তােলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু সময়াভাবে তা কার্যকর করা। হয়নি। সময়াভাব ও পার্টি কর্মীদের নিম্নমান ও অনভিজ্ঞতার কারণে সেনাবাহিনীতে মতাদর্শগত শিক্ষা ও পার্টি-কর্মী সংগ্রহের দিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
যাভাব, কর্মীদের সশস্ত্র সংগ্রামের অনভিজ্ঞতা এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের কারণে প্রথম থেকেই আমাদের কাজ হয়েছিল এরূপ বিভিন্ন স্থানে গেরিলা কম পাঠিয়ে ১নং ফ্রন্টের বিকল্প আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। একই কারণে যে সকল স্থানে হামলা হয়েছে সেখানে পার্টি-কাজ গড়ে তােলা, সহানুভূতিশীল, গােপন আশ্রয়স্থল তৈরী করা, ১নং ফ্রন্টের সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করার জন্য আশেপাশের শহর, বন্দর, বাজারসমূহে কাজ গড়ে তােলার পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে (…….)১ সম্মুখে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবুও ১নং ফ্রন্ট এরিয়া প্রচন্ড ঘেরাও-দমনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করলে ১নং ফ্রন্ট থেকে গেরিলা প্রত্যাহার না করেও টিকে থাকা সম্ভব ছিল।
১নং ফ্রন্ট এরিয়া থেকে আমাদের গেরিলাদের এক অংশ গৌরনদী অঞ্চলে সরে আসে। বাকীরা ১নং ফ্রন্টের আশেপাশে থেকে যায়।
গৌরনদী অঞ্চলে আমাদের কর্মী ও গেরিলারা বহু জাতীয় শত্রু খতম করে এবং পাতার হাট, মেহেদীগঞ্জ, উজিরপুর, ধামুরা, মুলাদী, বাবুগঞ্জ, হিজলা, বানারীপাড়া,
…………………………………………………………………….
এখানে মূল রচনায় কিছু শব্দ বা বাক্য ছিল যা পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়নি -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৭২
বামনা, গলাচিপা প্রভৃতি এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত করে; প্রায় দুইশত গেরিলা সংগৃহীত হয় এবং বিরাট এলাকা মুক্ত হয়।
১নং ফ্রন্ট এরিয়ার ঘেরাও-দমন উঠে গেলে আমাদের গেরিলারা গেরিলা যুদ্ধকে কাউখালি, রাজাপুর, স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি, বরিশাল সদর থানার বিস্তৃত এলাকায় সম্প্রসারিত করে। ইতিমধ্যে পাঁচজন গেরিলা বরিশালের দক্ষিণাংশে মঠবাড়িয়া অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ বিস্তৃত করে, অচিরেই পাথরঘাটা, খেপুপাড়ায় গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়। পাঁচজন থেকে আমাদের গেরিলা সংখ্যা কয়েক শতে পৌঁছে এবং পাঁচটি রাইফেল থেকে আশিটি রাইফেল ও বন্দুক সংগৃহীত হয়।
১নং ফ্রন্টের মুজিব-তারেকের মাঝে সমরবাদ দেখা দেয়, ফলে ১নং ফ্রন্টের কাজ বিঘ্নিত হয়। তারেক-মুজিবকে প্রথমে সকল পদ থেকে সরিয়ে প্রকাশ্যে নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আহ্বায়ক কমিটি কর্তৃক তদন্তের ভিত্তিতে সংগঠন থেকে চিরদিনের জন্য এ সকল অধঃপতিত ব্যক্তিদেরকে বহিষ্কার করা হয় এবং নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানানাে হয়।
ইতিমধ্যে ভােলায় আমাদের কর্মীরা নিজস্ব উদ্যোগে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করে এবং বহু জাতীয় শত্রু খতম করে ও অস্ত্র সংগ্রহ করে।
ফরিদপুর জেলায় মাদারীপুর মহকুমায় আমাদের গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়, জাতীয় শত্রু খতম হয়, অস্ত্র ও গেরিলা সংগৃহীত হয়।
ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জে গেরিলা যুদ্ধ বিস্তৃত হয়। সাভার এলাকা, নরসিংদী এলাকার গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়। সাভার এলাকায় অস্ত্র ছাড়াই গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করে শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশটিরও বেশী বন্দুক ও রাইফেল সংগৃহীত হয়। নরসিংদী এলাকায়। একইভাবে বহু অস্ত্র সংগৃহীত হয়।
টাঙ্গাইল-পাবনা জেলায় আমাদের কর্মীরা গেরিলা যুদ্ধ সম্প্রসারিত করে এবং বিরাট অঞ্চল শত্রুমুক্ত করে এবং বহু অস্ত্র ও গেরিলা সংগৃহীত হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম হয়।
এভাবে পূর্ব বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে বহু জাতীয় শত্রু, পাক-সামরিক দস্যু, রাজাকার, আল-বদর খতম করা হয়। অস্থায়ী প্রকৃতির বহু মুক্ত এলাকা গড়ে উঠে, এ সকল মুক্ত অঞ্চলের অনেক স্থানেই ভূমিহীন কৃষকের মাঝে জাতীয় শত্রুর ভূমি বিতরণ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতীয় শত্রু সঠিকভাবে খতম হয়। কর্মীদের অনভিজ্ঞতার কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে এক-আধটি ভুল হয়ে থাকতে পারে।
পাবনা-টাঙ্গাইলে মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কি-চেবাদীরা শ্রেণী শত্রু খতমের নাম করে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল হিসেবে জনগণের বাড়ীতে ডাকাতি, তাদের হত্যা শুরু করে। জনগণ তাদেরকে ডাকাত বলে আখ্যায়িত করে। ব্যাপক এলাকায় জনগণ তাদেরকে প্রতিরােধের জন্য নিজেরাই উদ্যোগ নেয়, তাদের পাঁচজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ এলাকায় জনগণের আহ্বানে বাধ্য হয়ে আমাদের গেরিলারা মতিনআলাউদ্দিনের দস্যুদলকে জনগণের সহায়তায় আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত তারা এলাকা ছেড়ে পলায়ন করে।
পঁচিশে মার্চের পর আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযােগীরা ভারতে আশ্রয় নেয়। পূর্ব বাংলায় তাদের সংগঠন ভেঙ্গে পড়ে। এ সময় এদের বহু কর্মী, সমর্থক এবং ই.পি.আর, পুলিশ, আনসার, বেঙ্গল রেজিমেন্টের লােক আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
পৃষ্ঠা: ১৭৩
আওয়ামী লীগ ও তার সহযােগীরা ভারতে যেয়ে পুনরায় মিলিত হয় এবং ভারতের তাবেদারে রূপান্তরিত হয়। তারা ‘নসাল খতম’ অভিযান চালিয়ে ভারতের উপনিবেশ স্থাপনে রাজী হবে না এরূপ আমাদেরসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের খতম করার নীতি গ্রহণ করে।
আমাদের কর্মীরা আওয়ামী লীগ, মতিয়া গ্রুপ, মস্কো ন্যাপ ও তাদের সহযােগীদের ছয় পাহাড়ের দালালে পরিণত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সম্পর্কে আমাদের নীতি পাল্টাতে এবং নিজেদের মধ্যকার পার্টি-বহির্ভূত গেরিলাদের সম্পর্কে, পার্টি-বহির্ভূত গেরিলা সংগ্রহ করা সম্পর্কে, জনগণের মধ্যকার কাজের পদ্ধতি সম্পর্কিত নীতি পাল্টাতে ব্যর্থ হয়।
গেরিলারা প্রধানতঃ ক্ষেত মজুর, গরীব চাষীদের মধ্য থেকে সংগ্রহ না করে বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, তাদের মাঝে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক শিক্ষা চালিয়ে সমস্ত গেরিলাদের পার্টি-কর্মী বা সহানুভূতিশীলে রূপান্তরিত করা হয়নি, পার্টিকর্মী বা সহানুভূতিশীল নয় এরূপ বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রহ বন্ধ করা হয়নি (এরাই অনেকে পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং আমাদের গেরিলাদের ধরিয়ে দেয়, নিরস্ত্র করে এবং খতম করে ছয় পাহাড়ের দালালের উস্কানিতে); কর্মী ও গেরিলারা ছয় পাহাড়ের দালালদের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়, জনগণের সাথে যথাযথভাবে যুক্ত হয়নি, তাদের মাঝে গােপনে কাজ করেনি।
যে সকল স্থানে ব্যাপক জনগণ আমাদের সমর্থক ছিল আমাদের কর্মী ও গেরিলারা গােপনে থেকে সে সকল স্থানের জনগণকে প্রকাশ্য গণসংগ্রামে লাগায়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রের ও লােকসংখ্যার তুলনা করেই আমাদের কর্মীরা এলাকা পরিত্যাগ করে।
জনগণের মাঝে গােপনে পার্টি গড়ে না তােলা, সহানুভূতিশীল, আশ্রয়স্থল তৈরী না করা; গােপন কাজের জন্য কর্মী নিয়ােগ না করে সকলেই প্রকাশ্যে কাজ করা ও প্রকাশ হয়ে পড়া এবং উপরােক্ত কারণসমূহের জন্য ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের হামলার ফলে আমাদের সকল মুক্ত অঞ্চল হারাতে হয়, বহু কর্মী প্রাণ হারায়, বহু অস্ত্র হারাতে হয়।
এ সময় কিছুসংখ্যক কর্মী যারা এ জটিল অবস্থায় তাদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, তারা বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করা, সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করা, গ্রামে গেরিলা যুদ্ধ করা যাবে না প্রভৃতি হতাশাব্যঞ্জক দক্ষিণপন্থী মতামত ব্যক্ত করে। এগুলাে হচ্ছে। ঝড় উঠলে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবীদের শ্রমিক-কৃষকের থেকে উল্টো ভূমিকার প্রকাশ। পার্টি সময়মত বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে কয়েকটি দলিলের (১নং ও ২নং) মাধ্যমে এ সকল মতামতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং যে কোন অবস্থায় শ্রমিক-কৃষকের উপর নির্ভর করে, তাদের সাথে যুক্ত হয়ে, নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে গেরিলা যুদ্ধের বস্তুগত নিয়ম অনুযায়ী চলার নীতি তুলে ধরে।
বর্তমানে ছয় পাহাড়ের দালালদের বিরুদ্ধে জাতীয় ও শ্রেণী ঘৃণা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে হবে, অতীতের ভুলত্রুটি-সীমাবদ্ধতাকে অবশ্যই দূর করে সঠিকতা ও সাফল্যকে অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হবে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হবে ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ,সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে। আমাদের নেতৃত্বে অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে। প্রায় শূন্য থেকে বিকাশ
পৃষ্ঠা: ১৭৪
গােপনভাবে কৃষকদের উপর নির্ভর করে দেশীয় অস্ত্রের দ্বারা জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করা, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করা, গেরিলা ও পার্টি-কর্মী সংগ্রহ করা, জনগণের মাঝে প্রচার করা, জনগণকে সংগঠিত করা, নিজেদেরকে পােড় খাওয়ানাে ও শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা যায় এবং তা সম্ভব।
ভৌগােলিক অবস্থা নির্বিশেষে পার্টির মূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার। সর্বত্র গেরিলা যুদ্ধের বিকাশ ঘটাতে হবে, সশস্ত্র সংগ্রামে লেগে থাকতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দিয়ে পার্টি বিকাশের সকল প্রকার সুবিধাবাদী চিন্তাধারাকে দূর করতে হবে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভিকরণ অর্জন করতে হবে। প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
সাংগঠনিক
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার সময় কমরেডদের মার্কসবাদী পার্টি গঠনের কাজের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু অনভিজ্ঞতা আমাদেরকে ভীত করতে পারেনি। আমরা অনুশীলনে লেগে থাকি এবং অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টিসংগঠন পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করি।
বর্তমানে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির শৃঙ্খলা উন্নত, পার্টির মাঝে একটি সুদৃঢ় কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের অটুট ও দৃঢ় আস্থা রয়েছে; কর্মীরা শৃঙ্খলা, গােপনীয়তা, সাংগঠনিক এককসমূহ পরিচালনা ও তার দায়িত্ব সম্পর্কে মােটামুটি অবগত হয়েছেন।
কিন্তু এখনও কর্মীরা জনগণ থেকে আসা, জনগণের নিকট নিয়ে যাওয়ার কর্মপদ্ধতি, পার্টি-কমিটি সুচারুরূপে পরিচালনা, অধীনস্থ কর্মীদের পরিচালনা, প্রকাশ্য গণসংগ্রামে জনগণকে চালিত করার বিষয়ে দক্ষ নন।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার সাংগঠনিক কাজে বস্তুর দ্বান্দ্বিক গতির নিয়ম বজায় রেখেছে, পুরানাে কর্মীদের তুলনায় যােগ্য নতুন কর্মীদের পুরানাে কর্মীদের স্থানে দায়িত্ব দিয়েছে, বাসীটা বর্জন করে টাকটাকা গ্রহণ করেছে, যার ফলে সংগঠন প্রাণবন্ত রয়েছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে উপদলবাদ, পার্টির অভ্যন্তরে বিভেদপন্থীবাদের উদাহরণ খুবই কম। পক্ষান্তরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী সংগঠনগুলাে বিভেদপন্থীবাদ ও উপদলবাদের ফলে ছিন্ন ভিন্ন।
সঠিক রাজনীতি পার্টির মধ্যে লৌহ-কঠিন শৃঙ্খলা এবং এক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। সংশােধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র ও কপটতা তাদের মধ্যকার অনৈক্যের জন্য দায়ী।
পৃষ্ঠা: ১৭৫
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে বরিশাল জেলায় বিভেদপন্থীবাদের উদ্ভব হয়। সেখানে ছাত্র পরিচালনা গ্রুপের সাথে শ্রমিক পরিচালনা গ্রুপের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয় এবং সংগঠন প্রায় বিভক্ত হয়ে যায়। বরিশাল জেলা নেতৃত্বের মতাদর্শগত কাজ পরিচালনায় অক্ষমতা, নিজেদেরকে দুই দলের একটার সাথে জড়িয়ে ফেলা প্রভৃতির ফলে ইহা প্রকট আকার ধারণ করে।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ অবস্থা তদারক করতে যায় এবং সাংগঠনিক বিষয় সব কিছু ঠিক করার পূর্বে মতাদর্শগতভাবে সব কিছু ঠিক করার জন্যে পাঁচটি প্রবন্ধ বিশেষ করে ভুল চিন্তাধারার সংশােধন এবং কতগুলাে দলিল (লাল ঝাণ্ডা১ ২নং-এ সংযােজিত হয়েছে) পড়ায় এবং দ্বন্দ্বের সমাধান করে।
ময়মনসিংহের হাজিপুরে ভাগ্যান্বেষী, নেতৃত্ব লােভী, বিশ্বাসঘাতক সাদিক, দলত্যাগী আসাদ ও তার ভাই, হটকারী-সমরবাদী বেবীর সাথে যুক্ত হয়ে একটি চক্র গঠন করে এবং ‘পার্টি সঠিক কিন্তু নেতৃত্ব খারাপ’ এ অভিযােগ উত্থাপন করে নিজেদেরকে পার্টিকর্তা বলে জাহির করে এবং সেখানকার কর্মীদেরকে ডাকাতি, পার্টি ও জনগণ বিরােধী কাজে প্ররােচিত করার প্রচেষ্টা চালায়। সাচ্চা পার্টি-কর্মী ও জনগণ তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয় এবং তাদেরকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে। শেষ পর্যন্ত তারা ছয় পাহাড়ের দালালে পরিণত হয়। এর ফলে স্থানীয় পার্টি-কাজে মারাত্মক ক্ষতি হয়।
পার্টির অভ্যন্তরে সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতির উৎস হলাে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ। কাজেই সাংগঠনিকভাবে সকল প্রকার অসুস্থতা দূর করতে হলে অবশ্যই কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সর্বহারার মতাদর্শের প্রকাশ রপ্ত করতে হবে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি সর্বদাই সংগঠনের অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে সাংগঠনিক ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ঐক্যকে, নীতিহীন বাহ্যিক ঐক্যকে নয়। নীতিকে বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদের সাথে আপােষ করে ঐক্যের অর্থ হলাে নিজেরাই সুবিধাবাদী হওয়া।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মার্কসবাদী নামধারী বুর্জোয়া উপদলের সাথে আমাদের ঐক্য ফ্রন্ট, যৌথ এ্যাকশন, সমন্বয় করার প্রশ্ন এসেছে। আমরা উপদলের অস্তিত্বকে দৃঢ়ভাবে বিরােধিতা করেছি, উপদলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম করেছি, একই সময় এ সকল উপদলস্থ বা বিচ্ছিন্ন সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যের জন্য প্রকাশ্য আহ্বান জানাই এবং দেবেনবাসারদের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হই।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন বিকাশের সাথে সাথে সংগঠন যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংবিধান অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করে, বিশেষ করে গত চার বছরের অভিজ্ঞতার আলােকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান সংবিধান লিপিবদ্ধ হয়েছে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের ও ছয় পাহাড়ের দালালদের চরম নির্যাতনের সময় পার্টি-কর্মীরা সকল প্রকার নির্যাতন এমন কি মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে সাংগঠনিক কার্য চালায়, বিভিন্ন দলিল প্রকাশ করে, বিভিন্ন স্তর ও জনগণের নিকট তা পৌঁছে দেয়, বিভিন্ন স্তরের সাথে যােগাযােগ বজায় রাখে। এ সময় অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টি ও
…………………………………………………………………….
১. পার্টির তৎকালীন তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক পত্রিকা প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৭৬
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা কোন প্রকার সাংগঠনিক তৎপরতা কেন্দ্রীভূতভাবে চালাতে সক্ষম হয়নি। ইহা আমাদের বিরাট সফলতা ও শক্তির পরিচায়ক।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে মতাদর্শগত শিক্ষা জোরদার করতে হবে, সর্বস্তরে শৃঙ্খলা ও নেতৃত্ব জোরদার করতে হবে, সঠিকভাবে নেতৃত্বের পদ্ধতি প্রয়ােগ করতে হবে। গুজব রটনা করা, ষড়যন্ত্র করা, নির্দেশ অমান্য করা, শৃঙ্খলাকে অবহেলা করা, নেতৃত্বকে দুর্বল। করা পরিহার করতে হবে। সভাপতি মাওয়ের সাংগঠনিক লাইন দৃঢ়ভাবে প্রয়ােগ করে সর্বস্তরের সংগঠনকে সংগ্রামের দূর্গে রূপান্তরিত করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান সংবিধান আমাদের অভিজ্ঞতার আলােকে রচিত। আপনারা এ সংবিধান পর্যালােচনা করবেন ও অনুমােদন করবেন।
মতাদর্শগত
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অধিকাংশ কর্মীই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকাংশই ক্ষুদে বুর্জোয়া। পার্টি এদের দ্বারা পরিবেষ্টিত।
কাজেই মতাদর্শগত ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের অসর্বহারা মতাদর্শ দূর করে সর্বহারা শ্রেণীর মতাদর্শ গ্রহণ করানাে, তাদের মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠনই হচ্ছে সংগঠনের প্রধান সমস্যা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন ও সর্বহারার বিশ্বদৃষ্টিকোণ অর্জনের জন্য অভিজ্ঞতার সারসংকলনের মাধ্যমে প্রণয়ন করেছে নিম্নলিখিত সঠিক পদ্ধতিঃ
সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করা; কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া; বিপ্লবী ঝড়তরঙ্গে পােড় খাওয়া।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি মতাদর্শগত পুনর্গঠনের জন্য তিনটি প্রবন্ধ, পার্টির মধ্যকার ভুল চিন্তাধারার সংশােধন, উদারতাবাদ। বিরােধিতাকে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বদা পাঠ ও প্রয়ােগ করার রীতি সৃষ্টির জন্য বলে। আসছে। মতাদর্শগত পুনর্গঠনে সাফল্য অর্জনের জন্য পার্টি ২নং লাল ঝাণ্ডা প্রণয়ন করেছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মতাদর্শগত পুনর্গঠনে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া ও বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পােড় খাওয়ার তাৎপর্য যথার্থভাবে উপলব্ধি করেনি। কিছু মার্কসবাদী পুস্তক পাঠ, তত্ত্ব ও উদ্ধৃতি আওড়ানাে, শ্রমিক বা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে পাঠচক্র বা গ্রুপ গঠন ও পরিচালনা করতে পারলেই তাকে উন্নত কর্মী বলা হতাে।
সংগঠনে অধিক সংখ্যায় বুদ্ধিজীবীদের আগমন, তথাকথিত তত্ত্বগত উন্নত কর্মীদের কার্যকলাপ প্রমাণ করছে মতাদর্শগত পুনর্গঠনে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া, বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পােড় খাওয়ার প্রকৃত তাৎপর্য আমরা উপলব্ধি করিনি।
আমাদের সংগঠনে বহু কর্মী রয়েছেন যারা তত্ত্ব জানেন কিন্তু অনুশীলনের সাথে সে তত্ত্ব সংযুক্ত নয়। তারা বাস্তব থেকে শুরু না করে শুরু করেন তত্ত্ব থেকে।
কর্মীদের বড় বড় বই, তত্ত্ব পড়ার ঝোক, কিন্তু প্রয়ােগ করতে অক্ষমতা বাস্তব বিবর্জিত তত্ত্বগত বিবাদের জন্ম দেয়। বুর্জোয়া সমাজের প্রয়ােগ বিবর্জিত বােকা বানাবার শিক্ষার পদ্ধতির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে অনুশীলনের সাথে যুক্ত না করে তত্ত্ব পড়া। ইহা বিপ্লবী তত্ত্ব অধ্যয়নে প্রয়ােগ করলে তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে গােড়ামীবাদ।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী সংগ্রামের জটিল সংগ্রামে এই সকল বুলি শেখা কমরেডদের ভূমিকা কৃষক-শ্রমিকের থেকে সম্পূর্ণ উল্টো হয়, তারা হন অস্পষ্ট, দোদুল্যমান। পক্ষান্তরে শ্রমিক শ্রেণী হল দৃঢ়, স্পষ্ট।
পৃষ্ঠা: ১৭৭
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মাঝে কিছু কর্মী রয়েছেন যারা বাস্তব কাজ করেছেন কিন্তু নিজেদের সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, অভিজ্ঞতাকে তত্ত্বের সাথে সমন্বিত করে প্রতিনিয়ত নিজেদের মান ও কর্মদক্ষতা উন্নত করেন না। এরা হচ্ছেন সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী। এরা সহজেই গােড়ামীবাদীদের লেজুড়বৃত্তি করেন।
গােড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের মাঝে বর্তমানে গােড়ামীবাদ পার্টির মধ্যকার প্রধান বিপদ।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অবশ্যই গােড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ দূর করার জন্য গােড়ামীবাদী কর্মীদের অনুশীলনে প্রেরণ করতে হবে, বিশেষ করে শ্রমিক কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া, তাদের মাঝে কাজ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদেরকে মনােযােগের সাথে তত্ত্বগত পড়াশুনা ও পর্যালােচনা করতে হবে।
মতাদর্শগত ফ্রন্টে সকল কর্মীকে কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত করা, তাদের সাথে সর্বক্ষণ বা আংশিক শ্রমে অংশগ্রহণ করা এবং শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে পােড় খাওয়ার দৃঢ় পদক্ষেপের ব্যবস্থা করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সকল পার্টি-কর্মীদেরকে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শ্রমিক-কৃষক কর্মীদের বাড়ীতে থাকা, উৎপাদনে অংশগ্রহণ করা, তাদের মাঝে কাজ করা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা পার্টির একটা নিয়ম হওয়া উচিত। অন্যথায় তাদেরকে পার্টি সদস্যপদ প্রদান করা উচিত নয়।
এভাবে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পার্টির সংশােধনবাদী বা ক্ষুদে বুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত হওয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হবে।
মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পার্টির আভ্যন্তরীণ ও বাইরের বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও তার প্রকাশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হবে। তাদের মুখােশ উন্মােচন করতে হবে, তাদের সাথে আমাদের সংগ্রামকে আঁকড়ে ধরতে হবে।
আন্তর্জাতিক
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ১৯৬৮ সালে তার থিসিসে বর্তমান বিশ্বের বিকাশের জন্য মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহ নিম্নরূপ বলে উল্লেখ করেছে।
১। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশ ও জাতিসমূহের দ্বন্দ্ব।
২। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের শাসকগােষ্ঠীর সাথে নিজেদের দেশের জনগণের দ্বন্দ্ব।
৩। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের নিজেদের মধ্যকার এবং সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের দ্বন্দ্ব।
পৃষ্ঠা: ১৭৮
৪. সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহের দ্বন্দ্ব।
উপরোক্ত দ্বন্দ্বসমূহের বিকাশের কারণেই বর্তমান পৃথিবী এগিয়ে চলেছে।
সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণ তাদের সংগ্রাম অধিকতর জোরদার করছে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি দেশের জনগনের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করেছে।
খােদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও কালাে অধিবাসীদের সংগ্রাম প্রচণ্ড রূপ গ্রহণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সােভিয়েট জনগণ এবং বিভিন্ন জাতি সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করছে। সােভিযেট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার রাষ্ট্রসমূহের সাথে সােভিয়েটের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে।
তাবেদারদের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াকে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করছে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতে তার নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে। পূর্ব বাংলায় তার নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে ভারতকে উস্কে দেয় পূর্ব বাংলা দখল করার জন্য। তারা এখানকার কাঁচামাল, সস্তা শ্রমশক্তি দখল করা, ভারত মহাসাগরে প্রভুত্ব স্থাপন। এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বৃটিশের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় নিজেদের প্রভাব স্থাপন ও দখল করার জন্য এ জঘন্য কাজ করে।
এ উদ্দেশ্যে তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সাথে যৌথ সামরিক জোট গঠন করেছে, নৌবহর প্রেরণ করছে। তাদের কার্যকলাপ পুরানাে জারদেরই অনুরূপ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারত ও বঙ্গোপসাগরে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সােভিয়েট সামাজিক সামাজ্যবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌবহর প্রেরণ করে।
বর্তমান বিশ্বে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বর্তমান, কিন্তু বিপ্লব হচ্ছে প্রধান প্রবণতা।
মহান গণচীন ও এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী দেশ ও রাষ্ট্রসমূহ পূর্ব বাংলার বিষয়ে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করে এবং পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নের সমাধান পূর্ব বাংলার জনগণ ও পাকিস্তান সরকারের হাতে ন্যস্ত করার দাবী জানিয়ে। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মহান গণচীন পূর্ব বাংলার প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ করে ফেলে এবং তাদের মুখােশ উন্মােচিত করে।
সভাপতি মাও-এর বৈদেশিক নীতির সাফল্যের ফলে চীন জাতিসংঘে তার ন্যায্য ভূমিকা অর্জন করেছে, নীতিতে অটল থেকে বিশ্ববিপ্লবকে অধিকতর সহায়তা করেছে। মহান গণচীনের নেতৃত্বে বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী, বিপ্লবী জনগণ, নিপীড়িত জাতি ও রাষ্ট্রসমূহ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ১৭৯
মহান গণচীন পূর্ব বাঙলায় ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপন ও তাদের তাবেদারদের পুতুর সরকারকে সমর্থন ও স্বীকৃতি জানায়নি। পরন্তু সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের মহান সংগ্রাম সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিপ্লবে বিরাট সাহায্য করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ অবশ্যই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণের হস্তক্ষেপ, প্রভাব কায়েমের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দৃঢ়ভাবে বিরােধিতা করবেন, নিজেদের ঐক্যকে দৃঢ় করে নিজেদের মুক্ত করবেন।
উপসংহার
কমরেডগণ,
পূর্ব বাংলার সমাজের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল সর্বদাই অনুশীলনের অগ্নিপরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রধান ধরনের সংগ্রাম এবং সশস্ত্র সংগঠনকে প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলার দিকে মনােনিবেশ করেছি।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আমরা প্রয়ােগ করেছি সঠিকভাবে মার্কসবাদী সাংগঠনিক লাইন। সঠিক রাজনীতি ও সামরিক লাইনে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামে লেগে থাকার ফলেই পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভীকরণ অর্জিত হয়েছে।
মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী কর্মীদের পুনর্গঠনের জন্য শ্রমিক-কৃষকদের সাথে একীভূত হওয়া, দৈহিক শ্রমে অংশগ্রহণ করা, তাদের কাছ থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করে মতাদর্শগত পুনর্গঠনের ধারণা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।
আমাদের এ সকল সাফল্যের কারণেই সংগঠন অল্পসংখ্যক কর্মী থেকে বিকাশ লাভ করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের মুখেও একমাত্র আমাদের সংগঠন টিকে
(পূর্ণাঙ্গ নয়)১
…………………………………………………………………….
১. রিপাের্টটির শেষের দিকের কিছু অংশ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বিধায় অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ছাপানাে
হলাে -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ১৮০
ইন্দিরা গান্ধী জবাব দেবেন কি?
(মার্চ, ১৯৭২)
[১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদেশ সফরে আসেন। এই প্রচারপত্রটি তখন রচনা ও প্রচার করা হয় প্রকাশক।]
১। আপনার সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনী। কিন্তু মিত্র বাহিনী কিভাবে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের কয়েকশত কোটি টাকার অস্ত্র-যুদ্ধ সরঞ্জাম ভারতে নিয়ে গেল, পূর্ব বাংলার বহু কলকারখানা, তার খুচরাে অংশ, গাড়ী, উৎপাদিত পণ্য, পাট, চা, চামড়া, স্বর্ণ, রৌপ্য ভারতে পাচার করল?
আপনি আপনার দখলদার বাহিনী প্রত্যাহার করার কথা বলে জনগণকে ভাওতা দিচ্ছেন। আপনার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলাে বাঙালীদের দ্বারা আপনার উপনিবেশ পাহারা দেওয়া, বাঙালীদের দমন করা। এছাড়া অসংখ্য ভারতীয় দখলদার সৈন্য আপনি সাদা পােশাকে এবং বাংলাদেশ বাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলের ইউনিফর্মে পূর্ব বাংলায় রেখেছেন। আপনার সৈন্য প্রত্যাহারের কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
২। আপনি নিজেকে মুক্তি সংগ্রামের বন্ধু বলে জাহির করেন। কিন্তু নাগা, মিজো, কাশ্মিরী, শিখদের মুক্তি সংগ্রামকে কেন ফ্যাসিবাদী উপায়ে দমন করছেন?
ইহা কি প্রমাণ করে না আপনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সহায়তার বেশ ধরেছেন? এ উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলায় আপনার উপনিবেশ স্থাপন, আপনার হারানাে পশ্চাভূমি পুনরুদ্ধার, পূর্ব বাংলা শােষণ ও লুণ্ঠন করে আপনার আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট হ্রাস করা, চীন ও কমিউনিজম প্রতিহত করার ঘাঁটি স্থাপন করা।
৩। আপনি মিত্রের বেশে পূর্ব বাংলার মাছ-মাংস-ডিম-তরকারী-ধান-চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য, পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য কাঁচামাল, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রশাসন, দেশরক্ষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে শােষণ ও লুণ্ঠন করেছেন, পূর্ব বাংলায় আপনারা উপনিবেশ কায়েম করেছেন।
এ উপনিবেশ কায়েমের জন্য আপনি পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিকদের খােরাক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
যে সকল দেশপ্রেমিক বিশেষ করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মী যারা আপনার গােলাম হতে রাজী হয়নি তাদেরকে ‘নকশাল’ অভিহিত করে আপনি খতম করিয়েছেন। এভাবে পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিকদের রক্তে আপনি হাত কলঙ্কিত করেছেন।
এতদিন আপনি এ শােষণ ও লুণ্ঠন গােপন চুক্তির মাধ্যমে করেছেন। বর্তমানে ২৫ বৎসরের শান্তি, মৈত্রী ও সহযােগিতার চুক্তির নামে আপনার তাবেদার বাংলাদেশ পুতুল সরকার প্রকাশ্যে আপনাকে বাঙালী জাতির দাসখত লিখে দিয়েছে এবং আপনার শােষণ-লুণ্ঠনকে ন্যায়সঙ্গত করেছে।
আপনার ও আপনার তাবেদারদের শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলায় ৭০-৮০ টাকা মণ হয়েছে চাল, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য হয়েছে অগ্নিমূল্য। অনাহার-অর্ধাহার ও
পৃষ্ঠা: ১৮১
বেকারীর হাহাকার উঠেছে পূর্ব বাংলায়। পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। না খেয়ে লােক মরছে। পূর্ব বাংলার জন্য আপনার দরদ উছলে পড়ছে, চাল ও অন্যান্য সাহায্য দ্রব্য পূর্ব বাংলায় পাঠাবার কথা বলে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু কত গুণ বেশী লুটে নিচ্ছেন তা তাে বলেন না, এর ফলেই আজ ভারতে চাল ও খাদ্যদ্রব্যের দাম কমেছে।
এভাবে ভারতের অর্থনৈতিক সংকট আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে আপনি উদ্ধার পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
৪। আপনি গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু আপনার দেশে কি আপনি সামরিক বাহিনী, রিজার্ভ পুলিশ, পুলিশ, সশস্ত্র যুব কংগ্রেসের পাণ্ডাদের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসন চালাচ্ছেন না? নকশাল’ অভিহিত করে শত-সহস্র জনগণকে হত্যা করছেন, পাকসামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আপনার নির্যাতনের কোন পার্থক্য আছে কি?
৫। আপনি গলাবাজি করে বেড়ান আপনি ধর্ম নিরপেক্ষ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের তাবেদার কংগ্রেসস্থ হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার, জোতদার, পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবীরা যদি পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণের উপর রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন না চালাতাে তবে কি পূর্ব বাংলার জনগণ পৃথক ভূ-খণ্ড দাবী করতাে? তারা এ কারণেই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব সমর্থন করেছে।
১৯৪৭-এর পরে ভারতে মুসলিম বিরােধী কয়েক শত রায়ট হয়েছে। অবাঙালী মুসলমান, কলিকাতা, আসাম, ত্রিপুরার লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙালী মুসলমান জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদেরকে বলপূর্বক কপর্দকহীন অবস্থায় পূর্ব বাংলায় ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী যারা ১৯৪৭ সালে ভারতে গিয়েছিল তাদেরকে আপনি শরণার্থীর বেশে পূর্ব বাংলায় পাঠাচ্ছেন, আপনার পুতুল সরকারের মাধ্যমে তাদের ভূ-সম্পত্তি ফেরত দেওয়াচ্ছেন।
কিন্তু ভারত থেকে বিতাড়িত বিহারী এবং বাঙালী জনগণকে আপনি তাদের জন্মস্থান ভারতে ফেরত নিতে, তাদের সম্পত্তি ফেরত দিয়ে তাদেরকে পুনর্বাসন করতে। কেন রাজী হচ্ছেন না? আপনি আফ্রিকা, বার্মা, সিংহল থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ফেরত নিয়েছেন। কিন্তু ভারত থেকে বিতাড়িত বাঙালী মুসলমানদের ফেরত না নিয়ে আপনি কি প্রমাণ করছেন না যে, মুসলিম এই কারণে তাদেরকে ফেরত নিচ্ছেন না? ইহা প্রমাণ করে আপনি সাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ নন। আপনার ধর্মনিরপেক্ষতার বুলির উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলায় আপনার উপনিবেশ বজায় রাখার পথে মুসলিম ধর্মের বাধা দূর করা এবং ধর্মীয় নিপীড়ন চালানাে।
৬। আপনি ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গরিবী হটাও’ বুলি কপচাচ্ছেন। এটা কি জনগণকে ভাওতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু? সমাজতন্ত্রের নামে ভারতে চলছে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এই চার পাহাড়ের নির্মম শােষণ-লুণ্ঠন। এর ফলে জনগণ অকল্পনীয় খারাপ অবস্থায় পতিত হয়েছে।
আপনার ‘গরিবী হটাও’, ‘সমাজতন্ত্রের বুলির ভাওতা ঢাকার জন্য অন্য দেশ শােষণ ও লুণ্ঠন করে চরম অর্থনৈতিক সংকট কাটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
অতীতে জাপানী ফ্যাসিস্টরা এশিয়াসহ উন্নত অঞ্চলের বুলিকে এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের দখলকৃত এলাকায় তথাকথিত স্বাধীন পুতুল সরকার বসায়।
আপনিও জাপানী ফ্যাসিস্টদের কবরে যাওয়ার পদচিহ্ন বেয়ে অগ্রসর হচ্ছেন,
পৃষ্ঠা: ১৮২
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আপনার সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করছেন।
পূর্ব বাংলার জাতীয় সমস্যার সুযােগ গ্রহণ করে পূর্ব বাংলায় ছয় পাহাড়ের দালাল মীরজাফরদের সহায়তায় পূর্ব বাংলা দখল করে এখানে উপনিবেশ কায়েম করেছেন। মীরজাফরদের নিয়ে পুতুল সরকার কায়েম করেছেন।
কিন্তু এখানেই আপনার অভিলাষ শেষ নয়, আপনি নেহেরুর ‘ভারত আবিষ্কার’ অনুসরণ করে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে রাজত্ব বিস্তার করার রঙীন স্বপ্ন দেখছেন। আপনার এই সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষায় সহায়তা করছে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী নয়া জার ব্রেজনেভ-কোসিগিন বিশ্বাসঘাতক চক্র।
হিটলারের পােল্যান্ড আক্রমণ তার পরাজয়ের সূচনা করে, জাপানী ফ্যাসিস্টদের চীন আক্রমণ তার পরাজয়ের সূচনা করে, একইভাবে আপনার ঢাকা দখল বিজয়ের পদক্ষেপ নয়, আপনার চূড়ান্ত কবরে যাওয়ার পদক্ষেপ মাত্র।
আপনার ও আপনার তাবেদারদের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণ ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করছেন। পূর্ব বাংলার বীর জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পূর্ব বাংলায় ছয় পাহাড়ের দালাল মীরজাফরদের চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করে পূর্ব বাংলার সত্যিকার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ!।
কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!
নােটঃ
ছয় পাহাড়ের দালাল সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ-এই ছয় পাহাড়ের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের সংগঠনসমূহ।
পৃষ্ঠা: ১৮৩
পূর্ব বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি,
পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার
মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান।
(মার্চ, ১৯৭২। সংশােধিত ও পুনঃমুদ্রিত, মে, ১৯৭২। সংশােধিত ও পুনঃমুদ্রিত, মার্চ, ১৯৭৪)
১. পূর্ব বাংলার জনগণ বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যু, তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার-জোতদার, পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং এ শােষণ-নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য পাকিস্তানে যােগদান করে।
পাকিস্তানের সামরিক ফ্যাসিস্টরা পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় বিকাশ অবাধে চলতে দেয়ার পরিবর্তে পূর্ব বাংলাকে শােষণ ও লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করে, একে তার উপনিবেশে পরিণত করে।
পূর্ব বাংলার জনগণ এ উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির জন্য মহান সংগ্রাম পরিচালনা করে, লক্ষ লক্ষ জনগণ এ সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দেয়।
পূর্ব বাংলার জনগণের এ মহান সংগ্রামে সর্বহারা শ্ৰেণী মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী, পূর্ব বাংলার লিউশাওচী-ক্রুশ্চোভ হক-ততায়াহা, পূর্ব বাংলার নাম্বুদ্রিপদজ্যোতিবসু দেবেন-বাসার, কাজী-রণাে, পূর্ব বাংলার ঐটস্কী-চে মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতি বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়। এরা সকলেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
ফলে পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। তারা এ সংগ্রামকে বিপথে পরিচালনা করে। প্রথমে তারা পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কানা। গলিপথে জনগণকে পরিচালনা করে, এ পথের দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হলে তারা জনগণকে অহিংস-অসহযােগের ভুল পথে পরিচালনা করে, পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা। জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে এ পথেরও দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয়, জনগণ সশস্ত্র। বিদ্রোহ করে। তারা বিচ্ছিন্নভাবে কোনাে কোনাে স্থানে এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়, কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জনগণকে অসহায়ভাবে রেখে তারা ভারতে পলায়ন করে।
মীরজাফর ক্ষমতার লােভে বৃটিশ দস্যুদের নিয়ে আসে, তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত তুলে দেয় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা। এই ইতিহাস পরিবর্তিত অবস্থায় পুনরাবৃত্তি লাভ করে ১৯৭১ সালে। পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, বুদ্ধিজীবী ও
পৃষ্ঠা: ১৮৪
সামন্তবাদীদের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ ও মনিসিং-মােজাফফর বিশ্বাসঘাতক চক্র নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে পূর্ব বাংলা মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতার লােভে সাড়ে সাত কোটি জনগণের জাতীয় স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে; বাঙালী জাতির আত্মমর্যাদাকে পদদলিত করে পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিকট বিক্রি করে দেয়, পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের উৎখাতের জন্য তাদেরকে ডেকে আনে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তা ও সমর্থনে এ সুযােগ গ্রহণ করে। তারা পূর্ব বাংলা দখল করার জন্য বাংলাদেশ পুতুল সরকার গঠন করে একে শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করায়, কামানের খােরাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য তার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তাবেদার মুক্তি বাহিনী গড়ে তােলে, তাদেরকে পূর্ব বাংলায় নাশকতামূলক তৎপরতা চালাবার জন্য প্রেরণ করে। শেষ পর্যন্ত তারা পাকিস্তান আক্রমণ করে এবং সশস্ত্র আগ্রাসী বাহিনী দ্বারা পূর্ব বাংলা দখল করে নেয় এবং আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা পুতুল সরকার কায়েম করে।
এভাবে পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশে রূপান্তরিত হয় এবং পূর্ব বাংলার জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়। পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক জনগণের রক্তপাত বৃথা যায়।
আওয়ামী লীগ, তার নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনী ও অন্যান্য সংগঠন, মােজাফফর ন্যাপ, মনিসিং-মােজাফফর কমিউনিস্ট নামধারী সংশােধনবাদী বুর্জোয়া উপদল, এর নেতৃত্বাধীন সংগঠনসমূহের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, বুদ্ধিজীবী ও সামন্তবাদীরা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ এ ছয় পাহাড়ের স্বার্থ রক্ষা করছে। এরা এই ছয় পাহাড়ের দালাল। বাংলাদেশ পুতুল সরকার এই ছয় পাহাড়ের স্বার্থ রক্ষা করছে। দেবেন-বাসার, কাজীরণাে জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদ উপদল ছয় পাহাড়ের দালালদের তাবেদারে পরিণত হয়েছে এবং ছয় পাহাড়ের দালালী করছে।
২. পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশ স্থাপনের একটি উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য কাঁচামাল, মাছ, মাংস, ডিম, চাল, তরিতরকারী ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য, সাড়ে সাত কোটি লােকের বাজার, সস্তা শ্রমশক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, পূর্ব বাংলার গ্যাস, বিদ্যুত, প্রাকৃতিক সম্পদ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সকল ক্ষেত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও তা লুণ্ঠন করা; ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট হ্রাস করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলায় উপনিবেশ স্থাপনের অপর এক উদ্দেশ্য হলাে ভারতীয় শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রাম, নাগা-মিজো, কাশ্মিরীদের মুক্তি সংগ্রাম ধ্বংস করা, ভারত মহাসাগরে ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভুত্ব করা।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে সহায়তা ও সমর্থন করেছে ভারতের ওপর তার আধিপত্য জোরদার করা, পূর্ব বাংলা লুণ্ঠনের বখরা নেয়া, ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব করা, এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এবং চীন ও কমিউনিজম প্রতিহত করার জন্য।
পৃষ্ঠা: ১৮৫
৩. ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা নির্মম শােষণ ও লুণ্ঠন শুরু করে দিয়েছে। এ শশাষণ ও লুণ্ঠন আরাে জোরদার করার জন্য তারা সীমান্ত এলাকার যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত করছে।
পূর্ব বাংলার মাছ-মাংস-ডিম, তরিতরকারী, ধান-চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য প্রত্যহ ট্রাক, ট্রেন, জাহাজে ভারতে যাচ্ছে। বাজার করার জন্য কলিকাতা থেকে ভারতীয় নাগরিকেরা পূর্ব বাংলার সীমান্ত শহরগুলােতে আসছে। এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার খাদ্যদ্রব্য লুণ্ঠন করছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলা দখলের সময় শতসহস্র মণ পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য শিল্পীয় কাঁচামাল লুট করে। ভারত কর্তৃক কাঁচামাল, বিশেষ করে পাট ক্রয়ের ওপর থেকে বাংলাদেশ পুতুল সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। এর ফলে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অবাধে পূর্ব বাংলার শিল্পীয় কাঁচামাল, পাট ক্রয় করা এবং বিদেশে রপ্তানীর সুযােগ পাচ্ছে। এভাবে পূর্ব বাংলার কাঁচামাল বিশেষ করে পাটের ওপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ ও লুণ্ঠন প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের সাথে পূর্ব বাংলার পাটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান হয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার বহু গােটা শিল্প-প্রতিষ্ঠান, যন্ত্রপাতি, খুচরা অংশ ভারতে পাচার করছে। পূর্ব বাংলার অসংখ্য গাড়ী, স্বর্ণ, রৌপ্য, পূর্ব বাংলার। বাজারের বৈদেশিক দ্রব্যাদিও তারা পাচার করছে। এর ফলে বহু শিল্প-কারখানা চালু করা বা পুরাে উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
তারা পূর্ব বাংলার বিদ্যুৎ-গ্যাস ভারতীয় শিল্পে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।
এ সকলের উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলার শিল্প-কারখানা ধ্বংস করা; এর বিকাশ ব্যাহত করা এবং ভারতীয় শিল্পের সাথে পূর্ব বাংলার শিল্প যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
তাদের অপর এক উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলার শিল্পকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তােলা। এ উদ্দেশ্যে তারা ভারত থেকে বিদ্যুৎ, তৈল, কাঁচামাল ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল করে পূর্ব বাংলার সীমান্ত এলাকার শিল্পসমূহ চালু করার চেষ্টা করছে।
ভারতীয় পণ্যে বাজার ছেয়ে গেছে। এ সকল পণ্যদ্রব্য নিম্নমানের কিন্তু উঁচু মূল্যের। পূর্ব বাংলার জনগণ বাধ্য হচ্ছে এগুলাে কেনার জন্য। এভাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাতকোটি জনগণের বাজার দখল করছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা এবং কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে।
ভারত থেকে পণ্যদ্রব্য আমদানী, তা বাজারে বিক্রয় করা এবং পূর্ব বাংলার অভ্যন্তর থেকে দ্রব্যাদি সংগ্রহ ও ভারতে রপ্তানীর বিরাট প্রক্রিয়ার ফলে পূর্ব বাংলার গােটা ব্যবসা-বাণিজ্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা আত্মসমর্পণকারী পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের শত শত কোটি টাকার অস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি ভারতে নিয়ে যায়। এভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের ন্যায্য পাওনা অস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্য থেকে বঞ্চিত হয়।
পূর্ব বাংলার পুনর্গঠনের বিরাটাকার কাজগুলাে ভারতীয় কোম্পানীসমূহ লাভ করছে। ফলে পূর্ব বাংলার প্রতিষ্ঠানসমূহ বঞ্চিত হচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ১৮৬
ভারতীয় চলচ্চিত্র, সাহিত্য, শিল্পকলা, পাঠ্যপুস্তক পূর্ব বাংলার বাজার দখল করছে এবং এসকল ক্ষেত্রে নিয়ােজিত পূর্ব বাংলার প্রতিষ্ঠানসমূহ এর ফলে মারাত্মক সংকটে পড়ছে।
তারা বৃটিশ উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের ওপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি-সাহিত্য দ্বারা পূর্ব বাংলার বাজার দখলের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তাদের শােষণ ও লুণ্ঠন মেনে নেয়ার পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়; পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ব্যাহত হয় এবং তাদের আর্থিক লাভ হয়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা বাংলাদেশ পুতুল সরকার দ্বারা মুদ্রামান হ্রাস করে এবং ভারতীয় মুদ্রা অবাধে চালু করে পূর্ব বাংলার মুদ্রাকে ভারতীয় মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল করে ফেলেছে এবং বিরাটাকার মুনাফা লুটছে।
যৌথভাবে কাজ করা, পরামর্শদাতা, উপদেষ্টা, সাহায্যদাতা প্রভৃতির ছদ্মবেশে তারা উদ্বৃত্ত কর্মচারি ও বেকার যুবকদের পূর্ব বাংলার সরকারী-আধা সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহে নিয়ােগ করে তা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সংশ্লিষ্ট ভারতীয় বিভাগের অধীনস্ত সংস্থায় রূপান্তরিত করছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা শরণার্থীর বেশে ভারতীয় নাগরিক, যুব কংগ্রেসের সশস্ত্র গুণ্ডা-গােয়েন্দাদের বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। তারা ছাত্রলীগ, মুক্তি বাহিনী, মুজিব বাহিনী, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশদের মধ্যে তার এজেন্ট অনুপ্রবেশ করিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভারতে যায়নি এ অজুহাতে দেশপ্রেমিক কর্মচারীদের তারা পুতুল সরকারের মাধ্যমে ছাটাই করাচ্ছে। দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং বিভিন্ন পেশার লােকদের হয়রানী করছে, তাদের জীবিকা নির্বাহের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করছে। তারা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রাক্তন দালাল যারা ভারতের তাবেদার হতে ইচ্ছুক তাদেরকে চাকুরী ও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা দিচ্ছে।
অতীতে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা উর্দু ভাষাভাষীদের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীলদের মাধ্যমে সাধারণ উর্দুভাষী জনগণকে প্রতারিত করে, তাদের কিছু অংশকে হাত করে এবং বাঙালী জনগণের ওপর অত্যাচার চালায়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরাও একইভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী জমিদার-জোতদার, পুঁজিপতি, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ও টাউটদের ওপর নির্ভর করে সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগণকে প্রতারিত করে, পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলিম জনগণের ঐক্যকে বিনষ্ট করে জনগণের এক অংশকে হাত করে অন্য অংশের ওপর শােষণ ও লুণ্ঠন চালাবার চক্রান্ত করছে।
পূর্ব বাংলার কোথাও কোথাও হিন্দু ধর্মাবলম্বী জমিদার-জোতদার, পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এবং টাউটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগণের সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে, জোর করে তাদের বিক্রয় করা সম্পত্তি দখল করছে।
এভাবে পূর্ব বাংলায় ধর্মীয় বৈষম্য এবং কোথাও কোথাও মুসলিম জনগণের ওপর ধর্মীয় নিপীড়নের ষড়যন্ত্র চলছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলার মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার-জোতদার, পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার তার দালাল
পৃষ্ঠা: ১৮৭
অংশ (পি.ডি.পি, জামাত, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগের একাংশ) এ ধর্মীয় নিপীড়নের সুযােগ গ্রহণ করে সাধারণ দেশপ্রেমিক হিন্দু জনগণ বিরােধী দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধাবার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে এবং এর সহায়তায় পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ স্থাপনের চক্রান্ত করছে। তথাকথিত মুসলিম বাংলার দাবী এ ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
৪. ১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারতের সংশােধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী নিপীড়নের একটি রূপ ধর্মীয় নিপীড়নের বিরােধিতা করেনি।
ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণ বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যু ও তাদের ওপর নির্ভরশীল হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার-জোতদার, পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিশেষ করে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মুসলিম সামন্তবাদী, বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান দাবী সমর্থন করে এবং পাকিস্তানে যােগদান করে।
এর ফলে পাক-ভারত উপমহাদেশকে বিভক্ত করে তার সমর্থকদের দ্বারা শােষণ ও লুণ্ঠন করার বৃটিশ দস্যুদের চক্রান্ত সফল হয়।
বর্তমানেও পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের ধর্মীয় নিপীড়ন এবং এর সুযােগ গ্রহণ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের দাঙ্গা, রায়ট বাধানাে এবং পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ স্থাপনের চক্রান্তকে পূর্ব বাংলার জনগণ যদি বিরােধিতা না করেন, তবে পূর্ব বাংলায় দাঙ্গা, রায়ট এবং সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ স্থাপনের সম্ভাবনা জোরদার হবে।
অতীতের মতাে বর্তমানেও বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতকরা এ প্রশ্নে নীরব থেকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের সাম্প্রদায়িক ও উপনিবেশিক চক্রান্তকে সহায়তা করছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা প্রচার করছে তাদের আগ্রাসী বাহিনী যে উদ্দেশ্যে এসেছিল তা সম্পন্ন হওয়ায় তারা ভারতে ফিরে গেছে। তারা যে উদ্দেশ্যে এসেছিল তা হলাে পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ স্থাপন করা, তার তাবেদার ছয় পাহাড়ের দালালদের ক্ষমতায় বসানাে। তার তাবেদার বাহিনী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ তার স্বার্থ রক্ষার মতাে যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ায় বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সৈন্য রাখা অপ্রয়ােজনীয় হয়ে পড়েছে। তারা বাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালী দমন করে শােষণ ও লুণ্ঠন চালাতে চায়।
তারা শিক্ষাদাতা, উপদেষ্টা, গােয়েন্দা এবং তাবেদারদের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। উপরন্তু পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ভারতের ওপর নির্ভরশীল অর্থাৎ পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ভারতের নিয়ন্ত্রণে এ সত্য বাংলাদেশ পুতুল সরকার বহু বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে। পূর্ব বাংলার জনগণ ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম দমনের জন্য বহু সৈন্য প্রেরণ করেছে, এমন কি বিমান বাহিনী পর্যন্ত ব্যবহার করেছে।
পৃষ্ঠা: ১৮৮
এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ, লুণ্ঠন, শােষন ও নির্যাতন প্রতিষ্ঠা করেছে, পূর্ব বাংলাকে তার উপনিবেশে পরিণত করেছে এবং পূর্ব বাংলাকে তাদের পশ্চাদভূমিতে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার তার পুতুল। সরকার ব্যতীত আর কিছুই নয়। ছয় পাহাড়ের দালালরা প্রকাশ্য ও গােপন চুক্তির মাধ্যমে এ শােষণ ও লুণ্ঠন-নিয়ন্ত্রণ, নির্যাতনের সুযােগ করে দিয়েছে, পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিকট বিক্রী করে দিয়েছে।
অতীতে জাপানী ফ্যাসিস্টরা এশিয়ায়সহ উন্নত অঞ্চল গড়ে তােলার শ্লোগানকে উপনিবেশ স্থাপনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। বর্তমানে ভারতীয়। সম্প্রসারণবাদীরাও তাদের অনুকরণে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগানকে তার উপনিবেশ স্থাপনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের এ উপনিবেশে লুটের ভাগ বসাচ্ছে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী এবং মার্কিনের নেতৃত্বে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা। তারা ঋণ প্রদান, অসম বাণিজ্যচুক্তি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের লুণ্ঠন চালাচ্ছে।
এভাবে পূর্ব বাংলার জাতীয় বিপ্লব অর্থাৎ পূর্ব বাংলা থেকে বৈদেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের অবসান ও স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
সামন্ত জমিদার-জোতদারদের উৎখাত করে কৃষকের মাঝে ভূমি বিতরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান দায়িত্বও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ছয় পাহাড়ের দালালরা প্রতিক্রিয়াশীল গ্রাম্য সামন্ত জমিদারজোতদার-মহাজন, টাউট ও অত্যাচারীদের শাসন কায়েম করেছে। এদেরকে পাহারা দেয়ার জন্য গঠন করা হয়েছে ডাকাত দল গ্রামরক্ষী বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।
এভাবে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
৬. পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী প্রমাণ করছে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী বা সামন্তবাদী কোনাে শ্রেণীর পক্ষেই পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এরা নিজেদের ও জাতীয় স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বিদেশের কাছে দেশ ও জাতিকে বিক্রী করে দেয় এবং দেশের মধ্যকার সামন্তবাদের সাথে আপােষ করে।
কাজেই অনিবার্যভাবেই পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার। মহান দায়িত্ব এসে পড়েছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টির ওপর। পূর্ব বাংলার কিছু সংখ্যক মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক ব্যতীত পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষকছাত্র-বুদ্ধিজীবী-ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-চাকুরীজীবী অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র বাঙ্গালী জাতি অচিরেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠন, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শােষণ-লুণ্ঠন ও তাদের তাবেদারদের শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বিরাটাকার সংগ্রাম পরিচালনা করবে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির মহান ঐতিহাসিক দায়িত্ব হলাে এ সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করা ও তাকে সঠিক পথে পরিচালনা ও সম্পন্ন করা।
পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের দখল কায়েম হওয়ার ফলে পাকিস্তানের সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে। পূর্ব বাংলার সমাজের বিকাশের জন্য বর্তমানে নিম্নলিখিত মৌলিক দ্বন্দ্বসমূহ দায়ী ও
১৮৯
১। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। ২। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। ৩। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। ৪। মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের দালালদের দ্বন্দ্ব। ৫। পূর্ব বাংলার সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব। ৬। পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা তার সেনাবাহিনীর সাহায্যে আগ্রাসী যুদ্ধ চালিয়ে পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ কায়েম করেছে, এ কারণে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব উপরােক্ত দ্বন্দ্বসমূহের মাঝে প্রধান দ্বন্দ্ব।
এ দ্বন্দ্ব সমাধানের উপায় হচ্ছে সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লব পরিচালনার মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালাল জাতীয় শত্রুদের খতম ও উৎখাত করা, বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে উৎখাত করা, পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শৃংখল থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করা।
এ বিপ্লবের অপর এক লক্ষ্য হবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের উৎখাতের সাথে সাথে পূর্ব বাংলা থেকে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করা, এদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক সামন্ত জমিদার-জোতদারদের জাতীয় শত্রু হিসেবে খতম ও উৎখাত করা, তাদের ভূ-সম্পত্তি ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা, জাতীয় বিপ্লব সমর্থক সামন্তবাদীদের সামন্ত শােষণ কমানাে, শেষ পর্যন্ত সামন্তবাদ উৎখাত করা। এভাবে পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করা।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের জাতীয় শত্রু হিসেবে উৎখাত করা।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় এ বিপ্লব সমর্থক বুর্জোয়াদের রক্ষা করা, শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রম সময় নির্ধারণ এবং তাদেরকে অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা প্রদান করা।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগণ অবশ্যই তাদের ঐক্যকে দৃঢ়তর করবেন। ভারতীয় সমপ্রসারণবাদ ও তার দালাল প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার-জোতদার-পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবী, টাউটদের মুসলিম জনগণের ওপর ধর্মীয় নিপীড়নের এবং সম্প্রসারণবাদী স্বার্থে হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগণকে ব্যবহার করার চক্রান্তকে বিরােধিতা করবেন। একই সাথে এ ধর্মীয় নিপীড়নের সুযােগ গ্রহণ করে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তার মুসলিম ধর্মাবলম্বী দালাল জমিদার-জোতদার, পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবী (পি.ডি.পি, জামাত, মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগের একাংশ) এবং টাউটদের দেশপ্রেমিক হিন্দু জনগণ বিরােধী সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত এবং পূর্ব বাংলায় মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ স্থাপনের ষড়যন্ত্রকে বিরােধিতা করবেন। সকল প্রকার ধর্মীয় নিপীড়নের অবসান করবেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অধিকার, সমতা ও সম্প্রীতি রক্ষা করবেন।
পৃষ্ঠা: ১৯০
পূর্ব বাংলার এই অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মৌলিক পরিচালক শক্তি হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক-ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী । সর্বহারা শ্রেণী হচ্ছে এ বিপ্লবের নেতা।
পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করা সম্ভব দীর্ঘস্থায়ী নির্মম গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়ােগের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। এ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সূচনা করতে হবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে, শ্রমিক-কৃষক বিপ্লবীদের সমন্বয়ে শূন্য থেকে গেরিলাপ গঠন করতে হবে, হাতের কাছে যা কিছু পাওয়া যায় তাই দিয়ে ছয় পাহাড়ের দালাল জাতীয় শত্রুদের খতম করতে হবে, শত্রুর অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে, গেরিলা যুদ্ধকে পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে, গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, গ্রাম্য এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন, নিয়মিত বাহিনী, স্থানীয় গেরিলা, গ্রাম্য আত্মরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত উন্নত পর্যায়ের সচল যুদ্ধ, বড় রকমের ঘেরাও ও অবস্থান যুদ্ধ পরিচালনা করে শহরসমূহ দখল করতে হবে এবং সমগ্র পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে হবে ।
সর্বহারা শ্রেণী কৃষক-শ্রমিক মৈত্রীর ভিত্তিতে জাতীয় বুর্জোয়া এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, গােষ্ঠী, দল, ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করবে। একই সময়ে বুর্জোয়া সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের আপােষমুখীতা, দোদুল্যমানতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার মনােভাব ও কার্যকলাপকে সমালােচনা ও বিরােধিতা করবে।
এ বিপ্লব পরিচালনা করে সমগ্র পূর্ব বাংলা মুক্ত করে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণীর যৌথ গণতান্ত্রিক একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
এই বিপ্লব পরিচালনার প্রক্রিয়ায় মুক্ত এলাকায় স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে হবে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করে পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকাংশের আশা-আকাঙ্খার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার সম্পর্কের সমস্যার (পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, পশ্চিম পাকিস্তানস্থ বাঙালীদের ফিরিয়ে আনা, পূর্ব বাংলার গণহত্যা ও ফ্যাসিস্ট ধ্বংসযজ্ঞের অপরাধে অপরাধী পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ও সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তি প্রদান করা, পূর্ব বাংলা থেকে গত ২৪ বৎসরে পশ্চিম পাকিস্তানে যে পুঁজি ও মূল্যবান সম্পদ পাচার হয়েছে তা সুদসহ ফেরত আনা, পূর্ব বাংলা থেকে পাচার করা ঐতিহাসিক দ্রব্যাদি ফেরত আনা, বৈদেশিক ঋণ পরিশােধের সমস্যা, পূর্ব বাংলায় তারা যে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন চালিয়েছে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায় করা ইত্যাদি সমস্যা) সমাধান করা।
এভাবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা ও পরিচালনা করা।
৭. পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি সংগ্রাম সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর
পৃষ্ঠা: ১৯১
একটি নির্ভুল রাজনৈতিক পার্টি প্রয়ােজন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালে মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে পথ প্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে নিয়ে প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী ও গেরিলারা পাকিস্তান কাউন্সিল, মার্কিন তথ্যকেন্দ্র, বি.এন.আর-এ বােমা বর্ষণ করে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করে।
পঁচিশে মার্চ ও তার পরবর্তী সময়কার পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরমতম ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের মুখেও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা ভারতে পলায়ন না করে জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে জনগণকে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সঠিক পথে মুক্তিযুদ্ধে পরিচালনা করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা জাতীয় শত্রু ও পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের নিকট থেকে কেড়ে নেয়া অস্ত্র দ্বারা গেরিলা যুদ্ধ চালায়। অচিরেই বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, ঢাকা, পাবনা ও টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলায় আটটিরও বেশী গেরিলা ফ্রন্ট, মুক্ত অঞ্চল ও নিয়মিত বাহিনী গড়ে ওঠে, গেরিলা যুদ্ধ দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে।
এভাবে আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সঠিক পথে পরিচালনা করে সমগ্র বাঙালী জাতির সামনে সঠিক পথের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গােলার শব্দের মাঝে গড়ে ওঠে ৩রা জুন, ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি”।
ছয় পাহাড়ের দালালরা পূর্ব বাংলায় ছয় পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠন কায়েম এবং অব্যাহতভাবে তা পরিচালনার পথে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে একমাত্র বাধা বলে গণ্য করে। তারা আমাদের আক্রমণ করে, আলােচনার ভাওতা দিয়ে আমাদের বহু গেরিলা, কর্মী, সহানুভূতিশীল ও জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা করে, তাঁদের রক্তে হাত কলংকিত করে, আমাদের মুক্ত অঞ্চলসমূহ তারা দখল করে নেয়। এভাবে তারা সঠিক পথে পরিচালিত মুক্তি সংগ্রামকে অস্থায়ীভাবে ব্যাহত করে।
পূর্ব বাংলার প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখলের পর তারা তাদের নির্যাতন ও লুণ্ঠন জোরদার করেছে। তারা যত্রতত্র লুটতরাজ, হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, অর্থ সংগ্রহ, অগ্নিসংযােগ করছে। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের মতাে তারাও বধ্যভূমি তৈরী করেছে। তারা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে তারা মগের মুল্লুক কায়েম করেছে।
তারা অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে উর্দু ভাষাভাষী শিশু-যুবক, বৃদ্ধ-নারীদের হিটলারের ইহুদী নিধনের অনুরূপভাবে নির্মুল করছে।
তাদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলার নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের অগ্নিমূল্য হয়েছে, শত-সহস্র লােক বেকার হয়ে পড়েছে। জনগণ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন ধারণ করছে।
অসংখ্য ঘটনা প্রমাণ করছে, ছয় পাহাড়ের দালালরা যে গণতন্ত্র চায় তা হচ্ছে ছয় পাহাড়ের দালালদের ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, তারা যে সমাজতন্ত্র চায় তা হচ্ছে ছয়
পৃষ্ঠা: ১৯২
একটি নির্ভুল রাজনৈতিক পার্টি প্রয়ােজন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালে মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে পথ প্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে নিয়ে প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী ও গেরিলারা পাকিস্তান কাউন্সিল, মার্কিন তথ্যকেন্দ্র, বি.এন.আর-এ বােমা বর্ষণ করে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করে।
পঁচিশে মার্চ ও তার পরবর্তী সময়কার পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরমতম ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের মুখেও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা ভারতে পলায়ন না করে জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে জনগণকে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সঠিক পথে মুক্তিযুদ্ধে পরিচালনা করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা জাতীয় শত্রু ও পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের নিকট থেকে কেড়ে নেয়া অস্ত্র দ্বারা গেরিলা যুদ্ধ চালায়। অচিরেই বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, ঢাকা, পাবনা ও টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলায় আটটিরও বেশী গেরিলা ফ্রন্ট, মুক্ত অঞ্চল ও নিয়মিত বাহিনী গড়ে ওঠে, গেরিলা যুদ্ধ দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে।
এভাবে আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সঠিক পথে পরিচালনা করে সমগ্র বাঙালী জাতির সামনে সঠিক পথের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গােলার শব্দের মাঝে গড়ে ওঠে ৩রা জুন, ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি”।
ছয় পাহাড়ের দালালরা পূর্ব বাংলায় ছয় পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠন কায়েম এবং অব্যাহতভাবে তা পরিচালনার পথে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে একমাত্র বাধা বলে গণ্য করে। তারা আমাদের আক্রমণ করে, আলােচনার ভাওতা দিয়ে আমাদের বহু গেরিলা, কর্মী, সহানুভূতিশীল ও জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা করে, তাঁদের রক্তে হাত কলংকিত করে, আমাদের মুক্ত অঞ্চলসমূহ তারা দখল করে নেয়। এভাবে তারা সঠিক পথে পরিচালিত মুক্তি সংগ্রামকে অস্থায়ীভাবে ব্যাহত করে।
পূর্ব বাংলার প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখলের পর তারা তাদের নির্যাতন ও লুণ্ঠন জোরদার করেছে। তারা যত্রতত্র লুটতরাজ, হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, অর্থ সংগ্রহ, অগ্নিসংযােগ করছে। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের মতাে তারাও বধ্যভূমি তৈরী করেছে। তারা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে তারা মগের মুল্লুক কায়েম করেছে।
তারা অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে উর্দু ভাষাভাষী শিশু-যুবক, বৃদ্ধ-নারীদের হিটলারের ইহুদী নিধনের অনুরূপভাবে নির্মুল করছে।
তাদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলার নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের অগ্নিমূল্য হয়েছে, শত-সহস্র লােক বেকার হয়ে পড়েছে। জনগণ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন ধারণ করছে।
অসংখ্য ঘটনা প্রমাণ করছে, ছয় পাহাড়ের দালালরা যে গণতন্ত্র চায় তা হচ্ছে ছয় পাহাড়ের দালালদের ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, তারা যে সমাজতন্ত্র চায় তা হচ্ছে ছয়
পৃষ্ঠা: ১৯২
পাহাড়ের শােষণ ও লুণ্ঠন, তারা যে ধর্ম নিরপেক্ষতা চায় তা হচ্ছে মুসলিম জনগণের ওপর ধর্মীয় নিপীড়ন, পূর্ব বাংলায় ভারতের উপনিবেশ বজায় রাখার পথে মুসলিম ধর্মের প্রতিবন্ধকতাকে দাবিয়ে রাখা, তারা যে জাতীয়তাবাদের কথা বলছে তা ভাষাভাষীদের নির্মূল করা।হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও জাতীয় পরাধীনতা এবং পূর্ব বাংলার জাতিগত সংখ্যালঘু ও উর্দু
মুজিববাদ হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ।
পূর্ব বাংলার জনগণের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ উপলব্ধি করছেন পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও ছয় পাহাড়ের দালালদের মাঝে কোন তফাৎ নেই, তারা সাপের মুখ থেকে বাঘের মুখে পড়েছেন।
গত নয় মাসের বিপ্লবী ঝড়-তরঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের চেতনা খুবই উচ্চস্তরে পৌঁছেছে। তারা উন্নত রাজনৈতিক মান অর্জন করেছেন, মুত্যুকে তাঁরা ভয় করেন না।
তারা ছয় পাহাড়ের দালাল ও তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছেন। পূর্ব বাংলার শ্রমিকরা ধর্মঘট, মিছিল, ঘেরাও সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছেন। ছােট চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীরাও সংগ্রাম শুরু করেছেন।
কৃষকরা ছয় পাহাড়ের দালাল জোতদার-জমিদার-টাউটদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছেন।
এভাবে ছয় পাহাড়ের দালালরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তাদের মুখােশ উন্মােচিত হচ্ছে, জনগণ তাদের ভাওতা ও মীরজাফরী বুঝতে পারছেন।
ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ উৎখাতের প্রচণ্ড গণসংগ্রাম শুরু হয়েছে।
ছয় পাহাড়ের দালালদের নিজেদের মধ্যকার কামড়াকামড়ি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমনকি নিজেদের মাঝে সশস্ত্র সংঘর্ষ, হত্যা, অপহরণ চলছে।
তারা সংকট এড়ানাের উদ্দেশ্যে ভিক্ষার ঝুলি হাতে বৈদেশিক সাহায্যের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে।
কিন্তু কোন কিছুই তাদের পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। জনগণ পাকসামরিক ফ্যাসিস্টদের মতাে এদেরকেও এদের প্রভুদেরসহ চূড়ান্তভাবে কবরস্ত করবে।
আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের জনপ্রিয়তাহীনতা এবং সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার সুযােগ গ্রহণ করে এককালের মুজিববাদের প্রণেতা রব গ্রুপ (বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) তথাকথিত শ্রেণীসংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলে পূর্ব বাংলার ক্ষমতা দখল করে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ স্থাপনের চক্রান্ত করছে। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের মতাে তাদের পতনও অনিবার্য।
৮. আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট ও তার তাবেদাররা জনগণের ওপর নির্যাতন জোরদার করার সাথে সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ‘নকশাল’ দমন অভিযান, চীন ও কমিউনিজম প্রতিহত করা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করার প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপে অংশগ্রহণ জোরদার করছে।
পৃষ্ঠা: ১৯৩
কাজেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের গােপনভাবে কার্য পরিচালনা করতে হবে। পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে প্রকাশ্য কাজের সুযােগকে সশস্ত্র সংগ্রামে সহায়তার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হবে।
পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের অবশ্যই ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম সহযােগিতা স্থাপন ও দৃঢ়করণ, ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের নেতৃত্বে জনগণের মহান সংগ্রাম, নাগা, মিজো, কাশ্মিরীদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সাথে একাত্ম হতে হবে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্র ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে উৎখাত করতে হবে।
আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের হাতে নিহত পূর্ব বাংলার জনগণের রক্তের রক্ত, মাংসের মাংস পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান কমরেড চুন্ন, যিনি মৃত্যু পর্যন্ত ধ্বনি দিয়েছেন স্বাধীন পূর্ব বাংলা জিন্দাবাদ, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি জিন্দাবাদ, কমরেড সিরাজ সিকদার জিন্দাবাদ; কমরেড হিরু, নজরুল, আনিস, শশাঙ্ক, জিলু, তাহের, পলাশ, সাঈদ, রইস এবং অন্যান্যদের; গেরিলা মান্নান, মজিদ ও অন্যান্যদের; পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে নিহত কমরেড পিন্টু ও অন্যান্যদের; দুর্ঘটনায় নিহত কমরেড শাহিন ও অন্যান্যদের; নিখোঁজ কমরেড ও গেরিলা এবং পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে শহীদ লক্ষ জনতার কথা স্মরণ রেখে আসুন আমরা এগিয়ে যাই, পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলি, ৩০শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে পেয়ারা বাগানে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে ওঠে তার পথ অনুসরণ করে পার্টির অধীন প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী গড়ে তুলি, কৃষক-শ্রমিক মৈত্রীর ভিত্তিতে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুলি পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট, ছয় পাহাড়ের দালাল জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাই, শহীদ কমরেড গেরিলা ও বন্ধুদের রক্তের বদলা রক্ত নেই, সশস্ত্র সংগ্রামে লেগে থাকি। এর মাধ্যমে পার্টি, সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী ও জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ে তুলি, বন্দুকের নলের মাধ্যমে গড়ে তুলি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র, সম্পন্ন করি পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।
* পূর্ব বাংলার লিউশাওচী-ক্রুশ্চোভ হক-তােয়াহা, জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদ দেবেনবাসার, কাজী-রণে-অমল সেন, ট্রটস্কি-চে মতিন-আলাউদ্দিন বিশ্বাসঘাতক চক্র-নিপাত যাক!
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি- জিন্দাবাদ!
* কমরেড সিরাজ সিকদার- জিন্দাবাদ!
* পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন!
* পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট-জিন্দাবাদ!
* পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী-জিন্দাবাদ!
* স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করুন!
পৃষ্ঠা: ১৯৪
প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম, দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন এবং
একটি জরুরী অধিবেশনের ইশতেহার
(সম্ভবতঃ মার্চ, শেষ সপ্তাহ, ১৯৭২)
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠক ১৭ই জানুয়ারী শুরু হয় এবং ১৮ই জানুয়ারী সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
সভায় সকল সদস্য ও বিকল্প সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরেড সিরাজ সিকদার। তিনি সভায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্বোধনী ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের গুরুদায়িত্ব এবং আদর্শের ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, কেন্দ্রীয় কমিটির স্থায়ী কমিটি গঠনের প্রয়ােজন নেই, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডাকবেন।
কংগ্রেসের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত করা, পার্টির তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক পত্রিকা ‘লাল ঝাণ্ড’ নিয়মিত প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।
বিভিন্ন ব্যুরাে সমূহ বাতিল করা, বিভিন্ন স্তরের আহ্বায়ক কমিটি গঠন ও তাদের কংগ্রেস করার ব্যবস্থা করা, সর্বহারা পার্টির সদস্যপদ প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং পাঠ্যসূচী নির্ণয় করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
আরাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পার্টির খরচের যথাযথ ভাউচার পেশ করতে হবে। এবং তা উচ্চস্তরের অনুমােদন করিয়ে নিতে হবে। সার্বক্ষণিক কর্মীদের অবশ্যই পার্টির নির্দেশ পালন করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের ইশতেহার জনগণের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়।
শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হওয়া, শ্রমে অংশগ্রহণ করা, তাদের কাছ থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করা এবং পুনর্গঠিত হওয়া, পাঠচক্রের সদস্যদের কমপক্ষে একজন শ্রমিক বা কৃষক বন্ধু সংগ্রহ করতে হবে প্রভৃতি সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়।
সভায় বিভিন্ন সদস্যদের কাজের দায়িত্ব ও এলাকা ঠিক করে দেওয়া হয় এবং জনৈক কমরেডকে শােধরানাের জন্য কতগুলাে শর্তাবলী নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তী সভার তারিখ ঠিক করে সভার সমাপ্তি ঘােষণা করা হয়।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ২৫শে মার্চ শুরু হয় এবং ২৬শে মার্চ সম্পন্ন হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যগণ ও বিকল্প সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন এবং কমরেড সিরাজ সিকদার সভাপতিত্ব করেন।
পৃষ্ঠা: ১৯৫
সভায় পূর্ব বাংলার সামাজিক পরিস্থিতি এবং কংগ্রেসউত্তর কালের বাস্তব অনুশীলনের পর্যালােচনা করা হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পূর্ব বাংলার চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতি দ্রুত গতিতে সৃষ্টি হচ্ছে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইন পূর্ব বাংলার বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সঠিক।
সভায় বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সাধারণ পরিণতি নির্দেশ করা হয়। পূর্ব বাংলার সমাজের প্রচণ্ড বিপ্লবী ঝড়তরঙ্গে এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামের (তত্ত্বগত ও অনুশীলন উভয় ক্ষেত্রেই) ফলে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের দেউলিয়াত্ব ও বিশ্বাসঘাতকতা সকল ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। তারা মারাত্মকভাবে নিঃসঙ্গ, অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত, বিভক্ত এবং তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। অচিরেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা ও জনগণ তাদের কবরস্থ করবে।
পক্ষান্তরে আমরা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছি।
সভায় পর্যালােচনা করা হয় যে, আমাদের কাজ হয়েছিল এরূপ অধিকাংশ স্থানের সাথেই যােগাযােগ পুনঃস্থাপিত হয়েছে, অবশিষ্ট যােগাযােগসমূহ দ্রুত স্থাপন করা এবং দ্রুত নতুন যােগাযােগ স্থাপনের কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রয়ােজন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের পুনঃনিয়ােগ সম্পূর্ণ হয়েছে। বর্তমানে কর্মীর তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। তবে সার্বক্ষণিক হতে ইচ্ছুক এরূপ প্রচুর কর্মী পাওয়া যাচ্ছে। কিছুটা শিক্ষিত শ্রমিকদের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিয়ােগের বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত।
কর্মীস্বল্পতা এড়ানাের জন্য জরুরী ভিত্তিতে স্থানীয় কর্মীদের সর্বনিম্ন ট্রেনিং প্রদান করে কাজে নিয়ােগ করা প্রয়ােজন। ট্রেনিং-এর জন্য সর্বনিম্ন পাঠ্যসূচী নিম্নরূপ বলে নির্ধারণ করা হয়ঃ উদ্ধৃতির শৃংখলা, সংগঠনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত দলিল, পাঁচটি প্রবন্ধ, গণযুদ্ধ, সংবিধান, সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতি (পার্টি ও সামরিক), শ্রেণী বিশ্লেষণ ও শ্রেণী অনুসন্ধানের পদ্ধতি, রিপোের্ট লেখা, সামরিক লাইনে প্রাথমিক জ্ঞান, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল ইত্যাদি।
নতুন কর্মী সংগ্রহ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কারণ শত্রু চর আমাদের মাঝে অনুপ্রবেশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের নীতি হলাে সাহসের সাথে কর্মী বাড়াও কিন্তু একটিও শক্ৰচর আমাদের মাঝে ঢুকতে দিও না।
এভাবে বর্তমানে পার্টির প্রধান সমস্যা কৰ্মীস্বল্পতা সমস্যার সমাধান করতে হবে।
সভায় আমাদের নাম নিয়ে শত্রুর খারাপ কাজ (ডাকাতি, লুট, হত্যা ইত্যাদি) পর্যালােচনা করা হয় এবং এ সম্পর্কে প্রকৃত ঘটনা উল্লেখ করে জনগণের নিকট প্রচার করার আহবান জানানাে হয়। শত্রু-মিত্র বিচার না করে স্বতঃস্ফূর্ত হামলা, ছিনতাই ইত্যাদির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানাে হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে জাতীয় গণভিত্তিক পার্টি রূপে অর্থাৎ সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী জনগণের সাথে যুক্ত পার্টি রূপে গড়ে তােলার আহ্বান জানানাে হয়।
কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের সামাজিক অনুসন্ধান অর্থাৎ শ্রেণী বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের পদ্ধতি এবং গণলাইনের কর্মপদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া জরুরী প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে দলিল প্রণয়ন এবং কর্মীদের ট্রেনিং প্রদানের ব্যবস্থা করার পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
ভারত ও অন্যান্য দেশের সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের প্রচেষ্টা চালানাের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৯৬
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের সর্বদা বর্তমান কার্যাবলীর সাথে অতীতের অভিজ্ঞতার সংযােগ সাধন করার এবং ভবিষ্যতের দিশা ঠিক রেখে কাজ করার আহ্বান জানানাে হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানাে, ঐক্যে ইচ্ছুকদের প্রতি সংবিধানের নিয়মাবলী প্রয়ােগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে, এ কারণে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা বর্তমান। বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাবার জন্য আমাদের বিপ্লবী কাজ জোরদার করা প্রয়ােজন।
জনৈক কমরেডের ভুল চিন্তাধারা ও ত্রুটিসমূহকে সমালােচনা করা হয় এবং তাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ বিপ্লবী স্বার্থের অধীন রাখার আহবান জানানাে হয়। অন্যথায় কেন্দ্রীয় কমিটি ও সংগঠন তার অগ্রগামী চরিত্র বজায় রাখার জন্য যে সকল সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে তা তাকে জানানাে হয়।
এ সভায় পূর্ববর্তী সভার সিদ্ধান্তসমূহ পুনরায় অনুমােদিত হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে সভাপতি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ অনুমােদিত হয়।
এ সভায় কেন্দ্রীয় কমিটিকে পুনর্গঠিত করা হয়। পুনর্গঠনের সাথে জড়িত কমরেডের বিষয় ছয়মাস পরে পুনরায় বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তী সভার তারিখ ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে সভা সমাপ্ত হয়।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির একটি জরুরী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২৮ শে মার্চ এবং ঐদিনই তা সমাপ্ত হয়।
সভায় সকল সদস্য এবং বিকল্প সদস্য উপস্থিত ছিলেন এবং কমরেড সিরাজ সিকদার সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভায় জনৈক সদস্যের ব্যক্তিগত জীবন রাজনৈতিক জীবনের অধীনে রাখতে না পারার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অগ্রগামী ও আদর্শ স্থানীয় ভূমিকা ও কমিউনিস্ট হওয়ার সর্বনিম্ন মানদণ্ড তুলে ধরা হয়। উক্ত কমরেডের মানদণ্ড এর তুলনায় কম বলে বিবেচিত হয়। এ ত্রুটি সংশােধনের জন্য তাকে বহুদিন পূর্ব থেকেই বারংবার বলা সত্ত্বেও তিনি তা সংশােধন করতে ব্যর্থ হন।
এ সকল কারণে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির পরবর্তী উচ্চস্তরের প্রধানের পদে উক্ত কমরেডকে নিয়ােগ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পুনর্গঠনের সাথে জড়িত কমরেডের বিষয় পুনরায় ছয়মাস পরে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এ সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব পুনরায় বণ্টন করা হয়। সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৯৭
প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সার্কুলার নং-৪
(মার্চ, ১৯৭২)
১। সশস্ত্র বাহিনী দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ও পার্টি দিবস উদযাপন করুন।
ক) ৩০শে এপ্রিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর ও জনগণের সশস্ত্র বাহিনী দিবস।
৩০শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে বরিশালের পেয়ারা বাগানে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণের স্বার্থ রক্ষাকারী নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে।
খ) ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস উদ্যাপন করুন।
গ) ৩রা জুন পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি দিবস। ৩রা জুন ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল স্তর, সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বাধীন গেরিলা এবং অন্যান্যরা এ দিবসসমূহ উদ্যাপন করবেন, এ দিবসসমূহ উপলক্ষে লাল ঝাণ্ডার সম্পাদকীয়ের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়িত করবেন।
২। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির জন্য গুরুত্বের সাথে অর্থ সংগ্রহ করুন। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় ফান্ড প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে।
কাজেই বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি সমূহ অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে অতিসত্তর অর্থ সংগ্রহ করবেন, নিজেরা আত্মনির্ভরশীল হবেন।
পার্টির প্রচার, সার্বক্ষণিক কর্মী রক্ষণাবেক্ষণ, যােগাযােগ, আঞ্চলিক কমিটিসমূহে সাহায্য, নিরাপত্তা এবং কেন্দ্রের কার্য পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন।
মারাত্মক আর্থিক সংকটের কারণে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। বিপ্লবের আরাে ব্যাপক দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হতাে।
কাজেই এ অবস্থার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা দূর করার জন্য গুরুত্ব দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে অতিসত্বর।
৩। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্য, প্রার্থী সদস্য এবং পাঠচক্র সদস্য প্রসঙ্গে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্য বা প্রার্থী সদস্য পদের জন্য নির্ধারিত আবেদন পত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির নিকট আবেদন করতে আহ্বান জানানাে হচ্ছে।
একজন সদস্যের সুপারিশ সংক্রান্ত স্থানে আবেদনকারীর পরিচালক সুপারিশ করবেন। আবেদনপত্র কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে নিতে হবে।
পাঠচক্রের সদস্যপদের আবেদনপত্রে প্রদত্ত তথ্যাদি যাচাই করার পর পাঠচক্রের সদস্য করতে হবে, আগে নয়।
তথ্যাদি যাচাই করার প্রয়ােজন, যাতে শত্ৰুচর ঢুকতে না পারে।
পৃষ্ঠা: ১৯৮
৪। আলতাফ ওরফে আবুল হাসান এবং তার চক্র প্রসঙ্গে।
আলতাফ মিয়া ওরফে আবুল হাসান, শান্তিলাল এবং তার ডাকাত চক্রের সাথে বা তাদের কার্যকলাপের সাথে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কোন সম্পর্ক নেই।
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের পর এ চক্র স্বরূপকাঠি এলাকায় নির্বিচারে ডাকাতি, লুট, হত্যা, নারী নির্যাতন প্রভৃতি জঘন্য অপরাধ করে।
এ সময়ে সে ও তার ডাকাত দল নিজেদেরকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের লােক বলে মিথ্যা পরিচয় দেয় এবং সংগঠনের বদনাম করে।
আবুল হাসান একজন ঠিকাদার। ঠিকাদারের শঠতা, প্রতারণা, বেপরােয়া অর্থ খরচের বদ অভ্যাস, নারীদের সাথে অবৈধ সম্পর্কের ইতিহাস তার ছিল।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সে প্রথম দিকে যুক্ত ছিল, কিন্তু সংশােধিত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সংগঠন তার সাথে যােগাযােগ রাখা বন্ধ করে দেয় (১৯৭০ সালের প্রথম দিকে)।
এ সময় তার পরিচালনাধীন কিছু সংখ্যক সহানুভূতিশীল পার্টিকে বুঝিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে ব্যক্তিগত অর্থ লাভের জন্য সে রেখে দেয়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে পঁচিশে মার্চের পর যােগাযােগ হলে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আবুল হাসান ও অন্যান্য অপরাধীদের নিরস্ত্র করা হয়। আরাে অনুসন্ধান পরিচালনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
কিন্তু আবুল হাসান অনুসন্ধান পরিচালনার বিষয়ে সম্পূর্ণ অসহযােগিতা প্রদর্শন করে।
সম্প্রতি আবুল হাসান ও তার চক্র নিজেদের পার্টি কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ডাকাত দল গঠন করে এবং সর্বহারা পার্টির বক্তব্য বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
পূর্ব বাংলার জনগণ ও সর্বহারা বিপ্লবীরা অবশ্যই এ ডাকাত দলের চক্রান্তকে নস্যাৎ করবেন।
পৃষ্ঠা: ১৯৯
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী বুর্জোয়া উপদলের সাথে যুক্ত সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতি
(মার্চ, ১৯৭২)
“বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী উপদলের সাথে যুক্ত সর্বহারা বিপবীরা, ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত’-সভাপতি মাও-এর এ পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সংশােধনবাদী উপদলসমূহের নেতৃত্বের বিরদ্ধে বিদ্রোহ করন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিস্রধারা এবং পূর্ব বাংলার বিপবের বিশেষ অনুশীলনে তার বিশেষ প্রয়ােগের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে ঐক্যবদ্ধ হােন! সর্বহারা বিপবীদের মধ্যকার অনৈক্যকে দূর করন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিত্সধারায় সুসজ্জিত, সুশৃংখলিত, সমালােচনা-আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী, জনগণের সাথে যুক্ত, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং এককেন্দ্রীক পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলুন!”
কমরেডগণ,
আপনারা আন্তরিকভাবে পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের মুক্তির জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা গ্রহণ করেছেন, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী উপদলের নেতৃত্বের ভাওতায় পড়ে আপনারা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী উপদলের সাথে জড়িত হয়েছেন।
এ সকল উপদলের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব আপনাদেরকে বিপথে পরিচালনা করে এবং আপনাদের সাথে, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
এরই ফলে পূর্ব বাংলায় ভারতের উপনিবেশ কায়েম হয়েছে; সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এ উপনিবেশিক লুণ্ঠনের ভাগ বসাচ্ছে, তাদের তাবেদার ছয় পাহাড়ের দালালরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের কথা বলে ছয় পাহাড়ের ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। এরই ফলে মহান গণচীনের এবং পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের সর্বহারাদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে; চীন বিরােধী, কমিউনিস্ট বিরােধী প্রতিবিপ্লবী ঘাঁটি গঠন এবং জনমতের সৃষ্টি হয়েছে।
আপনাদের আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রম ভুল পথে ব্যবহৃত হয়ে নিরর্থক হয়েছে।
আসুন, আমরা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী নেতৃত্বের অপরাধসমূহ উদ্ঘাটন করি, এ সকল পুঁজিবাদের পথগামী কর্তৃস্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখােশ উন্মােচিত করি, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি।
নয়া সংশােধনবাদী হক-তােয়াহা-বশির এরা সুদীর্ঘদিন মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী পার্টিতে কাজ করে। এ সময়
পৃষ্ঠা: ২০০