You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

১৫১
সিলেট, মৌলভী বাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেক্টর
৫৮। প্রারম্ভিক পর্যায় হতেই এই এলাকাটি ছিল ১৪তম ডিভিশনের দায়িত্বের মধ্যে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৩৬ এহক ডিভিশনের সৃষ্টির পরে ১৯ নভেম্বর তারিখে এটি ৩৯ এহক ডিভিশনের দায়িত্বের ওপর গিয়ে বর্তায়। ৩৬-এ ডিভিশন সৃষ্টির পর হতে মেঘনা নদী ৩৬ ডিভিশন এবং ১৪ ডিভিশনের মধ্যকার সীমারেখা হিসেবে বিবেচ্য হতে থাকে। ৩৯-এ ডিভিশন সৃষ্টির পরে এর দায়িত্বসীমা পুনরায় হ্রাস করে আনা হয়। কসবা রেলওয়ে স্টেশন এলাকাটিও এ ডিভিশনের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়।
৫৯। এই এলাকাটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নদী-নালা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এর ভূমি নবম প্রকৃতির। তবে চা বাগান এলাকায় রয়েছে উঁচু-নিচু ভূমি।
৬০। এ এলাকায় যাতায়াত ও যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল রেলপথ এবং সড়কপথ উভয়ই ভারতীয় সীমানা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। সে কারণে এলাকাটি শত্রুদের সমতলভূমি থেকে আক্রমণের জন্যও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
৬১। ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যােগাযােগ মিটারগেজ রেলপথের মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে । পথে ছিল আশুগঞ্জ এবং ভৈরব বাজার সেতু। সড়কপথে রয়েছে বাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, দাউদকান্দি এবং তারপর মেঘনা নদীর উপর দিয়ে ফেরির মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছে। মেঘনা নদী নৌ-চলাচল উপযােগী। এই নদীর উপর দিয়ে সিলেট এবং নারায়ণগঞ্জের যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছে।
৬২। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগও এই একই এলাকা দিয়ে রয়েছে। যেমন- কসবা-আখাউড়া-ব্ৰহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ। কিন্তু এই এলাকার কৌশলগত গুরুত্ব হলাে যে, এখান দিয়েই ভারতের আগরতলা এলাকার সঙ্গে ঢাকার রেলপথ ও সড়ক যােগাযােগের সংক্ষিপ্ত পথ অবস্থিত।
৬৩। এই সেক্টরের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে, এই এলাকাটি সকল দিক থেকে বাস্তবে আশুগঞ্জ-সরাইল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যে নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছে। এই এলাকাটির উত্তরে, পূর্ব এবং দক্ষিণে রয়েছে তিস্তা নদী এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে মেঘনা নদী। সে কারণে এই অংশটিকে বলা হয়ে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দ্বীপ’। এর আরও একটি কৌশলগত গুরুত্ব হলাে, মেঘনা নদীর উপরে ভৈতর সেতুর পরেই এই দ্বীপের পশ্চতে রয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহের যােগাযােগের প্রধান রেল সংযােগ।
৬৪। সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি দুর্গ হিসেবেই গড়ে ওঠে। শেষ অবধি তা ধরে রাখার প্রত্যয় বহাল থাকে। নদীর উপরে অবস্থিত আশুগঞ্জ ছিল একটি শক্ত ঘাঁটি। উপরন্তু তা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুর্গের জন্য যাবতীয় সরবরাহের ঘাঁটি। এই দুর্গটি উত্তমভাবে প্রস্তুত করা হয়। এটিকে দুর্জেয় বলে মনে করা হতাে। বিশেষ করে এর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাসম্পন্ন পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনার জন্য এ দুর্গটি বিনা বাধায় পরিত্যক্ত ঘােষণা করে চলে আসতে হয়েছিল।
১৫২
৬৫। এই ডিভিশনে সৈন্য ছিল তিন ব্রিগেড। এর ছিল ৬টি গােলন্দাজ ব্যাটালিয়ন। এই তিনটি ব্রিগেডের মধ্যে মাত্র একটি ছিল এক কোয়ার্টাস। ডিভিশনের সমর্থনে ছিল একটি মাত্র ফিল্ড রেজিমেন্ট, ছিল একটি মর্টার ব্যাটারি এবং পাঁচটি ট্যাঙ্ক যা অস্ত্র তৈরির কারখানার গুদাম থেকে নেওয়া হয়েছিল। এতদ্ব্যতীত, এখানে ছিল দুটি ফ্রন্টিয়ান কর্পস, তবে তা সিলেটে নিয়ােজিত ছিল। এখানে যথারীতি ছিল দ্বিতীয় ফোর্স যেমন- ইপিসিএএফ, ছিল মুজাহিদ এবং রাজাকার।
৬৬। এই বাহিনীর ওপর দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেট দুর্গের প্রতিরক্ষা সুরক্ষা করা। পাশাপাশি ভৈরব সেতুর নিরাপত্তা যে কোনাে মূলে নিশ্চিত করা। তবে এজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আশুগঞ্জকেও শক্তিশালী অবস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিওসি, ১৪ ডিভিশন (সাক্ষী নং ২৫৪), অভিযােগ আনেন যে, যদিও তাঁকে উভয় দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য বলা হয়েছিল; কিন্তু “ইস্টার্ন কমান্ড সেজন্য অগ্রাধিকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেনি। তাই তিনি এ দুটোকে অন্যান্যগুলাের মতাে সমানভাবেই দেখেছেন। যদিও এদের মধ্যে অমিলও ছিল; যা গুরুত্বের দিক থেকে বিবেচ্য হতে পারত। এ কারণে সেখানে সম্পদের অপব্যবহার হয়েছিল।
৬৭। এই ডিভিশনটিকে একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে (এস-৩১৩ ব্রিগেড) আগরতলার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার ভূমিকা রাখতে মৌলভীবাজার এলাকায় রাখা হয়েছিল। আমাদের জানামতে আগরতলা ছিল ভারতের IV কর্পস্-এর হেডকোয়ার্টার।
৬৮। উপরন্তু, ৩১৩ ব্রিগেড সম্পর্কে প্রারম্ভেই বলা হয়েছে এই কমান্ডের অধীনস্ত অন্য দুটি ব্রিগেড ছিল; যথাক্রমে ২৭ ব্রিগেড় এবং ২০২ এহক ব্রিগেড । এই শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের কর্পস্ এর হেডকোয়ার্টার ছিল আগরতলা। এই কর্পস-এর ছিল দুটি ডিভিশন, প্রতিটিতে ছিল তিনটি ব্রিগেড । ছিল ১৮ ব্যাটালিয়ান করে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। ছিল স্বাভাবিক সাঁজোয়া ও গােলন্দাজ বাহিনীর সমর্থন। এছাড়াও ছিল অতিরিক্ত গােলন্দাজ ইউনিট যা নেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় এবং পঞ্চম মাউনটেইন ডিভিশন থেকে। এর দায়িত্ব ছিল চীন-ভারত সীমান্ত দেখভাল করা।
৬৯। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে ভারতীয়রা ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর হতেই এ এলাকায় আক্রমণ কার্যক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। এ সময় তারা ধূলাই এবং পেট্রাখানা বিওপিএস্ আক্রমণ করে। তারা ভারী আকারের গােলা নিক্ষেপণের মাধ্যমে তা করেছিল। আরও নিবিঢ় গােলা নিক্ষেপণের মাধ্যমে তাদের এ আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে প্রকৃতপক্ষে ভারতের আক্রমণ আরম্ভ হয়েছিল। তখন ভারতের নিয়মিত বাহিনী মােহাম্মদপুর এবং সালদা নদীর নিকটবর্তী বিওপিএ এর দিকে অগ্রসর হয়ে তা অতিক্রম করে। ২১ নভেম্বর শত্রুরা আটগ্রাম দখল করে নেয়। এটি ছিল সীমান্ত ফাঁড়ি এবং সিলেটের জকিগঞ্জ তারা নিয়ে নেয় সকাল ৩টার সময়। এ দুটি অবস্থানই আমরা হারিয়ে ফেলি। আমাদের বাহিনী পিছু হটে চারখাই চলে আসে। এমতাবস্থায় ভারতীয়রা বলতে থাকে যে, তারা সিলেট দখল করে নিতে যাচ্ছে।
৭০। এক ব্রিগেড সেনাসদস্য নিয়ে শত্রুপক্ষ যুগপৎভাবে জয়ন্তিয়াপুর আক্রমণ করে এবং কমলগঞ্জ ও শমসেরনগরের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে। ভারতের
১৫৩
অনিয়মিত বাহিনীও একটি ব্যাটালিয়নের শক্তি নিয়ে আক্রমণ চালায়। তাদের সমর্থনে ছিল গােলন্দাজ বাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী। এ আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল বড়লেখা, সি, কুলাউড়া এবং জুরির ওপর। এ আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুবাহিনী আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনীকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল ।
৭১। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর তারিখে আক্রমণের প্রধান প্রকোপ আরম্ভ হয়। আর এটি হয় আখাউড়ার কসবা এলাকায়। ২৭ ব্রিগেড এর এ আক্রমণ প্রতিরােধ করার কথা ছিল। এই ব্রিগেডের হেডকোয়ার্টার ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত । কিন্তু এর অগ্রবর্তী অবস্থান ছিল আখাউড়া রেলস্টেশন, গঙ্গাসাগর এবং লাটুমুরায়। সেখানে ছিল এক ব্যাটালিয়ন ১২ এফএফ। কসবা, সালদা নদী এলাকায় ছিল ৩৩ বালুচ ব্যাটালিয়ন। ১২ এ কে ১২ এফএফসহ একটি কোম্পানি ছিল আখাউড়ার।
৭২। বলা হয় ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর তারিখে শত্রুদের একটি সুবৃহৎ বাহিনী পাকিস্তানের ভূখণ্ডের তিন মাইলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, তারপর ১০ বিহার রেজিমেন্টের দ্বারা ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ চালায়। সেইসময় গুরখা ৪ গার্ড অগ্রসর হয়ে আখাউড়া-বাহ্মণবাড়িয়া সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল স্টাফ অফিসার-১ (জি১) এর ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রতি-আক্রমণ চালিয়ে এই ভীতি মুক্ত করলেও সকালবেলা দেখা গেল ১২ এফএফ সেই অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসে এবং সে সুযােগে শত্রুপক্ষ আখাউড়ার অবস্থান দখল করে নেয়। এর ফলে কুমিল্লাগামী সড়ক ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে কারণে জিওসি ব্যক্তিগতভাবে নিজে সামনে অগ্রসর হয়ে সৈন্য পুনর্গঠন করে ভারতীয় ভীতির চাতুর্যকৌশল ভোঁতা করে দিতে চেষ্টা করেন। শত্রুরা আখাউড়ায় ফিরে আসে এবং পরবর্তী দুদিন আখাউড়াকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এসব প্রচেষ্টা প্রতি-আক্রমণের দ্বারা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। কিন্তু শত্রুরা সফলতার সঙ্গে ৪/৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা প্রতিরােধ করে রাখে। তারা আরও একটি প্রকট আক্রমণ আখাউড়ার দক্ষিণ এলাকা থেকে পরিচালিত করে এবং আংশিকভাবে তা অতিক্রম করে।
৭৩। ইত্যবসরে জিওসি নিজেদেরকে ঘেরাও অবস্থায় দেখতে পান। এমতাবস্থায় কোনাে প্রকার প্রতিরােধ ছাড়াই ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুর্গ পরিত্যাগ করেন। এমনকি ইস্টার্ন কমান্ড, সর্বশক্তিসম্পন্ন যুদ্ধ যা কেবলমাত্র আরম্ভ করেছিল, কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অবস্থার দ্বারা আমরা এই সর্বশক্তিসম্পন্ন যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থার পরিণতি দেখতে পাব।

কুমিল্লা, লাকসাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল।
৭৪। এই এলাকাটি সূচনায় ১৪ ডিভিশনের অধীনে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর এটি নতুনভাবে গড়ে তােলা হয়। ফলে তা ৩৯-এ ডিভিশনের দায়িত্বে চলে আসে। এই ডিভিশনের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর-জেনারেল এম. রাহীম খান। এই ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার ছিল চাঁদপুর। তার এলাকাটি ছিল কুমিল্লা জেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার কিছু অংশ এবং নােয়াখালী জেলা, চট্টগ্রাম জেলা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে। চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার মধ্যে সড়ক এবং রেলপথের দ্বারা
১৫৪
যােগাযােগ ছিল এ রাস্তায় ওপর। সেখানে ছিল ফেনী, যেখানে ভারতীয় সীমান্ত সমুদ্রের নিকটবর্তী হয়েছে।
৭৫। কুমিল্লা-নােয়াখালী এলাকার ভূখণ্ডটি সমতলভাবে স্রোতধারা এবং নদী-নালা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই জলধারা ভারতের ত্রিপুরা-মেঘনায় থেকে চলমান। জলধারাটি এই ভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। অন্যদিকে চট্টগ্রাম এলাকার ভূখণ্ড, প্রধানত পাহাড়ি এবং বনজঙ্গল দ্বারা পরিবেষ্টিত। তবে সংকীর্ণভাবে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা ব্যতীত কুমিল্লা এবং নােয়াখালীর সড়ক যােগাযােগ পশ্চিম দিকে সীমান্ত এলাকা ঘেঁষে মেঘনা নদীর দিকে চলে গিয়েছে। এ এলাকাটিতে রয়েছে তিনটি প্রধান রাস্তা। প্রথম সড়কটি ছিল কুমিল্লা-দাউকান্দি যা মেঘনা নদী অতিক্রম করেছে। তবে তা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাস্তার সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করেছে। দ্বিতীয় রাস্তাটি হলাে ময়মনসিংহ-কুমিল্লা-চাঁদপুর যা আবার স্টিমার অথবা লঞ্চের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। তৃতীয় রাস্তাটি হলাে বাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, ফেনী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামের রেলপথ দ্বারা যােগাযােগ সম্পন্ন। এই পথটি এক পর্যায়ে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে এমনভাবে গিয়েছে যে, ভারত ইচ্ছে করলে একটি সাধারণ বন্দুকের গুলি দিয়েই যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে।
৭৬। ফেনী উপ-সেক্টরের ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যগুলােও কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির। সেখানে আমাদের ভূখণ্ডের একটি অংশ, বিলােনিয়া এলাকা ভারতীয় ভূখণ্ডের আঙুলের ডগার উপর অবস্থিত। সেজন্য এটি ভারতের দ্বারা তিন দিক থেকে ঘেরাও-এর মধ্যে ছিল। তাই এর প্রতিরক্ষা ছিল খুবই দুঃষ্কর।
৭৭। নবগঠিত ৩৯-এ ডিভিশন ছিল ৫৩ ব্রিগেড কমান্ডের জন্য সংরক্ষিত। এটিকে ঢাকা থেকে ফেনী সেক্টরে প্রেরণ করা হয়। ১১৭ নং ব্রিগেড ছিল কুমিল্লায়, যা ১৪ ডিভিশনের জন্য নিয়ে নেওয়া হয় এবং দুটি এহক ব্রিগেড; যেমন ৯১ এবং ৯৭ ব্রিগেড; কার্যত ৯১ এহক ব্রিগেড ভেঙে গড়ে তােলা হয়েছিল, এর সঙ্গে ২৬ মার্চ ১৯৭১ এ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত দুই কোম্পানি, ২১ যুক্ত করা হয়েছিল।
৭৮। ৯১ এহক ব্রিগেডকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়েছিল। ৯৭ ব্রিগেড ছিল চট্টগ্রামের সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত। সমগ্র পদাতিক বাহিনীর শক্তি ছিল শুধুমাত্র আট ব্যাটালিয়ন, যার স্বাভাবিক শক্তি ছিল নয় ব্যাটালিয়ন। এই এক ব্যাটালিয়ন (৪৮ বালুচ) ছিল নিছক একটি গ্যারিসন। ব্যাটালিয়ন। কিন্তু এই ডিভিশনের সমর্থনে ছিল দুই কোম্পানি এসএসজি, দুটি মুজাহিদিন ব্যাটালিয়ন এবং সমানুপাতিক সংখ্যক ইপিসিএএফ এবং ছিল রাজাকার। এর গােলাগুলির বহর ছিল একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং একটি মর্টার ব্যাটারি মতাে; যা ৪টি ব্রিগেডে বিভক্ত ছিল।
৭৯। এই এলাকায় শত্রু সৈন্যের সংখ্যা ছিল এক ডিভিশন। নাম ছিল ২৩ ডিভিশন। এটি আগরতলার কমান্ডের দ্বারা পরিচালিত হতাে। তাদের সমর্থনে ছিল বিএসএফ ব্যাটালিয়নসমূহ এবং গােলন্দাজ বাহিনী। এরা আসতেন সংরক্ষণ কর্পস থেকে।
১৫৫
৮০। ভারতীয় নৌবাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লিটের দ্বারা চট্টগ্রামের সমুদ্ৰাঞ্চল ছিল ভীতিপ্রাপ্ত । এতে ছিল এয়ারক্রাফ্ট বহনকারী দুটি সাবমেরিন এবং কিছু সংখ্যক উভচর অবতরণকারী ক্র্যাক্ট’ । ছিল কিছু ফ্রিগেট এবং ডেস্ট্রয়ার।
৮১। ৭ নভেম্বর ১৯৭১, শত্রুপক্ষ এই এলাকার ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল বিলােনিয়া অঞ্চল। আমাদের উপর্যপরী প্রতিরােধ- এমনকি বিমান বাহিনী ব্যবহারের পরও তারা অঞ্চলটি দখল করে নেয়।
৮২। যুগপৎভাবে শত্রুপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামাঞ্চলের কাসালংখালের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
৮৩। ১২ নভেম্বর তারিখে শত্রুপক্ষ জাইলহারার একটি চৌকি আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। তারা এ চৌকিটি হালকাভাবে নিয়ে নেয়। একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন মােরাটিয়া চৌকি হাতিয়ে নেয়। এ কাজটিও হালকাভাবেই করা হয়। এর অর্থ হলাে শত্রুবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামাঞ্চলের ভূখণ্ডের ৪৫ মাইলের ভিতরে প্রবেশ করে। ভারতীয়রা চট্টগ্রাম থেকে ৪৫ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত রাঙ্গামাটির ওপর দারুণ চাপ প্রয়োেগ শুরু করে। রাঙ্গামাটির সম্মুখে অবস্থিত বরকলে শত্রুরা আক্রমণ চালায়। ৯১ এহক ব্রিগেড এই আক্রমণ প্রতিহত করে।
৮৪। ১৮ নভেম্বর তারিখে আমাদের ৯১ এহক ব্রিগেড মােরাটিয়া পােস্ট এলাকায় শত্রুপক্ষের মােকাবিলা করে। তারা তাদের সেখানে অবস্থান করতে বাধ্য করে। কিন্তু বিলম্বে হলেও ২০ নভেম্বর তারিখে শত্রুরা খাগড়াচারা অতিক্রম করে।
৮৫। ফেনী, লাকসাম এবং কুমিল্লা অঞ্চলে শক্ররা বিলােনিয়া দখলে নেবার পর খুবই সতর্ক হয়ে এগােতে থাকে। এবং ২৪ নভেম্বর তারিখে, একটি শিখ ও একটি বিএসএফ ব্যাটালিয়ান নিয়ে তারা চৌদ্দগ্রাম এলাকায় আমাদের মুখােমুখি হয়। ২৫ নভেম্বর ভারতীয়রা ফেনীর ওপর গােলাবর্ষণ করে। এতে বেশকিছু বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সেজন্য পরবর্তী দুদিনের মধ্যে ফেনী শহরের বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
৮৬। ২৯ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির উত্তরে শত্রুপক্ষ আনুমানিক এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য (ছত্রিসেনা) হেলিকপ্টারের সাহায্যে অবতরণ করায়।
৮৭। চৌদ্দগ্রামে ৫৩ ব্রিগেড এলাকায় ২৩ পাঞ্জাব অবস্থান করছিল (এক কোম্পানির কম)। সেখানে শত্রুপক্ষ ৩/৪ ডিসেম্বর রাতেরবেলায় মূল আক্রমণ পরিচালনা করে। এই আক্রমণে অংশ নিয়েছিল দুই ব্রিগেড সৈন্য। তাদের সমর্থনে ছিল বিএসএফ এবং মুক্তিবাহিনী। তাদের এক ব্রিগেড সৈন্য চাঁদপুর ঘেরাও করে ফেলে এবং তারা চাঁদপুর বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অন্য একটি প্রচেষ্টার দ্বারা উত্তর দিক থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মুজাফগঞ্জমুখী* হয়। ভারতীয় বাহিনীর মালামাল বহন করে স্থানীয় অধিবাসী। তারা তাদের পথঘাটও দেখায়। প্রতিটি
———————————————
* মূল প্রতিবেদনে মুজাফফরগঞ্জ বানান কোথাও কোথাও মদাফফরগঞ্জ লেখা হয়েছে অনুবাদক।
———————————————
১৫৬
ব্যাটালিয়নের জন্য প্রায় ২০০ মানুষ নিযুক্ত হয়। এই অবস্থানটি আমাদের বাহিনী ডিসেম্বরের ৪ তারিখে পরিত্যাগ করে। বলা হয়ে থাকে অবস্থানটি পরিত্যাগ করা হয়েছিল জিওসিএর অনুমােদনক্রমে। তারপর বাহিনী লাকসামের দিকে ফিরে আসে। অন্যদিকে ডাকাতিয়া নদীর পেছনে আমাদের বাহিনী পেরিকোটে প্রতিরােধ যুদ্ধ চলমান রাখে। এভাবে তারা প্রত্যাবর্তনরত সৈন্যদের প্রত্যাবর্তন নিরাপদে রাখতে তৎপর হয়।
৮৮। আমাদের ভূখণ্ডের উপর ভারতীয় বাহিনীর সকল দিক; যেমন- সাঁজোয়া, গােলন্দাজ, বিমানসহ নিত্যনৈমিত্তিক পদচারণার মুখে আমরা এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত হতে অসুবিধাজনক বলে মনে করি যে, ভারতীয়রা তখন পর্যন্ত কেবলমাত্র সীমিত পরিধির যুদ্ধের মধ্যে ছিল; যার দ্বারা তারা কিছু পরিমাণ ভূমি দখলপূর্বক সেখানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
৮৯। উপরে উল্লিখিত বর্ণনামতে বাস্তবতা ও সত্য উপলব্ধি করলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শত্রুদের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দখল করে ঢাকার উপর ‘ধরাসায়ী আঘাত হানা; এভাবেই ভারতীয়রা কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গােয়েন্দা তৎপরাও ছিল সেরূপ। উদ্দেশ্য যে কেবলমাত্র “কিছু পরিমাণ ভূমি” দখলে নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা তা নয়; বরং সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সেই উদ্দেশ্যে দখল করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। যদি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার তার চতুর্পার্শ্বের পরিস্থিতি দেখতে ও বুঝতে অস্বীকার করে থাকেন তাহলে বলা যায় তিনি সুস্পষ্টভাবে ছিলেন সামরিক মাত্রার যুদ্ধের পরিস্থিতি বুঝবার জন্য অক্ষম ব্যক্তি। অথবা, নিকৃষ্টভাবে বলা যায়, জিএইচকিউ কর্তৃক প্রদত্ত খবর-বার্তার প্রতি ‘থােরাই কেয়ার করার মতাে অনিচ্ছাপ্রবণ মানুষ। এটি তার কাছে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছিল যে, তাঁর বাহিনী সীমান্ত এলাকার সর্বত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পকেটে ভারতীয়দের আঘাত ও ভীতির প্রতি সমুচিত জবাব দিয়ে কোনাে সফলতা দেখাতে পারছিল না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অন্ততপক্ষে একটি ব্রিগেডের শক্তি সঞ্চিত করে শত্রুর মুখােমুখি হতে পারছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি তার পরিকল্পানার মধ্যে স্থান পায়নি। তার ফলাফল ছিল এমন যা আমরা উপলব্ধি করতে পারলাম, যখন শত্রুদের চাপ এলাে; তখন আমাদের বাহিনী পিছু হটে এলাে। বাস্তবতা হলাে যেসব স্থানকে দুর্গ বলে গড়ে তােলা হয়েছিল বা শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হতাে; সেই সব দুর্গ ও শক্ত ঘাঁটিও ধরে রাখতে পারল না।
৯০। শত্রুদের ছত্রিসেনা নামবার পরিকল্পনাও কমান্ডারের ছিল অজানা। এমনকি যেসব স্থানে সম্ভাব্য ছত্রিসেনা নামাতে পারে, সেখানে তাঁদের সঙ্গে লড়বার মতাে আগে থেকে কোনাে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।
৯১। অধিকতর আশ্চর্যজনক হলাে; যদি এমনকি পরিকল্পনাও থাকত, তাহলেও ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, ঢাকায় শত্রুদের আগমন থামাতে পারতেন না, তারপরও বলা যায়, সেজন্যও তেমন কোনাে প্রকার পরিকল্পিত ব্যবস্থা ছিল না। যদি এ কাজ করার মতাে কার্যকর ইচ্ছা তিনি পােষণ করতেন, তাহলে তার জন্য প্রয়ােজন। হতাে সেনা বরাদ্দ করা এবং তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা, যাতে করে তারা শত্রুদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে সক্ষম হন। কিন্তু সেজন্য তেমন কিছুই করা
১৫৭
হয়নি। কোনাে অবস্থান বা ক্ষেত্রেই তিনি প্রস্তুত ছিলেন না, কোনাে সেনা-বরাদ্দও ছিল না। কোনাে নির্দেশনাসহ কোনাে মানুষ কোনাে পর্যায়েই দেওয়া হয়নি। কেবলমাত্র যখন শত্রুবাহিনী উত্তম অবস্থানে চলে এলাে এবং আমাদের নিজস্ব বাহিনী পিছু হটে আসছিল তখন সেই উদ্দেশ্যে একটি মরণপণ কর্মকাণ্ড নেওয়া হলাে। কিন্তু ইতােমধ্যে তা অতি বিলম্বিত হয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিক যেসব বাধা আমাদের বাহিনী প্রত্যাশা করেছিল যা উৎরিয়ে সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করা যায়; বাস্তবে তার চেয়েও অধিক পরিমাণে বাধা-বিপত্তি আসে। ফলে কার্যত তা আমাদের সৈন্যদের পিছু হটাকেও বাধাগ্রস্ত করে তােলে। এ বিষয়টি আমারা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাব।
১৫৮

৪৬
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর হতে সর্বশক্তি নিয়ােগসম্পন্ন যুদ্ধ

১। আমাদের মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অধ্যায়ে আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর, বিকেল ৫টার সময় আমাদের বিমান বাহিনী (যেভাবে বলা হয়েছে) পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণ চালায় ভারতের শ্রীনগর, পাঠানকোট, অমিত্রসর, হালওয়ারা, সিসরা এবং আমবালার ‘এয়ারবেজের ওপর। তবে এর দ্বারা ইস্টার্ন থিয়েটারের জন্য দুর্ভাগ্যজনক প্রভাব সৃষ্ট হয়। এখন আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব এ ধরনের কর্মকাণ্ড কতখানি সঠিক ছিল। এজন্য যে, যদি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলা না হতাে; তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ তীব্রতর হতাে না।
২। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা আমাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছি ভারতীয়রা কোনাে প্রকার অজুহাতের জন্য বসে থাকত না। তারা ইতােমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে, ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর হতে সর্বশক্তি নিয়ােগসম্পন্ন যুদ্ধারম্ভ করবে। এজন্য যদি প্রয়ােজন দেখা দেয়। এমনকি তারা বিমানবাহিনীও ব্যবহার করবে। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর তাদের বিমানবাহিনী প্রথমে দৃশ্যপটে দেখা যায়। তারা তখন মােগােলহাটে বােমাবর্ষণ করে। এই দিন হতে পরবর্তী সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী উপর্যুপরিভাবে আমাদের আকাশসীমা লংঘন করে। ২২ নভেম্বর তারা তাদের স্থলবাহিনীকে বিমান সমর্থন দেয়। তারা শার্শা, বেনাপােল, নাভারন এবং রঘুনাথপুরে রকেট নিক্ষেপ করে। পুনরায় তারা তাদের বাহিনীর সমর্থনে এগিয়ে আসে; যখন আমাদের বাহিনী চৌগাছা-গৌরীপুর এলাকায় প্রতিআক্রমণ চালায়। এই পর্যায়ে আমাদের বিমানবাহিনীকে দৃশ্যপটে আনা হয়। আমাদের তিনটি এয়ারক্রাফট উড্ডয়ন করা হলে পর ভারতীয়রা পাকড়াও করে দুটি ফেলে দেয়। একই দিনে তারা মাগুরায় ৯ম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারে বােমাবর্ষণ করে।
৩। ২৪ নভেম্বর তারিখে ভারতীয় হান্টার এয়ারক্রাফ্ট বগুড়া সেক্টরের নওপাড়া অবস্থানের ওপর বােমাবর্ষণ করে। একই দিনে রংপুর সেক্টরের অমরখানার ওপর দিয়ে তাদের উড়তে দেখা যায়।
৪। ২৫ নভেম্বর তারিখে রংপুর-বগুড়া সেক্টরের হিলি অবস্থানে আক্রমণ করতে গিয়েও তারা বিমান সমর্থন নেয়। অনুরূপভাবে ২৭ নভেম্বর তারিখে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বােমাবর্ষণের পরে পঞ্চগড়ে আক্রমণ চালানাে হয়। একই রকমের কৌশল ওই একই এলাকায় পুনরায় ২৮ নভেম্বর এবং ২৯ নভেম্বর তারিখে
১৫৯
পুনরাবৃত্তি করা হয়। বাস্তবে শত্রুরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে ছত্রিসেনা নামানাের কাজটি করেছিল।
৫। এমতাবস্থায়, আমরা বুঝতে অক্ষম হই যখন বলা হয় যে, ভারতীয় বিমানবাহিনী কেবল মাত্র দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলার পরে ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী ইতােমধ্যে কাজ আরম্ভ করেছিল। আসলে সত্য হলাে; ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ হতে তারা তাদের বিমান বাহিনীর কার্যক্রম জোরদার করেছিল। তারা ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান বহরের ওপর রকেট হামলা ও বােমা নিক্ষেপ করেছিল । আমাদের ছিল কেবলমাত্র একটি স্কোয়াড্রন, তা-ও অকার্যকর অবস্থার মুখােমুখি ছিল। আকাশের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেই তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। যা কি না ভূমি অথবা নৌপথে সম্ভব ছিল না।
৭। পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলার অন্য আর একটি ফলাফল ইস্টার্ন থিয়েটারের ওপর ছিল। ইতােমধ্যে বঙ্গোপােসাগরে অবস্থান নিয়ে থাকা ভারতের ইস্টার্ন ফ্লিট চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল । এবং সেইসঙ্গে চট্টগ্রাম সমুদ্ৰাঞ্চল থেকে নৌবহরে থাকা বিমান থেকে তারা বােমাবর্ষণ করল। ভারতীয় এয়ারক্রাফ্ট বহনকারী “ভিকরান্ট” এর পরে কক্সবাজারের ওপরও বােমাবর্ষণ করে। সেজন্য আমরা বিনা দ্বিধায় এই উপসংহারে উপনীত হতে চাই যে, ইস্টার্ন কমান্ড সামগ্রিকভাবে একটি ভুল ধারণার উপরে দণ্ডায়মান ছিল। তারা সত্যিই ভেবে থাকত যে, যদি দ্বিতীয় ফ্রন্ট ভােলা না হয় তাহলেও পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ হবে, তাহলে সে অবস্থায় তারা সমুদ্রাঞ্চলের সীমানায় ভারসাম্যহীনতা, অপর্যাপ্ততা এবং সম্পদহীনতার পরও শত্রুকে আটকিয়ে রাখার ব্যবস্থা নিতে পারত।
৮। এই বিষয়টি উল্লেখপূর্বক আমরা এখন পূর্ব পাকিস্তানে সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধের বর্ণনা বিবরণ দিতে অগ্রসর হবাে, যার ভিত্তি হবে ইতােমধ্যে আমাদের বিবৃত অধ্যায়সমূহের তথ্য-উপাত্ত ।

যশাের-খুলনা সেক্টর
৯। এই অঞ্চলটি ছিল ১০৭ ব্রিগেডের অধীন, আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে আমাদের সেনাবাহিনী চৌগাছা খালি করে দেয়। এটি ছিল একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। গবীরপুর গ্রামে আমাদের প্রতি-আক্রমণ ব্যর্থ হলে পর আফ্রা এলাকায় পুনরায় সৈন্য মােতায়েন করা হয়। এর অবস্থান ছিল যশাের সেনানিবাস থেকে কয়েক মাইল দূরে। এই ব্যাটালিয়ন থেকে আরও একটি কোম্পানি বেনাপােলে নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু তা প্রত্যাহার করে ঝিকরগাছা এবং আরও অগ্রবর্তী অবস্থান শার্শায় ও নাভারনে নেওয়া হয়। ২৫ নভেম্বর তারিখে কোনাে প্রকার যুদ্ধ ব্যতীতই, জীবননগরের অবস্থান পরিত্যাগ করা হয়। ২৭ নভেম্বরের মধ্যে শত্রু বাহিনী সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কোটচাঁদপুরে আসে। তারা ঝিনাইদা ও যশাের সড়ক হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। তারা আরও সামনে অগ্রসরপ্রবণ হয়ে গবীরপুর-আফ্রা এলাকার ফাঁক-ফোকরের ভেতর দিকে আমাদের দিকে আসতে থাকে।
১০। এই পর্যায়ে ১০৭ ব্রিগেড ছিল অত্যন্ত মরণপণ অবস্থায়। এই ব্রিগেড ইতােমধ্যে তার নিজস্ব বাহিনী বাদ দিয়ে দিয়েছিল। তারা ডিভিশনের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট
১৬০
সংরক্ষিত অংশ এবং সেইসঙ্গে কমান্ড সংরক্ষণ থেকে নতুন সংখ্যক সৈন্য পেয়েছিল । এরা এসেছিল ১৬ ডিভিশন থেকে। এ সময় এর অবস্থান সম্পর্কে ব্রিগেড কমান্ডার বলেন-
“৬ পাঞ্জাব ছিল আফ্রা-মেরুরেখার এপাশ-ওপাশে ঝুলন্ত অবস্থায়। ১২ পাঞ্জাব (এক কোম্পানিরও কম) ঝিকরগাছা মেরুরেখায় এবং এ দুটোর মধ্যে ফাঁক ছিল ৬ থেকে ৭ মাইল । আর তা পূরণ করতে চাওয়া হয়েছিল ইপিসিএএফ এর একটি কোম্পানির দ্বারা । আফ্রায় ৬ পাঞ্জাব এর পার্শ্বদেশ সম্প্রসারিত করা হয়েছিল এক্স-১২ পাঞ্জাব নামের অতিরিক্ত কোম্পানির দ্বারা। এবং দক্ষিণ পার্শ্ব ২২ এফএফ-এর দ্বারা পূর্ণ করতে চাওয়া হয়েছিল বেনাপােল হতে। এভাবে ঝিকরগাছার সঙ্গে সংযােগ স্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। এই ছিল সমস্ত শক্তি-১০ কোম্পানি; অথবা দুই এবং অর্ধ (২.৫) ব্যাটালিয়ন। এটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয় অথচ এর কোনাে গভীরতা ছিল না এবং এর ছিল না কোনাে সংরক্ষণ বাহিনী। যশােরে তেমন অতিরিক্ত কেউই ছিল না। সেখানে ছিল কেবলমাত্র একটি ফিল্ড আর্টিলারি; এর দায়িত্ব ছিল সমগ্র সম্মুখ ভাগকে সমর্থন দেওয়া।” ।
১১। এই ধরনের সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে যশাের পাহারা দেবার জন্য ১০৭ ব্রিগেডকে ১.৫ ব্যাটালিয়ন সৈন্য দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল এই যে, বাদবাকি ২২ এফএফ তখন পর্যন্ত ছিল বেনাপােলে এবং ১৫ এফএফ ছিল সাতক্ষীরায় ।
১২। আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে, এ সময়ের ভিতর নভেম্বরের শেষের দিকে, ব্রিগেড কমান্ডার ঝিকরগাছায় প্রেরণের জন্য বাদবাকি ২২ এফএফ এর জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু ৯ ডিভিশনের জিওসি, ইত্যবসরে হেডকোয়ার্টার যশাের হতে তা মাগুরায় পরিবর্তন করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি এই অনুরােধ নাকচ করে দেন এই কারণ দেখিয়ে যে, বেনাপােল একটি সম্মানজনক অবস্থান এবং কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড, বারবার জোর দিয়েছেন যেন তা ধরে রাখা হয়। জিওসি (সাক্ষী নং ২৩৩), সুস্পষ্টভাবে এটি অস্বীকার করেন এবং বলেন তিনি এ ধরনের প্রত্যাহারের অনুমােদন দেননি এবং বলেন যে, “এটি একটি চরম মিথ্যা কথা।”
১৩। এটি বােধগম্য নয়, কী কারণে ব্রিগেড কমান্ডার দুই কোম্পানি সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। কেননা এমনকি ইস্টার্ন কমান্ডের নিদের্শনা ছিল কোনাে প্রত্যাহার কার্যকর হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না “টু-আপ” ধারায় তা না আসে। এই উদ্দেশ্যে সেজন্য জিওসি অথবা ইস্টার্ন কমান্ডের অনুমতি নেবার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। ব্রিগেড কমান্ডার তারপর এই বৈরী অবস্থার মুখােমুখি হন। তিনি ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন যে, বরাবর থেকেই তিনি কমান্ডের অনড় অবস্থান অবলােকন করেছিলেন আর সেজন্যই সৈন্য অন্যত্র সরিয়ে নেবার আগে তিনি জিওসি-এর অনুমতি গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ ব্যাখ্যা আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। অবশ্য
১৬১
পিছিয়ে আসার প্রয়ােজনে, কৌশলগত প্রত্যাহার সম্পূর্ণভাবে আলাদা কথা। এ অবস্থায় কমান্ডার নিজেও তা স্বীকার করে নেন এবং এর ওপর তিনি কোনাে বাধা-নিষেধ আরােপ করেননি। বিষয়টি স্থানীয় কমান্ডারের জন্য মুক্ত রাখা হয় । তারা স্বাধীনভাবেই সমন্বয় করার অধিকার রাখেন যদি তিনি তা উত্তম মনে করেন। জেনারেল নিয়াজী (সাক্ষী নং ২৮৫) বলেন, “তিনি যুদ্ধে লড়াই করার খাতিরে সৈন্য প্রত্যাহার করেন, তাই এ প্রত্যাহার-দৌড়ে পালিয়ে আসার জন্য ছিল না।”
১৪। বেনাপােলের পার্শ্বে অবস্থিত গরীবপুরে শত্রুপক্ষের সেনা-অবস্থান ইতােমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। সেখানে আর কোনাে উপায় ছিল না। সেজন্য বেনাপােলে কোনাে বাহিনী ফেলে আসার অর্থ ছিল যােগাযােগ বিচ্ছিন্নতাবস্থায় সেই ব্রিগেডকে হারিয়ে ফেলা। ব্রিগেড কমান্ডার, যদি তিনি প্রয়ােজনীয় বলে বিবেচনা করেন যে, বাহিনী প্রত্যাহার করে যশাের দুর্গে আনা দরকার, তা হলে তিনি তা করতে পারেন বা করবেন।
১৫। সাতক্ষীরায় অবস্থিত ১৫ এফএফ, ছিল ঝিকরগাছা হতে ৩০ মাইল দূরে, তারা সম্ভাব্য অক্ষরেখার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। কারণ সেখানে ভারতীয়দের প্রবেশ করার সম্ভাবনা ছিল । বিশেষ করে প্রারম্ভিক গােয়েন্দা প্রতিবেদনের মতে । কিন্তু তাদেরকেও প্রত্যাহার করে যশাের আনার প্রয়ােজন হয়েছিল, যাতে করে সেখানকার প্রতিরােধ গভীর করা যায়। কেননা, তখন শত্রুপক্ষ তাদের স্বরূপ উন্মােচন করে যশােরের দিকে অগ্রসরমান ছিল। জিওসি অথবা থিয়েটার কমান্ডারের সঙ্গে কোনােরূপ আলােচনা ছাড়াই তিনি ব্যাটালিয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি যশাের পরিত্যক্ত করেছিলেন। সে সময়ে নির্দেশনা যথারীতি কাজ করেনি। শত্রুরা পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বয়রা এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে তিনটি অক্ষরেখা উন্মুক্ত করেছিল। প্রথমটি হলাে জীবননগর হয়ে কোটচাদপুর এবং তারপর কালিগঞ্জ অভিমুখ। এটি ছিল যশাের হতে মাত্র ২০ মাইল দূরবর্তী এলাকা। ইতােমধ্য শত্রুরা জীবননগর দখলে নিয়ে নিয়েছিল এবং কোটচাঁদপুরকে ভীতির মধ্যে রেখেছিল । কিন্তু সেখানে তারা আফ্রিদীর টাস্ক কোর্সের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাদেরকে কোটচাদপুর উদ্ধার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জিওসি, ৯ম ডিভিশনের ভাষ্য অনুযায়ী তারা শত্রুর অগ্রগতি বিলম্বিত করেছিল এবং কালিগঞ্জের পতন হতে দেয়নি।
১৬। পরবর্তী মেরুরেখা ছিল চৌগাছা। এটি ছিল যশাের হতে মাত্র ১৫ মাইল দূরবর্তী। শত্রুসৈন্যরা এই মেরুরেখার ওপরও ছিল । চৌগাছা খালি করে দেওয়া হয়েছিল। শত্রুপক্ষ প্রতিরক্ষা রেখার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠুকে পড়তে থাকে।
১৭। তৃতীয় মেরুরেখা ছিল বেনাপােল হয়ে ঝিকরগাছা । এটি ছিল যশাের হতে মাত্র ৮ মাইল দূরবর্তী। তখন পর্যন্ত ঝিকরগাছা আমাদের দখলের মধ্যে ছিল। শত্রুরা তিনটি মেরুরেখার সংস্পর্শী হয়ে এগিয়ে আসে। যশােরের ১৪ মাইল দূরে ছিল বাহ্যিক প্রতিরক্ষা। সেখানে আমাদের অনিশ্চিতভাবে গড়ে তােলা একটি সরু প্রতিরক্ষা বলয় ছিল। এ প্রতিরক্ষা বলয়টি ছিল মূলত সম্প্রসারিত ধারায়
১৬২
কালিগঞ্জ থেকে ঝিকরড়াছা অবধি । তবে তা ছিল কোটচাঁদপুর এবং চৌগাছার ভিতর দিয়ে তৈরি।
১৮। ২৭ নভেম্বর হতে ৫৭ ব্রিগেড এলাকায় শত্রুরা আগের চাইতে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ১০৭ ব্রিগেডের এলাকায় আফ্রা অবস্থানের সামনে নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য তারা কিছু সময় নেয়। তারপর ৫ ডিসেম্বরে চৌগাছার রাস্তায় তারা চাপ বাড়িয়ে দেয়। সেখানে ৬ পাঞ্জাব অবস্থান করছিল। কয়েকশত গজ প্রশস্ত একটি খাদ অতিক্রম করতে তারা সফল হয়। কিছু সংখ্যক ভারতীয় ট্যাঙ্ক সেখানে আটকা পড়ে। তবে এটি নিশ্চিত, কিছু সংখ্যক ট্যাঙ্ক উৎরে গিয়েছিল । ব্রিগেড কমান্ডারের মতে এ সংখ্যা হতে পারে ১৬। কিন্তু জিওসি এটি নাকোচ করে দেন এবং বলেন ট্যাঙ্ক নয় তা ছিল কেবলমাত্র এপিসি। দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, ব্রিগেড কমান্ডার এটি তদন্ত এবং গণনা করে দেখারও প্রয়ােজনবােধ করেননি।
১৯। উভয় পক্ষের অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখন পর্যন্ত ছিল অটুট। কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার বিষয়টি নিরীক্ষা করার মতাে কষ্ট স্বীকার না করেই ধরে নেন যে, “প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শত্রুপক্ষের দ্বারা তছনছ হয়ে গিয়েছে। অতএব, আমাদের হাতে তাদের আর প্রতিরােধ করার মতাে শক্তি নেই।” শত্রুরা যশােরে এক্ষুনি ঢুকে পড়বে। সে মতাে তিনি তার মনােস্থির করেন এবং যশাের পরিত্যাগ করে খুলনা অভিমুখে যাত্রা করেন। যদিও ইত্যবসরে ২২ এফএফকে বেনাপােল হতে প্রত্যাহার করার জন্য (৫/৬ ডিসেম্বর) অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল। সে কারণে সেখান থেকে রাতের প্রথম প্রহরে তারা যশােরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।
২০। ব্রিগেড কমান্ডার দাবি করে বলেন যে, ভারতীয়দের ট্যাঙ্কের সাফল্য সম্পর্কে খবর পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে তিনি সঠিকভাবে পরিমাপ করেন যে, তার দ্বারা সৃষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনিবার্যভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই সে অবস্থায় শক্রদের কোনাে বাড়তি বিরােধিতা না করে যশােরে মুক্তভাবে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় । পুনরায় কেউ বলতে পারেন যে, ব্রিগেডিয়ার হায়াত (সাক্ষী নং ২২৩) বিষয়টি খতিয়ে দেখার অভিপ্রায়ে কখনাে পিছনের পানে তাকিয়ে দেখেননি। এমনকি, যদিও তাঁকে জিওসি সেভাবে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই পরিমাপ যদি হয়েও থাকে, তাহলে তা সম্পন্ন করা হয়েছিল মিথ্যা তথ্য ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।
২১। এই অবস্থায় তিনি বলেন যে, তিনি জিওসি’র সঙ্গে যােগাযােগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাকে আর পাওয়া যায়নি। তারপর তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের সংস্পর্শে আসেন এবং যশাের খালি করে খুলনা অভিমুখে যাত্রা করার সুযােগ পান। তার বিবেচনায় এটি ছিল অধিকতরভাবে কার্যকর। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার কিংবা তার চীফ অব স্টাফ কেউই ব্রিগেড কমান্ডারের এই বক্তব্যের প্রতি সমর্থন দেননি। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং তাঁর চী অব স্টাফ স্বীকার করেন যে, ৫ ডিসেম্বর ব্রিগেড কমান্ডার তাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং জানান যে, তিনি খুলনা অভিমুখে যাচ্ছেন এবং এটাই তার “আখেরি সালাম”। কিন্তু তাঁরা কেউই তাঁকে যশাের খালি করার অনুমতি
১৬৩
দেননি। তাঁরা পরিষ্কারভাবে তাঁকে বলেছিলেন তিনি যেন জিওসি’র নিকট থেকে অনুমতি নেন। অথবা পরে যেন তিনি তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। জিওসি (সাক্ষী নং ২৩৩) বলেন, “৬ তারিখে আনুমানিক ১৬০০ সময়ে যখন আমি ব্রিগেডের খোঁজখবর নেবার জন্য হায়াতকে ফোন দিই … তিনি তখন বলেন যে, তিনি সামনে যাচ্ছেন না। আমি বলেছিলাম, আপনি অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাবেন এবং দেখবেন কী ঘটছে। তিনি আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলছিলেন, তখন তিনি সামান্য ধাক্কা খাচ্ছিলেন এবং বলেন, “স্যার শত্রুরা যশাের সেনানিবাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, ‘খােদা হাফেজ,…’ এবং এই কথা বলে তিনি ফোন রেখে দেন।” আমরা জানতাম যে, শত্রুরা তখনও যশােরে ঢুকে পড়েনি। অবশ্য, আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন অত্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে। তাই তিনি জিওসি’র আদেশ-নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করেননি। বাস্তবিকভাবে, এমনকি রসদ এবং গােলাবারুদ ধ্বংস করার মতাে সময়ও তিনি নেননি। কিংবা তার ইউনিট থেকে যথার্থ নির্দেশও নিতে পারেননি যে, তিনি খুলনা অভিমুখে যাচ্ছেন। ফলে তার বাহিনী এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানতে পারলেন না শত্রুর কাছে যশাের ছেড়ে দিয়ে তিনি খুলনায় গিয়েই বা কী করবেন!
২২। শত্রুরা তখনও পর্যন্ত যশাের দুর্গের নাগাল পায়নি। তারা যশাের দুর্গটি শূন্য দেখতে পাবেন এমনটি প্রত্যাশা করেনি। সে কারণে তারা খুবই সর্তকতার সঙ্গে এগােতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর বিকালবেলা যশাের প্রবেশ করে এটি তারা শূন্য দেখতে পান। সেজন্য বলা যায়, যশাের আমরা হারিয়েছিলাম এ কারণে নয় যে, সেখানে সৈন্য-সামন্তের অভাব ছিল কিন্তু জিওসি যেভাবে সত্য উচ্চারণ করেছেন, “অকালে খালি করার জন্য।”
২৩। এটি এখন প্রতীয়মান হয় যে, কমান্ডার কর্তৃক যশাের ত্যাগ করে খুলনা গমন, না ছিল পরিকল্পিত এবং না ছিল অনুমােদিত। এ কর্মকাণ্ড কার্যত তার বাহিনীর মধ্যে নানান প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। এ কারণে বাহিনী তাদের হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যােগাযােগ পর্যন্ত করতে পারেনি। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং খুলনার দিকে পিছু হটতে থাকে। এ সময় তাদের ওপর শত্রুপক্ষের দারুণ চাপ ছিল। এজন্য তাদের ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে আসতে হয়। এই পিছু হটা কোনােভাবেই সাধারণ প্রত্যাহার ছিল না, এটি ছিল চরম পরাজয় ও ছত্রভঙ্গাবস্থা। এই পিছু হটা বাহিনী যশােরের বহিঃপরিসীমার প্রতিরক্ষার জন্য দখলদারিত্ব নেয়নি। বরং খুলনার রাস্তা দিয়ে দৌড়ে ছুটেছে। ডিভিশনাল কমান্ডার তার আগের প্রস্তাবের বিপরীতে সিদ্ধান্ত দেন। ফলে ব্রিগেড কমান্ডার খুলনার দিকে ছুটতে থাকেন। এমনকি তার আগের প্রস্তাব তিনি বাতিল করেন, যাতে বলা হয়েছিল একটি রেলগাড়ি যাবে যাতে করে যশাের থেকে গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র খুলনায় বহন করা হবে। এই ঘটনায় অবশ্য আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম কোনাে ডিভিশনাল কমান্ডার ব্রিগেড কমান্ডারের ফোনের মাধ্যমে তাঁর অপ্রত্যাশিত আচরণ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও নিজে মাগুরা হতে বের হয়ে গিয়ে অবস্থার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করলেন না। বিশেষ করে যখন ব্রিগেড কমান্ডার নিখোঁজ হলেন এবং কিছুক্ষণ তার কোনাে প্রকার হদিস ছিল না।
১৬৪
২৪। ব্রিগেড কমান্ডার একমাত্র কাজ সঠিকভাবে করেছিলেন। খুলনার উদ্দেশ্য যাত্রার পথে তিনি সাতক্ষীরা হতে ১৪ এফএফকে ডেকে পাঠান এবং খুলনার রাস্তার ওপর তাদের সমাবেশ করেন ‘ওয়াই (Y) সংযােগের ধারায়। যাতে করে শত্রুদের অগ্রগতি বিলম্বিত হতে পারে । ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৫/৬ তারিখে। রাতে বেনাপােল থেকে ২২ এফএফ কে প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই বাহিনী যশােরের পৌছে তা ফাঁকা দেখে খুলনা অভিমুখে যাত্রা করে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সময়ে ৬ পাঞ্জাব আফ্রা অবস্থান পরিত্যাগ করে যশাের পৌছে তা খালি দেখতে পায়। কমান্ডিং কর্মকর্তা ধারণা করে নেন যে, ব্রিগেড কমান্ডার অবশ্যই খুলনায় চলে গিয়েছেন। তিনি বলেন সেই অবস্থায় তিনিও সে পথে যাওয়ার চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেন। তিনিও তাঁর পথই অনুসরণ করেন (বক্তব্য লে. কর্নেল, মালিক, সাক্ষী নং ২২৪)।
২৫। ইত্যবসরে শত্রুরা প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি ক্ষীণ বলয় ভেঙে ফেলেন এবং বাহিনীকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। তবে তারা তাৎক্ষণিকভাবে যশােরে প্রবেশ করেনি। পরের দিন তারা যশােরে প্রবেশ করেন। ইতােমধ্যে পিছু হটা বাহিনী ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার খালি পড়ে থাকতে দেখে, তারাও ব্রিগেড কমান্ডারের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। যদিও ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তারা তার কোনাে প্রকার খোঁজ পাননি যে, তার অবস্থান কোথায়। তারপর তিনি নিজে খুলনা ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল ফজলে হামিদের মাধ্যমে জিওসি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তিনি তাঁদের জানান তারা নােয়াপাড়া এলাকায় তাদের হেডকোয়াটার স্থাপন করেছেন।
২৬। বাহিনী সরিয়ে আনাই ছিল অবশ্য প্রতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা যদি তা যশােরের প্রতিরক্ষা কাজে না লাগত। তবে সে অবস্থায় যাত্রা পথ হবে ঝিনাইদা এবং তারপর মাগুরা। সেখানে এজন্য সিমুলখালিতে নতুন পথের মাথায় সৈন্য সমাবেশও করা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার মতামত দেন যে, সেই পথটিও শত্রুবাহিনী বন্ধ করে রেখেছিল। তারা যশাের-ঝিনাইদা রাস্তার ওপরও ঝুলে ছিলেন। সে কারণে, পিছানাের মতাে একমাত্র পথ ছিল খুলনা অভিমুখে যাওয়া । সেইসময় যেহেতু তিনি কোনাে প্রকার পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাননি; তাঁর। নিজের জিওসি অথবা ইস্টার্ন কমান্ড থেকে, তাই তিনি খুলনার রাস্তাতে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন। তার এই প্রত্যাশা ছিল যে, তাতে করে তিনি সেই পথে শত্রুদের অগ্রযাত্রা বিলম্ব করতে পারবেন এবং খুলনায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে পারবেন। ব্রিগেডিয়ারের ধারণা সঠিক এবং যথার্থ ছিল না। যদি তিনি চাইতেন তাহলে ৬ ডিসেম্বরে তিনি শিমুলখালি হয়ে মাগুরা যেতে পারতেন।
২৭। শত্রুদের বিবেচনা ছিল প্রথমত, মাগুরার দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং তারপর মধুমতি নদী অতিক্রম করে ফরিদপুর পৌছা। সেখান থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এটি প্রত্যাশিত ছিল না যে, শত্রুরা খুলনা অভিমুখে যাবে। এই অবস্থায়, শত্রুরা একটি ভুল করে। যশাের ফাঁকা দেখতে পেয়ে তারা ব্রিগেডিয়ার হায়াতের নাগাল পেতে খুলনার দিকে যেতে থাকে।
১৬৫
২৮। ইতােমধ্যে, ব্রিগেড কমান্ডার বেনাপােল এবং সাতক্ষীরার বাহিনী পেয়ে যান এবং তাদেরকেও পান যারা প্রতিরক্ষা লাইনে ছিলেন। তাদের দ্বারা তিনি ১৯৭১ সালের ৮ এবং ৯ তারিখে খুলনায় প্রতিরােধ সুসংগঠিত করেন।
২৯। এই ভুলের কারণে তার মূল্য ছিল বিলম্বতা; সেজন্য তাঁকে খুলনার পথে হিংস্র যুদ্ধের মুখােমুখি হতে হয় এবং ১০৭ ব্রিগেডের প্রতিরক্ষা হতে পার্শ্বদেশ অতিক্রম করে যাওয়ার কারণেই ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শত্রুপক্ষের সাফল্য আসে। সেখানে তখনও যুদ্ধ চলছিল যখন কি না অন্যান্যরা আত্মসমর্পণ করেছেন।
৩০। যদি শত্রুপক্ষ এই ভুলটি না করত এবং খুলনার দিকে না যেত, তাহলে হয়তাে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা আরও আগেই ঘটে যেত। কিন্তু যেভাবে ঘটনা ঘটেছিল; তা হলাে, ব্রিগেডিয়ার হায়াত কর্তৃক খুলনা দুর্গ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবার সিদ্ধান্ত দ্রাবরণে হলেও শত্রুদের প্রতি তা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবে সেইসঙ্গে এটিও বলতে হয় যে, ব্রিগেডিয়ার হায়াত খুব কৃতিত্বের সঙ্গে খুলনায় যুদ্ধ করেছিলেন। তবে যশােরের পতন মনস্তাত্ত্বিকভাবে সেনাবাহিনী এবং জাতিকে সাংঘাতিকভাবে হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল।

৫৭ ব্রিগেড :
৩১। এবার চলুন আমরা ৫৭ ব্রিগেডের দিকে দেখি। আমরা ইতােমধ্যে যা দেখেছি, শত্রুদের একটি ব্রিগেড ৪ মাউনটেইন ডিভিশন, দর্শনা অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং অন্য আর একটি সমান্তরালভাবে ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর আরও দক্ষিণের দিকে আন্দুলবাড়ীয়া ও কোটচাঁদপুরের দিকে এগিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর উথালীর পতনের ফল হিসেবে দর্শনা ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে যায়। শত্রুরা কোটচাদপুরকেও ভীতির মধ্যে ফেলে দেয়। কেননা, এটি ছিল যােগাযােগের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয়রা এই অবস্থান ধরে রেখেছিল । ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরে তারা আরও একটি আক্রমণ চালায়। আর এ স্থানটি ছিল দর্শনা অঞ্চলে। স্থানটির ভিতর দিয়ে রেলপথ চলে গিয়েছে। ১৮ পাঞ্জাব কোম্পানি অংশত অবস্থানটি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। সেখানে তারা তাদের নিজস্ব অবস্থান ধরে রেখেছিল ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখানে হতাহত হয়েছিল প্রায় একশত জন।
৩২। এমতাবস্থায় শত্রুপক্ষ দুই কোম্পানি সৈন্য, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক প্রেরণ করে। আমাদের সৈন্যদের সরিয়ে আনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। শত্রুদের এই বাহিনী গ্রামাঞ্চলের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা পথপ্রদর্শিত হয় ১৯৭১ সালের ৪/৫ ডিসেম্বর রাতে। তারা চুয়াডাঙ্গার পেছনে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়। ব্রিগেড কমান্ডার শত্রুদের দ্রুত অবরুদ্ধকরণ ও অপসারণের জন্য প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর কোটচাদপুরের (১৫ মাইল দূরেই অবস্থিত ছিল) পতন হয়। ফলে ঝিনাইদা হয়ে কালিগঞ্জের রাস্তার ওপর শত্রুপক্ষ শক্তভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে।
৩৩। ব্রিগেড কমান্ডার দেখতে পান, তার হাতে কেবলমাত্র ১৮ পাঞ্জাবের দুটি কোম্পানি রয়েছে। তবে তার মধ্যে একটি কোম্পানি ৩০ নভেম্বর ১৯৭১,
১৬৬
উথালীতে দারুণভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল। তাদের ছিল একটি ট্যাঙ্ক বাহিনী, আরও ছিল ভারী অস্ত্রসহ একটি প্লাটুন। এটি মেহেরপুর থেকে এসেছিল। একটি কোম্পানি আর’ ও ‘এস এসেছিল প্রাগপুর এবং আর একটি কোম্পানি এসেছিল ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার কর্তৃক প্রদত্ত ৫০ পাঞ্জাব। তবে এ শক্তি শত্রুদের পরাজিত করার জন্য মােটেও যথেষ্ট ছিল না। কেননা, তাদের ছিল প্রায় কমপক্ষে এক ব্রিগেড শক্তিসম্পন্ন বাহিনী। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় আক্রমণ না করে এবং রাস্তা পরিষ্কার করার পরিবর্তে রেলরাস্তা ধরে কুষ্টিয়ার দিকে নিজেদের সরিয়ে নিতে। ডিসেম্বরের ৮ তারিখে তারা কুষ্টিয়া পৌছান। পথে ছিল প্রচুর বাধাবিপত্তি। কেননা, অধিকাংশ কালভার্ট এবং সেতু মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল। তবে সরে আসার এই প্রক্রিয়ায় ব্রিগেড কমান্ডার নিজেই তাঁর হেডকোয়ার্টার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
৩৪। খালিশপুরে অবস্থান ধরে রাখার জন্য নিয়ােজিত ডিভিশনাল কমান্ডারের অধীনস্ত আফ্রিদী টাস্ক ফোর্স দেখতে পান তাদের অতিক্রম করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর তারিখে তারাও ঝিনাইদা ফিরে আসতে থাকেন। তবে শত্রুপক্ষের নিদারুণ চাপের মধ্যে মধুমতি নদীর দিকে সরে আসতে থাকে। চূড়ান্তভাবে তারা ৯ ডিসেম্বর তারিখে সেখানে এসে পৌঁছান।
৩৫। ভারতের ৪ মাউনটেইন ডিভিশন ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ঝিনাইদা দখল করে। তারা তাদের একটি ব্রিগেড মাগুরা এবং অন্য আর একটি ব্রিগেড কুষ্টিয়ায় প্রেরণ করে। কুষ্টিয়ায় প্রেরিত ব্রিগেড ৫৭ ব্রিগেডের প্রতি-আক্রমণের মুখে পড়ে। ভারতীয়দের এক শত সৈন্যের মৃত্যু হয়। চল্লিশ জনকে বন্দি করা হয়। তিনটি ট্যাঙ্ক দখল করা হয় এবং চারটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা হয়। শত্রুপক্ষ ঝিনাইদার দিকে পিছু হটতে থাকে। কিন্তু সেই সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং গােলন্দাজ বাহিনী কুষ্টিয়ার ওপর আঘাত হানে। সে কারণে ১০ ডিসেম্বর তারিখে চূড়ান্ত ভাবে আমাদের বাহিনী কুষ্টিয়া খালি করে দেয় । কুষ্টিয়া হতে আমাদের বাহিনীর একটি অংশ পাশী সেতু পার হয়। বাকি অংশ ফেরির মাধ্যমে নদী পার হয়ে ১৬ ডিভিশনের এলাকায় (বগুড়া-রাজশাহী) পৌছায়। ইস্টার্ন কমান্ড চেয়েছিলেন তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হােক। কিন্তু যেহেতু ব্রিগেড কমান্ডার (১৬ ডিভিশনের মতানুযায়ী) দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন এবং তার বাহিনী ছিল ক্লান্ত; সেইসঙ্গে ছিল অসংগঠিত। এমতাবস্থায়, তাই তাদের পক্ষে ঢাকার দিকে যাওয়ার সম্ভব ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল আতঙ্ক। সে কারণে তাদেরকে বিশ্রাম করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। অন্য একটি ব্যাটালিয়ন এক্স-১৬ ডিভিশন নগরবাড়ী ঘাটে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু, ইত্যবসরে ফেরি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় বিমানবাহনীর তৎপরতার কারণে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে তাদের নিয়ে আসাও সম্ভব ছিল না।
৩৬। মাগুরা অভিমুখী আফ্রিদী বাহিনী কুমারখালীতে অবস্থান নেয়। এটি ছিল মধুমতী নদীর পারে । কুষ্টিয়ায় শত্রুসেনারা কিছু বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গিয়েছিল বলে তারা কিছুটা সতর্ক হয়ে চলাচল করতে থাকে। তারা তাদের সৈন্যদের প্রস্তুত করার জন্য কয়েকটি দিন সময় নেয়। তারপর নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে
১৬৭
থাকে । চূড়ান্তভাবে তারা ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১, মধুমতি নদী পার হন। কিন্তু তার পরের দিন সকাল ১০টায় যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ আসে। ইতােমধ্য অবশ্য ডিভিশনাল কমান্ডার ফরিদপুরে তার হেডকোয়ার্টার ফিরিয়ে নেন।
৩৭। একজন কর্নেলের নিয়ন্ত্রেণ থাকা এক ব্রিগেড, খুলনায় নিয়ােজিত ছিল। ১০৭ ব্রিগেড খুলনায় পৌছবার পর তাদেরকে বরিশালের দিকে যাত্রা করতে বলা হয়েছিল। এই এক ব্রিগেড বরিশালের উদ্দেশ্যে স্টিমার যােগে রওনা হয়েও রাস্তা বদলিয়ে ঢাকা চলে আসে।
৩৮। চালনা বন্দরে অবস্থানরত নৌ কমান্ডার একটি বেসামরিক জাহাজযােগে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন।
৩৯। লে. কর্নেল ভাট্টির নিয়ন্ত্রণাধীন বরিশাল সেক্টর কেবল বেসামরিক বাহিনীর দ্বারা সজ্জিত ছিল। ৩ ডিসেম্বরের পরে সেখানে অবস্থান করা অসহনীয় হয়ে ওঠে। কেননা, তখন মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় তারা সাহায্যের আবেদন জানায়। খুলনা থেকে কর্নেল ফজলে হামিদ এবং তার বাহিনীকে সাহায্যের জন্য বরিশাল প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। আমরা জানতে পেরেছি, এই বাহিনী বরিশালের বদলে ঢাকা যায়। সে অবস্থায় লেফ, কর্নেল। ভাট্টিও ৮ ডিসেম্বর তারিখে বরিশাল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তিনিও ঢাকা পৌছে যাবার ব্যবস্থা করেন। তবে এতে তার বাহিনীর ব্যাপক সৈন্য হতাহত হয়। আর এটি ঘটেছিল নৌপথে, তারা লঞ্চে যাত্রা করেছিলেন।
৪০। সেজন্য এর প্রকৃত (নিট) ফলাফল ছিল, বিশেষ করে ৯ম ডিভিশনের বেলায় বলা যায় ব্যর্থতা। এটি তার মিশন পূরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। যশােরের পতন ছিল একটি দারুণ চপেটাঘাত। ফলে আমাদের সেনাদের নৈতিক মনােবল উল্লেখযােগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই এলাকায় পর্যদস্ত হওয়ার জন্য ইস্টার্ন কমান্ডের ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনাই কেবল দায়ী নয়, সেইসঙ্গে স্থানীয় কমান্ডারদের অবনতিশীল ভূমিকা; বিশেষ করে ব্রিগেডিয়ার হায়াতের হটকারী ভূমিকাও দায়ী। পূর্ব পাকিস্তানে ‘দুর্গ পরিকল্পনার ধারণা ও তার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ ব্যর্থতার চিত্র। এর ভিতর দিয়ে প্রকাশমান হয়ে ওঠে। ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক এই ব্যবস্থার প্রতি কঠোর অবস্থানে থাকার উপর্যুপরী অনঢ় সিদ্ধান্তের ফলাফল হিসেবে চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণের মতাে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
৪১। এমনকি ডিভিশনাল পরিকল্পনার কথা ধরলে বলা যায়, যদি সত্যিই তা থেকে থাকে তবে তা ছিল দুর্বলভাবে প্রণীত এবং দুর্বলভাবেই বাস্তবায়িত । গভীরতা ব্যতীত রৈখিক প্রতিরক্ষা, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যায়। উপরন্তু আমরা না বলে পারছি না যে, এই এলাকায় অভিযান (অপারেশন) কার্যক্রম পরিচলনাও কোনােভাবেই সন্তোষজনক ছিল না। স্থানীয় কমান্ডারগণ যে কেবলমাত্র শত্রু-শক্তিকে খাটো করে দেখেছিলেন তাই নয়, সেইসঙ্গে তারা নেতৃত্ব এবং পথপ্রদর্শনীর দায়িত্বও কাক্ষিত মাত্রায় সম্পন্ন করতে পারেননি। দৃশ্যত তারা তাদের নিজেদের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার বিষয় নিয়েই বেশি। মনােযােগী ছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব তাদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল না। ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডারকে কোনােভাবেই দায়মুক্ত করা যায় না। সুষ্ঠু
১৬৮
পরিকল্পনা প্রণয়ন, অথবা তা কার্যকর করা, তদারকি বিশেষ করে গরীবপুর অথবা যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে যশাের রক্ষার জন্য প্রতি-আক্রমণের বেলায়, কিংবা যশাের দুর্গ রক্ষায় তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কোনাে নির্দেশ ব্যতীতই যশাের পরিত্যক্ত করা, সেখানে কোনাে প্রতিরােধ গড়ে না ভােলা ছিল ব্রিগেড কমান্ডারের জন্য লজ্জাজনক এবং কর্তব্য অবহেলার সামিল।

বগুরা, রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর এলাকা
৪২। আগের অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে মেজর জেনারেল নজর হােসাইন শাহ-এর কমান্ডে ১৬ ডিভিশন এই এলাকার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রস্তুত করা গােয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, শত্রুপক্ষ থেকে প্রধান প্রধান। আক্রমণ পরিচালিত হবে সেই সকল এলাকায় যেখানে ট্যাঙ্কের ব্যবহার করা সুবিধাজনক বলে মনে হবে। এ কারণে এই ডিভিশনকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য ডিভিশনের চাইতে বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তােলা হয়। এজন্য সেখানে তিনটি ব্রিগেড নিয়ােগ করা হয়। এই ব্রিগেডগুলাের জন্য আক্রমণাত্মক এবং প্রতিরােধক উভয় প্রকারের ট্যাঙ্ক সরবরাহ করা হয়। প্রত্যাশা করা হয়েছিল যুদ্ধের সময় “এখানে দ্রুত আমাদের বাহিনী সম্মুখে এগিয়ে যাবে।” তারা হিলির উলটোদিকে অবস্থিত বালুর ঘাট এলাকার ভারতীয় সামরিক অবস্থান গুড়িয়ে দেবে। এর ব্যাপকতা ছিল আমাদের সীমান্ত এলাকা থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। সেইসঙ্গে তারা শিলিগুড়ির দিকে চলমান কুশানগঞ্জ এবং ধূলিয়ানে অবস্থিত শত্রুবাহিনীকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এমনও পরিকল্পনা ছিল যে, সুযােগ আসলে ট্যাঙ্ক বাহিনীর মাধ্যমে তারা ফারাক্কা সেতু পর্যন্ত সম্প্রসারমান হবে।
৪৩। দুর্ভাগ্যজনক হলাে এই যে, যখন এই অতিমাত্রার উচ্চাকাক্ষি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তখন জরুরি পরিস্থিতির জন্য কোনাে পরিকল্পনার কথা চিন্তা করা হয়নি। যদি কোনােক্রমে শত্রুপক্ষ যমুনা নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা করে তাহলে সিরাজগঞ্জ, নগরবাড়ী-ঘাট-উল্লাপাড়া এবং সম্ভবত পাবনায় কীভাবে শত্রুর অগ্রযাত্রাকে ঠেকানাে যায়, সে বিষয়ে কোনাে পরিকল্পনা ছিল না । জিওসি (সাক্ষী নং ২৪৪) খােলাখুলিভাবে স্বীকার করেন যে, তিনি কখনাে “দুর্গ-ভিত্তিক প্রতিরােধ কৌশল” প্রত্যাহার করার কথা ভাবেননি। তাছাড়া “ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে সেই ধরনের কোনাে প্রকার আপদকালীন পরিকল্পনা ছিল কি না তা তার জানা ছিল না।”
৪৪। এই ডিভিশন তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব তিনটি সেক্টরের মধ্যে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্ব এর ব্রিগেডের ওপর অর্পণ করে। ২৩ ব্রিগেড ছিল পাঁচটি পদাতিক বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। এই ব্রিগেডের ছিল একটি ট্যাঙ্ক বহর (স্কোয়াড্রন)। এগুলােকে উত্তরের দিনাজপুর এবং রংপুরের বেসামরিক জেলা রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রস্থিত সেক্টরের (বগুড়া-হিলি) দায়িত্ব ছিল ২০৫ ব্রিগেডের ওপর। এটি গঠিত ছিল তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান ও এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক দ্বারা। যদিও মৌলিক ধারণায় দেখা যায়, যেভাবেই করা হয় এই পথেই শত্রুদের আঘাত আসবে। হিলিকে কেবলমাত্র একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিল, তার বেশি কিছু নয়। বগুড়ায় দুর্গ তৈরি করা
১৬৯
হয়েছিল। তৃতীয় ব্রিগেড, তথা ৩৪ ব্রিগেডের ছিল তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান। এটিকে সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে প্রত্যাশা ছিল যে, এটি স্বল্পমাত্রায় ভীতিপ্রাপ্ত দুটি জেলা পাবনা এবং রাজশাহীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব। পালন করে যাবে।
৪৫। ইস্টার্ন কমান্ডের সিদ্ধান্ত ও নীতি অনুযায়ী ২৩ এবং ২০৫ ব্রিগেড ইপিসিএএর সঙ্গে সীমান্তঘেঁষা অগ্রসর অবস্থানে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সাধারণভাবে বললে বলতে হয় পাকিস্তানের ভূখণ্ডে শত্রুদের প্রতিটি অভ্যাগম (এপ্রােচ) ছিল একটি ব্যাটালিয়ান গােষ্ঠীর সংযােগে। অথচ সেখানে প্রতিরক্ষার জন্য কোনাে ব্রিগেডেরও অবস্থান ছিল না। জেনারেল নিয়াজী এবং নজর হােসেন শাহ্ এ কথা স্বীকার করেছেন।
৪৬। এমতাবস্থায়, যেমন আগেই বলা হয়েছে, জিওসি বলেছেন ২১ অক্টোবর ১৯৭১, তেঁতুলীয়া এলাকা যখন ভারতীয় বাহিনী দখল করে নিল তখন ইস্টার্ন কমান্ডের সুনির্দিষ্ট নির্দেশে প্রতি-আক্রমণ ১৬/১৭ নভেম্বর তারিখে ফলশূন্যভাবে চালানাে হয়। এই কাজের ভার যাদের ওপর অর্পণ করা হয়েছিল সেই ২৫ পাঞ্জাব নিজেদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির পর পিছু হটে আসে। এর পরে সেখানে শত্রুদের অগ্রগামিতা নিয়ন্ত্রণ করার মতাে আর কোনাে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমতাবস্থায় কুড়িগ্রাম, আলীপুর এবং চিলমারী ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর দ্রুত পতনের মুখে পড়ে। আমাদের বাহিনী অমরখানা এবং বড়খাদায় সীমান্ত চৌকিগুলােও শূন্য করে দেয়। এর মর্মকথা হলাে তিস্তা নদীর পূর্ব দিকের উত্তর এলাকার সমগ্র ভূমি অসহনীয় হয়ে ওঠার দরুন তা ছেড়ে চলে আসা হয়েছিল।
৪৭। এর পরে ভারতীয় বাহিনী নিজেদের কেন্দ্রীভূত করার জন্য পঞ্চগড় এবং হিলি এলাকার বিপরীত দিকে বালুর ঘাটে তাদের নিজস্ব অঞ্চলে দুদিন সময় কাটায়। শত্রুদের এসব তৎপরতার খবরে এবং সর্বাত্মক তীব্র আক্রমণের কথা জানার পরে, ডিভিশনাল কমান্ডার তার হেডকোয়ার্টার নাটোর থেকে বগুড়ায় সরিয়ে নেন। এমতাবস্থায় ৩৪ সংরক্ষিত ব্রিগেডকেও নাটোর হতে বগুড়ায় আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। এটুকু ব্যতীত পরবর্তী পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আর কোনােরকম পরিবর্তন অথবা সেনাবাহিনী মােতায়েন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
৪৮। যেমনটি অনুমান করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ২১/২২ নভেম্বর তারিখে, পঞ্চগড়ে ভারতীয়দের আক্রমণ আরম্ভ হয়। আমাদের বাহিনী শক্রদের থামাতে পারেনি। তারা ঠাকুরগাঁও-এর দিকে পিছু হটতে থাকে। সেখানে অবস্থিত ছিল প্রধান প্রতিরক্ষা বলয়। ৩৪ পাঞ্জাব এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় কর্মরত ছিল। তারা পঞ্চগড়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে। যদিও শত্রুদের দৃষ্টিতে তারা যথাসময়ের পূর্বেই ঠাকুরগাঁয়ে চলে আসে। কেননা ঠাকুরগাঁওকে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তােলা হয়েছিল। সেখানে তারা প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলে।
৪৯। এটি বলা হয়ে থাকে বুরুংগামারী ঘটনার পরে, সেখানে কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড, প্রতি-আক্রমণ পরিচালনার জন্য চাপাচাপি করছিলেন। নিজের ভাগ্য গড়ার প্রশ্নেই সেখান থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে আনা অসুবিধাজনক কাজ ছিল। “যে কেউ
১৭০
যিনি কিছু বলার জন্য সাহসী হয়ে থাকেন”—বলেছেন মেজর জেনারেল কাজী আব্দুল মজিদ খান (সাক্ষী নং ২৫৪) “তার ঊধ্বর্তন কমান্ডারকে কিছু বললে তাকে ভীরু অথবা অযােগ্য মনে করা হতাে।”
৫০। যখন শত্রুরা অনবরত চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে, তখন এমনকি কোনােরূপ যুদ্ধ ছাড়াই ঠাকুরগাঁও পরিত্যাগ করা হয়। এটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ২৮ এবং ৩০ নভেম্বর।
৫১। ব্রিগেড কমান্ডার বলেন বিভাগীয় হেডকোয়ার্টারের নির্দেশেই ঠাকুরগাঁও খালি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিভাগীয় কমান্ডার তা অস্বীকার করেন। তিনি ব্রিগেড কমান্ডারকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে অভিযােগ আনেন যে, তিনি তাঁর নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে বাহিনীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাননি। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, ঠাকুরগাঁও খালি করা নিয়ে এতই উত্তেজিত ছিলেন যে, তিনি নিজে এইরূপ ভয়ানক দোষের জন্য ঐ এলাকার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন।
৫২। আমাদের নিকট যেসব তথ্য-প্রমাণাদী রয়েছে; তা থেকে দেখা যায়, ব্রিগেডিয়ার আনসারী ভারতীয় বাহিনীর দারুণ চাপের ফলে যে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের জন্য কিংবা তার নিজের বাহিনীর ওপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোনাে প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ঠাকুরগাঁও থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার ফলস্বরূপ তিস্তা নদীর পূর্ব পারে অবস্থানরত সকল সৈন্যকে প্রত্যাহার করে নদীর পশ্চিম পাড়ের দিকে অবস্থান নিতে হয়েছিল। তারা তখন ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ-এর অধিনস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
৫৩। ৩৪ ব্রিগেড ছিল সংরক্ষিত ব্রিগেড। বগুড়া থেকে এটি রংপুরের দিকে এগিয়ে নেওয়া হয়। ধারণা করা হয়েছিল তারা তিস্তা নদীর পশ্চিম তীরে (আত্রাইসহ) অবস্থানরত ৮ এবং ২৫ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
৫৪। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, ব্রিগেড ৩৪ নিজেই ছিল (ইতােমধ্যে) একটি নিঃস্ব প্রায় বাহিনী। ওই ব্রিগেড থেকে ইউনিট এবং উপ-ইউনিট প্রত্যাহার করার মধ্যে এর কারণ নিহিত ছিল। আর এই প্রত্যাহারের মাধ্যমে ডিভিশন এলাকার ভিতরের ও বাইরের ফাঁক পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল । ১২ পাঞ্জাবকে এই ব্রিগেড থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং সেই বাহিনী ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর যশােরে প্রেরণ করা হয়েছিল। অন্য দুটি কোম্পানি ৩২ বালুচ, ১৬ ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ-এর কাছে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় তিনি তিস্তার পশ্চিম পাড়ের কমান্ডের দয়িত্বে ছিলেন। এই ব্রিগেডের হেডকোয়ার্টার খুবই স্বল্প পরিমাণ শক্তির দ্বারা গঠিত ছিল। রংপুর এলাকায় ৮ এবং ২৫ পাঞ্জাবের কিছু ইউনিটের (২৩ ব্রিগেডের অন্তর্গত) শক্তি বৃদ্ধিপূর্বক তাকে পশ্চিম এলাকাসহ আত্রাই নদী পর্যন্ত মনােযােগ দিতে বলা হয়েছিল । দেখা যায়, এভাবে সৈন্য সমাবেশের কারণে রাজশাহী এবং পাবনা জেলা দুটি বাদ পড়ে থাকল। এখানে থাকল কেবলমাত্র এহক হেডকোয়ার্টার যার নাম ছিল “নাটোর সেক্টর”।
৫৫। শত্রুপক্ষ আমাদের বাহিনীকে তিস্তা নদীর তীরে ব্যস্ত রাখে । অন্যদিকে ভারতের আর একটি বাহিনী ২০৫ ব্রিগেডের ব্যুহ ভেদ করে পীরগঞ্জ অথবা পলাশবাড়ী চলে
১৭১
আসে। তারা রংপুর-বগুড়ার সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় । হিলির অবস্থানে তাদের আক্রমণ ছিল খােলামেলা। আগের অধ্যায়ে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর তারিখে, তারা সামরিক ভাষায় যাকে বলে ব্রিগেড আক্রমণ, অর্থাৎ ট্যাঙ্কের সমর্থনপুষ্ট দুটি ব্যাটালিয়নসহযােগে আক্রমণ চালায়। ভারতের দুটি হান্টার বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করে তারা নওপাড়ার আংশিক দখল করে নেয়। তথাপিও, ২০৫ ব্রিগেড পরবর্তী সময়ে প্রতি-আক্রমণ চালায় এবং শত্রুদের ঐ স্থান ত্যাগে বাধ্য করে। কিন্তু পরের দিন তারা একই অবস্থানে আবার আক্রমণ চালায়। এ সময়ে তাদের সমর্থনে যে কেবল ট্যাঙ্ক বাহিনী ছিল তাই নয়, ছিল গােলন্দাজ এবং বিমানবাহিনী। তবে ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর তারিখে তাদের আবার বিতাড়িত করা হয়। তাদের প্রায় ১৫০ সৈন্য হতাহত হয়। শত্রুরা আমাদের সীমান্ত এলাকা দখলে ব্যর্থ হয়ে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু ২৯ নভেম্বর তারিখে তারা হিলির রেলপথে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে আসে।
৫৬। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে দেখা যায় শত্রুবাহিনী হিলি অবস্থানের ওপর তাদের আক্রমণ নবায়ন করে। এর জন্য তারা একটি পুরাে ডিভিশন নিয়ােজিত করে। তাদের মূল আক্রমণ ছিল গােলন্দাজ ও বিমানবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত। এ আক্রমণটি তারা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালিয়ে যায়। ২০৫ ব্রিগেডের কমান্ডার এবং তার বাহিনী, বিশেষ করে ৪ এফএফ যদিও প্রচুর কষ্ট স্বীকার করেছিলেন তারপরও তারাই হিলির বীর (হিরাে) হিসেবে খ্যাতিমান হন। তারা অকুতভয়ে বীরের মতাে যুদ্ধ করে অবস্থান ধরে রাখেন। ৭ ডিসেম্বর তারিখে শত্রুপক্ষের ২০ মাউনটেইন ডিভিশন উত্তর দিকে একটি ফাক ধরে। আসতে থাকে। এমতবস্থায় ৩৪ ব্রিগেড; সময় পরিমাপ পূর্বক সেখানে অবস্থান করা আর বাস্তবসম্মত নয় এমন নির্দেশনায় এই এলাকাটি ২৩ ব্রিগেডের হাতে অর্পণ করে ফেরির মাধ্যমে করতােয়া নদী পার হয়ে নবাবগঞ্জ এবং হাতিবান্দার দিকে চলে যায় । কিন্তু এ কাজ করার আগে শত্রুবাহিনী ২০৫ ব্রিগেডের পাশ কাটিয়ে, পীরগঞ্জের কাছে উভচর ট্যাঙ্কের মাধ্যমে নদী পার হয়ে রংপুর ও বগুড়ার যােগাযােগ রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শত্রুদের এই কাজটি আমাদের বাহিনী এবং ডিভিশনাল কমান্ডার আঁচ করতে পারেনি। এসময় তারা রংপুর হতে ২০৫ ব্রিগেডের সঙ্গে এই পথে আসছিলেন। একটি “অর্ডার গ্রুপ” ৭ তারিখে পীরগঞ্জের নিকট ওত পেতে থাকে। ভাগ্যক্রমে তিনি স্থানীয় একজন গ্রামবাসীর মাধ্যমে খবর পেয়ে যান এবং সে তাঁকে তার কুঁড়ে ঘরে নিয়ে যান। ফলে তিনি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয়দের গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন।
৫৭। শত্রুরা ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১, বগুড়া-রংপুর সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার পরে ঘােড়াঘাটের দিকে যাত্রা করে। তারা ১৬ ডিভিশন থেকে ২০৫ ব্রিগেডের যােগসূত্র ছিন্ন করে দেয়। এই বিলম্বিত সন্ধিক্ষণে একটি টাস্কফোর্স বগুড়া থেকে পলাশবাড়ী প্রেরণ করা হয়, যাতে করে শত্রুদের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু এ কর্মকাণ্ড কোনাে সফলতার মুখ দেখেনি। শত্রুপক্ষ পলাশবাড়ী দখল করে নেয়। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর তারা বগুড়ার ওপর তীব্র। চাপ প্রয়ােগ করে। একই সময়ে রংপুরের ওপরও চাপ আসে।
১৭২
৫৮। এই পর্যায়ে এসে শক্ত অবস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হিলির অবস্থান বিলুপ্ত করা হয়। কারণ শত্রুরা এর উত্তর দিক দিয়ে প্রবেশ করে এই সাহসী বাহিনীকে ঘেরাও করার পর্যায়ে নিয়ে আসে। তবে তখন পর্যন্ত আমাদের সৈন্যরা সেখানে শক্ত অবস্থানেই ছিল। ২০৫ ব্রিগেডের সৈনিকেরা বগুড়া দুর্গ রক্ষা করার অভিপ্রায়ে ক্রমান্বয়ে সেই দিকে আসতে থাকে। জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন যে, এই দুর্গটিতে সত্যিকারভাবে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। তাই সেখানে পর্যাপ্ত সৈন্য মােতায়েন করার জন্য বাহিনীকে সেই দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়েছিল।
৫৯। শত্রুরা বিরামহীনভাবে বগুড়া এবং রংপুরের রাস্তার ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে। তারা সফলতার সঙ্গে গােবিন্দগঞ্জে ৩২ বালুচ অবস্থান ব্যুহ ভেদ করে যায়। এই অবস্থা অবলােকন করে ডিভিশনাল কমান্ডার তাঁর ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার বগুড়া হতে ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১, পুনরায় নাটোর ফিরিয়ে নেন। এবং ৩৪ ব্রিগেডকে শক্রদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে পাঠিয়ে দেন। এইভাবে আত্রাই নদীসহ সংলগ্ন এলাকার অবস্থান রক্ষা করতে চাওয়া হয়।
৬০। ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হােসাইন, ২০৫ ব্রিগেডের কমান্ডার, হিলির অবস্থানে তার বীরােচিত প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের পরে বগুড়ার প্রতিরােধের জন্য অবস্থান নেন। শত্রুরা ১৪ ডিসেম্বর বগুড়া সংস্পর্শে আসে। কিন্তু তাদের কিছু অংশ বগুড়া পাশ কাটিয়ে শেরপুরের দিকে এগিয়ে যায়। পরদিন বগুড়া বেদখল হওয়ার যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এবং শেরপুর শত্রুদের দখলে চলে যায়। তথাপিও ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হােসাইন (এটি তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব যে) বগুড়ার অবস্থান ধরে রাখার জন্য প্রস্তুত হন এবং শেষ অবধি, নিদেনপক্ষে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান বাহিনীর দ্বারা বগুড়া অজেয় রাখতে। কিন্তু পরদিন ৪টার সময়ে, আত্মসমর্পণের নির্দেশ চলে আসে। ব্রিগেডিয়ার দাবি করেন যে, তিনি নির্দেশ অমান্য করার ইচ্ছা পােষণ করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন তার বাহিনী তার নেতৃত্ব আর মানতে ইচ্ছুক নয়। সেজন্য তিনি তার কমান্ড ত্যাগ করে নিজে বেসামরিক পােশাক পরিধান করেন এবং তার ব্যাটম্যানকে নিয়ে বগুড়া থেকে বের হয়ে নাটোর যাওয়ার চেষ্টা করেন। পথে তিনি মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ঘেরাও হন। তার ব্যাটম্যানকে মেরে ফেলা হয়। তিনি সাংঘাতিকভাবে মার খান। এবং মারতে মারতে তাঁকে প্রায় প্রাণবায়ু বের হয়ে আসার অবস্থানে আনা হতাে, যদি তিনি না বলতেন যে, তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। এর ফলে তাঁকে বন্দি করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন একজন বীর এবং সাহসী ব্রিগেডিয়ার; যিনি যুদ্ধের প্রায় সমগ্র সময় হিলিতে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও সেখানে ছিল শত্রুপক্ষের ব্যাপক গােলাগুলি, শেলিং এবং উপর্যপরী বিমান হামলা।

জামালপুর-ময়মনসিংহ সেক্টর
৬১। আমরা আগের অধ্যায়ে যেমন উল্লেখ করেছি, এই এলাকার গুরুত্ব এখানে যে, এটি ঢাকার ত্রিভুজ অথবা ‘বােল (Bowl), ঢাকার নিরাপত্তার জন্য অধিকাংশ সামরিক বিশেষজ্ঞগণ এ রকম মতই প্রকাশ করেছেন, আর সেজন্যই স্থানটি
১৭৩
গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতােমধ্যে এলাকাটির কৌশলগত ও রাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরেছি এবং দেখিয়েছি তারপরও কীভাবে যে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ১৯৭১ সালের মে এবং আগস্ট মাসে এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নগ্ন অবস্থায় ফেলে রেখেছিলেন। এরপর কেবলমাত্র জিএইচকিউ-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, ৫৩ ব্রিগেড চট্টগ্রাম হতে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় সংরক্ষিত কমান্ড হিসেবে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মেজর জেনারেল জামশেদের অধীনে (৩৬ এ ডিভিশন) এডহক ভিত্তিতে ৫৩ ব্রিগেডকে যুক্ত করা হয়। এই ব্রিগেডের সঙ্গে আব্দুল কাদির এবং সেইসঙ্গে ইপিসিএএফ-এর কিছু সংযােগে অন্য আর একটি ব্রিগেডও এতে যােগ করা হয়।
৬২। এই এলাকার ভারতীয়দের ভীতি প্রদর্শন এবং শত্রুপক্ষের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কেও আলােচনা করা হয়েছে। এই সাধারণ অংশীদারিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রুরা ১৯৭১ সালের ২০/২১ নভেম্বর রাতের বেলায় আক্রমণ পরিচালনা করে। তবে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে শত্রুরা অবশ্য প্রত্যক্ষ আক্রমণ পরিচালনা করে। আর তা আরম্ভ করা হয় কামালপুর সীমান্ত চৌকি হতে । এখানে আমাদের সৈন্যরা অসম সাহসীকতা ও বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরােধ করে। কিন্তু শত্রুপক্ষ ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপর্যপরীভাবে আক্রমণ চালাতে থাকে। এ সময় তারা তৃতীয় আক্রমণ হানে। গােলাগুলি ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করে গেলেও তারপর তারা শত্রুদের হাতে বন্দি হন। এরপরে বশীগঞ্জে প্রতিরক্ষা ব্যুহ শক্তভাবে স্থাপন করা হয়। এ জায়গাটি আগে ইস্টার্ন কমান্ড প্রতিরক্ষার জন্য বিবেচনা করেননি। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এটিরও পতন হয় । ৩১ বালুচ স্থান পরিত্যাগ করে পিছু হটার সময় শেরপুরের ফেরির নিকট এসে দেখতে পায় তা বিচ্ছিন্ন অবস্থার রয়েছে।
৬৩। কামালপুরের ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে, বাহাদুরাবাদ এবং ময়মনসিংহের উপসেক্টরের সীমান্ত চৌকিগুলাে থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। প্রথমে জামালপুরে এবং তারপর হালুয়াঘাটে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর শক্ররা হালুয়াঘাট আক্রমণ করে এবং আমাদের বাহিনী ফুলপুর ফেরির দিকে পিছু হটে আসে। অনুরূপভাবে ৩১ বালুচ শত্রুদের দুটি ব্রিগেডের দ্বারা চাপে পড়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৭/৮ তারিখে জামালপুরে পিছু হটে আসে। জামালপুরকে একটি দুর্গের মতাে করে গড়ে তােলা হয়েছিল। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত এটি ধরে রাখা সম্ভব হবে। ৩১ বালুচ এর কমান্ডিং অফিসারকে ভারতীয় ব্রিগেড কমান্ডার আত্মসমর্পণ করার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি ৭-৬২ এম.এম বুলেটসহ উত্তর পাঠিয়ে দেন এই বলে যে, “যদি ক্ষমতা থাকে তবে আসুন এবং দখল করুন।”
৬৪। ৩৩ পাঞ্জাবের বাহিনী ময়মনসিংহে একত্রিত হয়েছিল। ময়মনসিংহকে দুর্গ হিসেবে গড়ে তােলা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সমস্ত ব্রিগেডকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকার ২০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে গােড়াই এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কারণ, ইতােমধ্যে শক্ররা ৩৯ এবং ৯ম ডিভিশনের ব্যুহ ভেদ করে ঢাকা
১৭৪
অভিমুখে আসতে আরম্ভ করেছিল। তবে অন্যান্য এলাকা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে প্রতিরােধ গড়ে তােলার কোনাে পূর্ব পরিকল্পনার অভাবে এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। বড়াে বড়াে নদী পারাপারের জন্য যানবাহন ছিল না। এমতাবস্থায় ৯৩-এ ব্রিগেডকে জামালপুর ও ময়মনসিংহ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
৬৫। সে অবস্থায় প্রতিরক্ষার অবস্থান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জ্ঞানােচিত হলেও সৈন্য প্রত্যাহারের কাজকর্ম ছিল চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। মুক্তিবাহিনীর জোর তৎপরতার কারণে যােগাযােগ ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল চলাচল অযােগ্য। ব্রিগেড কমান্ডার (সাক্ষী নং ২৪৩) প্রত্যাহারের কাজটি দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিতে চাইলেও হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে তিনি যােগাযােগ স্থাপন করতে পারছিলেন না। যদিও কোনাে বিকল্প ছিল না; তবুও তিনি নির্দেশ পালনে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে চেষ্টা করেন। তার অধীনস্ত একজন কমান্ড অফিসার, ৩১ বালুচ, এই নির্দেশ গ্রহণ করেছিলেন; তবে তিনি তা করেছিলেন “প্রতিবাদের সঙ্গে।
৬৬। ১০ ডিসেম্বর ব্রিগেড প্রত্যাহারের কাজ শুরু করে এবং ১১ তারিখে মধুপুর আসে। প্রত্যাহারের পরিকল্পনাটি পুনঃবিবেচনা করা হয় এবং বেলা তিনটার সময় বাহিনীকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করতে বলা হয়। তারা বিকেল ৪টার সময় টাঙ্গাইল আসে। কিন্তু আধা ঘণ্টার মধ্যে দেখতে পায় যে, ভারতীয় ছত্রীবাহিনী জেট বিমান থেকে টাঙ্গাইলের কাছে প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করছে। মনে করা হয় এক ব্যাটালিয়নের বেশি সৈন্য এভাবে অবতরণ করে। এ অবতরণ সম্ভবত এই উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল; যাতে পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আসা ভারতীয় ডিভিশনগুলাের চলাচলকে নির্বিঘ্ন করা যায়।
৬৭। ব্রিগেড কমান্ডার ভারতীয় প্যারা বাহিনীকে প্রতিরােধ করতে চেষ্টা করেন এবং ৩১ বালুচকে সামনে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। পরিস্থিতি ছিল খুবই বিভ্রান্তকর। সে কারণে প্রত্যাহারের কাজটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ও অসংগঠিত প্রকৃতির হয়ে উঠেছিল। ব্রিগেড কমান্ডারসহ একটি ক্ষুদ্র বাহিনী গােড়াই এর কাছে ১৩ ডিসেম্বর তারিখে ভারতীয় প্যারা-বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করতে গেলে ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধৃত হয় । ব্রিগেডের অন্যান্য সৈন্যরা, ৩১ বালুচের একজন কমান্ডারের অধীনে চলে আসে। তারা কালিয়াকৈরে ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অবস্থান নেন। এ অবস্থায় তারা একদিনের মতাে সেখানে থাকেন।
৬৮। ৩১ বালুচ ঢাকায় পৌঁছায়, তবে যানবাহন ব্যতীত । তারা তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রও বহন করে আনতে পারেনি। রণকান্ত অবস্থায় দীর্ঘ ১০০ মাইল পথ হেঁটে তারা এসেছিল। তথাপিও, তারা অবস্থান নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ১৫ ডিসেম্বর পুনরায় টঙ্গীতে প্রতিরােধ ব্যুহ গড়ে তােলে। সৌভাগ্যক্রমে কোনাে ভারতীয় সৈন্য ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত এ দিকটায় আসেনি।
৬৯। এই পর্যায়ে ঢাকার প্রতিরক্ষা সম্পর্কে আমরা কিছু বলার প্রয়ােজনীয়তা বােধ করছি। আমরা আগের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে, ঢাকার প্রতিরক্ষা সম্পর্কে ইস্টার্ন কমান্ডের এই ধারণা ছিল যে, তারা শত্রুদের ঢাকা প্রবেশের সকল পথ বন্ধ করে দেবেন। এছাড়া ঢাকা বােলে’র অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা সম্পর্কে কোনাে
১৭৫
প্রকার বিস্তারিত পরিকল্পনাও নেওয়া ছিল না। সেসঙ্গে বাড়তি কোনাে সৈন্যবাহিনীও এ উদ্দেশ্যে বণ্টন করা হয়নি। যদিও এটি জানা ছিল যে, ঢাকা হলাে একটি লােহার খিলান” (লিন্সপিন), ঢাকার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা কৌশল নির্ভরশীল ও সম্পর্কযুক্ত ছিল।
৭০। আমাদের দৃষ্টিতে, ঢাকার প্রতিরক্ষা যে কেবল ঢাকা শহরের প্রতিরক্ষা তাই নয়, এর শহরতলী, সেনাবিনবাস এলাকা ছিল একটি দুর্গের মতাে। সেখানে ছিল তিন দিকের বড়াে বড়াে নদী, যেমন- যমুনা, পদ্মা এবং মেঘনা । উত্তরের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাও এর সঙ্গে জড়িত ছিল। ঢাকা দুর্গটি নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর এবং আরিচা ঘাটের সঙ্গেও সম্পৃক্ত।
৭১। ঢাকা বােলে’র প্রতিরক্ষার জন্য ১৯৭১ সালের আগে ইস্টার্ন কমান্ড কার্যকর কৌশল গ্রহণ করেছিল। এজন্য সেখানে চারটি ব্রিগেডের সঙ্গে একটি সংরক্ষিত ব্রিগেড রাখার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে ইস্টার্ন থিয়েটার মাত্র এক ডিভিশন সৈন্যের ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের পরে, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যসংখ্যা বেড়ে যখন তিন ডিভিশনে উন্নীত হয়েছিল, তখনও এ বিষয়ে কোনাে প্রকার ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি। সেই বাড়তি শক্তি বরং প্রতি-বিপ্লবী তৎপরতা বন্ধে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া এটিও ইস্টার্ন কমান্ডের নিকট প্রত্যাশিত ছিল না যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করবে। এ কারণে ঢাকা ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছিল অরক্ষিত। যখন জিএইচকিউ নির্দেশ দিল, তখন ৫৩ ব্রিগেডকে চট্টগ্রাম থেকে ডেকে এনে তা সংরক্ষিত কমান্ড হিসেবে রাখা হলাে। তারপর ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে এটিকে ৩৬ এহক বাহিনীটি ডিভিশনে উন্নীত করা হলাে। অন্য একটি এক ব্রিগেড, ৯৩ ব্রিগেডও তখন সেখানে সংযুক্ত করা হলাে। সেই সময় থেকে এই ডিভিশনে সংযুক্তিকরণ আরম্ভ হতে থাকল। আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, ৯৩ ব্রিগেড তখন উত্তরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর কাছে অবস্থান করছিল। ঢাকার বােল’ এর বাইরে সেখানে যে সৈন্য স্থাপন করা হয়েছিল আমরা ইতােমধ্যে দেখেছি, তা ঢাকার ৩৬ ডিভিশনের জন্য ছিল না। ইত্যবসরে, সংরক্ষিত সৈন্য ফেনীতে নতুন এহক ৩৯ ডিভিশনে প্রেরণ করা হয়। এর ফলে ৩৬ ডিভিশন ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য রেখে গেল কেবলমাত্র ১২ কোম্পানি ইপিসিএএফ, ১২ কোম্পানি পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, দুই কোম্পানি পূর্ব পাকিস্তানি পুলিশ এবং প্রায় আটশত রাজাকার। এই শক্তির সাহায্যে ‘ঢাকা বােল’ এর প্রতিরক্ষা ছিল দুঃসাধ্য। তাই আর একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয় তা হলাে, ঢাকার অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার প্রতি যতদূর সম্ভব নজর দেওয়া। ঢাকা এলাকা তিনটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এজন্য ইপিসিএএফ এর প্রতিটি শাখাকে প্রত্যেক সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঘােড়াশাল-ডেমরানারায়ণগঞ্জ নিয়ে গঠিত হয় পূর্বাঞ্চলের সেক্টর । উত্তরাঞ্চলের সেক্টর গড়ে ওঠে কালিয়াকৈইর-রাজেন্দ্রপুর-জয়দেবপুর-টঙ্গী নিয়ে। পশ্চিম সেক্টর ছিল ধামরাইসাভার-মিরপুর নিয়ে গঠিত। দক্ষিণের সেক্টর ছিল পদ্মা এবং বুড়ীগঙ্গার মধ্যবর্তী এলাকা নিয়ে গঠিত। তবে এটি অরক্ষিত রাখা হয়। কেননা, সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই ছিল প্রতিরক্ষার উপকরণ।
১৭৬
৭২। ঢাকা দুর্গের কেন্দ্রীয় এলাকা দুভাগে ভাগ করা হয়। ঢাকা সেনানিবাস বিমানবন্দরসহ বর্ধিষ্ণু এলাকা নিয়ে অন্য একটি দুর্গ গঠিত হয়। এই শক্তি নিয়ে সমগ্র ঢাকা ও সেনানিবাস এলাকায় ইস্টার্ন কমান্ড যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল । অবশ্য সে সঙ্গে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানির ফেরত আসা সৈন্যরাও যুক্ত হতাে। এতদ্ব্যতীত, ঢাকায় ছিল এক স্কোয়াড্রন বিমানবাহিনী, এর ছিল ১৬টি এয়ারক্রাফট (স্যাবাের জেট) এবং ছিল একটি হালকা ধরনের বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট। আরও ছিল ৪৭ এন্টি-এয়ারক্রাফ্ট বন্দুক ।
৭৩। ১৯৭১ সালের ৩ এবং ৪ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ওপর হুমকি অনুভূত হতে থাকে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়। ভারতীয় বিমানবাহিনী আমাদের বিমানবাহিনীর জন্য ব্যবহারযােগ্য একমাত্র বিমানঘাঁটির ওপর বিমানহামলা আরম্ভ করে। তাছাড়া, ঢাকা এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার ভূমি এবং নদীপথে যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর তারা গুরুত্বপূর্ণ আক্রমণ চালায়। আমাদের বিমানবাহিনী দুদিন ধরে যুদ্ধ করে ভারতের চৌদ্দটি বিমান ভূপাতিত করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সেই শক্তি অকার্যকর হয়ে। পড়ে। কারণ, ভারতীয় বিমানবাহিনীর অনবরত বােমা বর্ষণের কারণে রানওয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তবুও ভারতের প্রায় ২৮টি বিমান আমাদের বিমান বিধ্বংসী কামানের দ্বারা ধ্বংস করা হয়। এটি অবশ্যই ছিল একটি কৃতিত্বপূর্ণ কাজ।
৭৪। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর যখন শত্রুপক্ষের চাপের কারণে অগ্রবর্তী সৈন্য সমাবেশ থেকে আমাদের সৈন্যরা পিছু হটে আসতে থাকে; তখন ঢাকা বােলের উপর ভয়ভীতি বাস্তব রূপ নেয়। কেবলমাত্র তখনই ইস্টার্ন কমান্ড সজাগ হয়ে ওঠে এবং মরিয়া হয়ে। তাদের পরিকল্পনা পুনর্গঠন করতে শুরু করে। নরসিন্দীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ভার ১৪ ডিভিশনের ওপর অর্পণ করা হয়। ৩১৪ এক ব্রিগেডের অবস্থান খুলনা থেকে সেই সময় ঢাকা পৌঁছে গিয়েছিল। তাদেরকে সাভার-মিরপুরে আরিচার রাস্তার ওপর স্থাপন করা হয়। টঙ্গী এবং ঢাকা গােলন্দাজ কমান্ডকে কিছু বিমান বিধ্বংসী কামান সহযােগে ভূমি ও আকাশ-পথ প্রতিরক্ষার জন্য টঙ্গীতে স্থাপন করা হয়। ২৭ ব্রিগেড এক্স-১৪ ডিভিশন শক্রদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পারার দরুন ভৈরব বাজার হয়ে রায়পুরা আসার পরিবর্তে তাদের হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ৭ এবং ৯ তারিখে নরসিন্দীতে নামানাে হয়। ১২ এফ এফ এর দুটি কোম্পানিকে নদীপথে পাঠানাে হয়। তারা ডেমরা নরসিংন্দীতে আসতে সক্ষম হয় এবং ঢাকার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়ােজিত হয়।
৭৫। ৩৯ এহক ডিভিশন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৮/৯ তারিখে চাদপুর খালি করে দেওয়ার পর তা বিক্ষিপ্ত ও ছত্রছঙ্গ হয়ে পড়ে। ডিভিশনাল কমান্ডার নিজেও আহত হন এবং হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মনসুরকে ডেমরা এবং নরসিংন্দীর প্রতিরক্ষার জন্য নিয়ােজিত করা হয়।
৩৯। ডিভিশন পরিত্যাক্ত করে এর কমান্ডারকে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
৭৬। এসবের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষ হেলিকপ্টার এবং ফেরি যােগে ৭ ডিসেম্বর নরসিংদী চলে
আসে এবং পরবর্তী দিনগুলােতে সেইসঙ্গে তাদের আরও এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য
১৭৭
নৌকার মাধ্যমে মেঘনা পার হয়। তাদের শক্তি এ পথে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে এক ব্রিগেডে গিয়ে পৌঁছায়। এই বাহিনী রেলপথ ধরে ঘােড়াশাল এবং টঙ্গী ও ডেমরার রাস্তায় এগিয়ে আসতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর শত্রুসেনারা দাউদকান্দি দখল করে নেয়। একটি ব্রিগেড শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে ডেমরার উলটা দিকে হাজির হয়। তবে তা অতিক্রম করার কোনাে উদ্যোগ তারা নেয়নি।
৭৭। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর, টাঙ্গাইলের কাছে আরও একটি প্যারা-বাহিনী ভূমিতে অবতরণ করে। বিষয়টি আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি। এটি ৯৩-এ ব্রিগেডের জামালপুর এবং ময়মনসিংহ থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা অভিমুখে পিছু হটার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এই বাহিনী গােড়াই এবং কালিয়াকৈইর ১২ ডিসেম্বর দখল করে এবং ধামরাইয়ের দিকে যাত্রা করে আমাদের বাহিনীর সমস্ত গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকে। মিরপুর সেতু এলাকায় নিয়ােজিত ৩১৪ এহক বাহিনীর দ্বারা এই দলটি ১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা ‘অ্যামবুশপ্রাপ্ত হয়।
৭৮। শত্রু সৈন্য টঙ্গী এবং ঘােড়াশাল অভিমুখে অভিযাত্রারত ইপিসিএএফ এর দুটি কোম্পানির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিছু পরিমাণ বিরােধিতার পর টঙ্গীর দিকে তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সেখানে গােলন্দাজ বাহিনীও ছিল এবং তারা সেখানে আত্মসমর্পণের সময় পর্যন্ত অবস্থানরত ছিল।
৭৯। কোন্ কোন্ বাহিনী তখন ঢাকার প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিল; দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা স্ববিরােধ ও দ্বন্দ্বমূলক নজীরবিশিষ্ট। নজীর মােতাবেক আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় যে, খুলনা থেকে প্রত্যাহারকৃত ৩১৪ এহক ব্রিগেড যারা ইতােমধ্য ঢাকা পৌঁছেছিল তারাই ছিল মূল দায়িত্বে। ১৪ ডিভিশন কর্তৃক ১২ এফ এফ এর দুটি কোম্পানিও ডেমরা এলাকায় এসে পৌছেছিল। ৯৩ ব্রিগেডের কিছু কোম্পানি টাঙ্গাইলে ভারতীয় প্যারা-অবতরণকারীদের পাশ কাটিয়ে ঢাকা আসতে সক্ষম হয়েছিল। তদুপরী, আমরা আগেই তথ্য দিয়েছি যে, দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইনের বাহিনীও সেখানে উপস্থিত ছিল। অন্যান্য যােদ্ধা কারা ঢাকায় উপস্থিত ছিল সে সম্পর্কে সত্যিকার সংখ্যা এবং সেসঙ্গে শেষের দিনগুলােতে যারা ঢাকার সুরক্ষার জন্য কর্মরত ছিলেন, তাদের বিষয়ে ধারণা সুস্পষ্ট নয়। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এ সংখ্যার বিষয়ে বলেছেন ২৬,৪০০ জন। এর মধ্যে দ্বিতীয় লাইনের যােদ্ধারাও ছিলেন। অন্যদিকে কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা এ সংখ্যা বেশ স্বল্প ছিল বলে জানন । আমাদের নিজের জরিপ ও হিসাব মতে তা ছিল ১০,০০০। জেনারেল ফরমান আলী মনে করেন ঢাকায় সে সময় আট হাজারের অধিক সৈন্য ছিল না। ঢাকা দুর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার বশির আহম্মদ মনে করেন এ সংখ্যা ১২,০০০ হাজার থেকে ১৪,০০০ হাজার। তবে এর বিস্তারিত সংখ্যা স্টাফ গবেষণার দ্বারা পাওয়া সম্ভব।
৮০। রাজাকার, পূর্ব পাকিস্তানি পুলিশ এবং মুজাহিদীনসহ আঞ্চলিকভাবে সংগৃহীত ইপিসিএএফ-এর ওপর নির্ভর করা যাচ্ছিল না। দায়িত্ব ছেড়ে পালানােদের সংখ্যা এই পদমর্যাদার ক্ষেত্রে দারুণভাবে বাড়ছিল। বিশেষ করে শেষের সময়গুলােতে। কর্মকর্তাদের অভিমতে, তাদের অধিকাংশই ছিল অকার্যকর, তারা
১৭৮
কেবল নিয়মিত বাহিনীর সহায়তাতেই কাজ করতে পারত। আমরা সেজন্য এই বিষয়টি গ্রহণ করতে অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মুখােমুখি হই যে, ইপিসিএএফএর অন্তর্গত বিহারী অংশ, রাজাকার এবং মুজাহিদীনের সংখ্যা ছিল স্বল্প । আমরা জানতাম যে, তারা উত্তমরূপে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র কমরেডদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শেষ অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিছু প্রমাণাদীর মাধ্যমে দেখা যায়, তারা কান্নাকাটির ভিতর দিয়ে ভিক্ষুকের মতাে নিয়মিত বাহিনীর কাছে অনুনয় করতে থাকে যেন আত্মসমর্পণ না করা হয়, এমনকি তারা বলতে থাকেন, যেকোনােভাবে রেলপথ মেরামত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু ঢাকার কমান্ডারদের যুদ্ধ করার মতাে মনােবল ও ইচ্ছা আর ছিল না। বিষয়টি পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করে দেখা হবে।
৮১। তারা ইতােমধ্যে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। সেকারণে তারা ঢাকার প্রতিরক্ষার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলেন। ইতােমধ্যে লে. জেনারেল নিয়াজী এবং জেনারেল মানিকশাের মধ্যে বার্তা বিনিময় হয়েছিল । ভারতের চীফ অব আর্মি, জেনারেল নাগরা, সেই সময়ে মিরপুর এসে পৌঁছান। এবং কাউকে তিনি অনুরােধ করেছিলেন সেখানে তাঁকে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়ার জন্য। জেনারেল জামশেদকে সেখানে পাঠানাে হয় এবং তিনি তাঁকে ‘স্কট’ করে ঢাকা নিয়ে আসেন। কিছু সংখ্যক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা; যেমন ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিংও এ সময় ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, জেনারেল নাগরার। পদার্পণের পর পূর্ব পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারস ভারতীয় বাহিনী। ঘেরাও করে ফেলে। অধিকাংশ যারা আমাদের সম্মুখে এসেছিলেন এবং সেই সময়ে ঢাকায় ছিলেন, বলেন যে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার যুদ্ধ করার মতাে সাহস ও ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেননি। ঢাকা দুর্গ দখল করার জন্য ভারতীয় বাহিনীকে আরও মূল্য দিতে হতাে এবং কমপক্ষে ঢাকা আরও দুই সপ্তাহ রক্ষা করা যেত।
৮২। এ বিষয়টি নিয়ে পৃথক অধ্যায়ে আলােচনা করা হবে যে, কীভাবে আত্মসমর্পণের প্রশ্নটি এলাে। তবে একটি বিষয় আমরা এখানে বলতে চাই; জেনারেল নিয়াজী তাঁর নিজস্ব দুর্গ-ধারণা পরিত্যাগ করতে চাননি। তিনি এর কার্যকারিতা দেখাতে ইচ্ছুক ছিলেন। যদি তিনি ঢাকার প্রতিরােধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেন; তাহলে তাঁর দুর্গ হয়তাে শত্রুদের নিষ্ক্রান্ত করতে যােগাযোেগ লাইনসহ কাক্ষিত ধারায় ফলাফল দিত। অর্থাৎ ধারণাটি এর আদি বা মৌল নীতির মতাে সেক্ষেত্রে ইতিবাচক হতে পারত। এই সুযোেগটি দুর্ভাগ্যক্রমে কখনাে পাওয়া গেল না। কারণ, যুদ্ধবিরতির আদেশ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ভাের ৪টায় পাওয়া গিয়েছিল এবং জেনারেল নিয়াজী নিজে সেই দিনই বিকেল তিনটার সময় অসম্মানজনক আনুষ্ঠানিকতার ভিতর দিয়ে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন।

সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেক্টর
৮৩। মেজর জেনারেল কাজী আব্দুর মজিদ খানের কমান্ডে পরিচালিত ১৪ ডিভিশন এই এলাকার দায়িত্বে ছিল। এই অধ্যায়ে সেই এলাকায় সংঘঠিত সীমিত যুদ্ধের
১৭৯
ঘটনাবলি সম্পর্কে বলা হবে। এই ডিভিশনের সৈন্যসংখ্যা, তাদের সমাবেশ পদ্ধতি, শত্রুবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত ভীতি, এলাকার ভূপ্রকৃতি এসব বিষয়ে ইতােমধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে।
৮৪। ভারতীয়রা এ অঞ্চলের ওপর ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর তারিখে ধূলাই এবং প্রেট্রাখানা চা বাগানে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে তাদের কার্যক্রম আরম্ভ করেছিল। অবশ্য ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর তারিখে তারা সত্যিকার আক্রমণ শুরু করে। এ সময় শত্রুপক্ষ মােহাম্মদপুর এবং সালদা নদী এলাকার সীমান্ত চৌকি দখলে। নিয়ে নেয় এবং সিলেট সেক্টরের আটগ্রাম, জাকিগঞ্জ ২১ নভেম্বর জয় করে নেয়। আমাদের বাহিনীকে “পেনি পকেটে” ঠুকিয়ে তারা পিছিয়ে যায় । কিন্তু শত্রুপক্ষের চাপ আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানে জোরদার করা হয়। যেমনজয়ন্তিয়াপুর, কোমলগঞ্জ, শমসেরনগর, বড়লেখা, সিভা, কুলাউড়া এবং জুড়িতে। আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানে দায়িত্বরত বাহিনীকে দুর্বল করতেই তারা। এ সকল আক্রমণ করেছিল। ফলে আমাদের বাহিনী বড়াে ধরনের আক্রমণের ধাক্কা সহ্য করতে অপারগ হয়ে যায়। এ আক্রমণ ৩০ নভেম্বর ১৯৭১, আরম্ভ হয়েছিল আখাউড়া কসবা অঞ্চলে এবং তা ২৭ ব্রিগেড প্রতিহত করেছিল। সেইদিন সন্ধ্যার মধ্যে, শত্রুরা আমাদের ভূখণ্ডের তিন মাইলের ভিতর প্রবেশ করে এবং আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের ওপর সাংঘাতিক চাপ সৃষ্টি করে। শত্রুদের প্রতিহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত আখাউড়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ১২ এফএফ, পিছু হটে কুমিল্লাভিমুখী পথ ধরে। ওই ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত জিওসি সেই বিপর্যয় ঠেকাতে ব্যক্তিগতভাবে সামনে এগিয়ে এসেছিলেন এবং তিনি সফলতার সঙ্গে তা করেও ছিলেন। কিন্তু ৪/৫ ডিসেম্বর তারিখের রাতের বেলা, শত্রুরা আখাউড়ার দক্ষিণ দিকে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ফলে আংশিকভাবে তাদের কিছু সৈন্য এগিয়ে যায় এবং এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুর্গ পাশ কাটিয়েও চলে যায়।
৮৫। এই পরিস্থিতিতে জিওসি ২৭ ব্রিগেড প্রত্যাহার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে যান। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর তারিখে সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মূল বাহিনীর ওপর শত্রুরা আক্রমণ চালায়। এ সময় যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা, ডিভিশনাল কমান্ডার দেখতে পান শত্রুরা তিনটি ব্রিগেডের সমন্বয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্ব ও উত্তর দিক হতে আক্রমণ চালিয়েছে। আরও একটি ব্রিগেড তারা সরাইল থেকে সােজা আশুগঞ্জ প্রেরণ করেছে এবং এভাবে তা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিরােধের জন্য কমান্ডারের হাতে ছিল মাত্র দুটি ব্যাটালিয়ন ও একটি কোম্পানি। ঘেরাও থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এই বাহিনী পর্যাপ্ত ছিল না। এর দ্বারা পূর্ব দিক থেকে ঢাকার প্রবেশপথ ভৈরব ব্রিজের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিল না। বিপদ আঁচ করতে পেরে, জিওসি মৌলভী বাজার থেকে ৩১৩ ব্রিগেড প্রত্যাহার করে আশুগঞ্জে স্থাপন করার অনুমতি চাইলেও সে অনুমতি তিনি পাননি। সে কারণে আশুগঞ্জের কৌশলগত দিক বিবেচনা করে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপরীত দিকে নদীর অন্য পাড়ে অবস্থান নেওয়ার
১৮০
সিদ্ধান্ত নেন যাতে এভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিত্যাগ করে আশুগঞ্জ রক্ষা করা যায়, যা ডক না শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তােলা হয়েছিল। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে গােলাবারুদ জমা ছিল। সে উদ্দেশ্য ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে সজোয়া বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। শত্রুরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রবেশ করে এবং তা শূন্য দেখতে পায়। আশুগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা অব্যাহত থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৭/৮ তারিখ রাতে শত্রুরা সরাইল থেকে এসে আশুগঞ্জের উত্তর অংশ দখল করে নেয়। পরদিন সকালে তারা আরও সৈন্য প্রেরণ করে ভৈরব রেল সেতু দখল নেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়।
৮৬। এই পর্যায়ে ২৭ ব্রিগেডের প্রধান অংশ তখনও নদীর পাড়েই থাকে (নদীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে)। ব্রিগেড কমান্ডার বুঝতে পারেন যে, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হতে পারে; সেজন্য যে পরিমাণ সৈন্যভার ছিল তা নিয়েই তিনি প্রতিআক্রমণ পরিচালনা করেন এবং তা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার কর্তৃক বিবেচিত হয়। সৌভাগ্যক্রমে তিনি শত্রুদের পথের আগে যেতে পারেন। এ ঘটনা শত্রুদের কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। তাদের সাতটি ট্যাঙ্ক ফেলে আসতে হয়। যদি এগুলাে থাকত তাহলে বাহিনী ধ্বংস হয়ে যেত।
৮৭। এই অবস্থায় ব্রিগেড কমান্ডার ভৈরব সেতু উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেজন্য ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, ১১টার সময় নির্দেশ দেন। যদিও, যেমনটি বলা হয়েছে, ২৭ ব্রিগেডের একটি বড়াে অংশ তখন অন্য পাড়ে ছিল। ব্রিগেড কমান্ডার বলেন যে, তিনি কাজটি করেছিলেন, কারণ, সেখানে অনেক ফেরি ছিল, এবং বাহিনী বাস্তবে ফেরির মাধ্যমে পাড় হয়েছিল। তাই সেতুটির বিধ্বংসের কারণে বাহিনীর কোনাে প্রকার ক্ষতি হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিত্যাগকৃত বাহিনী ভৈরব বাজার চলে আসে। এদের সঙ্গে ছিল ৩০ এফএফ এবং ২২ বালুচ, এক্স ৩৩ ব্রিগেড, যারা মৌলভী বাজার হতে চলে এসেছিল। দাবি করা হয় যে, সেতুর ওপর আঘাত হানার দরুন তারা ভারতের ৫৭ ডিভিশনের অগ্রযাত্রার গতি যথেষ্ট পরিমাণে থামাতে পেরেছিল। কিন্তু শত্রুরা স্থানীয় জনগণ এবং মুক্তিবাহিনীর সহায়তা নিয়ে মেঘনা নদীর দক্ষিণের অঞ্চল দিয়ে এবং ফেরির মাধ্যমে, নৌকা যােগে নদী অতিক্রম করে এসে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নােয়াপাড়ার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর সেতু ধ্বংস করে দেয়। এক ব্রিগেড সৈন্য নিশ্চিত করে শত্রুরা ৭ ডিসেম্বর এবং তার পরবর্তী সময়ে হেলিকপ্টার যােগে পার হয়ে নরসিংন্দী এবং মাতিতে পৌছতে থাকে।
৮৯। বলা হয় যে, ইস্টার্ন কমান্ড, ১৪ ডিভিশনকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে হেলিকপ্টারযােগে অবতরণরত সৈন্যদের প্রতিরােধ করতে বারবার বলেছিল। কিন্তু গভীর তিক্ততার সঙ্গে বলতে হয়, ১৪ ডিভিশন সে কাজ করেনি। ১৪ ডিভিশনের কমান্ডার অবশ্য বলেছেন যে, এই দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব ছিল। কেননা, অবতরণরত সৈন্যরা তার গুলির রেঞ্জের বাইরে ছিল। এবং শত্রুবাহিনী ইতােমধ্যে নােয়াপাড়ায় একটি ব্রিগেডের শক্তি সঞ্চয় করেছিল। এমতাবস্থায় তার পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তথাপিও, যদি ২৭ ব্রিগেড ভৈরব না। গিয়ে নােয়াপাড়ার দিকে আসত, তাহলে হয়তাে এটি সম্ভব হতে পারত।
১৮১
সেজন্য, বাস্তবে ২৭ ব্রিগেডকে ভৈরব বাজার উলটিয়ে ১০-১৬ তারিখের মধ্যে আসতে হতাে, ততক্ষণে অবশ্য আত্মসমর্পণের সময় এসে যেত । বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে ভৈরবের প্রতিরক্ষার জন্য শক্তি সংগঠিত করা হয় এবং যদি আত্মসমর্পণের নির্দেশ না আসত তাহলে সেখানে যুদ্ধ করতে হতাে।
৯০। সিলেট অঞ্চলের দায়িত্ব ছিল ২০২ এহক ব্রিগেডের ওপর। এর হাতে ছিল সমাবেশ করার মতাে মাত্র একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, একটি মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন, ১.৫ শাখার ফ্রন্টিয়ার কর্পস, এক ব্যাটারি ৩১ ফিল্ড গােলন্দাজ রেজিমেন্ট। এর সঙ্গে আরও ছিল যথারীতি ইপিসিএএফ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি রেঞ্জার ও রাজাকার। বিপরীতে শত্রুদের ছিল দুই ব্রিগেডেরও বেশি নিয়মিত বাহিনী এবং বিপুল পরিমাণ মুক্তিবাহিনী। জয়ন্তিয়া আটগ্রামের অক্ষরেখার উপর তারা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল।
৯১। ইতােমধ্যে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, এই এলাকায় শত্রুদের ৫৯ ব্রিগেড ২১ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল এবং তারা এর দ্বারা আটগ্রাম ও জকিগঞ্জ দখল করে নেয়। ৩১ পাঞ্জাব বাহিনী প্রতি-আক্রমণ চালায় এবং শত্রুদের দেড় মাইল পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু আটগ্রাম উদ্ধার করা যায়নি। ইতােমধ্যে চারকাহে প্রতিরক্ষাকারীগণ পিছিয়ে আসেন। তারা ১২ একেএর সাহায্য নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করে এবং সেই স্থানটি ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা ধরে রাখা হয়। কিন্তু শত্রুপক্ষের চাপে সিলেটে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সিলেট পৌঁছে গিয়েছিল।
৯২। ইত্যবসরে, ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর শত্রু বাহিনী আরও একটি ব্রিগেড আক্রমণ চালায়। আমাদের নিজেদের বাহিনী হেমুতে পিছিয়ে আসে। কিন্তু শত্রুরা তাদের অনুসরণ করে ১০ ডিসেম্বর হেমুতে আরও দুটি ব্রিগেড পাঠিয়ে তাদের অবস্থান ও শক্তি জোরদার করে। এই অবস্থায় আমাদের বাহিনী ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর চুড়ান্তভাবে পিছু হটে সিলেট দুর্গে চলে আসে।
৯৩। শত্রু বাহিনী সেইসঙ্গে অন্যান্য অক্ষরেখায় আমাদের বাহিনীর ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে। এসব স্থানে আমাদের ছিল দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরােধ ব্যবস্থা। এবং তা পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়। ফলে তারাও ১৯৭১ সালের ১২ এবং ১৩ তারিখে সিলেট এসে পৌঁছায়।
৯৪। ৩১৩ ব্রিগেডের ওপর সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলের দায়িত্ব অর্পিত ছিল । এটি ছিল ৩০ এফএফ এবং ২২ বালুচ দ্বারা গঠিত (এক কোম্পানির চেয়েও কম)। তাদেরকে অগ্রবর্তী অবস্থানে স্থাপন করা হয়েছিল। শত্রুপক্ষের চাপের কারণে তাদেরকেও প্রত্যাহার করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর তারা সিলেট দুর্গে চলে আসে।
৯৫। এই স্তরে এসে দেখা যায়, দুজন ব্রিগেডিয়ার ব্রিগেডটি নিয়ন্ত্রণ করেন। ব্রিগেডিয়ার রানার চাইতে জ্যেষ্ঠ ব্রিগেডিয়ার হাসান কমান্ডের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তবে বাস্তবে তিনি ব্রিগেডিয়ার রানার স্থলাভিসিক্ত হন। এটি সন্তুষ্টির জন্য এখানে উল্লেখ করা যায় যে, অতি সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে তারা পারস্পরিক সহযােগিতায় কাজ করেন।
১৮২
৯৬। এই ব্রিগেটটি মূলগতভাবে সীমান্ত এলাকায় নিয়ােজিত করা হয়েছিল, প্লাটুন এবং কোম্পানি গ্রুপ আকারে তা দক্ষিণে ইটাখােলা হতে উত্তরে লিটু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯৭১ সালের ২৭/২৮ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী শমসেরনগর এলাকায়। রাতেরবেলা গােলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তারপর তারা আক্রমণ চালায়, আর এজন্য তারা ৮ মাউনটেইন ডিভিশনের সাহায্য নেয়। পরদিন সকালে, তারা। আমাদের বাহিনীকে মুন্শী বাজারের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে । এই চাপ এত প্রবল ছিল যে, ৪ ডিসেম্বর এই ব্রিগেডের সমস্ত বাহিনী, সীমান্ত চৌকি পরিত্যাগ। করে ৫ ডিসেম্বর শক্ত ঘাঁটিতে অবস্থান নেয়। ভারতীয়রা মুন্সিগঞ্জে আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। বাহিনীর ছিটেফোঁটা সৈন্য মৌলভী বাজারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
৯৭। ঘটনার এই পর্যায়ে, ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর, ডিভিশনাল কমান্ডার, ৩১৩ ব্রিগেডকে মৌলভী বাজার এবং কুলাউড়া (সীমান্তের নিকটে মৌলভী বাজারের উত্তর-পূর্ব দিক) থেকে প্রত্যাহার করে কুশিয়ারা নদীর ওপর শেরপুর ফেরি এবং সিলেটের দক্ষিণ এপ্রােচে অবস্থিত ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এরপর, ব্রিগেডটি শত্রুপক্ষের চাপের মুখে প্রত্যাহার করে সিলেটে স্থাপন করা হয় এবং ২০১ ব্রিগেডের সঙ্গে সহযােগিতার মাধ্যমে সিলেটের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ব্রিগেডটি ৮ তারিখে মৌলভীবাজার ত্যাগ করে ডিসেম্বরের ১২ তারিখে সিলেট পৌছায়।
৯৮। সিলেট দুর্গটি ডিসেম্বরের ৭ তারিখে শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। হেলিকপ্টার যােগে নামা ব্যাটালিয়নের একদল সাহসী সেনাদের দ্বারা সিলেট শহরের প্রান্ত দেশে তারা চলে আসে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ২০২ ব্রিগেড এই আক্রমণ প্রতিহত করে দেয়। শত্রুরা শহরের দুই মাইল দূরত্বে চলে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে শহর দখলের জন্য আক্রমণ অব্যাহত রাখে । আমাদের বাহিনী যদিও অবস্থান নিয়ে থাকে, কিন্তু সীমান্ত এলাকা হতে সেনা প্রত্যাহারের কারণে শত্রুরা চারদিক থেকে গােলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। তথাপিও দুর্গটি বীরত্বের সঙ্গে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আদেশ পর্যন্ত ধরে রাখা হয়।
৯৯। উপরের বর্ণনা থেকে দেখা যায় শত্রুবাহিনীর যে অংশটি সত্যিকারভাবে ঢাকার ওপর ভয়ভীতি সৃষ্টি করেছিল তা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৭ ব্রিগেডের শােচনীয়। দশা থেকে সৃষ্ট। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার তিক্ততার সঙ্গে অভিযােগ করেন যে, ১৪ ডিভিশনের কমান্ডার কর্তৃক ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিত্যাগের জন্য তিনি গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর এটি ছিল প্রায় অজেয় একটি দুর্গ; যা বিনা যুদ্ধে পরিত্যাগ করা হয়। অন্যদিকে ডিভিশনাল কমান্ডার তার ব্যর্থতার বিষয়টির দায়-দায়িত্ব ইস্টার্ন কমান্ডের ক্রটিপূর্ণ পরিকল্পনার ওপর চাপান। তাঁর মতে, ডিভিশনের দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বিধা-বিভক্তিমূলক কার্যক্রম ছিল বিলম্বিত এবং বােকামিপূর্ণ। এলাকাটির ভার আগের মতাে তার একার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। প্রয়ােজনবােধে, ৫৩ ব্রিগেডকে তাঁর কমান্ডের অধীনে আনা যেত এবং তাহলে তিনি আশুগঞ্জের জন্য একটি কার্যকর ব্রিগেড-যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারতেন। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য নয়। ডিভিশনাল কমান্ডারের মতে
১৮৩
তাহলে মেঘনা নদী পাররত শত্রুবাহিনীকে ঘায়েল করার জন্য অধিকতর উত্তম অবস্থানে থাকতে পারা যেত।
১০০। ঘটনাদৃষ্টে আমরা একথা না বলে পারছি না যে, ডিভিশনাল কমান্ডারের কথার যৌক্তিকতা রয়েছে। যেভাবে অভিযান/অপারেশন কার্যক্রম ঘটানাে হয়েছিল, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি তার হেডকোয়ার্টারের পশ্চাদে ছিলেন না। কিন্তু বাস্তবে তিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রবর্তী অবস্থানে যুদ্ধ করেছিলেন। তার কিছু ব্রিগেড কমান্ডারও উত্তমভাবেই যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ইস্টার্ন কমান্ডের ভ্রান্ত প্রতিরক্ষা ধারণার মধ্যে ছিল ভুলের অবস্থান। আমরা তাঁর সঙ্গে একমত পােষণের জন্য উদগ্রীব যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া দ্বীপের পতন এবং শত্রু সেনাদের নরসিংন্দীতে সফলতার সঙ্গে হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ ঠেকানাে যেত, যদি ইস্টার্ন কমান্ড তাঁকে পরিষ্কারভাবে ‘মিশন মাত্রার নির্দেশ দিতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিরক্ষার সঙ্গে তাকে সংশ্লিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। তাঁকে সেখানে সংযুক্ত করে রাখা যথার্থ হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পার্শ্বদেশ সংরক্ষণ করা যেত যদি ইস্টার্ন কমান্ড সিলেটে প্রেরণের পরিবর্তে ৩১৩ ব্রিগেডকে প্রত্যাহার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রেরণের অনুমতি দিত। ইস্টার্ন কমান্ডের অনমনীয়তা এবং ক্ষমতা চর্চার ধরন (অবস্থানের উদাহরণসহ), প্রতিটি সীমান্তের চৌকিগুলােতে সময়ােচিতভাবে সৈন্যদের স্থাপন ও আঞ্চলিক কমান্ডারদের দ্বারা যথাযথভাবে সৈন্য পরিচালনা করতে না পারাই কার্যত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়।

কুমিল্লা, লাকসাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল
১০১। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা (ইতােমধ্যে) যেমন উল্লেখ করেছি, এই অঞ্চলের দায়িত্ব বর্তিয়েছিল এহক ৩৯ ডিভিসনের ওপর। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর হতে এর নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার হিসেবে মেজর-জেনারেল রাহীম খান। সুবিধাজনকভাবে এই অঞ্চলটি দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, যথা : কুমিল্লা এবং নােয়াখালী জেলা নিয়ে একটি ভাগ এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্য একটি ভাগ। সেমতে উভয় ভাগের জন্য সেনাবাহনী বণ্টন করা হয়েছিল। ইতােমধ্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ৫৩ ব্রিগেড কমান্ড সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল নােয়াখালীর ফেনীতে। ১১৭ ব্রিগেড ছিল কুমিল্লা, ৯১ এক ব্রিগেড ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ৯৭ এড়হক ব্রিগেড ছিল চট্টগ্রাম জেলায় ।
১০২। এভাবে ডিভিশনকে এলাকা ভিত্তিক প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কুমিল্লা, লাকসাম, ফেনী, চট্টগ্রাম, দাউদকান্দি এবং চাঁদপুর দুর্গ হিসেবে এবং এর অতিরিক্ত হিসেবে রামগড়, রাঙামাটি, কাপ্তাই, সীতাকুণ্ডু এবং খাইয়ারহাট ছিল শক্ত ঘাঁটি হিসেবে। এ সব দুর্গ ও শক্ত ঘাঁটিতে অবস্থিত বাহিনীর মূল কাজ ছিল সুস্পষ্টভাবে ত্রিপুরা হতে মেঘনার দিকে অগ্রসরমান শত্রু সৈন্যদের প্রতিরােধ করা। ফলে তারা যেন পূর্ব দিক থেকে ঢাকা অভিমুখে আসতে না পারে এবং সেইসঙ্গে চট্টগ্রাম অভিমুখী রাস্তাও যেন তারা ব্যবহার করতে না পারে।
১০৩। মেজর জেনারেল এম রাহীম খান জিওসি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ডিভিশনের ভিতর কিছু পুনঃগােষ্ঠীবদ্ধ সংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করেন। এজন্য তিনি ইউনিটগুলাে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নেন। কিন্তু এর ছিল বিরূপ
১৮৪
প্রতিক্রিয়া। এবং বস্তুগতভাবে বাহিনীর অভিযানমূলক প্রস্তুতির ওপরও এর ফলাফল ছিল নেতিবাচক। এ কারণে আমরা তার দ্বারা সম্পন্ন পরিবর্তনগুলাে উল্লেখ করতে চাই। এগুলাে ছিল
(১) তিনি ২৫ এফএফ ব্যাটালিয়নকে সরিয়ে নেন যা মূলগতভাবে ছিল ঢাকার ৫৩ ব্রিগেডের অংশ এবং এর দায়িত্ব ছিল লালমাই পাহাড় মিয়াবাজার এলাকার ১১৭ ব্রিগেডের কমান্ডের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
(২) ১৫ বালুচ ছিল কুমিল্লা দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতকৃত । কিন্তু তিনি তা ৫৩ ব্রিগেডের অধীনে ফেনীতে স্থানান্তর করেন।
(৩) ৩৯ বালুচ এর স্থানে ২৩ পাঞ্জাবকে নারায়ণগঞ্জ হতে স্থানান্তরিত করে চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম-ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হয়।
(৪) ৯২ এহক ব্রিগেডকে ভেঙে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগকে খাইয়ারহাটে নতুন ব্রিগেড কমান্ডারের হাতে দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ভাগটি ৯৭ এহক ব্রিগেডের সঙ্গে চট্টগ্রাম হেডকোয়ার্টারে স্থাপন করা হয়।
(৫) ২১ (আজাদ কাশ্মীরকে) পশ্চিম পাকিস্তান হতে অবতরণের পরে তাৎক্ষণিকভাবে ২৫ নভেম্বর, ৩৯ ডিভিশনের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। এটি স্মরণযােগ্য যে, ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টাস্-এর স্টাফ অফিসার ব্যক্তিবর্গ এবং সাজসরঞ্জাম সামরিক আইন বিষয়ক হেডকোয়ার্টাস হতে নেওয়া হয়েছিল। আর সেজন্য এই সকল দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ছিল দুর্বলতার উৎস।
১০৪। উপরে উল্লিখিত পুনর্বিন্যাস এমন সময় করা হলাে; যখন যুদ্ধ ছিল আসন্ন; বিশ্বাসঘাতকতাসম্পন্ন, পরিকল্পনাবিহীনতার মতাে ঘটনার প্রকাশ প্রতীয়মান করে ১৫ বালুচকে কুমিল্লা এবং ৩০ বালুচকে লাকসাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার ফলাফল ছিল প্রমাণিতভাবে আকস্মিক বিপর্যয়। কেননা, নতুনভাবে সমাবেশকৃত সৈনিকেরা সেই এলাকার প্রতিরক্ষা সম্পর্কে যেমন পরিচিত ছিলেন না, তেমনি তাদের তেমন সুযােগও ছিল না যে তারা শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন।
১০৫। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর তারিখে ফেনীতে ৫৩ ব্রিগেডের সমাবেশের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জেনারেল রাহীম খান এবং ইস্টার্ন কমান্ড এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এসব কিছুই জিএইচকিউ কর্তৃক রাওয়ালপিন্ডির নির্দেশ মােতাবেক করা হয়েছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে লিখিত কোনাে কাগজ দেখানাে হয়নি। তবে একমাত্র নির্দেশ যা দু দিন পরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ এ এসেছিল তা ছিল নিম্নরূপ-
“এটি এসেছিল ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের জন্য। সম্ভাব্য শক্র চট্টগ্রাম সমুদ্র হতে পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে চায়। তাই চট্টগ্রামের দিকের যাবতীয় ‘এপ্রােচ’ যেকোনাে মূল্যে সুরক্ষা দিতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়ােজনবােধে অন্যান্য কম। গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হতে সৈন্য প্রত্যাহার করে চট্টগ্রামে সেনা সমাবেশ জোরদার করতে হবে।”
১০৬। যদি ইস্টার্ন কমান্ডের এই বার্তা ব্যাখ্যা করা হয়; তবে দেখা যায়, এর অর্থ হলাে চট্টগ্রামের সঙ্গে প্রদেশের অন্যান্য স্থানের যােগাযােগ ব্যবস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে
১৮৫
হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখতে পাই বার্তাটির ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
১০৭। পূর্ব পাকিস্তানে নতুন নন এমন কমান্ডারের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ফেনী “চিকেন নেক” এর নিকট দিয়ে (এটি আগেই বলা হয়েছে) সড়ক এবং রেল যােগাযােগ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, সীমান্ত এলাকা এবং তা শত্রুদের ক্ষুদে অস্ত্রের নাগালের মধ্যে অবস্থিত (ফেনীর সেতুর অবস্থান)। সেজন্য আমাদের মতে কেবলমাত্র ভুলভাবে পরিকল্পিতই নয় বরং সেইসঙ্গে সেখানে কিছু করতে যাওয়াও হবে অন্তঃসারশূন্য। যদি ব্রিগেডটি লাকসামে রাখা যেত তাহলে এটি আরও লাভজনক হতে পারত। অতিযত্নের সঙ্গে গড়ে তােলা দুর্গ, মুজাফফরগঞ্জ সড়কসংযােগের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু সৈন্য চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে গিয়ে ফেনীতে রাখা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ফেনী নদীর স্থলে চট্টগ্রামের পৌছার পাড়ের প্রতিরক্ষা দেওয়া।
১০৮। যেমনটি ঘটতে দেখা গিয়েছিল ভারতীয়রা সেই অক্ষরেখা বরাবর মােটেও অগ্রসর। হয়নি। তারা চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে এসেছিল কাসালংখাল ধরে এবং কুমিল্লাননায়াখালী এলাকায় এসেছিল দাউদকান্দি, চাঁদপুর হয়ে। ১৯৭১ সালের ৩/৪ ডিসেম্বর রাতেরবেলা শত্রুপক্ষ কুমিল্লা-নােয়াখালী এলাকায় মূল আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণটি করা হয়েছিল চৌদ্দগ্রামে দুই ব্রিগেড শক্তি নিয়ে। আক্রমণের সমর্থনে ছিল বিএসএফপি এবং মুক্তিবাহিনী। এই অবস্থানটি ছিল মাত্র একটি ব্যাটালিয়নসমৃদ্ধ। এটি ছিল ২৩ পাঞ্জাব, ছিল এক কোম্পানিরও কম। স্থাপন করা হয়েছিল পেরিকোট এবং ডাকাতিয়া নদীর পিছনে গভীরতম স্থানে।
১০৯। শত্রুদের একটি ব্রিগেড বিএসএফ এবং মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে চৌদ্দগ্রাম ঘেরাও করে ফেলে। তারা পেরিকোটের সঙ্গে সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অন্য ব্রিগেডটি উত্তর দিক থেকে অগ্রসর হয়ে উভয় অবস্থান পাশ কাটিয়ে মুজাফফরগঞ্জের অভিমুখে এগিয়ে যায়। স্থানীয় জনগণ তাদের পথপ্রদর্শক ছিল। তারা তাদের মালপত্র বহনেও সহায়তা দেয়।
১১০। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর অবধি চৌদ্দগ্রামের যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। তারপর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লাকসামের দিকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দাবি করেন, এ কাজের আগে তিনি ব্রিগেড কমান্ডার এবং জিওসি-এর অনুমােদন নেন। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এর সত্যতার কোনাে চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই প্রত্যাহার ছিল প্রকৃত পক্ষে পরাজয়ের পরে ছত্রভঙের মতাে। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টাস্ একটি কোম্পানিসহ লাকসাম পৌছতে পারলেও বাদবাকিরা পথ হারিয়ে ফেলেন এবং অদৃশ হয়ে যান।
১১১। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর লালমাই-মিয়াবাজারে অবস্থিত ২৫ এফএফ সামনে এবং পিছন উভয় দিক থেকেই আক্রমণের মুখে পড়ে। কেননা, আগের রাতে শত্রুরা অজান্তেই পিছনে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ব্রিগেড কমান্ডার লালমাই পাহাড় এবং লাকসামের ভিতরের ফাঁক পূরণের জন্য নির্দেশ দেন। এই কোম্পানির সংরক্ষিত অবস্থায় থাকা ব্রিগেডকে সেইসঙ্গে সামনে অগ্রসর হয়ে মিয়াবাজার হতে আসা সৈন্যদের সাথে মিলিত হতে বলা হয়। মিয়াবাজার হতে আরও একটি এহক কোম্পানিকে অবস্থান নেওয়ার জন্য পাঠানাে হয়। তবে
১৮৬
উভয়েই ব্যর্থ হয়। কমান্ডিং কর্মকর্তা নিজে প্রায় ৩৫ জন সৈন্য নিয়ে ফাক পূরণের জন্য আসেন এবং তিনি নিজেকে শত্রুসৈন্য দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় দেখতে পান এবং আত্মসমর্পণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে এটিই ছিল প্রথম আত্মসমর্পণের ঘটনা।
১১২। ২৩ পাঞ্জাব এবং ২৫ এফএফ এর হঠাৎ করে এভাবে পতিত হওয়ার কারণে সমগ্র ডিভিশনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সংকটাপন্ন হয়ে যায়। ফলে একটি মারাত্মক পরিস্থির জন্ম হয়। জিওসি ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে সন্ধ্যায় লাকসামে একটি নির্দেশে তার অধিনস্তদের নিয়ে সভা করেন। ফেনী থেকে পেছনে এনে বাহিনী লাকসাম এলাকায় স্থাপন করা হয়। ২৩ পাঞ্জাবকে ৫৩ ব্রিগেডের অধীনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ব্রিগেডকে অবিলম্বে মুজাফফরগঞ্জ দখল করতে বলা হয়। কেননা, এর মাধ্যমে চাঁদপুরের প্রতিরক্ষা দিতে হবে। ১৭ ব্রিগেডকে প্রতি-প্রবেশের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের কুমিল্লা-লাকসাম-মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসরমানতা থামাতে বলা হয়।
১১৩। ৫৩ ব্রিগেড লাকসামে ফিরে ৫ তারিখে ট্রেন যােগে এবং রাস্তায় ৩৯ বালুচের দুটি কোম্পানিকে তুলে নেয়, যারা ডক না ৪ ডিসেম্বর তারিখে চৌদ্দগ্রাম হতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল।
১১৪। ১৯৭১ সালের ৫ এবং ৬ ডিসেম্বর তারিখে ১১৭ ব্রিগেড শত্রুদের ওপর একটি প্রতি-আক্রমণের প্রচেষ্টা চালায়। এই শত্রুরা মিয়াবাজার হতে লাকসামের দিকে তাক করেছিল । কিন্তু এ আক্রমণের ভিতর দিকে তারা এগােতে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে, কেউই মনে হয় আঁচ করতে পারেনি যে, ভারতের একটি ব্রিগেড মুজাফফরগঞ্জের দিকে এগিয়ে আসছে। অবশ্য, “অর্ডার গুপের” ৪ ডিসেম্বর তারিখে লাকসামে অনুষ্ঠিত সম্মিলনের পরে, ব্রিগেড কমান্ডার ৫ তারিখে ২৩ পাঞ্জাবকে নির্দেশ দেয়, লাকসামের দিকে অগ্রসরমান বাহিনীকে মুজাফফরগঞ্জে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে। ২৩ পাঞ্জাব ইতােমধ্যে চৌদ্দগ্রামে আক্রান্ত হয়ে অসংগঠিত হয়ে পড়েছিল। তাদের না ছিল যুদ্ধ করার মতাে অবস্থানে না ছিল ওই অঞ্চল সম্পর্কে অবহিত। ওই এলাকাটি সম্পর্কে অবহিত ছিল ৩৯ বালুচ। কেননা, তারা এখানে আগে অবস্থানে ছিল এবং লাকসাম এবং মুজাফফরগঞ্জের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছিল।
১১৫। সত্যিকারভাবে শত্রুরা মুজাফফরগঞ্জ আগেই পৌছে যায় এবং তা তারা খালি দেখতে পায়। তারা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান দখল করে নেয়। এটি ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমাদের বাহিনী প্রস্তুত করেছিল। শত্রুবাহিনীর মুজাফফরগঞ্জে উপস্থিতির বিষয়ে জিওসি কেবলমাত্র তখনই বুঝতে পারেন যখন তিনি চাঁদপুর হতে লাকসাম আসছিলেন। তিনি নিজেও গােলাগুলির মুখােমুখি হন। তিনি চাঁদপুর ফিরে যান এবং ৫৩ ব্রিগেডকে নির্দেশ দেন যেন মুজাফফরগঞ্জ পরিষ্কার করা হয়। ব্রিগেড কমান্ডার “অর্ডার গ্রুপ সম্মিলনের প্রকৃত বার্তা গ্রহণ না করেই ৫৩ বালুচ এবং বাদবাকি ২৩ পাঞ্জাবকে অনুসরণ করেন। ইতােমধ্য শত্রুবাহিনী মুজাফফরগঞ্জে ঢুকে পড়ে। তারা নিজেদেরকে সুস্থির করে ত্রিপুরা এবং চাদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ২৩ পাঞ্জাব একাই ২১ এ
১৮৭
কে নিয়ে টাস্ক কোর্স হিসেবে তাদের মােকাবিলা করতে যায় । কিন্তু যখন তারা মুজাফফরগঞ্জের অভিমুখী হয়, তখন অয়ারলেসে খবর আসে, “পরিষ্কার (ইন ক্লিয়ার)” হাজিগঞ্জের দিকে আস।
১১৬। শত্রুপক্ষ স্বাভাবিকভাবে নির্দেশাবলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছিল এবং বলতে গেলে শুরু হতেই মুক্তিবাহিনী টাস্ক ফোর্সকে নাজেহাল করছিল। সারা দেশে তারা যাতায়াতের জন্য যােগাযােগ ব্যবস্থা ব্যাহত করেছিল এবং বিভিন্ন প্রান্তে এর বিরুদ্ধে কাজ করছিল। এতসব নাজেহাল ও নাজুক পরিস্থিতির ভিতরেও ২৩ পাঞ্জাব ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সকাল ৯টায় হাজীগঞ্জে পৌছে। এজন্য তাদের ৩০ মাইলের অধিক পথ ‘মার্চ’ করতে হয়েছিল। এখানে বাহিনীকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। তবে সেই সময় তাদের খাদ্য এবং গােলাবারুদ ছিল না। দুটি অংশই চাঁদপুরে ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারে যােগদানের ইচ্ছা পােষণ করে। কিন্তু তারা খবর পান যে, ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ রাতে চাঁদপুর থেকে চলে গিয়েছে। নিজেদেরকে আশাহত অবস্থায় দেখে দুটি অংশ ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর এটি ছিল যুদ্ধে দ্বিতীয় আত্মসমর্পণের ঘটনা।
১১৭। ঘটনাক্রমে আমরা বুঝতে অক্ষম; কেন এমন একটি খবর দেওয়া হলাে “(ইন ক্লিয়ার)”, যদি কি না টাস্ক ফোর্সকে শত্রুপক্ষের সামনে ঠেলে দেওয়ার অভিপ্রায় থাকত। যদি তাই হয়, তাহলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড যে কেবল তিস্কারযােগ্য তাই নয়, সেইসঙ্গে তা চরম অপরাধমূলকও।
১১৮। ইত্যবসরে ৫ এবং ৬ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে শত্রুরা কুমিল্লা এবং দাউদকান্দি সড়ক বিচ্ছিন্ন থাকার দরুন উত্তর-পূর্ব দিক; যেমন- জাফরগঞ্জ এবং চান্দিনা হয়ে কুমিল্লার দিকে অগ্রযাত্রা আরম্ভ করে। কুমিল্লা দুর্গ যে কেবলমাত্র এক পার্শ্বে পরে থাকল তাই নয়, সকল দিক থেকে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। কোনাে প্রকার ডিভিশনাল সাহায্য ছাড়াই তা একক ও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধের জন্য রয়ে গেল।
১১৯। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে কুমিল্লা গ্যারিসন শত্রুদের দ্বারা সকল দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়ে। শত্রুরা লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ অংশ দখল করে নেয়। তারা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য সৈন্য কেন্দ্রীভূত করতে থাকে।
১২০। বাহিনী এ সময় গ্যারিসন ত্যাগ করে এবং ৩০ পাঞ্জাবকে বিমানবন্দর এলাকায় নিয়ােজিত করা হয়। ২৫ এফএফ এর দুটি কোম্পানিকে লালমাই এবং একটি দুর্বল কোম্পানি ২১ এ কে সেখানে দেওয়া হয়; যারা আগের দিনই সেখানে পৌছেছিল । জিওসি ব্রিগেড কমান্ডারকে দাউদকান্দি পরিত্যাগের কথা বলেন। কিন্তু তিনি জানান তার পক্ষে নড়াচড়া করা সম্ভব নয়। কারণ দাউদকান্দির রাস্তা ইতােমধ্যে শক্ররা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তারপর, ময়নামতি দুর্গ হতে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (ময়নামতি হলাে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়)। যে পরিমাণ সৈন্য ছিল তার দ্বারা শুধুমাত্র সেনানিবাসের ভিতরের প্রতিরক্ষা কার্যক্রম সম্ভব ছিল। সেজন্য দুর্গ পুনর্গঠন করা হয় এবং শেষ সময় পর্যন্ত শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া হয়।
১৮৮
১২১। মুজাফফারগঞ্জ দখলে নিয়ে নেবার পরে শত্রুরা লাকসাম দুর্গে একটি “নিরব” আক্রমণ হানে ৬ ডিসেম্বর, ভেবেছিল যে দুর্গটি অদখলকৃত। সেখানে আমাদের সৈন্যরা ছিল, তারা যথাসময়ে শত্রুর ওপর প্রতি আক্রমণ চালায় এবং এতে শত্রুপক্ষের বিপুল সৈন্য হতাহত হয়।
১২২। দুর্গের সৈন্যরা ছিলেন মূলত ১৫ বালুচ, ৩৯ বালুচ, ২৩ পাঞ্জাব (যাদের হাতে ভারী অস্ত্র ছিল না) ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং এক কোম্পানি ২১ এ কে । কিন্তু ২১ বালুচ, ২৩ পাঞ্জাবের অংশ এবং ২১ এ কের একটি কোম্পানিকে পুনঃদখল করার অভিপ্রায় নিয়ে মুজাফফারগঞ্জ প্রেরণ করা হয়। ব্রিগেড কমান্ডারের হাতে থাকল কেবলমাত্র ৩৯ বালুচ এবং ২৩ পাঞ্জাবের বাদবাকি সৈন্য। এই সৈন্যদল লাকসাম থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন (তারা রয়ে গেলেন)। এই সামান্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি বুঝতে পারলে যে, বেশিক্ষণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে পারবেন না । সেজন্য তিনি তার জিওজি’র সঙ্গে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, যােগাযােগ করে তাকে তিনটি বিকল্প দেন যেমন-
(১) চাঁদপুরের ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন,
(২) স্থানত্যাগপূর্বক কুমিল্লার ১১৭ ব্রিগেডের সঙ্গে সংযােগকরণ,
(৩) লাকসামে অবস্থান করে যুদ্ধ করে যাওয়া।
১২৩। বলা হয় যে, ব্রিগেড কমান্ডার, লাকসামে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যখন জিওসি নিজে তার হেডকোয়ার্টারসহ চাঁদপুর খালি করেন ৮/৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, এবং শত্রুপক্ষের বিমান হামলা লাকসামের ওপর জোরদার হতে থাকে, তখন তিনি লাকসাম থেকে সরে কুমিল্লা আসেন। পেছনে পড়ে থাকে মৃত এবং আহতরা । তিনি বলেন যে, ইস্টার্ন কমান্ডের আদেশ বলেই তিনি তা করেছিলেনতত্ত্বগতভাবে তখন তার ব্রিগেড সেখানেই বাধা ছিল । ব্রিগেড কমান্ডার পুনরায় আমাদের বিশ্বাস করাতে চান যে, তিনি এ কাজ করার সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বগ্রস্ত ছিলেন। কেননা, এতে করে তাকে যানবাহনগুলাে পেছনে ফেলে আসতে হয়। তার ওপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রায় ১৩২ জন আহত সৈন্য আনা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যখন একটি সাঙ্কেতিক বার্তার মাধ্যমে তাকে ত্যাগ করে আসতে বলা হলাে, তখন তার কাছে সেভাবে চলে আসা ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না। সেই বার্তা মােতাবেক তিনি ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে বেলা ৪ টার সময় লাকসাম পরিত্যাগ করেন।
১২৪। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং তার চীফ অব স্টাফ, বিপরীতভাবে বলেন যে, লাকসাম খালি করে চলে আসার নির্দেশটি ব্রিগেড কমান্ডারের চাপাচাপির জন্যই তার অনুরােধে দেওয়া হয়েছিল। তিনি উপর্যপরীভাবে মরিয়া হয়ে বলতে থাকেন যে, তার গােলাবারুদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
১২৫। আমাদের সামনে হাজিরা দিতে হবে জানার পরে, আমরা বুঝতে পারলাম ব্রিগেড কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডকে চাপ দেন যেন তিনি তাকে সেই অনুমতি দেন। কেননা, তিনি ততক্ষণে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তাঁর বিপরীত চরিত্রের জন্য। তার কার্যকলাপ থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। তালগােল পাকানাে অবস্থার ভিতর তিনি যেভাবে প্রথমে মুজাফফরগঞ্জ এবং তারপর একটি বার্তা “ইন ক্লিয়ার”
১৮৯
এর দ্বারা হাজিগঞ্জের দিকে পরিচালিত হন; তাতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি জানতেন না তিনি কী করতে যাচ্ছেন। তাঁর দুর্গ ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত, যদিও আদেশ মাফিক কেবল যে বােকামিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল তাই নয়, সেইসঙ্গে তা ছিল বেপরােয়া এবং উদাসীনসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। এ কার্যকলাপ কার্যত ইচ্ছাপূর্বকভাবে জীবন নাশ করেছে, কেননা সেখানে ছিল অসুস্থ এবং আহতরাও। আমরা মনে করি অসুস্থ এবং আহতদের পেছনে ফেলে চলে আসা সামরিক নৈতিকতার চরম অমান্যতা। এটি সত্যিই দুঃখজনক যে, অসুস্থ এবং আহতদের কাছে গােপন রেখে (না জানিয়ে) লাকসাম ত্যাগ করে আসা হয়েছিল। দুজন ডাক্তার তাদের দেখভাল করতেন। গােলাগুলির স্বল্পতার কাহিনি ছিল মিথ্যা। কারণ, লাকসামে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং যথেষ্ট গােলাবারুদের মজুদ ছিল । তাছাড়া অন্যান্য সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিল। এমনকি ছেড়ে আসার কার্যক্রমটিও ছিল। দুর্বলভাবে পরিকল্পিত ও অধিকতর দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত। “অর্ডারগ্রুপের” কোনাে কনফারেন্সের দ্বারা কোনাে জায়গা ছেড়ে আসার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। সেখানে ছিল না কোনাে প্রকার অগ্রাবিধার সম্পর্কিত নির্দেশ বা শৃঙ্খলা । ৯ ডিসেম্বর রাতেরবেলায় বাহিনী সাদামাটাভাবে দুটি ধারায় বের হয়ে আসে। রাত ৯টায় শক্রকবলিত এলাকা পাড় হয় এবং শক্রদের থেকে ১২-১৫ মাইল দূরবর্তী স্থান দিয়ে এগােতে থাকে।
১২৬। নির্ভরযােগ্য প্রমাণাদি থেকে দেখা যায় সেখানে সংখ্যা ছিল সামগ্রিকভাবে ৪,০০০ হাজার। যুদ্ধ করে বা না করে লাকসাম থেকে বের হয়ে আসে মাত্র ৫০০ শত। তার মধ্যে ছিল ব্রিগেড কমান্ডার এবং সিও, ১৫ বালুচ। এরা শেষ পর্যন্ত কুমিল্লা পৌছতে সক্ষম হয়। বাদবাকিরা হয় নিহত অথবা ধরা পড়ে। ৩৯ বালুচের সিও প্রায় ৪০০ সেনা সদস্যসহ শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তখন তিনি কুমিল্লা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে ছিলেন। চলাচল কেবলমাত্র রাতের বেলাতেই সম্ভব ছিল । কেননা, দিনের বেলায় তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের বিপরীতেই ওত পেতে থাকা হতাে। যখনই তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যেত, তখনই তারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করত। এমনকি রাতের বেলাতেও। ডিসেম্বর মাসের ১০/১১ তারিখের রাতের বেলায় কিছু সংখ্যক সৈনিক কুমিল্লা পৌছায় এবং অন্যান্যরা আসে পরদিন সকাল বেলা।
১২৭। মুজাফফরগঞ্জ পুনরায় দখলে নিতে ব্যর্থবাহিনী; পরে জিওসি নিজে মেনে নেন যে, তিনি চাঁদপুরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হয়েছেন। সেজন্য, তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের নিকট হয় দাউদকান্দি অথবা নারায়ণগঞ্জ থেকে সৈন্য খালি করার অনুমতি চান। তাঁর চাঁদপুর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে বর্ণিত বাহিনী ছিল-
(১) পদাতিক বাহিনী (মােটামুটিভাবে প্রতিটিতে এক কোম্পানি) এক্স-২৫ এফএফ এবং পাঞ্জাব, অন্য একটি কোম্পানি, বাদ ছিল ১২ এফএফ।
(২) এমএমজি (বিশেষ সার্ভিস গ্রুপ) এক প্লাটুন।
(৩) এক প্লাটুন, প্রকৌশলী।
(৪) সিগন্যাল, এক কোম্পানি।
(৫) আমি সার্ভিস কর্পস, এক প্লাটুন।
১৯০
(৬) ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ কোম্পানি।
(৭) সিএসএইচ।
(৮) বিবিধ বাহিনী, এর মধ্যে ছিল, ডিটাচমেন্ট, মিলিটারি, পুলিশ, গােলাবারুদ প্লাটুন এবং রেজিমেন্টাল পুলিশ। উপরন্তু, এর বাইরে, সেখানে ছিল একটি স্কেলিটন স্টাফ অব অফিসার এবং কেরানিগণ। তাদের ঢাকার সামরিক আইন প্রশাসনের হেডকোয়ার্টার হতে নেওয়া হয়েছিল।
১২৮। জিওসি বলেন যদিও ১৯৭১ সালের ৬/৭ তারিখে খালি করার অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল তারপরও তিনি ২৪ ঘণ্টা পরে অগ্রসর হন (বিলম্বিত করেন)। প্রত্যাশা ছিল, ২৩ পাঞ্জাব যারা কি না লাকসাম থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল তারা ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারে সঙ্গে এসে সংযুক্ত হবে। কিন্তু তা ঘটেনি। সেখানে সেজন্য তাঁর মতে, শত্রুপক্ষ থেকে বিপদ নিকটবর্তী হচ্ছিল। হেডকোয়ার্টার ও সিএমএইচ দখল হওয়ার সম্ভাবনা দ্রুত দেখা দিচ্ছিল। তাই তিনি ১৯৭১ সালের ৮/৯ ডিসেম্বর তারিখে চাদপুর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১২৯। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার অন্যদিকে বলেন তিনি চাঁদপুর খালি করার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। কেননা, জিওসিকে অত্যন্ত “দোদুল্যমান” বলে মনে হচ্ছিল। এবং সে অবস্থায় তাঁকে সেখানে রেখে কোনাে কাজ হতাে না। নদীর নিয়ন্ত্রণের ভার ছিল নৌবাহিনীর ওপর। তারা ৮ ডিসেম্বরের সকাল ৮টায় এসে পৌছেছিল। তাদের আসতে বিলম্ব হয়েছিল বলে পরদিন; অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ২টায় যাত্রা শুরু হয়। এর অর্থ হলাে এই ভ্রমণের কিছু সময় ৯ ডিসেম্বরের দিবালােকে ঘটেছিল।
১৩০। পরিবহণ, ভেসেলস্-এর কমান্ডার, নৌবাহিনীর কর্মকর্তা পরিষ্কারভাবে জানান যে, দিবালােকে চলাচল না করার জন্য তারা বলেছিলেন। কিন্তু তাদের উপদেশের প্রতি কর্ণপাত না করেই চলে যাওয়ার জন্য জিওসি খুবই চাপাচাপি করছিলেন। এর ফল হয়েছিল এমন যে, যখন তারা ভেসলসমূহসহ নারায়ণগঞ্জের নিকটবর্তী হলেন, তখন ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের আক্রমণ করল। তাদের জন্য স্কট করতে আসা এলসিটিস্ (LCTS) এবং গানবােট ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭ জন নৌসৈনিক এবং জিওসি’র চারজন, (একজন কর্নেলসহ) নিহত হলেন। অনেকেই আহত হলেন। আহদের মধ্যে জিওসি নিজেও ছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্ষত ছিল সামান্য। ডান উরুতে কিছু আঘাতসহ আঁচড় লেগেছিল গােলার টুকরাের দ্বারা। তাঁর পায়ের গােড়ালির গাঁট মচকে গিয়েছিল সম্ভবত নিজেকে নিরাপদ করতে গিয়ে। যখন নারায়ণগঞ্জে অবতরণ করা হলাে তখন তাঁকে খুবই মর্মাহত দেখাচ্ছিল। সে কারণে তাকে ঢাকা সিএমএইচ-এ পাঠানাে হয়। তিনি দ্রুত আরােগ্য লাভ করেন এবং ৩৪ ঘণ্টা পরেই হাসপাতাল ত্যাগ করেন। তিনি নিজেও হাসপাতালকে নিরাপদ স্থান মনে করেননি। ভেবেছিলেন সেখানেও শত্রুরা আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এই আহত হওয়ার কারণ যাই হােক না কেন; তিনি অগ্রাধিকারভাবে চিকিৎসার সুযােগ নেন। এবং ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দিন সকালবেলা কিছু মহিলা এবং শিশুসহ পাহারার সুবিধাসহ
১৯১
বিমানযােগে বার্মা চলে যান। সে ধরনের সুযােগ তখনও ঢাকায় ছিল… ঢাকা সিএমএইচ-এর ছয়জন নার্স সেই বিমানে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হন।
১৩১। ৩৯ এহক ডিভিশন হেডকোয়ার্টার খণ্ড-বিখণ্ডতার মধ্যে পতিত হয়। নারায়ণগঞ্জ সেক্টরে আর একটি হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মিয়া মনসুর মােহাম্মদ। নারায়ণগঞ্জ সেক্টরের সকল প্রতিরক্ষা কার্যক্রমসহ ৩৯ ডিভিশনের ভগ্নাংশ একত্র করে সেখানে এটি গড়ে তােলা হয়।
১৩২। এটি ছিল হতাশাব্যঞ্জক। অবশ্য ৩৯ ডিভিশনের জিওসি এত মরিয়া হয়ে তড়িঘড়ি করে চাঁদপুর ত্যাগ করেন যে, এমনকি তিনি তার সিগন্যাল এবং অয়ারলেস সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিও সেখানে ফেলে এসেছিলেন। যদি তার হেডকোয়ার্টার চাদপুরেই রয়ে যেত, সিও ২১ এ কে এর টাস্কফোর্স হয়তাে সেখানে গিয়ে যুক্ত হতাে, তাহলে ভারতীয়দের কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হতাে না।
১৩৩। এখন আমরা চট্টগ্রাম এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের দিকে নজর দিতে পারি। এই এলাকাটি ৯১ এবং ৯৭ এক ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিল। আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি যে, শক্ররা ৭ নভেম্বর থেকে কাসালংখাল পথে অগ্রসর হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বরের ভিতর তারা মােরাটিয়ার ঘাঁটির নিকট পৌছে যায়। এবং তারা কর্ণফুলী নদীর তীরে রাঙামাটির ওপর দারুণ চাপ প্রয়ােগ শুরু করে। ৯১ এহক ব্রিগেড ২০ নভেম্বর তারিখে মােরাটিয়ায় শত্রুর মুখােমুখি হয়।
১৩৪। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর, শত্রুরা হেলিকপ্টার যােগে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য অবতরণ করায়। তারা রাঙামাটির উত্তর দিকে নামে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের বাহিনী সফলতার সাথে অবস্থান সুস্থির রাখে তখন পর্যন্ত যখন পর্যন্ত তাদের প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম দুর্গে আনা না হয়। শত্রুরা তাদের অনুসরণ করে ১৫ তারিখে দুর্গে আমাদের বাহিনীর মুখােমুখি হয় । আত্মসমর্পণের আদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে, কিন্তু সেখানে ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করা হয়।
১৩৫। এরই ভিতর শত্রুপক্ষ ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ চট্টগ্রামে আক্রমণের একটি উদ্দ্যোগ নেয়। আর এটি নেওয়া হয় সমুদ্র এলাকা থেকে। সেখানে শত্রুদের একটি জাহাজ বন্দরের বাইরে মাইনে আঘাত করে। এরপরে শত্রুরা আক্রমণের আর কোনাে প্রচেষ্টা নেয়নি। তার পরিবর্তে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ উচ্চাকাঙ্ক্ষী অবতরণ ক্রাফটের দ্বারা দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক বাহিনী কক্সবাজারে অবতরণ করায় এবং তারা চট্টগ্রাম অভিমুখে আসতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণ আত্মসমর্পণের সময় এসে যায়।

উপসংহার :
১৩৬। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ঘটনা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্বলিত এই অধ্যায় বস্তুত হতাশাব্যঞ্জক চালচিত্রের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এটি ছিল কার্যত একের পর এক সার্বক্ষণিক পরস্পরবিরােধী ধারাবিশিষ্ট। যেকোনাে মূল্যে পরিচালিত একমাত্র যুদ্ধ ছিল হিলি সেক্টরে। সেখানে ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হােসাইন ১৬ দিন ধরে বীরত্বের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিলেন। অন্যথায়, আমাদের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ত। কেননা, তারা
১৯২
ছিলেন সর্বক্ষণ সীমান্ত এলাকায়। প্লাটুন এবং কোম্পানি গ্রুপ হিসেবে, অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রায়ই আসত পিছিয়ে তবে অসংগঠিতভাবে। কেননা, সেখানে পরিকল্পিত অথবা সুসংগঠিত প্রত্যাহারমূলক কার্যক্রম অনুপস্থিত ছিল।
১৩৭। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার তাঁর আত্মঘাতী নীতিতে অবিচল ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর সেই মৌলিক বিশ্বাস নিয়ে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে আমরা ভারতীয়দের না চটালে তারা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক যুদ্ধ আরম্ভ করবে না। যদিও তার কাছে ভারতীয়দের পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বিষয়ে গােয়েন্দা তথ্য যথাসময়ে পৌঁছানাে হয়েছিল। তার চী অব স্টাফ জিএইচকিউ-এ বিষয়ে সারসংক্ষেপ (ব্রিক্ট) তুলে ধরেছিলেন। অতএব, তাঁর কর্মকাণ্ড যে কেবল মাত্র নিশ্চিতভাবে ভুল ব্যাখ্যা ছিল তাই নয় সেইসঙ্গে তা ছিল ক্ষমার অযােগ্য অস্বীকৃতি। এজন্য যে, তিনি তার ওপর ভারতীয়দের সামরিক ভীতির গভীরতা উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিলেন না। তিনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতেন, তবে বুঝতে পারতেন তাঁর অধিনস্ত তিনটি ডিভিশন ইতােমধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে প্রতি-বিপ্লবী কার্যক্রম করতে গিয়ে পরিশ্রান্ত ও প্রায় নিঃশেষিত হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের কার্যক্রম প্রায় ৮ মাস ধরে সার্বক্ষণিকভাবে করতে হয়েছিল। সেখানে স্বাভাবিক গােলন্দাজ, সাঁজোয়া এবং বিমান সমর্থন ছিল না; যার দ্বারা তিনি সামনে এগিয়ে যেতে পারেন, থামাতে পারেন শত্রুর অগ্রযাত্রা। অথচ, শত্রুরা ছিল সার্বিকভাবে অস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম সমৃদ্ধ। তাদের সংখ্যাও ছিল আট ডিভিশন। উপরন্তু, তাদের সমর্থনে ছিল প্রায় সমপরিমাণ সংখ্যক বর্ডার সিকিউরিটি গার্ড এবং মুক্তিবাহিনী। তিনি তার চক্ষুদ্বার উন্মােচিত করলেই এ বাস্ত ব দৃশ্য দেখতে পারতেন, বুঝতে পারতেন এর খারাপ পরিণতি।
১৩৮। দুর্গ-ধারণার প্রতি তার প্রদর্শিত যুক্তি দুটিই আকস্মিকতা সংযুক্ত। যেমন, প্রতি বিদ্রোহী কার্যক্রম (অপারেশন) এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের সময় এর ব্যবহারযােগ্যতা। এ দুটিই প্রকৃতপক্ষে দুঃখজনক-অজ্ঞতা প্রসূত ধারণা থেকে সৃষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা, তা একাধারে ছিল দুর্গ ভিত্তিক প্রতিরক্ষা এবং অন্যদিকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ কৌশলের নীতির সঙ্গে বেমানান।
১৩৯। তাঁর দাবি তিনি পুরাতন যুদ্ধ কৌশল নতুনভাবে ব্যবহার করেছেন এবং তিনি তা করেছেন জিএইচকিউ কর্তৃক ভারতীয়দের পরিকল্পনা সম্পর্কে খবরাখবর প্রাপ্ত হয়েই। তাছাড়া তিনি পশ্চিম পাকিস্তান হতে পুনরায় সৈন্য সরবরাহের ভিত্তিতেই তার অভিযান/অপারেশন সংক্রান্ত নির্দেশাবলি অত্যন্ত সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের দ্বারা স্থাপন ও পরিচালনা করেছিলেন- এ দুটোই সমানভাবে অসমর্থনযােগ্য। যেমন, আমরা প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইঙ্গিত দিয়েছি, একমাত্র পরিবর্তন তিনি ঘটিয়েছিলেন; আর তা হলাে, তিনি একটি এডহক ডিভিশন তৈরি করেছিলেন এবং তার কমান্ড সংরক্ষণ সেই ডিভিশনে প্রয়ােগ করেছিলেন। অথচ, সেখানে তা কোনাে প্রকার কাজেই লাগেনি। এছাড়া তার দ্বারা আর কোনাে প্রধান পরিবর্তন ঘটানাে হয়নি।
১৪০। ১৯৭১ সালের ২৫ এবং ২৭ নভেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাওয়া তিনটি ব্যাটালিয়ন, আরও একটি কমান্ড সংলক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু তা দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অগ্রবর্তী লাইনের ফাঁক-ফোকর বন্ধ করতে চাওয়া
১৯৩
হয়েছিল। সৈন্য প্রত্যাহারসক্রান্ত কোনাে কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি, বিশেষ করে ঢাকা-ত্রিভুজের জন্য। অথচ, সেখানে প্রবেশের অক্ষরেখার ওপর পাহারা দেওয়া এবং শত্রুদের হেলিকপ্টার যােগে অবতরণ ঠেকাবার জন্য সৈন্যদের ব্যবহার করা যেত। বড়াে বড়াে নদীতে ফেরিগুলাে প্রয়ােজনবােধে সৈন্য পারাপারের জন্য থাকবে কি না- বিশেষ করে কৌশলগত এলাকায় সে বিষয়েও কোনাে প্রকার উদ্যোগ ও কর্মপন্থা ছিল না।
১৪১। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের মনের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণার অবস্থান। যেমন রাজনৈতিক মিশন, অর্থাৎ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করা, যাতে করে যেকোনাে আকারের ভূখণ্ড (চাঙ্ক অব টেরিটোরি) নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে; তখন পর্যন্ত তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল; যখন কি না সবাই জানত যে, ভারত একখণ্ড ভূমি নয়, বরং সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান একটি ধরাশায়ী আঘাতের (নক আউট ব্লো) মাধ্যমে দখল করতে যাচ্ছে। কমান্ডারের এই আত্মপ্রতারণাকে বলা যায়, প্রবঞ্চনার একটি মহৎ শিল্পকর্ম (মাস্টার পিস)। সেই তত্ত্বের প্রতি তাঁর উপর্যুপরি চাপাচাপি যে তত্ত্বে বলা হতাে যে, তার রাজনৈতিক মিশন পরিবর্তন করার কোনাে ক্ষমতা নেই; যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সার্বভৌমতু। রক্ষাকারী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবর্তিত না হয় সে সময়ে কেউই তা সমর্থন দেয়নি; না নীতিগতভাবে না সামরিক কৌশল হিসেবে। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বরের আগে পর্যন্ত মিশনের’ যে যথার্থতাই থাকুক না কেন, সেই তারিখের পরে এর কোনাে প্রকার বৈধতা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়াই ছিল তাঁর প্রধান কর্তব্য। আর এটিই ছিল বৃহত্তরভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার তাঁর ‘মিশনের’ রেডিক্যাল পরিবর্তনের সেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তাহলে বলা যায় ‘মিশনের কোনাে প্রকার ত্রুটি ছিল না, ক্রটি ছিল ‘মিশন’ সম্পর্কে কমান্ডারের উপলব্ধির মধ্যে। এই পর্যায়ে তার। কাছে এটি প্রতীয়মান হওয়া দরকার ছিল যেকোনােভাবে তার সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং পাকিস্তানের পতাকা উড্ডয়নশীল রাখা। এমনকি তা যদি দেশের একটি অংশের ওপরও হয়, তা হলেও বােঝা যেত যে, তিনি তাঁর মিশন’ অধিকতরভাবে কার্যকর ও অর্থপূর্ণভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৪২। নজীর এবং প্রদর্শিত সাক্ষীপ্রমাণ যে যুক্তিকে সমর্থন দেয় না, তেমন যুক্তি গ্রহণ করা যায় না। অথচ কমান্ডার এখন তেমন যুক্তিই দিয়ে যাচ্ছেন : যে তার ‘মিশন’ তখনও পরিবর্তিত হয়নি। কারণ, এমনকি, জিএইচকিউ তাকে একের অধিক বার্তায় পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এখন ভূখণ্ড ততটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে অবস্থায় কমান্ড যুদ্ধ করে যাবে সময়ােচিত দৃষ্টিতে এবং সেখানে ভূখণ্ডের গুরুত্ব হলাে কৌশলগত । এরপর অতিরিক্ত কী ধরনের নির্দেশনা কমান্ডারের চাইবার ছিল? এটি যদি তাঁর কাছে পরিষ্কার না হয়ে থাকে, তাহলে আমরা দুঃখিত হয়ে বলছি, সেক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে ছিল ভ্রান্তির অধিবাস।
১৪৩। নিজের তত্ত্বের প্রতি জেনারেল নিয়াজীর বদ্ধ ধারণা পুনরায় প্রকাশ পায় তাঁর নিজের প্রাথমিক পর্যায়ের সীমিত যুদ্ধের কৌশল বাছাই ও এর উলটো ফলাফলের ওপর প্রতিক্রিয়ার ভিতর দিয়ে। তার দ্বারা সৈন্য বিস্তারণ করার মৌল ভুল-ভ্রান্তি
১৯৪
উপলব্ধি না করে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার প্রথম প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে একটি নির্দেশ তিনি জারি করেন। এতে জানানাে হয় টু-আপ’ ক্লিয়ারেন্স না দেওয়া পর্যন্ত কোনাে প্রকার প্রত্যাহর করা যাবে না। সেইসঙ্গে আরও নির্দেশ দেওয়া হয়, শতকরা ৭০% ভাগ হতাহত না হলে কোনাে প্রত্যাহার করা যাবে না। এরপর ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আবার একটি নির্দেশে বলা হয়, শতকরা ৭৫ ভাগ হতাহত না হলে প্রত্যাহার করা যাবে না। এটি সৌভাগ্যের বিষয় যে, তার এ ঘােষণা বাস্তবায়নের চেয়ে ব্যত্যয় ঘটেছিল বেশি। অন্যথায়, আমাদের বাহিনীর বিরাট অংশ সীমান্ত এলাকায় ‘কসাইয়ের দ্বারা জবাইয়ের পর্যায়ে চলে যেত। এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বহু আগেই শত্রুপক্ষ তাদের লক্ষ্য অর্জন করে ফেলত।
১৪৪। এখানে আমরা ইস্টার্ন কমান্ডের দ্বারা প্রণীত দুর্গ-ধারণার ভ্রান্তির বিষয়ে আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কিংবা আবার সেই প্রশ্ন নিয়ে এই পর্যায়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে অনিচ্ছুক, যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে তা বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা এই বিষয়টি বলতে চাই; তখন পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজমান পরিস্থিতিতে যদি সেই ধারণার মােটেও কোনাে ফলাফল থাকত, তাইলে দুর্গগুলাে একে অপরকে পারস্পরিক সহযােগিতা দিত। সে মতাে ঢাকা ত্রিভুজের সন্নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পূর্ব-স্থিরকৃত পরিকল্পনা থাকত যে, কীভাবে সম্মুখবর্তী বাহিনীকে পর্যায়ক্রমে শত্রুদের মােকাবিলা করার পথ প্রত্যাহার করে তাদের দুর্গে আনা হবে। কীভাবে এর কার্যকর ব্যবহার করে আক্রমণের শক্তি বাড়ানাে সম্ভব। অধিকন্তু, সেখানে জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য থাকত জরুরি পরিকল্পনার রূপরেখা যে কীভাবে ঢাকা-ত্রিভুজ এলাকায় প্রত্যাহারের কাজ সুসম্পন্ন করা হবে। কিংবা বড়াে বড়াে নদীর পেছনে, শত্রুদের আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য প্রয়ােজনবােধে, শক্রদের হেলিকপ্টারের দ্বারা সৈন্য অবতরণ করানাের বিষয়টি নিমূল বা নিরপেক্ষ করার জন্য আমাদের এক স্কোয়াড্রন বিমান কীভাবেই বা ব্যবহৃত হবে সে বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিল না।
১৪৫। জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার বিষয়ে কোনাে পরিকল্পনা না থাকার বিষয়টি আমাদের কাছে আশ্চর্য হওয়ার মতাে কোনাে ঘটনা নয়। এর অভাবে হালকা ধরনের অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা লাইন তাৎক্ষণিকভাবে সহজেই পেরিয়ে শত্রুসৈন্যরা প্রবেশ করে। সর্বাত্মক যুদ্ধের ১৪তম দিনে যে চালচিত্র সেই সব এলাকা যেখানে শত্রুপক্ষ প্রধান প্রবেশ দ্বার হিসেবে ব্যবহার করেন বলে প্রকাশ পায়; সেসব স্থানের দুর্গগুলাে বিনা যুদ্ধেই ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে দেখা যায়। যেমন, যশাের এবং ঝিনাইদা (পশ্চিম দিকে) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া (পূর্ব দিকে)। পরবর্তী দিনে, কুমিল্লা দুর্গ চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে যায় ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে । এমনকি একজন বিভাগীয় কমান্ডার তার দায়িত্বের আওতাধীন এলাকা হেডকোয়ার্টারসহ পেছনে ফেলে চলে এসেছিলেন। এই দিনে আরও দুটি দুর্গ, একটি পশ্চিমে এবং অন্যটি পূর্বে, যেমন কুষ্টিয়া এবং লাকসাম পরিত্যাক্ত করা হয়। শেষে উল্লিখিত দুর্গগুলােতে এমনিক অসুস্থ এবং আহতদের ফেলে লজ্জাজনকভাবে চলে আসা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৯/১০ ডিসেম্বর তারিখে শত্রুরা একটি অন্যতম প্রধান
১৯৫
নদী, যেমন, মেঘনা অতিক্রম করে এবং ফেরি ও নৌকা যােগে নদী পার হয়ে এবং হেলিকপ্টার যােগে নরসিন্দী ও রায়পুরায় একটি ব্রিগেড শক্তি সঞ্চার করে। পরে তারা ডেমরা ও টঙ্গীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখের ভিতর হিলিও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ময়মনসিংহ হতে সেনাবাহিনী ঢাকা অভিমুখে আসতে থাকে।
১৪৬। এমন গুরুতর পরিস্থিতিতে, ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য অন্যান্য স্থান হতে সৈন্য প্রত্যাহার করে ঢাকামুখী করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। কেননা, শত্রুদের বিমান আক্রমণ সেনা-চলাচল দিনের পর দিন অসম্ভব করে তােলে । বড়াে বড়াে নদীতে পারাপারের ফেরিগুলাে নিখোজ হতে থাকে। এমতাবস্থায় শত্রুপক্ষ ঢাকার ওপর চূড়ান্ত আঘাত আনতে তাড়াহুড়াে করতে আরম্ভ করে । সেজন্য তারা টাঙ্গাইলে প্যারাসুটের মাধ্যমে সৈন্য অবতরণ করায়। ময়মনসিংহ হতে আসতে থাকা বাহিনীটি এই ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা ঝামেলার মধ্যে পড়ে যায়। ব্রিগেড কমান্ডারসহ তার বাহিনীর কিছু সংখ্যক সৈন্য শক্ররা কারাবন্দি করে। বাদবাকি ছিটেফোঁটা সৈন্য বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকা পৌঁছায়।
১৪৭। ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য কোনাে প্রকার যথাযথ পরিকল্পনা ছিল না। এটি কমান্ড নির্ভর হয়ে পড়েছিল। যা কিছু আছে তাই দিয়ে তড়িঘড়ি করে নিরুদ্যমভাবে যে কোনাে রকমে একটি প্রতিরক্ষা গড়ে তােলা হয়। কমান্ডার দাবি করেন যে, আত্মসমপর্ণের নির্দেশনা না এলে তিনি ২৬,৪০০ শত পােশাক সজ্জিত সৈন্য দিয়ে ঢাকার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতেন। ঢাকা এবং অন্যত্র সংঘটিত আত্মসমপর্ণের কাহিনি নিয়ে আমরা চর্চা করেছি, এবং এই উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, আত্মসমর্পণের কোনাে নির্দেশ সেখানে ছিল না। এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার কর্তৃক গুরুতর বর্ণনাসহ যে প্রতিচ্ছবি এ সম্পর্কে অঙ্কিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আত্মসমর্পণের অনুমতি তাঁকে দিয়েছিল এ ভাবে যে, যদি তিনি তার বিচার-বুদ্ধিতে এটি প্রয়ােজনীয় বলে মনে করেন তা হলে তিনি তা করতে পারেন। আমাদের অভিমত হলাে জেনারেল নিয়াজী সেই নির্দেশ অমান্য করেছিলেন। এমনকি সেই বিষয়টি নির্দেশ ধরে নিলেও ঢাকার প্রতিরক্ষা দেওয়া তাঁর সাধ্যের মধ্যে ছিল। তাঁর নিজের হিসাব অনুযায়ী, তিনি আরও দুই সপ্তাহ ঢাকার অবস্থান ধরে রাখতে পারতেন। কারণ, শত্রুরা ঢাকা আক্রমণের আগে নিজেদের সুসংগঠিত করতে এক সপ্তাহ সময় নিতেন। এ অবস্থায় ঢাকার দুর্গগুলাে হ্রাস করতে তাদের আরও এক সপ্তাহ সময় লাগত। যদি জেনারেল নিয়াজী তা করতেন এবং এই প্রক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হতাে, তাহলে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করতেন এবং সামনের প্রজন্মের কাছে মহান বীর (হিরাে) হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতেন, হয়ে উঠতেন শ্রেষ্ঠ শহিদ। কিন্তু ঘটনা থেকে জানা যায় যে, তিনি ইতােমধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর যখন প্রধান দুটি দুর্গ যশাের এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতন হলাে তখনই যুদ্ধ করার স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। ইতিহাস সৃষ্টির প্রশ্নটি সে কারণে তখনও তার মনে আসেনি। এমনকি তিনি ইউএনও কর্তৃক প্রচেষ্টারত যুদ্ধ বিরতির চেষ্টা; যা সামান্য সময়ের মধ্যে হতে পারত সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে নেননি।
১৯৬
১৪৮। আমাদের মূল প্রতিবেদনে; যেমন আমরা ইতােমধ্যে বলেছি, এর প্রকৃত ফলাফল হলাে, যেমনটি আমরা লিখতে চেষ্টা করেছি, “দুঃখজনক মন্তব্য, আমাদের। সামরিক নেতৃত্বের দক্ষতা বিচারে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যে, শক্তিধর প্রতিবেশীর সঙ্গে কৌশলগতভাবে অথবা পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ করার জন্য তারা যােগ্য কি না।” এটি এমন একটি যুদ্ধ ছিল; যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল ভুল-ভ্রান্তি যা পাকিস্তান সেনাবাহনী করেছিল। তারা যে কেবল সংখ্যায় ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে ছিল তাই নয়, ছিল অস্ত্রশস্ত্রে সংখ্যাতিরিক্ত এবং জেনারেলদের সংখ্যা বিবেচানাতেও সংখ্যাতিরিক্ত। “আমাদের পরিকল্পনা ছিল অবাস্তব। কৌশল ছিল অ-লাগসই। সিদ্ধান্ত ছিল অ-সময়ােচিত এবং তার বাস্তবায়ন ছিল ভ্রান্ত।”
১৪৯। আত্মসমপর্ণের কলঙ্ক নিঃসন্দেহে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডের ওপর বর্তায়। কিন্তু আমরা অস্বীকার করতে পারি না, যেমন আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি, “আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টার তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালনে সুস্পষ্ট ব্যর্থতাকে অস্বীকার করতে পারে না।” দিকনির্দেশনায়, পরিচালনায় এবং যুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করার বেলায়, তা পূর্ব পাকিস্তানেই হােক অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে হােক বিবেচনাযােগ্য। যদি কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড, শক্রদের দ্বারা সৃষ্ট নতুন ভয়ভীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ না নিয়ে থাকেন তবে আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টারের দায়িত্ব ছিল তাঁকে শুধরে নেওয়ার। যদি তিনি তা গ্রহণে অস্বীকার করতেন তাহলে তাকে বাদ দিয়ে দেওয়ার প্রয়ােজন ছিল।
১৫০। আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হলাে সেখানে লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছিল সাহসিকতা এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে। এজন্য দায়ী ছিলেন কিছু আঞ্চলিক (স্থানীয়) জ্যেষ্ঠ কমান্ডার। এদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একজন ডিভিশনাল কমান্ডার, যিনি বিপদের মুখে তার কর্মক্ষেত্র এবং দায়িত্বের গণ্ডি পরিত্যাগ করেছিলেন। বুঝতে পারা যায় এবং প্রতীয়মান হয় যে, তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। নিয়ে তারা বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন ছিলেন, অথচ যাদের নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ করবেন। তাদের জন্য নয়। যখন তারা প্রতিঘাত আঁচ করতে পারলেন; তখন তারা যুদ্ধ করার মতাে ইচ্ছা শক্তি হারিয়ে বরং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এটি বলা প্রয়ােজন নিমপদস্থ কর্মকর্তা ও সৈন্যদের কৃতিত্ব যে, তারা যুদ্ধে লড়েছিলেন সাহসীকতার সঙ্গে। যদি তারা সঠিক নেতৃত্ব পেতেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতেন। আত্মসমর্পণের মতাে মর্যাদাহীন পরিস্থিতির মধ্যে তাদের হয়তাে পড়তে হতাে না; যদি তারা সেই মিথ্যা ধারণার মধ্যে না থাকতেন যে, আত্মসমর্পণের নির্দেশও হলাে একটি আইনসিদ্ধ নির্দেশ যা কখনাে অমান্য করা যায় না।
১৯৭

৪৭
পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর ভূমিকা

১। নৌবাহিনীর সচরাচর ভূমিকার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে নৌবাহিনীর ভূমিকা ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের ভূখণ্ডের তিনদিকই ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। কিন্তু মাত্র একটি দিক সমুদ্রের দিকে উন্মুক্ত। এই অবস্থার ফলাফল থেকে প্রত্যাশা করা যায় না যে, সর্বাত্মক যুদ্ধের সময় সেখানে নৌ যুদ্ধ হবে যথার্থ। এবং বিভিন্নভাবে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা ব্যতীত সে কারণে নৌবাহিনীর প্রধান ভূমিকা হবে পাকিস্তান তীরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনীকে ধরে রাখা।
২। নৌবাহিনীর সত্যিকার ভূমিকা সম্পর্কে আলােচনা করার আগে পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর কমান্ডের সাংগঠনিক দিক সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করা সম্ভবত উত্তম হবে । আর এটি করতে হবে যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময়কে ভিত্তি করে। ১৯৭১ সালের জুন মাস অবধি, সর্বোচ্চ ন্যাভাল অফিসার পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল একজন কমােডাের (ব্রিগেডিয়ার), যার শিরােনাম ছিল কমমাডাের কমান্ডিং, পূর্ব পাকিস্তান’, যা সাধারণত বলা হতো সিওএনসিইপি নামে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে, একটি ন্যাভাল হেডকোয়ার্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ নতুন সৃষ্ট পদ ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিং পূর্ব পাকিস্তান (এফওসিইপি)-এ নিয়ােগ পান। সিওএনসিইপি’কে নতুন শিরােনামে বলা হয় কমােডাের চট্টগ্রাম।
৩। সুষ্ঠু ও সাবলীল কর্মধারার জন্য নৌবাহিনীকে তিনটি প্রধান শাখায় (সেক্টরে) ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের প্রয়ােজন মনে রেখে রসদ ও সম্পদাদি পুনঃবণ্টন করা হয়। কমােডাের নামধারী (ব্রিগেডিয়ার) একজন কর্মকর্তা যিনি চট্টগ্রাম ভিত্তিক; তাঁকে কমােডাের চট্টগ্রাম বলা হয় এবং তাঁর ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ইস্টার্ন সেক্টর ও ১৪ ডিভিশন এবং চট্টগ্রাম ব্রিগেডের চাহিদা পূরণের। ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিং, পূর্ব পাকিস্তান (এফওসিইপি)-এর হেডকোয়ার্টার ঢাকায় স্থাপন করা। হয়। কেন্দ্রীয় সেক্টর প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ১৬ ও ৩৯ (এডহক) ডিভিশনের চাহিদা পূরণ করবে, কমান্ডিং অফিসার পিএনএস তাইমুরকে খুলনা বসানাে হয় যার দায়িত্ব হলাে ইস্টার্ন সেক্টর এবং ৯ ডিভিশনের সঙ্গে সংযােগস্থাপনপূর্বক চাহিদা পূরণ করা।
৪। নৌবাহিনীর ওপর যে দায়িত্ব (মিশন) বর্তিয়েছিল তা হলাে “বাহ্যিক এবং নদীপথে শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীর ভীতি থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করা এবং সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডকে তাদের অভিযান (অপারেশন) কার্যক্রমে সমর্থন দেওয়া।” এই মিশনের আওতায় প্রকৃত কার্যপরিধি ছিল নিম্নরূপ :
১৯৮
(ক) সমুদ্র এবং নদীপথে পাহারা (পেট্রোলিং) দেওয়া।
(খ) উচ্চাকাঙ্ক্ষী অপারেশনগুলােতে সেনাবাহিনীকে নৌবাহিনীর গানফায়ার | সমর্থন প্রদান করা; (যেখানে প্রয়ােজন পড়ে)।
(গ) সমুদ্র অথবা নদীপথে সেনাবাহিনীর চলাচলের সময় সমর্থন দেওয়া।
(ঘ) ভূমিতে নৌবাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করা এবং বন্দর এলাকাসমূহে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা।
(ঙ) চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরকে কার্যক্ষম করার জন্য প্রয়ােজনীয় সাহায্য সহযােগিতা দেওয়া।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র নদীপথে নিরাপদ নৌচলাচলের জন্য ট্রাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা ।
যুদ্ধ প্রকাশ পাওয়ার পর ইস্টার্ন থিয়েটারে নৌবাহিনীর শক্তি ছিল খুবই সামান্য। ছিল ৪টি পেট্রোল ক্রাফট এবং ২৪টি গানবােট। তবে বাস্তবে ছিল মাত্র ৪টি গানবােট এবং এর বেশি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রত্যাশা করবার মতাে ছিল না। ২৪টি গানবােটের সংখ্যা আমরা চয়ন করেছি রিকুইজিশনিং’ বােটসহ, যা সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বন্দুক যুক্ত করা হয়েছিল। যুদ্ধের আগে ২টি ন্যাভাল জাহাজ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, নাম ছিল, ‘ঢাকা’ এবং জাহাঙ্গীর। প্রথমটি ছিল একটি ট্যাঙ্কার এবং পরেরটি ছিল একটি ডেস্ট্রোয়ার। তবে এগুলাে দৃশ্যত পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে হয়েছিল; এই ভাবনা থেকে যে, নৌবাহিনীর সামান্য ভূমিকার প্রেক্ষাপটে হয়তাে পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রয়ােজন তেমন হবে না, সে কারণে হয়তাে পশ্চিম পাকিস্তানে ঐগুলাের অধিকতর ব্যবহারের প্রয়ােজন। পড়বে। কারণ, শত্রুর ভয়ঙ্কররূপ সেখানেই বেশি প্রকাশ পাবে। অবশ্য সত্যিকারভাবে ন্যাভাল হেডকোয়ার্টার শাহ্জাহান’ নামের আরও একটি ডেস্ট্রয়ার পাঠিয়েছিল। কিন্তু পুনরায় একই কারণে রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ নিজে এটি এখানে রাখেননি। ব্যাটারিজ এবং গানস্-এর কিছুই খুলনায় ছিল না। অবশ্য চট্টগ্রামে একটি কোস্টাল ব্যাটারি ছিল। কিন্তু তা ঘূর্ণিঝড়ের দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । কক্সবাজারে বলতে গেলে কোনাে সম্পদই ছিল না। কিছু কাঠ দ্বারা নির্মিত লঞ্চ খুলনা, বরিশাল এবং চট্টগ্রামে পরিবর্তন করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংযােগ করা হয়েছিল উত্তম ব্যবহারের জন্য।
৬। এর বিপরীতে ভারত তার নিজস্ব যা পূর্ব পাকিস্তানে রেখেছিল তা হেলা-
(১) এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার (ভিকরান্ট)।
(২) ৪ থেকে ৬টি ডেস্ট্রোয়ারস্ (ফ্রিগেটস)।
(৩) ২টি ‘এফ’ শ্রেণির ডুবােজাহাজ।
(৪) ৩টি অবতরণকারী জাহাজ।
(৫) ২০-২৫টি পেট্রোল ক্রাফ্ট।
৭। আমাদের দিক থেকে উপরিউক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় তা মূলত ছিল একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। এমতাবস্থায় এটি নৌবাহিনীর কৃতিত্ব যে এটুকু নিয়েও, অর্থাৎ
১৯৯
সীমিত সম্পদের দ্বারাও তারা তাদের দায়িত্বের অংশ পূরণ করেছিল। এই সীমিতাবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটেছিল যখন নৌবাহিনীর কমান্ডকে নদীপথে সেনাবাহিনীর ইউনিটের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এজন্য বিবিধ প্রকারের দেশি ক্রাক্টকে ভূখণ্ডের সেনাবাহিনীর পরিবহণের জন্য ব্যবহার করা হলাে এবং উপরন্তু ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে ৪০০ মেরিন ব্যাটালিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে অবতরণ করে এবং এর শক্তিকে চট্টগ্রামের বিমানবন্দর রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।
৮। বিভিন্ন স্থানে আমরা যেমন কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডের বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছি এবং দেখিছি যে তিনি একজন থিয়েটার কমান্ডার ছিলেন না, (যদিও বাস্তবে তিনি তেমন ভূমিকাই পালন করেছিলেন) যেহেতু নৌবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে তাঁর কমান্ডের অধীনস্ত ছিল না। রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ, পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন নৌবাহিনীর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং তার কমান্ড ইস্টার্ন কমান্ডারের অধঃস্তন ছিল না। কিন্তু এটি ছিল তার দায়িত্বের অংশ যে, “ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনস্ত সেনাবাহিনীর অভিযান (অপারেশন) কার্যক্রমকে সমর্থন দিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের ইচ্ছাকে মেনে নিতে হতাে। কিন্তু আন্তঃসার্ভিস সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভূভাগের জন্য কৌশলাদীর বেলায় জেনারেল নিয়াজী অ্যাডমিরালের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করতেন না, তেমনিভাবে অ্যাডমিরালও সে-সকল বিষয়ে কোনাে প্রকার উপদেশ প্রদানের ইচ্ছা দেখাতেন না।
৯। এই পর্যায়ে এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, এমনকি যথাস্থানে ও যথাসময়ে অ্যাডমিরাল কর্তৃক যে উপদেশ দেওয়া হতাে, আমরা দেখব, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ফেরি সম্পর্কে সেক্ষেত্রেও জেনারেল নিয়াজী তা কর্ণপাত করতেন না। সে কারণে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি, যদিও জেনারেল নিয়াজী এটি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবে সেখানে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর পরিকল্পনা-সংশ্লিষ্ট সমন্বয়ের বিষয়ে কোনােরূপ সীমিত পরামর্শ বা আলােচনাও হতাে না। একই রকমের ঘটনা পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর ক্ষেতেও সত্য ছিল। সে কারণে কখনাে কখনাে বিমানবাহিনী ভূভাগের সমর্থন প্রার্থনা করলেও, সেরূপ সমর্থন আসত না। ফলে বিমানবাহিনীকে তাদের নিজস্ব ধারায় ব্যবস্থা নিতে হতাে।
১০। নৌবাহিনীর জন্য অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল সমুদ্রে যােগাযােগের রাস্তা উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে তারা ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ। আরম্ভ হওয়ার আগে পর্যন্ত সফল ছিল। ওই সময় পর্যন্ত সমুদ্রে আমাদের যাতায়াতের ওপর তেমন কোনাে ভীতি ছিল না। আমাদের জাহাজগুলাে মুক্তভাবেই উভয় প্রদেশের মধ্যে যাতায়াত করতে পারত। অবশ্য, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মংলা বন্দরে পশুর নদী হতে আসা জাহাজযােগাযােগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ, সেখানে ভারতীয়রা নদীপথে মাইন বসিয়েছিল। কিন্তু মাইন অপসারণের জন্য আমাদের কোনাে প্রকার প্রচেষ্টা হাতের কাছে ছিল না। তবে বিমান দ্বারা মাইনফিল্ডের ওপর বিস্ফোরক নিক্ষেপণের মাধ্যমে ৬টি মাইনের ওপর আঘাত আনা হয়। এই অপারেশনের
২০০
সময় সেখানে পেট্রোলিং’ এ কর্মরত একটি গানবােটে আঘাত লাগে। এর ফলে দশ জন নাবিক নিহত হন। অন্য দুজনসহ চার জন নাবিক আহত হন।
১১। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পরে, ভারতীয় বাহিনীকে থামিয়ে রাখার কাজ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দরের সুরক্ষার জন্য মাইন স্থাপনের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার প্রয়ােজনীয় সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই অপারেশন কার্যক্রম ১৯৭১ সালের ৬-১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছিল দৈব্যচয়ন (র্যানডম) প্রক্রিয়ায় মাইন বসানাের ভিতর দিয়ে। এই দৈব্যচয়ন (র্যানডম) পদ্ধতির কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়ােজন। এটি ন্যাভাল বাচনভঙ্গির একটি অংশ, এর অর্থ কিন্তু এলােমেলােভাবে মাইন স্থাপন করা নয়। এর অর্থ হলাে কোথায় কোথায় মাইন স্থাপন করা হলাে তার কোনাে গােপনীয় তালিকা তৈরি না করা। মাইন স্থাপনের তালিকা (স্থান নির্দেশসহ) প্রস্তুত করার কারণ হলাে, সাধারণভাবে যুদ্ধাবসানের পরে মাইন অপসারণের কাজ করতে হয়, আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের পানিতে। মাইন অপসারণের কাজটি ব্যয়বহুল এবং এজন্য লাগে দীর্ঘ সময় ও প্রক্রিয়া। সেজন্য প্রয়ােজন হয় মাইন স্থাপন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের, যে কীভাবে কোথায় মাইন বসানাে হয়েছে। এই যুদ্ধের অভিনব পরিস্থিতির কারণে, অবশ্য এ বিষয়টিকে কম গুরুত্ব বা একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে সেনাবাহিনীর হাতে এ ধরনের খবরবাদীর সম্ভাবনাসমূহ পরবর্তীতে শক্ররা ব্যবহার করতে পারে বিধায় তা। নির্মূল করে দেওয়া হয়। বাস্তবে নজীর রয়েছে; এমতাবস্থায়, সন্দেহাতিতভাবে লক্ষ করা হয়েছিল তারা যে যে স্থানে মাইন ছিল তা দেখিয়ে দিতে বলে এবং ভারতীয়রা বিশ্বাস করতে অনিচ্ছুক ছিল যে, মাইন স্থাপনের কোনাে প্রকার খতিয়ান রাখা হয়নি। বন্দিকৃত আমাদের সেনাবাহিনী নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যেখানে-যেখানে মাইন বসানাে আছে তারা সেই সব স্থান এড়িয়ে চলবে। কেননা, তাতে করে তাদের জীবনের নিরাপত্তাও জড়িত ছিল।
১২। সেনাবাহিনীর জন্য বিভিন্ন প্রকার সরবরাহ কাজে সাহায্য করার জন্য নৌবাহিনী ভূমিকা রেখেছিল। সে কারণে এ সম্পর্কে আমরা আগেই বলেছি যে, পূর্বালােচনা অথবা নিদেনপক্ষে পরিপূর্ণ এবং সেনাবাহিনীর বিষয়ে প্রায়ম্ভিক জ্ঞান থাকা নৌবাহিনীর জন্য প্রয়ােজনীয় সমর্থন হিসেবে কাজ করতে পারত । নৌবাহিনীর কাছে বারবার সাহায্য-সহযােগিতার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়েছিল। তারাও সাধ্যমতাে সাহায্য-সহযােগিতার যােগান দিয়েছিল। এবং বিভিন্ন সময়ে সারসংক্ষেপের সময়ে যা বলা হতাে নৌবাহিনী তা প্রস্তুত রাখত। সেজন্য সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, এটি কোনাে সন্তোষজনক পথ ছিল না, যেভাবে বিষয়গুলাে সম্পন্ন করা হয়েছিল। বাস্তবে অ্যাডমিরাল শরীফ জেনারেল নিয়াজীকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁর দুটি অধ্যায় এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন-
“আমি জানি কী রকম সমর্থন তারা প্রত্যাশা করে। তারা আমাকে বাহিনী বদল করতে বলেছিল। তিনি জানেন আমি অনেক নৌকা রূপান্তরিত করেছিলাম। তিনি জানতেন কোস্টারগুলাে নৌবাহিনীতে চাকরিজীবীদের
২০১
অধীনে চলাচল করত না। এ কারণে আমি বলছি আমি জিওসি-এর দিকে। অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলাম, জেনারেল নিয়াজির উপস্থিতিতেই যে, আপনি স্থানীয় ক্রাক্টগুলাে আপনার কাছে চলাচলের জন্য রাখুন। আমি অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম নই। এবং আপনার বাহিনীর চলাচলের দায়িত্বও নিতে পারি না। এ কারণে আমি দেখলাম কখনাে কখনাে চীফ অব স্টাফ ফোন করে বলেন, “শত শত টন গােলাবারুদ এখানে স্থানান্তরের অপেক্ষায় রয়ে গিয়েছে। তাই প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা নৌকা/বােট সংগ্রহ করে এ ধরনের স্থানান্তরের কাজ সমাধা করি।” “জিওসি-এর কাছে আমি বারবার জানাই যখনই সেনাবাহিনীর চলাচলের বিষয়টি আমার নজরে আসে এবং তারা তাদের এলাকার নৌকা না পেলে তারা চলাচল করতে পারতেন না। ফেরিগুলাে ভারতের বিমানবাহিনীর দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল এবং নৌকাগুলাে কেবল মাত্র রাতের আঁধারে চলাচল করতে পারে- তাও ছিল খুবই বিপজ্জনক। এর ফলে ১৪ ডিভিশনের কমান্ডার জেনারেল মাজেদ আমার পরামর্শে নৌকাগুলাে তার এলাকার জন্য নিজের আয়ত্তে নিয়েছিলেন, এবং চূড়ান্তভাবে তিনি সেইসব নৌকাযােগে ঢাকা পৌছতে পেরেছিলেন।”
১৩। ফেরি এবং অন্যান্য যাত্রী পরিবহণ-সেবা ছিল আইডব্লিউটি-এর অধীন (অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ অথরিটি)। এটি ছিল একটি বেসামরিক সংস্থা। এই সংস্থাটি লাগাতারভাবে তাদের কর্তব্য পালন করতে থাকে। কিন্তু সব সময়ই সেবা হ্রাস পায় এবং কিছু বাছাই করা পথ ধরে চলাচল করতে থাকে। আর এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। সেজন্য বিদ্রোহী তৎপরতা অধিকতরভাবে বৃদ্ধি করাসহ এবং মুক্তিবাহিনী, গেরিলারা তাদের লঞ্চে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংযুক্ত করে, যার দরুন চলাচল বিপদাপন্ন ও বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে নৌবাহিনী তাদের সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বিপদ থেকে উদ্ধার করার অভিপ্রায় নিয়ে। নৌবাহিনীর গানবােটগুলাে সদাসর্বক্ষণ বিদ্রোহী, মুক্তিবাহিনীর নাগাল পেতে ছুটে বেড়ায়। তাদের কার্যক্রম সে কারণে আইডব্লিউটি এ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। যদিও তা কার্যকর বলে মনে হয়। কিন্তু বেসামরিক নাগরিকদের চলাচলের জন্য তা অপর্যাপ্ত ছিল। নিরাপত্তাবােধ বিঘ্নিত ছিল এবং এর ওপর নির্ভরশীল হওয়া যেত না।
১৪। নৌবাহিনীর পাহারায় সেনাবাহিনী, খাদ্যসামগ্রী এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পরিবহণ করা হতাে। কনভয়গুলাে উত্তমভাবে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হতাে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতাে। অবশ্য এমনও ঘটনা ঘটত সেনাবাহিনী একটি নদী পার হতে পারত না যদিও নদী পারাপারের জন্য বাহন থাকত। কারণ, নদীর ঘাট ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত। এসব কিছুর জন্য আমরা মনে করি রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফের সতর্কতাকে জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক উপেক্ষা করার জন্যই তা ঘটত। ক্যাপ্টেন জামির (সাক্ষী নং ২৭২) সেই সময়ের চীফ স্টা অফিসার এফওসিইপি, বলেছেন সেই সব ফেরির বিষয়ে কোনাে ধরনের পরিকল্পনা ছিল না, ইস্টার্ন কমান্ড কখনাে ফেরিগুলাের কৌশলগত গুরুত্বের কথা
২০২
নৌবাহিনীকে বলেনি। কমান্ডার এ. এ. খান (সাক্ষী নং ২৬২), ছিলেন অপারেশন কার্যক্রমের স্টাফ অফিসার, তিনি বলেন, নৌবাহিনীকে কখনাে সীমিত যুদ্ধের সময় অথবা সেনাবাহিনী চলাচলের সময় পাশাপাশি থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়নি। তবে তিনি বলেন তা সত্ত্বেও আশুগঞ্জের নিকটে এবং দক্ষিণ চাঁদপুরে এ ধরনের “কভার” প্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল।
১৫। নৌবাহিনীর সদস্যদের সাক্ষীর মতে পেট্রোলিং কার্যক্রমের বেলায় চ্যানেলগুলাের জন্য কোনাে সমন্বিত পেট্রোলিং-এর পরিকল্পনা ছিল না। তারপরও যেন সেখানে মুক্তিবাহিনী চলাচল করতে না পারে সেজন্য নৌবাহিনী কিছু কিছু এলাকায় পেট্রোলিং নিশ্চিত করত। এসব কারণে, যদি কোথাও তাদের ওপর গুলিবর্ষণের কোনাে ঘটনা ঘটত; তাহলে তারাও পালটা জবাব দিত।
১৬। একটি বিষয় সত্যিকারভাবে এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা প্রয়ােজন; তা হলাে, বিমান যুদ্ধ; কেননা, এক্ষেত্রে নৌবাহিনীরও কিছু করণীয় ছিল। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে জেট বিমান এবং বিমানবাহিনীর এয়ারক্রাফটের জন্য প্রস্তুত রাখার প্রশ্নের সঙ্গে এটি জড়িত ছিল। কমডাের কে এম হােসাইন (সাক্ষী নং ২৭১), যিনি ছিলেন কমােডাের, চট্টগ্রাম যখন এফওসিইপি সৃষ্ট করা হলে তিনি বলেন যে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ছিল তার দায়িত্বের মধ্যে যতক্ষণ এটি তার সেক্টরের মধ্যে ছিল। যখন আত্মসমর্পণের সময় এলাে তখন রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছিল এবং তা প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল । এয়ার কমডাের এনামুল হক খানও বলেন : “চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ে ৭৫০০ ফুট সম্প্রসারণে কাজ ১৯৭১ সালে বেসামরিক বিমান পরিবহণের আওতায় হয়েছিল। কিন্তু সেখানে আমাদের লােকজনের জন্য অথবা এয়ারক্রাফটের জন্য কোনাে প্রকার সুযােগ-সুবিধা ছিল না। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ সময় থেকে আমাদের একটি ক্ষুদ্র রক্ষণাবেক্ষণের দল সেখানে থাকত বিশেষ করে যদি কোনাে এয়ারক্রাফ্ট জরুরি ভিত্তিতে গতি বদলিয়ে সেখানে আসে তবে তা গ্রহণ করার জন্য।” সুস্পষ্টভবে সেখানে একটি পরিকল্পনা ছিল যাতে করে বিমানবন্দরটি ব্যবহার উপযােগী করা যায়। তবে সেই পরিকল্পনাটি সময়মতাে বাস্তবায়ন করা হয়নি।
১৭। প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা (ডিনায়েল প্লান) বাস্তবায়নের বেলায় নৌবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা চূড়ান্ত আলােচনায় এসেছি, আমরা ইতােমধ্যে বলেছি যে, কোন্ পরিস্থিতিতে প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া হবে তার জন্য কোনাে রকম নির্দেশ আর প্রদান করা হতাে না। এই প্রশ্নটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখতে পেরেছি; শেষ পর্যন্ত কীভাবে প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনার অংশ প্রত্যাহার করা হতাে। কমডাের কে এম হােসাইন হলফ করে সাক্ষ্য দেন যে, তারা (নৌবাহিনী) একটি প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন; যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপর্ণ সংস্থাপন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এর মধ্যে বন্দর এলাকাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন তিনি আত্মসমর্পণের সঙ্কেত পেলেন তখন তিনি প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি বার্তাও পেয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ছিল আশ্চর্যজনক (হতবাক করার মতাে), সেহেতু
২০৩
তিনি এফওসিইপি-এর সঙ্গে যােগাযােগ করেন এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য, এবং তাকে বলা হয়, তিনি যেন প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অগ্রসর না হন। তিনি বলেন, তারপরও তিনি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান এবং যাবতীয় গুপ্তলিখনসম্পন্ন যন্ত্রপাতি, গুপ্ত লিখন সম্বলিত প্রমাণাদি ও তথ্য, শ্রেণিবদ্ধ প্রমাণাদি, যােগাযােগের জন্য সুযােগ-সুবিধাবলি, সকল স্বয়ংক্রিয় বন্দুক- সবই ধ্বংস করে দেন। সমস্ত বােটগুলাে ফুটো করে ডুবিয়ে দেওয়া হয় । কমান্ডার এ. এ. খান এবং ক্যাপ্টেন এস আর রব (সাক্ষী নং ২৭৪), তাঁরা উভয়ই নিশ্চিত করেন যে, প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। অ্যাডমিরাল শরীফ স্বীকার করেন যে, তিনি নিজে প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনার সঙ্কেত প্রত্যাহার করেননি। কিন্তু তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এটি ছিল জেনারেল নিয়াজীর দৃষ্টান্ত এবং কেবলমাত্র সেইসব ধ্বংসাত্মকতা যা কি না সৃষ্টি করতে পারে একটি “বিগ ব্যাং” তা যেন বাস্তবায়ন না করা হয়। তাই আমরা প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা নিয়ে এভাবে এগিয়ে যাই, তা যেন সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যাত বলে বিবেচিত হয়। তদুপরী নৌবাহিনীর দ্বারা এই প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা যেমন বই-পুস্তক এবং যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও তা বাস্তবায়ন করা হয়।
১৮। এটি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যে, অ্যাডমিরাল শরীফ নিজে বলেছেন তাঁর ছিল দুটি প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা। তবে তার মধ্যে কেবলমাত্র তেল শােধনাগার এবং গােলাবারুদের ডাম্প’ সম্পর্কিত পরিকল্পনাটি বাতিল করা হয়েছিল। সেজন্য আমরা অনুভব করি যে, পেট্রোল কার্যক্রম জ্বালানি হয়তাে সমুদ্রের মধ্যে ফেলে দেওয়া যেত এবং গােলাবারুদও নিদেনপক্ষে সমুদ্রের মধ্যে অভ্যন্তরে জড়াে করা যেত।

পূর্ব পাকিস্তানে বিমানবাহিনীর ভূমিকা
আমাদের মূল প্রতিবেদনে আমরা সংক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে বিমানবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে আলােচনা করেছি (অংশ IV, অধ্যায় VIII, অনুচ্ছেদ, ১৭৪)। তবে তখন এ বিষয়ে আমরা যা বলেছি তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ কিছু এখানে উল্লেখ করার প্রয়ােজনীয়তা বােধ করছি না। অবশ্য তখন হাতের কাছে পাওয়া যায়নি এমন কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ এখন আমরা পেয়েছি, এবং সেগুলাের দ্বারা বিষয়টি একটু বিস্তারিত করতে চাই।
১। আমাদের সমগ্র বিমানবাহিনী গঠিত হয়েছিল শুধুমাত্র ১১-১/২ স্কোয়াড্রন নিয়ে । এর মধ্যে মাত্র একটি পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়েছিল । মােটের ওপর সেজন্য আমাদের চাইতে ভারতের বিমানবাহিনীর শক্তি ছিল অধিক। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক স্কোয়াড্রন রাখা হয়েছিল তা-ও বােধগম্য। এটি স্মরণযােগ্য যে, প্রথম পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক প্রতিরক্ষার ধারণা সব সময়ই মনে করা হতাে তা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর। এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে, এমনকি যদি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে তার প্রতিরােধের একমাত্র উপায় হচ্ছে শত্রুর ওপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চাপ প্রয়ােগ করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সেনাবাহিনীর সকল কার্যক্রম হবে যতদূর সম্ভব ভারতীয় বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যস্ত রাখা । কিন্তু এসব সিদ্ধান্তগুলাে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল দিক ভারতের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল ।
২০৪
কেবলমাত্র সমুদ্রের দিকটি ছিল ভােলা। সেইসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সকল দিকই ভারতের বিমান ক্ষেত্রের নিকটবর্তী ছিল। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র একটি এয়ারফিল্ড’ এবং তার অবস্থান ছিল ঢাকায় (অন্য এয়ারফিল্ডের পরিকল্পনা এবং সম্ভাব্য বিকল্প সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে কিছু বলব)। এমতাবস্থায়, বিমানবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ নিজে তাঁর জরিপে মনে করতেন আমাদের বিমানবাহিনী যুদ্ধাবস্থায় এমনকি ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় টিকে থাকার কথা নয়। বিষয়টি সম্ভবত প্রশ্নবােধক । কিন্তু প্রধানত তা নির্ভর করে সেই প্রশ্নের ওপর যে প্রশ্নে জানা যাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢাকা এয়ারফিল্ড যথাসময়ে মেরামত করার ভিতর দিয়ে বিমানবাহিনীকে দীর্ঘ সময় ধরে কার্যক্ষম করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কি না। তা যেভাবে হয়েছিল, সে অনুযায়ী কমান্ডার ইন চীফ-এর নিজের মূল্যায়ন সম্পর্কিত উক্তি থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি না যে, এই প্রশ্নের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর আচরণ শর্তস্বাপেক্ষ ছিল। এটি আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বিমানবাহিনী অনুভব করেছিল; যদি তারা ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় সফলতার সঙ্গে টিকে থাকে তাহলে তাদের যা কিছু করণীয় ছিল তা তারা সম্পন্ন করতে পারবে। অথবা, তাদের লক্ষ্যই ছিল তাই। বাস্তবে তারা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কার্যক্ষম ছিল।
২। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত এক স্কোয়াড্রনে ছিল ১৬ এফ-৮৬ ফাইটার বিমান। ২টি হেলিকপ্টার যার দ্বারা অনুসন্ধান এবং উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হতাে। ছিল ২টি টি-৩৩ অনুসন্ধান বিমান। তবে কোনাে সাক্ষীই ঠিকমতাে জানাতে পারেননি সেখানে সত্যিকারভাবে কতজন পাইলট ছিলেন। কিন্তু গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ বেগ (সাক্ষী নং ২৭৭), আমাদের বলেছিলেন যে, সেখানে সম্ভবত প্রতি এয়ারক্রাট পিছু ১.২৫ অথবা ১.৩৩ পাইলট ছিলেন। সেই তথ্যানুযায়ী বলা যায়, সেখানে। ২৫ অথবা ২৬ জন পাইলট ছিলেন।
৩। আমরা যেমনটি বলেছি মূলত কী কারণে আমাদের বিমানবাহিনী ঢাকায় ভারতীয়দের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি রােধ করতে অক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ তেজগাঁও বিমানবন্দরের ক্ষয়ক্ষতি তারা ঠেকাতে পারেনি। এটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে। প্রমাণাদির দ্বারা প্রতীয়মান হয়; তা ঘটেছিল দৃশ্যত এজন্য যে, বিমানবন্দরের মধ্যভাগে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ফলে যুদ্ধ বিমানগুলাের উড়বার ক্ষমতা ছিল না। এমন নজির বিমানবাহিনীর সাক্ষী থেকে পাওয়া যে, মেরামতের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। এয়ার কমডাের এনামুল হক খান (সাক্ষী নং ২৭৮), কমান্ড অফিসার এ বিষয়ে বলেন-
“স্যার, আপনি জানেন, ৬ তারিখে রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমগ্র প্রকৌশলী দলসহ আমরা রাতে মেরামতের কাজ আরম্ভ করি। কিন্তু ক্যানবেরা রেইড’ এর মাধ্যমে বারবার আমরা বাধা পাই। বােমার আঘাতে সৃষ্ট দুই-তিনটি খাদ ভরে ফেলি । কিন্তু উপরে কোনাে শক্ত প্রলেপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত নিই রাতের বেলায় আর কোনাে মেরামতের কাজ করা নয়। তাই আমরা দিনের আলােতে রানওয়ের মেরাতের কাজে হাত
২০৫
দিই। পুনরায় বােমা নিক্ষেপণ আরম্ভ হয় এবং তা চলতে থাকে। আমাদের প্রচুর ভােগান্তি হয়। সেদিন আমাদের কয়জন হতাহত হয়। যখন ‘রেইড’ হতাে তখন মানুষজনকে আশ্রয়ে আসতে হতাে। কিন্তু উপরের অংশে একটি বিরাট খণ্ড উর্ধ্বে ওঠে এবং আমার মনে হয় ছয় অথবা সাতজন ধ্বংসাবশেষের আঘাতে সেদিন নিহত হয়। সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ, যেমনটি আমি যৌক্তিকভাবে নিশ্চিত যে, আমরা ‘রেইডের’ মুখে টিকে থাকতে পারিনি, এবং রানওয়েরও কোনাে যৌক্তিক ব্যবহারযােগ্য রূপ দিতে পারিনি।” তার বক্তব্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ বেগও সমর্থন করেছেন।
৪। অবশ্য একটি ভিন্ন চালচিত্র দেখান দুজন সেনা কর্মকর্তা। প্রথম জন হলেন ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরীফ (সাক্ষী নং ২৬৯)। তিনি ছিলেন একজন কমান্ডার, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং তাঁকে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পদচ্যুত করা হয়। তিনি আশ্চর্য হয়ে যান; যখন গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ বেগ তার কাছে এগিয়ে আসেন। এবং ঢাকা বিমানবন্দরের প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে বলেন। সাক্ষী ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরীফ গ্রুপ ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, এই প্রশ্নটি আসেই না, যদি সেখানে কোনাে কাজ করা হয় তবে তা হবে যথার্থভাবে বিপরীতমুখী। সাক্ষী সে-সময় বােমাবর্ষণের ফলে সৃষ্ট গর্ত ভরাটের জন্য এক প্লাটুন। প্রকৌশলী সৈনিক এবং তাদের সাহায্য করার জন্য প্রয়ােজনীয় বেসামরিক শ্রমিক চান। সত্যিকারভাবে বােমা আক্রমণের ফলে বিমানবন্দরটি কাজের জন্য অনুপযােগী হয়ে উঠেছিল। বিমান বাহিনী কর্তৃক নিয়ােজিত শ্রমিক ও প্লাটুন গর্ত মেরামতের কাজ করতে থাকে। যখন এভাবে কাজ চলছিল, তখন ঢাকা বিমানবন্দরের ওপর বিমান হামলা আরম্ভ হয় এবং যখন মেরামত পরিকল্পনা করা হয় তখন প্রকৃতপক্ষে বিমানবন্দরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি। রাতভর মেরামতের কাজ চলতে থাকে। প্রায় ৮৫% ভাগ গর্ত ভরাটের কাজ শেষ করা হয়। এমতাবস্থায় সাক্ষী বিমান কর্মকর্তা কমান্ডিংকে নিশ্চিত করেন যে, আর একটি রাত কাজ করতে পারলে মেরামতের কাজ শেষ করা যাবে। কিন্তু বিমান কমান্ডিং কর্মকর্তাকে কিছুটা অনিচ্ছাপ্রবণ মনে হয়েছিল। তবে সাক্ষী বলেন যে, সেখানে আর মেরামতের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়নি। কেননা, পাইলটগণ চলে গিয়েছিলেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ, বরাবরই অস্বীকার করে বলেন তার সঙ্গে সাক্ষীর কোনাে প্রকার আলাপ-আলােচনাই হয়নি।
৫। লে. কর্নেল মােহাম্মদ আফজাল (সাক্ষী নং ২৬৬)-এর বক্তব্যের দ্বারা ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান শরীফ এর সাক্ষীর বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয় । লে. কর্নেল মােহাম্মদ আফজাল তখন ছিলেন ৬নং লাইট অ্যাক অ্যাক (ACK ACK) রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। তাঁর দায়িত্ব ছিল ঢাকা বিমানবন্দর দেখভাল করা । এই সাক্ষী বলেন সেখানে শ্রমিকের কোনাে অপ্রাপ্তি ছিল না। কেননা, ছিল প্রচুর বিহারি । তাদের সংখ্যা ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় অতিরিক্ত; যারা স্বেচ্ছাকৃতভাবে এ কাজে শ্রম দিতে আগ্রহী ছিল। এটি এমন হয়েছিল, কিন্তু যেমনভাবে এয়ার কমডাের এনামুল হক খান সমস্যাটি ব্যাখ্যা করেছেন তা হলাে শ্রমিক নয়, অথবা মালমসলার প্রশ্নও নয়; প্রশ্ন ছিল সময়ের সমস্যাসংশ্লিষ্ট । এমনকি মেরামতের কাজ
২০৬
এবং ভারতীয় বিমান কর্তৃক আক্রমণ একই সময়ে চলছিল। সেজন্য কোনাে মেরামতই সময়মতাে সম্পন্ন করে বিমানবন্দরকে কার্যপযােগী করা যায়নি। তারা দুই বা তিনটি গর্ত ভরাট করেছিলেন। তবে উপরিভাগের কাজ সুসম্পন্ন করা যায়নি, নতুন করে বিমান হামলার আরম্ভ হওয়ার কারণে। এই হামলা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিল। তখন বিমানবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের আর কিছুই করার মতাে নেই।
৬। এটি এখন সত্য যে, কুর্মিটোলায় আমাদের একটি বিমানবন্দর নির্মাণের প্রকল্প চলছিল। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি সমাপ্ত হতে পারত ১৯৭৬ সালে। কুর্মিটোলা তেজগাঁও থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তা ব্যবহার উপযােগী করা সম্ভব ছিল না বলে এয়ার কমডাের এনামুল হকের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কাজটি শুরু হলেও তা স্বাভাবিক গতিতে এগােচ্ছিল না। তদুপরি তাঁর মতে সেখানে রানওয়ে পর্যাপ্ত ছিল না। উপরন্তু, তার মতে কেবলমাত্র রানওয়ে থাকাটাই পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন : “আমি যা ব্যাখ্যা করতে চাই তা হলাে, আমরা এমন একটি বিমানবন্দর চাই যেখানে কেবল রানওয়ে নয় টেক্সিওয়েও থাকতে হবে, থাকতে হবে বােমা নিরােধােক আশ্রয়, ওয়ার্কসপ, যােগাযােগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার মতাে বিরাট আকারের কেন্দ্র। সেখানে আমাদের অভিযান (অপারেশন) কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কক্ষও ছিল না। ১৯৭১ সালে কুর্মিটোলাকে ব্যবহার উপযােগী করে গড়ে তােলা সম্ভব ছিল না।
৭। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বােমাবর্ষণের আগের দিন ভারতীয়রা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বােমাবর্ষণ করে। মনে করা হয়, ভারতীয়রা ভেবেছিল কুর্মিটোলা একটি কার্যক্ষম বিমানবন্দর। কেননা, সেখানে কিছু ডামি বিমান ফেলে রাখা হয়েছিল। সম্ভবত এয়ার কমডাের যথার্থই বলেছেন যে, একের অধিক বিমানবন্দর চালু রাখার জন্য তাদের ছিল না মানুষ এবং সম্পদ। এটি এক ধরনের বক্রাঘাত। কারণ, এই বিমানবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পরিবহণে গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু সেই বিমানবাহিনী নিজেরা নিজেদের সাহায্যে আসতে পারল না বৈরী পরিস্থির কারণে। এটি এখানে যুক্ত করা প্রয়ােজন পিআইএ’র মাধ্যমে সেনা পরিবহণে বিমানবাহিনী মূল ভূমিকা পালন করেছিল। যখন এটি স্মরণ করা হয় যে, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের আগে সেনাবাহিনীকে বিমানে আনা হয়েছিল, কিন্তু বিমানবাহিনীর অকার্যকারিতার মূল কারণ ছিল এই যে, বিমানবন্দর না থাকার জন্য তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ছিল না। আর এটি আমাদের কাছেও বােধগম্য হয়েছে।
৮। তবে বাস্তবে এয়ার কমডাের এনামুল হকের মতে, যদি আদৌ আরও একটি বিমানবন্দর থাকত, তা হলে তা তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলার মতাে এত নিকটবর্তী হতাে না। বিমানবাহিনীর নিজস্ব ধারণা মতে ঢাকা হতে ৩০-৪০ মাইল দূরে টাঙ্গাইলে বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য বাছাই করা যেত। আগের অধ্যায়ে আমরা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে সেরকমের একটি বিমানবন্দর করার সম্ভাবনার কথা বলেছি। তার ভিত্তিতে বিমানবাহিনীর পক্ষে আর সেখানে গিয়ে কাজ করার অবস্থা ছিল না। কেননা, ১৯৭১ সালের ৮-৯ ডিসেম্বর তারিখে চারজন পাইলট পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান । ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের অনুমতি ব্যতীতই এয়ার কমডাের এনামুল হক এ কাজটি করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে তাকে অবহিত করা হয়েছিল। জেনারেল নিয়াজীর কাছ
২০৭
থেকে অনুমতি না নেওয়ার জন্য এয়ার কমডােরকে সমালােচনা করার বিষয়টি বােধগম্য নয়। প্রথমত, যেভাবে আমরা ব্যাখ্যা করেছি যান্ত্রিক দৃষ্টিতে কমান্ডের বেলায় সেনাবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনীর তিনি কমান্ডার ছিলেন না। উপরন্তু, যুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু আগেই ওই চারজন পাইলটকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিমানবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ কর্তৃক নেওয়া হয়েছিল। বিমানবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ তাঁকে নিজে ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরে বলেছিলেন- যতদিন তাদের অনুড্ডয়ন অবস্থায় আনা না হয়, ততদিন তারা থাকবেন এবং তারপর তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে। কেননা, সেখানে তাদের সার্ভিসের প্রয়ােজন রয়েছে। এখানে এটি স্মরণযােগ্য যে, একজন পাইলটকে প্রশিক্ষিত করতে টাকা এবং সময় উভয়ই লাগে। এজন্যও এরূপ সিদ্ধান্তের কারণ ছিল যে, প্রশিক্ষিত পাইলটদের হারাতে চাওয়া হচ্ছে না। সেই কারণে যুদ্ধ বিরতি না হওয়া অবধি তাদের পশ্চিম পাকিস্তানের বাইরে রাখতে চাওয়া হয়নি।
৯। পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ২টি রাডার। একটি ছিল উচ্চ মাত্রায় উপযুক্ত রাডার এবং অন্যটি ছিল নিচের দিকে দেখার উপযুক্ত রাডার। উঁচুতে দেখার রাডারের সাহায্যে কেবল মাত্র উঁচুতে উড্ডয়নশীল বিমানকেই দেখা সম্ভব। সম্ভবত এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই রাডারটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেওয়া হয়। কেননা, ধরে নেওয়া হয়। যে, ভারতীয় বিমানগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে নিচু দিয়ে উড়ে আসবে। একথা সত্য যে, উঁচুতে দেখার মতাে রাডার আক্রমণ করতে আসা বিমানের উচ্চতা নির্ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু বিমানবাহিনীর সাক্ষীর মতে যেহেতু রেইড নিচু মাত্রায় হয় এবং তারপর আবার বিমান আক্রমণ নির্ধারণের জন্য উপরে উঠে যায় সে কারণে ওই রাডারের কোনাে প্রকার ব্যবহার যােগ্যতা থাকে না।
১০। অবশ্য, এখানে এটি যুক্ত করা প্রয়ােজন যে, এমওইউ (মােবাইল অবজারভিং ইউনিট) ইতােমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (মার্চ মাসে)। সে কারণে একমাত্র (একচেটিয়াভাবে) নিচু মাত্রায় দেখার যােগ্যতাসম্পন্ন রাডার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকে না। এ বিষয়ে এয়ার কমডাের এনামুল হক নিজে বলেছেন, “এমওইউ না থাকার ফলে কোনাে আগাম সতর্ক বার্তা জানানাে যেত না। এমতাবস্থায়, উপরে উড়ে গিয়ে শত্রুকে চিহ্নিত করা; অথবা নিচু মাত্রার রাডারের সাহায্য নিয়ে শত্রু বিমানকে বাধা দেওয়া ব্যতীত অন্য কোনাে উপায় ছিল না।”
১১। এ ধরনের কাজকর্মের বিষয়টির সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। বলা হয় যে, নিদেনপক্ষে ঢাকা-দুর্গের প্রতিরক্ষার খাতিরে এর ব্যবহার যােগ্যতা ছিল। যদিও ঢাকা ত্রিভুজের প্রতিরক্ষায় এর কোনাে মূল্য নাই। এই সমালােচনার পক্ষে যুক্তি আছে। কিন্তু এটি স্মরণযােগ্য যে, এ ধরনের ব্যর্থতা এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং বিমানবাহিনীর কমান্ডারের মধ্যে কোনাে সমন্বিত ও যৌথ পরিকল্পনা না থাকার জন্য। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি নৌবাহিনীর সঙ্গেও সমন্বিত কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। বিমানবাহিনীর ক্ষেত্রে এটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার বিমানবাহিনীর বিষয়ে খুব সামান্যই আগ্রহ দেখাতেন; বা একেবারেই আগ্রহ দেখাতেন না।
১২। এই পর্যায়ে একটি দৃষ্টান্ত (রেফারেন্স) তুলে ধরা হচ্ছে নৌবাহিনী ভারতের বিমানবাহী জাহাজ ভিকরান্ট এর দ্বারা বিমান আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এ
২০৮
অবস্থায় তারা বিমানবাহিনীর নিকট অনুরােধ জানিয়েছিল; অবশ্য এটি নিশ্চিত নয় যে, বিমানবাহিনীর নিকট নৌবাহিনীর সেই অনুরােধ আদৌ পূর্ব পাকিস্তান বিমানবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে পৌছেছিল কি না। কারণ, এমনকি একজন ডিউটি অফিসার পর্যন্তও কোনাে প্রকার যােগাযােগ করেনি। আমরা এই দ্বন্দ্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিনি। আমরা অনুভব করেছি যে, এ ধরনের আক্রমণ সম্ভবপর ছিল না। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ভারতীয় জাহাজের দূরত্ব এত বেশি ছিল যে, আমাদের যুদ্ধ বিমানগুলাের জ্বালানি ধারণ ক্ষমতায় তা কুলাত না। তারা এমন অবস্থানে ছিল না। নৌবাহিনীর মনােভাব অন্যদিকে এমন ছিল যে, তারপরও, যেহেতু জাহাজে পর্যন্ত জ্বালানি ছিল এবং যুদ্ধবিমানগুলাে জাহাজটি পর্যন্ত পৌছবার মতাে জ্বালানি ধারণ করতে পারত, তাই পাইলট সেখানে অবতরণ করতে পারত। এমন হলে তারা ভারতীয় জাহাজ ভিকরান্ট-এর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করতে পারত। অবশ্য বলা যায়, এমনটি সম্ভব ছিল। এমনকি সেজন্য আত্মঘাতি মিশনও উপযুক্ত হতে পারত। কিন্তু তারপরও নৌবাহিনীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চূড়ান্ত মন্তব্যে বলা যায় যে, ভিকরান্ট ছিল একটি যুদ্ধ বিমানবাহী জাহাজ। এজন্য এর গুরুত্ব ছিল অন্য রকম। তাই তারা আগেই আঁচ করতে সক্ষম হতাে এবং আমাদের বিমানের বিরুদ্ধে তারা সকল প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সক্ষম হতাে। এমতাবস্থায়, আমরা মনে করি, নৌবাহিনীর প্রস্তাবটি বাস্তবসম্মত এবং প্রয়ােগযােগ্য ছিল না। তাই এজন্য বিমানবাহিনীকে অভিযুক্ত করা যায় না যে, কোনাে তারা আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়নি।
১৩। বিমানবাহিনীর বেলায় প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা এখন আলােচনা করতে পারি । নজিরগুলাে কিছুটা পরস্পর বিরােধী। কিন্তু আমরা সন্তুষ্ট নই যে, প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা বিমানবাহিনীতে পুরােপুরিভাবে বা সর্বোচ্চ মাত্রায় বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়েছিল। এই প্রশ্নটি নিয়ে সাধারণভাবে আমরা আমাদের এই সম্পূরক প্রতিবেদনে আত্মসমর্পণের অংশে আলােচনা করেছি। আমরা বলেছি জেনারেল নিয়াজী নিজে স্বীকার করেছেন যে, ঢাকা এবং চট্টগ্রামকে বিবেচনায় নিয়ে সেই মতাে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন; যাতে করে সে ধরনের ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা না হয়, যা কি না হৈ চৈ বাধিয়ে ফেলতে পারে। স্পষ্টত ঢাকাকে এই প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়ার অর্থ হলাে এর ভিতর বিমানবাহিনীও ছিল। এটি স্মরণযােগ্য যে, জেনারেল নিয়াজীর বিকৃত উদ্দেশ্য ছিল । যদি এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয় তা হলে কার্যত তা কোন সতর্কতা থেকে বিরত রাখে এবং যখন আমরা এয়ার কমডাের এনামুল হককে জিজ্ঞাসা করি কার জন্য সতর্কতা বাদ দেওয়া হয়। তিনি উত্তর দেন : “আমি তা জানি না। হয়তাে আমাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি অথবা বিহারিদের জন্য। আমি সত্যিকারভাবে জানি না তিনি কাদেরকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন বিমানগুলাে উড়িয়ে দেওয়ার বদলে বিমানের উপর হামানদিস্তা (হ্যামার) এবং কুড়াল দ্বারা আঘাত করা হয়। এ কাজটি সেরে ফেলা হয় ১৫ তারিখে এবং বিমানগুলাের সকল ধ্বংসযােগ্য অংশ ধ্বংস করা হয় । বৈদ্যুতিক তার সংযােগও কেটে দেওয়া হয়। আমি ভারতীয় খবরের কাগজ থেকে জানতে পারিনি যে, তারা উড়াল দিয়েছে। পাকিস্তানে ফিরে আমি জানতে পারলাম
২০৯
এবং আমি বিশ্বাস করি দুই অথবা তিনটি এয়ারক্রাফ্ট সন্নিবিষ্ট করা হয়। তারা কখনাে সেই এয়ারক্রাফট উড্ডয়ন করেননি।”
১৪। আমরা সন্তুষ্ট নই যে, শুধুমাত্র হামানদিস্তা এবং কুঠার দ্বারা এয়ারক্রাফ্টকে অকেজো করা হয়। কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, যেকোনােভাবে এগুলােকে ক্ষগ্রিস্ত করা হয়। আমরা মনে করি, সেই ক্ষতি এমন পরিমাণে ছিল যা মেরামতযােগ্য।
১৫। এয়ার কমডাের অস্বীকার করেন যে, বাংলাদেশ ওই এয়ারক্রাক্টগুলাে ব্যবহার করেছে। কিন্তু গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ কিছুটা বিপরীত মত প্রকাশ করেন। তিনি যদিও বলেন এয়ারক্রাক্টগুলাে লৌহদণ্ড এবং হামানদিস্তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় কিন্তু শত্রুরা অবশ্যই ৩ থেকে ৪টি পুনরায় মেরামত করে । আত্মসমর্পণের পর তিনি সেগুলাে দেখেছেন।
১৬। যেভাবেই হােক, আমরা এ বিষয়ে বুঝতে অক্ষম যে, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে কোনাে পাইলটদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এজন্য বলা হয়েছিল এয়ারক্রাক্টগুলাে আর উড্ডয়নযােগ্য ছিল না। সে সময়ে এয়ারক্রাফ্টগুলাে ধ্বংস করা জ্ঞানােচিত কাজ ছিল না। এ কাজের জন্য এয়ার কমডাের এনামুল হক। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের নিকট থেকে কোনাে নির্দেশ অথবা অনুমতি পাওয়ার প্রয়ােজন বােধ করেননি। পাইলটদের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণের ক্ষেত্রেও এমনিটি ছিল । লে. কর্নেল মােহাম্মদ আফজাল উদ্দীপনা উদ্যোগকারী কিছু ধারণা দিয়েছিল। প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। আর সে বিষয়টি নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বলেন একটি গুজব রয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পদাদি ভাগাভাগির একটি আপস আলােচনা হয়েছিল।
১৭। বিমানবাহিনীর কোনাে সদস্যই এরূপ সাক্ষ্য দেননি যে, প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার বাতিল করেছিলেন (অবশ্যই আকস্মিক অভিযান দ্বারা ধ্বংসের বাইরে)। কিন্তু ক্যাপ্টেন মজিদ বলেন যদিও এয়ার কমডাের এনামুল হক খান রণসজ্জা কর্মকর্তা এবং রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, যে স্থানটির কথা বলা হয়েছিল সে স্থানটি ছিল বিমানবন্দর সংলগ্ন । তিনি সেই নির্দেশ প্রত্যাহার করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। যদিও, মনে হয় তিনি পুনরায় সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৮। গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ বেগ অন্যান্য স্থাপনা সম্পর্কে বলেছেন যে, সেগুলাে ধ্বংস করা হবে না-কি অক্ষত অবস্থায় হস্তান্তর করা হবে; সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
১৯। একমাত্র সাক্ষী, যিনি বিমানবাহিনী সম্পর্কিত প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা নিয়ে বলেছেন, যদিও তিনি নিজে বিমানবাহিনীর লােক ছিলেন না, ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা, যার কথা আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি, লেফ, কর্নেল মােহাম্মদ আফজাল। তিনি তার কাজের ধরনের জন্যই বিমানবন্দরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। তাঁর মতে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন তিনি আত্মসমর্পণের খবর শুনতে পেলেন, তখন তিনি জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি কি ভারতীয় বিমানে আগুন দেবেন। কেননা, গ্রুপ ক্যাপ্টেন মজিদ বেগ তাঁকে সেরকম কিছু না করতে বলেছেন। তারা যদি আক্রমণাত্মক রূপ নিয়ে আসেন তাহলে আমরা প্রকাশিত হবাে। সে কারণে আত্মসমর্পণের দিন তিনি গােলাবারুদ ও বন্দুকগুলাে ধ্বংস করেননি। তারপর তিনি নির্দেশ নিশ্চিত করেন যে, তিনি নির্দেশপত্র পান যেখানে
২১০
উল্লেখ ছিল যন্ত্রপাতিগুলাে ধ্বংস না করে অক্ষত অবস্থায় হস্তান্তর করতে হবে : এজন্য অন্যান্য স্থানেও আমরা নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছি।
২০। এই বিষয়ে আরও কিছু বলা যায়, তা হলাে লে. কর্নেল দাবি করেন যে, তিনি আংশিকভাবে বন্দুকগুলাে ধ্বংস করেছিলেন। এজন্য তিনি বন্দুকগুলাের কলকজা এবং অভ্যন্তরীণ কায়দাকৌশল বিকল করে দেন। তাই এটিকে আংশিক ধ্বংস বলে গণ্য করা যায়। তিনি বলেন : “আমরা সেগুলাের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিই। সেগুলাে আর উৎপাদনযােগ্য থাকল না। সেগুলাের মধ্যে ছিল চীনা বন্দুক । ভারতীয়দের চীনা বন্দুক ছিল না, তাই তারা আর সেগুলাে উৎপাদনের যােগ্যতা রাখল না। সেই দৃষ্টিশক্তিগুলাে ছিল স্বয়ংক্রিয়। এই অংশ ব্যতীত সেই বন্দুক দিয়ে গুলি ছােড়া সম্ভব ছিল না।”
২১। এ ধরনের দাবির বিষয়ে আমরা কিছুটা সন্দেহ প্রবণ হয়ে পড়ি। তাকে বলি চীনা যন্ত্রপাতি আসলে রুশ যন্ত্রপাতির কপি (ডুপ্লিকেট)। সুতরাং রুশীয়রা অতি সহজেই এর ঘাটতি মিটাবার জন্য ফায়ারিং পিন দেবে এবং সেভাবে বন্দুকগুলাে পুনরায় কাজ করতে পারবে।
২২। আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের অংশে আমরা বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছি যে, কীভাবে আমাদের মতে, কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড আত্মসমর্পণের আগের সময়ে উত্তমভাবে যুদ্ধ করার ইচ্ছাশক্তি এবং আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং সে অবস্থায় তাঁর কমান্ডক্ষমতা ছিল নিচু পর্যায়ের যা স্বভাবতই অন্যান্যদের সংক্রমিত করেছিল। যদিও বিমানবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে তার কমান্ডের আওতাধীন ছিল না, কিন্তু তারপরও আমরা মনে না করে পারছি না যে, এর প্রভাব বিমানবাহিনীর ওপরও বর্তিয়েছিল। যদিও এটি বলা খুবই নির্দয় যে, বিমানবাহিনী যুদ্ধ করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছিল। তবে এটি অতিরঞ্জিত হবে না, যদি বলা হয়, তাদের পক্ষে যা করার ছিল তা তারা করে ফেলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের পরে তাদের আর কিছু করা সম্ভবও ছিল না। সেই তারিখে পাইলটদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাই এর ইতিবাচক প্রমাণ।
২৩। ভারতীয় আক্রমণের প্রকোপে যদিও বিমানবাহিনীকে অনুড্ডয়ন (গ্রাউনডেড) করা হয়েছিল, তারপরও বলা যায়, বিমানবাহিনী কৃতিত্বের সাথেই কর্তব্য পালন করেছিল। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর, বিমানবাহিনী কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করে। মােটের ওপর তারা ভারতের ১১টি এয়ারক্রাফ্ট ধ্বংস করেছিল । (অন্য ১৭টি অ্যাক অ্যাক (ACK ACK) বন্দুক দ্বারা ভূপাতিত করা হয়েছিল। তাই সর্বোপরি আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি, যদিও ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের আগে তাদের কার্যক্রম ছিল প্রশংসনীয়, কিন্তু তার পরের দিনগুলােতে তাদের কাজকর্ম ছিল হতাশাজনক।
২১১

৪৯
ভূমিকা/উপক্রমণিকা

এই সম্পূরক প্রতিবেদনের অন্যত্র আমরা পূর্ব পাকিস্তানে কমান্ডে থাকা অবস্থায় জেনারেল নিয়াজীর পেশাগত মর্যাদার অবস্থান যথাযথভাবে উল্লেখ করেছি। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন্ অবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে আত্মসমর্পণের পরিস্থিতির চরম ঘটনা ঘটিয়েছিল তা-ও বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনের এই পর্যায়ে এসে আমরা আগে যা উল্লেখ করেছি তার পুনরুক্তি করতে চাই না। অবশ্য সেই বিষয়টি এখন আমরা বলব, যে বিষয়টি পটভূমি হিসেবে বিবেচিত হবে। আত্মসমর্পণের প্রশ্নে আরও একটি বিষয় বিবেচনার যােগ্য তা হলাে সামরিক শাসন চলাকালীন সেই সময়ে ঢাকায় সৈন্যসামন্ত, গােলাবারুদ, খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়ােজনীয় রসদ ও সরঞ্জামাদির প্রাপ্যতা। এটিও আমরা পুনরায় উল্লেখ করতে ইচ্ছুক নই। কিন্তু আত্মসমর্পণের আবশ্যকীয়তার দিকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য অতিসংক্ষেপে বিষয়টি উল্লেখ করার দরকার বােধ করছি।
সংকেত (সিগন্যালের) পারম্পর্য কোন্ কোন্ কারণে এবং কীভাবে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর তারিখ হতে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলাে এবং সেই যুদ্ধ আত্মসমর্পণের তারিখ পর্যন্ত চলমান থাকল তা আমরা এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব। এ উদ্দেশ্যে ঐ সময়কালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংকেত (সিগন্যাল) আদান-প্রদানের ঘটনাগুলাে থেকে বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত করা হবে। কেননা এভাবেই ঘটনাসমূহের পরিপূর্ণ চিত্র অর্জন করা যাবে বলে আমরা মনে করি।
১। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর জি-১১০৪ নং সংযুক্ত সংশ্লিষ্ট প্রথম সিগন্যাল কমান্ডার চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ-এর নিকট থেকে দেওয়া হয় : “সিজিএস এর সিওএসডি থেকে বলা হচ্ছে (.) এক (.) বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইতােমধ্যে অবশ্যই আপনারা জেনে গিয়েছেন যে ভারতীয়রা পরিপূর্ণ শক্তিসহ বিদ্রোহীদের নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে (.) যশাের, বুরুংগামারী, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার শহরতলী এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে () ভারতীয়রা যশাের বিমান ক্ষেত্রে মধ্যম মানের গােলা নিক্ষেপ করেছে (.) এ ধরনের চাপের মুখে নিজস্ব রাজাকারেরা বিস্ফোরকের সাহায্যে সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে এবং তাদের নিজস্ব বাহিনীর বিরুদ্ধে ওত পেতে রয়েছে (.) দুই (.) অতিরিক্ত পদাতিক বাহিনী দেওয়ার জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি (.) আরও গােলন্দাজ বাহিনী সরবরাহ করলে তা অভিনন্দনযােগ্য হতে পারত, কিন্তু আপনার সীমাবদ্ধতা পরিপূর্ণভাবে বােধগম্য (.) তিন () সকল ধরনের কর্মসূচি অত্যন্ত মন্থর গতিতে নড়াচড়া করছে (.) সময় কিন্তু আমাদের বিপক্ষে (.) যুদ্ধের সময় যেমন জরুরি ভিত্তিতে সবকিছু সম্পন্ন করা হয় তেমনি সেনাবাহিনী চলাচলে সেরকম গতি আনার জন্য অনুরােধ জানানাে হলাে (.) নতুনভাবে বাহিনী বাড়ানাে সময় সাপেক্ষ; সে কারণে বাহিনী প্রেরণের কাজ ইতােমধ্যে বৃদ্ধি করা হয়েছে (.) যেহেতু পরিপূর্ণভাবে ডিভিশন সৈন্য সরবরাহ করা
২১২
হচ্ছে না, সেহেতু আরও দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন সরবরাহ করে তা দশ ব্যাটালিয়নে উন্নীতকরণ, স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক, একটি বিডিইএইচকিউ একান্তভাবে প্রয়ােজনীয় হয়ে উঠেছে এবং তা যথাশীঘ্র সম্ভব ছাড় দেওয়ার জন্য বিবেচনা করতে বলা হলাে (.) অনুরােধ নিশ্চিত করা হলাে।”
২। এটি দৃশ্যমান হবে যে, প্রারম্ভিক সময় থেকেই কমান্ডার কর্তৃক আবেদন আটকে দেওয়া ছিল খুবই দুঃখজনক। অবশ্য পরবর্তী সিগন্যালের প্রতি আচরণ ছিল আরও বেশি পরিমাণে দুঃখভারাক্রান্ত। এ ধরনের প্রতিচ্ছবি জানানাে হয়েছিল যে, বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে এবং সেহেতু আরও দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য চাওয়া হয়েছিল। এজন্য বাড়তি ৮ এর জন্য ইতােমধ্যে প্রতিশ্রুতিও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।
৩। সিগন্যাল সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড থেকে সেই অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে কোন প্রকার উত্তর দেওয়া হয়েছিল এমন নজীর আমরা পাইনি। রেকর্ড অনুযায়ী পরবর্তী ২২ নভেম্বর নং জি-১০৮৬ তে চী অব স্টাফ কমান্ডার তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, “শত্রুপক্ষ ভূমি এবং সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। সে কারণে তার নিকট থেকে চট্টগ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য এলাকা থেকে সৈন্য চট্টগ্রামে সমাবেশ করার অনুরােধ জানানাে হয়।”
৪। ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর কমান্ডার নিম্নলিখিত ভাষায় সিগন্যাল প্রেরণ করেন :
“জি-০৮৬৬(.) সিওএনএফডি (.) কমান্ডার ইন চীফ এর জন্য সিওএসডি (.) জি০২২১, ২৭ অক্টোবর (.) অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আপনার সুবিবেচনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানাচ্ছি যে, ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে আমি এবং আমরা সকলেই খুবই প্রীতিমুগ্ধ হবাে আমাদের মৌল কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়ার জন্য (.) বাস্তবিকভাবে সুগভীর ও আন্তরিকতাপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ওপর নির্ভরতার জন্য (.) আমরা ধন্য। তথাপিও আপনাকে পুনঃনিশ্চিত করার জন্য উল্লেখ করছি আমাদের প্রাণপ্রিয় পাকিস্তানের জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ, বাহিনীর সকলেরই নৈতিক সাহস, যথাযথ গড়ন এবং যেকোনাে প্রকার ত্যাগ স্বীকার করার মতাে পর্যাপ্ত ও চূড়ান্তভাবে অনুপ্রাণিত আত্মশক্তি, হিংসা উদ্রেককারী স্বার্থহীন সম্মানবােধ, সততা এবং সংহতিসহ আমরা প্রস্তুত রয়েছি (.) ইতিহাসের এই সংকটময় সন্ধিক্ষণে আমি সকল সৈনিকের পক্ষ থেকে আত্মউৎসর্গের বিষয়টি পুনর্ব্যক্তপূর্বক জানাচ্ছি যে, শেষবারের মতাে হিন্দুস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা সর্বোচ্চ পরিমাণে প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের পবিত্র ভূমির ওপর তাদের শয়তানী নজর উপড়ে ফেলা হবে। সেজন্য প্রয়ােজনবােধে উন্মুক্ত আগ্রাসনমূলক আক্রমণ অথবা অন্য কোনাে পথ বেছে নেওয়া হবে (.) আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা এবং আপনার সদয় নেতৃত্ব আমাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবােজ্জ্বল ও ফলপ্রসূ ভূমিকা ইনশাল্লাহ পরিপূর্ণভাবে পুনর্জাগরিত হবে। আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ ঐতিহ্য। আমরা এই সুযােগে সমুন্নত করবই।” । এটি উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হবে যে, এই পর্যায়ে কমান্ডার কেবলমাত্র লড়াইয়ে লড়বার মতাে বলিষ্ঠ মনােভাবই ব্যক্ত করেনি সেইসঙ্গে হিন্দুস্তানকে শেষ শিক্ষা দেওয়ার মতাে সুদৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এবং অনাগত সময়কে একটি “সুবর্ণ সুযােগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
৫। আমরা ইতােমধ্যে বলেছি যে, ভারতের উন্মুক্ত আক্রমণের মনােভাব এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের বিষয়টি কেবলমাত্র সম্ভাবনা বা অনুমানের মধ্যে ছিল না। একটি পরিষ্কার
২১৩
ধারণার মাধ্যমে কমান্ডার বহু আগেই এ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তথাপিও ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বার্তা নং জি-০৮৮৮ এর মাধ্যমে চীফ অব স্টাফ এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিলেন :
“কমান্ডার, চীফ অব স্টাফের তরফ হতে এটি অনন্য বিষয় () নজীর হতে এখন পরিষ্কার যে, গােয়েন্দা প্রতিবেদনসহ জানা যায় ভারত স্বল্পকালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণাত্মক আঘাত হানতে যাচ্ছে (.) এর অর্থ দাঁড়ায় সামগ্রিক বা সর্বাত্মক যুদ্ধ (.) অতএব, আপনার মনে রাখার জন্য এমন একটি সময় এসেছে যে এখন আপনার অভিযান (অপারেশন) কার্যক্রম শুরু করার জন্য আপনি সৈন্য মােতায়েন করতে পারেন (.) এই কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থাৎ সেনা মােতায়েন এমনভাবে করা দরকার যাতে করে কৌশলগত অঞ্চলসমূহ বিবেচিত হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক এবং চাতুর্যপূর্ণ গুরুত্ব আমাদের ইস্টার্ন কমান্ডের কর্মকাণ্ডের প্রচারণার মধ্যে প্রকাশমান হােক (.) উত্তম কাজ।”
একটি পরিষ্কার নির্দেশনা (কমান্ড), দেখা যায় কমান্ডার সমীপে প্রদান করা হয়েছিল যাতে করে তিনি অবস্থা অনুযায়ী তার বাহিনীর সমাবেশ ঘটান- যা হবে তার অভিযান (অপারেশন) কার্যক্রমের সমগামী। এই বার্তার মাধ্যমে বাস্তবিকভাবে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত অঞ্চলের রাজনৈতিক ও চাতুর্যপূর্ণ গুরুত্ব বিবেচিত হবে বলে প্রত্যাশিত ছিল। আমরা মনে করি, অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁকে যথার্থ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, যা তিনি প্রয়ােজনবােধে ব্যবহার করবেন। এটি পরবর্তীতে আরও পরিষ্কার করে দেওয়া হয়।
৬। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর বার্তা নং জি-০২৩৫ এর দ্বারা পুনরায় চীফ অব স্টাফ কমান্ডারকে জানান যে, চীফ অব স্টাফের কাছ থেকে কমান্ডারের জন্য ব্যক্তিগত নির্দেশ (.) শত্রুপক্ষ আপনার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির কাজটি এগিয়ে নিচ্ছে এবং মনে করা হচ্ছে এটি তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে আনবে (.) তারা যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তান দখল করার প্রচেষ্টা চালাবেন। এবং তারপর অধিকাংশ সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানকে মােকাবিলা করার জন্য সেখানে পাঠাবেন () এটি তাকে কিছুতেই করতে দেওয়া হবে না (.)। কিছু ভূখণ্ড বেদখল হওয়াটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহ যাতে রক্ষা করা সম্ভব হয় সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সৈন্য সেভাবে ব্যবহার করবেন (.) চীনের কার্যক্রম অতি সন্নিকটে শুরু হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। আপনার সৌভাগ্য কামনা করছি। এই গুরুতর খারাপ পরিস্থিতির মােকাবিলা করতে আপনার তাৎপর্যপূর্ণ কাজ প্রত্যাশিত (.) আল্লাহ আপনার প্রতি সদয় হােন।” এটি নজরের মধ্যে আনা প্রয়ােজন যে, যেকোনােভাবে যদিও আগে ভূখণ্ডের প্রশ্নে গুরুত্বের বিষয়টি ছিল গৌণ কিন্তু প্রধানতম বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সুরক্ষা । কেননা শত্রুদের লক্ষ্য হলাে ক্রমাগতভাবে ভূখণ্ডের কিছু অংশ দখল করে; সর্বশেষ লক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখলে নিয়ে এসে আধিপত্য বিস্তার করা। সে কারণে কোনােক্রমেই ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান যাতে দখল করতে না পারে সে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জিএইচকিউ এর কার্যপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এই সংকটকালীন সময়ে ছিল খুবই অবাস্তব এবং বলা চলে সেখানে তার কোনােপ্রকার ভিত্তিও ছিল না। অতি নিকটবর্তী সময়ে চীনা তৎপরতা আরম্ভ হওয়ার বিষয়টি খারিজ হয়ে যায়। সেখানে আমরা দেখতে পেলাম এই পর্যায়ে সর্বত্র জিএইচকিউ অস্পষ্ট এবং
২১৪
প্রতারণামূলকভাবে বিদেশি সাহায্যের অঙ্গীকার করতে থাকে। আমরা কুৎসা রটনার মতাে করে বলছি না যে, জেনারেল নিয়াজীর দায়িত্বের অংশ বিশেষ করে আমরা যখন বলি, জিএইচকিউ সেইসঙ্গে তাঁর নিজের দায়িত্বের অংশের দ্বারা প্রত্যাশার এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে তা বাস্তবে পূরণ হওয়ার মতাে ছিল না।
৭। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সিগন্যাল নং জি-১২৩৩ এর উত্তরে কমান্ডার বলেন, এমওডিটিই বিশেষ সিট্রিপ (Sitrep) ৪ (.) সাধারণ মতামত (.) এক (.) ৩ ডিসেম্বর থেকেই সর্বাত্মক বৈরিতাপূর্ণ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের কর্মকাণ্ডের মাত্রা এবং গুরুত্বের ভার ইস্টার্ন ফ্রন্টে আক্রমণাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায় () শত্রুপক্ষের শক্তি ৮ ডিভিশনে উন্নীত হয়েছে। এর সমর্থনে ছিল ৪টি ট্যাঙ্ক বহর। নিয়ােজিত ছিল অতিরিক্ত ৩৯ ব্যাটালিয়ন সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী। ৬০-৭০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিদ্রোহী; যারা ছিল তখন পরিপূর্ণভাবে নিবেদিতপ্রাণসম্পন্ন (.) তদুপরি শত্রুদের ছিল বিমান দ্বারা আক্রমণের শক্তি (১) ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যাপক ধ্বংসলীলা সম্পন্ন করে (.) তারা রকেট এবং নাপাম দ্বারা আক্রমণের শক্তি জোরদার করে (.) অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে অবস্থানরত বিদ্রোহীরা উচ্চমাত্রায় কার্যক্ষম হয়ে ওঠে। তারা অধিকাংশ যাতায়াত পথে বাধা-বিপত্তির মাধ্যমে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয় (.) এর মধ্যে ছিল রাস্তাঘাট/সেতু/কালভার্ট/রেলপথের ফেরি/নৌকা ইত্যাদি (.) স্থানীয় জনসাধারণও সেইসঙ্গে আমার বিরুদ্ধে (.) যােগাযােগ ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতার কারণে সৈন্যসংখ্যা প্রেরণপূর্বক শক্তি বৃদ্ধি অথবা শূন্যস্থান পূরণ করা অথবা অবস্থানের পুনর্বিন্যাস করার কাজ অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে (.) চট্টগ্রাম প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সেভাবে সেখানেও যােগাযােগ-রাস্তা বঞ্চিত হয়ে যায় (.) অধিকন্তু ভারতীয় নৌবাহিনী সাংঘাতিকভাবে সমুদ্র বন্দরকে ভয়ভীতির দিকে ঠেলে দেয়। তারা কার্যকরভাবে বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে নদীপথের অ্যাপ্রােচসমূহের ওপর (.) দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর এবং যশাের তীব্র চাপের মুখে পড়ে যায় (.) অবস্থা নিদারুণভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে (.) দুই (.) আমাদের নিজস্ব বাহিনী ইতােমধ্যে নয়মাস ব্যাপী সক্রিয়ভাবে অপারেশন কার্যক্রমের মধ্যে ছিল এবং এখন তারা তীব্র যুদ্ধের মধ্যে পড়ে যায় (.) সুস্পষ্টভাবে বলা যায় তাদের কোনাে প্রকার বিশ্রাম বা পরিত্রাণ ছিল না (.) ধৈর্যহীন ১৭ দিনব্যাপী যুদ্ধে আমাদের সৈন্য ও বস্তুগত হানি পরিষ্কারভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল (.) ট্যাঙ্ক, গােলন্দাজ এবং বিমান সমর্থন ছাড়া চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধ বাস্তবে পরিস্থিতিকে পুনরায় শােচনীয় করে তােলে (.) রাজাকার/মুজাহিদিনের অস্ত্রসহ স্বপক্ষ ত্যাগের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছিল (.) তথাপিও আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে আমাদের বাহিনী শত্রুপক্ষকে যথেষ্ট ঘায়েল ও হতাহত করে এবং তাদের উল্লেখযােগ্য ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হয় (.) যুদ্ধক্ষেত্রে সে কারণে শত্রুপক্ষকে তাদের সাফল্যের জন্য প্রচুর মূল্য গুণতে হয়েছিল (.) তিন (.) পূর্ব পরিকল্পিত প্রতিরক্ষামূলক ধারার ওপর ভিত্তি করে আমাদের কার্যক্রম একটি পর্যায়ে পৌঁছেছিল (.) আর তা ছিল দুর্গ/শক্ত ঘাঁটি ভিত্তিক (.) শত্রুপক্ষ যুদ্ধের যাবতীয় প্রথাসিদ্ধ পদ্ধতিতে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ পরিচালনা করে এমনভাবে যাকে বলা যায় শেষ ব্যক্তির শেষ রাউন্ড (.) চার (১) কার্যক্রম জোরদার করার জন্য আপনার অনুরােধ যথা জি-০২৩৫, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিবেচিত হয়।”
২১৫
৮। এটি হলাে পরিস্থিতির প্রকৃত এবং বিস্তারিত চালচিত্র। এবং পরিষ্কারভাবে এখন যে চিত্র উপস্থাপিত হয় সেটি হতাশাব্যাঞ্জক। অবস্থা উত্তরণের পথ আছে, কিন্তু যদিও তা আমাদের কাছে যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয় না। এ ধরনের ভাষ্য, যেমন উদাহরণস্বরূপ, সেখানে ১৭ দিনব্যাপী ধৈর্যহীন যুদ্ধে হতাহতের যে কথা বলা হয়েছে। তা কিন্তু বাস্তব তথ্য দ্বারা কোনাে প্রকার সমর্থন পায় না। তাছাড়া শত্রুপক্ষের হতাহতের যে কথা বলা হয়, তাও পর্যাপ্ত বলে গণ্য হয় না। বার্তাটির সর্বশেষ শব্দটি খুবই গুরুত্ববহ। কিন্তু আক্রমণ জোরদার করার প্রত্যয় ছিল প্রকৃত প্রস্তাবে চীনের তৎপরতা।
৯। একই দিনের বেপরােয়া বার্তায় (নং জি-১২৩৪) কমান্ডার চীফ অব স্টাফকে সংকেত দেন প্রত্যাশিত সাহায্য (চীনের তৎপরতা) কখন আসতে পারে ।
১০। পরবর্তী সংকেত বার্তাটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর কর্তৃক প্রেসিডেন্ট বরাবর প্রেরণকৃত। এটি উদ্ধৃত করার আগে কোন্ পরিস্থিতি ও বাস্তবতা উক্ত বার্তা প্রেরণের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে তার বর্ণনা দেওয়া প্রয়ােজন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ বিষয়ে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর উদ্ধৃতি তুলে ধরা মূল্যবান বলে মনে করা যায় : “৬ ডিসেম্বর রাতেরবেলায়, গভর্নর মালেক আমার কাছে পরিস্থিতি জানতে চান। কারণ তিনি প্রদেশের সকল এলাকা থেকে উত্তেজনাকর খবর-বার্তা পেয়ে আসছিলেন। আমি এইচকিউ পরিদর্শন করে জেনারেল নিয়াজীর কাছ থেকে। সরাসরি (প্রত্যক্ষভাবে) পরিস্থিতি সম্পর্কে সারসংক্ষেপ জানার জন্য উপদেশ দিলাম এবং তিনি তা করেছিলেন। অর্থাৎ জেনারেল নিয়াজী তাঁর কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে সারসংক্ষেপ বর্ণনা করেছিলেন। আমি গভর্নরের সঙ্গে সেখানে যাইনি। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে আমি কর্পস হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসার পরে সকালবেলা গভর্নরকে সারসংক্ষেপ জানাই। গভর্নর আমাকে যানবাহনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলেন যাতে করে মন্ত্রীরা নিজ নিজ এলাকায় চলে গিয়ে জনমত গঠন করতে পারেন। তিনি বলেন যে, জেনারেল তাঁকে বলেছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে এবং কর্পস কর্তৃক মন্ত্রীদের জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে (অথচ সেখানে মাত্র ৪/৫টি হেলিকপ্টার ছিল)। আমি গভর্নরকে জানালাম যে, গতকাল হতে পরিস্থিতি সম্ভবত বদলে গিয়েছে, তার উচিত হবে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে পুনরায় বৈঠক করা। সেমত জেনারেল নিয়াজী এসেছিলেন। তাঁর অবস্থা ছিল শােচনীয়, চেহারায় ছিল দুঃশ্চিন্তা ও অদ্রিার ছাপ- অর্থাৎ তার রাত কেটেছে নিঘুমে। প্রধান সচিব জনাব মােজাফফর হােসাইনও এ সময়ে উপস্থিত হন। জেনারেল নিয়াজী । উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করতে থাকেন, তবে গভর্নর সে সময় খুব কমই কথা বলেছিলেন। আমি বাহক (বেয়ারাকে) বাইরে চলে যেতে বললাম। গভর্নর তাঁর চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন তাকে স্পর্শ করলেন এবং কিছু সান্ত্বনাবাক্য উচ্চারণ করলেন। আমিও কিছু কথা যুক্ত করলাম। বললাম, আপনার সম্পদ ছিল সীমিত। সুতরাং এটি আপনার কোনাে দোষ নয়, ইত্যাদি। তিনি স্বাভাবিক হলে পর আমরা পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করলাম। গভর্নর শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতির সমাধান করার কথা বললেন। এই অধিবেশন সমাপ্তির পরে আমি জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। তিনি উর্দুতে বললেন। সম্ভবত গভর্নর হাউজে বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে। আমি অনুভব করলাম
২১৬
কমান্ডারের নৈতিক শক্তি ও মান-সম্মান বজায় রাখার জন্য সৈন্যদের কাজ করা উচিত।”
১১। এই সভার বিষয়বস্তু প্রধান সচিব মােজাফফর হােসাইন দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানান।
১২। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ গভর্নর যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন (নং এ-৬৯০৫) তা হলাে :
“পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের জন্য (.) ধরে নেওয়া যায় আপনি পূর্ব পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত আছেন () আমি জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে আলােচনা করেছি তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, আমাদের বাহিনী বীরােচিতভাবে খুব খারাপ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তবে তাদের জন্য পর্যাপ্ত গােলন্দাজ বাহিনী ও বিমান-সমর্থন নেই (.) বিদ্রোহীরা তাদের পশ্চাতের অংশ বন্ধ করে দিচ্ছে, যন্ত্রপাতি নষ্ট করে দিচ্ছে। তারা সংখ্যায়ও অধিক পরিমাণে আছে। যন্ত্রপাতির ঘাটতি পূরণযােগ্য অবস্থায় নেই (.) পূর্ব এবং পশ্চিমাংশের সম্মুখভাগ পতনের পর্যায়ে চলে গিয়েছে () মেঘনা নদীর পূর্ব দিকের করিডােরের পতন ঠেকানাে সম্ভব হচ্ছে না () ইতােমধ্যে যশােরের পতন ঘটেছে যা পাকিস্তানদরদিদের ওপর একটি বড়াে ধরনের আঘাত (.) বেসামরিক প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়েছে যােগাযােগ প্রক্রিয়াবিহীনতার কারণে (.) খাদ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহে চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কিছুই আনা সম্ভব হচ্ছে না। প্রদেশের অন্যত্র থেকেও সরবরাহ আনবার উপায় নেই (.) এমনকি আগামী ৭ দিন পরে ঢাকা শহরে খাদ্য থাকবে না (.) জ্বালানি এবং তেল না থাকার দরুন জীবনযাত্রা পঙ্গু হয়ে পড়েছে (.) আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক। সেনাবাহিনী সরে আসবার পরে সে সব স্থানে বিদ্রোহীরা হাজার হাজার পাকিস্তানপন্থিদের জবাই করছে (.) মিলিয়ন পরিমাণ অ-বাঙালি এবং পাকিস্তানের প্রতি অনুগতরা মৃত্যুর দিন গুনছে (.) বিশ্বশক্তির কেউই এ নিয়ে কোনােকিছু উচ্চারণ করছে না বা সাহায্যের জন্য বা আক্রমণের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে এগিয়ে আসছে না (.) যদি আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ প্রত্যাশিতভাবে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে তবে পরবর্তী ৪৮; পুনরায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার ফলাফল দেখা যাবে (.) যদি প্রত্যাশিত তেমন কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে, তবে আমি আপনাকে মিনতি করে বলছি মীমাংসামূলক আলােচনার ব্যবস্থা নিন এবং সুসভ্য ও শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করার ভিতর দিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের জীবন বাঁচান এবং অব্যক্ত দুঃখ-দুর্দশা হতে রক্ষা করুন (.) এটি হবে একটি বড়াে রকমের উৎসর্গ, কেননা এছাড়া গত্যন্তর নেই (.) যদি সাহায্য আসে তাহলে আমরা মরণপণ হয়ে লড়ব, তার ফলাফল যাই হােক না কেনাে (.) অনুরােধটি জানানাে হলাে।” এটি অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, এই বার্তার মাধ্যমে নির্মম প্রতিচ্ছবির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এই বর্ণনা যে সত্যবিবর্জিত তা আমরা বলতে পারছি না। ঢাকা শহরে ৭ দিন পরে আর কোনাে খাদ্য থাকবে না- এমন বক্তব্য অসদৃশ । কেননা জেনারেল নিয়াজী খাদ্যসামগ্রী ভালােই মজুত করেছিলেন। জেনারেল নিয়াজী ভাবতেন সম্ভবত সেনাবাহিনী নিয়ে; অন্যদিকে গভর্নর সামগ্রিকভাবে ঢাকার অবস্থা নিয়ে ভেবেছিলেন। এটিও সত্য যে, এই বার্তায় এমন আবেদন ছিল যখন অত্যাবশ্যকীয়ভাবে শেষ পর্যায় আসবে তখন উৎসর্গ করতে হবে। তবে আত্মসমপর্ণের অনুমতি এতে চাওয়া হয়নি। যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা হলাে
২১৭
রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা গ্রহণের প্রচেষ্টা পরিচালনা করা। অবশ্য সুসভ্যভাবে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে হস্তান্তরের কাজ করা। জেনারেল নিয়াজী দাবি করেন, এই বার্তাটি তার সঙ্গে ঐকমত্য ছাড়াই প্রেরিত হয়েছিল। কিন্তু এর সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছি না। প্রামাণ্য সত্য হলাে এই যে, বার্তাটি তাঁকে দেখানাে হয়েছিল এবং যেভাবেই হােক আমরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে অপারক যে ডা. মালেক তাঁর বার্তাটি এভাবেই আরম্ভ করেছিলেন যে, জেনারেল নিয়াজী বলেছেন তিনি পর্যাপ্ত গােলন্দাজ এবং বিমানবাহিনীর সমর্থন ব্যতীত অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। সামরিক বাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে বার্তায় যা বলা যায় সে বিষয়ে তিনি অকপটে বলেছেন। সেসব কিছু তিনি জেনারেল নিয়াজীর বক্তব্যের ওপর নির্ভর করেই বলেছেন।
১৩। একই দিনে চীফ অব স্টাফ তাঁর বার্তা নং জি-০৯০৮ এ কমান্ডারকে জানান যে, তার বার্তা নং-১২৩৪ তে (যা উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে) চীনের সাহায্যের যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তা এখন বিবেচনাধীন পর্যায়ে রয়েছে।
১৪। একই দিনে চীফ অব জেনারেল স্টাফ তাঁর বার্তা নং জি-০৯০৭ এ জানান : “চী অব জেনারেল স্টাফ এর কমান্ডার থেকে বলছি () আপনার ৬ ডিসেম্বরের বার্তা নং জি-১২৩৩ এর সূত্র উল্লেখ করছি () অবস্থা ও পরিস্থিতি বর্ণনার ধারা পরিপূর্ণভাবে প্রশংসামুখর। একটি ব্যতিক্রমধর্মী যুদ্ধ পরিচালনা আমাদের গর্বের বিষয় () আপনার কৌশলগত ধারণা অনুমােদন করা হলাে (.) ভূখণ্ডের বিষয়টি মাথায় না রেখে কৌশলগত শক্তি ধরে রাখুন। চট্টগ্রামের প্রতি বিশেষভাবে সৈন্য অক্ষত রাখতে চেষ্টা করুন; যথাসম্ভব সৈন্য ও বস্তুগত সামগ্রী শক্রর প্রতি তাক করুন।”
“আপনার কৌশলগত ধারণা অনুমােদিত”- এর ওপর ভিত্তি করে জেনারেল নিয়াজী তাঁর “কৌশলগত দিক অনুমােদিত হিসেবে ভিত্তি অর্জন করেন।” এই সূত্রটি অবশ্য বাস্তবিকভাবে কমান্ডারের ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নং জি-১২৩৩ এর বার্তা (সংকেতে) থেকে উদ্ধৃত করা। এতে বলা হয়, “পূর্বনির্ধারিত প্রতিরক্ষা লাইনে পৌছে যেতে থাকুন।” এর দ্বারা বুঝানাে হয়নি যে, “অনুমােদিত” । কিন্তু ধরে নেওয়া যায় এটির দ্বারা পূর্ব পরিকল্পিত লাইন হতে প্রত্যাহারের গ্রহণযােগ্যতা অর্জিত হয়েছে।
১৫। প্রেসিডেন্ট একই দিনে গভর্নরের কাছে বার্তা প্রেরণ করেন, নং এ-৪৫৫৫। এটি ছিল গভর্নর কর্তৃক প্রেরিত বার্তার প্রতি সাড়া দান। এটিও আগে বর্ণিত (নং এ৬৯০৫)। বার্তায় উল্লেখ করা হয় : “রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে গভর্নরের প্রতি (.) এক (১) ৭ ডিসেম্বরের প্রেরিত আপনার সংকেতটির সূত্র ধরে বলছি (.) সম্ভাব্য সকল প্রকারের পদক্ষেপই হস্তগত (.) পূর্ণমাত্রায় এবং তিক্ত যুদ্ধ পশ্চিম রণাঙ্গনে চলছে (.) বিশ্ব-শক্তিসমূহ যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা আপ্রাণভাবে এগিয়ে নিচ্ছে (.) নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার উপর্যুপরি ভেটো প্রদানের পরও বিষয়টি সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হচ্ছে (.) নিউইয়র্কে একটি শক্তিশালী দল পাঠানাে হয়েছে (১) অনুগ্রহপূর্বক মনে রাখবেন; যে সাংঘাতিক পরিস্থিতির মধ্যে আপনি নিপতিত হয়েছেন তা উত্রাবার জন্য আমি জীবিত আছি (.) চীফ অব স্টাফ আমার দ্বারা নির্দেশিত হয়ে জেনারেল নিয়াজীর সামরিক কৌশলাদি দেখভাল করছেন (.) আপনি এবং আপনার সরকার সুদৃঢ় এবং শক্তিশালী পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রীর রেশনিং ঠিক
২১৮
রাখবেন এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবেন। যাতে করে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলেও যেন এক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি না হয় (.) আপনার জন্য বিদায় সম্ভাষণ থাকল (.) আমরা সবাই প্রার্থনা করছি (.)”। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এই ধরনের বার্তার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়; এটি পরিপূর্ণ হলেও এতে যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল তা ছিল অস্পষ্ট। তিনি তার হস্তগত যাবতীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেছিলেন এবং বিশ্ব-শক্তিসমূহ যে সাংঘাতিকভাবে যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করে চলেছে তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি জাতিসংঘে প্রচেষ্টার বিষয়টিও জানিয়েছেন এবং খাদ্য-রেশনিং এর উপদেশ দিয়েছেন।
১৬। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর কমান্ডারের প্রতি চী অব স্টাফ দুটি বার্তা দেন; নং জি-০৯১০ এবং জি-০৯১২। এ দুটি বার্তা উদ্ধৃত করা অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে করা যায়। কিন্তু এতে মনে করা যায় লে: জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক বারংবার প্রকৃত ভূখণ্ড ক্রমাগত গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হচ্ছিল।
১৭। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সে সময়ে কিছু সংকটাপন্ন অবস্থা উৎসারিত সংকেত বিনিময় হয়েছিল। প্রথমটি ছিল নং জি-১২৫৫; চীফ অব স্টাফের প্রতি কমান্ডারের সংকেত বার্তা। এটি ছিল নিম্নরূপ :
“কমান্ডারের নিকট থেকে চীফ অব জেনারেল স্টাফের প্রতি () এক (১) পুনঃগােষ্ঠীবদ্ধকরণ সম্ভব নয়, কেননা শত্রুপক্ষ আকাশে আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে (.) জনসাধারণ সাংঘাতিকভাবে ক্ষেপে গিয়েছে এবং তারা শত্রুদের প্রতি সর্বপ্রকার সাহায্য সহযােগিতা দিচ্ছে (.) রাতের বেলায় কোনাে প্রকার চলাচল সম্ভব নয়, কারণ বিদ্রোহরীরা ওত পেতে থাকছে (.) বিদ্রোহীরা। শত্রুদের পথ দেখিয়ে কৌশলগত অবস্থানে নিয়ে আসছে (.) বিমানপথ চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গত তিনদিন কোনাে ‘মিশন’ চালানাে সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও তা সম্ভব হবে না (.) সমস্ত জেটি, ফেরিসমূহ এবং নৌযান শত্রুপক্ষ বিমান আক্রমণ দ্বারা ধ্বংস করে দিয়েছে () সেতু, কালভার্ট বিদ্রোহীরা ধ্বংস করে দেওয়ার দরুন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। (১) দুই (.) শত্রুপক্ষের বিমান হামলার কারণে অস্ত্রশস্ত্র এবং যন্ত্রপাতির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে (.) আমাদের সেনাবাহিনী উত্তমভাবেই যুদ্ধ করছে; যদিও তারা নিদারুণ চাপে আছেন এবং এখন তারা বলছেন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে () গত ২০ দিন তাদের চোখে ঘুম নেই (.) তারা সদাসর্বদা গােলাগুলি, বিমান হামলা, গােলা এবং ট্যাঙ্কের মুখখামুখি ও আক্রমণের মধ্যে রয়েছে () তিন (.) অবস্থা খুবই সাংঘাতিক, আমরা আমাদের সাধ্যমত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি () এখানে কিছু বিষয়ে অনুরােধ জানানাে যাচ্ছে, যথা (১) এই যুদ্ধমঞ্চে শত্রুদের প্রতি অনতিবিলম্বে বিমান আক্রমণ পরিচালনা করা হােক (.) ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিমান শক্তি জোরদার করা হােক।”
আমাদের মতে এই স্বাধীন ও দূরবর্তী যুদ্ধমঞ্চ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কোনাে আশাহত বার্তা কমান্ডারের নিকট হতে সর্বোচ্চ কমান্ডারের কাছে প্রেরণ করা হয়নি। এই বার্তার মধ্যে সকল ক্ষেত্রেই হতাশাব্যাঞ্জক অবস্থা এবং অসহায়ত্বের পরিস্থিতি বিবৃত হয়েছে। “আমরা সাধ্যমত যুদ্ধ করে চলেছি”, কমান্ডারের নিকট থেকে এই ধরনের বার্তা প্রদানের পরও আমরা মনে করি আত্মসমর্পণের মতাে
২১৯
পরিস্থিতিতে এ ধরনের বার্তা আশ্চর্যজনক বৈ কিছু নয়। ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিমানবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে দেওয়া আবেদনটি ছিল অবাস্তবতাপ্রসূত। কমান্ডার ভালােভাবেই জানতেন যদি সেই ধরনের বাহিনী থাকতও তারপরও তা ঢাকায় প্রেরণ করা সম্ভবপর ছিল না। ঢাকা বিমানবন্দর আর ব্যবহার উপযােগী অবস্থায় ছিল না। এবং কমান্ডার নিজেই শত্রুদের বিমান হামলার কথা উল্লেখ করেছেন। এমতাবস্থায় কমান্ডার তার আবেদন যে খুব সাংঘাতিকভাবে নিগৃহীত হবে; এটি মনে করেননি। আমরা ধরে নিচ্ছি এ ধরনের বার্তার মাধ্যমে যে অনুরােধ জানানাে হয়েছে তা প্রকৃত প্রস্তাবে সেই উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত ছিল। যার মাধ্যমে কমান্ডার নিজের দোষ ধামাচাপা দিতে পারেন।
১৮। একই দিনে নয় ঘণ্টা পরে, পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে আলােচনা করেই গভর্নর প্রেসিডেন্টের কাছে সংকেত প্রেরণ করেন, নং এ৪৬৬৬, যা নিম্নরূপ : “এ-৪৬৬০, ০৯১৮০০ () প্রেসিডেন্টের জন্য (.) সামরিক অবস্থা বেপরােয়া (,) শত্রুবাহিনী পশ্চিম দিক থেকে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে কুমিল্লা ও লাকসামে অবস্থিত আমাদের বাহিনী পাশ কাটিয়ে তারা মেঘনা নদীর কাছাকাছি এসে গিয়েছে () চাঁদপুর শত্রুবাহিনীর দখলে চলে গিয়েছে- সেজন্য নদীপথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে (.) যদি এখানে বাইরে থেকে কোনাে প্রকার সাহায্য না আসে তাহলে শক্ররা যেকোনাে দিন ঢাকার প্রান্তসীমার মধ্যে ঢুকে পড়বে (.) ঢাকাস্থ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি প্রস্তাব করেছেন ঢাকা শহরকে মুক্ত রাখতে যাতে করে বেসামরিক নাগরিক, বিশেষ করে অ-বাঙালিদের জীবন রক্ষা করা যায় () আমি | ঘােষণাটি গ্রহণের জন্য রাজি আছি () এটি অনুমােদন করার জন্য জোর সুপারিশ রাখছি (.) জেনারেল নিয়াজী এটি অনুমােদনের পক্ষে নন, কেননা তিনি শেষ সময় অবধি যুদ্ধ করে যেতে ইচ্ছুক। এতে করে ঢাকা বেদখল হয়ে যাবে (.) এর ফলে সমগ্র সেনাবাহিনী বিধ্বংস হয়ে যাবে, পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ এবং সমগ্র অ-স্থানীয় এবং আঞ্চলিক অনুগতরা বিপদের মুখে পড়বেন (.) এখানে সংরক্ষিত অবস্থায় আর কোনাে নিয়মিত বাহিনী অবশিষ্ট নেই। যদি শত্রুবাহিনী একবার গঙ্গা নদী এবং মেঘনা নদী অতিক্রম করতে পারে তাহলে চীন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ব্যতীত আমাদের বাহিনীর পক্ষে তাদের প্রতিরােধ করা অসম্ভব (.) পুনরায় আপনাকে যুদ্ধ বিরতি এবং রাজনৈতিক মীমাংসা স্থাপনের জন্য অনুরােধ জানাচ্ছি। অন্যথায় ভারতীয় বাহিনী কদিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তভাবে এসে যাবে। এতে করে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিরােধ শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়বে (.) বােধগম্য যে আঞ্চলিক লােকেরা বিপুলভাবে ভারতীয় বাহিনীকে স্বাগত জানাচ্ছে। তারা ভূখণ্ড দখলে নিয়ে নিচ্ছে এবং ভারতীয় বাহিনীকে সকল প্রকার সহযােগিতা দিয়ে যাচ্ছে (.) বিদ্রোহীদের তৎপরতার কারণে আমাদের বাহিনী প্রত্যাহার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, (.) এই অবস্থায় পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তান উৎসর্গ করা হবে অর্থহীন।”
১৯। প্রেসিডেন্ট অতিশীঘ্র সংকেত নং জি ০০০১ দ্বারা উত্তর দেন, যা নিম্নরূপ : “প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে গভর্নরের প্রতি এবং পুনরায় কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড (.) আপনার বার্তা নং এ-৪৬৬০, ডিসেম্বর ৯ প্রাপ্ত হয়েছি এবং আদ্যপ্রান্ত বুঝতে পেরেছি (.) আমার কাছে আপনি সিদ্ধান্ত বিষয়ে যে অনুমতি চেয়েছেন তা অনুমােদিত () আমি আন্তর্জাতিকভাবে সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য
২২০
অনবরত কথা বলে চলেছি; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানজনিত কারণে যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে সেজন্য আমি সকল প্রকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আপনার সুচিন্তিত মনােভাবের ও বিচার-বুদ্ধির ওপর ছেড়ে দিচ্ছি (.) আপনি যেকোনাে সিদ্ধান্ত নেবেন আমি তার অনুমােদন দিব এবং সেমত আমি জেনারেল নিয়াজীর নিকট নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি যাতে তিনিও যুগপৎভাবে আপনার নির্দেশ মেনে নেন। এবং সে অনুযায়ী যা কিছু করণীয় তা করে যান (.) অবিবেকোচিতভাবে করা বেসামরিক জনগণের দুঃষ্কর্মের হাত থেকে আমাদের সেনাবাহিনীকে রক্ষার জন্য। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী আপনি এগিয়ে যেতে পারেন এবং তার জন্য যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম আমাদের বিরােধীদের সঙ্গে প্রয়ােগ করতে পারেন।” যেকোনাে দৃষ্টিতে এই নির্দেশটি দেখা হােক না কেন তা উৎসাহউদ্দীপক। পরিষ্কার শব্দের দ্বারা জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন, “আমার কাছে প্রেরিত প্রস্তাবের বিষয়ে আপনি যা কিছু করতে চান তার অনুমতি দেওয়া হলাে।” যদিও তিনি উল্লেখ করেন যে, আন্তর্জাতিকভাবে সকল প্রকারের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তারপরও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে যেকোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গভর্নরের বিচার-বুদ্ধির ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন এবং আগামভাবে সে সকল বিষয়ে অনুমােদন দেওয়ার কথা উল্লেখ করছেন। সেই সঙ্গে তিনি জেনারেল নিয়াজীকে নির্দেশ প্রদান করছেন যাতে করে নিয়াজী তাঁর নির্দেশনা মেনে নেন। প্রেসিডেন্টের এই বার্তা যেখানে গভর্নরকে রাজনৈতিকভাবে মীমাংসায় আসার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বতাে ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে; সেখানে এ নিয়ে কোনাে প্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আসার সুযােগ নেই।
২০। সে অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর বার্তা নং- এ-৭১০৭ দ্বারা গভর্নর তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন । (কিছু ভুলের কারণে দুটি বার্তা নম্বর এক প্রকারের হয়ে গিয়েছে এ-৭১০৭, অন্য আর একটির ক্ষেত্রেও একই নম্বর হয়েছিল, নং জি-০০০২) :
“পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের জন্য (.) আপনার জি-০০০১, ০৯২৩০০ ডিসেম্বর () চূড়ান্ত এবং মারাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়দায়িত্ব আমার ওপর বর্তিয়েছে; আমি সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল সি. পল মার্ক হেনরি-এর কাছে এই নােট আপনার। অনুমােদনের পর প্রেরণ করছি (.) নােটের আরম্ভ (.) পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে সামগ্রিক যুদ্ধ করার কোনাে ইচ্ছা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কখনাে ছিল না (.) কিন্তু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। (.) পাকিস্তান সরকারের সবসময়ই অভিপ্রায় ছিল পূর্ব পাকিস্তান সংক্রান্ত ইস্যুসমূহ রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করা। আর এটি এখনাে অগ্রসরমান (.) সেনাবাহিনী সাংঘাতিক খারাপ পরিস্থিতির মাঝেও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। কিন্তু আরও রক্তপাত এড়াতে এবং নিরাপরাধ মানুষের জীবন রক্ষার্থে আমি নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ উপস্থাপন করছি (.) রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়েই সংকটের জন্ম। হয়েছে। সেজন্য এর পরিসমাপ্তি অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সমাধানের মাধ্যমেই ঘটাতে হবে (.) সে কারণে আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দ্বারা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ডাক দিয়ে ঢাকায় একটি শান্তিপূর্ণ সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি (.) এই কাজের প্রয়ােজনে আমি অনুভব করছি এই কর্তব্যবােধের যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মতানুযায়ী
২২১
অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ করা সম্ভব হয়ে উঠতে পারে (.) সেজন্য আমি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং সেজন্য অনুরােধও জানাচ্ছি (.) এক (.) অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা (.) দুই (.) যথাবিহিত সম্মানের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা (.) তিন (৩) পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সৈনিক-সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী (-) চার (.) ১৯৪৭ সাল হতে পূর্ব পাকিস্তানে যারা বসতি স্থাপন করেছেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা (.) পাঁচ (.) পূর্ব পাকিস্তানে। কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিশােধমূলক তৎপরতা যাতে না হয় তার নিশ্চয়তা বিধান (.) এই প্রস্তাব প্রদানের নিমিত্তে আমি এটি পরিষ্কার করতে চাই যে, এটি সুস্পষ্টভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি নিশ্চিত প্রস্তাব (.) সেনাসদস্যদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি আসে না। এটি বিবেচিত হবে না এবং তা গ্রহণযােগ্যও নয়। সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ব্যক্তিটি যুদ্ধ চালিয়ে যাবে (,) নােটের সমাপ্তি (.) জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে আলােচনা হয়েছে এবং আপনার কমান্ড তিনি নিজেই জানিয়েছেন।”
২১। তারপর আমরা ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের দিনটিতে পৌছলাম। সেই দিনটিতে জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক প্রেরিত বলে অভিযােগপ্রাপ্ত এবং সকলের জানা। বার্তাটি প্রকাশিত হয়। এটি (বার্তাটি) জাতিসংঘের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি । মি. পল মার্ক হেনরিকে প্রদান করা হয়। এ বিষয়টি কেউই অস্বীকার করেন না যে, ঐ বার্তাটি জাতিসংঘে আমাদের অবস্থানের ওপর বিপর্যয়কারী ফলাফল হিসেবে কাজ করেছিল। সেই সময় ভাবা হয়েছিল এবং নিশ্চিতভাবে আমরা যখন আমাদের মূল ও প্রধান প্রতিবেদন লিখেছিলাম তখন মনে করেছিলাম জেনারেল রাও ফরমান আলী দৃশ্যত নিজেই এটি ইস্যু করেছেন। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পেরেছি বিষয়টি সত্য। নয়। তিনি গভর্নরের নির্দেশ মােতাবেক কাজ করেছিলেন। এবং জেনারেল নিয়াজীরও এতে সম্মতি ছিল। তার নিজের ভাষায় এবং আমাদের কাছে যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ও প্রতীয়মান হয়েছে তা নিম্নরূপ :
“৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, জাতিসংঘে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মি. পল মার্ক হেনরি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেন। আমি তাদের স্বাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলাম না। সভা শেষে এবং টেলিফোনে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পরে তিনি সংকেত নং এ-৪৬৬০, ০৯১৮০০ সময়ে তৈরি করেন (প্রেরণ করেন)। এর একটি প্রতিলিপি (কপি) সংযুক্তি ‘সি’তে দেওয়া হলাে । মূল সুপারিশগুলাে ছিল : ‘পুনরায় আবারও আপনার কাছে। যুক্তিসহকারে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিকভাবে মীমাংসার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য বলা হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের জবাব (নিমে সংযুক্তি ‘সি’) রাতের বেলায় পাওয়া গিয়েছিল। গভর্নর এবং প্রধান সচিব এটি নিয়ে আলােচনা করেন। এটি উপস্থাপন করা হয়নি। তারা এই মর্মে উপসংহারে উপনীত হন যে, দায়-দায়িত্ব এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিষয়টি গভর্নরের ঘাড়ে পড়বে। আমি এখানে যুক্ত করতে পারি যুদ্ধারম্ভের আগে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠিত হয়েছিল; যে কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে সিদ্ধান্ত দেবে; এমন সময়ে যখন কি না পরিস্থিতির প্রকোপে ঢাকার সঙ্গে
২২২
কেন্দ্রের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এই কমিটি গঠিত হয়েছিল গভর্নর, অর্থমন্ত্রী ও জেনারেল নিয়াজীকে নিয়ে এবং আমি ছিলাম এ কমিটির সদস্য সচিব।” প্রধান সচিব একটি সংকেতের খসড়া প্রস্তুত করেন (সংযুক্তি ‘ডি’)। এটি প্রেসিডেন্টের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং জাতিসংঘের জেনারেল সেক্রেটারিকে এর একটি কপি দেওয়া হয়েছিল। (খসড়াটিতে পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, এটি একটি বেসামরিক ধরনের বার্তা)। গভর্নর এই খসড়াটি নিয়াজীর কাছে নিয়ে যেতে বলেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপের প্রস্তাবের জন্য অনুমতি আনতে বলেন। আমি প্রধান সচিবকে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল নিয়াজীর কাছে যাই। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল জামশেদ এবং অ্যাডমিরাল শরীফ। জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতি লেখা প্রস্তাবগুলাে পাঠ করলে পর জেনারেল জামশেদ ছিলেন প্রধান ব্যক্তি যিনি এটির প্রশংসাসূচক সাড়া দিয়ে বলেন, “এটিই উত্তম। এটিই এখন একমাত্র পথ যা সামনে খােলা রয়েছে।” জেনারেল। শরীফও এটি অনুমােদনের পক্ষে কথা বলেন। জেনারেল নিয়াজী বলেন কোন্ ক্ষমতাবলে তিনি এতে লেখা প্রস্তাবগুলাে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনুমােদন করবেন। প্রধান সচিব বলেন, “উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আপনি অনুমােদন দেবেন।” তিনি তাঁর অনুমতি দেন। এরপর আমি গভর্নর হাউজে ফিরে আসি। আমি গভর্নর এবং মি. পল মার্ক হেনরিকে আমার অফিসে দেখতে পাই (আমি আমার আগের প্রতিবেদনে বলেছিলাম যে সেখানে প্রধান সচিবও উপস্থিত ছিলেন। এটি সম্ভবত, ছিল স্মৃতিভ্রমাত্মক। প্রধান সচিব এখন আমাকে বলছেন যে, যদিও তিনি গভর্নর হাউজে আসার বিষয়ে মি. মার্ক হেনরিকে যােগার করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন না)। গভর্নর বার্তাটির একটি প্রতিলিপি মি. হেনরিকে হস্তান্তর করতে বলেন এবং আমি তা করেছিলাম। বার্তাটিতে আমার স্বাক্ষর প্রদান করতে হয়, কারণ এটি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেওয়া হয়। মি. হেনরি বলেন, “এটি মি. আগা শাহী এবং সেক্রেটারি জেনারেলের মধ্যে আলােচিত হবে। যদি মি. আগা শাহী এর অনুমােদন দেন তখন এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করার পর্যায়ে আসবে।” এ কথা সত্য যে, এই বিবৃতিটি ছিল প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের কাউন্টার’ কার্যক্রমসম্বলিত । কিন্তু এর দ্বারা যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা আমাদের কমিশনের দ্বারা প্রস্তুতকৃত মূল প্রতিবেদনে আলােচনা করেছি।
২২। যদিও এ বার্তাটি ছিল ১০ তারিখের, এতে লেখা ছিল “আমি আপনার অনুমতি সাপেক্ষে এই নােটটি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মি. পল মার্ক হেনরির নিকট হস্তান্তর করতে যাচ্ছি, কিন্তু বাস্তবে ৯ তারিখে এটি হস্তান্তর করা হয়েছিল । পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যে, গভর্নর কার্যত জেনারেল ফরমান আলীকে। নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে বার্তাটির তলিপি (ডিটেট) নিজেই প্রদান করেছিলেন।
২২৩
২৩। মি. পল হেনরির নিকট হস্তান্তরিত নােটের এই হলাে পূর্ণাঙ্গ ঘটনা। এখন বিষয়টি দিবালােকের মতাে পরিষ্কার যে, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের অনুমােদন নিয়েই নােটটি মি. হেনরির কাছে দিয়েছিলেন। এবং এটিও পরিষ্কারভাবে বােধগম্য যে, গভর্নর প্রেসিডেন্টের পক্ষ হয়ে কাজটি করেছিলেন। আমরা মনে করি সেই সন্ধিক্ষণে এটি ছিল একটি বিজ্ঞচিত কাজ। কেননা, এছাড়া অন্য কোনাে উপায় ছিল না। তাছাড়া গভর্নর যথাযথভাবেই উল্লেখ করেছিলেন যে, এটিকে আত্মসমর্পণ হিসেবে বিবেচনা করার প্রশ্ন আসে না। যদি এই প্রস্তাব গ্রাহ্য করা না হয় তাহলে সৈন্যবাহিনী শেষ অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
২৪। আমরা এই পর্যায়ে ঐ বার্তাটি সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া জেনে আশ্চার্যান্বিত হই । তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া একই তারিখে বার্তা নং জি-০০০২-তে কর্মকর্তার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, যেমন : “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে (.) আপনার হঠাৎ প্রেরিত বার্তা এ-৭১০৭ তারিখ ১০ ডিসেম্বর, পেলাম (.) প্রস্তাবিত বার্তার খসড়াটি আপনার দ্বারা প্রেরিত ও আমার দ্বারা অনুমােদতি উপদেশাবলির থেকেও অনেক কিছু (.) এটির দ্বারা আমার এরূপ মনােভাবের উদয় হয়েছে যে, আপনি পাকিস্তানের তরফ থেকে কথা বলছেন, কেননা, সেখানে রয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজনৈতিক মীমাংসা এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে পুনর্বাসনের মতাে বিষয়াদি (.) এর দ্বারা দৃশ্যত মনে হয়; পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া (.) বিরাজমান সাম্প্রতিক অবস্থায় আপনার এলাকায় আপনার তরফ থেকে খুব সীমিত কিছু করার রয়েছে; যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটানাে সম্ভবপর হতে পারে (.) এমতাবস্থায় এমন একটি খসড়া প্রেরণ করুন যার মাধ্যমে আপনাকে ইস্যুটি সম্পর্কে কর্তৃত্ব করার অধিকার দেওয়া সম্ভব হয় (.) উদ্ধৃত (.) সমুদ্র ও বিমানপথে ভারতের ব্যাপক সংখ্যক সৈন্যসদস্যের দ্বারা সৃষ্ট বাধা-বিপত্তির কারণে এবং অবিজ্ঞচিতভাবে বেসামরিক জনগণের ওপর রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়ার ঘটনা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা নতুন রূপ নিয়েছে (.) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাকে এমন কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন যার বলে আমি আমার সিদ্ধান্তে যেকোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি (.) সে কারণে আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতিশয় নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও বীরােচিতভাবে যুদ্ধ করছে তারপরও আরও রক্তপাত ও প্রাণহানি যাতে না ঘটে সে বিষয়টি মাথায় রেখে আমি নিম্নলিখিতভাবে প্রস্তাব রাখছি (.) এক (.) শত্রুভাবাপন্নতা রােধকল্পে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি করা হােক (.) দুই (.) ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ (.) তিন (.) পূর্ব পাকিস্তানে যাতে কোনাে প্রকারের প্রত্যাঘাতমূলক কাজ না ঘটে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা (.) চার (.) পূর্ব পাকিস্তানে সকল সেনাসদস্যের সুরক্ষাকরণ (.) আমি এ বিষয়টি স্পষ্ট এবং পরিষ্কার করতে চাই যে, এটি হলাে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব; যার মাধ্যমে বৈরিতার অবসান ঘটবে এবং সে অবস্থায় সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করার প্রশ্নটি বিবেচ্য হবে না বা তা উত্থাপিত করারও সুযােগ থাকবে না (.) উদ্ধৃতির সমাপ্তি (.) এই প্রস্তাবের কাঠামাের মধ্যে থেকে আপনি এটির সঙ্গে নতুন কিছু সংযুক্ত অথবা পরিবর্তন করতে পারেন।”
২২৪
জেনারেল ইয়াহিয়াকে ইচ্ছুক বলে মনে হয়। কেননা তিনি তাঁকে (গভর্নরকে) “সকল প্রকার রাজনৈতিক উপায়ের মাধ্যমে কাজ করার জন্য কর্তৃত্ব প্রদান করেছিলেন।
২৫। বাস্তবে সত্যিকারভাবে প্রেসিডেন্ট আগে গভর্নরকে সার্বিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছিলেন। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেই বার্তায় যে বার্তাটি চীফ অব স্টাফ ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর নং জি-০২৩৭ এর মাধ্যমে কমান্ডারের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। এতে উল্লিখিত সময় ও ক্ষণ সুস্পষ্টভাবে প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বার্তার সময় ও ক্ষণ একই, যথা ৭:১০ সন্ধ্যা, যা নিম্নরূপ :
“সেনাবাহিনীর সিওএস-এর প্রতি সিওএমডি (.) গভর্নরের প্রতি প্রেসিডেন্টের সংকেত (সিগন্যাল) বার্তার কপি আপনার নিকট প্রেরিত হলাে () প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে একান্ত শলাপরামর্শের পরে গভর্নরের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার প্রদান করেছেন () যেহেতু কোনাে সংকেতবার্তাই আপনার কাছে সঠিকভাবে যাচ্ছে না, সেহেতু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনাপূর্বক আমি অকুতস্থলের পরিস্থিতি বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আপনার ওপর ন্যস্ত করছি (১) ঘটনাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে সৈনাধিক্য এবং অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান্য ও বিদ্রোহীদের দ্বারা সার্বিক সমর্থনের সুযােগ নিয়ে শত্রুবাহিনী অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। এটি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র (১) ইতােমধ্যে বেসামরিক জনগণ এবং সেনাসদস্যদের প্রভূত ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। মারা গেছে অনেক মানুষ (.) আপনি যুদ্ধের মূল্যের পরিমাপ নির্ধারণ করবেন এবং যদি সম্ভব হয় তবে বেসামরিক ও সামরিক দিক থেকে ক্ষয়ক্ষতির ভার নির্ণয় করতে চেষ্টা করবেন (.) তারপর তা আপনি (এটি) খােলামেলাভাবে উপদেশ আকারে গভর্নরের নিকট পেশ করবেন যাকে প্রেসিডেন্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিমিত্তে ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করেছেন (.) যখন আপনি উপযুক্ত সময় বলে মনে করবেন তখনই অধিকাংশ সামরিক সাজসরঞ্জাম বিনষ্ট করবেন যাতে করে তা শত্রুপক্ষের হাতে পড়তে না পারে (.) সব খবরাখবর আমাকে জানাবেন (.) আল্লাহ্ আপনার সহায় হােন।” এটি প্রতীয়মান হয় যে, চীফ অব স্টাফ পুনঃনিশ্চয়ন করেছেন যে গভর্নরই চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। কেননা প্রেসিডেন্ট তাঁর কাছে সে ধরনের ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করেছেন। আমরা হতভম্ব হওয়ার মতাে অবস্থায় স্বীকার করে নিচ্ছি যে, সুস্পষ্টভাবে প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর চীফ অব স্টাফ-এর দ্বারা গভর্নরকে কর্তৃত্ব দেওয়ার পরও গভর্নরের সিদ্ধান্তের প্রতি অস্বীকৃতির মতাে ঘটনা ব্যাখ্যা করার মতাে নয়।
২৬। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে কমান্ডার চীফ অব স্টাফকে নিম্নলিখিত সংকেতবার্তা প্রেরণ করেন :
“কমান্ডারের নিকট থেকে চীফ অব জেনারেল স্টাফ এর প্রতি (.) অভিযান পরিস্থিতি (.) এক (.) আলফা (.) সকল সেক্টরের ধরনের প্রতি এই কমান্ড চূড়ান্ত চাপের ফলশ্রুতি () ব্রাভাে (,) বাহিনীর ধরনে/অধিকাংশ দুর্গেই প্রাথমিকভাবে শত্রুবাহিনী কর্তৃক নিয়ােজিত চাপ এখন চরম আক্রমণমুখী, তাই আমাদের অবস্থা সম্ভবত তরল হওয়ার মতাে (.) আকাশে শত্রুরা
২২৫
পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ আরােপ করছে এবং তার ফলে তারা স্বাধীনভাবে ইচ্ছামতাে আমাদের যানবাহন ধ্বংস করছে। তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছে (.) ডেল্টা (.) স্থানীয় জনগণ এবং বিদ্রোহীরা যে কেবল বৈরী তাই নয়; সেসঙ্গে তারা আমাদের নিজেদের বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করতে সকল অঞ্চলে তৎপর রয়েছে (.) ইকো (.) নদী ও স্থলভাগের সকল যাতায়াত ও যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে (.) দুই (.) সর্বশেষ সৈনিক দ্বারা সর্বশেষ আঘাত হানার নির্দেশ থাকল, এটি হয়তাে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না, কারণ সৈন্যরা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন (.) যাহােক, এভাবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা অসুবিধাজনক হবে। কেননা, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ শত্রুবাহিনী এবং বিদ্রোহীদের দ্বারা বিনষ্ট করা হচ্ছে। এতে করে যুদ্ধের জন্য ব্যয়ের পরিমাণও বাড়ছে (.) তিন (.) খবর-বার্তা ও উপদেশ প্রদান করার জন্য বলা হলাে।” ধারা মােতাবেক এটি হলাে পুনরায় অবস্থার বর্ণনাতীত পরিস্থিতির বিবরণ । এখন কমান্ডার অবস্থা স্বীকার করে নিয়ে যদিও বলছেন যে সর্বশেষ সৈনিক সর্বশেষ আঘাত হানবেন কিন্তু তিনি আবার “খবর বার্তা এবং উপদেশও চাইছেন।”
২৭। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর, প্রেসিডেন্ট আরও একটি বার্তা গভর্নরের নিকট প্রেরণ করেন (নং জি-০০০২) যা ছিল নিম্নরূপ :
“প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে গভর্নরের প্রতি (.) আপনার প্রতি আমার সর্বশেষ বার্তার কার্যকারিতার বিষয়ে পুনরায় কোনাে প্রকার কার্যক্রম নেবেন না (.) আমাদের বন্ধুদের নিকট হতে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রম আসছে (.) যেকোনাে মূল্যে আমাদের আরও ছত্রিশ ঘণ্টা অবস্থান ধরে রাখতে হবে (.) অনুগ্রহপূর্বক এই বার্তাটি জেনারেল নিয়াজী এবং জেনারেল ফরমানকে পাঠাবেন।”
২৮। ধারণা করা যায় তিনি তাঁর এই বার্তায় উল্লিখিত শেষ বার্তার দ্বারা যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা কার্যকর করা হয়নি। সেখানে তিনি পুনরায় প্রস্তাবের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। গভর্নরের প্রতি তাঁর আগের কর্তৃত্ব প্রদানের প্রতি অস্বীকৃতি যা ইতােমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। ধারণা করার কারণ রয়েছে যে, রাও ফরমান আলীর সূত্র মােতাবেক প্রেসিডেন্ট জানতেন যে, রাও ফরমান আলী নােটটি জাতিসংঘের জেনারেল সেক্রেটারির নিকট হস্তান্তর করেছিলেন। পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘে অবস্থা শুধরে নেওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন। এটি মনে রাখা প্রয়ােজন যে, উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদাশীল জনাব জেড. এ ভুট্টো ইতােমধ্যে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন এবং তার হাত যে শক্তভাবে বাঁধা তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আমাদের মূল প্রতিবেদনে আমরা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছি, তাই এখানে এই পরিসরে এটি আর বিস্তারিত করার ইচ্ছা নেই।
২৯। কমপক্ষে আরও ছত্রিশ ঘণ্টা অবস্থান ধরে রাখার জন্য যে উপদেশ এমনকি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং ১১ ডিসেম্বর তারিখে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল যে আমাদের বন্ধুরা হস্তক্ষেপ করার জন্য আসছেন। এ সম্পর্কে নিম্নলিখিত ভাষায় কমান্ডার চীফ অব স্টাফের প্রতি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন (নং জি-১২৭২) :
২২৬
“চী অব স্টাফের প্রতি কমান্ডারের বার্তা () শত্রুপক্ষ হেলিকপ্টারের সাহায্যে প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য নরসিংদীর দক্ষিণাঞ্চলে ১৬ : ৩০ সময়ে এবং একটি প্যারা ব্রিগেড টাঙ্গাইল এলাকায় অবতরণ করেছে (১) বন্ধুদেরকে অনুরােধ জানাবেন যেন তারা ১২ তারিখে সকালবেলার মধ্যে ঢাকায় বিমানে পৌঁছতে পারেন।”
৩০। চীফ অব স্টাফ এই বার্তাটির কোনাে উত্তর দেননি। তবে আগের বার্তা সংকেত নং জি-০০১১ ও ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর জবাবে কমান্ডারকে নিমলিখিতভাবে জানিয়েছিলেন :
“চীফ অব স্টাফের নিকট থেকে কমান্ডারের প্রতি (.) আপনার (সংকেত) নং জি-১২৭৫ ডিসেম্বর এবং গভর্নরের প্রতি প্রেসিডেন্টের বার্তা, সংকেত নং জি-০০০২ সূত্র ১১০৪৩০ ডিসেম্বর (.) এক (.) আপনার ব্যক্তিগত অবগতির জন্য জানানাে যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর খুব শীঘ্রই অবস্থানে আসছে (.) চীনাদের এনইএফএ ফ্রন্ট শীঘ্রই কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। যদিও সুস্পষ্ট কারণে ভারতীয়রা জানার পরও তা ঘােষণা করছে না (.) দুই (.) যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা রাশিয়া এবং ভারতের উপর তীব্র চাপ প্রয়ােগ করা হয়েছে () এসব কারণে ভারত মরণপণভাবে অতিদ্রুততার সাথে পূর্ব পাকিস্তানে আপনার বিরুদ্ধে সর্বাধিক মাত্রায় শক্তি প্রয়ােগ করছে; যাতে করে তাদের দ্বারা কৃতকর্ম না ফেরানাের পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ আসছে (.) তিন () সুতরাং প্রেসিডেন্টের সংকেত বার্তা নং জি-০০০২ ডিসেম্বর ১১০৪৩০ অভিপ্রায় অনুযায়ী আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলাে অবস্থান ধরে রাখা (.) চার (.) আপনার সাফল্য কামনা করছি।” কীসের ভিত্তিতে চীফ অব স্টাফ জানালেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর শীঘ্রই অবস্থান নিচ্ছে এবং চীনারা এনইএফএ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে; তার কোনাে প্রকার প্রমাণ আমরা এমনকি অনুমানও করতে পারিনি।
৩১। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর বার্তা নং জি-১২৭৭ পঠনের জন্য খুবই উদ্দীপনাময় যা নিম্নরূপ :
“সিওএস এর প্রতি সিওএমডি এর বার্তা () আপনার জি-০০১১ ডিসেম্বর ১১০২৪৫ (সূত্র), এক (.) অবগতির খোজখবর ও সাফল্য কামনার জন্য ধন্যবাদ (.) দুই (.) আগের সংকেত বার্তার দ্বারা নির্দেশিত হয়ে আমি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করেছি তারা যেন তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে সর্বশেষ ব্যক্তিটি সর্বশেষ প্রতিরােধ ও যুদ্ধ চালিয়ে যায়, বিশেষ করে দুর্গ স্থাপনা এলাকায় (.) তিন (৩) অবস্থা নিঃসন্দেহে খুবই শােচনীয়; কিন্তু আমরা ঢাকাকে দুর্গে পরিণত করব এবং রক্ষার করার জন্য মরনপণ লড়ে যাব।” সর্বশেষ ব্যাক্তির দ্বারা সর্বশেষ লড়াই চালিয়ে যাবার প্রসঙ্গে আমরা পূর্ববর্তী সংকেত বার্তায় ইতােমধ্যে তাঁর প্রত্যয় সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু তিনি এখন ঢাকাকে দুর্গে পরিণত করার এবং শেষ অবধি তা রক্ষার জন্য লড়ে যাবার কথা বলেছেন। ১২ ডিসেম্বর এবং তার পরবর্তী সময়ে সংকেতের ভাষা ও। মাত্রার ভিতর হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ সম্ভবত চীফ অব স্টাফ এর সংকেত
২২৭
নং জি-০০১১ ডিসেম্বর ১১, যেখানে বলা হয়েছে, সেইসঙ্গে চীনাদের এনইএফএ কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে এই আশাবাদের মধ্যে নিহিত রয়েছে।
৩২। কমান্ডারের দ্বারা পরবর্তী সংকেত নং জি-১২৭৯ ছিল ১২ ডিসেম্বরে প্রেরিত, যেখানে বলা হয় :
“চীফ অব স্টাফ এর প্রতি কমান্ডারের নিকট থেকে (.) এক (.) আমাদের একজন কর্মকর্তাকে পিডব্লিউতে নিয়ে শত্রুপক্ষ একটি বার্তাসহ তাঁকে কুমিল্লা দুর্গে পাঠিয়ে দেয় (.) উদ্ধৃত, (.) যদি তােমরা সকলেই আত্মসমর্পণ না কর তাহলে আমরা তােমাদের বন্দি করে হত্যার উদ্দেশ্যে মুক্তিফৌজের। হাতে তুলে দিব’ (.) উদ্ধৃতি শেষ () দুই (.) বিষয়টি রেডক্রস কর্তৃপক্ষ এবং ভারতীয় বাহিনীর সি-ইন-সি কে অবিলম্বে অবহিত করা হােক (.) এটি। খুবই সাংঘাতিক বিষয়।” এটি প্রথম চোটেই খুব উদ্দীপনাময় ও দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়। কেননা তা ছিল অশ্রেণিভুক্ত সংকেত। দ্বিতীয়ত, এই সংকেতের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একটি ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে অভিযােগ করা যেখানে বলা হয়েছিল, যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ না করে তাহলে বন্দিদের মুক্তি ফৌজের হাতে হত্যার উদ্দেশ্যে তুলে দেওয়া হবে। আমরা ধারণা করতে পারি এই ধরনের ভয়ভীতি চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছিল। তবে এখানে আমরা বিষয়টি শুধুমাত্র উল্লেখ করলাম এবং এ সম্পর্কে পরবর্তীতে মন্তব্য করা হবে।
৩৩। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বরে কমান্ডার একটি বার্তা প্রেরণ করেন নং জি-১২৮২, তাতে নিম্নলিখিত বিষয় উল্লেখ ছিল :
“এমওডিটিই-এর জন্য (.) বিশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবহিতকরণ নং ৪ (১) এক (.) শত্রুপক্ষ (.) আলফা (.) ম্যাটারাল এসকিউ ৭৩৪৪ সেনানিবাসে বােমাবর্ষণ করছে () শত্রুবাহিনী ম্যাটারাল ৭৩৪৪ এখন ম্যাটারাল ডেমরা আরএল ৫৬২৪ এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে () ব্রাভাে (.) প্যারা-বাহিনীর বিশরিত কর্মকাণ্ড জানার অপেক্ষায় আছি () চার্লি () খবর পাওয়া গিয়েছে শত্রুবাহিনী দাউদকান্দি আরএল ৭৯০৩ এ কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং দুটি হেলিকপ্টার নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণে অবতরণ করেছে, আরএল ৫৭১৩*(.) বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় (.) ডেল্টা (.) ঢাকা দখলের জন্য শক্ররা মরণপণ আক্রমণ হানতে যাচ্ছে (.) দুই (.) ঢাকা দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উত্তমভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং যুদ্ধ করার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তাৎক্ষণিকভাবে যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে সেই অংশ যেখানে বলা হয়েছে ঢাকা দুর্গ সুসংগঠিত এবং কমান্ডার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এখানে এটি উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, হেলিকপ্টার অবতরণের খবরটি ছিল ভুয়া।
৩৪। একইদিনে তিনি আরও একটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন নং জি-১২৮৬, যা ছিল নিম্নরূপ :
“চীফ অব স্টাফ এর কাছে কমান্ডারের পক্ষ থেকে (.) এক (.) আলফা (.) সকল সেক্টরেই দুর্গ নিদারুণ চাপের মধ্যে পড়েছে (.) আমি কেবলমাত্র অয়্যারলেসের মাধ্যমে যােগাযােগ রাখার পর্যায়ে আছি (.) শূন্যস্থান পূরণ
২২৮
করার কোনাে প্রকার অবস্থাও নেই। এমনকি গােলাবারুদও নয় (.) ব্রাভাে (.) ঢাকা ভীষণ চাপের মধ্যে আছে। বিদ্রোহীরা চারদিক থেকে ঢাকা ঘেরাও করে ফেলেছে। তারা আরআরএস এবং মর্টারের সাহয্যে গােলাগুলি ছুড়ছে। তাদের সহায়তায় আছে আইএএফ বাহিনী (-) ভারতীয়রাও এগিয়ে আসছে (.) অবস্থা খুবই বেগতিক ও সাংঘাতিক () দুর্গগুলাের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উত্তম এবং আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি (.) দুই (.) আলফা (.) প্রতিশ্রুত সহযােগিতার বিষয়টি অবশ্যই ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আকার পেতে হবে () ব্রাভাে (.) চীনা এনইএফএ যযাদ্ধাদের কোনাে প্রকার আভাস পরিদৃষ্ট হচ্ছে না (.) এর কার্যকারিতা কেবলমাত্র শিলিগুড়িতে অনুভূত হচ্ছে। শত্রুপক্ষের বিমানক্ষেত্রগুলাে আমাদের চারপাশে তৎপর রয়েছে।”
স্পষ্টত ভয়ানক পরিস্থিতি বিরাজ করার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। চীনা যােদ্ধাদের তৎপরতার কোনাে চিহ্ন না থাকার বিষয় নিয়ে কমান্ডার উদ্বিগ্নতা প্রদর্শন করেছেন। তথাপিও তিনি পুনঃনিশ্চিত করেছেন যে, দুর্গগুলাের প্রতিরক্ষা সুসংগঠিত রয়েছে এবং তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
৩৫। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অবধি সবকিছু আরও কিছু সময় ধরে রাখার ওপর চীফ অব স্টাফ জোর দিয়েছেন, বার্তা নং জি-০০১২, যা নিম্নরূপভাবে পঠিত হয় :
“চীফ অব স্টাফ-এর কাছ থেকে কমান্ডারের প্রতি () সূত্র, আপনার ১৩ ডিসেম্বর তারিখের বার্তা নং জি-১২৮৬ () জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন চলছে এবং খুব সম্ভব সেখান থেকে যুদ্ধ বিরতির ঘােষণা আসবে। (.) এ সকল কিছু জানার পর ভারতীয়রা ঢাকা দখল করার অভিপ্রায়ে যা কিছু করতে হয় তা করে যাচ্ছে এবং জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি সম্পর্কিত রেজুলিউশন অনুমােদিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে () আমরা যতদূর ধারণা করতে পারি এটি এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার (১) জাতিসংঘের রেজুলিউশন অনুমােদিত হওয়া অবধি সময়ে কী করণীয় সে বিষয়ে আমি আপনার কাছে আর নতুন করে যুক্তি দেখাতে চাই না (.) বিষয়টি পুরােপুরিভাবে উপলব্ধি করেই আমি বলছি যে, সবকিছু সাহসীকতার সঙ্গে মােকাবিলা করতে হচ্ছে এবং পরিস্থিতি সাংঘাতিকভাবে বৈরী (.) আল্লাহ্ আপনার সহায় হােন।” বার্তাটির মাধ্যমে ধরে রাখার (টিকে থাকার) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না জাতিসংঘের রেজুলিউশন অনুমােদিত হয়। ধারণা করা হয়েছে, জাতিসংঘের রেজুলিউশনটি এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অনুমােদন অর্জন করবে।
৩৬। দৃশ্যত মনে হয় এই বার্তাটি কমান্ডার কর্তৃক বার্তা নং জি-১২৮৮ এর মাধ্যমে যে ধরনের পরিষ্কার দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল তা এতে অনুপস্থিত। উপরন্তু এই বার্তার ওপর চীফ অব স্টাফ-এর ব্যক্তিগত সচিব একটি সংযুক্তি দেন যা নিম্নরূপ :
“ইস্টার্ণ কমান্ডের কমান্ডারের সঙ্গে কথা হয়েছে, সময় ০৮২৫। কী করতে হবে সে সম্পর্কে তিনি এখন সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। রাশিয়া কর্তৃক ভেটো দেওয়ার পরেও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক চলছে। মনে করা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নিদেনপক্ষে ঢাকার ওপর আধিপত্য ধরে রাখতে হবে।”
২২৯
৩৭। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট গভর্নর এবং জেনারেল নিয়াজীর কাছে বার্তা প্রেরণ করেন নং জি-০০১৩, যেমন-
“প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে গভর্নর এবং জেনারেল নিয়াজীর প্রতি (.) গভর্নরের পূর্ববর্তী বার্তার সূত্র মােতাবেক () অধিকতর বৈরী পরিস্থিতিতেও। আপনি বীরােচিতভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন (.) আপনার এই বীরােচিত কাজের জন্য জাতি গর্বিত এবং বিশ্ব পরিপূর্ণভাবে মুগ্ধ (.) একজন মানুষ হিসেবে যতদূর করা যায়; এই সমস্যা সমাধানকল্পে আমি করে চলেছি () আপনি এমন একটি অবস্থানে এসে ঠেকেছেন সেখান থেকে পুনরায় প্রতিরােধ করা কিংবা তা কোনাে প্রকার কাজে আসার অবস্থায় নেই (.) আপনাকে যা করতে হবে তা হলাে যুদ্ধ বন্ধ করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ও পশ্চিম পাকিস্তানি এবং পাকিস্তানের প্রতি অনুগতদের জীবন বাঁচাতে হবে (.) ইতােমধ্যে আমি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয়দের বৈরিতা বন্ধ করাপূর্বক সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য মানুষের জীবন রক্ষা করা যায়। কেননা তারা সকলেই দুস্কৃতকারীদের লক্ষ্যবস্তু (টার্গেট)।”
এই সংকেত বার্তাটি হলাে ১:৩২, অর্থাৎ এর সময় হলাে ১:৩২ অপরাহ (পশ্চিম পাকিস্তানের সময় অনুযায়ী)। অন্যদিকে ঐ সময়ে ঢাকায় অবস্থানের অন্যান্য সাক্ষীদের সর্বসম্মত মতানুযায়ী দেখা যায়; বার্তাটি দেওয়া হয়েছিল রাতের বেলায়। আমরা মৌলিক উৎস যাচাই করে দেখেছি এবং পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছি বার্তাটিতে উল্লিখিত মূল সময়টি যথার্থ। দুটি সূত্র ও অবস্থার বিবেচনায় এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বার্তাটিতে উল্লিখিত সময় সঠিক। সংকেত নং জি০০১২ যা আমরা উদ্ধৃত করেছি এবং যেখানে কমান্ডারকে বলা হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বসেছে এবং সেজন্য তার প্রতি আহ্বান জানানাে হয়েছে যেন তিনি অবস্থান ধরে রাখেন। এটি ১২:৩৫ এ প্রেরিত হয়েছিল, (পশ্চিম পাকিস্তানের সময়)। কমান্ডারের কাছ থেকে এর ব্যাখ্যা চেয়ে প্রেরিত সংকেত বার্তাটি প্রেরিত হয়েছিল ৮:৪৫ পূর্বাহে (পূর্ব পাকিস্তানের সময়) সেমত পশ্চিম পাকিস্তানের সময় ৭:৪৫ পূর্বাহ্। এই সর্বশেষ বার্তার ভিত্তিতেই ব্যক্তিগত সচিবের সংযুক্তি ছিল যা আমরা উদ্ধৃত করেছি (সি) যেখানে বলা হয়েছে চীফ অব স্টাফ পশ্চিম পাকিস্তানের সময় ৮ : ২৫ পূর্বাহে কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলেছেন। এমতাবস্থায় তথ্য প্রমাণাদী থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সংকেত নং জি-০০১৩ এ উল্লিখিত সময় ১৩৩২ (১ : ৩২ পূর্বাহ্) যথার্থ ও নির্ভুলভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের বা সন্দেহের অবকাশ নেই। তাছাড়া মৌখিক কথার ওপর ভিত্তি করে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা অসম্ভব।”
৩৮। বিভিন্ন প্রকার বার্তার মধ্যে আমাদের বিবেচনায় এটি একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এ কারণে বার্তাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। প্রথমেই বলতে হয় এটি ছিল একটি অ-শ্রেণিকৃত বার্তা। অর্থাৎ এটি প্রেরিত হয়েছিল পরিষ্কারভাবে এবং সেহেতু তা শ্রবণযােগ্যও ছিল। এবং সম্ভবত ভারতীয়রাও এটি শুনতে পেরেছিল, সে সঙ্গে অন্যান্য দেশে থেকে তা শােনা গিয়েছিল। অন্যান্য বিষয়াদির সূত্র না টেনেও বলা যায় এর ফলাফল ছিল বিপর্যয়মূলক। জাতিসংঘের নিরাপত্তা
২৩০
পরিষদ তখন ছিল অধিবেশনে, কিন্তু আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ করে ও গােপনীয়তা রক্ষা না করে আমরা কীভাবে প্রত্যাশা করতে পারি যে, এর দ্বারা আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারব। এমনকি যেসকল দেশ থেকে আমরা সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলাম এ বার্তা শােনার পর তারা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। আর এটাই ছিল এর স্বাভাবিক পরিণতি।
৩৯। উপরন্তু জাতিসংঘে পাকিস্তানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়ার সময়ে আমরা মনে করি, এরপরে জেনারেল মানিকশাে জেনারেল নিয়াজীর ওপর আত্মসমর্পণের জন্য চাপাচাপি করার সুযােগ পেয়ে গিয়েছিলেন। যদিও জেনারেল নিয়াজী নিজেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
৪০। আমরা ভেবে পাই না এবং বুঝতে অক্ষম যে, কীভাবে এই রকমের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা অ-শ্রেণিভুক্তভাবে প্রেরিত হলাে। কর্তব্যরত কর্মকর্তার এবং সংকেত প্রেরণ কেন্দ্রের ভুল হয়ে থাকতে পারে যার জন্য তারা এটি শ্রেণিভুক্ত না হয়েই প্রেরিত হয়। “ক্লিয়ার” শব্দটি যখন ব্যবহৃত হয় তখন এর দ্বারা বুঝা যায় না যে এটিকে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে কি না। যদিও অ-টেকনিক্যাল ভাষায় এর অর্থ পরিষ্কার।
৪১। যেহেতু এই বার্তাটি ছিল অ-শ্রেণিভুক্ত সেহেতু ঢাকায় এ ধরনের একটি ধারণা সৃষ্টি হয় যে, এটি কোনাে প্রকার সঠিক অর্থবহ বার্তা নয় বরং কৌতুক বার্তা। স্বাভাবিকভাবেই সেজন্য কমান্ডার নিশ্চিত হওয়ার জন্য এটি যাচাই করেন যে, এর দ্বারা আত্মসমর্পণ বুঝাতে চাওয়া হচ্ছে কি না।
এ কারণে জেনারেল নিয়াজী দ্বারা প্রস্তুতকৃত নিম্নলিখিত সারাংশ তুলে ধরা যুক্তিযুক্ত :
“এই সংকেতটি অ-শ্রেণিভুক্ত। এজন্য সম্ভবত তা ভারতীয়দের দ্বারা পাকড়াও হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এটি ভারতীয়দের চাতুর্যপূর্ণ পরিকল্পনা। অবশ্য পরে আমি এর যথার্থতা এবং সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উদ্যোগ নিই :
(ক) ভিন্ন দেশে স্বাধীন সেনাবাহিনীর কমান্ডারের মতাে পর্যায়ে থেকে আমি যুদ্ধরত ছিলাম না। আমি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে জিএইচকিউ-এর পরিকল্পনা এবং এর শর্তসমূহ যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চেয়েছি।
(খ) যদি আমি আমার স্বাধীন অবস্থান থেকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মধ্যস্থতা/দরকষাকষি করতাম, তাহলে শক্তির অবস্থানে থেকে তা করা হতাে না। তাহলে তা হয়ে পড়তে আত্মসমর্পণের শামিল। ব্রিগেডিয়ার জানজুয়ার সিওএস-এর অনুরােধ নিশ্চিত করেন যে, এই সংকেতটির অর্থ বুঝাতে চাওয়া হয়েছিল এটি ‘আনক্লাস’। একটি সংকেত সংক্রান্ত এসব চিন্তা-ভাবনার পুনরাবৃত্তির বদলে, আমরা জিএইচকিউ-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম প্রেসিডেন্টের সংকেতের শেষাংশের ব্যাখ্যা জানার জন্য। সেইসঙ্গে আমরা সিওএস/সিজিএস-এর সাথে টেলিফোনে যােগাযােগ করার ব্যবস্থা করি। ১৪ ডিসেম্বর দুপুরের কাছাকাছি অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের সংকেত পাওয়ার ৯ ঘণ্টা পরে আমি সিজিএস, লে. জেনারেল গুল হাসান খানের নাগাল পাই এবং প্রেসিডেন্টের সংকেত সম্পর্কে তাঁকে জানাই।
২৩১
তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কোন্ সংকেত, কোন্ যুদ্ধবিরতি অথবা আত্মসমর্পণ সম্পর্কে কথা বলা হচ্ছে। যখন আমি তাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি তখন তিনি উত্তর দেন তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং যেহেতু প্রেসিডেন্ট এই সংকেত প্রেরণ করেছেন সেহেতু আমি যেন তার সাথেই কথা বলি। এই বলে তিনি উচ্চশব্দে ফোন রেখে দেন।”
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে দিনের প্রারম্ভে, গভর্নর ডা. মালেক প্রেসিডেন্টের নির্দেশ সম্পর্কে আমার সাথে কথা বলেন। তাকে জানাই যে, এ বিষয়ে (সংকেত) আমি জিএইচকিউ-এর নিকট ব্যাখ্যা চেয়েছি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি আছি; না-কি রাজি নই। আমি উত্তর দিই এখনও পর্যন্ত আমার যুদ্ধ চালিয়ে যাবার প্রবল ইচ্ছা আছে। আমি সেই দিন বিকাল বেলা গভর্নরের পদত্যাগের কথা শুনতে পাই এবং জানতে পারি তিনি গভর্নরের ভবন পরিত্যাগ করে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠেছেন। তার সঙ্গে সকল মন্ত্রী, বেসামরিক কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যরা সড়ে গিয়েছেন। তিনি ১৫ ডিসেম্বর তারিখে এ সম্পর্কে আমাকে একটি পত্র দেন যা নিম্নরূপ :
প্রিয় নিয়াজী প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর বর্তিত সংকেত নং জি-০০১৩, তারিখ ১৪/১২/৭১ প্রেরিত নির্দেশ মােতাবেক কোনাে | প্রকার কার্যক্রম আপনার তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে কি না তা কি আমি জানতে পারি। ঐ বার্তাটি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আপনার নিকট এবং গভর্নর হিসেবে আমার নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল। এই বার্তায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল : “আপনি যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল সদস্যের জীবনসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগতদের জীবন ও পাকিস্তানের প্রতি অনুগত সকলের জীবন রক্ষা করবেন।” এই সংকেতে আরও বলা হয়, “আপনি এখন এমন একটি অবস্থানে চলে এসেছেন যেখান থেকে পুনরায় প্রতিরােধ করা মানবীয়ভাবে অসম্ভব, কিংবা সেরূপ কাজের দ্বারা কোনাে কার্যকর ফলাফলও অর্জিত হবে না।” বিরােধাত্মক পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে এবং জীবনহানি ও বিধ্বংস চলছে। আপনাকে প্রয়ােজন মাফিক কিছু করতে অনুরােধ করছি।
আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক,
আপনার বিশ্বস্ত
এ.এস. মালেক
ফোন : ২৫২৯১-১২

৪২। রাওয়ালপিন্ডির জন্য এটি ছিল একটি দুঃখজনক প্রতিফলন। যদিও আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করেছি তবুও, এটি একটি পার্শ্বপ্রদীপ। এমন ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও কমান্ডার তাৎক্ষণিকভাবে চীফ অব স্টাফের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করেননি, প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও নয় । একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে তিনি তাৎক্ষণিক যােগাযােগ করেছিলেন তিনি হলেন ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া। ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া অবশ্য নিশ্চিত করেছিলেন যে,
২৩২
সংকেতটি জেনেশুনেই অ-শ্রেণিভুক্তভাবেই পাঠানাে হয়েছিল। বিকেল অবধি কমান্ডার এমনকি চীফ অব দা জেনারেল স্টাফ এর সঙ্গেও কথা বলেননি। যখন তিনি কথা বলেন তখন তাঁকে জানানাে হয় যে, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের আদেশ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। এটি প্রতীয়মান হচ্ছে না যে কমান্ডার যেকোনাে সময়ে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে পারতেন। সর্বোচ্চ তিনি যা করেছেন তা হলাে তিনি চীফ অব স্টাফের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তিনি তা করেছেন ১৪ ডিসেম্বরের সন্ধ্যার আগে নয়। জেনারেল নিয়াজীর ভাষ্য মতে, তিনি সাদামাটাভাবে বলেছেন, “যেভাবে বলা হয়েছে। সেভাবে কাজ করতে” এবং এয়ার কমান্ডার-ইন-চীফ, এয়ার মার্শাল এম রহিম খানও তাকে উৎসাহিত করেছেন যেন প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মান্য করা হয়।
৪৩। জেনারেল নিয়াজী প্রেসিডেন্টের বার্তার ভাষা এবং পরবর্তী সময়ে রাওয়ালপিন্ডিস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথােপকথনের জের ধরে বলেন এ আদেশ ছিল কার্যত আত্মসমর্পণের আদেশ। যে কারণে আমরা একটু পরেই যে বিষয়টি বিস্তারিত করব তা হলাে আমরা সেভাবে পড়তে অসমর্থ হই। কেননা, আমাদের কাছে এটিও মনে হয়েছে তা যেন আত্মসমর্পণের অনুমতি সংক্রান্ত। অন্যদিকে, অবশ্য আমরা সন্তুষ্ট নই যেভাবে পরস্পরবিরােধী যুক্তি দিয়ে দেখাতে চাওয়া হয়; এটি মােটেও আত্মসমর্পণকে বুঝায় না। এ কারণে, আমরা মনে করি এটি ভাষাগত মারপ্যাচ (দ্ব্যর্থক ভাষায় শব্দের ব্যবহার)। এটি সত্য যে, সত্যিকারভাবে “আত্মসমর্পণ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে আরাে প্রতিরােধ করার প্রচেষ্টা মানবিকভাবে সম্ভবপর নয়। এর অর্থ নিশ্চিতভাবে বুঝায় আত্মসমর্পণ; এর দ্বারা ব্যাখ্যাত হয় যে, আত্মসমর্পণই যথার্থ, তবে প্রয়ােজনবােধে নিঃশর্তভাবে।
৪৪। এর সঙ্গে কিছু সংকেতে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামাদি ধ্বংস করার কথা বলা হয়েছে। তবে এই পর্যায়ে সে বিষয়টি উদ্ধৃত করার প্রয়ােজন বােধ হচ্ছে না।
৪৫। জেনারেল নিয়াজী এটিকে সরাসরি আত্মসমর্পণের নাকি আত্মসমর্পণের অনুমতি সংক্রান্ত তা বুঝে বা না বুঝে আমেরিকান কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে ভারতীয়দের কাছে নিম্নলিখিত শর্তে যুদ্ধবিরতির অনুরােধ জানান :
“(ক) বিবাদমান পক্ষের সেনা-কমান্ডারদের পরস্পর মতৈক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্ধারিত এলাকাসমূহে পুনঃগােষ্ঠীবদ্ধকরণ।
(খ) সামরিক এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা।
(গ) ১৯৪৭ সাল থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে এসে বসবাস করছেন তাদের সকলের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
(ঘ) ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে যারা প্রশাসনকে সহযােগিতা করে এসেছেন। তাদের প্রতি কোনােরূপ প্রত্যাঘাত না করা।”
৪৬। ইতােমধ্যে ভারতীয়রা জেনারেল মানিকশাে-এর নামে জেনারেল রাও ফরমান আলীর প্রতি লিফলেট ছেড়েছেন; যা নিম্নরূপ :
“আমি ইতােমধ্যে আপনার কাছে দুটি বার্তা পাঠিয়েছি; কিন্তু আপনার পক্ষ হতে কোনাে প্রতি উত্তর পাইনি। আমি পুনরুক্তি করছি যে, আপনার পক্ষ থেকে আরও প্রতিরােধ গড়ে তােলা হবে অর্থহীন। এর ফল হবে আপনার কমান্ডের অধীনস্থ দরিদ্র সেনাদের অহেতুক মৃত্যু- যা অপ্রয়ােজনীয়।
২৩৩
আমি পুনর্ব্যক্ত করছি যে, আমাদের তরফ থেকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে (গ্যারান্টি)। জেনেভা সনদ অনুযায়ী আত্মসমর্পণকৃত সকল সেনাসদস্য ও আধাসামরিক ব্যক্তিগণের প্রতি ব্যবহার করা হবে বলে আমি নিশ্চিত করছি। বাংলাদেশের বাহিনী নিয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই। তারা সকলেই আমার কমান্ডের অধীনে রয়েছেন। তদুপরি বাংলাদেশ সরকার জেনেভা সনদ অনুযায়ী আচরণ করার প্রত্যয় ঘােষণা করেছে। আমার অধীনস্ত সেনাবাহিনী ঢাকার নিকটবর্তী এবং চারদিকে ঘিরে রয়েছে এবং আপনার গ্যারিসন আমার কামানের গােলার আওতার মধ্যে রয়েছে। আমি আমার সেনা-সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন সকল বিদেশি নাগরিক এবং এথনিক সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। আমার কমান্ডারদের প্রতি এটি কর্তব্য বলে মনে করছি তারা যাতে করে অযথা রক্তপাত না করেন এবং নিরীহ মানুষের প্রতি আঘাত না করেন। আমি আপনার কাছে পুনরায় আর্জি পেশ করছি যেন আপনি আমাকে পরিপূর্ণ সহযােগিতা দেন- এই মানবিক দায়িত্ব পালনের জন্য সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। আপনি কি আপনার দিক থেকে প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়ার মনস্থির করেছেন- তাহলে আমি শক্তভাবে যুক্তি সহকারে বলতে চাই, যদি তাই হয়; তবে সেক্ষেত্রে আপনি সকল বেসামরিক জনগণ এবং বিদেশি নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবেন যাতে সংঘাতযুক্ত এলাকার বাইরে তারা অবস্থানের সুযােগ পায়। আপনার নিজস্ব বাহিনীর স্বার্থে আমি আশা করছি আপনি আমাকে বাধ্য করবেন না যাতে কি না আমি শক্তি প্রয়ােগ করে আপনার গ্যারিসনের আকার ক্ষুদ্র করতে পারি।”
৪৭। জেনারেল নিয়াজীর প্রস্তাব প্রসঙ্গে জেনারেল মানিকশাে রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে একটি বাণী (বার্তা) নিয়াজীর জন্য প্রেরণ করেন। এর সংক্ষিপ্তসারকথা হলাে এই যে, জেনারেল নিয়াজী একটি নির্দেশ জারি করবেন এই মর্মে যে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করছেন। তার বদলে তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন তাদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা হবে যা জেনেভা সনদে উল্লেখ রয়েছে। এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও নিহতদের সৎকারের ব্যবস্থা। নেওয়া হবে। তিনি সেইসঙ্গে ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে রেডিও সংযােগ স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।
৪৮। বার্তার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে জেনারেল নিয়াজীর প্রস্তাব প্রসঙ্গে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ জেনারেল মানিকশাের উত্তর নিম্নরূপ :
“প্রথমত, নয়াদিল্লিস্থ আমেরিকার দূতাবাসের মাধ্যমে আজ ১৪৩০ সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে আপনার প্রস্তাব পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, ইতঃপূর্বে জেনারেল ফরমান আলীর কাছে দুটি বার্তার মাধ্যমে। জানিয়েছি যে আমি (ক) বাংলাদেশে আপনার সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণকৃত সদস্যদের যাবতীয় নিরাপত্তা বিধান করার পূর্ণ নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) দিচ্ছি। (খ) বিদেশি নাগরিক, এথনিক সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগতদের পরিপূর্ণ সুরক্ষার ভার নিচ্ছি- তারা কী করেছেন তা না জেনেই। যেহেতু আপনি যুদ্ধ থামাবার ইঙ্গিত দিয়েছেন সেহেতু আমি প্রত্যাশা করছি আপনি আপনার কমান্ড থেকে বাংলাদেশে অনতিবিলম্বে
২৩৪
যুদ্ধ বিরতির এবং আত্মসমর্পণের আদেশনামা প্রদান করবেন। তারা আমার অগ্রবর্তী সেনাদলের কাছে যে-যেখানেই থাকুক আত্মসমর্পণ করবেন। তৃতীয়ত, আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে নিশ্চয়তা সহকারে বলছি আপনার সেনাসদস্য ও আধাসামরিক বাহিনীর যারা আত্মসমর্পণ করবেন তাদের প্রতি যথাবিহীত সম্মান ও প্রাপ্য মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা হবে এবং জেনেভা সনদের শর্তসমূহ মেনে চলা হবে। অধিকন্তু, আপনার তরফে অনেকেই আহত হয়েছেন, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তাদের যথাসাধ্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে এবং মৃতদের সত্ত্বার করার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কাউকেই ভীত হতে হবে না। এটি ভাববার বিষয় নয়; তারা কে কোথা থেকে এসেছেন। আমার কমান্ডের অধীনস্ত সৈন্যরা কোনাে প্রকার প্রতিঘাতও করবে না। চতুর্থত, যখনই আমি আপনার কাছ থেকে ইতিবাচক কোনাে খবর পাব তৎক্ষণাৎ আমি ইস্টার্ন থিয়েটারে ভারত ও বাংলাদেশি সৈন্যদের কমান্ডার জেনারেল অরােরাকে বলে দিব যেন বিমান বা ভূমিতে কোনাে প্রকার আক্রমণ আপনার বাহিনীর বিরুদ্ধে না করা হয়। পঞ্চমত, আমার প্রতি উত্তম আস্থার প্রতীক হিসেবে আমি আজ ১৭০০ সময় থেকে ঢাকায় কোনাে প্রকার বিমান হামলা পরিচালনা না করার নির্দেশ দিব। ষষ্ঠত, যাতে করে আলােচনা ও দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু চূড়ান্ত করা সম্ভব হয় সেজন্য আমি ভারতীয় সময় ১৫০০ আজ থেকে রেডিও সংযােগ স্থাপনের ব্যবস্থা করেছি। এর ফ্রিকোয়েন্সি হবে ৬৬০৫ (৬৬০৫) কিলােহর্স (দিনের বেলায়) এবং ৩২১৬ (৩২১৬) কিলােহর্স (রাতের বেলায়)। কল প্রতীক হবে (কলকাতা) এবং (ঢাকা)। আমি আপনার সংকেতদাতাদের প্রতি এটি মনে রেখে মাইক্রোওয়েভে তা সংযুক্ত করতে অনুরােধ জানাচ্ছি (.)।”
৪৯। এটি উল্লেখ করার বিষয় যে, “আত্মসমর্পণ” শব্দটি এই প্রথম ভারতীয় কোনাে বার্তায় ব্যবহৃত হলাে।
৫০। এরপরে (অনুসরণে) ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১, জেনারেল নিয়াজীর কাছে নং জি ০০১৫ সংকেতটি চীফ অব স্টাফ এর কাছ থেকে আসে, যা নিম্নরূপ :
“চীফ অব স্টাফ এর কাছ থেকে কমান্ডারের প্রতি (.) আপনার জি-১৩১০, ডিসেম্বর ১৫২২৩০ সূত্র ধরে (.) প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেরিত আপনার জবাব (উত্তর) আমি দেখেছি। আমি সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক যােগাযােগ মাধ্যমে আপনার প্রস্তাবের বিপরীতে ভারতীয় রেডিও মারফত জেনারেল মানিকশাের জবাব শুনেছি (.) যেহেতু আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আপনার ওপর দিয়েছি সেহেতু আমি উপদেশ দিচ্ছি আপনি ভারতীয় বাহিনীর চীফ অব স্টাফ এর প্রস্তাবের শর্তগুলাে মেনে নেবেন তখন, যখন সেগুলাে আপনার চাহিদা পূরণ করে (.) এটি খাঁটিভাবে একটি আঞ্চলিক সামরিক সিদ্ধান্ত এবং এটি পৃথকভাবে কোনাে রাজনৈতিক ফলাফল বহন করে না (.) পারস্পরিক সিদ্ধান্ত যা আপনি নেবেন তা গ্রহণযােগ্যতা পাবে না যদি কি না সেগুলাে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অমিলসম্পন্ন হয়। জেনারেল নিয়াজী বুঝাতে চান যে, চীফ অব স্টাফ “উপদেশ” এর নামে যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা আসলে অধঃস্তনকে সৌজন্যসূচকভাবে বলা হলেও কার্যত তা “আদেশ” হিসেবেই গণ্য করা হয়। সাধারণভাবে তার
২৩৫
বক্তব্য হয়তাে সত্য হলেও; কিন্তু বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যা নিয়ে আমরা কাজ করছি সেখানে জেনারেল নিয়াজীর দাবি অনুযায়ী আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা মনে করি, তাঁকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল সত্য; কিন্তু তা আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়ার মতাে পর্যায়ে নয়।
৫১। প্রেসিডেন্টকে তাঁর বার্তার উত্তর হিসেবে কমান্ডার কর্তৃক প্রেরিত সংকেতটি এখানে সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে (তারিখ ১৫ ডিসেম্বর) যা নিমরূপ :
“জি-১৩০৫ (.) গােপনীয় () কমান্ডার কর্তৃক প্রেসিডেন্টের জন্য প্রেরিত (.) আপনার সংকেত জি-০০১৩, ১৪ ডিসেম্বর সূত্র (.) আমি আমেরিকার কাউন্সিল জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং এখানে বর্ণিত লেখাগুলাে তাঁকে দিয়েছি (.) উদ্ধৃত (.) এক (.) ঢাকা এবং অন্যান্য বড়াে শহরকে আরও সশস্ত্র সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমি আপনাকে নিমলিখিত শর্তসাপেক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে অনুরােধ জানাচ্ছি (.) আলফা () প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলাের মধ্যে কমান্ডার পর্যায়ে পারস্পরিক মতৈক্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের পুনঃগগাষ্ঠীভুক্তকরণ। ব্রাভাে () সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সকল সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। চার্লি (.) ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সকলের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা। দুই (.) এই সকল শর্তে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সামরিক কার্যক্রম বন্ধ ঘােষণা করবে (.) তিন (.) এর বাইরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আরােপিত অন্যান্য যা কি না বর্তমান বিবাদের স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রণীত হবে তাও মেনে নেওয়া হবে ) চার (.) সামরিক আইন অঞ্চল এর (পূর্ব পাকিস্তান) প্রশাসক হিসেবে এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের ক্ষমতা বলে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব আমি এই অঞ্চলের পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর ওপর চর্চা করার অধিকার রাখি (.) উদ্ধৃতি শেষ (.) উত্তরের জন্য অপেক্ষায়।
৫২। আত্মসমপর্ণের তাৎক্ষণিক আগের সময়ের আনুক্রমিক হিসেবে এটিই ছিল বার্তা বিনিময়ের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত বার্তা।
২৩৬

৫১
জেনারেল নিয়াজী কি আত্মসমর্পণের
আদেশ মানতে বাধ্য ছিলেন?

১। জেনারেল নিয়াজী আমাদের কাছে দাবি করেছেন যে, তিনি আইনগতভাবে আত্মসমর্পণের আদেশ মানতে বাধ্য ছিলেন (তার এ দাবির সঙ্গে আমরা একমত নই)। আমাদের মতে (ধারণাগতভাবে) তিনি আদৌ সেরকম কোনাে আদেশ পেয়েছিলেন কি না। পাকিস্তান সেনা আইনে কোথাও সেরকম কোনাে কথা নেই যে আত্মসমর্পণের জন্য প্রদেয় আদেশ মানতে বা তার ওপর আস্থা রাখতে হবে। এজন্য অনুচ্ছেদ ৩৩ বিবেচনা করা যায় :
“৩৩। আইনগত কমান্ডের প্রতি অবাধ্যতা-
(১) এই আইনের আওতাধীন কেউ যদি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কর্তৃপক্ষের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ করে, তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ন্যায়সংগত আদেশ অমান্য করে এবং তা যদি বিশ্বাস করার মতাে বলে মনে হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে সামরিক আদালত গঠন করা হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে কঠোরভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জন্য, অথবা এই আইনে উল্লিখিত বিধি মােতাবেক তারচেয়ে কম সময়ে জন্য।
(২) যে কেউ এই আইনের অধীনে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত নির্দেশ। অমান্য করবেন এবং তা যদি বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জন করে তাহলে তাঁকে সামরিক আদালতের মুখােমুখি হতে হবে। যদি তিনি তার চাকরিকালীন সময়ে উল্লিখিত অপরাধ সংঘটিত করেন তাহলে তাকে কঠোরভাবে ১৪ বছরের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। অথবা এই আইনে যে ধরনের বিধান রয়েছে সে অনুযায়ী তাকে স্বল্প পরিমাণ শাস্তি দেওয়া হবে; এবং যদি তিনি সক্রিয়ভাবে চাকরিতে থাকাকালীন সময়ের বাইরে সে ধরনের অপরাধে লিপ্ত হন তাহলে তাঁকে ৫ বছরের জন্য কঠোরভাবে কারাবদ্ধ করা হবে; অথবা আইনের বিধান মতে স্বল্প পরিমাণ শাস্তি দেওয়া হবে।”
২। এই আইনের অনুচ্ছেদ ২৪ এ শাস্তিযােগ্য অপরাধগুলাে একে একে গণনা করা হয়েছে। এতে এক পর্যায়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে আত্মসমর্পণের বিষয়টি কোনাে কোনাে অবস্থায় এসেছে। যদিও পুনরায় বলছি, এই শব্দটি সত্যিকারভাবে ব্যবহার করা হয়নি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে নির্দেশনামা আইনসিদ্ধ কি না এটি একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুবই মুস্কিল। তবে পাকিস্তান সেনা-আইনের সারগ্রন্থে (ম্যানুয়েল) এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়েছে যা মূল্যবান, যেমন
২৩৭
“এই কমান্ড হতে হবে ব্যক্তির প্রতি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কমান্ড- অর্থাৎ যাকে উদ্দেশ্য করে এ আদেশ প্রদান করা হবে সে আদেশ মান্য করার মতাে সাধ্য তার থাকতে হবে। এবং সেই আদেশ সামরিক বিষয় দ্বারা বিবেচিত ও যুক্তিসংগত হতে হবে। সেইসঙ্গে তা সিভিল আইনেও ব্যবহারযােগ্য হতে হবে। এই আদেশ সামরিক দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত হতে হবে এবং সেক্ষেত্রে অবাধ্যতার (অমান্যতার), ধরন অবশ্যই হতে হবে বাধাগ্রস্ত করা, বিলম্ব করা, অথবা সামরিক কার্যক্রম রহিত করার মতাে।”
এই আলােচ্য আদেশটি ধারাসম্মত বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি।
৪। সম্ভবত সর্বপ্রধান কমান্ডারের অকুততাস্থলে অবস্থান ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণপূর্বক প্রদেয় আদেশই এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য আদেশ, কিন্তু আমাদের নিকট এটি কোনাে প্রশ্ন নয়। আমরা মনে করি পরিস্থিতির প্রসঙ্গ সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন প্রকৃতির। এক্ষেত্রে সর্বপ্রধান কমান্ডার এবং কমান্ডার-ইন-চীফ ছিলেন একই ব্যক্তি- জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি অবস্থান করছিলেন অকুতােস্থল থেকে হাজার মাইল দূরে। খবরবার্তা যা তিনি পাচ্ছিলেন তার উৎস ছিল জেনারেল নিয়াজীর দ্বারা পেশকৃত প্রতিবেদনসমূহ। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অকুতস্থলের বাস্তব সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেন। আমরা বলেছি, এটি সত্য যে, আধুনিক সময়ে বিভিন্ন স্থানের মধ্যে ভৌগােলিক দূরত্বের বিষয়টি তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও ইতিহাসের প্রারম্ভে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা তখন যােগাযােগ ব্যবস্থা দ্রুত ছিল না। তথাপিও এক্ষেত্রে এটি ছােটো করে দেখার বিষয় নয়। এমতাবস্থায় বহু দূরত্বে বসে দাখিলকৃত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে দেওয়া সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং ঐ প্রতিবেদনই বা কতটুকু সত্যনির্ভর সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কাছে থেকে চাক্ষুষ দেখা এবং না দেখার মধ্যে পার্থক্য বিশাল । এটি আমাদের কাছে প্রতীয়মান যে, যদি উর্ধ্বতন কমান্ডার বহু দূরত্বে বসে অকুতােস্থলে যুদ্ধ না দেখে ও না বুঝে কমান্ডারের মতামত অনুযায়ী আত্মসমর্পণের আদেশ প্রদান করেন তাহলে পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা সর্বোচ্চ কমান্ডারের কাছে যুক্তিযুক্ত বলে প্রতিভাত হয় না। তাই সে অবস্থায় আদেশ আইনসংগত হয় না। এবং তা মান্য করার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আর থাকে না।
৫। এটি সত্য; সাধারণত নিখাদ আইনের প্রশ্নে সাক্ষীর নিছক মতামতই যথার্থ নয় । তথাপি, আমরা মনে করি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার মতামত সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর পেতে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সেনাপ্রথার সাথে সংযুক্ত এবং সেনা ও যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে সম্মানজনক ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তাদের মতামত নিশ্চিতভাবে যথাযথ বলে বিবেচিত হতে পারে। বেশকিছুসংখ্যক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন তাঁদের মতে কমান্ডার যেমন জেনারেল নিয়াজী যে অবস্থানে ছিলেন সে অবস্থান থেকে সে ধরনের কোনাে। আদেশ মান্য করতে বাধ্য ছিলেন না। কেননা দূরত্বে অবস্থান করে সর্বোচ্চ হুকুম দাতার পক্ষে পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না যে সেই পরিপ্রেক্ষিতে সত্যিকারভাবে আত্মসমর্পণ করার প্রয়ােজন রয়েছে কি না। তিনি যদি মনে করেন যে, তার বিবেচনায় ঐ আদেশ মান্য করা দেশের জন্য যুক্তিযুক্ত
২৩৮
নয়; তাহলে তিনি সে আদেশ সম্পর্কে নিজে মুক্তভাবেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখেন। এবং সেটিই হলাে প্রকৃতপক্ষে সম্মানজনক কাজ।
৬। মেজর জেনারেল রাহীম খান তার দায়িত্বে থাকা এলাকা ছেড়ে চলে এসেছিলেন পরিস্থিতির প্রকোপ বিবেচনা করে (বিষয়টি অন্যত্র আলােচিত হয়েছে)। আমরা দেখতে পাব তিনি আত্মসমর্পণ মেনে নেওয়ার মতাে কাজ করেছিলেন। যদি তিনি আদেশ অমান্য করে যুদ্ধে অবদান রাখতে গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন তাহলে তা হতে পারত একটি সম্মানজনক কাজ। কিন্তু পরিস্থিতির প্রকোপে তিনি আদেশ মেনে নিয়ে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।”
৭। মেজর জেনারেল জামশেদকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় জেনারেল নিয়াজী আদেশ অমান্য করেছেন কি না, তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন : “ব্যক্তি হিসেবে বলব যে, যদি দেশের মঙ্গলের খাতিরে সেখানে শতকরা ৩০ ভাগ ইতিবাচক ফলাফল আসার সম্ভাবনা থাকত তাহলে আমি তা করতাম, কিন্তু আমার হিসাবে এটি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।” তিনি একমত হন যে আত্মসমর্পণের আদেশ হলাে একটি অপমানজনক কাজ। এতে করে তা শত্রুর সঙ্গে তালমেলানাের মতাে কাজের শামিল। কেননা তার ফলে শক্রর উদ্দেশ্যই কেবল সাধিত হয়ে থাকে। অতএব, এ আদেশ বেআইনি।
৮। মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় একজন সামরিক কমান্ডার নিজের দৃষ্টিতে যা যুক্তিযুক্ত নয়- এটি বােঝার পরেও সে বিষয়ে আদেশ মান্য করতে বাধ্য কি না। তিনি উত্তর দেন : “আমার দৃষ্টিতে যদি এ ধরনের আদেশ আমাকে দেওয়া হতাে তাহলে আমি আত্মসমর্পণ করতাম না। কোনাে ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বৈরিতা ছাড়াই আমি নিঃসঙ্কোচে বলতে চাই জেনারেল নিয়াজী নিজেই আত্মসমর্পণ চাইছিলেন। তিনি সকল প্রকারের চালচিত্র উদ্ধৃত করলেন, যেমন তার অধীনে ছিল ২০০০০ সৈন্য ইত্যাদি। আমি এটি স্বীকার করতে চাই যে, তাঁর কাছে ছিল প্রকৃতপক্ষে উপযুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য যা আমি ঢাকা পাঠিয়েছিলাম। তাঁর কাছে একটিও গােলন্দাজ ছিল না, যেমন ছিল না। একটিও মর্টার।”
৯। মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্ উল্লেখ করেন সেনা-আইনের মধ্যে অর্থবহভাবে আত্মসমর্পণের কোনাে আদেশের আইনানুগ বিধান নেই। আইন যা বলে, তার অর্থ হলাে শত্রুর কাছে বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করা। তার মতে যখন কোনাে কমান্ডার আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তিনি আর কমান্ডারের পর্যায়ে থাকেন না। তখন তিনি শত্রুদের সহযােগিতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিষয়টির কার্যকারিতা এমন যে, যদি জেনারেল ইয়াহিয়ার সংকেতকে একটি আদেশ বলে ধরা হয় তাহলে তিনি সত্যিকারভাবে আর কমান্ডার থাকেন না- যার আদেশ মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। তিনি ইতিহাস থেকে অনেক উদ্ধৃতি দেন যেখানে এ ধরনের আদেশ সত্যিকারভাবে অমান্য করা হয়েছে।
১০। বিখ্যাত কমান্ডার নেপােলিয়ন বলেছিলেন : “সি-ইন-সি কে যুদ্ধে তার ভুলভ্রান্তির জন্য মুক্তি দেওয়া যায় না, যা তিনি করে থাকেন তাঁর নিজস্ব সার্বভৌম অবস্থা
২৩৯
অথবা একজন মন্ত্রীর মতাে হয়ে । যিনি মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থাকেন এবং যুদ্ধের গতি-প্রকৃতির বিষয়ে স্বল্প পরিমাণ জ্ঞাত থাকেন। তাঁর কাছে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনাে তথ্য সাধারণত থাকে না। এমতাবস্থায় এটি বর্তায় যে, একজন কমান্ডার ইন-চীফ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা বাস্তবায়নের জন্য। যদি তা খারাপ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে তবে তার জন্য তিনিই অপরাধী। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করতে পারেন যে, নিজ সৈন্যদের ধ্বংস করার চাইতে বরং পরিকল্পনার মধ্যে রদবদল কিংবা চূড়ান্তভাবে তা বাতিল করা যায়। যেকোনাে কমান্ডার-ইনচীফ যিনি সর্বোচ্চ আদেশদাতা, তার অধীনে যদি যুদ্ধে পরাজয় ঘটে তবে তিনি সমানভাবে অপরাধী। তিনি আদেশ মান্য করতে অস্বীকার করতে পারেন। একটি সামরিক আদেশের জন্য প্রয়ােজন আক্ষরিক আনুগত্য, তবে তখন যখন কি না সে আদেশ তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রদান করেন এবং যিনি যুদ্ধ-মঞ্চে উপস্থিত থাকেন; সেই সময়ে যখন তিনি আদেশটি প্রদান করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থেকে; তিনি সে অবস্থায় আপত্তিগুলােও শুনবেন এবং প্রয়ােজনে তার উত্তর ও ব্যাখ্যা দেবেন সেইসব কর্মকর্তাকে যাঁরা তা বাস্তবায়ন করবেন।”
১১। এটি এখানে উল্লেখ করা সম্ভবত মূল্যবান যে, সত্যিকারভাবে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঘটনাক্রমে একটি সম্মানজনক অবস্থায় আসা অবধি যথা বিরােধের সম্মানজনক মীমাংসায় না আসা অবধি। আজকাল কেউই নিবিষ্টভাবে তাঁর বিরুদ্ধে একটি আইনানুগ আদেশ ভঙ্গ করার অভিযােগ উত্থাপন করেন না যার মাধ্যমে কি না তিনি সামরিক দিক থেকে অপরাধ সংঘটিত করেছেন।
১২। সে কারণে আমরা এই উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, আত্মসমর্পণ প্রয়ােজনীয় ছিল না। আদেশটি তেমন ছিল না যা একজন সামরিক কমান্ডারের জন্য মান্য করা বাধ্যতামূলক বলে গণ্য করার মতাে।
২৪০

৫২
জেনারেল নিয়াজীর জন্য আত্মসমর্পণ করা
কি প্রয়ােজনীয় ছিল?

‘আত্মসমর্পণ ব্যতীত তার সামনে আর কোনাে বৈধ পথ খােলা ছিল না’- জেনারেল নিয়াজীর এই দাবিটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখতে চেয়েছি যে, আত্মসমর্পণ করার বিষয়ে তার প্রতি আদেশ ছিল কি না। এবং সেই পরিস্থিতিতে আত্মসমর্পণ যুক্তিসংগত ছিল কি না। আগের একটি অধ্যায়ে আমরা বিস্তারিতভাবে সংকেত/বার্তা উদ্ধৃত করেছি যা তাঁর কাছে অথবা গভর্নরকে লক্ষ করে প্রেরিত হয়েছিল, অথবা বিপরীতভাবে চীফ অব স্টাফ এবং প্রেসিডেন্টের প্রতি প্রদান করা হয়েছিল। আমরা সেগুলাে অবিকৃতভাবে তুলে ধরেছি এবং সেগুলাে থেকে কোনাে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অসমর্থ হয়েছি। এখানে আমরা অবশ্য সংযুক্ত করতে চাই জেনারেল নিয়াজী এবং জিএইচকিউ কর্তৃক প্রেরিত বার্তাগুলাের অধিকাংশই ছিল সাংঘাতিকভাবে দ্ব্যর্থক, নির্দেশনামূলক নয়, যাকে বলা চলে কর্মবিমুখ ও দায়সারা ধরনের। সেই সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট এ ধরনের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমাগতভাবে পরিস্থিতি খারাপের দিকে মােড় নিচ্ছে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘে আমাদের কার্যক্রম (বিষয়টি নিয়ে আমরা আমাদের মূল প্রতিবেদনে কাজ করেছি) ছিল পুরােপুরিভাবে বােকামিমূলক। এ অবস্থায় যা গােচরিভূত ছিল তা হলাে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট গভর্নরকে দরকষাকষি এবং মীমাংসা করার পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান করেছিলেন। সুস্পষ্টভাবে এটি- যা গভর্নরের উত্তরে আকারে প্রদত্ত হয়েছিল তা ছিল রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে যখন গভর্নর তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে কাজ করলেন তখন সে কাজের প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ছিলেন অসন্তুষ্ট ও ক্ষুরধারতুল্যভাবে রাগান্বিত । তিনি এর পরিপ্রেক্ষিতে একগুচ্ছ নতুন প্রস্তাব প্রেরণ করলেন, কিন্তু সেগুলাে ছিল সার্বিকভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত। পরবর্তী বার্তাগুলােতে জেনারেল নিয়াজীকে সীমিতসময় অবধি অবস্থা ধরে রাখতে বলা হয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাকে জানানাে হয় যে, জাতিসংঘের নিকট প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমরা কীভাবে এই সিদ্ধান্তটি আমাদের মূল প্রতিবেদনে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম, সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনি মূল প্রতিবেদনে উপস্থাপন হয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের বার্তাটিতে (নং জি-০০১৩) পরিষ্কারভাবে যা উল্লেখ ছিল তা হলাে আত্মসমর্পণের অনুমতি কিন্তু আদেশ আকারে ছিল না। জেনারেল মানিকশাে’র সঙ্গে জেনারেল নিয়াজীর যােগাযােগের পরে তাঁকে “অবস্থা অনুসারে কাজ করতে উপদেশ দেওয়া হয়। তবে তা ছিল পূর্ববর্তী ঘটনার অনুকূল। তাই এটিকে আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গে ২৪১
স্বাধীন এবং নতুন কোনাে আদেশ বলে গণ্য করা যায় না। যদিও এটি একটি বিতর্কিত বিষয় যে, জেনারল নিয়াজী সে সময়ে ঢাকায় অবস্থানরত অন্যান্য জ্যেষ্ঠ জেনারেল ও নৌ এবং বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলােচনা করেছিলেন কি না। তবে এটি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে আলােচনা হয়েছিল এবং সর্বসম্মতভাবে বলা হয় আত্মসমর্পণ করা হবে কি হবে না সে সিদ্ধান্ত তার নিজেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ সে সিদ্ধান্ত হবে তাঁর নিজের। তবে এটিও মানতে হবে তাদের কেউই তাঁকে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনার বিষয়ে কার্যকরভাবে কোনাে প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি।
২। জেনারেল ফরমান আলী তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন সবাই মিলে আত্মসমর্পণের একত্রে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বা আত্মসমর্পণ না করে বিষয়টি বিভাগীয় কমান্ডারদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হােক। তাঁরা তাঁদের অবস্থা বুঝে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেবেন বা নেবেন না।
৩। রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ প্রস্তাব করেন এভাবে : “আমি জেনারেল নিয়াজীকে বলেছিলাম বার্তাটির মর্ম অনুযায়ী তিনি আত্মসমর্পণের দায়িত্ব বহনে বাধ্য নন। আমি বলেছিলাম, এতে তাঁকে বলা হয়েছে তার পক্ষ থেকে কিছু একটা করতে । তবে আত্মসমর্পণের কোনাে প্রয়ােজন নেই। তিনি যেকোনাে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারতেন। জাতিসংঘকে কিছু একটি করতে দেওয়া হােক। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন অন্যথায় তিনি অভিযুক্ত হবেন। কিন্তু আমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল নিয়াজীর মধ্যে কোনাে প্রকার প্রতিক্রিয়া ছিল না। তিনি ছিলেন সার্বিক ও চূড়ান্তভাবে নীরব। আর এটিই ছিল সত্যিকার চালচিত্র। তার মধ্যে কোনাে প্রকার ভাবান্তর বা প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। কোনাে বিষয় উপলব্ধি করার মতাে আত্মউপলব্ধির সূক্ষ্ম চেতনা তাঁর মধ্যে ছিল না।” সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে আত্মসমর্পণই কি সবচেয়ে উত্তম পথ যা খােলা ছিল- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয় কেউই আত্মসমর্পণ’ শব্দটি শ্রবণ করতে পছন্দ করেন না। এটি শ্রবণ করা এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়া একজন মানুষের জীবনে ঘটা সবচেয়ে খারাপ মাত্রার কিছু। আমি যদি জেনারেল নিয়াজীর জায়গায় থাকতাম, আমি আত্মসমর্পণের মতাে কাজের কথা চিন্তাও করতাম না… যদি আমার হাতে ২০০০০ সৈন্য থাকত যেমনটি জেনারেল নিয়াজী দাবি করেছেন। সে অবস্থায় আমি বাধা প্রদান করতাম।”
৪। এটি মনে হয় যে, প্রকৃত আত্মসমর্পণের বহু আগেই যুদ্ধ করার ইচ্ছাশক্তি উবে গিয়েছিল । নিদেনপক্ষে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ যশােরের পতনের পরে কমান্ডের তরফ থেকে এমনকি সেখানে নিমমাত্রায়ও কোনাে প্রতিরােধ প্রচেষ্টা ছিল না। জেনারেল নিয়াজী নিজেই স্বীকার করেছেন তখন থেকে পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যুদ্ধ পরিচালনায় খুব সামান্যই কিছু করতেন। ফলে কার্যক্ষেত্রে তাঁর আর তেমন প্রভাব ছিল না, কেবলমাত্র তিনি কিছু উপদেশ প্রদান করতেন। ফলে এ ধরনের কার্যকলাপকে আমরা তার সার্বিক দূরদৃষ্টির অভাব বলে গণ্য করতে পারি এবং এটি যুদ্ধের ওপর প্রভাব রেখেছিল। তখন থেকে বলা যায় তিনি যুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং মস্তিষ্কের দিক থেকে পঙ্গু হয়ে পড়েন। জেনারেল রাও ফরমান আলী
২৪২
হলফনামা সহযােগে বলেন যে, ১৯৭১ সালের ৫ অথবা ৬ ডিসেম্বর এবং তার পরবর্তী সময় থেকে জেনারেল নিয়াজী এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করেন; যা থেকে মনে করা যায় তিনি পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। গভর্নর হাউজে অনুষ্ঠিত সভায়- যে সভা থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে বার্তা পাঠানাে হয় এবং সেই বার্তার কপি জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদকের প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয় সেখানে জেনারেল নিয়াজী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অ্যাডমিরাল এম শরীফ হলফনামা সহযােগে বলেন, “ইস্টার্ন কমান্ডের অঙ্গনে। সম্পূর্ণভাবে অসারতা বিরাজ করছিল।” অন্য একটি পৃথক ঘটনার সময় সাক্ষী বলেন, অ্যাডমিরাল শরীফের সঙ্গে কথা বলার সময় জেনারেল নিয়াজী ক্রন্দন করতে থাকেন এবং গভীর শােকাভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর চোখে জল গড়াতে থাকে। তিনি বলতে থাকেন তিনি আগে কোনােদিনও পরাজয় দেখেননি, অথচ, এখন তার সামনে আত্মসমর্পণ ঝুলে রয়েছে। সাহসী মানুষেরা আগেও কেঁদেছেন এবং আমরা কেবলমাত্র এই ক্রন্দনের ঘটনার সূত্র ধরে তাঁর দৈহিক শক্তিহীনতার কথা ভাবতে পারি না। আমাদের এতে কোনাে প্রকার সন্দেহ নেই যে, ব্যক্তিগত পরাক্রমের ক্ষেত্রে তাঁর দাবি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সাহসিকতার রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ব্যক্তিগত সাহসিকতা সহজভাবে একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডারের জন্য খুব বেশি কিছু নয়। সাহসিকতা বলতে ভয়শূন্যতা নয়, কিন্তু মনের সেই অবস্থা যার দ্বারা ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং গুরুতর বা সাংঘাতিক বৈরী অবস্থার মধ্যে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করা যায়, সেখানে থাকতে হয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দক্ষতা, সমীকরণ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যাবতীয় গুণাবলি । সে ধরনের সাহসিকতা দেখাতে জেনারেল নিয়াজী ব্যর্থ হয়েছিলেন।
৫। তথ্য-প্রমাণ থেকে এটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে কমান্ডের শিকল যত বেশি নিচে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল যুদ্ধের ক্ষুরধার তত বেশি নিমগামী হচ্ছিল। এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি হয় খারাপ দৃষ্টান্ত। এবং সেইসঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনাবিহীনতাও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সৈন্যরা মােটের ওপর মানব প্রজাতির জীব । যখন তারা দেখতে পেলেন একের পর এক অবস্থান বিচ্ছিন্ন ও ইতস্তভাবে হাত থেকে চলে যাচ্ছে; তা নিশ্চিতভাবেই তাদের যুদ্ধ করার আত্মিক মনােবলকে নষ্ট করে দেয়। জেনারেলের আত্মসমর্পণের আগেই ব্যক্তিগত আত্মসমর্পণের মতাে ঘটনা ঘটতে থাকে। এটি হয়তাে ছিল ঐ অবস্থারই জের।
৬। যদি সেখানে সুষ্ঠু ও টেকসই পরিকল্পনা থাকত তাহলে বিশেষ করে ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য সংকটকালীন সময়ের জন্য সুসংগঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আয়ােজন থাকত। থাকত যথাযথ পরিমাণ সেনাবাহিনী। তাহলে সেখানে ঢাকাকে দীর্ঘসময় ধরে রাখার ব্যবস্থা পাকাপােক্ত থাকতে পারত। কিন্তু তেমন কোনাে পরিকল্পনা নেওয়া ছিল না।
৭। তথাপিও, আমরা কোনােভাবেই বুঝে উঠতে সক্ষম হইনি যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে সেই পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করতেই হতাে। জেনারেল নিয়াজী দৃশ্যত এ কথাটি স্বীকার করে নেন। যদিও তার শেষের দিকের সংকেতগুলাে এমন একটি
২৪৩
চিত্র অঙ্কিত করে; যাতে মনে হয় যে, ভারতীয় বাহিনী দৃশ্যত ঢাকার প্রান্তদেশে চলে এসেছে; অথচ এটি তেমন ছিল না। চরমভাবে বলা যায় এমনকি এ তথ্য-প্রমাণ সন্দেহজনক- নরসিংদীর কাছে কিছু হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা সৈন্য জড়াে হয়েছিল। তারপরও এটি মানতে হবে আক্রমণের জন্য ভারতীয় বাহিনীকে কমপক্ষে আরও সাতদিন প্রস্তুতি নিতে হতাে। তাছাড়া যুদ্ধ থাকলে ঢাকা দখল করতে আরও সাত দিন লাগত। অর্থাৎ সর্বমােট দুই সপ্তাহ সময় পাওয়া যেত, যা গণনা করা যায় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১, থেকে।
৮। আমরা মনে করি জেনারেল নিয়াজী সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় বােমাবর্ষণের ভয়ভীতিকে অতিরঞ্জিত করে (অতিমাপ) দেখেছিলেন। বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রীক। তবে এটিও ভেবেছিলেন যে, ভারতীয়রা ঢাকায় কখনাে বােমা নিক্ষেপ করবে না। এটি স্মরণযােগ্য, ভারতীয়রা বাঙালি জনসাধারণের রক্ষার্থেই মাঠে নেমেছিল এমতাবস্থায় সম্ভাব্য বাঙালি নিধনের জন্য তারা ঢাকায় বােমা নিক্ষেপ করত না। এমনকি ভারী অস্ত্র দ্বারা গােলাগুলিও ছিল সেক্ষেত্রে ঝুঁকিবহুল। কেননা, সেক্ষেত্রে ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক মানুষ হত্যার শিকার হতেন। এ বিষয়টি ছিল ভারতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে বৈসাদৃশ্যমূলক এবং অসংগতিপূর্ণ। জেনারেল নিয়াজী যা করতে পারতেন তা হলাে ক্ষুদ্র ধরনের অস্ত্র এবং মর্টার দ্বারা প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়া।
৯। যা সত্যিকারভাবে জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের দিকে ধাবিত করিয়েছিল তা হলাে, আমাদের মতে, প্রাথমিকভাবে এই সত্য; তার ছিল চরম জেদি পর্যায়ের দোষী সাব্যস্তকরণের মনােভাব, যে সর্ববিতরাণযােগ্য যুদ্ধ কখনই ঘটবে না এবং পূর্ব পাকিস্তানে তার সর্বময় কাজ হলাে বিপ্লবী তৎপরতা বন্ধ ও প্রতিরােধ করা। তিনি কখনাে একটি যুদ্ধ করার মনােভাব পােষণ করতেন না। সেজন্য এ সম্পর্কিত কোনাে প্রকার পরিকল্পনাও তিনি নেননি। এর ফলাফল ছিল এমন যে, তিনি যুদ্ধ করার মতাে ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং তা শুরু হয়েছিল একেবারে প্রথম থেকেই যখন কি না সর্ববিতরণ যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল। তিনি মানসিকভাবে যেকোনাে সময়ে ঘটতে পারে এমন আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত বিধ্বংসের ভয়ভীতি আমাদের মতে ছিল অনেকটাই তাঁর নিজস্ব মস্তিষ্কজাত উৎপাদন। কিন্তু তার কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে এটি প্রকাশ পায়, তাই কোনাে অবস্থায় আত্মসমর্পণের মতাে পরিস্থিতি আসতে পারে তা তার চিন্তার গভীরে ছিল না। এই ভীতির নিদর্শন সংকেতগুলাের মধ্যেই লক্ষ করা যায়, অশ্রেণিভুক্তটি বিশেষভাবে এখানে উল্লেখযােগ্য (১২ ডিসেম্বর ১৯৭১, নং জি১২৭৯)। ঢাকায় তার সঙ্গে অবস্থানরত অপরাপর জেনারেলরাও সাহসকিতার অবস্থান থেকে বহুদূরে ছিলেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে জেনারেল রাহীম খানের কথা উল্লেখ করা যায়।
১০। বাস্তবিকভাবে এটি পরিষ্কার যে, জেনারেল রাহীম খান নিজেই ছিলেন আতঙ্কগ্রস্ত। আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি কীভাবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পরিত্যাগ করেছিলেন, অবশ্য সেখানে জেনারেল নিয়াজীর অনুমতি ছিল। এমতাবস্থায় তিনি আহত হয়েছিলেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। এমনকি হাসপাতালেও তিনি ছিলেন
২৪৪
আতঙ্কগ্রস্ত এবং আরও নিরাপদ স্থানে তাকে স্থানান্তরের জন্য তিনি অনুনয় করেন। সেই সময়ে তার কক্ষে বিশেষভাবে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল রাও ফরমান আলী হলফ করে বলেন যে, দু’এক মিনিট পরেই সেখানে জেনারেল নিয়াজী এবং জেনারেল জামশেদ এসে হাজির হন এবং সভায় যােগদান করেন। অবশ্য এটি খুবই স্বাভাবিক যে, জেনারেলগণ তাঁকে দেখতে আসবেন যেহেতু তিনি ছিলেন আহত। তবে তারা তাঁর জন্য হাসপাতালে সেই সময়ের ভিতর অনেক কিছু করেছিলেন। এতে জেনারেল নিয়াজী নিজেও যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ১২ তারিখের এই সভা কেবলমাত্র আহত জেনারেলকে দেখা ও তাঁর সুচিকিৎসার বিষয়ভিত্তিক ছিল না। জেনারেল জামশেদ বলেছেন সেই সভায় তেমন কিছুই আলােচিত হয়নি। তবে আমরা এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট ও একমত নই যে, জেনারেলগণ কেবলমাত্র জেনারেল রাহীম খানকে নিয়েই মেতে ছিলেন এবং সেখানে গুরুতর কোনাে বিষয় নিয়ে আলােচনা হয়নি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না। নজির থেকে জানা যায় (বিপরীতভাবে) জেনারেল রাহীম উপদেশ দেন, “সবকিছুই শেষ হয়ে গিয়েছে এবং তারা একদিনের মধ্যেই শেষ করবেন।” জেনারেল জামশেদ। যদিও বলেন জেনারেল নিয়াজী তাঁকে ফোন করে বলেন জেনারেল রাহীম এর কক্ষে চলে আসতে, কেননা এ ধরনের খবর আসছে যে, ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুক্তিবাহিনীর হাতে দু’দিন পরে তুলে দিতে চাচ্ছে। এই ধরনের ভয়ভীতি কার্যনির্ধারণে কাজ করেছিল। তাছাড়া সংকেত-বার্তাতেও বাহিনীর নিরাপত্তা সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচিত হয়েছিল।
১১। জেনারেল নিয়াজী বলেন, আত্মসমর্পণের দিন ও তার তাৎক্ষণিক আগের দিন ঢাকায় তার বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৬০০০। এটি সত্য যে, সেখানে সবাই যােদ্ধা ছিলেন না। কিন্তু শেষ মহুর্তে যখন প্রতিরক্ষা গড়ার প্রশ্ন দেখা দিল তখন সম্ভাব্য সশস্ত্রদের অস্ত্র মাফিক গণনা করা হয়। প্রমাণ এমন যে এ সম্পর্কে বিতর্কিত খবর পাওয়া যায়; আসলে সেখানে কতজন ছিলেন। তারা তাদেরকেও ধর্তব্যের মধ্যে এনেছিলেন যেসব যােদ্ধারা ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিলেন। কিন্তু যদি জেনারেল নিয়াজীর গণনা সঠিক ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে প্রতিরােধ ধরে। রাখার যাবতীয় কারণ পায়ের নিচে মাটি পায়।
১২। সে কারণে আমরা উপসংহারে এসে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না যে, আত্মসমর্পণ ব্যতীত জেনারেল নিয়াজীর আর কোনাে উপায় ছিল না।
২৪৫

৫৩
আলাপ-আলােচনা (দরদস্তুর) এবং সত্যিকার আত্মসমর্পণ

১। ১৫ এবং ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, রাতের মধ্যে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘটনাদৃষ্টে (প্রমাণসহ) প্রতীয়মান হয়ে উঠল যে, জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছেন। এটি আর গােপন কিছু ছিল না। সেই রাতেই কিছুসংখ্যক সেবিকা (নার্স) এবং জেনারেল রাহীম খানকে নিরাপদে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলাে । কেননা যুক্তি দেখানাে হলাে একজন আহত জেনারেলকে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেওয়ার সুযােগ দেওয়া যায় না। ঐ রাতে ৪ টায় (সকাল) জেনারেল নিয়াজী একটি নােটিশ জারি করেন যেখানে বলা হয় যুদ্ধবিরতি এবং বৈরিতা ভাের ৫ টার মধ্যে শেষ (সম্পন্ন) হবে। আরও বলা হয় এর মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করতে হবে।
২। সেইদিন সকাল বেলা সাধারণ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সে বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে বড়ােজোর তাকে “আলােচনা” বলা যেতে পারে। আত্মসমপর্ণের সিদ্ধান্ত ইতােমধ্যে নেওয়া হয়েই হয়েছিল। এমনকি শর্তগুলাে নিয়েও আলােচনার অবকাশ ছিল না। কেননা জেনারেল নিয়াজী তাঁর নিজের বুদ্ধিতে অথবা রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রাপ্ত উপদেশের কারণে জেনারেল মানিকশাে’র শর্তগুলােই মেনে নিয়েছিলেন। কেবলমাত্র একটি বিষয় আলােচিত হতে পারত তা হলাে আত্মসমর্পণের ধরন নিয়ে। তবে বিষয়টি আলােচিত হয়নি।
৩। যখন আলােচনা চলছিল তখন জেনারেল নিয়াজীকে উদ্দেশ্য করে ভারতীয় একজন ডিভিশনাল কমান্ডার জেনারেল নাগরা একটি চিরকুট প্রেরণ করেন; তাতে লেখা ছিল : “আমার প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর সেতুর উপর অবস্থান করছি; মানুষের জান এবং মাল রক্ষার্থে আপনি যথাযথ কাজটিই করেছেন। মিরপুর সেতুর উপরে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কাউকে পাঠিয়ে দিন।” আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বলতে যা চাইব তা হলাে সম্ভবত “সম্পত্তির সূত্র ধরে। কেউই বলতে পারেন না। কীভাবে এই চিরকুটটি এসেছিলেন। এ বিষয়টি সম্পর্কে কোনাে সাক্ষীই আমাদের কাছে কিছু বলেননি। জেনারেল রাও ফরমান আলী খোজ খবর নিয়েছিলেন জেনারেল নাগরা আলাপ-আলােচনা ও দরদস্তুর টিমের নেতা কি না। কিন্তু পুনরায় কেউই সত্যিকারভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। অ্যাডমিরাল এম শরীফ বলেন- তাঁকে সমর্থন দেন জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং জেনারের জামশেদজেনারেল রাও ফরমান আলী উদ্বিগ্নতার সাথে জানতে চেয়েছিলেন সেখানে কোনাে প্রকার বাধা প্রদানের সুযােগ আছে কি না; অন্যথায় যা কিছু বলা হবে তা মেনে নেওয়া। জেনারেল রাও ফরমান আলীর প্রশ্নের কেউই কোনাে জবাব দেননি। তারপর অ্যাডমিরাল শরীফ উর্দুতে বিশেষভাবে জেনারেল জামশেদের কাছে জানতে
২৪৬
চান “Kush pulley hai” অর্থ হলাে কোনাে প্রকার প্রতিরােধের সামর্থ আছে কি না।” কিন্তু জেনারেল জামশেদ শুধুমাত্র তার মাথা নাড়িয়ে যা বােঝালেন তাঁর অর্থ হলাে সেখানে তেমন কোনাে সুযােগ অবশিষ্ট নেই। জেনারেল নিয়াজী দৃশ্যত ছিলেন আগাগােড়া নীরব এবং তারপর সিদ্ধান্ত হয় জেনারেল জামশেদ জেনারেল নাগরার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন এবং তিনি সেখানে যান।
৪। জেনারেল জামশেদ যখন জেনারেল নাগরার কাছে গিয়েছিলেন তখন তিনি তার পিস্তলটি সমর্পণ করেন। এবং ছবিতে (ফটোগ্রাফ) আমরা দেখতে পাই জেনারেল জামশেদ জেনারেল নাগরার কোম্পানির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এবং খাপের ভিতর তাঁর পিস্তলটি নেই। এর দ্বারা বুঝা যায় প্রকৃত আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটার আগেই জেনারেল জামশেদ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এই ফটোগ্রাফ নিয়ে কোনাে প্রকার সন্দেহ বা বিভ্রান্তি নেই। তবে এটি স্মরণযােগ্য যে, এই ফটোগ্রাফ যে কেবল মাত্র ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত হলাে তাই নয় সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী তা ব্যাপকভাবে প্রচারণায় এলাে। এতে মনে হয় ফটোগ্রাফটি প্রচারণার কাজে ব্যবহার করার জন্যই নেওয়া হয়েছিল। যেভাবেই হােক না কেন, আমরা মনে করি, এই ছােট্ট ঘটনাটিকে খুব বেশ বড়াে করে তােলা হয়েছিল, আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের আগেই একটি আত্মসমর্পণ উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবেই করানাে হয়েছিল।
৫। যেদিন জেনারেল জামশেদ জেনারেল নাগরার সঙ্গে স্বাক্ষাৎ করেন সেইদিন পূর্বাহ্ন এবং তারপরেও কিছু সংখ্যক ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল নাগরার অবস্থান স্থলে আসেন, এদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল অরােরার চীফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব এবং একজন কর্নেল । তবে সেই সময়ের মধ্যে ভারতীয় যানবাহনের দ্বারা ইস্টার্ন কমান্ড চত্বর ঘেরাও হয়ে যায়। আলাপ-আলােচনার নিমিত্তে এক ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় টিম আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত দলিলের খসড়া নিয়ে আসেন, সেখানে উল্লেখ ছিল আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং তা হবে ভারতীয় এবং বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের নিকট। উপস্থিত কেউ কেউ বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণের বিষয়ে আপত্তি তােলেন। কিন্তু তাদের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে, আসলে আত্মসমর্পণ করা হচ্ছে ভারতীয় বাহিনীর নিকটে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র। জেনারেল নিয়াজী শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যদি তিনি রাজি না হন তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানি এবং পাকিস্তান অনুগতদের মুক্তিবাহিনীর হাতে অর্পণ করলে পর ব্যাপকমাত্রার বিধ্বংস আসবে। এখানে এটি অবশ্যই উল্লেখযােগ্য যে, কোনাে একজন সাক্ষীও এমন ভীতির মূলে যে সত্যতা আছে তা বলেননি, অধিকাংশই বিষয়টি অস্বীকার করেন। ইতােমধ্যে জেনারেল জ্যাকব সবসময়ের জন্য উপস্থিত ছিলেন না। তবে তিনি বাইরে থেকে এসে পাইপ ফুকতে ফুকতে পায়চারি করতে করতে বলেন এই খসড়াটি দিল্লি হতে এসেছে এবং এটি কোনাে প্রকার পরিবর্তন ব্যতীতই স্বাক্ষর করতে হবে। সেইসঙ্গে একথাও বলা হয়; অবশ্য ব্রিগেডিয়ার বাকীর সিদ্দিকী তা অস্বীকার করেন। তাঁকে ভারতীয় দরদস্তুর টিমের সঙ্গে অবন্ধুসুলভ মনে হচ্ছিল এবং তিনি ভারী ভারী মালপত্রসহ তাঁর লাগেজ’ কীভাবে চূড়ান্তভাবে পাকিস্তানে নেওয়া যাবে সেই বিষয়টি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এটিও
২৪৭
বলা হয় যে পরবর্তীতে তার মালপত্র বহনের স্বার্থে যুদ্ধবন্দির বিশেষ মর্যাদাসহ ভিন্ন গাড়ি সরবরাহ করা হয় এবং সে কারণে জেনারেল নিয়াজী অথবা ব্রিগেডিয়ার বাকীর সিদ্দিকীর সঙ্গে ভারতীয়দের একটি গােপন আঁতাত করতে হয়। কিন্তু এ বিষয়ে এরচেয়ে অধিক কিছু জানতে পারিনি। তবে পরবর্তীতে আরও যত্নের সঙ্গে আর একটি আনুষঙ্গিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হলে তা বের করার চেষ্টা করা হবে।
৬। এভাবে আলাপ-আলােচনা বা দরদস্তুর সমাপ্ত হয় এবং তা কার্যকর করার পথে এগিয়ে যায়।
৭। এটি দাবি করা হয় যে, ভারতীয় টিমকে মধ্যাহ্নভােজের দ্বারা আপ্যায়িত করা হয়।
তবে আমরা এ বিষয়টিকে সাংঘাতিক রকমের কোনাে অভিযােগ হিসেবে দেখতে চাচ্ছি না। সময়টি ছিল মধ্যাহ্নভােজের এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় টিমের খাবার গ্রহণের প্রয়ােজন ছিল। তাদের সে সময় খাবার সরবরাহ না করাটাই হতাে অসৌজন্যমূলক কাজ।
৮। অ্যাডমিরাল শরীফ-এর মতে সেই সময় জেনারেল নাগরা কিছু একটা খুঁজে ফিরছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। এমতাবস্থায় অ্যাডমিরাল শরীফ তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি কী খুঁজছেন। তিনি তখন উত্তর দেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য তিনি যুতসই চেয়ার খুঁজছেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়ােজন এভাবেই আরম্ভ হয়েছিল। বিশেষ করে অ্যাডমিরাল শরীফ সাক্ষ্য দেন সেখানে কোনাে প্রকার আনুষ্ঠানিকতার প্রয়ােজন নেই বলেও বলা হয়েছিল। আমরা জানতে পেরেছি সাময়িক ধারার রীতিতে এমন কিছু নেই যে, আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কীভাবে আত্মসমর্পণ সাধারণত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সে বিষয়ে নজিরের অভাব নেই। তবে বিজয়ী কমান্ডারের ইচ্ছার কারণেই আনুষ্ঠানিকতার ব্যবস্থা করা হয়। জেনারেল নিয়াজী অবশ্য রাজি হয়েছিলেন এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায়। তিনি বলেন এটি এভাবে ঘটেছিল কারণ, যদি তিনি এমন কিছুতে রাজি না হতেন তাহলে বিধ্বংসের ভীতি ঘাড়ে ঝুলে থাকত এবং তা ঘটতেও পারত। আমরা যেমনটি আগেও বলেছি এরকমের একটি ভয়ভীতির দ্বারা জেনারেল নিয়াজী চালিত হয়েছেন এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে বিষয়টি উপসংহার হিসেবে বিবেচ্য। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র তাদের কাছ থেকে পরিত্যাগ করানাে হয়। বিষয়টি এমন যে, যেহেতু ভারতীয় বাহিনী তাদের নিরাপত্তা কারাগারে নিচ্ছেন সেহেতু তাদের কাছে আর অস্ত্রশস্ত্র থাকার প্রয়ােজন নেই।
৯। তারপর জেনারেল নিয়াজী নিজে বিমানবন্দরে ছুটে যান জেনারেল আরােরাকে গ্রহণ করতে। আমরা মনে করি (পুনরায়) এটি যে সর্বতােভাবে অপ্রয়ােজনীয় ছিল তাই নয়, সেইসঙ্গে তা ছিল অসম্মানজনক। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে জেনারেল একজন অকুতােভয়ের মতাে মর্যাদা প্রদর্শন করতে পারেননি বরং পরাজিত সৈনিকের মতাে। মস্তকাবনত হয়ে থেকেছেন। এসব কিছুই জেনারেলের দাবির সঙ্গে বেমানান; যে দাবির মাধ্যমে তিনি বলেছেন, তাঁর প্রতিরােধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতাে ক্ষমতা ছিল, তবে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন ওপরের আদেশ মােতাবেক। জেনারেল অরােরাকে গ্রহণ করতে বিমানবন্দরে ছুটে যাওয়া সম্পর্কে জেনারেল নিয়াজী যে
২৪৮
ব্যাখ্যা দাঁড় করান তা হলাে : এমন যে বিমানবন্দর থেকে জেনারেল অরােরা সােজা রেসকোর্স ময়দানে আসবে যেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হবে। পরিকল্পনা এমনই ছিল। যানবাহনের স্বল্পতার জন্য জেনালে নিয়াজীর রেসকোর্স ময়দানে যাবার গাড়িটি তাই বিমানবন্দর হয়ে আসতে হয়েছিল। আমরা জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক প্রদত্ত এই ব্যাখ্যা গ্রহণে অসমর্থ হই; কেননা ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ড অথবা এমনকি ভারতীয় বাহিনীর যানবাহন এত সামান্য ছিল না যে সে কারণে জেনারেল নিয়াজীকে বিমানবন্দর হয়ে আসতে হবে। আরও যুক্তি দেখানাে হয় যানবাহনটিতে তারকা/স্টার থাকার প্রয়ােজন ছিল। আমরা মনে করি এ যুক্তিটিও যথাযথ নয়; বরং খোড়া।
১০। অনুষ্ঠানস্থলে ভারতীয় জেনারেলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি গার্ড অব অনার প্রদান করে। এর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন আহমদ নেওয়াজ খান (সাক্ষী নং ২৬৫), তিনি ছিলেন তখন এডিসি জেনারেল। আমরা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে অক্ষম যে, কোনাে জেনারেল নিয়াজী এ ধরনের কাজ করার চিন্তা করেছিলেন বা এর দ্বারা উপকারই বা কি পাওয়া গেল। তিনি নিজে এটি দৃশ্যত স্বীকার করেন এবং অবশ্যই ক্যাপ্টেন আহমদ নেওয়াজ বলেন যে, তিনি হুকুম তামিল করেছেন। জেনারেলের ভাষ্য ছিল নেহায়েত এমন যে, এটি ছিল একটি কৌশলগত কাজ যা চালিত হয়েছিল রক্ষা করার খাতিরে, সম্মান দেখানাের উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না ভারতীয় বাহিনীকে কার হাত থেকে রক্ষা করা বা কার বিরুদ্ধে তিনি এমন কাজ করলেন। পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে আক্রমণ করার মতাে অবস্থানে ছিল না। তাছাড়া স্থানীয় জনগণের ভিতর থেকে যতদূর জানা যায়; তিনি ছিলেন অভিনন্দিত (সুস্বাগতম)। জেনারেল বলতে থাকেন যে, রেসকোর্স ময়দানে হঠাৎ করেই দেখতে পান যে, একটি কোম্পানি সারিবদ্ধ হয়েছে ভারতীয় জেনারেলকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য। সে অবস্থায় তিনি আর আপত্তি করেননি। এটি বিশ্বাসযােগ্য নয় যে, একজন ক্যাপ্টেন যার পদমর্যাদা হলাে এডিসি পর্যায়ের তিনি জেনারেলের পূর্বানুমতি ব্যতীত এমন কাজ করতে পারেন। ভারতীয়দের উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য ঢাকাবাসীদের কাছে নিজেদের বিজয়ী হিসেবে উপস্থাপন করা এবং সেমতাে ছবি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া- যার মধ্যে দিয়ে আমরা অপমানিত হই; সে ধরনের কার্যকলাপ জেনারেলের হাত লাগানাের প্রয়ােজন ছিল না।
২৪৯

৫৬
সূচনা

সূচনা
মূল প্রতিবেদনের অংশ ৫, অধ্যায় ১ এ আমরা ১৯৭১ সালে আমাদের পরাজয়সংশ্লিষ্ট কিছু কারণ মৌখিক বিবরণী আকারে তুলে ধরেছি। কমিশনের সামনে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে নেওয়া বিপুল সংখ্যক সম্মানিত সাক্ষী, যেমন উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব কর্মকর্তাও ছিলেন। সামরিক শাসনামলে সামরিক শাসনের সঙ্গে জড়িতদের দ্বারা সংঘটিত দুর্নীতি, যৌনকামনা, মদ ও নারী আসক্তি, জমি এবং বাড়িঘরের প্রতি মােহাচ্ছন্নতাসহ এ জাতীয় কর্মকাণ্ড করার ফলে বিশেষভাবে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে যুদ্ধের ইচ্ছা যে কেবল হারিয়ে বসেছিল তাই নয়; সেইসঙ্গে তাদের পেশাগত দক্ষতাও বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছিল। ফলে তারা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল পরিস্থিতিতে সফলতা অর্জনের জন্য প্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্ত প্রদানের ব্যর্থতার পরিচায় দিয়েছেন। সাক্ষীদের নিকট থেকে এটি বের হয়ে আসে যে, অসম্মানজনক কাজে ও বিশেষ অনৈতিক জীবন ধারায় নিয়ােজিত সৈনিকদের কাছ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা যুদ্ধ জয় করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল।
২। কমিশনের সামনে উপস্থাপিত তথ্য-প্রমাণাদি বিশ্লেষণপূর্বক আমরা এই উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের নৈতিক অধঃপতন; কার্যত গতি ও মাত্রা অর্জন করেছিল, এবং তা আরম্ভ হয়েছিল ১৯৫৮ সালের সামরিক আইনের অধীনে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। সেই প্রবণতাগুলাে পুনরায় আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে ১৯৬৯ সালে পুনরায় দেশে সামরিক আইন জারির ফলে। এ সামরিক আইন জারি করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সেসময় বাস্তবিকভাবে বিপুলসংখ্যক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেশকিছু ভূমি দখল, বাড়ি নির্মাণ এবং অপরাপর ব্যবসায়-বাণিজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার অভিযােগ ও তথ্যপ্রমাণাদি পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত তারা ব্যাপক সংখ্যক অনৈতিক কার্যকলাপ বা লাম্পট্যমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এতে করে তাদের পেশাগত মান ও দক্ষতা সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পায়। নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা ও গুণের ওপর পড়ে এর বিরূপ প্রভাব।
৩। আমরা কিছুসংখ্যক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার কার্যকলাপের ওপর কিছু মন্তব্য করি- এর মধ্যে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীও ছিলেন। সেই অধ্যায়টি ৩৫নং অনুচ্ছেদে আমরা বলেছিলাম যে, “লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ভারতে যুদ্ধবন্দি থাকার কারণে আমাদের পক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে আসা। অভিযােগসমূহ পেশ করার সুযােগ পাচ্ছিনে, তাই এর যথাযথ প্রমাণের জন্য
২৫০
আমাদেরকে ভারতের বন্দিদশা থেকে ফিরে আসার পরে পুনরায় বাছবিচার করতে হবে।” এখন কেবলমাত্র লে. জেনারেল নিয়াজীকেই নয় সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁর বা তাদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এ সম্পর্কে আমরা তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ কার্যাবলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত উপসংহার উপস্থাপন করবাে।
সামরিক আইনের অধীনে কর্তব্য পালনের প্রভাব
৪। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সামরিক কার্যক্রম শুরুর পরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে করে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসন থমকে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় প্রদেশের প্রশাসন চালাবার ভারও ব্যাপকভাবে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায়। বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক কর্মকর্তাদের প্রাধান্য অপ্রতিহত গতিতে চলমান থাকে। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মােটামুটি বিপুলসংখ্যক বেসামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার জন্য আনার পরেও; এদের মধ্যে ছিলেন প্রধান সচিব, পুলিশের মহা পরিদর্শক এবং কমপক্ষে দুজন বিভাগীয় কমিশনার।
৫। জনাব এম এ কে চৌধুরী, পুলিশের মহাপরিদর্শক, (সাক্ষী নং ২১৯) এর মতে, “১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলের গােলযােগের পরে সেখানে ছিলেন একজন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার সামরিক গভর্নর, তার উপদেষ্টা ছিলেন একজন বেসামরিক প্রশাসক। সে সময়ে প্রতিটি স্তরেই সমান্তরালভাবে ছিল সামরিক আইনের প্রশাসন। উভয় প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রশাসন ছিল কার্যত সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ। একজন পশ্চিম পাকিস্তানি উপ-ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ। প্রাদেশিক হেডকোয়ার্টারে পুলিশের মহাপরিদর্শকের সাথে আলােচনা সভায় যােগদানের অনুমতি স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসকের নিকট থেকে পাননি।” সাঈদ আলমদার রাজার মতে (সাক্ষী নং ২২৬), ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকেও রুটিন মাফিক কার্যক্রমের জন্যও বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য সামরিক কর্মকর্তার সাধারণ পরিদর্শন ও কার্যক্রমের আওতার মধ্যে থাকতে হতাে। কিন্তু এর দ্বারা তেমন কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জিত হতাে না। বাঙালি কর্মকর্তা যাদেরকে সন্দেহ করা হতাে যে তারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নন; তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতাে। এমনকি তাদের বন্দি করা হতাে, অথচ কেউই তা জানতেন না। এমনকি তাদের উপরের কর্মকর্তা বা পূর্ব পাকিস্তানের সরকারও তা জানতে পারতেন না।
৬। বেসামরিক গভর্নর এবং তার দ্বারা নিয়ােগপ্রাপ্ত মন্ত্রীবর্গের ক্ষমতা গ্রহণের পরও বেসামরিক প্রশাসনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ শেষ হয়নি (যথা ডা. এএম মালেক)। এ বিষয়ে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর (সাক্ষী নং ২৮৪) বক্তব্য মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে বিধায় উদ্ধৃত করা হলাে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের সচিবালয়ে মেজর জেনারেল পদে নিয়ােগ প্রাপ্ত হন :
“বিদায়ী (সাবেক) প্রেসিডেন্টের ঘােষণা অনুযায়ী একটি পরিপূর্ণ বেসামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে গঠন করা হয়নি। একজন বয়ােবৃদ্ধ রাজনীতিক ডা. মালেক ছিলেন দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি কখনাে সামরিক আইন
২৫১
প্রশাসক লে. জে. এ এ কে নিয়াজীকে ঘাঁটাতে চাননি। এর কারণ এই যে, প্রদেশে তাঁর অবস্থান ছিল অস্থায়ী প্রকৃতির। অপরদিকে জেনারেল নিয়াজীর হাতে ছিল সর্বময় ক্ষমতা। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টি ও যােগ্যতা ছিল না বলে তিনি রাজনৈতিক বিষয়গুলাের গুরুত্ব উপলব্ধি করার যােগ্যতা রাখতেন না । বেসামরিক গভর্নরের প্রতি তিনি যথাযথ সম্মান দেখাতেন না… দৃশ্যত সামরিক বাহিনীই বেসামরিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন।”
৭। তৎকালীন সময়ে ঢাকায় কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তাদের মনােভাব ও উপলব্ধি সম্পর্কে সাবেক অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার জনাব মােহাম্মদ আসরাফ (সাক্ষী নং ২৭৫)-এর বিবরণ থেকে জানা যায়। তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেসামরিক গভর্নরের নিযুক্তি ছিল মূলত জনমতকে দেশে ও ভিনদেশে বিভ্রান্ত করা। নিঃস্ব ডা. মালেক এবং তাঁর মন্ত্রীবর্গ ছিলেন শশাভাবর্ধক হিসেবে নামমাত্র গভর্নর ও মন্ত্রীসভা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সত্যিকার সিদ্ধান্ত তখন পর্যন্ত দিতেন সেনাবাহিনী। আমি নতুন মন্ত্রীসভার প্রথম দিনের প্রতিচ্ছবি স্মরণ করি। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী সম্মানজনকভাবে দৃশ্যমান হয়ে গভর্নরের ডান পার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলে তিনি মন্ত্রী সভার কেহ-ই ছিলেন না।”
৮। এই মনােভাব আরও পাকাপােক্ত হয় তখন যখন পরবর্তী সময়ে দেখা গেল জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ঘােষিত উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী প্রধান ভূমিকায় নামলেন। লে. জেনারেল নিয়াজী এবং তার কিছু সংখ্যক অধীনস্ত সামরিক আইন প্রশাসককে বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়ােজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থায় সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের পরে সেনাবাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। তারা যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ব্যবসায় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যাদি চালুর ক্ষেত্রেও কাজ করতে থাকেন।
৯। ভারতে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক থাকার পর প্রত্যাবর্তনকৃত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের তথ্য-প্রমাণ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক আইনের অধীনে দায়িত্ব পালন এবং বেসামরিক প্রশাসনে অংশগ্রহণের ফলে তাদের পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতার ওপর দীর্ঘস্থায়ীভাবে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব রেখেছে। ব্রিগেডিয়ার এস সলিমুল্লাহ এর মতে (তিনি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ২০৩ (এ) ব্রিগেডিয়ার কমান্ডিং কর্মকর্তা ছিলেন দীর্ঘস্থায়ী সামরিক আইনের অধীনে কাজ করা এবং এর ফলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পেশাগত মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।” সাক্ষী নং ২৮৩ রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ (তিনি ছিলেন সে সময়ে পাকিস্তান নৌবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার ফ্ল্যাগ অফিসার কমান্ডিং-এর পদে) বলেন, “আমাদের পরাজয়ের শেকড় ১৯৫৮ সালের সঙ্গে প্রথিত- সে সময় সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেছিল… রাজনৈতিক কূটকৌশলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ধীরে ধীরে তারা সৈনিকসুলভ কলাকৌশল বাতিল করতে
২৫২
থাকেন। তারা সেইসঙ্গে সম্পদ ও মর্যাদার মতাে বিষয়গুলাে নিজেদের জন্য অন্যায়ভাবে দখল করতে থাকেন।” কমােডাের আই. এইচ মালিক প্রায় একই রকমের মনােভাব আমাদের সামনে তুলে ধরেন (সাক্ষী নং ২৭২)। তিনি আত্মসমর্পণের সময় পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে কর্মরত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার এস.এস.এ কাশেম, সাবেক আর্টিলারি কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড, কর্নেল মনসুরুল হক মালিক (সাবেক জিএসও-১, ৯ম ডিভিশনে, পূর্ব পাকিস্তান এবং কর্নেল ইজাজ আহমেদ (সাক্ষী নং ২৪৭) সাবেক কর্নেল স্টাফ (জিএস) ইস্টার্ন কমান্ডসহ আরও অনেকেই উপযুক্ত মনােভাব ব্যক্ত করেছেন।
১০। কমিশনের কাছে আসা নতুন নতুন তথ্য প্রমাণ আসলে আমাদের মূল প্রতিবেদনের উপসংহারকেই সমর্থন ও সমৃদ্ধ করেছে যাতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সামরিক আইনের অধীনে এবং বেসামরিক প্রশাসনে কাজ করতে গিয়ে দারুণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে তারা পেশাগত দায়িত্ব ও জ্ঞান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন। তাদের প্রশিক্ষণের মান নেমে যায়; যেখানে দৃষ্টি থাকে তাদের সেনা-ইউনিট সংশ্লিষ্ট জ্ঞান-গরিমা। খুবই সুস্পষ্ট কারণে তারা তাদের হাতে পেশাগত উৎকর্ষ ধরে রাখা বা তার উন্নতি বিধানের যথেষ্ট সময় পাননি। এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পেশাগত দক্ষতার প্রতি অনুরাগ ও প্রিহা হারিয়ে ফেলেন।

ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করার ফলশ্রুতি
১১। পূর্ব পাকিস্তানে ২৫ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা “ঝেটিয়ে বিদায় করা
(সুইপ অপারেশন)” কার্যক্রমের ফলে নতুন করে সেখানে পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে। ওঠে। এই সামরিক কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল সমগ্র প্রদেশব্যাপী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী তৎপরতাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সেনাবাহিনীকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতে হতাে, কিন্তু সেখানে থাকা-খাওয়ার মতাে ব্যবস্থা না করেই। ফলে বিশেষ করে কার্যক্রম শুরুর প্রথম প্রথম খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রীর সরাহ বেসামরিক উৎস থেকেই সংগ্রহ করতে হতাে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অভ্যাস চলতেই থাকে। এমনকি যখন থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত সামরিক বাহিনীর সরবরাহ দ্বারা পূরণ করা সম্ভব ছিল; তখনও। এমন নজিরও সেখানে রয়েছে। বেসামরিক লােকজনের দোকানপাট ভেঙে খুলে সেখান থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মালামাল নিয়েছেন। কিন্তু কোন্ কোন্ পণ্য কী পরিমাণ নিলেন তার কোনাে খতিয়ান বা তালিকা না রেখেই। প্রয়ােজনের তাগিদে জরুরি পরিস্থিতিতে যানবাহন, খাদ্য, ঔষধ এবং অন্যান্য সামগ্রী জোরপূর্বক সংগ্রহ করা সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে গ্রহণযােগ্য কাজ। তবে এটি করতে হবে সুষ্ঠুভাবে, অর্থাৎ হিসাব রেখে, যাতে করে পরবর্তীতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়। যেহেতু এ ধরনের কোনাে পদ্ধতি বা কর্মধারা মাফিক কাজ করা হয়নি; সেহেতু সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক এমনকি কর্মকর্তাদের মনে এ ধরনের ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, তারা সেখান থেকে যা কিছু প্রয়ােজন তা সগ্রহ করার অধিকার রাখেন। এর ফলে আমাদের মনে হয়েছে এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত সেনাসদস্যদের দ্বারা লুটপাটের মতাে ঘটনার উৎপত্তি হয়েছিল।
২৫৩
১২। অভিযানের প্রারম্ভে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা ও কমান্ডারদের দ্বারা উৎসাহ প্রাপ্ত হয়েছিল। এর মধ্যে লে. জেনারেল নিয়াজীও ছিলেন। জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে কমান্ড গ্রহণের প্রথম দিনেই এ সম্পর্কিত তার কথাবার্তা আমরা ইতােমধ্যে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি, যেমন- “রেশন স্বল্পতার কী কথা আমি শুনতে পেয়েছি? এ দেশে; সেখানে কী কোনাে গােরু, ছাগল নেই? এটি হলাে শত্রুর ভূখণ্ড। যা চাই তা সংগ্রহ করুন। বার্মায় আমরা এভাবে সংগ্রহ করতাম।” (মেজর জেনারেল ফরমান আলী এভাবেই সাক্ষ্য দিয়েছেন)। লে. জেনারেল নিয়াজী অবশ্য এটি অস্বীকার করে বলেন যে, “না সেভাবে নয় বরং একটি চিরকুট দেওয়া হতাে এবং যাতে করে বেসামরিক সরকার তার ক্ষতিপূরণ পরিশােধ করতে পারেন।” এই ভাষ্যটি অন্যান্য কর্মকর্তাদের দ্বারা সমর্থিত হয়নি। বিপরীতভাবে, কতিপয় কর্মকর্তা যেমন লে. কর্নেল বােখারী (সাক্ষী নং ২৪৪) একটি ইতিবাচক বর্ণনা দেন এবং বলেন ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ হতে লিখিত নির্দেশ দিয়ে ঝেটিয়ে বিদায় করার মতাে সেনা-কর্মকাণ্ডের বেলায় বলা হয় ভূখণ্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করুন এবং সেভাবে টিকে থাকুন।
১৩। অবশ্য একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ইস্টার্ন কমান্ড এবং বিভাগীয় কমান্ডারগণ একটি কঠোর নির্দেশনা দেন যাতে করে এই কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হয়। কোনাে কোনাে কমান্ডার সেনা-ব্যারাকে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করেন; যাতে করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক লুট করে আনা টেলিভিশন সেট, ফ্রিজ, টাইপরাইটার, ঘড়ি, স্বর্ণ, এয়ারকন্ডিশনার এবং অন্যান্য লােভনীয় পণ্য পাওয়া যায়। আমাদের জানানাে হয়েছিল বেশ কিছু ঘটনায় শৃঙ্খলা কমিটি দ্বারা অনুসন্ধানপূর্বক ‘কেইস’ এর সূত্রপাত করা হয়। কিন্তু এসব ‘কেইস’-এর মীমাংসা হওয়ার আগেই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে যায় ।

পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত কর্মকর্তাদের তীব্র নৈতিকতা হীনতার মতাে ঘটনাবলি। (১) লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী
১৪। আমাদের মূল প্রতিবেদনে আমরা জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) খুদাদাত খান, লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, মেজর জেনারেল জাহানজেব এবং ব্রিগেডিয়ার হায়াতউল্লাহর ব্যক্তিগত নৈতিক স্খলনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ এবং সে সম্পর্কিত প্রমাণাদি উল্লেখ করেছিলাম।
১৫। মূল প্রতিবেদনের মনােযােগ সহকারে তৈরি করা ৩০ থেকে ৩৪ অনুচ্ছেদ, অধ্যায় ১ এর অংশ ৫ পাঠপূর্বক দেখা যাবে যে লে. জেনারেল নিয়াজী’র বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাে হলাে : যেমন তিনি শিয়ালকোট এ জিওসি হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে সামরিক আইনসংক্রান্ত কেইসসমূহ থেকে প্রচুর টাকা বানিয়েছেন, এবং পরবর্তী সময়ে লাহােরে জিওসি পদে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। লাহাের-এর মিসেস সায়েদা বােখারী গুলবাগ-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং তিনি সিনােরিতা হােম’
২৫৪
নামে একটি বেশ্যালয় চালাতেন। উপরন্তু তিনি জেনারেলের দালাল হিসেবে ঘুষের টাকা সংগ্রহ করতেন এবং সেমত কাজ করে দিতেন। এছাড়াও তিনি শামীম ফেরদাউস নামের শিয়ালকোটের এক মহিলার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনিও লাহােরের মিসেস সাইদা বােখারীর মতাে কাজ করতেন। পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করতে এসে তিনি তার চরিত্রের ওপর দুর্গন্ধ ছড়ানাের মতাে কাজ করতেন খারাপ রমণীদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে। তিনি। তার অধিনস্ত কনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে, বিভিন্ন স্থানে নিশাচরের মতাে অনৈতিক কাজ করতেন। তাছাড়াও তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে। পান (Pan) চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কমিশনের সামনে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযােগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাইয়ুম আরিফ (সাক্ষী নং ৬), মনােয়ার হােসাইন, শিয়ালকোটের উকিল (সাক্ষী নং ১৩), আব্দুল হাফিজ কারদার (সাক্ষী নং ২৫), মেজর সাজ্জাদুল হক (সাক্ষী নং ১৬৪), স্কোয়াড্রন লিডার সি.এ ওয়অহিদ (সাক্ষী নং ৫৭) এবং লে. কর্নেল হাফিজ আহমাদ (সাক্ষী নং ১৪৭)।
১৬। আমাদের তদন্তের এই স্তরে এসে জেনারেল নিয়াজীর যৌনকর্ম সম্পর্কিত খারাপ এবং ক্ষতিকারক প্রমাণ ও রেকর্ড আসতে থাকে। সেসঙ্গে পান চোরাচালানী সম্পর্কিত প্রমাণাদি পাওয়া যেতে থাকে। এ বিষয়ে লে. কর্নেল মনসুরুল হক (সাক্ষী নং ২৬০), সাবেক জিএসও-১, ৯ম ডিভিশন, লে. কর্নেল এএ খান (সাক্ষী নং ২৬২) পাকিস্তানি নৌবাহিনী, ব্রিগেডিয়ার আই আর শরীফ (সাক্ষী নং ২৬৯), সাবেক কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ারিং ইস্টার্ন কমান্ড, জনাব মােহাম্মদ আশরাফ (সাক্ষী নং ২৭৫), সাবেক এডিডিআই ডিসি, ঢাকা এবং লে. কর্নেল আজিজ আহম্মদ খান (সাক্ষী নং ২৭৬) সাক্ষ্য প্রদান করেন।
১৭। মেজর জেনারেল কাজী মজিদ খান (সাক্ষী নং ২৫৪) এবং মেজর জেনারেল ফরমান আলী (সাক্ষী নং ২৮৪) জেনারেল নিয়াজীর পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পান রপ্তানির বিষয়ে কথা বলেন। মেজর জেনারেল আব্দুল মজিদের মতে, ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজী, কমান্ডার ৫৩ ব্রিগেড এবং জ্যেষ্ঠ পুলিশ পরিদর্শক দিলজান, উভয়ই নিয়াজীর সঙ্গে ঢাকার ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে বসবাস করতেন। তারা দুজনই নিয়াজীর পান রপ্তানির কাজে সহযােগিতা করতেন। মেজর জেনারেল ফরমান আলী আরও একটু বেশি করে বলেন, “জেনারেল নিয়াজী আমার প্রতি রাগান্বিত ছিলেন, কারণ আমি তার পান ব্যবসায় সহযােগিতা করিনি। পিআইএ’র ব্রিগেডিয়ার হামিদউদ্দিন আমার কাছে অভিযােগ করে বলেন যে, কর্পস হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে পান পরিবহণের বেলায় হস্তক্ষেপ করত। সে ক্ষেত্রে শুল্ক বিষয়ক সীমাবদ্ধতা পরিহার করা হতাে।” আমি জেনারেল নিয়াজীর এডিসিকে বলেছিলাম (যখন তিনি আমার অফিসে এসেছিলেন) যে, “এটি একটি ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় এবং পিআইএ ও পান ব্যবসায়ীদের মধ্যেকার ধারা মােতাবেক তা চলা উচিত।” আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, জেনারেল নিয়াজীর এক পুত্র সন্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পান রপ্তানির ব্যবসায় নিয়ােজিত ছিলেন। মেজর এসএম হায়দার
২৫৫
(সাক্ষী নং ২৫৯) এবং ব্রিগেডিয়ার আতা মােহাম্মদ (সাক্ষী নং ২৫৭) বলেন এমনকি ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী, চীফ অব স্টাফ ইস্টার্ন কমান্ড, পান রপ্তানির ক্ষেত্রে জেনারেল নিয়াজীর অংশীদার ছিলেন।
১৮। পূর্ববর্তী অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে উল্লিখিত অভিযোেগ সম্পর্কে আমরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম; যখন তিনি আমাদের সামনে এসেছিলেন। তিনি স্বাভাবিকভাবেই এ সকল অভিযােগ অস্বীকার করেন। যখন আমরা যৌনতার প্রতি তাঁর দুর্বলতার কথা জিজ্ঞাসা করি তখন তিনি উত্তর দেন, “আমি বলব না। আমি সামরিক আইনের অধীনে দায়িত্ব পালন করতাম। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি তাঁকে থামাতে পারতাম না। পূর্ব পাকিস্তানে গােলযােগের সময় আমি খুবই ধার্মীক হয়ে পড়েছিলাম। এর আগে আমি তেমন ধার্মীক ছিলাম না। এসব বিষয় আশয় নিয়ে ভাববার চাইতে আমি মৃত্যু নিয়ে বেশি ভাবতাম।”
১৯। পান রপ্তানির অভিযােগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন বিষয়টি তদন্ত করার জন্য আমি একটি কমিটি গঠন করি। এ সম্পর্কে অভিযােগ এনেছিলেন ভূঁইয়া নামে একজন লােক যিনি পান রপ্তানির ক্ষেত্রে একচেটিয়াত্ব কায়েম করেছিলেন। তিনি উল্টো অভিযােগ করে বলেন, বাস্তবে ব্রিগেডিয়ার হামিদ উদ্দিন এবং পিআইএ নিজেরাই পান চোরাচালানী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২০। বেসামরিক ও সামরিক উভয় শ্রেণির সাক্ষ্য থেকে আসা অনেক প্রমাণাদি কমিশনের সামনে চলে আসে। এসব থেকে খুব সামান্য সন্দেহই বলা যায় জেনারেল নিয়াজী দুর্ভাগ্যজনকভাবে যৌন বিষয়ে দুর্নাম অর্জন করেছিলেন। তার এই বদনাম শিয়ালকোট, লাহাের এবং পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় এক পর্যায়েই রয়ে গিয়েছিল। ইস্টার্ন কমান্ড-এর অবস্থান এবং আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের পদমর্যাদার অপব্যবহার করে পান রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত হওয়ার অভিযােগও তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে শক্ত ভিত্তি অর্জন করে। অবশ্য এ সকল বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত। করা আমাদের কাজ নয়। সরকার ইচ্ছা করলে এ সম্পর্কে তদন্ত কমিটি গঠন করে চূড়ান্তভাবে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

(২) মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদ, সাবেক জিওসি, ৩৬(এ) ডিভিশন, পূর্ব পাকিস্তান
২১। ইস্টার্ন কমান্ডের অধীন ডিডিএমআই পদে নিয়ােজিত ছিলেন এমন কর্নেল বসির আহমাদ খান (সাক্ষী নং ২৬৩), কমিশনের সামনে বলেন যে, মেজর জেনারেল জামশেদ খানের স্ত্রী কিছু টাকা নিয়ে আসে যখন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। তিনি আরও বলেন লে. কর্নেল রশীদ, কর্নেল স্টার্ফ অব দা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস, মেজর জেনারেল জামশেদ খানের দ্বারা হুকুমপ্রাপ্ত হয়ে টাকা সংক্রান্ত অপকর্মের কাজে নিয়ােজিত হয়েছিলেন। আমাদের কাছে এমন কিছু গােচরীভূত হয়েছে যে, জেনারেল ১৫ অথবা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, হেলিকপ্টার যােগে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগকারী কিছু লােকের মধ্যে টাকা বিতরণ করেন।
২২। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলে মেজর জেনারেল জামশেদ খান বলেন : “সমগ্র টাকার পরিমাণ ছিল ৫০,০০০ টাকা। এই টাকা আমি সরকারের
২৫৬
নির্দেশ মােতাবেক উঠিয়েছিলাম যা নষ্ট করার কথা ছিল। তারপর এই পুরাে টাকা আমি নিয়মকানুন কঠোরভাবে পালন করেই কর্মকর্তা, বিহারি, বাঙালি, খবর প্রদানকারী এবং টাকার প্রয়ােজন ছিল; এমন মানুষদের মধ্যে ১৫/১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বিতরণ করি। সরকার একটি গােপন ফান্ড আমাকে দিয়েছিলেন যার মাধ্যমে খবর বার্তা ক্রয়, পুরস্কার প্রদানের কাজ সমাধা করা হতাে। এই ফান্ড ছিল হিসাব বহির্ভূত (অডিট বহির্ভূত)। যেসব পরিবার ১৫/১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হেলিকপ্টারযােগে চলে আসছিলেন তাদের অনেকেরই টাকার প্রয়ােজন ছিল, তাদের টাকা দেওয়া হয়েছিল ইপিসিএএফ-এর ডাইরেক্টর জেনারেলের ফান্ড থেকে। এ অর্থ বরাদ্দ করার একক কর্তৃত্ব ছিল আমার । অবস্থা বিবেচনা করে আমি উল্লিখিত টাকা খরচ করেছি। সেই টাকা পুনরায় উদ্ধার করার কোনাে অভিপ্রায় আমার ছিল না। উপরে উল্লিখিত ব্যাখ্যা মােতাবেক এখানে এ বিষয়ে আর কোনাে প্রকারের প্রয়ােজন নেই যার মাধ্যমে এই খবর পত্রাদির বিস্তারিত বিবরণ ও হিসাব পাওয়া যেতে পারে।”
২৩। আমরা অনুতপ্ত হচ্ছি মেজর জেনারেল জামশেদের জবাব শ্রবণ করে এবং সেইসঙ্গে বলছি তার জবাব সন্তোষজনক নয়। তার দ্বারা উত্তোলিত এবং বিতরণকৃত ফান্ড’ যদিও তা সাধারণ অবস্থায় অডিটযােগ্য ছিল না, তবুও এটি প্রশংসনীয় বলে গণ্য হতাে যদি তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতেন। কেননা, বিলি-বণ্টন নিয়ে পরবর্তীতে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে এবং তৎপর যুদ্ধবন্দিদের ক্যাম্পে। আমাদের উপদেশ হলাে দ্বিধাদ্বন্দ্বের বেড়াজাল হতে মুক্ত হওয়ার জন্য; এমনকি জেনারেলের নিজের স্বার্থেই এ বিষয়ে পুনরায় তদন্ত হতে পারে।
(৩) ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার, সাবেক কমান্ডার ৫৭ ব্রিগেড।
(8) লে. কর্নেল (এখন ব্রিগেডিয়ার) মুজাফর আলী খান, আলী খান জাহিদ, সাবেক সিও ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট।
(৫) লে. কর্নেল বাসারাত আহমেদ, সাবেক সিও ১৮ পাঞ্জাব।
(৬) লে. কর্নেল মােহাম্মদ তাজ, সিও ৩২ পাঞ্জাব।
(৭) লে. কর্নেল মােহাম্মদ তােফায়েল, সিও ৫৫ ফিল্ড রেজিমেন্ট।
(৮) মেজর মাদাদ হােসাইন শাহ্, ১৮ পাঞ্জাব।
২৪। মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ-এর প্রমাণ (সাক্ষী নং ২৪২), জিওসি, ১৬ ডিভিশন, মেজর জেনারেল এমএইচ আনসারী (সাক্ষী নং ২৩৩), জিওসি ৯ ডিভিশন, সেইসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী (সাক্ষী নং ২১৮), চীফ অব স্টাফ, ইস্টার্ন কমান্ড, প্রকাশ করেন যে এসকল কর্মকর্তাদের ইউনিট ব্যাপক লুটপাট এবং তার সঙ্গে সিরাজগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংকের ট্রেজারির ১,৩৫,০০০ টাকা চুরির সঙ্গে উপরে উল্লিখিত সকল কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। পাশী সেতু দিয়ে পাড় হওয়ার সময় এই টাকা জেসিও কর্তৃক পাকড়াওকৃত হয়। একটি ট্রাকের নিমাংশের মধ্যে লুকিয়ে তা বহন করা হচ্ছিল। ট্রাকের চালক একটি চিরকুট দেখান যাতে লেখা ছিল “এই টাকা মেজর মামাদ কর্তৃক প্রেরিত।”
২৫৭
আমাদের জানানাে হয় যে, একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় যার চেয়ারম্যান ছিলেন। মেজর জেনারেল এমএইচ আনসারী। তিনি কিছু প্রমাণাদি নথিভুক্ত করেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তিনি তদন্ত কাজ শেষ করতে পারেননি।
২৫। জিএইচকিউ প্রতিনিধি আমাদের জানাতে পারেননি যে, চূড়ান্তভাবে জিএইচকিউ কর্তৃক কী ধরনের ব্যবস্থা উল্লিখিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবারকে একটি ডিভিশনের প্রধান হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। কমিশন মনে করে তদন্ত চলাকালীন সময়ে বা অভিযােগ থেকে অব্যাহতি না পাওয়া অবধি জিএইচকিউ কর্তৃক এ ধরনের নিয়ােগ গ্রহণযােগ্য নয়। আমরা সুপারিশ করেছি কালবিলম্ব না করে অবিলম্বে মেজর জেনারেল আনসারীর নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের কাজ সমাপ্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হােক। এটি করার জন্য নথিপত্রাদি পুনর্গঠনে কোনাে সমস্যা হবে না। সাক্ষী কর্তৃক উপস্থাপিত বস্তুগত বিষয়াদী এখনও পাকিস্তানে রয়েছে প্রয়ােজনবােধে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
২৬। এই অধ্যায়ের উপসংহার টানার আগে আমরা বলতে চাই; জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডারদের নৈতিকতা বিরােধী কাজকর্মে অংশগ্রহণ এবং অসততার বিরুদ্ধে আনিত অভিযােগের তদন্ত করার মতাে কাজ আমরা করতে চাই না; কিন্তু এসব বিষয়গুলাে তদন্ত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাফিক সুরাহা করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুপ্রাণিত করছি। কেননা, এসব কুৎসিত কাজকর্ম প্রকারান্তরে সরাসরিভাবে সেনা-কমান্ডারদের নেতৃত্বের মানের সঙ্গে সংযুক্ত; যা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত সত্য এবং অবশ্যই তা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমান্ডারদের কাজের মানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। আমরা দুঃখ ও পরিতাপের সাথে দেখতে পেয়েছি যে, এ সকল কাজ যুদ্ধের মানকে দারুণভাবে অবনতিশীল করে তুলেছিল। তাই, এটি স্বাভাবিকভাবেই সরকারের ওপর বর্তায় যে, সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করবে। ফলে পাকিস্তানের মুসলমান সেনাবাহিনী উচ্চমাত্রার নৈতিক মান ও ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে উদ্ধারপূর্বক নিজেদের নিয়ে গর্ববােধ করতে পারবে।
২৫৮

৫৮
কতিপয় জ্যেষ্ঠ সেনা কমান্ডারদের
ব্যক্তিগত দায়ভার

কমিশনের মূল প্রতিবেদনের পঞ্চম অংশের অধ্যায় ৩ এবং ৪-এ আমরা নৈতিক স্খলন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘটনা সম্পর্কে আলােচনা করেছি যাতে কার্যত ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা যায়। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব সম্পর্কেও আলােকপাত করেছি। এই সম্পূরক প্রতিবেদনের পরবর্তী দুটি অধ্যায়ে আমরা আরও কিছু অতিরিক্ত বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করব এবং পূর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত ছিলেন; এমন কিছুসংখ্যক সেনা কর্মকর্তার কার্যকলাপের প্রতি মন্তব্য প্রকাশ করব। সেখানে এখনও এই প্রশ্নের বিষয়টি রয়ে যায় কিছুসংখ্যক জ্যেষ্ঠ সেনা-কমান্ডারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল কি না যারা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁদের পেশাগত সামরিক কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ধরন।
২। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত কিছু সংখ্যক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার তীব্র মাত্রার দুর্বলতা এবং কর্তব্য কাজের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের কারণে আমরা উৎকণ্ঠার সঙ্গে ঐসব ক্ষেত্রে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রকৃতি বিবেচনা করি। আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৫২ সালে প্রণীত পাকিস্তান সেনা আইনে এ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারা রয়েছে। সে ধারাগুলাে এসব। ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়ােগযােগ্য। প্রথমত, সেই আইনের ২৪ অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ :
“২৪। শত্রুপক্ষ সম্পর্কিত অপরাধ এবং তার মৃত্যুদণ্ডতুল্য শাস্তি। যে কেউ এই অপরাধে অপরাধী হতে পারেন, যিনি নিম্নলিখিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হন, যেমন-
(ক) লজ্জাজনকভাবে যদি কেউ কোনাে গ্যারিসন, দুর্গ, বিমানবন্দর, স্থান, পদ অথবা পাহারা পরিত্যাগ করেন যেখানে তার কর্তব্যস্থান- যেখান থেকে তিনি কর্তব্য পালন বা প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত। অথবা, যদি কেউ তার কমান্ডিং কর্মকর্তাকে যেকোনােভাবে বাধ্য করেন বা তাকে অনুপ্রাণিত করেন কর্তব্য বা কর্তব্য স্থান। পরিত্যাগ করতে; তাহলে এই আইন তার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে; অথবা,
(খ) শত্রুপক্ষের উপস্থিতিতে লজ্জাজনকভাবে কেউ যদি তার বন্দুক/হাতিয়ার, গুলি, যন্ত্রপাতি শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেন, অথবা এমন অসদাচরণ করেন যাতে মনে হবে যে সে কাপুরুষ; অথবা,
(গ) ইচ্ছাপূর্বকভাবে এমন ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করেন অথবা, যেকোনােভাবে কাউকে বাধ্য বা প্ররােচিত করেন; তাহলে এই আইনের অথবা ভারতীয়
২৫৯
বিমানবাহিনী আইন ১৯৩২ (১৪) অথবা পাকিস্তান বিমানবাহিনী আইন ১৯৫৩ অথবা ১৯৬১ সালের পাকিস্তান নৌবাহিনী অধ্যাদেশে উল্লিখিত কেউ শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করতে বিরত থাকে; অথবা, কাউকে শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করেন; অথবা,
(ঘ) প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কেউ যদি গােয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ বা খবর আদান-প্রদান করেন, অথবা, কেউ যদি এ ধরনের কাজের জন্য কর্তৃপক্ষের নজরে আসেন, অথবা, প্রতারণামূলক তৎপরতা তার কমান্ডিং অথবা, অন্য কোনাে উপরস্থ কর্মকর্তার নজর এড়িয়ে যায়; অথবা,
(ঙ) প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে শত্রুদের অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, যন্ত্রপাতি, সরবরাহ অথবা টাকা-পয়সা বহন অথবা জেনেশুনে যুদ্ধবন্দি ব্যতীত শত্রুকে আশ্রয় দান বা সুরক্ষা দেওয়া; অথবা,
(চ) প্রতারণামূলকভাবে অথবা, কাপুরুষােচিতভাবে শত্রুপক্ষকে পতাকা প্রেরণের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা করেন; অথবা, (ছ) যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অথবা, যেকোনাে সেনা অভিযান কর্মকাণ্ড চলার সময়ে ইচ্ছাপূর্বকভাবে মিথ্যা বিপদসংকেত সৃষ্টি করেন; অথবা,
(জ) কর্মকাণ্ড চলাকালীন সময়ে কমান্ড কর্মকর্তাকে ত্যাগ করা, অথবা পদ থেকে ভেগে যাওয়া, পাহারা, পিকেট, নিরাপত্তা বিধানের জন্য পরিক্রমণ (প্যাট্রোল) অথবা দলত্যাগ করা অব্যাহতি কিংবা ছুটি ব্যতীত; অথবা,
(ঝ) যুদ্ধবন্দি হিসেবে স্বেচ্ছায় শত্রুর পক্ষ হয়ে কাজ করা বা শত্রুপক্ষকে সহায়তা করা; অথবা,
(ঞ) সক্রিয়ভাবে চাকরিতে থাকাকালীন সময়ে যেকোনাে কাজের মাধ্যমে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী অথবা যেকোনাে বাহিনী যা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সহযােগী অথবা, এই বাহিনীর কোনাে অংশের সফলতার বিপক্ষে পরিকল্পিত কোনাে কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং সামরিক আদালতে তার বিচার হবেপ্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা আইন ও বিধি অনুসারে তার নিমমাত্রিক শাস্তি দেওয়া হবে।”
৩। এই আইনে অনুচ্ছেদ ২৫ প্রাসঙ্গিক এবং তা নিম্নলিখিতভাবে পঠিত হবে :
“২৫। শত্রু সম্পর্কিত অপরাধ; তবে তা মৃত্যুদণ্ডযােগ্য নয়। যে কেউ এই আইনের আওতাধীন যিনি সক্রিয়ভাবে চাকরিরত :
(ক) পদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশ ব্যতীত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বন্দিদের নিশ্চিতকরণ, পশু অথবা মালামাল রক্ষা করা অথবা আহত ব্যক্তির দেখভাল করা; অথবা,
(খ) পদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশ ছাড়াই স্বেচ্ছাকৃতভাবে সম্পত্তির ক্ষতিসাধন বা তা ধ্বংস করা; অথবা,
(গ) বিচারের জন্য অপেক্ষয়মান বন্দিকে সরিয়ে নেওয়া, অথবা আদেশ অমান্য করা
অথবা স্বেচ্ছাকৃতভাবে কর্তব্য কাজে অবহেলা করা, অথবা বন্দিকে সরিয়ে নেওয়া এবং সেই কাজ করার সময়ে কাজে যােগদানে ব্যর্থতা; অথবা,
(ঘ) যথাযথ কর্তৃত্বপ্রাপ্ত না হয়ে, কোনাে প্রকার লিখিত যােগাযােগ স্থাপন, অথবা গােয়েন্দা যােগাযােগ অথবা শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ফ্লাগ প্রদান; অথবা,
২৬০
(ঙ) মৌখিক বাক্যে অথবা লিখিতভাবে, অথবা সংকেতের সাহায্যে সমীকরণকৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করা, অথবা বিপদসংকেত দেওয়া; অথবা নৈরাশ্য ভাব প্রকাশ করা; অথবা,
(চ) কাজে অথবা পূর্বের কোনাে কাজে, বাক্য এমনভাবে তৈরি করা যার মাধ্যমে বিপদসংকেত; অথবা নৈরাশ্য প্রকাশ পেয়েছে, এর ফলস্বরূপ সামরিক আদালতের মুখােমুখি হতে হবে, এর সর্বোচ্চ শাস্তি হলাে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, অথবা তার কম সাজা-শাস্তি যা এই আইনের বিধানে স্থির করা হবে।”
৪। চূড়ান্তভাবে, এখানে রয়েছে ৫৫ ধারা, যা কি না সাধারণ ধরনের, যেমন-
“৫৫। উত্তম নির্দেশ ও নিয়ম ভঙ্গ করা: যেকোনাে সামরিক ব্যক্তি এই আইনের ধারায় অপরাধী বলে গণ্য হবেন যদি তিনি কোনাে কাজে অসমর্থ, অবহেলার মাধ্যমে সামরিক সংস্কৃতির উত্তম বিষয়াদি লঙ্ঘন করেন। এমতাবস্থায় তার বিরুদ্ধে সামরিক আদালত গঠিত হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ৫ বছরের কারাদণ্ড, অথবা তার কম সময়ের জন্য শাস্তি বিবেচিত হবে যা এই আইনের মাধ্যমে স্থিরকৃত হয়।”
৫। আমরা পরিপূর্ণভাবে স্বজ্ঞাত যে, যুদ্ধে পরাজিত হওয়া, এমনকি আত্মসমর্পণ ততক্ষণ পর্যন্ত শাস্তিযােগ্য অপরাধ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশ্লিষ্ট কমান্ডারের কর্তব্য অবহেলা, বিশেষ করে শত্রুপক্ষের অভিপ্রায়, শক্তি, নিজেদের শক্তি-সামর্থ, ভূখণ্ড ইত্যাদি পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝার অক্ষমতা হিসেবে প্রকাশিত হয়। অথবা যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা; অথবা পরিস্থিতি বুঝে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বেলায় ইচ্ছাকৃত অনীহা। স্বীকৃত যুদ্ধরীতি সম্পর্কে অকর্মণ্যতা, অবহেলা এবং যা কি না সৎ মনােভাবের ভুল। বলে চালিয়ে দেওয়ার মতাে অপরাধ । যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা ও প্রতিরােধের ব্যর্থতা। বিশেষ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা সময়মতাে নির্দেশিত না হয়েও পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট অবস্থা মােকাবিলার জন্য আশ্রয় গ্রহণ না করা ইত্যাদিও এ অপরাধের আওতার মধ্যে পড়ে। আমাদের নিকট আরও প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিজন কমান্ডারের জ্ঞানগরিমা এবং গুণ ও মান ধারণ করতে হয়; তা না হলে এটি যুদ্ধে পরাজয়কে এগিয়ে আনে। তাঁকে বাতিল করা এবং গ্রহণ করার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হয়। অর্থাৎ যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার মতাে বিচার-বুদ্ধি, ক্ষমতা ও দক্ষতা থাকা প্রয়ােজন এর ব্যতীক্রমের অর্থ হলাে কর্তব্য অবহেলা এবং তা অনিচ্ছাকৃত ভুল ও তার নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরের সঙ্গে পার্থক্যসূচিত করে থাকে। তিনি শাস্তির আওতায় আসবেন, যদি তিনি যুদ্ধের প্রতি অনিচ্ছা দেখান এবং যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও সরঞ্জামাদি থাকার পরও প্রতিরােধ না করে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেন। এ ধরনের আইন ধারা।
(ক) অংশ ২৪ পাকিস্তান সেনা আইনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে।

বিচার এবং শাস্তির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা
৬। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ সাক্ষীর মতামত শ্রবণপূর্বক কমিশন অনুভব করে যে, সকলের মধ্যে এমন একটি মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছে যে, পাকিস্তানের অপমান ও পরাজয়ের পশ্চাতে রয়েছে জ্যেষ্ঠ সেনা-কমান্ডারদের পেশাগত যােগ্যতাহীনতা, শাস্তিযােগ্য অবহেলা, দায়িত্ব পালনের
২৬১
বেলায় ইচ্ছাকৃত অনীহা, শারীরিক ও নৈতিকভাবে কাপুরুষােচিত মনােভাব- যার দরুন সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তারা শত্রুপক্ষকে প্রতিরােধ করা থেকে বিরত থাকেন এবং যুদ্ধ বাতিল করেন। আমরা আরও অভিমত পােষণ করছি যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যে লজ্জাজনক পরাজয় ও অবনতিশীল পারদর্শিকতা প্রদর্শিত হয়েছে; যাতে তার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে সেজন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেবলমাত্র চাকরি থেকে অবসর প্রদান করাই নয়; সেইসঙ্গে আরও কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দরকার রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এ ধরনের কর্মকাণ্ড (বিচার ও শাস্তি) জাতির প্রত্যাশা পূরণ করবে (কেননা জাতি এর বিচার ও শাস্তি চায়)। সেইসঙ্গে তা পেশাগত জবাবদিহিতার ওপর জোর দেওয়ার পরিবেশ প্রস্তুত করবে- যা কি না দৃশ্যত মনে হচ্ছে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছেবিশেষ করে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে- কেননা, তারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। আত্মমগ্ন হয়েছেন বেসামরিক ও সামরিক আইনের অধীনে কাজ করার মধ্যে।

সামরিক আদালতের মাধ্যমে কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা
৭। বর্তমান প্রতিবেদনের ৩ অংশে, আমরা লে. জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলােচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছি। সেইসঙ্গে এটিও আলােচিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে যে, তৎকালীন সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজিত সম্পদ ও সুযােগ-সুবিধার আওতায় তিনি এবং তাঁর বিভাগীয় ও ব্রিগেড কমান্ডারগণ বাস্তবায়নের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তারপরে আমরা আত্মসমর্পণের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলাে বর্ণনা করেছি, বিশেষ করে সুরক্ষিত শক্ত ঘাঁটি এবং দুর্গে- যেখানে যুদ্ধ ব্যতীতই অপমানজনক ঘটনা ঘটেছিল। দায়িত্বে থাকা অঞ্চল থেকে একজন বিভাগীয় কমান্ডারের পলায়ন, ব্রিগেডে ও ব্যাটালিয়নের সংহতি ভেঙে যাওয়া, গোঁড়ামি ও বােকামির মতাে কাজের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, যুদ্ধাহত ও অসুস্থদের ত্যাগ করে চলে আসা- এ সবই মানবিক ও সামরিক মূল্যবােধের গুরুতর ব্যত্যয়। ভারতের সঙ্গে সর্বশক্তি নিয়ােগসম্পন্ন যুদ্ধে এবং বিশেষ করে ঢাকার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে, আমরা দেখেছি ইস্টার্ন কমান্ড কীভাবে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে যেখানে ঢাকা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে লৌহখিলান। এরপরে আমরা আত্মসমর্পণের মতাে বেদনাদায়ক ঘটনার পটভূমিসহ বর্ণনা দিয়েছি। এর ভিতর দিয়ে আমরা প্রচুর সংখ্যক মানুষ ও সম্পদ ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি সেই সময়ে যখন কি না যেকোনাে হিসাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আরও দুই সপ্তাহ বা তার অধিককাল। ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম ছিল। এমতাবস্থায়, জানাচ্ছি যে, অব্যাখ্যাত এমন এক নির্দেশ ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক দেওয়া হলাে; যার মাধ্যমে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র বিধ্বংস করা হলাে এবং তা করা হলাে আত্মসমর্পণের আগেই। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের আত্মসমর্পণের আচার-অনুষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরে ভারতীয় জেনারেলদের উপস্থিতিতে নির্লজ্জ আচরণ ও মনােভাব খুবই বেদনাদায়ক ও
২৬২
অপমানজনিত ঘটনা। চূড়ান্তভাবে আমরা অবলােকন করেছি যে জব্বলপুরে আটক থাকা অবস্থায় (ভারতে) লে. জেনারেল নিয়াজী তাঁর নিম্নপদস্থ কমান্ডারদের ওপর ভয়ভীতির দ্বারা রাজি করাতে চেষ্টা করেছেন যেন তারা সাজানাে বাহিনী উপস্থাপন ও সমন্বিত করে যুদ্ধে পরাজয়ে তার দায়িত্বের বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন।
৮। উল্লিখিত বিশ্লেষণের আলােকে বিচার করলে দেখা যায়, যে সব ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের পথের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা মােতাবেক, নিম্নলিখিত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায় এবং সেজন্য তাদেরকে সামরিক আদালতের মুখােমুখি দাঁড় করানাের জন্য আমরা সুপারিশ করছি।

লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড
(ক) তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে ভারতের সঙ্গে আসন্ন সর্বশক্তি নিয়ােগসম্পন্ন যুদ্ধের বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। যাবতীয় লক্ষণসমূহ দেখেও বিপরীতে যেমন- ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতাদের ঘােষণা, ভারত-সােভিয়েত চুক্তি (আগস্ট ১৯৭১) ভারতে ৮ ডিভিশন সৈন্য পুঞ্জিভূতকরণ, ভারতের ১১ স্কোয়ার্ডন। বিমানবাহিনী প্রস্তুত করা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ঘিরে ভারতের বিপুল সংখ্যক নৌসেনা মােতায়েন, পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান পরিচালনা করার নিমিত্তে ভারতের পরিকল্পনা তিনি উপলব্ধি করেননি। এমতাবস্থায়, তিনি সামনের দিকে তার সৈন্য সমাবেশ করতে থাকলেও সেই সমাবেশ ছিল সর্বতােভাবে অসুবিধাজনকভাবে করা যার মাধ্যমে ভারতের উন্মুক্ত আগ্রাসন ঠেকানাে সম্ভব ছিল না;
(খ) তাঁর দ্বারা সৈন্য সমাবেশকরণ ছিল পেশাদারিত্ববহির্ভূত এবং তাতে দূরদৃষ্টির চিহ্ন ছিল না। একজন সেনা-কমান্ডার হিসেবে তার কাছে যে দক্ষতা প্রত্যাশিত ছিল; তার জ্যেষ্ঠতা এবং অভিজ্ঞতার আলােকে তার পরিপূর্ণতার প্রকাশ তিনি ঘটাতে ব্যর্থ হন। তার কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল বিপ্লবীদের তৎপরতা দমন করা এবং যেন তারা “ভূখণ্ডের কোনাে অংশ দখল করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তিনি সেই আংশিক দায়িত্বের মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ভারত কর্তৃক সর্বশক্তিসম্পন্ন আক্রমণ শুরু হলে পর নিয়াজী অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন। প্রতিরােধ ও সামরিক পরিকল্পনা তথা বিদেশি আগ্রাসন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা (যা ছিল তাঁর কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ) সংকটের মধ্যে পড়ে যায়।
(গ) দুর্গ এবং শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি শাস্তিযােগ্য অবহেলা প্রদর্শন করেছেন। এ বিষয়ে তিনি এর ‘টেকনিক্যাল নিহিতার্থ পরিপূর্ণভাবে না বুঝেই কাজ করেছিলেন। কেননা দুর্গ ও শক্ত ঘাঁটিগুলাে পরস্পরের মধ্যে সমর্থন যােগানাের অবস্থায় ছিল না। দুর্গ এবং শক্ত ঘাঁটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া শত্রুসৈন্যদের বাধা দেওয়ার মতাে প্রচুর সংরক্ষিত সৈন্যের আয়ােজনও তার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। শত্রুসৈন্যদের চেয়ে সংখ্যাধিক্য সৈন্যও মােতায়েন ছিল না। তদুপরি স্থানীয় জনগণও বন্ধুবাৎসল ছিল না। এসব বিপর্যয়পূর্ণ পরিস্থিতির প্রতিফলস্বরূপ তিনি আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলেন, যদিও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে অনেক দুর্গ ও শক্ত ঘাঁটি তখনও পর্যন্ত অক্ষত ছিল;
২৬৩
(ঘ) শাস্তিযােগ্য অবহেলা তিনি প্রদর্শন করে অপরাধীতে পরিণত হয়েছিলেন, বিশেষ করে তাঁর কর্মপরিচালনা পরিকল্পনার নির্দেশনা নং ৩ (১৯৭১) যা ১৫ জুলাই ১৯৭১ এ জারি করা হয় তাতে সুপরিকল্পিত ধারায় প্রাকৃতিকভাবে অবস্থিত নদ-নদীর বাঁধা বিবেচনায় রেখে সৈন্য প্রত্যাহার করার সুষ্ঠু দিক নির্দেশনা ছিল না। এমতাবস্থায় ভারতীয়দের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে (উদাহরণস্বরূপ) ঢাকা ত্রিভুজকে রক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। এর মাধ্যমে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তানকে অগুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল;
(ঙ) তিনি ঢাকার সুরক্ষার জন্য কোনাে ইতিবাচক পরিকল্পনা নেননি। এবং এটি ছিল তার স্বেচ্ছাপ্রণােদিত অনীহা এবং অবশ্যই তা অবহেলামূলক ও শাস্তিযােগ্য কর্মকাণ্ড।
(চ) তিনি একজন জেনারেলশিপ’ তুল্য জ্ঞান গরিমা প্রদর্শনে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। পরিপক্ক বিচারবােধের দ্বারা তিনি তার অধীনস্ত কমান্ডারদের যুগপতভাবে অগ্রগামী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আবার নাবিকবিহীন দুর্গগুলাে দখলে রাখা এবং নির্দেশ প্রদান করা যে; শতকরা ৭৫ ভাগ মৃত্যু না ঘটলে অবস্থান থেকে সরে আসা যাবে না, “ওয়ানআপ” পরিবর্তক প্রক্রিয়া থেকে “টু-আপ” পরিবর্তকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে কমান্ডারগণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, দেখা দেয় বিভ্রান্তি। ফলে তারা কাজেকর্মে অপারদর্শিতার পরিচয় দেন এবং কার্যত প্রচুর সংখ্যক সৈন্য অপ্রয়ােজনীয়ভাবে হতাহতের শিকার হন। সৈন্যদের মধ্যে দেখা দেয় সেইসঙ্গে বিশৃঙ্খলা, এলােমেলা পরিস্থিতি। শত্রুপক্ষের চাপের মুখে অপরিকল্পিতভাবে প্রত্যাহারের কাজ চলতে থাকে;
(ছ) ঢাকার প্রতিরক্ষা বিষয়ে তাঁর অবজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি শাস্তিযােগ্য অপরাধ করেছেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধরীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঢাকাকে নিঃস্ব করেছিলেন। ঢাকাকে রিক্ত করে সেখানকার প্রাত্যহিক সেনাবাহিনীর ৫৩ বিগ্রেড স্থানান্তর করেছিলেন। এই বাহিনী আগে কপস্ রিজার্ভ হিসেবে ছিল। তিনি কেবলমাত্র প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করেছিলেন, ঐ প্রত্যাশার কারণ ছিল এই যে ১৯ নভেম্বর ১৯৭১ এর মধ্যে জিএইচকিউ এর কথামতাে তিনি ঢাকার জন্য আরও অতিরিক্ত বাহিনী পাবেন;
(জ) যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত যানবাহন, ফেরি ইত্যাদি নিশ্চিত না করে তিনি অপরাধমূলক অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর এই অব্যবস্থাপনার কারণে এমনকি শেষ মুহূর্তে মরণপণভাবে অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে ঢাকার প্রতিরক্ষা কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিল। তাছাড়া যেসকল সেনাসদস্য শেষ পর্যন্ত ঢাকা আসতে পেরেছিলেন তারাও ছিলেন ভারী অস্ত্রবিহীন। তদুপরি তারা অপ্রয়ােজনীয়ভাবে রাস্তায় হত্যার শিকার হন;
(ঝ) তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তদুপরি তিনি লজ্জাজনক ও অপরিপক্ক আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তিনি কমিশনের কাছে নিজেই বলেছেন ভারতীয়দের ঢাকা আক্রমণের জন্য কমপেক্ষে ৭ দিনের প্রস্তুতির প্রয়ােজন পড়ত এবং প্রতিরােধের মুখে ঢাকা দখলের জন্য আরও অন্তত ৭ দিন লাগত। তা সত্ত্বেও তার পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ততা এবং
২৬৪
শত্রুপক্ষের তুলনায় মানুষ ও বস্তুগত সামগ্রীর অপ্রতুলতা, বিমানবাহিনীর সমর্থনহীনতা এবং ঢাকার চারপাশে মুক্তিবাহিনীর আনাগােনা পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করে তােলে;
(ঞ) তিনি সচেতন এবং ইচ্ছাপূর্বকভাবে জিএইচকিউতে অসমীচীন এবং হতাশাব্যাঞ্জক, বিপদসংকেতসম্পন্ন প্রতিবেদন প্রেরণ করেন যাতে করে জিএইচকিউ আত্মসমর্পণের জন্য অনুমতি প্রদানে প্রাণিত হয়েছিল। কারণ তিনি ১৯৭১ সালের ৬ অথবা ৭ তারিখ থেকেই যুদ্ধ করার ইচ্ছা থেকে সরে এসেছিলেন। যুদ্ধ মঞ্চের ব্যবস্থাপনা; কমান্ডারদের প্রভাবিত, অনুপ্রাণিত এবং পথপ্রদর্শনের মতাে কাজ করতে তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
(ট) ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ধারায় ও কারণে তিনি বুঝতে ও মানতে চাননি যে ‘অগ্রাহ্য পরিকল্পনা* থামানাে প্রয়ােজন নেই। ফলে বিপুল পরিমাণে মূল্যবান। যুদ্ধসামগ্রী আত্মসমর্পণের পরে ভারতীয় বাহিনীর হস্তগত হয়। অথচ জিএইচকিউ সুনির্দিষ্টভাবে সংকেতের মাধ্যমে ১৯৭১ সারের ১০ তারিখে অগ্রাহ্য পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে বলা হয়েছিল;
(ঠ) তিনি ভারতীয় কমান্ডার-ইন-চীফের কাছে নিজে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেন এবং সেই সময় লজ্জাজনক ও শােচনীয়ভাবে আত্মসমর্পণে রাজি হন। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করার সময়ে তিনি ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন (অস্ত্র নামিয়ে ফেলেন)। তিনি ঢাকা বিমান বন্দরে নিজে গিয়ে বিজয়ী জেনারেল অরােরাকে সুস্বাগত জানান। তিনি তাঁর নিজের এডিসিকে নির্দেশ প্রদান করেন জেনারেল অরােরার প্রতি গার্ড অব অনার প্রদান করতে। তিনি ভারতের প্রস্তাব অনুসারে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে ও আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী লজ্জা বয়ে আনেন;
(ড) একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এবং কমান্ডার হিসেবে তিনি ভয়ংকরভাবে যৌন কেলেংকারীর অপবাদ কুড়ান এবং অনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পকিস্তানে পান চোরাচালানীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত করেছেন। এসব ঘটনার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে তিনি তার অধীনস্থ কমান্ডারদের অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত করতে এবং সম্মাজন অর্জন এবং বিশ্বাসভাজন হতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বগুণ এ কারণে দুর্বল হয়ে যায়। এসব কারণে তাঁর অধিনস্ত সেনা কর্মকর্তা ও মানুষজনের মধ্যে তা সংক্রমণ ব্যাধির মতাে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হয়;
(ঢ) ভারতের জব্বলপুরে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক থাকার সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে পুনর্বাসিত হওয়ার পরে তিনি নানা প্রকারের অসংগত উপায়ে তাঁর অধীনে ছিলেন এমন কমান্ডারদের প্ররােচিত ও প্রভাবিত করতে সচেষ্ট হন। এমনকি এজন্য তিনি তাদের ওপর ভীতি প্রদর্শনেও পিছপা হননি। যাতে করে তারা তাঁর সাজানাে গল্পে অংশ নিয়ে জিএইচকিউ এবং তদন্ত কমিশনের নিকটে তাকে পূর্ব
———————————————
*অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামাদি ধ্বংস করে ফেলা- অনুবাদক।
———————————————
২৬৫
পাকিস্তানের অপকর্মমূলক ঘটনাবলি এবং পরাজয়ের দায়ভার থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করেন;
(ণ) পাকিস্তানে পুনর্বাসিত হওয়ার পরে তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে মিথ্যা এবং অসততার আশ্রয় নিয়ে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালান যে, তিনি যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখতেন এবং যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই একজন অনুগত ও কর্তব্যপরায়ণ সৈনিক হিসেবে তিনি অন্য কোনাে উপায় না পেয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদ, সাবেক-জিওসি ৩৬ (এ হক) ডিভিশন, ঢাকা
(ক) তাঁকে ১৪ ডিভিশন থেকে ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুরক্ষিত করার জন্য জিওসি ৩৬ (এড-হক) ডিভিশনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু ইচ্ছাপূর্বকভাবে তিনি ঐ দায়িত্ব পালনের বেলায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থ হন। যুদ্ধের জন্য সুদৃঢ় নিয়ম নীতি প্রণয়ন না করা এবং সেজন্য উদ্যোগহীনতা প্রদর্শন তার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান;
(খ) তিনি জেনারেল নিয়াজীকে ইচ্ছাপূর্বকভাবে অবহেলাবশত বিভিন্ন সম্মিলনে ঢাকার প্রতিরক্ষা বিষয়ে সম্পদের অপর্যাপ্ততা বিষয়ে কিছু জানাননি। বিশেষভাবে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বরের পরে, যখন ৫৩ ব্রিগেড ঢাকা থেকে ফেনীতে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন তিনি ঢাকার নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেননি।
(গ) তিনি গভীর অবহেলা সহকারে হঠাৎ করে জামালপুর থেকে ৯৩ ব্রিগেড ঢাকার প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন কোনােরূপ সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যতীতই। যদিও সবারই জানা ছিল যে, জামালপুরের দুর্গটি ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় ছিল। এই ভুল পরিকল্পনার খেসারত হিসেবে ৯৩ ব্রিগেড ঢাকা ফেরার রাস্তায় সম্পূর্ণভাবে অসংগঠিত ও অসংহতিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, ব্রিগেডের কমান্ডার শত্রুবাহিনী | কর্তৃক ধৃত হন। তাছাড়া ব্রিগেডের বিপুল সংখ্যক সৈন্য শক্রর হাতে ধরা পড়েন।
(ঘ) যুদ্ধ করার ইচ্ছা এবং সাহস তিনি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমতাবস্থায়, তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারকে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য রাজি করাতে সচেষ্ট হন- অথচ তখনও অন্ততপক্ষে দু’সপ্তাহ যুদ্ধ করার মতাে অবস্থা পাকিস্তান বাহিনীর ছিল;
(ঙ) তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলাপূর্বক কর্তৃপক্ষকে জানাননি, অন্তত পাকিস্তানে পুনর্বাসিত হওয়ার সময় অবধি, যে তিনি শেষ পর্যায়ে ৫০,০০০ টাকা এবং অন্যান্য ফান্ড তার অধীনে রেখে তাঁরই একক নিয়ন্ত্রণে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে বিতরণ করেছিলেন (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের সকাল বেলায়)।
মেজর জেনারেল এম রাহীম খান, সাবেক-জিওসি ৩৯ (এড-হক) ডিভিশন
(ক) মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় ৩, অংশ ৫ এর ৯-১১ অনুচ্ছেদ, আমরা ঘটনাক্রমে মেজর জেনারেল রাহীম খানের জিওসি ৩৯ [এডহক] ডিভিশন সম্পর্কে মন্তব্য করেছি। তিনি তার বিভাগ পরিত্যাগ করেছিলেন; এবং চাঁদপুরে অবস্থিত তার বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার খালি করেছিলেন, তাঁর স্থলে সে সময় ঐ বিভাগের কোনাে স্থলাভিষিক্ত ব্যতীতই; এ জন্য তিনি কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডের অনুমতি গ্রহণ
২৬৬
করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ তাঁর নেতৃত্বাধীন বিভাগটি অসংগঠিত ও সংহতিহীন হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে তা একজন ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বাধীন নারায়ণগঞ্জ সেক্টরের হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে মিলিত হয়। মূল প্রতিবেদনে আমরা সুপারিশ করেছিলাম মেজর জেনারেল রাহীম খান তাঁর বাহিনী পরিত্যাগপূর্বক তাঁর দায়িত্বের বাইরে বাহিনী প্রেরণ করে প্রাথমিকভাবে অপরাধ করেছিলেন কি না যা কর্তব্য অবহেলা অথবা কাপুরুষােচিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে সেজন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হােক। আমরা সেইসঙ্গে তার সম্পর্কিত আরও কিছু বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য বলেছিলাম;
(খ) যুদ্ধের সময় মেজর জেনারেল রাহীম খান পূর্ব পাকিস্তানে একজন অন্যতম জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে কমিশনের বর্তমান কার্যকালের সময়ে কমিশনের সম্মুখে এসে উপস্থিত হন। তবে তার প্রাথমিক মূল লক্ষ্য ছিল তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করে নেওয়া। ৩৯ (এক) বিভাগের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আদ্যপ্রাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিশন সামরিক কায়দার বিষয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এখন কমিশনের কাছে থাকা যাবতীয় তথ্য উপাত্ত বিবেচনা করে কমিশন মনে করে যে, নিম্নলিখিত অভিযোেগসমূহের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে বিচার হওয়া প্রয়ােজন, যেমন-
(১) নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার খাতিরে তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের কাছে। লজ্জাজনকভাবে অবৈধ ও কাপুরুষােচিতভাবে অনুমতি চেয়েছেন এবং তা অর্জন করে নিজের বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার চাঁদপুর, ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে পরিত্যাক্ত ও খালি করেছেন ! এর খুব সাদামাটা কারণ ছিল শত্রু কর্তৃক প্রদর্শিত ভয়ভীতি। ফল হিসেবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের মাঝপথে তিনি তাঁর বাহিনী পরিত্যাগপূর্বক তার দায়িত্বের অঞ্চল থেকে সরে আসেন;
(২) তাঁর স্বেচ্ছাকৃত জোরাজুরির ফলে মুক্তিবাহিনীর ভয়ে রাতের বেলার পরিবর্তে দিনের বেলায় নৌবাহিনীর জাহাজে যাত্রা করেন (যদিও পরামর্শ ছিল রাতের বেলায় যাত্রা করার)। এর ফলস্বরূপ ভারতীয় বিমান বাহিনীর বােমাবর্ষণের ফলে ১৪ জন নৌবাহিনীর সদস্যসহ তার হেডকোয়ার্টারের ৪ জন কর্মকর্তা নিহত হন এবং অন্যান্য কিছু সংখ্যক সৈন্য আহত হন। তিনি নিজেও ভারতীয় বিমান হামলার কারণে আহত হন;
(৩) চাঁদপুর হতে দ্রুত বের হয়ে আসার বিষয়ে তার উৎকণ্ঠার কারণে তিনি স্বেচ্ছাকৃতভাবে সংকেতসংক্রান্ত মূল্যবান যন্ত্রপাতি পরিত্যাগ করে এসেছিলেন। এর ফলে বিভাগের সঙ্গে যােগাযােগের ব্যাঘাত ঘটে এবং তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের তিনি তাদের নিজের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেন;
(৪) ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর, তিনি তাঁর মৌখিক বাক্যে লে. জেনারেল নিয়াজীকে বলেন যে, সময় খুবই সংকটজনক ও বিপদসঙ্কুল (এ সময়ে জামশেদ এবং ফরমান। আলীও উপস্থিত ছিলেন) “সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে, চলুন একদিনের মধ্যে আমরা এর সমাপ্তি ঘটিয়ে দিই।” এবং মুক্তিবাহিনী সম্ভবত সবকিছু ধ্বংস করে দেবে;
(৫) তিনি স্বেচ্ছাকৃতভাবে তার কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সারসংক্ষেপ না দেওয়া থেকে বিরত
২৬৭
থাকেন, বিশেষত যখন তিনি ১৯৭১ সালের শুরুতে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। সুতরাং চাদপুরে তার হেডকোয়ার্টারের বিষয়টি গুপ্তাবস্থাতেই রয়ে যায়। ফলে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করে পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞাত না হয়েই পাকিস্তানে তাকে চীফ অব দা জেনারেল স্টাফ পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়।
ব্রিগেডিয়ার জি এম রাকের সিদ্দিকী, সাবেক সিওএস, ইস্টার্ন কমান্ড, ঢাকা
(ক) ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ হিসেবে তিনি অপরাধী, কেননা তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারকে সৎপরামর্শ দান করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন। তিনি তার কাজে কর্মে সুদক্ষ সামরিক পেশাদারিত্ব প্রদর্শনেও ব্যর্থ হয়েছেন। বিষয়টি ইতােমধ্যে নিয়াজীর বিরুদ্ধে গঠিত অভিযােগে (ক) থেকে (ঝ) পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
(খ) তিনি স্বেচ্ছায় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারকে সহযােগিতা করেছেন যেখানে কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড, অবৈধভাবে হতাশাব্যাঞ্জক ও বিপদসংকেতযুক্ত জিএইচকিউ বরাবর। প্রতিবেদন এবং সংকেত পাঠিয়েছিলেন। এবং তাতে আত্মসমর্পণ করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করা হয়েছিল; যেহেতু তিনি যুদ্ধ করার মতাে ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। কঠিনভাবে বলা যায় এটি ছিল কর্তব্য অবহেলা, এবং পেশাদারিত্বসম্পন্ন সামরিক কাজে অকৃতকার্যতা। এর দ্বারা তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এটি সন্দেহাতীতভাবে শাস্তিযােগ্য অপরাধ;
(গ) তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারকে যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে সুদক্ষ যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নের বেলায় সমর্থনযােগ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন সংকেত, প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট, সরবরাহসহ অপরাপর সমর্থন, চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়াদির সম্পর্কে তথ্য ও সমর্থন দেননি। সুতরাং এমতাবস্থায় কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডের জন্য সুষ্ঠু যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মতাে কাজ কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাঁর এই ধরনের কার্যকলাপ শাস্তিযােগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা যায়;
(ঘ) তিনি ভারতের পক্ষ থেকে আসা ভয়ভীতির যথার্থতা ও গভীরতা সম্পর্কে কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডারকে যথাযথভাবে সারসংক্ষেপ আকারে অবহিত করেননি। অথচ জিএইচকিউ কর্তৃক তিনি এসব বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে সারসংক্ষেপপ্রাপ্ত হয়েছিলেনযখন তিনি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি অধিবেশনে যােগ দিয়েছিলেন। তাছাড়া এসব ভয়ভীতির বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বেলায় তিনি কমান্ডারকে বাহিনী পুনঃসংগঠন করার কোনাে প্রকার উপদেশ দেননি। তাঁর এ ধরনের সকল কার্যকলাপই ছিল কর্তব্যের প্রতি শাস্তিযােগ্য অবহেলা।
(ঙ) হঠাৎ করেই যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে কমান্ড পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে তিনি দায়দায়িত্ব বহন করেন। যুদ্ধের সেই অত্যন্ত সংকটাপন্ন দিনগুলােতে তাঁর এ ধরনের কার্যকলাপ এমনকি ঊর্ধ্বতন কমান্ডারের প্রতি অধীনস্ত কর্মকর্তার খবরদারির মতাে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ফলে সেখানে বিভিন্ন রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব যুদ্ধ পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল; কোন্ মনােভাবের দ্বারা তাড়িত হয়ে তিনি প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনার’ স্বেচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবায়নকে থামিয়ে দিয়েছেন তা বােধগম্য নয়। কিন্তু তাঁর এ কার্যকলাপের ফলে বিপুল পরিমাণের যুদ্ধ সামগ্রী আত্মসমর্পণের পরে ভারতীয় বাহিনীর হস্তগত হয়ে
২৬৮
যায়। অথচ জিএইচকিউ কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৭১ সালের ১০ তারিখে সংকেত বার্তায় প্রত্যাখ্যান পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
(ছ) বিশেষভাবে, তিনি কমান্ডার সংকেতকে (সিগন্যাল) নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন আন্তঃপ্রদেশ সংকেত ট্রান্সমিটার সচল রাখা হয়, এমনকি আত্মসমর্পণের পরেও, তার উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে সাহসীকতার জন্য পদক ইত্যাদি পাওয়া যায়। অথচ তাঁর এ কর্মকাণ্ডের কারণে শত্রুপক্ষের হাতে এ সম্পর্কিত মূল্যবান সামগ্রী অক্ষত অবস্থায় চলে যায়;
(জ) বন্দি হওয়ার মুহূর্তে তিনি অবৈধভাবে শত্রু বাহিনীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সখ্যতা গড়ে তােলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে কলকাতায় তারা তাকে বাজার করার অনুমতি প্রদান করেন। এই ধরনের সুযােগ-সুবিধা ভারতীয়দের দ্বারা অন্য কাউকেই কখনাে দেওয়া হয়নি;
(ঝ) তিনি জিএইচকিউ ও তদন্ত কমিটির নিকট চাকরির সুনামমূলক নিয়নমনীতি ভঙ্গ করে আত্মসমর্পণের বিষয়ে বানােয়াট ও বানানাে গল্প সাজাতে চেয়েছেন।

ব্রিগেডিয়ার মােহাম্মদ হায়াত, সাবেক কমান্ডার, ব্রিগেড (৯ ডিভিশন)
(ক) যশাের দুর্গ রক্ষার জন্য কমান্ডার হিসেবে তিনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রদর্শনে ইচ্ছাপূর্বক গাফিলতি দেখিয়েছেন;
(খ) গরীবপুরে প্রতি-আক্রমণ পরিচালনার সময়ে তিনি শত্রুবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে সত্যিকার খবর-বার্তা জানতে ইচ্ছাপূর্বক অবহেলা দেখিয়েছেন। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সেতুর নিকটবর্তী প্রতি-আক্রমণে নিজে কমান্ড দানে বিরত ছিলেন, যার ফলে তাঁকে এমনকি ট্যাঙ্ক হারাতে হয়েছিল। ফলে তার অধীনস্ত বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য নিহত হন; এবং চূড়ান্তভাবে যশাের দুর্গের প্রতিরক্ষা সাংঘাতিক রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে;
(গ) একটি খবরে যখন বলা হয় যে, শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্ক যখন যশােরের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে আসছে তিনি তখন এমনকি খবরটির সত্যতা যাচাই না করেই লজ্জাজনকভাবে যশাের দুর্গ পরিত্যাগ করে বিনা যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে দুর্গে থাকা যাবতীয় যুদ্ধ সাজসরঞ্জাম অক্ষত অবস্থায় রেখে আসেন যা শত্রুদের হস্তগত হয়ে যায় । এবং বাহিনীকে কোনাে প্রকার নােটিশ না দিয়েই চলে আসেন। বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা এমতাবস্থায় নিজস্ব সিদ্ধান্তে রাতের বেলা নিজ নিজ পথে চলতে থাকেন।
(ঘ) শত্রুদের সঙ্গে না লড়েই যশোের দুর্গ পরিত্যাগ করার পরে, তিনি স্ববিবেচনায় এবং স্বেচ্ছায় খুলনা অভিমুখে অভিযাত্রা আরম্ভ করেন, জিওসি কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশ যেখানে বলা হয়েছিল যশাের থেকে সৈন্য প্রত্যাহারপূর্বক মাগুরা অভিমুখে আসতে হবে- এমন নির্দেশ তিনি পরিষ্কারভাবে লংঘন করেছেন। যে কারণে বিভাগীয় কমান্ডারের পক্ষে অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে মধুমতি নদীর বিপরীত দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
ব্রিগেডিয়ার মােহাম্মদ আসলাম নিয়াজী, সাবেক কমান্ডার, ৫৩ ব্রিগেড (৩৯ এডহক ডিভিশন)
(ক) ৫৩ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে তিনি শাস্তিযােগ্য অপরাধ করেছেন এজন্য যে তিনি জিওসি কর্তৃক ৩৯ এডহক ডিভিশনের প্রতি ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রদত্ত নির্দেশ মােতাবেক মুজাফফরগঞ্জ রক্ষার ক্ষেত্রে কাজের কোনাে উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এর
২৬৯
ফল হিসেবে শত্রুপক্ষ এলাকাটি দখল করে নিতে সমর্থ হয়। এজন্য ত্রিপুরা এবং চাঁদপুর লাইনের প্রতিরক্ষা কার্যক্রম দারুণ হুমকির মুখে পড়ে যায়। অথচ চাঁদপুরে ডিভিশনাল সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল;
(খ) তিনি কাঙ্ক্ষিত সাহসিকতা প্রদর্শনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন এবং এটি শাস্তিযােগ্য অপরাধ। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে জিওসি কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী তিনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে শত্রুবাহিনীকে মুজাফফরগঞ্জ থেকে হটিয়ে দিতে অক্ষমতার পরিচয় দেন। এর ফলস্বরূপ ২৩ পাঞ্জাব এবং ২১ একের একটি অংশ ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে । তাদের জন্য পরিস্থিতি ছিল সাংঘাতিকভাবে প্রতিকূল। তাদের না ছিল পানি না ছিল খাদ্যসামগ্রী। তাছাড়া গােলাবারুদও ছিল প্রান্তিক পর্যায়ে।
(গ) তিনি ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ এবং এর কাছাকাছি সময়ে লাকসাম দুর্গ লজ্জাজনকভাবে পরিত্যাক্ত করেন। অথচ কমান্ডার হিসেবে এ দুর্গ রক্ষা করা ছিল তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য;
(ঘ) তিনি ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লাকসাম দুর্গ হতে কুমিল্লা দুর্গে আসবার সময় দায়িত্ব অবহেলার মতাে কাজ করেছেন, যার দরুন ৪০০০ জন সৈন্যসহ যাত্রা করলেও মাত্র ৫০০ সৈন্যসহ ব্রিগেড কমান্ডার ১৫ জন সিও সহ কুমিল্লা পৌছতে পেরেছিলেন। বাদবাকি সৈন্যরা হয় নিহত হন অথবা শত্রুর কাছে ধরা পড়েন। ১৫ বালুচও কুমিল্লা আসতে সক্ষম হয়। ৩৯ বালুচ এর সিও কুমিল্লার মাত্র তিন মাইল দূরবর্তী থাকা অবস্থায় ৪০০ সৈন্যসহ শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফলে ৫৩ ব্রিগেড সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
(ঙ) তিনি সামরিক সংগঠনের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে ইচ্ছাপূর্বকভাবে চরম উদাসীনতার পরিচয় দেন। তিনি ১২৪ জন অসুস্থ ও আহত সেনাসদস্যকে দুজন। চিকিৎসকসহ দুর্গে ফেলে এসেছিলেন। তাদেরকে এমনকি জানানাে হয়নি যে বাহিনী দুর্গ পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছে; এবং
(চ) তিনি লাকসাম দুর্গ পরিত্যাগ করে আসার সময় ইচ্ছাপূর্বকভাবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ বিনষ্ট করে আসেননি। ফলে ঐসব যুদ্ধ সামগ্রী শত্রুবাহিনীর হাতে অক্ষত অবস্থায় পড়ে যায়। অর্থাৎ তিনি প্রত্যাখ্যন-পরিকল্পনার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন।
২৭০

বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা

ব্রিগেডিয়ার এম.এ আনসারী, সাবেক কমান্ডার, ২৩ ব্রিগেড (১৫ ডিভিশন)
এই কর্মকর্তা ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে রংপুর ও দিনাজপুর বেসামরিক জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এর মধ্যে হিলির একটি ক্ষুদ্র এলাকা ছিল ২০৫ ব্রিগেডের অধীনে। প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই তিনি দৃশ্যত হেরে যাওয়ার অবস্থানে ছিলেন। বুরুংগামারী হারানাের মাধ্যমে তা আরম্ভ হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ অথবা ১৫ নভেম্বর তারিখে আক্রমণপূর্বক এটি দখল করে নেয়। তার বাহিনী পঞ্চগড়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হারায়। এর কারণ ছিল কমান্ডার হিসেবে আনসারীর অদক্ষতা। কেননা তিনি অবস্থা বুঝে উত্তমভাবে বাহিনী ও পরিকল্পনা পুনর্গঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারপরে তিনি ২৮ এবং ২৯ নভেম্বর ১৯৭১ সালের মধ্যে ঠাকুরগাঁও পরিত্যাগ করেন এবং সেখানে তিনি কোনাে প্রকার প্রতিরােধ ব্যুহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন। এর সব হঠকারী কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্ যুদ্ধে তাঁর পারঙ্গমতা সম্পর্কে খুবই খারাপ মন্তব্য করেন, আমরা এটি উল্লেখ করতে সঙ্কোচবােধ করছি না । আমাদের কাছে আসা সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি সাহসীকতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হন। তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে যােগ্যতা ও লক্ষ্যে পৌছবার মনােভাবের ঘাটতি ছিল। কমিশন অনুভব করে যে, এই কর্মকর্তাকে পুনরায় চাকরিতে রাখা ঠিক হবে না। কেননা সে যােগ্যতা তার নেই।
ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমেদ, সাবেক কমান্ডার ৫৭ ব্রিগেড (৯ ডিভিশন)
এই কর্মকর্তা শক্তহাতে যুদ্ধ করেননি। এর ফলে তার অধীনস্থ ঝিনাইদা দুর্গ কোনাে প্রকার যুদ্ধ ব্যতীতই শত্রুপক্ষের দখলে চলে যায়। শত্রুর দ্বারা কোটচাঁদপুরে সৃষ্ট বাধা তিনি তার যােগ্যতাহীনতার কারণে অপসারণ করতে পারেননি। তাছাড়া তিনি বিভাগীয় কমান্ডারের সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তের দ্বারা এবং নির্দেশ না। নিয়েই ব্রিগেডকে বিভাগীয় সীমানার বাইরে নিয়ে যান, এবং তা ১৬ ডিভিশনের অধীনে স্থাপন করেন। তিনি এভাবে তার মূল হেডকোয়ার্টারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং শেষ অবধি এ অবস্থা চলমান ছিল। তিনি প্রথম থেকেই যুদ্ধে কোনাে প্রকার অবদান রাখতে ব্যর্থ হন এবং তার কার্যকলাপ এরূপ ধারণা সৃষ্টি করে। যে, তিনি যুদ্ধের বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বগ্রস্ত । তিনি তার চাকরিতে থাকার বিষয়ে পরবর্তী সময়ের জন্য যােগ্য নন বলে কমিটি অভিমত প্রকাশ করছে ।
ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির খান, সাবেক কমান্ডার, ৯৩ ব্রিগেড (৩৬ ডিভিশন) :
এই ব্রিগেডিয়ারের কার্যকলাপ দুটি মাত্রায় কমিশনের দৃষ্টিগােচরে আসে যথা : আন্তঃচাকরি স্ক্রিনিং কমিটির চেয়ারম্যান (ঢাকা) এবং পরবর্তী সময়ে কমান্ডার ৯৩
২৭১
(এডহক) ব্রিগেড (৩৬ ডিভিশনের অধীন)। আগের কাজ ছিল কার্যত সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের এবং সেইসঙ্গে কার্যালয়ের সাথে সংযুক্তিবিহীন মানুষের কার্যকলাপ স্ক্রিনিং করা। যেমন আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সময়ে পক্ষত্যাগী ছিলেন কি না অথবা অন্য কোনােভাবে বিরােধী অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন কি না তা স্ক্রিনিং করা। অভিযােগ রয়েছে যে, তার হেফাজতে থাকা কেউ কেউ বিনা বিচারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছেন, অথবা কারও কারও দোষ গােপন করা হয়েছিল । অবশ্য এসব ঘটনার সত্যতা-অসত্যতা যাচাই হয়নি, এজন্য তা তার দায়দায়িত্বের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ৯৩ এডহক ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে তিনি ভারতীয়দের হাতে ধৃত হন, যখন তিনি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা অভিমুখে সৈন্যসহ প্রত্যাবর্তন করছিলেনএ বিষয়ে কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডের নির্দেশ ছিল। তিনি তার নির্ধারিত চাকরিকালের শেষ প্রান্তে এসে গিয়েছেন, অতএব সরকারি চাকরিতে তার আর থাকার প্রয়ােজন নেই। কমিশন খবর পেয়েছে যে, ইতােমধ্যে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন।
অপরাপর জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের কাজকর্ম
৯। লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, মেজর জেনারেল জামশেদ এবং মেজর জেনারেল রাহিম খানের বাইরেও সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে আরও চারজন জেনারেল কর্মকর্তা আত্মসমর্পণের সময় অবধি কাজ করেছেন এরা হলেন, মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারী, জিওসি, ৯ ডিভিশন, মেজর জেনারেল কাজী আব্দুল মজিদ, জিওসি, ১৪ ডিভিশন, মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্, জিওসি, ১৬ ডিভিশন এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা। সেই একইভাবে আগের অধ্যায়ে আলােচিত ব্রিগেডিয়ারদের বাইরেও আরও ১৯ জন ব্রিগেডিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করেছেন। চূড়ান্তভাবে সেখানে নৌবাহিনীর একজন রিয়াল অ্যাডমিরাল তিন জন কমােডরের। সহায়তা নিয়ে কাজ করেছেন। আরও ছিলেন একজন এয়ার কমােডর, যিনি পূর্ব পাকিস্তানে পিএএফ কমান্ডিং এর কাজ করেছেন।
১০। আমরা যখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বিষয়টি আলাদাভাবে আলােচনা করেছি তখন দেখেছি তিনি সেই সময়ে কোনাে বাহিনীর কমান্ডিং কর্মকর্তার পর্যায়ে কাজ করেননি। তারপরেও আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ১৯৭১ সালের তাৎক্ষণিক আগে ও সেই সময়ে যে সকল জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানপূর্বক বিভিন্ন প্রকারের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা সকলেই যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের জন্য দায়ী। তবে যখন তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয় (ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব সম্পর্কে) তখন কমিশন অনুভব করে এবং এটি উল্লেখ করা উচিত বলে মনে করে যে, তাদের সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ডের দ্বারা নির্ধারিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে শত্রুদের বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর তুলনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ও যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ছিল অপ্রতুল। সাধারণ মনােবলহীনতার জন্য দায়ী ছিল আসলে রাওয়ালপিন্ডিস্থ সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড এবং ঢাকাস্থ ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার। এ কর্মকাণ্ড ছিল শাস্তিযােগ্য অপরাধ।
২৭২
চূড়ান্তভাবে বলা যায় সেখানে আরও ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা শর্তহীনভাবে আনুগত্য প্রকাশের ধারা; যার জন্য অধীনস্থ সেনাকর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার কোনাে কাজকর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতেন না। সংকটজনক সময়েও বিনা প্রশ্নে হাইকমান্ডের নির্দেশ মান্য করাই হলাে নিয়ম । এই বিষয়টি চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দু’একজন ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা কোনাে প্রকার সুচিন্তিত প্রশ্ন ছাড়াই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মেনে নেন; যদিও সেখানে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের গৌরব রক্ষার্থে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পক্ষে মানুষ ছিলেন।
১১। উপযুক্ত মনােভাব ও বিষয়সমূহ মনে রেখেই আমরা জ্যেষ্ঠ সেনাকর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কার্যাবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। মূল প্রতিবেদনের সংশ্লিষ্ট অংশের সঙ্গে এই সম্পূরক প্রতিবেদনে আমরা দৈনন্দিন বেড়ে ওঠা সামরিক ঘটনাবলির কিছু অংশ বর্ণনা করেছি এবং এই উপসংহারে উপনীত হতে চাই যে, তাদের প্রতি বিরূপ মন্তব্যের জের ধরে যে অনুরণন সৃষ্টি হয় তাতে করে তাদেরকে আর সামরিক বিভাগে কার্যরত রাখা যুক্তিযুক্ত হবে না। এছাড়া আমরা কর্মকর্তাদের ভিতর থেকে কাউকে বের করে এনে তার বিশেষ গুণগান গাইতেও চাই না। যদিও বললেও সত্য যে, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কিছু কর্মকর্তা তাদের কর্তব্য কাজ পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন যা ছিল অসাধারণ প্রকৃতির।
নিমপদস্থ কর্মকর্তাদের কার্যকলাপ
১২। বিষয়গুলাের প্রকৃতিগত কারণেই ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের নিচের সামরিক কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অবস্থানে কমিশন ছিল না। যদিও কিছু কিছু বিষয় আমাদের নজরে এসেছে; যেখানে ঐ সব কর্মকর্তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গনে যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা নৈতিক ও শৃঙ্খলাজনিত নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছেন। এ সব ঘটনসমূহ প্রতিবেদনের সংশ্লিষ্ট অংশে বিবৃত হয়েছে। তবে কম-বেশি ঐসব নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে অধিকাংশ ঘটনার বিবরণ সংশ্লিষ্ট সেনাসদরদপ্তরের ওপর বিস্তারিত সারসংক্ষেপ সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের তাৎক্ষণিক উপরের স্তরে কার্যরত কর্মকর্তাগণ কাজকর্মের মূল্যায়ন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
মেজর জেনারেল ফরমান আলীর ভূমিকা
১৩। প্রতিবেদনের এই অধ্যায়টি শেষ করার আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করা অ-যথার্থ হবে না বলে ধরে নেওয়া যায়। কেননা, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে নানা প্রকারের কথাবার্তা স্থান পেয়েছে। সেসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও তার কথা উল্লেখ করেছেন।
১৪। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ১৯৬৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়রি হতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানাভাবে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদায় ১৪ ডিভিশনের গােলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ
২৭৩
জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি করার পর তিনি আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরে ব্রিগেডিয়ার (বেসামরিক বিষয়) হিসেবে নিয়ােগ পান। একই বিষয়ে তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পরবর্তীতে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই হতে ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, পর্যন্ত তিনি মেজর জেনারেল (রাজনৈতিক বিষয়) হিসেবে কাজ করেন। এর পর ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি ডা. এ এস মালেকের পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে পদত্যাগের সময় পর্যন্ত তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।
১৫। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি করা র সময় থেকে মেজর জেনারেল ফরমান আলীর বিভিন্ন নিয়ােগের স্বভাবগত ধরন ছিল এমন যে, তা যেন বিভিন্ন স্তরের সামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকা যায়। সেইসঙ্গে তিনি বিভিন্ন স্তরের সামরিক আইন প্রশাসকদের সাথেও সংশ্লিষ্ট থেকেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সামরিক তৎপরতার (অভিযানের নিমিত্তে প্রণীত পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন বলে কমিশনের সামনে তিনি অপকটে স্বীকার করেন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সামরিক সরকার যে সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ গ্রহণ করেছিল তিনি তার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য তৎপরতা ছিল উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ সদস্যকে অযােগ্য ঘােষণা করা। তথপিও জেনারেল ফরমান আলীকে দীর্ঘসময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার লিখিত বিবৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক এবং অন্যান্য সাক্ষীর দেওয়া তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, তিনি স্টাফ কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের সময় অত্যন্ত আন্তরিকতা, বৃদ্ধিদীপ্ততা এবং সৎ মনােবৃত্তি দেখিয়েছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের চতুর্পার্শ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সামরিক জান্তার অভ্যন্তরীণ চক্রের সদস্য ও সমর্থক হিসেবে তিনি কাজ করেননি। আমরা আরও লক্ষ করেছি যে, সাধারণ নৈতিকতা বিরুদ্ধ (পাবলিক মরালিটি), মানবিক বিবেচনাবােধ এবং সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তা বিরােধী কোনাে প্রকার কর্মকাণ্ডে তিনি জড়াননি কিংবা কাউকে তা করতে পরামর্শও দেননি। এ প্রসঙ্গে আমরা ইতােমধ্যে আমাদের এই প্রতিবেদনের আগের অংশে মন্তব্য করেছি। শেখ মুজিবুর রহমান মেজর জেনারেল ফরমান আলীর বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযােগ আনেন যে, তিনি “সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে লাল করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল পুরাে ঘটনা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করা হয়েছে।
১৬। এই কর্মকর্তা যুদ্ধের সংকটকালীন দিনগুলােতে সামরিক অভিযানের বিষয়ে সরাসরি কোনাে প্রকার দায়িত্বে ছিলেন না। তবে তার পরেও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ও সেইসঙ্গে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন। এই সম্পৃক্তার জন্য তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হতাে, ফরমান আলী আখ্যান। আত্মসমর্পণের বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কিত এই প্রতিবেদনের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল ফরমান আলী জাতিসংঘে
২৭৪
পাঠাবার উপযুক্ত বার্তার অনুমতি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের নিকট থেকে পেয়ে গিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সেই ক্ষমতা আগেই অর্জন করেছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে। এই বার্তার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটাবার জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তৈরি করা। এমতাবস্থায় বার্তা প্রণয়ন ও তা জাতিসংঘে পাঠানাের জন্য মেজর জেনারেল ফরমান আলীকে দায়ী করা যায় না। বাস্তবিকভাবে মেজর জেনারেল ফরমান আলী তার বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য এক সময় নিজেই সামরিক আদালতে তার বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য বলেছিলেন। যেহেতু তারা এখন কমিশনের সামনে হাজির হয়েছেন সেহেতু পুনরায় আর কোনাে প্রকার তদন্ত বা বিচারের প্রয়ােজন নেই।
১৭। চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাগণ ইস্টার্ন কমান্ডের সদরদপ্তরে আত্মসমর্পণ সক্রান্ত দরকষাকষি বা সমঝােতার জন্য লে. জেনারেল নিয়াজীর নিকট এসেছিলেন তখন মেজর জেনারেল ফরমান আলী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উভয় কর্মকর্তার (মেজর জেনারেল ফরমান আলী লে. জেনারেল নিয়াজীর) আচরণ ও মনােভাব সম্পর্কে আমাদের নিকট আসা খতিয়ান থেকে বিনা দ্বিধায় আমরা বলছি যে, মেজর জেনারেল ফরমান আলী সঠিক পথেই লে. জেনারেল নিয়াজীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। যদি লে. জেনারেল নিয়াজী তাঁর দেওয়া উপদেশ মতাে কাজ করতেন, তা হলে হয়তাে অনেক অসম্মানজনক অধ্যায় পরিহার করা যেত।
১৮। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ জেনারেল মানিকশাে মেজর জেনারেল ফরমান আলীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার (অধিনায়ক) সম্মােধন করে কেন প্রচারপত্র দিয়েছিলেন; তার কারণও আমরা ব্যাখ্যা করেছি। জানা যায় ১৯৭১ সালের ৮ অথবা ৯ ডিসেম্বর লে. জেনারেল নিয়াজীকে তাঁর কমান্ড বাঙ্কারের বাইরে দেখা যায়নি, এমতাবস্থায় বিবিসি এই মর্মে একটি খবর সম্প্রচার করে যে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন এবং মেজর-জেনারেল ফরমান আলী কমান্ডারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই কমান্ডার মেজর-জেনারেল ফরমান আলীকে ভারতীয় অধিনায়ক আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা সন্তুষ্টচিত্তে ব্যক্ত করছি যে, মেজর জেনারেল ফরমান আলী কখনাে কোনাে পর্যায়েই ভারতীয় জেনারেলের যােগাযােগ স্থাপন করেননি। এই পরিস্থিতি তখনই সংশােধিত হয় যখন লে. জেনারেল নিয়াজী ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হন।
১৯। লে: জেনারেল নিয়াজী কমিশান বরাবর এই মর্মে একটি অভিযােগ আনেন যে মেজর-জেনারেল ফরমান আলী বিপুল পরিমাণ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে সরিয়ে ফেলেছেন। এ টাকার পরিমাণ আনুমানিক ৬০,০০০ হাজার টাকা। জে. নিয়াজী তাঁর অভিযােগে বলেন মেজর জেনারেল ফরমান আলীর ভাতিজা সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সকালে ঢাকা ত্যাগ করেন। মেজর জেনারেল ফরমান আলী তার মাধ্যমেই ঢাকাগুলাে বাইরে পাঠিয়েছেন। উক্ত অভিযোেগ এবং অন্যান্য বিষয়ে ব্যাখ্যা দানের জন্য মেজর জেনারেল ফরমান আলীকে কমিশনের সম্মুখে ডাকা হয়। তিনি ব্যাখ্যাসহকারের
২৭৫
বলেন যে, ঐ অর্থ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরকে প্রয়ােজন অনুযায়ী খরচ করার জন্য দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অথবা তার কাছাকাছি সময়ে পদত্যাগ করলে স্বভাবই ঐ টাকা খরচ করার দায়দায়িত্ব গর্ভনরের উপদেষ্টা হিসেবে তার ওপর এসে বর্তায়। এই অবস্থায় ঢাকার ইসলামিয়া প্রেসকে তিনি ৪,০০০ হাজার টাকা দেন। ইসলামিয়া প্রেসকে টাকা প্রদানের বিষয়টি গভর্নরের সামরিক সচিব (এখন তিনি প্রত্যাবাসিত হয়ে এসেছেন) জানতেন। বাদবাকি ৫৬,০০০ হাজার টাকার মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল রাহীম খানকে ৫,০০০ হাজার টাকা দেন যখন তিনি ঢাকা ত্যাগ করছিলেন। যাত্রাপথে এ অর্থ তার এবং তার পথের সঙ্গীসাথিদের প্রয়ােজন ছিল। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল রাহিম খান ঐ টাকা খরচের একটি হিসাব তৈরি করেন।
২০। ইসলামিয়া প্রেস এবং মেজর জেনারেল রাহীম খানকে দেওয়ার পরে বাদবাকি৫১,০০০ হাজার রুপি তিনি তার ভাতিজা মেজর আলী জওহরের হাতে দেন। সে সময় আলী জওহর (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল বেলা) ঢাকা হতে পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রা করছিলেন। পাকিস্তানের প্রত্যাবর্তনের পর মেজর জেনারেল ফরমান আলী সরকারি কোষাগারে ৪৬,০০০ হাজার টাকা জমা দেন। জেনারেল সদরদপ্তরের পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট বিভাগের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার কাজীকে তিনি উক্ত টাকা জমা দেওয়ার রসিদ প্রদান করেন। বাদবাকি ৫,০০০ হাজার টাকা মেজর জেনারেল ফরমান আলী পশ্চিম পাকিস্তানে তার স্ত্রীসহ বসবাসকারী পরিবারের বাড়িভাড়ার আংশিক খরচ হিসেবে দেখান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর তার পরিবারের জন্য মাসে ১,৪০০ শত টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু এ বরাদ্দ ১২ মাস না নেওয়া অবস্থায় জমে ছিল। সে হিসেবে তাঁর দাবি ছিল ১৫,০০০ হাজার টাকা, কিন্তু তিনি মাত্র ৫,০০০ টাকা গ্রহণ করেছেন।
২১। আমরা মেজর জেনারেল ফরমান আলীর দেওয়া ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী ঘটনার বিষয়সমূহ সহজেই যাচাই যােগ্য। আমরা মনে করি কমিশনের সামনে তিনি অসত্য কোনাে বক্তব্য দেননি।
২২। পূর্বোল্লিখিত কারণে আমরা মনে করি পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকালীন পুরাে সময়ে মেজর জেনারেল ফরমান আলীর দায়-দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ডের ওপর বিরূপ কোনাে মন্তব্য করার সুযােগ নেই।
২৭৬

৬০
সুপারিশসমূহ

১৯৭২ সালে দাখিলকৃত মূল তদন্ত প্রতিবেদনের উপসংহারের অংশে ১৯৭১ সালের শােচনীয় পতনের কারণসমূহের ওপর ভিত্তি করে আমরা কিছু সুপারিশ তৈরি করেছিলাম। ঐ সুপারিশসমূহের কিছু কিছু দিক পুনরায় সংগৃহিত তথ্য-প্রমাণের আলােকে পরিবর্তন, অথবা জোরালাে করার প্রয়ােজন রয়েছে। সেইসঙ্গে কোনাে কোনাে বিষয় আমরা গুরুত্বের সাথে বলবার দরকার বােধ করছি। আমরা মনে করি এই কমিশন গঠনের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হবে যদি দ্রুততার সাথে সরকার সুপারিশসমূহের ভিত্তিতে প্রয়ােজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে।
১। মূল প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এমন কিছু বিষয়ের পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা মনে রেখেই, আমরা মনে করি যদি সকল সুপারিশগুলাে চূড়ান্তভাবে একত্রিত করা যায়। তাহলে তা হবে যথার্থ কাজ। এভাবে সেই সুপারিশসমূহের আলােকে কার্যক্রম গ্রহণ ও তা সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত হবে। সুপারিশসমূহের বিস্তারিত কারণ ও যৌক্তিকতা মূল প্রতিবেদনের সংশ্লিষ্ট অধ্যায়গুলােতে এবং সম্পূরক প্রতিবেদনে পাওয়া যাবে। আমরা জানি যে, মূল প্রতিবেদনে উল্লিখিত কিছু কিছু সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত কার্যক্রম ইতােমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। তারপরও চূড়ান্ত উপসংহারের সারসংক্ষেপে সেগুলাে উল্লেখ না করার কোনাে কারণ নেই।
বিচারিক কার্যক্রম
২। সংবিধানকে ধ্বংস করে অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে,
ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা পূর্বক বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং শারীরিক ও স্বাভাবিক ভীরুতার বশবর্তী হয়ে, শক্তি-সামর্থ থাকার পরও শক্রর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সৃষ্টি না করে যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছেন। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছে। এর জন্য দায়ী জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডারদের অপরিহার্যভাবে জমা-খরচের খাতাভুক্ত করার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে একটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা শাস্তি পাওয়ার মতাে অপরাধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় এবং যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের ভিতর দিয়ে শুধু যে জাতিকে পরিতৃপ্ত করা যাবে তাই নয়- এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের লজ্জাজনক ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে তার নিশ্চয়তাও অর্জন করা যাবে। অতএব আমরা সুপারিশ করছি যেন কালবিলম্ব না করে নিম্নলিখিতভাবে বিচারিক কার্যক্রম আরম্ভ করা হয় :
(i) জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, লে. জেনারেল এস, জি এম এম পিরজাদা, লে. জেনারেল গুল হাসান, মেজর
২৭৭
জেনারেল উমার এবং মেজর জেনারেল মিত্থা কর্তৃক ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এবং শক্তি প্রয়ােগ করে অবৈধভাবে ও অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করে লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতায় বসায়। অতএব এসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার জনসমক্ষে বিচার হওয়া দরকার। তারা তাদের সকলের সাধারণ স্বার্থ সিদ্ধির অভিপ্রায়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাজনৈতিক দলগুলােকে প্রভাবিত করেছেন। তাছাড়া তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলােকে উৎসাহিত করেছেন, এমনকি ঘুষ দিয়েছেন যাতে করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত নকশা অনুযায়ী দলগুলাে কাজ করে এবং এর মাধ্যমে নির্বাচনে বিশেষ ধরনের নকশাকৃত ফলাফল অর্জিত হতে পারে। পরবর্তী সময়ে তাঁরা কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক দল ও জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের প্ররােচিত করেছেন যাতে করে ঐ সব দল ও সদস্য জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যােগদানে বিরত থাকেন। এই অধিবেশন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এর পর তারা পরস্পর যােগসাজসে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন যার দরুন পূর্ব পাকিস্তানে ‘সিভিল ডিসওবিডেন্স’ আন্দোলন, আওয়ামী লীগের সশস্ত্র বিদ্রোহে নিয়ােজিত হওয়া এবং চূড়ান্তভাবে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের বাহিনীর আত্মসর্পণ মতাে ঘটনা ঘটে এবং পাকিস্তান ভেঙে যায়।
(ii) উপরিউল্লিখিত নং (5) সামরিক কর্তাগণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধকালীন সময়ে ইচ্ছাপূর্বকভাবে কর্তব্য অবহেলা করেছেন, এবং তা অবশ্যই শাস্তিযােগ্য অপরাধ। অতএব সেজন্যও তাদের বিচার হওয়া প্রয়ােজন।
(iii) সাবেক কমান্ডার ১ কপস লে. জেনারেল ইরশাদ আহম্মেদ খান পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট জেলার শাকারঘর তেহসীল এলাকায় প্রায় ৫০০ গ্রামের নিকটবর্তী স্থানে বিনা যুদ্ধে শত্ৰু-বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ কাজের ভিতর দিয়ে তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে কর্তব্য অবহেলা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। এটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তার এ ধরনের কাজের ফলাফল হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিকল্পনা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(iv) সাবেক জিওসি ১৫ ডিভিশন, মেজর জেনারেল আবিদ জাহিদ, স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে কর্তব্য অবহেলা করেছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট জেলার পুকলিনের ৫০টি গ্রামব্যাপী বিস্তৃত এলাকায় লজ্জাজনকভাবে শত্রুবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর এই অপকর্মের ফলস্বরূপ মারালার নিরাপত্তা সাংঘাতিক হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। এর ফলে ভারতীয় বাহিনী ঐ এলাকার ১৫০০ গজের মধ্যে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক পুকলিন এলাকা বেদখল
২৭৮
হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জিএইচকিউকে অবহিত করেননি। যুদ্ধ। শেষে বিষয়টি জানা যায়। সাবেক জিওসি মেজর জেনারেল বি এম মােস্তফা স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে কর্তব্য অবহেলা করেছেন। পশ্চিম রণাঙ্গনের রাজস্থান এলাকার রামগড়ে ভারতীয় অবস্থান দখল করার নিমিত্তে তাঁর প্রণীত পরিকল্পনাটি ছিল অবান্তর এবং অপরিকল্পিতভাবে প্রস্তুতকৃত। তাছাড়া এ পরিকল্পনাটি সুসংগঠিতও ছিল না। এমতাবস্থায় তাঁর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মরুভূমিতে পাকিস্তান বাহিনী বিপুল পরিমাণ যানবাহন ও যুদ্ধসামগ্রী হারাতে বাধ্য হয়েছিল।
(vi) ইস্টার্ন কমান্ডের সাবেক কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আদালতে বিচার হওয়া দরকার। এ সব অভিযােগ সম্পূরক প্রতিবেদনের অধ্যায় ৩, অংশ ৫ এ বিবৃত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার বিষয়ে তিনি তাঁর পেশাদারিত্ব ও সামরিক কর্তব্য ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করেছেন। যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতাে ক্ষমতা থাকলেও তিনি সে পথে না গিয়ে লজ্জাজনকভাবে বাহিনীসহ ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
(vii) সাবেক জিওসি, ৩৬ (এড়হক) ডিভিশন, ঢাকা, মেজর জেনারেল জামশেদকে সম্পূরক প্রতিবেদনে উল্লিখিত ও তালিকাকৃত পাঁচটি অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করার প্রয়ােজন রয়েছে। তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য কোনাে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেননি বিধায় কর্তব্য অবহেলা প্রদর্শন করেছেন। তিনি যুদ্ধে তার সামগ্রিক সাহসীকতা ও ইচ্ছাহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়কের দ্বারা ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তে নীরব সমর্থন যুগিয়েছেন। অথচ সেই সময়ে কমপক্ষে দু’সপ্তাহব্যাপী প্রতিরােধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতাে অবস্থা ছিল। এভাবে তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে কর্তব্য পালনে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানে পুনর্বাসিত হওয়ার পরে, (পাকিস্তানি মুদ্রায়) ৫০,০০০ হাজার টাকা পূর্ব পাকিস্তানে তার দখলে থাকার বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
(viii) সাবেক জিওসি, ৩৯ (এক) ডিভিশন, চাঁদপুর, পূর্ব পাকিস্তান, মেজর জেনারেল রাহীম খানকে তালিকাভুক্ত পাঁচটি অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই প্রতিবেদনে দেখানাে হয়েছে যে, তিনি নিজের নিরাপত্তার খাতিরে তার দায়িত্বে থাকা ডিভিশন পরিত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি চাঁদপুরে
২৭৯ .
অবস্থিত তাঁর বিভাগীয় সদরদপ্তর খালি করে দেন। তাঁর ইচ্ছাকৃত জোরাজুরির কারণে মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ভীতি হয়ে দিনের বেলায় নৌপথে যাত্রার কারণে ১৪ জন নৌ সেনা এবং তার সদরদপ্তরের ৪ জন কর্মকর্তা নিহত হােন। তিনি নিজেও আহত হন। সে ঘটনায় আরও কিছু সৈন্য আহত হয়েছিলেন। এসব ঘটনাই ঘটেছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলার কারণে। সংকেত (সিগনাল) বিষয়ক মূল্যবান যন্ত্রপাতি তিনি চাঁদপুরে ফেলে এসেছিলেন এবং এ সব কিছুই শত্রুদের হস্তগত হয়ে যায়। ফলে ১২ ডিসেম্বর ঢাকার কিছু কথাবার্তা হতাশাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে জিএইচকিউ এর কাছে চাঁদপুর পরিত্যাগের বিষয়টির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা থেকে বিরত থাকেন। ফলে চাঁদপুর থেকে কোন্ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পলায়ন করলেন তা গােপন বিষয় হয়ে থেকে গিয়েছিল।
(ix) সাবেক জিওসি, ইস্টার্ন কমান্ড, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বাকের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশনের দ্বারা তালিকা প্রণয়ণকৃত নয়টি অভিযােগের কারণে সামরিক আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করা দরকার। ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়কে নিম্নলিখিত বিষয়ে সুপরামর্শ না দিয়ে তিনি ইচ্ছাপূর্বকভাবে কর্তব্য অবহেলা করেছেন। যেমন, সুষ্ঠু প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন, ভারতীয় ভয়ভীতির যথাযথ উপলব্ধিকরণ, প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, হঠাৎ করেই কমান্ড পরিবর্তন, বন্দি থাকা অবস্থায় ভাতীয়দের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তােলা, জেএইচকিউ এবং তদন্ত কমিশনের নিকট গালগল্প ফেঁদে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের দায়-দায়িত্ব থেকে পাড় পাওয়ার জন্য কমান্ডারদের ওপর জবরদস্তি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন।
(x) সাবেক কমান্ডার ১০৭ ব্রিগেড, ৯ ডিভিশন ব্রিগেডিয়ার মােহাম্মদ হায়াতের বিরুদ্ধে চারটি অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আদালতে বিচার হওয়া প্রয়ােজন। তিনি স্বেচ্ছাকৃতভাবে তার অধীনস্ত যশাের দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নে গাফিলতি করেছেন; তিনি গরীবপুরে তাঁর ব্রিগেডকে প্রতি-আক্রমণের জন্য সুষ্ঠু ও সাবলিলভাবে পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে পারেননি। তিনি যশাের দুর্গ লজ্জাজনকভাবে পরিত্যাগ করেছেন এবং যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সাজসরঞ্জাম অক্ষত অবস্থায় যশাের দুর্গে ফেলে গিয়েছেন, যা শত্রুর হাতে পড়ে এবং তা শত্রুর হাতকে শক্ত করে; যশাের দুর্গ পরিত্যাগের পর তিনি জিওসি ৯ ডিভিশন কর্তৃক নির্দেশিত মাগুরার দিকে অগ্রসর না হয়ে আদেশ অমান্য করেছেন।
(xi) সাবেক অধিনায়ক, ৫৩ ব্রিগেড, ৩৯ (এক) ডিভিশন, পূর্ব পাকিস্তান, | ব্রিগেডিয়ার মােহাম্মদ আসলাম নিয়াজীকে কমিশন কর্তৃক প্রণয়নকৃত ৬টি অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা
২৮০
প্রয়ােজন। অভিযােগগুলাে হলাে : তিনি ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর জিওসি-এর নির্দেশ মােতাবেক মুজাফফরগঞ্জে প্রতিরােধ গড়ে তােলার ক্ষেত্রে শাস্তিযােগ্য উদ্যোগহীনতা দেখিয়েছেন। তাছাড়া আত্মপ্রত্যয়ী সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রেও তার ব্যর্থতা ছিল; ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর জিওসি-এর আদেশ অনুযায়ী তিনি মুজাফফরগঞ্জ থেকে শত্রুবাহিনী বিতাড়ন করতে ব্যর্থ হন; তিনি লজ্জাজনকভাবে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, লাকসাম দুর্গ পরিত্যাগ করেন; ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি লাকসাম থেকে সৈন্যবাহিনী কুমিল্লার দিকে সরিয়ে আনার সময় ব্যর্থতার পরিচয় দেন, এর ফলে পথে তাঁর বাহিনীর প্রচুর সংখ্যক সৈন্য নিহত হন এবং শক্রর হাতে ধরা পড়েন; তিনি সামরিক রীতিনীতির ও নৈতিকতার প্রতি উদাসিন্য দেখিয়ে লাকসামে ১২৪ জন অসুস্থ এবং আহত সৈন্য, দুজন ডাক্তারসহ ফেলে রেখে এসেছিলেন। এমনকি দুর্গ পরিত্যাগ বিষয়ে তাদের তিনি জানতেও দেননি; তিনি লাকসাম দুর্গে যাবতীয় ভারী অস্ত্র, গােলাবারুদের মওজুদ এবং অন্যান্য সরবরাহ অক্ষত অবস্থায় ফেলে আসেন। ফলে তা শত্রুর হাতে চলে যায় এবং তারা তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
বর্বরতার অভিযােগের তদন্ত ও বিচার
৩। মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় III, অংশ V অনুচ্ছেদ ৭ বর্ণিত সুপারিশ এবং এই সম্পূরক প্রতিবেদনের অধ্যায় III, অংশ V অনুচ্ছেদ ৩৯ অনুযায়ী একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা কথিত বর্বরতার অভিযােগের তদন্ত করা প্রয়ােজন; এবং যাদের বিরুদ্ধে বর্বরতার অভিযােগ প্রমাণিত হবে তাদের বিচার করতে হবে। কারণ তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য বদনাম কুড়িয়েছে, স্থানীয় জনগণের মহানুভূতি লাভ করা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বঞ্চিত করেছে। কেননা, তারা নিজেদের জনগণের ওপর নির্দয় অত্যাচার করে নিজেদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাদের কর্মকাণ্ডের এই দিকটি অনৈতিক ও চরম নিষ্ঠুরতা। এই তদন্ত কমিটির গঠন জনসম্মুখে উন্মােচন করা প্রয়ােজন; যদিও কার্যবিবরণী নয়। এভাবে জাতির বিবেককে সন্তুষ্ট করা যাবে, বিশ্ব জনমতও পাকিস্তানের পক্ষে ফিরবে। একটি ফলপ্রসূ তদন্তের জন্য প্রয়ােজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্ত এখন পাকিস্তানের হাতে রয়েছে বলে কমিশন অভিমত প্রকাশ করছে। যেহেতু বাংলাদেশের সরকার পাকিস্তান কর্তৃক স্বীকৃতি অর্জন করেছে সেহেতু ঢাকার কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ করা যেতে পারে তাদের হাতে অতিরিক্ত কোনাে তথ্য-প্রমাণ থাকলে তা দিয়ে যেন তারা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকে সহায়তা করেন।
২৮১
তদন্তের অন্যান্য দিকসমূহ
৪। (i) ব্যক্তিগত অনৈতিক কর্মকাণ্ড, মাতলামি, দুর্নীতিমূলক কাজের ভিতর দিয়ে নিজের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খান, আব্দুল হামিদ খান এবং মেজর জেনারেল খােদা দাদ খানের ঘটনাগুলাে যথাযথভাবে তদন্ত করে দেখার প্রয়ােজন রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ঐ ধরনের কার্যকলাপের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণাদি রয়েছে; যার মাধ্যমে দেখা যায় নৈতিক অধঃপতন, সিদ্ধান্তহীনতা, কাপুরুষতা এবং পেশাগতভাবে অযােগ্যতার মধ্যে তারা পতিত হয়ে গিয়েছিলেন। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচারের সুপারিশ করা হয়েছে তাদের বিষয়ে এই তদন্তের ফলাফলের আলােকে অভিযােগ গঠন করা যেতে পারে। অভিযােগসমূহের সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত নজীর, সাক্ষ্য-প্রদান, তথ্য-উপাত্ত মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় ১ এর ৫ নং অংশে পাওয়া যাবে।
(ii) ব্যক্তিগত নৈতিকতা সম্পর্কে অনুরূপ কুখ্যাতি লে. জেনারেল নিয়াজীর বিরুদ্ধে রয়েছে, শিয়ালকোট এবং ঢাকায়। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি পান’ চোরাচালানীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযােগ রয়েছে। এসব অভিযােগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। প্রয়ােজনবােধে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় পেশাগত ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা সম্পর্কে আগের সুপারিশ অনুযায়ী বিচারের জন্য অতিরিক্ত অভিযােগ আনা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত মূল প্রতিবেদনের ১ম অধ্যায়য়ের ৫ম অংশে পাওয়া যাবে, সেইসঙ্গে এই সম্পূরক প্রতিবেদনের ১ম অধ্যায়ের ৫ম অংশে তা পুনরুল্লিখিত হয়েছে।
(iii) কথিত ৫০,০০০ হাজার রুপি বিতরণ সম্পর্কিত অভিযােগের বিষয়ে মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদের (সাবেক জিওসি, ৩৯ [এডহক] ডিভিশন এবং ডাইরেক্টর জেনারেল) বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার করা যেতে পারে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এরকম ঘটনায় জড়িত ছিলেন। জেনারেলের ব্যাখ্যাসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ, এই সম্পূরক প্রতিবেদনের অধ্যায় ১, অংশ ৫ এর অনুচ্ছেদ ২১-২৩ এ পাওয়া যাবে। আমরা ইতােমধ্যে সুপারিশ করেছি যে, সামরিক আদালতে এই কর্মকর্তার বিচার করা যেতে পারে। অভিযােগগুলাের মধ্যে স্বেচ্ছাকৃতভাবে ৫০,০০০ হাজার টাকার বিষয়টি প্রকাশের ব্যর্থতাও থাকবে। যদিও এই অভিযোেগ তাঁর অসততার পরিচয় বহন করে না। কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে অপরাপর অভিযােগের (ইতােমধ্যে সুপারিশকৃত) সঙ্গে এটিকে সংযুক্ত করার জন্য সুপারিশ করছে।
২৮২
(iv) পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক লুটপাটের অভিযােগের সঙ্গে সাবেক কমান্ডার ৫৭ ব্রিগেডে, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার, সাবেক সিও, ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট লে. কর্নেল (এখন ব্রিগেডিয়ার), মুজাফফর আলী জাহিদ, সাবেক সিও, ১৮ পাঞ্জাব বাসারাত আহমেদ, সাবেক সিও, ৩২ পাঞ্জাব, লে. কর্নেল মােহাম্মদ তাজ, সাবেক সিও, ৫৫, ফিল্ড রেজিমেন্ট মাদাদ হােসাইন শাহ্ কর্তৃক সিরাজগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংক ট্রেজারি থেকে ১,৩৫,০০০ টাকা চুরি করার অভিযােগ রয়েছে। বিষয়টি এই সম্পূরক প্রতিবেদনের ৫ম অংশের ২৪ এবং ২৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কিছু আমলে নিয়ে বিস্তারিত ও নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটন পূর্বক তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করা গেল।
(v) মূল প্রতিবেদনের অনুচ্ছেদ ৩৬ অধ্যায় ১, অংশ ৫ এ আমাদের দ্বারা উত্থাপিত অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত অনুষ্ঠিত করতে হবে মেজর-জেনারেল জাহানজেবের বিরুদ্ধে। মুলতানে সামরিক প্রশাসক হিসেবে (সম্ভবত সেই সময়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে ছিলেন) তিনি একজন পিসিএস কর্মকর্তা যিনি তখন মুলতানের মিউনিসিপ্যাল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। তাঁর কাছে এক লক্ষ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। এজন্য তাঁর বিরুদ্ধে তিনি সামরিক আইনে দুর্নীতির অভিযােগ এনেছিলেন। ঘুষের এই দাবির ফলাফল হিসেবে সেই পিসিএস কর্মকর্তা একখানি পত্রে ঘটনার বিবরণ লিখে রেখে আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে কথিত রয়েছে। তিনি তাতে লিখেছিলেন মাত্র ১৫,০০০ টাকা তিনি বানিয়েছিলেন অথচ তাঁকে ঘুষ বাবদ সামরিক আইন কর্মকর্তাকে ১ লক্ষ টাকা দিতে হবে। এই অভিযােগটি কমিশনের সামনে উত্থাপন করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার আব্বাস বেগ (সাক্ষী নং ৯)।
(vi) ব্রিগেডিয়ার হায়াতউল্লাহর বিরুদ্ধেও একটি তদন্ত হওয়া দরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের মকবুলপুর সেক্টরে ১৯৭১ সালের ১১ ও ১২ তারিখ রাতের বেলায় তিনি কিছু সংখ্যক মেয়ে মানুষকে বাঙ্কারে আপ্যায়ন করেছিলেন, অথচ তখন ভারতীয় কামানের গােলা-বাহিনীর উপর বর্ষিত হচ্ছিল। কমিশনের নিকট আসা অনেক বেনামি চিঠিপত্রের মাধ্যমে অভিযােগটি করা হয়। ঐ সব চিঠিপত্রের মাধ্যমে আসা অভিযােগটি ব্রিগেডিয়ার হায়াতউল্লাহ্র ব্রিগেড মেজর, মেজর মনােয়ার খান (সাক্ষী নং ৪২) দ্বারা সমর্থিত হয়।
(vii) মূল প্রতিবেদনের ১ অধ্যায়ের ৫ অংশের ৯-১৪ অনুচ্ছেদে বিবৃত অভিযােগসমূহের আলােকে তদন্ত হওয়া আবশ্যক। সেখানে বলা হয়েছে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাগণ অমার্জিতভাবে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক পদমর্যাদা
২৮৩
ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সামরিক আইনের অধীনে বিপুল পরিমাণ ভূমি, বাড়িঘর করেছেন এবং গৃহনির্মাণ বিষয়ক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে মালিক বনে গিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছেন যেখানে তারা বিভাগীয় ফান্ড জমা রাখতেন। এই ধরনের কার্যকলাপ সামরিক আইন ও দেশের সাধারণ আইনে অপরাধমূলক; এবং এজন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে।
(viii) কমিশনের মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া সন্দেহগুলাে নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হওয়া দরকার- ভারত থেকে প্রত্যাবাসিত কর্মকর্তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় অতিরিক্ত কিছু তথ্য-প্রমাণ আমাদের গােচরীভূত হয় যেখানে কমান্ডারদের ভিতর কিছু মাত্রার জটিলতা ও সংর্ঘষের মতাে ঘটনা ঘটেছিল। এর মধ্যে ছিলেন, কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড, লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী এবং তাঁর চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী এক দিকে এবং অন্যদিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ভিতর ইস্যু ছিল ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর জিএইকিউ কর্তৃক নির্দেশ প্রদান করার পরও আত্মসমর্পণের তাৎক্ষণিক আগে প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ব্যর্থতা। আমরা ইতােমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযােগ দায়ের করেছি, তবে আমরা মনে করি জনস্বার্থে বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষায়িত এজেন্সির দ্বারা পুনরায় তদন্ত করা হােক। আমাদের কাছে যে তথ্য-উপাত্ত রয়েছে তার দ্বারা শুধুমাত্র সন্দেহের মতাে অভিযােগ আনা সম্ভব। কিন্তু ইস্টার্ন কমান্ড কর্তৃক ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রত্যাখ্যাত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বন্ধ করার নির্দেশের যথাযথ কারণ দাঁড় করানাে বা তা ব্যাখ্যা করার মতাে উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। এ ঘােষণার ফলে বিপুল পরিমাণের যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী অক্ষত অবস্থায় ভারতীয় বাহিনীর হস্তগত হয়ে যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ অধ্যায় ৭, অংশ ৪ দেওয়া হয়েছে ।
(ix) ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর খুলনার পিএনএস তিতুমীর নৌ সেনা দপ্তরে কার্যরত পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডার গুল জারিন কোন্ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসি জাহাজ- এমভি ফট্রক্সকিউতে করে খুলনা থেকে সিঙ্গাপুর গেলেন সে বিষয়ে একটি তদন্ত হওয়ার আবশ্যকীয়তা রয়েছে। মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় ৩, অংশ ৫ এর ১১ ও ১৩ অনুচ্ছেদে আমরা উক্ত কর্মকর্তার বিষয়টি বর্ণনা করেছি।
বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণযােগ্য ঘটনা
৫। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে আমরা সাবেক কমান্ডার ২৩ ব্রিগেড, ব্রিগেডিয়ার এম, এ আনসারী,
২৮৪
ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমাদ, সাবেক কমান্ডার ৫৭ ব্রিগেড, ৯ ডিভিশন এবং ৩৬ (এডহক) ডিভিশনের ৯৪ ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাদির খানের সম্পর্কে খুবই অনুত্তম মন্তব্য করেছিলাম। আমরা মনে করি তাদের আর জনস্বার্থে চাকরিতে রাখার প্রয়ােজন নেই। এবং এমতাবস্থায় তাদের অবসর প্রদান করাই সমীচীন হবে।
যুদ্ধে নিমপদস্ত কর্মকর্তাদের ভূমিকা
৬। ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার নীচের কোনাে সামরিক কর্মকর্তার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা কমিশনের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তারপরও আমাদের দৃষ্টিগােচরে। এসেছে যে, তাদের কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের ভাগ্যনির্ধারণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন অথবা কারও কারও ভূমিকা ছিল শৃঙ্খলাবােধের সীমা লংঘন করার মতাে। যথাস্থানে আমরা তেমন ভূমিকার উল্লেখ করেছি। কিন্তু মােটের ওপর নিমপদস্থ কর্মকর্তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট সদরদপ্তর দ্বারা সম্পন্ন হওয়া। দরকার। এ ভাবে তারা তাদের অধীনস্ত নিমপদস্থ কর্মকর্তাদের ভূমিকার সার সংক্ষেপ জমা দিতে পারেন।
সামরিক বাহিনীতে নৈতিকতা সম্পর্কিত বিষয়াদির সংস্কার প্রসঙ্গ
৭। ১৯৭১ সালের বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে নৈতিক বিষয়াদি নিয়ে কিছু কাজ করতে গিয়ে আমরা যা পেয়েছি তা মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় ১, অংশ ৫ এ বিবৃত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এ বিষয় নিয়ে সম্পূরক প্রতিবেদনেও বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। আমরা এই মতের সঙ্গে একমত হয়েছি যে, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া। অভিযােগ (কেবল বিশ্বাসই নয়), যেমন সামরিক আইনের অধীনে কাজ করতে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া। মদ এবং নারী আসক্তি, জমিজমা ও বাড়িঘরের প্রতি লােভাতুরতার কারণে বিপুল সংখ্যক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা, বিশেষভাবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কেবল যে যুদ্ধ করার মতাে ইচ্ছা শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তাই নয়, সেইসঙ্গে তারা পেশাগত দিক থেকেও অযােগ্য হয়ে পড়েছিলেন। এ কারণে দেখা গিয়েছিল যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তারা সফলতার পরিচয় দিতে পারেননি। ফলে যুদ্ধে বিপর্যয় নামে। সে কারণে আমরা সুপারিশ করেছি যে :
I) সরকার সকল সেনা-কর্মকর্তাদের তাদের সম্পদের ঘােষণাপূর্বক তার বিবরণ জমাদানের জন্য আদেশ দিতে পারে। এর মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর। সব ধরনের সম্পদেরই হিসাব থাকতে হবে। তাদের আত্মীয়স্বজন ও তাদের ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদের বিবরণ গত বছর থেকে শুরু করে জমা দিতে হবে। (দুই সামরিক শাসনের সময়ে তারা এ ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন)। যদি কোনাে কর্মকর্তার জ্ঞাত ও বৈধ আয় বহির্ভূত সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
২৮৫
(ii) সামরিক বিষয়াদি নিম্নলিখিতভাবে নিশ্চিত করার জন্য উপায় উদ্ভাবন করতে হবে-
(ক) উচ্চপর্যায়ে নৈতিকতা বিরােধী কোনাে প্রকার অপকর্মের সঙ্গে আপস না করা;
(খ) উচ্চতর পদে পদায়নের ক্ষেত্রে পেশাগত গুণপনা ও দক্ষতার সঙ্গে নৈতিক বিষয়টিকেও ধরতে হবে;
(গ) সামরিক অ্যাকাডেমি এবং সেনা সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় মূল্যবােধ, গণতান্ত্রিকতা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্ক শিক্ষণীয় বিষয় রাখতে হবে;
(ঘ) সেনাবাহিনীর মেস-এ এবং অনুষ্ঠানে মাদক ও মাদক জাতীয় পানীয় নিষিদ্ধ করতে হবে; যৌন কেলেংকারী এবং অন্যান্য দুর্নীতি সম্পর্কে সাংঘাতিকভাবে খোঁজখবর রাখতে ও তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শৃঙ্খলা এবং চাকরির শর্তাবলি
৮। মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় ৩ এর অংশ ৫ এ এসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে; এখন এ সম্পর্কে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলাে পরিবেশিত হলাে :
(i) কর্মকর্তাদের জন্য আন্তঃচাকরি বিষয়ে গবেষণা করতে হবে যাতে চাকরি বিধি এবং আনন্দদায়ক উপকরণসমূহের মধ্যে সমন্বিত পন্থা অর্জন করা যায়। জেসিও এবং অন্যান্য পদমর্যাদার চাকরিজীবীদের মধ্যে যেন ব্যবধান ঘােচানাে যায়; এতে করে নিমপদস্ত কর্মকর্তাদের ভিতর জমে থাকা ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি লাঘব করা যাবে।
(ii) মেজর-জেনারেল ইফতেখার জানজুয়াকে প্রধান করে গঠিত শৃঙ্খলা কমিটির প্রতিবেদনের সুপরিশসমূহ জিএইচকিউ কর্তৃক বিবেচনায় আনতে হবে;
(iii) নৌ ও বিমানবাহিনী নিজস্ব শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করতে পারে। কেননা তাদের চাকরি ক্ষেত্রের সমস্যার ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্রতা রয়েছে। এই পদক্ষেপ হবে আন্তঃচাকরির বিষয়ের গবেষণার সুপারিশের অতিরিক্ত।
পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর উৎকর্ষবিধান ও আধুনিকীকরণ
১০। মূল প্রতিবেদনের অধ্যায় viii, অংশ iv এর অনুচ্ছেদ (ডি)-তে পাকিস্তান নৌ বাহিনীর পূর্বপাকিস্তানে কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। সম্পূরক প্রতিবেদনেও বিষয়টি বিস্তারিতভাবে পুনরায় আলােচিত হয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর উৎকর্ষ বিধানপূর্বক নৌবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিমলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়ােজন, যেমন-
(i) পাকিস্তান নৌবাহিনী মৌলিক প্রয়ােজন মিটাবার মধ্যে দিয়ে এর উৎকর্ষসাধন ও আধুনিকীকরণের জন্য এক্ষুনি নজর দেওয়া প্রয়ােজন;
২৮৬
যাতে করে নৌবাহিনী দেশের একমাত্র নৌবন্দরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে এবং জাতির জীবন প্রবাহ চলমান রাখতে সক্ষম হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনী দেশের প্রথম সামরিক আইন জারির সময় থেকেই অবহেলার নিগড়ে পতিত হয়। সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের অভিমত হলাে এই যে, নৌবাহিনীর কাছ থেকে অধিকতর ভূমিকা প্রত্যাশিত নয়। এই তত্ত্বের মূঢ়তা এই যুদ্ধের সময় পরিপূর্ণ ও নিদারুণভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। আমরা অত্যন্ত প্রবলভাবে সুপারিশ করছি পাকিস্তান নৌবাহিনীর নিজস্ব বিমানঅস্ত্র ও যুতসই বিমান থাকতে হবে যার মাধ্যমে শত্রুর অবস্থান এবং মিসাইল বােটের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা সম্ভব হয়। ভারতের ক্রমবর্ধিষ্ণু নৌবাহিনী এবং তার মিসাইল বােটের ভীতির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ একমাত্র ভাবেই হতে পারে;
(ii) করাচি বন্দর থেকে দূরে কোথাও নৌবাহিনীর পৃথক নিজস্ব পােতাশ্রয় থাকা জরুরিভাবে প্রয়ােজন। এভাবেই নৌবাহিনী কার্যকরভাবে করাচির প্রবেশমুখের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে;
(iii) পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রতি সাংঘাতিক বাধা এসেছিল D-day এবং H-hour এ; এবং যুদ্ধের এ বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণভাবে বাতিলকৃত । এমতাবস্থায় জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ এর মধ্যে সর্বদায় নৌবাহিনীকে সংযুক্ত করতে হবে।

Previous