This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
হামদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদন: ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ: স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব (বাছাইকৃত)
ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ (অনুবাদক)
ভূমিকা
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক পটভূমির ক্যানভাস আকারে বিশাল এবং প্রকারে বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি ক্ষেত্র এবং পর্যায় থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এর পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বজনগ্রাহ্য অবয়ব দেওয়া সময় সাপেক্ষ ও কঠিন কাজ। দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য যেকোনাে জাতির ইতিহাস উপলব্ধির ক্ষেত্রে একটি বড়াে মাপের প্রতিবন্ধক। ঘটনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ, স্থান, কাল, দল, মত এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শগত ভেদাভেদের কারণে নৈর্ব্যক্তিকভাবে। দেখবার সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য । তারপরও একটি জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসবােধ সৃষ্টির জন্য ইতিহাস রচনা ও তা চর্চা করার তাগিদ অব্যাহত রাখার প্রয়ােজন রয়েছে। এটি কেবলমাত্র অ্যাকাডেমিক অনুশীলনের জন্য নয় সেইসঙ্গে তা জাতি-চেতনা বিকাশ ও সমুন্নত রাখা এবং উপর্যপরীভাবে তা শক্তিশালী অবস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বস্তুগত বিষয়ের সঙ্গে জাতি-চেতনা একটি জাতি-রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য বিমূর্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বয়স চার দশক অতিক্রম করেছে। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সে তুলনায় অগ্রগতি খুব সামান্য এবং বিতর্ক এড়িয়ে ঐকমতে পৌছবার প্রচেষ্টা খুবই নিম্নমাত্রিক। নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য এখানে একটি বড়াে বাধা।
অত্যন্ত পরিতাপের সাথে উল্লেখ করতে হয় রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য বিভক্ত। তাছাড়া আরও পরিতাপের বিষয় হলাে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী চক্র প্রজন্মান্তরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এখনও সক্রিয় অবস্থানে বহাল রয়েছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্ম দিয়েছি সেই দেশ পাকিস্তান; সম্ভবত আজ পর্যন্ত চেতনাগত দিক থেকে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের জন্ম মেনে নিতে পারেনি; যদিও আনুষ্ঠানিক বা বাহ্যিক স্বীকৃত তারা জানিয়েছে। তাই দেখা যায় ২০১৪ সালে এসেও দেশটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত যুদ্ধ এবং মানবতাবিরােধী অপরাধে অপরাধী এ দেশীয় দালালদের বিচার কার্যক্রম ও রায়ের প্রতি আন্তর্জাতিক ধারা বহির্ভূত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সক্রিয়ভাবে প্রকাশ করে চলেছে। ‘৭১-এ তাদের ঘৃণ্য কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া বা ক্ষমা প্রার্থনা তাে বহু দূরের কথা!
২
হামদুর রহমান কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তারিখে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসম্মানজনকভাবে আত্মসমপর্ণ করেছিল এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পশ্চিম
১১
পাকিস্তানের সীমান্ত ও আজাদ কাশ্মীর একতরফাভাবে হঠাৎ করে ঘােষিত যুদ্ধ বিরতির আহ্বান মেনে নিয়েছিল তা খতিয়ে দেখা এবং সেইসঙ্গে পাকিস্তানের জাতির সামনের দিনগুলােতে যাতে করে এরূপ দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য সুপারিশমালা প্রস্তুত করার লক্ষ্য নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সে সময়ের প্রধান বিচারপতি হামদুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করেন। উক্ত কমিশন। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রতিবেদন (রিপাের্ট) পেশ করে। কমিশন প্রথম পর্যায়ের এই প্রতিবেদনটিকে আপাতস্থায়ীকৃত (টিনটেটিভ) প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য করে। কেননা, কমিশন মনে করেছিল, পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার এবং তার অধীনস্থ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণ ভারতের কারাগারে যুদ্ধবন্দি হিসেবে থাকার কারণে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়নি বিধায় তারা যখন ভারত থেকে ফিরে আসবেন তখন তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে সাময়িকধর্মী প্রতিবেদন প্রয়ােজনবােধে বদলানাে যাবে। ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মকালে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তাগণ ভারতের বন্দিদশা হতে ফিরে এলে ১৯৭৪ সালের ২৫ মে তারিখে আগের করণীয় ঠিক রেখে হামদুর রহমান কমিশনকে পুনরায় নিয়ােগ দেওয়া হয়। এ কারণে দুটি পর্যায়ের জন্য তদন্ত কমিশনের দুটি প্রতিবেদন রয়েছে। তবে প্রথম প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিতীয়বার গঠিত কমিশনের সম্পূরক প্রতিবেদনের মধ্যে পার্থক্য আঁচ করা যায় না।
৩
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতিপক্ষ ও বিরােধিতাকারী পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেড এ. ভুট্টোর নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক মূল্যায়ন যে থাকবে না এটিই স্বাভাবিক। তারপরেও বলা যায়; আলােচ্য কমিশনের প্রতিবেদনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় এবং উপাদান রয়েছে। এ কারণে হামদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন বাঙালির ইতিহাস চর্চার অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই ধারণার দ্বারা তাড়িত হয়ে আমি স্বপ্রণােদিতভাবে কমিশনের রিপাের্টের উল্লেখযােগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাছাই করে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য মাতৃভাষায় রূপান্তরের কাজে হাত দিই। রিপাের্টটি নানাবিধ করণে হয়তাে পূর্ণাঙ্গভাবে পাওয়া যাবে না বা এটি অবিকৃত আছে বা থাকবে তা-ও বলা মুশকিল। এমতাবস্থায় একথা বলা সমীচীন হবে যে ইংরেজি ভাষায় রচিত রিপাের্ট যতটুকু প্রকাশিত অবস্থায় সংগ্রহ করা গিয়েছে তা-ও আংশিক। প্রশ্ন উঠতে পারে ইংরেজি ভাষায় রচিত এবং প্রকাশিত যতটুকু দৃশ্যমান হয়েছে ততটুকু পূর্ণাঙ্গভাবে রূপান্তরের জন্য বিবেচিত হয়নি কেন? আমার তরফ থেকে বলা যায় কমিটির রিপাের্টে অনেক কিছুই রয়েছে যা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বা বিবেচনার যােগ্য নয়, যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়া বা ঐ অঞ্চলের যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ভুলভ্রান্তির বিশ্লেষণ ইত্যাদি। তাছাড়া দুই প্রতিবেদনেই ঘটনা ও বিশ্লেষণে পুনরাবৃত্তি পরিদৃষ্ট হয়েছে। বাংলা ভাষায় রূপান্তর করতে গিয়ে সেই অংশসমূহ যথাসম্ভব পরিহারের
১২
চেষ্টা করা হয়েছে। এ কারণে বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি না করে যৌক্তিকভাবে কিছুটা সঙ্কোচন নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় বিজ্ঞ পাঠক বিষয়টি উপলব্ধির মধ্যে নেবেন। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরন ও ধারণ যথার্থভাবে যাতে করে সমন্বিত করা যায় সেদিকে খেয়াল রেখেই বাছাই পর্বটি পরিচালনা করা হয়েছে। অতএব, বাছাইকৃত হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছুট গিয়েছে এমন কিছু পাওয়া যাবে না বলে নিশ্চিত করা যায়।
৪
হামদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট সরকারের কাছে দাখিল করার পরে তা কড়া নিরাপত্তায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, কমিশন জনসম্মুখে প্রতিবেদনের কার্যবিবরণী প্রকাশ না করার পরামর্শ দিয়েছিল। যদিও সুপারিশ করা হয়েছিল প্রতিবেদন অনুযায়ী যেন তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলাে কমিশনের সুপারিশ মতাে পাকিস্তান সরকার তা বাস্তবায়নের কোনাে কার্যকর পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। অবশ্য একথাও উল্লেখ করা প্রয়ােজন, কমিশনের মূল প্রতিবেদন ক্ষত-বিক্ষত এবং তা রাজনৈতিক সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযােগ রয়েছে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তার ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিবেদনের কিছু পৃষ্ঠা আংশিক সংশােধন করে তার নিজের অবস্থান কলুষমুক্ত করেছিলেন বলে গুজব রয়েছে। উল্লেখ, ভুট্টো কর্তৃক গঠিত একটি উপ-কমিটি প্রতিবেদন পাঠপূর্বক তা জনসম্মুখে প্রকাশ না করার সুপারিশ করেছিল।
প্রায় পঁচিশ বছর প্রতিবেদন নিরাপত্তা সহকারে সংরক্ষণের পরেও ফাঁক-ফোকর দিয়ে ২০০০ সালের আগস্ট মাসে ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডে প্রতিবেদনের সম্পূরক অংশের কয়েকটি অধ্যায় প্রকাশ করে দেয়।
এতে পাকিস্তানে ব্যাপক চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় একই বছর (২০০০) ডিসেম্বর মাসে সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জনাব পারভেজ মােশাররফ প্রতিবেদনের অংশবিশেষ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তী সময় তিনি জনমতের চাপে স্পর্শকাতর অংশ গােপন রেখে বাদবাকি অংশ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এজন্য পাকিস্তানি পিপলস পার্টির তরফ থেকে অভিযােগ করে বলা হয়, একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের ঘটনায় জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করার অসৎ উদ্দেশ্যে মােশাররফের সামরিক সরকার প্রতিবেদনটিতে অতিরিক্ত কিছু পৃষ্ঠার মাধ্যমে বিবৃতি সংযােজন করেছে। তাই দেখা যায় হামদুর রহমান কমিশনের রিপাের্টটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে ওঠে। তাছাড়া একথাও বলা যায়, প্রকাশিত (খণ্ডিত) প্রতিবেদন। হয়তাে কোনােদিনও পূর্ণাঙ্গ রূপ অর্জন করবে না। এমতাবস্থায় বিভিন্ন উৎস হতে সংগ্রহ করে রিপাের্টের বাছাইকৃত অংশ বাংলা ভাষায় রূপান্তরের চেষ্টা করা হলাে। খণ্ডিত হলেও ঘটনার পরিপূর্ণতা এবং ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়েছে। আশা করা যায় বাংলাভাষী পাঠক সমাজ এই কাজটির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং মুদ্রার উল্টো দিক দেখার সুযােগ পাবেন।
১৩
৫
আমি মনে করি হামদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন স্বব্যাখ্যাত। তারপরও পাঠককে আগামভাবে প্রভাবিত করার ইচ্ছা ছাড়াই আমি আমার পক্ষ হতে এ বিষয়ে কিছু অতি সংক্ষেপে মূল্যায়ন তুলে ধরতে চাই। এবং এ কথাও বলতে চাই, এ মূল্যায়ন একান্তই আমার নিজের।
প্রতিবেদনটিতে পাক-ভারত উপমহাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে; সম্ভব প্রতিবেদনের পটভূমি তৈরির উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি গভীর মনােযােগের সঙ্গে তা পাঠ করেছি এবং লক্ষ করেছি বিবৃত এই ইতিহাসে কার্যত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের যৌক্তিকতাকে উর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সচরাচর ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টির আদলে। তাই এতে নতুনত্ব কিছু নেই। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ইতিহাসের ঘটনাবলি ব্যাখ্যাত হয়েছে। শব্দ চয়নেও সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ যথার্থভাবে ফুটে উঠেছে, যেমন প্রায়ই হিন্দুরা-মুসলমানেরা ধরনের শব্দাবলি ব্যবহৃত হয়েছে। বলাবাহুল্য, ইতিহাস রচনায় এধরনের অ্যাপ্রােচ কেবল অযথার্থ তা-ই নয়, সেইসঙ্গে তা অযৌতিক। ‘৭১-এর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে ভারতপাকিস্তানের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলা চলে কমিশন নিরক্ষেপতা’ ধরে রাখতে পারেনি। এ পর্যায়ে কমিশনের ইতিহাস মূল্যায়নের ধারার ভ্রান্তি সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ষড়যন্ত্রকারী এবং মেধাহীন রাজনৈতিক হিসেবে তকমা লাগানাের প্রচেষ্টাও তেমনি যথার্থ নয় বলে মনে করা যায়। রাজনীতির স্বার্থে একজন রাজনৈতিক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল নেবেন- এটি রাজনীতির ব্যাকরণ বহির্ভূত নয় । তবে সেই কৌশলকে মাধ্যম হিসেবে না দেখে লক্ষ্য হিসেবে দেখাটি বিজ্ঞচিত নয়। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার এ দেশীও দোষরদের হাতে কতজন প্রাণ হারিয়েছেন সে সংখ্যা যদিও সর্বতােভাবে সঠিক করে বলা মুশকিল; তারপরও প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তার বিশ্বাসযােগ্যতা নেই। অর্থাৎ কমিশন বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। এবং এ বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা অবাস্তব ও অনুমাননির্ভর। তাই বাঙালি পাঠকদের এ সম্পর্কে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনাে সুযােগ নেই।
তবে হামদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদনে পূর্বাঞ্চলে (স্বাধীন বাংলাদেশে) ‘৭১-এর পুরাে নয় মাসব্যাপী পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগের চিত্র সীমিত; কিন্তু পরিষ্কার ও সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের পক্ষ হতে কমিশন আংশিক ধন্যবাদ পাওয়ার যােগ্যতা রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকে পাশ কাটিয়ে অদ্যাবধি পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং সম্ভবত জনগণের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করে না বা করতে চায় না। দ্বিতীয়ত, হামদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদনে দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানের সেনা সদস্যদের এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনৈতিক কার্যকলাপ তথ্য প্রমাণসহ উন্মােচন করা হয়েছে। মদ্যপান, নারী লালুপতা, বেআইনি ব্যবসায়-বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতি এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারের অসংখ্য নজীর চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ভীরুতা, কাপুরুষতার চালচিত্রও বাদ যায়নি। সেইসঙ্গে ১৯৫৮ সালের সেনা অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে
১৪
বেসামরিক প্রশাসনের অংশীদারিত্ব এবং এমনকি নেতৃত্ব গ্রহণের সুযােগ লাভের ফলে | সেনা কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার মাত্রা যে গুরুত্বভাবে হ্রাস পেয়েছিল- এ বিষয়ে প্রথাগত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বের বাস্তব দৃষ্টান্তও প্রতিবেদনের মাধ্যমে উন্মােচিত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, হামদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং দালিলিক উপাত্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। প্রতিবেদনটির বাছাইকৃত অংশ বাংলা ভাষায় রূপান্তরের কাজটি আমি কতটুকু সম্পন্ন করতে পেরেছি তা বিচারের ভার পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। কোনাে ভুল-ভ্রান্তি দেখিয়ে দিলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। প্রতিবেদনটি ধৈর্য ও দক্ষতার সঙ্গে কম্পােজ করার জন্য আমি কমলেশ ধরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনিন্দ্য প্রকাশের প্রকাশক জনাব মােঃ আফজাল হােসেনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মাঘ ১৪২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
ড. মােহাম্মদ আবদুর রশীদ
প্রফেসর (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
গাজীপুর
১৫
৩১
সার-সংক্ষেপ এবং সুপারিশ
ক. সার-সংক্ষেপ
১। ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই কমিশন নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়। কমিশনের কাজ হলাে কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে অসম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত ও আজাদ কাশ্মীরে একতরফাভাবে হঠাৎ করে ঘােষিত যুদ্ধ বিরতির আহ্বান মেনে নিয়েছিল তা খতিয়ে দেখা। ২১৩ জন সাক্ষী এবং বহুসংখ্যক নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে এই মন্তব্যে উপনীত হওয়া যায় যে, অধঃপতনটি ছিল রাজনৈতিক, নৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামরিক পরিস্থিতি ও উপাদানগুলাের ক্রমবর্ধমান ফলাফল। আমরা সেজন্য এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সামরিক বিষয়ের ভিতর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেদের সীমিত করে রাখব না।
২। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের আবির্ভাব ঘটেছিল “অনিয়ন্ত্রিত ইতিহাসের” শেষ মিনিটের বিশেষ ছাড় হিসেবে। যেখানে কাজ করেছিল; মােটেই ক্ষুদ্র নয় এমন পরিমাপে ব্রিটিশ শাসকদের ‘ভেদ কর এবং শাসন কর’ এই কুচক্রী নীতি। এ বিষয়টি আবশ্যকীয়ভাবে যে ফলাফল বয়ে আনে তা হলাে, উপমহাদেশে। বসবাসকারী দুটি প্রধান সম্প্রদায়, যথা : হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের অনুভূতি।
৩। হিন্দুরা যে আধিপত্য অর্জন করেছিল তা ছিল মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের নীতি ও মনােভাবের রেডিক্যাল পরিবর্তনের ফলশ্রুতি। মুসলমানেরা যে কেবলমাত্র অস্পৃশ্যভাবে ঘৃণিত হতাে তাই নয়, সেইসঙ্গে তারা মনে করতেন এক সময়ে তারা ছিলেন বিদেশি দখলদার (বিজয়ী)। তারা এদেশ হাজার বছরের অধিক সময়ব্যাপী শাসন করেছিলেন। ১৮৫৮ সালে রানি কর্তৃক ঘােষিত আজ্ঞাপত্ৰ দ্বারা ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভব ঘটেছিল। এগুলাের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখানে স্বায়ত্তশাসিত-সরকার প্রতিষ্ঠিত করা। সে অবস্থায় হিন্দুরা সমগ্র উপমহাদেশে হিন্দুরাজ কায়েম করার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেন। আর সেজন্য দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা আরও বাড়তে থাকে। দুটি সম্প্রদায়ের ভিতর ক্রমাগত অধিক থেকে অধিকতরভাবে প্রায়ই তুচ্ছ ঘটনায় সংঘাত শুরু হতে থাকে। যদিও এসবের মূল কারণ ছিল সবসময়ই আগাগােড়া রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনােভাব।
৪। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ ছিল খাটিভাবে প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত পরিকল্পনা। কিন্তু অস্বাভাবিক ও মারাত্মক বিদ্বেষপূর্ণভাবে হিন্দুরা এর
১৭
বিরােধিতা করে। এর কারণ, এর ভিতর দিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে যে প্রদেশ গঠিত হয়েছিল সেখানে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশরা হিন্দুদের। আন্দোলনের জের ধরে বঙ্গভঙ্গ রদ করেন। এই ঘটনা মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হওয়ার মতাে চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের। আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলােতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়েছিল। হিন্দুরা এটিকে সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের স্বপ্নের আধিপত্যের ওপর মারাত্মক অভিঘাত হিসেবে দেখেছিলেন, এমনকি পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু পরবর্তীতে এ ঘটনাকে “পাকিস্তানের ছায়া” হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ১৯১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী মি. মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর (কায়েদ-ই-আজম) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তিটি লক্ষ্মৌ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এই চুক্তি হয়েছিল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে। এতে কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাই যে মেনে নেওয়া হয়েছিল তাই নয়, সেইসঙ্গে জনসংখ্যার হারের চেয়েও অ্যাসেমব্লিতে ‘ওয়েটেজ’-এর স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহেরু রিপাের্টে (সর্বদলীয় কনফারেন্সে পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব প্রস্তুত করেন) পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বিলােপের সুপারিশ করা হয়। সেইসঙ্গে অন্যান্য উপায়সমূহের কথা বলা হয় যাতে করে মুসলমানরা তাদের রাজনীতির পায়ের তলায় মাটির জন্য কংগ্রেসের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে মুসলমানরা কলকাতা কনফারেন্সে এটির বিরােধিতা করেন। কিন্তু যখন মুসলমানদের বিরােধিতা উপেক্ষা করে খসড়া সংবিধান গৃহীত হয় তখন মুসলমানরা কায়েদ-ই-আযমের নেতৃত্বে ‘ওয়াক আউট করেন এবং পরবর্তীতে ঘােষণা করেন যে, এটি বিভক্তির পদক্ষেপ বৈ কিছু নয়। তথাপিও, ১৯২৯ সালে, মুসলিম লীগ শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ১৪ দফা দাবি উত্থাপন করে। এর লক্ষ্য ছিল যাতে করে ন্যূনতম সহযােগিতা অর্জন করে কংগ্রেসের সঙ্গে একত্রে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা যায়।
৫। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বাস্তবায়নের মুখে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে পুনরায় একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তিতে বলা হয় উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের পর উভয় দল একত্রে মিলিত হয়ে সরকার গঠন করবে। কংগ্রেস উক্ত নির্বাচনে বিপুল বিজয়সহ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু চুক্তি মােতাবেক মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনে অসম্মত হয়। তারা বলেন যে, মুসলমানরা সরকারে যােগ দিতে পারেন কেবলমাত্র কংগ্রেস দলের সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে। এই ঘটনা মুসলমানদের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা নিশ্চিত হন যে, তাদের পূর্বানুমান মতাে হিন্দুরা কখনাে মুসলমানদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবেন না। ভারতের ১১টি প্রদেশের ৮টিতে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সরকার গঠন করে যে আচরণের প্রকাশ ঘটায় তার দ্বারা বিষয়টি পুনরায় প্রমাণিত হয়। ঐ সব প্রদেশে মুসলমানদের হিন্দি জানা বাধ্যতামূলক করা হয় । তাদের মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যা মন্দির’ গ্রহণ করা এবং বন্দে মাতরম’ আবৃত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনকি ঈদ-উল-আযহায়
১৮
গােরু কোরবানি দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলিম লীগের অনুকূলে করা দুটি প্রতিবেদন, যেমন পীরপুর প্রতিবেদন এবং শরীফ প্রতিবেদন যা ১৯৩৯ সালে প্রস্তুত করা হয়েছিল তাতে কংগ্রেস শাসনে মুসলমানদের নির্দয় ভােগান্তির কথা উল্লেখ করা হয়। জনাব ফজলুল হক বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হিসেবে এই প্রতিবাদে অংশ নেন। এখন ব্রিটিশ লেখকেরাও স্বীকার করেন যে, ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সময়ে। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলােতে সরকারের আচরণই হলাে দ্বি-জাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ।
৬। অপ্রীতিকর অবস্থা বৃদ্ধি পেয়ে এমন এক পরিস্থিতিতে পৌছায় যার দরুন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে মিলিত হয়ে একটি রেজুলেশন প্রস্তাব করে। এ প্রস্তাবে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় স্বাধীন সরকারসমূহ স্থাপনের কথা বলা হয়। এই রেজুলেশনটি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহােরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনাব ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত হয় এবং সর্বসম্মতভাবে ২৪ মার্চ, ১৯৪০ সালে গৃহীত হয়। এই রেজুলেশনে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি উল্লেখ ছিল না। সেখানে কেবলমাত্র দাবি করা হয় যে, “ভৌগােলিকভাবে সংলগ্ন যেসব ইউনিটগুলাে অঞ্চল দ্বারা বিভক্ত সেখানে প্রয়ােজনবােধে তা ভূখণ্ডগতভাবে পুনঃবিন্যাস করে ক্রমবর্ধমান হারে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ যেমনউত্তর-পশ্চিম এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা একত্রিত করে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে।”
৭। এই রেজুলেশনটি অবশ্য, পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লীগের। আইন প্রণেতাদের এক কনভেনশনে সংশােধন করে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, “মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ও আসামের উত্তর-পূর্ব এলাকা এবং পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু-বেলুচিস্তান এলাকা পাকিস্তান এলাকা নামে পরিচিত হবে, যেখানে মুসলমানগণ প্রভাবশালীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ঐ সকল এলাকা একত্রিত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে।” বাংলার মুসলমানগণসহ ছাঁচটি এভাবে উত্থাপন করা হয়েছিল যে এতে অনুভব করা গিয়েছিল তাদের সামনে এর কোনাে প্রকার বিকল্প আর অবশিষ্ট নেই।
৮। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে হিন্দুরা সাংঘাতিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলােতে মুসলমান নিধনযজ্ঞ আরম্ভ করে দেয় । সৌভাগ্যক্রমে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে যখন জাপান ভারতের দরজায় করাঘাত করছিল তখন কংগ্রেস, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করে দেয়। এর ফলে সমস্ত প্রদেশে কংগ্রেসের সরকারের পতন ঘটানাে হয় এবং সকল কংগ্রেস নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয় । মুসলমানগণ এ দিনটিকে “নাজাত দিবস” হিসেবে উদ্যাপন করে। কায়দ-ই-আযম ব্রিটিশদের “ভারত ভাগ করে চলে যাবার জন্য আহ্বান জানান।
৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধাবসানের পরে, যখন যুক্তরাজ্যে শ্রমিক দল ক্ষমতাসীন হয়, তখন নীতি পরিবর্তন করে হিন্দুরা পুনরায় কোয়ালিশন শুরু করতে তৎপর হয়। ব্রিটিশ সরকার স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে নতুন প্রস্তাবসহ ভারতে প্রেরণ করে। তার প্রস্তাবের মূল
১৯
বক্তব্য ছিল ভারতে দুই অথবা ততােধিক স্বাধীন ইউনিয়ন গঠন করা। কংগ্রেস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এর ধারাবাহিকতায় ওয়াভেল পরিকল্পনা পেশ করা হয়। এতে বলা হয় ভারতের প্রদেশসমূহে তাৎক্ষণিকভাবে জনপ্রিয় প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হবে। ১৯৪৫ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।* সে নির্বাচনে মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় আইন সভার প্রতিটি মুসলমান আসনে জয়ী হয়। তথাপিও কংগ্রেস উপযুপরিভাবে দাবি জানাতে থাকে যে, তারা হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই প্রতিনিধিত্ব করছে। সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকার ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের সমন্বয়ে আরও একটি মিশন প্রেরণ করে। এ মিশনটিও পরিকল্পনা এঁকে বসে যেন তাৎক্ষণিকভাবে ভারতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়। প্রস্তাব মতে এটি গঠিত হবে হিন্দু-মুসলমান সমতার ভিত্তিতে। একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হয়; যেখানে তিন স্তর (টায়ার) বিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। এতে কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র বিদেশ সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যােগাযােগের দায়িত্ব অর্পিত থাকবে। তিনটি ভিন্ন গােষ্ঠীর দ্বারা গঠিতব্য প্রদেশসমূহ হবে যথাক্রমে- রাজ্যসমূহ, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ নিয়ে। এই পরিকল্পনা মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত হলেও কংগ্রেস দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটির বিষয়ে কিছু আপত্তিসহ তা গ্রহণ করে। পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু ওই পরিকল্পনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে শুরু করেন এবং এর মূল লক্ষ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। অবশেষে কংগ্রেস চূড়ান্তভাবে পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে। পরিকল্পনাটির ব্যর্থতা সত্ত্বেও ব্রিটিশরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা গঠনের প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে যান। মুসলিম লীগ এর বিরােধিতা করে এবং প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের (ডাইরেক্ট অ্যাকশন) ডাক দেয়; যাতে করে ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাইয়ের প্রস্তাব মােতাবেক পাকিস্তান অর্জন করা যায়।
১০। ১৯৪৬ সালের ১৪ আগস্ট মুসলিম লীগ ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ দিন পালন করে। কিন্তু কলকাতা শহরে হিন্দুরা মুসলমানদের ঐদিনে প্রস্তাবিত জনসভায় যােগদান উপলক্ষ্যে আসা প্রতিটি মিছিলে সহিংস আক্রমণ চালায়। কলকাতায় এই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে (হলােকাস্ট) ২০,০০০ মানুষ দাঙ্গায় প্রাণ হারান। এর জের হিসেবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে আরও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারান। এ ঘটনার পরে এমনকি ব্রিটিশ এবং হিন্দুরা অনুভব করতে পারেন যে, ভারত বিভক্ত করা ব্যতীত অন্য কোনাে উপায় নেই।
১১। ভারত ত্যাগের উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ব্রিটিশ সরকার লর্ড ওয়াভেলকে সরিয়ে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে আর্ল অব মাউন্টব্যাটেনকে দায়িত্ব অর্পণ করে । কেননা, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ব্রিটিশরাজ অবসানের লক্ষ্যে একটি তারিখ নির্ধারণের ওপর জোর দিতে থাকেন। এই শর্তে যে, পূর্ব নজির মােতাবেক অফিসের দায়িত্ব নেবেন। ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে এই ঘােষণাটি দেওয়া হয়েছিল।
—————————————————————–
* সালটি কমিশন ভুলভাবে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে।-অনুবাদক।
———————————————————–
২০
এই ঘােষণা অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের জুন মাস নাগাদ সময়ের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু আর্ল অব মাউন্টব্যাটেন কায়েদ-ই-আযমকে বাধ্য করেন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের বিভক্ত মেনে নিতে। এভাবেই পাঞ্জাব এবং বাংলা বিভক্ত হয়। আসাম জেলার সিলেট এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এই ইস্যুতে গণভােট অনুষ্ঠিত হয়। তারপর এলাে রেডক্লিফ এওয়ার্ড, যার ভিতর দিয়ে দুটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা; যেমন- বাংলার অধীনে মুর্শিদাবাদ এবং পাঞ্জাবের অধীন গুরুদাসপুর ভারতের হস্তগত হয়। যদিও প্রারম্ভিক পরিকল্পনায় এ দুটি জেলা পাকিস্তানের ভাগে বণ্টন করা হয়েছিল।
১২। উজানের মুর্শিদাবাদ জেলায় হুগলী নদী গঙ্গা নদী থেকে দুটি শাখায় বিভক্ত করা হয়। অনুরূপভাবে, জম্মু ও কাশ্মীরের যােগাযােগের একমাত্র রাস্তা তখন গুরুদাসপুর জেলার ভিতর দিয়ে চলাচল ছিল। এ দুটি বিষয়ই মুসলিম লীগ মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৩। এ দেশ বিভক্তির সিদ্ধান্ত যদিও কংগ্রেস মেনে নিয়েছিল, কিন্তু তা হিন্দু-আমজনতা মেনে নিতে পারেননি। সে মতাে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। ফলে কার্যত সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা নিয়ে পরিস্থিতি বিস্ফোরিত ও স্ফীত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হন। মহিলাদের অপহরণ করা হয়। মিলিয়ন মিলিয়ন গৃহহীন মানুষ দুর্যোগের মুখােমুখি হয়ে পড়েন। বিরাট সংখ্যক মুসলমান উদ্বাস্তু ভারত থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসতে থাকেন। অনুরূপভাবে, ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু পাকিস্তান থেকে ভারতে অভিবাসী হতে থাকেন। উদ্বাস্তুদের এই স্রোত বাধা দেওয়ার জন্য একটি সীমান্ত বাহিনী গঠন করা হলেও তা সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে যায়। কেননা, সে সকল বাহিনী সাম্প্রদায়িকতার দোষ থেকে মুক্ত ছিল না। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে এটি ভেঙে দেওয়া হয়।
১৪। কায়েদ-ই-আযম কর্তৃক পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হওয়ার বিষয়টি স্বীকৃত হলে আর্ল অব মাউন্টব্যাটেন অসন্তুষ্ট হন। এটি পুনরায় পাকিস্তানের আর্থিক এবং প্রশাসনিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রিজার্ভ ব্যাংক হতে পাকিস্তানের পাওনা নগদ টাকা প্রদানের বিষয়ে রাজি হয়েও তা ছাড় দেওয়া হয়নি। অনুরােধ সত্ত্বেও কোনাে ব্রিটিশ বাহিনীকে উদ্বাস্তুদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নিয়ােগ করা হয়নি। দা নবেল আর্ল তার নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে মহারাজার পদমর্যাদা ভারতের কাশ্মীর থেকে নিরাপদ করেন। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির চুক্তি করতে সক্ষম হয়। একটি যুদ্ধবিরতি রেখা টানা হয় । সেই যুদ্ধবিরতি রেখার প্রান্তে উভয় দেশের সৈন্য-সামন্ত অবস্থান নেন।
১৫। ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করার জন্য একটি রাজনৈতিক মেশিনারী’ গঠন করা হয়। কায়েদ-ই-আযমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয়, এবং মৌলবি তমিজউদ্দিন হন স্পিকার। এটি ফেডারেল আইন সভা হিসেবে কাজ করে। উদ্বাস্তু সমস্যা ও তাদের পুনর্বাসনের বিষয় এবং প্রশাসন স্থাপনের কাজের দ্বারা বিপুলভাবে ভারাক্রান্ত সরকার সংবিধান প্রস্তুতের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে প্রধানত জরুরি ক্ষমতার দ্বারা গভর্নর জেনারেল দেশের শাসনের কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, নিখিল-ভারত মুসলিম লীগ
২১
ভেঙে দিয়ে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠন করা হবে; তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ব্যক্তিগত রেষারেষি সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। জনাব সােহরাওয়ার্দীকে পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগের কাউন্সিল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ ঘটনা কার্যত পূর্ববঙ্গে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কাজটি সংঘটিত করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এবং মৌলানা ভাসানীও এই নতুন দলের নেতৃত্বে চলে আসেন। পাঞ্জাবে, মুসলিম লীগের অসন্তুষ্ট নেতারা জিন্নাহ আওয়ামী লীগ গঠন করেন। মামদুদের নবাব, যাকে পাঞ্জাবের মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানানাে হয়; তিনি তা গঠন করতে গিয়ে দারুণ সংকট দেখতে পান; কার্যত বিদ্রোহীদের কার্যকলাপের কারণে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। সিন্ধুতে জনাব খুরােকে দুর্নীতির অভিযােগে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি। তখনও প্রাদেশিক মুসলিম লীগে তাঁর আধিপত্য বজায় রাখেন। ফলে সেখানে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এমনকি তিনি করাচিতে কেন্দ্রীয় রাজধানী করার বিরােধিতার প্রচারণায় নেমে পড়েন। এই প্রচারণা এতটাই শক্তিমত্তা সৃষ্টি করেছিল যে, পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে যাতে চলে না যায় সেজন্য কায়েদ-ই-আযম নিজে হস্তক্ষেপ করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাকিস্তানের কাছে ঋণী থাকতে অস্বীকৃতি জানানাের কারণে ডা. খান সাহেব ক্ষমতাচ্যুত হন। খান আব্দুল কাইয়ুম খান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। লীগের বিরােধ পূর্ববঙ্গে তুঙ্গে ওঠে। কায়েদ-ই-আযম নিজে সেই বিরােধ মীমাংসার উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ সফর করেন।
১৬। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে কায়েদ-ই-আযমের মৃত্যু জাতির জন্য ছিল একটি বিরাট মাপের আঘাত। খাজা নাজিমউদ্দীন গভর্নর জেনারেল হিসেবে তার স্থলাভিসিক্ত হন। জনাব নূরুল আমিন পূর্ববঙ্গের চীফ মিনিস্টার হন। ইত্যবসরে হিন্দুরা পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন এজন্য মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে হিন্দুদের সদস্যপদ গ্রহণের উপযােগী করে তােলা হয়।
১৭। মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থিরাও আওয়ামী লীগের মধ্যে স্থান পেতে শুরু করেন। তাঁরা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ভেঙে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। ইতােমধ্যে ১৯৫০ সালে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তানেও মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ভারত সফরে যান। সেখানে তিনি তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলােচনা করেন। ১৯৫০ সালে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তুষ্টি আঁচ করতে সক্ষম হন, কেননা, সংবিধান প্রণয়ন ও নতুন নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছিল। ফলে তিনি গণপরিষদ কার্যকর করতে সচেষ্ট হন। মূল সংবিধান কমিটি ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মতাে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদন কারও কাছেই গ্রহণযােগ্যতা পায়নি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এত প্রবল ছিল যে, সেই প্রতিবেদন পুনর্বিবেচনার জন্য গণপরিষদে ফেরত নেওয়া হয়।
১৮। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে আরও একটি সাংঘাতিক পরিস্থিতি নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়। এটি আবিষ্কৃত হলাে যে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে
২২
লিপ্ত আছেন। সৌভাগ্যক্রমে এই চক্রটিকে কুঁড়ি অবস্থায়ই ছিড়ে ফেলা হয় । ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের মুখােমুখি করা হয়। এটি রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র’ ঘটনা নামে পরিচিত। ১৯৫১ সালের অক্টোবরের যথাশীঘ্র পরেই প্রধানমন্ত্রী হত্যার শিকার হন। সেই সময় তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। হত্যাকারীকে তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলা হয় এবং তাঁকে জনগণ হত্যা করে। যদিও সেই অপরাধ অদ্যাবধি অনাবিস্কৃতই রয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ আবার অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে পড়ে। খাজা নাজিমউদ্দীন, বিরােধিতার পরও গভর্নর জেনারেল-এর পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি জনাব গােলাম মােহাম্মদকে গভর্নর জেনারেল করতে সুপারিশ করেন। খাজা নাজিমউদ্দীন যদিও খােদাভীতু এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু দুঃসাধ্য রকমের অফিস চালানাের জন্য তেমন যােগ্যতা তাঁর ছিল না।
১৯। তার দায়িত্বপালনকালীন সময়ে মুসলিম লীগের সংহতি অধিকতরভাবে বিনষ্ট হয়েছিল । এর সুস্পষ্ট ও প্রধান কারণ ছিল মূলত নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনােভাব এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকে। দেশে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্যের ঘাটতি প্রকটভাবে দেখা দেয়। রাজনীতিবিদগণ দেশের সংবিধানের ধরন কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। গণপরিষদ ১৯৫২ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় খসড়া চূড়ান্ত করে। কিন্তু আবারও তা পাঞ্জাবের গ্রহণযােগ্যতা পায়নি। কারণ উচ্চকক্ষে এই খসড়ায় উভয় অঞ্চলের জন্য সমান সমান প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়েছিল। তারা প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিট হতে সমান সমান প্রতিনিধিত্বের দাবি জানিয়ে আসছিলেন, সেক্ষেত্রে ইউনিটের ভৌগােলিক আকার ও জনসংখ্যা যাই হােক না কেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এটিই ছিল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। পূর্ববঙ্গ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের দাবি জানিয়ে আসছিল । বিষয়টি পুরােপুরিভাবে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। খাজা নাজিমউদ্দীন উভয় অংশের মধ্যে সমতার তত্ত্ব (প্যারিটি) আবিষ্কারের মাধ্যমে তফাত ঘােচানাের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এজন্য খাজা সাহেব পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় অংশেই অ-জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। লাহােরে কাদিয়ানী-বিরােধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ মনে করেন তারা। খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে তাকে লক্ষ করেই এটি আরম্ভ করেছিলেন। অন্যরা মনে করেন ধর্মের প্রতি খাজা সাহেবের সহনশীল মনােভাবই এ সমস্যা এগিয়ে নিয়েছিল। সে যাই হােক না কেন, আমলারা এটিকে একটি অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্তমূলক কার্যক্রম শুরু করে দেন।
২০। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। জনগণ নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা এবং উভয় অংশের মধ্যে অসম উন্নয়নের বিষয় নিয়ে সােচ্চার হতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে বিরােধী দলগুলাের দ্বারা উদ্দীপনা পেয়ে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদায় আনার দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন আরম্ভ করেন। সেসঙ্গে তারা নতুন নির্বাচনেরও দাবি জানান। পাঞ্জাবে এ ধরনের নির্বাচন ইতােমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫২ সালের প্রারম্ভে ভাষা আন্দোলন ওপরে উঠে আসে। সেই সময় প্রাদেশিক আইনসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর্যায়ে ছিল । ছাত্ররা হরতালের ডাক দেন এবং একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
২৩
প্রাদেশিক আইনসভা ভবনের আশেপাশে বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল; যাতে করে আইনসভার সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করা যায়; যেন তারা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সুপারিশসহ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ছাত্ররা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। গুলিবর্ষণ করা হয়। কিছু সংখ্যক ছাত্র নিহত হন। সরকার অতিরিক্ত জরুরি ক্ষমতা প্রয়ােগ করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়াস পায়। একটি আদেশের বলে পূর্ববঙ্গে সােহরাওয়ার্দীর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও মৌলানা ভাসানীসহ অপরাপর অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাকে কারাগারে নেওয়া হয়।
২১। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধুতেও রাজনৈতিক পরিস্থতি খারাপের দিকে চলে যায়। খান আব্দুল কাইয়ুম খান এবং জনাব খুররাে পুনর্বার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই পর্যায়ে গভর্নর জেনারেল জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তাহীনতার সুযােগে তাঁকে ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে গতিচ্যুত করেন। ঠিক এর এক মাস আগে তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন সভায় বাজেট পাশ করিয়ে নেন। ধরে নেওয়া যায়; তাঁর ওপর আইন সভায় সে সময় আস্থা ও বিশ্বাস অটুট ছিল ।
২২। এই দিনটি এ কারণে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজার দিন বলে চিহ্নিত করা হয়। রাজনীতিবিদদের মনােবলহীনতা এবং ঔচিত্যবােধবিবর্জিত কর্মকাণ্ডের দরুন তারা এই পরিবর্তন দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেন। আমেরিকা থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী আমদানি করা হয়। সেখানে তিনি দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি এমনকি আইন পরিষদের কোনাে নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন না । তিনি একান্ত বাধ্যানুগতভাবে এ প্রস্তাব মেনে নেন। তিনি মুসলিম লীগ দলের নির্বাচিত নেতা হন। এই পরিবর্তনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলাে সংসদীয় ঐতিহ্য উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফকে মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
২৩। এই সময়টি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে মােড় ফেরার সময় হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি পরিত্যাগ করে তার বদলে পাকিস্তান ১৯৫৪ সালের মে মাসে আমেরিকার সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযােগিতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তারপর সেইসঙ্গে বাগদাদ (সেনন্টো” এবং “সিয়েটো’) চুক্তিতে প্রবেশ করে।
২৪। নতুন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার জনাব মােহাম্মদ আলী পুনরায় কিছুটা পরিবর্তন স্বাপেক্ষে গৃহীত সমতার নীতি (প্যারিটি ফরমুলা) অনুযায়ী দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের প্রচেষ্টা চালান। উভয় কক্ষের যুক্ত অধিবেশনে সমতার (প্যারিটির) বিষয়টি উভয় অংশের মধ্যে নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হন। এ বিষয়টির আরও সুরক্ষা প্রদানের জন্য বলা হয় যে, কোনাে বিশেষ অংশের কোনাে প্রকার সুবিধা-অসুবিধার দিকটি ওই অংশের কমপক্ষে সমস্ত সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ উপস্থিতিতে অ্যাসেমব্লির ভােটের মাধ্যমে সুরাহা করা হবে। প্রত্যাশা করা হয়েছিল এই ফর্মুলা গ্রহণের ভিতর দিয়ে একটি নতুন সংবিধান শীঘ্রই উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত ভিন্নপথে পরিচালিত হয়। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল অ্যাসেমব্লি গঠনের কাঠামােটি বদলে দেয়। এই
২৪
নির্বাচনে জনাব ফজলুল হক, জনাব সােহরাওয়ার্দী এবং মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত বিরােধী জোটের (যুক্তফ্রন্ট) কাছে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে। এই অ্যাসেমব্লিতে মুসলিম লীগের (এমনকি) ১৫টি আসনও ছিল না।
২৫। মুসলিম লীগের সঙ্গে গভর্নর-জেনারেল নিজেও এভাবে পুনরায় দুর্বল হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় আমলারা হয়ে ওঠেন উত্তম অবস্থাসম্পন্ন। তারা সরকার ও গভর্নর জেনারেলকে তাদের মতাে করে নির্দেশ প্রদান করতে থাকেন। এটি সেমতাে নিষ্পত্তি করার জন্য পুনরায় পূর্ব পাকিস্তান জনাব ফজলুর রহমানের দ্বারা নেতৃত্বপ্রাপ্ত হতে থাকে। তিনি অষ্ক্রিতার সাথে; যাকে সে সময় বলা হতাে ‘রেকর্ড সময়’ এর ভিতরে যেকোনাে আইনসভাকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে বিল পাশ করতে হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়, যার বক্তব্য ছিল যেমন—
ক) মন্ত্রিপরিষদের দায়িত্ব হবে যৌথ;
খ) যেকোনাে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার অর্থ হবে সমগ্র মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা; এবং
গ) গভর্নর-জেনারেল মন্ত্রিসভার পরামর্শ মােতাবেক কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। গভর্নর জেনারেল তখন পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণরত ছিলেন। ফিরে এসে জানতে পারেন যে, আইনসভা তার ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে, ১৯৪৯ সালের ‘পাবলিক অ্যান্ড রিপ্রেজেনটেটিভ অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অ্যাক্ট’, অতীতের ক্ষেত্রে প্রযােজ্যসহ প্রয়ােগ করে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মােকাবিলা করেন। গণপরিষদ বাতিল ঘােষণা করেন; এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে যে, অ্যাসেমব্লি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। স্পিকার আদালতের নিকট বিচার চেয়ে গভর্নর জেনারেলের এ কাজের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি হাইকোর্টে জয়ী হন। কিন্তু আপিল আদালত অর্থাৎ ফেডারেল আদালত রায় দেয় যে, এ আবেদন গ্রহণযােগ্য নয়। কেননা, যে আইনের বলে এই আবেদন জানানাে হয়েছে তা একটি অকার্যকর আইন। কেননা এখানে গভর্নর-জেনারেলের সম্মতি গ্রহণ করা হয়নি। গভর্নর জেনারেল আইনি লড়াইয়ে প্রথম স্তরে জিতলেও তিনি তার ভুল সংশােধনের জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। কিন্তু অকার্যকর আইন বিষয়ে আদালত পুনরায় ঘােষণা দেয় যে, অকার্যকর আইন কার্যকর করার কোনাে সাংবিধানিক পদক্ষেপ যা ইতােমধ্যে অ্যাসেমব্লি কর্তৃক গৃহীত তা গভর্নর জেনারেল করার ক্ষমতা রাখেন না। গভর্নর জেনারেল তখন ফেডারেল আদালতের রেফারেন্স প্রার্থনা করেন। আদালতের তখন সরকারকে উপদেশ দেন যে আদালতের নির্দেশিত পথ ধরে একটি নতুন অ্যাসেমব্লি গঠন করতে হবে। নতুন একটি অ্যাসেমব্লি গঠন করা হয় আদালতের দ্বারা নির্ধারিত নীতিমালার ভিত্তিতে। নতুন অ্যাসেমরি গঠিত হওয়ার পর বগুড়ার জনাব মােহাম্মদ আলী ফের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অবশ্য এটি বলা হয়ে থাকে যে, ফজলুর রহমান যে কাজ করেছিলেন তাতে মােহাম্মদ আলীরও গােপন সমর্থন ছিল। ইতােমধ্যে গভর্নর জেনারেলের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়। সে কারণে তাকে ছুটিতে পাঠানাে হয়। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তখন তিনি মন্ত্রিপরিষদের একজন মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এসব কাজই করেছিলেন অন্য আর একজন আমলা; চৌধুরী মােহাম্মদ আলী। তিনি ছিলেন
২৫
তখন অর্থমন্ত্রী। আরও একটি নতুন সরকার গঠিত হয় পুনরায় বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে। জনাব সােহরাওয়ার্দী হলেন সেখানে বিরােধী দলের নেতা। শীঘ্রই মােহাম্মদ আলীকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁকে আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠানাে হয়। এ সময় চৌধুরী মােহাম্মদ আলী সে সময়ের অর্থমন্ত্রী তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি মুসলিম লীগ দলের নেতৃত্ব এবং সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদ অর্জন করেন।
২৬। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরও চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান পাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার ভিত্তি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমতার নীতি বা প্যারিটি’। পুরাে পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি প্রদেশের আওতায় আনা হয়। প্যারিটির এই নীতি জনাব সােহরাওয়ার্দী ও জনাব ফজলুল হক সহ পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক সমর্থিত হয়েছিল । কারণ, এটি অনুভূত হলাে যে, এর মাধ্যমে দেশে সঠিক প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, এর ভিতর দিয়ে জননীতি, শাসন সুনিশ্চিত হবে এবং উভয় অংশ। একটি সুষ্ঠু নীতির ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বের পদগুলাে সমতার ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব অর্জন করতে পারবে।
২৭। দুর্ভাগ্যবশত এই সুষ্ঠু রীতিটি কখনাে বেড়ে ওঠার সুযােগ পায়নি। নতুন প্রেসিডেন্ট আগের জনের চাইতে কোনাে অংশেই কম ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন না। তিনি কেবলমাত্র দেশের সাংবিধানিক প্রধান ছিলেন না। তিনি রাজনৈতিক দলগুলােকে দুর্বল করার জন্য প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কাজে লিপ্ত হন। তিনি নিজে তার একটি ‘প্রাসাদ পার্টি গঠন করেন। এই দলের নাম দেওয়া হয় রিপাবলিকান দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন ডা. খান সাহেব, যিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নরের পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। কারণ, তিনি স্বাধীনতা অর্জনের পর পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মুসলিম লীগ নৈতিক শক্তির অবক্ষয়ের পর্যায়ে তলিয়ে যেতে থাকে। মুসলিম লীগের অনেক সদস্য রিপাবলিকান দলে দলছুট হয়ে যােগদান করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন যে, অ্যাসেমব্লিতে এমন কোনাে সন্তোষজনকভাবে উত্তীর্ণ শক্ত দল নই যারা কি না তার বিরােধিতা করার মতাে যােগ্যতা রাখে, অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে তার নিজের দলের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন না করে। সরকারের কোনাে কাজ হওয়া বা না হওয়া এটি প্রেসিডেন্টের অবসরের খেলায় পরিণত হয়। মন্ত্রিপরিষদ গঠনের কাজটি মিউজিক্যাল চেয়ারে বসার মতাে পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। ধর্ম থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন রাখার নীতিতে ছিল তার আস্থা। এ দুটি তত্ত্ব পাকিস্তানের শিকড়ের গােড়ার সঙ্গে ছিল প্রথিত। ডা. খান সাহেবের দায়বদ্ধতা ছিল তার প্রভুর আজ্ঞা নির্ভর। তাই গণতন্ত্র পূর্ব নির্ধারিতভাবেই ব্যর্থ হয়ে যেতে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, এ পরিস্থিতির উৎস ছিল রাজনীতিবিদদের মধ্যে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-বিবাদ, ব্যক্তিগত হিংসা-বিদ্বেষ এবং এমনকি অ্যাসেমব্লির ফ্লোরে মারপিট, ইত্যাদি যা আমলাদের সেই সুযােগ এনে দিয়েছিল যার জন্য তারা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করছিলেন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা, সংবিধান বাতিল করেন। তিনি অ্যাসেমরি ভেঙে দেন
২৬
এবং মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে সামরিক শাসন চাপিয়ে দেন। সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন।
২৮। ইস্কান্দার মির্জা তাঁর নিজের কার্যকলাপ যে তাঁর বিরুদ্ধে যাবে এবং যা তাঁকে নিঃশেষ করে দেবে, সে বিষয়ে খুব কমই আঁচ করতে পেরেছিলেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর তারিখে সেনাবাহিনীর প্রধান এবং প্রধান সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বিষয়টি তাঁকে উত্তমভাবেই টের পাইয়ে দিলেন। ইস্কান্দার মির্জাকে বন্দি করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। কার্যত আইয়ুব খান ক্ষমতার মসনদ দখল করলেন।
২৯। এভাবে পাকিস্তানে সংক্ষিপ্ত আড়াই বছরের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বলা যায় এর ব্যর্থতা সত্ত্বেও এবং অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কর্মকাণ্ড ও ষড়যন্ত্র সেইসঙ্গে আত্মস্বার্থমুখী রাজনীতিবিদদের নৈতিক অধঃপতনসম্পন্নতার ভিতরও পাকিস্তানের কোনাে অংশকে বিচ্ছিন্ন করার কোনাে ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেনি। এটি অনুভূত হয়েছিল যে, সাংবিধানিক সরকার গঠনের ভিতর দিয়ে দেশটি নানামুখী পরিবর্তনের ভিতর দিয়েও ‘এক দেশ হিসেবে চলতে থাকবে। অংশগ্রহণের ধারণা সেজন্য যে একেবারে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল তা নয়। তিনজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রীত্ব পেয়েছিলেন। আর একজন হয়েছিলেন এমনকি গভর্নর জেনারেল। তাছাড়া অন্যান্য অনেকেই মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পদ। পেয়েছিলেন। তবে যদি পূর্ব পাকিস্তান একটি সম্মিলিত এককদলের অধীনে আসত, তাহলে তাদের পক্ষে হয়তাে দেশ শাসন করা সম্ভব হতে পারত।
৩০। মুসলিম লীগের সংহতিহীনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চে ক্ষুদ্র দলগুলাের আবির্ভাব কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠদের অপেক্ষা পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানে নিয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে পুরাতন কংগ্রেস পার্টি পুনঃজাগরিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন বসন্ত কুমার দাস। তিনি ছিলেন সিলেটের একজন বিখ্যাত কংগ্রেসী। সিলেট ছিল আগে আসামের অধীনে। এই দলটি মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও বিভক্তির (যেমন- আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির) সুযােগ গ্রহণ করে। বাস্তবে তা। খুবই কার্যকর হয়ে ওঠে। যেকোনাে দলের সাথে দরকষাকষির মাধ্যমে সরকার গঠন, পরিবর্তন এবং এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলাতেও হিন্দুরা সুবিধামতাে প্রভাব বিস্তার করার পর্যায়ে চলে আসে। এরই ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের দলীয় চীফ মিনিস্টার জনাব আতাউর রহমান খান তাদের প্রভাবে সেনাবাহিনীর সাহায্যে চোরাচালান বিরােধী আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিন্দুদের চাপের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আনীত অনেক অপরাধমূলক মামলা আদালত থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
৩১। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার জন্য লাগামহীন ক্ষেপাটে মনোেভাব এবং সম্পদ জড়াে করার দুর্বার আকাক্ষার কারণে পাকিস্তান গােল্লায় যাবার পর্যায়ে চলে আসে। “একটি নির্ভেজাল দেশ উপহাস-বিদ্রুপের দেশে রূপান্তরিত হয়”, গণতন্ত্র হত্যা করার ভিতর দিয়ে। কিন্তু এর কোনাে প্রতিকার ছিল না, যা সংবিধান বাতিলের মাধ্যমে করা হয়েছিল। আমাদের মতে তা ছিল বেঠিক পথ। এখন পর্যন্ত তা কার্যকর রয়েছে। এ ধরনের কাজ যে কেবলমাত্র রাজনীতিবিদগণই করেছেন তা
২৭
নয়, সেসঙ্গে সংবিধান অকার্যকর করার পেছনে আমলাদের ভূমিকাও কম নয়। যদি জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সংবিধান কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে হয়তাে সংবিধান এভাবে প্রহসনে পরিণত হতাে না। পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট, আমাদের মতে, প্রাথমিকভাবে তার নিজের ক্ষমতা এগিয়ে নেওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিবাদ, দলাদলি উসূকে দিয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে তাঁর আপন পাতা ফাঁদে তিনি নিজেই আটকে যান; যখন তার সামরিক আইন বিষয়ক প্রধান প্রশাসক তিন সপ্তাহের মধ্যে সামরিক আইন জারি করেন এবং তাকে বন্দি করে বিদেশে চালান দেন। শুধু তাই নয়, তিনি ঘােষণা দেন যে, মির্জা নিজেই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে জোট বেধে দেশকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন।
৩২। সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাধিপতির এই ক্ষমতা দখল জেনারেল আইয়ুব খান সম্ভবপর করে তুলেছিলেন। কারণ তিনদিন আগেই সুপ্রীম কোর্ট ‘স্টেট বনাম ডডাসাে কেইসে’ ঘােষণা দেয় যে, যদি একটি সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয় তাহলে তা ক্ষমতার উৎসের বৈধতা অর্জন করবে। এটি ছিল একটি আইনি নির্দেশ। দেখা গেল যে, জেনারেল আইয়ুব খান ছিলেন ষড়যন্ত্রের মূল হােতা। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি দেশের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং তিনি ইস্কান্দার মির্জাকে কেবলমাত্র ব্যবহার করেছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য সফল করার জন্য; যাতে করে বিনা বাধায় কাজ করা যায়। যখন তাঁর উদ্দেশ্য সাধিত হলাে; তৎক্ষণাৎ তিনি ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাহীন করে দেন। এবং এভাবে পাকিস্তান দুই ধরনের প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়।
৩৩। জেনারেল প্রারম্ভে ভালােভাবেই কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার দ্বারা আশ্চর্যজনক কিছু ফল পাওয়া যায়। যেমন- দ্রব্যমূল্য দ্রুত হ্রাস পায়, চোরাচালানী, কালােবাজারি ও মজুদদারী বন্ধ হয়ে যায়। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় । বিপুল পরিমাণে চোরাচালানকৃত স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এমনকি সামারিক আইনের ভয়ে ভীত হয়ে উদ্বাস্তুরা মিথ্যা তথ্য দ্বারা দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রচেষ্টা থেকে সরে আসেন। ব্যবসায়ী ব্যক্তিগণ তাদের গােপন আয় এবং আত্মসাৎকৃত বিদেশি মুদ্রা প্রকাশ করেন। জনগণ প্রথমে এসব পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানায় এবং স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। তারা মনে করেন যে, সামরিক শাসন একটি সাময়িক বিষয়। পরিস্থিতির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শীঘ্রই তা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। জেনারেল আইয়ুবের প্রাথমিক সফলতার আর একটি কারণ হলাে, তিনি যতদূর সম্ভব সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের মধ্যে রেখেছিলেন। তিনি বেসামরিক বিভাগগুলাে ব্যবহার করতেন এবং সামরিক শাসনের সর্বোচ্চ সীমা সীমিত পর্যায়ে রাখতেন। বেসামরিক এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে রক্ষা করতেন, যাতে করে উভয়ের ভিতর কোনাে প্রকার সংঘাত দেখা না দেয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ ভূমি সংস্কার, আইন সংস্কার এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ও বিজ্ঞানের ব্যবহারের জন্য কমিশন গঠন করেন। এ সকল কর্মকাণ্ড গ্রহণযােগ্যতা পেয়েছিল। অনুরূপভাবে, উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি আত্মপ্রত্যয়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে করাচি, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে শহর এলাকা বৃদ্ধি পায়- এসবই জনগণের সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই এক ধরনের মােহমুক্তির অনুভূতি ভিত্তি পেতে আরম্ভ করে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে, যখন সেখানে মৌলিক গণতন্ত্রের
২৮
বিধান প্রদান করা হলাে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এটি ছিল একটি পশ্চাত্মখী পদক্ষেপ। ফলে এধরনের মনােভাব দানা বাঁধে যে, সরকার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য প্রত্যয়ী নয়। বাস্তবে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি মনে করেন যে, জেনারেল আইয়ুব বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের জনগণ গণতন্ত্রের উপযােগী। তিনি ভেবেছিলেন, কমপক্ষে একটি প্রজন্মব্যাপী এমন ধরনের শাসন ব্যবস্থা থাকা উচিত; যার মাধ্যমে তারা গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে পারেন। সেই লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৯ সালে গণতন্ত্রের আকার পুনরায় দেওয়ার মানসে মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনৈতিকভাবে ছিলেন বেশি সচেতন। তাই তারা এর বিরােধিতা করেন ও তারা অনুভব করেন তাদেরকে ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে নিমগ্ন করে ফেলা হয়েছে। তারা আরও মনে করেন, এই ধরনের ব্যবস্থায় কখনাে তারা শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। হতাশাজনক পরিস্থিতি দূর করার জন্য ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ক কমিশন গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি। কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করে। সেখানে আমেরিকার ধরনের একটি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়। এবং সেইসঙ্গে সেখানে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার। আইন সভা হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট এবং থাকবে ক্ষমতার মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য ব্যবস্থা। প্রস্তাব করা হয় রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে একটি ইলেকট্ররাল কলেজের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। সীমিত ভােটাধিকারের মাধ্যমে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জেনারেল আইয়ুব কেবলমাত্র প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু অন্যান্য সুপারিশ গ্রহণ করেননি। ১৯৬২ সালে চূড়ান্তভাবে যে সংবিধান দেওয়া হয়, তাতে সমস্ত ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে সংরক্ষণ করা হয়। যিনি পরােক্ষভাবে ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত ইলেকট্ররাল কলেজের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। জনগণের জন্য কোনাে প্রকার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। এমনকি আইনসভার ক্ষমতাও বিপুল পরিমাণে হ্রাস করা হয়। দেশের ওপর তাদের ক্ষমতা কিছু নতুন উপাদানের মধ্যে সীমিত করা হয়। প্রদেশগুলাে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এমনকি প্রাদেশিক মন্ত্রীদেরকেও প্রেসিডেন্টের দ্বারা অনুমােদিত হতে হতাে।
৩৪। সংবিধানটি উভয় প্রদেশের জন্যই বিরাট আশাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংঘাত এড়ানাের জন্য বিরােধীদের কঠোর হাতে দমন-নিপীড়ন করা হয়। সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ইলেকটিভ বডিস ডিসকোয়ালিফিকেশন (এবডাে) অর্ডার ১৯৫৯ সালের আইন দ্বারা প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করার অধিকার ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। খবরের কাগজের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং জাতীয় প্রেস স্ট্রাস্ট-এর অধীনে নতুন ধারায় খবর-বার্তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়।
৩৫। অস্বাভাবিক বিষয় ছিল এই যে, এবডাে এর দ্বারা মুজিবুর রহমানকে অযােগ্য করা হয়নি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এককভাবে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে মামলাটি থেকে তাঁকে
২৯
বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। বিরােধী পক্ষের বিক্ষোভে মুজিব একজন নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। ছাত্ররা পুনরায় বিরােধীদের ‘ভ্যানগার্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশৃঙ্খলা ও বেমানান শিক্ষা সংস্কারের বাস্তবায়নের প্রশ্ন থেকে বিক্ষোভ আরম্ভ হয়। ছাত্ররা ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে পুলিশের সাথে মুখােমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ওঠে। গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনা পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে ওঠা আন্দোলনের আগুনে ঘৃত বর্ষণ করে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররা একটি সাধারণ হরতালের ডাক দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা এটি গ্রহণ করেন। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌছায় যে সরকার তিন বছরের স্নাতক প্রােগাম’ বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর, ১৯৬২ সালের জুলাইয়ে রাজনৈতিক দলবিধি পাশ হয়। রাজনৈতিক দলগুলাে সীমিত অবস্থায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অধিকার পায়। সেই সময় মৌলিক অধিকার পুনঃবহালের জন্য একটি বিক্ষোভ জেগে ওঠে। ফলে দাবিটি মেনে নেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে সংবিধান সংশােধন করা হয়। বিরােধীরা ক্রমাগত শক্তি সঞ্চার করতে থাকে। তবে ১৯৬২ সালের সংবিধানের অধীনে প্রথম মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯০ ভাগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৭৫ ভাগ ভােটার নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রকৃত উত্তেজনা অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আরম্ভ হওয়াকে ঘিরে আবর্তিত হতে আরম্ভ করে। সকল বিরােধী দল একত্রিত হয়ে মােহতারমা ফাতিমা জিন্নাহকে (পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর বােন) জেনারেল আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেয়। ছাত্র সমাজও তাকে সমর্থন জানায়। নির্বাচনকে ঘিরে উচ্চ মাত্রায় অনুভূতি জমে ওঠে এবং প্রচারণার সময় প্রায়ই সংঘাতের মতাে ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে। ছাত্রদের ভিতর যারা সক্রিয়ভাবে প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন মিস্ জিন্নাহর পক্ষে তারা প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা, করাচি, লাহাের ও পেশােয়ারে গুলিবর্ষণের মতাে ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা পুনরায় ছাত্রদের আরও উত্তেজিত করে তােলে।
৩৬। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে মুজিবুর রহমান ছিলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিরােধী সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম সংগঠক। কিন্তু যখন নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলাে, মানুষ আশ্চর্য হয়ে দেখলেন যে, ফিল্ড মার্শাল ২১,২৬০ ভােট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে ফাউল প্লে’ এর সন্দেহ করা হয় এবং সরকারকে ব্যাপক ভােট কারচুপির অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়। এর ফলে পরবর্তীতে বিরােধী দল জাতীয় এবং প্রাদেশিক কোনাে নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করেনি। আইয়ুব খানের দ্বারা গঠিত দল; কনভেনশন মুসলিম লীগ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
৩৭। এই নির্বাচনের সময়ে মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতাে ১৯৬৪ সালে তাঁর আওয়ামী লীগ দলের নির্বাচনি ঘােষণাপত্রে দুই অর্থনীতি তত্ত্বের অবতারণা করেন। এবং তার দ্বারা ব্যাখ্যাত ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে তিনি সংবিধান প্রণয়নের দাবি করেন; যেখানে থাকবে তার কল্পিত “দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।”
৩৮। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জেনারেল আইয়ুব আরও একটি আরামদায়ক অফিসকাল অতিবাহিত করার পরিকল্পনা করছিলেন। তবে তার এ পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে
৩০
যখন ভারত বিশ্বাসঘাতকের মতাে ১৯৬৫ এপ্রিল মাসে কচ্ছের রান এলাকায় আক্রমণ করে বসে। আমাদের বাহিনী ১৯৬৫ সালের জুন মাসের যুদ্ধ বিরতির সময় পর্যন্ত মজবুতভাবে ভূমিতে অবস্থান নেয়। সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে তােলা হয়। কিন্তু সেখানে শান্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয়রা আজাদ কাশ্মীরে পুনরায় আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈন্যরা পালটা আক্রমণ করে যুদ্ধ বিরতি রেখা অতিক্রম করে চাষ ও জুরিয়ান দখল করে এবং আখনুরকে হুমকির মধ্যে রাখে। যখন তারা আখনুরের ৬ মাইলের মধ্যে চলে আসে, তখন ভারতীয়রা আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর আরও একটি বিশ্বাসঘাতক আক্রমণ চালায় ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে। দুটি দেশ তখন মরণপণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ ১৭ দিন। স্থায়ী হয়। তবে বৃহৎ শক্তিসমূহের হস্তক্ষেপে ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বিরতি মেনে নেওয়া হয়।
৩৯। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে এবং এই ভুল তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। যদি চীন ভারতকে খােলাখুলিভাবে আক্রমণকারী (আগ্রাসী) না বলত এবং সিকিম সীমান্তে তার সৈন্য সমাবেশ না করত, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানেও আক্রমণ করত। এই বিচ্ছিন্নতাবােধ সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের কোনাে প্রকার ঘাটতি ছিল না। তারা দৃঢ়ভাবে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং তাদের আপসােস ছিল যে এই শত্রুর বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধে যােগদানের কোনাে সুযােগ পাচ্ছেন না। বিচ্ছিন্নতাবােধের অনুভূতি, অবশ্য যুদ্ধাবসানের পরে গভীর হয়ে তা হতাশায় পরিণত হয়; এই ভেবে যে, পশ্চিম অংশ যে সংকটে পড়েছে তা উতরিয়ে তারা পূর্বাঞ্চলকে আর সহযােগিতা দেবার জন্য এগিয়ে আসতে পারবে না।
৪০। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মি. কোসিগিনের মাধ্যমে একটি শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হয়। তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীকে তাসখন্দে শান্তি আলােচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাসখন্দ ঘােষণা আসে। এতে উভয় দেশের সৈন্য তুলে নেওয়ার কথা বলা হয় নিজ নিজ দেশের সীমানায় এবং কাশ্মীর বিরােধসহ অন্যান্য বিরােধের মীমাংসা আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার কথাও বলা হয়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে এই ঘােষণা অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তা বিরােধী দলগুলােকে পুনরায় আরও একটি সুযােগ ও শক্তির যােগান দেয়। এই ইস্যু নিয়ে তারা সরকারকে দোষারােপ করতে থাকেন। নবাবজাদা নাসুরুল্লাহ খান ১৯৬৬ সালের ৫ জানুয়ারি লাহােরে বিরােধী দলগুলাের একটি সমাবেশ আহ্বান করেন। এই সমাবেশের ভিতর দিয়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ আহ্বান করা হয়। কিন্তু এটি মিইয়ে যায়। এই সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতাে ৬ দফা উত্থাপন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। এটি বিরােধী দলের মধ্যে একটি ফাটল তৈরি করে। ফলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গড়ে ওঠা বিক্ষোভ শক্তি হারিয়ে ফেলে।
৪১। শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিরােধীদলগুলাের অধিকাংশ নেতাকে বন্দি করা হয়। জরুরি অবস্থার জন্য গৃহীত ক্ষমতা বলে তাদের আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ আইনটি ১৯৬৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্রহণ করা হয়েছিল।
৩১
৪২। অধিকাংশ মানুষের মতামত হলাে এমন যে, ৬ দফা তৈরি করার মতাে মেধা মুজিবুর রহমান-এর ছিল না। কিন্তু এখানে ৬-দফার উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্নমতও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন সেগুলাে বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট ছিল। অন্যরা মনে করেন ৬-দফা পূর্ব পাকিস্তানি কিছু মেধাবী সিএসপি কর্মকর্তার তৈরি । আবার কেউ কেউ বলেন আইয়ুব খানের সঙ্গে কাজ করতেন এমন একজন বিশ্বাসভাজন সিএসপি’র দ্বারা ৬ দফা প্রণীত। ৬-দফা তৈরি করা হয়েছিল, যাতে করে লাহােরের সর্বদলীয় অধিবেশন ধ্বংস হয়ে যায় । সে যাই হােক না কেন, সত্য হলাে ৬-দফা উক্ত অধিবেশনে আবির্ভূত হয় এবং এর ফলে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এজেন্ডা দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪৩। ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী যে নির্দয় পথে জেনারেল আইয়ুব খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুজন গভর্নর নিয়ােগ দিয়েছিলেন তা বেসামরিক (সিভিল) জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। ফলে আইয়ুব সরকারের ভাবমূর্তি নিপ্রভ হয়ে যেতে থাকে। দুর্নীতি বৃদ্ধি, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি এবং কতিপয়ের হাতে সম্পদ জড়াে হওয়ার কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিপুল পরিমাণে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের দাবি ছিল সম্পদের সুষম বণ্টনের এবং অধিকতর সমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে কম-বেশি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক সম্পদ-শােষণের বিষয়টি উঠে আসতে থাকে এবং সেনাবাহিনীকে দোষারােপ করা হতে থাকে। কেননা, তা ছিল অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা গঠিত বাহিনী। বাস্তবিকপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে এরকম একটি অনুভূতি গড়ে উঠতে থাকে যেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের আদলে প্রস্তুত ব্যবস্থার দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানিদের শাসনের বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলােনিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
৪৪। এই সময়ে জেড এ ভুট্টো আইয়ুব সরকারের বিদেশ সম্পর্কিত মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে বিরােধী দলে যােগ দেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) গঠন করেন এবং জেনারেল আইয়ুবকে ক্ষমতা থেকে হটাতে উঠেপড়ে লেগে যান। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড ছিল সতর্কতামূলক। তারা তাদের বিক্ষোভকার্যক্রম মূলত জরুরি আইন তুলে নেওয়ার দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিল। তারা একটি যুক্ত জাতীয় কমান্ড’ গঠন করেন। সরকার অনড় মনােভাব নিয়ে চলতে থাকে। ভুট্টোকে বন্দি করা হয়। সরকার দেশে জরুরি অবস্থা চালিয়ে নেবার জন্য জাতীয় সংসদে একটি সিদ্ধান্ত নেয়।
৪৫। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য ৩৫ জন সহ পূর্ব পাকিস্তানকে সহিংস পথে বিচ্ছিন্ন ও বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্রের অভিযােগে চার্জ গঠন করা হয়। এই বিচার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত। এটি ১৯৬৮ সালের জুন মাসে আরম্ভ হয়েছিল।
৪৬। পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা অবশ্য চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সেখানে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে মারাত্মক সংঘাত দেখা দেয়। এ ধরনের গােলযােগ। ঘটেছিল ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে। এ বিদ্রোহে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। আইনজীবী, ডাক্তার ও ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে
৩২
আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে সভা-মিছিল করতে থাকেন। পেশােয়ারে একটি সভায় বক্তৃতা করার সময় জেনারেলকে লক্ষ করে গুলি ছােড়া হয়। অবস্থা এমন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায় যে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে তাদের সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গােলটেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন। পিপলস পার্টি ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলাে একত্রিত হয়ে ডাইরেক্ট অ্যাকশন কমিটি (ডাক)’ গঠন করেন এবং জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার শর্তে গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানে রাজি হয়। কিন্তু পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে প্যারােলে’ এবং পরবর্তীতে জামিনে বন্দিমুক্ত হয়ে বৈঠকে যােগ দেবেন বলে চুক্তি হওয়ার পরে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত আসামির রহস্যজনকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা ভিন্নপথে মােড় নেয়। অভিযােগ করা হয় যে, তিনি পালাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মৃতদেহ তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নিকট ফিরিয়ে দিলে পর ঐ শবদেহ ঢাকা সেনানিবাস থেকে একটি মিছিলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে একটি বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । ব্যাপক গণ্ডগােল শুরু হয়ে যায়। অনেক বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হয়, এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের বাড়িও ছিল। এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও সহিংসতা অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ঢাকা, কুষ্টিয়া এবং নােয়াখালীতে গুলিবর্ষণ করে। ফলে ৯ জন মানুষ মারা যান এবং ৫১ জন আহত হন। এমতাবস্থায়, মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানে অস্বীকার করেন।
৪৭। ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান আরও একটি সিদ্ধান্তের জন্ম দেন। তিনি ঘােষণা করেন যে, আসন্ন নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের ওপর একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর অধীনে মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করা হয়। ফলে মুজিবুর রহমান একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে বেরিয়ে আসেন। যদিও তাকে খালাস করা বা অব্যাহতি দেওয়া হলাে না। শেখ মুজিব গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করেন এবং ‘ডাক’ এর সদস্যদের সঙ্গে তার বােঝাপড়ার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৬-দফা দাবি তিনি উত্থাপন করেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান একটি পার্লামেন্টারি ধরনের সরকার ব্যবস্থার দাবি মেনে নেন। এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটে অ্যাসেমব্লির সদস্যদের নির্বাচনের দাবিও গ্রহণ করেন। এ সবকিছু মােটামুটিভাবে অন্যান্য সবাই মেনে নেন। তবে পিপলস্ পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তখনও পর্যন্ত অধিবেশনে যােগদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল । ফিল্ড মার্শাল তার গভর্নরদ্বয় বদলিয়ে ফেলেন। কিন্তু তারপরও পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিক্ষিপ্তভাবে চলতে থাকে। গােলটেবিল বৈঠকের পরে শেখ মুজিবুর রহমান ‘ডাক’ থেকে বেরিয়ে যান এই অভিযােগে যে, ডাক’ ৬-দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানায়নি।
৪৮। এটি গােচরীভূত হয় যে, গােলটেবিল বৈঠক চলাকালীন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং জেনারেল হামিদ-এর সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধানের বাসায় প্রাইভেট মিটিং করেন। এবং এটি আরও অনুভূত হয় যে, এরপর থেকে
৩৩
শেখ মুজিবুর রহমান শক্ত অবস্থানে চলে যান। বলা হয় যে, তিনি ডাক’ নেতাদের বলেছিলেন তিনি আর সামরিক শাসনকে ভয় করেন না। এভাবে কটাক্ষ করে অনেকেই বলতে থাকেন যে, প্রত্যক্ষ সাক্ষীর দ্বারা জানা গিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের মনােভাবের এমন পরিবর্তনের মূলে রয়েছে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে এক ধরনের নিশ্চয়তা পেয়েছেন যে, গােলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলেও সামরিক শাসন চাপিয়ে দেওয়া হবে না।
৪৯। গােলটেবিল বৈঠকে যখন ঐক্যমতের ভিত্তিতে ১৯৬২ সালের সংবিধান যথাযথভাবে সংশােধন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন দেশ আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করল যে, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ, যখন কি না বিক্ষোভ প্রায় মিটমাট হয়ে গিয়েছিল; ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান (সিইসি) জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি সংবিধান স্থগিত করেন। এভাবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং আইয়ুব খানের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
৫০। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ১২ বছরের সরকার তুলনামূলকভাবে ছিল সুস্থির এবং এ সময়ে উল্লেখযােগ্য উন্নয়ন হয়েছিল। সকল ক্ষেত্রেই এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও তা ঘটেছিল। এই সময়কালে পাকিস্তানে শিল্প ও কৃষিখাত অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ পাকিস্তানের উভয় অংশেই সমাপ্ত হয়েছিল। শিল্পায়নের অগ্রগতি হয়েছিল সুন্দর ও সন্তোষজনকভাবে। দেশ অভ্যন্তরীণভাবে যে কেবল সুস্থিরতা অর্জন করেছিল তাই নয়; সেইসঙ্গে কিছুমাত্রার সম্মান অর্জন করেছিল বিশ্বের জাতিগুলাের মধ্যে। রাজনৈতিক উন্নয়ন অবশ্য দমন করা হয়েছিল নিবর্তনের মাধ্যমে। কেননা, ফিল্ড মার্শাল মনে করতেন; পাকিস্তানিরা পশ্চিমা গণতন্ত্রের জন্য এখন পর্যন্ত যােগ্যতা অর্জন করেনি। যদি কেবলমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধিসম্পন্নভাবে কাজ করার সুযােগ দেওয়া। হতাে এবং জনগণকে বৃহত্তরভাবে রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা যেত; তবে তার সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা নিজের ওপর কেন্দ্রীভূত করার পরও, এই দুর্ভাগা দেশের ইতিহাস হয়তাে ভিন্ন হতে পারত।
৫১। ফিল্ড মার্শাল কর্তৃক হঠাৎ করে ক্ষমতা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনাে কারণ জানা যায়নি। কিন্তু প্রমাণাদি থেকে যা জানা যায় তাতে আমাদের কাছে মনে হয়েছে গােলটেবিল বৈঠকে পর্যাপ্ত পরিমাণে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যাতে করে সংবিধান পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন একটি অবস্থায় আসা যাবে যার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা সহজেই উতরে আনন্দঘন একটি রাজনৈতিক যুগের রচনা করা যায়।
৫২। কমান্ডার ইন চীপ (প্রধান সেনাপতির)-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে কিছু সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কেননা, ১৯৬২ এর সংবিধানে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের ফলে ক্ষমতা কীভাবে কার কাছে যাবে তা উল্লেখ ছিল। কেউ কেউ মনে করেন যে, ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের গুরুত্বর অসুস্থতার কারণে তিনি যেকোনাে বিষয়ে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড এই ধরনের চাতুর্যপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য
৩৪
তাঁর ওপর চাপ প্রয়ােগ করেছিলেন। আর এ সবের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এই গােষ্ঠী বাস্তবে তাদের আধিপত্য নিশ্চিত না করে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। অন্যদের কেউ কেউ মনে করেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এ বিষয়ে ছিলেন উভয় সংকটের মধ্যে। তিনি স্পিকার বা অন্য কোনাে রাজনীতিকের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার কথা মাথায় আনেননি বা তা চাননি। তার নিজের এমন কেউ ছিলেন না যার ওপর তিনি পুরােপুরি আস্থা রাখতে পারতেন। এ অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দৃঢ়হস্তে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়ােজন ছিল। এটি একমাত্র হতে পারত, “আঞ্চলিক সামরিক আইনের ভেতর দিয়ে। কিন্তু সেনাবাহিনী এতে রাজি ছিল না, তারা পরিপূর্ণভাবে ক্ষমতা পেতে চাচ্ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি সেনাবাহিনীকে বাছাই করেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে, নিদেনপক্ষে তারা তার এবং তাঁর পরিবারবর্গের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে যাতে করে তার ওপর কোনাে প্রকার অপমানজনক ঘটনা না ঘটে।
৫৩। জেনারেল ইয়াহিয়া খান এ বিষয়ে এই ধারণা পােষণ করতেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তার নিজের কিছু বলার নেই। এ সম্পর্কে ফিল্ড মার্শালের নিজেরই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু একই সময়ে তিনি বারবার বলেছেন যে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান অসুস্থতার জন্য কোনাে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়ে পড়েছিলেন। এটি বলা হয়ে থাকে যে, তিনি তার সংবিধান রক্ষা করা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এর দ্বারা বােঝা যায় যে, এ বিষয়ে অবশ্যই ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছিল।
৫৪। সিইনসি’র হাতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরের বৈধতার প্রশ্নের বিষয়টির বাইরেও সংবিধানের ধারার অবমাননা করা হয়েছিল। আমরা দেখতে পাই যে, আইয়ুব খানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনাে ছােটো মাপের সিদ্ধান্ত ছিল না। কেননা, এখানে সেনাবাহিনী কোনাে বেসামরিক সরকারকে সাহায্য করতে চাইছিলেন না এই ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যে, সেখানে তাদের শর্তগুলাে পরিপূর্ণ হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে ডক না (এমন নিশ্চয়তা তাদের প্রয়ােজন ছিল)।
৫৫। আমাদের কাছে আসা তথ্য-প্রমাণ থেকে বিনা দ্বিধায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এই পদক্ষেপটি সেনাবাহিনী প্রত্যাশা করেছিলেন যেন তিনি ক্ষমতা নিজের হাতেই নেন এবং পরিকল্পনাও তিনি নিজেই করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক দেওয়া এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করে নেওয়া অসুবিধাজনক। কারণ এ সিদ্ধান্ত ছিল সেনাবাহিনীর জন্য একটি স্বাভাবিক আকস্মিক পরিকল্পনার অংশ যা সব সেনাবাহিনীই নিয়ে থাকে। এটি কোনাে স্বাভাবিক কাজের অংশ ছিল না যার। মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়েছিল, যতক্ষণ তা পূর্ব পরিকল্পিত এবং মধ্যস্থতাকরণ সম্পন্ন না হয়।
৫৬। যদিও আমরা এই প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বক্তব্য নিয়ে সন্তুষ্ট নই যে, ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে ফিল্ড মার্শাল আয়ুইব খানের অসুস্থতার ফলশ্রুতিতে বাস্তবিকপক্ষে ইয়াহিয়া খান নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। কেননা, প্রচুর সংখ্যক প্রমাণ এই
৩৫
সত্য এখনও জানায় না যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশের বেসামরিক বিষয়াদী নিয়ে জ্যেষ্ঠ বেসামরিক কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতেন। এই সময়ে সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধান এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তা-মন্ত্রীসহ বৈঠকের ঘটনা খুব একটা হতাে না। এভাবে দেখা যায়, তাহলে এক ধরনের পরিকল্পনার জন্ম দেওয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে এরূপ বােঝাপড়ায় উপনীত হওয়া গিয়েছিল যে, যদি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের সরকার রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতায় আসতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সংবিধান যেভাবেই থাক না কেন প্রধান সেনাপতির দ্বারা একটি সামরিক সরকার গঠিত হবে।
৫৭। সেনাবাহিনীর প্রধান এবং তার সেনাসদর দ্বারা রাষ্ট্রের শাসনের ক্ষমতা যে গ্রহণ করা হবে; এই পরিকল্পনাটি আগেই করা হয়ে গিয়েছিল। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি করা হবে তা ছিল এমন, সেখানে আঞ্চলিক পর্যায়ে সেনাশাসনের কথা বলা হয়েছিল। সেনাবাহিনী প্রধান গােলটেবিল বৈঠক চলাকালীন সময়ে অস্বাভাবিকভাবে তার স্বার্থ তুলে ধরেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। কেউই এই ধারণাটি উপেক্ষা করতে পারবেন না যে, জেনারেল ইয়াহিয়া কেবলমাত্র শাসন ক্ষমতা হাতে তুলে নিয়েছিলেন দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করতে। বরং তিনি এটি করেছিলেন তার নিজের ক্ষমতা অর্জন করতে। সেইসঙ্গে তাদের জন্য ক্ষমতা নিশ্চিত করতে; যারা তাকে সহযােগিতা করেছিলেন তারই পূর্ণজ্ঞাতে এবং তারই ইচ্ছায়।
৫৮। ইয়াহিয়া খানের পরবর্তী কার্যকলাপ উক্ত অনুমানকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আজ্ঞা তাঁর সত্য-প্রত্যাশার ওপর কেবলমাত্র ধোঁকা দেওয়ার জন্য মিথ্যা প্রতিভাস বৈ কিছু ছিল না যে, তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নিমিত্তে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করবেন। দেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রত্যাশাসমূহ, নিঃসন্দেহে এমন ছিল যে, এমনকি যদি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলাে নির্বাচিত হয়ে আসবে; কোনাে একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে কার্যকর কণ্ঠ পাবে না। ফলে সাংবিধানিক সংস্থা বা আইনসভা ইয়াহিয়া খানকে তাঁর ইচ্ছামতাে খেলার সুযােগ এনে দেবে, যেমন করে সুযােগ এনে দিয়েছিল জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে । তিনি গণপরিষদকে ১২০ দিন সময় বেঁধে দেবেন এবং এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করতে না পারলে তিনি অ্যাসেমব্লি ভেঙে দেবেন বলে ‘একধাপ এগােনাে এক ধরনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, তার প্রত্যাশা ছিল এমন যেখানে গণপরিষদ প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে সংবিধান প্রস্তুতে ব্যর্থ হবে এবং সেজন্য গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তাঁর কমান্ডারগণ কোনাে বিকল্প না থাকার কারণে দেশ শাসন অব্যাহত রাখবেন।
৫৯। তিনি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন সেগুলাে সমালােচনামূলক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তা আগের অনুমানকেই তা সমর্থন দেয়। নির্বাচনের তারিখ ঘােষণার প্রশ্নে প্রাথমিক বিলম্ব, কার্যত প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুগুলাের ক্ষেত্রে আগের রাজনৈতিক ধারণাকে রেডিক্যালি পরিবর্তিত করে দেয়। তারপক্ষে যা ব্যর্থতা ছিল তা হলাে একটি আইনগত কাঠামাে নির্দেশ (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার), প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথাবার্তা যা ছিল পূর্ব
৩৬
পাকিস্তানে নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি জ্বলন্ত ইস্যু এবং ভােট সংক্রান্ত প্রক্রিয়ায় যেকোনাে যােগান না থাকার সকল নকশা- এসবই ছিল আমাদের দৃষ্টিতে একটি অচলাবস্থাজনক পরিস্থিতি। এ সবকিছু করা হচ্ছিল এজন্য যে, তা প্রকারান্তরে তাঁর সরকারকেই ক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে।
৬০। যদি তার মনােভাব ও মনােবৃত্তি সৎ ও স্বচ্ছ থাকত, তাহলে এমতাবস্থায় সুস্পষ্টভাবে ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন করা যেত; যেখানে নিদেনপক্ষে ছিল একটি সাংবিধানিক কাঠামাে যা তৈরি হয়েছিল নির্বাচিত অ্যাসেমব্লির দ্বারা। তারপরে বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলাের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত; নির্বাচনােত্তর সময়ে এটি যথাযথ পরিবর্তন করার অভিপ্রায়ে । এটি এবং কেবলমাত্র এটিই হতে পারত প্রকৃত ও যথার্থ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের ভিতর রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব হতাে। যদি জেনারেল ইয়াহিয়া এক ইউনিট প্রথা বাতিল করতেন এবং সমতা বা প্যারিটির নীতি থেকে দূরে সরে আসতে পারতেন, তাহলে আমরা মনে করি প্রয়ােজনীয় ও পরিমাণ মতাে স্বায়ত্তশাসন প্রদেশগুলােকে দেওয়া এবং সেইসঙ্গে এর সাথে সংবিধান-কমিটির নির্বাচনের জন্য কার্যকর রাখার সুপারিশ করা যেত।
৬১। তাঁর অবশ্যই জানা উচিত ছিল যে, “এক ব্যক্তির এক ভােট” এই নীতি গৃহীত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানিরাই আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। এমনকি যদি তারা একটি দলের দ্বারা সংগঠিত না হয় তাহলেও সেখানে হাতে হাত মিলিয়ে সুপারিশ আসবে যে, ভােটাভুটি হবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মাফিক। তিনি এটিও জানতেন যে, মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী সময়েও দাবি জানিয়ে আসছিলেন এমন একটি সংবিধানের; যার ভিত্তি হবে ৬-দফা, যার অর্থ দাঁড়াবে সত্যিকারভাবে একটি কনফেডারেশন এবং তা কোনােভাবেই ‘ফেডারেশন’ হবে না। তথাপিও তিনি কখনাে বছরব্যাপী সময়ে ৬-দফা বিষয়ে অধ্যয়ন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেননি। তিনি এটিও নিরূপণ করতে পারেননি যে, ভােটের ওপর ৬-দফার কীরূপ প্রভাব সত্যিকারভাবে পড়বে এবং তার ফলাফল কী দাঁড়াবে। তাছাড়া তিনি কখনাে আওয়ামী লীগকে ৬দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিযােগিতা করার প্রচেষ্টা থেকে থামানাের জন্যও কোনাে প্রকার চেষ্টা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। যদিও তার আইনগত কাঠামাে নির্দেশে (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারে) উল্লেখ করেছিলেন যে, পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হবে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার আলােকে।
৬২। শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়েছিলেন এই নির্বাচন কেবলমাত্র সংবিধান প্রণয়নের জন্য অ্যাসেমব্লির নির্বাচন হবে না- এ নির্বাচন হবে ৬-দফার ভিত্তিতে একটি গণভােট। কিন্তু এরপরও না ইয়াহিয়া খান বা না তার উপদেষ্টাগণ কেউই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বা শেখ মুজিবকে থামাবার কোনাে প্রকার পদক্ষেপ নেননি বা সেজন্য কোনাে চিন্তাও করেননি।
৬৩। আওয়ামী লীগ কর্তৃক স্বাধীনভাবে নির্বাচনে ভােটারদের প্রতি জবরদস্তি এবং খবরদারির (চোখ রাঙানাের) মতাে কাজকে খুব হালকাভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল। সেই সময়ের সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নির্বাচনের প্রভাবমুক্তাবস্থা একটি সন্দেহজনক পর্যায়ে যাবে তাই এর গ্রহণযােগ্যতা হবে প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক
৩৭
প্রত্যক্ষদর্শী হলফ করে বলেছেন যে, সরকার আওয়ামী লীগের ধ্বংসযজ্ঞ চালানাের কাজকে থামাবার জন্য কোনাে প্রচেষ্টা নেয়নি। আওয়ামী লীগ কর্তৃক নির্বাচনে অসদুপায় অবলম্বন, যেমন- নকল ভােট (ডুপলিকেট) ভােট প্রদান, মিথ্যা ভােটার দ্বারা ভােট দেওয়ানাে, ভােটারদের ভীতি প্রদর্শন, এমনকি ভােটকেন্দ্রে ভােটারদের যেতে বাধা দেওয়ার মতাে কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা সরকার করেনি।
৬৪। এটি গ্রহণযােগ্য নয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে সে সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান। সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত ছিলেন। কিংবা ভােটারদের প্ররােচিত করা এবং ভােট চলাকালে কী ঘটছে সে বিষয়ে তিনি জানতেন না। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখে মনে হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু এবং পক্ষপাতহীনভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন মনে করার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। এমনকি ধরেও নেওয়া যায় যে, সরকার কোনাে পক্ষ নেয়নি। তারপরও এ অনুমানের স্বীকৃতি যথাযথ বা সত্য নয়। আমরা অনেক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি যাতে দেখা যায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার কর্মকর্তাগণ অবৈধ উপায়ে শিল্পপতিদের নিকট থেকে বড়ােমাপের টাকা সংগ্রহ করেছিলেন এবং এর দ্বারা কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। ওইসব দলকে সেই সংগৃহীত টাকাও দিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত কাজে; যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়েছে জেনারেল ওমার এবং জনাব রিজভী যথার্থতা থেকে বহুদূরে সরে গিয়েছিলেন।
৬৫। কেবলমাত্র নির্বাচনের ফলাফল যখন ঘােষিত হলাে তখন জেনারেল অনুভব করতে সক্ষম হলেন যে, তাঁর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কার্যত তার কার্যকলাপ এখন অধিকতর দ্ব্যার্থক এবং সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে এবং তাঁর সত্যিকার মনােভাব এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। তার পরবর্তী কার্যকলাপ পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে থাকার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবেই ওইসব কাজকর্ম করেছিলেন। প্রয়ােজনে এমনকি দেশের বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকিও তিনি নিতে তােয়াক্কা করেননি।
৬৬। দেখা যায়, তাঁর “আকস্মিকতা সম্পর্কিত পরিকল্পনা (কন্টিনজেনন্সি প্ল্যান)” যা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি নিয়েছিলেন তা প্রকারান্তরে নির্বাচনের ফলাফলের ভিতর দিয়ে বিশৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। কেননা, নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে একটি মাত্র দল চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অন্য একটি দল সর্বমােট ১৪৪টি আসনের ভেতর ৮৫টি আসনে বিজয় অর্জন করে। সে। কারণে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার কোনাে তাড়া তিনি দ্রুত অনুভব। করেননি। তিনি এটি বিলম্বিত করেছিলেন ততক্ষণ যতক্ষণ তা বিলম্বিত করে রাখা যায় । কিন্তু যখন আওয়ামী লীগ নিজেই সভা আহ্বান করার জন্য ভয়ভীতি দেখাতে লাগল তখন তিনি তড়িঘড়ি করে অতিদ্রুত ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা আসেন যাতে করে মুজিবুর রহমানকে তাঁর কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখা যায়। তিনি তাঁকে তােষামােদ করেন এবং এমনকি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘােষণা দেন। কিন্তু একই সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে। পিপলস্ পার্টির সঙ্গে একটি সমঝােতার প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন এবং তাঁদের উভয়ের সাক্ষাৎ পরিতৃপ্তির ভিতর দিয়ে সমাপ্ত হয়।
৩৮
৬৭। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়েই জেনারেল লারকানা চলে যান এবং ভুট্টোকে মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটি সমঝােতায় আসার জন্য জোরালাে সুপারিশ জানান। আওয়ামী লীগ সংসদের অধিবেশন ১৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যে ডাকার কথা। বললেও পিপলস পার্টি মার্চের শেষ সপ্তাহে সংসদ অধিবেশন বসার কথা বলে । জেনারেল দুটি দলকেই স্পষ্ট কিছু না বলে বিষয়টি অনুমানের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখেন। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখে জেনারেলের সাথে দেখা করেন এবং এমন একটি ধারণা নিয়ে বেরিয়ে আসেন যে, জেনারেল তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। কিন্তু যখন জেনারেল তাঁর গভর্নরের নিকট থেকে খবর পান শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দলের নির্বাচিত সদস্যদের একটি সভা আহ্বান করেছেন যাতে করে ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংসদ অধিবেশন বসে। সেজন্য করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে । সেইসঙ্গে এমন একটি পরিকল্পনা করতে; যাতে জেনারেল যদি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংসদে অধিবেশন আহ্বান না করেন তবে একটি রিকুইজিশন সভা ডাকা যায় কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। তখন জেনারেল নিজে উদ্যোগী হয়ে মুজিবুর রহমান কর্তৃক সম্ভাব্য রিকুইজিশন সভা ঠেকাবার জন্য তড়িঘড়ি করে ১৯৭১-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩ মার্চ তারিখে সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানিয়ে দেন। এই অবস্থায় খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়ে পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান ঘােষণা দেন যে, তিনি আসন্ন সংসদ অধিবেশনে যােগ দেবেন না। জেনারেল ঠিক এমনটি চাইছিলেন। তিনি নিজেই অন্যান্য দলের নেতাদের ভুট্টোর অনুরূপ ঘােষণা দেওয়ার জন্য আহ্বান। জানিয়েছিলেন। জেনারেল ওমার এবং জনাব রিজভীকে এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজে লাগানাে হয়। তাঁরা সেইসঙ্গে অন্যান্য দলের কিছু সংখ্যক নেতাদের ভীতি প্রদর্শন এবং ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যান।
৬৮। রাওয়ালপিন্ডিতে গভর্নর এবং সামরিক আইন-প্রশাসকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ২২ ফেব্রুয়ারির সভায় অ্যাসেমব্লি সভা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা মােহাম্মদ ইয়াকুব আলী খান, আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক, যিনি ছিলেন অ্যাসেমরি সভা স্থগিতের বিরুদ্ধে, তাদের পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানকে খবরটি জানাতে বলা হয়। কেননা, অ্যাসেমব্লি স্থগিতের খবর ১লা মার্চ ঘােষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতােমধ্যে, পিপলস পার্টির সভাপতি অ্যাসেমব্লির অধিবেশন স্থগিত করার খবর না জেনেই (যা ইত্যবসরে গ্রহণ করা হয়ে গিয়েছিল) তার দলীয় সদস্যদের। নিকট থেকে অঙ্গীকারনামা গ্রহণ করেন যে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ অ্যাসেমব্লিতে যােগ দেবেন না যদি তা ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি লাহােরে অনুষ্ঠিত এক ভাষণে তিনি কঠোর সমালােচনাসহ বলেন তার দল অ্যাসেমব্লিতে বসবেই না; এমনকি তার দল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কাউকে অ্যাসেমব্লিতে বসতেও দেবে না। যদি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনাে নেতা অ্যাসেমব্লি সভায় যােগ দিতে যান তবে তিনি ‘ওয়ানওয়ে টিকেট নিয়ে যাবেন। কেননা, তাকে আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে নামতে দেওয়া হবে না। এটি ছিল
৩৯
ভুট্টোর স্বভাবসুলভ ‘ধরন’, যার সঙ্গে ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া এবং খাইবার থেকে করাচি, সারাদেশে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতাে ভীতিও দেখানাে হয়। অবশ্যই বলতে হয়, এটি ছিল জনাব ভুট্টোর কৃতিত্ব যে তিনিও আইনগত কাঠামােতে (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে) বেঁধে দেওয়া ১২০ দিনের সময়সীমার বিষয়ে বিকল্প হিসেবে নমনীয় উপদেশ সম্বলিত প্রস্তাব দেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ইচ্ছাপূর্বকভাবে তা উপেক্ষা করেন। কারণ, এটি তার পরিকল্পনার সঙ্গে মানানসই ছিল না।
৬৯। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং সে অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেলকে যুগপৎভাবে একই ঘােষণায় অ্যাসেমব্লি সভার পরবর্তী তারিখ জানাবার জন্য তুমুল প্রচেষ্টা চালালেও সে প্রচেষ্টা কোনাে ফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। ১ মার্চ তারিখে সংবাদ এবং অন্যান্য খবর-বার্তার মাধ্যমে অ্যাসেমব্লি সভার তারিখ বাতিল করা হয়েছে; এমন ঘােষণা প্রচার করা হয়। কিন্তু কবে অ্যাসেমব্লি সভা অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হলাে না। কারণ হিসেবে বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে রাজনৈতিক নেতা অ্যাসেমব্লিতে যােগদানের জন্য প্রস্তুত নন। এতে সত্যিকার কোনাে কিছু স্পষ্ট না করে বরং তা গােপন রাখা হয়। যদিও তা জানাজানি হয়ে যায়।
৭০। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ইয়াকুব যেমনটি প্রত্যাশা করেছিলেন তেমনটিই ঘটল। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক এবং অসাধারণ সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখা ছিল। আওয়ামী লীগ একটি হরতালের ডাক দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে হত্যা, অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়ে। অবাঙালিরাই ছিলেন সেই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। আঞ্চলিক সামরিক কর্তৃপক্ষ দাঙ্গা দমনে সেনাবাহিনী তলব করে। কিন্তু এ নিয়ে আওয়ামী লীগ হৈ চৈ বাধিয়ে ফেলে এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানায়। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ তারিখে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়; অনুমান করা হয় রাওয়ালপিন্ডির নির্দেশে। কিন্তু তখন থেকেই আওয়ামী লীগ আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করলে পর সমস্ত অফিস, ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়ে। শান্তি রক্ষার জন্য শেখ মুজিবের আবেদনের পরেও হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ চলতে থাকে। ঘরে ঘরে লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিকদের কাছ থেকে অস্ত্র জোর করে নিয়ে নেওয়া হয় । ছাত্রীসহ ছাত্ররা ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র মহড়া দিতে থাকে। ফলে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং অবাঙালিরা ঢাকা শহর ছাড়তে থাকেন। খবরের কাগজে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র বিপ্লবাত্মক খবরাদি প্রকাশিত হতে থাকে এবং ১৯৭১এর ৭ই মার্চ থেকে আওয়ামী লীগ সকল প্রকার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দেশের শাসনভার হাতে তুলে নেয়। দলটি ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক/বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষণে ক্ষণে প্রদত্ত নির্দেশনামা জারি করে। নির্দেশনামা ব্যতিরেকে কোনাে ধরনের দায় পরিশােধ না করতে এবং জনগণকে কর প্রদান না করতে বলে। এমনকি সেনাবাহিনীর জন্য রেশন প্রদান বন্ধ করা হয়। যার জন্য বিমানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রসদ সরবরাহ করা হতে থাকে। রাস্তাঘাট, রেলপথ এবং নৌ চলাচল সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। সর্বত্র পলায়নপ্রবণ অবাঙালি খোঁজার জন্য ‘চেকপােস্ট’ স্থাপন করা হয় এবং আওয়ামী
৪০
লীগের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ (রেভ্যুলেশনারী কাউন্সিল) কর্তৃক তাদের মূল্যবান সম্পদাদি হরণ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় একটি একপক্ষীয় স্বাধীনতার ডাক দেবেন বলে ধারণা করা হলেও চূড়ান্তভাবে তিনি তা করেনি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আইন অমান্য আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘােষণা দেন এবং এর ফলে সেখানে বেসামরিক সরকার পঙ্গুত্ব বরণ করে।
৭১। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসান পদত্যাগ করেন। আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল ইয়াকুব খানও ৪ মার্চ পদত্যাগ করেন। কিন্তু পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয় । লে. জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ থেকে কার্যভার গ্রহণ করেন, তিনি একইসঙ্গে গভর্নর এবং আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। কিন্তু ঢাকা শহরে তিনি কোনাে বিচারপতি খুঁজে পাননি যিনি তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করাতে পারেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটেছিল যে, বিচারালয় বসার মতাে অবস্থা ছিল না। কোনাে বিচারকই তাঁর জীবনে ঝুঁকি গ্রহণ করতে চাননি। সেনাবাহিনী সেনা ছাউনিতে ফিরে গেলে কী হবে তা ভেবে জেনারেল টিক্কা কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন কেবলমাত্র একজন সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় সংঘঠিত চলমান অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দাঙ্গার পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি দৃঢ় কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি এই অজুহাত দেখান যে, তাঁকে আলাপআলােচনার মাধ্যমে “মীমাংসার দরজা উন্মুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা তাঁর দেওয়া ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করা গিয়েছিল জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা ফুলবাবু’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার ফলে দেশানুগত নাগরিকের জীবন ও সম্পত্তির হানি ঘটতে থাকে। যদিও আমরা যতদূর জানতে পেরেছি সেখানে সামরিক আইন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা সামরিক সদর দপ্তর থেকে পরিস্থিতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না; এমন কোনাে নির্দেশও ছিল না। আমরা এই অনুভূতির প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারিনি যে, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য কর্মকর্তারা এবং তাদের আদেশদাতাগণ এ সময়ে তাদের কর্তব্য অবহেলা করেননি। যদি তারা কর্তব্য কাজ করে যেতেন, তাহলে ২৫ মার্চের সহিংস আক্রমণজনক পরিস্থিতির প্রয়ােজন হয়তাে পড়ত না। জেনারেল ইয়াহিয়া ভাবতে থাকেন যে, লে. জেনারেল ইয়াকুব যিনি আগে অপারেশ ব্লিজ’ এর পরিকল্পনা করেছিলেন তা চূড়ান্তভাবে ৭ মার্চের পরে টিক্কা খানের অকমৰ্ণতার কারণে শীতল পদযুগলে’ পরিণত হয়।
৭২। বিষয়টি যেমনই হােক সেদিকে না তাকিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ ১৯৭১, ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি সভায় যােগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন, কিন্তু শেখ মুজিব উক্ত সভায় আসতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায়, জেনারেল নিজে ঢাকায় এসে ১৫ মার্চ তারিখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি মীমাংসামূলক সভা করেন। টিমের সদস্য, সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন কতিপয় ব্যক্তি, যেমন বিচারপতি এ আর কর্নেলিওয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা এবং জেএজি
৪১
শাখার কর্নেল হাসান। তবে জেনারেল এ হামিদ খান এবং মেজর জেনারেল মিত্থা উপস্থিত থাকলেও তাঁরা সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেননি। খবরের কাগজের সূত্রে জানা যায় এই মীমাংসামূলক সভা ভালােভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে সেই কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের ঢাকায় ডেকে পাঠানাে হয়। তারা সকলে এবং বিশেষ করে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান এ রকমের ধারণা নিশ্চিত করেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের দাবিগুলাে মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন যদি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা সে বিষয়ে রাজি থাকেন। তথাপিও, মীমাংসালােচনা ভেস্তে যায় এবং পিপলস পার্টি লােকজন ব্যতীত অন্য সকল নেতাকে ২৪ মার্চের মধ্যে ঢাকা ত্যাগের জন্য বলা হয়েছিল।
৭৩। মীমাংসালােচনার সবচেয়ে উৎসুক দিক ছিল এই যে, রাজনৈতিক নেতারা কেউই কখনাে কোথাও আলােচনা চলাকালে জেনারেলের দেখা পাননি। প্রত্যেক দল আলাদা আলাদাভাবে জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং অন্য দলের মনােভাব সম্পর্কে তাঁর নিকট থেকে জ্ঞাত হন। কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদে দলসমূহ যুক্তভাবে জেনারেলের সঙ্গে সভা করেন এবং তারপর তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। জনাব ভুট্টো এবং শেখ মুজিবুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপস্থিতিতে বা অন্য কোনভাবে কখনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনা করেননি। তাদের একমাত্র যৌথ আললাচনা করতে দেখা গিয়েছে যখন শেখ মুজিবুর রহমানের বিদায় লগ্নে সৌজন্যবশত জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনের বারান্দা অবধি এগিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কুশল বিনিময় করেন। তখন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রস্তাবসমূহ যাতে জনাব ভুট্টো মেনে নেন সেভাবে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। জেনারেল তাদের এ সখ্যতা নিজ কক্ষ থেকে দেখে ফেলেন। এবং রাগান্বিত স্বরে অথচ সরস মন্তব্য ভুট্টোর প্রতি ছুড়ে দিয়ে বলেন ‘এটি যেন ভালােবাসার পাখিদ্বয়ের মিলন।
৭৪। পুনরায়, সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, দলগুলাের মধ্যকার প্রস্তাবের ধারাগুলাে সম্পর্কে আমরা এখনও পর্যন্ত অন্ধকারের মধ্যে রয়েছি। তবে জেনারেলের ভাষ্য মােতাবেক জানা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যবৃন্দ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত সদস্যবৃন্দের সমন্বয়ে অ্যাসেমব্লি দুটি ভাগে বসবে। তারা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে খসড়া প্রস্তুত করবেন এবং পরবর্তীতে একটি যুগ্ম অধিবেশনে তা আলােচনা করা হবে। পাকিস্তান ভাঙার প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান খান আবদুল ওয়ালী খানের সম্মুখে এটি অস্বীকার করে বলেন যে, তিনি পাকিস্তান অর্জনের একজন লড়াকু ছিলেন, তাই তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চান না। কিন্তু তিনি অতি সামরিক শাসনের অবসান চান। এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা সম্বলিত প্রদেশের দাবি জানান। বলা হয়ে থাকে। এক পর্যায়ে শেখ মুজিব নিজে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর কর্তৃত্ব ফলাবার বেলায় উৎসাহী ছিলেন না। অর্থাৎ, জেনারেল যেভাবে চান সেভাবেই কেন্দ্র গঠিত হবে বা চলবে। তবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করবেন। কিন্তু দেখা যায়; আপসমূলক আলােচনা ভেস্তে গিয়েছিল একটি বিষয়ে; তা হলাে অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিষয়ে মতভেদের কারণে। জেনারেলের পরামর্শকেরা
৪২
ভেবেছিলেন (বলা হয়ে থাকে), এটি করা সম্ভব নয়। কেননা, তা ক্ষমতা-শূন্যতার সৃষ্টি করবে। এবং একজন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল অকার্যকর হয়ে পড়বেন। উপদেষ্টাগণ ভেবেছিলেন যে সে লক্ষ্যে নিদেনপক্ষে একটি ‘রেজুলেশন’ না নিয়ে বা অ্যাসেমব্লিতে না বসা পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। যখন বিচারপতি কর্নেলিওয়াস আওয়ামী লীগের নিকট এই তত্ত্ব উচ্চারণ করলেন; তখন আওয়ামী লীগের একজন নেতা এর প্রতিবাদ জানান এবং বলেন যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি জেনারেলের রাজি হওয়ার আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চান। কিন্তু সন্দেহ করা হয় এটি ছিল সমাধান অযােগ্য বিষয়। মীমাংসালােচনা বিফল করার জন্যই কি এটি উত্থাপন করা হয়েছিল?
৭৫। ভালাে বা মন্দ এ ধরনের অপ্রয়ােজনীয় যুক্তিতর্কে না গিয়ে আমরা অবশ্যই উল্লেখ করতে চাই, যে জটিল বিষয়ে মীমাংসার আলােচনা চলছিল তা ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ ছিল এই যে, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে সামরিক আইন রদ করে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেছিল। তাদের কাছে এটি যথার্থ বলে বিবেচিত হয়নি। কারণ, সামরিক আইন রদ করলে শাসন ব্যবস্থায় দেশে সামরিক বাহিনীর পক্ষে আর বৈধভাবে কাজ করা সম্ভব হতাে না। আমরা বলতে চাই এ অবস্থা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে ক্ষমতাহীন করে ফেলত।
৭৬। কারণ যাই থাক না কেন যে জন্য মীমাংসালােচনা ভেঙে গিয়েছিল, সে বিষয়ে আমাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ২৫ মার্চ, ১৯৭১ মধ্যরাতে যে ধরনের কর্মকাণ্ড চালানাে হয়েছিল তা আওয়ামী লীগকে দমনের জন্য হলেও কোনােভাবেই যুক্তিযুক্ত ছিল না। এ কাজে ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব। এ কাজের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যের ওপর সিলমােহর এঁটে দেওয়া হয়েছিল।
৭৭। সেখানে উপদেশ ছিল ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করার পরপরই ২৫ এবং ২৬ মার্চ মাঝামাঝি সময়ে সামরিক বাহিনী অভিযান/আক্রমণ চালাবে। এটি তাদের জন্য প্রয়ােজনীয় ছিল। কেননা, সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ খবর পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নিজেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল ৩টায় আক্রমণে যাবে। এর সমর্থনে যা বলা হয় তার বিরুদ্ধে অভিযােগ আসে যে, এ ধরনের কোনাে পরিকল্পনা আদৌ ছিল কি না। কেননা, বাংলাদেশ রেডিও তার পরবর্তী দিনে চালু করা হয়নি। এমনকি সেখানে ছিল না “লিবারেশন অর্মি” যা রাতারাতি গঠন করা সম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাপ্ত গােয়েন্দা তথ্য থেকে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এবং আর্মড পুলিশ দ্বারাই লিবারেশন আর্মি’ গঠন করার সম্ভাবনা থাকতে পারত, তাছাড়া ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি তাদের সমর্থন ইতােমধ্যে প্রদর্শিত হয়েছিল। অন্যদিকে, এটি যুক্তির সঙ্গে বলা হয় যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দ্বারা পরিচালিত মীমাংসালােচনা ছিল একটি ধাপ্পাবাজি ও চক্ষু ধােলাই কার্যক্রম যা “ওপারেশন ব্লিস” এর প্রস্তুতিকে আড়াল করার জন্য করা হয়েছিল। যাতে করে তা উত্তমভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। মীমাংসালােচনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সেনা, অস্ত্র, রসদ, জড়াে করার জন্য প্রয়ােজনীয় কালক্ষেপণ হিসেবে। এটিও কেউ কেউ বিবেচ্য বলে মনে করেন যে, মীমাংসালােচনা পুরােপুরিভাবে ভেঙে যাবার আগেই সামরিক
৪৩
অভিযান/আক্রমণ চালানাে হয়েছিল। কেননা ৭১-এর মার্চের ২৫ তারিখেও জেনারেল ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের আলােচনার মধ্যে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাছাড়া এমনকি পিপলস্ পার্টির নেতাকে বলা হয়নি যে, জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তার সাহায্যকারীরা ২৫ মার্চ চলে গিয়েছেন।
৭৮। সামরিক অভিযানের পেছনে যে যুক্তিই থাকুক না কেন, নিঃসন্দেহে বলা যায় এটি কেবলমাত্র প্রতিরােধমূলক ছিল না, সেইসঙ্গে তা ছিল শাস্তিমূলক। প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী সেনাবাহিনীর খাদ্যসহ রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং তারা সার্বক্ষণিক তিরস্কারের মধ্যে ছিলেন। এমনকি, তাদের প্রতি খারাপ ব্যবহারও করা হয়েছিল। এই অবস্থায় যখন অভিযান/অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ তারা পেলেন তখন তারা এর বাস্তবায়নে ভাললাত্বের গুণাগুণ বা যথার্থতার পরিমাপ বজায় থাকছে কি না তা খতিয়ে দেখার প্রয়ােজনবােধ করেননি। তাদের কর্মকাণ্ড ছিল সে কারণে প্রতিশােধপ্রবণ। এমনকি সেনাবাহিনীতে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অনেকেই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, বর্বরতামূলক কাজ অনেক ক্ষেত্রেই করা হয়েছিল। পুরাে গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছিল। কোথাও কোথাও এ সময় বয়স্ক অথবা নারী-পুরুষ বিবেচনা না করে সকলকে একত্রিত করে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যদিও কোনটি সত্য এটি সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যায়ন করা অসম্ভব। তারপরও কিছু কারণ রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা মজবুত মন্তব্যে পৌঁছিয়েছি যে, এ ধরনের ঘটনা যে প্রকারেই হােক না কেন যা শ্বেতপত্রের মাধ্যমে বলতে চাওয়া হয়েছে তারচেয়ে ছিল বেশি, নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিনা উসকানিতে প্রতিহিংসামূলক তৎপরতা সেখানে ঘটানাে হয়েছিল। সেনাবাহিনীর অভিযানের কারণে কতজন মানুষ নিহত হয়েছিল ঘটনার চারমাস পরে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রে তা উল্লেখ করা হয়নি। যদিও সেখানে মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক তৎপরতার কারণে কত মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিল সে সংখ্যা উল্লিখিত ও মূল্যায়িত হয়েছে। এখন সেখানে কারও পক্ষেই সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। আমাদের নিকট সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ে টিক্কা খান নিহত মানুষের সংখ্যা সম্ভাব্য ১৫,০০০ বলে উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিহতের সংখ্যা ৩০,০০০ বলেছেন। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড কর্তৃক সরবরাহকৃত ও প্রাপ্ত তথ্যে উল্লিখিত নিহতের সংখ্যাও সঠিক নয়। তাঁরা ২৬,০০০ হাজার বলেছেন। তাঁরা আঞ্চলিক কমান্ডারদের মাধ্যমে কাজ করতেন। মনে করা যায়, নিহতের সংখ্যা নির্ধারণে তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তা মিনিমাইজ করেছেন (ন্যূনতম সংখ্যা বলার চেষ্টা করেছেন)। সেখানে বাছবিচারবিহীন হত্যাযজ্ঞ বা কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতা ঘটনানাে হয়েছিল- এটি সুনিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে বারবার অধীনস্থ বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল যেন সঠিকভাবে আচরণ করা হয়। কেননা, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে কেন্দ্রে অপ্রত্যাশিত ঘটনার নানা অভিযােগ এসে জমা হচ্ছিল। আমরা প্রমাণ পেয়েছি সেখানে বেশ কিছু ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, বাছ-বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন চালানাে হয়েছিল এবং কোথাও কোথাও তা করা হয়েছিল ব্যাপকভাবেই । আর এসব কর্মকাণ্ডে এমনকি কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েছিলেন। এসব নিয়ে কিছু কিছু তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল । কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কিছুসংখ্যক সেনাসদস্যের শাস্তি হয়, কিন্তু সেসব শাস্তির
৪৪
পরিমাণ মােটেও দৃষ্টান্তমূলক ছিল না। এর কোনাে রেকর্ড না থাকার কারণে তাদের অপকর্মের খতিয়ান সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তা বহির্বিশ্বে আমাদের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছিল। সে কারণে অভিযােগগুলাের পরিপূর্ণ তদন্তের জন্য আমরা উপদেশ দিচ্ছি যখন বন্দি সৈনিকেরা দেশে ফিরে আসবেন তখন তা সম্পন্ন করার জন্য।
৭৯। তথ্য-প্রমাণ থেকে আমরা এই মন্তব্য থেকে রেহাই পেতে পারছি না যে, মার্চের মীমাংসালােচনায় কোনাে ইতিবাচক সমাধান আসুক এটি ইয়াহিয়া খান বা তার বিশ্বস্ত অনুসারীরা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন। সামরিক এবং রাজনৈতিক দুটি অবস্থান সম্পর্কে তিনি পুরােপুরিভাবে জ্ঞাত ছিলেন। বরং তিনি পরিপূর্ণভাবে মনস্থির করেছিলেন যে, এখন বা যেকোনাে পর্যায়েই তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না।
৮০। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে আমরা অনুভব করেছি; এটি উল্লেখ করা আমাদের কর্তব্য যে, শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি যদিও তার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে আরম্ভ করতে চাননি; কিন্তু নির্বাচনােত্তর পরিস্থিতিতে তিনি তার নিজস্ব কর্মসূচির বন্দিত্বের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। এটি তিনি আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। এটি দৃষ্টিগােচরে এসেছিল যে, নির্বাচনের আগে তিনি সত্যিকারভাবে কাউন্সিল মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীকে পূর্ব পাকিস্তানে কিছু আসন ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তারা যদি এটি গ্রহণ করতেন, তাহলে আওয়ামী লীগ অ্যাসেমব্লিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত না। যদিও তারপরেও দলটি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নিজেদের বজায় রাখতে পারত। স্পষ্টত যে, তাহলে তিনি তাঁর দল কর্তৃক প্রদত্ত ছয়-দফা বাস্তবায়নের চাপ এড়িয়ে যেতে পারতেন এবং তার দলসহ তখন তিনি অ্যাসেমব্লিতে সামগ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য কাজ করতে পারতেন। এই মনােভাব থেকেই এমনকি ৭ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত দলের চাপমুক্ত হওয়ার জন্য তিনি ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। যাতে তাকে বন্দি করা হয়। মীমাংসালােচনার সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলােচনার সময়ে গােপনীয় কী কী বিষয় ছিল বা আওয়ামী লীগের বক্তব্য কী ছিল সে বিষয়ে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করার সুযােগ নেওয়া সম্ভব নয়। কিংবা সে বিষয়ে কোনাে পত্রও আমাদের হাতে আসেনি। কিন্তু খান আবদুল ওয়ালী খানের ভাষ্যানুযায়ী জানা যায়, জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পত্র মারফত সত্যিকারভাবে ছয় দফার চেয়ে অনেক বেশি কিছু গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যেহেতু আমাদের নিকট এ বক্তব্য সঠিকভাবে প্রমাণ করার মতাে অন্যকোনাে তথ্যাদি নেই, সেহেতু এটি গ্রহণ করা খুবই মুস্কিল যে, সত্যিই জেনারেল ইয়াহিয়া এমনটি করেছিলেন কি না। কোনাে কোনাে রাজনৈতিক নেতা সাক্ষ্য প্রদান করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাদের জানিয়েছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজেই ‘দুই কমিটি’ ফরমুলা এবং প্রদেশসমূহে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্ত রের প্রস্তাব করেছিলেন। ঘােষণায় এ বিষয়টি সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, প্রস্তাবটির খসড়া তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ। সেহেতু, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কষ্টকর যে, জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক প্রস্তাবিত হয়েই দুটি পৃথক কমিটি’র ধারায়।
৪৫
অ্যাসেমব্লি বসবে। আমরা বরং বিশ্বাস করতে ইচ্ছুক যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রস্তাব করেছিলেন আওয়ামী লীগ এবং পিপলস্ পার্টির মধ্যে মতৈক্যর ভিত্তিতে একটি গ্রান্ড কোয়ালিশন গঠনের। সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমান কখনাে সেরকম প্রস্তাবে রাজি হননি। যাই হােক না কেন, আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে, শেখ মুজিব এই ধাক্কাধাক্কিজনক পরিস্থিতিতে সুদক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনাবিদের (স্টেটসম্যানশীপ) পরিচয় দিতে পারেননি। আর এজন্যই দেশ চূড়ান্তভাবে বিভক্তির দিকে এগিয়ে যায় । তিনি উভয় প্রদেশের ওপর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ক্ষমতারােপ করে, উত্তম অবস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তুষ্টির নিরসন করতে পারতেন। সেইসঙ্গে দেশে গণতান্ত্রিক ধারার পুনরুদ্ধার ও উপযুক্ত জীবনযাপনের পরিবেশ রক্ষা করতে পারতেন। এরপরও যদি তিনি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। হওয়ার প্রয়ােজনবােধ করতেন; তাহলে হয়তাে সময়ের আবর্তে বিনা রক্তপাতে তা সম্ভবপর হতে পারত। এমতাবস্থায় বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপও হয়ে পড়ত অপ্রয়ােজনীয়। কেননা, এটি তার জন্য ছিল নিজস্ব প্রতিকূলতা।
৮১। আমরা সেইসঙ্গে পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান-এর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবকে অনুভব না করে পারছি না। কেননা, অ্যাসেমব্লি বসার তারিখ স্থগিত করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে তার প্রতিক্রিয়া কতদূর গড়াবে সে বিষয়ে তিনি আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি আমাদের কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, এর ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানে এভাবে সহিংস প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা ছিল তাঁর কাছে প্রত্যাশার বাইরে। যদি (বলা হয়) শেখ মুজিবুর রহমান তার আচরণে ছিলেন আপসহীন, তাহলে বলতে হবে ভুট্টোও ছিলেন সমানভাবে অনড়। শেখ মুজিবুর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র দলগুলাের সহায়তায় অ্যাসেমব্লিতে ২/৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একটি সংবিধান পাশ করাতে সক্ষম হবেন। কিন্তু পিপলস্ পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয় তাদের সংশ্লিষ্টতা ব্যতিরেকে দেশে কোনাে সংবিধান পাশ করা যাবে না। কোন ধরনের নীতির ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ এগিয়ে নেবার দাবি করা হয়েছিল তা আমরা উপলব্ধি কতে পারিনি। যদি মতৈক্যের মানদণ্ডে বিচার করা হয়, তাহলে প্রতিটি ফেডারেশনের একককে গুরুত্ব দিতে হতাে। এবং তা কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তর দলভিত্তিক হলেও হতাে না। কেননা, দলটির কমপক্ষে দুটি ফেডারেল ইউনিটে কোনাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না।
৮২। দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ তত্ত্ব এবং “গ্রান্ড কোয়ালিশনের প্রস্তাব পিপলস্ পার্টির নিকট থেকে দেখা হয় এমনভাবে যে, তা কেবলমাত্র কনফেডারেশন’ এর অবয়বেই হতে পারে। কিন্তু ফেডারেশনের আওতায় নয়। ফেডারেশন ধরনের সরকার ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সাধারণত স্বাভাবিকভাবেই সরকার গঠন করে থাকে। কোয়ালিশনের প্রশ্ন তখনই দেখা দিতে পারে; যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যথার্থভাবে সবল নয়, যার জন্য এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারে। অথবা সেক্ষেত্রে জাতীয় সরকার গঠনের প্রত্যয় অনুভূত হয়। সেজন্য আমাদের কাছে মনে হয়েছে, পিপলস্ পার্টিও দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পুরােপুরি ও যথাযথভাবে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ, সে সময়ে দেশের সংহতি রক্ষার জন্য তা ছিল অতীব প্রয়ােজনীয়।
৪৬
৮৩। ৩ মার্চ, ১৯৭১ সালে ডাকা অ্যাসেমব্লিতে যােগদান না করা বিষয়ে পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান-এর দেওয়া ব্যাখ্যা আমাদের কাছে মনঃপূত বলে মনে হয়নি। যদি আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্যুতে ছয়-দফা কর্মসূচি সংযুক্ত না থাকত; কিংবা এর বিরুদ্ধে নির্বাচনের আগে প্রচারণা না-ও হতাে, তারপরও এটি মেনে নেওয়া মুশকিল যে, কীভাবে তারা বুঝতে পারলেন নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ এই কর্মসূচির পক্ষে জোরাজুরি করবে। বিশেষ করে অধিবেশনে যাওয়ার সময়ে যে তারা উক্ত কর্মসূচি বাতিল করবেন বা প্রদত্ত ম্যান্ডেটের ওপর সমঝােতায় আসবেন। যদি কোনাে ধরনের সমঝােতার প্রশ্ন আসত; তাহলে তা আসত পরিষদের অধিবেশনের কক্ষে। অথবা কমিটি সভায় আলােচনার সময়ে। কেন পিপলস্ পার্টি তাদের সমুদয় ক্ষমতা অধিবেশনে গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্তভাবে প্রয়ােগ করে ছয় দফা কর্মসূচি বা ভােট পদ্ধতির বিরােধিতায় গেল না তা আমাদের কাছে বােধগম্য নয়।
৮৪। এ বিষয়ে কোনাে ধরনের সন্দেহ নেই যে, সামরিক ধারার কার্যক্রমের মাধ্যমে কোনাে সমাধান অর্জন করা যায়নি। এটি বাস্তবসম্মত বা বস্তুনিষ্ঠ হতে পারত যতটুকু সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করে রাজনৈতিক মধ্যস্থতার পথ পরিষ্কার করে দেওয়া যেত ততটুকু প্রয়ােগ করা। অথচ, তা এমনভাবে প্রয়ােগ করা হলাে যার দরুন রাজনৈতিক সমঝােতা বা সমাধানের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলাে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন যে, যদি সামরিক কার্যক্রম কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমঝােতার সুযােগ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতাে, তাহলে ১৯৭১-এর। এপ্রিল-মে মাসে যখন দেশে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটেছিল, তখন রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা হয়তাে ফল দিতে পারত। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে জানা গিয়েছিল যে, ভারত মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ করে দিয়েছিল এবং বর্ষা মৌসুমে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রেরণের ব্যবস্থা নিচ্ছিল। এ ধরনের সমাধান যদি সত্যিই অর্থবহ করতে চাওয়া হতাে; তাহলে তা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সঙ্গেই হতে পারত। বিশ্বাসঘাতক অথবা জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত দলগুলাের সঙ্গে নয়। কেননা তারা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই দেখা যায়, আন্তরিক এবং অর্থবহ কোনাে পদক্ষেপই তখন কিংবা পরবর্তীতে নেওয়া হয়নি ; যার ভিতর দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝােতার পথে আসা যায়। যদিও তখন আওয়ামী লীগের দুজন নেতা সরকারের কারাগারেই ছিলেন। এবং বিদেশি শক্তি এ বিষয়ে সহযােগিতার জন্য হস্ত প্রসারিত করেছিল; যাতে করে ভারতে চলে যাওয়া কিছু নেতাকে আলােচনার টেবিলে আনা যায়। এমনকি পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের যদি সেরকম রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান না থাকে, আমাদের জানানাে হয়, বিদেশি বন্ধুপ্রতীম দেশের পক্ষ থেকেও সেরকম কোনাে উপদেশ আমাদের দেওয়া। হয়নি; যাতে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ের ওপর গুরুত্বারােপ করা যায়। রাজনৈতিক সমস্যাগুলাে রাজনৈতিক পথ ভিন্ন অন্য কোনােভাবে সমাধানযােগ্য নয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টাদের জানা উচিত ছিল সামরিক পথে নিজের দেশের মানুষের ওপর শক্তি প্রয়ােগ করে সমাধান আনা যায় না। আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, জেনারেল ইয়াহিয়া সমস্যা সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়ে তেমন অনুভূতিশীল ছিলেন না। তাঁর এই নিস্পৃহ মনােভাব; আমাদের মতে, এর
৪৭
দ্বারা কেবলমাত্র আসন্ন বিপদের জটিল পরিস্থিতি উত্তরণের প্রতিই যে তিনি বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন তাই নয়, সেসঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রটিকে নিজের দেশ ভেঙে ফেলার সুযােগ এনে দেওয়া হয়েছিল। এবং তা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যার ফলে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হলাে।
৮৫। ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাগণের এই মনােভাব আমাদেরকে উল্লেখযােগ্যভাবে ভুগিয়েছে। সেই অবস্থা আমাদের পুরাে বিষয় খতিয়ে দেখতে প্রাণিত করে যে, সত্যি জেনারেল উত্তমভাবে চালিত বিশ্বাসযােগ্যতা বজায় রেখে কাজ করেছিলেন কি না। তার কর্মকাণ্ড সৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত ছিল কি না, অথবা তা অন্যায়ভাবে তাঁর নিজের ক্ষমতামুখী ছিল কি না। সেই পরিস্থিতিটি নিমােক্তভাবে বর্ণনা করা হলাে :
(১) ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ তার ক্ষমতারােহণ কেবলমাত্র বেআইনিই ছিল না, সেইসঙ্গে তা ছিল পূর্বনির্ধারিত সমীকরণসম্পন্ন (ক্যালকুলেটেড)। এটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। কেননা, ২৫ মার্চ, ১৯৬৯-এর আগেই ক্ষমতা দখলের যাবতীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে উপর্যুপরিভাবে ভুলপথে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল এ বলে যে, আঞ্চলিকভাবে সামরিক শাসন। প্রয়ােগ কোনাে ফল দেবে না। এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কুমন্ত্রণা ও ষড়যন্ত্র করে ফিল্ড মার্শালকে হতাশাগ্রস্ত করে তােলা হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল বিরােধী পক্ষের সঙ্গে কোনাে সমঝােতায় পৌছানাে যাবে না। এটি সর্বতােভাবে সম্ভব যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর দাবির প্রতি অনমনীয় থাকার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল। এ কার্যক্রম ছিল পরিকল্পিত, যাতে করে গােলটেবিল আলােচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
(২) এমনকি প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়ে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন এই অঙ্গীকার নিয়ে যে, গণতন্ত্র পুনঃজাগরিত করা হবে। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বরের আগে পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনি কোনাে প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, যার মাধ্যমে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা যায়। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হলেও ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে গিয়ে তিনি নির্বাচনের জন্য আইনগত কাঠামাে বা ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’ প্রদান করেন। এমনকি তা আবার পরিবর্তন করে ১৯৭০-এর ডিসেম্বর দেওয়া হয়।
(৩) নির্বাচনের প্রচারণার সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান টাকা প্রদান করে এবং অন্যান্য উপায়ে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। যাতে করে একটি অথবা দুটি দলই কেবল নয়; ক্ষুদে দলগুলাে সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসতে পারে। উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে কোনাে দলই এককভাবে প্রভাব বিস্তার বা প্রভাব ও হুকুম করার অবস্থানে না। আসতে পারে।
(8) জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর উপদেষ্টাদের দ্বারা শেখ মুজিবের ছয়-দফা কর্মসূচির সুষ্ঠু পর্যালােচনা করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে শেখ মুজিব ছয়দফার ইস্যুতে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে যেতে পারেন। শেখ মুজিব ঘােষণা
৪৮
করেন যে, নির্বাচন হচ্ছে আসলে ছয়-দফার ইস্যুতে একটি গণভােট। এতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে জেনারেল বা তাঁর উপদেষ্টাগণ কেউই নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে সে বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। জেনারেলের তরফ থেকে প্রতিশ্রুত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মেটানাের অথবা ভােট-বিষয়ে আগে থেকেই আইনগত কাঠামাে বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক আদেশ না দেওয়ার ব্যর্থতা ছিল। যদিও জেনারেলের ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ সালের এবং ২৮ মার্চ ১৯৭০ সালের ভাষণে বিষয়গুলাের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছিল। ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান তৈরি করা সম্পর্কিত আইনগত কাঠামাে বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করার বিষয়টি ছিল অলঙ্ঘনীয় যা কখনাে পরিবর্তন করা যাবে না। এমতাবস্থায় সুস্পষ্টভাবে এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে যায় যে, যদি এ শর্ত পূরণে অ্যাসেমব্লি ব্যর্থ হয়; তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাসেমব্লি ভেঙে দেওয়া হবে। আর এভাবে জেনারেল মক্তভাবে দেশ শাসন করার অধিকার অর্জন করবেন।
(৭) অ্যাসেমব্লি-এর সভা ডাকা বিষয়ে জেনারেলের গড়িমসি এবং তারপর ডেকেও তা পরবর্তী তারিখ ঘােষণা করা ব্যতিরেকেই স্থগিত করার মধ্য দিয়ে তিনি এবং তাঁর কর্মকর্তারা আসলে একটি কৌশল নিয়েছিলেন যাতে করে রাজনৈতিক নেতারা ঘােষণা করেন যে, তারা আর অ্যাসেমব্লিতে বসবেন না । ফলে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে; যার মধ্যে দিয়ে তাঁর শাসন তিনি অবাধে চালিয়ে যেতে থাকবেন।
(৮) ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যে ধারায় সমঝােতার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার দ্বারা বােঝা যায় যে, জেনারেল প্রতিটি দলকেই একে অন্যের মতানৈক্যকে নির্ভর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইতেন। ফলে পারস্পরিক সংঘাত ও অসুবিধাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এভাবে তিনি একটি দলকে দিয়ে অন্য দলের বিরুদ্ধে খেলেছেন এবং অচলাবস্থার দায়ভার ও বদনাম তাদের ওপর চাপাতে চেয়েছেন। যেকোনাে কারণেই হােক মার্চের সমঝােতা সম্পর্কিত আলােচনা কখনাে চূড়ান্ত ফলাফল অর্জিত হওয়ার পথে ছিল না। সেজন্য তিনি নিজে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এ কার্যক্রম সম্পর্কে তার বেসামরিক সঙ্গীসাথি এবং পিপলস্ পার্টির সভাপতিও জানতেন না।
(১০) ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে বিদেশের উপদেশের পরও সমঝােতা সম্পর্কিত আলােচনা পুনঃজীবিত করতে না পারার ব্যর্থতা জেনারেলের জন্য ছিল যুদ্ধের নিমিত্তে কবরের মতাে ঝুঁকিসম্পন্ন। যা বাস্তবে ঘটেও ছিল। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান স্বশরীরে উল্লেখ্য আলােচনার জন্য হাতের কাছেই ছিলেন। এমন পরিস্থিতি পুনরায় এই মনােভাবকে সুদৃঢ় করে যে, জেনারেল রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান হােক; সে বিষয়ে আদৌ আন্তরিক বা আগ্রহী ছিলেন না।
(১১) একটি সংবিধান তৈরি করাই ছিল যেখানে প্রধান কাজ, সেখানে তিনি দেশে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য কার্যকর করার ইচ্ছা পােষণ করেছিলেন। এই সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদে বহাল থাকাসহ
৪৯
কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে একইসঙ্গে তার পছন্দ মােতাবেক সামরিক শাসন জারি করার অধিকার রাখার ইচ্ছা পােষণ করতেন। এখানে চূড়ান্তভাবে তিনি নিজেকে শুধু সাংবিধানিক পন্থায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্বময়ই করতে চাননি, সেইসঙ্গে সংবিধানের ওপরেও নিজেকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
(১২) দেশে কবরখানার ন্যায় জরুরি অবস্থায় যুদ্ধের সময় তিনি চরম ঔদাসিন্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তখন রাষ্ট্র তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠেনি, যতটা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের মতে, অফিসের কাজকর্মে এই অবহেলা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ। তাঁর অবস্থা এমন হয়েছিল; যাকে বলা যায় ‘রােম যখন জ্বলছে নিরাে তখন বাঁশি বাজাচ্ছেন।
৮৬। উপযুক্ত অবস্থা বিবেচনাপূর্বক আমরা এই সিদ্ধান্তে না এসে পারছিনা যে, জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক সহকর্মীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল অবৈধ এবং যেনতেননা ভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতায় বহাল রাখা।
৮৭। যদিও স্পষ্টতই এই ক্ষমতা সেনাবাহিনীর সমর্থন ব্যতিরেকে চর্চা করা সম্ভব ছিল না। অবশ্য এ কথা বলা যাবে না যে, সেনাবাহিনীর প্রত্যেক কর্মকর্তা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেসকল সেনা কর্মকর্তা তাঁকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন- জেনারেল হামিদ, সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান, চীফ অফ জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল পীরজাদা, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ কর্মকর্তা এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর ওমার, জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল এবং মেজর জেনারেল মিত্থা, দ্য কোয়াটার মাস্টার জেনারেল । (জেনারেল গুল হাসান নিজেই ইয়াহিয়া কর্তৃক তাঁর সহযােগী হিসেবে বাছাইকৃত, যিনি ছিলেন অভ্যন্তরীণভাবে ঘনিষ্ঠজনদের একজন সদস্য)।
৮৮। আমরা সেসঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকারের বেসামরিক এবং সচিব ও উপদেষ্টাদের বিষয়টিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। কিন্তু আমরা তাঁদের একই শ্রেণিতে আনতে সক্ষম হয়নি। দেখা গিয়েছে যে, তাদের এমন কোনাে ক্ষমতা ছিল না যা দ্বারা তারা জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বিরত রাখতে পারতেন। কারণ নিজস্ব ক্ষমতার দ্বারা ইয়াহিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং তা চলমান রেখেছিলেন। তাদের উপদেশ তিনি খুব কমই গ্রাহ্য করতেন। বরং তাদের কথাবার্তাকে দৈনন্দিন কাজের বেশি কিছু বিবেচনা করতেন না। এ কথা বলতে গিয়ে, অবশ্য আমরা না বলে পারছি না যে, তাদের সাহসের অভাব ছিল। বিশেষ করে একজন সাবেক বিচারপতি যা করেছিলেন তা প্রশংসা পাবার নিকট থেকে বহু দূরবর্তী ছিল। তাঁর কাজকর্মের নমুনা এতই বিরূপ ছিল যে, তা আওয়ামী লীগ এবং পিপলস্ পার্টি উভয় দলের দ্বারাই ছিল ব্যাপকভাবে সমালােচিত। তিনি যদি এত নিদারুণভাবে ভুল বােঝাবুঝির মধ্যে পড়ছেন বলে মনে করতেন, তাহলে কেন তিনি সেই অসহনীয় অবস্থায় থেকে নিজেকে উত্তরণের জন্য পদত্যাগ করলেন না । কেননা, তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি জেনারেলগণের সঙ্গে একমত হতে পারছিলেন না।
৫০
৮৯। রাজনৈতিকভাবে শুরু হওয়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর সৃষ্ট ফাটল মূলত তৈরি হয়েছিল অতি-উচ্চাভিলাষী রাষ্ট্রপ্রধানদের ষড়যন্ত্রের কারণে। সেইসঙ্গে নিজের স্বার্থ বাগিয়ে নেওয়ার কৌশলসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের মস্তিষ্কে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কর্তৃক চালিত প্রথম সামরিক আইন চলাকালীন সময়ে অনুভূত হতে থাকল যে, যতদিন পর্যন্ত সামরিক শাসন বহাল থাকবে ততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অংশগ্রহণ সম্পন্ন সরকার ব্যবস্থার কোনাে আশা-ভরসা নেই। এ বােধােদয় ছিল একটি মাইলফলক। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমে ৬-দফা কর্মসূচি সামনে এগিয়ে নেয়া হয়। দৃশ্যত এটি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীতার জন্য ছুড়ে দেওয়া দাবিদাওয়াবিশিষ্ট। কিন্তু এতদসত্ত্বেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান বােকার মতাে মনে করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সামরিক বাহিনীর কর্মতৎপরতার দ্বারা ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা যাবে। যেভাবে সামরিক বাহিনীর দ্বারা শক্তি প্রয়ােগ করা হয়েছিল; তা ছিল যুগপভাবে অনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে তীক্ষাধীবিহীন। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত সামরিক অভিযান বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিতে ধ্বংসের পর্যায়ে নামায়। এবং সেইসঙ্গে তা ভারতের দীর্ঘদিনের হস্তক্ষেপের লালিত্য বাসনা পূরণের সুযােগ এনে দেয়। যার দরুন তারা খােলামেলাভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবার সুযােগ পেয়ে যায়। এটি ছিল চূড়ান্ত পাগলামি যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু জনগােষ্ঠীকে ঝেটিয়ে বিদায় করলে পর পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চিন্তাশূন্য এই কাজকর্মের জন্য যেই দায়ী হােন না কেন; এর দরুন প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে চলে যান। যদিও এমন নজীর অতীত ইতিহাসেও ছিল। কিন্তু তারপরও এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অদূরদর্শী তৎপরতা। বাছবিচারশূন্য সামরিক অভিযানের খাটি বা ‘নিট’ ফলাফল হিসেবে দেখা গেল; এমনকি যে সব নাগরিক পাকিস্তানের প্রতি দরদি ও অনুগত ছিলেন, তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন এবং দেশের সংহতি রক্ষায় হয়ে পড়লেন দ্বিধাদগ্রস্ত।
৯০। ঔদাসিন্য এবং নিস্পৃহতার কারণে ভারতীয় ভয়-ভীতিকে গ্রাহ্য করা হয়। এ বিষয়ে বহির্দেশীয় বন্ধুস্থানীয় রাষ্ট্রগুলাের উপদেশও অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, যা অন্যকে আশ্চর্য করে দেয়। এই অর্থে বলতে হয়, আদৌ সরকার সত্যিকারভাবে চিন্তা করেছিল কি না যে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিযােগিতার মুখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে । যদি তারা বেছে নেয় জনাশ্রয় অথবা আবর্জনার স্তুপ’, তাহলে সেই প্রদেশ শাসিত হবে পশ্চিমা অকর্মা রাজনীতিবিদদের দ্বারা কোনাে প্রকার বিলম্ব বা বাধা ছাড়াই এমন মনােভাব ছিল ভ্রান্তিবিলাস।
৯১। যে ধারায় সরকার পূর্বাঞ্চলের নাট্যমঞ্চে ভারতের সঙ্গে নিজেকে যুদ্ধের মধ্যে চালনা করেছিল, তাতে জানাই ছিল যে, সেখানে ছিল না কোনাে প্রকার দায়দায়িত্ব, ছিল না বৃহৎশক্তির কোনাে সমর্থনের আশ্বাস। বরং তাতে দেখানাে হয়েছিল আত্মপ্রবঞ্চনা। জেনারেল ইয়াহিয়া খানও বিষয়টি স্বীকার করেছেন; তারা কখনাে প্রত্যাশা করেননি যে, “ভারত এরূপ নির্লজ্জ ভ্রান্তি করে বসবে।” অথবা বলা যায়, তারা এর ফলাফল সম্পর্কে ছিলেন দায়িত্বহীনভাবে উদাসিন। অন্যথায়, এটি মেনে নেয়া কষ্টকর যে কেন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তমমানের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জাতিসংঘে উদ্যোগ বা ‘মােশন’ নেওয়া হলাে; নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত পৌঁছা পর্যন্ত কেনইবা পূর্বাঞ্চলের কমান্ডকে প্রতিরােধ অব্যাহত রাখার জন্য কার্যকর ও জোরালে পদক্ষেপের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলাে না।
৫১
৯২। যেদিন সামরিক আক্রমণ করা হয়েছিল, সেদিনই মােটামুটিভাবে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যায় হারিয়ে গিয়েছিল। এরপরও আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতায় পৌছার জন্য যথার্থ সময় ছিল এবং সেই সুযােগ গ্রহণ করলে পরিস্থিতি পরিশুদ্ধ করা যেতে পারত। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সেইদিকে কোনাে খেয়াল কিংবা প্রস্তুতি ছিল না। বরং তিনি একের পর এক রাজনৈতিক ভুল করে গেলেন। এবং এভাবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে সংশােধন ও নিয়ন্ত্রণ অযােগ্য পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
৯৩। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার ডামাডােলে কূটনৈতিক ক্ষেত্র উত্তম ফল দেয়নি। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি যে বিদেশ নীতির সঙ্গে আঁটসাঁটভাবে সংশ্লিষ্ট, এ বিষয়টি সরকার খুব সামান্যই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
৯৪। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে বুঝতে মােটেও কষ্ট হয় না যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানে সংকট সৃষ্টির দ্রুতায়নের জন্য যা কিছু করা প্রয়ােজন তা করতে পিছপা হয়নি। বাস্তবিকভাবে এই সংঘাতের দৃষ্টান্ত আগরতলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ্যে উন্মােচিত হয়ে ওঠে। এটি জানা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে বিপ্লব সংগঠনের জন্য ভারত অস্ত্রশস্ত্র এবং আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি না দিলেও আকাশ এবং নৌপথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যােগাযােগের মধ্যে বাধা সৃষ্টির প্রচেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু এরপরও ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে সরকার লাহােরে ভারতীয় বিমান ছিনতাই ঘটনার ক্ষেত্রে তেমন। কোনাে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অথচ, এরই ফলশ্রুতিতে ভারত তার আকাশপথে পাকিস্তানের বেসামরিক বিমান উড্ডয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তাছাড়া সরকার ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে ভারত কর্তৃক নির্ভুলভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সমরায়ােজনের বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যদি এই কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনাে প্রকার সন্দেহ পােষণ করা হতাে, তাহলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, আইন সভা, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীদের মতামত খােলামেলাভাবে রেকর্ডবদ্ধ হতে পারত। এর পক্ষে বলতে গিয়ে তারা পরিষ্কারভাবে এই তত্ত্ব জাহির করতেন যে, পাকিস্তান টুকরাে টুকরাে করার কাজটির মাধ্যমে ভারত তার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। এই সুযােগটি বারবার আসে না, এবং এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে তা গ্রহণ করার দরকার ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট জোরদার করার মাধ্যমে উদ্বাস্তু সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণও ছিল পরিষ্কারভাবে ভারতের নীতিরই অংশ। এই ইস্যুতে ভারতের কূটনৈতিক আক্রমণ ছিল পর্বতসম। এটি ছিল বৃহৎ এবং সুফলদায়ক তৎপরতা। ফলে দুনিয়ার খুব কম রাষ্ট্রই পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের সেনা অভিযানকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাবার মতাে পরিস্থিতিতে ছিল । ভারতের ‘প্রােপাগাণ্ডা’ এত সফল ছিল যে, পাকিস্তানের সেনাশক্তিতে সরকার। কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে গৃহীত পদক্ষেপগুলাে বিশ্বের জন্য ছিল অ-মুগ্ধকর। কেবলমাত্র এই নয় যে, বহির্বিশ্বের কোনাে দেশই ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে
৫২
প্রচেষ্টা দেখায়নি, বরং ভারত এ বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন বৃহৎ রাষ্ট্রের সহানুভূতিও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন- এ দেশটি ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা ভারতে প্রয়ােজনীয় যাবতীয় সরবরাহ করার তকমা পেয়ে যায়। অন্যান্য দেশ ভারতে বড়ােমাত্রার টাকা সাহায্য হিসেবে দেয়। এই অবস্থায় আমরা বিশ্বকে কখনাে বুঝাতে সক্ষম হইনি যে, আমাদের বাহিনী নির্মম ঘটনার বা এমনকি গণহত্যার জন্য আনা অভিযােগের উপযুক্ত নয়।
৯৫। রুশরা আমাদের নির্ধিদ্বায় বলেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে তারা উদাসীন থাকতে পারেননি। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমঝােতায় আসতে তারা আমাদের পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু তাদের উপদেশ অবজ্ঞার সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এমনকি তাদের রাষ্ট্রদূতকে অপমান করা হয়েছিল। ইরানের শাহ্ এর দয়ায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পার্সিপােলিশে একটি সভার আয়ােজন করা হলেও সে সভা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
৯৬। চীনা বন্ধুরাও আমাদের বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে সামরিক পদক্ষেপ যৌক্তিক হলেও এটি রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প ছিল না।
বিগ্রথিত না করা
৯৭। আমেরিকার সরকার প্রারম্ভে মুজিবকে সমর্থন জানাতে অস্বীকার করে এবং তারা সামরিক সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু আমেরিকার জনগণ, সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীমহল, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক কর্মকাণ্ডের অনৈতিক দিক সমর্থন করেনি। আমেরিকার সরকার পরিষ্কারভাবে জানায় যে, পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধে তারা বাইরে থাকবে। আমাদের অনুরােধে তারা একটি কাজ করেছিল, তা হলাে বঙ্গোপােসাগরে ৭ম নৌবহর প্রদর্শন করা । অবশ্য, এর মােটেও কোনাে কার্যকারিতা ছিল না। কেননা, নৌবহর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল থেকে হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থান করেছিল।
৯৮। সরকার দাবি করে যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তারা বিপুল ভােটে জয়ী হয়েছে, যেখানে ১০৪টি রাষ্ট্র সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু এটি পরিষ্কার করা প্রয়ােজন। যে, ওই সমর্থন পাকিস্তানের দাবির প্রতি ছিল না। তা ছিল বরং নীতিগতভাবে প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণ বা কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক। জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে সংগৃহীত প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কোনাে দেশই জঘন্য পাপাচারের জন্য আনীত অভিযােগ অস্বীকার করেনি। ভারতের ‘প্রােপাগাণ্ডা এবং আমাদের প্রােপাগাণ্ডা’র মধ্যে বিশ্বাসযােগ্যতার তফাত ছিল। খুবই বড়াে আকারের। সেজন্য তা সংযুক্ত করা ছিল কঠিন। যদিও ভারতসহ অন্যান্য প্রায় সকল বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল যে, সামরিক কর্মকাণ্ডের কারণে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছে। হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা হয়েছে। এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক সরকার নিহত, আহত ইত্যাদির প্রকৃত হিসাব কখনাে তুলে ধরেনি, কিন্তু কেবলমাত্র মুখের কথায় প্রতিবাদ করে বলেছে যে,
৯৩
ভারতসহ বিদেশি মিডিয়া এ সম্পর্কে যে প্রচারণা চালাচ্ছে তা অতিরঞ্জন বিশেষ। ১৯৭১ সালে যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়; এমনকি সেখানেও সে বিষয়ে কোনাে সংখ্যার উল্লেখ ছিল না। প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত না দেওয়ার জন্য এ বিষয়ে শতকরা ৯৮ ভাগ খবরাখবর আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। বলা হয় যে, আমরা প্রকৃত সংখ্যা ও চালচিত্র প্রকাশ করতে ভয় পেয়েছিলাম।
৯৯। জাতিসংঘেও আমরা আমাদের অবস্থান আনাড়ির মতাে ভণ্ডুল করেছিলাম। জনাব জেড এ ভুট্টোকে আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সেখানে পাঠানাে হয়েছিল; তাঁকে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশ সংক্রান্ত মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে। অথচ, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার উদ্বেগজনক খবরাখবর অথবা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক যুদ্ধবিরতির জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে প্রেরিত প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁকে যথাযথভাবে অবহিত (ব্রিক্ট) করা হয়নি। জেনারেল রাও ফরমান আলী প্রদত্ত তথ্য প্রমাণে জানা যায়নি যে, কোন্ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর পক্ষে ঢাকাস্থ জাতিসংঘের প্রতিনিধি মি. পল মার্ক হেনরি-এর নিকট বার্তা জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদকের নিকট উপস্থাপনের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। এমনকি এ বিষয়ে জেনারেল রাও ফরমান আলীর বার্তা এবং প্রকৃতপক্ষে জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক অনুমােদিত বার্তার মধ্যে তফাত ছিল । এই পার্থক্য ছিল কেবলমাত্র রাজনৈতিক মীমাংসাসংশ্লিষ্ট।
১০০। এই খবরটি যেভাবেই হােক ভারতের হাতে চলে যায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের প্রতিনিধির দ্বারা তা প্রচারিত হয়। এবং এর একটি কপি ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মি. জেড এ ভুট্টো নিউইয়র্কে পৌছা মাত্র তার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
১০১। যে-কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন অবস্থা যখন এতই বেগতিক ছিল; তখন রাশিয়া কর্তৃক প্রদত্ত প্রথম রেজুলেশন কেন গৃহীত হলাে না? তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমাদের বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে অপমানজনক আত্মসমর্পণের হাত থেকে মুক্ত করা যেতে পারত। রাশিয়ার নিশ্চয়তা এমন ছিল যে, তারা পাকিস্তানের বিখণ্ডতা দেখতে চাননি। দেখা গিয়েছিল যে, রেজুলেশন গ্রহণের পরও আমরা একই পতাকার নিচে ছিলাম। যদিও সকল দিক থেকেই দেশের দুটি অংশ এ সময় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদায় ছিল।
১০২। উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অঙ্গনেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলেন। এই বিচ্ছিন্ন অবস্থার পাকে পড়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করা, অথবা অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এর কোনােটিই আর তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমনকি জাতিসংঘের বিষয়ে যতদূর সম্ভব বলা যায়, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ভারতের পূর্ব পাকিস্তানে হামলার ঘটনাটি এবং এতদসংক্রান্ত বিরােধ যথাসময়ে তথা তাৎক্ষণিকভাবে জাতিসংঘে উত্থাপন করলে হয়তাে অন্যরকম কিছু ঘটতে পারত। কিন্তু তা না করে পশ্চিমাঞ্চলে অবনতিশীল শত্রুভাবাপন্নতা বজায় রাখা হয়। যদি জেনারেল ইয়াহিয়া খান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে সেনাবাহিনীকে অধিকতর সাহসিকতার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডকে সুসংহত করে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর পরও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে
৫৪
সর্বতােভাবে বলা যায়, নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আদেশের বলে সন্তোষজনকভাবে যুদ্ধ বিরতির মতাে ঘটনা ঘটতে পারত।
১০৩। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সামরিক দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, বর্তমান বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল পদাতিক বাহিনীর কারণে। ১৯৬৭ সালের ‘ওয়ার ডাইরেকটিভ নাম্বার ৪ অনুযায়ী আমাদের মতে, পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া বিষয়ে ১৯৭১ সালের মার্চের পরে রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে জোরালােভাবে পুনঃবিবেচনা এবং তা সংশােধন করার দরকার ছিল। কিন্তু আমরা গভীর পরিতাপের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, সেনাবাহিনীর হাই কমান্ড’ কর্তৃক গভীরে অধ্যয়ন ও তা বিশ্লেষণ করার কোনাে প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বা বুঝতে চেষ্টা করা হয়নি নতুন উপাদানগুলাের প্রভাব কী হতে পারে। বাস্তবিকভাবে এটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড’ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক পরিস্থিতির বিষয়ে একটি মিথ্যা আশাবাদ ধারণ করে ছিল। তার দরুন ভারত-রাশিয়ার ১৯৭১ সালের আগস্টের চুক্তির প্রভাব এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভারত ও পাকিস্তানের সেনাশক্তির ভারসাম্যের ওপর চরম বৈষম্য বয়ে এনেছিল।
১০৪। ১৯৪৭ সাল থেকেই সম্পদের অপর্যাপ্ততা ছিল। কিন্তু তাকে খুব কমই যুক্তি হিসেবে আনা হতাে। কিন্তু এটিকে খুব সামান্যই যৌক্তিকভাবে দৃঢ় কৌশলগত ধারণা সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়েছিল । যদি বাস্তবিকভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার জ্যেষ্ঠ সেনা-কমান্ডারদের দোষারােপ করে বলা হয় যে, সামরিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে আটকিয়ে রাখা অসম্ভব ছিল, তাহলে আমরা দেখতে ব্যর্থ হব কেন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানাে হলাে। এবং কেন একটি রাজনৈতিক সমাধানের সমস্ত উপদেশাবলি কাজে লাগানাে হলাে না।
১০৫। আমরা এই উপসংহারে আসা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে পারছি না যে, সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার থেকে পথপ্রদর্শন, নির্দেশনা এবং যুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করার প্রশ্নে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে প্রচুর ব্যর্থতা।
১০৬। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল এই প্রচলিত সাজসরঞ্জাম ব্যবহারপূর্বক সেখানে। সমন্বিত এবং সহযােগিতামূলক কোনাে প্রতিরােধ পরিকল্পনা ছিল না। প্রায় সকল প্রকার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান অথবা সেনা-সদর দপ্তর। আর এসব সিদ্ধান্ত বাস্তব অবস্থা থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন । বিশেষ করে অন্য অংশের প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বিমান বাহিনীর প্রধানের কর্মকাণ্ডে। তিনি সমুদয় চালচিত্র মাথায় রেখে আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন তাঁর রাওয়ালপিন্ডিস্থ অস্থায়ী কেন্দ্র থেকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশের প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তার কমান্ড-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তবলিতে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের মতামত বিবেচনা করার প্রয়ােজন বােধ করতেন না। এই ত্রুটির কারণে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে উচ্চতর কমান্ড। ছিল এলােমেলাে প্রকৃতির। তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও আঞ্চলিক কমান্ডারগণ নিজ নিজ ইচ্ছামতাে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতেন। ফলে সেখানে ছিল সমন্বয়হীনতা এবং বিচ্ছিন্নতা। এ ধরনের পরিস্থিতি কোনাে যুদ্ধের পরিকল্পনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বৈ কিছু নয়। তাছাড়া, উচ্চ পর্যায়ে পরিকল্পনা যত্নের সঙ্গে
৫৫
পর্যালােচনা করা হতাে না বিধায় তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এ কারণে জেনারেল হেডকোয়ার্টার কর্তৃক অনুমােদিত হওয়ার পরও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মােটামুটিভাবে তিনটি ত্রুটি চিহ্নিত করা যায়, যথা-
(১) এখানে পথপ্রদর্শনমূলক কোনাে নির্দেশনা তৈরি ছিল না; যার মাধ্যমে সময় নির্ধারণপূর্বক সীমান্ত এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে পূর্বপরিকল্পিত প্রতিরক্ষা লাইনে তাদের আনা যায় ।
(২) নগর-দুর্গ স্থাপনের ধারণা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কেননা, সেখানে শক্ত ধাঁচের আঘাতের জন্য কোনাে সংরক্ষিত বা রিজাভ সৈন্য রাখার ব্যবস্থা ছিল না, যারা কি না শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য পাশ কাটাতে পারেন। অথবা | তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যবহার করতে পারেন।
(৩) এই পরিকল্পনার মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সময়মতাে প্রত্যাহার করে নেওয়ার মতাে স্থলপথ বা সমুদ্রপথের নির্দেশ ছিল না। যদি শত্রুপক্ষ ভূখণ্ড অতিক্রমের জন্য ভরপুর হয়ে ওঠে, তখন কী করা হবে, তার দিক নির্দেশনা ছিল না।
১০৭। এটি ভেবে আমরা আশ্চর্য না হয়ে পারি না যে, ঢাকা ছিল সামরিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অথচ, ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড-কোয়ার্টারের কোনাে বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল না।
১০৮। পশ্চিম রণাঙ্গনের (ওয়েস্টার্ন থিয়েটারে) মাস্টার পরিকল্পনাতেও ছিল গুরুত্বর দুর্বলতা, যেমন-
(১) এখানে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আক্রমণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনাে প্রকার সময় বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
(২) সংরক্ষিত সেনাবাহিনী কোন্ কোন্ পরিস্থিতিতে কাজে লাগানাে হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। এবং
(৩) মাস্টার পরিকল্পনায় এডহক ভিত্তিতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। অথচ, তা সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার কর্তৃক যথাযথভাবে পরীক্ষিত ছিল না।
১০৯। পরিকল্পনার এই সকল ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা কার্যত সবকিছু অকার্যকর করে দেয় । এবং ব্যক্তিকেন্দ্রীক সিদ্ধান্তহীনতা সবকিছু ব্যর্থ করে দেয়। যার দরুন পশ্চিম পাকিস্তানের বড়ােমাপের ভূখণ্ড শক্রর কাছে হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়।
১১০। শত্রুর সক্ষমতার বিষয়ে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান, আমাদের সীমান্তের বাইরে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নড়াচড়া ও অগ্রসরতা এবং সীমান্তে আমাদের বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন লড়াই সত্ত্বেও আমরা ভেবে আশ্চর্য হই যে, আমাদের সেনানেতৃত্ব একটি বিভ্রান্তমূলক ঘােরের মধ্যে ছিলেন। তারা। ভেবেছিলেন, ভারত প্রত্যক্ষ এবং উন্মুক্ত আক্রমণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের ভূখণ্ড দখল করার মতাে বােকামি করবে না। বাস্তবে আমরা জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট থেকে জানতে পেরে বিস্মিত হই যে, তিনি নিজে “কল্পনা করেছিলেন ভারত কখনাে এই বিষয়ে আমাদের সঙ্গে অশালীন যুদ্ধে মেতে উঠবে না… তারা মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে, অস্ত্র দিচ্ছে এবং তারা এটিই করে যাবে। কেন তারা নিজে যুদ্ধ করবে।”
৫৬
১১১। সে কারণে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ খােলর প্রজ্ঞা নিয়ে আমরা মারাত্মক সন্দেহগ্রস্ত হয়েছি। যদি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলার প্রয়ােজন হতাে, তাহলে তা খােলা উচিত ছিল ভারতীয় বাহিনী যখন খােলামেলাভাবে পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেছিল তখন। অন্যদিকে, যদি ‘সেনা হাইকমান্ড’ নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতীয়রা শুধুমাত্র মুক্তি বাহিনীকে সমর্থনদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, তাহলে দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ খােলার অর্থ দাঁড়াল পূর্ব পাকিস্তানের পতনকে দ্রুততর করা।
১১২। এমনকি ‘দ্বিতীয় ফন্ট খােলার পরেও পরিকল্পিত আক্রমণ পরিচালনা করা হয়নি। যদিও ভারতকে যথেষ্ট উসকানি দেওয়া হয়েছিল। যেমন ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, আমাদের বিমান বাহিনী কর্তৃক প্রাচীন ধারায় আক্রমণ, এবং চাম্ব, ডাহারাস, লাহাের সেক্টর, হুসেনিওয়ালা এবং সুলেমানকিতে ভারতীয় ভূখণ্ডে আমাদের বাহিনীর অনাহুত অনুপ্রবেশ করেছিল। এই সব উসকানির ফল হিসেবে ভারতীয়রা প্রতিক্রিয়া দেখাতে আরম্ভ করেন। এবং যদিও এমনটি প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, তারপরও আমাদের তরফ থেকে আক্রমণ পরিকল্পনামাফিক হচ্ছিল না। কোনাে প্রকার সাংঘাতিক যুদ্ধ ব্যতীতই আমরা হারিয়েছিলাম পুকলিয়ান অঞ্চল, সাকারগড় এলাকার প্রায় ৫,০০০ গ্রাম যা ছিল সিন্ধুর প্রায় ৫০০ কিলােমিটার এলাকায়। শত্রুরা কেবলমাত্র উক্ত এলাকার ওপর দিয়ে হেঁটে যায়, যা খুবই হালকাভাবে আমরা আঁকড়ে ধরেছিলাম। শত্রুরা যখন এই হালকা প্রতিরােধ বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়াল তখন আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পিছু হটলাম। শত্রুরা খনিজ এলাকা দিয়ে সতর্কভাবে এগােল। যে আক্রমণ পরিচালনা করার কথা ছিল তা চীফ অব স্টাফ কর্তৃক বরফ শীতল করে দেওয়া হলাে। কেউই কোনাে প্রকার আপত্তি উত্থাপন করলেন না। আর এভাবে আমাদের মহাকৌশলের সমাপ্তি ঘটল।
১১৩। আমাদের বিমানবাহিনী বীরবিক্রমের সঙ্গে এগিয়ে এলেও আমরা দেখলাম; সেখানেও আমাদের বিমানবাহিনী পেশােয়ার থেকে করাচি এবং সীমান্ত এলাকার প্রতিরক্ষা বিষয়ে কার্যকর হতে পারছে না। প্রতিটি দিনই শত্রুরা ক্রমান্বয়ে আকাশে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যার দরুন সামরিক বাহিনীর চলাচল মুস্কিল হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে ঢাকা পতনের পর ৯ স্কোয়াড্রন বিমানবাহিনীকে পূর্বাঞ্চল (ইস্টার্ন থিয়েটার) থেকে স্থানান্তর করার পর।
১১৪। নৌবাহিনী যদিও ক্ষতির দিক থেকে ভারতীয় নৌবাহিনীর সমানতালেই ছিল; কিন্তু ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে এটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। কেননা, ওএসএ (OSA) শ্রেণির বােট থেকে মিসাইল আক্রমণ হচ্ছিল। আর এ ধরনের আক্রমণের জন্য আমাদের নৌবাহিনী প্রস্তুত ছিল না।
১১৫। এসকল কিছুর খাঁটি বা ‘নিট’ ফলাফল হলাে, আমরা যে কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে হারালাম তাই নয় সেসঙ্গে শত্রুপক্ষের সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেরও ব্যাপক ভূখণ্ড হারালাম।
১১৬। এটি একটি দুঃখজনক মন্তব্য যে, আমাদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব আমাদেরকে শক্তিশালী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অথচ, তাদের ছিল না কোনাে প্রকার মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি অথবা সমন্বিত বাস্তব পরিকল্পনা। এটি এমন একটি যুদ্ধ ছিল, যার সবকিছুই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিক থেকে
৫৭
ভুল-ভালে ভরা। সেগুলাে যে সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল তাই নয়, সেইসঙ্গে তা ছিল সমরাস্ত্রের বাইরে এবং জেনারেলেরও ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল অবাস্তব। কৌশল ছিল অ-লাগসই । সিদ্ধান্তগুলাে ছিল ভ্রমাত্মক। এমনকি, আমাদের বাহিনীও ছিল অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে দুর্বল এবং স্বল্পপ্রশিক্ষিত। তথাপিও, পূর্ব পাকিস্তানে অপমানকর আত্মসমর্পণ এবং একপক্ষীয় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ প্রমাণ করে যে, সাহসিকতা এবং নৈতিকতা, দৃঢ়তা। অথবা ইচ্ছাশক্তি হারানাের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উচ্চ পর্যায়ের যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের অক্ষমতা।
১১৭। এমনকি ঢাকায় আত্মসমর্পণ সম্পর্কে বলা যায়, ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল নিখুঁতভাবে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এবং বলা যায় আত্মসমর্পণ না করে ঢাকায় আরও কয়েকদিন যুদ্ধ পরিচালনা করা যেত। পরিস্থিতি সে পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল না যে, তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করতেই হবে। যদিও লে. জেনারেল নিয়াজীর নিকট চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া ছিল না। সেজন্য আমরা ধরে নিতে পারি জেনারেল ইয়াহিয়া কেবল যে দেশকে একটি বােকার মতাে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন তাই নয়। কেননা, এ যুদ্ধ থেকে কোনাে প্রকার উত্তম ফলাফল পাওয়ার আশা ছিল না, সেইসঙ্গে তিনি আত্মসমর্পণের বিষয়টি উসূকে দিয়ে এবং অনুমােদিত করে জাতিকে লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেন, যা ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে সমান্তরালপূর্ণ নয়।
১১৮। জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডারদের এই নৈতিক অধঃপতন এবং অদক্ষতাকে মােটামুটিভাবে সবাই মনে করে যে, ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের জন্য কর্তব্য কাজ করতে গিয়েই এরূপ হয়েছিল। এমনকি আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে, দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও এ ধরনের কাজে যুক্ত থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রচণ্ড যৌন কামনা, মদ, মেয়ে মানুষ, জমি এবং বাড়ির জন্য তাদের লালসা ছিল প্রবল। ব্যাপক সংখ্যক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা, বিশেষ করে যারা উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তারা যে কেবল যুদ্ধের প্রতি তাদের ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তাই নয়, সেইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটকালীন সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতাে পেশাগত যােগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছিলেন। নিঃসন্দেহে বলা যায় নৈতিক সততা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা হলাে। নেতৃত্বের প্রয়ােজনীয় শর্ত, তা জাতীয় জীবনের যেকোনাে পর্যায়েই হােক না কেন, বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের উল্লিখিত গুণাবলি অতি আবশ্যক এবং বৃহত্তরভাবে তা কাম্য। দুঃখজনক বিষয় হলাে, পাকিস্তানের বেলায়, মােটেই ক্ষুদ্র মাত্রায় নয় এমন নৈতিক দুর্বলতা জাতীয় নেতৃত্বে এবং সামরিক বাহিনীতে আমাদের জাতির ইতিহাসে সাংঘাতিকভাবে জেঁকে বসেছিল।
১১৯। অত্যধিক ক্ষমতাবান হওয়ার দরুন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাগণ সামরিক শাসন চলাকালীন সময়ে নানামুখী বিনিয়ােগ করে সুনিশ্চিতভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারা তাদের রিপুকে সংযত করতে ব্যর্থ হতেন এবং তারা বড়ােমাপের ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী শিল্পপতির ব্যবস্থাপক, অবৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী দালাল, বেশ্যাসহ সমাজের অন্যান্য অপরাধীদের সঙ্গে কারবার করতেন। প্রথমবারের সামরিক শাসনের সময়ে এর সমূহ বিপদ আঁচ করা
৫৮
গিয়েছিল এবং সে সময় সামরিক কর্মকর্তাদের দ্রুত বিতাড়িত করে তার স্থলে বেসামরিক কর্মকর্তাদের বসানাে হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সামরিক শাসন ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে আরম্ভ হলে পর সামরিক কর্মকর্তাদের বহুমুখী কাজকর্মে নিয়ােজিত করা হতে থাকে। এমনকি মহকুমা পর্যায়েও তারা নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। শয়তানের মতাে কার্যকলাপ তাদের কর্মক্ষেত্রের সকল পর্যায়েই পরিব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। ঘুষ খাওয়ার অভিযােগ সর্বত্র প্রায়ই শােনা যেতে থাকে। এমনকি এমনও খবর পাওয়া যায় যে, টাকা খেয়ে সামরিক কর্মকর্তারা (সামরিক আইন কর্মকর্তাগণ) গুরুতর অপরাধের সাজা মওকুফ বা হ্রাস করতে আরম্ভ করেন। অভিযােগ এত ঘন ঘন আসতে থাকে যে, সব অভিযােগ অবজ্ঞা করার কোনাে সুযােগ ছিল না।
১২০। দুর্নীতির প্রভাব ছাড়াও সামরিক শাসন সংক্রান্ত কাজকর্মের বেলায় দেখা যায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সামরিক বাহিনীকে অনুগত রাখার অভিপ্রায়ে তাদের জন্য নতুন নতুন সুযােগ-সুবিধার দ্বার উন্মোচন করতে থাকেন। এরই অংশ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের নতুন নতুন চাকরির সুযােগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার উচ্চতরভাবে বিশেষায়িত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ অলংকৃত করতে থাকেন। যেমন, করাচি বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি, সিমেন্ট উৎপাদন শিল্প, স্যুয়ারেজ, গ্যাস উৎপাদন ক্ষেত্র ইত্যাদি। এমনকি ব্যাংক ব্যবস্থাপনার বেলাতেও তাদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হতে থাকে।
১২১। সেনা সদস্যদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কৃষিজ জমি-জমা মুক্তভাবে বণ্টন করে দেওয়া হয়; এবং বড়ােমাপের বিভিন্ন প্রকল্পে সেনাসদস্যদের জমি দেওয়া হয়, যেমন- খাল উন্নয়ন প্রকল্প, দা মাখি ধান্দ প্রকল্প, গােলাম মােহাম্মদ বাঁধ প্রকল্প, নওয়াবশাহ প্রকল্প, গুড়ু বাঁধ প্রকল্প এবং সীমান্ত এলাকা প্রকল্প। আমাদের নিকট যে তথ্য-উপাত্ত সাক্ষীর মাধ্যমে এসেছে তাতে দেখা যায় ১৭৪৮ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে জমি বণ্টন করা হয়; এর ভেতর চাকরিরত এবং অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলগণও আছেন। এই জমির কিছু অংশ সামরিক বাহিনীর এবং অ্যাটজুটেন্টদের পারস্পরিক কল্যাণ সমিতির সদস্যদের পুনর্বাসনের নিমিত্তে কর্ষণের জন্য দেওয়া হয়। ব্যক্তিগতভাবে বণ্টনের বাইরেও ব্যাপক এলাকার ভূমি জেনারেল হেডকোয়ার্টারের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল বলেন যেহেতু টেকনিক্যাল অসুবিধার জন্য অনেক জমি সংগঠনের নামে নেওয়া যাচ্ছিল না, সেহেতু তা ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়া হয়। কিন্তু এসব প্রতারণাযুক্ত মালিকানা শর্ত যথাযথ দলিল-দস্তাবেজ দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছিল কিনা এর কোনাে সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি তাতে দেখা যায় কিছু উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন। জেনারেল বিপুল পরিমাণের ভূমি পেয়েছিলেন; যা ছিল এমনকি উল্লিখিত প্রকল্পগুলাের বাইরে, উদাহরণস্বরূপ :
(ক) জেনারেল ইয়াহিয়া খান পেয়েছিলেন ৩৯৬ একর জমি;
(খ) জেনারল আবদুল হামিদ এবং তার পরিবারের জমির পরিমাণ। ১,৩৬১ একর;
(গ) জেনারেল খােদাদাত খান এবং তাঁর পরিবারের জমির পরিমাণ ৬২২ একর।
৫৯
আমাদের জানানাে হয় অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পুনরায় কিছু জমি রাখার জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৭,০১,৫৬৫ টাকা প্রদান করেছিলেন, যা লিজ হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল হামিদ, মেজর জেনারেল খােদাদাদ খান, মেজর জেনারেল কায়ানি এবং লে. কর্নেল গুলজারকে সামরিক কর্মকর্তা, সামরিক ইস্টেট কর্মকর্তার সুপারিশে ৪,৩৩,৬৪০ টাকা ক্ষতিপূরণের নামে দেওয়া হয়েছিল। কেন এই ধরনের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে লিজ প্রদান করা হয়েছিল তা আমরা নিশ্চিত নই। তবে এর দ্বারা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাগণ অবৈধ সুবিধা গ্রহণে পিছপা ছিলেন না। সেই সময়ে যখন দেশ সামরিক শাসনের কারণে তাঁদের হাতে শাসিত হচ্ছিল।
১২২। বহুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা বিপুল বিক্রমের সঙ্গে গৃহ নির্মাণ কাজকর্মের মধ্যে নিজেদের জড়িত করে ফেলেন। এটি তাদের নিজেদের গৃহ নির্মাণের জন্য ছিল না, বরং তা ছিল ফটকাবাজি ব্যবসায়িক মনােভাবাপন্ন। কেউ কেউ একাধিক স্থানে বাড়িঘর নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে এটি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সকল বেসামরিক কর্মকর্তা এমনকি বিচারকদেরকে অধিনস্ত সম্পত্তির পরিমাণ ঘােষণা করতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মকর্তাদের জন্য এ ধরনের কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্য জানাজানি হওয়ার পরে বলা হয় সামরিক কর্মকর্তারা জ্ঞাত সম্পত্তির মালিকানার বাইরে নন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সহজেই সামরিক কর্মকর্তাদের সুবিধাজনক হারের সুদে ঋণ মঞ্জুর করতেন। আর তারা তা করতেন সামরিক তহবিল থেকে। ফৌজি ফাউন্ডেশনের আমানত এভাবে ঋণে বিতরণ করা ছিল একটি ধ্রুপদী উদাহরণ।
১২৩। উপযুক্ত অবস্থা ছাড়াও ব্যক্তিগত অনৈতিকতা ও লাম্পট্যের অভিযোেগ কিছু উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। এর জন্য যুদ্ধের সময় তারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি মনােযােগী হতে পারেননি। অভিযােগ আসে বিশেষভাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল খােদাদাদ খান (অব.), জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, মেজর জেনারেল জাহানজেব এবং ব্রিগেডিয়ার হিদায়েত উল্লাহ এর বিরুদ্ধে। আমরা সেইসব রােমাঞ্চকর অভিযােগের বিষয়গুলাের বিস্তারিত বর্ণনায় যাব না। কেননা, সেইসব অভিযােগের পক্ষে পরিপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এ ধরনের কার্যকলাপ জাতির চলার পথ ও সদিচ্ছার প্রশ্নে খুব ক্ষুদ্র ক্ষত নয়, তাই আমরা প্রত্যাশা করি এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এর মাধ্যমে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম রক্ষা করা যায়।
১২৪। সশস্ত্র বাহিনীর বাছাই এবং পদোন্নতির পদ্ধতির বিষয়ে কিছু অভিযােগ আমাদের কাছে আসে। আমরা দেখি যে, ১৯৭০-৭১ সালে এ বিষয়ে মেজর জেনারেল ইফতেখার খান জানজুয়া এইচজেএসকিউ-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, গােপনীয় প্রতিবেদন সবসময় বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখা হয় না। এজন্য নিস্পৃহ ও সঠিকভাবে এটি লেখার প্রয়ােজন রয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমেরিকার ধারায় দক্ষতা সূচক” প্রবর্তনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান পদ্ধতিতে ৭ বছরের গড় হিসাবে ব্যক্তিগত গােপনীয় প্রতিবেদন
৬০
প্রণয়ন করার উপদেশ প্রদান করা হয়। আমরা পরিপূর্ণভাবে এই সুপারিশসমূহ সমর্থন করছি এবং প্রত্যাশা করি যে, কমিটির এই প্রতিবেদনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হবে। জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই বাের্ডের কর্ম-প্রক্রিয়ার কোনাে অন্তঃরস্থ গলদ না থাকলেও দেখা যায় পদোন্নতির বেলায় সাধারণ প্রক্রিয়ার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছিল। বিশেষ করে মেজর জেনারেলদের পদে কমান্ডার ইন চীফ আগেই বাছাই বাের্ডকে প্রভাবিত করে রাখেন। এর ফলে কখনাে কখনাে অসন্তুষ্টি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুতির কারণে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। কমান্ডার ইন চীফ অবৈধ সুযােগ-সুবিধা নেন- কেননা, তিনি বাের্ডকে প্রভাবিত করেন ব্যক্তিগত ধারায়। নিজের স্বার্থে সুবিধা বণ্টন করেন। কোনাে কোনাে কর্মকর্তা অভিযােগ করেন সকল জেনারেলের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই বাের্ড আকারে বৃহৎ এজন্য বাস্তবে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণে তা অদক্ষ হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় তাদের মতে, বাছাই বাের্ডের আকার ছােটো করা দরকার। এটি ১০-১২ জন জ্যেষ্ঠ জেনারেলের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত।
১২৫। আমাদের নিকট আরও কিছু বিষয় আসে, যেখানে দেখা যায়; যুদ্ধের খানিক আগে বা যুদ্ধের সময়ে কিছু সদস্যকে বাছাই করা হয়। কিন্তু সেইসব সেনা কর্মকর্তারা তাদের দায়দায়িত্বের ক্ষেত্র এবং পরিকল্পনা মাফিক অধীনস্তদের দিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা কার্যকর হয়নি। কারণ, তারা অভিজ্ঞ ছিলেন না। এমনকি ভূখণ্ড সম্পর্কেও ছিলেন অজ্ঞাত। এমন কোন কোন কর্মকর্তাকে কমান্ডারের পর্যায়ে বসানাে হয়েছিল, যারা দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের মতাে যােগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না।
১২৬। তিন বাহিনীর জুনিয়র কমিশন্ অফিসার এবং অন্যান্য পদমর্যাদার সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা বর্তমান নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আমরা এটি স্বীকার করে নেই যে, সবসময়ই কিছু লােক থাকেন যারা প্রচলিত বিধিবিধানের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। বিশেষ করে দেশের সাম্প্রতিক সামাজিক প্রবণতায় যথার্থ অধিকারবােধ সম্পর্কে অনেকেই সচেতন হন। এমন সচেতনতা বােধ সামরিক বাহিনীর মধ্যেও জাগ্রত হচ্ছে। এমতাবস্থায় আমরা এই অনুভূতিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না যে, এখানে একটি সাধারণ পুনর্মূল্যায়নের প্রয়ােজন রয়েছে। যার ভিতর দিয়ে প্রতিটি চাকরির পুনঃপরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক অধিকতরভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায়। এটি গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার শাস্তির ভীতি দ্বারা কমান্ড বাধ্যবাধকতা আনার প্রক্রিয়া যথার্থ বা সম্পূর্ণ নয়, যা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলাে নেতৃত্বের গুণাবলির দ্বারা প্রতিটি পদমর্যাদার পারস্পরিক সম্মানবােধ, বিশ্বাস, আনুগত্য আনা। আমরা এই বিষয়টি বিতর্কে আনতে চাই এজন্য যে, বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে পূর্ব পাকিস্তানে কমবেশি তথাকথিত দুষ্কৃতকারীর তকমা লাগিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও অনধিকার বল প্রয়ােগ করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিদের তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় আমাদের অনেক কর্মকর্তা ও মানুষ উদ্ধৃঙ্খলভাবে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণ এবং বাছবিচারবিহীনভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। এটি অভিযােগ আকারে এসেছে ব্যাংক, দোকানপাট এবং এমনকি ব্যক্তিগত বাসাবাড়ি পর্যন্ত বাহিনীর দ্বারা
৬১
লুটপাট সংঘটন করা হয়েছে। অনেক বাড়িঘর নির্দয়ভাবে পুড়িয়ে ছাড়খার করা হয়েছে। বারবার ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে বলা হয় যে, সেনাবাহিনী যেন কোনােভাবেই সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। আর এসবই ছিল অরাজকতার নজির। এসব ঘােষণাপত্রের পরও বাস্তবে অবস্থার উন্নতি দেখা যায়নি, কারণ সেখানে কোনাে প্রকার কার্যকর বা দৃষ্টান্তমূলক দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের কাছে আসা প্রাপ্ত খবর থেকে দেখা যেখানে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা আন্তরিকভাবে এবং যত্নের সঙ্গে শক্ত হাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছেন, সেখানে সেসব ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বাস্তব গল্প অন্যরকম, কেননা, জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারাও তাদের অধঃপতিতদের মতােই ব্যবহার করেছেন। সত্যিকারভাবে কত লােক নিহত, ধর্ষিত অথবা কতসংখ্যক গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বা ধ্বংস করা হয়েছিল সেই পরিসংখ্যান বিষয়ে বিতর্ক-সংঘাতে না গিয়েও বলা যায় বিভিন্ন প্রমাণাদি থেকে প্রতীয়মাণ হয়, সেনাবাহিনীর দ্বারা এ ধরনের নৃশংসতার মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল এবং তা বৃহদায়তনেই করা হয়েছিল। এটিও প্রয়ােজনীয় যে, যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যাগমনের সময়ে যথাযথ তদন্ত করা প্রয়ােজন তারা কি পরিমাণে নৃশংসতা চালিয়েছিল, কেউ অপরাধী স্বাব্যস্ত হলে তার জন্য যথাযােগ্য শাস্তি বিধানও করার দরকার রয়েছে।
১২৭। আমাদের নজরে আসা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ত্রুটিবিচ্যুতি আমরা আমাদের প্রতিবেদনের প্রথম পর্যায়ে শ্রেণিবদ্ধ করেছি। আমরা প্রত্যাশা করেছি, তাদের ভালাের জন্যই এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
১২৮। সামরিক ও বেসামরিক সদস্যদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণের বেলায় আমরা কোনাে প্রকার ভুল-ভ্রান্তি দেখি না। কিন্তু এটি উল্লেখ করা দরকার সেই পুরষ্কার, যা যুদ্ধের সময় সংঘটিত ব্যক্তিগত বিক্রম/শৌর্য নির্ভর তা পদপর্যাদা নির্বিশেষে সকলকেই এবং সকল ঘটনার জন্যই সন্তোষজনক যাচাই-বাছাইয়ের পর মেধা নির্ভরভাবে কমিটির দ্বারা বিতরণ করাই সমীচীন।
খ. সুপারিশসমূহ
আমাদের চূড়ান্ত মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত সুপারিশসমূহ সরকারের বিবেচনার জন্য প্রদান করা কর্তব্য বলে আমরা মনে করি :
(১) জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আবদুল হামিদ খান, লে. জেনারেল এস জি এম. পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমার, লে. জেনারেল গুল হাসান, মেজর জেনারেল মিত্থার আইয়ুব খানের নিকট থেকে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং অবৈধভাবে ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখল করার জন্য প্রকাশ্যে বিচার হওয়া উচিত । শুধু তাই নয়, তারা শক্তি প্রয়ােগের ওপর নির্ভর করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতায় রেখেছিলেন। এর বাইরেও তারা শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলােকে প্রভাবিত করেছিলেন। তাদের দিয়েছিল ঘুষ যাতে করে তারা তাদের দ্বারা প্রণীত নকশা অনুযায়ী কাজ করে এবং যাতে করে ইচ্ছামাফিক ভােটের ফলাফল পাওয়া যায়। তারা কিছু রাজনৈতিক দলকে জাতীয় সংসদে যােগদানে বিরত রাখতে উসকানি দিয়েছিলেন, যখন তা ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। এভাবে তারা পরস্পরের মধ্যে যােগসাজশ করে পূর্ব পাকিস্তানে এমন
৬২
একটি পরিস্থিতির জন্ম দেয়; যার জন্য সেখানে সিভিল ডিসওবিডেন্স’ আন্দোলন আরম্ভ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। ফলশ্রুতিতে ঢাকায় আমাদের বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং দেশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়।
(২) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধসংক্রান্ত কর্তব্য অপরাধীর মতাে অবহেলার জন্য উপযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে বিচার হওয়া দরকার।
(৩) পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস কর্মকাণ্ডের অভিযোেগ তদন্ত করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন। এবং যারা নিষ্ঠুরতা ও অনৈতিকতার জন্য দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের (কোর্ট অব অ্যানকোয়েরি গঠনের) ঘােষণা (যদিও কার্যবিবরণী নয়) জনসম্মুখে প্রদান করা প্রয়ােজন। তার ফলে, আমাদের জাতীয় বিবেক জাগ্রত হবে এবং আন্তর্জাতিক মতামত সন্তোষজনক হবে।
(৪) মেজর জেনারেল রাহীম খান যিনি এখন চীফ অফ স্টাফ-এর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়ােজন। কোন্ পরিস্থিতিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর অধিনস্ত বাহিনী ৩৯ (এ হক) ডিভিশন বাতিল করে তা তার দায়িত্বে থাকা নির্ধারিত এলাকার বাইরে সরিয়ে এনেছিলেন এবং কোন্ পরিস্থিতিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কোনাে প্রকার তদন্ত ব্যতিরেকেই জলজ্যন্তভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের চীফ নিযুক্ত হলেন সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
(৫) একইরূপ তদন্ত পাকিস্তানের নৌ-বাহিনীর কমান্ডার গুল জারিন এর বিরুদ্ধে হওয়া উচিত। কেননা, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে তার কাছে নির্দেশ যাবার আগেই তিনি খুলনার নেভাল বেজ এর পিএনএস তিতুমীর বাতিল করেছিলেন।
(৬) অনুরূপ তদন্ত নিম্নলিখিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও হওয়ার প্রয়ােজন রয়েছে, কেননা, তারা যে ধারার যুদ্ধের সময় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম (অপারেশন) বা দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা উঘাটন হওয়া দরকার-
(ক) লে. জেনারেল ইরশাদ আহম্মদ খান, সর্বশেষ যুদ্ধের সময় ১নং কর্পের কমান্ডার।
(খ) মেজর জেনারেল আবিদ জাহিদ; জিওসি ১৫ ডিভিশন এবং
(গ) মেজর জেনারেল বিএম. মুস্তফা, জিওসি ১৮ ডিভিশন। শুধুমাত্র এসব কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠানােই আমাদের মতে যথার্থ বা পর্যাপ্ত নয়। যদি তারা অপরাধমূলক অবহেলার জন্য দায়ী হন, অথবা কাপুরুষােচিত কাজ করে থাকেন; তাহলে তাদের সেভাবেই বিচার করা উচিত।
(৭) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, লে. জেনারেল নিয়াজী এবং অন্যান্য কিছু কর্মকর্তা ভারতে যারা যুদ্ধবন্দি অবস্থায় রয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়ােজন। কোন্ অবস্থার পরিস্থিতিতে জেনারেল ফরমান আলী মি. পল মার্ক হেনরীর মাধ্যমে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে তাঁর বার্তা পাঠালেন। কে তাঁকে এমন কাজের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা তদন্তের মাধ্যমে উদ্বাটন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
(৮) আমরা আরও সুপারিশ করছি অধ্যায় ১ অংশ-৫ এ উত্থাপিত আমাদের প্রতিবেদনের আলােকে সরকার যেন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগসমূহের বিস্তারিত তদন্ত করেন যাতে বলা হয়েছে তারা অফিস সংক্রান্ত অবস্থানের ব্যাপক (গ্রস) ব্যত্যয়
৬৩
ও বিকৃত ব্যবহার করেছেন এবং দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের নৈতিক স্খলন ঘটিয়েছেন। এসব তারা করেছেন মূলত সিদ্ধান্তহীনতা, কাপুরুষতা এবং পেশাগত অদক্ষতার দ্বারা।
(৯) পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারণসমূহের ওপর আমাদের পর্যবেক্ষণসমূহ ও মন্তব্যাবলি নিতান্তই পরীক্ষামূলক (টিনটেটিভ), আমরা সুপারিশ করছি যে, যখন কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড এবং অপরাপর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যারা এখন ভারতের কারাগারে যুদ্ধবন্দি হয়ে অবস্থায় আছেন, তারা যখন হাতের নাগালে আসবেন পুনঃতদন্ত করে দেখতে হবে, কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তারা পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
(১০) যুদ্ধের জন্য উচ্চ নির্দেশনা সম্বলিত প্রস্তাবনার নিমিত্তে আমরা নিমের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরছি :
(ক) কমান্ডার ইন চীফ-এর পদটি চীফ অফ স্টাফ দ্বারা পুনঃস্থাপন করতে হবে (এটি আমরা যতদূর জেনেছি, পাকিস্তানে ইতােমধ্যে প্রেসিডেন্টের দ্বারা কার্যকর করা হয়েছে)।
(খ) মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষা কমিটি পুনরায় কার্যক্ষম করতে হবে। এবং এর নিয়মিত বৈঠক সুনিশ্চিত করতে হবে। এটিকে চার্টারে ইতিবাচক নির্দেশনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ডিভিশনকে কার্যকরভাবে গড়ে তােলার ক্ষমতা মন্ত্রিসভার ওপর প্রদান করতে হবে। যাতে করে সভা আহ্বান করা যায়। কমপক্ষে বছরে চারবার অথবা চার্টারে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে এবং প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেও যাতে করে সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমতাবস্থায় মন্ত্রিসভায় সর্বাপেক্ষা বয়ােজ্যেষ্ঠ সদস্য এতে সভাপতিত্ব করতে পারেন।
(গ) এখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর জন্য একটি কমিটি থাকতে হবে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিনির্ধারণী সংস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্ট/মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষা কমিটির দ্বারা নির্দেশিত হয়ে সঠিক কার্যাবস্থা পরিচালনা করবে। প্রতিরক্ষা কর্মসূচির সঙ্গে তিন বাহিনীর স্থায়ী আলাপ-আলােচনার মধ্যে যােগসূত্র বজায় রাখতে হবে। এর মাধ্যমে বাস্তবসংগত পরিকল্পনার প্রস্তুতি পর্ব নিশ্চিত হবে যা জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য হবে কার্যকর এবং এটি বাজেট বরাদ্দের মধ্যে সীমিত থাকবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সভাপতিত্বে প্রতিরক্ষা সচিব এতে সংযুক্ত থাকবেন। এতে আরও থাকবেন, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, প্রতিরক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ সংক্রান্ত উপদেষ্টা, সিভিল ডিফেন্সের ডাইরেক্টর, অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন সংক্রান্ত বিভাগের ডাইরেক্টর, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্রয় বিষয়ের ডাইরেক্টর জেনারেল, আন্তঃবিভাগীয় গােয়েন্দা বিষয়ের ডাইরেক্টর, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং অন্যান্য সচিবগণ যারা সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা মাফিক প্রয়ােজনবােধে এতে যােগ দেবেন। যদি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত পদ বা পাের্টফলিও ধরে রাখা হয়, অথবা তা প্রধানমন্ত্রীর নিকট থাকে, তাহলে সভায় সভাপতিত্ব করবেন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উৎপাদনের (ডিফেন্স প্রােডাকশন) ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। যদি কোনাে মন্ত্রী উপস্থিত না থাকেন তবে সেক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা সচিব সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে প্রােটোকল কার্যপ্রণালি বিধির কোনাে প্রকার বাধা-নিষেধ থাকবে না।
৬৪
(ঘ) সচিবদের সমন্বয়ে যে কমিটি বর্তমানে রয়েছে তা চলমান থাকবে।
(ঙ) এটি জরুরি যে, তিন বাহিনী যৌথভাবে ও দায়িত্বে সমমর্যাদার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবে এবং সেনাবাহিনীর যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ যৌথ কৌশলের দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যের জন্য নির্ণীত হবে। সেজন্য প্রয়ােজন হলাে, সার্ভিস প্রধান জয়েন্ট চীফ অফ স্টাফ হিসেবে কাজ করবেন এবং তা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত হিসেবে নির্ধারিত সার্ভিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এ ধরনের যৌথ চীফ অফ স্টাফ একটি কর্পোরেট বডি’ গঠন করবেন। সেখানে থাকবে সমন্বিত বা যৌথ দায়-দায়িত্ব। নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে তারা যৌথ পরিকল্পনার ভেতরে একীভূত হবেন এবং তাদের সদর দপ্তর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে লাগােয়া থাকবে। চেয়ারম্যান এবং জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ-এর কার্যকাল হবে চক্রাকার বিশিষ্ট। তিন বাহিনীর প্রধানগণ তাদের পদমর্যাদার ঊর্ধ্বে উঠে এ পদ অলংকৃত করবেন। তাদের কার্যকাল হবে ১ বছর। চেয়ারম্যানের পদটি আরম্ভ হবে পদাতিক বাহিনীর প্রধানের মাধ্যমে। জয়েন্ট চীফের কর্মকাণ্ডের চার্টার-১১ অধ্যায়ের অংশ যাতে সংযুক্তি ‘ই’ হিসেবে এই প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।
(চ) জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ-এর সংগঠনের অধীনে থাকবে একটি সবিচালয়, সেসঙ্গে থাকবে জয়েন্ট প্লানিং স্টাফ’ এবং তা তিন বাহিনী থেকেই সংগৃহীত হবে। এটিকে জয়েন্ট সেক্রেটারিয়েট অ্যান্ড প্লানিং স্টাফ’ নামকরণ করা যেতে পারে। এ সংগঠনটি প্রয়ােজনীয় সাচিবিক সমর্থন যােগাবে এবং সেসঙ্গে তা জয়েন্ট ডিফেন্স প্লন কৌশলগত অধ্যয়নসহ আন্তঃকাজকর্ম সংক্রান্ত বিষয়গুলাে প্রক্রিয়াজাত করবে। জয়েন্ট চীফ অব স্টাফের অন্যান্য জয়েন্ট কমিটি থাকতে পারে; যার মাধ্যমে তিনি সহায়তা পেতে পারেন সেই সব বিষয়ে যেগুলাে প্রয়ােজনীয় বলে মনে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুত হওয়া সংক্রান্ত দুর্বলতা যা ইতােমধ্যে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, তাতে আমাদের মনে হয়েছে যে, এখানে প্রয়ােজন হলাে আমেরিকার “ইন্সপেক্টরেট-জেনারেল” এর মতাে প্রতিষ্ঠানের যে সংগঠন হঠাৎ পরিদর্শন করবেন এবং ইউনিট যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতযােগ্য কি না তা প্রদর্শন করতে বলবেন। বর্তমানে তেমন কোনাে ব্যবস্থা নেই যার দ্বারা তিন বাহিনির প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা এবং প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এই ইন্সপেক্টরেট জেনারেল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করবেন। থাকবে ক্ষুদে আকারের স্টাফ এবং তিনি মেজর জেনারেলের পদমর্যাদার নিচে হবেন না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীতে জবাবদিহিতার নীতি কার্যকর করা সম্ভব হবে এবং সেইসঙ্গে তিন বাহিনীর জন্য যৌথ ইন্সপেক্টরেট জেনারেল এর ব্যবস্থা নিলে কারও কোনাে আপত্তি থাকবে না। আমরা কৌশলগত দিক অধ্যয়নের জন্য একটি স্ট্র্যাটিজিক স্টাডি ইনস্টিটিউটের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করি। এটি হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রােগ্রামের অংশ বিশেষ। এই প্রতিষ্ঠান আমাদের তিন বাহিনীর জয়েন্ট স্ট্র্যাটিজিক প্লানিং এর দুর্বল দিকগুলাে তুলে ধরবে। আমরা মতামত প্রকাশ করছি যে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অপরাপর প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংগঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে।
৬৫
(১১) আমাদের দেশের আকাশ পথের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনঃবিবেচনা করা প্রয়ােজন।
(ক) আমরা মােটেই সন্তুষ্ট নই জেনে যে, অধিকতর অগ্রসর-দৃষ্টিসম্পন্ন কায়দা-কৌশল বিমান বাহিনীতে প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়। কেননা, দেশে রয়েছে বিচিত্র রকমের প্রয়ােজনীয়তা। সেহেতু আমরা সুপারিশ করছি, এ দেশেও অধিকতর অগ্রসর বিমান ক্ষেত্র থাকতে হবে এবং এমন স্থানে তা বসাতে হবে যেখান থেকে আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাসমূহ উন্নত যােগাযােগের ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়। এবং যেখানে কেন্দ্রীভূত রয়েছে প্রধান প্রধান শিল্প স্থাপনা। এই ধরনের অগ্রসরমান কৌশল গ্রহণ করে আমাদের তরফ থেকে আক্রমণ করা ও প্রতিরােধ করার ক্ষমতা অর্জন সংশ্লিষ্ট বিষয়াদীর মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
(খ) আমাদের আগাম সতর্কসংকেত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। প্রথম লাইনের ভ্রাম্যমাণ পর্যবেক্ষণ শাখা (অবজারভার ইউনিট) এবং চূড়ান্তভাবে সংবাদ বিমান অপারেশন কেন্দ্রে প্রেরণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমাতে হবে। বর্তমানে তা অসামঞ্জস্যজনকভাবে দীর্ঘ সময় নেয়। কেননা, সেখানে রয়েছে শ্লথগতিসম্পন্ন ব্যবস্থা। কাজকর্মের সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়ােজন রয়েছে। বিভিন্ন স্তরে কর্মরতদের মধ্যে পারস্পরিক যােগাযােগ বৃদ্ধি করতে হবে। আগাম সতর্ক ব্যবস্থা। উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে তাদের দক্ষতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে।
(গ) বিগত যুদ্ধে করাচি বন্দর প্রায় অরক্ষিত ছিল। এমতাবস্থায়, করাচি বন্দরের জন্য নিম্নমাত্রার সমুদ্র-দর্শনযােগ্য রাডার বসাতে হবে।
(ঘ) করাচিতে মিসাইল বােটের মাধ্যমে ব্লকেট’ তৈরির বেলায় ভারতের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে করাচির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারােপ করতে হবে। করাচির প্রতিরক্ষার জন্য শুধুমাত্র এক স্কোয়ার্ডন ফাইটাস্ এবং অর্ধ স্কোয়ার্ডন বাের্ষাট রাখা চূড়ান্তভাবে বােকামি।
(১২) (ক) যেমনটি আগেই সুপারিশ করা হয়েছে, দেশের বিমান প্রতিরক্ষা কার্যক্রমকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনতে হবে। এবং এটিকে আর একক দায়িত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে রাখা যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারকে সার্বিক নিয়ন্ত্রণের দায়ভার গ্রহণ ও দেশের সিভিল ডিফেন্স সংগঠনের ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) যেহেতু অদূর ভবিষ্যতে সন্তোষজনক মাত্রায় আমাদের বিমান বাহিনীর বড়ােমাপের সম্প্রসারণ সম্ভব হবে না, সেহেতু এমতাবস্থায়, আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে সুপারিশ করছি যেন আমাদের বিমান প্রতিরক্ষা কর্মসূচি নিদেনপক্ষে দ্বিগুণ ‘অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান’ দ্বারা সজ্জিত করা হয়। এবং তা করতে হবে ১৯৭২ এর শেষ সময়ের মধ্যেই। বিমান বাহিনীর ৩৪২ ব্যাটেরিস্ যেভাবে উপদেশ করছে সেভাবে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।
(গ) দেশের আকাশ সুরক্ষার জন্য গ্রাউন্ড-টু-এয়ার মিসাইল ক্রয় করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়ােজন।
(ঘ) যদি গ্রাউন্ড টু এয়ার মিসাইল পাওয়া না যায়, তবে রাডার নিয়ন্ত্রিত মধ্যম মানের এইচএএ গান চীন থেকে ক্রয় করার সুপারিশ করা হলাে।
৬৬
(ঙ) দেশের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বিশেষ করে বন্দর এবং শিল্প এলাকায়।
(চ) শিল্পপতিরা তাদের নিজস্ব সম্পত্তি রক্ষার জন্য সহজদাহ্য পদার্থসহ অন্যান্য বিপজ্জনক স্থানের প্রতি নজর রাখবেন এবং এ দায়-দায়িত্ব তাদের নিতে হবে।
(ছ) প্রচুর পরিমাণে পেট্রোল মওজুদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে ।
(১৩) পাকিস্তান নৌবাহিনীকে আধুনিক করতে অতিসত্বর মনােযােগ দিতে হবে; যাতে করে দেশের একমাত্র সামুদ্রিক বন্দরের সুরক্ষা করা যায়। কেননা তা দেশের জীবন প্রবাহ (লাইফ লাইন) হিসেবে বিবেচ্য। প্রথম সামরিক শাসনামল থেকেই নৌবাহিনী অবজ্ঞার মধ্যে পতিত হয়ে রয়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের মধ্যে এমন একটি ধারণা রয়েছে যে, দেশের জন্য নৌবাহিনীর তেমন কোনাে কিছু করার নেই। এই তত্ত্বের দ্বারা আচ্ছন্ন মূঢ়তা যুদ্ধচলাকালীন সকল সময়েই বজায় ছিল। আমরা জোরের সঙ্গে সুপারিশ করছি পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য লাগসই বিমান-অস্ত্র এবং এয়ারক্রাফট থাকতে হবে। যাতে করে তারা শত্রুপক্ষের অবস্থান এবং মিসাইল বােটের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারেন। এটিই একমাত্র পথ যার দ্বারা ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত ভয়ভীতি এবং তাদের মিসাইল বােটকে প্রতিহত করা সম্ভব ।
(১৪) করাচি বন্দর থেকে দূরে পৃথক একটি পােতাশ্রয় নৌবাহিনীর জন্য স্থাপন করা প্রয়ােজন। তাহলে এটির দ্বারা করাচির সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা যাবে।
(১৫) আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, ভয়ঙ্কর মুস্কিল হয়েছিল তখন যখন পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিলম্ব পরিবহণের জন্য ডি-ডে এবং এইচ-আওয়ার এর জন্য সমগ্র যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। আমরা সুপারিশ করছি এমন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। নৌবাহিনীকে সামগ্রিক সহযােগী সদস্য হিসেবে জয়েন্ট চীপস্ অব স্টাফ সংগঠনে রাখতে হবে।
(১৬) জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের কার্যাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা এই মতামত দিচ্ছি যে, গােয়েন্দা নিয়ন্ত্রক ব্যুরাে (ডাইরেক্টরেট অব ইন্টেলিজেন্সি ব্যুরাের) ওপর এ ধরনের একটি সংগঠন উপরিস্থাপন করা উচিত নয়। আন্তঃচাকরি গােয়েন্দা নিয়ন্ত্রক (ডাইরেক্টর অব ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) এর বেলাতেও এ কথা সত্য। জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের বিলােপ সাধন করা প্রয়ােজন।
(১৭) আমরা সুপারিশ করছি সামরিক সেবা নিম্নলিখিতভাবে পরিকল্পিত ও নিশ্চিত হওয়া দরকার :
(ক) উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে কুখ্যাত এবং ঘৃণ্য আচরণের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবােধের কোনাে ছাড় দেওয়ার সুযােগ দেওয়া যাবে না।
(খ) উচ্চতর পদে পদায়নের জন্য পেশাগত গুণের সঙ্গে নৈতিক অবস্থানও মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
(গ) সামরিক একাডেমির সামরিক অধ্যয়ন বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য একাডেমিক সেবার বেলায় পাঠ্যক্রম বিন্যাসে যুব-মনে যাতে ধর্মীয়, গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদী অধ্যয়ন স্থান পায় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৬৭
(ঘ) সেনাবাহিনীর মেস-এ মদ্যপান নিষিদ্ধ করতে হবে, এবং
(ঙ) লাম্পট্যজনক যৌনাচরণ এবং অন্যান্য দুর্নীতিযুক্ত কাজকর্মের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
(১৮) আমরা সুপারিশ করছি যে, সরকার সকল সেনাকর্তাদের সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য করবে। বিগত দশ বছরে যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব এতে দিতে হবে এবং তাদের নিকটাত্মীয়গণ যে সম্পত্তি অর্জন ও ভােগ করছেন তারও দশ বছরের হিসাব নিতে হবে (বেসামরিক কর্মকর্তা এবং বিচারপতিগণ যখন সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেন তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেঁচে গিয়েছিলেন)। যদি জ্ঞাত ও সংগত আয় বহির্ভূত কোনাে সম্পত্তি কোনাে কর্মকর্তার নিকট পাওয়া যায়; তখন তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
(১৯) সেনাকর্মকর্তাদের নামে কোন পরিস্থিতিতে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। যদি ভূমি বরাদ্দ সঠিকভাবে দেওয়া না হয়ে থাকে, তাহলে তা বাতিল করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
(২০) প্রতিটি সেবার (সার্ভিস) মধ্যে তুলনামূলকভাবে চাকরির শর্ত এবং সুযােগ সুবিধার মধ্যে সমতা বিধান করতে হবে। বিশেষ করে জিওসি এবং অন্যান্য পদমর্যাদার বেলায় তা করতে হবে। এ সম্পর্কে মেজর জেনারেল ইফতেখার খান। জানজুয়ার নেতৃত্বে গঠিত জিএইচকিউ পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
(২১) পরিশেষে আমরা উপদেশ প্রদান করছি যে, আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল খােদাদাত খান এবং জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করা দরকার এবং সে অনুযায়ী প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
হামদুর রহমান, প্রেসিডেন্ট
এম. আনােয়ারুল হক, সদস্য
তোফায়েল আলী এ রহমান, সদস্য
তারিখ: লাহাের, ৮ জুলাই, ১৯৭২ সাল।
৬৮
৩২
সূচনা : সম্পূরক প্রতিবেদন দেওয়ার কারণ
১। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই তদন্ত কমিশিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়। কমিটির কাজ হলাে তদন্ত করে দেখা যে, “কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের (ইস্টার্ন কমান্ডের) কমান্ডার এবং তাঁর নির্দেশে পাকিস্তানের সৈনিক-সদস্যরা আত্মসমর্পণপূর্বক তাদের অস্ত্রশস্ত্র অর্পণ করলেন; সেসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তে এবং জম্মু-কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতির মেনে নিলেন।” ২১৩ জন সাক্ষীর বক্তব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিশন ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রতিবেদন পেশ করে।
২। প্রতিবেদন দাখিল করার আগে মেজর-জেনালের রাহীম ব্যতীত আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘটনার সঙ্গে অংশগ্রহণসংশ্লিষ্ট এবং প্রধান ব্যক্তিত্বদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে নেবার ফলে তাঁদের কাছ থেকে সাক্ষ্য প্রমাণাদী গ্রহণ করা যায়নি। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের কাহিনি প্রস্তুত করার সময়ে আমরা যথাসাধ্য প্রচেষ্টার দ্বারা তা সম্পন্ন করতে হাতের নাগালে পাওয়া তথ্যপ্রমাণাদী কাজে লাগিয়েছি। এ কারণে, অত্যাবশ্যকীয়ভাবে আমরা আমাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলাম যে, এটি একটি আপাত স্থিরীকৃতধর্মী (টিনটেটিভ) প্রতিবেদন। আমরা আরও অনুভব করেছিলাম যে, যদিও যা কিছু ঘটেছিল সে সম্পর্কে আমরা বিরূপ মন্তব্য করতে পারতাম ও চূড়ান্ত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম এবং যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের কোনাে প্রকার বক্তব্য দেওয়ার সুযােগ না দিয়েই। কিন্তু তা অনুচিত হতাে, কেননা, এটি করা হলে তারা তাদের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হতেন। সেজন্য আমরা বলেছিলাম, “পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ ও চূড়ান্ত মন্তব্য এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদী হবে সাময়িক। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের যখন পাওয়া যাবে তখন তাঁদের বক্তব্য ও সাক্ষ্য প্রমাণাদী স্বাপেক্ষে এটি বদলানাে যাবে।” (মূল প্রতিবেদনের ২৪২ নং পৃষ্ঠা দেখুন)। কমিশন পুনরায় কার্যক্ষম করা ।
৩। সে মতাে, যুদ্ধবন্দি এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরায়িত বেসামরিক কর্মকর্তারা ভারত থেকে পাকিস্তানে ফিরে আসার পরে ফেডারেল সরকার এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে যে, “তদন্তের জন্য তারিখ এবং স্থান নির্ধারণপূর্বক কমিশন তদন্তের কাজ সমাপ্ত করবে এবং পূর্ব নির্ধারিত বিষয়গুলাের ফলাফল বের করে আনবে। কমিটি কাজ শুরু করা থেকে আরম্ভ করে এজন্য দুই মাস সময় পাবে। এবং তদন্ত প্রতিবেদন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করবে।” এই প্রজ্ঞাপনের একটি কপি পরিশিষ্ট ক’ শিরােনামে এই অধ্যায়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা
৬৯
হলাে। লে. জেনারেল (অব.) আলতাফ কাদির, যিনি ইতঃপূর্বে কমিশনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁকে সেরূপ কাজের জন্য পুনরায় নিয়ােগ দেওয়া হয় এবং সেসঙ্গে জনাব এম. এ লতিফকে কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। কমিশনের অনুরােধে সরকার কর্নেল এম. এ হাসানকে কমিশনের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ােগ দেয়।
৪। ১৯৭৪ সালের ১ জুন তারিখে কমিশন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যাতে পূর্বপাকিস্তান হতে যুদ্ধবন্দি এবং অপরাপর বেসামরিক প্রত্যাবাসিতদের (রিপ্যাট্রিয়ট) এই খবর জানানাে হয় যাতে করে তারা কমিশনের জন্য সম্ভাব্য দরকারী কাজের বিষয়ে জ্ঞাত থাকতে পারেন।
কর্মপন্থাসমূহ
৫। কমিশন ১৯৭৪ সালের ৩ জুন তারিখে লাহােরে একটি অনানুষ্ঠানিক সভা করে । যেখানে বিভিন্ন পর্যায়ের বিষয়গুলাে প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করে সেই কর্মপন্থাসমূহ ১৯৭৪ সালের ১৬ জুলাই এরােটাবাদে আরম্ভ হতে যাওয়া সভায় উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইত্যবসরে, কিছু সংখ্যক প্রশ্নমালা তৈরি করে তা বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বিশেষ করে যারা পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাগুলাের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সময়ে কর্ণধার হিসেবে কাজ করেছেন। সেসঙ্গে তাদের মধ্যেও প্রশ্নমালা বিতরণ করা হয় যাদেরকে আমরা ওই ঘটনায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জ্ঞান রাখেন বলে বিবেচনা করেছিলাম। ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এমন সামরিক, বেসামরিক এবং পুলিশ সদস্যদেরও মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অতঃপর সেগুলাে বাছাই করে। সাক্ষীদের তলব করা হয়। আমরা ৭২ জনের অধিক মানুষের সাক্ষ্যপ্রমাণ রেকর্ড করি যার মধ্যে ছিলেন বিশেষভাবে পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার এ এ কে নেয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, জামশেদ এবং অন্যান্য জেনারেলবৃন্দ, যারা সেখানকার ডিভিশনে কর্মরত ছিলেন। আরও তলব করা হয় সর্বাপেক্ষা জ্যেষ্ঠ নৌবাহিনী কর্মকর্তা রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ, এয়ার কমােডর এনাম, যিনি ছিলেন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে। বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ডাকা হয় তখনকার প্রধান সচিব মুজাফফর হােসাইন এবং প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা জনাব মােহাম্মদ আলী চৌধুরীকে। এর বাইরেও মেজর জেনারেল রাহীমকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হয়। একমাত্র অনতিক্রম্য ব্যতিক্রম ছিলেন ডা. মালেক যিনি শেষ অবধি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। তবে তাঁর বিষয়ে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সরাসরি তথ্য-প্রমাণ আমাদের নিকট ছিল। সে কারণে চূড়ান্ত উপসংহারে উপনীত হওয়ার জন্য আমরা নিজেদের যােগ্য বলে মনে করেছি।
৬। সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর কমিশন অনুভব করে যে বিভিন্ন কারণে ১৯৭৪ সালের ১৫ নভেম্বরের আগে কমিশনের পক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব নয়। এজন্য কমিশন ১৯৭৪ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময় প্রার্থনা করে আবেদন। পাঠায় এবং পরে আবার ১৯৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তা বৃদ্ধি করতে সময়। চাওয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণাদি এবং সাক্ষাৎকারসংক্রান্ত রেকর্ড কার্যক্রমের উপসংহার ১৯৭৪ সালের ৫ নভেম্বর গ্রহণ করা হয়। নীতিগতভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম
৭০
কারণ আমাদের সঙ্গে কর্মরত দুজনের ১৯৭৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করাচির সুপ্রীম কোর্টে উপস্থিত হওয়ার প্রয়ােজন দেখা দিয়েছিল । তাছাড়া রাষ্ট্রপতি নিজেও জেনেভার উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। আমাদের মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্পূরক প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য আমরা ১৯৭৪ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে অ্যাবােটাবাদে পুনরায় মিলিত হয়েছিলাম।
সম্পূরক প্রতিবেদনের পরিকল্পনা
৭। সাধারণভাবে যদিও আমরা বেশ কিছু পরিমাণের নতুন তথ্য ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি; তারপরও আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনের উপসংহারে কোনাে প্রকার পরিবর্তন আনার কারণ খুঁজে পাইনি। যদি কোনাে কারণে বিস্তারিত কোনাে খবরাদি পাওয়া যেত, তবে আমরা উপসংহারে তা নিশ্চিত করতাম। সে কারণে, আমরা পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা আছে এমন প্রস্তাব এড়িয়ে যাবার জন্য মূল প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছিল তা থেকে সরে যাইনি। তবে উপসংহারের খানিক অংশে প্রয়ােজন অনুযায়ী যৎসামান্য পুনর্গঠন করা হয়েছে, যাকে আমরা নীতিগতভাবে সম্পূরক বলে মনে করছি। কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য ও খবরাদি ছিল অপ্রতুল, যদিও তা অবজ্ঞা করার পর্যায়ে নয়। সে ক্ষেত্রে আমরা ওই সব বিষয়গুলাে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে চেয়েছি। সে কারণে আমরা এই সম্পূরক প্রতিবেদন প্রস্তুত করার প্রস্তাব দিই ঠিক একই বাস্তবসম্মত ধারায়, যে ধারায় আমরা মূল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। সেই প্রতিবেদনের অংশ-২ এ রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম, এখন এখানে আমরা কেবলমাত্র ১৯৭১ এ সংঘটিত বিষয়াদি বিশেষভাবে ২৫ মার্চ ১৯৭১ এ সংঘটিত বিষয়াদি সংযুক্ত করতে ইচ্ছুক। যেখানে থাকবে বিশেষভাবে ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর আগের ও পরের ঘটনা। অংশ-৩ এ সংযুক্ত করার মতাে আমাদের তেমন কিছু নেই, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা হয়েছে। অংশ-৪ এ আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিকসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেছি, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে তার প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্কের বিষয়ে আমাদের মনে খটকা লেগেছিল যে কোন্ জ্ঞানে পশ্চিমাঞ্চলে ফ্রন্ট খােলা হয়েছিল। এই অংশের জন্য যা প্রয়ােজনীয়, তা হলাে, আমরা মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় II, III, IV, V, VI, VII, VIII এবং IX সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে আলােচনা করব, কেননা সেগুলাে পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তারপর আমরা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলব, যার মধ্যে সামরিক সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত বর্বরতা ও নৃশংসতার অভিযােগ সংযুক্ত রয়েছে। প্রয়ােজনের তাগিদে আমরা এ অংশের সঙ্গে মূলত, বিভিন্ন ব্যক্তির, ব্যক্তিগত আচার-আচারণ ও কর্মকাণ্ড যা আগের অধ্যায়ের সূত্র ধরে এসেছে সে বিষয়টিও তুলে ধরব। তারপরে আমরা এমন সব বিষয় নিয়ে আলােচনা করব যে সব বিষয় ভারতে বন্দিত্বদশার সময় উপস্থিত হয়েছিল যা সমন্বিতভাবে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সুসংবদ্ধভাবে না হলেও তুলে ধরেছেন; যদিও হয়তাে তা সঠিকভাবে নয়। সর্বশেষে আমরা এই সম্পূরক প্রতিবেদনের দ্বারা আমাদের মূল প্রতিবেদনের সুপারিশসমূহ সমৃদ্ধ করেছি।
৭১
পরিশিষ্ট ক’
পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রাওয়ালপিন্ডি, ২৫ মে, ১৯৭৪
নম্বর ১০৭/১৯/৭৪-(Min)। যেহেতু তদন্ত কমিটি ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে নােটিশ নং ৬৩২(১)/৭১, প্রেসিডেন্টের দপ্তর সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েছে এবং কমিটি ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই তারিখে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, যেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির বেলায় কমিশনের দ্বারা প্রাপ্ত তথ্য ছিল আপাতত পরীক্ষামূলক এবং সুপারিশসমূহ ছিল এমন যে, “পূর্বাঞ্চলের কমান্ডের কমান্ডার (ইস্টার্ন কমান্ড) এবং অপরাপর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যারা এখন যুদ্ধবন্দিদশায় ভারতে আটক রয়েছেন; তারা যখন এখানে ফিরে আসবেন তখন পুনরায় আবার তদন্ত হবে যে, কোন্ পরিস্থিতি আত্মসমর্পণের দিকে তাদের ধাবিত করেছিল।” যেহেতু সকল যুদ্ধবন্দি এবং বেসামরিক কর্মকর্তারা এখন পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন এবং যেহেতু ফেডারেল সরকার এই অভিমত দিয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ সম্পর্কে তদন্ত কমিটি তাদের সাময়িক সুপারিশের আলােকে সেটি চূড়ান্ত করতে গিয়ে প্রয়ােজনবােধে কথিত বন্দিদের; (তারা সেনা-সদস্য বা বেসামরিক কর্মকর্তা যাই হােন না কেন) কমিশন তাদের পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবে। এখন, যেহেতু, ১৯৫৬ সালে (VI ১৯৫৬) প্রণীত পাকিস্তান কমিশন অব এনকোয়ারী আইনের ৩ ধারার উপ-ধারা (১) এর আলােকে ফেডারেল সরকার সন্তুষ্ট চিত্তে কমিশনকে নিজেদের দ্বারা নির্দিষ্ট স্থান ও তারিখ মােতাবেক তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে এবং প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে নির্দেশ প্রদান করছে। কমিশন তাদের কাজ আরম্ভ করার দুই মাসের মধ্যে প্রাপ্ত তথ্যাদিসহ কাজ সম্পন্ন করবে।
এসডি/
বাকের আহমাদ
মন্ত্রিপরিষদ সচিব
পরিশিষ্ট ‘খ’
লাহাের, ১ জুন ১৯৭৪, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত যুদ্ধ সম্পর্কিত তদন্ত কমিটিকে কোন পরিস্থিতিতে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার (ইস্টার্ন কমান্ডার) আত্মসমর্পণ করলেন ও তাঁর অধিনস্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সদস্যগণ অস্ত্র অর্পণ করলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় এবং জম্মু ও কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ প্রদান করা হলাে, তা তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রেসিডেন্টের নিকট পেশ করতে বলা হয়। কমিশনের প্রধান ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি হামদুর রহমান। কমিশনের অন্য দুজন
৭২
সদস্য হলেন যথাক্রমে, পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি জনাব বিচারপতি এস. আনােয়ারুল হক এবং সিন্ধু ও বালুচিস্তানের প্রধান বিচারপতি জনাব বিচারপতি তােফায়েল আলী আবদুর রহমান। লে. জেনারেল (অবসর প্রাপ্ত) আলতাফ কাদির এবং পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার এবং সামরিক উপদেষ্টা ও কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়ােগ পান জনাব এম. এ লতিফ।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে কমিশন রাওয়ালপিন্ডিতে রুদ্ধদ্বারে তার কার্যক্রম আরম্ভ করে। কমিশনে ২১৩টি সাক্ষী রেকর্ড করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ জুলাই কমিশন পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনে কমিশন অভিমত প্রকাশ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের কারণ সম্পর্কিত বিষয়গুলাের ওপর তাদের মতামত অস্থায়ী বা সাময়িক। সেজন্য তারা সুপারিশ করেন যে, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার এবং অপরাপর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণ যাঁরা ভারতে রয়েছেন তারা যখন পাকিস্তানে ফিরে আসবেন তখন পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে দেখা হবে কোন্ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ ঘটেছিল। এখন যেহেতু ভারতে থাকা সকল যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক কর্মকর্তারা পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেছেন; সেহেতু পাকিস্ত নি সরকার কমিশনকে তদন্তের সেই অংশটুকু সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছে।
লাহােরের সুপ্রীম কোর্ট ভবনে কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করা হয়। কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় যে, কাজ আরম্ভ করার আগেই কমিশনের কার্যালয় সংক্রান্ত ঘােষণা দেওয়া হবে। বেসামরিক সদস্য, বেসামরিক কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর সদস্য যারা কি না যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে বা অন্য কোথাও অবস্থানপূর্বক পূর্ব পাকিস্তান থেকে পরবর্তীতে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের কারণ সম্পর্কে তাদের ধারণা ও অভিজ্ঞতা পাবার জন্য কমিশন সুযােগ প্রদান করবে। এসব খবরাখবর লিখিতভাবে দাখিল করতে হবে, তবে সুবিধাজনক হলাে প্রতিটি খবরাখবরের পাঁচটি করে কপি দাখিল করা, অবশ্য যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে এবং ৩০ জুন, ১৯৭৪ সালের মধ্যে। খবরাখবর দাখিল করার ঠিকানা : সচিব তদন্ত কমিশন, প্রযত্নে, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট, লাহাের। খবর প্রদানকারী যদি কমিশনের সামনে নিজে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক হন তা-ও উল্লেখ করতে হবে।
যারা খবরদারী সরবরাহ এবং সাক্ষ্য প্রদান করবেন তাদের নাম-পরিচয় সম্পূর্ণভাবে গােপন রাখা হবে। এটি উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি, পাকিস্তান সরকার খবরের কাগজে প্রকাশ করে যে, কমিশনের কার্যক্রমধারা চলবে রুদ্ধদারভাবে । আরও উল্লেখ করা হয় কমিশনের কাছে দেওয়া ভাষ্য এবং সাক্ষী ইত্যাদি হবে অসামান্য। অধিকার সম্বলিত কর্মকাণ্ড এবং কোনাে ব্যক্তিকে তাঁর বক্তব্য-ভাষ্যের জন্য সিভিল বা ক্রিমিন্যাল ধারার আওতায় আনা হবে না; যদি তিনি মিথ্যা কিছু উল্লেখ না করেন। পাকিস্তানের যে কোনাে নাগরিকের কাছে খবর বা তথ্য চাওয়ার অধিকার কমিশনকে দেওয়া হয়। কমিশন প্রয়ােজনবােধে সাক্ষীর উপস্থিতির জন্য পরােয়ানা জারি করতে পারবে। তবে তিনি আইনানুগভাবে কোর্টে হাজিরা না দেওয়ার বিষয়ে অব্যাহতি পেতে পারবেন। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কোনাে ব্যক্তি যিনি কমিশনের সম্মুখে সাক্ষ্য প্রদানে ইচ্ছুক হবেন তাঁকে সেজন্য কোনাে প্রকার শাস্তি বা নাজেহাল করা যাবে না।
৭৩
অংশ-II
১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলি
৩৩
সূচনা
১। আমরা ইতােমধ্যে মূল প্রতিবেদনের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের অংশ-II এ ইয়াহিয়া সরকারের দ্বারা প্রণীত দ্বিতীয় সামরিক শাসন যা কি না পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা। এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছি। তারপরও আমরা মনে করছি এর প্রধান প্রধান দফাগুলাের উপসংহার যথাসম্ভব সংক্ষেপে বর্ণনা করা প্রয়ােজন। ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ৩ অনুচ্ছেদের অংশ II হতে (মূল প্রতিবেদন পৃ. ৬৭) সেই তারিখের জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ (সম্প্রচারিত) থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলাম, “জেনারেল ইয়াহিয়া কেবলমাত্র সাদামাটা ধরনের তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার)-এর ভূমিকার জন্য প্রতিশ্রুতিশীল, যিনি দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বল্প সময়ের মধ্যে উদ্ধার করতে প্রয়াসী হবেন; তার পরে তিনি নিয়মিত ও নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন। অবশ্য এই পরিপ্রেক্ষিতে এর অর্থ হতে পারত নিজের দ্বারা একটি অধ্যাদেশের জারির মাধ্যমে অথবা এক ধরনের ব্যবস্থার দ্বারা একটি নতুন সংবিধান কার্যকর করা।”
২। আমরা যেমনটি বলেছি, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা দ্রুততার সঙ্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সেজন্য পরবর্তী ধাপ হিসেবে সংবিধান প্রবর্তন করার কাজটি সামনে চলে আসে। সে উদ্দেশ্যে একটি আইগত কাঠামাের আদেশের মধ্যে (আন্ডার দা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) সাধারণ নির্বাচনের ছক আঁটা হয়। সে মতাে আইগত কাঠামাে আদেশ জারি করা হয়। আমরা বিস্তারিতভাবে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করেছি এবং প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা ৭৪ এবং ৭৬ এ উপসংহার টেনেছি যে, উক্ত নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি বিজয়ী হিসেবে বেরিয়ে আসে। উল্লেখ করার মতাে বিষয় যা আমরা উপসংহারে বলেছি, তা হলাে : এধরনের ফলাফল যে আসবে তা সরকার আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি। যদিও আমরা বুঝতে অক্ষম হয়েছি যে, কীভাবে এধরনের উপসংহারে তারা এসেছিলেন। আরও একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলাে এই দুটি দলের বিজয়ে দেখা গেল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ আসনে ব্যাপকভাবে জয়ী হলাে, অন্যদিকে পিপলস্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুরূপ ব্যাপকভাবে অধিকাংশ আসেন জয়ী হলাে। তবে মােটের ওপর অওয়ামী লীগ দেশের অধিকাংশ আসন দখল করল। কারণ সমতার বিধান (প্রিন্সিপাল অব প্যারিটি) দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুটি দলের কোনাে দলই অন্য অংশে ন্যূনতম সমর্থনও অর্জন করতে পারল না।
৭৪
৩। আলাপ-আলােচনা বা দরদস্তুর করার প্রয়ােজনীয়তা ছিল সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত । কিন্তু শুরু হতেই বিভিন্ন কারণে যা আমরা এখানে পুনব্যক্ত করতে চাই না; তা কার্যত অবাস্তব এবং সম্ভবত প্রতারণামূলকভাবে চলেছিল, যেখানে প্রেসিডেন্ট নিজেই আলাপ-আলােচনা পরিচালনা করেন। এটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মীমাংসার লক্ষ্যে পরিচালিত আলাপ-আলােচনা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। যদিও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলােচনার ব্যর্থতার বিষয়টি জানাননি। ইত্যবসরে, অবশ্য, ১ মার্চ থেকেই তখন পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক ধরনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যে ব্যবস্থাকে বলা চলে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সমান্তরাল সরকার ব্যবস্থা। যদিও তা প্রেসিডেন্টের দ্বারা কোনােভাবেই উৎসাহপ্রাপ্ত ছিল না। মূল প্রতিবেদনের ৮৭ পৃষ্ঠায় আমরা শেখ মুজিবুর রহমান যেসকল দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন এবং বারংবার তা বর্ধিত করেছিলেন তা সংযুক্ত করেছি। এ সবকিছু এটিই পরিষ্কার করে যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তির ঝুঁকি ব্যতিরেকেই উত্তরােত্তর শক্তি বৃদ্ধি করতে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। আমরা তখন বুঝবার মতাে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম; এখনও সেই অবস্থার মধ্যেই রয়েছি যে, কীভাবে একটি সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করে যার ফলে। সংগঠিতভাবে উশৃঙ্খল জনতার শাসন (মব রুল) চলতে থাকে। ফলে নাগরিকদের জীবন, সম্পত্তি এবং সম্মানহানিমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরােধ বা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা (প্যাসিভিটি) আওয়ামী লীগকে সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়; যার মাধ্যমে দলটি ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসের রাজত্ব সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যায়। এবং কেন্দ্র সেই সব লােকদের সহানুভূতি ও বিশ্বাস হারায় যারা ‘এক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগের নেতারা ওই সব লােকদের ওপর তাদের দ্বারা পরিচালিত সমান্তরাল শাসন মেনে নিতে বাধ্য করেন। তখন ওই সব লােকেরা আওয়ামী লীগের কার্যকলাপের বিরােধিতা করার সাহস হারিয়ে ফেলেন। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিলাস পায়ের তলার মাটি আরও শক্তভাবে অর্জন করে। প্রারম্ভিক পর্যায়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহগুলােকে মােকাবিলা করার ব্যর্থতার কারণে দোদুল্যমান জনগােষ্ঠীর সহানুভূতি পেতে সরকার যে কেবল ব্যর্থ হয়েছিল তাই নয়, সেসঙ্গে ওইসব মানুষজনকে সরকারবিরােধী শিবিরের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। আর এটিই ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সামরিক কর্মকাণ্ডের উপক্রমণিকা।
৭৫
৩৪
সামরিক অভিযান এবং আলাপ-আলােচনার প্রয়ােজনীয়তা
১। সরকারকে আমরা অভিযুক্ত করতে পারি দুঃখজনক অবস্থা এগিয়ে যাবার সুযােগ দেওয়ার জন্য; কেননা, সরকার পরিস্থিতি সে পথে যাবার বিষয়টি গ্রহণ করে নিয়েছিল। যদি জেনারেল ইয়াহিয়া নাগরিকদের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য অনবরত সদিচ্ছাসহ কাজ করতেন তাহলে, যেভাবেই হােক না কেন, একমাত্র জ্ঞানচিত হতাে যেকেনাে ভাবে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিমিত্তে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঘােষণার সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে তখনকার পরিস্থিতির বেশকিছু নিকটতম মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাভাবিক রাজনৈতিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের জন্য পুনরায় তাঁর অতীতের ‘বেতার সম্প্রচারের বাক্যগুলাে প্রযােজ্য ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়ার বক্তব্য ছিল, “প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তাঁর প্রথম এবং প্রধান কাজ হলাে, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞান ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের সন্তুষ্টির জন্য প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজকর্ম পুনরায় জীবিত করা।” সেই চেতনার আলােকে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের সামরিক অভিযান ছিল একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সেজন্য নিশ্চিতভাবে বলা যায়; এটি কোনাে যুদ্ধ ছিল। না। সে পর্যায়ে এমনকি তা পালটা আক্রমণের স্তরেও ছিল না। তবে পরবর্তীতে আমরা সেই স্তরে প্রবেশ করেছিলাম।
২। দেশের বেসামরিক প্রশাসন নিঃসন্দেহে সামরিক স্বৈরাচারের হস্তগত হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু তবুও নিঃসন্দেহে বেসামরিক সরকার সামরিক স্বৈরাচারের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে থাকে। কিন্তু সামরিক স্বৈরতন্ত্র অঙ্গীকারগতভাবে ছিল সাময়িক উদ্দেশ্যে কর্মরত; যার লক্ষ্য ছিল দেশে বেসামরিক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা, যা কোনাে ভাবেই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়। আমরা সত্যিকারভাবে অবলােকন করেছি জেনারেল ইয়াহিয়া এবং তার নিকটস্থ ‘কোটারী এই বিষয়ে মােটেও সৎ ছিলেন না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সামরিক কার্যক্রমকে, যুক্তিযুক্ত করা যায় কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে। অর্থাৎ, পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রাথমিক কর্মকাণ্ড হিসেবে, যার আকাক্ষা ও লক্ষ্য হবে স্বাভাবিক সরকার স্থাপন। এটি নিজের কোনাে লক্ষ্য ছিল না, এটি ছিল কেবলমাত্র লক্ষ্যে পৌছার উপায় মাত্র। তাহলে প্রথম প্রশ্ন উত্থাপিত হয়; সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের পরে কত দ্রুততম সময়ে রাজনৈতিক মীমাংসা স্থাপনের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল । বিষয় হলাে; সেই সময়ের ভেতর ওই আলােচনার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি নিযুক্ত করা হয়েছিল কি না। এটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ যা আমরা পরবর্তীতে আলােচনা করে দেখব। অথবা আলােচনার জন্য কেবলমাত্র পদক্ষেপ গ্রহণের ভনিতা করা হয়েছিল কি না; তাও বিচার-বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হবে।
৭৬
৩। আমরা ইতােমধ্যে মূল প্রতিবেদনে ভারতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু পরিমাণ আলােচনা করেছি, এক্ষেত্রে দেশটি কোনাে প্রকার গােপনীয়তার আশ্রয় নেয়নি। এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে তারা পাকিস্তানকে ভেঙে পূর্ব পাকিস্তানের স্থানে স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপন করার অভিপ্রায় গ্রহণ করেছিল। সে কারণেই এক্ষেত্রে আগেই রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রয়ােজনীয়তা খুব শক্তভাবে এসে পড়েছিল।
৪। এ বিষয়ে আমাদের সামনে বেশ কিছু পরিমাণের মানুষের সাক্ষ্য প্রমাণ চলে আসে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক এবং বেসামরিক অংশের একটি বড়াে পরিমাণ সাক্ষী সেই সময়ে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রয়ােজনীয়তার কথা চিন্তা করেন এবং সেসঙ্গে মনে করেছিলেন যে, যুদ্ধের আগেই এজন্য ছিল উপযুক্ত সময়। কেউই এখন ভান করতে পারবেন না যে, আমাদের দ্বারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ সামারিক আক্রমণের পরে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ড. কামাল হােসেনকে বন্দি করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জনসমক্ষে শেখ মুজিবকে বিশ্বঘাতক হিসেবে ঘােষণার পরে পাকিস্তানের মতাদর্শের নিরিখে সংহতিপূর্ণ পাকিস্তান-এর সমাধান একটি আদর্শিক আকার হিসেবেই উপস্থাপিত হতে পারে। কিন্তু মীমাংসা করতে পারলে তা হতাে তুলনামূলকভাবে সুরুচিপূর্ণ সমাধান। নিশ্চিতভাবে তা হতে পারত মানসম্মান ও প্রাণহানি না ঘটিয়ে দেশকে একই পতাকার তলে ধরে রাখার মতাে কাজ। তা হলে যে অবমাননাকর পরিস্থিতিতে আমরা ভুক্তভােগী হয়েছিলাম তা ঘটত না। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দায়ও এড়ানাে যেত।
৫। সামরিক কার্যক্রমের ফলাফল ছিল দ্রুতগতিসম্পন্ন, যদিও এর সম্পন্নকরণ এবং ফলপ্রসূতা কতখানি অনুভূত হয়েছিল তা নিয়ে তথ্য-প্রমাণাদি একরূপ ছিল না। এসব বিষয়ে স্বাভাবিক মানবীয় মতপার্থক্য মেনে নিয়েও আমরা এ ধরনের একটি উপসংহারে উপনীত হয়েছিলাম যে, ১৯৭১ সালের মে মাসে সেই পরিস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল। সম্ভবত তখন আশার আলাে নিবু নিবু হচ্ছিল। এবং তারপরও সে অবস্থা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ঘটনা প্রবাহ ও তথ্য প্রমাণ থেকে দেখা যায়, এ কথা বলা যেত না যে সমগ্র প্রদেশে পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতা এবং পূর্ণ সরকারি কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা গিয়েছিল। কিন্তু পরিষ্কারভাবে এটি ফুটে উঠেছিল বিদ্রোহীদের প্রারম্ভিক প্রতিরােধের দেওয়াল ভেঙে গিয়েছিল।
৬। ২১৪ নং সাক্ষী জনাব মােজাফফর হােসেন যিনি ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ ঢাকা গিয়েছিলেন জাতীয় সংসদের সচিব হিসেবে, তার তথ্য থেকে দেখা যায়, যখন ঢাকায় সান্ধ্য আইন থাকত তখন মানুষের চলাচল ছিল খুবই সামান্য, কেবলমাত্র সামগ্রিক অবাধ্যতা ব্যতীত। এর কিছুকাল পরে; ৬ এপ্রিল ১৯৭১ (যখন ইতােমধ্যে সামরিক অভিযান গ্রহণ করা হয়েছিল), তিনি ফিরে আসেন এবং এই মনােভাব নিয়ে আসেন যে, ঢাকা ছিল একটি মৃত নগরী । বিস্তারিতভাবে তিনি বলেন-
“বিমানবন্দর এলাকা ব্যতীত অন্য রাস্তাগুলােতে মানুষের চলাচল ছিল না। বিমান বন্দর ছিল উদ্বাস্তুতে ভরপুর। হাজার হাজার মানুষ বারান্দা এবং করিডােরে থাকত। তারা বের হতে চাইতেন। কিন্তু সান্ধ্য আইন থাকার জন্য বাইরে বের হতে পারতেন না। আমি বলতে পারব না যে, সেখানে সত্যিকারভাবে সান্ধ্য আইন
৭৭
ছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনীকে সর্বত্র স্থাপন করা হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে গভর্নমেন্ট হাউজ অবধি কোনাে প্রকার চলাচল ছিল না।”
১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যে, যদিও তিনি স্বীকার করেছেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুনঃস্থাপন সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তবুও মােটামুটিভাবে কর্তৃপক্ষ সমগ্র ভূখণ্ডে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭১ সালের জুলাই; তিনি বলেছেন, সেখানে সবকিছু সত্যিকারভাবে শান্ত হয়ে এসেছিল। তিনি তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, আগস্ট মাস হতে পারত আলাপ-আলােচনার জন্য উপযুক্ত সময়।
৭। সাক্ষী নং ২১৯, জনাব এম এ কে চৌধুরী, যিনি ১৫ মে, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশের মহাপরিদর্শন-এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তিনি বলেন-
স্যার, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় এবং তা পরিপূর্ণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ ভূখণ্ড এবং প্রধান প্রধান অংশ বিদ্রোহীদের হাত থেকে ফিরে পাওয়া গিয়েছিল। খতম করার নিমিত্তে চালিত অভিযান/অপারেশন কার্যক্রম সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। ভূখণ্ডের কিছু অংশ; বিশেষত উত্তরে রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ তখনও পর্যন্ত বিদ্রোহীদের দখলে ছিল। সেখান থেকে বিশ্বাসঘাতকতামূলক তৎপরতা। চালানাে হতাে। তবে বিদ্রোহী তৎপরতা চলতে থাকলেও তা ছিল কার্যত খুব স্বল্প মাত্রায়। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক মীমাংসার (আপস) জন্য উপযুক্ত সময় ছিল সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যায়ে; কিংবা অক্টোবরের শুরুতে। তিনি উল্লেখ। করেন যে, এ কথাটি জনাব নূরুল আমিনকে (প্রয়াত) বারবার বলা হয়েছিল; তিনি তার কাছে প্রায়ই আসতেন। জনাব নূরুল আমিন ছিলেন অ-আওয়ামী লীগার হিসেবে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত অতি স্বল্প সংখ্যক সদস্যের একজন। তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযােগ্য স্টেটসম্যান’, যার সম্মান ছিল তখনও পর্যন্ত নিঃসন্দেহে উচ্চমাত্রায়। আমরা এই সাক্ষী কর্তৃক জনাব নূরুল আমিন সম্পর্কে উচ্চবাক্য করার কারণ ব্যাখ্যা করেছি এভাবে যে, নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানে আগে সরকারি কাজ করেছিলেন। এই সাক্ষী প্রায় একই সুরে অন্যান্য সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন, জনাব হাবিবুর রহমান, মৌলবি ফরিদ আহম্মদ এবং জনাব সবুর খান সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেন।
৮। অনুরূপভাবে, জনাব এস এম নওয়াব (সাক্ষী নং ২২০) যিনি ছিলেন পুলিশের ডিআইজি, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা, ১২ জুলাই ১৯৭১ থেকে কার্যরত ছিলেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে মীমাংসার বিষয়টি কোনােক্রমেই অসম্ভব ছিল না। এবং নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় ছিল জুন মাস পর্যন্ত ।
৯। সৈয়দ আলমদার রেজা (সাক্ষী নং ২২৬), ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা বিভাগের কমিশনার-এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মনে করেন; মে মাসে | মােটামুটিভাবে সাধারণ মানুষ একটি মিটমাটমুখী মনােভাব পােষণ করতেন, কিন্তু এই সুযোেগ ক্রমান্বয়ে অপসৃত হতে থাকে।
১০।জনাব হুমায়ুন ফায়েজ রাসুল (সাক্ষী নং ২২৯), ১৯৭১ সালের ২০ মে তারিখে তথ্য সচিব পদে যােগদান করেন। তিনি নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন এভাবে যে,
৭৮
রাজনৈতিক সমাধান কাক্ষিত এবং সম্ভবপর ছিল। তিনি আমাদের বলেন, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথােপকথন থেকে তাঁর মনে হয়েছিল, যদিও সঠিকভাবে নয়, সেনাবাহিনী একাই এর উত্তর দেওয়ার যােগ্যতা রাখে।
১১। দেখা যায় রাজনৈতিকভাবে সংকট নিষ্পত্তির বিষয়টি সকল কিছুর বিনিময়ে পাওয়ার জন্য কোনাে প্রকার আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তা কেবলমাত্র বেসামরিক কর্মকর্তা কর্তৃক সমর্থিত ছিল। অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তাই আমাদের কাছে প্রায় একই রকমের চিন্তা-ভাবনার কথা বলেছেন। বাস্তবে এটি ছিল তাদের দুঃখ-দুর্দশার অংশ। তাদের মধ্যে অধিকাংশই মনে করতেন সামরিকভাবে সমস্যার সমাধানের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে অবৈধ ও অযৌক্তিকভাবে। কেননা সেখানে সমস্যার প্রকৃতি ছিল পরিষ্কারভাবে কার্যত রাজনৈতিক। তাদের মধ্যে সকল সাক্ষীর ভিতর রয়েছে একটি অন্তঃস্রোতের মতাে বয়ে যাওয়া অনুভূতি। তা এমন যে, তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব অসম্ভবের মতাে হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের বিভ্রান্তির কারণে এবং এমনকি চিন্তার মধ্যে সেখানে বিকৃতিও দেখা দেয়। এই বিষয়ে বিপুল আয়তনের সাক্ষী উদ্ধৃত করা অসম্ভব এবং এমনকি বাস্তবিকপক্ষে তা অপ্রয়ােজনীয়। কিন্তু আমরা কিছু সংখ্যক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি; যারা উপযুক্ত বক্তব্য দিয়েছেন। এমনি জেনারেল নিয়াজী (সাক্ষী নং ২৮৫) নিজে তার লিখিত বক্তব্যে বলেছিলেন-
“পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে, নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে রাজনৈতিক মহাদুর্যোগের ওপর সামরিক বিজয় অর্জন করতে হবে। তারা এ লক্ষ্যটি অতিস্বল্প সময়ের মধ্যে অর্জন করে। এবং জুন ১৯৭১ তারা পরিস্থিতি পর্যাপ্ত পরিমাণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এমতাবস্থায় সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে পরিস্থিতিতে দেশের উভয় অংশের মধ্যে সমঝােতা আনতে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য সেখানে কোনাে প্রকার সামগ্রিক জাতীয় লক্ষ্য, অথবা জাতীয় নীতি কিংবা জাতীয় কৌশল ছিল না। হাইকমান্ড’ পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের প্রারম্ভিক সামরিক সাফল্যের ফসল চয়ন করতে ব্যর্থ হয়। বিপরীতভাবে, আমাদের দ্বারা পুনঃস্থাপিত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে শত্রুপক্ষ তাদের সুযােগ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগায়। তারা সুসংগঠিত হয়ে বিদ্রোহকে যুদ্ধে পরিণত করে পরবর্তীতে তাদের শেষ পোঁচ বয়ে আনে যা হলাে, “বাংলাদেশ অর্জন করা।”
১২। তাঁর চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জি এম বাকির সিদ্দিকী (সাক্ষী নং ২১৮) বলেছেন। যে, যদিও সরকারি কর্তৃত্ব জুন মাসে পুনরুদ্ধারসম্পন্ন ছিল না। কিন্তু সে সময়ের। মধ্যে প্রতিরােধ সংগ্রাম নিশ্চিতভাবে খান খান হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক সমস্যা সামরিক কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসার বিপক্ষে তিনি একটি প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
১৩। ব্রিগেডিয়ার এম এ নায়েম (সাক্ষী নং ২৩৭); তিনি সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ না করলেও বলেছেন যখন স্বাভাবিক অবস্থা অর্জন করা হলাে তখন ধরেই নেওয়া গেল যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাওয়া আবশ্যক। কিন্তু তিনি অকপটে বলেন এটি তাঁর অভিমত; কিন্তু সে সময়ে রাজনৈতিক মীমাংসার কোনাে প্রকার উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।
৭৯
১৪। অনুরূপভাবে, ব্রিগেডিয়ার বশির আহমেদ (সাক্ষী নং ২৪৫), প্রায় একই রকমের মনােভাব ব্যক্ত করেছেন এবং বলেছেন যে, রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত সময় ছিল মে-জুন মাস।
১৫। ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার আহমেদ রানা (সাক্ষী নং ২৪৯), রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিয়ে বলেছেন এটি করা অত্যাবশ্যকীয় ছিল এবং এর জন্য উপযুক্ত ছিল মে মাসের মাঝামাঝি সময়। সবচেয়ে ভালাে হতাে যদি তা মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে করা হতাে।
১৬। ব্রিগেডিয়ার সলিমউল্লাহ (সাক্ষী নং ২৫০), সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করার বিষয়টির ওপর আনা প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটিসহ রাজনৈতিকভাবে আলাপ-আলােচনার জন্য উপযুক্ত সময় ছিল মে মাসের প্রারম্ভ। কেননা, সে সময়ে সামরিক কর্মকাণ্ড শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিল।
১৭। ব্রিগেডিয়ার এস এ হাসান (সাক্ষী নং ২৫০), আরও একটু অগ্রসর হয়ে বলেছেন এমনকি সেপ্টেম্বর নয়, কেননা, সে মাসটিও ছিল অতি বিলম্বিত, তার আগেই রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তির জন্য কমান্ডার ইন-চীফকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সামরিকভাবে সমাধানের কথা জোরের সঙ্গে বলেছিলেন।
১৮। ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ খান (সাক্ষী নং ২৫৩), ভেবেছিলেন যে, এটি সহজেই সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে করা যেত। ১৯। ব্রিগেডিয়ার আতা মােহাম্মদ খান মালিক (সাক্ষী নং ২৫৩), বলেছেন সাধারণ ক্ষমার জন্য উপযুক্ত সময় ছিল আগস্ট মাস। কেননা সে সময় আমাদের অবস্থান ছিল সুবিধাজনক (আপার হ্যান্ড) এবং সেখানে নিশ্চিতভাবে বেসামরিক ক্ষমতা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু তিনি বলেন ওই সময় গভর্নর পরিবর্তন করা ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। তাঁর মতে, সেভাবে একজন বেসামরিক গভর্নর বাছাই প্রকৃতপক্ষে ছিল অর্থহীন এবং বেসামরিক কর্তাদের ক্ষমতায়নের প্রয়ােজনীয়তা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান-এর ক্ষমতা অর্জন ডা. মালেকের গভর্নর হওয়া নয়। কিন্তু তিনি বলেন এসব বিষয়গুলাে বরং অনেক বিলম্বে গ্রহণ করা হয়েছিল। অথচ এর জন্য সুবর্ণ সময় ছিল এপ্রিল অথবা মে মাস।
২০। ব্রিগেডিয়ার এস এম এইচ আতিফ (সাক্ষী নং ২৫৫), আমাদের কাছে চালচিত্রের আরও একটি দৃষ্টিকোণ দেখিয়ে দেন, যখন তিনি বলেন এমনকি নভেম্বর মাসে এসেও জনগণ সম্পূর্ণভাবে আমাদের বিরুদ্ধে ছিলেন না। কলকাতার একটি জনমত জরিপে প্রকাশ করা হয়েছিল যে, কেবল মাত্র শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে। তিনি ব্যাখ্যা দেন এবং আমরা কারণগুলাে দেখলাম সেই ব্যাখ্যা থেকে বয়ােবৃদ্ধগণ অনুপ্রাণিত হতেন। কেননা, তাঁরা তাঁদের স্মৃতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মতাদর্শের প্রতীকগুলাে ধারণ করে রেখেছিলেন। সেজন্য তারা পাকিস্তানের প্রতি ছিলেন বিশ্বাসী এবং যেহেতু যুব সমাজ সেই সংগ্রাম ও স্মৃতি সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ; সেহেতু তারা ওই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল।
২১। সে সময়ে কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদ (সাক্ষী নং ২৪৬), তিনি তার মতামতে বলেন, মে মাসের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সংকট মীমাংসার জন্য ছিল উপযুক্ত সময়। এটি একটি উৎসুকপূর্ণ প্রতিধ্বনি যে, সে সময়ে কেবল তিনিই নন অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তারও সাধারণ মন মানসিকতা এমন ছিল যে, তারা মুখ ফুটে তেমন কিছু বলতেন না (অবশ্য এর
৮০
কিছু ব্যতিক্রম ছিল)। কেননা, তিনি বলেন এ বিষয়ে তিনি কাউকে কিছু বলেননি। নিমােক্ত বাক্যগুলাে থেকে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার বক্তব্যের উল্লেখযােগ্য দিকের প্রমাণ পেতে পারি-
প্রশ্ন : যে ঘটনা এখন ঘটছে এবং যে ঘটনা সম্পর্কে আপনি আপনার উচ্চতর কর্মকর্তা কর্তৃক অবহিত ছিলেন, তার আলােকে কি এটি। বলা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না যে, সামরিক আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্জনের জন্য কোনাে প্রকার সদিচ্ছা পােষণ করতেন না?
সাক্ষী : প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই আমার মনে হয়েছে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সে বিষয়ে কোনাে প্রকার সদিচ্ছা ছিল না। এটি তাঁর। ব্যক্তিগত মতামত ছিল। একটি গণতান্ত্রিক দেশ অর্জন করাই ছিল আমার মনােভাব; যা আমি সদা-সর্বদা ধারণ করেছি। সেজন্য আমি আমার সমগ্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনকে মুক্ত ও স্বচ্ছ করতে চেয়েছি।
প্রেসিডেন্ট : যেহেতু আপনি সামরিক ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে ছিলেন, তাই আপনি এবং আপনার সহকর্মীগণ কি মনে করতেন যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করলে পর রাজনীতিবিদগণ ছােটোখাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত করবে এবং তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােষ্ঠী ও দলে । আমি কি সঠিকভাবেই এরকম চিন্তা করছি। অন্য ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, আপনি একটি গণতান্ত্রিক রীতি চান যা আপনাকে অবদমিত ও অধীনস্ত করবে। কিংবা তা আপনি যেভাবে চান সেভাবে কাজ করবে?
সাক্ষী : আমি কখনাে সে পথে চিন্তা করিনি। আমি নিশ্চিতভাবে চিন্তা করেছি যে, গণতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে হলে তার আগে এর জন্য সময়ের প্রয়ােজন রয়েছে।
এখানে সংযুক্ত করা যায় যে, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফের মতে, জেনারেল জামশেদ ছিলেন মতামত প্রকাশের প্রশ্নে স্বভাবগতভাবে অনেকটা সংযমী এবং বিমুখ ।
২২। সামরিক বাহিনীর মধ্যে থেকে যিনি রাজনৈতিক বিষয়ে সর্বাপেক্ষা বেশি পরিমাণ মতামত দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী (সাক্ষী নং ২৮৪)। এটি সম্ভবত একটি বােধগম্য কারণ যে, তিনি সেসব কাজে ছিলেন ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত। এই সাক্ষীকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল সামরিক আইন জারির বহু আগে। কিন্তু ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ সালে সামরিক আইন জারির সময় তিনি ব্রিগেডিয়ার এবং পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হিসেবে বেসামরিক বিষয়ে দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই অবধি তিনি উক্ত দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। ওই তারিখ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজনৈতিক বিষয়সংশ্লিষ্ট মেজর জেনারেল। চূড়ান্তভাবে, শেষ অবধি তিনি। গভর্নরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁর লিখিত বিবৃতিতে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, তিনি কখনাে গভর্নরের উপদেষ্টা পদে ছিলেন না। তিনি আরও দাবি করেন তিনি কখনাে নীতি-নির্ধারণী কোনাে পদে অথবা সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক
৮১
অবস্থানে ছিলেন না। যদিও এটি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি নীতিনির্ধারণী কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এটি মানতে হবে যে, তাঁর ক্ষমতা কেবলমাত্র উপদেষ্টার গণ্ডির মধ্যে সীমিত ছিল। তবে এটি তিনি চর্চা করতেন স্বাধীন ও মুক্তভাবে । তাঁর বিবৃতির সর্বত্র জুড়ে এবং আমাদের সম্মুখে তিনি উপর্যুপরিভাবে বলেছেন তিনি যে কেবলমাত্র রাজনৈতিক পথে সমাধানের পক্ষে ছিলেন তাই নয়, সেসঙ্গে তিনি অবশ্যই সামরিক অভিযানেরও বিরুদ্ধে ছিলেন। সে সম্পর্কে আমরা বলেছিলাম এখন আমরা যা নিয়ে আলােচনা করছি, তাতে আমরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানকে নিছক সামরিক কার্যক্রম হিসেবে দেখছি না। বরং তাকে দেখছি বেসামরিক ক্ষমতার প্রতি সাহায্যকারী ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম হিসেবে। তথা রাজনৈতিক পদক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি প্রাথমিক কাজ হিসেবে, যাতে করে পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপ সহজতর হয়ে উঠতে পারে। এখানে তার দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ধৃত করা মূল্যবান বলে মনে হতে পারে। বিশেষ করে স্বাভাবিকতার অর্থ কী এবং কেনই বা সামরিক অভিযান গ্রহণ করা হয়েছিল । তিনি তাঁর লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন-
২৩। স্বাভাবিক অবস্থা বলতে কী বুঝায়? স্বাভাবিক অবস্থা হলাে এমন একটি অবস্থা যা আমার চিন্তায় তখনই থাকে যখন-
(ক) সরকারি আদেশপত্র দেশের সর্বত্র এবং সমগ্র ভূখণ্ডের সীমার ওপর কার্যকর থাকে।
(খ) কোনাে প্রকার ভয়ভীতির উর্ধ্বে থেকে মানুষজন নিত্যদিনের কাজকর্ম করে যেতে পারে এমন অবস্থা নিশ্চিত করার মতাে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় থাকা।
(গ) আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠানাদির রাষ্ট্রের আইন এবং বিধিবিধান অনুযায়ী কাজকর্ম সম্পাদন করার পরিস্থিতি।
(ঘ) সড়ক, রেলপথ, বিমানপথ, ডাক এবং টেলিযােগাযােগসহ যাবতীয় যােগাযােগ ব্যবস্থার স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করার অবস্থা।
(ঙ) ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতাে পরিস্থিতি বজায় থাকা। শিক্ষা ও সামাজিক কাজকর্ম চলতে থাকা।
(চ) মানুষের সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
২৪। জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণার তাৎক্ষণিক সময় থেকেই স্বাভাবিক অবস্থা দূর হয়ে গিয়েছেল। সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক অভিযান আরম্ভ করা হয়। এটি প্রত্যাশিত ছিল যে, এর ফলে স্বাভাবিক অবস্থা অন্যান্য বিষয়গুলাের সঙ্গে আপনা-আপনিই ফিরে আসবে। দুঃর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগের পূর্ব পরিকল্পিত বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের দরুন সেনাবাহিনীর কর্মতৎপরতার তাৎক্ষণিক সময় ছিল নিম্নরূপ“
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের ভূমির অধিকাংশই ছিল বিদ্রোহীদের দখলে। সে কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল বৈধ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পুলিশ এবং ইপিআর সক্রিয়ভাবে বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছিল। সেজন্য আমাদের হাতে প্রাথমিক স্তরে স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ছিল না।
(খ) বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও আওমায়ী লীগের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এদের বিরাট অংশ হয় ভারতে চলে গিয়েছিলেন।
৮২
অথবা কল্পিত ভয়ে ভীতু হয়ে স্বেচ্ছায় কর্মস্থল ত্যাগ করে গ্রামেগঞ্জে চলে যান। বেসামরিক সরকার ব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল, যদিও তা অস্তিত্বহীন ছিল না।
(গ) আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের কারণে যাতায়াত যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। সেতু, কালভার্ট ভেঙে ফেলা হয়েছিল; এজন্য বিদ্রোহীরা ছিল সক্রিয়। খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্য পরিবহণ কার্যক্রম দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে অসুবিধার মধ্যে পড়ে।
(ঘ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাে ছিল বিপ্লবীদের প্রতিরােধ তৎপরতার মূল কেন্দ্র। এর অধিকাংশই দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
(ঙ) দেশের স্বাভাবিক আইন প্রয়ােগ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। যথাযথ আইন-বিধি স্থবির হয়ে গিয়েছিল। পুলিশবাহিনীর অনুপস্থিতির কারণে অপরাধ দমন এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে যায়।”
২৫। এসব কিছু বলার পর তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বলেন-“৪৪। চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সীমিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকত্ব আনার জন্য প্রয়ােজন ছিল জন মানুষের আস্থা অর্জন। আর এভাবেই তাদের সমর্থন নিয়ে বিদ্রোহীদের জনবিচ্ছিন্ন করা এবং চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা। এ কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় অংশীদার ছিল-
(ক) রাষ্ট্রপতি ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
(খ) গভর্নর এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ।
(গ) সেনাবাহিনী।
২৬। চূড়ান্ত লক্ষ্য কেবলমাত্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়েই অর্জন করা যেত। এ কাজটি স্বয়ং রাষ্ট্রপতি আরম্ভ করতে পারতেন। মাঠ পর্যায়ে অপারেশন পরিচালনা করত সেনাবাহিনী। স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য গভর্নর তার সীমিত গণ্ডির ভিতর কিছু নীতি-নির্ধারণ করতেন। সামগ্রিক অবস্থার বিচারে তাঁর কার্যকারিতা ছিল সীমিত। এমনকি তখনও যখন দুমাস পরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছিল। কিন্তু ভারতের পরােক্ষ এবং পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ভিতরও আমরা প্রতিনিধিত্বশীল বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করি। এভাবে ক্রমান্বয়ে একত্রে থাকার জন্য একটি কার্যপযােগী ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে আনতে চেষ্টা করি।”
২৭। তাঁর দৃষ্টিতে এটি পরিষ্কার যে, তেমন একটি স্বাভাবিক অবস্থার জন্য প্রয়ােজন ছিল ফলপ্রসূ আলাপ-আলােচনার । ১৯৭১ সালের মে মাসে তা সম্ভবপর ছিল।
২৮। সে কারণে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি এটি সম্পূর্ণরূপে একটি অগ্রাহ্যকর তত্ত্ব যে, সরকারের পর্যাপ্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে আলাপআলােচনার সুযােগ ছিল না। সুতরাং, আমরা বলতে চাই; যেকোনাে বিবেচনায়। মীমাংসা এবং আলাপ-আলােচনার সুযোেগ আপেক্ষিকভাবে বজায় ছিল। তবে প্রারম্ভের ঘােষণা থেকে শুরু করে শেষ অবধি জেনারেল ইয়াহিয়া খান সে পথে এগিয়ে যাননি।
৮৩
৩৫
আলাপ-আলােচনার সম্ভাব্যতা।
১। এরপর যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হলাে- কার সঙ্গে মীমাংসার জন্য আলােপ-আলােচনা? এটি দাবি করা হয় যে, আলাপ-আলােচনা কে কার সঙ্গে করবেন, এ সম্পর্কে মহৎ ইচ্ছা থাকলেও কীভাবে এটি বাস্তবায়ন হবে, তা ছিল একটি প্রশ্ন। আমরা পরবর্তী পর্যায়ে এসে দেখব আলাপ-আলােচনার জন্য তথাকথিত যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে করা হয়নি, যারা কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে কথা বলতে পারতেন। এমনকি যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি নন তাদের সঙ্গে আলােচনার ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়ে এ দুটোর মধ্যে কোনাে প্রকার বাছবিচারও করা হয়নি। যাদের সঙ্গে এ ধরনের আলাপ-আলােচনা কার্যকরভাবে এগিয়ে যেতে পারত, কিংবা জনপ্রতিনিধি; এ রকম কেউই সরকারের তালিকায় ছিলেন না। আগস্ট মাসে একটি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা হয়। কিন্তু নজির ও সাক্ষী থেকে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় এবং সেসঙ্গে আমরা সন্দেহ করতে কোনাে প্রকার দ্বিধাগ্রস্ত হই না যে সে আহ্বানের প্রতি সাড়াদান ছিল খুবই নগণ্য। বিশেষ করে আলাপ-আলােচনা এবং মীমাংসার দৃষ্টিতে কতকগুলাে বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। যেমন, তার মধ্যে প্রধান হলাে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে ফিরে আসতে অনুমতি দিচ্ছিল না। এ ঘটনা আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক কিছু ছিল না। কেননা, তাঁরা ছিলেন ভারতের কাছে মূল্যবান জিম্মি (হােস্টেজ)।
২। অবশ্য আমরা এ বিষয়টিকে উপসংহারমূলক চূড়ান্ত বাধা বলে মনে করছি না। আন্তর্জাতিক এজেন্সির মাধ্যমে এটি অতিক্রম করা যেত। এভাবে এগিয়ে গেলে যেকোনাে ব্যক্তির সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন সম্ভবপর ছিল। তথ্য-প্রমাণাদি থেকে দেখা যায় এ ধরনের কাজের জন্য অনেক পথ খােলা ছিল। সবচেয়ে অসুবিধার বিষয় যা আমরা বুঝতে পারি না; তা হলাে কীভাবে এটি অসুবিধাজনক ছিল বলে দাবি করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল হােসেন ছিলেন শেখ মুজিবের অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি যিনি এমনকি বাংলাদেশে এখনও শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার সদস্য। জেনারেল ইয়াহিয়া যে কেবলমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন তাই নয়, সেসঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলেন। তার অনুশােচনাহীন চিন্তা থেকে; যদিও তা অসততা নয় যে, তথ্য-প্রমাণাদি থেকে বুঝা যায় এবং আমরা তাকে যেভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি মূল প্রতিবেদনের জন্য, তাতে তিনি বলেছেন, একজন বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইতিহাসে এবং সেসঙ্গে উপমহাদেশের ইতিহাসেও নজির রয়েছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার দৃষ্টিতে দোষী ব্যক্তিকে কারাগার থেকে বের করে এনে আলাপ-আলােচনা করা হয়েছে। সে ধরনের কার্যক্রম সফলতার মুখ দেখেছে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ধারার সঙ্গেও এরকম উদাহরণ রয়েছে।
৮৪
৩৬
প্রশাসনের বেসামরিকীকরণ
কিছু মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপিত হওয়ার পরে সরকারের পক্ষ থেকে তথাকথিত বেসামরিকীকরণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন কারণে আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি যে, এটির দ্বারা কী বুঝাতে চাওয়া হয়। অথবা, এর দ্বারা কী অর্জন করতে চাওয়া হয়েছিল তাও বােধগম্য নয়। আমরা মনে করি এই পদক্ষেপ- পূর্ব নির্ধারিতভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এটি ব্যর্থ হবে। বাস্তবে যা ঘটেছিল তা হলাে; পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ কিছু মানুষকে সেই বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। অধিকন্তু সেখানে প্রচুর সংখ্যক পুলিশ প্রেরণ করা হয়। এমন কার্যক্রম বেসামরিক প্রশাসনের অংশ কীভাবে হতে পারে তা বােধগম্য নয়। এটি ছিল কার্যত ইতােমধ্যে শেষ হয়ে যাওয়াদের স্থানপূরণ করা। এবং কার্যত তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি আস্থাহীনতা। প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও অনেক কর্মকর্তাই এটি মেনে নেননি, তাই পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাগণ সেখানে (পূর্ব পাকিস্তানে) যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আমরা একে নিছক ভীতি বলে মেনে নিতে পারি না। ব্যাপক সংখ্যক কর্মকর্তা মনে করেন যে, এ ধরনের কাজ হবে অ-ফলপ্রসূ। বেসামরিক কর্তৃত্ব দ্বারা শাসন করার ভিতর দিয়ে গণআস্থা ফিরিয়ে আনাই যদি সরকারের লক্ষ্য হতাে; তাহলে বলা যায় এই প্রচেষ্টা ছিল পরিষ্কারভাবে একটি হটকারী প্রচেষ্টা। চাকরি ছেড়ে পালিয়েছেন এমন পদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাদের স্থলে নতুন লােক নিয়ােগ দেবার ফলে বাঙালিদের মনে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে, সামরিক বাহিনী কাজকর্মে ঢিলা দিচ্ছেন। অথবা তা পরিত্যাগ করছেন। অনুতাপের সঙ্গে, যদিও তা ছিল সর্বতােভাবে অত্যাবশ্যকীয়; বলা যায় যে এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সামরিক স্বৈরাচারকে পাশ্চাত্যের আধিপত্যের মতােই মনে করতে থাকেন। ব্যাখ্যাতীতভাবে এই ধারণার জন্ম নেয়, বিশেষত আওয়ামী লীগের প্রােপাগাণ্ডার কারণে যে, দৃশ্যত দেশ ‘অনিবার্য বিভক্তির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এর আস্বাদ অবশ্য তিক্ত। শেখ মুজিবের দ্বারা স্থাপিত সংক্ষিপ্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক শাসন ছিল কার্যকর। সে কারণে সামরিক অভিযানের এবং শেখ মুজিব নিজেও সেই শাসনের ছিল নিজস্ব ফলাফল। বাস্তবতার দৃষ্টিতে সেজন্য বেসামরিক প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন করার বিষয়টির তেমন কোনাে গুরুত্ব ছিল না। অথবা সেজন্য তেমন কোনাে পার্থক্য সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে এটি প্রতীয়মান হয় যে, বাঙালি মুখ্য সচিব, জনাব সফিউল আজম, যিনি ছিলেন জনাব মােজাফ্ফর হােসেনের তাৎক্ষণিক পরবর্তী সচিব, কার্যত ঘটনার ক্ষেত্রে তেমন কোনাে হেরফের ঘটাতে পারেননি। জনাব মােজাফফর। হােসেন নিজে বলেছেন কমিশনের প্রেসিডেন্টের প্রশ্নের জবাবে যে মুখ্য সচিব হওয়ার পরে রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তার কোনাে প্রকার মাথাব্যথা ছিল না :
৮৫
“না, স্যার, এটি নিশ্চিতভাবে আমার কোনাে বিষয় ছিল না। প্রথমত, এবং সর্বাগ্রে আমাকে পাঠানাে হয় পরিষ্কার একটি বােঝাপরার মধ্য দিয়ে যে, সেখানে হবে একটি বেসামরিক সরকার। দ্বিতীয়ত, আমাকে এ ধরনের একটি নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল সেখানে একটি রাজনৈতিক সমাধান আসবে। এবং তৃতীয়ত, আমাকে বলা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগকে পুনরায় আবার পিছিয়ে আসতে বলা হবে। যদি তারা পেছনে ফিরে না আসে তা হলে সেখানে একটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং যারা সংসদ সদস্য হবেন তারা ১৯ ডিসেম্বর তারিখে সভায় মিলিত হবেন এবং তখন আমাকে ভারমুক্ত করে জনাব রব আমার নিকট থেকে দায়িত্বভার নেবেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আমি ডা. মালেকের সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনায় মিলিত হয়েছিলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলাে যদিও তিনি গভর্নরের দায়িত্ব নেন, আমি ঢাকায় তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানের আগে দেখা করিনি। তিনি আমাকে বলেন যে, আমার নিকটে তার সুনির্দিষ্ট কিছু জিজ্ঞাসা করার রয়েছে। এ কথা জেনারেল ইয়াহিয়াও আমাকে বলেছিলেন। আমরা দীর্ঘ সময় ধরে আলােচনা করেছিলাম। আমি এই মনােভাব ধারণ করেছিলাম নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শীঘ্রই তার চলে যাবার মতাে ঘটনা ছাড়া তাঁর মনে আর কিছু ছিল না। তিনি খুব পরিষ্কারভাবেই বলেছিলেন তিনি ৩ অথবা ৪ মাসের জন্য এসেছেন। তিনি দায়িত্ব চালিয়ে নেওয়ার জন্য সক্ষম নন। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত । আর এটিই হলাে তাঁর শেষ দায়িত্ব।”
২। ঘটনাক্রমে, অবশ্য জনাব মােজাফফর হােসেনের ভূমিকা সত্যিকারভাবে তেমন কার্যকর ছিল না। এবং আরও একজন অত্যন্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, জনাব এম এ কে চৌধুরী অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে একইরূপ বলেন, যেমনটি বলেছিলেন সৈয়দ আলমদার রেজা, ঢাকার কিমিশনার। সৈয়দ খালেদ মাহমুদ (সাক্ষী নং ২২৭), তার কর্মস্থল ছিল কমিশনার হিসেবে চট্টগ্রামে। তিনি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেন, জুলাই মাসে যখন রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য ছিল সুবিধাজনক সময় তখন তথাকথিত বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি মােড় ফেরার মতাে কাজটি বিজ্ঞচিত ছিল না । এমতাবস্থায় জেনারেল ইয়াহিয়ার দ্বারা ঘােষিত খসড়া সংবিধানের ধারণাটি ভণ্ডুল হয়ে পড়ে।
৩। এ বিষয়ে আরও অনেক সাক্ষীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা যা বুঝেছি তা হলাে, এগুলাে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু হবে না। বেসামরিক এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্য সংঘাতের অভিযােগ সম্পর্কে কিছু বলা এই পর্যায়ে কার্যকর বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এসব কর্মকর্তাগণ প্রায় একমত হয়ে বলেন যে, তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ দাবি করে বেসামরিক কর্মকর্তাগণ নিজেদের কাঁধে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। উভয় পক্ষের কথাবার্তার ভিতর কিছুটা সত্যের চিহ্ন ছিল। যদিও তা মােটেও মিলানাে যাবে না। কেননা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ছিল না। প্রথম এবং প্রধানত এটি স্মরণ করা যায় যে, সে সময়ে অধিকাংশ কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন। দ্বিতীয়ত, ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানিদের মন-মানসিকতায় পশ্চিম পাকিস্তান এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রায় সমার্থক হিসেবে গণ্য হতাে। সেজন্য যা সত্য ছিল তা হলাে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেসামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে
৮৬
নিয়ে গেলেই যে পরিস্থিতির কোনাে হেরফের হতাে তা নয়। সত্য কথা হলাে, সেসব কর্মকর্তাগণ যে খুব অশান্তির মধ্যে নিপতিত হতেন; তাও নয়। আরও সত্য কথা। হলাে, কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা জেলা পর্যায়ে কর্মস্থলে যেতে পারলেও তাঁদের পক্ষে সামরিক বাহিনী দ্বারা পাহারা (স্কট) ব্যতীত কাজ করা সম্ভবপর ছিল না। সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী (পশ্চিম পাকিস্তানসহ) সামরিক শাসন কায়েম ছিল। এমতাবস্থায়, বেসামরিক প্রশাসন যদিও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের প্রতি সদয় ছিল না, তবুও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার স্বার্থে তারা ছিলেন প্রয়ােজনীয় হাতিয়ার স্বরূপ। উচ্চ পর্যায়ের বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি অভদ্র আচরণের অভিযােগ ছিল এবং তা অস্বীকারও করা হতাে। কিন্তু এ অবস্থায় সংঘাত ও দ্বন্দ্ব ছিল অবশ্যম্ভাবী। একদিকে অভিজ্ঞ বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজ করতে না দেবার কারণে অথবা কাজ করতে না পারার জন্য ছিল হতাশা, অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় | বেসামরিক প্রশাসন বহাল রয়েছে এমন কিছু দৃশ্যমান করতে হতাে।
৪। প্রায় সবাই এমনকি পদস্থ কর্মকর্তাসহ একত্রে এটি অস্বীকার করেন যে, পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণ তাঁদের প্রতি কোনাে প্রকার অভদ্রতা বা অসততা দেখাননি। কিন্তু তারপরও সেখানে উল্লেখযােগ্য ও ব্যাপকভাবে বিশ্বাসযােগ্য ব্যতিক্রম ছিল । জেনারেল জামশেদ জনাব এম এ কে চৌধুরীর প্রতি অভদ্রচিত এবং চূড়ান্ত উদ্ধত আচরণ করেছিলেন। তবে জেনারেল জামশেদ পরে এটি সংশােধন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এটি ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। এ অবস্থায় প্রশাসনের নিম্ন পর্যায়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ ছিল পরিস্থির কারণে একটি আত্মগত বিষয় ।
৫। এ কথা সত্য যে, ডা. মালেক অতঃপর গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ পান। বাস্তবে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সে সময়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র বেসামরিক গভর্নর। যদিও এর কোনাে প্রকার ফলাফল বা প্রভাব ছিল না। একজন বিশিষ্ট ‘স্টেটসম্যান’, যদিও তিনি ছিলেন ব্যাপকভাবে সম্মানিত, তারপরও নিঃসন্দেহে বলা যায়; পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় জনসাধারণের কাছে তার কোনাে প্রকার বিশ্বাসযােগ্যতা ছিল না। এটি এমন ছিল না যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে গ্রহণযােগ্যতাসহ তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েছেন। পরিস্থিতির ওপর তাঁর ছিল যৎসামান্য নিয়ন্ত্রণ । সেখানে যে কেবলমাত্র সামরিক শাসন ছিল তাই নয়; সেসঙ্গে ছিল প্রথমদিকে প্রায় যুদ্ধাবস্থা এবং পরবর্তীতে পরিপূর্ণ যুদ্ধাবস্থা। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি। কিন্তু তিনি কোনােভাবেই সামরিক আইন প্রশাসকের প্রতিনিধি ছিলেন না। তার ওপর তাঁর কর্মসংশ্লিষ্ট পরামর্শের জন্য ছিলেন একজন মেজর জেনারেল উপদেষ্টা। নিঃসন্দেহে উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের নির্দেশের ওপর সামরিক আইনের নির্দেশাবলি অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে নিশ্চিত করতেন। শেষের দিকে কেবলমাত্র তিনি প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত প্রতিনিধিসুলভ কিছু কাজকর্ম সম্পন্ন ও ক্ষমতা চর্চা করতে পেরেছিলেন। সেজন্য যখন আত্মসমর্পণের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করি তখন এর একটি বিপর্যয়কারী ফলাফল দেখতে পাই। তাই আমরা তাঁকে কোনােভাবেই দোষারােপ করতে পারি না।
৮৭।
৩৭
সাধারণ ক্ষমা
১। যারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন তাদের প্রতি ঘােষিত সাধারণ ক্ষমার বিষয়ে আসা যাক। ইতােমধ্যে এই অধ্যায়ে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ঘােষিত সাধারণ ক্ষমার প্রতি মানুষের সাড়াদান ছিল খুবই সামান্য। এ কথা সত্য এ সম্পর্কিত কারণ ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু সেখানে এমন কিছু ছিল, যা আমাদের দ্বারা সৃষ্ট। প্রথমেই উল্লেখ করা যায়; সাধারণ ক্ষমার ঘােষণাটি ছিল অত্যন্ত বিলম্বিত । এতদ্ব্যতীত, এতে ব্যবহৃত ভাষাও ছিল অর্থহীন। এরকম উল্লেখ ছিল যে যারা রাষ্ট্রবিরােধী তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা। হচ্ছে। কিন্তু এতে করে যেসব লােকজন সাধারণ অপরাধের জন্য অভিযুক্ত তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। তত্ত্বগতভাবে নিঃসন্দেহে বলা যায় এই পার্থক্যটি অর্থপূর্ণ ছিল। কিন্তু ঘটনা বিবেচনায় এই পার্থক্যের কারণে কোনােরূপ ভিন্নতা ছিল না। দেশের সাধারণ ‘পেনাল আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ ছিলেন অপরাধী বা অভিযুক্ত। সে কারণে যে ধরনের সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা হয়েছিল তা ছিল পরিষ্কার । এবং এটি ছিল স-প্রমাণ স্বাপেক্ষ। এ বিষয়ে উপযুক্ত ‘স্ক্রিনিং কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিগুলাে সকল মানুষকে তিনটি ভাগে ভাগ করে। কালাে, সাদা এবং ধূসর। তত্ত্বগতভাবে এর অর্থ ছিল যেসকল ব্যক্তি অপরাধী ছিলেন না তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। যাদের আনুগত্য নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে তারা মুক্তি পাবেন না। সত্যিকার অর্থে যদিও বাস্তবে এরূপ কিছু করা হয়নি। আমাদের সম্মুখে যেসব নজির ও প্রমাণ আসে তা থেকে দেখা যায়; প্রায় সব কিছুই ছিল অত্যন্ত আবছা আবছা ধরনের। সে কারণে আমরা এই শ্রেণিবদ্ধকরণের কোনাে প্রকার উপলদ্ধিযােগ্য মানদণ্ড খুঁজে পাইনি। এমনকি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দেশে ফিরে আসার প্রশ্নে ভারতের অনুমতির বেলায় অনিচ্ছা নাও যদি থাকত; তাহলেও এ ধরনের ঘােষণায় প্রকারান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পুনঃপ্রবেশকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল।
২। ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদির খান (সাক্ষী নং ২৪৩) ছিলেন আন্তঃসার্ভিস স্ক্রিনিং কমিটির প্রধান, আমাদের কাছে তিনি পরিমাপ করা (স্ক্রিনিং) সম্পর্কে লিখিতভাবে জানান-
মিশন
“১। এই মিশন আইএসএসসি অর্গানাইজেশন যথা ভাইড এইচকিউ পত্র নং ২৭২১/৭/২ ইপি/জিএসআই(এফআই) তারিখ ১৪ মে, ১৯৭১ ছিল“বিস্তারিতভাবে সেনা সদস্য, মুজাহিদ, আনসার, পুলিশ, বেসামরিক জনগণ এবং ভারতের বেসামরিক ব্যক্তিগণ, সেনাসদস্য, বিএসএফ এর সদস্যদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যারা কিনা পূর্ব-পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর দ্বারা আটকাবস্থায় থাকবেন। অথবা জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তীতে সেরূপ অবস্থায় থাকবেন।”
৮৮
কার্যপরিধি
২। সংগঠন হিসেবে আইএসএসসি-কে প্রদত্ত দায়দায়িত্ব হলাে নিম্নরূপ-
(ক) বিভিন্নভাগে বন্দিদের গুণাগুণ বিবেচনা করে তাদের বিভাজিত ও শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে ইউনিট/ইপিআর, পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী কর্তৃক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র কার্যত সাধারণ বিদ্রোহের দিকে ধাবিত হয়েছে কি না তা বের করা।
(গ) বিদ্রোহের সঙ্গে কোনাে বিদেশি সহযােগিতা আছে কি না তা চিহ্নিত করা ।
(ঘ) ১৯৭১ সালের ১-২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়ে আওয়ামী লীগ কর্তৃক সমান্তরাল সরকারের পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করা ।
(ঙ) পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক-সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত রাষ্ট্রবিরােধী তৎপরতার মাত্রা এবং কারণ উদ্ঘাটন।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানিদের দ্বারা অ-স্থানীয় (নন-লােকাল) এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের প্রতি নির্মমতার বিস্তারিত বিবরণ উদঘাটন।
(ছ) পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত সামরিক ও বেসামরিক পূর্ব পাকিস্তানিদের বিস্তারিতভাবে চিহ্নিতকরণ। অ-স্থানীয় (নন-লােকাল), এবং সেনা| সদস্যদের নিরাপত্তা বিধানের উপায় উদ্ভাবন।
(জ) সন্দেহভাজন/বিদ্রোহী/বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নামধাম জিজ্ঞাসাবাদের সময় বের করে আনা।
আটককৃতদের শ্রেণিবিভাগ
৩। প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে তা বিভক্ত করা হয়েছিল, যথা : কালাে, ধূসর এবং সাদা। প্রতিটি শ্রেণিতে ছিল স্তর । শ্রেণি ও স্তর (গ্রেড) বিভক্তির নীতি ছিল নিম্নরূপ-
(ক) কালাে :
যাবজ্জীবন জেট কালাে (ব্ল্যাক) :
(১) বিদ্রোহী/বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ এবং সেসঙ্গে তাঁদের চিন্তার মদদদাতাগণ; যারা কি না সকল সময়ের জন্য সমাজ ও দেশের সংহতির প্রশ্নে বিপজ্জনক।
(২) জেট কালাে : এরা যাবজ্জীবন জেট কালােদের বিশ্বস্ত অনুসারী। তারা আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত তাদের প্রতি অনুগত থাকে। এরা সকল সময়ের জন্য সমাজ ও দেশের সংহতির প্রশ্নে বিপজ্জনক।
(৩) কালাে : যারা চাকরিতে কালাে তালিকাভুক্ত নয়। কিন্তু তারা শান্তিপূর্ণ সামাজিক জীবনের জন্য বিশ্বস্ত নয়।
(খ) ধূসর :
(১) ডার্ক ধূসর : সেইসব লােক; যারা আবেগতাড়িত হয়ে আন্দোলনে যােগ দিয়েছেন। যারা চাকরি থেকে চ্যুতির জন্য দায়ী। তবে তারা সমাজে নিশ্চয়তা এবং রক্ষাকবচ অর্জনের জন্য সম্ভবত ফিরতে চায়। তাদেরকে কড়া পাহারায় রাখতে হয়।
(২) ধূসর এবং
(৩) হালকা ধূসর/ধূসর সাদাটে : প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য দায়ী। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সমাজে তাদের সেবার প্রয়ােজন রয়েছে। তবে তা হলাে যুদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে। তাদেরকে স্বল্প পরিমাণ পাহারায় রাখতে হবে।
৮৯
(গ) সাদা : যাবতীয় টানাপােড়ন মুক্ত। তারা সমাজের শান্তিপ্রিয় ও মুক্ত সদস্য হিসেবে বিবেচিত।
৪। আটককৃতদের বিভিন্ন শ্রেণি এবং ধারায় (গ্রেডে) বিভক্ত করার প্রধান বিচেনাসমূহ নিম্নরূপ-
(ক) কালাে :
(১) জীবনব্যাপী জেট কালাে;
(ক) আওয়ামী লীগে বেসামরিক এবং সামরিক বুদ্ধিদাতাগণ।
(খ) বিপ্লবীদের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাগণ।
(গ) প্রদেশটিতে যারা বিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
২/ জেট কালাে
(ক) জীবনব্যাপী জেট কালােদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীসাথি এবং অনুসারীগণ।
(খ) বিদ্রোহী নেতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যেকোনাে মূল্যে অনুসারী হওয়া।
(গ) বিদ্রোহের পরিকল্পনার ও তা সংঘটিত করার সঙ্গে সংযুক্ততা।
(ঘ) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া, গুলি করা এবং সেনাসদস্যদের হত্যা করা।
(ঙ) বিদেশি বাহিনী/বহির্দেশ/ বা বিদেশের চরদের নিকট খবরবার্তা সরবরাহ করা।
(চ) বিদেশি বাহিনী/বাহির্দেশ থেকে কোনাে প্রকার বস্তুগত সামগ্রী গ্রহণ করা।
(ছ) উধ্বর্তন কোনাে কর্মকর্তা অধিনস্ত কর্তৃক হত্যা হওয়া এবং সেই হত্যাকারী।
(জ) পাকিস্তান-রাষ্ট্রের এবং সেনাবাহিনী ও সংহতির প্রতি অনুগত কারও বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজ করা।
৩। কালাে
(ক) সেনাবাহিনী অথবা সরকারের কোনাে সম্পত্তির বিনাশকারী ।
(খ) অ-স্থানীয় কাউকে হত্যা/খুন করা।
(গ) আত্মঘাতী তৎপরতা, লুটতরাজ, ধর্ষণ, হত্যা, রাহাজানি ও জঘন্য এবং গর্হিত অপরাধমূলক কার্যকলাপসম্পন্নকারী।
(ঘ) যেকোনাে উপায়ে জেনেশুনে অথবা ইচ্ছাপূর্বকভাবে বিদ্রোহীদের সমর্থনদানকারী।
(খ) ধূসর
১) ডার্ক ধূসর
(ক) স্বেচ্ছাকৃতভাবে সরকারি সেনাবাহিনীর চলাচলের ওপর বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করা।
(খ) এমন কোনাে কাজে লিপ্ত থাকা; যার দ্বারা সেনাবাহিনী অথবা সরকারি কাজে | নিয়ােজিতদের প্রতি নির্মমতা এবং দোষারােপের মতাে ঘটনা ঘটে থাকে।
(গ) সেই সব ব্যক্তি যারা আওয়ামী লীগের অসহযােগ আন্দোলনে সমর্থন জানায়।
(ঘ) তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিরাপত্তা সুরক্ষা করে নাই এমন ব্যক্তি।
(ঙ) অ-স্থানীয়দের হত্যার অপরাধে অপরাধী।
(২) ধূসর।
(ক) বিদ্রোহীদের অবস্থান সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সরকারের কাছে তা গােপন রাখা।
(খ) অন্য কাউকে বিদ্রোহী হতে প্ররােচিত করা/কাজ করা থেকে বিরত থাকা/বিচ্ছিন্নবাদী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া/বিদ্রোহী আন্দোলনে যুক্ত থাকা।
৯০
(গ) প্রতিরােধ আন্দোলনকারী এবং বিদ্রোহীদের সমাবেশে উপস্থিত ছিল এমন কেউ।
(ঘ) তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে রক্ষা করার বেলায় ব্যর্থতা।
(ঙ) সেনাবাহিনীর জন্য এবং সরকারি অফিস/এজেন্সির খাতিরে কাজের সুযােগ
সৃষ্টিতে ব্যর্থতা।
(চ) অস্ত্রসহ কর্তব্যকাজ থেকে পালানাে।
৩। হালকা ধূসর/ধূসর সাদাটে
(ক) স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে; কিন্তু কালাে’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোনাে প্রকার দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত নয়।
(খ) বাধ্য হয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
(গ) লুটপাটে অংশ নিয়েছে; কিন্তু সংঘটিত বিদ্রোহের অংশীদার হিসেবে নয়।
(ঘ) কর্তব্যকাজে অনুপস্থিতি।
(ঙ) সামরিক অঞ্চল ‘খ’ তে সরকারের ঘােষণার পরও কর্তব্যকাজে যােগদানে ব্যর্থতা।
(চ) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা ঘােষিত ও পরিচালিত অসহযােগ আন্দোলনে অনিচ্ছাকৃতভাবে অংশগ্রহণ বা সহযােগিতা করা।
(ছ) অস্ত্র ছাড়া কর্তব্যকাজ থেকে পালানাে।
(জ) উত্তম আদেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এমন কাজ করা। এবং গণ নিরাপত্তা সামান্য বিঘ্নিত করা।
(ঝ) সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় ব্যর্থতা।
(গ) সাদা।
(১) রাষ্ট্রবিরােধী কিংবা কোনাে প্রকার বৈপ্লবিক তৎপরতার সঙ্গে সংযুক্ত নয়।
(২) যেসকল ব্যক্তি ছুটিতে থাকলেও বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে কর্মস্থলে আসতে পারেননি।
(৩) বিপ্লবী অথবা সমাজবিরােধীদের দ্বারা বাধ্য হয়ে আইনভঙ্গমূলক কিংবা অবৈধ কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেছেন।
(৪) সেনাবাহিনীর চলাচলের রাস্তায় বিদ্রোহী অথবা সমাজ বিরােধীদের দ্বারা বাধ্য হয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন।
(৫) বিদ্রোহী/সমাজ বা রাষ্ট্রবিরােধীদের দ্বারা বাধ্য হয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেছেন।
(৬) বিদ্রোহী/সমাজ/রাষ্ট্রবিরােধীদের দ্বারা বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক চাহিদা ও সুযােগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন।
(৭) দর্শক হিসেবে অ-আইনানুগ সমাবেশে উপস্থিত থেকেছেন।
(৮) অনিচ্ছাকৃতভাবে অথবা অজ্ঞতাবসত সান্ধ্য আইনের বাধ্যবাধকতা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ
৫। এফআইসি-এর/এফআইটি-এর বেলায় স্তরবিন্যাস (গ্রেডিং) নির্ণয়কারী কর্তৃপক্ষ নিম্নরূপ(ক) সাদা : কমান্ডার আইএসএসসি
(খ) ধূসর
(১) সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য : কমান্ডার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (ইস্টান কমান্ড)।
৯১
(২) বেসামরিক নাগরিকগণ : মেজর জেনারেল বেসামরিক বিষয়সংক্রান্ত (হেড| কোয়ার্টার এমএলএ অঞ্চল ‘খ’ ।) ১ অক্টোবর, ১৯৭১ সাল, প্রেসিডেন্টের পক্ষ হতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ক্ষমা অনুমােদনের কর্তৃপক্ষ হলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর।
(গ) কালাে
১। বেসামরিক ব্যক্তিদের জন্য : পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, তবে অন্য যেকেউ যিনি গভর্নর কর্তৃক মনােনীত হবেন।
(২) সশস্ত্র বাহিনীর ব্যক্তিদের জন্য : জিএইচকিউ
৩। কমিটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই বিস্তারিত বিবরণের পরেও আমরা অতৃপ্ত থেকেছি। এবং এর দ্বারা আকৃষ্ট বােধ করিনি যে, এটি পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে সেভাবে যেভাবে বলা হয়েছে। বাস্তবিকভাবে তাঁর অপসারণ সম্পর্কে তিনি একটি হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দেন। নিমলিখিত বর্ণনা দিক নির্দেশক“আইনগত পরামর্শক : আপনি আপনার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, আত্মসমর্পণ এবং সাধারণ ক্ষমা বাদেও তারা পরিমাপিত হয়েছিলেন (ক্রিড)। সাধারণ ক্ষমার লক্ষ্যটি বিস্বাদগ্রস্ত বলে প্রতীয়মান হয়। যেসব মানুষ একবার যখন আত্মসমর্পণ করেন তাদের আর পুনরায় পরিশােধিত করার প্রয়ােজন পড়ে না। এটি করা হলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সাক্ষী : কী কারণে সাধারণ ক্ষমা ফলপ্রসূ হয়নি এ বিষয়টি আমি ইতােমধ্যে বলেছি।
সদস্য-১: এটি অন্যতম একটি কারণ। কিন্তু তাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে পরিমাপিত (স্ক্রিনড) করার প্রয়ােজন পড়েছিল।
সাক্ষী : তাঁদের পরিমাপিত করার প্রয়ােজন ছিল। কেননা, সেখানে এমন লােকও ছিল যাদের পুনর্বাসিত করার মতাে অবস্থা ছিল না। পরিচ্ছন্ন করার কাজটি বিস্তারিত করা হয়নি। বাস্তবিকভাবে এফআইসি’র কাজ ছিল তাদের পরিচ্ছন্ন করার।”
৪। আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি ছিল বিলম্বিত, হটকারীভাবে জন্ম নেওয়া এবং তা সুসংগঠিত ছিল না। এটি ছিল অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত এবং আগাগােড়া আনাড়ি হাতের দ্বারা বাস্তবায়িত । এ থেকে কোনাে প্রকার ব্যবহারযােগ্য ফলাফল প্রত্যাশা করা উচিত ছিল না। শুরু থেকেই এটি ছিল নিষ্ফল কর্ম বিশেষ।
৯২
৩৮
উপ-নির্বাচন
হতাশাগ্রস্তভাবে অথবা হতাশার ভানপূর্বক যেকোনাে প্রকার সমঝােতার লক্ষ্যে দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তির দ্বারা প্রহসনমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। নির্বাচনের প্রার্থীদের নামের তালিকা নীতিগতভাবে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশনা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল, যারা কি না বিভিন্ন দলের টিকিট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নির্বাচনে কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি । এবং সবচেয়ে উত্তেজনাকর বিষয় হলাে এই যে, প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে কিছু আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
এ ধরনের কর্মকাণ্ডের অন্তঃসারশূন্যতা ছিল সুস্পষ্ট : এটি খুব সামান্যই বােঝাপড়া তথা সমঝােতামুখী ছিল। এটি ছিল সমাধানের পথকে আরও বিচ্ছিন্ন করার মতাে। এটি ছিল প্রকারান্তরে পুনরায় সমানভাবে অ-ফলদায়ক কার্যক্রম। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে কাজটি নির্বাচনমূলক ছিল না। বলা চলে এটি ছিল রাও ফরমান আলী কর্তৃক বাছাইমূলক কার্যক্রম। জনাব মুজাফফর হােসেন বলেন : “বাস্তবতা হলাে পরিশােধনের দৃষ্টিতে উপনির্বাচনের কাজটি সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছিল, এটি জনগণকে বুঝানাের অভিপ্রায় নিয়ে যে, ইয়াহিয়া নির্বাচনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে চান। জেনারেল রাও ফরমান আলীকে এমএনএ এবং এমপিএ নির্বাচনে জন্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য নিয়ােগ দেওয়া হয়।”
২। জেনারেল অস্বীকার করে বলেন যে, জনাব মুজাফ্ফর হােসেন কখনাে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেননি। বরং যা ঘটেছিল সে বিষয়ে তিনি একটি লম্বা-চওড়া বক্তব্য দেন। তাঁর এ ব্যাখ্যা-বক্তব্য পুনরায় তুলে ধরা প্রয়ােজন।
“সাক্ষী : তার উচিত ছিল সেই সময়ে আমার কাছে তাঁর মতে কী হওয়া বা করা দরকার তা জানানাে। সত্যিকার অবস্থা হলাে- আমি সাধারণ নির্বাচনের দিনগুলােতে ফিরে গিয়েছিলাম। এর আগেই আমি পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে নিবিড় যােগাযােগ স্থাপন করি। তারা বলেন এবং দাবি করেন যে, আমার প্রতি তাদের রয়েছে গভীর শ্রদ্ধাবােধ। তারা আমাকে ভালােবাসেন। সেই সাধারণ নির্বাচনে আমি হেরে গিয়েছিলাম। কেননা, আমি তাদের একটি প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হতে রাজি করাতে পারিনি। তাঁদের প্রতি আমার প্রণােদনা খুব শক্তিশালী ছিল না। সেনাবাহিনীর অভিযান গৃহীত হওয়ার পরে, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করতে আমার কোনাে অসুবিধা ছিল না। তারা সবাই আমার পরিচিত ছিলেন। তাদের প্রতি আমার সাধ্যমতাে সাহায্য
৯৩
সহযােগিতার হাত আমি সর্বদা প্রসারিত করে রেখেছিলাম। নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয় করার দরকার ছিল। এজন্য আমি তাদের অন্যান্যদের বলতে ও বুঝাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। যখন নির্বাচন এলাে তখন নিবিড়ভাবে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সেনাবাহিনীর দরকার ছিল। কেননা, তখন আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ছিল খারাপ। সেনাবাহিনীর নিবিড় সমন্বয় ব্যতীত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কাজ করা সম্ভব ছিল না। উপ-নির্বাচন কমিশনার জনাব হাবিবুর রহমান সাধারণভাবে সেখানে কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছিলেন না। সে কারণে ‘পােলিং বুথ’ স্থাপনের জন্য তিনি আমার সাহায্য কামনা করেন। কেননা, স্বাভাবিকভাবে ‘পােলিং বুথ’ তৈরি করা যাচ্ছিল না। সেগুলাে এমন সব স্থানে স্থাপন করতে হচ্ছিল যেন সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত এবং সময়মতাে পৌছতে পারে।”
সদস্য-১: “এটি আপনার কর্মপরিধির মধ্যে ছিল।” সাক্ষী : “এটি একটি দিক। অন্য বা দ্বিতীয় দিক হলাে আমি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলাম নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য। আমি জানতাম যে ধরনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল এবং যে ধরনের মনমানসিকতা ছিল সে অবস্থায় অন্যান্য দলগুলাে জোটবদ্ধ না হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে সম্মুখে চলে আসার সম্ভাবনা ছিল। আমরা কোনাে একজন প্রার্থীকেও তার প্রার্থিতা থেকে বিরত করিনি। সে কারণেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেষ্টা করতে পেরেছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থী বা অন্যদেরকেও বিরত করতে চাওয়া হয়নি।
প্রেসিডেন্ট : “এটি কী সত্য যে, আপনি চেয়েছিলেন আপনার প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেরিয়ে আসুক।”
সাক্ষী : “যেসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন ছিল যে, নির্বাচন করা সম্ভব ছিল না; সেসকল এলাকা আসলে মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেসব এলাকা ছিল উত্তরে ও দক্ষিণে বরিশালের কিছু এলাকা এবং সিলেটের কিছু অঞ্চল। পুনরায় স্যার, কী করতে হবে সে বিষয়ে এটি ছিল একটি প্রস্তাব বিশেষ । রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিদিন মিলিত হতেন; যাতে করে তাদের মধ্যকার প্রভেদসমূহ মিটানাে যায়। সেখানে আমি তাঁদের বলতাম না যে কী করতে হবে বা হবে না। আমি নাক গলাতাম সে কথাটি সঠিক নয়। আমি তাদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম। এবং আমি তা অস্বীকার করব না, … যদি তাঁরা এককভাবে সাধারণ নির্বাচনে লড়তে চান যেভাবে তারা লড়েছিলেন; তা হলে তারা স্বতন্ত্র সদস্যদের দ্বারা পরাভূত হবেন। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ; সেখানে আপনাদের রাজি হওয়া উচিত হবে একক প্রার্থী দাঁড় করানাের বিষয়ে।”
৯৪
সদস্য-১: “কিন্তু আপনি ব্যক্তিগত প্রার্থীদের মনােনয়ন দিয়েছিলেন। আপনি প্রধান সচিবের মনােভাব সম্পর্কে শুনেছিলেন। আমরা আপনাকে জানাতে পারি যে, এমএলএ এবং এসএমএ ও বেসামরিক কর্মকর্তারাও একই রকমের বক্তব্য দিয়েছিলেন। হয়তাে এ ধরনের প্রণােদনামূলক আলাপ-আলােচনার ক্ষেত্রে আপনার সেখানে কোনাে প্রকার স্বাধীনতা ছিল না। তারপরও এটি প্রতীয়মান হয়েছিল যে, প্রার্থীগণ ছিলেন আপনার দ্বারা পছন্দকৃত।”
সাক্ষী : “এটি সত্য নয় স্যার।”
সদস্য-১: “একজন এসপি’র নিকট থেকে জানা যায় যে, আপনার নিকট তাঁদের পাঠানাে হয়েছিল।”
সাক্ষী : এটি চূড়ান্তভাবে অসত্য। যদি আমার সামনে এসে সেই এসপি এ কথা বলতে পারেন তাহলে আমাকে যেকোনাে শাস্তি দিতে পারেন।
সদস্য-১ : “প্রকৃতপক্ষে কী করা হয়েছিল।”
সাক্ষী : “আমি সকল দলকে একত্রিত করেছিলাম। কিছুসংখ্যক সদস্যের বিষয়ে দলগুলাে একমতে এসেছিল। এভাবে আমি তাদের সাহায্য করেছিলাম। উদাহরণস্বরূপ, বিগত নির্বাচন নিয়ে আমি একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছিলাম। তা ছিল দলভিত্তিক ভােট প্রাপ্তির শতকরা হিসাব সম্পর্কিত। এমনই ছিল অবস্থা। বিগত নির্বাচনে দলভিত্তিক অবস্থান ও প্রাপ্ত উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল জামাতে ইসলামী। এ দলের প্রাপ্ত ভােটের শতকরা পরিমাণ ছিল ১৫ ভাগ। আমি অস্বীকার করছি না যে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। এবং সেসময় তারা বলেছিলেন, আমার প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধাবােধ রয়েছে। তবে আমি জানতাম না যে সত্যিই তা ছিল কি না।”
প্রেসিডেন্ট : “তাহলে বিষয়টি এভাবে দেখা যায়- আপনি যেভাবে সিদ্ধান্ত দিতেন তারা সেভাবেই তা গ্রহণ করতেন।”
সাক্ষী : “স্যার, এভাবে যে কেউ বলতে পারেন, তবে সিদ্ধান্ত ছিল তাদের।”
প্রেসিডেন্ট : “তাহলে বলা যায় আপনি ছিলেন সত্যিকারভাবে একজন কিং মেকার?”
সাক্ষী : “না সত্যিকারভাবে তা নয়। সততার সঙ্গে বলতে হয়, স্যার, একজনের অবস্থান পরিষ্কার করা খুবই কঠিন। আমি সততার সঙ্গে আপনাকে বলছি, আমি কারও ওপর জবরদস্তি করিনি।
প্রেসিডেন্ট : “যা আমরা জানতে চাই তা হলাে, আপনি এবং প্রেসিডেন্ট যে ধরনের রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন তা কি বাস্তবে কার্যক্ষমতাসম্মত ছিল। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানকার সমস্ত মানুষ, যাদেরকে আপনি টেনে এনেছিলেন, নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। এখন আপনি তাদের পুনরুৎসাহিত করছেন জেগে ওঠার জন্য। ভােটারদের সামনে তা গুছিয়ে দিচ্ছেন। তারা কি নির্বাচনে জয়ী হবেন?”
সাক্ষী : “স্যার, এই বিষয়টি আমি আগেই উত্থাপন করেছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সকল রাজনৈতিক দলই এই সমাধানে রাজি হয়েছিল।
৯৫
৩। আমাদের নিকট পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, যেভাবে দেখা হােক না কেন সে নির্বাচন ছিল তামাশার নির্বাচন। প্রত্যাশার বিষয় হলাে ফলপ্রসূ কোনাে কিছু জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। যারা এই ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে কৃতকার্য হয়ে বেরিয়ে আসবেন, তারা বিষয়টি বালকসুলভ দাতব্য কর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন। আমরা শােকাহত। কেননা, আমরা দাতব্যসুলভ কর্ম হিসেবে বিষয়টি দেখতে সম্পূর্ণভাবে অপারগ ছিলাম। জেনারেল ইয়াহিয়া। ইতােমধ্যে ঘােষণা দিয়েছিলেন যে, তাঁর কাছে রয়েছে একটি খসড়া সংবিধান। সুতরাং, যারাই নির্বাচিত হয়ে আসবেন সেসব সদস্য শুধুমাত্র আইন সভার সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করার জন্য নয়। আমরা জানতাম, সত্যিকারভাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া একটি সংবিধান প্রস্তুত করেছিলেন। তা মুদ্রণের জন্য ছাপাখানায় প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু পুনরায় সংশােধনের জন্য একেবারে শেষ মিনিটে তা ফিরিয়ে আনা হয়। এসব বিষয়ে। আমরা মূল প্রতিবেদনের অংশ II-এর অধ্যায় VII-তে বিস্তারিত মন্তব্য প্রদান করেছি। বিশেষত, অনুচ্ছেদ ১০-১৫, পৃষ্ঠা ১২৬-১২৮ পর্যন্ত। সে কারণে উপনির্বাচন নিয়ে কথা বলা অপ্রয়ােজনীয়। তার চেয়ে বরং আমাদের উপসংহার পুনরায় পাকাপােক্ত করা উত্তম। আর তা হলাে রাজনৈতিক পথে সমাধানের জন্য তেমন। কোনাে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
৯৬
অংশ-III
সামরিক দিকসমূহ
৩৯
সূচনা
১। ১৯৭২ সালে আমাদের দ্বারা প্রদত্ত প্রতিবেদন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়ে সামরিক দিক থেকে ছিল সীমিত এবং সামগ্রিক। তবে তা ছিল সেসঙ্গে অপ্রমাণিত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে অপমানজনক আত্মসমর্পণের পরে এ ঘটনায় তাদের দুঃখজনকভাবে যুদ্ধবন্দি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই এ বিষয়ের মূল কারকদের সম্পর্কে আমাদের নিকট খুব সামান্যই সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল ।
২। তথাপিও সেখানে একটি ফলপ্রসূ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কিত অখ্যানটির পুনর্গঠনের গুরুত্ব প্রতিভাত হয়েছিল । এটি সম্পন্ন করা হয় যতদূর সম্ভব সেই সব তথ্য ও মালমসলার ভিত্তিতে যা সংগ্রহ করা গিয়েছিল সদর দপ্তর এবং তাদের নিকট থেকে যারা আত্মসমপর্ণের তাৎক্ষণিক আগেই চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে চলে আসতে পেরেছিলেন। সেই মালমসলাগুলাে অপর্যাপ্ত ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে কেননা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌছা মুস্কিল। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির ক্ষেত্রে। সে কারণে, ওই সময়ের উপসংহার ছিল মূলত পরীক্ষামূলক এবং ক্ষণস্থায়ী চরিত্রের; এজন্য সেখানে বলা হয়েছিল প্রয়ােজনবােধে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ফিরে আসার পরে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে উল্লিখিত প্রতিবেদন সংশােধন করা হবে। এখন আমাদের সেই সুযােগ এসেছে। সেজন্য আমরা ৫৮ জনের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পেরেছি। লে. জেনারেল (অব.) আলতাফ কাদির, (আমাদের সামরিক উপদেষ্টা), তিন বাহিনীর প্রতিনিধিগণ, ব্রিগে. সাবির হােসাইন কোরেশী, ক্যাপ্টেন হামিদ রব, পিএন, গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল হামিদ কোরেশী, পিএএফ এবং কর্নেল এম. হাসান, (আমাদের আইন উপদেষ্টা) এর সাহায্য নিয়ে। সামরিক উপদেষ্টা এবং বাহিনী প্রধানগণ তাদের পেশাদারিত্ব দিয়ে চমৎকার অনুসন্ধানও উপহার দিয়েছেন। এটি আমাদের সম্পূরক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খণ্ড ।
৩। আমাদের মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্পূরক প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে আমরা দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠভাবে লেগে ছিলাম সেই রীতি বা ধারার প্রতি যা প্রয়ােগ করা হয়েছিল প্রাপ্ত তথ্য নির্ভরতার ভিত্তিতে প্রয়ােজন অনুযায়ী তাতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্যাদি পাওয়া গিয়েছিল।
৯৭
৪। কোনাে আলােচনায় যাবার আগে যে বিষয়টি আমাদের মূল প্রতিবেদনের প্রথম অধ্যায়ের ৩নং প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে তা আমরা দেখতে চাই। যথাযথ প্রেক্ষাপটে লে. জেনারেল এ, এ, কে নিয়াজীর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ও যথার্থ অবস্থানগত বর্ণনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার । তাঁর এই আনুষ্ঠানিক মর্যাদা একটি সাধারণ ধারণাকে তুলে ধরে যে “পূর্বাঞ্চলীয় (ইস্টার্ন কমান্ড) ছিল যুদ্ধের থিয়েটার, নিখাত সামরিক চেতনায়। এবং সেজন্য কমান্ডার ছিলেন থিয়েটার কমান্ডার।” জেনারেল নিজেই জোরের সঙ্গে অস্বীকার করেন যে, তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থিয়েটার কমান্ডার এর মর্যাদায় ছিলেন না, অথবা সেই থিয়েটারের ক্ষমতাধর কায়েমী স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কমান্ডারের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না। তাঁর নিজের অবস্থান তিনি নিম্নলিখিতভাবে মূল্যায়ন করেন-
“পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কর্পস্ কমান্ডার হিসেবে আমি সকল বাহিনীর কমান্ডার। পূর্ব পাকিস্তানে এটিকে জিওসি বলা হতাে। সেনাবাহনীর সকল সদস্য এবং সিভিল-স্বশস্ত্র বাহিনী আমার অধীনে ছিল। আমি যাবতীয় অভিযানের/অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম। বাহিনীকে কমান্ড দেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণ করার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত ছিল। সামরিক আইন এবং কখনাে বেসামরিক প্রশাসন বিষয়ে আমার কিছু করার ছিল না …। ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ হতে পরবর্তী সময়ে আমিও সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পাই। তখনও বেসামরিক প্রশাসনের বিষয়ে আমার কিছু করার ছিল না। সে কাজের জন্য ছিলেন গভর্নর, তার মন্ত্রিপরিষদ এবং মন্ত্রীগণ। ছিল সমগ্র বেসামরিক সরকার” (পৃষ্ঠা ১/২)।
৬। এমনকি হেডকোয়ার্টার থেকে বহু দূরবর্তী এলাকায় দায়িত্বরত থেকে তিনি যা করেছেন সেগুলােও তিনি অস্বীকার করেন। যেমন একজন সাধারণ কর্পস্ কমান্ডারের চাইতে তিনি অধিক পরিমাণ স্বাধীনতা ও নমনীয়তা ভােগ করতেন। তাঁর মতানুসারে, “তিনি ছিলেন অন্যান্য কর্পস্ কমান্ডারদের সমতুল্য।” কারণ, “তিনিও অন্যান্যদের মতাে একজন কমান্ডার ইন চীফ্রে আওতায় কাজ করতেন। তিনি বলেন, “আমিও পাকিস্তানের জন্যই যুদ্ধ করেছিলাম। যদিও কিছুটা দূরে থেকে। আমাদের যােগাযােগ ছিল উত্তম ব্যবস্থাসম্পন্ন। তাঁরা আমার সঙ্গে অতি অল্প সময়ের মধ্যে কথা বলতে পারতেন। এমনকি সিন্ধুতে অবস্থিত কারও সঙ্গে যােগাযােগের চাইতেও আমার সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপিত হতাে দ্রুত।”
৭। পরবর্তী সময়ে যখন সুনির্দিষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আপনার সম্পৃক্ততায় অক্ষাংশের (ল্যাটিচিউড) প্রকৃতি ও তার পরিমাপের দিক কেমন ছিল । তিনি তখন এক অদ্ভুত উত্তর দেন, যা নিম্নরূপ-
“জ্যেষ্ঠ কমান্ডার যে কাজ দেন তাকে ‘মিশন’ বলা হয়। তিনি সেজন্য তাকে প্রয়ােজনীয় সম্পদও দেন। তারপর তিনি দায়িত্বের বর্গ সরবরাহ করেন। যে সম্পদ এবং কার্যভার আপনার ঘাড়ে দেওয়া হয়, তা মনে রেখে সর্বময়
৯৮
অক্ষাংশ (ল্যাটিচিউড) পাওয়া যায়। সেই মিশনের আওতার সকল কর্পস্ কমান্ডা; সকল ডিভিশনাল কমান্ডারস্ তাদের অক্ষাংশ পেয়ে যান। অর্পিত কাজগুলাে যথাযথভাবে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে কি না, জ্যেষ্ঠ কমান্ডার তা দেখভাল করে থাকেন। যদি কাজগুলাে যথাযথভাবে এগিয়ে না নেওয়া হয় তাহলে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়, অথবা কার্জকর্ম নিজ হাতে তুলে নেওয়া হয়।”
৮। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলতে বুঝায় সি-ইন-সি, যিনি সংশ্লিষ্ট সময়ে ছিলেন প্রেসিডেন্ট। সে কারণে সে সময়ে তার ওপর যৌথভাবে রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্ব কেন্দ্রীভূত ছিল। এই প্রক্রিয়াটি কার্যত রাজনৈতিক মিশন এবং সামরিক দায়দায়িত্বের ভিতরকার তফাত ঘুচিয়ে দেয়। কিন্তু এই ধারণাটি অব্যাহত আছে। এবং যৌক্তিকভাবে নিম্ন পর্যায়ের কমান্ডারদের মধ্যে দায়িত্বের মাত্রার ভিন্নতাও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলাে; সে সময়ের ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষপটে পূর্ব পাকিস্তান কি যুদ্ধের মঞ্চ এবং সেসঙ্গে সেখানকার কমান্ডার কি সেনাবাহিনীর সামগ্রিক “থিয়েটার কমান্ডার হওয়াটাই বাস্তবসম্মত ছিল না? মৌলিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত সেনাবাহিনী ছিল সাধারণ কমান্ডিং এর পর্যায়ে। কিন্তু ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে ইস্টার্ন কমান্ডকে একটি কর্পস্ কমান্ডের অধীনে আনা হয়। যদিও সেই কর্পস্-এর অধীনস্ত বাহনী এখন একটি ডিভিশনের মর্যাদাসম্পন্ন। সেই কর্পটিকে তিনটি কর্পস্-এর মর্যাদাসম্পন্ন করে লে. জেনারেল এস, এম, ইয়াকুবের কমান্ডে আনা হয়। সি-ইন-সি কর্তৃক একটি নির্দেশে ১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর উক্ত তিনটি কর্পকে ইস্টার্ন কমান্ডও বলা হয়।
১০। এই বিষয়টি নিয়াজী কর্তৃক প্রদত্ত যুক্তিকে সমর্থন দেয় যে, তিনি ছিলেন কেবলমাত্র কৰ্প কমান্ডার। এবং যথার্থ অর্থে থিয়েটার কমান্ডার ছিলেন না। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হলাে, যেখানে কর্পস কমান্ডার হলেন কেবলমাত্র। কিছু সংখ্যক ডিভিশনের কমান্ডার, সেখানে থিয়েটার কমান্ডার’ শুধুমাত্র বাহিনীর কমান্ডারই নন; সেসঙ্গে তিনি তিন বাহিনীর যথা : নৌ, বিমান এবং পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার। জেনারেল নিয়াজীর বেলায় তেমনটি ছিল না। রিয়াল অ্যাডমিরাল শরীফ, ফ্লাগ কমান্ডিং অফিসার পূর্ব পাকিস্তান, বিমান বাহিনীর কমডাের এনামুল হক, পূর্ব পাকিস্তানে এয়ার অফিসার কমান্ডিং বলেছেন যে, তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জেনারেল নিয়াজীর নিকট কখনাে স্থাপিত হননি। বরং তারা। তাঁদের সংশ্লিষ্ট কমান্ডার ইন চীফ্রে কাছে দায়ী ছিলেন। তাঁদেরকে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সম্ভাব্য সকলভাবে সমন্বিত হতে বলা হয়েছিল। কেননা তারা হেডকোয়ার্টার থেকে বহু দূরত্বে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ছিলেন। বাস্তব কার্যক্ষেত্রে যদিও তারা তাই করতেন; সচরাচর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার অথবা নিয়াজী। অনুরােধসহ যা প্রত্যাশা করতেন। পূর্ব পাকিস্তানের এফ ও সি তাঁর নিজের উৎকণ্ঠার কারণে সহযােগিতা করতেন। যার অর্থ এই নয় যে, সেখানে কোনাে প্রকার বাধ্যবাধকতা ছিল।
৯৯
১১। এমনকি ইস্টার্ন কমান্ডের প্রতি ১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে নির্দেশনামূলক ইস্যু জারি করার পরও দেখা যায়, “৩টি কর্পস্-এর কমান্ডারের দায়িত্বে সামগ্রিক অপারেশনের পরিকল্পনাকে সমন্বয় করার ভার প্রদান করা হয়। কিন্তু রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ বিষয়টি দেখিয়েছেন ঢাকায় ন্যাভাল হেডকোয়ার্টার ফ্ল্যাগ কমান্ডের স্থাপনের পূর্বে সেখানে তা একজন ফ্লাগ কর্মকর্তার অধীনে ছিল।
১২। ১৯৭১ সালের অবস্থান বিবেচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ফ্লাগ অফিসার এবং বিমানবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার প্রত্যক্ষভাবে তাদের নিজ নিজ কমান্ডার ইন চীফ্রের আওতায় ছিলেন। যদিও তাদেরকে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের সঙ্গে লিয়াজো এবং সমন্বয়পূর্বক কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
১৩। সে কারণে যেমনটি জেনারেল নিয়াজী যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যদিও সেনা সদর থেকে দূরত্ব ৩,০০০ হাজার মাইলে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া ভারতের মাটিতে বিমান নামার অধিকার বন্ধ ঘােষণায় বিমান পথও দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল, তারপরও তার সঙ্গে গুপ্ত এবং প্রকাশ্য যােগাযােগ ব্যবস্থা যথারীতি উত্তমভাবেই চালু ছিল এমনকি শেষ অবধি পর্যন্ত ।
১৪। যান্ত্রিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, জেনারেল নিয়াজী যে কখনাে থিয়েটার কমান্ডার ছিলেন না এ বিষয়টি পরিষ্কার করার অভিপ্রায় নিয়ে তিনি নিজে উপস্থিত হয়েছিলেন । তথাপিও তিনি যে অবস্থার মধ্যে ছিলেন; সে অবস্থায় আমরা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই অভিমত পােষণ করি যে, নিদেনপক্ষে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী সময়ে সকল উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় নিয়ে তিনি সময়ের প্রয়ােজনে এবং পরিস্থিতির প্রকোপে বাধ্য হয়ে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন একজন ক্ষমতাধর থিয়েটার কমান্ডারের মতাে। এমনকি উচ্চ মার্গের হাই কমান্ড তাঁর কাছ থেকে তেমনটিই আশা করেছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁকে প্রতিস্থাপন করার কোনাে প্রকার ইচ্ছা উচ্চ মার্গের হাই কমান্ডের ছিল না।
১৫। এ সম্পর্কে, এটি স্মরণযােগ্য যে, জেনারেল নিয়াজী, তার নিজের কথায়; অপরাপর ১১ বা ১২ জন সমমানের জেনারেলের ভিতর থেকে উক্ত দায়িত্বের জন্য তিনি বাছাই হয়েছিলেন যারা তার চেয়ে বাস্তবে জ্যেষ্ঠ ছিলেন, যদিও চাকরির দিক থেকে নয় । পূর্ব পাকিস্তানের যাবতীয় অবস্থা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেই সে সময়ে তাঁকে সেখানে দায়িত্ব পালনের জন্য বাছাই করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ভারত পরােক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছিল। তবে শীঘ্রই তা প্রত্যক্ষ সমর্থনে রূপ নেয় এবং তা কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এভাবে আমাদের ভূখণ্ডের ওপর ভারতের আগ্রাসন, যথাসময়ে প্রকাশমান হয়ে ওঠে। অপারেশনাল নির্দেশ নং ৩, ১৯৭১, যা জেনা. নিয়াজী কর্তৃক ১৯৭১ এর জুলাই মাসে দেওয়া হয়েছিল, তাতে খুবই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, ইস্টার্ন কমান্ড প্রয়ােজনবােধে স্বাধীন অবস্থানে থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। এটি গ্রহণ করা মুস্কিল লে. জেনারেল নিয়াজী কীভাবে এ কথা এখন প্রতিষ্ঠিত করতে চান যে, তিনি ছিলেন জিএইচকিউ-এর নির্দেশের অধীনে কেবলমাত্র
১০০
একজন কর্পস কমান্ডার এবং সেহেতু স্বাধীন অবস্থানে থেকে যুদ্ধ বিষয়ে নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কোনাে প্রকার ক্ষমতা ও দায়িত্ব তার ছিল না। সেজন্য, আমরা এরূপ মনােভাব প্রকাশ করি যে, জেনারেল নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে থিয়েটার কমান্ডার পদমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়; যুদ্ধের চূড়ান্ত স্তরে এসে তিনি যুদ্ধের ওপর স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। এবং যুদ্ধের সকল নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়ােজনবােধে একজন স্বাধীন কমান্ডারের ভূমিকায় ছিলেন। থিয়েটার কমান্ডার এবং একজন স্বাধীন কর্পস কমান্ডারের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি দূরত্বে অবস্থান করে না। বলা চলে থিয়েটারের বিষয়টি এখানে কেবলমাত্র যান্ত্রিক অর্থে’ পার্থক্যের মতাে। থিয়েটার কমান্ডার কথাটির মানে হলাে প্রতিষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর ওপর প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব থাকা। পূর্ব পাকিস্তানে তখন যে অবস্থা বিরাজ করছিল; সে অবস্থায় এটি ধর্তব্যের মতাে। কোনাে বিষয়ই ছিল না।
১৬। এমতাবস্থার আলােকে আমরা এটি বিবেচনা করার জন্য প্রস্তাব করছি যে, তাঁর যুদ্ধসংক্রান্ত কার্যকলাপের মধ্যে তিনি আত্মসমর্পণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
১০১
৪০
জাতীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত সামরিক ধারণা
১। আমারা আমাদের মূল প্রতিবেদনে এ বিষয়টি নিয়ে ইতােমধ্যে কিছুটা আলােচনা করেছি এবং তা উল্লেখ করেছি। আমরা জানিয়েছি, যদিও ১৯৬৭ সালের ৯ আগস্ট যুদ্ধ নির্দেশনা নং ৪-এ ইস্যুকৃত বিষয়টি ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ব্যর্থভাবে বদলানাে হয়েছিল। বিশেষত, ভারত-সােভিয়েট পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি এবং আঞ্চলিক লােকজনের বিচ্ছিন্নতার কারণে ও সেনাবাহিনী কর্তৃক সেসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিদ্রোহীদের নিরবিচ্ছিন্ন অভিযান পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে বদলিয়ে দিয়েছিল। তারপরও সেই সংশােধনী কার্যক্রম থেকে ফলদায়ক কোনাে কিছুই অর্জন করা যায়নি, সেই ধারণা থেকে যেখানে বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর।” এই ধরণাটি আগের মতােই মনে ও প্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এবং তা আমাদের সকল স্তরের সামরিক কমান্ডারদের মনে অনুভূত হতে থাকে।
২। আমরা উল্লেখ করেছি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ নির্দেশনা নং ৪-এর বিষয়ে একটি জোরালাে সংশােধনী আনা নতুন সামরিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতে প্রয়ােজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু সে বিষয়ে কিছুই করা হয়নি। যদিও সাধারণ সেনাসদর থেকে এবং নৌবাহিনীর সদরদপ্তর হতে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে কিছু নির্দেশনা পুনঃপরীক্ষা করার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছিল।
৩। অবশ্য লেফ, জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, আবেগ তাড়িত হয়ে অনুভব করেছিলেন, সনাতনী ধারায় চালিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল’ এমন ধারণা এখন চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হয়েছে । কেননা, শত্রুপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের এলাকা ঘিরে ৮ ডিভিশন সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল। তাছাড়া তাদের আরও ৩ অথবা ৪ ডিভিশন সৈন্য ডাকের জন্য অপেক্ষমান থাকে। তার ধারণায় শত্রুপক্ষ “পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। কেননা, তাদের সেরকম সৈন্যশক্তি নেই। সেখানে ছিল সংখ্যার সমতা। পশ্চিম রণাঙ্গনে এবং সেই কারণে আমাদের বিশ্বাস করানাে হবে যে, তিনি জেএইচকিউ-এর মানুষজনের কাছে অনুরােধ করেছিলেন-
“অনুগ্রহ করে যুদ্ধারম্ভ করবেন না। ভারত আপনাদের আক্রমণ করতে যাবে না। সে কখনাে উন্মুক্ত যুদ্ধের পথে হাঁটবে না।” তিনি বলেন এই অনুরােধ তিনি তাঁর চীফ অব স্টাফ জেনারেল জামশেদ এর মাধ্যমে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর তারিখে, যখন তিনি জিএইচকিউ সফর করতে গিয়েছিলেন। তিনি লিখিতভাবেও পুনঃবার জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত সে ধরনের কোনাে লেখা
১০২
পাওয়া যায়নি। জেনারেল জামশেদও তাঁর এ বক্তব্যের জোর সমর্থন জানাননি। তাঁর সাক্ষ্যে তিনি এমন কিছু বলেননি যার দ্বারা ওই অনুরােধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
৪। ১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর যে মিশন নির্দেশ আকারে প্রদান করা হয় লে. জেনারেল নিয়াজী তার সূত্র ধরে বলেন যে, উক্ত নির্দেশ সময়ে সময়ে মৌখিকভাবে পরিবর্তন করা হয় সঙ্কেতের দ্বারা বা অন্য কোনােভাবে। বাস্তবে, তিনি যা করতে চেয়েছিলেন তা হলাে সামগ্রিকভাবে নির্দেশনামা নতুন কাজে এবং দায়িত্বের ক্ষেত্রে তাঁকে নতুনভাবে প্রচুর বাহুল্য কাজের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। এবং তার নিরিখে বাহিনীর সংখ্যা পরিবর্তন করা হয়। যার দরুন নির্দেশনাগুলাে প্রয়ােগ করা হয়নি।”
৫। তার ধারণা অনুযায়ী মিশন এবং কমান্ডারের কাজ সম্পর্কে আমাদের আরও কিছু বলবার রয়েছে। ইস্টার্ন কমান্ড সম্পর্কে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বলব। তবে এখানে এটি উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, জেনারেল পর্যাপ্ত আগ্রহের সাথে ১৯৬৯ সালের নির্দেশগুলাে পাঠ করার মতাে যন্ত্রণা নেননি। কারণ, তাঁর মতে সেগুলাে ছিল- “তারিখ উত্তীর্ণ বিষয়”। যখন নির্দেশনার একটি কপি তাঁকে দেখানাে হলাে; তখন তিনি সেটি গ্রহণ বা তাকিয়ে দেখতেও অস্বীকার করেন। সে অবস্থায় কিছু নির্দেশনামা তার সম্মুখে পড়ে শােনানাে হয়। পরিশেষে তিনি স্বীকার করেন যে, এসব নির্দেশনামা মােটেও বাহুল্য ছিল না।
৬। এ পর্যায়ে আমরা শুধুমাত্র উল্লেখ করার জন্যই বলছি যে, লে. জেনারেল নিয়াজী, তাঁর ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের মতাে শত্রুপক্ষের শক্তির জাগরণ সম্পর্কে সত্যিকার ধারণা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অথচ ইস্টার্ন থিয়েটারের ক্ষেত্রে তা দ্রুত বর্ধিষ্ণু হয়ে উঠছিল। সেসঙ্গে তিনি নিজেকে একটি বিভ্রান্তির ঘােরে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন, যেখানে ছিল মিথ্যা আশা যে, “ভারত কখনাে উন্মুক্ত যুদ্ধে নামবে না।” “তারা আঘঘাষিত যুদ্ধের বিষয়টি এগিয়ে নিতে থাকবে।” আমরা দুঃখের সঙ্গে বলছি, জেনারেল এই মিথ্যা ধারণা মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে রেখেছিলেন যে, জিএইচকিউ এর চীফ অব স্টাফ কর্তৃক তিনি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে যখন খবর পেলেন যে, ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ছুটে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনও তিনি নড়েচড়ে বসলেন না। বরং নতুন করে পুনরাবৃত্তি করলেন
“আমি আবারও আমার অবস্থান থেকে বলছি যে, তারা “বন্দুকের গুলির সীমার মধ্যে আসবে না। (পৃষ্ঠা-৩০)।
৭। সে কারণে, তার প্রমাণ, কেবল যে আমাদের আগেকার মনােভাবকে সুদৃঢ় ও নিশ্চিত করল তাই নয়; ওই মনােভাব ছিল এমন যে, তা ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডারগণ শত্রুদের দ্বারা সৃষ্ট ভারতভীতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কেননা, পাকিস্তানের ভূ-রাজনীতি এবং সামরিক পরিস্থিতির ভিতর গুরুত্বপূর্ণ অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু এটি উন্মােচিত হয়ে গেল যে, ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এমন বাস্তবমুখি কৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যার দ্বারা কি না নতুন ধরনের ভয়ভীতির মােকাবিলা করা যায় এবং পরিস্থিতি সহজে আয়ত্তে আনা যায় যা তাকে সাহায্য করতে পারত।
১০৩
৮। তাঁর অপারেশন সংক্রান্ত পরিকল্পনা সম্পর্কে পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করা হবে। তবে এ পর্যায়ে এটি উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, জেনারেলের ধারণা ছিল সর্বতােভাবে ভুলভালে ভরা, তথা ভ্রান্তধারণাসমৃদ্ধ। ইতােমধ্যে এটি সম্পূর্ণভাবে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মুক্তিবাহিনী তাদের নিজস্ব শক্তির বলে, এমনকি ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরও পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিল না। এমনকি ভারতীয় বাহিনীও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধেরত থাকার মতাে অবস্থানে ছিল না। তারা অনির্ধারিত সময়ের জন্য যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ভূখণ্ড দখল করার পরিকল্পনাও” হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। কেননা, আমরা আমাদের অগ্রবর্তী সৈন্যে সমাবেশ ঘটিয়েছিলাম। সুতরাং, এমতাবস্থায় একটি সর্বশক্তিসম্পন্ন যুদ্ধ ছিল অত্যাসন্ন এবং অপরিহার্য বিষয়। যদি সেখানে পাকিস্তানকে ভূখণ্ডগতভাবে একত্রিত রাখবার জন্য সাংঘাতিকভাবে মনোেযােগী ইচ্ছা কাজ করে থাকে; তাহলে তার একমাত্র পথ খােলা ছিল সনাতনী ধাঁচের পরিকল্পনা অনুসরণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতেও সুরক্ষা দেওয়া। তার জন্য প্রয়ােজন ছিল কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯। জেনারেলের ধারণার ভ্রমাত্মক দিক উন্মােচিত হয়ে ওঠে তখন; যখন তিনি তাঁর তিক্ত অভিযােগটির বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চতর কমান্ডের দ্বারা দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হন। কেননা, যেমনটি তিনি যথার্থভাবে তার লিখিত। বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করার বিষয়টি কোনােক্রমেই বিচ্ছিন্ন কিছু হতে পারে না। ভারতের সাথে যুদ্ধের সার্বিক
পরিকল্পনার ও কৌশলের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ একাত্ম হওয়া প্রয়ােজন।”
১০। যেমন আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি, এই ধারণাটি ছিল একটি বৈধ ধারণা। যদি সেখানে কোনাে প্রকার নাকগলানাের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেবার অবকাশ থাকত; তাহলে তার জন্য উপযুক্ত সময় ছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর, যখন ভারতীয় বাহিনী নগ্ন হামলা চালিয়ে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে এগিয়ে আসছিল। মূল প্রতিবেদনে আমাদের অভিযােগ কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলে ফ্রন্ট খােলার বিরুদ্ধে ছিল না। বরং তা ছিল বিলম্বে এটি খােলার বিরুদ্ধে। কেননা, সেখানে অবস্থা ছিল সংকোচ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং নিরুদ্যম প্রকৃতির। কারণ, যেভাবে তা খােলা হয়েছিল চূড়ান্তভাবে তার ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যয়ের মতাে ঘটনার ওপর হাত লাগিয়েছিল ।
১০৪
৪১
প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন
১। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ বিষয়ক নির্দেশনা নং ৪ এর ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালনায় ইস্টার্ন কমান্ড একটি যুদ্ধ। পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বর্তমান অধ্যায়ে আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে ইতােমধ্যে সম্পন্ন বিষয়টির প্রধান দুর্বলতা এবং ঘাটতি নিয়ে আরও আলােচনা করব। মূলত প্রয়ােগের অভিপ্রায়ে এটি জেনারেল নিয়াজীর দ্বারা ১৫ জুলাই ১৯৭১ সালে প্রণীত এবং জিএইচকিউ কর্তৃক অনুমােদিত ছিল। আমাদের নিকট উপস্থাপিত প্রমাণাদির তেমন কিছুই নাই; যা কি না আমাদেরকে আমাদের মতামত পরিবর্তন করার দিকে ধাবিত করাতে পারে। ভবিষ্যতে যদি তেমন কিছু পাওয়া যায়; তাহলে আমরা আমাদের মতামত পরিবর্তন করে নেব।
২। জেনারেল আমাদের কাছে বলতে আরম্ভ করলেন তখন থেকে যখন তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার পদে নিয়ােগ পেলেন। তখন তাঁকে মৌখিকভাবে সারসংক্ষেপ করেছিলেন জিএইচকিউ, কমান্ডার-ইন-চীফ কাম প্রেসিডেন্ট, চী অব আর্মি স্টাফ এবং সিজিএস। তবে তিনি তা থেকে কোনাে লিখিত নােট নেননি। তিনি বলেন সেই মিশনের ক্ষেত্রে তাকে যা করতে বলা হয়েছিল তা নিম্নরূপ-
১. পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করা।
২. বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
৩. এটি নিশ্চিত করা যে, ভূখণ্ডের কোনাে মাটি দখল করে বিপ্লবীরা যেন সেখানে সরকার গঠন করতে না পারে।
৪. সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া।
৫. অনুগত বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।
৬. নদী এবং ভূ-উপরিস্থানে যাতায়াত করার জন্য যােগাযােগ ব্যবস্থা মুক্ত রাখা; যাতে করে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক এবং সেনাবাহিনীর কাজে তা ব্যবহৃত হতে পারে।
৭. বহিঃশক্তির আগ্রাসন হতে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করা।
৮. কিছু সংখ্যক চিহ্নিত শহর এলাকার নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য বিশেষ নজর দেওয়া এবং সেগুলােকে শক্তিশালী এলাকা হিসেবে গণ্য করা।
৯. শত্রুবাহিনীর অধিকাংশকে পূর্ব পাকিস্তানের এলাকা সংলগ্নস্থানে ব্যস্ত রাখা হবে। যাতে করে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে নজর দিতে না পারে।
৩। সামরিক পরিভাষায় উপযুক্ত কাজগুলাে “মিশন” ছিল কি না সে প্রশ্ন না করে, অথবা, সেগুলাে কি নিছক “সাদামাটা কাজ” হিসেবে বিবেচিত হতাে, তা খতিয়ে না দেখে, সাধারণ কর্মধারা মাফিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য নিম্নলিখিত ধারণাগুলাে নেওয়া হয়
১০৫
১. ভারতের সঙ্গে শত্রুতার মনােভাবের উদ্যেগ গ্রহণ করা।
২। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে স্বাভাবিক যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এবং সেজন্য নৌপথ সুদৃঢ় করতে হবে। ভারত সম্ভবত পাকিস্তানসংলগ্ন সমুদ্রে পরিপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
৩. পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এবং চীন-ভারত সীমান্তে তারা মহড়া চালাবে।
৪. ভারতের পক্ষ থেকে আমরা বড় ধরনের সামরিক অভিযানের সতর্কতার প্রত্যাশা করতে পারি; যা সর্বোচ্চ ৪ দিন স্থায়ী হতে পারে।
৪। এই পর্যায়ে, তিনি সম্ভাব্য কিছু যুক্তিসহযােগে, দৃষ্টিরূপ অনুমান করেন যে, ভারতের কৌশল হবে প্রধানত উত্তরবঙ্গ অথবা চট্টগ্রামের কিছু ভূখণ্ড দখল করে সেখানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বিকল্প হিসেবে সম্ভাবনা রয়েছে ভারত একটি ধরাশায়ী আঘাতের মাধ্যমে (নক আউট ব্লো এর মাধ্যমে) দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা দখল করে নিতে পারে। আর এজন্য তারা তুরা-ময়মনসিংহ পথ বেছে নিতে পারে। এটিই তাদের জন্য সর্বসুবিধাযুক্ত। এ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না । তাঁর অপারেশন সংক্রান্ত নির্দেশনা ছিল সম্মুখ-আত্মরক্ষামূলক মনােভাবসম্পন্ন, যা ছিল শক্তপােক্ত পয়েন্ট এবং সুরক্ষিত দুর্গসম্বলিত। এটি সেইসঙ্গে ছিল সুযােগসুবিধার দিক থেকে আত্মনির্ভর। সেগুলাের মাধ্যমে যুদ্ধ ৩০ দিন বা তার অধিক সময় চালিয়ে নেওয়া যেত। প্রত্যাশা ছিল, শত্রুর বিরুদ্ধে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। সামনে-পিছনে তীব্র প্রতিরােধ গড়ে উঠবে। ফলে সকল প্রকার প্রতিরােধের মাধ্যমে ঢাকা রক্ষা করা যাবে।
৫। এই ধারাণার মূল লক্ষ্য হলাে শত্রুসেনাদের বিরাট অংশকে ব্যস্ত রাখা; যাতে করে তারা রেডিক্যালি’ অবস্থান পরিবর্তন করতে না পারে। অথবা সৈন্যদের মুক্ত করে পশ্চিমাঞ্চলে নিতে না পারে। এবং এভাবে শক্তির সমতা বিধান করা যায়। সেসঙ্গে আমাদের সৈন্যরা কড়া নজরদারী অবস্থায় থাকবে, যাতে করে শত্রুসৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখে অগ্রসর হতে না পারে।
৬। ঢাকা নিজেই ছিল একটি দুর্গের মতাে। তারপরও যেকোনাে মূল্যের বিনিময়ে ঢাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থার কথা চিন্তায় ছিল। কেননা, যেকোনাে বিচারে ঢাকা ছিল রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে লৌহখিলান শিকলাবদ্ধ (লিনসৃপিন)।
৭। জেনারেল নিয়াজী বিশ্লেষণ করেন যে, এটি কোনাে মহৎ ধারণা ছিল না। যদিও পাকিস্তানে তিনি এর উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এ কার্যক্রম উক্ত ধারণা বিকশিত হওয়ার বেলায় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল। মনে করা হতাে আমাদের সম্পদ ছিল সীমাবদ্ধ। এমতাবস্থায় এই ধারণাটি ছিল একমাত্র ধারণা; যা কি না সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান করতে পারে। ১৯৭১ সালের ১২ জুন তারিখে কমান্ডারগণের সমন্বয়ে গঠিত একটি সেমিনারের আলােচনার সারসংক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি কার্যপােযােগী আপারেশন নির্দেশনা প্রণয়ন করেন। তারপর তিনি তা জিএইচকিউতে মতামত প্রদানের জন্য প্রেরণ করেন। তবে সেখান হতে কোনাে মতামত আসেনি। অপারেশনাল নির্দেশনাসমূহ, ১৯৭১ সালের নং ৩ হিসেবে পরিচিত ছিল। পুনরায় তা কমান্ডারগণের সভায়
১০৬
আলােচিত হয় এবং মূল্যায়ন ও অনুমােদনের জন্য তা আবার জিএইচকিউতে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট তারিখে জিএইচকিউ এর পত্র নং ৪০৩৭/২১/এমও-২১ এর দ্বারা অনুমােদনসংক্রান্ত খবর জানিয়ে দেওয়া হয়। জেনারেল বলেন এটি চীফ অব আর্মি স্টাফ এবং সিজিএস লে. জেনারেল গুল হাসান কর্তৃক অনুমােদন অর্জন করে। সে অনুযায়ী, এই পরিকল্পনা, জিএইচকিউ কর্তৃক অনুমােদনের পরে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা হিসেবে রূপ লাভ করে।
৮। জেনারেল আরও মনে করেন দুর্গ-ধারণাটি ইতঃপূর্বে জেনারেল ইয়াকুব কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল। তাঁর একজন পূর্বসূরি হিসেবে ১৯৬৯ সালের ‘আর্মি ডাইরেকটিভ’-এর ভিত্তিতে তিনি এ কাজটি করেছিলেন। এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে অনাবশ্যকভাবে বদলিয়ে ফেলেছিল।
৯। সে কারণে এই ধারণাটির আরও সমালােচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া দরকার। কেবলমাত্র এজন্য নয় যে, অনেক জ্যেষ্ঠ সেনাকর্মকর্তা ও কমান্ডারগণ এর বিরুদ্ধে সমালােচনামুখর ছিলেন, সেসঙ্গে এর দ্বারা বাস্তবে পূর্ব পাকিস্তানে যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল; তা ছিল এর মাধ্যমে স্থাপিত মাইল ফলক এবং ছিল চরম সন্ধিক্ষণসম্পন্ন বিষয়।
১০। ১৯৭১ সালের অপারেশনাল নির্দেশনা নং ৩ এর একটি কপি (যা আর কোনাে গােপন বিষয় ছিল না) এই অধ্যায়ের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে দেওয়া হলাে। এবং তার সঙ্গে সেই পরিকল্পনাটিও দেখানাে হলাে; যেখানে দুর্গের অবস্থান নির্দেশ করা হয়েছিল। এ থেকে দেখা যায়; সেখানে ছিল ২৫টি দুর্গ। এবং ৯টি শক্ত ঘাঁটির পরিকল্পনার নির্দেশ করা হয়েছিল। এগুলাে প্রধানত, জেলা অথবা মহকুমা সদর, বৃহৎ গ্রাম এবং সেনানিবাস পর্যায়ে স্থাপন করা হয়েছিল। ঐ সকল অবস্থানে গােলাবারুদ, খাদ্যসামগ্রী মজুত করা হয়েছিল, যার দ্বারা ৩০ পর্যন্ত দিন চলতে পারে। সেখানে বিমান পােত প্রতিরক্ষা, প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি পদক্ষেপও নেওয়া হয়। সৈন্য স্বল্পতার কারণে প্রদর্শনযােগ্য সেনাবাহিনীর সদস্য রাখা যায়নি। কিন্তু প্রত্যাশিত ছিল যে, সীমান্ত এলাকায় যে সৈন্যবাহিনী নিয়ােজিত করা হয়েছিল এবং বিচ্ছিন্নতা’ তৎপরতা দমনে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা ধীরে ধীরে পেছনে সড়ে আসবেন। এবং দুর্গ ও শক্ত ঘাঁটিসমূহে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করবেন। এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য খুব পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু এটি মনে করা নিরাপদ ছিল যে, সেই ধারণাটি দুর্গগুলােকে সুরক্ষা দিতে পারবে : যাতে করে “শেষ মানুষ এবং শেষ রাউন্ড পর্যন্ত তা চলে । তাদের অবস্থানই বিবৃত করে যে, তারা বিস্তৃতভাবে দাঁড়িয়ে পড়বে বৃহৎ অরক্ষিত এলাকার মধ্যে। এ থেকে এটি সুস্পষ্ট, তারা এমন অবস্থানে ছিলেন না যেখান থেকে পারস্পরিক সমর্থন পাওয়া যায়। অথবা যথােপােযুক্তভাবে শত্রুকে ঘায়েল করতে পারবেন। বিশেষ করে দুর্গ পাশ কাটিয়ে অতিক্রম (বাইপাস) করার পরে । জেনারেল নিজেই তার পরিকল্পনার দুর্বল দিক সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি বলেন : “শক্তিশালী অবস্থান সম্পর্কিত পারস্পরিক সমর্থনের বিষয়টি হয়তাে আসে না । কিন্তু ফাঁক-ফোকরগুলাে পেট্রোলিং’, নুইসেন্স মাইনস্ ও আর এবং এস (R & S) উপাদান দ্বারা তা পূরণ করা হতাে …। কৌশলী কার্যক্রম হিসেবে শক্তিশালী অবস্থানগুলাে কার্যত ফাঁক-ফোকর ও শত্রুপক্ষের বাইপাস অবস্থানে এল অব সি (L of C) এর দ্বারা বিচ্ছিন্ন করা হয়।”
১০৭
শনিবার ২৭/১
১১। দুর্গকৌশলের জন্য কী ধরনের বিষয়গুলাের আবশ্যকীয়ভাবে প্রয়ােজন ছিল, সে বিষয়ে জেনারেল অবগত ছিলেন। তাঁর নিমে বর্ণিত সাক্ষ্য থেকে এটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বিষয়টি তিনি নিম্নলিখিতভাবে ব্যাখ্যা করেন“দুর্গগুলাে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ও পারস্পরিক সমর্থনযােগ্য হবে। দুর্গ বলতে কী বুঝায়? দুর্গ হলাে শক্তিশালী ঘাঁটির সাড়ি বিশেষ, যা চতুর্পার্শ্বে কিছু প্রতিবন্ধকের দ্বারা ঘেরাওসম্পন্ন। ফলে বহিঃশক্তির পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা দুষ্কর। এবং প্রবেশ মুখ হতেই বাহিনীকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। এজন্য গােলাগুলি অথবা শারীরিক শক্তি ব্যবহার করা হয়। যদি দুর্গন্থ কোনাে শক্ত ঘাঁটির পতন হয় এবং কমান্ডারের হাতে পর্যাপ্তসংখ্যক বাহিনী বা সংরক্ষিত বাহিনী না থাকে যার দ্বারা তিনি আক্রমণকারীদের হটিয়ে দিতে পারেন, কিংবা তিনি তার অবস্থান পুনঃসমন্বয় করার মতাে অবস্থানে না থাকেন; তখনও এটি অরক্ষিত অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয় না। শক্ত ঘাঁটি হলাে খুবই ক্ষুদ্র বিষয়। দুর্গ কার্যত বিভিন্ন শক্ত ঘাঁটির দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে। যেমন ধরুন একটি শহরে থাকে বিভিন্ন মহল্লা…। শক্ত ঘাঁটি হল ক্ষুদ্রাকৃতির ঘটনাস্থল, যেখানে থাকে অস্ত্র, ইউনিট এবং সাব-ইউনিট, যা একে অপরকে সুরক্ষা ও সমর্থন দেয় । আর এভাবেই অনুপ্রবেশকারীকে প্রতিহত করা হয়। যদি আপনি কিছু করতে না পারেন তবে ফিরে আসুন। আপনি পাঠ চুকিয়ে ফেলুন অথবা শত্রুরা অন্য কোথাও চলে যাক এবং কেউ হয়তাে আপনাকে সড়ে আসতে বলবেন…। সেখানে যদি পিছনে কিছু থাকে; তাহলে পিছনে ফিরে এসে সর্বশেষ পরিখা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হােন, যতক্ষণ পর্যন্ত না পরবর্তী কমান্ডার তাদের সেই দিকে যেতে না বলবেন, ততক্ষণ তিনি সর্বশেষ পরিখা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। স্যার, এখন আপনার সংরক্ষিত অবস্থায় থাকা তিনটি কারণে খুবই প্রয়ােজনীয়। এই দুর্গ প্রথা খুবই প্রাচীন ধাঁচের। প্রত্যেকেই যারা দুর্বল তারা এ ব্যবস্থায় নিজেদেরকে বন্ধ করে নিতে পারেন…। প্রতিরক্ষাকারী বাহিনী দুর্গ থেকে ফাকা করে ফেলা যায়। এবং তাদেরকে অন্যত্র প্রেরণ করা যায়…। পূর্ব পাকিস্তানে সেমতাে সকল অবস্থান থেকে কোননা। পারস্পরিক সমর্থন আমরা পাইনি। কেননা, সেখানে কোনাে পার্শ্ববর্তী সংযােগ রাস্তা ছিল না।”
১২। সাধারণভাবে অবশ্য দাবি করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে এই কৌশলধারণা ফল বয়ে এনেছিল। কারণ, আত্মসমর্পণের সময় পর্যন্ত বাহিনী দুর্গের অবস্থানে সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান রত ছিল, বিশেষ করে সৈয়দপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায়। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন যে, যশাের, লাকসাম। এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় যুদ্ধ ব্যতীতই দুর্গ পরিত্যক্ত করা হয়েছিল। সেখানকার সৈন্যবাহিনী শত্রুদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, কুমিল্লা এবং সিলেটের বাহিনী ছাড়া অন্য কোথাও যােগাযােগ না করেই।
১৩। নামের বেলায় যেমন, তেমনি একটি দুর্গ এমন একটি স্থান যা সুরক্ষিত, অস্ত্রসজ্জিত এবং শক্তিতে যেকোনাে মূল্যে সামর্থপূর্ণভাবে বলীয়ান হয়। প্রয়ােজনবােধে; এমনকি তা দীর্ঘ দখলদারিত্বের ভিতর থেকেও প্রতিরােধে সক্ষম হয়। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি এ ধরনের ধারণা কোনাে প্রকার সামরিক বিষয়ক মতবাদের গৃহীত অংশ নয়। কিংবা তা পদাতিক ডিভিশনের যুদ্ধসংক্রান্ত ম্যানুয়েলেও উল্লেখ নেই। তবে ক্রুসেডের সময় এই
১০৮
ধরনের প্রতিরক্ষা রীতিটি ব্যবহৃত হয়েছে। সামরিক পরিকল্পনাকারীগণ বিষয়টি বাস্তবায়িত করেছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ সম্পূরক-সংযুক্তিতে দেওয়া হবে। এখন এ বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যে, এর সফলতার জন্য তিনটি বিষয় প্রয়ােজনীয় শর্ত বলে বিবেচিত হয়-
১। দুর্গের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কমান্ডার এবং সামগ্রিক অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কমান্ডার উভয়েরই সৈন্যসমাবেশ করার জন্য পর্যাপ্ত সংরক্ষিত বাহিনী থাকতে হয়। শত্রুদের প্রথম দুর্গ পাশ কাটিয়ে অতিক্রমের মতাে কর্মকাণ্ডে অন্য দুর্গের সঙ্গে পারস্পরিক সমর্থন ও সহযােগিতা এবং দ্বিতীয়ত, দুর্গের সহায্যের জন্য কমান্ডারের এগিয়ে আসার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
২। দুর্গগুলাের অবস্থান এমন হতে হয়; যাতে করে দুর্গগুলাে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সাহায্যে এেিগয় আসার মতাে পরিস্থিতে থাকতে পারে।
৩। যেসব এলাকায় দুর্গ গড়ে তােলা হয়, সেসব এলাকার মানুষজন যেন বিরােধী | অবস্থানে না থাকেন।
জেনারেলের নিজের বক্তব্য যা ইতােমধ্যে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি নিজেও এসব অবস্থা ও ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। তিনি আরও সচেতন ছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে এ সব শর্তের কোনােটিই পূরণ হওয়ার মতাে অবস্থা ছিল না । তিনি আরও জানতেন ৩৪টি দুর্গ এবং ২৯টি শক্ত ঘাঁটিতে সমাবেশ করার মতাে পর্যাপ্তসংখ্যক বাহিনী তার ব্যাটেলিয়নে নেই। তিনি আরও অবগত ছিলেন তার দুর্গগুলাে যথাসময়ে পরস্পরকে সাহায্য প্রদানে সক্ষম নয়। তিনি পরিপূর্ণভাবে আরও জানতেন; যখন তার বাহিনী দুর্গের ভেতর আবদ্ধ হবে, তখন যখন মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ও চতুর্পার্শ্বের এলাকার মানুষের বিরােধিতার কারণে তাদের নড়াচড়া ও চলাচল অসম্ভব হওয়ার মতাে অবস্থা সৃষ্টি হবে। তিনি খুব ভালােভাবেই অবগত ছিলেন যে, দুর্গের এবং শক্ত ঘাঁটিগুলাের দ্বারা গঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চরিত্র এমন ছিল যে, তা শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্ক এবং কামানের দ্বারা সংঘটিত আক্রমণ মােকাবিলা করার যােগ্যতা রাখে না। ভূখণ্ডগত বিষয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যতটুকু সুবিধা তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন ততটুকু সুবিধা বাস্তবায়িত হয়নি এবং “সত্যিকারভাবে ভূখণ্ডের মানুষ তাঁর প্রতি বিরােধাত্মক হয়ে উঠেছিলেন। কেননা, মানুষ বৈরী হয়ে পড়েছিল।” এ অবস্থায় তিনি কীভাবে জয় প্রত্যাশা করেছিলেন?
১৪। তাই, জেনারেলের উপযুক্ত সাধারণ দাবির মতাে, যদি আমরা বলি তিনি যেভাবে ধারণা গঠন ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার ভেতরই ব্যর্থতার বীজ নিহিত ছিল; বােধ করি তা ভুল বলা হবে না। নজির থেকে পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে দুর্গের কোনােটিই জনবলসহ প্রতিরক্ষাগত দিক থেকে এমন অবস্থানে ছিল না; যার মাধ্যমে তা শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্কবহর সুসজ্জিত জোরালাে আক্রমণ প্রতিরােধ করতে পারে। গােলন্দাজ বাহিনী অথবা ভারী অস্ত্রশস্ত্রসম্বলিত বাহিনীকে দুর্গের মধ্যে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। নজির থেকে প্রতীয়মান হয়; গােলাবারুদ সম্পর্কিত বিষয়ে, এমনকি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা থেকে রাত্রে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে তা দুর্গে দুর্গে সরবরাহ করা হয়েছিল। যখন ভারতীয় আক্রমণ আরম্ভ হয়েছিল তখন মুক্তিবাহিনী তাদের সঙ্গে চর্তুদিকে ছিল এবং এলাকার লােকজনও বিরােধী হতে আরম্ভ করেছিল। সে কারণে দুর্গের বাইরে বেড়িয়ে আক্রমণ প্রতিহত করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
১০৯
১৫। দুর্গ হতে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কোনােভাবেই সুশৃঙ্খলতার সাথে করা হয়নি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা হয়েছিল তাকে বলা যায় বিশৃঙ্খলভাবে পিছু হটে আসা। এমনকি পিছনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পর্যন্ত ফেলে আসা হয়েছিল। শত্রু বাহিনী যখন। দুর্গের নিকট এসেছিল তারা তখন ছিলেন অতিরিক্ত ক্লান্ত। সেজন্য তারা তেমন কোনাে কার্যকর প্রতিরােধব্যুহ গড়ে তুলতে পারেনি। ১৬তম ডিভিশন ব্যতীত আঞ্চলিক কমান্ডারগণের হাতে অতিরিক্ত সৈন্যের কোনাে প্রকার সংরক্ষিত সৈন্য ছিল না। কেবলমাত্র এক বিগ্রেড শক্তিসম্পন্ন কমান্ড সংরক্ষিত সৈন্য ইস্টার্ন সেক্টরে ছিল। তা-ও আবার এটি ছিল শত্রুপক্ষের আচমকা হুমকীর মুখে। এই ধারণায় কতটুকু দৃঢ়তা ছিল, তা একটি গুরুতর প্রশ্ন। যে কারণে এর অসাড়তার বিষয়টির আগাগােড়া শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে পড়ে ।
১৬। যদি এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য এই হয় যে, বাহিনী বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকবে, তখন যখন শত্রুপক্ষ কার্যকরভাবে বাদবাকি দেশ দখল করে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, তারপর পরিকল্পনাটি সফলতার দিকে যাবে, সেটি ভিন্ন কথা।
১৭। এমতাবস্থায় আমরা কোনােভাবেই একমত নই যে, পরিকল্পনাটি লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক ছিল। যা তারা পেতে চেয়েছিলেন তা এর মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব ছিল না । আমাদের দৃষ্টিতে, এসব ধারণা সম্পূর্ণভাবে ছিল অযথার্থ প্রকৃতির। এর মাধ্যমে কমান্ডারগণ মিশনের দায়ভার মােচন করতে পারতেন এবং ইস্টার্ন কমান্ড পূর্ব পাকিস্তানকে সুরক্ষা দিতে পারত বিশেষ করে শত্রু কর্তৃক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাথায় এ রকম প্রত্যাশা ছিল দিবাস্বপ্নের মতাে।
১৮। মানুষ এবং যন্ত্রপাতি উভয় ক্ষেত্রেই, তাঁর নিজের সাজসরঞ্জামের ভারসাম্যহীনতা মিশ্রিত হয়ে পরিস্থিতি এমন একটি সত্যের মুখােমুখি হলাে যে, বাহিনী ইতােমধ্যে প্রায় পরিশ্রান্ত অবস্থার প্রান্ত সীমায় এসে দাঁড়িয়েছিল। কেননা তারা সদাসর্বক্ষণ প্রতি-বিদ্রোহী তৎপরতায় (যা চলমান ছিল প্রায় আট মাস ধরে) ব্যস্ত ছিল। আমদের মতে, বিজ্ঞচিত কাজ হতে পারত, বাহিনীকে একটি সংক্ষিপ্ত এলাকার মধ্যে সীমিত করে রাখা, যেখানে আছে প্রচুর প্রাকৃতিক প্রতিরােধের ব্যবস্থা। এবং যা সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ঢাকার লােহার খিলান’ বিশেষের মতাে।
১৯। জেনারেল এবং তাঁর চীফ প্রতিরক্ষার ধারণাকে ঢাকা ও টাঙ্গাইল-এর মধ্যে উপহাসের পর্যায়ে নিয়ে এলেন। এটিকে শত্রুপক্ষের ভেলকিবাজি রূপে চরিত্রায়িত করলেন। কিন্তু আমরা এই অনুভূতিকে না মেনে পারছি না যে, এমতাবস্থায়, যেখানে কমান্ডার কেবলমাত্র তাঁর ধারণাপ্রসূত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে সীমিত ছিলেন, যেকোনাে বিচারে সেখানে প্রয়ােজন ছিল একটি আকস্মিক পরিস্থিতি মােকাবিলা করার মতাে পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে, ঢাকা-টাঙ্গাইল ঘেরাটোপ থেকে উঠে এসে সর্বত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা যায়। কেননা, শত্রুপক্ষ সম্পদ ও সামর্থ্যে, ভূমি এবং বিমান উভয় স্থানেই ছিল উচ্চমার্গের। ইস্টার্ন কমান্ডের ব্যর্থতা ছিল আমাদের দৃষ্টিতে বড়াে মাপের অবহেলা। তারা যা করেছিলেন তা হলাে বাস্তবে যুদ্ধকে দুর্বল করে ফেলা। আর সেভাবে নিজেদেরকে পরাজয় ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত করা । দুর্গ-কৌশলের সত্যিকার ফলাফল ছিল এমন যে, তাতে করে শত্রুপক্ষ সুবিধা পেয়েছিল। তারা তাদের নিজেদের সুবিধা মতাে রাস্তা
১১০
ধরে এগিয়ে আসে। আমাদের বাহিনীকে ছত্রভঙ করে দেয়। ফলে তারা মনােযােগের সঙ্গে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
২০। প্রতি-বিদ্রোহী তৎপরতা দমনে হয়তাে দুর্গ-কৌশল কাজ দিতে পারত। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের পরে নিম্ন পর্যায়ের একজন কমান্ডার জেনারেলের পছন্দের একজন হিসেবে সুবিধার নিয়ােগ পান। উদাহরণ হিসেবে নাম উল্লেখ করা যায়, মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ-এর, ১৬ ডিভিশন। অবশ্য, জেনারেল নিজেও এটি স্বীকার করেছেন। “দুর্গ-ধারণার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঠেকানাের কৌশল ছিল অনাবশ্যক।” অবশ্য জেনারেল নিয়াজী এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এই ধারণায় স্থির থাকতে চান যে, দুর্গ-পরিকল্পনা উভয় অবস্থাই সৃষ্টি করেছিল। কেননা, এটি ভারতীয় বাহিনীকে যুদ্ধে আসতে বাধা প্রদান। করেছিল। এটি অবশ্য, তার একান্ত নিজস্ব ধারার চিন্তা যে, তাঁকে ভারত-পাকিস্তান। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে বড়াে কোনাে যুদ্ধ করতে হয় নাই। যখন তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি তখন খুবই আবেগের সঙ্গে বলেন“হ্যা, আমি তাদের সম্পর্কে দীর্ঘদিন থেকেই জানতাম। বিভাগ-পূর্বাবস্থায় তাঁদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছিলাম। আমি তাদের মনের খবর জানতাম। তারা কখনাে গুরুতর কোনাে ভুল করবেন না। কারণ উন্মুক্ত যুদ্ধে না এসেও তারা তাদের লক্ষ্য। অর্জন করতে পারেন।”
২১। এ ধরনের চিন্তার ভ্রান্তিমূলক দিক তখনই সুস্পষ্টভাবে বেড়িয়ে আসবে যখন কেউ পূর্ব পাকিস্তানের চতুর্পার্শ্বে ভারতে ব্যাপক স্থাপনা দেখতে পাবেন। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হই; জেনারেল নিয়াজীর সরল বিশ্বাসপ্রবণতা দেখে! তিনি কি ভেবেছিলেন। যে, ভারত তার ৮ ডিভিশন নিয়মিত বাহিনী এবং ৩৫ ব্যাটালিয়ন নিরাপত্তা বাহিনী কেবলমাত্র কিছু পরিমাণ ভূখণ্ড দখলে নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে মুক্তিবানীকে সাহায্য করতে সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন? এমনকি, যদি কোনাে পর্যায়ে তার এরূপ ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের সঙ্গে তাঁকে কোনাে বড় ধরনের যুদ্ধে অংশ নিতে হবে না, তাহলে যখন তাঁকে ভারতের বিস্তারিত পরিকল্পনা জানানাে হলাে এবং তাঁর চীফ অব স্টাফ জিএইচকিউতে ডেকে যেভাবে তা পূর্ণাঙ্গ সারসংক্ষেপ বর্ণনা করেছিলেন তারপরে তাঁর মাথা থেকে উক্ত ধারণা ঝেড়ে ফেলে দেওয়াই সংগত ছিল। এর পরে কোনােভাবেই তাঁর বাহিনীকে সমাবেশ না করানাের ব্যর্থতার বিষয়টি ক্ষমাযােগ্য হতে পারে না। এখানে সুস্পষ্ট প্রমাণের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সিজিএস এবং ভিসিজিএস ইস্টার্ন। থিয়েটারে তাদের শেষ সফরের পরে তাঁকে সৈন্যবাহিনী পুনঃসমাবেশের যথাযথ উপদেশ প্রদান করেছিল । কিন্তু জেনারেল নিয়াজী ঝোঁকের মাথায় পরিবর্তিত নতুন ভয়ভীতিকর পরিস্থিতিতে ৩৬ ডিভিশনের দুটি এড়হক বাহিনী সেপ্টেম্বর মাসে সমাবেশ করেছিলেন। যখন ভারতের বৈরী মনােভাব প্রথম জানা গিয়েছিল; তখন এবং ১৯ নভেম্বর তাঁর চীফ জিএইচকিউ হতে পুনরায় ফিরে এসে তার কমান্ডের অধীনস্ত ৩৯ ডিভিশনের সংরক্ষিত বাহিনীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ করতে বলেছিলেন। জেনারেল অবশ্য তার অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে বলেছেন যখন তাঁর সিওএস এবং জেনারেল জামশেদ জিএইচকিউ থেকে গিয়ে এ ধরনের। সংরক্ষিত সৈন্য সমাবেশের কথা বলেছিলেন তখন তিনি ৮ ব্যাটালিয়ন অতিরিক্ত
১১১
সমাবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এবং যদি সেগুলাে প্রেরণ করা হতাে তাহলে তাকে নতুন এক প্রক্রিয়ার বিষয়াদির বেলায় ঘাটতি পূরণের জন্য নতুন এক সংরক্ষণ বাহিনী গড়ে তােলার দরকার ছিল।
২২। প্রমাণাদি থেকে দেখা যায় সেই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে তেমন কোনাে সুদৃঢ় জোগান জিএইচকিউ থেকে দেওয়া হয়নি। এ কারণে নতুন করে প্রয়ােজনের তুলনায় যথাসাধ্য মাত্র ৩ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নভেম্বরের ২৬-২৭ তারিখে প্রেরিত হয়েছিল । কিন্তু সেই সৈন্যদের ব্যবহার করার জন্য সেখানে কোনাে প্রকার পরিকল্পনা ছিল না। এমনকি যদি অন্য আরও বাদবাকি পাঁচ ব্যাটালিয়ন সৈন্য সেখানে পাঠানাে হতাে, তাহলেও বস্তুগত কোনাে উৎকর্ষ সেখানে দেখা যেত না। কারণ, সেখানে সেই সৈন্য ব্যবহারের কোনাে পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন পরিকল্পনা ছিল অনুপস্থিত।
২৩। জেনারেল জামশেদ সে ধরনের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কিছু বলেননি। কিন্তু জেনারেলনিয়াজী তাঁর সম্পূরক বিবরণে উক্ত অভিযােগ সম্পর্কে বলেন জিএইচকিউ কর্তৃক এটি কেবলমাত্র প্রতিশ্রুতি ছিল না, ছিল একটি সুদৃঢ় অঙ্গীকার। এমনকি ধরে নেওয়া যায় যে, এর পরও অভিযােগ থেকেই যায়। কেননা, তিনি কেবল ততটুকুই পরিকল্পনার মধ্যে রেখেছিলেন; যতটুকু শক্তি তার সে সময়ে হাতে ছিল । যদি আদৌ কিছু থেকে থাকত, তার পরিকল্পনা, তাও বাস্তব বস্তুগত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত সেভাবে প্রণয়ন করার প্রয়ােজন ছিল। জিএইচকিউ-এর সংকট সম্পর্কে তিনি ভালােভাবেই সচেতন। ছিলেন। সেজন্য সিওএএস-এ তাঁর শেষবারের সফরে তিনি নিজে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বাহিনী গঠনসংক্রান্ত বিষয়ে কমান্ডারদের প্রতি বলেন যে, যদি কেউ সিওএএস-এ নতুন বাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন তােলেন তাহলে তিনি তাকে জনসমক্ষে তিরস্কার করবেন। সেজন্য আমরা একমত নই যে, সেখানে কোনাে প্রকার অঙ্গীকার ছিল না। অথবা জেনারেল নিয়াজীর বাস্তবে সংরক্ষিত বাহিনী আসার বিষয় সম্পর্কিত প্রদত্ত যৌক্তিকতার সঙ্গেও আমরা একমত নই।
২৪। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের ওপর অর্পিত আদি মিশন ও প্রত্যয় যেমন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করতে হবে, সে বিষয়ে উর্ধ্বতন কমান্ড যে কখনাে প্রদত্ত পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটায়নি তা কমান্ডার তার পরবর্তী কৈফিয়ত হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন এটি ছিল একটি রাজনৈতিক মিশন। তাই তাঁর পক্ষে এটি পরিবর্তন করার কোনাে ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু একই সময়ে তিনি বলেন “২১ নভেম্বর যখন বেলুন আকাশমুখী হলাে; তৎক্ষণাৎ আমি ভারতীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিই। আমার গঠিত ব্যবস্থার মধ্যে সেইসব স্থান থেকে সৈন্য খালি করা হয়, যে সব স্থান ভারতীয়দের বিরুদ্ধে কাজে লাগবে না …। আমরা সেই সব এলাকা ধরে রাখি; যা ছিল এ বিষয়ে অর্থপূর্ণ। ওই সব এলাকা ছিল রাজনৈতিক, কৌশলগত অথবা ভৌগােলিক দৃষ্টিতে গুরুত্ববহ। এ কারণে তার বাইরের অঞ্চলসমূহ খালি করা হয়।”
২৫। প্রায় প্রতিটি ইস্যুকে এ জাতীয় স্ববিরােধী অবস্থানে নেওয়ার বিষয়টি জেনারেলের সাক্ষ্যে প্রতীয়মান হওয়ার দরুন আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা আমাদের ভিতর এইরূপ মনােভাব সৃষ্টি করে যে, তিনি কর্তব্য (মিশন) এবং তা বাস্তবায়নের প্রশ্নে কোনাে প্রকার স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন না। যা যেমন ছিল তেমন হােক, এরূপ সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে, তিনি সেরূপও করেননি। যদি সে ধরনের
১১২
কোনাে পরিকল্পনা থেকে থাকত, তাহলে সেই সব কৌশলগত অবস্থান তিনি দেখতে ও বুঝতে পারতেন। এবং সৈন্যসামন্ত প্রত্যাহার করার পরে কীভাবে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়, সে সম্পর্কে বাস্তবধর্মী কৌশল নিরূপণ করতেন। তিনি এ প্রশ্নের উত্তরে নিম্নলিখিত দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন জবাব দেন-
“কর্পস কমান্ডার হিসেবে আপনি ডিভিশন কমান্ডারের কাছে এফএলএল (FLL) লাইন নির্ধারণ করে দেন। বলা হয় এর বাইরে তারা যাবেন না। সেসঙ্গে আপনি তাদের সীমাপরিসীমাও নির্ধারণ করে দেন। এসব কিছুই আমি পরিকল্পনার মধ্যে সংযুক্ত করেছিলাম। এবং তা ডিভিশনাল কমান্ডারদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম । কিন্তু ঢাকা এলাকায় কীভাবে ফিরে আসতে হবে, তা ছিল তাদের বিষয়।”
২৬। এটি ছিল এক আশ্চর্য হওয়ার মতাে জবাব। এর মধ্য দিয়ে তাঁর কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় বের হয়ে আসে। এমনকি, এতে তাঁর সামরিক পরিকল্পনার প্রাথমিক জ্ঞানহীনতারও পরিচয় প্রকাশ পায়।
২৭। এই নজির অবশ্য দেখায় না যে, সর্বত্র সৈন্যবাহিনী কোনাে যুদ্ধে বা দুর্গ সুপরিকল্পিতভাবে প্রত্যাহার কার্যক্রমে তৎপর ছিল। বাস্তবে, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখে জেনারেল কর্তৃক সুনিশ্চিতভাবে ইস্যুকৃত নির্দেশে তা থেকে তাদের বিরত রাখা হয়। এতে উল্লেখ ছিল; যেকোনাে অবস্থায় শতকরা ৭৫ ভাগ হতাহত না হওয়া অবধি সেনা প্রত্যাহার করা যাবে না। এবং সেসঙ্গে প্রত্যাহারের বিষয়টি যেন ‘টু-আপ’ দ্বারা বাস্তবায়িত হয়। এই কট্টর অবস্থান প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক কমান্ডারদের কার্যক্ষেত্রে স্বাধীনতার ওপর সাংঘাতিক বাধা নিষেধের জন্ম দেয়। এতে করে তারা কৌশলগত অভিযান পরিচালনার বেলায় বড়াে মাপের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। যদিও এ আদেশ কখনাে পালন করা হয়নি। এমন কোনাে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না যেখানে আমাদের সেনাবাহিনীর পিছিয়ে আসার আগে শতকরা ৭৫ ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু নিম্নস্তরে থাকা কমান্ডারগণ এই অবিবেচনামূলক নির্দেশকে ভারতীয়দের অগ্রসরমানতা প্রতিরােধে ব্যর্থতা এবং তাদের নিজেদের অদক্ষতাকে ধামাচাপা দিতে ব্যবহার করেন।
২৮। ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার হায়াত যশাের দুর্গে তাঁর ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেন। (যেখান থেকে রাস্তার আরম্ভ) সেখানকার মানুষকে। পরিকল্পনানুযায়ী তিনি তাঁর অধীন সেনাবাহিনীকে অগ্রবর্তী অবস্থান যথা, বেনাপােল ও সাতক্ষীরার জন্য প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার অজুহাতের সারগর্বর্তা প্রসঙ্গে পরবর্তী অধ্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। কিন্তু এই পর্যায়ে কেবলমাত্র নির্দেশটির দ্বারা সৃষ্ট বিভ্রান্তির উল্লেখ করা হলাে।
২৯। যখন ১৬ ডিভিশন এলাকার ঠাকুরগাঁও-এ ব্যাটালিয়ন শত্রুদের চাপে খালি করা হয়, তখন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে আবার সেখানে যেতে বলা হয়। কমান্ডার ব্যক্তিগতভাবে সেখানে বিষয়টি দেখতে গিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে, সিলেট এলাকায়, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের পরেও শমসেরনগর এবং লাটু সীমান্তের পর্যবেক্ষণকারী ব্যবস্থা যেন অবশ্যই ধরে রাখা হয়; তেমন নির্দেশ জেনারেল দিয়েছিলেন। ১১৩
৩০। এ ধরনের বিষয়গুলাের অন্যান্য উদাহরণ পরবর্তী অধ্যায়ে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলােচনার সময়ে উঠে আসবে। কিন্তু এখন চলুন দেখা যাক ভারতীয়দের দ্বারা সৃষ্ট ভয়ভীতি সম্পর্কে জেনারেলের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল।
৩১। জেনারেল যখন নিজেকে ধীরে ধীরে শত্রুর দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং শত্রুরা সফলতার সঙ্গে দুর্গ পাশ কাটিয়ে বিকল্প রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে ফরিদপুর, খুলনা, দাউদকান্দি এবং চাঁদপুরে (ঢাকা আসার সংক্ষিপ্ত পথ) পৌঁছে গিয়েছিলেন, তখন তিনি গোঁড়ামিসুলভ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলেন। উদ্দেশ্য ছিল; সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে এনে ঢাকার সুরক্ষা দেওয়া। যদিও তিনি ইতপূর্বে ১৪। ডিভিশনের মেজর জেনারেল মাজেদ কর্তৃক ঢাকার দিকে দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য আসার কার্যক্রমকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবসত তা ছিল ইতােমধ্যে অনেক বিলম্বিত । বড়াে নদী যমুনা পার হওয়ার জন্য প্রয়ােজন ছিল ফেরির, সে এলাকায় অগ্রসর অযােগ্য ১৬তম ডিভিশনকে মুক্তিবাহিনী যাতায়াতের জন্য যােগাযােগ ব্যবস্থার অসম্ভব করে দিয়েছিল। এ কারণে ডিভিশন অগ্রসর-অযােগ্য হয়ে গিয়েছিল । ৯৩তম ব্রিগেডকে ময়মনসিংহ থেকে হঠাৎ করেই প্রত্যাহার করা হয়। প্রায় ১০০ মাইল পদব্রজে মার্চ’ করার কারণে তারা যানবাহন এবং ভারী। অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যক্ত করেছিলেন। রাস্তায় তারা শত্রুদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র ছয় কোম্পানি সৈন্য ঢাকা এসেছিল; কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার ছাড়াই তারা ঢাকা এসেছিলেন।
৩২। অনুরূপভাবে, অন্য আর একটি ব্যাটালিয়ন ১৪তম ডিভিশন অবস্থান প্রত্যাহার করে ঢাকার দিকে সরিয়ে আনা হয়। এক্ষেত্রেও তারা তাদের সমস্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন পিছনে ফেলে আসে। ৫৭তম ব্রিগেড ১৯তম ডিভিশনের এলাকা অতিক্রম করে ১৬তম ডিভিশনের কাছে আসে, পাকশি ব্রিজ পেরিয়ে তারা বগুড়ায় এসে অলসভাবে বসে থাকে। কারণ, কীভাবে তারা যমুনা পার হবেন তার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না।
৩৩। উল্লিখিত অবস্থার আলােকে দেখা যায়; জেনারেল-এর পক্ষে এটি বলা বৃথা যে, তাঁর প্রণীত কার্যপােযােগী পরিকল্পনা সুষ্ঠু ও যথার্থ ছিল । অথবা তা ঘটনাক্রমের জন্ম দিয়েছিল । সুসামঞ্জস্য কোনাে প্রকার পরিকল্পনা সেখানে ছিল না; যার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের একটি ডিভিশন অথবা একটি ব্রিগেডের আক্রমণ যুদ্ধের কোনাে স্তরে প্রতিহত করা যায়। আক্রমণের মুখে শত্রুদের পিছু হটতে বাধ্য করার মতাে কোনাে পরিকল্পনা যদি জেনারেল এভাবে নিয়ে থেকে থাকেন যে, নিদেনপক্ষে প্রতিটি সেক্টরে দুটি ডিভিশন দ্বারা শত্রুপক্ষের আক্রমণ বিতাড়ন করা যাবে, তাহলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তিনি শত্রুপক্ষের শক্তি ও সক্ষমতাকে ছােটো করে দেখেছিলেন।
৩৪। সে কারণে, মূল প্রতিবেদনে আমাদের উপসংহার যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি প্রমাণাদির দ্বারা নিশ্চয় পাওয়া স্বাপেক্ষ। এখন আমাদের সম্মুখে তা চলে এসেছে। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের প্রাপ্ত তথ্যাদিসমূহের পুনঃনিশ্চয়ন দিচ্ছি। আর তা হলাে তার পরিকল্পনা ছিল হতাশাব্যঞ্জকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। ঢাকার সুরক্ষার জন্য সেখানে মােটের ওপর কোনাে পরিকল্পনাই ছিল । এই ব্যর্থতার দ্বায়ভার যে কেবলমাত্র ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের ওপর বর্তায়।
১১৪
তাই নয়; সেসঙ্গে তা জিএইচকিউ এর ঘাড়েও চাপে। কেননা, ইস্টার্ন কমান্ডের ক্ষেত্রে তাদের ভুলত্রুটিসমূহ তারা সংশােধন করে নেননি। আমরা এ যুক্তির দ্বারা গদগদ নই যে, পূর্ব পাকিস্তান এবং বিশেষভাবে ঢাকার প্রতিরক্ষার প্রশ্নে ইস্টার্ন কমান্ডের বিস্তারিত প্রস্তুতির ক্রটিই একমাত্র দায়ী। আগেই বলা হয়েছে, এর দায়দায়িত্ব জিএইচকিউও এড়িয়ে যেতে পারে না। কেননা, নির্দেশনা ও পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। তাদের ওপরই ছিল ইস্টার্ন থিয়েটারের যুদ্ধ পরিচালনার মূল দায়িত্ব; বিশেষ করে তখন যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল যে, ইস্টার্ন থিয়েটারের কমান্ডার এ দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা দেখাচ্ছেন।
৩৫। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, বর্তমান ঘটনায়, একজন ব্যক্তি, যিনি (তাঁর নিজস্ব ভাষায়) বিশ্বাস করতেন, “সকল প্রকার সরবরাহ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দেউলিয়া।” সেজন্য, আমরা অবশ্যই উপসংহার টানব ‘একটি উত্তম জেনারেলপনা, এই জেনারেলের মতে, তিনিই যিনি ঘটনাকে পিছনে ফেলে যাওয়ার মতাে কাজ করেন। এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু সত্যিকারভাবেই তাই হয়েছিল।
১১৫
৪২
ভারতীয় ভীতির মূল্যায়ন
১। আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে এই বিষয়টি নিয়ে কিছুমাত্র আলােচনা করেছি এবং দেখিয়েছি যে, কত নিদারুণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্ধ্বতন কমান্ড শত্রুপক্ষের প্রদর্শিত ভয়ভীতির বিষয়ে যথার্থ মূল্যায়নে ভুলভ্রান্তি করেছিল। যদিও ভারত কী করতে যাচ্ছে; আমাদের হাতে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা আগেই এসে গিয়েছিল। আমাদের উপসংহার বদলাবার কোনাে প্রকার কারণ আমরা দেখছি না। আমরা এখন ইতােমধ্যে জানা সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট সেই সব প্রমাণের আলােকে বলছি যে, ইস্টার্ন কমান্ড দুর্ভাগ্যজনকভাবে মতিবিভ্রমে ভুগেছিল।
২। আমরা ইস্টার্ন কমান্ডের চিন্তাতেও দেখতে পেরেছি যে, মনে করা হতাে; ভারত যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ্য আগ্রাসন এড়িয়ে যাবে, অথবা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশক্তি নিয়ােগসম্পন্ন যুদ্ধে নামবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যেন পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলা না হয়। এমন ঘটনায়, মূল যুদ্ধ ঘটবে পশ্চিম পাকিস্তানে। সেক্ষেত্রে ওই ধারণার প্রতিফলন হবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার ওপর। সে কারণে ইস্টার্ন কমান্ডকে কখনাে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সঙ্গে প্রধান কোনাে যুদ্ধে জড়াতে হবে না। তারা কেবলমাত্র ভারতীয় বাহিনীকে পূর্বাঞ্চলে ব্যস্ত রাখতে চাইবে। ফলে সেখানকার কোনাে পক্ষই পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মুখে যুদ্ধ করতে যাবে না।
তাই, ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার কর্তৃক প্রদর্শিত অগ্রবর্তীমূলক প্রতিরক্ষার মনােভাব, তাঁর সহযােগী কর্মকর্তা ও সহকর্মী কার্যত সার্বিকভাবে ঢাকার প্রতিরক্ষার বিষয়টি অবহেলা করেছিলেন।
৩। মেজর জেনারেল জামশেদের নেতৃত্বে এহক ভিত্তিতে গড়া ৩৬তম ডিভিশন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে ঢাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। মেজর জেনারেল জামশেদ স্বীকার করেছেন যে, “ঢাকা বিদ্রোহীদের দমনের জন্য প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের জন্য সেখানে কোনাে প্রকার প্রস্তুতি ছিল না। কারণ, ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ভেবেছিলেন সীমান্ত এলাকায় অগ্রবর্তী সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়ে ঢাকার “ত্রিভুজের প্রতি শত্রুর ঢাকা অভিমুখে অভিযান রােধ করা সম্ভব হবে। আমরা তাঁর নিকট থেকে এ বিষয়ে আরও জানতে পারলাম : “যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত, অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য অগ্রবর্তী সৈন্য সমাবেশের জন্য বরাদ্দকৃত সৈন্যদের ঢাকার দিকে ফিরিয়ে আনার কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। এই পর্যায়ে এসে অবশ্য ততক্ষণে বিষয়টি বিলম্বিত হয়ে গিয়েছিল। কেননা, সম্মুখাবস্থা ইতােমধ্যে ভেঙে পড়ে সেখানে সৈন্যদের অবস্থান সমস্যাসঙ্কুল হয়ে পড়েছিল।”
১১৬
৪। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বরের পরে জেনারেল ফরমান আলীর মূল্যায়ন হলাে, “যুদ্ধ চলমান থাকলেও কমান্ড যুদ্ধ হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ, পূর্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে। ‘যেকোনােভাবে সৈন্য প্রত্যাহারপূর্বক ঢাকার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা যাবে’ ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের এমন ভুল ধারণার ভরাডুবি হয়েছিল। তিনি ভারতীয় মনােভাবও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ ব্যর্থতা আমাদের মতে দায়িত্বের প্রতি গুরুতর এবং বড়াে ধরনের অবহেলা। কেননা, তাঁকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের পরে বড়াে মাপের ভয়ভীতির আগমন ঘটতে যাচ্ছে।
৫। লে. জেনারেল নিয়াজী দাবি করেন যে, ভয়ভীতি সম্পর্কে তিনি যথাসময়ে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এজন্য তিনি একটি এডহক ডিভিশন সৃষ্টি করেছিলেন মেজর জেনারেল জামশেদের অধীনে। কিন্তু আমরা পরবর্তীতে জানতে পেরেছি, জিএইচকিউ-এর উদ্দেশ্যে তার ঢাকা ত্যাগ করার আগে মধ্য নভেম্বরে, কেবলমাত্র এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে ঢাকায় সংরক্ষিত সৈন্য হিসেবে ৩৬ ডিভিশন অবস্থান করছিল। আরও একটি ব্রিগেড এর সঙ্গে সংযুক্ত করে ঢাকার শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা ছিল। ধারণা করা হয়েছিল; এর মাধ্যমে ঢাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু ঢাকায় ফিরে এসে তিনি দেখতে পেলেন, “একমাত্র ব্রিগেডটি ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছে। এভাবে ৩৬ ডিভিশন। কেবলমাত্র কাগজে-কলমে আছে এবং এটি শুধুমাত্র ৯৩ ব্রিগেড দ্বারা গঠিত হয়েছে। কেননা, সেই ব্রিগেড ঢাকা থেকে ১০০ মাইল দূরে ময়মনসিংহে অবস্থান করছে।” জেনারেলের দাবিটি এজন্য সবৈ অযৌক্তিক। অতএব, আমরা এই অনুভূতি ধারণ না করে পারছি না যে, ভারতীয়দের দ্বারা প্রদর্শিত ভয়ভীতি যথাযথভাবে উপলব্ধি না করে, অথবা জিএইচকিউ কর্তৃক সময়ােচিত ও প্রদত্ত সতর্কতা আমলে না নিয়ে, তিনি আসলে সংশােধন অযােগ্য প্রচণ্ড রকমের ভুল করেছিলেন।
৬। এটি আমাদের উপলব্ধিতে অগম্য যে কীভাবে একজন জেনারেল বিশ্বাস করলেন। সেই শত্রুকে (আগের অধ্যায়ে আলােচিত) যে শত্রুর শক্তি তাঁর, জানার ভিতরই ছিল। এবং সে-সম্পর্কে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস থেকেই সে বিষয়ে তারবার্তা সংগ্রহ করা শুরু হয়েছিল। শত্রুপক্ষের ছিল ৩টি কর্পস্-এ আনুমানিক ৯টি ডিভিশন। এদের সমর্থনে ছিল কামান দ্বারা সুসজ্জিত বাহিনী। অধিকন্তু, ছিল আরও দুটি দূরবর্তী ব্রিগেড, একটি রিজার্ভ প্যারাসুট ব্রিগেড; ছিল কিছু সংখ্যক গােলন্দাজ ব্রিগেড এবং সীমান্ত নিরাপত্তার (বর্ডার সিকিউরিটির) ৩৫ ব্যাটেলিয়ন। এদের সমর্থনে ছিল বিমানবাহিনীর ১১টি স্কোয়াড্রন। ছিল দুটি সাবমেরিন সম্বলিত নৌবাহিনী, একটি এয়ারক্রাফট, যাতে সংযুক্ত ছিল বহনকারী এবং অবতরণ ক্রাফট যেখানে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য অবতরণ করতে পারত, তার সমর্থনে ট্যাঙ্ক এবং আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০টি ক্রাফ্ট ছিল। ছিল কিছু ব্রিগেড এবং ডেস্ট্রয়ার । এত কিছু জানার পরও তিনি কীভাবে ভেবেছিলেন যে, সেখানে একটি প্রক্সি যুদ্ধ চলবে।
৭। শত্রুপক্ষের শক্তির এ ধরনের ভয়ংকর বৃদ্ধি (বিল্ড-আপ) সম্পর্কে জানার পরও তা অগ্রাহ্য করে কারও পক্ষে চক্ষুবুজে থাকা প্রকারান্তরে বাস্তবতার প্রতি অবজ্ঞা বৈ কিছু নয়। সেসঙ্গে তা বড়াে মাপের একটি অবহেলা। তাই এটি চূড়ান্ত শাস্তিযােগ্য অপরাধ।
১১৭
৮। এখন যে আবেদন করা হচ্ছে তা একটি খাটি ভুল (বােনাফাইড মিসটেক), এই অর্থে যে, যদি তার পরিকল্পনায় কোনাে প্রকার ভুল হয়ে থাকে, তবে জিএইচকিউ অথবা ঊর্ধ্বতন কমান্ড তা সংশােধন করে দিতে পারতেন। এমনকি তাঁকে সরিয়ে যােগ্য অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারতেন। এমতাবস্থায়, আমরা উর্ধ্বতন কমান্ডকেও দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারি না। এটি উত্তমভাবেই অনুমিত হয় যে, তারা নিশ্চিতভাবেই ছিলেন চুপচাপ; ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল তা তাদের নকশা অনুযায়ীই করা হয়েছিল। যেমনটি আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে বলেছি; জিএইচকিউ-এর সামরিক শক্তি প্রয়ােগের আকাক্ষা যা ছিল; সম্ভবত তা তারা ভারতের সঙ্গে অগ্রগামী হওয়ার জন্য পশ্চিম ফ্রন্টে অধিকতর সুযােগের জন্য ধরে রেখেছিলেন। সেখানে ছিল প্রায় সমতাজনিত অবস্থা। এমনতর সমতাবস্থা হয়তাে আর কখনাে ফিরে আসবে না। সুতরাং, এই সুযােগের সদ্ব্যহার করা দরকার বলে তারা ভেবেছিলেন। সে কারণে, দরকষাকষিতে সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান বাদ হয়ে পড়েছিল। আমরা পুনরাবৃত্তি করে বলছি যে, আমরা এই অনৈতিক এবং বিকৃত চিন্তাচেতনাকে ঘৃণা করছি। এ ধরনের মনােভাব ও ঘটনা আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। এ কারণে, আমরা। ইতােমধ্যে জড়িত সকল নেতৃত্বের বিচারবােধকে ঘৃণা করেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তাঁরা দেশের লক্ষ্যকে সে সময় যথার্থভাবে উপলব্ধি ও সে মতাে কাজকর্ম পরিচালিত করতে তারা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
১১৮
৪৩
সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি পর্বের অবস্থা
১। আমাদের মূল প্রতিবেদনে আমরা সাধারণভাবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি পর্বের বিষয়ে কিছু আলােচনা করেছি। সেই আলােচনা মূলত ছিল এর বস্তুগত ও প্রশিক্ষণগত অবস্থা সম্পর্কিত। ইস্টার্ন থিয়েটার সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তা চিন্তারও বাইরে বিষন্ন প্রকৃতির এবং সাংঘাতিক রকমের অনুশােচনাযােগ্য।
২। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে ইস্টার্ন থিয়েটার, ইস্টার্ন কমান্ড নামেই পরিচিত ছিল। যদিও তা একজন লে. জেনারেলের কার্পস কমান্ডের দ্বারা চালিত হতাে। কিন্তু তা ছিল এক ডিভিশন সমৃদ্ধ গ্যারিসন প্রকৃতির। কিন্তু দ্রুত সেই শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এবং এজন্য বাহিনী সিংহল হয়ে আকাশ পথে পরিবহণ করা হয়। পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে সেই শক্তি ৩ ডিভিশনের কাছাকাছি পৌছে যায়। যদিও এটি ছিল স্মরণীয় ঘটনা। কিন্তু বিষয় হলাে, বিমানপথ হওয়ার দরুন কেবল সৈন্যই বহন করা গিয়েছিল শুধুমাত্র হালকা ধরনের অস্ত্রসহ । পরবর্তীতে কিছু মধ্যমভারী আকারের অস্ত্রশস্ত্র সমুদ্রপথে আনা হয়েছিল। আর এটিই ছিল সমগ্র ।
৩। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল
১. ইস্টার্ন কমান্ডের সদরদপ্তর।
২. ১৪ ডিভিশন সংবলিত সদরদপ্তর।
৩. ৪ ব্রিগেড সদরদপ্তর।
৪. ১২ গােলন্দাজ ব্যাটেলিয়ন।
৫. একটি ট্যাঙ্কবাহিনী (রেজিমেন্ট) [এই বাহিনীটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তনিদের দ্বারা মিশ্রভাবে গঠিত ছিল। এর ছিল সেকেলে ধরনের এম ২৪ ট্যাঙ্ক]।
৬. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মিশ্রণসংবলিত একটি কমান্ডাে | ব্যাটালিয়ন; এর ছিল দুটি কোম্পানি।
৭. ৫টি গােলােন্দাজ রেজিমেন্ট (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা মিশ্র অবস্থায় গঠিত)।
৮. একটি হালকা ধরনের বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানির দ্বারা মিশ্রিত)।
৯. ২টি মর্টার ব্যাটেলিয়ন (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা মিশ্রিত)।
১০. এক স্কোয়াড্রন পিএএফ (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা মিশ্রিত)।
১১. চাকরিরতদের মধ্যে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি।
১১৯
৪। এমনকি সৈন্যবাহিনীকে ৩ ডিভিশনে উন্নীত করার পরও, ট্যাঙ্ক এবং গােললান্দাজ বাহিনী ও বিমানবাহিনীর শক্তি কম শক্তিসম্পন্ন রয়ে যায় এবং তা ছিল কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নিচে। দৃশ্যমান হয় যে, মাত্র একটি গােললান্দাজ ফিল্ড রেজিমেন্ট, তিনটি স্বাধীন মর্টার ব্যাটারিজ, চারটি প্রকৌশলী ব্যাটালিয়ন, স্বল্প মাত্রার ভারী সামগ্রী এবং পাঁচটি সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন এর সঙ্গে এটিকে সংযুক্ত করা হয়েছিল (এসব তথ্যাদি জিএইচকিউ-এর রেকর্ড ভাইড স্টাফ স্টুডিও নং ১, পৃষ্ঠা ৬০ থেকে সংগৃহীত)।
৫। এই পরিস্থিতিতে, লে. জেনারেল নিয়াজী তিক্ততার সঙ্গে অভিযােগ করে বলেন যে, “যদিও এপ্রিলের শুরুর দিকে অধিক পরিমাণে পদাতিক বাহিনীর ডিভিশন এলাে, কিন্তু তারা ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রবিহীন এবং গােলােন্দাজ বাহিনীও ছিল অনুরূপ। যােগাযােগ ব্যবস্থার জন্য বস্তুগত সামগ্রী ছিল সীমিত। তাই যদিও এ উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়, কিন্তু বাস্তবে তারা ছিলেন কেবলমাত্র হালকা অস্ত্র সজ্জিত এবং এসেছিলেন মাত্র অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য…। শেষ অবধি পর্যন্ত এই সজ্জার পরিপূর্ণ জৈবিক, পতাদিক এবং ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী বন্দুক ছিল না…। ইস্টার্ন কমান্ডের সদরদপ্তরের একটি নিজস্ব কোনাে একক কার্পসম্পন্ন গােলােন্দাজ বাহিনী পর্যন্ত ছিল না…। এমনতর স্বল্প-অস্ত্রশস্ত্র ও স্বল্পসজ্জিত সেনাবাহিনী কীভাবে যুদ্ধে জয়ী হতে পারে, যখন এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধানে পুলিশি ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করেছে।”
৬। জেনারেলের চূড়ান্ত ব্যাখ্যার ভিতর যুক্তির প্রাবল্য রয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে, ইস্টার্ন কমান্ড ছিল, “অধিকতরভাবে সামরিক আইনের অধীনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। এটি প্রচলিত ধারায় সু-সজ্জিতভাবে শক্তপােক্ত হয়ে সুসমন্বিত তৈরি একটি বিদেশি শত্রুবাহিনীকে মােকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত ছিল না। বিশেষ করে শত্রুপক্ষ যেখানে ছিল ব্যাপক মাত্রায় শক্তিধারী।” এটি প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যে, প্রদেয় তথ্য ও সংখ্যার ভিত্তিতে (যা জিএইচকিউ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ছিল), এটি তিনটি মধ্যম প্রকৃতির গােলােন্দাজ রেজিমেন্টেরও নিচে ছিল। এটি বাস্তবে ছিল কার্যত তিনটি ফিল্ড রেজিমেন্ট, দুটি ট্যাঙ্ক বাহিনী এবং একটি আর এবং এস রেজিমেন্ট সংবলিত ।
৭। বিমানবাহিনী সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, সেখানে ছিল মাত্র এক স্কোয়াড্রন ১৬টি এফ-৮৬ যুদ্ধ বিমান। সেখানে কেবলমাত্র একটি অপারেশনাল এয়ারফিল্ডের ছিল একটি মাত্র ‘লাে-লুকিং রাডার। একটি হাই-লুকিং রাডার ঢাকায় স্থাপিত ছিল। তবে তা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং একটি রেডিওসমৃদ্ধ ‘মােবাইল’ অবজারভার ইউনিট ছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী সেটি অকার্যকর করে দিয়েছিল। সেজন্য এটি মেরামতের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল। সে কারণে শত্রুপক্ষের প্রতি নজর রাখার জন্য আগাম সতর্কতা প্রদানের ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে।
৮। নৌবাহিনী সম্পর্কে যতদূর জানা গিয়েছে, সেখানে কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছিল চারটি গানবােট এবং একটি ডেস্ট্রয়ার-এর মাধ্যমে। এই ডেস্ট্রয়ারটি অবশ্য, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে হয়েছিল। কিন্তু বিদ্রোহী তৎপরতা মােকাবিলা করার জন্য নৌবাহিনীকে উন্নত করা হয়েছিল হাতের কাছে আঞ্চলিকভাবে পাওয়া সাজ-সামগ্রীর দ্বারা। এক্ষেত্রে আইডব্লিউটিএ (অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ)-কে বাতিল করে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন নৌজানগুলাে
১২০
গানবােটের সঙ্গে সংযুক্ত করে নদীপথে নজরদারীর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এবং সেগুলােতে করাচি থেকে আনা ‘বােফোর গান’ সংযােগ দেওয়া হয়।
৯। এসব ঘাটতি ও খুঁত এই সত্য যােগ করতে উদ্বুদ্ধ করে যে, প্রাথমিক ৮ মাস যাবৎ বাহিনী অনবরতভাবে বিদ্রোহীদের দমনে থিয়েটার’ ব্যাপী কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে। আর তা তারা করেছে ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিনিয়ত সীমান্ত এলাকায় কামানের গােলা নিক্ষেপিত স্থানেই শুধু নয়, সেইসঙ্গে এমনসব স্থানেও; যেখানে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয়দের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান গুরুতরভাবে চলাচল বিঘ্নিত করে তুলেছিল।
১০। জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের নিকট থেকে নির্ভরযােগ্য তথ্য আমাদের সামনে আসতে থাকে, যারা পূর্ব পাকিস্তানের সমন্বিত সামরিক হাসপাতালে খোঁজখবর নিতেন, তারা নিশ্চিতভাবে দেখতে পান সেখানে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমতাবস্থায় সেখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখা উত্তরােত্তরভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী- রাজাকার, মুজাহিদিন, শিল্প-নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের মাধ্যমে ভারসাম্যহীনতা দূর করার প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছিল। বিপজ্জনক স্থানে তাদের নিয়ােগ দেওয়া হয়। সেসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষিত পুলিশ এনে তাদের দিয়ে সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে তাদের হাতে দেওয়া হয় বহুপুরাতন ধাঁচের ৩০৩ রাইফেল এবং একটি প্লাটুন কমান্ডের হাতে বড়ােজোর একটি করে সাব মেশিনগান। ভারতের নিয়মিত বাহিনীর সামরিক সাজসজ্জার কাছে এর কোনাে প্রকার তুলনাই করা যায় না। তাদের ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদ্রোহ দমনমূলক কার্যভার তুলে দেওয়া হয়। তারা কেবলমাত্র লড়তেন, “তখন, যখন তারা সেনাবাহিনীর দ্বারা ব্যাক-আপ’ সমর্থন পেতেন, অন্যথায় তারা প্রথম চোটেই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতেন।” তথ্য থেকে আরও দেখা যায়, যখন তারা ভারতীয় বাহিনীকে অগ্রসরমান অবস্থায় দেখতেন, তখন তারা পালিয়ে যেতেন। কেউ কেউ আবার হাতিয়ারসহ পালাতেন। এ অবস্থাকে কোনােভাবেই যুদ্ধের জন্য পুরােপুরি প্রস্তুতাবস্থা বলা যায় না। এর দ্বারা ভারতের অগ্রসরমান আট ডিভিশন সৈন্যকে সকল প্রান্তে প্রতিরােধ করা এবং থামানাে সম্ভব ছিল না। কেননা, ভারতীয় বাহিনী ছিল সার্বিকভাবে প্রস্তুতকৃত গােলােন্দাজ বাহিনী ছিল বিমানবাহিনী; যা প্রতিদিন ২০০ বার শত্রুপক্ষের দিকে উড্ডয়নের সক্ষমতাসম্পন্ন ছিল।
১২১
৪৪
ভারতীয় বাহিনীর হামলার পূর্ববর্তী সময়ে
পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি
১। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণের পূর্বের অবস্থা সম্পর্কে এই অধ্যায়ে ইতােমধ্যে আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন তুলে ধরেছি। কিন্তু তারপর এ সম্পর্কে আমাদের কাছে আরও প্রমাণাদি আসতে থাকে, সেজন্য আমরা এটি সার্বিক ও পরিপূর্ণভাবে পুনর্বার আলােচনার প্রস্তাব রাখি।
২। এইসব প্রমাণাদিগুলাে সুবিধাজনকভাবে চারটি স্তরে আলােচনা করা যায়। যথা :
(১) আওয়ামী লীগের তৎপরতা।
(২) সামরিক বাহিনীর তৎপরতা।
(৩) সেনা অভিযান কার্যক্রম এবং
(8) ভারতের প্রত্যক্ষ হামলা।
আওয়ামী লীগের তৎপরতা :
৩। আমাদের মূল প্রতিবেদনে আমরা উল্লেখ করেছি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নির্ধারিত জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়। এ ঘাষণাটি ১৯৭১ সালের ১ মার্চে দেওয়ার পরে তার প্রতিক্রিয়াও মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য বড়াে বড়াে শহরে চরম মাত্রায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অ-বাঙালিদের বাড়িঘরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগের সাথে ব্যক্তি পর্যায়ে তাদের নানাভাবে নাজেহাল করা হতে থাকে। জনাব এস.এম নওয়াব (সাক্ষী নং ২২০)-এর মতে, “হঠাৎ করেই দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করে এবং কিছু সংখ্যক অ-বাঙালির ওপর অপমানজনক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।” ব্রিগেডিয়ার কাশিম (সাক্ষী নং ২৬৭) অবশ্য বলেন যে, “ঢাকার বাণিজ্যিক অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখা দেখা যায়। বিশেষভাবে অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ চালানাে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সকাল ৯টার সময় সেনাবাহিনী তলব করা হয়, কেননা পুলিশ এবং ইপিআর পরিস্থিতি মােকাবিলা করতে অপারগ হয়ে ওঠে। তারা এমন আচরণ করেছিল হয়তাে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সহমর্মীতার জন্য, অথবা প্রত্যাঘাতের ভয়ে। জেনারেল ফরমান আলী (সাক্ষী নং ২৮৪), আমাদের জানান যে, “সন্ধ্যা ৬টার ভিতর পুলিশ এবং ইপিআর পরিস্থির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ হলাে এই যে তারা নিজেরাও লুটপাট এবং জ্বালাও-পােড়াও এ অংশ নেয়।”
৪। আওয়ামী লীগ এ নিয়ে হৈচৈ বাধিয়ে দেয়। তারা সােনাবাহিনীর হাতে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত গুলি করার ক্ষমতা প্রদানের বিরুদ্ধে বন্য অভিযােগ এনে সাধারণ হরতালের ভিতর দিয়ে পালটা জবাব দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়। এমনকি এ পর্যায়েও
১২২
অ্যাডমিরাল আহসান পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর এবং লে. জেনারেল মােহাম্মদ ইয়াকুব, তৎকালীন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, এরূপ মনােভাব প্রকাশ করেন যে, রাজনৈতিক সমাধান বের করতে হবে। সেজন্য তারা এমন কোনাে কাজ করতে অনীহায় ছিলেন; যে কাজ কার্যত রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনার দরজা বন্ধ করে দিতে পারে। তারা প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনীর প্রধানকে জাতীয় সংসদের আর একটি তারিখ ঘােষণা করা এবং আলাপ-আলােচনা শুরু করার জন্য উদ্বেগজনকভাবে রাজি করাতে চেষ্টা করেন। সেই প্রচেষ্টারই ফল হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চের পরিবর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশনের তারিখ নির্ধারণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। কিন্তু সেইদিনই গভর্নরকে কাজ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। ৪ মার্চ তারিখে তিনি জেনারেল ইয়াকুবের নিকট দায়িত্ব বুঝে দেন।
৫। এই তারিখটি তেমন কোনাে ফলাফল সৃষ্টি করেনি। আওয়ামী লীগ এটিকে সরকারের দুর্বলতা হিসেবে দেখে। তারা জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যােগদানের আগে পুনরায় চার দফা দাবি পূরণের জন্য উত্থাপন করে, যথা-
(১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
(২) অবিলম্বে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
(৩) বিগত কিছুদিন ধরে সামারিক বাহিনীর তৎপরতার কারণে নিহতদের বিষয়ে তদন্ত করতে হবে ।
(৪) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
৬। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দাবি গৃহীত হয়েছিল। নিয়ােজিত এলাকা থেকে অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহারের ঘােষণাটি ৩ তারিখে জেনারেল ইয়াকুব কর্তৃক ঘােষিত হয়। সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার বিষয়টির ঘােষণা আসে তার পরদিন ঢাকায় ফিরে এসে। আওয়ামী লীগের অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন জেনারেল ইয়াকুব খান। কিন্তু তা হবে সেনাসদস্য এবং বেসামরিক প্রশাসনের দ্বারা গঠিত যৌথ তদন্ত রাের্ডের মাধ্যমে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ তারিখে জেনারেল ইয়াকুব খান ঢাকার রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে একটি সম্মিলন তলব করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান এ আন্দোলন যাতে করে অহিংস প্রকৃতির হয় সে ঘােষণা দেন। সেই সময়ের সচরাচর ঘটনা ছিল অবাঙালি এবং অন্যান্য পাকিস্তানপন্থিদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে অগ্নি সংযােগ, লুটতরাজ এবং নারী ধর্ষণের মতাে কাজ। প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্রসহ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের পথে পথে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা মহড়া দিতে থাকে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের প্রাঙ্গণে সেনা-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। জোরজবরদস্তির মাধ্যমে মানুষের দ্বারে দ্বারে তারা অস্ত্র এবং টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতে থাকে। যেসব মানুষ অস্ত্র এবং টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। এমনকি কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অবাঙালি ব্যবসায়ী এবং পােশাজীবীদের শিশু-সন্তান অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হতে থাকে। কেউ কেউ দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ দিয়ে রেহাই পেলেও; যারা দাবিপূরণে ব্যর্থ হন তাদের নির্দয়ভাবে “খতম” করে দেওয়া হয়।
১২৩
৭। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে আওয়ামী লীগ যেসকল নৃসংশমূলক তৎপরতা পরিচালিত করেছে, সেসব বিষয় অন্য একটি অধ্যায়ে অধিকতর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হবে। এখন আমরা শুধুমাত্র উল্লেখ করতে চাই যে, ১৯৭২ সালে আমাদের সম্মুখে প্রত্যক্ষ সাক্ষীর মাধ্যমে যা জানা গিয়েছে তার ভিতর দিয়ে ঘটনার সত্যতার নিশ্চয়ন মিলেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অবধি সময়ে আওয়ামী লীগ বড়াে মাত্রার নৃশংসতামূলক তৎপরতা চালিয়েছিল। তাদের ছিল সামরিক শাখা। সংগ্রাম পরিষদ এবং ছিল বিশৃঙ্খলমুখী জনতা। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে অপরাধী হিসেবে যারা কারাগারে বন্দি ছিলেন তাদের মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম-আন্দোলন করে যাওয়া হচ্ছিল।
৮। আমরা ইতােমধ্যে মন্তব্য করেছি যে, কীভাবে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের সামরিক কার্যকলাপের দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল হিসেবে ১৯৭১ সালের ৪ মার্চের পর হতে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকারি, আধা-সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক এবং বিচার বিভাগের স্বপক্ষত্যাগীদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সংবাদ মাধ্যমগুলাে আওয়ামী লীগের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রত্যাশা করে; তারা সেভাবেই খবর-বার্তা পরিবেশন করতে থাকে। কার্যত সরকার আওয়ামী লীগের নির্দেশে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী চলতে থাকে। এজন্য তারা এমনকি প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করারও প্রয়ােজন মনে করেনি।
৯। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে এক বিশাল জনসভায় স্বাধীনতা ঘােষণার একতরফা ভীতি প্রদর্শনপূর্বক বক্তৃতা দেন; যার কোনাে প্রকার ব্যাখ্যা নেই।
১০। জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা দাবি করেন যে, উক্ত জনসভার আগে একজন গুপ্তচরের মাধ্যমে তাঁর কাছে শেখ মুজিব খবর পাঠান যে, তাঁকে যেন বন্দি করা হয়। ১৪ ডিভিশনের জিওসি জেনারেল এতে করে কিছু জঘন্য এবং ফাউল। রকমের খেলার আগাম গন্ধ পান। সেজন্য তিনি গুপ্তচরের মাধ্যমে ফেরত বার্তা প্রেরণ করে বলেন এ ধরনের কোনাে কাজ তিনি করবেন না। তবে একতরফাভাবে যদি স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়া হয়; তাহলে তিনি বন্দুক এবং গােলাবারুদের ভাষায় তার জবাব দেবেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর এমন কথা হয়তাে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘােষণার মতাে কাজ থেকে বিরত রাখবে। কিন্তু বাস্তবে তার এ ধরনের কোনাে খবর কাজ দেয়নি। বরং শেখ মুজিব একভাবে না একভাবে স্বাধীনতার ঘােষণার কথা ব্যক্ত করেন।
১১। এটি অবশ্যই তাঁর অবস্থানগত শক্তি সামর্থ্যের কারণে ঘটেছিল। শেখ মুজিব জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক দুই দুই বার পশ্চিম পাকিস্তানে আমন্ত্রিত হয়ে আলােচনার প্রস্তাব কর্ণপাত না করে বরং তিনি উলটো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ঢাকা এসে তাঁর আতিথ্য গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান।
১২। রাষ্ট্রীয় দয়িত্বের কারণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ তারিখে ঢাকা আসেন। ঢাকায় এসে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের জন্য আলাপ-আলােচনা ও দরকষাকষি আরম্ভ করতে চান। এটি দৃষ্টিগােচরে আসে যে, সে-সময় রাষ্ট্রপতি ভবনে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে শেখ মুজিবের একক নির্দেশে তা আবার চালু করা হয় ।
১২৪
১৩। সেনাবাহিনী সেই সময় কেবল যে ব্যারাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাই নয় সেইসঙ্গে তাদের চলাচলের ওপরও ছিল বাধানিষেধ। তারা নিরাপত্তার কারণে খুব কমই বাইরে আসতেন। যখন তারা বাইরে আসতেন তখনই তারা নানারূপ অপমানজনক অবস্থার মধ্যে পড়তেন। এমনকি তারা নাজেহালের শিকার হতেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নিষেধ থাকার দরুন এর বিরুদ্ধে কোনােরূপ ব্যবস্থা নিতে পারতেন না। সেনাবাহিনীর জন্য নতুন রেশন বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেননা, আওয়ামী লীগ রেশন সরবরাহকারীদের সেনানিবাস এলাকায় প্রবেশের ওপর বাধা বিপত্তি সৃষ্টি করে। এমতবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানের সাহায্যে সরবরাহ ঠিক রাখা হয়, (সাক্ষী নং ২৩৩ জেনারেল আনসারীর সাক্ষী নং ১১৩ জেনারেল টিক্কা খান, সাক্ষী নং ২৭৪ জেনারেল ফরমান আলীর ভাষ্য মতে)
১৪। উশৃঙ্খল জনতার মারমুখী কার্যকলাপ সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে। ১৪ মার্চ ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি ঘটনার মাধ্যমে ঢাকার অদূরবর্তী জয়দেবপুর বাজারের কাছাকাছি যখন সেনাবাহিনী একটি সামরিক ট্রাকে করে চলাচলরত ছিল তখন তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। রাস্তায় ছিল প্রতিবন্ধকতা, যাতে করে কেউ চলাচল করতে না পারে (সাক্ষী নং ১১৩ জেনারেল টিক্কা খানের ভাষ্য)। এ ঘটনায় সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার জন্য পালটা গুলি ছােড়ে। এ ঘটনাটি এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সরকারের বিশ্বাস ভঙের অভিযােগ হিসেবে উচ্চারিত হয়; এভাবে যে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘােষণা ও প্রতিশ্রুতি পালন। করা হয়নি।
১৫। আমাদের মূল প্রতিবেদনে আলােচনা ও দরকষাকষির বিষয়টির অগ্রগতির বিবরণ দিয়েছি। এখানে আমরা অতিরিক্ত কিছু সংযুক্ত করতে চাই, আর তা হলাে; সেই আলাপ-আলােচনার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং শেখ মুজিব ২৩ মার্চ ১৯৭১, আগমণ করেছিলেন গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দুলিয়ে। সে সময় ঢাকা শহরে একটিমাত্র ভবনে পাকিস্তানের পতাকা উড্ডয়নরত ছিল। আর তা হলাে রাষ্ট্রপতি ভবন। এছাড়া আর সকল ভবনেই বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল।
১৬। কর্তৃপক্ষ কেন সেই সময় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে নিষ্ক্রিয় ছিল, সে বিষয়ে চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যাওয়ার কোনাে প্রকার ইচ্ছা আমাদের নেই। এমনকি সামরিক বাহিনীর কোনাে কোনাে সাক্ষী বলেছেন যে, এই নিষ্ক্রিয়তা ছিল ইচ্ছাপূর্বক। একটি ভুল ধারণাকে ধরে নিয়ে; তা হলাে এই যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যেখানে শেখ মুজিবের পক্ষেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। আর সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা। ফিরিয়ে আনার জন্য অনুরােধ জানাতে বাধ্য হবে। (সাক্ষী নং ২৫৩) ব্রিগেডিয়ার সালাহউদ্দিন তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এভাবে বলতে আরম্ভ করেন, “ডিএমআই এর মতে কেন্দ্রীয় সরকার দেখাতে চেয়েছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান সরকার পরিচালনায় নিজে সফল হবেন না। সেই অবস্থায় সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতা স্বপ্রমাণিত হিসেবে গণ্য হবে এবং বৈধতা অর্জন করবে।”
১৭। বলা যায়, এমনটি ঘটেনি। বিপরীতভাবে সরকারি নিষ্ক্রিয়তার ফলাফল হিসেবে বরং পরিস্থিতির কাছে সার্বিকভাবে আত্নসমর্পণ করা হয়েছিল। এ কারণে আওয়ামী
১২৫
লীগ উত্তরােত্তর তাদের অবস্থা আরও শক্তিশালী করার স্পর্ধা এবং সুযােগ পেয়েছিল। অধিকন্তু বলা যায়। এর ফলেই বেসামরিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ও আধা-সামরিক চাকরিরত ব্যক্তিদের আনুগত্য হারাতে হয়।
১৮। জেনারেল নিয়াজী তার বক্তব্যে দাবি করেন যে, হেডকোয়ার্টার, এমএলএ, জোন ‘খ’, তার সিগন্যাল নং এ ৬০০৭, তারিখ ১২ মার্চ, ১৯৭১, এর দ্বারা এটি প্রেসিডেন্টদের এবং জিএইচকিউ এর নিকট পরিষ্কার করে দেয় যে, বাঙালি সেনাবাহিনী, ইপিআর এবং পুলিশের আনুগত্য সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। কেননা, তাদের সমর্থন আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, (বক্তব্য পৃষ্ঠা ১১)। এইসব খবরের পরেও কোনাে প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সেনাবাহিনী আনা হয়নি। অথবা বাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের সতর্ক করে দেওয়া হয়নি। অথবা বলা হয়নি; যদি রাজনৈতিক সমঝােতা ব্যর্থ হয় তাহলে প্রয়ােজনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠিন এবং কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
১৯। ‘আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের গুরুত্ব তাদের কার্যকলাপের দ্বারা হালকা হতে শুরু করেছিল। এমনকি আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন’ তাঁদের বাংলাদেশ গবেষণায় স্বীকার করেছেন যে, ব্যাপক সংখ্যক অবাঙালি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এর অনেক আগেই দেশ ত্যাগের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। ঢাকা সেনানিবাস এবং ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাদেরকে সংগ্রহ করা হয়। নির্দয়ভাবে তাদের মালামাল লুটপাট করা হয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃক স্থাপিত বিভিন্ন তল্লাসী ঘাঁটি (চেকপােস্ট) এলাকায় তাদের মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নেওয়া হয়।
২০। এই পটভূমিতে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান যে মাত্রার সফলতা প্রত্যাশা করেছিলেন; সে মাত্রায় সফলতা আসেনি। তথা কার্যত রাজনৈতিক সমঝােতার মাধ্যমে যা ঢাকায় আরম্ভ হয়েছিল সেই প্রশ্ন সম্মুখে রেখে, যে প্রশ্ন নিয়ে ইতােমধ্যে আমরা আমাদের মতামত প্রকাশ করেছি। বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করতে আমরা এখানে উল্লেখ করছি যে, সেই সমঝােতা ভণ্ডুল হবেই যতক্ষণ পর্যন্ত না জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের দাবিগুলাে শুধুমাত্র কতিপয় প্রধান সুবিধার বেলায় ছাড় না দেন। বিষয়গুলাে ছিল বৈদেশিক নীতি, বৈদেশিক সাহায্য, টাকা এবং রিজার্ভ ব্যাংক সংক্রান্ত। ফেব্রুয়ারি মাসেই রাওয়ালপিন্ডিতে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওই সকল বিষয়ে কোনাে প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। তবে এর জন্য অজুহাত লাগবে। এখানে তাই প্রতীয়মান হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের “আনুগত্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার” কর্মকাণ্ডসমূহ অবলােকন করা হচ্ছিল।
সামরিক অভিযান/তৎপরতা (অ্যাকশন) :
২১। রাজনৈতিক সমঝােতা ও দরকষাকষি সম্পর্কে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, তা প্রতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে কখনাে আমরা ব্যর্থ হইনি। তবে এখনও পর্যন্ত জানতে পারিনি আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ অথবা পিপলস পার্টিকে না জানিয়ে গােপনে ছদ্দবেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানিক রীতি মাফিক পিপলস্ পার্টির প্রতিনিধিকে জানানাে হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট ইস্টার্ন কমান্ডের দপ্তরে খাওয়া-দাওয়া করতে গিয়েছেন। অথচ, সত্যিকারভাবে তিনি তখন করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন, এই
১২৬
নির্দেশ দিয়ে যে, তাঁর বিমান করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছার পরপরই সামারিক অভিযান (অ্যাকশান) শুরু করতে হবে। ১৯৭১ সালের মার্চের ২৫ এবং ২৬ তারিখের প্রায় মধ্যরাত নাগাদ সেনাবাহিনী ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে সরকারি কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা কল্পে এবং সামরিক অভিযানের (অ্যাকশনের) অভিপ্রায়ে কুখ্যাতিপূর্ণ কার্যক্রম আরম্ভ করে।
২২। এই সম্পূরক প্রতিবেদনের অপর একটি অংশে পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এক ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়ােজনয়ীতা অত্যাবশ্যক ছিল মর্মে আমরা মনােভাব পােষণ করেছিলাম। কেননা, সেখানে সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কেবলমাত্র একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক মীমাংসার পটভূমি থেকে তা বিবেচ্য ছিল। দুর্বলতা নয় বরং শক্তির বিবেচনায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেসময়ের সামরিক আইনসম্পন্ন সরকার বিষয়টিকে নিজেদের দুর্বল অবস্থায় নিয়ে এসেছিল। জেনারেল নিয়াজী; প্রসঙ্গত তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, রাজনৈতিক মহাদুর্যোগকে তারা “সামরিক বিজয়ের পর্যায়ে আনেননি। দুর্ভাগ্যবসত, এ ধরনের পদক্ষেপ ও পরিস্থিতি এসে পড়েছিল। আকস্মিক পরিকল্পনাটি (কন্টিনজেন্সি প্ল্যান) ‘অপারেশন ব্রিজ হিসেবে পরিচিতি পায়। আর এটি আগেই জেনারেল ইয়াকুব কর্তৃক প্রস্তুত করা হয়েছিল । এটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বহাল ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গৃহীত সামরিক কার্যক্রমটি তা থেকে উদ্ভূত ছিল; এমন বলা যাবে না। এক ধরনের দ্রুত পরিকল্পনা, বলা হয়ে থাকে; সম্পন্ন করা হয়েছিল সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, যে অবস্থায় গােয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল ৩ টায় সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই গােয়েন্দা প্রতিবেদনের সত্যতা প্রতীয়মান হয় এবং তা নিশ্চিত করা যায়। কেননা, আমরা নিশ্চিত হয়েছি; যখন সেনানিবাস থেকে বাহিনী অভিযানের (অ্যাকশনের) জন্য বের হয়; তখন তারা রাস্তাঘাটে বেরিকেট বা প্রতিবন্ধকতা দেখতে পায় । ফার্ম গেইট এলাকা থেকে আরম্ভ করে সেনানিবাসের বাইরের গেট অবধি তা বিস্তৃত ছিল। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু সাক্ষী বলেন যে, ২৫ মার্চ, ১৯৭১ মধ্যরাত্রে ঢাকার রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। অপরদিকে কিছু বেসামরিক সাক্ষীর মতে সামরিক অভিযানের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার দরুন আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রাপথ বাধাগ্রস্ত করতেই রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সাক্ষী নং ২৬০, কর্নেল মনসুরুল হক, আমাদের বলেছিলেন যে, “সেনাবাহিনী বিদ্রোহের ঘটনা আগে আঁচ করেনি, কিন্তু বিদ্রোহ নিক্ষেপণ (ইনজেকটেড) করেছিল।”
২৩। জনাব এস, এম নওয়াব, সাক্ষী নং ২২০, “আমাদের বলেছিলেন ২৫ মার্চ, ১৯৭১, রাত ৯ টায় ঢাকার সকলেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এই সময়ের নিকটবর্তীতে কিছু বাঙালি রাস্তাঘাট বন্ধ করতে এবং রেলপথের ওপর ওয়াগন স্থাপন করতে থাকেন। ২৪। জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে এখন প্রতীয়মান হয় যে, সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে ১৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঢাকায়
১২৭
আসার পরেই আলােচনা করা হয়েছিল। ২৩ মার্চ ১৯৭১, তারিখে এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করার অভিপ্রায়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল ।
২৫। বর্তমান চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল টিক্কা খান, ১৯৭২ সালে ১৯৭১ সালের ঘটনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে বলেন, “২৩ মার্চ বিকেল বেলা আমাকে ২৪ মার্চের জন্য অভিযান পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলা হয়…। ঢাকার জন্য কার্যকর হবে; এমন একটি পরিকল্পনা প্রেসিডেন্ট এবং চীফ অব স্টাফ এর নিকট ব্যাখ্যা করা হয়।”
২৬। জেনারেল রাও ফরমান আলীও স্বীকার করেন যে, ২৩ তারিখে তাদেরকে একটি আকস্মিক (কনটিনজেন্সি) পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছিল। জেনারেল ফরমান আলীর সূত্র মতে, “জেনারেল টিক্কা খান এবং খাদিম হুসাইন রাজা তার সঙ্গে এ কাজের জন্য সংযুক্ত ছিলেন। এটি সাধারণভাবে ‘অপারেশন ব্রিজ অনুসরণ করেই প্রস্তুত হয়। এ কাজের জন্য যাদের বাছাই করা হয়, তাদের মধ্যে যারা ঢাকায় ছিলেন, এ পরিকল্পনা মােতাবেক, ৬৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। চিহ্নিত বাড়িগুলােতে বাছাই করে সেখানে বাহিনীর সদস্যদের প্রেরণ করতে ব্রিগেডিয়ারকে বলা হয়। কিন্তু জেনারেল ফরমান আলীর মতে, “প্রায় সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ তারা (আওয়ামী লীগের নেতারা) জানতে পেরেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট চলে যাচ্ছেন। সুতরাং, তাঁরাও গা ঢাকা দেন। একজন বাদে, যিনি তাঁর বাসায় থেকে যান। তারা তাদের আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধু-বান্ধবের বাসায় লুকিয়ে যান। তাদের একজন, খােন্দকার মােশতাক যিনি কোনােভাবে নিজের শরীরে ব্যান্ডেজ বেঁধে হাসপাতালে চলে যান।”
২৭। জেনারেল টিক্কা খান আমাদের মধ্যে বিশ্বাস জাগ্রত করার জন্য বলেন তিনি কর্নেল পদমর্যদার সামরিক কর্মকর্তা পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের নিকট সামরিক কার্যক্রম বা অ্যাকশানের বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে তার এই প্রত্যয়টির সত্যতার নিশ্চয় কোনাে সামরিক কর্মকর্তার দ্বারা পাওয়া যায়নি। ঘটনার কার্যক্রম বা পরম্পরার দ্বারাও তা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে না। ঢাকাস্থ সরবরাহ সংশ্লিষ্ট সামরিক কর্তাদের একজন এটি অস্বীকার করেন যে, তিনি তার কাছে এমন সারসংক্ষেপ (ব্রিফিং) করেছিলেন (বক্তব্য মেজর জেনারেল আনসারী সাক্ষী, নং ২৩৩)। যদি সত্যিই এভাবে তাদের বলা হতাে, তাহলে পক্ষত্যাগীদের দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা ও তাদের পরিবার পরিজনের জীবন (যারা নিহত হয়েছিলেন) হয়তাে রক্ষা করা যেত।
২৮। জেনারেল ফরমান আলীর মতে পরিকল্পনাটি সাজানাে ছিল নিম্নরূপ “আমার ধারণা ছিল এমন যে, আমরা এক ধরনের কু ঘটানাে এবং তার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দখল নিয়ে নেব। জনগণকে সাময়িক সময়ের জন্য ঘরে বন্ধ করে রাখা হবে। যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হবে।” কিন্তু জেনারেল বলতে থাকেনসামরিক প্রস্তুতির পর্বে সেনাবাহিনী যখন যাত্রা করল, তখন আওয়ামী লীগ অলসভাবে বসে থাকল না …। তারাও প্রস্তুতি সহকারে এই পরিকল্পনার প্রতিবাদে প্রায় একই ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করল। জেনারেল ওসমানীর (সে সময়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল) দ্বারা তারা একটি সামরিক শাখা প্রস্তুত রেখেছিল।
১২৮
তারা ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন কমান্ডারদের নিয়ে মিটিং করলেন। এর সঙ্গে ছিলেন মুজাহিদিন, রাজাকারগণ* এবং তাদেরও একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত ছিল। সেই পরিকল্পনা মাফিক তাঁরা সামরিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আর একটি সামরিক কার্যক্রম দৃশ্যমান করেছিল। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে, এসব বিষয়ে খবর যখন তাদের নিকট পৌছায় তখন সামরিক কার্যক্রম আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও, জেনারেল কর্তৃক যা উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল- “রাস্তার প্রতিরােধ অপসারণ করে নীরব আক্রমণকে সরব আক্রমণে পরিণত করা।” এবং প্রয়ােজনের তাগিদেই পিলখানাস্থ ইপিআর সদস্যদের এবং আর্মড পুলিশকে ব্যারাকে নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্র করার দরকার ছিল। ইপিআর সদর দপ্তরের অপারেশন ছিল সহজ প্রকৃতির। সেখানে কোনাে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের একজন মেজর আহত হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ ব্যারাক এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। কেননা, বাহিনী সেখানে প্রথমে গুলিবর্ষণ করেছিল।
২৯। এই সাক্ষীর মতে, রাস্তার প্রতিবন্ধকতা কোথাও কোথাও ছিল তীব্র। এমনকি তা ৬ ফুট দেওয়ালের মতাে। অন্যান্য স্থানে প্রচুর সংখ্যক গাছপালা, ট্রাক এবং বিভিন্ন প্রকার অকেজো মােটরজান দ্বারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল। রাস্তার প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রয়ােজন পড়েছিল অগ্নিসংযােগের। ধারণা করা হয়েছিল; প্রতিবন্ধকতার আড়ালে থেকে তারা গুলিবর্ষণ করবে। তবে জেনারেল জোরের সঙ্গে বলেন যে, “কারও বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার গুলিবর্ষণ করা হয়নি।”
৩০। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সম্পর্কে তিনি এ কথা পুনরায় অস্বীকার করেন যে, সেখানে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়ােগ করা হয়েছিল। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয় দুই মাসের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়েছিল। সকল ছাত্রাবাস খালি করা হয়েছিল। তথাপিও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যখন সেনাবাহিনী গিয়েছিল তখন সেখানে প্রায় তারা চারঘণ্টা ধরে গুলিবর্ষণ করেছিল। এই পর্যায়ে ব্যাটালিয়ান একটিমাত্র রকেট লাঞ্জার নিয়ে যায়। এর দ্বারা তারা গােলা নিক্ষেপ করেছিল মানুষ হত্যা করার অভিপ্রায়ে নয়, বরং ভয়ভীতি ছড়ানাের উদ্দেশ্যে। যেন তারা ভিতর থেকে বের হয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে।।
৩১। তাঁর মতে, এতদ্ব্যতীত, সমগ্র ঢাকায় এ ধরনের সামরিক অভিযানে ১৩৯ লােক হতাহত হয়েছিল। ৬০ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। এর বিপরীতে একজন কর্মকর্তাসহ সর্বমােট চারজন সেনা আহত হন মেশিনগান এবং রাইফেলের গুলিতে । বেসামরিক এলাকায় নিহত-আহত হওয়ার বিষয়ে জেনারেল বলেন ১৩৯ জন নিহত হয়। এক্ষেত্রে কতজন আহত হয়েছিলেন সে বিষয়ে জেনারেল তথ্য জানবার মতাে অবস্থায় ছিলেন না।
৩২। এখানে আরও একজন সাক্ষীর বিষয় উল্লেখ্য, জনাব মােহাম্মদ আশরাফ, ঢাকার অতিরিক্ত কমিশনার (সাক্ষী নং ২৭৫) তিনি আমাদের বলেন যে, এই সামরিক
———————————————-
* আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বেচ্ছাসেবক/বিদ্রোহীদের এখানে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে – অনুবাদক
———————————————-
১২৯
কার্যক্রমের কারণে ঢাকা এবং এর শহরতলী এলাকার নিহতের সংখ্যা যথাক্রমে পাঁচ শত এবং এক হাজার।
৩৩। ব্রিগেডিয়ার কাশিম (সাক্ষী নং ২৬৭), যথাক্রমে এই সামরিক অভিযানে কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন, বলতে আরম্ভ করেছিলেন যে, “২৫ মার্চ, ১৯৭১, ঢাকায় সংঘটিত কার্যক্রম সুসজ্জিত ও পরিকল্পিত কোনাে যুদ্ধ ছিল না। সেনা-সদস্যগণ প্রতিশােধ পরায়ণ এবং রাগান্বিত হয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়ােগ করেন।”
৩৪। জেনারেল এ সবকিছুই অস্বীকার করেন। তিনি এ কথাও অস্বীকার করেন যে, সেখানে গণকবর গড়ে তােলা হয়েছিল।
৩৫। তারপর সুনির্দিষ্টভাবে জেনারেলের নিকট জানতে চাওয়া হয় যদি সেখানে আওয়ামী লীগ কর্তৃক তাদের দ্বারা সামরিক কার্যক্রম সংঘটনের কোনাে আগাম সংবাদ হাতে না-ই থাকত তাহলে কীভাবে সামরিক কার্যক্রমের তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করা হলাে? এর জবাবে তিনি বলেন-
“এটি সঠিক নয়। যদি কেউ এ কথা বলে থাকেন যে, আওয়ামী লীগ কিছু করতে যাচ্ছে সে জন্যই আমরা এটি করেছি। প্রায় এইচ ০১৩০ সময়ে আমরা এটি জানতে পেরেছিলাম।”
পরবর্তী সময়ে, যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় সত্যি কি সেখানে নৈশভােজের আয়ােজন ছিল, জেনারেল বলেন-
“আমার মনে হয় সেই আয়ােজন বাতিল করা হয়েছিল। কেননা, প্রেসিডেন্ট ছিলেন গমনােমুখ। সন্ধ্যা ৭টা নৈশভােজের সময় নয়। তবে এটি সর্বতােভাবে সম্ভব ছিল যে, প্রেসিডেন্ট ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলা হয়েছিল তিনি নৈশভােজে যাচ্ছেন।”
জেনারেলের নিকট থেকে এটি শ্রবণ করা আরও উৎসাহব্যঞ্জক ছিল যে, তিনি সামরিক কার্যক্রম আরও আগে সংঘটনের জন্য চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁর কাছে থাকা প্রাপ্ত খবর মতে, আওয়ামী লীগের সকল নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় একত্রিত হয়েছিলেন রাত ৯টা নাগাদ। কিন্তু তাঁকে পরিষ্কার ভাষায় জানানাে হয়েছিল যে-
“প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান করাচির ৪০ মাইলের ভিতর না পৌছা অবধি সামরিক কার্যক্রম আরম্ভ করা যাবে না। কেননা, সেখানে এ ধরনের চিন্তাও মাথায় রাখতে হয়েছিল, আগে কার্যক্রম শুরু করলে প্রেসিডেন্টের বহনকারী বিমান ভারত ভূপাতিত করতে পারে।”
অবশ্য সামরিক কার্যক্রম, ঢাকায় সকাল বেলা সমাপ্ত হয়; এবং তারপর বাহিনী একটি ট্যাঙ্কসহযােগে নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করে। জেনারেল ফরমান আলীর সূত্র অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ উত্তমভাবেই সুরক্ষা করা হয়েছিল। ক্ষুদে বন্দুক ও মলােটব ককটেইল দ্বারা বাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। এই ধরনের বিরােধিতার মুখে নারায়ণগঞ্জে, সামরিক শক্তি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একদিনের ভিতরই সেখানকার প্রধানত ছাত্রনেতাদের দ্বারা পরিচালিত বিদ্রোহী তৎপরতা দূর করা হয়।
৩৬। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তারিখে, খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইপিআর বিদ্রোহ করেছে। সেখানে বাহিনী প্রেরণ করা হয়। দেখা গিয়েছিল যে, সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানি জেসিও-এর সকল সদস্য তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ নিহত হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানি বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে । খুব স্বাভাবিকভাবেই এতে করে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীকে ক্রোধান্ধ করে তােলে। লে. কর্নেল আজিজ
১৩০
আহমেদ খান (সাক্ষী নং ২৭৬) বলেন : “ব্রিগেডিয়ার আরবাব আমাকে বলেন জয়দেবপুরের প্রতিটি বাড়িঘর ধ্বংস করতে। আমি সেই আদেশ যতদূর সম্ভব পালন করেছি।”
৩৭। চট্টগ্রাম সম্পর্কে যা বলার তা হলাে, মেজর জেনারেল এম. এইচ. আনসারী (সাক্ষী নং ২৩৩), তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তানে সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, বলেন যে, ২৪ মার্চ, ১৯৭১, তাঁকে চট্টগ্রাম পাঠানাে হয়। তাঁর সঙ্গে পাঠানাে হয় এস.এস. থেকে মালামাল খালাস করতে জেনারেল খাদিম হুসাইন এবং জেনারেল মিত্থাকে । এমনকি এই পর্যায়েও, তাঁকে জানানাে হয়নি যে, ২৫/২৬ মার্চ রাতে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে যাওয়া হচ্ছে। যাহােক, ২৫ মার্চ প্রায় বেলা ৪টার সময় জেনারেল টিক্কা খান তাকে ফোন করেন এবং বলেন সােয়াত জাহাজ থেকে মালামাল খালাসকারী ২০ বালুচ রেজিমেন্টকে অবিলম্বে যথাশীঘ্র চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জড়াে করতে হবে। তারপরে রাত ২টার সময় তিনি টেলিফোনের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, রেজিমেন্টাল কেন্দ্রে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘটে যাওয়া ঘটনা ও পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে, সাক্ষী নৌবাহিনীর সহায়তায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা নিরাপদ করার বিষয়ে নিজ দায়িত্বে সিদ্ধান্ত নেন। ২৬ মার্চের দুপুর নাগাদ, জেনারেল মিত্থা পুনরায় চট্টগ্রাম আসেন এবং তাঁকে সামরিক কার্যক্রম আরম্ভ করতে বলেন।
৩৮। ঘটনাক্রমে জেনারেল টিক্কা খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তারিখে প্রদত্ত সারসংক্ষেপ সমাবেশে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। যদিও যে কেউই ভাবতে পারেন যে, সামরিক কার্যক্রম-পরিকল্পনাসংক্রান্ত যেকোনাে বিষয়ে তিনি জানবেন এটিই স্বাভাবিক।
৩৯। পূর্ব পাকিস্তান রেজিমেন্টাল কেন্দ্রে নিরস্ত্র করার দায়িত্ব প্রদান করা হয় ২০ বালুচ রেজিমেন্টকে। কিন্তু যখন তারা অগ্রসর হলেন তখনই গােলাগুলি শুরু হয়ে যায় । পরবর্তীতে উপলব্ধি করা গেল যে, কেন্দ্রটি উঁচুস্থানে গর্ত করে আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল । গােলাগুলি রাত এবং পরের দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর বিদ্রোহীরা কালুর১ ঘাটের দিকে সরে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেয়।
৪০। শহরের অন্যান্য অংশে অবাঙালিদের হত্যা, বাড়িঘর লুট করা এবং ধর্ষণের মতাে কার্যকলাপ চলতে থাকে। এমতাবস্থায়, ২৭/২৮ মার্চ রাতে আর একটি ব্যাটালিয়ন, ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়, এবং ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চের মধ্যে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে। তারপর ব্রিগেডিয়ার হাসান চট্টগ্রাম পৌছলে সাক্ষী তাঁর হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেন।
৪১। উপরের বর্ণিত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, পরিস্থিতির প্রকোপে অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তাই সামরিক অভিযানে অভিযানে/কার্যক্রমে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত ছিল বলে মনে করেন। তবে সেখানে জেনারেল নিয়াজীসহ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা মনে করেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনাবলির জের হিসেবে সেনাবাহিনীর ওপর খারাপ প্রকৃতির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছিল। তাঁরা প্রতিশােধ পরায়ণ মনােভাব নিয়েই নেমেছিলেন। যখন তারা জানতে পারলেন কিছু সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা পরিবার
——————————————-
১. কালুর ঘাটকে প্রতিবেদনে কালি ঘাট লেখা হয়েছে -অনুবাদক।
——————————————-
১৩১
পরিজনসহ বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন তখন পরিস্থিতি পুনরায় আরও খারাপ পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যায়।
৪২। সামরিক অভিযান/কার্যক্রম গ্রহণের খবর দেশের একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সীমান্ত এলাকায় যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী তখন পৌছতে পারেনি; সেখানে ইপিআর সদস্যরা সশস্ত্র বিদ্রোহ অব্যাহত রাখেন। বিভিন্ন সেনানিবাসে পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করার পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে, কার্যত পুনরায় সেখানে বিদ্রোহ দেখা দিতে থাকে। নিরস্ত্রকরণ তৎপরতা যশাের, কুমিল্লা এবং রংপুর ব্যতীত অন্যত্র মােটামুটিভাবে সফলতার সঙ্গে করা হয়। এ ধরনের একটি অভিযােগ ওঠে যে, কুমিল্লা সেনানিবাসে নিরস্ত্রকরণসম্পন্ন সেনাসদস্যদের পরবর্তীতে “খতম” করে দেওয়া হয়। একইভাবে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট-এর বিরুদ্ধে রংপুরে নিরস্ত্রকরণসম্পন্ন সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিযােগ ওঠে। তবে এ ধরনের নৃশংসতা বিষয়ে আমরা অন্য একটি অধ্যায়ে আলােচনা করব।
৪৩। এটি প্রতীয়মান হয় যে, যশােরে পূর্ব পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করার পরও (স্বপক্ষত্যাগীরা) সীমান্ত এলাকার ইপিআর সদস্যদের প্ররােচনায় বিদ্রোহ শুরু করেন। তারা অস্ত্রশস্ত্র মজুদাগার কোটের পূর্ণদখল নেয়। এবং সেখানে একটি যুদ্ধ এভাবে অত্যাসন্ন হয়ে পড়ে। উভয় পক্ষেই হতাহত হয়। তবে পরবর্তীতে চূড়ান্তভাবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৪৪। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে নতুন একটি দিক উন্মােচিত হয়ে ওঠে … সেনা-কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। এমনটি আমরা ১৯৭২ সালের প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বাস করেছিলাম। এজন্য ছিল কিছু সুনির্দিষ্ট খবর সেই পরিপ্রেক্ষিতে যে, আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে সেনা-কার্যক্রম শুরু করেছিল। এটি অবশ্যই এই অর্থ বহন করে না যে, আওয়ামী লীগের নিজের সামরিক কার্যক্রমের কোনাে প্রকার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু আমরা জেনারেল ফরমান আলীর সঙ্গে একমত পােষণের পর্যায়ে যেতে পারছি না যে, সামরিক কার্যক্রম আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার দ্বারা সংঘটিত ছিল না। জেনারেল ফরমান আলী যেভাবে বিষয়টি তুলে ধরেন তা হলাে :
“আমার কাছে উভয় প্রতিবেদনই ভুল বলে মনে হয়। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, এটি ভুল । বলতে গেলে বলতে হয় তারা বিদ্রোহ করতে যাচ্ছে এটিও ছিল অসত্য। ” যখন বাস্তবে জিজ্ঞাসা করা হলাে, কেন তাহলে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল, জেনারেল তখন এই ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলেন যে, “প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, তখন সামরিক বাহিনীর ওপর বাজপাখির মতাে নজর রাখতেন এবং সামরিক কার্যক্রম চাইছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানিদের দ্বারা কৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থার আধিপত্য মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এই আক্রমণাত্মক মনােভাবের সঙ্গে যারা ছিলেন। তারা হলেন- জেনারেল ওমার, জেনারেল মিত্থা, জেনারেল হামিদ এবং জেনারেল আকবর।”
৪৫। এটি আমাদের আগের উদ্ভাবিত উপাত্তকেই সমর্থন করে এভাবে যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার দ্বারা পরিচালিত সরকার কখনাে ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব চান না এটি সত্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরুদ্ধারের জন্য তাদের যাবতীয় প্রকল্পই ছিল একটি ধোঁকাবাজি। জেনারেল ফরমান আলী এখন প্রকাশ করে দিয়েছেন যে,
১৩২
শেখ মুজিবকে কোণঠাসা করার সিদ্ধান্ত ইতােমধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসেই গ্রহণ করা হয়েছিল। অতএব, সমঝােতা ও দরকষাকষির যাবতীয় কার্যক্রম ছিল একটি কপটবেশ (ক্যামােফ্লাজ), যার রেশ ধরে সামরিক জান্তা সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের অজুহাত খুঁজে নেয়।
৪৬। জেনারেল ফরমান আলীর বক্তব্যের পুনরুক্তি মূল্যবান বলে মনে হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে যে চিন্তার প্রসার ঘটান তা হলাে-
“এটি সর্বতােভাবে সত্য যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা। হতাে; তাহলে পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যেত । পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনীর হাতে। আমি প্রত্যেক ক্ষেত্রের সঙ্গেই সংযুক্ত ছিলাম। আমি কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর কথা বলতে পারি না। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানির মনােভাব ছিল সর্বতােভাবে এরূপ যে, তারা কোনােভাবেই পূর্ব পাকিস্তানিদের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে অধীনস্তজনক পরিস্থিতি মেনে নেবেন না।”
৪৭। এই চিন্তা যদি সেনাবাহিনীর মধ্যেও বহাল থাকে, তাহলে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের প্রতি তাদের অনীহা ছিল সুস্পষ্ট।
ঝেটিয়ে দূর করার মতাে সামরিক অভিযান/কার্যক্রম
৪৮। পূর্ব পাকিস্তানে সেনা-সদস্য বৃদ্ধি করার তাগিদে বিমানযােগে সেনাপরিবহণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। বিষয়টি আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। সেনা-সদস্যরা তাদের সঙ্গে হালকা ধরনের অস্ত্র আনতেন। ঝেটিয়ে দূর করার মতাে মনােভাবে উজ্জীবিত করে ঢাকা থেকে তাদেরকে বিভিন্ন জেলায় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য পাঠানাে হয়। তা ছিল অভ্যন্তরে এবং তা সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রমাণাদি থেকে দেখা যায় এই অপারেশন, সুপরিকল্পিত প্রকৃতির ছিল না। এর জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহসংক্রান্ত সমর্থনও ছিল না। অতএব, বাস্তবে বিষয়টি দাঁড়াল “ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করার মতাে।
৪৯। বাহিনী যখন বের হয়ে এলাে; তখন তারা ইতােমধ্যে আওয়ামী লীগের নৃশংসতার খবর পেয়েছিল। তারা জানতে পেরেছিলেন; এমনকি তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন এবং কিছু সহকর্মীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা প্রতিহিংসাপরায়ণ মনােভাবসম্পন্ন ও রাগান্বিত হয়েই বের হয়েছিলেন। এইরূপ পটভূমিতে তাদের কেউ কেউ মাত্রা অতিক্রম করবেন; এটি অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু একই সময়ে, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না; যে অবস্থায় তাদের ডাকা হয়েছিল এবং যা সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছিল, সেই পরিকল্পনা ঠিকমতাে কার্যকারিতার দিকে যাচ্ছে কি না তা পর্যাপ্তভাবে নজরদারি করা হয়নি।
৫০। অনেক সেনাকর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, কোনাে গ্রাম বা জনপদ অতিক্রম করার সময় যদি তাদের লক্ষ করে গুলি করা হতাে, তাহলে তার বদলে রকেট লাঞ্চার এমনকি মর্টার দ্বারা প্রতিউত্তর দেওয়া হতাে। ফলে কুঁড়েঘরসহ ঘরবাড়িসম্পন্ন গ্রাম ও জনপদ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত । এটিও সর্বতােভাবে সম্ভব ছিল যে, গ্রামের ভিতর যারা সন্দেহভাজন ছিলেন, তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার বা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার মতাে কোনাে সুযােগ না দিয়েই গুলি করা হতাে। জেনারেল এরূপ মনােভাব ধারণ করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের বৃহত্তর সমর্থক হিন্দুরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণার পশ্চাতে প্রচার চালাতেন। কেননা, তাদের সহধর্মাবলম্বী
১৩৩
ভারত এ বিষয়ে তাদের প্রতি ইন্ধন দিত। আর এ বিষয়টির দ্বারা আমাদের বাহিনী প্রভাবিত ছিল।
৫১। যথাযথভাবে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার কারণে যা বিশ্বাসযােগ্য করে তােলে তা হলাে; কমান্ডের প্রত্যয় ছিল এটি একটি সামরিক প্রচার বা ক্যাম্পেইন’। তাই শত্ৰুপরিবেষ্টিত এলাকায় বাহিনী সেইরূপ আচরণ করবে যেরূপ আচরণ সচরাচর এ ধরনের সামারিক ক্যাম্পেইনে করা হয়ে থাকে । দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেনারেল ফরমান আলীর নিকট থেকে যেদিন জেনারেল নিয়াজী দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন, তিনি বলতে শুনেছিলেন, “রেশন স্বল্পতার যে কথা আমি শুনছি তা সত্য কি না? জোগাড় করে নেবে যা তােমাদের প্রয়ােজন। বার্মায় আমরা তেমনটি করেছিলাম।”
৫২। কিছু সংখ্যক সেনা-সদস্য স্বীকার করেন যে, হিন্দুদের ওপর সহিংসপরায়ণতার মনােভাব আমাদের বাহিনীর মধ্যে ছিল; এমনকি জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাগণও এরূপ মনােভাবমুক্ত ছিলেন না। সিওএএস এবং সিজিএস পর্যন্ত প্রায়ই উপহাস ছলে জানতে চাইতেন কতজন হিন্দু হত্যা করা হলাে।
৫৩। বিদ্রোহী ব্যতীত ভুলবসত যে সাধারণ মানুষও মারা হয়নি; সে সম্ভবনা বাতিল করা যাবে না।
৫৪। এ কথার দ্বারা বলা হচ্ছে না সকল সেনাসদস্য এভাবে অসদাচরণ করেছেন। এমন নজির আমরা পেয়েছি যে, একটি ব্যাটালিয়ন এমনকি কোম্পানির কমান্ডিং কর্মকর্তা বিবেকের দ্বারা চালিত হয়ে কাজ করেছিলেন। তারা লক্ষ্য অর্জন করেছেন। স্বল্প পরিমাণ হতাহত কিংবা কোনাে প্রকার হতাহতের ঘটনা ব্যতীতই।
৫৫। এ ধরনের কাজের ধ্রুপদি উদাহরণ হচ্ছে বরিশাল জেলার পটুয়াখালি শহরের পূর্ণদখল নেওয়ার ঘটনা। লে. কর্নেল হানিফ মালিক (সাক্ষী নং ২৭৯) তিনি একটি গুলিবর্ষণ ছাড়াই এ কাজটি সমাধা করেন এবং নিজে একটি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন।
৫৬। যেভাবে হােক সেভাবেই করতে হবে, এরূপ প্রত্যয় নিয়ে বাহিনী বিদ্রোহীদের দমন করতে সীমান্ত এলাকার দিকে ধাবিত হয়। আর এমনটি ঘটতে থাকে জুন মাসের শেষের দিক থেকে। ইতােমধ্যে প্রায় সকল সীমান্ত এলাকাই মুক্ত করা হয়। সেখানে বিদ্রোহীরা এমনকি স্বপক্ষত্যাগী পূর্ব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদেরও তেমন সাহস ছিল না যে তারা আমাদের সেনাবাহিনীর মুখােমুখি হন। যখন তাদের পক্ষে হতাহত হতাে; তখন তারা দৌড়ে পালাতেন। এমনকি খাকি পােশাকধারী প্লাটুন দেখলেই তারা ভয়ে পালাতেন।
৫৭। অধিকাংশ কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, ইত্যবসরে মােটামুটিভাবে, সরকারি কর্তৃত্ব প্রদেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের কার্যক্রম শুরুর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কেননা, সেনাবাহিনীর দ্বারা কেননা সমাধান কখনাে চূড়ান্ত বা স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। সামরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত সমাধান বা পরিস্থিতি কেবলমাত্র রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য প্রয়ােজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত বা পটভূমি সৃষ্টি করতে পারে। অথচ রাজনৈতিকভাবে সমাধানের কার্যসূচি জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তক ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অবস্থায় চলে গিয়েছিল। এই বিষয়টি আমরা ইতােমধ্যে আমাদের মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। তবে এ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে কার্যরত
১৩৪
কমান্ডারেরা পুনঃপুন তাগাদা দিয়েছিলেন। তিনি এবং তার রাজপাখিতুল্য উপদেষ্টারা এই মর্মে স্থির ছিলেন যে, একজন বিশ্বাসঘাতকের (মুজিবের) সঙ্গে আলাপ-আলােচনা হতে পারে না।
৫৮। এর ফল হিসেবে, অবশ্য নির্বিচারসম্পন্ন, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং এমনকি নিষ্ঠুর নির্দয় কাজকর্ম সামারিক বাহিনী কর্তৃক ঝেটিয়ে দূর কর’ এমন অভিযান/অপারেশন চলাকালে ঘটতে থাকে। তা যে কেবলমাত্র সীমান্ত এলাকায়। বিদ্রোহী তৎপরতা চলতে থাকার স্থানে চলতে থাকল তাই নয়; সেসঙ্গে ২৬/২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে (ভারতীয়দের ঘােষণা মােতাবেক) বাঙালিদের ওপর চলতে থাকল। ফলে বিপুল সংখ্যক হিন্দুজনতা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল। এতে করে আন্তর্জাতিকভাবে পরবর্তী সময়ে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলার সুযােগ এনে দেওয়া হয়েছিল । আমাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত শ্বেতপত্রে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল যে, ২ মিলিয়নের অধিক মানুষ সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিল। অবশ্য ভারত এই সংখ্যাটি অতিরঞ্জিতভাবে দেখিয়েছিল।
৫৯। প্রকৃতপক্ষে কত লােক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গিয়েছিলেন, আমরা এই প্রশ্নটির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হইনি। তবে আমরা উল্লেখ করেছি যে, সীমানা বন্ধ করে দেবার পরও ব্যাপকভাবে সীমান্তের ওপারে চলে যাওয়ার এই স্রোত। সম্পূর্ণভাবে থামানাে যায়নি। বিদ্রোহীরা ভারতে গিয়ে পুনরায় সংগঠিত হয়। তারা গােষ্ঠীবদ্ধ হতে থাকেন। ভারত কর্তৃক স্থাপিত ৩৩টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তারা পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে থাকেন। বিদ্যুৎ এবং প্রাকৃতিক গ্যাস লাইনের ওপর আঘাত হানতে থাকেন। থানা আক্রমণ করতে থাকেন। প্রত্যন্ত এলাকায় বেসামরিক জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তারা এমনকি আমাদের ক্ষুদ্রাকৃতির সেনাবাহিনীর নিবাসে ওঁত পেতে আক্রমণ চালায় (অ্যামবুশ করেন)। তাদের এই গেরিলা তৎপরতার কারণে আমাদের বাহিনীকে বাধ্য করে প্রতি-বিদ্রোহী কার্যক্রমের জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় মনােযােগ দিতে। আর এটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালের মে-জুন। থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত। তখন থেকে তারা “কিছু ভূমি দখল করে” বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সম্মুখে রেখে অগ্রসরমান হতে থাকেন।
৬০। এই দ্বৈত-ভূমিকা অবশ্যই সেনাবাহিনী উত্তম এবং সাফল্যের সঙ্গেই করে যাচ্ছিল।
কিন্তু বাহিনীকে স্বাভাবিকভাবেই দারুণ চাপ নিতে হয়েছিল। ফলে ভিতরে বিদ্রোহী ও বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হয়।
৬১। এই অবস্থায় যখন সেনাবাহিনী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােষ্ঠীতে যুদ্ধ করছিল, তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেবলমাত্র জেসিওস এর নেতৃত্বে কাজ হতে থাকে। এ কথা বলতে আশ্চার্যান্বিত হতে হয় না যে, শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল । কমান্ডের ধারা ব্যাহত হয়ে পড়েছিল। এ বিষয়টি ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমেদ (সাক্ষী নং ২৩২), স্বীকার করেন। জেনারেল রাহীম কর্তৃক প্রদত্ত প্রমাণাদি (সাক্ষী নং ১১৪), জেনারেল আনসারী (সাক্ষী নং ২৮৪), বিষয়টি নিশ্চয়ন করেন এবং বলেন যে, “ঝেটিয়ে দূর কর” এমন কার্যক্রমের ফলে বিবেচনাযােগ্য এবং অপ্রয়ােজনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়, যেমন জান মালের; তেমনি সহায়-সম্পত্তিরও।
১৩৫
৬২। ভূমি থেকে দূরে কোথাও নিজের ব্যবস্থা নিজে করে থাকার (বাস করার) নীতি গ্রহণ করার ফলে বাহিনীর ঝেটিয়ে দূর কর” কার্যক্রম প্রাথমিক পর্বে অন্যান্য পদ বা পদমর্যাদার ভিতরও নিজের ইচ্ছানুযায়ী বসবাস বা অবস্থান করার সুযােগ করে দেয়। পরবর্তীকালে এ ধরনের প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন স্থানে লুটপাটের ঘটনা অনুসন্ধান করা হয়। কর্নেল আওরঙ্গজেব (সাক্ষী নং ২৬৪) প্রকাশ করেন-
“ঢাকায় সিগন্যাল ব্যাটালিয়ানের জিম্বায় একটি উন্নতমানের দোকান ছিল, যার সামগ্রীগুলাে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কর্তৃক সংগৃহীত হয়েছিল বলে কথিত আছে । দোকানে ছিল টেলিভিশন সেটস, ফ্রিজসমূহ এবং মুদ্রাক্ষরিক যন্ত্রাদি ইত্যাদি।”
৬৩। অন্যান্য অনেক কর্মকর্তাও উপযুক্ত বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জেনারেল নিয়াজী এবং অপরাপর জ্যেষ্ঠ সেনা-কর্মকর্তা অবশ্য দাবি করে বলেন যে, যখনই এ ধরনের ঘটনার কথা আসত, তখনই যিনি বা যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতাে। সময়ে সময়ে নির্দেশ প্রদান। করা হতাে বাহিনী যেন এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে গােষ্ঠী গঠনের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়। এ প্রবণতা দমনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় এবং বলা হয় সব ধরনের কার্যক্রম যেন কমান্ডার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
৬৪। আমাদের সম্মুখে শেষ পর্যায়ে এ বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনামার কপি উপস্থাপন করা হয়। তবে সত্য হলাে এই যে, এ ধরনের ঘটনা যে ঘটত তা ওই সব নির্দেশ নামার দ্বারাই নিশ্চিত করা যায়। অর্থাৎ অভিযােগসমূহ ভিত্তিহীন ছিল না। তবে অবশ্যই তা বাংলাদেশ বা ভারতের দ্বারা উত্থাপিত অভিযােগের মাত্রায় ছিল না। তথাপিও, আমরা না বলে পারছি না যে, কমান্ডের ঢিলেমির কারণেই এই ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছিল। এর কারণে যে সব মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক বা বিদ্রোহী ছিলেন না, তারাও বিরােধী শিবিরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এবং আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ফলে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
৬৫। এই সামরিক কার্যক্রম পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মােটামুটিভাবে সফলতার মুখ দেখে। কিন্তু যেমন একজন জ্যেষ্ঠ সেনা-কর্মকর্তা, জেনারেল জামশেদ (সাক্ষী নং ২৪৬), বলেন যে, তারা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুরােপুরিভাবে আনতে পারেননি। জেনারেল মজিদ (সাক্ষী নং ২৫৪), স্বীকার করে বলেন সেনাবাহিনী প্রতিরােধের যাবতীয় পকেটগুলাে পরিষ্কার করতে পেরেছিল। তবে “আত্মঘাতী তৎপরতার ঘটনাগুলাে, যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার মতাে ঘটনা এবং ওঁত পাতা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। বিদ্রোহীরা, দৃশ্যত কাজকর্ম চলমান রাখে ভারতের সমর্থনে এবং যতই সময় পেরােতে থাকে, তাদের এ ধরনের কাজকর্ম ততই যেন মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
২০ নভেম্বরের আগে ভারতের সম্পৃক্ততা
৬৬। ইতােমধ্যে যদিও উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের সম্পৃক্ততা ছিল একেবারে শুরু থেকেই। দেখা যায় ভারত সফলতার সঙ্গে উদ্বাস্তুর বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করে এবং তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। তারা স্বপক্ষত্যাগী পূর্ব পাকিস্তানি সৈন্যদের পুনর্গঠিত করে পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, গেরিলা
১৩৬
তৈরি ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। যাদের মুক্তিবাহিনী নাম দেওয়া হয়; এদের অধিকাংশই ছিলেন আত্মনিবেদিতপ্রাণ যুবক। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। প্রায় সমগ্র সীমান্ত এলাকা জুড়ে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তােলা হয়। সংক্ষিপ্ত এবং নিবিড় প্রশিক্ষণের পরে বর্ষা মৌসুমে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসে (জুন-জুলাই এবং পরবর্তী সময়ে)।
৬৭। জেনারেল আনসারী (সাক্ষী নং ২৩৩) এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন-
“তারা সাধারণত ১০ জন মিলে দল গঠন করে অভিযান/অপারেশন কার্যক্রমে যেতেন। প্রতিটি দলে নেতা অথবা উপ-নেতা থাকতেন একজন হিন্দু কর্মকর্তা। প্রতিটি দলের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সদস্য থাকতেন মুসলমান। বাদবাকি শতকরা ২০ থেকে ৩০ জন সদস্য থাকতেন হিন্দু।”
তারা সারাক্ষণ আমাদের বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখতেন। এইভাবে, “জুলাই মাসের প্রারম্ভ হতে ভারতীয় সৈন্যরা তাদের নিজস্ব বাহিনীর দ্বারা গােলাগুলি ছুড়তে আরম্ভ করেন। আগস্ট মাস থেকে এই তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। ইস্ট বেঙ্গল ইউনিট, ইতােমধ্যে যথাযথভাবে সমরসাজে সজ্জিত হয়। তাঁরা নিজেদের বাহিনীর মাধ্যমে সারা সীমান্ত এলাকাব্যাপী সংঘাত আরম্ভ করে।”
৬৮। অনুরূপভাবে জেনারেল নিয়াজী মতামত প্রকাশ করেন যে, মুক্তিবাহিনী ভারতীয়দের দ্বারা সমর্থিত হয়েই সংগঠিত হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর নেতা বাছাই হতেন বিদ্রোহী ইপিআর এবং ইবিআরের লােকজন থেকে। তারা তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বেও থাকতেন। উচ্চমার্গের আত্মিক প্রণােদনা এবং আক্রমণের জন্য যথাযথভাবে সুসজ্জিত বাহিনী ১৯৭১ সালের নভেম্বর থেকে আমাদের সকল পরিকল্পিত প্রধান প্রধান অভিযান/অপারেশন কার্যক্রমের মুখােমুখি হতে থাকে। তারা মূলত ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা আধুনিক অস্ত্র ও সমরসজ্জায় সজ্জিত হতেন। প্রমাণিতভাবে তারা ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা। সহযােগিতা পেতেন। ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে খবর-বার্তা এবং গােয়েন্দা তৎপরতার বিষয় সম্পর্কে অদ্যপ্রান্ত জানিয়ে দিতেন। আমাদের অবস্থানের পশ্চাতে তারা তাদের বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতেন।
৬৯। জেনারেল আব্দুল মজিদ (সাক্ষী নং ২৫৪) বলেন যে, “সেই সময়ব্যাপী ভারতের নিয়মিত বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’ গােলন্দাজ সজ্জাসহ পাকিস্তানের ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনী এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে আক্রমণ হানতেন। সীমান্ত চৌকিগুলােও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হতাে। আর এতে সহায়তা দিত ভারতের গােলন্দাজ বাহিনী; আবার কখনাে তাদের নিয়মিত বাহিনী।”
৭০। মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্ (সাক্ষী নং ২৪২) তার অধীনস্থ এলাকা সম্পর্কে জানান“-
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে, মুক্তি বাহিনী আমাদের এলাকায় তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। তাদের এ কাজে সমর্থন যােগাত ভারতের গােলন্দাজ বাহিনী। সীমান্ত এলাকাসহ তারা বেশ কিছু সংখ্যক বিওপিএস’এ আক্রমণ চালিয়েছিল। লালমনিরহাট সেক্টরে তাদের কিছু সাফল্য আসে। বুরুংগামারী
১৩৭
অবস্থান আমরা মুক্তি বাহিনীর নিকট হারাই। ১৫ নভেম্বর তারিখে ২৫ পাঞ্জাব কোম্পানিকে বুরুংগামারীতে তারা ঘেরাও করে ফেলে। প্রচুর জানমালের ক্ষতি হয়। অবশিষ্ট ছিটেফোঁটা পিছুহটে আসেন নাগেশ্বরীতে।”
৭১। যেসব তথ্য-প্রমাণাদি এখন আমাদের কাছে এসেছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে ভারতীয়দের তৎপরতা ৯ অক্টোবর ১৯৭১, থেকে জোরদার ও বিস্তৃত হতে থাকে। তখন থেকে তারা তাদের মুখের সকল প্রকার ঘােমটা খুলে দিয়ে প্রকাশ্যে ও প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপমূলক তৎপরতা আরম্ভ করে দেয়। সম্ভবত, তারা এসময়ে এসে উপলব্ধি করেন যে, মুক্তিবাহিনীর একা আমাদের নিয়মিত বাহিনীর নিকট তেমন কোনাে শক্তি নয়। সুতরাং, তারা কখনাে নিজেদের শক্তিতে কিছু অর্জন করতে পারবে না।
৭২। সেইমতাে ভারতীয়রা রংপুর সেক্টরে অমরখানা, বড়াে খাতা এবং মােগলহাটে কামানের গােলা নিক্ষেপ করে। ভারতীয় বিমান ১৩ অক্টোবর তারিখে লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। তারা মােগলহাট এলাকায় বােমা বর্ষণ করে। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ‘জেট’ যুদ্ধ বিমান পুনরায় লালমনিরহাট জেলার রাণীসাইল এবং কালিগঞ্জের ওপর দিয়ে ১৫ অক্টোবর তারিখে উড়ে যায়। অক্টোবর মাসের ২১ তারিখে, ১৬তম ডিভিশন এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা নিয়ে মুক্তিবাহিনী তেঁতুলিয়া দখল করে নেয়। শেষ সময় অবধি (পর্যন্ত) তারা এ দখলদারিত্ব বহাল রাখতে সক্ষম হয়।
৭৩। অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে, ভারতীয়রা, এমনকি পরীক্ষামূলকভাবে ময়মনসিংহ জেলার বান্দরকাঠা চৌকিতে (বিওপিতে) ৬০ রাউন্ড রাসায়নিক গােলা নিক্ষেপ করে।
৭৪। ১৯৭১ সালের ৩রা নভেম্বর তারিখে ভারতের যুদ্ধংদেহী মনােভাব আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এজন্য তারা সীমান্ত চৌকিগুলােতে তাদের নিয়মিত বাহিনীর দ্বারা আক্রমণ করতে থাকে। বিদ্রোহীরা গােলন্দাজ বাহিনী দ্বারা সমর্থিত হতে থাকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ক্রমাগত বিস্তার লাভ করতে থাকে। ফেনী সেক্টরের বিলােনিয়া ভারতীয় এবং বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায় ১৯৭১ সালের ৭ এবং ৯ নভেম্বরের মধ্যে। এজন্য তারা যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল; তা হলাে প্রথমে তারা সীমান্ত চৌকি বাগে এনে ভারতীয় নিয়মিত বাহিনীর দ্বারা তারপর তারা দখল নেবার জন্য বিদ্রোহীদের হাতে তা ছেড়ে দেয়।
৭৫। পবিত্র ঈদের দিন ১৬ নভেম্বর এবং তারপরের সময়ে ১৯ নভেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনার আগাম খবর আসে। ভারতের গােলন্দাজ বাহিনী সকল সেক্টরে গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু যশাের, রংপুর, বাহ্মণবাড়িয়ায় এ আক্রমণ ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত আকারের। ওই একই দিনে ভারতীয়রা মােহাম্মদপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাদের নিয়মিত বাহিনী সহযােগে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসে।
৭৬। ভারতীয় বিমানবাহিনী উত্তরে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও-এর উপর দিয়ে উড়ে যায়। তারা ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে। এর দুদিন আগে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে এরূপ ঘটনা ঘটিয়েছিল। সেইসঙ্গে কাসালংখালেও তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ।
১৩৮
৭৭। এ অবস্থা থেকে, ভারতীয়দের মনােভাব কেমন ছিল তা প্রয়ােজন অতিরিক্ত; তথা পর্যাপ্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এমনকি এর পরও প্রতিটি সেক্টরে যথারীতি এ ধরনের আক্রমণের পরেও ইস্টার্ন কমান্ড তখন মনে এই ধারণা পােষণ করেছিল যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানে ফ্রন্ট খােলা হয়। এতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার মতাে কিছু নেই যে, কমান্ড ঘটনার আঁচ অনুধাবন না করে বরং তা অতিক্রম করে গেছে। এ নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করা হবে।
১৩৯
৪৫
১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাসমূহ
১. লে. জেনারেল নিয়াজী, তাঁর চীফ অব স্টাফ এবং তাঁর কিছু সংখ্যক কমান্ডার উল্লিখিত কার্যকালকে সীমিত-যুদ্ধকালীন সময় হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য প্রণােদিত করতে চেয়েছেন। অনুমেয় যে, এটি তারা করতে চেয়েছেন তাদের খামখেয়ালি বাতিকের জন্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলার কারণে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশক্তিসম্পন্ন যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল। আর এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করাই তাদের এ ধরনের মনােভাবের বাস্তব কারণ। জেনারেল নিয়াজী সদাসর্বদা এই কথাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, “৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা অঘােষিত যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তারা এই সময়কালে যুদ্ধে গভীরভাবে মগ্ন হননি।” সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহসমূহ নাড়াচারা করতে গিয়ে আমরা সেইমত পৃথকভাবে ইস্টার্ন কমান্ডের ভ্রমাত্মক ধারণা তুলে ধরে পুনরায় প্রকাশ করতে প্রয়াসী হয়েছি। যে, কীভাবে ‘থিয়েটারে সেইদিন থেকে যুদ্ধের বিষয়টি অগ্রসরমান হয়ে উঠেছিল।
২। ইতঃপূর্বে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতীয়দের যুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট নকশা সম্পর্কিত খবর তুলে ধরেছি। এর সঙ্গে সৌভাগ্যবসত প্রাপ্ত ভারতীয়দের অভিযান পরিকল্পনা (অপারেশনাল প্লন) আমাদের হাতে এসেছিল এবং ইস্টার্ন কমান্ড যথাসময়ে সে বিষয়ে অবহিত হয়েছিল অক্টোবর মাসে, এমনটি সাক্ষ্য দিয়েছেন জেনারেল জিলানী (সাক্ষী নং ৭২)। তাঁদের চীফ অব স্টাফ জিএইচকিউ’তে ডেকে এ বিষয়টি সম্পর্কে তাদের সার্বিকভাবে অবহিতও করেছিলেন। কিন্তু তারপরও, কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড, তাঁর বস্তুগত পরিকল্পনার মধ্যে কেননারূপ পরিবর্তন ঘটাননি। যদিও ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকেই তাঁর নিকট পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে তাদের নিয়মিত বাহিনীকে ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীভূত করে তাদের কর্মতৎপরতা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতেই (বিষয়টি চলমান অধ্যায়ে নির্দেশিত হবে)।
৩। জিএইচকিউ কর্তৃক প্রদত্ত শত্রুদের কাছ থেকে পাওয়া ভয়ভীতির মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে জেনারেল তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা এঁটেছিলেন। এ পরিকল্পনায় মনে করা হয়েছিল প্রধান আক্রমণ আরম্ভ হবে বগুড়া সেক্টরের হিলির ঘাড় ঘেঁষে। আর এর সম্ভাব্য বিকল্প হবে ভৈরব-দাউদকান্দি-চট্টগ্রামাঞ্চল। এ কারণে ইস্টার্ন কমান্ড
১৪০
১৬ ডিভিশনকে বগুড়া-রংপুর সেক্টরের দায়িত্বে স্থাপন করে। এটিই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী তিনটি ব্রিগেডের দ্বারা গঠিত একটি ক্যাভালরি রেজিমেন্ট। এর হাতে ছিল হালকা এম-২৪ সাফি ট্যাঙ্ক এবং ছিল পাঁচ উইং বিশিষ্ট ইপিসিএএফ। পূর্ব পাকিস্তানে অন্য কোনাে ডিভিশনে এত সমরসজ্জা ছিল না।
৪। পরবর্তী মূল্যায়নে দেখা যায়। অবশ্য, শত্রুপক্ষের আচমকা প্রধান ধাক্কা এসেছিল অগরতলা হয়ে ভৈরব-দাউদকান্দি-চাঁদপুর দিয়ে। এর অনুসঙ্গী তৎপরতা ছিল যশাের হয়ে আসা আক্রমণ। এসব আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ঢাকা দখলে আনা, ধরাশায়ী আঘাত (নকআউট ব্লো) এর দ্বারা। সত্যিকারভাবে যা ভাবা হয়েছিল তাই ঘটল। ভারতীয়রা ইস্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সমাবেশের যাবতীয় ত্রুটিবিচ্যুতি জানতেন। সে কারণে তারা সীমান্ত এলাকায় তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখলেন। এবং এভাবে তাদের প্রতিরােধ ক্ষমতা হ্রাস করে নিজস্ব পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে চললেন।
৫। ইস্টার্ন কমান্ড নতুনভাবে আবির্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যা করল তা হলাে, ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর তারিখে মেজর জেনারেল রাহীম খানের নেতৃত্বাধীন এহক ডিভিশনকে (যাকে ৩০-এ ডিভিশন বলে ডাকা হতাে) বিভক্ত করে ১৪ ডিভিশনের সাবেক এলাকায় দায়িত্ব অর্পণ করল। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামমুখী কুমিল্লা এলাকাকে এই নতুন ডিভিশনের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হলাে। এটিকে নিয়মিত ব্রিগেডের আওতায় এনে তার সঙ্গে যুক্ত করা হলাে দুটি এডহক্ ব্রিগেড, পুরাতুন এম-২৪ হালকা ট্যাঙ্ক বিশিষ্ট একটি বাহিনী, দুটি ফিল্ড ব্যাটারি এবং একটি মর্টার ব্যাটারি, যার দ্বারা তাদের সমগ্র এলাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হলাে।
৬। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত এহক ৩৬-এ ডিভিশনকে আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না। কারণ ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর, জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদের (সাক্ষী নং ২৪৬) মতে “এটি কেবলমাত্র কাগজে, কলমেই ছিল; বাস্তবে নয়। কেননা, এর শক্তির পরিমাণ ছিল একটি এক ব্রিগেড (৯৩-এ) এবং এর অবস্থান ছিল ১০০ মাইল দূরবর্তী স্থানে। যদিও জেনারেল নিয়াজী ভেবেছিলেন এই এডহক সৃষ্টি যেকোনাে ভাবে শত্রুকে বিভ্রান্ত করবে। তাহলে বলা যায় তিনি পুনরায় নিজেকেই মারাত্মকভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত করেছিলেন। শত্রুপক্ষের গােয়েন্দারা মুক্তি বাহিনীর মাধ্যমে এমন অবস্থানে এসেছিলেন, যা ছিল নিয়াজীর প্রস্তুতির চেয়ে অনেক উন্নতমানের। তাদের কাছে ছিল নিয়াজীর হাতে থাকা শক্তি ও অবস্থান বিষয়ে প্রকৃত ধারণা ও জ্ঞান।
৭। প্রাথমিক পর্যায়ের এসব বিবেচনায় আমরা দেখতে পাই কীভাবে বিভিন্ন সেক্টরে এসময় সামরিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। যেমনটি অনুমিত ছিল, ১৯ নভেম্বর থেকে সকল এলাকার কামানের গােলা ব্যাপকভাবে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এতে বােঝার বাকি ছিল না যে, ভারতীয়রা সত্যিকারভাবে যুদ্ধের দিকেই তাদের নিয়মিত বাহিনীকে চালিত করছেন। তাদের সমর্থনে ছিল ট্যাঙ্ক; বিশেষ করে যশাের, রংপুর, ময়মনসিংহ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ময়মনসিংহ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়
১৪১
ইতােমধ্যে দুটি সীমান্ত চৌকি ১৯ নভেম্বর ১৯৭১, এ তারা দখলে নিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ তারিখ থেকেই ভারতীয় বাহিনী চট্টগ্রামাঞ্চলের কাসালংখাল এলাকা অভিমুখে অগ্রসরমান ছিল।
যশাের সেক্টর
৮। এই সেক্টরে ভারতীয়দের ছিল দুটি ডিভিশন । প্রতিটি ডিভিশনে ছিল তিনটি করে ব্রিগেড। এই ডিভিশনের কমান্ডের অবস্থান ছিল তাদের II কর্পস্ কৃষ্ণনগরে । এই ডিভিশনটি আর একটি প্যারা-ব্রিগেড দ্বারা সমর্থিত ছিল। এর অবস্থান ছিল ব্যারাকপুরে । ছিল একটি ক্যাভালরি রেজিমেন্ট, পিটি-৭৬ এবং পিটি-৫৫ ট্র্যাঙ্ক এবং পাঁচ ব্যাটালিয়ন বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। এই সেক্টরের বেসামরিক এলাকা ছিল পুরাে খুলনা (বেসামরিক ডিভিশন), ফরিদপুর জেলা; দায়িত্বে। ছিলেন ৯ম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল এমএইচ আসনারী (সাক্ষী নং ২৩৩), তার ছিল দুটি নিয়মিত ব্রিগেড এবং একটি এক ব্রিগেড। এটি একটি স্বাধীনভাবে সজ্জিত ট্যাঙ্ক বাহিনীর দ্বারা সমর্থিত ছিল। তাদের ছিল এম-২৪ সাফি ট্যাঙ্ক এবং তা তিনটি উইং ইপিসিএএফ দ্বারা গঠিত। এই ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার ছিল প্রথমে যশাের। আর এটি ছিল পরিপূর্ণভাবে উন্নত একটি সেনানিবাস। ছিল বিমান পােত, সেখানে জেট বিমান ধারণের ক্ষমতা ছিল ।
৯। এই শহরটি একটি দুর্গের মতাে করে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে গােলা-বারুদের মজুদ ছিল এবং ছিল অন্যান্য সামগ্রীর পরিপূর্ণতা। তথাপিও, মাগুরায় আরও একটি বিকল্প হেডকোয়ার্টার প্রস্তুত করা হয়েছিল । এটি ছিল মধুমতি নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষে অবস্থিত। যশােরের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সময়ে যােগাযােগ করার জন্য একটি বিকল্প রাস্তাও নির্মিত হয়েছিল।
১০। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যশােরের উত্তরাঞ্চল ছিল অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ অঞ্চল। কারণ, ভারত থেকে আসা আক্রমণ ঢাকা অবধি পৌছার রাস্তা (এপ্রােচ) এখানে অবস্থিত ছিল। কলকাতা যাবার জন্য ভারতের এখান থেকে একটি পাকা সড়ক ছিল। দুটি ব্রড গেইজ রেলপথ ছিল। এই রেলপথের উৎসস্থল ছিল ভারতের কলকাতা। স্থলভূমির দর্শনা ও বেনাপােল দিয়ে এটি পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল। প্রথমটি উত্তরবঙ্গের দিকে পাকশীর হার্ডিং ব্রিজ অভিমুখী ছিল। দ্বিতীয়টি খুলনার দিকে চলে গিয়েছিল।
১১। যদিও এই ভূখণ্ড ছিল বদ্বীপ, নদ-নদী, খাল-খন্দরবিশিষ্ট, যার উৎস ছিল মূল নদী গঙ্গা এবং যমুনা। এ নদী দুটি অতিক্রম করেছিল ভারতের সীমান্ত এলাকা। এলাকাটি ছিল উত্তর ও পূর্বাঞ্চল অধ্যুষিত । অতএব, সে কারণে সামরিক বাহিনীর চলাচল ছিল এখানে জলপথ অতিক্রম স্বাপেক্ষ, কেননা, প্রতি ৭ থেকে ১০ মাইলের ব্যবধানে ছিল নদ-নদী।
১২। এ এলাকার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত ছিল খুলনা। এর দক্ষিণে যুক্ত ছিল সুন্দরবনের বনাঞ্চল। বরিশাল, পটুয়াখালীও ছিল সেইসঙ্গে নদীমাতৃক এলাকা। কিন্তু উত্তরাঞ্চল ছিল আপেক্ষিকভাবে সহজ-অতিক্রম্য, ছিল অপেক্ষাকৃত ভালাে যােগাযােগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। এই এলাকার ত্রিভূজাকৃতিতে, যশাের,
১৪২
ঝিনাইদা-মাগুরা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কেননা, এখান দিয়েই ফরিদপুর ও ঢাকার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণযােগ্য ছিল।
১৩। এই এলাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রশ্নে, ফ্রন্টে দুটি নিয়মিত ব্রিগেড ছিল, যেমন ৫৭ ব্রিগেড; যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মন্জুর আহমেদ এবং ১০৭ ব্রিগেড, নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মােহাম্মদ হায়াত। ব্রিগেডিয়ার মজুরের দায়িত্বে ছিল ঝিনাইদা-কালিগঞ্জ লাইন এবং ব্রিগেডিয়ার হায়াতের নেতৃত্বে ছিল এর দক্ষিণের এলাকা।
১৪। ১৯৭১ সালের ১৯/২০ নভেম্বর তারিখের রাতের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয়রা তাদের আক্রমণ আরম্ভ করেন মূলত বয়রাকে ভিত্তি করে। আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য ছিল ব্রিগেডিয়ার হায়াতের অধীনস্ত এলাকা। এখানে কামানের গােলা নিক্ষেপ আরম্ভ হয়, সমর্থনে ছিল এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক এবং তাদের বিমানবাহিনী। এর দ্বারা তারা শাহজাদপুর, মাসলিয়া এবং চারাবাড়ী সীমান্ত ফাঁড়ি দখলে নিয়ে নেয় এবং তারা গরীবপুর অবধি এগিয়ে আসেন। কিন্তু গবীবপুরের কোবাদাক নদীর তীরের চৌগাছা, গরীবপুরে এসে তারা থেমে যান।
১৫। এটি প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যে, যখন শত্রুরা সীমান্ত ফাঁড়ি নিয়ে নেয়, তখন ব্রিগেড কমান্ডার তার বাহিনীকে কোবাদাক নদীর কাছে তাদের মূল অবস্থানের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। প্রত্যাহার করে নেবার কাজটি সেরে ফেলা হয় রাতের বেলায়। কিন্তু শত্রু ব্রিগেড তাদের অনুসরণ করে এবং পরের দিন দুপুর নাগাদ সময়ে তারা মূল অবস্থানের উপর ট্যাঙ্ক এবং কামানের গােলা নিক্ষেপ করতে আরম্ভ করে।
১৬। ব্রিগেড কমান্ডারের মতে, একই রাতে, শত্রুপক্ষের আর একটি বাহিনী কোবাদক নদী অতিক্রম করে। এ নদীটি ছিল চৌগাছার আট মাইল দক্ষিণের নিমাঞ্চলে। ভূখণ্ড বিশ্লেষণে আগে এই এলাকাকে জলাধার হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ব্রিগেড কমান্ডার আশ্চার্যান্বিতভাবে ২১ তারিখে লক্ষ করলেন যে, শত্রুদের একটি বিরাট শক্তি ব্রিজের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছে বেনাপােলের পশ্চাতে । শার্শায় ব্রিগেড কমান্ডার এই খবর পেলেন। ৩৮ এফ এফ এর ব্রিগেড কমান্ডার মেজর এবং কর্নেল-ইন-কমান্ড তাঁকে জানালের যে, শত্রু সৈন্য যারা চৌগাছার দক্ষিণ দিক দিয়ে অতিক্রম করেছেন তারা পূর্বমুখী হচ্ছেন এবং এমতাবস্থায় চৌগাছার জন্য চলাচল সড়ক বিপজ্জনক ও হুমকীর মুখে পড়েছে। কালিগঞ্জে অবস্থিত ৬ষ্ঠ পাঞ্জাব দুটি কোম্পানিকে তিনি আদেশ করেন এক স্কোয়াড্রন ১১ এম-২৪ ট্যাঙ্ক দ্বারা শত্রুপক্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে। এটি ছিল প্রায় এক ব্যাটালিয়ন গােলন্দাজ আক্রমণের মতাে। ব্রিগেড কমান্ডারের নিজের নিয়ন্ত্রণে এই প্রতি-আক্রমণের কাজটি সকাল ৬:৩০টায় চালানাে হয়। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর কাছে যে খবর আসতে থাকে তাতে তার উপলব্ধি হয় যে, আক্রমণটি উত্তমভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। তার দুটি কোম্পানি গরীবপুর ব্রিজ দখলে নিয়েছে। এই পর্যায়ে শত্রুপক্ষ চারদিক থেকে গােলাগুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। ফলে সকাল ৭:৩৫ অথবা ৭:৪৫টার মধ্যে প্রতি-আক্রমণ কার্যক্রম চূড়ান্ত হয়ে থেমে যায়। আমাদের দুটি
১৪৩
ট্যাঙ্ক গুলিবিদ্ধ হয় এবং আর একটি অকেজো হয়ে যায়। সকাল ৯:৩০টার এর মধ্যে আমাদের সর্বমােট ৭টি ট্যাঙ্ক ক্ষতির খাতায় যায়। অন্যদিকে শত্রুপক্ষের ৫টি ট্যাঙ্ক শেষ হয়ে যায়। কর্নেল কে কে আফ্রিদী (সাক্ষী নং ২২), প্রতি-আক্রমণ সম্পর্কে জানান যে, এ আক্রমণটি ছিল শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান সম্পর্কে আমাদের দিক থেকে পরিকল্পনাবিহীন।… এ কারণে এ ধরনের আক্রমণ ব্যর্থ হতে বাধ্য”। এর ফলাফল ছিল “মনােবল দুর্বল করে দেবার মতাে” প্রভাব । আমাদের বাহিনীর ওপর তা সাংঘাতিকভাবেই বর্তিয়েছিল।
১৭। শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্কের মার্কা ছিল পিটি-৭৬, এগুলাে ছিল জল এবং স্থলে চলতে পারার মতাে উভচর ট্যাঙ্ক। এর সাজসজ্জা ছিল অদৃশ্য বর্ণসম্বলিত রঙের। ফলে এগুলােকে রাতে দেখা যেত না। তাদের ছিল সামগ্রিক স্কোয়াড্রনসম্পন্ন টি-৫৫ ট্যাঙ্কসমূহ।
১৮। ব্রিগেড কমান্ডার আরও একটি কোম্পানি চালান দিয়ে অগ্রসরমান শত্রু সেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এরপর রাতে পুনরায় আরও এক ব্যাটালিয়ন সেনা যুক্ত করা হয়। এভাবে শত্রুদের অগ্রগতি থামাতে গিয়ে তার মূল্য হিসেবে সাতটি ট্যাঙ্ক খােয়া যায় এবং বিপুল সংখ্যক হতাহত হয়। এই পর্যায়ে বেলা প্রায় ১০:৩০টার সময় ট্যাঙ্ক ফিরে পাবার চেষ্টা করে মাত্র দুটি পাওয়া যায়।
১৯। ইত্যবসরে, চৌগাছায় মুখখামুখি হওয়া শত্রুপক্ষ ব্রিগেড আক্রমণ হানে। এজন্য ব্রিগেড কমান্ডারকে চৌগাছার দিকে সৈন্য পরিচালনা করতে হয়। এভাবে তাদের উৎখাত করার চেষ্টা চালানাে হয়। সেখানে ছিল দুটি কোম্পানি, শত্রুপক্ষের। সৈন্যরা সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করে চলে যান। চৌগাছা এলাকায় তিনি তাঁর দুটি কোম্পানির দ্বারা আরও একটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। তবে এ আক্রমণের দ্বারা শত্রুদের উৎখাত করা না গেলেও তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তারা সে অবস্থায় সেখানেই বসে থাকেন এবং সর্বব্যাপী যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করেন।
২০। গবীরপুরের মুখােমুখি সংঘর্ষে বিমানযুদ্ধও পরিচালনা করা হয়। যেখানে আমরা আমাদের দুটি এফ-৮৬ স্যাভাের জেট বিমান হারাই এবং শত্রুপক্ষের একটি বিমান ভূপাতিত করা হয়। ভারতীয়রা আমাদের তিনটি ট্যাঙ্ক দখল করে নেয়। সেগুলাে তারা বয়রা নিয়ে যায় এবং তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলে যে, পাকিস্ত নি বাহিনী বয়রা এসেছিল। তবে আমরা তাদের বিতাড়িত করে দিয়েছি। এর পরে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম.এ মজিদ (সাক্ষী নং ১৭৭) বলেন, “বিমানগুলাে আকাশে প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত ছিল। সে সময় ভূমি থেকে খুব সামান্যই সমর্থন দেওয়া হয়েছিল।” যদিও দাবির পক্ষে কোনাে প্রমাণ নেই, তবুও এটি বলা যায় যে, বিমান বাহিনী ভূমির সমর্থন পুনরায়ও তেমন পায়নি।
২১। চৌগাছার অবস্থান ক্রমান্বয়ে সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে থাকে। শত্রুরা সে অবস্থায় যশাের বিমানবন্দরের উপর কামানের গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে- যার উদ্দেশ্য ছিল এ যে, তারা পুনরায় অগ্রসর হতে চায়। চৌগাছা ছিল একটি শক্ত ঘাঁটি (স্ট্রংপয়েন্ট)। কিন্তু শত্রুপক্ষের চাপে তা খালি করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় বাহিনীকে প্রত্যাহার করে আফ্রায় নিয়ে আসা হয় ।
১৪৪
২২। ১৯৭১ সালের ২৩-২৭ নভেম্বর পর্যন্ত, শত্রু বাহিনী ফাঁক পেলেই অগ্রসরমান হতে চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে যে একটি ফাঁক-ফোকর ছিল সে বিষয় ব্রিগেড কমান্ডার নিজেও স্বীকার করেছেন।
২৩। ইতােমধ্যে তার সমগ্র বাহিনী গরীরপুরের প্রতি-আক্রমণে নেমে পড়ে। এর মধ্যে ছিল দুটি সংরক্ষিত বাহিনীর একটি অংশ; ৬ষ্ঠ এবং ৩য় স্বাধীন গােলন্দাজ স্কোয়াড্রন। এমতাবস্থায় তিনি ফাঁক পূরণ করার অভিপ্রায়ে এবং পুনরায় যশােরের দিকে শত্রুসৈন্যদের অগ্রসরমানতাকে বাধা দিতে আরও সৈন্য চেয়ে আবেদন জানান। ইত্যবসরে ২২ এফ এফ ব্যাটালিয়ন তুলে নেয়। এই বাহিনী বেনাপােল থেকে ঝিনাইদার দিকে অবস্থান করছিল। তাদেরকে অগ্রিমভাবে শার্শা এবং নাভারনে স্থাপন করেন। কিন্তু থিয়েটার কমান্ডার তার যাবতীয় সংরক্ষিত বাহিনী এবং সমগ্র সম্পদ প্রয়ােগ করার পরও যুদ্ধরত এলাকায় সামগ্রিকভাবে প্রভাব বিস্ত রি করার মতাে শক্তি-সামর্থ হারিয়ে ফেলেন। তাছাড়া সে সময় তার নিকট আর কোনাে বাড়তি বাহিনীও ছিল না। শত্রুবাহিনী গরীবপুরে অবস্থান নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। কিন্তু ২১ পাঞ্জাব বাহিনীর হাতে তারা পরাস্থ হয়। প্রচুর হতাহতের বােঝা নিয়ে শত্রু বাহিনী পিছু হটে যায়। তাদের দুটি ট্যাঙ্ক খােয়া যায়, যা পরে বিদেশি গণমাধ্যমকে দেখিয়ে বলতে চাওয়া হয় যে, ভারতীয়দের আগ্রাসন বাস্তবে আরম্ভ হয়েছে।
২৪। এই সময়ে মরণপণভাবে ১০৭ ব্রিগেডকে সেখানে স্থাপন করা হয়। ইস্টার্ন কমান্ড তার ১২ পাঞ্জাব রিজার্ভ, বগুড়া থেকে পাকশী ব্রিজ দিয়ে যশােরে প্রেরণ করতে রাজি হয়। এই ব্যাটালিয়ান ১০৭ ব্রিগেডের এলাকায় ২৫ নভেম্বর এসে পৌঁছায়। তারা যথাশীঘ্র যশােরের দিকে ফাঁক পূরণের জন্য যাত্রা করে। যদিও দেখা যায়; যশাের দুর্গটি নিজেই তখন দৃশ্যমানের চাইতেও অধিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
২৫। নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে শত্রুদের দ্বারা জীবননগর আক্রান্ত হয়। তাদের আক্রমণে সহায়তা করে গােলন্দাজ এবং তারা ট্যাঙ্ক থেকে গােলা নিক্ষেপণ করে । সেখানে অবস্থিত কোম্পানি কোনাে প্রকার প্রতিরােধ ছাড়াই স্থানটি পরিত্যাগ করে। এর ফলে শত্রুবাহিনী পুনরায় দর্শনা এবং কোটচাঁদপুরের দিকে অগ্রসরমান হয়। যার দরুন ঝিনাইদা এবং যশােরের মধ্যকার সড়ক যােগাযােগ হুমকির মুখে পড়ে যায়।
২৬। ৫৭ ব্রিগেডের এলাকায় দেখা যায়; শত্রুদের ৪র্থ মাউনটেইন ডিভিশন বয়রা থেকে আক্রমণ শুরু করে জীবননগর অংশের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং এটি পরে চৌগাছায় অবস্থানরত থাকে। একটি ব্রিগেড দর্শনার দিকে আগ্রসর হয়। তৃতীয়টি সমান্তরালভাবে দক্ষিণ দিকে আন্দুলবাড়ীয়া এবং কোটচাঁদপুরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর আহমেদ (সাক্ষী নং ২৩২), কমান্ডার ২৭ ব্রিগেড, তাঁর ১৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ান নিয়ােগ করেন। তিনি বলেন
“একিট কোম্পানি ঝিনাইদার জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়। অন্য তিনটি কোম্পানি যথাক্রমে : মেহেরপুর, নাথুদা এবং দর্শনায় থাকে। এ অবস্থায়। একটি অবস্থান থেকে অন্য একটি অবস্থানের মধ্যে ফাঁক ছিল ৮ থেকে ১৫
১৪৫
মাইল । সেজন্য শত্রুরা সহজেই ব্যাটালিয়ন পাশ কাটিয়ে ওই ফাঁক দিয়ে যেতে পারত।”
২৭। অন্য ব্যাটালিয়ন ২৯ বালুচ চারটি কোম্পানির দ্বারা গঠিত ছিল। দুটি কোম্পানি ডাংগুরে স্থাপন করা হয় এবং অন্য দুটি ব্রিগেড সংরক্ষিতভাবে থাকে।
২৮। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর এই এলাকায় আক্রমণ করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে শত্রুরা তাদের বাহিনী জীবননগরকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল । শত্রুপক্ষের একটি ব্রিগেড আন্দুলবাড়ীয়া ও কোটচাদপুর এবং অন্যটি দর্শনার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর জীবননগরের পতন হয়। তারপর ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর শত্রুরা উথলী দখল করে নেয় এবং দর্শনা সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলা হয়। ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বররের মধ্যে কোটচাঁদপুরও ভীতির মুখে পড়ে যায়।
২৯। দেখা যায় যে, এই ব্রিগেডটি শত্রুপক্ষের অগ্রগতিকে ঐ অঞ্চলে প্রতিরােধ করতে পারেনি। সেজন্য ৯ম ডিভিশনের ৫৭ ব্রিগেডকে আরও দুটি ব্রিগেড ৫০তম ব্রিগেড, ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক দেওয়া হয় শক্তিশালী হওয়ার জন্য। এই ব্যাটালিয়ন ছিল নতুন। এটি ২৫-২৭ নভেম্বর তারিখের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় অবতরণ করেছিল। তথাপি, ব্রিগেড কমান্ডার তাৎক্ষণিকভাবে এই কোম্পানিগুলােকে দিয়ে শত্রুদের উথালীর উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়া থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ১০৭ ব্রিগেডকে দেওয়া দুটি কোম্পানি সেমতাে জীবননগর থেকে পেছনে ঠেলে এনে ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর তারিখে সেই এলাকায় নিয়ােজিত করা হয়। এই পর্যায়ে একটি টাস্কফোর্স’ আফ্রিদির ফোর্সের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটি দ্রুততার সাথে ৩৮ এফএফ (এক কোম্পানির কম) এবং ৫০ পাঞ্জাব (দুই কোম্পানির কম), ৫৭ ব্রিগেডের সাথে উথালীতে নিয়ােজিত করা হয়। তথাপিও, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর শত্রু বাহিনী তা দখলে নেয়।
৩০। ব্রিগেড কমান্ডার তাঁর কৌশলী হেডকোয়ার্টাসসহ দর্শনার দিকে চলে যান। সেখানকার যুদ্ধ তদারকি করতে পেছনে রেখে যান ঝিনাইদার তার মূল ব্রিগেড হেড-কোয়ার্টাস। কিন্তু ভীতি সৃষ্টি হয়েছিল উথালীর পতনের পরে, শত্রুপক্ষ কর্তৃক কোটচাঁদপুর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার ভিতর দিয়ে। এ কাজটি তারা ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর আরম্ভ করে । দর্শনা ঘেরাও করার পরে তারা এটি করেছিল।
রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া এলাকা
৩১। এই এলাকার দায়িত্বে ছিল ১৬তম ডিভিশন। এর আওতায় বেসামরিক জেলাগুলাে ছিল যথাক্রমে : দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া এবং সমগ্র উত্তর এলাকা- ব্রহ্মপুত্র নদী (যমুনা) এবং গঙ্গা (পদ্মা নদীর) উত্তর এলাকা। এই এলাকাটি ছিল উত্তমভাবে কর্ষিত এলাকা। বর্ষার মৌসুম শেষ হলে পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই শুষ্ক হয়ে ওঠে। অনেকটা পাঞ্জাবের মতাে এলাকাটি সামরিক অভিযান/অপারেশন। কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত স্থান।
৩২। উপরে উল্লিখিত দুটি নদী ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও কিছু ক্ষুদ্রাকৃতির নদী । যেমন- তিস্তা, করতােয়া, আত্রাই। এখানে একটি মূল সড়ক রয়েছে যা সকল জেলার হেডকোয়ার্টারকে স্পর্শ করে। প্রদেশটির অন্যান্য এলাকা ফেরির মাধ্যমে। যােগাযােগ সংস্থাপিত হয়ে থাকে। যেমন- যমুনার ওপর ফুলবাড়ী, সিরাজগঞ্জ,
১৪৬
নগরবাড়ী ঘাট এবং পাকশী। ভারত থেকে এই এলাকায় প্রবেশ করার মূল পথ হলাে বালুর ঘাট এলাকা।
৩৩। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, ১৬তম ডিভিশন ছিল পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সবচাইতে শক্তিশালী ডিভিশন। একটি পুরাে গােলন্দাজ বাহিনী ছিল এই বাহিনীর সমর্থনে। আর ছিল তিনটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল ভারতের শিলিগুড়ির ৩৩ কর্পস্। তাদের ছিল দুটি মাউনটেইন ডিভিশন, একটি স্বাধীন মাউনটেইন ব্রিগেড, দুই ক্যাভালরি রেজিমেন্ট, ৮ম মাউনটেইন ব্রিগেড এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের নয় ব্যাটালিয়নস্। ক্যাভালরি রেজিমেন্টে পিটি-৭৬ এবং পিটি-৫৫ ট্যাঙ্ক দ্বারা তা ছিল সুসজ্জিত।
৩৪। ১৬ ডিভিশনের কমান্ডার এই এলাকাকে তিনটি সেক্টরে ভাগ করেছিলেন এবং প্রতিটি সেক্টরে একটি করে ব্রিগেড ছিল। ২৩ ব্রিগেড ছিল অন্যতম শক্তিশালী একটি ব্রিগেড। এর ছিল পাঁচটি গােলন্দাজ ব্যাটালিয়ান এবং একটি ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন । উত্তরের দিনাজপুর এবং রংপুর জেলার প্রতিরক্ষার জন্য এগুলােকে নিয়ােজিত করা হয়েছিল। ভারতের আচমকা আক্রমণ প্রতিরােধ করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সেক্টরকে দেওয়া হয়েছিল। এখানে ছিল তিনটি ব্যাটালিয়ন এবং এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক। তৃতীয় ব্রিগেডকে ডিভিশনাল সংরক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা ছিল।
৩৫। এই এলাকায় ভারতের প্রকাশ্য আগ্রাসনমূলক তৎপরতা আরম্ভ হয় ২১ অক্টোবর, ১৯৭১, সে সময় তেঁতুলিয়া ব্যহটি ভারতীয় বাহিনী দখল করে নেয়। তারা বুরুংগামারীও আক্রমণ করে। এই আক্রমণটি সফলতার সঙ্গে হটিয়ে দেওয়া। হলে পর তারা ১৪ নভেম্বর তারিখে আবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের মাধ্যমে তারা বুরুংগামারী দখল করে নেয়। ইস্টার্ন কমান্ডের নির্দেশে প্রচেষ্টা। চালিয়েও এ অঞ্চল আর পুনর্দখল বা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে এতে করে ২৫ পাঞ্জাব-এর প্রভুত ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এরপর কুড়িগ্রাম, আলীপুর, চিলমারীর ওপর নিদারুণ চাপ আসে। তিস্তা নদীর পূর্ব পাড়ের অবস্থা অসহনীয় হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে অমরখানা এবং বাড়খাতা ছেড়ে আসতে হয়। তারপর, ভারতীয় বাহিনী থেমে গিয়ে তাদের বাহিনীকে একত্রিত করতে থাকে। তারা প্রধান এবং প্রবল আক্রমণ চালানাের জন্য নিজেদের তৈরি করতে থাকে।
৩৬। ১৯৭১ সালের ২১-২২ নভেম্বর, পঞ্চগড় আক্রান্ত হয়। ভারতীয়রা তা অতিক্রম করে ঠাকুগাঁও-এর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর সেখানে যুদ্ধ হয়। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও শত্রুবাহিনী তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। তারা ৩৪ পাঞ্জাব অবস্থান অতিক্রম করে যায়। ২৯-৩০ নভেম্বরে কোনাে প্রকার যুদ্ধ ব্যতীতই ৩৪ পাঞ্জাব অবস্থান পরিত্যক্ত করে। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এ ঘােষণা দেন। এই ভুলের জন্য ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডারকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং ইস্টার্ন কমান্ড থেকে নির্দেশ জারি করা হয়; যাতে উল্লেখ করা হয়, “কোনাে অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা যাবে না যতক্ষণ সেখানে শতকরা ৭০% ভাগ হতাহত না হয়।” (বক্তব্য, জেনারেল নজর হােসাইন শাহ্, সাক্ষী নং ২৪২)।
১৪৭
৩৭। তিস্তা নদীর পূর্ব পারের অবস্থানের পুনরায় অবনতি ঘটে। আমাদের বাহিনী ঘটনাক্রমে পশ্চিম তীরের দিকে পিছিয়ে এসে স্টাফ ডিভিশনের কর্নেলের নির্দেশে তিস্তা এবং করতােয়া নদীর মাঝখানে অবস্থান নেয়।
জামালপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকা সেক্টর
৩৮। এই এলাকাটি যেমন অনেকেই বলে থাকেন “ঢাকার বােল” অথবা “ঢাকার ত্রিভুজ” হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে। দৃশ্যত এটি ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত সেখানে কোনাে প্রকার নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। সে কারণে বিদ্রোহীরা এলাকাটিকে তাদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করার সুযােগ পায় ।
৩৯। এই এলাকাটি মূলত ১৪ ডিভিশনের দায়িত্বের মধ্যে অবস্থিত ছিল। এই ডিভিশন তৈরি করা হয়েছিল ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বেসামরিক ডিভিশনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধানের জন্য। কিন্তু ঝেটিয়ে বিতাড়ন কর” অপারেশনের সময় তা সীমান্ত এলাকা অবধি বিস্তৃত করা হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল বিক্ষিপ্ত; বিশেষ করে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা পর্যন্ত। এর ফলে সেখানে ছিল। শূন্যতা এবং ঢাকা নিজেও এই শূন্যতার মধ্যেই ছিল। যদিও ঢাকা ছিল ১৪তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার, ইস্টার্ন কমান্ডের কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক রাজধানী।
৪০। মুক্তিবাহিনী এই সুযােগ গ্রহণ করে এবং এখানে তাদের তৎপরতার বিস্তৃতি ঘটায়। এখানে আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ঘটে। এতে করে এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, যেন এই সেক্টরে সেনাবাহিনীর কোনাে প্রকার নিয়ন্ত্রণই নেই। ফলে অভ্যন্তরে এবং বাইরে সাংঘাতিক প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের বিরােধাত্মক প্রতিবেদনের জন্য। সে কারণে জিএইচকিউ-এর নিদের্শনা মােতাবেক, ইস্টান কমান্ড ৫৩ বিগ্রেড (মাত্র দুটি ব্যাটালিয়ন সমৃদ্ধ) চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে এটিকে সংরক্ষিত হিসেবে বহাল রাখে । তার পরে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আর একটি এক ডিভিশন, ৩৬এ মেজর জেনারেল জামশেদের নেতৃত্বে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই হেডকোয়ার্টারের অবস্থান ছিল ঢাকা। এটি ছিল ইপিসিএ এক-এর ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে তাঁর কাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব। তার অতিরিক্ত হেডকোয়ার্টার-এর সংরক্ষিত শক্তি, সেইসঙ্গে তাঁর ইপিসিএএফ-এর মধ্যেও পরিদৃষ্ট হয়।
৪১। ১৪তম ডিভিশনের কাজ ও দায়িত্বের পরিধি সে কারণে পুননির্ধারণ করা হয়। ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলা এই ডিভিশন থেকে সরিয়ে নিয়ে ৩৬-এ ডিভিশনের অধীনে আনা হয়। এই এলাকার উত্তর অংশ ছিল পূর্বে মেঘনা, উত্তর-পশ্চিমে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে পদ্মা ও মেঘনা, জামালপুরের উত্তরের অংশ। সামরিক দৃষ্টিতে সেজন্য এ এলাকাটি প্রধান প্রধান নদী দ্বারা প্রতিবন্ধকসম্পন্ন ছিল (এর প্রায় সকল দিকই), কেবলমাত্র ১৫ মাইলের একটি চওড়া ফাঁক ছিল উত্তরের হােসাইনপুরে। এমনকি সেখানেও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী বাহাদুরাবাদ থেকে ভৈরব। পর্যন্ত একটি উত্তম প্রতিবন্ধক হিসেবে ছিল। তবে শীতকালে নদীর তলদেশ দিয়ে হেঁটে বা গাড়িতে পারাপার হওয়া যায়।
১৪৮
৪২। এর বাইরেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল ছােটো ছােটো নদী-নালা। ঠিক ঢাকার বাইরেপশ্চিম দিকে ছিল বুড়ীগঙ্গা এবং তার পরই ছিল শীতলক্ষ্যা যা কিশােরগঞ্জ থেকে প্রবাহিত হয়ে নারায়ণগঞ্জের নিকট মেঘনা নদীতে মিশেছে। এ দুটি নদীই ছিল জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত এবং পরিষ্কারভাবে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাবিশিষ্ট। প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিবন্ধকতার সমাবেশের দৃষ্টিতে এর মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের দ্বার ছিল পূর্বদিকের ভৈরব বাজার রেলওয়ে সেতু। যন্ত্রচালিত ফেরি দ্বারা (জগন্নাথগঞ্জবাহাদুরাবাদ) ঘাটে নদী পার হতে প্রায় ১-৩০ সময় ব্যয় হয়। তাছাড়া সর্বাপেক্ষা লম্বা (গােয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ) পার হতে লাগে পাঁচ ঘণ্টার ওপরে।
৪৩। এ এলাকায় অন্য কোনাে ধরনের যােগাযােগ ব্যবস্থা খুব বেশি ছিল না। ঢাকার সঙ্গে ছিল টাঙ্গাইলের যােগাযােগের সড়ক। ময়মনসিংহের যােগাযােগ সড়ক মধুপুরে গিয়ে ভাগ হয়ে তার একটি ভাগ জামালপুরের অভিমুখে গিয়েছে। জামালপুরের উত্তর দিকের সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থা নিম্নমানের। সেখান থেকে সীমান্ত এলাকার যােগাযােগ ব্যবস্থাও ছিল নাজুক।
৪৪। ঢাকা থেকে আরিচা ঘাট পর্যন্ত একটি নতুন নির্মিত সড়ক আছে, যা ঢাকার পশ্চিম দিক তথা মিরপুর এবং মানিকগঞ্জ হয়ে চলে গিয়েছে। আরিচার পদ্মা নদী পার হয়ে পাবনার ভিতর দিয়ে হয় নগরবাড়ী দিয়ে রাজশাহী অথবা পদ্মা পার হয়ে ফরিদপুর জেলার গােয়ালন্দে গিয়েছে।
৪৫। একটি মিটারগেজ রেলপথ নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা এবং ময়মনসিংহ হয়ে পশ্চিমে বাহাদুরাবাদ ঘাটে এবং ঢাকা হয়ে পূর্বদিকে ভৈরব বাজার, সিলেট, কুমিল্লা, চাদপুর ও চট্টগ্রাম গিয়েছে। একটি রেলপথ দ্বারা ময়মনসিংহ এবং ভৈরব বাজারের ভিতর সংযােগ স্থাপন করা আছে।
৪৬। ঢাকা হলাে প্রদেশের রাজধানী, ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টার, পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসনের সরবরাহ স্থল (কেন্দ্র)। এখানে রয়েছে একমাত্র বিমানবন্দর যেখান থেকে বােয়িং অথবা অপরাপর জেট বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে। ঢাকা ছিল সামরিক এবং রাজনৈতিক অর্থে “লােহার খিল বিশেষ। ঢাকার কৌশলগত গুরুত্ব সামরিক পরিকল্পনাবিদগণের অজানা থাকার কথা নয়। এটি তাদের উপলব্ধি এবং মান্য না করার ব্যর্থতার পর্যায় থাকতে পারেন না। কেননা, এটি যে শত্রুপক্ষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে তা জানাই ছিল। আশ্চর্য হতে হয় এজন্য যে, তারপরও এ স্থানটি ১৯৭১ সালের মে এবং আগস্ট মাসে নিঃস্ব অবস্থায় রাখা হয়েছিল। কেবলমাত্র জিএইচকিউ-এর নিদের্শানুযায়ী (ইতােমধ্যে বলা হয়েছে) চট্টগ্রাম হতে একটি ব্রিগেড সম্বলিত বাহিনী তুলে এনে কমান্ড সংরক্ষণ রূপে সেখানে রাখা হলাে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের কেবলমাত্র সেপ্টেম্বর মাসে এসে একটি এহক বাহিনী সেই ব্রিগেডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলাে। সেসঙ্গে দুই ব্যাটালিয়ন মানের ৯৩-এ ব্রিগেডকে ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির এর অধীনে এখানে। এক ভিত্তিতে রাখা হলাে।
৪৭। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, এই এলাকায় ঢাকা সেনানিবাসের অবস্থান ছিল। এখানে ছিল বেসামরিক বিমানবন্দর (তেজগাঁও)। এ বিমানবন্দরটি
১৪৯
ছিল পিএএফ-এর একমাত্র ‘এয়ারবেজ’ । বিকল্প ‘এয়ারবেজ’ নির্মানাধীন ছিল কয়েকমাইল দূরে কুর্মিটোলায়। তখন পর্যন্ত তা ব্যবহারযােগ্য হয়ে ওঠেনি।
৪৮। ১৯৭১ সালের জুন মাসে নৌবাহিনীর ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিং হেডকোয়ার্টারও ঢাকায় স্থাপন করা হয়।
৪৯। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত যাতায়াতের জন্য ২৫ মার্চ, ১৯৭১, সেনাশক্তি বৃদ্ধি করতে সর্বক্ষণই বাহন ছিল বিমান। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সেনাশক্তি বৃদ্ধির জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করা হতাে। তাই ইস্টার্ন কমান্ডের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫০। এ কারণে এক ডিভিশনকে দুটি কাজ দিয়ে দেওয়া হয়, যেমন ময়মনসিংহ আসাম সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; যাতে করে ঢাকার সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। এবং যদি কখনাে বাহ্যিক প্রতিরক্ষা পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য দুরূহ হয়ে ওঠে। তখন কার্যকর ভূমিকা রাখা। প্রথম কাজটির জন্য ৯৩-এ ব্রিগেড বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু তা জামালপুর-ময়মনসিংহ এলাকায় রাখা হয় মােটামুটিভাবে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে। কিন্তু দ্বিতীয় কাজটির জন্য কোনাে প্রকার নিয়মিত বাহিনীর যােগান ছিল না। অথবা সে জন্য কোনাে পরিকল্পনাও প্রস্তুত করা হয়নি। যদি ঢাকা আক্রমণের হুমকির মধ্যে পড়ে যায় তা হলে কী হবে, সে বিষয়ে সুষ্ঠু কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। ৫৩ ব্রিগেড ছিল কেবলমাত্র একটি কমান্ড সংরক্ষিত বাহিনী। ঢাকার প্রতিরক্ষার বিষয়ে এদের জন্য কোনাে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এতদ্ব্যতীত, এই ব্রিগেড ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর তারিখে ফেনীর দিকে সরিয়ে নেওয়া হয় যখন অন্য একটি এক ডিভিশন, যেমন ৩৯-এ ডিভিশন যেখানে জেনারেল জামশেদ নিজে এটি গ্রহণ করেন। এরপর ৩৬ ডিভিশন কেবল নামমাত্র (কাগজে-কলমে) থাকল কিন্তু বাস্তবে যার অবস্থান ছিল শত মাইল দূরত্বে (জামালপুরে)।
৫১। ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর শত্রুপক্ষ এমন একটি অবস্থানে এসেছিল, যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, বান্দরকাটা সীমান্ত ফাঁড়িতে, যেখানে তারা পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ রাউন্ড ‘ওয়ার গ্যাস মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করেছিল। তারপর তারা মধুপুরের জঙ্গল এলাকায় বহু সংখ্যক মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। এই স্থানটি ছিল কার্যত ময়মনসিংহ এবং ঢাকার মধ্যে যােগাযােগের পথের ওপর অবস্থিত। তাছাড়া ঢাকা ছিল গেরিলা-যুদ্ধ তৎপরতার জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। যখন ৯৩-এ ব্রিগেড গেরিলা তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সার্বিকভাবে ব্যস্ত ছিল, তখন ভারতীয়রা ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বর বিওপিতে (আর-এ ২৭১৩) একটি আক্রমণ পরিচালনা করে। এ আক্রমণটি প্রতিহত করে শত্রুদের পিছু হটতে বাধ্য করা হলেও তারা পুনরায় ব্যাপকভাবে ভারী গােলাবর্ষণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ৩৩ পাঞ্জাব-এর দ্বারা গঠিত একটি কোম্পানির প্রতি-আক্রমণের মাধ্যমে অবস্থানটি দখলে আনা হয়।
৫২। ৯৩-এ ব্রিগেডের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব ছিল সীমান্ত চৌকির এলাকার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। এর ব্যাপ্তি ছিল প্রায় একশত মাইল। আরও দায়িত্ব ছিল সংলগ্ন
১৫০
জামালপুর ও ময়মনসিংহ দুর্গগুলাের মধ্যে অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং সর্বশেষ পর্যায়ে এগুলাের সুরক্ষা প্রদান করা। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে ব্রিগেডের হাতে মাত্র দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য দেওয়া হয়েছিল, ৩৩ পাঞ্জাব এবং ৩১ বালুচ, একটি মর্টার ব্যাটারি, এক কোম্পানি ফিল্ড প্রকৌশলী, তিন উইং পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যাংগার, পাঁচ কোম্পানি মুজাহিদ, কিছু অন্যান্য বিবিধ বাহিনী যারা ছিলেন সংরক্ষিত অবস্থায়, অথবা জামালপুর ও ময়মনসিংহের পেছনের গভীরতম অবস্থানে।
৫৩। বিপরীতে ভারতীয় বাহিনীর ছিল এখানে দুটি ভারতীয় ব্রিগেড, যার প্রতিটির ছিল তিনিট ব্যাটালিয়ান, বলা হয়ে থাকে তারও ছিল একটি ব্রিগেড। এটিও জানা ছিল যে, ভারতের ৫০ প্যারা ব্রিগেডের অবস্থান ছিল কলকাতার নিকটবর্তী ব্যারাকপুরে, যে ব্রিগেডটি এই এলাকায় বিশেষ করে দক্ষিণ টাঙ্গাইলে অবতরণে সক্ষম ছিল।
প্রতিবেদন ২১
মঙ্গলবার ৩০/১
৫৪। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বরের মধ্যে শত্রুদের ৬ মাউনটেইন ডিভিশনকে সেইসঙ্গে এই এলাকায় নিয়ে আসা হয়। ২১/১ নভেম্বরের রাতের বেলা ভারতের সেনাপ্রকৌশলীদের সহায়তায় টাঙ্গাইল এবং কাঁঠালিয়ার সকল সেতু ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ফলে ঢাকা এবং ময়মনসিংহের দিকে যাতায়াতকারী যাবতীয় যানবাহন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। এজন্য ঢাকার ৯৩ ব্রিগেডের সমর্থন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । এমতাবস্থায় পুনরায় প্রচেষ্টার মাধ্যমে যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে এ কাজে সফলতা আসে।
৫৫। ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর অবধি গুরুত্বপূর্ণ তেমন অতিরিক্ত কিছু ঘটেনি। কিন্তু ওই দিন শত্রুরা জালামপুর সীমান্তের চৌকিতে ভারী গােলাবর্ষণ করে। একদিনে এর পরিমাণ ছিল ৪০০০ রাউন্ড । কিন্তু আমাদের বাহিনী প্রভূত ক্ষতির পরও অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছিল। এরপর শত্রুবাহিনী ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখে অনুরূপভাবে বক্সিগঞ্জে আক্রমণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানি র্যাংগারদের সহায়তায় ৩১ বালুচ এ আক্রমণটি প্রতিহত করে। শত্রুবাহিনী ৩/৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তৃতীয়বারের মতাে আক্রমণ হানে এবং এজন্য তারা দুটি ব্রিগেড ঘেরাও করে ফেলে। তাদের যাবতীয় গােলাবারুদ ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা প্রতিরােধ যুদ্ধ চালাতে থাকেন। তারপরও যারা জীবিত ছিলেন শত্রুবাহিনী তাদের বন্দি করে।
৫৬। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, এমনকি এমনতর অবস্থাতেও কমান্ডিং অফিসার কর্তৃক বক্সিগঞ্জের অবস্থান থেকে সরে আসার অনুরােধ ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কমান্ড থেকে নির্দেশনামা জারি করা হয় যে, “শতকরা ৭৫ ভাগ সৈন্য হতাহত না হওয়া পর্যন্ত কোনাে অবস্থান পরিত্যাগ করা যাবে না।”
৫৭। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর শত্রুরা বক্সিগঞ্জ
দখল করে নেয় এবং সে অবস্থায় ৩১ বালুচ বাহিনী শেরপুর ফেরি পার হয়ে পিছিয়ে আসে। এই দিনটিতেই কেবলমাত্র অন্যান্য সীমান্ত চৌকি খালি করে দেওয়া হয়। হালুয়া ঘাট এবং জারিয়া ঝানজিআইলে সৈন্যরা শত্রুপক্ষের নিদারুণ চাপের মধ্যে ছিলেন। এ সম্পর্কিত ঘটনাগুলাে পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করা হবে।