You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

মুজিববর্ষ স্মারক প্রকাশনা
বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ
জাতির পিতার জীবনে আইন, মামলা ও বিচার কার্যক্রম

মুখবন্ধ
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার অদম্য স্পৃহায় বিকশিত হয়েছে বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রাম। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও অনিঃশেষ আত্মত্যাগের পরেও সেই আকাঙ্ক্ষার সার্থক পূর্ণতা পেতে একজন স্বপ্নপুরুষের জন্য জাতি অপেক্ষা করেছিল। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের স্থপতি ও মহানায়কই নন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপামর নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের সংগ্রামে এক বিস্ময়কর ঐতিহাসিক প্রেরণার নাম। সবুজ-শ্যামল এই দেশের অকপট অথচ দ্রোহী জনতার মননে স্বাধীনতার দীপশিখা জ্বালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শােষণের যাতাকল থেকে জাতিকে মুক্ত করেছেন। একটি মানবতাবাদী স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিরলস ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি। মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনে পরাধীনতা ও শােষণ-বৈষম্যের শৃঙ্খল থেকে বাঙালিকে মুক্ত করার সুমহান পার্থিব সফর শেষে তিনি যেন এক মহাকালকে যাপন ও অতিক্রম করেছেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তারুণ্যের উল্লেখযােগ্য সময় তিনি কাটিয়েছেন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে; হাসিমুখে বরণ করেছেন পুনঃ পুনঃ গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা ও অন্যায় আটকাদেশ। ফিরে এসেছেন ফাঁসির মঞ্চ থেকে। এমনকি অকাল-আত্মত্যাগ করেছেন কালের জঘন্যতম ঘটনায়। তাঁর দেশপ্রেমিক সত্তার সঙ্গে অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের। অপরিসীম যন্ত্রণা ও বেদনায় সিক্ত তাঁর জীবন অজস্র অতুলনীয় অর্জনে উদ্ভাসিত। সাহস, সংকল্প, ত্যাগ ও অর্জনের অনুপম দৃষ্টান্তে তিনি তাই আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়।
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ভারতবর্ষ জুড়ে উত্তাল ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের হাওয়া পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশে তখন ভীষণ বেগে বইছে। এমনই এক সময়ে বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরােধী আন্দোলনে। তারপর ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি ও পরবর্তীকালে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ইতিহাসের পাতায় জ্যোতির্ময় হয়ে আছে। দরিদ্র, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও ভাগ্যহত মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের এই দীর্ঘ লড়াইয়ে এমন কোনাে জুলুম-নির্যাতন নেই, যা তার উপর শাসকগােষ্ঠী করেনি।
মুজিববর্ষ তথা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে গঠিত সুপ্রীম কোর্টের জাজেস কমিটি কতিপয় ঐতিহাসিক রায় ও দলিলপত্রের সন্ধান পেয়েছেন, যেগুলাের বিষয়বস্তু স্পষ্ট জানান দেয় পাকিস্তানি শাসনের দুই
০৯

যুগে বঙ্গবন্ধুকে কী নিদারুণ নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, রায়গুলাের প্রতিটি পৃষ্ঠায় তাঁর অসামান্য সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক জীবনগাথার ঐতিহাসিক প্রমাণ ও উপাদানসমূহ ছড়িয়ে আছে।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফার কথা আমরা জানি। কিন্তু এই ছয় দফা প্রসঙ্গে তৎকালীন উচ্চ আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল তা এ যাবৎকাল সাধারণ মানুষের কাছে অনাবিষ্কৃত থেকে গিয়েছিল। ছয় দফা প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা দেশ সফর করে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং রায় নিয়েছেন সাধারণ জনগণের। সেসব বক্তৃতায় দেশদ্রোহিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে তাকে বারবার গ্রেপ্তার ও কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। ছয় দফাকে সারা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য তিনি যেসব বিশ্লেষণী বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলােতে কোনাে অপরাধমূলক উপাদান আছে কি-না তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে তৎকালীন সর্বোচ্চ প্রাদেশিক বিচারালয় ঢাকা হাইকোর্ট। ফলে, ক্ষেত্রবিশেষে অনিবার্যভাবেই আদালতের প্রসিডিংস বা বিচারিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতেও আলােচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল ছয় দফা।।
পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বহু মামলা করা হয়েছে; বারবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে; দীর্ঘদিন অন্যায়ভাবে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। এসবই করা হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামকে স্তব্ধ করা এবং মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শাসনযন্ত্রের সেসব ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। বরং প্রতিটি মামলা ও অন্যায্য কারাবাস যেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতীতি ও বিশ্বাসকে আরাে সুদৃঢ় করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক নেতা বিরল, যাকে শাসকদের চব্বিশ বছর সময়ের প্রায় অর্ধেককাল বিনা অপরাধে কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এত মামলা দায়ের সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলাতেও দণ্ডাদেশ দিতে পারেনি। কারণ সুস্পষ্ট, তিনি ছিলেন নির্দোষ এবং তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ ছিলেন আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জ্ঞানের আলােকচ্ছটায় ঋদ্ধ এবং প্রাজ্ঞতার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত। কাজেই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে সবসময় উপেক্ষা করেছেন তাঁরা। বঙ্গবন্ধু তাই ১৯৭২-এর ১৮ ডিসেম্বর দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট’ উদ্বোধনকালে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, “এত বিপদ-আপদ, এত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের মধ্যে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এত তাড়াতাড়ি এজন্য দিয়েছি যে আইনের শাসনে বিশ্বাস করি এবং সেজন্যে শাসনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে। আশা করি আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের শাসনতন্ত্র হয়েছে যার জন্য বহু রক্ত গেছে- এ দেশে আজ আমাদের সুপ্রীম কোর্ট হয়েছে। যার কাছে মানুষ বিচার আশা করে।”
একটি রাজনীতি-সচেতন পরিবারে বঙ্গবন্ধুর জন্ম। বাবার দেওয়ানি আদালতে চাকরিসূত্রে তাে বটেই, ভারত বিভাগ-পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়ন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মতাে খ্যাতনামা আইনজীবীদের নিবিড় সান্নিধ্য তাঁর আইন তথা বিচার বিভাগ সম্বন্ধীয় মনীষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে আদালতের তথা বিচার বিভাগের সম্পৃক্তি ও মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি এক সুবিশাল ক্যানভাসে চিত্রায়িত হয়েছে এই স্মারকগ্রন্থে।
আমার বিনীত অনুরােধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে লেখাটি দিয়েছেন তা এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠতম সংযােজন হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবে। বর্ণনার প্রাঞ্জলতায়, উপলব্ধির প্রগাঢ়তায় এবং স্মৃতিচারণের বিশিষ্টতায় তাতে স্নেহার্ড পিতার সঙ্গে কন্যার সম্পর্কের গভীরতম অনুভূতির মর্মস্পর্শী আখ্যানের পাশাপাশি অঙ্কিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও নিয়ত সংগ্রামের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিচারক তথা আইনজীবীগণের জন্য এই লেখা বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ধারণ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার
১০.

বিশ্বাস। নিযুত ব্যস্ততা সত্ত্বেও বিচার বিভাগের জন্য নিবন্ধ বিরচনে সময় দেওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

আমরা জানি, তীব্র সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর। তবে তাঁর জীবনে মামলা, আদালত, নির্যাতনমূলক গ্রেফতার তথা পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক আরােপিত আইনি অভিঘাতের ওপর বিশ্লেষণী উল্লেখযােগ্য আলাদা কোনাে সংকলনবদ্ধ প্রকাশনা ছিল না। এই গ্রন্থ সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও দূর করতে সক্ষম হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণার যে বলিষ্ঠ ধারা সূচিত হয়েছে, তা স্বচ্ছন্দ গতিতে চলমান থাকবে বলে আমি একান্তচিত্তে প্রত্যাশা করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা ও আদালতের রায় বিষয়ে। তথ্য ও দলিলভিত্তিক গবেষণাসমৃদ্ধ এই স্মারকগ্রন্থটি সেই ধারাবাহিকতায় একটি উল্লেখযােগ্য ও অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠবে। এই স্মারকগ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক ঘটনাবহুল জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতের মােট নয়টি রায় আমরা বাংলায় অনুবাদের প্রয়াস পেয়েছি। উৎপীড়িতের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সারা জীবন শক্তিশালী ও গতিশীল বিচার বিভাগ চেয়েছেন, বিশ্বাস করেছেন তার স্বাধীনতায়। অনূদিত রায়সমূহে দেখা যায় বিচার বিভাগও সেই বিশ্বাসের মূল্যায়ন করেছিল; পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর রক্তচক্ষু অবজ্ঞা করে স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অধিকার ও আন্দোলনের। বঙ্গবন্ধসহ তার পরিবারবর্গের হত্যা মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের। আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায়টির বঙ্গানুবাদও এই স্মারকগ্রন্থে সংযােজন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল মায়ের ভাষা বাংলাকে আদালতে প্রতিষ্ঠা পেতে দেখা। সেই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত রায়সমূহের বাংলা অনুবাদ জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র নৈবেদ্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনবিষয়ক বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট জাজেস কমিটির সকল সদস্যবৃন্দের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
এই সুবৃহৎ প্রকাশনায় আমার সঙ্গে জড়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকাবিষয়ক জাজেস উপ-কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের উদ্দেশ্যে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস যদি আগ্রহী পাঠক-গবেষক মহলকে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সূত্র জোগাতে সক্ষম হয়, তবেই আমাদের এ-উদ্যোগ সার্থকতায় পরিপূর্ণ হবে।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হােসেন
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও
সভাপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনবিষয়ক
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট জাজেস কমিটি
১১

ভূমিকা
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে মামলা, গ্রেফতার, কারাগার এবং আদালত- এই শব্দগুলাে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন, হয়েছেন মামলার ভারে জর্জরিত, সয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতন। পাকিস্তানি শাসনামলের চব্বিশ বছরে বঙ্গবন্ধুকে যতবার গ্রেফতার এবং কারাবরণ করতে হয়েছে, স্বাধিকার অর্জনের সংকটময় সময়ে বিশ্বের অন্য কোনাে নেতাকে ততবার গ্রেফতার করা হয়নি; এত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা আর কারাে বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়নি; প্রায় এক যুগের অধিক সময় আর কাউকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকতে হয়নি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি ও নির্যাতন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযােগে এবং পরবর্তীকালে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে তাঁকে বিনাবিচারে তিন বছর জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৫৩ সালে আবার মামলা দিয়ে তাঁকে জেলবন্দি করা হয়। শুধু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল পাঁচটি মামলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা সবারই জানা। এরকম বহু মামলায় হাজিরা, জামিন, শুনানি ইত্যাদির জন্য বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অহর্নিশ ছুটে বেড়াতে হয়েছে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে এসব মামলার প্রতিটিতে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণিত হতে দেখে আবার নতুন মামলা করা হয়েছে। তাঁকে দমন, নির্যাতন ও রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এমন কোনাে পন্থা নেই যা পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী অবলম্বন করেনি। তাকে নির্বাচনের অযােগ্য ঘােষণা করা হয়েছে; দুই-দুইবার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে; তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অমূলক অভিযােগের ভিত্তিতে ঘুষ-দুর্নীতি ও সরকারি ক্ষমতা অপব্যবহারের মামলা করা হয়েছে।
মামলার জন্য তাকে বিভিন্ন জেলা আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়েছে। তবে তিনি যেখানেই গিয়েছেন, কোর্টে হাজিরার আগে বা পরে ওই জেলায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। মূলত দেশব্যাপী ছয় দফার সফল প্রচার ও জনপ্রিয়তা অর্জনের পেছনে এসব মামলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যা আজও রয়ে গেছে। গবেষকদের দৃষ্টির অগােচরে। ছয় দফা ঘােষণার পর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা। আইয়ুব প্রশাসন শেখ মুজিবের উত্থান ঠেকাতে তাঁর বিরুদ্ধে আইনের অপব্যবহার বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে দেখা যায়, ছয় দফা ঘােষণার পর দেড় বছরে তার ওপর সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে এবং ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কমপক্ষে পনেরােটি মামলার বেড়াজালে পুরাে সময়টাই
১৩

কারাগারে আটক ছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলােচিত ও বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে তার বিরদ্ধে একই সময়ে আরাে অনেক মামলা চালু ছিল।
পাকিস্তানের দুই যুগে (১৯৪৭-১৯৭১) বঙ্গবন্ধুকে কমপক্ষে ত্রিশটি মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে। বারবার গ্রেফতার করা হয়েছে, মাঝে মাঝে জামিন দেওয়া হয়েছে, তবে বেশির ভাগ সময়ই জামিন দেওয়া হয়নি। তিনটি মামলায় বিচারিক আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ড ঘােষণা করা হয়; আবার এসব দণ্ড উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘােষিত হয়। আইয়ুব-মােনায়েম চক্র সব সময়ই কোনাে না কোনাে মামলা দিয়ে তাঁকে নিগৃহীত করতে চেয়েছে।
স্বৈরাচারী শাসনযন্ত্রের সেই সব হয়রানির বিরুদ্ধে বেশির ভাগ সময়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিল বিচার বিভাগ। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া সব সময় এসব জুলুমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিচার বিভাগ। এত মামলা দিয়েও যখন বঙ্গবন্ধুকে প্রতিহত করা যায়নি, তখন আইয়ুব সরকার সেসব সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে শুরু করে যারা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতি ইত্যাদি কাগজে ছাপতেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা মুদ্রণের কারণে রাতারাতি চারটি সংবাদপত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। এই নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা হয় এবং আদালতের নির্দেশে পত্রিকাগুলাে লাইসেন্স ফেরত পেয়েছিল।
ছয় দফা ঘােষণার দেড় মাসের মাথায় পল্টন ময়দানে প্রদত্ত এক ভাষণকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে নতুন করে এক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। তাঁকে আটক করা হয়। এই আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস রিট দায়ের করা হয়। এই সময়ে বিচার বিভাগের ওপরও অনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন নামঞ্জুর করা হলেও এই রায়ে ঢাকা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি একটি যুগান্তকারী ডিসেন্টিং রায় প্রদান করেছিলেন। সেই মাইনরিটি রায়ের রেশিওই পরবর্তীকালে অন্যান্য মামলায় স্বীকৃত ও গৃহীত হয়েছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বন্দিত্বকালেও বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির জন্য নীল নকশার বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বিষয়ও বর্তমান গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযােগী ও কর্মীদের সম্পর্কে উচ্চ আদালতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায় রয়েছে। এগুলাে দলিল হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতিমুখ বােঝা ও ব্যাখ্যার জন্য খুবই কার্যকর।
বঙ্গবন্ধু এক মহাজীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর জীবন নিয়ে এখনাে অবিরত গবেষণা চলছে। সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সম্পাদিত, এ পর্যন্ত দশ খণ্ডে প্রকাশিত, হাক্কানী পাবলিশার্স) এবং আগরতলা কনস্পিরেসি কেইস (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সম্পাদিত, চার খণ্ডে প্রকাশিত, মাওলা ব্রাদার্স) বই দুটি বঙ্গবন্ধুর জীবনী বিষয়ে অতিসম্প্রতি প্রকাশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম। এই দুটি বই হতে তার জীবনী বিষয়ে বর্তমান গবেষণাকর্মে অনেক তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সব দিকই কোনাে না কোনােভাবে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এলেও তাঁর জীবন-সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানিমূলক মামলা, বিচার কার্যক্রম এবং এসব মামলা বিষয়ে বিচার বিভাগীয় অবস্থানের দিকটি নিয়ে আজ পর্যন্ত ব্যাপক অনুসন্ধান হয়নি। আমাদের বর্তমান গবেষণায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বাঁকে বাঁকে তিনি যেসব মামলার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেসবের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
আমাদের হিসাব অনুসারে, পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ত্রিশটি মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি মামলায় (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ১৯৬৬ ও যুদ্ধে উস্কানি ১৯৭১) যথাক্রমে আইয়ুব

১৪

খান ও ইয়াহিয়া খান তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার সক্রিয় চেষ্টা করেছে। এছাড়া অন্যান্য মামলার উদ্দেশ্য ছিল বছরের পর বছর যেন তাকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটক রাখা যায়। এসব মামলার ইতিহাস পড়লে স্পষ্ট বােঝা যায় যে, পাকিস্তানি শাসনযন্ত্র বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কণ্ঠকে জেলের ভেতরে রেখে রুদ্ধ করে দিতে প্রতি মুহূর্তে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু কোনাে ষড়যন্ত্রেই কাজ হয়নি। প্রতিবার প্রতিটি মিথ্যা, বানােয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলার নাগপাশ ছিড়ে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন।
উল্লেখ্য যে, এতগুলাে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় মাত্র দুটিতে সাজানাে সাক্ষী ও বানােয়াট প্রমাণের ভিত্তিতে নিম আদালত তার বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেছিল। বাকি কোনাে মামলায়ই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযােগ দাঁড় করানাের মতাে প্রমাণও তারা খুঁজে পায়নি। সেসব মামলার উদ্দেশ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি করা ও কারাগারে আটকে রাখা। যে দুটি মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় প্রদান করা হয়েছিল সেই দুটি মামলার রায়ও শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে প্রমাণহীন ও ভিত্তিহীন হিসেবে বাতিল ঘােষিত হয়েছিল।
অর্থাৎ হাজারাে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটি মামলাও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। আধা-ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনকাঠামাে ও সরকারযন্ত্র নানাভাবে বিভিন্ন সংস্থাকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। তবে, সেই দুর্দিনেও বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সেই সময়ে পূর্ব বাংলার উচ্চ আদালত খুবই সূক্ষ্ম ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। সরকারি নানা নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের মুখেও বঙ্গবন্ধু সেই সময় বিচার বিভাগ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আইনের শাশ্বত বিচারনীতির আলােকে ন্যায্য আনুকূল্য লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, আবার কিছু ক্ষেত্রে তা হয়নি।
যে মানুষটিকে কালাে আইন এবং আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতা দিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে, সেই মানুষটি স্বাধীনতার পরপরই বিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বাধীন, ন্যায়ানুগ একটি বিচার কাঠামাের সূত্রপাত করেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এমন একটি সংবিধান বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি সংবিধান। সেই পবিত্র সংবিধানকে কলঙ্কিত করা হয়েছে বারবার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করার প্রাক্কালেও তাই বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছে।
আমরা দেখতে পাই, ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট উদ্বোধনকালে দেওয়া বক্তৃতায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে মামলা ও বিচার বিভাগসংক্রান্ত বহু উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমাদের এই গবেষণায় জাতির পিতার জীবনের সেই সব ঘটনার বহু অজানা অধ্যায় উন্মােচিত হয়েছে। এই গবেষণাকর্মে পাকিস্তান গণপরিষদে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা যেমন ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পর্কেও আলােকপাত করা হয়েছে। তবে এই সব বিষয়ে আরাে নিবিড় গবেষণা হওয়া প্রয়ােজন। আশা করি আইন গবেষণায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ এ-ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
এই সব মামলা পর্যালােচনার মাধ্যমে আমাদের চোখের সামনে জানা ইতিহাসের এক অজানা ও অনাবিষ্কৃত অধ্যায়ের উন্মােচন হবে। পড়তে পড়তে মনে হবে, এটিই বরং বিস্ময়কর যে কেন আজ পর্যন্ত জাতির পিতার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টির উপর ব্যাপক গবেষণা হয়নি।
১৫

পরিশেষে এই গবেষণাকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হােসেন মহােদয়কে, যার প্রবল আগ্রহ আর উৎসাহ ব্যতীত এই গবেষণাকর্ম আলাের মুখ দেখত না। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনসংক্রান্ত স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকাবিষয়ক জাজেস উপ-কমিটির সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ এবং বিচারপতি মাে. শাহিনুর ইসলামকে, যাদের নিরলস পরিশ্রমের ফসল আমাদের এই গবেষণাগ্রন্থ।
গবেষণাকর্মটি প্রকাশের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রশাসনের সকল কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আরও অনেকেই বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। এই ক্ষুদ্র কলেবরে তাদের নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাদের প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই বইয়ে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ থেকে যেতে পারে। তাছাড়া তথ্য, দিন, তারিখ ইত্যাদি বিষয়েও আমাদের অগােচরে কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। বিজ্ঞ পাঠকগণ সেসব ত্রুটি ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞতাসহ তা পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নেওয়া হবে।

সকলকে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা।

বিচারপতি মােঃ নূরুজ্জামান
বীর মুক্তিযােদ্ধা ও বিচারপতি, আপিল বিভাগ
আহ্বায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী
উদ্যাপনসংক্রান্ত স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকাবিষয়ক জাজেস উপ-কমিটি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
১৬

অন্তরের রক্তক্ষরণ : একটি রাষ্ট্রের জন্ম
শেখ হাসিনা’

বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ আজ সারা বিশ্বে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের সুযােগ পেয়েছেন। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকুরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য সবকিছুরই সুযােগ তৈরি হয়েছে। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা দেশের গন্ডী পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা দেশের কৃষির উন্নয়নে কোনাে পদক্ষেপই গ্রহন করেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর কৃষি এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। গবেষণা হচ্ছে। অবকাঠামাে উন্নয়ন হচ্ছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষ ঘর পাচ্ছেন; ঠিকানা পাচ্ছেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক মানুষ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী, প্রতিবন্ধী সকলে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ বিশ্বে আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে।
আজকে যা কিছু অর্জিত হয়েছে বা হচ্ছে তা সবই স্বাধীনতা অর্জনের ফসল। স্বাধীনতা অর্জিত না হলে বাঙালি জাতি আপন সত্তা নিয়ে দাঁড়াতেও পারত না। এই স্বাধীনতা কত মানুষকে কত সুযােগ করে দিয়েছে, যা স্বাধীনতার পূর্বে কল্পনাই করা যেত না।
কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে কত ত্যাগ, কত রক্তক্ষরণ হয়েছে তা কি কেউ কখনও ভেবে দেখেছেন? আপনজনহারা মানুষের বেদনা কি কেউ উপলব্ধি করতে পারেন?
আমার ছােটোবেলার কথা মনে পড়ে। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে তখন থেকেই শুনেছি আব্বা জেলে। গ্রামের বাড়িতে পুকুরে ছােটো ছােটো ছেলেমেয়েরা গােসল করতে আসতাে বাবা-মার সঙ্গে। আমি যেতাম আত্মীয়-স্বজনদের ছােটো ছােটো ছেলেমেয়ের সঙ্গে। একদিনের কথা মনে পড়ে। আমার খালাতাে বােনকে ফ্রক পরিয়ে দিয়ে কোমরের বেল্ট বেঁধে দিচ্ছেন তার বাবা। আমার খালাতাে বােন তার বাবাকে বলছে : “আর একটু কষে বাঁধাে”। কথাটা আমার কানে লাগল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “জেলি, তুই তাের আব্বাকে তুমি বলে ডাকিস?” এ কথা শুনে জেলি আমাকে বললাে, “কেন হাসু’পা? আপনি কী বলে ডাকেন?”
আমি কী উত্তর দেবাে? আমি বললাম, “তা তাে জানিনে। আব্বাকে ‘আব্বা বলে ডাকার সুযােগই তাে পেলাম না। আপনি’ না ‘তুমি’– কী বলতে হয় জানি না তাে?” কারণ, আব্বা তাে জেলে বন্দি, শুনেছি। হ্যা, যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে, পারিপার্শ্বিক সব ধীরে ধীরে জানতে শিখেছি, কেবলই শুনেছি- আব্বা জেলে।।
——————————————————————————————————-
“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
——————————————————————————————————–
২৩

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বছরও পূরণ হতে পারেনি। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হলাে। আর তখন থেকেই বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবার বন্দি হন। ঐ বছর ২৬ জুন মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই গােপালগঞ্জে গ্রেফতার হয়ে ঐদিনই মুক্তি পান। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হয়। ২৬ মাস পর ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। কারাগারে সেসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনশন ধর্মঘট করেন ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে। ঢাকা থেকে তাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে খবরটা আমার মা জানতেন না। তাকে দেখার জন্য আমার দাদা মা ও দাদিকে নিয়ে নৌকায় করে টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় আসেন। কিন্তু তখন আব্বাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যায় বলে আমি ও কামাল আব্বাকে দেখতে পেলাম না। আব্বা বলে আর ডাকার সুযােগও হলাে না। দাদা গেলেন ফরিদপুর। আমরা ফিরে গেলাম টুঙ্গিপাড়া।।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলাে। আব্বা প্রাদেশিক পরিষদে জয়ী হলেন। আমাদের ঢাকায় নিয়ে এলেন। শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। আব্বা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। আমরা মিন্টু রােডের বাড়িতে উঠলাম। কী সুন্দর বাড়ি, গাড়ি, কত কিছু! আব্বা ভীষণ ব্যস্ত। আমাদের স্কুলে ভর্তি করালেন। খােকা কাকা (আব্বার ফুফাতাে ভাই) আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। মাত্র কয়েক দিন। এর পরই জরুরি অবস্থা অর্থাৎ ‘৯২-ক ধারা জারি করা হলাে। মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়া হলাে।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে ঢাকা থেকে আব্বাকে গ্রেফতার করা হলাে। সেদিনের কথা খুব মনে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মা খাটের এক কোণে বসে আছেন। চোখে পানি। মাকে জিজ্ঞেস করলাম : “মা কী হয়েছে?” মা বললেন, “তােমার আব্বাকে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।” তখনও বুঝি না গ্রেফতারের অর্থ কী? এরপর ঐ বাড়ি ছেড়ে দিতে হলাে। আমরা নাজিরাবাজারের একটা একতলা বাড়িতে উঠলাম। ৭৯ নাজিরাবাজার লেন। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কোনােমতে দিন যাচ্ছে। মাসে দুই বার অর্থাৎ ১৫ দিন পরপর ঢাকা জেলখানায় গিয়ে আব্বাকে দেখতে পেতাম। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৪ সালে আব্বা মুক্তি পেলেন।
১৯৫৫ সালে আব্বা জাতীয় পরিষদের (National Assembly) সদস্য নির্বাচিত হলেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেব সরকার গঠন করলেন। আব্বা আবার মন্ত্রী হলেন। আমরা নাজিরাবাজার ছেড়ে ১৫ নম্বর আব্দুল গণি রােডের বাসায় উঠলাম। আমি ও কামাল স্কুলে ভর্তি হলাম। আমাদের পড়াশােনা শুরু হলাে। ১৯৫৭ সালে আব্বা মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দল গঠনের কাজে মনােযােগ দিলেন। সেই সঙ্গে ‘টি বাের্ডের চেয়ারম্যান হলেন। ১১৫ সেগুনবাগিচার একটা বাড়িতে উঠলেন মন্ত্রিপাড়ার বাড়ি ছেড়ে। এসময় কিছুটা হলেও আব্বাকে কাছে পেতাম আমরা। যদিও আব্বা প্রাদেশিক ও জাতীয় পার্লামেন্ট অধিবেশনে ব্যস্ত থাকতেন, করাচিতে যেতেন।
যখন স্কুলে ভর্তি হই, শিক্ষকরাও খুব আদর করতেন। মন্ত্রীর মেয়ে হিসেবে ভর্তি হয়েছি, কদরটাই আলাদা ছিল। খুব আদর-যত্ন পেতাম। কিন্তু যেদিন থেকে আব্বা জেলে গেলেন, সেদিন থেকে সব বদলে গেল। আদর-যত্ন শেষ। সকলে ঠিক না, কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর আচরণ কখনও ভুলতে পারবাে না। অন্য ক্লাসের শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরাও অহেতুক বকাঝকা করতেন। নানা কটুক্তি করতেন। স্কুলে যাওয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে যেত। পড়াশােনায় মন বসতাে না। এ কষ্ট আমাদের সকলকেই পেতে হয়েছে। এমনকি পরবর্তীকালে আমাদের ছেলেমেয়েরাও এহেন আচরণের শিকার হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পিতামাতাকে হারিয়ে বিদেশে ছয় বছর রিফিউজি হিসেবে থাকার পর দেশে ফিরে আসি। ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাই। সেখানেও দেখেছি কিছু কিছু শিক্ষক একই
২৪

ধরনের আচরণ করছেন। এমনকি রেহানা ফিরে এসে ছেলেমেয়েকে যখন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাে, তখনও কয়েকজন শিক্ষকের আচরণ অসহনীয় ছিল। নানা ধরনের কটুক্তি করতেন।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর মার্শাল ল জারি করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা দিয়ে ক্ষমতা দখল করলাে। ১১ অক্টোবর আব্বাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। সমস্ত বাড়িঘর সার্চ করা হলাে। আমার খেলার পুতুল, কাপড়চোপড়, খাটপালং কিছু বাদ গেল না। টেপ রেকর্ডার, জিপ গাড়িখানা, নগদ দুই হাজার টাকা সব সিজ করল। তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নােটিশ জারি করা হলাে। সিদ্ধেশ্বরীর একতলা একটা বাড়ির দুটো কামরায় আমাদের আশ্রয় মিলল। সে বাড়িতে প্রবেশ করার কোনাে রাস্তা ছিল না। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের খেলার মাঠ দিয়ে হেঁটে বের হতে হতাে। প্রতিনিয়ত স্কুলের পক্ষ থেকে বাধা আসত। গানের শিক্ষককে বিদায় দেওয়া হলাে। তবে মা আমাদের স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। রিকশা করে স্কুলে যেতাম। কয়েক মাস সেখানে থাকার পর ৭৬ নম্বর সেগুনবাগিচায় দোতলায় দুই বেডরুমের একটা ফ্ল্যাট পাওয়া গেল। আমরা সেখানে উঠলাম।
কিন্তু আমাদের বিপত্তির শেষ নেই। একের পর এক মামলা দিচ্ছে আব্বার নামে। সব থেকে কষ্ট আমার মায়ের। একদিকে সংসার, ছেলেমেয়েদের সামলানাে; অন্যদিকে আবার মামলা মােকদ্দমার জন্য কোর্ট, আইনজীবীর চেম্বার— সব জায়গায় ছুটতে হতাে তাঁকে।
সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে রাস্তায় উঠে রিকশা নিতে হতাে। অনেকটা পথ। মায়ের সে কষ্ট আমি দেখেছি। এমনকি একদিন রিকশা থেকে নেমে হেঁটে আসার সময় ড্রেন পার হতে গিয়ে মা পড়ে গিয়ে আঘাত পান। হাত-পা ছিলে যায়। বাসায় এসে বললেন, “তােমাদের জন্য কমলা কিনেছিলাম। কিন্তু সব ড্রেনে। পড়ে গেছে”। মা নিজের ব্যথা পাওয়ার কথা কিছুই বলেননি আমাদের। আমাদের জন্য কেনা কমলা নষ্ট হয়ে গেল- তাতেই যেন তিনি বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু মা আমাদের কখনও এসব বিষয়ে তার কষ্টের কথা বলতেন না। বরং সব সময় আমাদের সান্ত্বনা দিতেন।
আমার দাদা-দাদি, আমার চাচা এবং আব্বার বন্ধুরা সব সময় খোঁজ নিতেন। বাড়ি থেকে চালসহ প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সব দাদা নিয়ে আসতেন। মায়ের জমিজমা থেকে যে আয় হতাে তা মাকে দিতেন। দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৫৯ উচ্চ আদালতের নির্দেশে আব্বা মুক্তি পান। তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ। ঢাকার বাইরে যেতে হলে থানাকে বা আইবি অফিসকে জানিয়ে যেতে হতাে।
এরপর ১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আবার আব্বা বন্দি হলেন। তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে দুটো কামরা তৈরি করে মা সেখানে চলে এসেছেন। বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি হয়নি তখনও; মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল বাড়িটা। আব্বাকে গ্রেফতারের পর আমাদের বাড়িটা যেন নিঝুমপুরীতে পরিণত হলাে। সবার আসা-যাওয়া বন্ধ। রাস্তার সামনে দিয়ে যাতায়াতের সময়ও অনেকে মনে হয় আমাদের বাড়ির দিকে তাকাতে ভয় পেত। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা এমনই।
প্রায় সাড়ে চার মাস পর ১৮ জুন ১৯৬২ আব্বা মুক্তি পান। এরপর আবার ১৯৬৪ সালের ৩১ মে আব্বা গ্রেফতার হন। এদিনই কোর্ট থেকে মুক্তি পান। এভাবে ১৯৬৪ সালের ৩ জুন ও ৭ অক্টোবর এবং ১৯৬৬ সালের ২৮ জানুয়ারি বারবার গ্রেফতার হন। প্রতিবারই কোর্ট থেকে জামিন পান।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা দাবি পেশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৬-দফা প্রচারের কাজে সমগ্র বাংলাদেশে সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। ১৮ এপ্রিল থেকে খুলনা, যশাের, সিলেট, চট্টগ্রাম, পাবনাসহ সমগ্র বাংলাদেশে সভা-সমাবেশ করেন। এসময় এক জেলায় মিটিং করার পরপরই পুলিশ
২৫

তার বিরুদ্ধে মামলা দিত এবং গ্রেফতার করতাে। কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে তিনি আবার অন্য জেলায় সভা করতেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের আদমজীতে বিশাল জনসভা করে আব্বা বাড়ি ফেরেন। রাতেই পুলিশ বাসা ঘেরাও দিয়ে আব্বাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার দেখানাে হয় ৯ মে। কারাবন্দি হিসেবে যে কষ্ট তিনি সহ্য করেছেন, তার কিছু বর্ণনা তাঁর লেখা কারাগারের রােজনামচায় পাওয়া যায়।
১৯৫৮ সালে আব্বাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যায় জামাল তখন সাড়ে তিন বছরের। রেহানা খুবই ছােটো ছিল। কোনাে কিছু সেভাবে বুঝতে পারত না। বিপুলসংখ্যক পুলিশ আমাদের বাড়ি ছেয়ে ফেলে এবং বাসা তল্লাশি করতে থাকে। সব জায়গায় তল্লাশি চালাতে থাকে। জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলে। এতে ছােটো দুই ভাইবােন খুব ভয় পেয়ে যায়। রেহানা খুব ছােটো বলে কিছু ব্যক্ত করতে পারে না। জামাল খুব মন খারাপ করে এবং চঞ্চল হয়ে উঠে। একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক পুলিশসদস্য ঘরে ঢুকে তল্লাশির নামে যে তাণ্ডব চালায় তাতে শিশুদের মনে ভীতির সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার ওপর আবার আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তারপর যে ঘটনা ঘটল তাতে আমাদের সকলের মানসিক কষ্ট আরও বাড়ল। মাত্র তিন দিনের নােটিশ দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলাে। একদিকে পিতার স্নেহবঞ্চিত হওয়া, অপরদিকে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে যাওয়া। এর প্রভাব তাে শিশুদের ওপর পড়বেই।
আব্বা গ্রেফতার হওয়ার পর জামাল খুবই মানসিক কষ্টে ভুগত। কারও কথা শুনতে চাইত না। মনের কষ্টটা প্রকাশ করতে পারত না। কিন্তু তার আচার-আচরণে সে কষ্টটা প্রকাশ পেত। খেলাধুলাও বন্ধ করে দিলাে।
কামাল এবং আমি একটু বড়াে ছিলাম বিধায় ছােটো ভাইবােনদের সামলাতে চেষ্টা করতাম। আমাদের মনের কষ্ট আমরা কাকে বলব? কীভাবে প্রকাশ করবাে? সেও এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। দাদা-দাদি, মা সবাই যার যার মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে একে অপরকে সান্ত্বনা দিতেন। আব্বা জেলে কষ্ট করেছেন, আর বাইরে থেকেও আমাদের পরিবারের সবাইকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে- এটাই বাস্তবতা।
রেহানা ছিল সকলের আদরের। তখনও রাসেলের জন্ম হয়নি। কাজেই আমাদের সকলের ছােট্ট মণি ছিল রেহানা। আব্বারও সব থেকে আদরের। আব্বা যখন মুক্তি পেয়ে বাসায় আসতেন, তখন সর্বক্ষণ আব্বার পাশে থাকত। যখন থেকে লিখতে শেখা শুরু করেছে, তখন থেকে আব্বাকে নিয়মিত চিঠি লিখত রেহানা। বাসায় যা-ই ঘটুক, আব্বাকে জেলখানায় চিঠি দিয়ে সব জানাত। তার কচি হাতের লেখা চিঠি কিছু আব্বার হাতে পৌছাত, হয় তাে কিছু পৌঁছাত না। আব্বা যখন বাড়িতে থাকতেন তখন সব থেকে বেশি আবদার করত রেহানা। আমি ও কামাল তাে অবাক হয়ে যেতাম ওর সাহস দেখে। আব্বা না থাকলে খুবই মন খা থাকত সে। খাওয়া-দাওয়া একরকম ছেড়েই দিত।
কামালের জন্মের পরপরই আব্বা গ্রেফতার হন। টুঙ্গিপাড়ায় দাদা-দাদির কাছেই মায়ের সঙ্গে আমরা থাকতাম। সেবার আব্বা একটানা অনেকদিন জেলে ছিলেন। কামাল তাই আব্বাকে কাছে পায়নি। আব্বা যখন মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য গােপালগঞ্জ আসতেন অথবা মুক্তি পেয়ে টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে আসতেন সেসময় আমি যখন আব্বাকে ‘আব্বা বলে ডাকতাম, কামাল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত আর আমাকে জিজ্ঞেস করত, “হাসু আপা, তােমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি!”
কামাল সব সময়ই খুব দায়িত্ববান ছিল। আব্বা যখন জেলে থাকতেন কামাল মায়ের সঙ্গে থেকে সংসারের যাবতীয় কাজে সাহায্য করত। এমনকি রেশন তােলা থেকে শুরু করে অনেক দায়িত্ব খুব অল্প বয়সেই নিতে শুরু করেছিল।
রাসেলের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, তখন আব্ব গ্রেফতার হলেন। ১৫ দিন পরপর জেলখানায় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পাওয়া যেত। মা আমাদের সকলকে নিয়ে জেলখানায় যেতেন। আব্বাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে
২৬.

রাসেল আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতাে। আব্বার গলা জড়িয়ে ধরে আদর নিত। কিন্তু সমস্যা হতাে যখন সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে যেত। কিছুতেই সে আসতে চাইত না। আব্বার গলা ধরে শক্ত হয়ে থাকত। অনেক কষ্টে ওকে নিয়ে আসতে হতাে। সে রাতে আর ঘুমাত না রাসেল। সারা রাত ধরে কাঁদত। কেন কাঁদত তা বলতে পারত না। এরপর যখন একটু বড়াে হলাে, তখন রাতে কামাল, জামাল, রেহানা ও আমাকে কাছে ডেকে নিত। আমরা ওকে নানাভাবে আদর করতাম, গল্প শুনিয়ে মন ভালাে করার চেষ্টা করতাম। আমার মা মনের কষ্ট চেপে রেখে সবকিছু সামলাতেন।
আমি ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হই। কলেজ ইউনিয়নের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করি। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনায়েম খান এ নির্বাচনকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেয়। আমি যাতে নির্বাচিত হতে না পারি সে প্রচেষ্টা চালায়। তাদের যুক্তি হলাে, “শেখ মুজিবের মেয়ে যদি নির্বাচনে। জিতে যায়, তবে মানুষের মনে একটাই ধারণা হবে যে, ৬-দফার প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে।” একটা কলেজ ইলেকশন—সরকারি কলেজ তাই তাদের প্রচেষ্টা ছিল আমাকে নির্বাচনে পরাজিত করার। কিন্তু আমি বিপুলভাবে জয়লাভ করি। আমার বিরুদ্ধে যে দুইজন প্রার্থী ছিলেন তাঁদের ভােটের যােগফলের চেয়ে আমার ভােটের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। আমার নির্বাচন নিয়ে আব্বা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। মা-ও চিন্তিত ছিলেন। এ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে ৬-দফার প্রতি ছাত্রসমাজের সমর্থনেরই প্রতিফলন ঘটে। আইয়ুব-মােনায়েমের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।
কলেজ শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে গভর্নর মােনায়েম খান ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, “শেখ মুজিবের মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাে কীভাবে?” তিনি কেন বাধা দিলেন না? এম ও গণি ছিলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। শুনেছি তিনি নাকি জবাব দিয়েছিলেন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে কে কীভাবে ভর্তি হলাে সেটা জানা সম্ভব নয়।।
একই অবস্থা কামালেরও। শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। সরকারি কলেজ। গভর্নরের চাপ প্রিন্সিপালের উপর। প্রায় প্রতিদিনই ওর বিরুদ্ধে একটা করে নােটিশ আসত।
তখন সমগ্র বাংলাদেশে আন্দোলন চলছে। ৬-দফা, ১১-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমরা সকলেই এই সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। মিছিল-মিটিংয়ে যােগ দিতাম। কামাল কলেজ থেকে মিছিল করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সভায় যােগ দিত।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৬ গভীর রাতে মুক্তি দিয়ে ঐরাতেই জেল গেটে পুনরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে। গ্রেফতারের দিনটা ছিল ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৬। ঐদিনই আমাদের আব্বার সঙ্গে সাক্ষাতের তারিখ ছিল। নির্ধারিত সময়ে জেলগেটে গেলে আমাদের ভেতরে সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট কামরায় যেতে দেওয়া হলাে না। গেটের বাইরে আমরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকি। মা বিভিন্নজনের কাছে আব্বার খবর জানার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমরা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে আসি। আমরা জানতেও পারলাম না কেন কারাগারে আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে না।
সেসময়টা ছিল আমাদের জন্য ভীষণ কষ্টের। আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কী ঘটল আব্বার? কোথায় আছেন তিনি? বেঁচে আছেন কি? কোনাে খবর পাওয়া গেল না। যখন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হলাে, প্রথম কোর্ট বসল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে। কেবল তখনই জানতে পারলাম যে আব্বা বেঁচে আছেন।
২৭

এ কয়টা মাস আমাদের জন্য ভীষণ দুর্বিষহ ছিল। ছােট্ট রাসেল পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত; রেহানা ও জামাল আব্বার জন্য কেঁদে কেঁদে আকুল। আমার দাদা-দাদি ছেলের শােকে কাতর। কেবল আমার মা ছিলেন অবিচল। অসীম ধৈর্যশীল। মনের ভিতরে কী হচ্ছে তা জানতে দিতেন না- পাছে ছেলেমেয়েরা ভেঙে পড়ে।
প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আব্বা যেমন কষ্ট করেছেন, তেমনি মামলা চালানাে, আমাদের দেখাশােনা— সবই আমার মা করে গেছেন। তাঁর সব সময় একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। মাকে পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার লােকজন কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে। এক সময় তাে মনেই হচ্ছিল মাকেও বােধ করি পাকিস্তানি শাসকেরা গ্রেফতার করবে এবং মামলায় আসামি করবে।
ইতােমধ্যে ব্যাপক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। এ আন্দোলনের পেছনে আমার মা খুবই সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আন্দোলন সফল হয়। আব্বা মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তমানুষ হিসেবে জেলের বাইরে আসেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, নির্যাতন চালায়।
নয়-মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা জয়ী হই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি আব্বা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে পুনর্গঠনে ব্যস্ত, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই নেমে আসে চরম আঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমাদের তাে বটেই, সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের জীবনেই নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার।
আমি এবং রেহানা বিদেশে ছিলাম বলে বেঁচে যাই। পরিবারের আপনজনদের হারিয়ে নি কাটাতে হচ্ছে। এ যাতনা আপনজনহারা যারা শুধু তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন। এ কষ্ট, দুঃখ-যাতনা সকলের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘসংগ্রাম করেছেন। জেল, জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে। জাতির পিতার সেই আদর্শ পাথেয় করে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই আমি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি।
২৮

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি(১)
১৯২০-১৯৭৫

১৯২০
তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জ মহকুমা, বর্তমানে গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭্ইমার্চ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। টুঙ্গিপাড়ার অদূরে মধুমতী নদী। এখান থেকে স্টিমারে খুলনা হয়ে কলকাতা যাওয়া যেত। পিতা শেখ লুত্যর রহমান ছিলেন গােপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মাতা শেখ সায়েরা খাতুন।

১৯২৭
শেখ মুজিবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় স্থানীয় গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

১৯২৯
গােপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে (সীতানাথ একাডেমি) তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন।

১৯৩৩
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার চাচাতাে বােন বেগম ফজিলাতুন নেসার (রেণু) বিবাহ রেজিস্ট্রি করা হয়। বেগম ফজিলাতুন নেসার বয়স তখন তিন বছর।।

১৯৩৪
তাঁর পিতা নিজ কর্মস্থল মাদারীপুরে শেখ মুজিবকে নিয়ে যান।

১৯৩৪
সালে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। অসুস্থতার কারণে পড়াশােনায় সাময়িক ছেদ ঘটে।

১৯৩৭
পিতার নতুন কর্মস্থল গােপালগঞ্জের মিশন হাই স্কুলে শেখ মুজিব পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মুসলিম সেবা সমিতির সম্পাদক হিসেবে এ সংগঠনের মাধ্যমে মুষ্টিচাল সংগ্রহ এবং দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য প্রদান। ফুটবল খেলায় পারদর্শী এবং ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তি।

১৯৩৮
শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেসার আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হয়।
১৬ই জানুয়ারি বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং বাণিজ্য ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গােপালগঞ্জে আসেন। তাদের নিকট মিশন হাই স্কুলের ছাদ থেকে পানি পড়া এবং
———————————————————-
১। শেখ মুজিবুর রহমান, আমার দেখা নয়াচীন, বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃ. ১২৫-১৪৪
——————————————————-
৩১

ছাত্রাবাসের সমস্যা তুলে ধরে শেখ মুজিব সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। শেরে বাংলা ও সােহরাওয়ার্দীর সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃভূমিকা গ্রহণ। এ নিয়ে স্থানীয় কংগ্রেসিদের সঙ্গে বিরােধ। তাদের ইন্ধন ও মিথ্যা অভিযােগে জীবনের প্রথম কারাবরণ।

১৯৪০
নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যােগ দেন। শেখ মুজিব এক বছরের জন্য নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। গােপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত।
ফরিদপুর ছাত্রলীগের সম্মেলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ প্রমুখকে আমন্ত্রণ। ১৪৪ ধারা সত্ত্বেও হুমায়ুন কবিরের বাড়িতে সফলভাবে সম্মেলন সম্পন্ন।

১৯৪২
গােপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশের পর কলকাতায় গমন এবং কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) আইএ ক্লাসে কলা বিভাগে ভর্তি হন। কলকাতায় বেকার হােস্টেলে থাকাকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শ লাভ। কলকাতার বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ। ছাত্রকর্মী-মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে ফরিদপুর থেকে বিরাট কর্মীবাহিনী নিয়ে যােগদান।

১৯৪৩
পঞ্চাশের মন্বন্তরে (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) কংগ্রেস, ফরােয়ার্ড ব্লক ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মুসলিম লীগের যুবকর্মীদের নিয়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ কমিটিতে যােগদান। কলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যার্থে লঙ্গরখানা পরিচালনা। গােপালগঞ্জে ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করেন।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ। দিল্লিতে মুসলিম লীগের সম্মেলনে যােগদান। তখন দিল্লির লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, কুতুব মিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা পরিদর্শন করেন।

১৯৪৪
গােপালগঞ্জে মুসলিম লীগের সম্মেলনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, তমিজউদ্দিন খান, খাজা শাহাবুদ্দিন প্রমুখের আগমন। বঙ্গবন্ধু গােপালগঞ্জের স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত। ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসােসিয়েশন’-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে যােগদান এবং প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্বদান।

১৯৪৬
মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে দিল্লিতে ৭-৯ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ-সদস্যদের কনভেনশনে ছাত্রকর্মী হিসেবে অন্যান্যের সঙ্গে শেখ মুজিবের যােগদান। এ সময় আজমীর শরীফ, তাজমহল, আগ্রা দুর্গ, লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি ও সেকেন্দ্রা পরিভ্রমণ করেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। গােপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় ফরিদপুরসহ খুলনা, যশাের ও বরিশাল জেলা সফর করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
৩২

১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগ আহূত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে সূচিত কলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরােধে নেতৃভূমিকা পালন করেন। কলকাতা ও বিহারে দাঙ্গা-পীড়িতদের পাশে দাঁড়ান। দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে শরণার্থী ও মােহাজেরদের সাহায্যার্থে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেন।

১৯৪৭
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন। অধীত বিষয়ের মধ্যে ছিল ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
৩রা জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার পর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হলে ছাত্র ও যুব কর্মীদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের আলােচনা।
৬-৭ই জুলাই সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভােটে মুসলিম লীগের বিজয়ে শেখ মুজিব ও তাঁর বিরাট কর্মীবাহিনীর উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় আগমন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।।
পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরু ১৫০ নম্বর মােগলটুলির ‘পার্টি হাউস’ থেকে। ঢাকায়। রাজনৈতিক কর্মীসম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য। ৬-৭ই সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ৫ দফা ভিত্তিক গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত। এই সংগঠনের মাধ্যমে এদেশে তাঁর প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী রাজনৈতিক ধারার সূচনা ঘটে।

১৯৪৮
সরকারের গণবিরােধী ভূমিকার বিরােধিতা করে শেখ মুজিবের মুসলিম লীগ ত্যাগ। ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে নেতৃত্ব প্রদান। নতুন কেন্দ্রীয় অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত।
২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে ঘােষণা দিলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ২রা মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। শেখ মুজিব ছিলেন এ আন্দোলনে প্রথম সারির নেতা। ১১ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘটে সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার হন।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে খাজা নাজিমউদ্দীন সরকারের ৮ দফা সমঝােতা চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নেতৃবৃন্দ সমেত ১৫ই মার্চ তিনি মুক্তি পান। ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন।
২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভা এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন।। ১৯শে মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান। ১১ই সেপ্টেম্বর পুনরায় গ্রেফতার হন।

১৯৪৯
৮ই জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা প্রদান। সারা দেশের মতাে দিনাজপুরে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ ছাত্রনেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য শেখ মুজিবের দিনাজপুরে গমন এবং জেলা প্রশাসন কর্তৃক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের দিনাজপুর থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ প্রদান।
৩৩

২১শে জানুয়ারি কারামুক্তি লাভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন এবং জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বহিষ্কার। শেখ মুজিবের শিক্ষাজীবন এভাবে অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯শে এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটকালে গ্রেফতার হন।
২৯শে এপ্রিল ১৯৪৯ থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পর্যন্ত কয়েকবার কারাবরণ এবং একটানা কারারুদ্ধ হয়ে অসুস্থতা সত্ত্বেও রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থান।
২৩শে জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক নিযুক্ত হন। ২৭শে জুলাই মুক্তিলাভ করেন।
সরকারি কর্ডন প্রথার ফলে ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার দাওয়ালরা কৃষকের ধান কেটে প্রাপ্য অংশ নিয়ে ফেরার সময় সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাধার শিকার হন। দাওয়ালদের অধিকার রক্ষায় শেখ মুজিবের আন্দোলন। সেপ্টেম্বরে দেশে চরম খাদ্যসংকটে আন্দোলন করলে কয়েক দিনের জন্য তিনি বন্দি হন।
অক্টোবরের শেষ দিকে লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে প্রতিনিধি দল নিয়ে দেখা করার অপরাধে মওলানা ভাসানী সমেত কয়েকদিনের জন্য গ্রেফতার হন।

১৯৫০
১লা জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকায় আগমনকালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভুখা মিছিল করা, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সােচ্চার হওয়ার অপরাধে ১১ই মার্চ শেখ মজিব গ্রেফতার হন এবং প্রায় দুই বছর কারান্তরিন ছিলেন।

১৯৫১
২১শে ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলে বন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে গােয়েন্দা সংস্থার সাক্ষাৎ।

১৯৫২
একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে ১৪ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা জেল থেকে তিনি গােপনে বন্ধু ও অনুরাগীদের সংগ্রামের নির্দেশ দিতে থাকেন। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে মহিউদ্দিন আহমদ সমেত আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অনশনে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্যের অবনতিতে ঢাকা জেল থেকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর। শেষে ছাত্রসমাজের ওপর তাঁর প্রভাব লক্ষ করে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। একটানা অনশনে স্বাস্থ্যের অস্বাভাবিক অবনতিতে ২৭শে ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ।
২৩শে এপ্রিল সােয়ারীঘাটে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভায় যােগদান। ২৭শে এপ্রিল ঢাকা বার অ্যাসােসিয়েশনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শেখ মুজিবের গণভােটের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
২৮শে এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১২ই মে পূর্ববাংলার গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং স্মারকলিপি প্রদান।।
২১শে মে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পূর্ববাংলার নির্বাচন সম্পর্কে আলােচনার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শেখ মুজিবের করাচি গমন।
৩৪

২-১২ই অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে শান্তি পরিষদের পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে যােগদান এবং বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান। সদ্য বিপ্লবােত্তর গণচীনের শাসনব্যবস্থা ও জীবনচিত্র অবলােকন করে নিজ দেশকে গড়ে তােলার প্রত্যয় অর্জন।

১৯৫৩
৫ই জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৪ই নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দলের আহূত বিশেষ কাউন্সিলে বিরােধী দলসমূহকে নিয়ে সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১৯৫৪
গােপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নির্বাচনি এলাকা থেকে শেখ মুজিব বিপুল ভােটে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত। ১৫ই মে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি ঋণ, সমবায় ও পল্লি-উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ।।
৩০শে মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা প্রয়ােগ করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের পর সেদিনই গ্রেফতার হন। ২১শে ডিসেম্বর গােপালগঞ্জে শেখ মুজিবকে বিপুল সংবর্ধনাজ্ঞাপন। ঢাকায় ফিরে সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে করাচি গমন।।

১৯৫৫
৫ই জানুয়ারি করাচি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন। ২৭শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগ অফিসে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির এক সভায় শেখ মুজিবসহ অন্য নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ।
৫ই জুন বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৭ই জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘােষণা করা হয়। ২৩শে জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন।
২৫শে আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের বক্তৃতায় পূর্ববাংলা’ নামের পরিবর্তে কেন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা হবে-এ মর্মে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশ্ন উত্থাপন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিও ওঠে ওই বক্তৃতায়। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন :
Sir, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan. The word ‘Bengal’ has a history and a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about a joint electorate? What about autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite.
৩৫

(অনুবাদ : স্যার, আপনি দেখবেন ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না। এক ইউনিটের প্রশ্নটা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন ? চান? বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কী হবে? যুক্ত নির্বাচনি এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই কী সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কী ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলাের সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন আমাদের জনগণের রেফারেন্ডাম অথবা গণভােটের মাধ্যমে দেওয়া রায়কে মেনে নেন।)
পহেলা অক্টোবর গণপরিষদে বক্তৃতাকালে শেখ মুজিব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের সীমাহীন ক্ষমতার পরিণতি ও ৯২ (ক) ধারার তীব্র সমালােচনা করেন।
২১শে অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করে দলকে অসাম্প্রদায়িক করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৬
৩রা ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ২৮শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে নতুন সংবিধানে মহিলা আসন সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে শেখ মুজিব দীর্ঘ বক্তৃতা করেন।
১৪ই জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরােধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব আনেন বঙ্গবন্ধু। ৪ঠা সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। চকবাজার এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ৩ জন নিহত হয়। ১৬ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৫৭
সংগঠনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ৩০শে মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২৪শে জুন থেকে ১৩ই জুলাই তিনি চীনে সরকারি সফর করেন।

১৯৫৮
৭ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। ১১ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেলখানায় থাকার পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটেই গ্রেফতার করা হয়।

১৯৫৯
১৭ই ডিসেম্বর আদেশ নং ৯৫৯-এইচএস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ রেখে ৫টি শর্ত আরােপ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকার কেন্দ্রীয় জেল থেকে মুক্তি প্রদান।

৩৬

১৯৬০
সামরিক শাসন ও আইয়ুববিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গােপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গােপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিটি মহকুমা এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠিত হয়।।

১৯৬২
৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ২রা জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ই জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ২৫শে জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ই জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালােচনা করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহাের যান, এখানে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরােধীদলীয় মাের্চা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সারা পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন।

১৯৬৩
সােহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ই ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।

১৯৬৪
২৫শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় দেশের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভােটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সংবলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৯৯ সদস্যবিশিষ্ট দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি’। ঢাকার ওয়ারিতে হিন্দুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সময় শেখ মুজিব দাঙ্গাবাজদের মুখে পড়েন। উক্ত কমিটির উদ্যোগে প্রণীত ১৬ই জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক একটি আহ্বান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। দাঙ্গার পর আইয়ুববিরােধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ গ্রহণ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬৫
শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযােগে মামলা দায়ের। এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীসময়ে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ২০শে জুলাই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলােচনার জন্যে শেখ মুজিবের করাচি গমন।।

১৯৬৬
৫ই ফেব্রুয়ারি লাহােরে বিরােধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনি কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ঢাকায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে শেখ মুজিবের ৬ দফার প্রস্তাবনা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমােদন।
৩৭

১লা মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযােগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ৮ই মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ৭ই জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়।

১৯৬৮
৩রা জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মােট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযােগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলা দায়ের করে, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। ১৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।
১৯শে জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের বিচারকার্য শুরু হয়।

১৯৬৯
৫ই জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। পরে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর-এর গুলিবর্ষণ, বহু হতাহতের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে আইয়ুব সরকার ১লা ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল বৈঠকের আহ্বান। জানায় এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলে মুক্তিদান করা হবে বলে ঘােষণা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্যারােলে মুক্তিদান প্রত্যাখ্যান করেন। ২২শে ফেব্রুয়ারি গণআন্দোলনের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য অভিযুক্তকে মুক্তিদানে বাধ্য হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়ােজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতার এই সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের ভাষণে ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
১০ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করেন। গােলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গণঅসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ও রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ই মার্চ তিনি গােলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ই মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। ২৫শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। ২৫শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তিন সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে লন্ডন গমন করেন।
৫ই ডিসেম্বর শহীদ হােসেন সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের আলােচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুর চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। …একমাত্র বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। …জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘােষণা করিতেছি-আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’।”
৩৮

১৯৭০
৬ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১লা এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ই জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১৭ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু দলের নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে ‘নৌকা প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধােলাইখালে জনসভার মধ্য দিয়ে প্রথম নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন। ২৮শে অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভি ভাষণে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে। এলাকায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় চলে যান এবং আর্তমানবতার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি ঘূর্ণিঝড়-উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে।।

১৯৭১
৩রা জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য থাকার শপথ গ্রহণ করেন। ৫ই জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সম্মতির কথা ঘােষণা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮শে জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলােচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিন দিন বৈঠকের পর আলােচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘােষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান।
১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে ভূট্টোর দাবির তীব্র সমালােচনা করে বলেন, ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক। এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।
১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘােষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩রা মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩রা মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি দাবি জানান।
৭ই মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘােষণা করেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। … রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরাে দেবাে। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাল্লাহ।”
তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন।
৩৯

অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযােগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ১৬ই মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলােচনার জন্য জনাব ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলােচনা হয়। ২৫শে মার্চ আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স।
বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন:
This may be my last message, from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
(অনুবাদ : এটাই হয়তাে আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তােমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য আমি তােমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তােমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।]
এই ঘােষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি বার্তা পাঠান :
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনাে আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লােকদের কাছে এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।
বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানাে হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশাের সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিন দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬শে মার্চ জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।
২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার
৪০

গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গােপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী ঘােষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিগামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানাে হয়। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোনো অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতােমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।

১৯৭২
৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বিশ্বজনমত ও আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠানাে হয়। ৯ই জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি ঢাকায় পৌছালে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত যান। কলকাতার গড়ের মাঠের বিশাল জনসভা, কলকাতা কর্পোরেশন ও প্রেসক্লাবের সংবর্ধনায় ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। গড়ের মাঠে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ভাষণদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি তিনি সােভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
১লা মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘােষণা দেন। ৩০শে জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর লন্ডন থেকে জেনেভা যান। ১০ই অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ই মার্চ ১৯৭৩) ঘােষণা করেন। ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৫ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘােষণা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘােড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলামবিরােধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বাের্ড পুনর্গঠন, ১১,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য নারী পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের
৪১

পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘােড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সে প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প কারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যার মােকাবেলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামাে তৈরি করে দেশকে একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চালানাে হয়। অতি অল্প সময়ে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিশেষ সাফল্য।

১৯৭৩
জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩রা সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ই অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।

১৯৭৪
২২শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতাে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন।

১৯৭৫
২৫শে জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪শে ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলে যােগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযােগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘােষণা দেন যার লক্ষ্য ছিল-দুর্নীতি দমন; খেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করার মানসে ৬ই জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পান। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে।
নতুন আশার উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়ার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
১৫ই আগস্টের ভােরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেসা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযােদ্ধা লে. শেখ কামাল, পুত্র লে. শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রােজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর
৪২

ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশাের আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ ১৮ জনকে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহিদ হওয়ার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। কেড়ে নেয় জনগণের ভাত ও ভােটের অধিকার।
বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার জন্য হত্যাকারীদের বিচারের বিধান রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য ২৬শে সেপ্টেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ (ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স) জারি করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে এক কুখ্যাত কালাে আইন সংবিধানে সংযুক্ত করে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করে। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে।
১৯৯৬ সালের ২৩শে জুন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২রা অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়। ১২ই নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। ১লা মার্চ ১৯৯৭ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। ৮ই নভেম্বর ১৯৯৮ জেলা ও দায়রা জজ কাজী গােলাম রসুল ৭৬ পৃষ্ঠার রায় ঘােষণায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৪ই নভেম্বর ২০০০ সালের হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলে দুই বিচারক বিচারপতি মােঃ রুহুল আমিন এবং বিচারপতি এ.বি.এম খায়রুল হক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘােষণা করেন। এরপর তৃতীয় বিচারপতি মােঃ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। এরপর পাঁচজন আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠিত হয়। ২০০৯ সালে ২৯ দিন শুনানির পর ১৯শে নভেম্বর প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বিচারপতি রায় ঘােষণায় আপিল খারিজ করে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২রা জানুয়ারি আপিল বিভাগে আসামিদের রিভিউ পিটিশন দাখিল এবং তিন দিন শুনানি শেষে ২৭শে জানুয়ারি চার বিচারপতি রিভিউ পিটিশনও খারিজ করেন। এদিনই মধ্যরাতের পর ২৮শে জানুয়ারি পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছে। এবং ছয়জন বিদেশে পলাতক রয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
১৫ই আগস্ট জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শােক দিবস হিসেবে বাঙালি জাতি পালন করে।
৪৩

জাতির পিতার জীবনে মামলা ও বিচার কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
১৯৪৮-১৯৭১

জীবনে প্রথম জেল

১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক (তখন প্রধানমন্ত্রী) ও সােহরাওয়ার্দী (তখন শ্রমমন্ত্রী) গােপালগঞ্জ সফর করেন। গােপালগঞ্জের তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তাদেরকে বিরাট সংবর্ধনা প্রদানের আয়ােজন করা হয়। হক সাহেব তখন মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এ নিয়ে হিন্দু নেতৃবৃন্দের অপছন্দ ও অস্বস্তি ছিল। তাই এই দুই নেতার গােপালগঞ্জ সফরকে কেন্দ্র করে শহরের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে হিন্দু ও মুসলমান রাজনীতি-সমর্থকদের মধ্যে মারপিটের ঘটনাও ঘটে। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্মৃতিকথায় ঘটনাটির বর্ণনা প্রদান করেছেন এভাবে :
এই সময় একটা ঘটনা হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি চলছিল। গােপালগঞ্জ শহরের আশপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু’একজন মুসলমানের উপর অত্যাচারও হল। আবদুল মালেক নামে আমার এক সহপাঠী ছিল। সে খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হত। একদিন সন্ধ্যায়, আমার মনে হয় মার্চ বা এপ্রিল মাস হবে, আমি ফুটবল মাঠ থেকে বাড়িতে এসেছি। আমাকে খন্দকার শামসুল হক ওরফে বাসু মিয়া মােক্তার সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) ডেকে বললেন, “মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পার একবার যাও। তােমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস।” আমি আর দেরি না করে কয়েকজন ছাত্র ডেকে নিয়ে ওদের ওখানে যাই এবং অনুরােধ করি ওকে ছেড়ে দিতে। রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলােক আমাকে দেখেই গাল দিয়ে বসল। আমিও তার কথার প্রতিবাদ করলাম এবং আমার দলের ছেলেদের খবর দিতে বললাম। এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, “ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নেব।” আমার মামা শেখ সিরাজুল হক (একই বংশের) তখন হােস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। তিনি আমার মা ও বাবার চাচাতাে ভাই। নারায়ণগঞ্জে আমার এক মামা ব্যবসা করেন, তার নাম শেখ জাফর সাদেক। তার বড় ভাই ম্যাট্রিক পাস করেই মারা যান। আমি খবর দিয়েছি শুনে দলবল নিয়ে ছুটে এসেছেন। এর মধ্যেই আমাদের সাথে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়।। আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসি।
—————————————————–
৩. অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ : ২০১২, পৃষ্ঠা ১২-১৩
৪. হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন
——————————————————
৪৫

শহরে খুব উত্তেজনা। আমাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। সেদিন রবিবার। আব্বা বাড়ি গিয়েছিলেন। পরদিন ভােরবেলায় আব্বা আসবেন। বাড়ি গােপালগঞ্জ থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে। আব্বা শনিবার বাড়ি যেতেন আর সােমবার ফিরে আসতেন, নিজেরই নৌকা ছিল। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল। হিন্দু নেতারা থানায় বসে এজাহার ঠিক করে দিলেন। তাতে খন্দকার শামসুল হক মােক্তার সাহেব হুকুমের আসামি। আমি খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি। ভােরবেলায় আমার মামা, মােক্তার সাহেব, খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ এমএলএ সাহেবের মুহুরি জহুর শেখ, আমার বাড়ির কাছের বিশেষ বন্ধু শেখ নুরুল হক ওরফে মানিক মিয়া, সৈয়দ আলী খন্দকার, আমার সহপাঠী আবদুল মালেক এবং অনেক ছাত্রের নাম এজাহারে দেয়া হয়েছিল। কোনাে গণ্যমান্য লােকের ছেলেদের বাকি রাখে নাই। সকাল ন’টায় খবর পেলাম আমার মামা ও আরও অনেককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। আমাদের বাড়িতে কি করে আসবে- থানার দারােগা সাহেবদের একটু লজ্জা করছিল! প্রায় দশটার সময় টাউন হল মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে দারােগা আলাপ করছে, তার উদ্দেশ্য হল আমি যেন সরে যাই। টাউন হলের মাঠের পাশেই আমার বাড়ি। আমার ফুফাতাে ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, “মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।” বললাম, “যাব না, আমি পালাব না। লােকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।”
এই সময় আব্বা বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। দারােগা সাহেবও তাঁর পিছে পিছে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। আব্বার কাছে বসে আস্তে আস্তে সকল কথা বললেন। আমার গ্রেফতারি পরােয়ানা দেখালেন। আব্বা বললেন, “নিয়ে যান।” দারােগা বাবু বললেন, “ও খেয়েদেয়ে আসুক, আমি একজন সিপাহি রেখে যেতেছি, এগারটার মধ্যে যেন থানায় পৌঁছে যায়। কারণ, দেরি হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে।” আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, “মারামারি করেছ?” আমি চুপ করে থাকলাম, যার অর্থ “করেছি”।
আমি খাওয়া-দাওয়া করে থানায় চলে এলাম। দেখি আমার মামা, মানিক, সৈয়দ আরও সাত-আটজন হবে, তাদেরকে পর্বেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসেছে। আমার পৌছার সাথে সাথে কোর্টে পাঠিয়ে দিল। হাতকড়া দেয়নি, তবে সামনেও পুলিশ পিছনেও পুলিশ। কোর্ট দারােগা হিন্দু ছিলেন, কোর্টে পৌছার সাথে সাথে আমাদের কোর্ট হাজতের ছােট কামরার মধ্যে বন্ধ করে রাখলেন। হে দারােগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, “মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছােরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না।” আমি বললাম, “বাজে কথা বলবেন না, ভাল হবে না।” যারা দারােগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, “দেখ ছেলের সাহস!” আমাকে অন্য সকলে কথা বলতে নিষেধ করল। পরে শুনলাম, আমার নামে এজাহার দিয়েছে এই কথা বলে যে, আমি ছােরা দিয়ে রমাপদকে হত্যা করার জন্য আঘাত করেছি। তার অবস্থা। ভয়ানক খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে রমাপদের সাথে আমার মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে, ও আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করলে আমিও লাঠি দিয়ে প্রত্যাঘাত করি। যার জন্য ওর মাথা ফেটে যায়। মুসলমান উকিল মােক্তার সাহেবরা কোর্টে আমাদের জামিনের আবেদন পেশ করল। একমাত্র মােক্তার সাহেবকে টাউন জামিন দেয়া হল। আমাদের জেল হাজতে পাঠানাের হুকুম হল। এসডিও হিন্দু ছিল, জামিন দিল না। কোর্ট দারােগা আমাদের হাতকড়া পরাতে
৪৬

হুকুম দিল। আমি রুখে দাঁড়ালাম, সকলে আমাকে বাধা দিল, জেলে এলাম। সাবজেল, একটা মাত্র ঘর। একপাশে মেয়েদের থাকার জায়গা, কোনাে মেয়ে আসামি না থাকার জন্য মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখল। বাড়ি থেকে বিছানা, কাপড় এবং খাবার দেবার অনুমতি দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত সাত দিন পরে আমি প্রথম জামিন পেলাম। দশ দিনের মধ্যে আর সকলেই জামিন পেয়ে গেল।
হক সাহেব ও সােহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম করা হল। লােকও চলে গেল কলকাতায়। গােপালগঞ্জে ভীষণ উত্তেজনা চলছিল। হিন্দু উকিলদের সাথে আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। সকলেই আমার আব্বাকে সম্মান করতেন। দুই পক্ষের মধ্যে অনেক আলােচনা হয়ে ঠিক হল মামলা তারা চালাবে না। আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে পনের শত টাকা। সকলে মিলে সেই টাকা দিয়ে দেওয়া হল। আমার আব্বাকেই বেশি দিতে হয়েছিল। এই আমার জীবনে প্রথম জেল।

মামলা-১
রাজনৈতিক কারণে প্রথম গ্রেফতার, ১৯৪৮
দেশবিভাগের (১৯৪৭) পরপরই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকায় এসেই গণতান্ত্রিক যুবলীগের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঐ সময়ে পূর্ববাংলায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিরােধের সূত্রপাত হয়। শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শুরুতেই দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এ সময়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ‘৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে খাজা নাজিমুদ্দীনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং কারাবরণ উল্লেখযােগ্য।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে বলে ঘােষণা দিলে শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ জানান। খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেখ মুজিবও এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। তিনি ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যােগাযােগ করেন।
২ মার্চ ভাষার প্রশ্নে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিংয়ের সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় (তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র)। এ গ্রেফতারের কারণে সারা দেশের
——————————————————————-
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ মে ২০১৪, পৃষ্ঠা. ১৫৩
——————————————————————
৪৭

ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে শেখ মুজিবসহ গ্রেফতারকৃত ছাত্র নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব জামিনে মুক্ত হন। মুক্তি লাভের পর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্রসভার আয়ােজন করা হয়। এই সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।
রাজনৈতিক কর্মসূচি সংগঠিত করা ও আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে এই তাঁর প্রথম গ্রেফতার ও কারাগার গমন। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ১৯৮ দিনের মাথায় তিনি পাকিস্তান সরকারের গ্রেফতারের শিকার হন।

মামলা-২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও গ্রেফতার, ১৯৪৯
১৯৪৯-এর ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এর সমর্থনে সভা করেন। এজন্য ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করেন, যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালের ২৯ মার্চ বহু ছাত্রকে নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, নঈমুদ্দিন আহমদ, কল্যাণ দাশগুপ্ত, মিস নাদেরা বেগম ও আবদুল ওয়াদুদকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। বিভিন্ন হল থেকে আবদুর রহমান চৌধুরী, মােল্লা জালালউদ্দিন ও আবদুস সামাদসহ ১৪ জনকে বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় দবিরুল ইসলাম ও অলি আহাদসহ ৬ জনকে। প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল হরতাল। ডাকা হয়। ভিসির বাসায় অবস্থান ধর্মঘটের সময় শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন এবং কোনাে জরিমানা ও মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ১৯৪৯-এর ২৭ জুলাই পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়।(৬) বঙ্গবন্ধু তাঁর স্মৃতিকথায় ঘটনাটির বর্ণনা প্রদান করেছেন এভাবে(৭) :
দশটায় পিকেটিং শুরু হল। ছাত্র কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় শুয়ে পড়ল। একজন মাত্র ছাত্রী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। তার নাম নাদেরা বেগম। প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর ভগ্নি। নাদেরা একাই ছেলেদের সাথে দরজায় বসেছিল। মাত্র দশ-পনেরজন ছাত্র নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সমর্থক। এই কয়েকজন। বারবার ছাত্রদের উপর দিয়ে একবার ভিতরে একবার বাইরে যাওয়া-আসা করতে লাগল এবং এর মধ্যে একজন নাদেরাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়েছিল। সাধারণ ছাত্ররা এদের ওপর ক্ষেপে গেল। আমি
———————————————————
৬. মনসুর মুসা (সম্পাদিত), বাংলাদেশ’, রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ২০০৪) পৃ. ২৫৩-৫৫। দ্র. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ মে ২০১৪, পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬।
৭. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশক : ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১২, পৃষ্ঠা ১১৫-১১৭, ১২০।
—————————————————————-
৪৮

দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং সকলকে নিষেধ করলাম গােলমাল না করতে। আমি তাদের বললাম, “আপনারা ক্লাস করতে চান, ভিতরে যান, আমাদের আপত্তি নাই। তবে বারবার যাওয়া-আসা করবেন না। আর আজেবাজে কথা বলবেন না।”
তারা আমার কথা না শুনে আবার বের হয়ে এল এবং ভিতরে ফিরে যেতে লাগল যারা পিকেটিং করছিল, তাদের উপর পা দিয়ে। আর আমি কিছু করতে পারলাম না, সাধারণ ছাত্র তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা এদের আক্রমণ করে বসল। এরা পালিয়ে দোতলায় আশ্রয় নিল, যে যেখানে পারে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ ছাত্রদের বাধা দিলাম। যা হােক, ধর্মঘট হয়ে গেল। সভা হল, ধর্মঘট চলবে ঠিক হল। এ সময় ড. ওসমান গণি সাহেব সলিমুল্লাহ হলের প্রভােস্ট ছিলেন। তিনি এক্সিকিউটিভ কমিটির সভায় আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে অনুরােধ করলেন। তাঁকে সমর্থন করলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কিন্তু কমিটির অন্যান্য সদস্য রাজি হলেন না। ১৮ তারিখে ধর্মঘট হয়েছিল, আবার ১৯ তারিখে ধর্মঘট হবে ঘােষণা করা হল। ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহ কমে গেছে বলে আমার মনে হলাে। ১৮ তারিখ বিকালে ঠিক করলাম, ধর্মঘট করে বােধ হয় কিছু করা যাবে না। তাই ১৮ তারিখে ছাত্র শােভাযাত্রা করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে গেলাম এবং ঘােষণা করলাম, আমরা এখানেই থাকব, যে পর্যন্ত শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার না করা হয়। একশজন করে ছাত্র রাতদিন ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে বসে থাকবে। তাঁর বাড়ির নীচের ঘরগুলিও দখল করে নেওয়া হল। একদল যায়, আর একদল থাকে। ১৮ তারিখ রাত কেটে গেল, শুধু আমি জায়গা ত্যাগ করতে পারছিলাম না। কারণ শুনলাম, তিনি পুলিশ ডাকবেন। ১৯ তারিখ বিকাল তিনটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি বিরাট একদল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন। আমি তাড়াতাড়ি সভা ডেকে একটা সংগ্রাম পরিষদ করতে বলে দিলাম। সকলের মত আমাকেও দরকার হলে গ্রেফতার হতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিলেন আমাদের স্থান ত্যাগ করে যেতে। আমি আটজন ছাত্রকে বললাম, তােমরা এই আটজন থাক, আর সকলেই চলে যাও। আমি ও এই আটজন স্থান ত্যাগ করব না। ছাত্র প্রতিনিধিদের ধারণা, আমি গ্রেফতার হলে আন্দোলন চলবে, কারণ আন্দোলন ঝিমিয়ে আসছিল। একে চাঙ্গা করতে হলে, আমার গ্রেফতার হওয়া দরকার। আমি তাদের কথা মেনে নিলাম। পাঁচ মিনিট পরে এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের গ্রেফতারের হুকুম দিলেন।
কারাগারের যন্ত্রণা কি এইবার বুঝতে পারলাম। সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলেই আমার খারাপ লাগত। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত কয়েদির কামরায় কামরায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়া হয় গণনা করার পর।
২৫ এপ্রিল ১৯৪৯ পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এ. বি. খানের চিঠিতে প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সুপারকে তিনি লিখছেন যে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় (অর্থাৎ, বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার) শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়েছে। এবং তিনি মনে করেন তাঁকে আটক রাখা উচিত। (৮)
২৯ এপ্রিল ১৯৪৯ তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। ৩০ এপ্রিল তিন মাসের আটকাদেশ [ডিটেনশন] প্রদানের সুপারিশ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এ. বি. খানের কাছে চিঠি লেখেন তৎকালীন পুলিশের গােয়েন্দা বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ, ডিআইবি) অতিরিক্ত এসপি এ. গফুর। চিঠিতে বলা হয়, …ঢাকার পুলিশ সুপার ও ম্যাজিস্ট্রেটও এই সুপারিশ মঞ্জুর করেছেন।(৯) ৩৭ দিন আটক থাকার পর ১৯৪৯ সালের ২৫ মে তাঁর বিরুদ্ধে তিন মাসের আটকাদেশ জারি করেন গভর্নর। এই আটকাদেশের কথা তাঁকে
———————————————–
৮ Secret Documents Volume 1: 1948-1950, pp. 133-135.
৯. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, pp. 142-143.
————————————————–
৪৯

জানানাে (সার্ভ করা) হয় আরও দুদিন পর অর্থাৎ ২৭ মে।(১০) আটকাদেশের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।( ১১):
Communication of grounds of detention under section 10C of the Bengal Special Powers Ordinance (Ordinance VI of 1946) as enacted and continued in operation by the East Bengal Ordinances Temporary Enactment and Re-enactment Act, 1949 (East Bengal Act 1 of 1949).
In pursuance of section 10C of of the Bengal Special Powers Ordinance (Ordinance VI of 1946) as enacted and continued in operation by the East Bengal Ordinances Temporary Enactment and Re-enactment Act, 1949 (East Bengal Act 1 of 1949) you Sheikh Mujibar Rahman, son of Lutfar Rahman of T[u]ngipara, P.S. Gopalganj, Faridpur and 150 Moghultooly, Dacca at present detained in the Dacca Central Jail under order No. 1336 dated the 25th May, 1949 made under sub-section 1(a) and (4) of the said Ordinance, are hereby informed that your detention has been considered necessary on the following ground:
That you have been and are associated with the illegal activities of a [sic] secret association in the district of Faridpur and Dacca the object of which is to overthrow this Govt. (i.e. Government of East Bengal) by violent means and in this connection you have been carrying on prejudicial and disloyal propaganda against the Government and have been inciting the Kisans laborers and students of districts Faridpur and Dacca to acts of disloyalty and violence against this Government and
That all your activities mentioned above threaten and are likely to endanger the existence of public order and safety in this Province.
You are further informed that you have a right to make a representation in writing to this Government against the order of detention made against you, and should you wish to do so you should send the representation to the undersigned through the Superintendent of Dacca Central Jail, where you are at present detained.
By order of the Governor,
Sd/-A. B. Khan [handwritten signature]
Asst. Secy. to the Govt. of East Bengal,
Home (Political) Department. AI/16/6
————————————————————
* Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, pp. 172-173. ss
*Secret Document Volume 1 : 1948-1950, p. 189
————————————————-
৫০

১ মে ১৯৪৯ আই. বি. অফিসারের কাছে দেওয়া তাঁর জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধু বলেন,
“… দেশভাগের পর আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে কাজ করছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টি বা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোনাে দলের সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদে ডাকা ছাত্র ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করি। আমি ১৯.৪.৪৯ তারিখে বেলা আনুমানিক ৪.১০ মিনিটে কর্মচারীদের ডাকা সর্বশেষ অবরােধে অংশগ্রহণ করিনি। ডিএম, ডিআইজি ও সিটি এসপি অপর ছয়জনসহ আমাকে গ্রেফতার করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্যের রুম থেকে আমাকে কারাগারে নিয়ে আসা হয়।” (ইংরেজি থেকে অনূদিত](১২ )

১৬ জুন পত্রিকায় (ইত্তেহাদ) খবর প্রকাশিত হয় যে, আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবের পক্ষে ঢাকা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দায়ের করবেন।(১৩) পরদিনই গভর্নর বঙ্গবন্ধুর আটকাদেশ বাতিল করেন। এ আদেশ কার্যকর হওয়ার কথা ২৭ জুন থেকে। ১৭ জুন জারি করা আটকাদেশ বাতিল করার আদেশটি(১৪) নিম্নরূপ :
Dacca, 17 June 1949
Government of East Bengal
Home Department
Special Section.
Order.

No. 1742-H.S.
Dacca, the 17th June 1949.
In exercise of powers conferred by clause (a) of Sub-section (1) and Sub-section (4) of section 10A of the Bengal Special Powers Ordinance (Ordinance VI of 1946) as enacted and continued in operation by the East Bengal Ordinances Temporary Enactment and Re-enactment Act, 1949 (East Bengal Act 1 of 1949) the Governor is Pleased hereby to cancel order No. 1336-H.S., dated the 25th May, 1949 in respect of the security prisoner Sheikh Mujibar Rahman detained in the Dacca Central Jail with effect form the 27th
Junne 1949.
By the order of the Governor
Sd/-A. B. Khan
Asst. Secy. to the Gov. of East Bengal.
———————————————————-
* Secret Document Volume 1 : 1948-1950, p. 148.
* Secret Document Volume 1 : 1948-1950, p. 186.
১8. “Assistant Secretary, Govt. of East Bengal issued an order to cancel detention order no. 1336-H.S., dated the 25th May, 1949, in respect of S.Pr. Sheikh Mujibur Rahman detained at Dacca Central Jail with effect from the 27th June, 1949′, Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 194.
————————————————–
৫১

২৭ জুন ১৯৪৯ ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি টি. এইচ. এলিস ও বিচারপতি আমীরুদ্দীনের বেঞ্চে শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে হেবিয়াস কর্পাস রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। হাইকোর্ট শেখ মুজিবের আটক আদেশ কেন অবৈধ ঘােষণা করা হবে না এই মর্মে রুল ইস্যু করেন। সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাডভােকেট জেনারেল সময় প্রার্থনা করেন এবং জানান যে, ১ জুলাই আদালতকে অবহিত করা হবে।(১৫)
২৭ জুন আইবিইবি ও ডিআইজি(১৬) (ঢাকা) মাে. ইউসুফের ডেইলি রিপাের্ট থেকে জানা যায়, ইতিমধ্যে নিরাপত্তাবন্দি মুজিবকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২৬ জুন মুক্তি প্রদান করা হয়েছে।

মামলা-৩
গােপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে মামলা, ১৯৪৯

১৯৪৯ সালের ২৬ জুন মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে গমন করেন। ১৯৪৯ সালে ১৮ জুলাই গােপালগঞ্জ শহরে আয়ােজিত একটি সভায় তাঁর অংশগ্রহণ করার কথা। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সেদিন শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং আইন ভঙ্গ করে সভা অনুষ্ঠানের দায়ে শেখ মুজিব ও আবদুস সালাম খানকে আটক করা হয়। তাদেরকে কয়েক ঘণ্টা আটক রাখার পর মুক্তি দেওয়া হয়।(১৭) বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণে(১৮ )সেদিনের ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ :
“গােপালগঞ্জে খবর দিয়ে আমি বাড়িতে রওয়ানা করলাম। বােধহয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি হবে, জনসভা ডাকা হয়েছিল। সালাম খান সাহেব উপস্থিত হলেন, আমিও বাড়ি থেকে আসলাম। সভায় হাজার হাজার জনসমাগম হয়েছিল। হঠাৎ সকালবেলা ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। আমরা সভা মসজিদ প্রাঙ্গণে করব ঠিক করলাম। তাতে যদি ১৪৪ ধারা ভাঙতে হয়, হবে। বিরাট মসজিদ এবং সামনে কয়েক হাজার লােক ধরবে। সালাম সাহেবও রাজি হলেন। আমরা যখন সভা শুরু করলাম, তখন এসডিও মসজিদে ঢুকে মসজিদের ভিতর ১৪৪ ধারা জারি করলেন। আমরা মানতে আপত্তি করলাম, পুলিশ মসজিদে ঢুকলে মারপিট শুরু হল। আমি ও সালাম সাহেব সভাস্থান ত্যাগ করতে আপত্তি করলাম। আমাদের গ্রেফতার করা হল। জনসাধারণও মসজিদ ঘিরে রাখল। গুলি করা ছাড়া আমাদের কোর্টে বা থানায় নেওয়া সম্ভবপর হবে না, পুলিশ অফিসার বুঝতে পারল। যতদূর জানা গিয়েছিল, পুলিশ কর্মচারীরা মসজিদের ভিতর ১৪৪ ধারা জারি করতে রাজি ছিল না। এসডিও সাহেব জোর করেই করেছিলেন। মহকুমা পুলিশ অফিসার যখন বুঝতে পারলেন অবস্থা। খুবই খারাপ, গােলমাল হবেই, তখন আমার ও সালাম সাহেবের কাছে এসে অনুরােধ করলেন, “গােলমাল
————————————————————-
১৫.ইত্তেহাদ, ২৩ জুন, ১৯৪৯, উদ্ধৃত, Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 199-200.
১৬.ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ, ইস্ট বেঙ্গল (আইবিইবি)।
১৭. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 368.
১৮. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২৩।
————————————————————-
৫২

হলে অনেক লােক মারা যাবে। আপনারা তাে এখনই জামিন পেয়ে যাবেন, এদের বলে দেন চলে যেতে এবং রাস্তা ছেড়ে দিতে। আমরা আপনাদের কোর্টে নিয়ে যাব এবং এখনই জামিন দিয়ে দেব।”
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বহুদূর থেকে লােকজন এসেছে। বৃষ্টি হচ্ছে, সন্ধ্যার অন্ধকারে কি হয় বলা যায় না। জনসাধারণের হাতেও অনেক লাঠি ও নৌকার বৈঠা আছে। মহকুমা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিশেষ করে আমাকে বক্তৃতা করে লােকজনকে বােঝাতে বললেন। সালাম সাহেব ও গােপালগঞ্জ মহকুমার নেতাদের সাথে আলাপ-আলােচনা করে ঠিক হল আমি বক্তৃতা করে লােকদের চলে যেতে বলব। আমি বক্তৃতা করলাম, বলার যা ছিল সবই বললাম এবং রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরােধ করলাম। মসজিদ থেকে কোর্ট তিন মিনিটের রাস্তা মাত্র। পুলিশ ও আমরা কয়েক ঘণ্টা আটক আছি। জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত আমাদের রাস্তা দিল। আমাদের সাথেই জিন্দাবাদ দিতে দিতে কোর্টে এল। রাত আট ঘটিকার সময় আমাদের জামিন দেওয়া হল। তারপর জনগণ চলে গেল। এটা আমাদের আওয়ামী লীগের মফস্বলের প্রথম সভা এবং সে উপলক্ষ্যে ১৪৪ ধারা জারি।”
এই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু ও সালাম খানের বিরুদ্ধে মামলা গােপালগঞ্জ পি.এস. কেস নং ১১, তারিখ ১৮.৭.৪৯ দায়ের করা হয়। এই মামলায় সেদিনই জামিন হলেও তাকে পরে বহুবার হাজিরার জন্য গােপালগঞ্জ আদালতে আনা হয়েছে। যেমন, ১৯৫১ সালের ৪ জানুয়ারি (তিনি তখন অন্য একটি মামলায় আটক) শেখ মুজিবকে অবিলম্বে ফরিদপুর থেকে খুলনা জেলে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।১৯ ২২.১.৫১ তারিখে স্বাক্ষরিত ফরিদপুরের পি.পি. বি. এল. ভদ্রের একটি নােট থেকে জানা যায়, গােপালগঞ্জ পি.এস. কেইস নং ১১, তারিখ ১৮.৭.৪৯ মামলার শুনানি ৩০ জানুয়ারি ১৯৫১ তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। ২০ ১৯৫২ সালের ১৫ এপ্রিল গােপালগঞ্জ মহকুমা হাকিম এই মামলার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। আদালতের রায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুস সালাম খানকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ প্রদান করা হয়।(২১)

মামলা-৪
আরমানিটোলা জনসভা মামলা (১১ অক্টোবর ১৯৪৯)
১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে গােপালগঞ্জের মামলার পর শেখ মুজিব কয়েক দিন জেলের বাইরে ছিলেন। তবে তৎকালীন সরকার তাঁর উপর নজরদারি অব্যাহত রাখে। সেই সময়ের গােয়েন্দা বিভাগের রিপাের্ট থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভায় সরকারের সমালােচনা করা হয় এবং বিনা বিচারে আটক রাজবন্দিদের মুক্তি, ক্ষতিপূরণবিহীন জমিদারি বিলুপ্তি, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলন, পাটশিল্পের জাতীয়করণ,
—————————————-
» Secret Documents Volume 2 : 1948-1950, p. 3.
>> Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 7.
২১. আজাদ, ১৭ এপ্রিল ১৯৫২।
——————————————–
৫৩

সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি দাবি জানানাে হয়।(২২) এ সময়ে লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এই উপলক্ষ্যে অক্টোবরের শুরুতে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু একটি লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা করেন। লিফলেটে ১১ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগ আয়ােজিত জনসভায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানানাে হয়। সেই লিফলেটে বলা হয়, লাখ লাখ নারী, পুরুষ, শিশু অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, ম অভিভাবকরা নারী ও শিশুদের গবাদি পশুর মতাে (চ্যাটেল) বিক্রি করছে খাদ্যাভাবে, ইত্যাদি। ১১ অক্টোবরের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন। দেশে খাদ্য সঙ্কটের জন্য মন্ত্রিদের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানান তিনি।(২৩) বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিকথার এই সভার বর্ণনা করেছেন এভাবে(২৪) :
১১ই অক্টোবর ১৯৪৫ আরমানিটোলায় বিরাট সভা হল। সমস্ত ময়দান ও আশপাশের রাস্তা লােকে ভরে গেল। শামসুল হক সাহেব বক্তৃতা করার পর আমি বক্তৃতা করলাম। মওলানা পূর্বেই বক্তৃতা করেছেন। আমি শেষ বক্তা। সভায় গােলমাল হবার ভয় ছিল বলে ভাসানী সাহেব প্রথমে বক্তৃতা করেছেন। ভাসানী সাহেব আমাকে বললেন, শােভাযাত্রা করতে হবে সেইভাবে বক্তৃতা কর। আমি বক্তৃতা করতে উঠে যা বলার বলে জনগণকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম, “যদি কোন লােককে কেউ হত্যা করে, তার বিচার কি হবে?” জনগণ উত্তর দিল “ফাঁসি হবে।” আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “যারা হাজার হাজার লােকের মৃত্যুর কারণ, তাদের কি হবে?” জনগণ উত্তর দিল, “তাঁদেরও ফাঁসি হওয়া উচিত।” আমি বললাম, “না, তাদের গুলি করে হত্যা করা উচিত।” কথাগুলি আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। তারপর বক্তৃতা শেষ করে বললাম,
“চলুন আমরা মিছিল করি এবং লিয়াকত আলী খান দেখুক পূর্ব বাংলার লােক কি চায়!” সভা শেষে মিছিলের সময় নাজিরাবাজারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ করে। মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত শেখ মুজিব প্রায়-বেহুঁশ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যান। কয়েকজন লােক ধরাধরি করে তাঁকে রিকশায় করে মােগলটুলী নিয়ে আসে। সেদিন অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনায় মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার নম্বর হলাে- Kotwali P.s. cas no 19 dated 11.10.49 u/s 147/325 I.P.C. and 7(3) B.S.P.O.।(২৬) এই ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়িয়ে গােপনে শেখ মুজিব কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন। এরপর সুযােগ বুঝে তিনি সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করার জন্য লাহাের গমন করেন।(২৭)
এদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে গােয়েন্দা বিভাগ। ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর, আইবি, পূর্ববঙ্গ, ঢাকা-এর স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ একটি চিপার টেলিগ্রাফিক ম্যাসেজে ডিনটেল, ঢাকা থেকে গােপালগঞ্জ ফরিদপুরের সাবডিভিশনাল অফিসারের কাছে পাঠান। যার ভাষা ছিল নিম্নরূপ : Arrest Shaikh
———————————————–
২২. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 368.
২৩. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 368-9.
২৪. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৩২।
২৫. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৩২।
২৬. Secret Documents Volume 1:1948-1950, p. 369; অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৬৯।
২৭. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৩৩-১৩৫।
———————————————–
৫৪

Mujibur Rahman, son of Lutfar Rahman.(২৮) উক্ত মামলায় ২৬ ডিসেম্বর তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়।(২৯) ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ গােপালগঞ্জের এসডিপিও ঢাকার আইবিও ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে এক চিঠিতে জানান, শেখ মুজিবকে কয়েকবার গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি।(৩০)
এ যাত্রায় লাহাের, দিল্লি, বেনাপােল, খুলনা ও গােপালগঞ্জ হয়ে প্রায় মাস খানেক পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। এবার যে গ্রেপ্তার হতেই হবে সেই মানসিক প্রস্তুতি তাঁর ছিল, তবে যতদিন বাইরে থাকা যায় ততই মঙ্গল, এভাবেই চিন্তা করছিলেন। ঢাকায় ফিরে দুয়েক জায়গা ঘুরে অবশেষে আলী আমজাদ খানের পুরনাে বাড়ি খাজে দেওয়ানে এসে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন। আগে থেকেই সেখানে তাঁর আরও দুজন রাজনৈতিক বন্ধু বসবাস করতাে। (৩১)
৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ তারিখে আইবির এসআই সৈয়দ মাে. সিদ্দীক প্রণীত একটি রিপাের্ট থেকে জানা যায়, এসডিও (এস) জারিকৃত সার্চ ওয়ারেন্টেরবলে আই.বি-র স্টাফ এসআই খন্দকার সাইদুর রহমান, এসআই মাে. ইসমাইল লালবাগ থানার ওসির সহায়তায় ৬৯/১, খাজা দেওয়ান, ঢাকা- এই ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে নিচতলার একটি রুম থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এসআই সাইদুর রহমান তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। মামলার নম্বর-c/w Kotwali P.S. case no. 19(10) 49 u/s 147 I.P.C. r/w7(3) B.S.P.O. & u/s 18(2) B.S.P.0.।(৩২) পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই কয়টি দিন কেমন করে কাটিয়েছেন এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ :
“দিনভর বই পড়তাম, রাতে ঘুরে বেড়াতাম। ঠিক হল, আরমানিটোলা ময়দানে [আবার] একটা সভা ডাকা হবে। আমি সেখানে বক্তৃতা করব এবং গ্রেফতার হব। যখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, দু’একদিনের মধ্যে সভা ডাকা হবে, দুপুরবেলা বসে আছি, দেখি পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছে। দুইজন গােয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সাদা পােশাক পরে ভিতরে আসছেন। আমি যে ঘরে থাকি, সেই ঘরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। আমি বললাম, ভিতরে আসুন। তারা ভিতরে আসলে বললাম, “কয়েকদিন পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষায় আছি। বসুন, কিছু খেয়ে নিতে হবে।”…আমাকে লালবাগ থানায় নিয়ে আসা হলাে। দুইজন আইবি অফিসার আমাকে ইন্টারােগেশন করতে শুরু করল। প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সে পর্ব চলল।…আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখাল এবং সন্ধ্যার পর কোতােয়ালি থানায় নিয়ে গেল।(৩৩)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই অংশে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ওই বাড়ির মালিক অ্যাডভােকেট আলী আমজাদ খানের শ্যালক পুলিশকে তার গােপন আস্তানা সম্বন্ধে খবর দিয়েছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু জানতেন না, তাকে গ্রেফতার করার জন্য যারা গােপনে পুলিশকে খবর দিত পুলিশ তাদেরকে পুরস্কৃত করত। ১৮.১.৫০ তারিখে আইবি কর্তৃক প্রস্তুত একটি রিওয়ার্ড স্টেটমেন্টে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে যারা সহায়তা করেছে তাদের নাম ও পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে :(৩৪)
——————————–
২৮. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 317.
২৯. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 361.
৩০. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 324.
৩১ .অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৬৬।
৩২. Secret Documents Volume 1:1948-1950, p. 325-27. যুগান্তর (কলকাতা) ও আজাদ, ১ জানুয়ারি ১৯৫০; Secret Documents Volume 1:1948-1950, p. 333.
৩৩. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৬৬-১৬৭।
৩৪. Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 356.
————————————-
৫৫

ক্রমিক পদবি নাম  যে ভালাে কাজ করেছেনতার বিবরণ

 

ডেপুটি এস.পি.

সুপারিশ

এস.এস.আই 
পি.এ.সি.এ.২১ ৩১.১২.৪৯ তারিখে পলাতক ও

আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান, সাধা. সম্পাদক, আওয়ামী মুসলিম লীগ-এর ব্যাপারে তথ্য সরবরাহ করেছেন। যার ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

১০০/টাকা সুপারিশ

করা হলাে

১০০/

এসডি/- ২/২

এসআই সৈয়দ মাে. সিদ্দীক পি.এ.সি.এ.২১-এর সঙ্গে যােগাযোগ রক্ষা এবং ৩১.১২.৪৯ তারিখে তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার ৫০টাকা সুপারিশ

করা হলাে

৫০/

এসডি/- ২/২

এসআই খন্দকার সাইদুর রহমান, ডিআইবি, ঢাকা গ্রেফতারে সহায়তা ৩, ৪ ও ৫ নং এই তিন অফিসারকে জি.এস. মার্ক-এ পুরস্কৃত করা যেতে পারে জিএস মার্ক

এসডি/- ২/২

৩, ৪ ও ৫

নংকে

২৫/

টাকা করে দেওয়া হয়েছে

এসআই মাে. ইসমাইল, ডিআইবি, ঢাকা
এসআই আহসানুল্লাহ,  ওসি, লালবাগ
কন্সটেবল ইউসুফ ঐ হােসেন, আইবি (গার্ড কন্সটেবল নং ২) ৫/টাকা সুপারিশ করা হলাে

এসকে. এসডি/-১৮.১.৫০

৫/

এসডি/- ২/২

অনুমােদন

হলাে

করা। এসডি/-২. ২.৫০

১৮ জানুয়ারি ১৯৫০ বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ২৮ জানুয়ারি ১৯৫০ মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়।৩৫ এবার শেখ মুজিবকে তাঁর আটকাদেশের কারণ জানানাে হয়। প্রথম প্যারায় পুরনাে অভিযােগ, ২ ও ৩ নং প্যারায় তাঁর বিরুদ্ধে যােগ করা হয় নতুন অভিযােগমালা :(৩৬)
—————————————————-
৩৫. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 372.
৩৬ . Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 373-374.
—————————————————–
৫৬

2. That you have been concerned in acts of espionage in the district of with
the intention of collecting information regarding the armed forces, militancy concentration and strategic positions etc. of the Province of East Bengal for passing on the same to our enemies both within this Province and outside it.
3. That you have been participating and otherwise helping in the illegal
activities of a group of persons who are plotting to bring about a re-union of East and West Bengal by employment of violent and terrorist methods against this Govt. and its. Peaceful subjects.”
অর্থাৎ, আপনি পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী, সেনা মােতায়েন ও কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে গােপন খবর সংগ্রহ (স্পাইগিরি) করছেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে পুনরায় একত্রিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন।
আদালতে শুনানির দিন ঠিক হয় জানুয়ারির ২৮ তারিখ।
১৯৫০ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আটকাদেশের মেয়াদ আবার বর্ধিত করা হয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি একটি আদেশ জারি করেন যে, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, তার আটকাদেশ বহাল ও চলমান (কন্টিনিউড) রাখা উচিত। তাঁকে পরবর্তী আদেশ না-দেওয়া পর্যন্ত আটক রাখা হবে।(৩৭) ২০ মার্চ এক আদেশে তাঁকে গ্রেড-১ বন্দিতে উন্নীত করার আদেশ প্রদান করা হয়। (৩৮)
১৯৫০-এর ২৯ মার্চ অতিরিক্ত ডিআইবি, ঢাকা-র এসপি এসএসআইবি, ঢাকা-র কাছে চিঠি লিখে জানান যে, শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সবচেয়ে উগ্র (মিলিট্যান্ট) সদস্য। তিনি জেলে থেকেও সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করছেন এবং বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভাবিরােধী অবস্থানে অনড় রয়েছেন। সুতরাং, তাঁকে আরাে তিন মাস আটকাদেশ দেওয়া হােক। ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও তাই চান মর্মে মতামত ব্যক্ত করেন। ৬.৪.৫০ তারিখে তাকে আটকাদেশ বর্ধিত করার ভিত্তি অবহিত (গ্রাউন্ড সার্ভ) করা হয়।(৩৯) ৪.৫.৫০ তারিখে ভাসানী, শেখ মুজিব ও শামসুল হক এই তিনজনের আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা।(৪০) ১৫.৫.৫০ ডিআইজি, আইবি, পূর্ববঙ্গ বরাবর চিঠিতে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও এসএম হলের প্রভােস্টের সঙ্গে অনতিবিলম্বে দেখা করার অনুমােদনের প্রয়ােজনীয়তা ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু জানান জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে তিনি আসছে জুলাইয়ে ল [এলএল.বি.] পরীক্ষা দিতে চেষ্টা করবেন।(৪১) ১৪.৬.৫০ তারিখে অতিরিক্ত এসপি আইবি, এসএস, আইবিকে একটি মেমাের মাধ্যমে জানান যে, এখনও শেখ মুজিবের মনােভাবের মধ্যে কোনাে পরিবর্তন দেখা যায়নি এবং তিনি বন্ড সই করে মুক্তি পেতেও আগ্রহী নন। অতএব তাঁর আটকাদেশের মেয়াদ আরও ৬ মাস বৃদ্ধি করা হউক।(৪২)
———————————
৩৭. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 398. 0
৩৮. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 406.
৩৯ Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 411, 420-21.
৪0. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 429.
৪১. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 435.
৪২. Secret Documents Volume 1:1948-1950, p. 447.
—————————————————
৫৭

১৫.৬.৫০ তারিখে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল সুপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে জানান যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হয়েছে ১৭.৬.৫০ তারিখে।(৪৩) ১৬.৬.৫০ আইবির এক এসআই রিপাের্ট করছে যে, তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করেছেন। অর্ধেক রাজস্ব জোগান দিলেও পূর্ববঙ্গের শিক্ষা ও শরণার্থী সংকট সমাধানে সরকার অবহেলা করছে। মিলিটারি একাডেমি বা শিল্পকারখানার ক্ষেত্রেও পূর্ববঙ্গ বৈষম্যের শিকার। শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার চেয়ে জেলে মারা যাওয়াকে তিনি অগ্রাধিকার দেবেন বলে জানিয়েছেন। এসআইএর মন্তব্য, তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনও কোনাে পরিবর্তন আসেনি।(৪৪) ১৬.৬.৫০ জেল সুপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে জানান যে, অনিবার্য কারণবশত শেখ মুজিবের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ১৭.৬.৫০ তারিখ সকাল ১১.০০টায় হবে না, তবে তিনি ১৯.৬.৫০ দেখা করতে পারবেন।(৪৫)
২৬.৬.৫০ তারিখের এক গােপন মেমােতে প্রভােস্টকে জানানাে হয় তার মিটিং জেল গেটে ২৮.৬.৫০ সকাল ১১.০০টায় নির্ধারণ করা হয়েছে।(৪৬) ২৬.৬.৫০ তারিখের একজন এসআই কর্তৃক প্রণীত রিপাের্ট থেকে জানা যায়, শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রক্টরের ১১.৪৫ মিনিটে সাক্ষাত হয়েছে। শেখ মুজিব তার [এলএল.বি) পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন জমা দেন, প্রক্টর তাকে সর্বোচ্চ সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।(৪৭) ২৮.৬.৫০ প্রভােস্টের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে মন্তব্য করা হয় যে, শেখ মুজিব প্রভােস্টকে অনুরােধ করেছেন তাঁর আরােপিত শৃঙ্খলাজনিত শাস্তি (১৫/=) প্রত্যাহার করে নেওয়া যায় কিনা, যেন তিনি এ বছরের ল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন।(৪৮) ২৭.৭.৫০ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী শেখ মুজিব ও ভাসানীর সঙ্গে জেলে দেখা করেন এবং তাঁদের মামলা নিয়ে আলােচনা করেন।(৪৯ )
৮.৮.৫০ তারিখে ডিআইজি, আইবি-এর গােপন মেমাে থেকে জানা যায়, ডিএম আরাে ৬ মাসের আটকাদেশের সুপারিশ করেছেন।(৫০) ১৬.৯.৫০ তারিখে গভর্নর আটকাদেশ বহাল রাখা হয় পরবর্তী আদেশ পর্যন্ত। ১২ অক্টোবর ১৯৫০ ডিআইজি ডিএস-এর কাছে গােপন মেমােতে জানান, শেখ মুজিবকে কোতােয়ালি থানার কেস নং ১৯(১০)-এ (আরমিটোলা জনসভা মামলা) তিন মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে।(৫২)
২৬.১.৫১ তারিখে খুলনা জেলের সুপারের এক গােপন মেমাে থেকে জানা যায়, মামলার শুনানির জন্য শেখ মুজিবকে ২৮.১.৫১ তারিখে গােপালগঞ্জ সাব-জেলে ট্রান্সফার করা হবে। ৩০.১.৫১ তারিখে গােপালগঞ্জের এসডিও কোর্টে তার মামলা হাজিরা রয়েছে।(৫৩)
১২.২.৫১ শেখ মুজিব খুলনা জেলার আইবি এসপির কাছে একটি পিটিশন প্রেরণ করেন তার আইনজীবীর কাছে পাঠানাের জন্য। পিটিশনে বঙ্গবন্ধু জানান যে, তিনি হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস আবেদন দায়ের করতে চান।
——————————————————–
৪৩. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 449.
৪৪ Secret Documents Volume 1:1948-1950, p. 451.
৪৫. Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 451.
8৬. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 463.
৪৭ Secret Documents Volune 1: 1948-1950, p. 463.
৪৮ Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 463-64.
8৯. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 475.
৫০. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 463, 487.
৫১. Secret Documents Volume 1: 1948-1950, p. 493-95.
৫২. Secret Documents Volume 1 : 1948-1950, p. 515.
৫৩. To Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 9.

৫৮

আটকাদেশ, গ্রাউন্ডস অব ডিটেনশন এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে দেওয়া তাঁর স্টেটমেন্টের (রিপ্রেজেন্টেশন) ঐ কপি দেওয়ার অনুরােধ করেন যেন এগুলাে তিনি তার আইনজীবী আবদুস সালাম খানের কাছে পাঠাতে পারেন।(৫৪) ২২.২.৫১ তারিখে আইবি অফিসার শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার নেন। এ সময় তিনি পূর্ববঙ্গ সরকার ও মূলনীতি কমিটির বিষয়ে তাঁর সমালােচনামূলক অভিমত করেন। তিনি বলেন, এটা বাস্তবায়ন হলে পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানের কলােনিতে পরিণত হবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গে যে কোনাে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পরাজিত করবে। আরও জানান যে, জেল থেকে মুক্তির জন্য তিনি বন্ড দিতে রাজি নন।(৫৫ )
৭.৩.৫১ তারিখে গভর্নর শেখ মুজিবের আটকাদেশ বাতিল করেন।(৫৬) আইবির স্পেশাল সুপার খুলনা আইবির পুলিশ সুপারকে বিশেষ চিঠিতে আদেশ দেন যে, জেলে মুক্তির আদেশ সার্ভ করবেন এবং এরপর বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স ১৯৪৬-এর ১৮(১) ধারা অনুযায়ী পুনঃগ্রেফতার করবেন।(৫৭) একই তারিখে তাকে খুলনা থেকে বরিশাল জেলে পাঠানাের অনুরােধ করা হয়।(৫৮) ৮.৩.৫১ ঢাকার অতিরিক্ত এসপি আরাে ছয় মাসের আটকাদেশ দেওয়ার সুপারিশ করেন।(৫৯ )
খুলনা জেল সুপার শেখ মুজিবের মুক্তির আদেশের কপি পান ১২.৩.৫১ তারিখে এবং এ বিষয়ে বন্দিকে জানানাে হয় ১৩.৩.৫১ তারিখে। তবে তাকে খুলনা জেল সুপারের কাস্টডিতে রাখা হয় গােপালগঞ্জ কোর্ট জি.আর. কেস নং ৩১৪/৪৯ (পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১৪৩/১৮৮ ধারায় মামলায় বিচারাধীন আসামি (আন্ডারট্রায়াল) হিসেবে। এ মামলাটি ১২.৪.৫১ তারিখ পর্যন্ত মুলতুবি ছিল (উল্লেখ্য যে, এই তারিখের শুনানিতে শেখ মুজিব এই মামলায় নির্দোষ ঘােষিত হন)। গােপালগঞ্জ কোর্ট যেহেতু কোনাে অন্তর্বর্তীকালীন কাস্টডি ওয়ারেন্ট জারি করেনি, তাই খুলনা জেল সুপার খুলনা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে [ডিএম] তা জারি করার জন্য অনুরােধ করেন, কারণ বিধি অনুযায়ী জেল সুপার নিজে তা করতে পারেন না। খুলনা এডিএম (অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট] ইন্টারমিডিয়েট কাস্টডি ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা রাখেন না। তিনি খুলনা জেলা সুপারকে লেখেন ১৪.৩.৫১ তারিখে কয়েদিকে এসকর্ট দিয়ে স্টিমারযােগে গােপালগঞ্জ প্রেরণ করতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্টিমার ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁর পুনঃগ্রেফতারের সরকারি আদেশ খুলনার আইবির কাছে পৌছায়। তিনি গােপালগঞ্জ এসডিপিওকে টেলিগ্রামে অনুরােধ করেন, শেখ মুজিবকে বিএসপিও (বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ারস)-এর অধীনে ১৮(১) ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার করার নির্দেশ রয়েছে।(৬০)
১৫.৩.৫১ তারিখে গােপালগঞ্জের ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স অফিসারের (ডিআইও) রিপাের্ট থেকে জানা যায়, ১৪.৩.৫১ তারিখে তাকে পুলিশ প্রহরায় গােপালগঞ্জ মহকুমা হাকিমের আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে হাকিম ৩.৩০টায় তার জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন লাভের পর ২০০ ছাত্রের একটি শােভাযাত্রা তাঁকে নিয়ে নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে এবং মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ স্লোগান দেওয়া হয়। গােপালগঞ্জ কোর্ট মসজিদের কাছে গিয়ে শেখ মুজিব ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণে তাদেরকে একতাবদ্ধ হতে এবং সকল দুর্নীতি প্রতিরােধে সরকারের
——————————————
৫৪. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 10.
৫৫. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 13.
৫৬. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 17.
৫৭ Secret Documents Volume 2: 1951-1952, p. 18.
৫৮. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 20.
৫৯. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 23.
৬০. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 26.
————————————
৫৯

বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কর্ডন প্রথা বন্ধ করা এবং কৃষক-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি তােলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
বিকাল ৫টার দিকে এই সভা শেষ হয়। সাড়ে পাঁচটার দিকে শহরে তাঁর বাড়ির কাছে কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় এসপিও (১৯৫১ সালের ১নং আইন)-এর ১৮(১)নং ধারায় তাঁকে আবার গ্রেফতার করার নির্দেশ এসেছে বলে জানানাে হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন গােপালগঞ্জ শহরে সকাল ৮-১২টা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশসহ হরতাল পালিত হয়।(৬১) ১৭.৩.৫১ তারিখের এক রেডিওগ্রাম মেসেজ থেকে জানা যায়, গােপালগঞ্জ সাবজেলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় তাঁকে ফরিদপুর জেলে পাঠানাে হয়েছে।(৬২) ২১.৩.৫১ তারিখের আটকাদেশে জানানাে হয় যে, পরবর্তী আদেশ না-দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে ফরিদপুর জেলে আটক রাখা হােক।(৬৩)
২৩.৫.৫১ তারিখের এক গােপন মেমােতে জানা যায়, তিনি মুক্তি পেতে চান কিন্তু বন্ড দিয়ে নয়।(৬৪)
৫.৬.৫১ তারিখে মুন্সী হােসেন উদ্দীন নামের এক এসআই (আইবি)-র মুজিবের হেবিয়াস কর্পাসের ওপর রিপাের্ট নিম্নরূপ:
অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জনাব এম. এফ, বারি ও নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের হেবিয়াস কর্পাস মামলার ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেন। ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে সংশ্লিষ্ট জেল থেকে প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র আনাতে নির্দেশনা দেন। ৮ জুন শুনানির দিন বা তার আগে এসব কাগজপত্র আনার সমস্যা ব্যখ্যা করাতে তিনি বলেন, সেদিন সেই মামলা ডাক দেওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। কারণ, সে তারিখে এই মামলার আগে প্রায় শত মামলা পড়ে আছে শুনানির জন্য। ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে জানান যে, ৮ জুন হাইকোর্ট কজ লিস্টে এই মামলা প্রস্তুত নয় দেখানাে হবে। এলআর অফিসে এসব মামলা ডিল করে এমন অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনাে তথ্য দিতে পারেননি। তিনি আমাকে উপরােক্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট মালিকের কাছে রেফার করেন যার সঙ্গে আমি এর মধ্যে পরামর্শ করেছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা আগে আগে (আর্লি ডেটে) কাগজপত্রগুলাে আনাতে পারি।
মুন্সী হােসেন উদ্দীন
এস.আই, আই.বি., ৫.৬.৫১।(৬৫)
৩১.৭.৫১
তারিখে শেখ মুজিবসহ ১৩০ জন নিরাপত্তাবন্দির হেবিয়াস কর্পাস মামলার রিপাের্ট থেকে জানা যায়, বিচারপতি আমিন আহমেদ ও বিচারপতি ইব্রাহীমের বেঞ্চে এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি হয় ১৭, ১৮ ও ১৯ জুন। রায়ে বলা হয়, গােলাম কাদির শাহ ছাড়া বাকি সবার আটকাদেশ বৈধ। (৬৬) ৬.৮.৫১ তারিখে শেখ মুজিব তার মুক্তি বা চিকিৎসার জন্য ঢাকা জেলে বদলির জন্য আবেদন করেন।(৬৭) ২৯.৮.৫১ তারিখে তাকে ঢাকায় বদলি করা হয়। ১০.৯.৫১ তারিখে তিনি তার আইনজীবী আতাউর রহমান
——————————————
৬১. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 30-31.
৬২. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 13.
৬৩ Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 3-37.
৬৪. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 50.
৬৫ মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত। Secret Documents Volume 2: 1951-1952, p. 54-55.
৬৬. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 60-65.
৬৭. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 65.
————————————-
৬০

খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি আতাউর রহমানকে বলেন, হাইকোর্ট যেহেতু ডিটেনশন আদেশকে বৈধ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সুতরাং পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে আপিল করাই শ্রেয়। তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযােগ করা হয়েছে সেগুলাে পুরনাে মামলাসংক্রান্ত, যার অনেকগুলােতে তিনি ইতিমধ্যে খালাস পেয়েছেন। সুতরাং সরকারের হাতে তাকে আটক রাখার বৈধ কোনাে ভিত্তি নেই।(৬৮) ১২.৯.৫১ তারিখে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়াকে লেখা একটি চিঠিতে বঙ্গবন্ধু জানান :
“…আতাউর রহমান সাহেব দেখা করতে এসেছিলেন। [জামিনের জন্য] ফেডারেল কোর্ট করা যায় কিনা। আর করবে কিনা? জনাব সুরাওয়ার্দি সাহেব তাে পিন্ডি মামলা নিয়ে ব্যস্ত। কে [আমার] মামলা পরিচালনা করবেন? আপনি সুরাওয়ার্দি সাহেবের কাছে চিঠি লিখে জানুন তিনি করতে পারবেন কিনা আর তাহা না। হইলে অন্য কাহাকে দিয়া মামলা করার কোন অর্থ হবে বলে আমার মনে হয় না। আপনারা বাহিরে আছেন। ছালাম সাহেব, আতাউর রহমান সাহেব ও অন্যান্য সকলের সাথে পরামর্শ করে যাহা ভাল বােঝেন তাহাই করিবেন। আমার কিছু বলার নাই।”(৬৯)
২০.৯.৫১ তারিখে ইবিপিএসও-এর অধীনে তার পরবর্তী আদেশ পর্যন্ত আটকাদেশ সার্ভ করা হয়।(৭০) ৯.১০.৫১ আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খান জেলে দেখা করেন এবং মামলা নিয়ে কথা বলেন। তাঁরা জানান, তাঁর মুক্তির জন্য সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। সবশেষে সালাম খান বলেন, খুব দ্রুত আরেকটি হেবিয়াস কর্পাস পিটিশনও দায়ের করবেন।(৭১)
১.১.১৯৫২ তারিখের এক গােপন রিপাের্টে বলা হয়, শেখ মুজিবকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে। এই সুযােগে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানাের অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছেন।(৭২) ২.১.৫২ তারিখে সালাম খানকে সিন্ধু থেকে লেখা এক চিঠিতে সােহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের পক্ষে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেন। সােহরাওয়ার্দী মনে করেন, এই মামলা না জেতার কোনাে কারণ নেই। কারণ, কোনাে গ্রাউন্ডে কাউকে একবার গ্রেফতার করার পর ছেড়ে দেওয়া হলে একই গ্রাউন্ডে তাকে আবার গ্রেফতার করা যায় না।
১৭.২.৫২ তারিখে তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে মুক্তি প্রদানের আর কোনাে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে, ফরিদপুর জেলে ১৮.২.৫২ থেকে তিনি অনশন শুরু করেন। ২৫.২.৫২ তারিখে সরকার তাঁকে মুক্তির আদেশ দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মুক্তির আদেশ তাঁর কাছে এসে পৌছে। তিনি অনশন ভাঙলেন, কিন্তু সহবন্দি মহিউদ্দীনকে ছাড়া তিনি জেলের বাইরে যাবেন না, তাই আরাে একদিন জেলে থাকতে হলাে। অর্থাৎ ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বের হলেন।(৭৪) ২৯.২.৫২ তারিখের এক গােপন রিপাের্টে দেখা যায়, সরকার থেকে শেখ মুজিবের উপর নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি রাখার আদেশ প্রদান করা হয়েছে।(৭৫)
———————————————–
৬৮. Secret Documents Volune 2 : 1951-1952, p. 78.
৬৯. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 79.
৭০. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 87-89.
৭১. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 101.
৭২. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 137.
৭৩. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 138.
৭৪ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০৫-২০৬।
৭৫. Secret Documents Volume 2 : 1951-1952, p. 145-46.
—————————————-
৬১

মামলা-৫
কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিশৃঙ্খলার অভিযােগ, ১৯৫৪
৭ আগস্ট ১৯৫৩ ঢাকায় সব বিরােধী দল ও ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ-বিরােধী দিবস পালিত হয়।(৭৬) এর তিন দিনের মাথায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে চলমান মামলার খোঁজখবর করা হয়। ১০ আগস্ট ঢাকার আইবি (ডিআইজি) বরাবর পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানাে এক মেমােতে শেখ মুজিব ও ভাসানীর বিরুদ্ধে কথিত ৪০ হাজার মানুষ অনাহারে মারা যাওয়ার মিথ্যে অভিযােগের দায়ে অভিযােগ গঠন-সংক্রান্ত মামলার অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়।(৭৭)১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ব্যাপক ব্যবধানে জয়লাভ করে। ২৬ মার্চ যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক সরকার গঠিত হয়। দুই মাস না পেরুতেই ২৯ মে ৯২ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। সেদিনই করাচি থেকে সফর শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন শেখ মুজিব। রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর নিজের জবানিতে :
“জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে আমাকে নিয়ে আসা হল। তিনি বসেই ছিলেন, আমাকে বললে, “কি করব বলুন! করাচি আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য পাগল হয়ে গেছে।…” …তিনি আমাকে পাশের রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। ইদ্রিস সাহেব তখন ঢাকার ডিআইজি। তিনি আসলেন, আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করলেন। সিগারেট বা অন্য কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইলেন। আমি তাকেও বললাম যে, তাড়াতাড়ি জেলে পাঠিয়ে দিলেই খুশি হব। তিনি চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরে একজন ইন্সপেক্টর এসে একটা ওয়ারেন্ট তৈরি করতে লাগলেন। একটা মামলা আমার নামে করা হল; তাতে দেখলাম, ডাকাতি ও খুন করার চেষ্টা, লুটতরাজ ও সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, আরও কতগুলি ধারা বসিয়ে দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ‘ডিভিশন’ লিখে দিলেন। আমি রাত সাড়ে বারােটা কি একটা হবে, জেলগেটে পৌছালাম…”(৭৮)
এবার ১৯৫৪ সালের ৬ মে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেটে জেল ওয়ার্ডার ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযােগে তাকে গ্রেফতার দেখানাে হয়। মামলার অভিযােগপত্রে বলা হয়, ১৯৫৪ সালের ৬ মে সেন্ট্রাল জেলের সামনে এক হাঙ্গামায় শেখ মুজিবুর রহমান জনতাকে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করায় জনতা জেলগেট ও জনৈক জেল কর্মচারীর বাসগৃহ আক্রমণ করে। ফিরােজ, সিরাজউদ্দিন ও মাহমুদ মিয়া তাতে নেতৃত্ব দেয়।
অভিযুক্তদের পক্ষে বলা হয়, পুলিশ ও জেল কর্তৃপক্ষের ষড়যন্ত্রের ফলেই শেখ মুজিব ও অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযােগ দায়ের করা হয়েছে। তারা জেলগেটে জনতাকে শান্ত করতে গিয়েছিলেন। সেখানে জনতার উপর জেল ওয়ার্ডারগণ গুলিবর্ষণ করায় একজন নিহত ও ৫০/৬০ জন আহত হয়।
——————————–
৭৬.ওয়াচ রিপাের্ট, ৯৬।
৭৭. Secret Documents Volume 3 : 1953, p. 145-328.
৭৮ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৭২। ৭
৯ আজাদ, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪; Pakistan Obseroer, 14 October 1954.
৮০ আজাদ, ৮ এপ্রিল ১৯৫৫; Pakistan Obseroer, 7 April 1955.
———————————
৬২

এই ঘটনায় উসকানি দেওয়ার (কমপ্লিসিটি) অভিযােগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরাে দশ জনের বিরুদ্ধে অভিযােগপত্র দাখিল করা হয় ১৪ জুন ১৯৫৪ সােমবার। পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ৩২৬ ও ৩৯৫; সঙ্গে নিরাপত্তা অধ্যাদেশের ৭/৩ ধারায় তার বিরুদ্ধে অভিযােগ আনা হয়।
প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এ. রহমানের আদালতে তার বিচার শুরু হয়।(৮১)
এর আগে জেলগেট মামলায় ঢাকার এস.ডি.ও. (দক্ষিণ) বঙ্গবন্ধুর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। ১৮ জুন শুক্রবার জেলা দায়রা জজ আদালতে নতুন জামিন আবেদন দায়ের এবং ২৬ জুন শুনানির দিন ধার্য করা হয়।(৮২) ২৪ জুন পিটিশনের শুনানি হয়। পরদিন ২৫ জুন শুক্রবার আদেশ দেওয়ার কথা।(৮৩) ২৫ জুন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। (৮৪)
১২ জুলাই ১৯৫৪ তারিখে এক সরকারি আদেশে ১৬.৬.৫৪ তারিখে গ্রেফতারের দিন থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দুই মাসের আটকাদেশ প্রদান করা হয়। পরবর্তী আদেশ জারি না হলে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি আটক থাকবেন। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৫১, যা ইস্ট বেঙ্গল এক্সপায়ারিং ল’জ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪-এর মাধ্যমে প্রণয়ন ও কার্যকরী (কন্টিনিউড) রাখা হয়েছে, সেই আইনের ৪১(১) ধারা বলে। একই আইনের ৪১(২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আটকাদেশ জারি করেন গভর্নর। গভর্নরের পক্ষে আদেশটি জারি করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এম. এফ. বারি। (৮৫) ৩ আগস্ট তারিখের এক আদেশে পরবর্তী আদেশ পর্যন্ত আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানাে হয় এবং অক্টোবর ১৯৫৪-র মধ্যে মামলাটি রিভিউ করে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়। ২০ আগস্ট শেখ মুজিবকে এই আদেশ সার্ভ করা হয়।(৮৬)
৭ আগস্ট ১৯৫৪ শেখ মুজিবুর রহমান ও অপর দুজনকে ঢাকা সদর মহকুমা হাকিম নুরুদ্দিনের এজলাসে হাজির করা হয়। এ দিন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ফজলে রাব্বির আদালতে মামলাটি স্থানান্তর করা হয়।(৮৭) ৩১ আগস্ট অ্যাডভােকেট সালাম খান মামলার বিষয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদন জানালে তা মঞ্জুর করা হয়। (৮৮)
১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ বঙ্গবন্ধু আতাউর রহমান খান ও জহিরুদ্দীনের সঙ্গে মামলার বিষয়ে সাক্ষাতের আবেদন করেন এবং তা গৃহীত হয়।(৮৯) ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ বঙ্গবন্ধু গােপন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ক্ষতিকর ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ইত্যাদি অভিযােগসমূহ অস্বীকার করে তাঁর বয়ান (রিপ্রেজেন্টশন) পাঠান।(৯০) ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ বুধবার বিচারক ফজলে রাব্বির এজলাসে শেখ মুজিব, সিরাজউদ্দিন ও আবদুল হক ওরফে মােহাম্মদ মিঞাকে হাজির করা হয় এবং তাদের মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। অভিযুক্ত ১১ জনের মধ্যে ৭ জন পলাতক। দুজন পুলিশের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ১৩ অক্টোবর ১৯৫৪ পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি করা হয়।(৯১)
————————————
৮১. Pakistan Observer, 17 June 1954.
৮২. Pakistan Observer, 18 & 19 June, 1954.
৮৩. Pakistan Observer, 25 June 1954.
৮৪ মিল্লাত, ২৬.৬.৫৪, উদ্ধৃত, . Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 65-66|
৮৫. Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 59-60.
৮৬. Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 144-149.
৮৭ আজাদ, ৮ আগস্ট ১৯৫৪।
৮৮. Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 154.
৮৯. Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 156-157.
৯০. Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 144-149.
৯১ আজাদ, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪; Pakistan Observer, 14 October, 1954.
—————————————-
৬৩

১৩ অক্টোবর ১৯৫৪ ধার্য তারিখে শুনানি হয়নি। ২৫ নভেম্বর ১৯৫৪ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়।(৯২) ১৩ নভেম্বর ১৯৫৪ জেলা জজ এম. আহমদ তার জামিন মঞ্জুর করেন। তবে তিনি মুক্তি পাবেন না, কেননা জননিরাপত্তা অধ্যাদেশবলে তাঁর বিরুদ্ধে আটকাদেশ বহাল রয়েছে।(৯৩)
২৫ নভেম্বর পুনরায় শুনানি শুরু হয় প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। অন্য তিনজনকে ৫ টাকার ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবও জামিন লাভ করেন, তবে জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে আটক রাখা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৫৫ মামলার পরবর্তী শুনানি ধার্য হয়।(৯৪)
১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৫ বাবার অসুস্থতার জন্য তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে জেলগেটে অভ্যর্থনা জানান এবং ভিক্টোরিয়া পার্কমুখী এক শােভাযাত্রা করেন। এরপর তিনি বাবাকে দেখতে ফরিদপুরে রওয়ানা দেন।(৯৫) জেলগেট মামলায় ১১ জানুয়ারি ১৯৫৫ তারিখের শুনানিতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি করা হয়। ২৮ জন প্রসিকিউশন সাক্ষীর মধ্যে এ দিন পর্যন্ত ৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। (৯৬) ২ মার্চ আরও ৫ জন প্রসিকিউশন সাক্ষীর শুনানি হয়। ৩ মার্চ আরাে ৭ জন প্রসিকিউশন সাক্ষীর শুনানি হয়।(৯৭) নিম্ন আদালত থেকে শেখ মুজিবকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও ঢাকা শহরের বাইরে না যাওয়ার শর্তে জামিন প্রদান করা হয়। ৭ মার্চ দায়রা আদালত এসব শর্ত অন্যায়, বেআইনি ও নজিরবিহীন বলে শেখ মুজিবের জামিন বাতিল করে দেন।(৯৮)
জেলগেট মামলায় ১৯৫৫ সালের ৬ এপ্রিল চূড়ান্ত রায় প্রদান করা হয়। রায়ে শেখ মুজিব ও অন্য তিনজনকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়।(৯৯)

মামলা-৬
জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সম্পত্তি অর্জনের
অভিযােগ, ১৯৫৮
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। ১২ অক্টোবর ভােরে পূর্ব পাকিস্তান দুর্নীতি দমন ব্যুরাে ১৯৫৭ সালের দুর্নীতি দমন আইন ও ১৯৫৮ সালের
———————————–
৯২.আজাদ / Pakistan Observer 14 October, 1954.
৯৩ আজাদ, ১৪ নভেম্বর, ১৯৫৪।
৯৪ আজাদ, ২৬ নভেম্বর ১৯৫৪; Pakistan Observer, 26 November 1954.
৯৫. Secret Documents Volume 4 : 1954-57, p. 194;
৯৬. Pakistan Observer, 19 December 1954.
৯৭. Pakistan Observer, 12 January 1955.
৯৮. Pakistan Observer, 3 & 4 January, 1955.
৯৮ আজাদ, ৮ মার্চ, ১৯৫৫।
৯৯. আজাদ, ৮ এপ্রিল ১৯৫৫; Pakistan Obseroer, 7 April, 1955.
————————
৬৪

২নং অধ্যাদেশ অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানসহ আবুল মনসুর আহমদ, হামিদুল হক চৌধুরী, আবদুল খালেক, সদ্যলপ্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নুরুদ্দিন আহমেদ, প্রাক্তন পরিষদ সদস্য আবদুল হামিদ চৌধুরী, প্রাক্তন পরিষদ সদস্য ও চিফ হুইপ কোরবান আলী, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প বিভাগের সেক্রেটারি আসগর আলী শাহ (সিএসপি), পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এম. এ. জব্বার, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি আমিনুল এসলাম চৌধুরী (সিএসপি) প্রমুখকে গ্রেফতার করা হয়। ১২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকা সদর (দক্ষিণ) মহকুমা অফিসার জনাব এ. কবির ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের পৃথক পৃথকভাবে দাখিলকৃত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। তাঁদের জেলহাজতে পাঠানাে হয়। ২৪ অক্টোবর আদালতে হাজির করার পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়।(১০০)
১২ অক্টোবর ১৯৫৮ তারিখে আটককৃতদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সম্পদ অর্জনের অভিযােগে দুর্নীতি দমন আইনে গ্রেফতার দেখানাে হয়। পুলিশ দীর্ঘদিন পরে এজাহার দাখিল করলেও চার্জশিট দাখিল করেনি। ফলে, একের পর এক তারিখ পড়লেও মামলার নিয়মিত শুনানি হয়নি। এদের মধ্যে শেখ মুজিবসহ আরও দুইজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা ছাড়াও নিরাপত্তা অধ্যাদেশে আটকাদেশ জারি হওয়ায় দুর্নীতি মামলায় জামিন পেলেও নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে তাঁদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা হয়।(১০১)
২৭ মার্চ ঢাকার সদর মহকুমা হাকিমের কোর্টে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি দমন মামলার শুনানি শুরু হলে তার আইনজীবী জহিরউদ্দীন এক আবেদনপত্র দাখিল করেন। সেখানে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান দুর্নীতি দমন আইনের ৫(১) ধারায় দুর্নীতি দমন বিভাগ কোনাে মামলা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি বলে স্বীকার করায় বিবাদিকে মুক্তিপ্রদান এবং গ্রেফতারের সময় তাঁর বাজেয়াপ্তকৃত নগদ দুই হাজার টাকা ও অন্যান্য দ্রব্য প্রত্যার্পণ করা হোক। বিচারক এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন বিভাগের কাছে জরুরি রিপাের্ট চেয়েছেন এবং ৭ এপ্রিল চূড়ান্ত রায়ের তারিখ ঠিক করেন। ১২ অক্টোবর ১৯৫৮ তারিখে গ্রেফতার করার পর এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে কোনাে চার্জশিট দায়ের করেনি।(১০২)
দুর্নীতি দমন বিভাগ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৫৯ সালের ৭ জুন ঢাকা সদর দক্ষিণ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে নির্দোষ ঘােষণা করেন। তিনি রায়ে মন্তব্য করেন, দুর্নীতি দমন বিভাগ জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সম্পত্তি অর্জনের অভিযােগে পূর্ব পাকিস্তান দুর্নীতি দমন আইনের ৫(১) ধারায় অভিযােগ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হওয়ায় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৫৩(২) ধারা অনুযায়ী মামলা খারিজ ঘােষণাপূর্বক শেখ মুজিবকে নির্দোষ ঘােষণা করা হলাে।
এই মামলায় আদালত কর্তৃক নির্দোষ ঘােষিত হলেও তিনি জেল থেকে বের হতে পারেননি। কেননা জননিরাপত্তা অধ্যাদেশবলে তাঁকে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনের অধীনে জেলে আটক রাখা হয়েছে।(১০৩)
————————————
১০০ .আজাদ, ১৩ অক্টোবর, ১৯৫৮।
১০১. ইত্তেফাক, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯।
১০২.ইত্তেফাক, ২৮ মার্চ, ১৯৫৯।
১০৩ .সংবাদ, ৮ জুন, ১৯৫৯
————————————–
৬৫

মামলা-৭
চাকুরি প্রদানের মিথ্যা আশ্বাস, ১৯৫৯
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের আমলে দায়েরকৃত এটি দ্বিতীয় মামলা। মামলার অভিযােগ হলাে, ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৮ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত (যে সময়টি তিনি মন্ত্রী হিসেবে কর্তব্যরত) পাঁচ ব্যক্তির নিকট থেকে অর্থ গ্রহণ।
১৯৫৯ সালের ২ অক্টোবর প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট কে. এম. রহমানের আদালতে শেখ মুজিবুর রহমান ও অপর পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন বিভাগ কর্তৃক আনীত এই মামলার দ্বিতীয় দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন বারাে জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ১ অক্টোবর দুজন সরকারি সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। শেখ মুজিব ও অপর দুই আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। সরকারপক্ষে খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন ও অভিযুক্তর পক্ষে জনাব জহিরউদ্দীন মামলা পরিচালনা করেন।(১০৪)
২৮ অক্টোবর ও ২৪ নভেম্বর ১৯৫৯ একই আদালতে মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।(১০৫) বাদিপক্ষের কেঁৗসুলি খান বাহাদুর নাজিরউদ্দিন আহমদ প্রাপ্ত সাক্ষ্য ইত্যাদির ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র করার দায়ে চার্জ গঠনের জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানান। বিবাদিপক্ষের আইনজীবী জহিরউদ্দীন উক্ত আবেদনের বিরােধিতা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন বলে কোনাে প্রমাণ নেই। ১০ ডিসেম্বর পুনরায় শুনানির দিন ধার্য করা হয়।(১০৬)
১০ ডিসেম্বর বিচারক উপযুক্ত প্রমাণাভাবে দণ্ডবিধি আইনের ৪২০ ও ১২০খ [ও ৩৪] [ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা] ধারা মােতাবেক আনীত এই মামলা থেকে শেখ মুজিবকে অব্যাহতি প্রদান করেন।(১০৭)

মামলা-৮
ক্যালেন্ডারিং শিল্প মামলা, ১৯৫৯
১৯৫৯ সালের ১১ নভেম্বর (সােমবার) ঢাকা সদর (দক্ষিণ) মহকুমা হাকিমের আদালতে দুর্নীতি দমন ব্যুারাে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ছােট ভাই শেখ আবু নাসেরের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনের ৫(২) ধারা ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা অনুযায়ী দুর্নীতির অভিযােগে এই মামলাটি দায়ের করেন।(১০৮)

————————————————–
১০৪. ইত্তেহাদ, ৩ অক্টোবর, ১৯৫৯।
১০৫. ইত্তেফাক, ২৯ অক্টোবর, ১৯৫৯।
১০৬.সংবাদ, ২৬ নভেম্বর, ১৯৫৯।
১০৭. ইত্তেফাক, ১১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯।
১০৮. সংবাদ, ২৬ এপ্রিল, ১৯৬০।
————————————————–
৬৬

অভিযােগের বিবরণে বলা হয়, ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনকল্পে শিল্প বিভাগের ডিরেক্টর দরখাস্ত আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেন। সেই অনুযায়ী আল আমিন ইন্ডাস্ট্রিজ-এর জনৈক মুজিবুর রহমান ও অপর তিনজন অংশীদার টাঙ্গাইল থানার সীতাহাটিতে একটি ক্যালেন্ডারিং শিল্প স্থাপনের লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স না পেয়ে তারা শেখ মুজিবের ভাই শেখ আবু নাসেরের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। আবু নাসের তাদের বলেন, যদি বিনা মূলধনে তাকে তিন আনা শেয়ার দেওয়া হয় তাহলে লাইসেন্স বরাদ্দ করা হবে। তদনুসারে একটি দলিল সম্পাদন করা হয়। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প বিভাগের ডিরেক্টরের সুপারিশ গ্রহণ করে ১৯৫৭ সালের ৩ জুন উক্ত শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে উক্ত কোম্পানিকে ২ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকার আমদানি লাইসেন্স মঞ্জুর করেন। অভিযােগের বিবরণে আরাে বলা হয়, এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদাররা শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের জন্য তার ভাই আবু নাসের মারফত ১৫০০ টাকা দেন।(১০৯) এভাবে শেখ মুজিব ও তার ভাই শেখ নাসের আর্থিক সুবিধা লাভ করেন এবং সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন।(১১০)
১৯৬০ সালের ২৫ মে (বুধবার) এই মামলার শুনানি শেষ হয়। এ দিন সরকারপক্ষের কৌঁসুলির সওয়ালজওয়াবের উত্তরে বিবাদিপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার সওয়াল-জওয়াব শুরু করেন।

মামলার পটভূমি
জনাব সােহরাওয়ার্দী সওয়াল-জওয়াব প্রসঙ্গে এই মামলার পটভূমিও বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। সামরিক আইন প্রবর্তনের যৌক্তিকতা হিসেবে প্রাক্তন রাজনীতিকদের উপর যাবতীয় দোষারােপ করা হয় এবং এমন সব বিবৃতি ও বক্তৃতা চলতে থাকে যে, রাজনীতিকগণ যেন সকলেই অপরাধী। এই রাজনীতিকদের অপদস্থ করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়। অর্ডিন্যান্সবলে দুর্নীতি দমন আইন সংশােধন, নিরাপত্তা আইন সংশােধন, এবডাে আদেশ জারি এবং সম্ভাব্য অন্যান্য সকল প্রকার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। জনাব মুজিবুর রহমানও একজন বড় রাজনীতিবিদ। তিনি তৎকালীন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ছিলেন। অতএব একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক হিসেবে তিনি যাবতীয় নির্যাতনমূলক আইনের শিকারে পরিণত হন। সামরিক আইন প্রবর্তনের ৩/৪ দিন পরে অর্থাৎ ১১ অক্টোবর ৭২ নং অর্ডিন্যান্স জারি ও পরদিন তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানাে হয়। জেলখানায় থাকতেই তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে বর্তমান মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমান মামলা ছাড়া উপরােক্ত সব কটি অভিযােগ থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেছেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে আটকের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই সরকারকে মুজিবের বিরুদ্ধে এই মামলা করতে হয়েছে।(১১১)
সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, এই মামলার তদন্ত ১৯৫৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলে। কোনাে প্রকার তথ্য, অভিযােগ, কোনাে কাগজপত্র বা এজাহার ছাড়াই সরকার মামলা দায়ের করেছে। জেলের মধ্যে আটক রাখার উদ্দেশ্যে জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এমতাবস্থায় সরকারের পক্ষে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করে উপায় ছিল না।(১১২)
———————————-
১০৯. আজাদ, ২৬ এপ্রিল, ১৯৬০।
১১০. সংবাদ, ২৬ এপ্রিল, ১৯৬০।
১১১. ইত্তেফাক, ২৬ মে, ১৯৬০।
১১২.ইত্তেফাক, ২৬ মে, ১৯৬০।
—————————-
৬৭

আনীত সকল অভিযােগ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে শেখ মুজিব বলেন, আল আমীন ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সঙ্গে তাঁর কোনাে সম্পর্ক ছিল না। তিনি কোনাে প্রকার দলিল সম্পাদন সম্পর্কেও কিছু জানতেন না। মন্ত্রী থাকাকালে নিজের বা তাঁর ভাই বা অন্য কারাে জন্য কোনাে প্রকার আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেননি। তিনি আরও বলেন, “মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। জনসাধারণের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একটার পর একটা মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে। আমি যতদিন মন্ত্রী ছিলাম, কোনােদিন আমি আমার ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি। জনসাধারণের খেদমত ও কাজ করবার উদ্দেশ্যে নিয়াই আমি দেশের জন্য কাজ করিয়াছি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইয়া সকলকে খুশী করা যায় না এবং কাহারও পক্ষে উহা সম্ভবপর নহে।” তিনি আরও বলেন, আমরা যারা পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ছিলাম- যখনই আমরা পূর্ববাংলার প্রতি ন্যায়বিচার করার কথা বলেছি, তাদের ছলে-বলে-কৌশলে ও ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলায় আসামি করে জনসাধারণের কাছে ছছাট করার চেষ্টা করা হইয়াছে। আমরা যা করেছি দেশের মঙ্গলের জন্যই করেছি।(১১৩)

স্পেশাল জজের রায়
৩১ মে ১৯৬০ (মঙ্গলবার) ঢাকা বিভাগের স্পেশাল জজ এ. এস. এম. রাশেদ এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রী হিসেবে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বীয় মর্যাদাবলে আর্থিক সুবিধা অর্জনের অভিযােগ এবং শেখ আবু নাসেরকে এসব কাজে শেখ মুজিবকে সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা (অ্যাবেট) করার অভিযােগ থেকে নির্দোষ ঘােষণাপূর্বক খালাস প্রদান করেন।(১১৪) তবে এই মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্যের দায়ে দুজনকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ১২ জুলাই (মঙ্গলবার) শেখ মুজিব ও তার ভাই শেখ নাসেরের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি ও দুর্নীতিতে সহায়তা করার মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এই মামলার অন্যতম সাক্ষী আনােয়ার আলী ও মুজিবুর রহমান চৌধুরীকে যথাক্রমে ৪ বছর ও ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।(১১৫)

মামলা-৯
কোল মাইনিং কারখানা মামলা, ১৯৬০
অভিযােগের বিবরণে বলা হয়, ১৯৫৫ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার মেসার্স হাসান আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানিকে ভারত থেকে প্রতি মাসে তিন হাজার টন সফট কোক [জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কয়লা] সংগ্রহের জন্য এজেন্ট নিয়ােগ করা হয়। উক্ত ফার্ম সরকারের সঙ্গে কমিশনের ভিত্তিতে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। প্রাদেশিক বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প দফতরের মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বিভাগীয় সেক্রেটারির আপত্তি অগ্রাহ্য করে উক্ত এজেন্সি বাতিল

———————————-
১১৩.ইত্তেফাক, ২৬ মে, ১৯৬০।
১১৪ .টাইপ করা ২৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায়টি ছাপা হয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়। দ্র. ২ জুন, ১৯৬০।
১১৫. আজাদ, ১৩ জুলাই, ১৯৬০।
—————————-
৬৮

করেন এবং কোনাে টেন্ডার গ্রহণ না করে নতুন একটি কোম্পানি নারায়ণগঞ্জের মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড কোম্পানিকে ভারত থেকে সফট কোক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কয়লা] আনয়নের জন্য নিয়ােগ করেন। তাই, সাবেক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাঁর পদমর্যাদার অপব্যবহার করে কাজী আবু নসর ও অপর কয়েকজন ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধাপ্রদান পূর্বক মুনাফা করার সুযােগ দিয়ে ফৌজদারি অসদাচরণ সংঘটন করেছেন। আসামি কাজী আবু নসরকে উক্ত অপরাধ অনুষ্ঠানে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়।(১১৬)
২২ আগস্ট, ১৯৬০ তারিখে জেলা ও দায়রা জজ (এবং পদাধিকারবলে স্পেশাল জজ) জনাব এ. মওদুদের আদালতে প্রাক্তন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী আবু নসরের বিরুদ্ধে যথাক্রমে আনীত অসদাচরণ ও তাতে সহায়তা করার অভিযােগে করা মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ২৭ আগস্ট শুনানি সম্পন্ন হয়। এ দিন। সরকারপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়। মােট ছয় দিনে সরকারপক্ষের ১৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় (২৮ ও ২৯ আগস্ট, ১৯৬০)। ২৮ আগস্ট (রবিবার) মামলার শুনানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এ দিন সরকারি ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবের আইনজীবী সােহরাওয়ার্দীর আবেদনক্রমে সকাল ১০টা থেকে প্রায় নয় ঘণ্টা যাবৎ আদালতের অধিবেশন চলে। জনাব সােহরাওয়ার্দীর জরুরি একটি কাজ উপলক্ষে বিমানযােগে করাচি পৌছার সুযােগ দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় (সংবাদ, ২৯ আগস্ট, ১৯৬০)। দুজন অভিযুক্তই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।

স্পেশাল জজের রায়
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ জেলা ও সেশন জজ (এবং পদাধিকারবলে সিনিয়র স্পেশাল জজ) জনাব আবদুল মওদুদ অসদাচরণ ও তাতে সহায়তার অভিযােগে যথাক্রমে সাবেক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও কোল মাইনিং কোম্পানির ম্যানেজিং এজেন্ট কাজী আবু নসরকে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরাে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। হাইকোর্টে আপিল সাপেক্ষে অভিযুক্ত উভয়ের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে।

মামলা-১০
কোল মাইনিং কারখানা মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল, ১৯৬০
৭ নভেম্বর, ১৯৬০ (সােমবার) ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি মাের্শেদ ও বিচারপতি ইদ্রিসের বেঞ্চে সাবেক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী আবু নাসেরের আপিল আবেদন শুনানির জন্য উত্থাপিত হয়। বেঞ্চ এই আবেদনের
———————————–
১১৬. ত্সংবাদ, ২৩ আগস্ট ১৯৬০।
—————————
৬৯

শুনানি পরবর্তী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতুবি করেন। তবে তাঁরা আবেদনকারীদ্বয়কে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিনাদেশ প্রদান করেন।(১১৭)
আপিল আবেদনে শেখ মুজিব বলেন, তিনি যা করেছেন ন্যায়বিচার ও দেশের স্বার্থে করেছেন। তার পক্ষে বিচারপতিদের সামনে যেসব ল পয়েন্ট উত্থাপন করা হয়েছিল সেগুলাে হলাে :
(১) পাকিস্তান দণ্ডবিধির ২১ ধারার ৯ উপধারা অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কর্মচারী নন;
(২) শেখ মুজিব প্রদেশের গভর্নর কর্তৃক মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের মঞ্জুরি (স্যাংশন) কেবল গভর্নরের কাছ থেকেই নিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে মঞ্জুরি গভর্নর দেননি, ফলে মামলাটি অচল ও অকার্যকর।
(৩) একজন মন্ত্রী গভর্নরের উপদেষ্টা এবং জনপ্রতিনিধি ও তাঁর দফতরের প্রধান হিসেবে দেশের মানুষের কল্যাণার্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকেন। যদি কোনাে মন্ত্রী সেক্রেটারির আপত্তি অগ্রাহ্য করে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন তবে তা করার অধিকার মন্ত্রীর রয়েছে। তাই তিনি যা করেছেন, তা করার অধিকার তার ছিল এবং সেই ব্যাপারে প্রশ্ন তােলা যায় না।
(৪) আপিলকারীদের বিরুদ্ধে যে অভিযােগসমূহের বিষয়ে চার্জ গঠন করা হয়েছে তা কখনই ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনের আওতায় পড়ে না।(১১৮)

শেখ মুজিবের পক্ষে উত্থাপিত আবেদনে পয়েন্ট অব ফ্যাক্টসের মধ্যে রয়েছে :
(১) কাজী আবু নসর কখনােই তাঁর বন্ধু ছিলেন না এবং কোনাে বিশ্বাসযােগ্য প্রমাণ ছাড়া কেউ কারাে বন্ধু এটা বলা খুবই অন্যায়;
(২) মেসার্স কোল মাইনিং কোম্পানি সর্বনিম্ন টেন্ডারার হলেও মেসার্স হাসান আহমেদ লি. অবৈধভাবে এজেন্সি পেয়েছেন। তাছাড়া, মেসার্স হাসান আহমেদ-এর বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল। ফলে, শেখ মুজিবুর রহমান। মন্ত্রী হয়ে আসার পর অবৈধ এজেন্সি বাতিল করেন এবং বিধি অনুযায়ী সর্বনিম্ন টেন্ডারার মেসার্স কোল মাইনিংকে এজেন্সি মঞ্জুর করেন;
(৩) মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব অবৈধ এক সিদ্ধান্তকে সংশােধন (রেগুলারাইজ) করেছেন মাত্র। নতুন টেন্ডার আহ্বানের বিষয়টি আসেনি, কারণ সকল টেন্ডার তার সামনে ছিল এবং তিনি সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারীকে এজেন্সি দিয়েছেন। তাছাড়া, এটা ছিল মৌসুমের মাঝামাঝি সময়। ফলে, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য ছিল;
(৪) দর্শনায় কোকিং কারখানা এবং ভারত থেকে কয়লা আমদানির ব্যাপারে বলা হয় যে, এটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় এবং বিভাগীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ সিদ্ধান্ত এসেছে এবং তা অনুমােদন করে কেবল তিনি মন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্বই পালন করেছেন। এই ব্যাপারে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছুই জানেন না। ফলে, দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিব মন্ত্রী হিসেবে যা করেছেন তা সদুদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে, কোনাে ভয় বা সুবিধার (ফেভার) তােয়াক্কা না করে, দেশ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে করেছেন। সুতরাং ফৌজদারি অসদাচরণ ও তাতে অপর আপিলকারীর সহযােগিতার প্রসঙ্গ অবান্তর।
———————————–
১১৭. মর্নিং নিউজ, ৮ নভেম্বর, ১৯৬০।
১১৮ .অবজারভার, ১০ নভেম্বর, ১৯৬০।
————————————
৭০

রায়
৫ জুলাই ১৯৬১ বিচারপতি এম. আসির ও বিচারপতি আলীর ডিভিশন বেঞ্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী আবু নসরকে যথাক্রমে ফৌজদারি অসদাচরণ (অপরাধমূলক অসদাচরণ) ও তাতে সহায়তা করার অভিযােগে নিম আদালত কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাদেশ থেকে বেকসুর খালাস প্রদান ও নির্দোষ ঘােষণা করেন।(১১৯)

সরকার কর্তৃক সুপ্রীম কোর্টে আপিল
২৪ জানুয়ারি, ১৯৬২ সরকার ঢাকা হাইকোর্টের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করলে সুপ্রীম কোর্ট সেই আবেদন বাতিল ঘােষণা করেন। বিচারপতি এস. এ. রহমান ও বিচারপতি ফজলে আকবরকে নিয়ে গঠিত সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ (যার ঢাকা সেশন অনুষ্ঠিত হয় পুরনাে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অডিটোরিয়ামে (অডিটোরিয়ামটি বর্তমানে বিলুপ্ত]) সরকারপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শ্রবণ করেন।(১২০)

মামলা-১১
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৩ পল্টন ময়দানে বক্তৃতার বিরুদ্ধে
ঢাকার পুলিশ সুপার ১৯৬৪ সালের ১৯ মে তারিখে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের (এডিসি) কোর্টে একটি অভিযােগ দাখিল করেন। অভিযােগের সারমর্ম হলাে, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে (পল্টন ময়দান নামে অধিক পরিচিত) হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে আয়ােজিত শােকসভায় আপত্তিকর বক্তৃতাদান করেছেন। এ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সরকারের প্রতি আস্থাহীন, বিমুখ ও উত্তেজিত করার মাধ্যমে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। ফলে, তিনি ১৯৫৮ সালের পূর্ব পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের ৭(২) ধারা ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তিনি দেশদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত। এই অভিযােগে ৩১ মে ১৯৬৪ তাঁকে ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরের দিন ২০০০ টাকা বন্ডে তিনি জামিন লাভ করেন। মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৮ জুন, ১৯৬৪। উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে প্রথম ছয় মাসে এটি তাঁর বিরুদ্ধে তৃতীয় মামলা।। তাঁর বক্তৃতার যে অংশটি আপত্তিকর বলে সরকার অভিযােগ করে সেটির অংশ হলাে :
———————————-
১১৯. আজাদ/সংবাদ/মর্নিং নিউজ, ৬ জুলাই, ১৯৬১।
১২০. সংবাদ, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৬২।
————————————-
৭১

সরকার মনে করে] তিনি নিম্নলিখিত কথা বলিয়া শ্রোতাদের উত্তেজিত করেন :
“আমি জানি না, জনাব সােহরাওয়ার্দী মারা গিয়াছেন কিনা! কিন্তু আমি মনে করি, আমার নেতাকে হত্যা করা হইয়াছে। বৃদ্ধ বয়সে জেলে পুরিয়া আমার নেতাকে হত্যা করা হইয়াছে…।
আমার বাঙ্গালী ভাইরা, ঐক্যবদ্ধ হউন এবং ইহার প্রতিশােধ নিন..গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ন…যাহারা আমাদের নেতাকে হত্যা করিয়াছে তাহাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশােধ গ্রহণ করিতে হইবে।…হায় বাঙ্গালী। ঐক্যবদ্ধ হইয়া আমার নেতার মৃত্যুর প্রতিশােধ না লইলে আমি আপনাদের বিশ্বাসঘাতক ও অকতজ্ঞ বলিব। অত্যাচারীদের হাত হইতে জনসাধারণের হাতে আবার ক্ষমতা ফিরিয়া আসিলে তাহার বিচার করা হইবে।(১২১)
১৯৬৫ সালের ৫ জুন এ মামলার আরেকটি তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু এর আগে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে আহত হন বলে বঙ্গবন্ধু সেদিন আদালতে হাজিরা দিতে পারেননি। এজন্য আদালত তার জামিন বাতিলপূর্বক গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করেন। ১৯৬৫ সালের ৮ জুন মঙ্গলবার হাজিরা দেওয়ার পর এডিসি শেখ মুজিবুর রহমানকে পুনর্বার দুই হাজার টাকা বন্ডে দুজন জামিনদারের জিম্মায় জামিন প্রদান করেন।
৮ জুলাই, ১৯৬৫ বৃহস্পতিবার সরকারপক্ষের জবানবন্দি শেষে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার এম.বি. আলম শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযােগ গঠন করেন।
২৯ ডিসেম্বর, ১৯৬৫ বুধবার এই মামলার সওয়াল-জবাব সমাপ্ত হয়। পাবলিক প্রসিকিউটর সরকারপক্ষে সওয়াল -জবাব শুরু করেন। তিনি শেখ মুজিবের বক্তৃতার আপত্তিকর অংশটুকু আদালতে পেশ করেন। তিনি বলেন যে, সরকারবিরােধী এইসব উক্তি আইনত দণ্ডনীয়।
শেখ মুজিবের আইনজীবী তাঁর আরগুমেন্টের সময় বলেন,
“মরহুম জননেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন। তাঁহারই নেতৃত্বের দরুন একমাত্র বাংলাদেশেই পাকিস্তান ইস্যুর উপর মুসলিম লীগ বিপুল ভােটাধিক্যে জয়লাভ করিয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হয়। অথচ পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতীক মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীকেই বৃদ্ধ বয়সে বিনা বিচারে কারাভােগ করিতে হয়। ফলে তাঁহার স্বাস্থ্যের দারুণ অবনতি ঘটে, স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি বিদেশে যান এবং সেখানে মারা যান। শেখ মুজিবুর রহমান এই মহান নেতার ২০ বৎসর যাবৎ বিশ্বস্ত সহচর ও প্রিয়পাত্র ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি [শেখ মুজিব] তাঁহার বক্তৃতায় যাহা কিছু বলিয়াছেন উহা নেতার মৃত্যুতে শােকাভিভূত ভক্তের আবেগপূর্ণ আক্ষেপের বহিঃপ্রকাশমাত্র। উহা শুনিয়া শ্রোতারা শােকাভিভূত হইয়াছেন মাত্র, তাহাদের মনে অন্য কোনাে ভাব জাগে নাই।”(১২২)

রায়
৪ জানুয়ারি, ১৯৬৬ এই মামলার রায় প্রদানের তারিখ ঘােষিত হয়।(১২৩) এ দিন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ১০ জানুয়ারি, ১৯৬৬ পর্যন্ত রায় প্রদান মুলতুবি করেন,(১২৪) কিন্তু সেদিনও রায় প্রদান করা হয়নি। ২৮ জানুয়ারি, ১৯৬৬ রায়ের পরবর্তী তারিখ বলে ঘােষণা দেওয়া হয়।(১২৫)
————————————————
১২১. ইত্তেফাক ১৪ জুন, ১৯৬৪।
১২২..ইত্তেফাক, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৬৫।
১২৩. ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি, ১৯৬৬।
১২৪. ডন, ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৬।
১২৫. ইত্তেফাক, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৬৬।
—————————————
৭২

২৮ জানুয়ারি, ১৯৬৬ (শুক্রবার) বেলা ১১.৩০ মিনিটে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ মামলায় ২৭ পৃষ্ঠার রায় ঘােষণা করেন। তিনি শেখ মুজিবকে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ক ও পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ-এর ৭(৩) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ১ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এ মামলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দুটি ধারায় অভিযােগ আনা হয়েছিল। আনীত দুটি অভিযােগেই তাঁকে এক বছর করে মােট দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ের পর শেখ মুজিবের আইনজীবী অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন করলে ম্যাজিস্ট্রেট তা না-মঞ্জুর করেন।

হাইকোর্টে জামিন আবেদন মঞ্জুর ও মুক্তি
২৮ জানুয়ারি, ১৯৬৬ (শুক্রবার) মধ্যাহ্ন বিরতির পর শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন পেশ করা হয়। আবেদনে বলা হয়, যেহেতু শেখ মুজিব উক্ত রায়ের সার্টিফাইড কপি পাননি এবং তাতে কয়েক দিন সময় লাগবে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা পর্যন্ত শেখ মুজিবকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হােক। ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব তালুকদার এই আবেদন মঞ্জুর করেন। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জামিন নামঞ্জুর করার পর শেখ মুজিবকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল এবং হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে অপরাহ্নে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা পুষ্পস্তবকে ভূষিত করেন।(১২৬)

মামলা-১২
মামলা-১১ বা ১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ পল্টন ময়দানে। বক্তৃতার মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন
উল্লেখ্য যে, ১১ নম্বর মামলাটি এডিসির আদালত থেকে বদলি করে অন্য কোনাে আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট ১৯৬৪ হাইকোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন।
হাইকোর্টের আবেদনে তিনি বলেন, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ধারণা করেন যে, জনাব এম. বি. আলমের (এডিসি) কোর্টে সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজেই তাঁর মামলাটির অন্য কোনাে কোর্টে বিচার হওয়া উচিত। হাইকোর্ট প্রাথমিক শুনানির পর সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। ৫ মে, ১৯৬৫ তারিখে হাইকোর্ট তার রায়ে এই মামলা স্থানান্তরের আবেদন নাকচ করেন।(১২৭)
——————————–
১২৬. ইত্তেফাক/আজাদ/পাকিস্তান অবজারভার/ডন/ দৈনিক পাকিস্তান/সংবাদ/দৈনিক পয়গাম, ২৯ জানুয়ারি, ১৯৬৬।
১২৭. আজাদ, ৬ মে ১৯৬৫।
———————————
৭৩

মামলা-১৩
লিফলেট মামলা, ১৯৬৪

একটি প্রচারপত্রকে (লিফলেট) কেন্দ্র করে এই মামলা দায়ের করা হয়। অভিযােগের বিবরণে প্রকাশ, জানুয়ারি (১৯৬৪) মাসে প্রাদেশিক গভর্নর মােনেম খান সাভারে দাঙ্গাদুর্গত শিবির পরিদর্শন করে যখন ঢাকা ফিরছিলেন, তখন সাভারগামী একটি জিপ থেকে তার গাড়ির ওপরে এক বান্ডিল প্রচারপত্র নিক্ষিপ্ত হয়। উক্ত বান্ডিল গভর্নরের গাড়ির কাচে আঘাত করে এবং তার জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। জিপখানি শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান এবং জনাব শামসুল ইসলামের দুটি প্রাইভেট গাড়ির পিছনে পিছনে সাভার যাচ্ছিল।
পুলিশ ঘটনা তদন্তের পর শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, জনাব শামসুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব নূরুল ইসলাম, জনাব শফিউল ইসলাম এবং জনাব মনসুর আলীর বিরুদ্ধে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারার অপরাধ অনুষ্ঠান ও অনুষ্ঠানে সহায়তার অভিযােগে চার্জশিট দাখিল করে।(১২৮ )
১২ আগস্ট, ১৯৬৪ এই মামলায় বঙ্গবন্ধু পুনরায় জামিন লাভ করেন। আগেও তিনি জামিন পেয়েছিলেন, কিন্তু সর্বশেষ ধার্য তারিখে (৩ আগস্ট, ১৯৬৪) তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সফররত ছিলেন বিধায় কোর্টে হাজির হতে পারেননি। ফলে তার জামিন বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।(১২৯)
২৬ মে, ১৯৬৬ এই মামলার তারিখ ধার্য থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে আদালতে হাজির করা হয়নি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ সময় তাঁকে হঠাৎ আদালতে হাজির করা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে তার মুক্তির দাবিতে সারা দেশে যে প্রবল আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, এই জনপ্রিয়তা দেখে কর্তৃপক্ষ ভয় পেয়ে গেছে। এটি একটি কারণ হতে পারে।(১৩০)
——————————–
১২৮. ইত্তেফাক, ২২ মার্চ, ১৯৬৪।
১২৯. ইত্তেফাক, ১৩ আগস্ট, ১৯৬৪।
১৩০. ইত্তেফাক, ২৬ মে, ১৯৬৬।
—————————————-
৭৪

মামলা-১৪
হাইকোর্টে লিফলেট মামলা কোয়াশের আবেদন, ১৯৬৪
শেখ মুজিব লিফলেট মামলাটি কোয়াশের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। হাইকোর্ট (বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বেঞ্চ) এই মামলার কার্যক্রম কেন বাতিল বা কোয়াশ করা হবে না। এর কারণ দর্শানাের জন্য ঢাকার ডিসির প্রতি রুল জারি করেছিলেন।(১৩১)
পরবর্তীকালে হাইকোর্ট কর্তৃক মামলা কোয়াশের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। এরপর শেখ মুজিব এই মামলাটি ট্রায়ালের জন্য অন্য একটি আদালতে বদলির নির্দেশ প্রদানের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের সারমর্ম ছিল: বর্তমানে ঢাকার সাবডিভিশনাল অফিসারের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। কিন্তু তিনি আশঙ্কা করেন যে, এই আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন না। তাই মামলটি যেন একটি উপযুক্ত মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি করা হয়। ঢাকা হাইকোর্ট (বিচারপতি বাকের ও বিচারপতি সােবহান চৌধুরীর বেঞ্চ) শেখ মুজিব কর্তৃক আদালত পরিবর্তনের এই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন।(১৩২)

মামলা-১৫
‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও মামলা, ১৯৬৪(১৩৩)
১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
ভারত শাসনাধীন কাশ্মীরের একটি মসজিদে সংরক্ষিত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথিত চুল চুরি হওয়াকে কেন্দ্র করে সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কাশ্মীরের মুসলমানরা হরতাল আহ্বান করে এবং কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমে হিন্দু-মুসলমান, পরে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা শুরু হয়।(১৩৪)
১৯৬৪ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ঢাকা, আদমজী ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে পেশাদার গুণ্ডাবাহিনীর নেতৃত্বে বীভৎস বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় শত শত মানুষ নিহত হয়। ১০ জানুয়ারি তা প্রচণ্ড রূপ লাভ করে। ১৫ জানুয়ারি দাঙ্গাবিধ্বস্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে বাঁচাতে গিয়ে নবাবপুর রেলক্রসিংয়ের সামনে নিহত
—————————————–
১৩১. আজাদ, ২৩ জুন, ১৯৬৪।
১৩২. Pakistan Obseroer, 8th May 1965.
১৩৩. প্রচারপত্রটি গভর্নরের গাড়ির দিকে ছুড়ে মারার অভিযােগে পুলিশ একটি মামলা দায়ের করেছিল, আমরা সেটির নাম দিয়েছি “লিফলেট মামলা (মামলা-১৩)। আর ওই লিফলেট বা প্রচারপত্রে কারও স্বাক্ষর নেই বিধায় পুলিশ আরেকটি নতুন মামলা দায়ের করে। বর্তমান মামলাটি সেই মামলা। আমাদের হিসেবে মামলা নং-১৫।
১৩৪. হারুন-অর-রশিদ, আমাদের বাচার দাবি, ৬ দফা’র ৫০ বছর, বাংলা একাডেমি, ২০১৬, পৃ. ২১।
———————————————-
৭৫

হন কবি আমির হােসেন চৌধুরী। ১৬ জানুয়ারি বিহারিদের আক্রমণে নিহত হন নটরডেম কলেজের অধ্যাপক জেমস নােভাক। মােহাম্মদপুরে অবস্থানরত বিহারিরা ওই এলাকায় অবস্থিত ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের ছাত্রী হােস্টেলে হামলা চালায়।(১৩৫)
এরকম পরিস্থিতিতে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার সভাপতিত্বে এক সভায় মিলিত হন ঢাকার আইয়ুববিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। সভায় একটি দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠিত হয় এবং একটি ইশতেহার রচনা ও প্রকাশ করা হয়। ১৭ জানুয়ারি ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শীর্ষক এই ইশতেহার প্রকাশিত হয়। ইশতেহারটি প্রচারপত্র হিসেবেও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করা হয়।(১৩৬)
প্রচারপত্রটি (১৩৭) নিম্নরূপ :

পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও
সাম্প্রদায়িক দুবৃত্তদের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানের শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকের ছুরি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুবৃত্তদের হামলায় ঢাকার প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পােড়ান হইতেছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে, এমনকি জনাব আমির হােসেন চৌধুরীর মতাে শান্তিকামী মানুষদেরও দুবৃত্তদের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন। গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রীনিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বােনের সম্ভ্রম আজ মুষ্টিমেয় গুণ্ডার কলুষ স্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে।
এই সর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি, আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের রুখিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি।।
পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের ওপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ব বাংলার মানুষকে আহ্বান জানাইতেছি।
• প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করুন,
• গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নিমূল করুন,
. পূর্ব পাকিস্তানের মা-বােনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করুন।
—————————————-
১৩৫ .মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০-১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, ২০১৩, পৃ. ৮৫।
১৩৬. পূর্বোক্ত, মােহাম্মদ হাননান, পৃ. ৮৫-৮৬।
১৩৭ .ইত্তেফাক, ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৪; উদ্ধৃত, হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, খণ্ড ২, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পুনর্মুদ্রণ ২০০৯, পৃ. ২২৫।
———————————————
৭৬

মামলা দায়ের
দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান
১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটির পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামের প্রচারপত্র প্রকাশ করায় ১৯৬৪ সালের ১৭ জানুয়ারি রমনা পুলিশ দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটির বারাে সদস্যের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করে।(১৩৮)
এই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, আইন কলেজের অধ্যক্ষ ড. আলিম আল রাজী, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন, সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান, এনডিএফ নেতা মাহমুদ আলী, জাতীয় পরিষদ সদস্য মাহবুবুল হক, এনডিএফ নেতা অলি আহাদ, জনাব আলী আকসাদ (সহকারী সম্পাদক, ইত্তেফাক), ছাত্রনেতা ওবায়দুর রহমান, প্রমুখ।(১৩৯)
মামলার আসামিদের মধ্যে কয়েকজন শারীরিক অসুস্থতাবশত ৫ জানুয়ারি, ১৯৬৫ আদালতে হাজির হতে না পারায় ঢাকার সদর মহকুমা হাকিম (দক্ষিণ) উক্ত মামলার পরবর্তী তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ধার্য করেছিলেন।(১৪০)
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ বৃহস্পতিবার বেআইনি প্রচারপত্র মামলায় আসামিদের প্রত্যেককে ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আফসারউদ্দীন আহমদ ৫ হাজার টাকার বন্ডে ও একজন করে জামিনদারের জিম্মায় মুক্তিদান করেন। এর আগে বুধবার ঢাকার সদর মহকুমা হাকিম (দক্ষিণ) মামলাটি জনাব আফসারউদ্দীনের এজলাসে স্থানান্তরিত করেন। ২৬ মার্চ পরবর্তী তারিখ ধার্য হয়েছিল।(১৪১)
১ জুলাই, ১৯৬৫ বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রথম মুন্সেফ কোর্টে লিফলেট’ মামলার পরবর্তী শুনানি শুরু হয়। আদালত প্রত্যেককে এক হাজার টাকার বন্ডে জামিন প্রদান করেন। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা হাইকোর্ট এস.ডি.ওর কোর্ট থেকে মামলাটি অন্য আদালতে বদলির নির্দেশ দেন।(১৪২)
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ বুধবার ১৯৬৪ সালে দায়েরকৃত সাভারে গভর্নরের প্রতি প্রচারপত্র নিক্ষেপ’ মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।(১৪৩)
১১ নভেম্বর ১৯৬৫ ঢাকার প্রথম শ্রেণির মুন্সেফ ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হকের কোর্টে শেখ মুজিব ও আরাে সাত জনের বিরুদ্ধে আনীত লিফলেট মামলার শুনানি ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতুবি রাখা হয়।(১৪৪)
৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ বুধবার ঢাকার অন্যতম প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আফসারউদ্দীনের কোর্টে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই মামলার শুনানি মুলতুবি করা হয়।(১৪৫) ২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার একই কোর্টে পরবর্তী শুনানির জন্য মুলতুবি করা হয়।(১৪৬)
———————————————-
১৩৮. ইত্তেফাক/সংবাদ, ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৫।
১৩৯. ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
১৪০. ইত্তেফাক/সংবাদ, ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৫।
১৪১. ইত্তেফাক, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫।
১৪২. আজাদ, ৩ জুলাই, ১৯৬৫।
১৪৩. ইত্তেফাক, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।
১৪৪. ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর, ১৯৬৫।
১৪৫. ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
১৪৬. ইত্তেফাক, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
—————————————-
৭৭

২৫ মে, ১৯৬৬ বুধবার এই মামলায় বঙ্গবন্ধুর হাজিরা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ততদিনে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকার মুন্সেফ ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হকের আদালতে তাঁর হাজির হওয়ার কথা ছিল। তাঁর পক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। এদিন তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি।(১৪৭)
১৫ জানুয়ারি, ১৯৬৭ তারিখে এক খবরে দেখা যায়, প্রচারপত্র মামলার শুনানি ২৫ মার্চ পর্যন্ত মুলতুবি রাখা হয়েছে।(১৪৮)
এই মামলার হয়রানি পাঁচ বছর ধরে পােহাতে হয় অভিযুক্তদের। ১৯৬৯ সালের ৫ এপ্রিল মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।(১৪৯)

লিফলেট মামলা কোয়াশের আবেদন ও হাইকোর্টের রায়
লিফলেট মামলাটি বাতিল বা কোয়াশ(১৫০) করার জন্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। কিন্তু ঢাকা হাইকোর্ট ৭ মে ১৯৬৫ তারিখে উক্ত আবেদন নামঞ্জুর করেন। এ রায়টি বর্তমান বইয়ে বাংলায় অনুবাদ করে মুদ্রণ করা হয়েছে।

মামলা-১৬
২৯ মার্চ ১৯৬৪ আউটার স্টেডিয়ামে বক্তৃতার বিরুদ্ধে
১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানে একটি জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেন। উক্ত বক্তৃতায় দেশদ্রোহিতামূলক উপাদান রয়েছে অভিযােগে পুলিশ সুপার সৈয়দ আবদুল মান্নান বখশ ১৯৬৪ সালের ৫ নভেম্বর পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। অভিযােগে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে আইনসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করেছেন এবং ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন।(১৫১)
৭ নভেম্বর ১৯৬৪ তাঁকে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ফরিদপুর ও বরিশালে বিভিন্ন স্থানে সফর করে এ দিন রাতে তিনি ঢাকায় ফেরেন। রাতেই তাঁকে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের নির্দেশবলে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাঁকে দুই হাজার টাকা এবং অনুরূপ অংকের দুজন জামিনদারের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
————————————–
১৪৭. ইত্তেফাক, ২৬ মে, ১৯৬৬।
১৪৮ .পূর্বদেশ, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৬৭।।
১৪৯. পূর্বোক্ত, মােহাম্মদ হাননান, পৃ. ৮৭।
১৫০. ক্রিমিনাল রিভিশন নং ৩০৩/১৯৬৪।
১৫১. দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ মার্চ, ১৯৬৫।
—————————————————-
৭৮

২০ নভেম্বর ১৯৬৪ তারিখে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের (এডিসি) আদালতে বঙ্গবন্ধু হাজিরা প্রদান করেন। এ দিন তাঁকে ২০০০ টাকা বন্ডে নতুন করে জামিন মঞ্জুর করা হয়। পরবর্তী দিন ধার্য করা হয় ৩ ডিসেম্বর, ১৯৬৪।(১৫২) আবার এ দিনই তার নামে আরও একটি নতুন মামলা দায়ের করা হয়। এ দিনের শুনানিতে তার বর্তমান মামলাটি বিচারের জন্য অন্য কোনাে উপযুক্ত আদালতে বদলির জন্য শেখ মুজিবের পক্ষে আবেদন জানানাে হয়। কেননা অভিযুক্তর আশঙ্কা হলাে এডিসির আদালতে তাঁর পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়।(১৫৩) তার এই আবেদন মঞ্জুর করা হয়নি। মামলা স্থানান্তরের জন্য শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে আবেদন করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫ হাইকোর্টে এই বিষয়ে প্রথম দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় (মামলা-১৭ দ্র.)।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই মামলার ট্রায়াল বিষয়ে তৎকালীন পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা হলাে :
On a petition filed by Mr. Abdul Khaleq, DSP, the Additional District Magistrate, Dacca allowed the prosecution to hold the trial of Sheikh Mujibur Rahman inside Dacca Central Jail in yet another case of alleged prejudicial speech. In this case charges have been brought under section 124A PPC (Sedition) for an alleged speech delivered by the accused at, Outer Stadium on 29 March 1964, S.P. Dacca complained against him.
The sureties of the accused in this case were earlier notified to produce him before the court on Monday. The sureties replied that the accused was in detention under DPR and as such it was within the court’s power to order his production. He was, however, not brought to the court.
Advocate of Sheikh Mujibur Rahman disputed the prosecution prayer for trial inside the jail and submitted that the trial should be held in an open court.
The court rejected his submissions and fixed the case for hearing on March 27 1967.(১৫৪)
২৮ মে, ১৯৬৭ এই মামলার ট্রায়াল শুরু হয়। ১৯ জুন ১৯৬৭ পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী আরেকটি তারিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ১৬ এবং ১৭ অক্টোবর ১৯৬৭ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ঢাকার অতিরিক্ত কমিশনারের আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলার সরকারপক্ষীয় সাক্ষীদের জেরা অনুষ্ঠিত হবে।
এই মামলার সর্বশেষ ধার্য তারিখ ২৯ নভেম্বর, ১৯৬৭। কিন্তু এই তারিখ ও এরপর থেকে এই মামলা বিষয়ে আর কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না। কেননা ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের তােড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
——————————————–
১৫২. আজাদ, ২১ নভেম্বর, ১৯৬৪।
১৫৩. আজাদ, ৪ ডিসেম্বর, ১৯৬৪।
১৫৪. Pakistan Observer, 28th February 1967.
————————————-
৭৯

মামলা-১৭
মামলা বদলি বা কোয়াশের জন্য হাইকোর্টে শেখ মুজিবের আবেদন, ১৯৬৫
১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫ (মঙ্গলবার) ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব বাকের ও বিচারপতি জনাব এ. সােবহান চৌধুরী সমবায়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আনীত দেশদ্রোহিতার মামলা (মামলা-১৬) কোয়াশের আবেদনের পূর্ণ শুনানি শুরু হয়।
উল্লেখ্য, ৫ নভেম্বর ঢাকার পুলিশ সুপার ঢাকার অতিরিক্ত কমিশনারের আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা মােতাবেক দেশদ্রোহিতার অভিযােগে একটি মামলা (মামলা-১৬) দায়ের করেন। শেখ মুজিব উপরােক্ত মামলা বাতিল বা মামলাটি ডেপুটি কমিশনারের আদালত থেকে অন্য কোনাে আদালতে বদলির জন্য ঢাকা হাইকোর্টে বর্তমান আবেদনটি (মামলা-১৭) পেশ করেন।
ঢাকা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ আবেদনকারীর অনুকূলে রুল জারি করেন। আবেদনকারীর আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পাল বলেন যে, পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা শাসনতন্ত্রের পরিপন্থি। সুতরাং ১২৪ ধারা মােতাবেক আনীত এই মামলার আইনগত কোনাে ভিত্তি নাই।(১৫৫)
১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫ এই মামলার দ্বিতীয় দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পাল (এস. আর, পাল) আগের দিনের যুক্তির পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, এই মামলা বাতিলযােগ্য কিনা, এ প্রশ্নে আদালত যদি কোনাে প্রকার অভিমত প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক হন, তবে তিনি মামলাটি অন্য উপযুক্ত আদালতে বদলির আবেদন করবেন। এই মামলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনাে মুন্সেফি আদালতে এই মামলার বিচার হওয়া দরকার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এই মামলার বিচার হওয়া কোনােভাবেই সমীচীন নয়।(১৫৬)
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫ তারিখে (বৃহস্পতিবার) এই মামলায় তৃতীয় দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন সরকারপক্ষের আইনজীবী তাঁর সাবমিশন অব্যাহত রাখেন।(১৫৭) ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫ তারিখে (বৃহস্পতিবার) এই মামলায় চতুর্থ দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মার্চ, ১৯৬৫ (বৃহস্পতিবার) তারিখে হাইকোর্ট রায় ঘােষণা করেন। রায়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বাতিল (কোয়াশ) বা বদলির আবেদন নামঞ্জুর করা হয়।(১৫৮)
————————————–
১৫৫. ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫।
১৫৬. ইত্তেফাক, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫।
১৫৭. ইত্তেফাক, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫।
১৫৮. ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ, ১৯৬৫।
——————————————-
৮০

মামলা-১৮
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪ পল্টন ময়দান বক্তৃতার বিরুদ্ধে
আইনত প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত ও তাদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এক আপত্তিকর বক্তৃতাদানের অভিযােগে ১১ নভেম্বর, ১৯৬৪ রমনা থানায় পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশের ৭(৩) ধারা মােতাবেক শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়।(১৫৯)
অভিযােগপত্রে বলা হয়, তিনি ১৯৬৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে সকল বিরােধী দলের উদ্যোগে ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস উপলক্ষ্যে আয়ােজিত এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেছেন। তিনি উক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে আইনত প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত ও তাদের মনে সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। উক্ত আপত্তিকর বক্তৃতায় জনসাধারণকে আইন অমান্য ও শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য এবং জনসাধারণকে সরকারকে কর প্রদান না করার জন্য প্ররােচিত করা হয়েছে কিংবা প্ররােচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। রমনা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অফিসার এই অভিযােগ আনয়ন করেন।১৬০
মামলার শুনানি ২৮ জুন, ১৯৬৬ সােমবার ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এম. এ. মালেকের আদালতে আরম্ভ হয়। এ দিন সরকারপক্ষের চারজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।(১৬১)
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ বুধবার একই আদালতে শেখ মুজিবের এই মামলার মুলতুবি শুনানি শুরু হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। জেরার দিন ধার্য করা হয় ২ মার্চ।(১৬২) ২ মার্চ, ১৯৬৬ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এই মামলায় সরকারপক্ষের চারজন সাক্ষীর জেরা সমাপ্ত হয়। পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয় ২২ মার্চ।(১৬৩)
২২ মার্চ, ১৯৬৬ মামলার পরবর্তী তারিখ থাকলেও এ দিনের কোনাে পত্রিকায় এই তারিখের শুনানি বিষয়ে কোনাে খবর প্রকাশিত হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে, তিনি এ দিন শুনানিতে উপস্থিত হতে পারেননি। কেননা এ সময় থেকেই ৬ দফার প্রচারের জন্য তিনি সারা দেশ সফর শুরু করছেন। ১২ এপ্রিল তিনি ঢাকা ফেরেন। এর পরের দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল অন্য একটি মামলার (মামলা-১৫, পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও মামলা) শুনানির তারিখ রয়েছে। এই শুনানিতে হাজিরা দিয়েই ১৭ এপ্রিল তিনি খুলনা রওনা হয়ে যান।

রায় ঘােষণা
২৪ অক্টোবর, ১৯৬৬ (সােমবার) ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এম. এ. মালেক ১৯৬৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জুলুম প্রতিরােধ দিবস উপলক্ষে, পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবের আপত্তিকর বক্তৃতার অভিযােগে আনীত মামলা থেকে তাকে বেকসুর খালাস ঘােষণা করেন।
————————–
১৫৯. ইত্তেফাক, ১৯ অক্টোবর, ১৯৬৫।
১৬০ .ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৬৬।
১৬১ .আজাদ/ইত্তেফাক/সংবাদ/দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ জুন, ১৯৬৫।
১৬২. দৈনিক পাকিস্তান/সংবাদ/ডন, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
১৬৩. ইত্তেফাক, ৩ মার্চ, ১৯৬৬।
——————————-
৮১

মামলা-১৯
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪ পল্টন ময়দানে বক্তৃতাবিষয়ক রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে সরকারপক্ষের আপিল

১৯৬৭ সালের ১২ মে ম্যাজিস্ট্রেটের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে (মামলা-১৮ দ্র.) সরকার ঢাকা হাইকোর্টে আপিল দায়ের করে এবং আপিল গ্রহণ (অ্যাডমিট) করা হয়। সরকারের পক্ষে আপিল দায়ের করেন প্রাদেশিক আইন সচিব এবং পরিচালনা করেন ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার। আপিল আবেদনে বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ভুল ব্যাখ্যা (মিসরিড) প্রদান করেছেন এবং ফলে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।(১৬৪)
হাইকোর্ট সরকারের আপিল খারিজ করে দেন এবং অধস্তন আদালতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রদত্ত বেকসুর খালাস-আদেশ বহাল রাখেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য দ্র. Legal Remembrancer Govt. of E. Pakistan Dacca vs. Respondent : Sk. Majibur Rahman 21 DLR 1969 745 (১৯৬৭ সালের ২নং ক্রিমিনাল গভর্নমেন্ট আপিল)।

মামলা-২০
জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে মামলা, ১৯৬৪
৩ ডিসেম্বর, ১৯৬৪ (বৃহস্পতিবার) ১৯৫৮ সালের পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের ২ ধারার ৭(৩) ৪(গ) উপধারার অভিযােগে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আরও একটি নতুন মামলা দায়ের করা হয়। ৩ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হলে তাঁকে দুই হাজার টাকার বন্ডে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।(১৬৫)
১৫ জানুয়ারি, ১৯৬৫ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু এই তারিখে ও পরবর্তী সময়ে এই মামলার আর কোনাে অগ্রগতি সম্বন্ধে জানা যায় না। এর মূল কারণ হলাে এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযােগে কয়েকটি নতুন মামলা দায়ের করে। ফলে এই মামলাটির ওপর আর জোর দেওয়া হয়নি।
——————————————
১৬৪. পাকিস্তান অবজারভার, ১৩ মে, ১৯৬৭।
১৬৫. আজাদ, ৪ ডিসেম্বর ১৯৬৪।
——————————————-
৮২

মামলা-২১
কাউন্সিল অধিবেশন মামলা, ১৯৬৬
আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয় ১৮ মার্চ, ১৯৬৬। এ অধিবেশনে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। কাউন্সিল অধিবেশন শেষে ২০ মার্চ, রবিবার তিনি পল্টন ময়দানে একটি ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণের বিরুদ্ধেই এই মামলাটি দায়ের করা হয়।(১৬৬)
মূলত এই বক্তৃতার পরই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুখােমুখি বিতর্কের চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। কিন্তু ভুট্টো প্রথমে রাজি আছেন জানালেও পরে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।
১৭ এপ্রিল, ১৯৬৬ ঢাকার রমনা থানায় রুজুকৃত মামলার আসামি হিসেবে ঐ দিনই সকালবেলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এই গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয়। রমনা থানার সূত্রে জানানাে হয়, ২০ মার্চ আওয়ামী লীগ। কাউন্সিল অধিবেশন শেষে স্থানীয় আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসভায় “রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তিকর” উক্তি করায় শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ দিনই রাত চারটায় (অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল, ১৯৬৬ ভাের রাতে) পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারায় পুলিশ এই মামলার অভিযােগে যশােরে তাকে গ্রেফতার। করে। এ সময় তিনি খুলনা থেকে সদলবলে যশাের হয়ে ঢাকা ফিরছিলেন।
যশােরে আটক করায় তার পক্ষে ১৯ এপ্রিল, ১৯৬৬ তারিখে ঢাকায় প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অন্য আরেকটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় হাজির হওয়া সম্ভব হয়নি।
১৯ তারিখ সকাল দশটায় পুলিশ তাঁকে যশাের সদর (দক্ষিণ) মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করে এবং তাঁর পক্ষে জামিন চাওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান আগামী ২১ এপ্রিলের পূর্বে ঢাকায় প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন- এই শর্তে যশাের আদালত তাকে পাঁচ হাজার টাকার বন্ডে জামিন মঞ্জুর করেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর আদেশে মন্তব্য করেন যে, “শেখ মুজিবর রহমান একজন স্বীকৃত জননেতা এবং সমগ্র বিষয়টি পর্যালােচনা করিয়া আমার ধারণা জন্মিয়াছে যে, এই ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা যাইতে পারে।” পরবর্তী সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই মামলায় জেলের ভেতরে আদালত বসিয়ে শেখ মুজিবের বিচার
হবে।(১৬৭)
এই মামলার পরবর্তী অন্যান্য ধার্য তারিখ ছিল ৮ আগস্ট, ১৯৬৬; ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৬ ইত্যাদি।
৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সরকারপক্ষ তাদের সাবমিশনে শেখ মুজিব প্রদত্ত সেদিনের কাউন্সিল অধিবেশন শেষে প্রদত্ত বক্তৃতার ‘নিমােক্ত অংশসমূহকে আপত্তিকর বলে উল্লেখ করেছে(১৬৮) :
———————————-
১৬৬. আজাদ, ১৯ এপ্রিল, ১৯৬৬।
১৬৭. Pakistan Obseroer, 6th August 1966.
১৬৮. সংবাদ, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
——————————–
৮৩

১… আঠার বৎসর মানুষকে শােষণ করেছে সেই শােষকের দল বেরিয়ে পড়ছে।
২. …আঠার বৎসর পর্যন্ত সরকার সর্বস্ব লুট করছে…।
৩. …কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানকে একমাত্র আল্লাহ রক্ষা করছেন।
৪…পূর্ব বাংলায় কয়খানা ভাঙ্গা প্লেন ছিল। আমি জানি। যাহা ছিল তাহা শুনলে দিশেহারা হবেন। বাংলাদেশে এক ডিভিশন সৈন্য ছিল। আমি বলি সামান্য কয়খানা প্লেন ছিল।
৫. …আপনাদের কাছে আঠার বৎসর পর্যন্ত হিসাব-নিকাশের পাতা দেওয়া হইয়াছে, আপনারা আমাদের দিকে দেখেন নাই…।
৬…পূর্ব পাকিস্তানে সােনা ১৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে সােনা ১২০ টাকা। এতে আবার কাস্টমস হয়।
৭.. .পূর্ব পাকিস্তানে যে জিনিসের দাম ৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ২ টাকা। পূর্ব পাকিস্তানে বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিক হয়েছেন যারা তারা আয় করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যান।
৮. …রাজধানী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, মূলধন পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে…আপনারা সব বাজার। আমরা বাজার হতে চাই না, পাকিস্তানের নাগরিক হতে চাই।… জারি করে একটা… দিয়েছেন। বাংলা কোথায় আছে?
৯. …তুমি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও আমাদের দুর্দিনে আমাদের পাশে দাঁড়াতে পার নাই…।
১০. …আপনাদের কাছে আবেদন করব-আমাদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। পূর্ব বাংলায় বিড়ির পাতা নিতে পারবে না, পশ্চিম পাকিস্তানে আনতে পারবে। আমরা নাকি… সেইখান থেকে সােনা আনতে পারব না; কিন্তু যুদ্ধের সময়… এ ৪০ হাজার বস্তা গম পাওয়া গেল। আরব সাগরে সােনা পাওয়া গেল।
১১. … বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।….।
১২. … আমি জানি আইয়ুব খান সাহেব বলেছেন, আমাদের সমূলে ধ্বংস করে দিবেন, আমাদের উপর অত্যাচার করবেন……।
১৩. …তাই ভাইয়েরা-আপনারা ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান এবং সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
১৪. …মিথ্যাচারের অবসান করতে হবে। মানুষকে মুক্তি দিতে হবে…।
২৭ এপ্রিল, ১৯৬৭ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এই মামলার রায় ঘােষণা করা হয়। রায়ে তাঁকে ১৫ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। রায় শেষে জামিনের জন্য আবেদন করা হলে তা না-মঞ্জুর করা হয়।(১৬৯)
—————————–
১৬৯ আজাদ, ২৮ এপ্রিল ১৯৬৭।
———————–
৮৪

মামলা-২২
কাউন্সিল অধিবেশন মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল, ১৯৬৭
২১ নম্বর মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ মাসের কারাদণ্ড দানের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল দায়ের করেন। অতিরিক্ত দায়রা জজ ন্যায়বিচারের প্রয়ােজনে’ দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে পনের মাসের স্থলে আট মাস করেন। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৭ শেখ মুজিব ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত প্রদত্ত এই আট মাসের দণ্ডাদেশ বাতিলের জন্য ঢাকা হাইকোর্টে রিভিশন মামলা দায়ের করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব এ. সােবাহানকে নিয়ে গঠিত একক বেঞ্চ রুল জারি করেন।(১৭০)
এর পরেই এক সপ্তাহের মাথায় ৩ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সরকার আগরতলা মামলার ঘােষণা প্রদান করে। ১৭ জানুয়ারি তাঁকে আগরতলা মামলায় গ্রেফতার দেখানাে হয়। তাই হাইকোর্টের এই রুলের শুনানি আর এগােয়নি।

মামলা-২৩
দেশরক্ষা আইনে নিরাপত্তাবন্দি হিসেবে আটক, ১৯৬৬ এবার আর সুনির্দিষ্ট কোনাে অভিযােগে নয়, শেখ মুজিবকে দেশরক্ষা আইনের অধীনে গ্রেফতার দেখানাে হয়।
৮ মে, ১৯৬৬ (শনিবার) দিনগত রাত দুইটা থেকে চারটার মধ্যে দেশরক্ষা আইনের ৩২(১)(ক) ধারার বিধানবলে শেখ মুজিবসহ মােট সাতজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। দেশরক্ষা আইনের এই ধারাটিতে পাকিস্তানের জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনস্বার্থ, দেশরক্ষামূলক কার্য, কোনাে বিদেশি শক্তির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক রক্ষা, পাকিস্তানের সর্বত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা, প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ, সরকারি কাজকর্ম অব্যাহত রাখা ও যথাযথভাবে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যদি কোনাে ব্যক্তির আচার-আচরণ সন্দেহজনক বা আপত্তিকর বলে মনে করে তবে তাকে গ্রেফতারপূর্বক আটকের নির্দেশ দিতে পারবে বলে বিধান রাখা হয়েছে।।
———————-
১৭০. সংবাদ, ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৭।
———————-
৮৫

উল্লেখযােগ্য যে, এ দিন রাত দুইটায় শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবন ঘেরাও করা হয় এবং জনৈক পুলিশ অফিসার তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গ্রেফতারি পরােয়ানাটি তার হাতে দেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি প্রস্তুত হন। রাত তিনটায় তাঁর সহােদর এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র তাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল গেটে পৌঁছিয়ে দেন।(১৭১)
এই গ্রেফতার রাজধানী ঢাকার সর্বমহলে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্ষোভের সঞ্চার করে। এমনকি বিরােধী দলের নেতারাও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে গৃহীত এই ব্যবস্থাকে “চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার উপর নয়া হামলা’ বলে অভিহিত করেন। তারা আরও বলেন যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেশরক্ষা আইনবলে বিনা বিচারে নেতৃবৃন্দের এই আটক প্রতিষ্ঠিত আইনি রীতিনীতি ও ব্যক্তি অধিকারের চরম লঙ্ঘন।(১৭২)
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬-তে এই মামলা দায়ের পর্যন্ত ঘটনাবলির প্রতি লক্ষ করলে বােঝা যায় যে, এই সময়ের মধ্যে সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করেছে। এবং এটিও স্পষ্ট যে, তাঁকে গ্রেফতারের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়, কিন্তু জামিন দেওয়া হয় না। প্রায় প্রতিটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন সেশন জজের আদালত থেকে। ফলে, এত মামলা দিয়েও তাঁকে কারাগারে আটক রাখা যাচ্ছে না। এদিকে প্রতি সপ্তাহে তিনি ক্লান্তিহীনভাবে একাধিক জেলা ভ্রমণ করছেন, জনসভা করছেন, জনগণকে ৬ দফার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে চলেছেন। তাই সরকার এবার তাঁকে নিরাপত্তাবন্দি হিসেবে আটক করেছে। অর্থাৎ প্রতি বার যেহেতু জামিন পেয়ে যাচ্ছেন, এইবার আর জামিন পাওয়া সম্ভব নয়। এ আইনের অধীনে অনির্দিষ্ট মেয়াদে একজন ব্যক্তিকে প্রিভেনটিভ ডিটেনশনে আটক রাখা যায়।(১৭৩)

মামলা-২৪
মামলা ২৩ অর্থাৎ দেশরক্ষা আইনে আটকের বিরুদ্ধে। হাইকোর্টে মামলা, ১৯৬৬
১৩ মে, ১৯৬৬ (শুক্রবার) শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য আসামিদের পক্ষে ঢাকা হাইকোর্টে পৃথক পৃথক হেবিয়াস কপাসের আবেদন দায়ের করা হয়। কেন উপরােক্ত বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে না তার কারণ দর্শানাের জন্য বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ. বি. মাহমুদ হােসেনের বেঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। উল্লেখ্য যে, তাদেরকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির অধীনে গত ৮ মে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয়। কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।(১৭৪)
১৫ জন, ১৯৬৬ হেবিয়াস কর্পাস আবেদনের শুনানি আরম্ভ হয়। এর আগে এই মামলার শুনানির জন্য একটি স্পেশাল বেঞ্চ গঠন করা হয়। বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী, বিচারপতি এম. আর. খান, বিচারপতি সালাহউদ্দিন আহমদ, বিচারপতি এ. এম. সায়েম এবং বিচারপতি এ. এম. আবদুল্লাহকে নিয়ে এই স্পেশাল বেঞ্চ গঠিত হয়।
————————————
১৭১. ইত্তেফাক, ১০ মে, ১৯৬৬।
১৭২. ইত্তেফাক, ১০ মে, ১৯৬৬।
১৭৩. দ্য ডন, ১০ মে, ১৯৬৬।
১৭৪. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ মে, ১৯৬৬।
—————————–
৮৬

এ দিনের শুনানিতে তাঁর পক্ষে বলা হয় যে, আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত আটকাদেশটি অনির্দিষ্ট ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং ফলে অবৈধ। যেহেতু আবেদনকারীরা ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক নয়, সেহেতু অযথা হয়রানি করার উদ্দেশ্যে তাদের আটক রাখা হয়েছে। সর্বোপরি আবেদনকারীদের পক্ষ থেকে অভিযােগ করা হয় যে, দেশে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান না-থাকা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা আইন কার্যকর রাখা এবং উক্ত আইনের ভিত্তিতে আবেদনকারীদের আটক রাখা সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য ও বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাবের পরিচায়ক।
১১ জুলাই, ১৯৬৬ (বুধবার) ঢাকা হাইকোর্টের স্পেশাল বেঞ্চের সমীপে এই আবেদনের শুনানি সমাপ্ত হয়, তবে এ দিন রায় প্রদান করা হয়নি।
সরকারপক্ষের দাবি, আটক ব্যক্তিদের কার্যকলাপ আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে ও জননিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর বলে গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
শুনানিতে সরকারপক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, ছয় দফা কর্মসূচির সঙ্গে এই আটকাদেশের কোনাে সম্পর্ক নেই; কিন্তু উক্ত কর্মসূচির নামে দেশব্যাপী যেভাবে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা মারাত্মক ক্ষতিকর ও উদ্বেগজনক। ছয় দফা কর্মসূচি প্রচারের জন্য যে আন্দোলন অথবা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে তা পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থি। এর ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এই সংক্রান্ত কার্যকলাপ সম্পর্কে আটককারী কর্তৃপক্ষ বা সরকার সন্তুষ্ট হলেই আইনত আটকাদেশ দেওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার আইনজীবী সাবমিশনে বলেন যে, প্রতিরক্ষার নামে এবং আপত্তিকর তথ্য সরকারের হাতে রয়েছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ও অন্যায়ভাবে সরকার তাকে আটক করে রেখেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা বিনষ্ট হতে পারে এমন কোনাে কাজ করেছেন বলে সুস্পষ্ট কোনাে প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। শেখ মুজিব ক্ষমতাসীন দলের সমালােচক এবং যেহেতু ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট, সেহেতু তার আন্দোলনকে সমূলে বিনাশ করার জন্যই প্রতিরক্ষা বিধিবলে সরকার ধরপাকড়ের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা কোনােক্রমেই দেশের প্রতিরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
৯ আগস্ট, ১৯৬৬ এই মামলার রায় ঘােষণা করা হয়। ঢাকা হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ দফাবলে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের আটক আইনসঙ্গত বলে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তাই আটক ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক জারিকৃত প্রদত্ত আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে পেশকৃত আবেদনপত্রসমূহ না-মঞ্জুর (রিজেক্টেড) করা হয়।(১৭৫)
স্পেশাল বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিবৃন্দ (বিচারপতি জনাব সিদ্দিকী, বিচারপতি জনাব এম. আর. খান, বিচারপতি জনাব সালাহউদ্দিন এবং বিচারপতি জনাব সায়েম) গ্রেফতারের প্রয়ােজনীয়তা বিষয়ে সন্তুষ্টি সম্পর্কে বলেন যে, এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ সরকারের মানসিক সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল এবং সেই সন্তুষ্টির প্রশ্নটি সংশ্লিষ্ট আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের বিচার্য (জাস্টিশিয়েবল) নয়।
তবে, এই রায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের সঙ্গে (অর্থাৎ অন্য চারজনের সঙ্গে) ভিন্নমত পােষণ করেন বিচারপতি আবদুল্লাহ। তিনি পৃথক রায়ে বলেন যে, সংশ্লিষ্ট বন্দিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রচলিত নিরাপত্তা আইনের মতাে সাধারণ’ আইনসমূহই যথেষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে অতি কঠোর দেশরক্ষা আইনের প্রয়ােগ প্রয়ােজন ছিল না। তিনি আরও বলেন, দেশরক্ষা আইন ও বিধিসমূহ প্রণীত হয়েছে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হানিকর কার্যকলাপের ক্ষেত্রেই শুধু এই বিধিসমূহ প্রয়ােগ করা উচিত। শেখ মুজিব ও অন্যান্য বন্দি সম্পর্কে ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক পেশকৃত নথিপত্র প্রমাণ করে না যে, তারা দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর কোনাে কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন।(১৭৬)
—————————————-
১৭৫. আজাদ, ১০ আগস্ট, ১৯৬৬।
১৭৬.সংবাদ, ১০ আগস্ট, ১৯৬৬।
————————————-
৮৭

মামলা-২৫
মামলা-২৪(১৭৭)-এ হাইকোর্ট-প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল, ১৯৬৬
উপরে বর্ণিত মামলা-২০ এ হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে আপিল দায়ের করেন। ১৭ জুন, ১৯৬৭ সুপ্রীম কোর্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য (রিমান্ডে) ঢাকা হাইকোর্টে ফেরত পাঠান। সুপ্রীম কোর্ট মন্তব্য করেন যে, এই আইনের অধীনে কাউকে গ্রেফতার ও আটক রাখার সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত (সাবজেকটিভ) সন্তুষ্টির বিষয়। অতএব কোনাে নাগরিকের বিশেষ কোনাে কার্য প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে দেশের নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষার প্রতি হুমকিস্বরূপ কিনা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র বিচারক বা কর্তৃত্বের অধিকারী হলাে সরকার। তবে, ঢাকা হাইকোর্টের স্পেশাল বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিবৃন্দের যে অভিমত অর্থাৎ আদালত সংশ্লিষ্ট নাগরিকের আটকের কারণসমূহ পরীক্ষা করতে এখতিয়ারসম্পন্ন নন, এটি ঠিক নয়। বরং একটি সাম্প্রতিক মামলায় (মালিক গােলাম জিলানি বনাম রাষ্ট্র, ১৯৬৬ পিএলডি) পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট এর বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। সুপ্রীম কোর্টের মতে, পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের অধীনে জারিকৃত আটকাদেশ পরীক্ষার ক্ষমতা বিচার বিভাগের এখতিয়ার-বহির্ভূত নয়। যে কারণে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত কিনা এবং যে বিধিবলে আটকাদেশ জারি করা হয়েছে, উত্থাপিত অভিযােগগুলাে সেই বিধির আওতাভুক্ত কিনা আদালত তা পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন। The relevant portion of the Supreme Court’s Order which is the foundation of the re-hearing of the case is as follows:(১৭৮):
“The majority (4 to 1 Judges of the Dacca High Court) decision has upheld the validity of the detention of Sk. Mujibur Rahman. The detention was under Rule 32 of the Defense of Pakistan Rules and although the order of detention itself disclosed no grounds, the High Court relying upon the affidavit filed on behalf of the Government of East Pakistan took the view that since the satisfaction of the detaining authority is a subjective satisfaction. It was the sole judge of the facts, namely as to whether a particular activity of a particular citizen will in any way directly or immediately affect the society or the defense of the State or not.
“The learned judges in majority were of the opinion that for a court to go beyond this question, would amount to satisfying its mind for that of the executive without being in possession of facts and also not being authorized to do so.
“This conclusion is contrary to the view taken by this court in its recent decision in the case of Malik Golam Jilani wherein it has been held that even the orders of the executive passed under the Defense of Pakistan Rules are not immune from judicial
—————————————-
১৭৭ .অর্থাৎ দেশরক্ষা আইনে আটকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা, ১৯৬৬।
১৭৮. Pakistan Observer, 10th August 1967.
——————————————-
৮৮

review. It is for the courts to be satisfied that reasonable grounds existed on which the satisfaction of the detaining authority could be grounded and that such grounds were reasonable and within the ambit of the law authorizing the detention.
“The High Court can and should consider and reach a conclusion as to whether, upon the evidence placed before it, justification existed for the satisfaction expressed by the Deputy Commissioner”.
উক্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্ট মনে করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের আটকাদেশের বৈধতার বিচার সঠিক আইনগত গ্রাউন্ডে বিবেচনা করা হয়নি। অতএব মালিক গােলাম জিলানি মামলার আলােকে তাঁর আটকাদেশের বৈধতা বিচারের জন্য হাইকোর্টের নিকট মামলাটি ফেরত পাঠানাে হয়।(১৭৯)
সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক রিমান্ডে ফেরত পাঠানাের পর ২৬ জুন, ১৯৬৭ (সােমবার) ঢাকা হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির জন্য হেবিয়াস কর্পাস আবেদনটি উত্থাপন করা হয় (আবেদনকারী হলেন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে তার আত্মীয় শেখ আকরাম হােসেন)। বিচারপতি জনাব বাকের ও বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম উপরােক্ত আবেদনের ভিত্তিতে প্রাদেশিক সরকার, ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এবং সংশ্লিষ্টদের প্রতি নতুন করে রুল জারি করেন। রুলে বলা হয়, কেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানকে হাইকোর্টে হাজির এবং মুক্তি প্রদান করা হইবে না। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ রেসপনডেন্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে উক্ত রুলের জবাব প্রদানের নির্দেশ দান করেন। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে সময়ে সময়ে প্রদত্ত আটকাদেশের ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে আটক রাখা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখে প্রদত্ত এক আদেশের ভিত্তিতে তাঁর আটকের মেয়াদ আরও তিন মাসের জন্য বর্ধিত করা হয়।(১৮০)
২৬ জুলাই, ১৯৬৭ এই পিটিশনের পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি বাকের, বিচারপতি আবদুল্লাহ ও বিচারপতি আবদুল হাকিমের সমন্বয়ে শুনানির জন্য একটি স্পেশাল বেঞ্চ গঠন করা হয়।(১৮১)
২৮ জুলাই, ১৯৬৭ দ্বিতীয় দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে সরকার কী প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন যার ফলে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে শেখ মুজিবকে বন্দি করে রেখেছেন তা জানতে চান। এর উত্তরে অ্যাডভােকেট জেনারেল মাননীয় আদালতের নিকট উল্লেখ করেন যে, উক্ত তথ্যাদি গােপনীয়, সুতরাং প্রকাশ্য আদালতে উত্থাপন সম্ভব নয়। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১ আগস্ট, ১৯৬৬ উভয় পক্ষের আইনজীবীকে রুদ্ধদ্বার আদালতে শুনানির জন্য অংশগ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়। গােপন শুনানিতে উত্থাপিত এসব তথ্য সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করা হবে না বলে আইনজীবীগণ আদালতে হলফনামা স্বাক্ষর করেন।(১৮২)
১ আগস্ট, ১৯৬৭ এই মামলার শুনানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। কিন্তু এই দিন রায় ঘােষণা করা হয়নি। ১০ আগস্ট রায় ঘােষণা করা হয়। তিনজন বিচারপতির দুইজন (বিচারপতি বাকের ও বিচারপতি আবদুল হাকিম) মনে করেন শেখ মুজিবের আটকাদেশ বৈধ। কিন্তু বিচারপতি আবদুল্লাহ ভিন্ন মত পােষণ করেন এবং পৃথক রায় প্রদান করেন।(১৮৩) তার ডিসেন্টিং রায়ের উল্লেখযােগ্য অংশসমূহ নিম্নরূপ(১৮৪) :
———————————————
১৭৯. আজাদ, ১৮ জুন, ১৯৬৭
১৮০. আজাদ, ২৭ জুন, ১৯৬৭। ১৮৯.
১৮১. Pakistan Observer, 27th July 1967.
১৮২ সংবাদ, ২৮ জুলাই ১৯৬৭।
১৮৩. পাকিস্তান অবজারভার, ২ আগস্ট ১৯৬৭।
১৮৪.Pakistan Observer, 10th August 1967.
—————————————–
৮৯

Mr. Justice Abdulla in his separate judgment said that admittedly (which was not denied by the State) Mujib was a political leader and was first a member of Muslim League and fought for Pakistan. Now he was the President of the Provincial Awami League and in that capacity he formulated a ‘six-point programme mainly to remove disparity between the two Wings of Pakistan and to achieve complete provincial autonomy for both the Wings as he thought Pakistan could thereby be founded on a strong footing. The Judge said that a Bench of this High Court (consisting of Mr. Justice Baquer and Mr. Justice Abdul Hakim) earlier held that’six-point programme by itself was not prejudicial. On the basis of these facts the Judge said that it was obvious that when occasion arose. Sheikh Mujib in his capacity as the President of the East Pakistan Awami League would criticize the actions of the Government in the light of the ‘six-point, but “we are to see if the criticisms were violent and exciting and in any unwanted incident occurred due to that, the Judge observed.
Mr. Justice Abdulla further observed that the State could not place any material whatsoever to show that the activities of Sheikh Mujib were exciting. The expression “exciting’ used by the State in the files was only their presumptions.
Mr. Justice Baquer said that in considering a detention case it should not be lost sight of the fact that the law was not only retrospective but also prospective. So, the detaining authority could also consider the likelihood of the detenu’s indulging prejudicial activities after his release.
His Lordship was referring to the contention made on behalf of the detenu that the last order of his detention was passed on May 29, 1967 though the last but one order of his detention expired on May 3, 1967 and, in between, he was detained without any authority.
It was also contended on behalf of the detenu in this connection that since he could not indulge in prejudicial activities during the interregnum (from May 3 to May 29), the last order had no basis. In this connection Mr. Justice Baquer considered the statement made on behalf of the State that since Sheikh Mujib was detained due to a conviction, the necessity of passing any detention order did not arise.
Mr. Justice Baquer held that the detention order might be passed prospectively to stop a person from acting in a prejudicial manner in future. Mr. Justice Abdulla said that the detaining authority was the Deputy Commissioner of Dacca, and he must be satisfied personally as to the prejudicial activities of the detenu. In the present case a Section Officer of the Provincial Government came to depose. Neither he nor the Provincial Government was the detaining authority and the Deputy Commissioner of Dacca did not come before the Court to justify his actions, the Judge observed.
In the files produced before the Court the allegations against Sheikh Mujib of prejudicial activities located at different parts of the Province (and beyond Dacca). If these were also considered by the Deputy Commissioner, Dacca, before whom legitimately these facts could not come, the detenu at once deserved a release order, he said.
৯০

The satisfaction must be subjective of the detaining authority and for this reason his Lordship dissented with the majority Judges of the Full Bench (that earlier held the detention of Sheikh Mujib as valid) to hold that the High Court had right to scrutinize the veracity of an order of detention, the Judge said. His Lordship said that the Supreme Court upheld his view and referred this case for rehearing (as stated below).
Mr. Justice Abdulla said that while considering the prejudicial activities of the detenu, the facts that supported his innocence should also be considered together. His Lordship then referred to the speech first delivered by Sheikh Mujib condemning the Indian aggression which was broadcast from all stations of Radio Pakistan and in which he called upon all concerned to unite and fight.
His Lordship also said that while applying the Defense of Pakistan Rules (DPR) to detain a man, it must be shown that his activities were related to the defense of Pakistan or the state of war.
To deal with other kinds of prejudicial activities, the Public Safety Act was inexistence and the Provincial Government was powerful to apply that law. In the
present case the application of the Defence of Pakistan Rules was bad, the Judge said. উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল দায়ের করার জন্য হাইকোর্ট সার্টিফিকেট প্রদান করেছিলেন। কিন্তু সেই আপিল করা সম্ভব হয়নি। কেননা এর কয়েক মাসের মধ্যেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে আটক ঘােষণা করে সরকার।

মামলা-২৬
সিলেট জনসভায় বক্তৃতার বিরুদ্ধে মামলা, ১৯৬৬
১৩ মার্চ, ১৯৬৬ সিলেটে দুই দিনব্যাপী জেলা আওয়ামী লীগ সম্মেলেন অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু সিলেট পৌছান এবং সিলেট রেজিস্ট্রার গ্রাউন্ডে জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বর্তমান মামলাটি দায়ের করা হয়।
সিলেট এসডিও আদালতের এক পরােয়ানাবলে ঢাকার জনৈক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বাধীন একটি পুলিশ দল ২১ এপ্রিল, ১৯৬৬ (বৃহস্পতিবার) রাত নয়টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। এরপর তাঁকে ঢাকার মহকুমা হাকিমের (দক্ষিণ) বাসভবনে হাজির করা হয়। তিনি তাকে সিলেটে প্রেরণের নির্দেশ দেন। সেখান থেকে তাকে পুলিশ প্রহরায় সিলেট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় সিলেট মেল ট্রেনটি ঢাকা ত্যাগে এক ঘণ্টা দেরি করে।
৯১

উল্লেখ্য যে, ঢাকার রমনা থানার মামলার (১৬নং মামলা) আসামি হিসেবে যশােরের মহকুমা হাকিমের নির্দেশক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান এই দিন ঢাকার মহকুমা হাকিমের (দক্ষিণ) আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তার জামিনের আবেদন নাকচ করেন। পরে ঢাকার সেশন জজের কাছে জামিনের আবেদন করা হলে তিনি উক্ত আবেদন মঞ্জুর করেন।
পরে রাত্রি নয়টায় জনৈক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সিলেটের মহকুমা হাকিমের এক পরােয়ানাক্রমে শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের জন্য তার বাসভবনে আসেন। খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ কর্মকর্তা ও কর্মীবৃন্দ ছাড়াও তার বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীরা বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের (দক্ষিণ) সামনে হাজির করে। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে সিলেটে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
গ্রেফতারি পরােয়ানা থেকে জানা যায়, ১৮ এপ্রিল, ১৯৬৬ তারিখে সিলেটের মহকুমা হাকিমের আদালতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১৫৩ক, পূর্ব পাকিস্তান নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের ৭(৩) ও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৪৭(১) ধারাবলে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করেন।(১৮৫)
১৪ মার্চ, ১৯৬৬ সিলেটে প্রদত্ত যে বক্তৃতার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে তার সারাংশ নিম্নরূপ (তৎকালীন পত্রপত্রিকা থেকে সংগৃহীত)(১৮৬):
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান আজ বলেন যে, কেন্দ্রীয় রাজধানীর জল, স্থল ও বিমান বাহিনীর সদর দফতর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অপরাপর সুযােগ-সুবিধা পূর্ব পাকিস্তানে থাকিলে পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত নেতৃবৃন্দ ৬ দফায় উত্থাপিত দাবি অপেক্ষা অনেক বেশি দাবি করিয়া বসিতেন। আজ অপরাহ্নে স্থানীয় রেজিস্ট্রি অফিস ময়দানে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা উপরােক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের কল্যাণের জন্য কোনাে দাবি পেশ করিলেই উহাকে ধ্বংসাত্মক কাজ বলিয়া অভিহিত করা হয়। এমনকি, শেরেবাংলা বা সােহরাওয়ার্দীর মতাে নেতাও এই অভিযােগ হইতে রেহাই পান নাই।
জনাব মুজিবুর রহমান বলেন যে, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদে একের পর এক তিন-তিনবার রাজধানী নির্মাণ করা হইয়াছে। সশস্ত্র বাহিনীর ৩টি বিভাগের সদর দফতরও পশ্চিম পাকিস্তানে অথচ গত যুদ্ধে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায় না। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক একাডেমি, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি প্রভৃতিসহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তােলা দরকার এবং এখান হইতে সেনাবাহিনীতে লােক ভর্তি করা প্রয়ােজন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান তখনই শক্তিশালী হইবে যখন ইহার দুইটি অঞ্চল। সমানভাবে শক্তি অর্জন করিবে এবং সকল ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হইবে।
অর্থনৈতিক নীতিসহ বক্তৃতায় ৬ দফার বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি ধনিক শ্রেণির অর্থনৈতিক শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার আহ্বান।
…………………………………………
১৮৫. ইত্তেফাক, ২২ এপ্রিল, ১৯৬৬।
১৮৬. ইত্তেফাক, ১৬ মার্চ, ১৯৬৬।
———————————————-
৯২

জানান। জনগণের প্রতি শােষণের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামের আহ্বান জানাইয়া তিনি বলেন যে, ৬-দফা তথা ১০ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করিবেন না। সভায় তিনি গত ১৮ বৎসর ধরিয়া কেন্দ্রীয় অর্থের অসম বণ্টনের ব্যাখ্যা করেন।
বর্তমান লেভী নীতির সমালােচনা করিয়া তিনি বলেন যে, যেখানে পূর্ণ রেশন ব্যবস্থা নাই, সেখানে বাধ্যতামূলক লেভী ধার্য করা যায় না। তিনি বলেন যে, গত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান হইতে সংগৃহীত আড়াই কোটি টাকা গভর্নর প্রেসিডেন্টের হাতে তুলিয়া দিয়াছেন। অথচ তিনি সামরিক ব্যবস্থা গড়িয়া তােলার কথা চিন্তাও করিলেন না।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি এক শ্রেণির গুণ্ডা ছাত্র কর্তৃক মহল বিশেষের পৃষ্ঠপােষকতায় শিক্ষাজীবনে অরাজকতা সৃষ্টির নিন্দা করেন। ৬-দফার সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাইয়া শেখ মুজিব বলেন যে, জনগণ ঐক্যবদ্ধ না হইলে নেতাদের ঐক্যে কোনাে লাভ হইবে না। জনগণ ঐক্যবদ্ধ
থাকিলে নেতাগণ বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহসই পাইবে না।
২২ এপ্রিল, ১৯৬৬ (শুক্রবার) সিলেট মহকুমা হাকিমের এজলাসে শেখ মুজিবুর রহমানের জামিনের আবেদন করা হলে মহকুমা হাকিম জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন এবং তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করেন। মহকুমা হাকিমের নির্দেশ মােতাবেক শেখ মুজিবকে বেলা দেড়টায় জেলহাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ দিন সময় না থাকায় সেশন জজের কাছে শেখ মুজিবের জামিনের আবেদন পেশ করা সম্ভব হয়নি। তাই ২৩ এপ্রিল, ১৯৬৬ (শনিবার) সিলেটের দায়রা জজের এজলাসে বেলা ১১টায় জামিনের আবেদন পেশ করা হয়।(১৮৭)
সিলেটের দায়রা জজ তাঁকে জামিন প্রদান করেন। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ তাকে সঙ্গে সঙ্গে আবার অন্য একটি মামলায় (মামলা-২৭) গ্রেফতার করে। তাকে আবার সিলেটে এসডিওর আদালতে হাজির করা হয়। তাঁর পক্ষে জামিন চাওয়া হয় কিন্তু তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি। বরং এ দিন সন্ধ্যায়ই পুলিশ প্রহরায় ট্রেনযােগে তাঁকে সিলেট থেকে ময়মনসিংহ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সিলেট মামলায় ১৩ ও ১৪ জুন, ১৯৬৬ সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এই তারিখে ও পরবর্তী অন্যান্য সময়ে এই মামলার আর কোনাে অগ্রগতি সম্বন্ধে জানা যায় না। এর মূল কারণ হলাে সরকার ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযােগে ২১ নম্বর মামলাটি দায়ের করেছে। ফলে, এই মামলাটির উপর আর জোর দেওয়া হয়নি।
————————————–
১৮৭. ইত্তেফাক, ২৩ এপ্রিল, ১৯৬৬।
——————————
৯৩

মামলা-২৭
ময়মনসিংহে বক্তৃতার বিরুদ্ধে মামলা, ১৯৬৬
২২ এপ্রিল, ১৯৬৬ (শুক্রবার) সিলেটের মহকুমা হাকিমের আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের জামিনের আবেদন বাতিল হওয়ার পর ২৩ এপ্রিল, ১৯৬৬ (শনিবার) সেশন জজ তার জামিন মঞ্জুর করলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হয়নি। সিলেটের কারাগার থেকেই ময়মনসিংহের এক গ্রেফতারি পরােয়ানাবলে পুলিশ শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেফতার করে বেলা ২টার দিকে এক নাটকীয় পরিবেশে ট্রেন স্টেশনে নিয়ে যায়। সেশন জজের আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন পেশের প্রস্তুতি গ্রহণের আগেই পুলিশ তাঁকে নিয়ে আখাউড়াগামী ট্রেনযােগে ময়মনসিংহের পথে রওনা দেয়। স্থানীয় ব্যক্তিদের মতে, এ দিন ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের (২.৩০ মি.) ১৫ মিনিট আগে বেলা সােয়া দুইটায় সিলেট ত্যাগ করে।
উল্লেখ্য, ১১ মার্চ ১৯৬৬, বঙ্গবন্ধু ময়মনসিংহ সফর করেন এবং ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। এই ভাষণের বিরুদ্ধে বর্তমান মামলাটি দায়ের করা হয়।
২৪ এপ্রিল, ১৯৬৬ (রবিবার) সকাল ৯টায় ময়মনসিংহ সদর মহকুমা হাকিমের বাসভবনে শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজির করা হয়। এসডিও অভিযুক্ত পক্ষের বক্তব্য শুনে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শুনানি স্থগিত রাখেন। বিকেল ৪টায় তিনি জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
২৫ এপ্রিল, ১৯৬৬ (সােমবার) ময়মনসিংহের জেলা ও দায়রা জজের আদালতে তার জামিনের আবেদন পেশ করা হয়। বেলা ১২টার সময় ময়মনসিংহ সেশন জজ শেখ মুজিবের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। বেলা পৌনে তিনটার সময় তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন। (১৮৮)
মুক্তিলাভের পর মােটরযােগে রওনা দিয়ে সন্ধ্যা প্রায় ৭টায় তিনি ঢাকা উপস্থিত হন। তাঁর জামিন লাভের সংবাদ পেয়ে তেজগাঁও ফার্মগেটে বিপুলসংখ্যক জনতা তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সমবেত হন। শেখ মুজিবের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হর্ষধ্বনিতে জনতা ও কর্মীরা তাঁকে অভিনন্দন জানান এবং মাল্যভূষিত করেন।
তিনি সমবেত জনতাকে লক্ষ করে ৬ দফা দাবি আদায়ের জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। শেখ মুজিব আরও বলেন, অত্যাচার-উৎপীড়ন দিয়ে আমাদের দমাইয়া দেওয়া যাবে না। ৬-দফা আদায়ের সংগ্রাম চলতেই থাকবে। ৬-দফা আদায়ের জন্য তিনি জনসাধারণকে দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তােলার আহ্বান জানান। তিনি ৬-দফাকে এ দেশের মানুষের মুক্তির সনদ বলে অভিহিত করে বলেন যে, দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এই ৬-দফার উপর নির্ভর করছে। কয়েক দিন হাজতবাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, জনতার দাবি আদায়ের জন্য সারা জীবন তিনি জেলে থাকতে রাজি আছেন।(১৮৯)
——————————–
১৮৮ ইত্তেফাক, ২৫ এপ্রিল, ১৯৬৬।
১৮৯ ইত্তেফাক, ২৬ এপ্রিল, ১৯৬৬।
————————-
৯৪

মামলা-২৮
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৮ ( ১৯০)
পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়, কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযােগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি অপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেস বিজ্ঞপ্তি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রবিরােধী, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী এক ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভারতীয় সহায়তায় এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তালিকায় দেখা যায় এদের মধ্যে দুজন সিএসপি অফিসার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পিআইএ এবং ইপিআর-এর কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতা রয়েছেন। প্রেস নােটে আরও বলা হয়, এদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। এই উদ্দেশ্যে তারা ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সেক্রেটারি ও আগরতলায় কর্মরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন।
১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে আর এক ঘােষণায় অভিযােগ করা হয়, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে সরকারের কাছে প্রমাণ আছে।
শেখ মুজিব ১৯৬৬ সাল থেকেই দেশরক্ষা আইনে একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে বন্দি ছিলেন। ৬ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে ইতােমধ্যে তিনি পূর্ববাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ধারণা ছিল, এসব ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করলে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক উত্থান প্রচেষ্টা বন্ধ করা যাবে এবং গণসমর্থনও সরকারের পক্ষে চলে আসবে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দেশদ্রোহিতা, মিউটিনি বা বিদ্রোহ করার অভিযােগে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১ক ধারা ও ১৩১ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। ট্রাইব্যুনালকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যবিধিতে কিছু সংশােধনও আনা হয়।(১৯১) রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নামে এই মামলাটি দায়ের করা হয়।
১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ছােট্ট একটি কক্ষে অতি সুরক্ষিত ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার মধ্যে মামলার বিচারকার্য শুরু হয়। পরদিন থেকে দেশের বিভিন্ন দৈনিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে মামলাটির সংবাদ পরিবেশিত হতে থাকে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল কোনাে না কোনােভাবে গ্রেফতারকৃতদের প্রতি গণবিদ্বেষ জাগিয়ে তােলা এবং তাদের ফাঁসি প্রদান করা।
————————————-
১৯০. সাহিদা বেগম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র), বাংলা একাডেমি, জুলাই ২০১৯, পৃ. ২১-৩৩।
১৯১. ফৌজদারি আইন সংশােধনী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯-এর ৪ ধারা অনুযায়ী ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল জারিকৃত বিজ্ঞপ্তি নং এমআর ও ৫৯(আর), ৬৮-বলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নামে এই মামলা শুরু হয়। দ্র. দৈনিক পাকিস্তান, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, ১০ ফায়ূন ১৩৭৫, পৃষ্ঠা-১, কলাম-৮।
—————————————–
৯৫

মামলা দায়ের করার এক বছর আগে থেকে শেখ মুজিবসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষে সাক্ষী দেওয়ার জন্য গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের উপর নৃশংস দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানাে হয়। বিনা বিচারে এক বছর ধরে আটক দু-একজন অভিযুক্তের পক্ষে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়েরের পর জনসাধারণ প্রথম সরকারের এই গােপন গ্রেফতার ও নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারেন। এমনকি শুরুর দিকে বন্দিরা কোথায় আছেন সে ব্যাপারেও কোথাও কোনাে তথ্য জানানাে হয়নি। কারাগার থেকে সরিয়ে বন্দিদের তখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর সামরিক হেফাজতে রাখা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন বিচারকার্য শুরু হলে বন্দিদের সম্পর্কে তাদের আত্মীয়স্বজন জানতে পারেন।
তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক বা চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এস. এ. রহমান। অন্য দুজন বিচারক ছিলেন এম. আর. খান ও মুকসুম-উল হাকিম।
ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের পক্ষে মােট ছাব্বিশজন আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই ট্রাইব্যুনালের গঠন ও এর কাজকর্মের (প্রসিডিংস) বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে শেখ মুজিবের পক্ষে একটি রিট পিটিশন দায়েরে করা হয়েছিল (মামলা নং-২৯ দ.)। রিট পিটিশন শুনানির জন্য ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল প্রখ্যাত আইনজীবী ও সিনেট সদস্য টমাস উইলিয়ামস কিউ.সি.-কে।।
মামলার অগ্রগতি এবং ট্রাইব্যুনালের প্রতিদিনের কার্যবিররণী দৈনিক পত্রিকাগুলােতে ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ায় মামলাটির ব্যাপারে জনমনে প্রচণ্ড আলােড়ন তৈরি হয়। দুরভিসন্ধিমূলক এই মামলার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গণআন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে সারা দেশে প্রচণ্ড গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র বাঙালি জনগােষ্ঠী এক অখণ্ড জাতিসত্তায় পরিণত হয়। ঢাকাসহ প্রধান প্রধান শহরগুলােতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস প্রায়শই বর্জন করা হয়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন মিছিল-মিটিংয়ে সশস্ত্র পুলিশ ও ইপিআর-এর সাথে ছাত্র-জনতার খণ্ডযুদ্ধ চলছিল। বিচলিত সরকার অনেক ক্ষেত্রে ঘন ঘন কারফিউ ঘােষণা করে। কিন্তু কারফিউ দিয়েও জনতার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। এই উত্তপ্ত ও ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তান সরকার আশঙ্কা করছিল যে, এমনকি ক্যান্টনমেন্টও আক্রান্ত হতে পারে।
১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক)(১৯২) ‘জাতীয় বিক্ষোভ দিবস’ আহ্বান করে। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বটতলায় সর্বদলীয় ছাত্র সভা শেষে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল বের করে। ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও লালপানি নিক্ষেপ করে। চরম বিপর্যয়মূলক ঘটনা ঘটে ২০ জানুয়ারি। ছাত্র মিছিলের উপর জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর ছাত্রনেতা আসাদকে লক্ষ করে রিভলবার উঁচিয়ে গুলি করে। আসাদ নিহত হন। আরাে অনেক ছাত্র আহত হন। আসাদুজ্জামানের নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলাে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সমগ্র পূর্ববঙ্গে উত্তেজনা প্রবলতর হয়ে উঠে। জরুরি অবস্থা জারি থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মিছিল দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য সরকার আরাে মারমুখী হয়ে ওঠে। বেপরােয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণহানি ঘটে আরাে নিরপরাধ ব্যক্তির। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার কার্যক্রম প্রায় নস্যাৎ হওয়ার উপক্রম হয়।
বিচার চলাকালে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের রাখা হয়েছিল সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার্স মেসে ও অদূরে থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভােরে দায়িত্বরত গার্ডের অনুমতি নিয়ে সার্জেন্ট
—————————————
১৯২. DAC = Democratic Action Committee.
—————————–
৯৬

জহুরুল হক (১৭ নম্বর অভিযুক্ত) ও ফ্লাইট সার্জেন্ট মােহাম্মদ ফজলুল হক (১১ নম্বর অভিযুক্ত) তাদের কক্ষ থেকে বের হন। সামান্য কিছুদূর এগােনাের পর মাত্র সাত ফুট দূর থেকে লুকিয়ে থাকা একজন গার্ড তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সারা পূর্ববাংলায় গণআন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযােগ করে। এই মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস. এ. রহমানের সরকারি বাসভবনেও অগ্নিসংযােগ করা হয়।
পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৭ ফেব্রুয়ারি বিরােধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে একটি গােলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন। তবে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (ডাক) বৈঠকে প্রেসিডেন্টের সাথে আলােচনায় বসার পূর্বশর্ত হিসেবে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি করা হয়। আইয়ুব খানের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, প্যারােলে মুক্তি নিয়ে শেখ মুজিব গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দিতে পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব এই প্রস্তাবে রাজি হননি।
সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলায় যে-আগুন জ্বলে ওঠে, তারই এক পর্যায়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা এবং আহত হন আরাে তিন শিক্ষক। এসব নৃশংস ঘটনার কারণে পূর্ববঙ্গের উপরে সরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আশায় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ আইয়ুব খান প্রবল গণআন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবকে মুক্তি প্রদান করতে বাধ্য হন।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিপ্রিয় জনতার পক্ষ থেকে রেসকোর্স ময়দানে এক গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক পর্ববাংলার জনগণে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দানের প্রস্তাব করলে সমবেত জনসমুদ্র বিপুল করতালিতে তা সমর্থন করেন। শেখ মুজিব বাংলাদেশের গণমানুষের আন্দোলনের অপ্রতিহত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
উল্লেখ্য, এই মামলার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাইব্যুনালের সামনে একটি জবানবন্দি পাঠ করেছিলেন। সেই জবানবন্দি আগরতলা মামলায় প্রদত্ত শেখ মুজিবের জবানবন্দি’ নামে বিখ্যাত। এতে একটি অধিকারবঞ্চিত ও শােষিত জনগােষ্ঠীর নেতা হিসেবে তিনি আদালতের সামনে তাঁর ব্যক্তিপরিচয়, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচির সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কোনাে অপরাধের কারণে নয়, বরং এ দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার অর্জনের আন্দোলনে শরিক হয়ে তাঁকে যে নজিরবিহীন কারাভােগ ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সেসবের মর্মস্পর্শী দৃশ্য ফুটে উঠেছে এই জবানবন্দিতে। তাই এটি রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অনবদ্য দলিলের মর্যাদা লাভ করেছে। সম্পূর্ণ জবানবন্দিটি এই বইয়ের একটি আলাদা অধ্যায় হিসেবে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে।
৯৭

মামলা-২৯
আগরতলা মামলার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ, ১৯৬৮(১৯৩)
১৯৬৮ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আগরতলা মামলার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ মুজিব ঢাকা হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯ জুন থেকে ট্রাইব্যুনালে আগরতলা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। যখন এই রিট দায়ের করা হয় তখন মামলায় সরকারপক্ষের তিন নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে।
উপরােক্ত রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি জনাব বি. এ. সিদ্দিকী ও বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার এবং মেজর এ. বি. এম. নাসেরের প্রতি রুল জারি করেন। রুলে বলা হয়, কেন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে বেআইনি ও এখতিয়ারবহির্ভূত বিধায় অবৈধ ও আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর বলে ঘােষণা প্রদানপূর্বক এর কার্যক্রম বাতিল ও আবেদনকারীকে মুক্তির নির্দেশ প্রদান করা হবে না। বিচারপতিদ্বয় ১৪ তারিখের মধ্যে প্রতিবাদীদের রুলের জবাব প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন। রিট মামলার আবেদনকারী হিসেবে শেখ মুজিব যেসব যুক্তির (গ্রাউন্ড) ওপর নির্ভর করে হাইকোর্টে এই রিট আবেদনে দায়ের করেন সেগুলাে হলাে :
১. তিনি দেশের সর্ববৃহৎ বিরােধীদল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁকে, ১৯৬৬ সালের মে মাসে দেশরক্ষা আইনের ৩২ নং বিধিবলে গ্রেফতার করা হয়।
২. জনসভায় বক্তৃতা দানের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় প্রায় দশটি মামলা দায়ের করা হয়। অনুরূপ একটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন এবং বাকি মামলাগুলাে বিচারাধীন। একটি মামলা জনৈক বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন ছিল এবং গত ২৩ জানুয়ারি উক্ত মামলার রায় প্রদানের দিন ধার্য ছিল।
৩.আবেদনকারী উক্ত মামলার ফলাফল সম্পর্কে এখনও অবহিত নন। আবেদনকারী দেশরক্ষা আইনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। গত জানুয়ারি মাসের ১৭/১৮ তারিখে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সদর দরজায় অবস্থিত জেল অফিসে আনা হয় এবং ১৭ জানুয়ারি তারিখ সম্বলিত একটি আদেশ তার উপর জারি করা হয়। উক্ত আদেশ ছিল দেশরক্ষা আইনে আবেদনকারীর মুক্তি সম্পর্কিত। মুক্তির আদেশ থাকা সত্ত্বেও আবেদনকারীকে তখন কিংবা পরে প্রকৃতপক্ষে এক সেকেন্ডের জন্যও মুক্তি প্রদান করা হয়নি।
৪. অতঃপর আবেদনকারী লেফটেন্যান্ট শরীফের নেতৃত্বাধীনে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কতিপয় ব্যক্তিকে জেলগেটের সামনে অপেক্ষমাণ দেখতে পান। উক্ত ব্যক্তিরা জোরপূর্বক তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। আবেদনকারী উপরােক্ত ব্যক্তিদের নিকট তাঁর আটক সম্পর্কে জারিকৃত আদালতের আদেশ দেখানাের জন্য বলেন। কিন্তু আবেদনকারীর উপর কোনােরূপ আদেশ জারি হয়নি কিংবা কোনাে আদেশ তাঁকে প্রদর্শন করা হয়নি।।
—————————————-
১৯৩ . সাহিদা বেগম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র), বাংলা একাডেমি, ২০০০ (পুনর্মুদ্রণ ২০১৯), পৃ. ৫৭-৬০।
—————————————-
৯৮

৫. জানুয়ারি মাসের ১৭/১৮ তারিখের রাত্রিবেলা থেকে আবেদনকারীকে একটি নির্জন ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঘরের জানালাগুলিতে লাল রং দেওয়া হয়। ফলে তিনি দিনের আলাে থেকে বঞ্চিত। নির্জন ঘরে বন্ধ থাকার কারণে বহির্জগতের সঙ্গে তার যােগাযােগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। উক্ত সময়ে বই ও সংবাদপত্র পাঠ এবং রেডিও শ্রবণ করা থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়।
৬. উক্ত সময়ে আবেদনকারীকে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা তার আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযােগও প্রদান করা হয়নি। উক্ত সময়ে শুধু প্রহরী এবং সামরিক অফিসারদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও যােগাযােগ ছিল। আবেদনকারীকে নির্জনে রেখে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা প্রদান করা হয়। আবেদনকারীর বিরুদ্ধে কী অভিযােগ, তা তাঁকে অবগত করা হয়নি এবং তাঁর সঙ্গে বর্ণিত ব্যবহার করা হয়।
৭. ১৯ জুন তারিখে আবেদনকারীকে ফৌজদারি আইন সংশােধনী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্স মােতাবেক গঠিত কুর্মিটোলাস্থ বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করা হয়। আবেদনকারীকে ভারত কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্রের দ্বারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গকে বিচ্ছিন্নকরণের মাধ্যমে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিদ্রোহে উসকানি প্রদান করার দায়ে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১(ক) ও ১৩১ ধারা মােতাবেক অভিযুক্ত করা হয়। উপরােক্ত অপরাধ ১৯৬৪-১৯৬৭ সময়কালে সংগঠিত হয় বলে অভিযােগ করা হয়। যদিও ১৭/১৮ জানুয়ারি তারিখে উপরােক্ত ফৌজদারি আইন সংশােধনী অর্ডিন্যান্স জারি হয়নি, তারপরও আবেদনকারীকে সেনাবাহিনীর হেফাজতে রাখা হয়।
৮. সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে হাজির করার মাত্র কয়েক দিন আগে ষড়যন্ত্রের উপরােক্ত অভিযােগসমূহ আবেদনকারীকে জানানাে হয়। আবেদনকারী দাবি করেন যে, তিনি নির্দোষ এবং তিনি কখনই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ কিংবা সেনাবাহিনীর কোনাে ব্যক্তিকে বিদ্রোহ করা সম্পর্কে প্রলুব্ধ করেননি।
৯. আবেদনকারী বলেন যে, অপরপক্ষে তিনি গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে যথাযথ ভূমিকা
পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে গােপনে নয়, বরং প্রকাশ্যে এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে বহু সংস্কারের পক্ষে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর সেসব বিবৃতি পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ছয় দফায়
স্থান পেয়েছে।
১০. অভিযােগে দেখা যায় যে, তাঁর কার্যাবলি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে সংঘটিত। যখন আবেদনকারী তথাকথিত আপত্তিকর্মে লিপ্ত ছিলেন তখনকার প্রচলিত আইন মােতাবেক বিচারের অধিকার তার রয়েছে। পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ ও মামলাকে আবেদনকারীর পক্ষে অসুবিধাজনক করা হয়েছে। আবেদনকারীকে যখন জোরপূর্বক সেনাবাহি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন শাসনতন্ত্র মােতাবেক পাকিস্তানের একজন নাগরিক হিসেবে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য সম্পর্কিত আইন (এভিডেন্স অ্যাক্ট) অনুযায়ী তথাকথিত অভিযােগের দায়ে বিচারাধীন ঘােষণা করা যেতাে (কিন্তু তা না করে তাঁকে সামরিক হেফাজতে আটক রাখা হয়েছে)।
১১. উপরােক্ত ফৌজদারি আইন সংশােধনী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্স (১৯৬৮) জারি হওয়ায় তিনি
প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পর্কিত ফৌজদারি কার্যবিধির ষােড়শ অধ্যায়ের ষষ্ঠ অংশে প্রদত্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির করা এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন।
১২. সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স কেন্দ্রীয় সরকারকে বিচারের স্থান নির্দিষ্ট করার অধিকার দিয়েছে। উক্ত বিধানের ভিত্তিতে ঢাকা শহর থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে বিচারের স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে, অভিযুক্তর আইনজীবীদের এবং পরিবারের সদস্যদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
৯৯

১৩. সাক্ষ্য সম্পর্কিত আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে যা আগে সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হওয়ার ব্যাপারে আইনসিদ্ধ ছিল না, তা এখন আইনত গ্রাহ্য বা গ্রহণযােগ্য করা হয়েছে।
১৪. উক্ত অর্ডিন্যান্সের ফলে সংশ্লিষ্ট অভিযােগের শাস্তি কঠোর করা হয়েছে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির উনত্রিশ অধ্যায় ও চতুর্থ খণ্ডের প্রয়ােগকে বারিত ও অপ্রযােজ্য করা হয়েছে।
১৫. সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স ট্রাইব্যুনালের রায়কে চূড়ান্ত করেছে এবং আপিল ও পুনর্বিচারের অধিকার হরণ করেছে।
১৬. সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স সামরিক কর্তৃপক্ষকে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবেদনকারীকে অন্তরীণ এবং রাজসাক্ষীদের তাদের হেফাজতে রাখার এখতিয়ার প্রদান করেছে।
১৭. সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে জামিনে মুক্তিলাভের অধিকার থেকেও আবেদনকারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
১৮. আবেদনকারীর পক্ষে আরাে অভিযােগ করা হয় যে, সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স শাসনতন্ত্রের ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। উক্ত অর্ডিন্যান্সকে অতীতে ঘটে যাওয়া কাজ বা বিষয়ের উপর প্রযােজ্য ঘােষণা করা হয়েছে, যা শাসনতন্ত্রের ২ ও ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
আবেদনকারীর অভিযােগের যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উপরােক্ত বিচারপতিদ্বয় সংশ্লিষ্ট রিট আবেদনটি প্রাথমিক শুনানির পর গ্রহণ করেন এবং ১ ও ৩ নম্বর প্রতিবাদীদের উপর কারণ দর্শানাের জন্য রুল জারি করেন।
উপরােক্ত বিচারপতিদ্বয় উক্ত মামলার শুনানির সময় পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল ও পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভােকেট জেনারেলকে উপস্থিত থাকার জন্যও এক আদেশ দিয়েছেন। আবেদনকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন জনাব টমাস উইলিয়ামস, কিউ. সি. ও জনাব আমীর-উল ইসলাম এবং তাদের সাহায্য করেন জনাব মইনুল হােসেন ও জনাব মওদুদ আহমেদ।
শেষ পর্যন্ত এই রিট আবেদনটির চূড়ান্ত শুনানি হয়নি। গণআন্দোলনের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সরকার আগতরলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ঘােষণাপূর্বক প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ফলে, এই রিটের চূড়ান্ত শুনানির প্রয়ােজন আর হয়নি।।

মামলা-৩০
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার অভিযােগে মামলা, ১৯৭১
[এই মামলার বিস্তারিত কার্যক্রম এই স্মারকগ্রন্থের আলাদা একটি অধ্যায়ে (পৃষ্ঠা ১০৯) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট অধ্যায়টি দ্রষ্টব্য]।
১০০

আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর জবানবন্দি(১৯৪)
স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে।
স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, এর ফলে, ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিলাে এবং এখনও সেই একটি নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান।
১৯৫৪ সালে আমি প্রথম প্রাদেশিক পরিষদে এবং পরে জাতীয় বিধান সভায় সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ করি। অধিকন্তু আমি গণচীনে প্রেরিত বিধান পরিষদের এক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব লাভ করি। জনসাধারণের কল্যাণার্থে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরােধীদল গঠন করার জন্য আমাকে ইতিমধ্যে কয়েক বৎসর কারা নির্যাতন ভােগ করিতে হইয়াছিল।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতে বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় দেড় বৎসরকাল বিনা বিচারে আটক রাখে। আমাকে এইভাবে আটক রাখাকালে তাহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করে, কিন্তু আমি ঐ সকল অভিযােগ হইতে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। ১৯৫৯-এর ডিসেম্বরে কিংবা ১৯৬০-এর জানুয়ারিতে আমাকে উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তিলাভকালে আমার উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয়। যেমন : ঢাকা ত্যাগ করিলে আমাকে গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরেও একইভাবে সে বিষয় তাহাদিগকে অবগত করাইতে হইবে। গােয়েন্দা বিভাগের লােকেরা এই সময় সর্বদা ছায়ার মতাে আমার পিছু লাগিয়া থাকিত।
অতঃপর ১৯৬২ সালে দেশের বর্তমান শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়, তখন আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সবলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং ছয় মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং আমরা সম্মিলিত বিরােধী দলের অঙ্গদল হিসাবে
————————————————–
১৯৪ ফয়েজ আহমদ, আগরতলা মামলা : শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ, সাহিত্য প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ আগস্ট ২০০৬, পৃ. ১২৫-১২৬।
——————————————
১০৩

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরােধীদল এই সময় প্রেসিডেন্ট পদে জনাব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে মনােনয়ন দান করে।
আমরা নির্বাচনী অভিযান শুরু করি। সরকারি কর্তৃপক্ষও পুনরায় আমার বক্তৃতা সম্পর্কে কয়েকটি মামলা দায়ের করিয়া আমাকে মিথ্যা বিরক্ত ও লাঞ্ছিত করিতে থাকে।
১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।
যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে।
যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলাে।
আমি তাসখন্দ ঘােষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম। কারণ আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে আস্থাবান। আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল আন্তর্জাতিক বিরােধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত।
১৯৬৬ সালের গােড়ার দিকে লাহােরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থিত করি। ছয় দফা কর্মসূচিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হইয়াছে।
অতঃপর আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকূলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয় দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়।
ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী প্রশাসনযন্ত্র আমাকে অস্ত্রের ভাষায়’ ‘গৃহযুদ্ধ’ ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযােগে এক ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি যখন খুলনায় একটি জনসভা করিয়া যশাের হইয়া ঢাকা ফিরিতেছিলাম তখন তাহারা যশােরে আমার পথরােধ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযােগে ঢাকা হইতে প্রেরিত এক গ্রেফতারি পরােয়ানা বলে এইবারের মতাে প্রথম গ্রেফতার করে।
আমাকে যশােরের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলে তিনি আমাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদান করেন। আমি ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসকের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি আমার জামিনে অসম্মত হন কিন্তু মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে আমি সেই দিনই মুক্তি পাই এবং সন্ধ্যা সাতটায় নিজ গৃহে গমন করি। সেই সন্ধ্যা আটটায় পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতার উপর সিলেট হইতে
১০৪

প্রেরিত এক গ্রেফতারি পরােয়ানাবলে আমার বাসগৃহ হইতে আমাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সেই রাত্রেই আমাকে সিলেট লইয়া যায়। পরদিন প্রাতে আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন বাতিল করিয়া আমাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরদিবস সিলেটের। মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন প্রদান করেন। কিন্তু মুক্ত হইবার পূর্বেই পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতা প্রদানের অভিযােগে আমাকে কারা দরজায়ই গ্রেফতার করে। এবারের গ্রেফতারি পরােয়ানা মােমেনশাহী হইতে প্রেরিত হইয়াছিলাে। সেই রাত্রে আমাকে পুলিশ পাহারাধীনে মােমেনশাহী লইয়া যাওয়া হয়। এবং একইভাবে মােমেনশাহীর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিন প্রদানে অস্বীকৃত হন এবং পরে মাননীয় জজ প্রদত্ত জামিনে মুক্তিলাভ করিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি। উপরিউক্ত সকল ধারাবাহিক গ্রেফতারি প্রহসন ও হয়রানি ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হয়।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, সম্ভবত আটই মে, আমি নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি এবং রাত্রে ঢাকায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করি। রাত একটার সময় পুলিশ ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুল’-এর ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেফতার করে। একই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের বহুসংখ্যক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। ইহাদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, প্রাক্তন সহ-সভাপতি জনাব মুজিবর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জনাব জহুর আহাম্মদ। চৌধুরীসহ বহু নেতৃবৃন্দ। ইহার অল্প কয়েক দিন পরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম.এন.এ, প্রচার সম্পাদক জনাব মােমেন এডভােকেট, সমাজকল্যাণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শামসুল হক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য মােল্লা জালালউদ্দিন আহম্মদ এডভােকেট, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম.এন.এ. জনাব আমজাদ হােসেন, এডভােকেট জনাব আমিনুদ্দিন আহম্মদ, পাবনার এডভােকেট জনাব আমজাদ হােসেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব মুস্তফা সারওয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব মহীউদ্দিন আহম্মদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব মােহাম্মদুল্লাহ এডভােকেট ও সংগ্রামী নেতা শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দিন আহম্মদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি জনাব হারুনুর রশীদ, তেজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব আবদুল হাকিম, ধানমণ্ডি আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি জনাব রশীদ মােশারফ, শহর আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সুলতান আহাম্মদ, অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব নূরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগ অস্থায়ী সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান, পাবনার এডভােকেট জনাব হাসনাইন, মােমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব আবদুর রহমান সিদ্দিকীসহ অন্যান্য বহু আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিক নেতাকে পাকিস্তান রক্ষা বিধি ৩২ ধারা (নিষ্ঠুর অত্যাচার) বলে কারান্তরালে। নিক্ষেপ করা হয়। আমার দুই ভাগিনেয়- পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহীদুলকে কারারুদ্ধ করা হয়।
অধিকন্তু পর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাককেও বর্তমান শাসকগােষ্ঠী নিষি৷ করে। ইহার একমাত্র কারণ হইল যে, ইত্তেফাক মাঝে মাঝে আমার প্রতিষ্ঠানের নীতিসমূহ সমর্থন করিত। সরকার ইহার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং ইহার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়াকে দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ রাখিয়া তাহার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। যুগপৎ
১০৫

চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি, চট্টগ্রাম পাের্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহ-সভাপতি ও অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধিবলে অন্ধ কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়।
আমাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন হরতাল আহ্বান করে। প্রদেশব্যাপী এই হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশ প্রায় ৮০০ লােককে গ্রেফতার করে এবং অসংখ্য লােকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মােনেম খান। প্রায়শই তাঁহার লােকজন এবং সরকারি কর্মচারী সমক্ষে উন্মুক্তভাবে বলিয়া থাকেন যে, যতদিন তিনি গদিতে আসীন থাকিবেন ততদিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে। ইহা অনেকেই অবগত আছেন। আটকাবস্থায় কারাকক্ষেই আমাকে বেশ কয়েকবার বিচারালয়ের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। প্রায় ২১ মাস আটক রাখিবার পর ১৯৬৮ সালের জানুয়ারির ১৭/১৮ তারিখ রাত একটার সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয়। এবং কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়ােগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারও সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না। বিশ্ব হইতে সকল যােগাযােগবিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাসকাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযােগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এই মানসিক অত্যাচার সম্বন্ধে যতাে অল্প প্রকাশ করিতে হয় ততই উত্তম।
এই বিচারকার্য শুরু হইবার মাত্র একদিন পূর্বে, ১৯৬৮ সালের ১৮ই জুন, আমি প্রথম এডভােকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করি এবং তাঁহাকে আমার অন্যতম কৌসুলি নিয়ােগ করি।
কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনােবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমতার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা ও নিষ্পেষণ করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।
এই আদালতে আসিবার পূর্বে আমি লেঃ কঃ মােয়াজ্জেম হােসেন, এক্স-কর্পোরাল আমির হােসেন, এল এস সুলতান উদ্দিন আহাম্মদ, কামাল উদ্দিন আহাম্মদ, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ উল্লাহ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী কর্মচারীদের কখনও দেখি নাই। জনাব আহমদ ফজলুর রহমান, জনাব রুহুল কুদ্দুস ও জনাব খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান- এই তিনজন সি.এস.পি অফিসারকে আমি জানি। আমি মন্ত্রী হিসাবে সরকারী কার্য সম্পাদনকালে তাহাদিগকে জানিবার সুযােগ পাইয়াছিলাম এবং তাঁহারাও তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাদের সঙ্গে কখনাে রাজনীতি বিষয়ক আলােচনা করি নাই কিংবা কোনাে ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হই নাই। আমি কোনােদিন লেঃ কঃ মােয়াজ্জেম হােসেনের বাসগৃহে অথবা করাচিতে জনাব কামালউদ্দিনের বাসগৃহে গমন করি নাই কিংবা আমার অথবা লেঃ কঃ মােয়াজ্জেম হােসেনের অথবা করাচিতে জনাব কামালউদ্দিনের বাসগৃহে কোনাে সভা অনুষ্ঠিত হয় নাই কিংবা এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনাে ব্যক্তির সহিত কোনাে আলােচনা আমার অথবা জনাব তাজউদ্দীনের বাসায় সংঘটিত হয় নাই। ঐ সকল ব্যক্তি কোনােদিন আমার গৃহে গমন করে নাই এবং আমিও এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কাহাকেও টাকা দিই নাই। আমি কখনও ডাঃ সাঈদুর রহমান কিংবা মানিক চৌধুরীকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করিতে বলি নাই। তাঁহারা চট্টগ্রামে আমার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শত শত কর্মীদের ন্যায় মাত্র। আমার প্রতিষ্ঠানে তিনজন সহ-সভাপতি, ৪৪ জন কার্যকরী পরিষদ সদস্য, একজন সাধারণ সম্পাদক এবং আটজন সম্পাদক রহিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের
১০৬

অনেকেই প্রাক্তন মন্ত্রী, এম.এন.এ ও এম.পি.এ। বর্তমান কেন্দ্রীয় পরিষদের পাঁচজন ও প্রাদেশিক পরিষদের দশজন সদস্য আমার প্রতিষ্ঠানভুক্ত। চট্টগ্রামেও আমার প্রতিষ্ঠানের জেলা ও শহর সভাপতি ও সম্পাদকগণ; প্রাক্তন এম.এন.এ, এম.পি.এ ও অনেক বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিদ্যমান। আমি তাহাদের কাহারও নিকট কোনাে প্রকার সাহায্যের কথা উল্লেখ করি নাই। ইহা অসম্ভব যে, আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মানিক চৌধুরী ও একজন সাধারণ এল.এম.এফ. ডাক্তার সাঈদুর রহমানকে কোনাে সাহায্যের জন্য অ পারি। ১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব জহুর আহাম্মদ চৌধুরীর বিরােধিতা করিবার জন্য ডাঃ সাঈদুর রহমানকে বরং আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছিলাে। আমি ডাঃ সাইদুর রহমানের গৃহে কদাপি গমন করি নাই।
আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল- দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচি রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্য ন্যায়বিচার চাহিয়াছিলামদফা কর্মসূচিতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্য আমি যাহাই মঙ্গলকর ভাবিয়াছি সর্বদাই তাহা নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগােষ্ঠী এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর শােষণ ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখিতে চায়।
আমার উক্তির সমর্থনে আমি মহামান্য আদালতে আরাে নিবেদন করিতে চাই যে, আমাকে প্রতিহিংসাবশত মিথ্যা এই মামলায় জড়িত করা হইয়াছে। পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ২৮ ব্যক্তির নাম লিপিবদ্ধ ছিলাে এবং উহার মধ্যে আমার নাম ছিলাে না। উক্ত প্রচারপত্রে ইহাও উল্লেখ হইয়াছিলাে যে, সকল অভিযুক্তই অভিযােগ স্বীকার করিয়াছে- তদন্ত প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে- এবং শীঘ্রই বিষয়টি বিচারার্থে আদালতে প্রেরণ করা হইবে।
একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসাবে অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্বরাষ্ট্র বিভাগের উক্ত প্রচারপত্র সম্বন্ধে এ কথা জানাইতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেক্রেটারি কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিলপত্র পরীক্ষিত ও অনুমােদিত হওয়া ব্যতিরেকে কোনাে বিভাগ হইতে কোনাে প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায় না। এবং বিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনাে প্রচারপত্র প্রকাশ করিতে হইলে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমােদন লাভ আবশ্যক।
বর্তমান মামলা উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শােষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রজাল বর্তমান শাসকগােষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য কোনাে কিছু করি নাই কিংবা কোনােদিনও এই উদ্দেশ্যে কোনাে স্থল, নৌ বা বিমান বাহিনীর কোনাে কর্মচারীর সংস্পর্শে কোনাে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়ােগ করি নাই।
আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
১০৭

পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক
বিচার ১৯৭১(১৯৫)
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ ভাের রাত ১.৩০টায় পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।১৯৬ তিন দিন পরে অর্থাৎ ২৯ মার্চ প্লেনে করে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।(১৯৬) উক্ত তিন দিন বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে ঢাকার আদমজী স্কুলে এবং পরে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে আটক রাখা হয়। তাঁকে লায়ালপুর (বর্তমান ফয়সালাবাদ) জেলে রাখা হয়েছিল। তাঁকে অপরিসর একটি কুঠুরিতে রাখা হয়েছিল। তাঁর জগৎ বলতে সেখানে ছিল চার দেয়াল, একটি জানালা ও একটি উঁচু বিছানা। এই জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভালােভাবে ধারণা ছিল, কেননা আগেও তিনি কারাবন্দি ছিলেন। তিনি কারাবাস সম্পর্কে প্রায়শই বলতেন যে, প্রথম দফায় স্বল্পকাল কারাবাস ছাড়া তাঁকে বারবার কারাগারের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রাখা হয়েছিলাে(১৯৭)

বিচার
৩ আগস্ট ১৯৭১ ইয়াহিয়া খান টেলিভিশনে ঘােষণা করেন যে, শেখ মুজিবের বিচার করা হবে এবং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের আইন অনুসারে তার বিচারের ব্যবস্থা হবে। শেখ মুজিব তার নির্বাচনকালীন বক্তব্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে অবস্থান পরিবর্তন করে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা চেয়েছেন। জনগণকে অস্ত্র হাতে নেওয়া ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররােচিত করার জন্য তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী। ইয়াহিয়া বলেন যে, মুজিবের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত কোনাে বিদ্বেষ নেই, তিনি বরং মুজিবের জন্য দুঃখ অনুভব করেন, কেননা কৃতকর্মের সাজা তাে তাঁকে পেতেই হবে।(১৯৮)
এর একদিন আগে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে প্রচারিত এক প্রেসনােটে বলা হয়েছিল যে, “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা” ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে। ১১ আগস্ট রুদ্ধদ্বারকক্ষে বিচারকার্য শুরু হবে এবং এর কার্যবিবরণী গােপন রাখা হবে। অভিযুক্তকে তার পক্ষ সমর্থনের সুষ্ঠু সুযােগ দেওয়া হবে এবং নিজ পছন্দ অনুযায়ী কৌসুলি নিয়ােগের,
———————————————–
১৯৫ উৎস : পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন, আহমেদ সালিম (মফিদুল হক অনূদিত), প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, সাহিত্য
প্রকাশ, পৃ. ৪৬-৬০।
১৯৬ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, (ঢাকা : ভাস্কর প্রকাশনী, ২০০১), পৃ. ৩৩২-৩৩৪, ৩৩৬।
১৯৭. mir Taheri, The Decline and Fall of Sheikh Mujib, 17730 4175, Kayan (International), Theran, 1 August, 1971.
১৯৮ “মুজিব উইল বি পুট অন ট্রায়াল,” ডন, করাচি, আগস্ট ৫, ১৯৭১।
——————————————-
১০৯

অবশ্য এমন কৌসুলিকে হতে হবে পাকিস্তানের নাগরিক, সুযােগসহ আইন অনুযায়ী অন্য সকল সুবিধা প্রদান করা হবে।”(১৯৯)
ভারতের বিদেশমন্ত্রী শরণ সিং এর ত্বরিত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন এবং পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, মুজিবের কোর্ট মার্শাল করা হলে এর পরিণতি হবে গুরুতর। লােকসভায় ভাষণদানকালে শরণ সিং বলেন, “শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক বিচার-অনুষ্ঠান মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং গােটা বিশ্ব দ্বারা নিন্দিত হওয়ার দাবি রাখে।”(২০০) শ্রীমতি গান্ধী চব্বিশটি দেশের কাছে আবেদন জানান শেখ মুজিবের জীবন-রক্ষার্থে কিছু একটা করার জন্য।(২০১) পাকিস্তান সরকারের কাছে দ্বিতীয়বারের মতাে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমেরিকা জানায় যে, শেখ মুজিবের গােপন বিচারের “সংক্ষিপ্ত আয়ােজন” পূর্ববঙ্গের সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের সকল সম্ভাবনা তিরােহিত করবে।(২০২)
জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট বলেন যে, শেখ মুজিবের ভাগ্য পাকিস্তানের বাইরেও প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করতে বাধ্য। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের আশু-বিচার “একটি অতীব সংবেদনশীল ও জটিল বিষয়, যা সদস্য দেশের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার আওতায় পড়ে।” সংবাদ-বিবৃতিতে উ থান্ট বলেন যে, শেখ মুজিবের ভাগ্যে যা ঘটবে তা পাকিস্তানের বাইরে অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে অনেক জাতিসংঘ প্রতিনিধি যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তিনি তা অনুধাবন করতে সক্ষম। তিনি আরাে বলেন যে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ছাড়াও মানবিক বিবেচনায় এই বিচার বিভিন্ন মহলে অসাধারণ আগ্রহ ও উদ্বেগ সঞ্চার করেছে। তিনি জানান যে, পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন বার্তা তিনি পেয়েছিলেন এবং পাচ্ছেন।(২০৩)
জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পিত বিচারের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কমিশনের মহাসচিব অ্যালান ম্যাকডরম্যাট স্বাক্ষরিত এক তারবার্তায় বলা হয়, “আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন সামরিক বিচারের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গােপন কিছু থাকতে পারে না।”(২০৪)
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়ার কারণ বােধগম্য। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা”। এই অনির্দিষ্ট অভিযােগ বারােটি নির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ছয়টির জন্য সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড। বন্দি যদি এর কোনাে একটি অভিযােগেও অগ্রাধী প্রমাণিত হন, তবে তাঁকে ফাঁসিতে ঝােলানাে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানাে যেতে পারে।(২০৫) গােটা বিশ্ব এমন বিষয়কে হাল্কাভাবে নিতে পারে না। আমেরিকানরা নিশ্চয়তা আদায় করতে চেষ্টা করে যে, শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে না। ইয়াহিয়া খান হয়তাে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন কিন্তু মুজিবের বিচারানুষ্ঠান না করা অথবা তাঁকে
——————————–
১৯৯. ট্রায়াল ফর “ওয়েজিং ওয়ার অ্যাগেইনস্ট পাকিস্তান”, ডন, আগস্ট ১০, ১৯৭১।
২০০. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অ্যানাউন্সেস : “আওয়ামী লীগ চিফ টু বি ট্রাইড বাই আর্মি”, ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, আগস্ট ১০, ১৯৭১।
২০১. মুজিবস্ ট্রায়াল বিগিনস্ : ইন্ডিয়া অ্যাপিলস্ টু নেশনস্, ‘স্টেটসম্যান’, আগস্ট ১১, ১৯৭১।
২০২. পূর্বোক্ত।
২০৩. পূর্বোক্ত।
২০৪. পূর্বোক্ত।
২০৫. পূর্বোক্ত।
———————————
১১০

মুক্তিদানে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা তাে দূর অস্ত, যুদ্ধ যদি ভিন্ন পরিণতি লাভ করতাে, ইয়াহিয়া যদি টিকে যেতেন ক্ষমতায়, তবে তিনি দণ্ডাদেশ কার্যকর করে ছাড়তেন।(২০৬)
রাওয়ালপিন্ডি থেকে একশ পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে লায়ালপুরের কারাগারের একটি একতলা লাল ইটের ভবনে আয়ােজিত হয়েছিল বিচার অনুষ্ঠানের। সুচিন্তিতভাবে বাছাই করা হয়েছিল বিচারক ও সাক্ষীদের। অভিযুক্ত শেখ মুজিব আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং আদালত-মনােনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতেও অসম্মতি জানান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন সেসব সাংবাদিক, যারা শেখ মুজিবের বিভিন্ন ভাষণ শুনেছেন। বাংলায় প্রদত্ত মূল ভাষণ অনুবাদ করা হয়েছিল উর্দুতে। বিচারকরা মনােযােগ সহকারে নােট নেন। অভিযুক্ত ছিলেন নীরব। বিচার ছিল একটা প্রহসন, কেননা রায় তাে আগেই তৈরি করা ছিল।২০৭ এমন কি ইয়াহিয়া খান এমন ইঙ্গিত দেওয়াও শুরু করেছিলেন যে, ১১ আগস্ট থেকে মুজিবের বিচার চলছে এবং তাঁর সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড হবে। সামরিক জান্তা মুজিবকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিল এবং বিচারের ফলাফল ও আদালতের রায় আগে থেকেই তাদের জানা ছিল।(২০৮)
লায়ালপুরে ১৭ আগস্ট দিনটি ছিল গুমােট। তাঁর সেলে শুয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাপদগ্ধ মেঘবিহীন আকাশ থেকে যেন ঝরে পড়ছিল আগুন। একটি বাজপাখি ডানা মেলে কী সহজভাবে উড়ে বেড়াচ্ছিল আকাশে। ছােট্ট জানালার শক্ত শিকের ফাঁক দিয়ে বন্দি দেখছিলেন সেই দৃশ্য। নীল আকাশের পটভূমিতে পাখির স্বচ্ছন্দ ওড়াওড়ি উপভােগ করছিলেন বন্দি। প্রায় বিশ মিনিট ধরে আকাশবিহারী বাজপাখিটিকে দেখছিলেন শেখ মুজিব। এক সময় দৃশ্য বদলে গেল। ডানা মেলে পাখির ঝাঁপ দেওয়ার বদলে দেখা দিল শ্মশ্রুমণ্ডিত রক্তচক্ষু এক প্রহরী। ক্ষয়ে-যাওয়া হলদেটে দুর্গন্ধময় দাঁত বের করে তীক্ষ্ণ চোখে বন্দিকে দেখছিল নতুন প্রহরী। তাঁর চোখে-মুখে নিষ্ঠুরতার ভাব। শেখ মুজিব কিছুটা পিছিয়ে এলেন। তাই দেখে সন্তুষ্টির হাসি হাসলাে প্রহরী, এরপর বেরিয়ে গেল নীরবে। ভারি তালা লাগানাের শব্দ হলাে। এটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের সপ্তম দিবস।
লায়ালপুরের লাল ইটের আদালত-ভবনটি মূল কারাগারের লাগােয়া হলেও, বন্দিকে লম্বা সরু করিডাের দিয়ে আদালতে প্রবেশ করতে হতাে। সেখানে ছিল চারটি ভারি লােহার দরজা। প্রতিটি দরজার পাশে সাব-মেশিনগান হাতে যুদ্ধ-পােশাকে সজ্জিত সৈনিকরা দাঁড়িয়ে থাকতাে। সার-বাঁধা বেঞ্চ ও উঁচু প্ল্যাটফর্ম এবং পাকিস্তানি পতাকাসজ্জিত আদালতকক্ষে প্রবেশ করে শেখ মুজিব পুরােপুরিভাবে বিচারকার্য উপেক্ষা করতেন। তিনি না করতেন আত্মপক্ষ সমর্থন, না আক্রমণ করতেন অভিযুক্তদের। তিনি বেছে নিয়েছিলেন নীরবতার অস্ত্র। ব্যবহারের জন্য জটিল এক অস্ত্র। তবে বিভিন্নভাবে বহুবার বিচারের মুখােমুখি হয়ে তিনি এর ব্যবহারে পারঙ্গমতা অর্জন করেছিলেন। বিচারের একেবারে শুরুতে প্রধান বিচারক জানতে চেয়েছিলেন যে, আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি কোনাে বিবৃতি দিতে চান কি না। শেখ মুজিবের জবাব ছিল, “আপনারা যখন আমাকে মেরে ফেলবেন, আমি চাই তারপরে আমার মৃতদেহ যেন আমার প্রিয় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানাে হয়।”
সপ্তম দিনের বিচারকার্য আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার ঠিক আগে উকিল এগিয়ে এসে শেখ মুজিবের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন, “আপনি কি নিজের পক্ষে কোনােই অবস্থান নেবেন না?”
————————————————–
২০৬ হাসান জহির, দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান, করাচি, ১৯৯৪, পৃ. ৩৪৬।
২০৭ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৩, পৃ. ৯৭।।
২০৮ রফিকুল ইসলাম বিইউ (বীর উত্তম), অ্যা টেল অব মিলিয়নস্, ঢাকা ১৯৯৫, পৃ. ৩০৮।
——————————————
১১১

‘না’, শেখ মুজিবের অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ় উত্তর।।
“আমার কাজ জটিল করে তুলছেন আপনি।”
“তা জানি। তবে আমি কী করতে পারি? আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনাে অধিকার এদের নেই। আইনের দিক দিয়ে কোনাে বৈধতা এই আদালতের নেই।”
আদালতের কাজ শুরু হলাে। বিচারকগণ তাঁদের আসন গ্রহণ করলেন। অভিযুক্ত পক্ষের উকিল সামনের সারিতে মাথা নীচু করে বসেছিলেন। সরকারি উকিল কানে কানে কথা বলছিলেন একজনের সঙ্গে। এই ব্যক্তিটি পরে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে বলতে শুনেছিলেন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্র ধ্বংস করা। হৃষ্টপুষ্ট চেহারার ভারি গোঁফের এই সাক্ষী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ভালােভাবেই মহড়া দিয়েছিলেন তিনি এবং তােতাপাখির মতাে আউড়ে যাচ্ছিলেন শেখানাে বয়ান।
পরে অভিযুক্ত পক্ষের উকিলের জেরার সময় সাক্ষী অস্থির হয়ে উঠেন, গুলিয়ে ফেলতে থাকেন দিন-তারিখ এবং স্বীকার করেন যে, শেখ মুজিবের কথিত উক্তির সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না; তার এক বন্ধুর কাছ থেকে এটা শুনেছিলেন এবং সেই বন্ধুর নামও এখন স্মরণ করতে পারছেন না। যেন বহু দূরের কোনাে ঘটনা, এমনভাবে শেখ মুজিব শুনছিলেন আদালতের সওয়াল-জবাব। যেন তিনি এসব নিয়ে একেবারেই সচেতন নন, চোখ বন্ধ করে যেন দেখছিলেন আদিগন্ত নীল আকাশে মুক্ত বাজপাখির স্বাধীন ওড়াওড়ি।(২০৯)
আগস্টের শেষ সপ্তাহে প্রদত্ত ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি সন্দেহের আর বিশেষ অবকাশ রাখেনি যে, এই বিচার ন্যায়ানুগ হবে না এবং সামরিক জান্তা বিচারের রায় আগেই স্থির করে রেখেছে। আদালত কেবল জান্তা-স্থিরীকৃত। রায় পাঠ করে শােনাবে।(২১০)
বিচার সপ্তাহকাল ধরে চললাে এবং প্রতিদিন বিকেল চারটা নাগাদ শেখ মুজিব সেলে ফিরে আসতেন। কখনাে কখনাে অভিযুক্তের পক্ষে নিয়ােজিত কৌসুলিকে তার সঙ্গে দেখা করতে দিতে হতাে। তবে বন্দি প্রায় কখনােই কোনাে কথা বলতেন না। একবার আদালতের কার্যক্রমের বিবরণী তাঁকে দেওয়া হলে তিনি এর ওপরে লেখেন, “সব মিথ্যে”। আরেকবার লিখলেন, “কাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা? আমরা যে নির্যাতিত এটা মনে করাটা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা?”
আগস্টের মাঝামাঝি কোনাে একটা সময় লায়ালপুরের বিচারকার্যের আগের দিনের নথিপত্র দেখতে দেখতে ইয়াহিয়া খান অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, “আচ্ছা, শেখ তাহলে এখনাে কথা বলতে চাচ্ছে না। নীরবতা! ঠিক আছে, এই খেলা আমিও খেলতে জানি। বিচারকদের বলে দাও বিচারকাজ শেষ হয়েছে। আর বন্দিকে ফেরত পাঠাও মিয়ানওয়ালি জেলে। বিচার করা না করায় কিছু আসে যায় না।”(২১১)
১ সেপ্টেম্বর ফরাসি পত্রিকা লা ফিগারাে-কে ইয়াহিয়া খান বলেন, মুজিব হচ্ছে পাকিস্তানের জনগণের শত্রু। ২৯ সেপ্টেম্বর করাচি থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ প্রকাশিত হয় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের প্রেস নােট। তাতে বলা হয়, “বিচার শুরু হয়েছে ১১ আগস্ট, ১৯৭১। আদালত অবশ্য সেদিনই মুলতুবি হয়ে যায়, যাতে করে শেখ মুজিবুর রহমান নিজের পছন্দমতাে কেঁৗসুলি বেছে নিতে পারেন। ৭ সেপ্টেম্বর এ. কে. ব্রোহি ও তাঁর তিন সহকারী গুলাম আলী মেমন, আকবর মীর্জা ও গুলাম হুসেইনের সহায়তা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয় এবং
———————————–
২০৯ রবার্ট পেইন, দি টর্চার্ড অ্যান্ড দি ড্যাড়, চতুর্থ পর্ব, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, মে ২২, ১৯৭৭, পৃ. ৪৬।
২১০ পূর্বোক্ত।
২১১ পূর্বোক্ত।
—————————————
১১২

সরকারপক্ষের সাক্ষীদের জেরা শুরু হয়। অদ্যাবধি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের সমর্থনে সরকারপক্ষীয় ২০ জন সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। জনাব ব্রোহিকে অভিযুক্ত পক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে গ্রহণ করে এ যাবৎ মামলার কাজ অগ্রসর হয়েছে।”(২১২) ২১ সেপ্টেম্বর করাচির ডেটলাইনে প্রচারিত এএফপির খবরেও মামলা চলছে বলে উল্লেখ করা হয়। সরকারি মন্তব্যে দাবি করা হয়, ব্রিটিশ বিচারবিভাগীয় মান অনুসারে মামলা চলছে। এই ভিত্তিতে ‘অধিকতর তথ্য সংগ্রহের কারণে মুলতুবিসহ অন্যান্য বিধিবদ্ধ বিলম্বের অবকাশ রয়েছে। মুখপাত্র আরাে জানিয়েছিলেন যে, মামলা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা তিনি বলতে পারছেন না। খবরে আরাে প্রকাশ পায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে তখনাে জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল এবং উপনির্বাচনের জন্য শূন্য ঘােষিত আসনে তাঁর আসন অন্তর্ভুক্ত ছিল না।(২১৩)
কোনাে কোনাে মহলের মতে, বিচারের ঘােষণা প্রচারকালেও অভিযুক্ত পক্ষের কৌসুলি এ. কে. ব্রোহির মারফত শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা অনুষ্ঠানের চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল এবং আমেরিকানদের অবহিত রেখেই এটা করা হয়েছিল। জি. ডব্লিউ. চৌধুরী বলেছেন যে, উপযুক্ত সময়ে এবং মুখরক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ইয়াহিয়া প্রস্তুত ছিলেন মুজিবকে ছেড়ে দিতে। বাংলাদেশ সম্পর্কিত জ্যাকসন পেপারে হেনরি কিসিঞ্জারের সূত্রে প্রকাশ করা হয়েছে যে, “মুজিবের মুক্তিদান হচ্ছে একান্তভাবে একটি সম্মানরক্ষার সমস্যা।” জ্যাকসন নিজেও বলেছেন, এই মামলা হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের আগে উগ্রপন্থি জেনারেলদের নরম করার লক্ষ্যে একটি লেনদেনমূলক ব্যবস্থা”(২১৪)। ইয়াহিয়া ছিলেন একগুঁয়ে এবং তার শক্ত অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি সরতেও রাজি ছিলেন না। এই সব অপ্রীতিকর কথাবার্তা তার আত্মমর্যাদাকে পীড়িত করছিল এবং মুজিবকে বিশ্বাস না করার জন্য যারা তাকে পরামর্শ দিচ্ছিল তাদের সামনে নিজেকে অপদস্থ ও প্রতারিত মনে করছিলেন। ২৬ মার্চের বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং সেনা অভিযানের পর মুজিবের সঙ্গে আলােচনার সকল সম্ভাবনা বাতিল করেছিলেন। জেনারেল উমরের মতে, “মুজিবের প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের মনােভাব ছিল একেবারেই অনড়। পীরজাদা, যিনি এই মামলা তত্ত্বাবধান করছিলেন, ব্রোহি ছাড়া (যিনি ছিলেন অভিযুক্ত পক্ষের কৌঁসুলি) আর কাউকেও মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেননি। ব্রোহির মাধ্যমে ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলােচনা শুরু করতে চেয়েছিলেন বলে যেসব ধারণার অবতারণা করা হয়েছিল তা সঠিক ছিল না। পরিস্থিতি সামাল দিতে মুজিবের সঙ্গে সমঝােতায় পৌছতে যদি তারা চাইতেন এবং তাঁর সঙ্গে গুরুতর আলােচনা কামনা করতেন তবে প্রেসিডেন্ট আমার [জেনারেল উমর] শরণ নিতেন। এক-দুবার আমি যখন মুজিব সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছি, পীরজাদা বলেছেন, এখানে নাক গলাবেন না।”(২১৫)
পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতৃত্ব নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক জট মােচনে ইয়াহিয়া খান একাধিক জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সমস্যা সমাধানের প্রধান সূত্র ছিলেন মুজিব এবং তাঁকে হাতের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে এই সুযােগ ব্যবহার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছিলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে সেনা অভিযানের কারণে গােটা দেশের জন্য যখন গুরুতর বৈদেশিক হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল, তখন সামরিক জান্তার সামনে ইয়াহিয়ার বদলে আর কাউকে বসানাের চিন্তা দেখা দিয়েছিল কি, এমন কাউকে যিনি মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও তিক্ততা থেকে মুক্ত এবং নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে সক্ষম। জেনারেল উমর স্মরণ করতে পারেন এক-দুবার এমনি প্রশ্ন উঠেছিল।
————————–
২১২ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পেস নােট ডন সেইসব ১১
২১৩ এএফপি বার্তা, ডেটলাইন করাচি, সেপ্টেম্বর ২১, ১৯৭১।
২১৪ হাসান জহির, দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান, করাচি, ১৯৯৪, পৃ. ৩৪৪।
২১৫ পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪৪-৩৪৫।
—————————–
১১৩

“তবে পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাচক্রের অধিকাংশ সদস্য এতে সম্মত ছিলেন না। আমার মনে হয় দেশ যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল তার গুরুত্ব সম্পর্কে এঁদের বেশির ভাগই সচেতন ছিলেন না। ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে কখনােই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সবাই হাল্কাভাবে সবকিছু দেখছিলেন। এটা আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে কেন কেউ ভাবেননি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরিবর্তনের কথা, যা হয়তাে একটা পার্থক্য ঘটাতে পারতাে। ইয়াহিয়া মুজিবকে দেশদ্রোহীরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং সেনাদলে সবাই সেরকমই ভাবতেন। আমি মনে করি না তখন সেনাবাহিনীতে এমন কেউ ছিলেন, অন্তত আমাদের মধ্যে কেউ তাে ননই, যিনি মুজিবের সঙ্গে আলােচনার জন্য গ্রহণযােগ্য হতেন। যাই হােক, পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটেছিল যে, যারা কিছুটা বিকল্প চিন্তা করছিলেন তাঁরাও প্রস্তুত ছিলেন না এগিয়ে এসে ইয়াহিয়ার স্থান গ্রহণ করতে।”(২১৬)
পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রনেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের একটি গােষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে ইয়াহিয়া খানের বরাবর আবেদন করেছিলেন। এতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে ছিলেন তেহরিক-ই-ইশতিকলার নেতা প্রাক্তন এয়ার মার্শাল আসগর খান, লেনিন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, পাকিস্তান সােশ্যালিস্ট পার্টির সভাপতি সি. আ. আসলাম, ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান টাইমসের প্রাক্তন সম্পাদক মাজহার আলী খান, পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি মির্জা ইব্রাহিম প্রমুখ। তারা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাগুলাের সঙ্গে সঙ্গতিকল্পে’ এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী সংকট মােচনের শ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন। বিবৃতিতে বলা হয়, “রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য সামরিক আদালতে অভিযুক্ত শেখ মুজিবের মুক্তি যদি না দেওয়া যায়, তবে অন্তত প্রকাশ্য আদালতে তার যথার্থ বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হােক।” স্বাক্ষরদাতারা বলেন যে, তারা প্রেসিডেন্টের কাছে এই আবেদন জানাচ্ছেন মার্কিন নিউজউইক সাময়িকীকে প্রদত্ত তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের আলােকে, যেখানে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, জাতি দাবি করলে শেখ মুজিবের মুক্তি দিতে তিনি প্রস্তুত রয়েছেন।
অপরদিকে এসব ঘটনাক্রম সম্পর্কে শেখ মুজিব ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরে নিউজউইকের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং-এর কাছে প্রদত্ত প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন পাকিস্তানি কারাগারে তাঁর নয় মাসের অগ্নিপরীক্ষা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে জেড. এ. ভুট্টো কর্তৃক মুক্তি প্রদান।
“এটা যথাযথ কোনাে বিচারই ছিল না। কোর্ট মার্শাল ছাড়া একে আর কিছু বলা যায় না এবং তারা এটা পরিষ্কার করে তুলেছিল যেভাবে পারে আমাকে ফাঁসিতে ঝােলাবে। গােপনে আয়ােজিত বিচারানুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার আর ছিলেন দুইজন কর্নেল, একজন উইং কমান্ডার, একজন নেভাল কমােডর ও একজন জেলা সেশন জজ। মামলা চলেছিল ছয় মাস। এটা ছিল এক প্রহসন। আমি বলেছিলাম আত্মপক্ষ সমর্থন আমি করবো না। আমি তাদের ব্যাখ্যা করেছিলাম যে, যেহেতু ইয়াহিয়া ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তার হুকুমেই এই মামলা, আর যেহেতু তিনি বলেছেন আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছি ও শাস্তি আমার অবশ্য প্রাপ্য, তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করাটা অর্থহীন। আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রশ্নই ওঠে না। আমি আদালতকে বলেছি, ইয়াহিয়াকে বলুন তার যা খুশি তাই করতে। শিগগিরই আমি জানতে পেরেছিলাম গােটা ব্যাপারটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝােলাবার একটা বাহানা মাত্র, দুনিয়াকে কিছু একটা দেখানাের চেষ্টা। তাই আমি তাদের বলেছিলাম, চলে যান আপনারা! আমার এখানে কিছু করার নেই।”(২১৭)
—————————-
২১৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪৬-৩৪৭।
২১৭ ওয়েস্ট পাক ইনটেলেকচুয়ালস্ ওয়ান্ট মুজিবস্ রিলিজ, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, নভেম্বর, ১৯৭১।
——————————-
১১৪

২৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বলেছিলেন যে, সরকার তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কৌসুলি দিয়েছিল, তবে এর কোনাে মানে ছিল না। “আমার পক্ষ নেওয়ার কিছু ছিল না, কেননা এটা ছিল লােক-দেখানাে বিচার, একটি প্রহসনমাত্র। পরে আমি আদালতে উঠে দাঁড়াই এবং বলি, “মাননীয় বিচারক, অনুগ্রহ করে অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীদের চলে যেতে বলুন। কেননা, আপনি জানেন এটা একটা হাস্যকর বিচার। আমি একজন সিভিলিয়ান, আমি মিলিটারির লােক নই। আর ওরা আমার কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা করেছে এবং এটা যিনি পরিচালনা করছেন সেই ইয়াহিয়া খান স্বয়ং হচ্ছেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তিনি হচ্ছেন এই আদালত-গঠনকারী কর্তৃপক্ষ।”
মুজিবের অনুরােধে ব্রোহিকে নিয়ােগ করা হলেও আদালতে ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চের ভাষণের টেপ শােনার পর শেখ মুজিব কোনাে ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়াস নিতে অস্বীকার করেন এবং ব্রোহিকে অব্যাহতি দেন। তিনি বলেন যে, তিনি বুঝেছেন তার ভাগ্য আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। এতদ্সত্ত্বেও অভিযুক্তের কাছ থেকে নির্দেশ ছাড়াই আদালতের অনুরােধে ব্রোহি বিচারকালে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন। সরকারপক্ষ ১০৫ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিল, তবে বাস্তবে তার অর্ধেক সংখ্যককে হাজির করেছিল। সারবস্তুসম্পন্ন প্রমাণ বলতে ছিল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে বাঙালি আর্মি অফিসারদের অংশগ্রহণের স্বীকারােক্তি। পুলিশ ও মিলিটারি হেফাজতে এই সব স্বীকারােক্তি আদায় করা হয়েছিল। ব্রোহি অভিযুক্ত পক্ষের সাক্ষী হিসেবে কর্নেলিয়াস, পীরজাদা, এম এম আহমদ ও হাসানকে হাজির করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দেন। ৩ ডিসেম্বর আদালতের কাজ শেষ হয় এবং ৪ ডিসেম্বর আদালত সর্বসম্মতভাবে, কেবল পিতার মৃত্যুর কারণে অনুপস্থিত একমাত্র বেসামরিক সদস্য ব্যতীত, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত করে ও তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে। এই রায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমােদনসাপেক্ষ ছিল। সামরিক আদালতকে রায় বিশ্লেষণমূলক প্রমাণাদি অথবা সিদ্ধান্তের কোনাে কারণ প্রদর্শন করতে হয় না।(২১৮)
শেখ মুজিব ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, “৪ ডিসেম্বর আদালত চূড়ান্তভাবে বসার পর ইয়াহিয়া বিচারকদের সবাইকে রাওয়ালপিন্ডি ডেকে নিয়ে যান। উদ্দেশ্যে ছিল রায় ঠিক করে দেওয়া এবং সেখানে সবাই আমাকে ফাঁসিতে ঝােলাবার সিদ্ধান্ত নেয়।”
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তখনাে জানতেন না তাঁদের নেতা মৃত না জীবিত। তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জীবিত মৃত যা-ই হােন না কেন। বেঁচে থাকতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন জীবনের চেয়েও বড় মাপের এক গল্পকথা, যদিও তখন তিনি নীরব, দৃশ্যগােচর নন এবং বহু দূরে বন্দি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি ভেবে থাকেন বন্দিকে নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রেখে তিনি বাঙালিদের শাস্তি দিচ্ছেন তবে তিনি ভুল করেছেন। অনুপস্থিত ছিলেন বলেই শেখ মুজিবুর রহমান আরাে বেশি করে হাজির ছিলেন সবার মনে। তাঁরা লড়েছিলেন তাঁর নাম উচ্চারণ করে, মৃত্যুবরণও করেছিলেন তাঁর নাম উচ্চারণ করে।

ফাঁসির মঞ্চ অভিমুখে
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে শেখ মুজিবকে লায়ালপুর জেল থেকে মিয়ানওয়ালি জেলে নেওয়া হয়। এক বন্দির বিবরণ অনুযায়ী, “ডিসেম্বরের শুরুর এক রাতে জেল কম্পাউন্ডে একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। হেলিকপ্টার থেকে
—————————————–
২১৮ নিউজউইক, জানুয়ারি ২৪, ১৯৭২।
———————————-
১১৫

কে নেমে এলাে সেটা আমরা দেখতে পাইনি। কেননা আমাদের সেল তালাবদ্ধ ছিল। সকালে আমরা জানতে পারি শেখ মুজিবকে লায়ালপুর জেল থেকে মিয়ানওয়ালি আনা হয়েছে।”
একজন বন্দি বর্ণনা করেছেন, “মিয়ানওয়ালি জেলের জেনানা ফাটকে তাঁকে রাখা হয়। নারী বন্দিদের অন্য ব্যারাকে স্থানান্তর করা হয়েছিল। জেনানা ফাটক ছিল ১০ নম্বর ব্যারাকের ঠিক পেছনে, যেখানে ভারতীয় কারাবন্দিদের সম্প্রতি আনা হয়েছিল।”
শেখ মুজিবের আগমনের খবর রটে গেলে কয়েদিদের কেউ কেউ তাদের ব্যারাকের ছাদে উঠে তাঁর প্রতি গালাগাল বর্ষণ করতে শুরু করে। জেনানা ফাটকের চত্বরে তারা জুতা, পাথর ইত্যাদি ছুড়ে মারে। এর কোনাে কোনােটি সামরিক প্রহরীদের গায়ে লাগে।
এরপর প্রহরীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে কুঠুরিতে ফিরে গিয়েও তারা গালমন্দ অব্যাহত রাখে। তাদের ক্ষান্ত করতে জেল সুপার চৌধুরী নাসের টহলে আসেন এবং সবাইকে বলেন, “শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে লটকাবার জন্যই মিয়ানওয়ালি জেলে আনা হয়েছে।” ঘটনা যা-ই ঘটুক, শেখ মুজিব মৃত্যুদণ্ডের জন্যই তৈরি ছিলেন এবং তিনি ফাঁসির অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগলেন। কোনাে আপিল বা ক্ষমা ঘােষণার অবকাশ ছিল না। বিচারকালে তাঁর আচরণেও বােঝা গিয়েছিল তিনি অনুকম্পা যেমন চাচ্ছেন না, তেমনি সেটা প্রত্যাশাও করছেন না।
জেলখানায় হৈচৈ আসলে ছিল একটি সাজানাে ফাঁদ। জেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই তা তৈরি করেছিল, যাতে করে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে প্রহরীরা এটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।(২১৯) এমনকি তারা কতক পাড় ক্রিমিন্যালকেও পাঠিয়েছিল শেখ মুজিবকে খুন করতে।।
বন্দি থাকাকালীন ঈদের দিন সম্পর্কে পরে শেখ মুজিব বলেছিলেন :
“নিষ্ঠুর গণহত্যাকারীদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল বন্দির জন্য ঈদ এক নিষিদ্ধ স্বপ্নের মতাে। আর আমি তাে কোনাে সাধারণ কয়েদি ছিলাম না, একনায়ক সরকারের ঘােষিত শত্ৰু আমি। তাই ঈদের দিনেও ওরা আমাকে সেল থেকে বের হতে দেয়নি।
“বহুদিন যাবৎ (তখন আট মাসের ওপর) আটক থেকে আমি সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলেছিলাম। নরক-সম সেলের বাইরে ইতিমধ্যে আমার জন্য কবর খোড়া হয়ে গেছে, এমনি অবস্থায় সেকেন্ডের এক ভগ্নাংশকেও মনে হতাে জীবনের কিছুটা সম্প্রসারণ অথবা মৃত্যুর সাময়িক পশ্চাদপসরণ।
“মৃত্যদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দির অন্তিম ইচ্ছা পূরণের মতাে জেলার আমাকে কিছু ফল পাঠিয়েছিলেন। ঈদের নামে এটা এক ধরনের রসিকতাও হতে পারে। কিন্তু আমার আবারও মনে পড়ে গেল দেশে আমার জনগণের কথা এবং বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাে হৃদয়। মনে পড়লাে ২৫ মার্চ রাতের নিষ্ঠুর দৃশ্য, যখন বলপূর্বক আমাকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হলাে বাংলাদেশ থেকে এবং অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হলাে। আমার প্রিয় জনগণ কীভাবে তাদের ঈদ উৎসব পালন করছে? এই প্রশ্ন আমি করলাম, জানি না কাকে!
“সেই দিন, আবার কখনাে তাদের দেখা পাবাে কি না সেটা না জেনেই, আমি মােনাজাত করে আমার জনগণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা দয়াময় আল্লাহতালার হাতে সমর্পণ করলাম। এটাই ছিল আমার ঈদ।(২২০)
————————————————
২১৯ ক্লোজ একাউন্টার্স, ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, অক্টোবর ৪, ১৯৮৭।
২২০ ডেভিড ফ্রস্ট গৃহীত শেখ মুজিবের সাক্ষাঙ্কার, আউটলুক, করাচি, এপ্রিল ২২, ১৯৭২।
————————————————
১১৬

মিয়ানওয়ালি জেলের আরেক বন্দি মােহনলাল ভাস্কর পরে বলেছিলেন, “আমরা যখন রেশন আনতে যেতাম তখন প্রায়শ শেখ মুজিবের পাচকের দেখা পেতাম। কিন্তু তার সঙ্গে কখনাে কথা বলার সুযােগ হতাে না। কারা কর্তৃপক্ষের কেউ না কেউ সবসময় তার সঙ্গে থাকতাে। রেশন ক্লার্ক বিদ্রুপের স্বরে পাচককে জিজ্ঞেস করতাে, “বিশ্বাসঘাতকটা কেমন দিন কাটাচ্ছে”? পাচক অবজ্ঞাভরে জবাব দিতাে, “শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য ভালাে রয়েছে। তিনি প্রসন্ন মনে রয়েছেন এবং যতক্ষণ বেঁচে থাকবেন বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।(২২১)
তিনি যে জীবিত রয়েছেন এর অর্থ ইয়াহিয়া খান এখনও তাঁকে কোনাে ধরনের লেনদেনে ব্যবহারে সচেষ্ট রয়েছেন। এতে ইঙ্গিত মেলে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করেনি। এতে আরাে বােঝা যায় লড়াই এখনও চলছে, বাঙালিরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরােধ করছে এবং পাক-সামরিক বাহিনী চাপের মধ্যে আছে। তিনি বাঙালিদের জানতেন এবং এটাও জানতেন তারা কখনাে আত্মসমর্পণ করবে না।(২২২)
একদিন ভারতীয় বন্দিদের ব্যারাকে এলেন ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট ফজলদাদ। দুটো সেল থেকে তিনি আটজন বন্দিকে বাছাই করলেন। ভাস্করও ছিল এদের মধ্যে। তাদের জেনানা ফাটকে নেওয়া হলাে, যেখানে শেখ মুজিবকে আটক রাখা হয়েছিল।
পুলিশ অফিসার তাঁদের হুকুম দিলেন আট ফুট লম্বা, চার ফুট প্রশস্ত ও চার ফুট গভীর গর্ত খুঁড়তে। তারা চট করে বুঝে নিলেন, শেখ মুজিবকে সে রাতেই ফাঁসি দেওয়া হবে এবং তারা সেই কবর তৈরির কাজ করছেন। তাদের সন্দেহ পরখ করে নেওয়ার কোনাে উপায় ছিল না। “নয়টার মধ্যে কবর তৈরি হয়ে গেল। আমরা ব্যারাকে ফিরে এলাম। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম মুজিবের ফাঁসির দুঃসংবাদের জন্য। রাতভর কিছু ঘটলাে না, চাপা ও নিস্তেজ ছিল সেই রাত।”
গুজব রয়েছে যে, শেখ মুজিবের ফাসির জন্য নির্ধারিত সেই রাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে এবং শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে বােঝাতে চেষ্টা করেন যে, মুজিবকে যদি ফাঁসি দেওয়া হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা বসে থাকবে না। তাদের ক্রোধের লক্ষ্য হবে পূর্বাঞ্চলে মােতায়েনকৃত পাকবাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার থেকে সর্বনিম্ন সৈনিক পর্যন্ত সবাই। তারা শিশুদেরও রেহাই দেবে না। ভুট্টোর উপদেশ অনুসারে ইয়াহিয়া মুজিবের ফাসি স্থগিত রাখেন।
কয়েদিদের পরদিন আবারও ডেকে নেওয়া হয় এবং গর্ত ভরাট করে ফেলতে বলা হয়। তবে তাদের স্বস্তি ছিল স্বল্পস্থায়ী। পনের দিন পর পুনরায় তাদের ডেকে নেওয়া হয় এবং একই ধরনের গর্ত খোঁড়ার হুকুম দেওয়া হয়। তবে এবারও শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হলাে না। এমনি প্রক্রিয়া তিনবার ঘটেছিল এবং তিনবারই তাঁর ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়া হয়।(২২৩)
শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে পূর্বাঞ্চলে ফাঁদে-পড়া পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবও করেছিলেন পাকিস্তানিদের কেউ কেউ। তাঁরা মনে করেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে হার মানার পরিবর্তে এর ফলে বাংলাদেশের স্বীকৃত নেতার কাছে আপসে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে। এটা ছিল বেশ কেতাদুরস্ত চাল। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানিদের নিরাপদে প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতেও বাধ্য করা হবে। তবে বাংলাদেশে এর ফলে সৃষ্টি হবে রাজনৈতিক শূন্যতা, সামগ্রিক নিরাপত্তা সংকট ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা। এই প্রস্তাব বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং
———————————
২২১ ওবায়দুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : এ লিডার উইথ এ ডিফারেন্স, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ. ১১৫।
২২২ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৩, পৃ. ১২৮।
২২৩ ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, অক্টোবর ৪, ১৯৮৭।
————————————
১১৭

ইয়াহিয়াও পিছিয়ে আসেন। পরিবর্তে তিনি মুজিবের ফাঁসির হুকুম দেন। ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রদান করেন এবং পরদিন আত্মসর্মপণের দলিলে স্বাক্ষর দেন। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলের ফ্রন্টে বিপর্যয় সত্ত্বেও লড়াই অব্যাহত রাখার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে ইয়াহিয়া খান এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।(২২৪)
ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন শেখ মুজিবুর রহমান কারা-কুঠুরিতে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। পাশেই একটি কবর তৈরি ছিল এবং শেখ মুজিবকে বলা হয়েছিল এটা নিছক একটি ট্রেঞ্চ, বিমান আক্রমণের সময় ব্যবহারের জন্য খোঁড়া হয়েছে। তিনি মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন।(২২৫)
শেখ মুজিব জানতেন না যে, তার অনুপস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। জানতেন না মুক্তিবাহিনী কিংবা ঢাকা অভিমুখে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর বিজয় অভিযান সম্পর্কে। তিনি কিছুই জানতেন না গণহত্যা কিংবা শরণার্থী বিষয়ে, অথবা বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরের যাত্রার ফলে এতঞ্চলে আকস্মিকভাবে উদ্ভূত পারমাণবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা সম্পর্কে। বর্ষা মৌসুম পার হয়ে গেছে, আবার এসেছে শীত। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে তিনি কম্বলের নীচে জবুথবু হয়ে ঢুকলেন। ঢাকা তখন ছিল রৌদ্র-উদ্ভাসিত ও গাছে গাছে পুষ্পশােভিত।
বন্দিকে ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ইয়াহিয়া খান কারা কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য বিশেষ টেলিগ্রাম যাবে তাদের কাছে। তার আগেই পতন হলাে ঢাকার এবং সেই বিশেষ টেলিগ্রাম আর পাঠানাে হলাে না।(২২৬)
ইয়াহিয়া সবসময়ই ছিলেন প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং শেখ মুজিবকে হত্যা করার চিন্তাটা তার জন্য এতাে সুখকর ছিল যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিশেষ টেলিগ্রাম প্রেরণ বিলম্বিত করেছিলেন, যেন কাজটি তিনি সময় নিয়ে পরিপূর্ণভাবে উপভােগ করতে পারেন। ইতিমধ্যে মদ্যপান করছিলেন সচরাচরের চাইতে অনেক বেশি মাত্রায় এবং এক অসতর্ক মুহূর্তে তার সিদ্ধান্তের কথা ব্যক্ত করেছিলেন ভুট্টোর কাছে। সদ্য জাতিসংঘ-প্রত্যাগত ভুট্টো সেখান থেকে জেনে এসেছিলেন অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধি কী অবজ্ঞার দৃষ্টিতে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারকে দেখে থাকে।
ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে জিজ্ঞেস করলেন, “মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হলে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সৈনিকদের কী হবে বলে আপনি মনে করেন?” সম্পূর্ণ বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি লক্ষ করলেন যে, ইয়াহিয়া খান সমস্যাটি নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা করেননি। তিনি তৎপরতা গ্রহণে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু সেই তৎপরতার পরিণতি নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। ভুট্টো ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলেন যে, এর পরিণতিতে একজন সৈনিকও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।
ইয়াহিয়া খান একগুঁয়েভাবে বলতে লাগলেন, তাঁর হুকুম পালিত হতে হবে। পরম গােপনীয়তায় শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে, কাকপক্ষীও টের পাবে না। যদি দরকার হয় মৃত্যু-পরােয়ানায় তারিখ পিছিয়ে অক্টোবর করা হবে। দুনিয়াকে জানানাে হবে দেশদ্রোহিতার অভিযােগে শেখ মুজিব দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড ইতিমধ্যে কার্যকর হয়ে গেছে।(২২৭)
—————————–
২২৪ এ. এম. এ. মুহিত, বাংলাদেশ-ইমারজেন্স অব এ নেশন, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ৩৩১-৩৩২।
২২৫ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৩, পৃ. ১২৯।
২২৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৭।
২২৭ পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৯।
————————
১১৮

মুজিবের নিজের ভাষ্যে : “ভুট্টো আমাকে জানিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান যখন তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন তখন বলেছিলেন যে, মুজিবকে শুরুতেই না মেরে তিনি মহাভুল করেছেন।
” ফ্রস্ট : তিনি সেটা বলেছিলেন?
মুজিব : হঁ্যা। আরাে বলেছিলেন, “এখন আপনাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে অনুগ্রহ করে পেছনের তারিখ দিয়ে নির্দেশ জারি করে মুজিবকে মেরে ফেরার সুযােগ আমাকে দিন। কিন্তু ভুট্টো এতে সম্মত হননি।”(২২৮)
তবে ইয়াহিয়ার অপসারণের পরও নিজের অবস্থান সম্পর্কে মুজিব অজ্ঞ ছিলেন, “একজন অফিসার যিনি আমার দায়িত্বে ছিলেন, একদিন রাত তিনটার দিকে আমাকে জেলের বাইরে তাঁর বাংলােয় নিয়ে যান। কোনাে পুলিশ কিংবা সামরিক প্রহরা ছাড়াই তিনি আমাকে দুই দিন সেখানে রাখেন। দু দিন পর তারা আমাকে নিয়ে যান চাশমা বাঁধ কলােনির পরিত্যক্ত এলাকায় এবং পাঁচ-ছয়দিন আমাকে সেখানে রাখেন। ঐ চারজন অফিসার ছাড়া কেউ জানতেন না আমি কোথায় রয়েছি।”(২২৯)
এখন থেকে শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের বন্দি থাকার পরিবর্তে ভুট্টোর বন্দি হলেন। তাঁর কাছে দুইয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তাঁকে দিবারাত পাহারা দিতাে ভুট্টো-অনুগত আর্মি কমান্ডাে দল। তাকে কোনাে বই বা সংবাদপত্র দেওয়া হয়নি, রেডিও শােনার অনুমতিও ছিল না। পরিবারের কাছ থেকে কোনাে চিঠিও তিনি পাননি। তিনি তখনও জানতেন না, তিনি হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রধান। এটাও জানতেন না যে, ভুট্টোর কারণে তাঁর ঠাই বদল হয়েছে। তাঁকে স্রেফ এক কারাগার থেকে তুলে এনে আরেকটিতে রাখা হয়েছে।(২৩০)
২৬ ডিসেম্বর একটি আর্মি হেলিকপ্টার এসে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডির বাইরে এক বাংলােয় নিয়ে যায়। ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ মুক্তি না-পাওয়া অবধি আর্মি কমান্ডােদের প্রহরায় তিনি সেখানে থাকেন। ইতিমধ্যে সংবাদপত্র অথবা রেডিওর সহায়তা ছাড়াই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে এবং প্রতি বার কারাগার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাঁচার সম্ভাবনাও উজ্জ্বলতর হচ্ছে। এখন কেবল শীতলভাবে লক্ষ রাখছে তাঁর প্রহরীরা। তাদের খুনিসুলভ চাহনি আর নেই। তাদের কোনাে প্রশ্ন তিনি করেননি। কেননা তিনি জানেন, নীরব থাকার শপথ তারা নিয়েছে। তিনি লক্ষ করেছিলেন, তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কখনাে কখনাে তারা লাফ দিয়ে স্যালুটের ভঙ্গিতে সটান হয়ে দাঁড়ায়।(২৩২)
———————–
২২৮ পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩০।
২২৯ আউটলুক, এপ্রিল ২২, ১৯৭২।
২৩০ পূর্বোক্ত।
২৩১ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৩, পৃ. ১৩০।
২৩২ নিউজউইক, জানুয়ারি ২৪, ১৯৭২।
—————————
১১৯

দি টাইমস, লন্ডন, ১১ আগস্ট, ১৯৭১
ইয়াহিয়ার প্রতি ব্রিটিশ আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড শেরিডান অ্যান্ড(২৩৩) কোম্পানির পত্র
[চিঠিপত্র বিভাগে প্রকাশিত]
মহােদয়, আগামীকাল শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে এই মর্মে সােমবার সন্ধ্যায় পাকিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংবাদ আমাদেরকে প্রলুব্ধ করেছে আপনার পত্রিকার কলাম-এর শরণ নিতে, যাতে করে আপনার পাঠকরা সবিস্তারে জানতে পারেন শেখের পক্ষে, তাঁর সুবিচার নিশ্চিতকল্পে, আইনবিদরা কী প্রচেষ্টা নিয়েছেন।
যদিও শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এই বছরের মার্চের শেষ দিকে, নির্বাচনে তাঁর বিজয়ের পর, তাঁকে আইনগত পরামর্শ লাভের সকল সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাঁর আইনজীবী হিসেবে আমরা সরকারি মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা নিই। জুনের শুরুতে আমরা লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে যাই এবং তাদের অনুরােধে মুজিবের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে আনুষ্ঠানিক পত্র দিই। দুঃখজনকভাবে আমরা এই অনুরােধপত্রের কোনাে জবাব অথবা প্রাপ্তিস্বীকার কিছুই পাইনি। মিস্টার শন ম্যাকব্রাইডের সফরসঙ্গী, এই প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য, স্বয়ং পাকিস্তানে উপস্থিত হয়ে যে অনুরােধ করেছিলেন কোনাে জবাব মেলেনি।
ঐ সফরের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে বলা যে, শেখ মুজিবুরকে নিজের পছন্দমতাে আইনজীবীর পরামর্শ নিতে দেওয়া উচিত, প্রথম সুযােগেই তাঁকে অভিযােগের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত করা উচিত এবং যে কোনাে বিচার হওয়া উচিত বেসামরিক ট্রাইবুন্যালে প্রকাশ্য আদালতে। এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, তার পক্ষ হয়ে আমাদের আবেদন কারাে কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।
পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি মিস্টার ম্যাকব্রাইডের কাছে একেবারে হালে, ২৬ জুলাই তারিখেও, যা বলেছেন। তা থেকে দেখা যায়, আমাদের মক্কেলের বিরুদ্ধে না-কোনাে অভিযােগ দাঁড় করানাে হয়েছে, না-তাঁকে নিজ পছন্দসই কোনাে আইনজীবীর সহায়তা নিতে দেওয়া হয়েছে, তা সেই আইনজীবী বিদেশি বা পাকিস্তানি যে-ই হােক না কেন। আমরা এ কথাও যােগ করতে পারি যে, আমাদের মক্কেল কোথায় আছেন সেটা জানতেও মিস্টার ম্যাকব্রাইড সমর্থ হননি।
এটা আমাদের এই সিদ্ধান্তেই উপনীত করছে যে, স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের ন্যূনতম মান, যা আমরা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করতে সচেষ্ট হয়েছিলাম, সেই অনুসারে সুবিচারের সুযােগ শেখ মুজিবকে দেওয়া হবে না। এতদসত্ত্বেও আমরা আশা করবাে, এমনকি এতাে বিলম্বে হলেও, পাকিস্তান সরকারকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে বাধ্য করা যাবে।
আপনার বিশ্বস্ত
বার্নার্ড শেরিডান অ্যান্ড কোং
লন্ডন ডব্লিউ সি ১
আগস্ট ১০
———————————–
২৩৩ উৎস : পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন, আহমেদ সালিম (মফিদুল হক অনূদিত) প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, সাহিত্য
প্রকাশ, পৃষ্ঠা ৯৫-৯৬।
————————-
১২১

শেখ মুজিবের বিচার করা হবে : ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জেনারেল ইয়াহিয়া।(২৩৪)
দি ডন, করাচি, ৫ আগস্ট, ১৯৭১

MUJIB WILL BE PUT ON TRIAL
President Agha Mohammad Yahya Khan has said that Sheikh Mujibur Rahman, leader of the defunct Awami League, would be put on trial.
He said Sheikh Mujib was arrested for committing acts of treason and he would be dealt with under the law of the land.
In a television interview telecast from all stations of Pakistan Television Corporation last night, the President said that being a citizen of Pakistan he should be dealt with according to the law of Pakistan.
The President, who was asked what would be the fact of Sheikh Mujibur Rahman, said that the leader of the defunct Awami League had deviated from his electoral campaign in which he demanded autonomy for East Pakistan.
President Yahya said that after Sheikh Mujib got the mandate, he and a coterie of his people deviated from that aim and wanted secession. In other words, he said Sheikh Mujibur Rahman had committed “acts of treason, acts of open rebellion” and incited armed rebellion against the State.
In reply to a question, the President said that Sheikh Mujibur Rahman was not his opponent at all. The President said that he was only a caretaker and had nothing to oppose Sheikh Mujibur Rahman as a Politician.
The President made it clear that he had no political ambitions. He said as a soldier he was in his temporary duty of restoring the authority of the people.
The President said he was sorry for what Sheikh Mujibur Rahman had done for which he would suffer like any other person committing crimes on the nation would suffer. “How would you treat your criminal”, he posed a question to the foreign news media representatives present at the interview. :
(The Dawn, Karachi, August 5, 1971) T
—————-
২৩৪ উৎস : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪।
——————
১২২

“পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য” মুজিবের বিচার হবে : সরকারি তথ্য বিবরণী
দি ডন, করাচি, ১০ আগস্ট, ১৯৭১
TRIAL FOR “WAGING WAR AGAINST PAKISTAN” and
Official Press Note
August 9, 1971
Sheikh Mujibur Rahman, President of the defunct Awami League, will be tried by a Special Military Court for “waging war against Pakistan” and other offenses, a Press Note issued by the Headquarters of the Chief Martial law Administrator said today (August 9).
The trial will commence on August 11 in camera and its proceeding will be secret, the Press Note said.
The accused will be given proper opportunity to prepare his defense and will be provided with all facilities permitted in law including engaging a counsel of his own choice provided such a counsel is a citizen of Pakistan, it added.
Sheikh Mujibur Rahman was arrested from his Dhanmandi residence in the early hours of the morning of March 26 after the Pakistan Army moved in to restore the authority of the Government. Later, he was brought to West Pakistan where he is under detention. (The Dawn, Karachi, August 10, 1971)

দুই সপ্তাহের মধ্যে মুজিবের বিচার সম্পন্ন হবে :
নিউ ইয়র্কে পাক রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর বিবৃতি
ডেইলি নিউজ, ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

MUJIB’S TRIAL TO BE OVER IN ANOTHER TWO WEEKS
Pakistan Ambassador Agha Shahi’s Statement in New York
August 31, 1971
Pakistan Ambassador Agha Shahi yesterday (August 31) informed Secretary-General U Thant about new steps contemplated by the Pakistan Government to build confidence in the country.
১২৩

He told correspondents in New York afterwards “as you know, the President of Pakistan has taken many steps to build confidence and further steps are contemplated in this direction”.
He said they would take place “within the next two or three weeks”.
Questioned about the trial of Sheikh Mujibur Rahman, leader of the Awami League in East Pakistan, Mr. Shahi said his trial started August 11 and should be over in another two weeks.
He said Sheikh Mujib had been charged with waging war against the state and incitement to rebellion and violence.
The Ambassador declined to say where the trial was taking place, but said Sheikh Mujib was being represented by a lawyer of his own choice, Mr. A. K. Brohi, who, he said, was one of the best constitutional lawyers in Pakistan.
(DAILY NEWS, Karachi, September 1, 1971)

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের প্রেস নােট : কোর্টের রায় সম্পর্কে রটনার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি
দি ডন, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
PRESS NOTE ISSUED BY CHIEF MARTIAL LAW ADMINISTRATOR
Giving Details of Trial And Warning Against Contempt of Court
SEPTEMBER 28, 1971
It will be recalled that a Special Military Court was convened by the Chief Martial Law Administrator to try Sheikh Mujibur Rahman in camera for waging war against Pakistan and for other charges.
The trial commenced on August 11, 1971. The court, however, adjourned the same day in order to ensure fair trial and justice so that Sheikh Mujibur Rahman could have a defence counsel of his own choice.
On September 7, 1971 the services of Mr. A. K. Brohi and his three assistants, namely, Mr. Ghulam Ali Memon, Mr. Akber Mirza and Mr. Ghulam Hussain were procured, and the examination of the prosecution witnesses started.
The prosecution have so far examined 20 witnesses in support of the charges preferred against Sheikh Mujibur Rahman. The trial is in progress with Mr. A. K. Brohi as the defence counsel.

১২৪

The public will be informed of the further progress of the case in due course of time.
Meanwhile people should in their own interest refrain from saying or doing anything which may constitute a contempt of court or a breach of secrecy of the trial proceedings, or which may tend to prejudice the case of either the defense or the prosecution.
(The Dawn, Karachi, September 29, 1971)

খেয়ালবশে মুজিবকে মুক্তি দেওয়া যায় না : জেনারেল ইয়াহিয়া
দৈনিক পাকিস্তান, ৩ নভেম্বর, ১৯৭১

নিউ ইয়র্ক, ২ নভেম্বর (এএফপি)। প্রেসিডেন্ট জে. এ এম ইয়াহিয়া খান বলেছেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন এবং চীন তার (পাকিস্তানের) সশস্ত্র বাহিনীকে সবরকম অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ সরবরাহ করবে। তিনি বলেছেন, জাতি তার মুক্তি দাবি করলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেবেন।
নিউজউইক ম্যাগাজিনের প্রতিনিধির সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট এসব কথা বলেছেন। ইয়াহিয়া বলেন, যুদ্ধ (ভারতের সাথে) যে আসন্ন আপনাকে এ কথা না বলার কোনাে কারণ নেই। কেননা তা আসন্ন। ভারতীয়রা আমাদের সাথে যুদ্ধ শুরুই করে দিয়েছে। সার্বিক মােকাবিলা হচ্ছে না, কারণ আমরা পাল্টা আঘাত হানছি না।
তিনি বলেন, উত্তপ্ত পরিস্থিতির আরাে সম্প্রসারণ ঘটুক তা তিনি চান না। তবে একটা এলাকা দখল করে সেখানে ক্রীড়নক বাংলাদেশ সরকারকে বসানাের জন্য ভারত যদি উত্তেজনার প্রসার ঘটায় সেটা হবে যুদ্ধ। আর অবস্থা যদি তাই দাঁড়ায় চীন পাকিস্তানের উপর আক্রমণ সহ্য করবে না। প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া আমরা প্রয়ােজনীয় সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ পাবাে।
পূর্ব পাকিস্তানের দাবি প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের যে সময় নষ্ট হয়েছে তা পূরণ করার চেষ্টা করছি। ২০ ডিসেম্বর শাসনতন্ত্র জারি করা হবে। আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও কর ধার্যের বিষয় ছাড়া আর সব ক্ষেত্রে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ভােগ করবে।
শেখ মুজিব প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বলেন, মুজিব যদি এখন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান, তার লােকেরাই তাকে মেরে ফেলবে। কেননা, তারা তাদের সকল দুর্ভোগের জন্য তাকেই দায়ী করছে। খেয়ালের বশে আমি তাকে মুক্তি দিতে পারি না। তবে জাতি যদি তার মুক্তি চায় আমি তাকে মুক্তি দেবাে।
১২৫

বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু(২৩৫)
১৯৫৬-১৯৫৭
পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ২৫ আগস্ট ১৯৫৫ থেকে ৩ জানুয়ারি ১৯৫৮ সালের মধ্যে তিনি গণপরিষদে জনগুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা, দমন-নিপীড়নমূলক বিভিন্ন কালাে-আইন বাতিল ও রাজনৈতিক বন্দিদের বিনা বিচারে আটক রাখার বিরুদ্ধে তিনি জোরালাে দাবি উত্থাপন করেছেন। এসব বক্তব্যে বিচার বিভাগ সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।।
বঙ্গবন্ধু সবার জন্য ন্যায়বিচার ও সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন সারা জীবন। ধর্ম-বর্ণ-স্থান ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের সুযােগের সমানাধিকার ছিল তার সবসময় কাম্য। তিনি বলেন : There are the people who may not do justice. But there must be fair play; there must be justice and equity. They say that they will do all good things and Justice and fair play will be there and it would be a sort of heaven and we will give these backward areas services and safeguard. (P. 44, Karachi, Monday, the 26th September, 1955, 2.30. P.M.).
বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার খাদ্য ও বস্ত্রের মতােই জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এসব মৌলিক অধিকারের প্রতি কোনাে মনােযােগ দেয়নি। বরং যখনই অধিকারের দাবি তােলা হয়েছে তারা একেকটি নিপীড়নমূলক আইন তৈরি করেছে। বঙ্গবন্ধু নিজে এবং বহু রাজনৈতিক কর্মী তিন বছর বা চার বছর করে এসব আইনে গ্রেপ্তার হয়ে বিনা বিচারে আটক ছিলেন। তাদের নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁদের পক্ষে এসব মামলায় হাইকোর্টে হ্যাবিয়াস কর্পাস আবেদন করেছেন। হাইকোর্ট এক পর্যায়ে ইস্ট বেঙ্গল নিরাপত্তা আইন বাতিল ঘােষণা করেন। কিন্তু অত্যাচারী সেই শাসকবর্গ তখন ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর বেঙ্গল রেগুলেশনের অধীনে রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করে। যখনই কোনাে বন্দি আদালত থেকে জামিন পেতেন তখন তাঁকে এই ১৮১৮ সালের আইনে সঙ্গে সঙ্গে পুনঃগ্রেপ্তার করা হতাে।
শত বছরের বেশি পুরনাে এই আইনের এমন ন্যাক্কারজনক অপব্যবহারকে তিনি কঠোর সমালােচনা করেছেন। ঔপনিবেশিক কায়দায় দমন-নিপীড়নমূলক আইনের ব্যবহার রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য ভালাে নয়।
—————————-
২৩৫ উৎস : এখানে প্রদত্ত ইংরেজি উদ্ধৃতিসমূহ পাকিস্তান গণপরিষদে ও জাতীয় পরিষদে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তৃতার প্রাসঙ্গিক অংশ। এসব বক্তৃতা ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বেলি ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বেলি কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে, তবে সেগুলাে এখন দুষ্পপ্য। বঙ্গবন্ধুর এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাগুলাে গ্রন্থিত হয়েছে নিমােক্ত বইয়ে : Sheikh Mujib in Parliament (1955-58), Edited by Shahryar Iqbal, Agunee Prakashani, 1997. এই প্রবন্ধের সংশ্লিষ্ট জায়গায় উক্ত বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বরসহ রেফারেন্স প্রদান করা হয়েছে। অথধারেখা আমাদের প্রদত্ত।
——————————
১২৭

এতে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীদের দমন করার জন্যই এমন আইন ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন :
Eight years have passed, and what are we doing when we ask for food, for clothing for justice, they give us only one thing, that is Frontier Crimes Regulations (FCR). In East Bengal, Sir, our leader, Mr. H. S. Suhrawardy moved a habeas corpus petition in the High Court. Many of my friends and myself have suffered for three or four years in jail under the East Bengal Safety Act. When he challenged the East Bengal Safety Act in the High Court of Dacca, the High Court declared it illegal.
… When that Safety Act was declared illegal, we were to be released and they could not have kept us any longer in jail. Now what happened? Immediately after that we got an order from the Government that we have been re-arrested under Bengal Regulation III of 1818. Now, Sir, think about this 1818.

How many years have passed-practically more than 100 years and we are now living in 1955 and we are telling the world that we are an independent country, we are shouting from the platform in Jahangir park that we are a free country, but this regulation is over our head. Now we are going to pass the same Act again which was used by the British people to exploit the Indo-Pakistan Sub Continent. Sir, if we appeal to them that do not accept these rules and regulations, throw them into the Arabin Sea, they will not accept our plea. If somebody asks them to do justice, stop this bribery, nepotism and corruption, at once they will use Frontier Crimes Regulation Act and this Bengal Act of 1818 and send him to jail in-spite of the fact we are living in 1955 and this Act belongs to 1818, days of British Imperialism.
Now, can you think of it, Sir? My friends will tell me just now we can accept it, we are going to pass this one unit Bill and we will have to use it if anybody opposes this Act, Now, this is their intention of retaining this Act. Their intention is that if anybody of Frontier will say that you are doing injustice to use, they will at once tell him that you are working against one Unit and not only that but you are working against Pakistan, therefore, under this Act you are to be punished. Now, if they agitate against their Leaders, they say, “you are against the musalmans” and if you say anything against the Muslim League, they will say “you have spoken against Pakistan” and thus they will apply these regulations against their political opponents who do not see eye to eye with them. Now why all this is being done? We are as true a Pakistani as anybody. You know, Sir, being a son of Bengal, how this Bengal Regulation has been used against the people of Bengal.
ব্রিটিশ আমলে এসব আইনের দ্বারা কীভাবে নির্যাতনের স্টিমরােলার চালানাে হয়েছে সেই বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন :
১২৮

Many people were hanged by the Britishers and families were massacred in Bengal due to this Regulation of 1818. Do not forget it. My friends of the Congress will bear me out as many of them spent valuable time of their life extending over 20 or 25 years in jail due to this Regulation and now they are going to support that very Regulation to be passed. Now, they will vote for its passage.
২১ দফায় অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, সকল কালাে-আইন বাতিল করা হবে কিন্তু সেই ওয়াদা পূরণ হয়নি।
Sir, power is everything. Only the other day Mr. Hamidul Huq Choudhury in the Paltan Maidan told the people of East Bengal that all the black laws will go from the soil of [the country]. They have included this thing in their 21-Point Programme. (Page 53-54, Karachi, Monday, the 26th September, 1955, 2.30 P.M.).
মুসলিম লীগ সরকার সবসময় বিনা বিচারে মানুষদের জেলে বন্দি করে রেখেছে :
We are a political party who have suffered at the hands of the Muslim League. We have been jailed, not once but many times. These Muslim Leaguers put people in jail without trial. During our administration we have not put a single Muslim Leaguer in jail. They put two thousand workers of ours in jail. We have not used these tactics. (373, Karachi, Friday, the 30th August, 1957, 3.30 P.M.).
রাজনৈতিক কারণে মানুষকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা কোনাে সমাধান হতে পারে না। সেই সময় পূর্ববাংলায় তিন হাজার মানুষ নিরাপত্তা আইনের দ্বারা নির্যাতিত, নিগৃহীত হয়েছিল। এজন্য তিনি সব সময় এই কালাে-আইনের (নিরাপত্তা আইন) বিলুপ্তি চেয়েছেন। কেননা, এই আইনে মানুষকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। গণপরিষদে তিনি বলেন :
You should know that 3,000 people of East Bengal have suffered because they were anxious to give this provision in the manifesto that nobody will be detained without trial; there will be no Safety Act. I say that if anybody is against Pakistan, produce him before a court. If you adopt this approach I can assure that everybody will support you. What you intend to do put the political rival in the jail! (P. 110, Karachi, Saturday, the 21st January, 1956, 3.00 P.M.).
বহু বছর পার করে যখন ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত করা হয় তখন তাতে রাষ্ট্রবিরােধী কর্মকাণ্ডের অভিযােগে যে কোনাে ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক রাখার বিধান ছিল। বঙ্গবন্ধু শাসনতন্ত্রে এরকম বিধান সংযােজনের বিরােধিতা করেছেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতায় দেখেছেন মুসলিম লীগ সরকার সবসময় ডিটেনশন ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তিনি সারা জীবন এসব কালাকানুনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন :
Sir, it has been promised by us to the people of East Bengal that these black laws, these sorts of clauses will not be in the Constitution. If there is proof against anybody, you have got the courts, you have got the Judiciary, you can produce them before the courts,
১২৯

you can punish them, hang them; you have got the right to do that but why are these black laws here, saying that people will be detained for subversive activities. Sir, this is the ground which is generally used against the persons who work for the country, who work for the people ….. (P. 193, Karachi, Monday, the 13th February, 1956, 3.00 P.M.).
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কর্মদক্ষতা বিষয়ে তিনি সব সময় সােচ্চার ছিলেন। একবার পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশে প্রযােজ্য ইলেকশন বিষয়ক বিবাদের বিচার করার জন্য সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আইনে বিধান রাখা হয় যে, ট্রাইব্যুনালের বিচারকের রায় নয়, গভর্নর জেনারেল যে সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন তা-ই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এই অসভ্য ও অপমানজনক আইন বিষয়ে তিনি বলেন :
Now, I come to Judiciary. You know, Sir, in West Pakistan Unit, the Governor can appoint a tribunal if there is any election petition, consisting of the judges of the High Court and what is the power of the High Court Judges and of the Judges of the tribunal? Absolutely nothing. That tribunal will only be a recommending body leaving everything to be finally decided by the Governor. What will he do? He can pass any-order that he likes. You can feel that in this way they are not only insulting the judiciary but they are insulting [the country and it’s people) as a whole. (P.73 Karachi, the 30th September, 1955, 2.45 P.M.)..
১৯৫৬ সালের পকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগ পৃথককরণের কোনাে সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু এই অস্পষ্টতার কঠোর সমালােচনা করেছেন :
Now, they talk of Islam and Islamic way but what they will do in case of judiciary- they will endeavor to separate, how silly it looks, it may take 25 years, it is all vague, there should be categorical provision in the Constitution [on the separation of the judiciary from the executive.]
***
They say, “The State shall endeavor to separate Judiciary from the Executive as soon as Possible”. Is this according to the wishes of the people of [the country]? In every constitution you will find that Judiciary has been separated from the Executive. Here the ruling junta and the privileged classes want to keep power intact in their own Hands.
Can you expect justice in such condition where the Executive wants to control the Judiciary? Now they will say we will transfer you from Lahore to Dacca and from Dacca to Lahore. This is a new thing that the High Court Judges can be transferred from this province to that.
এছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের হাইকোর্টের বিচারপতিদের এক হাইকোর্ট থেকে অন্য হাইকোর্টে বদলির বিধান করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই বিধানের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছেন :
Then what they have done is that a judge of a High Court can be transferred from one province to the other. Now Executive wants to control the Judiciary, is this Islamic
১৩০

Constitution? I want to know what was the position of the Qazi? Even the Khalifa had to go in front of the Qazi for the charges. That is Islamic Constitution, but here we want to separate Judiciary from the Executive. God knows how many years; it may take 25 years! It may be after our death. (P.113. Karachi, Saturday, the 21st January, 1956, 3.00 P.M.).
পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু যখনই সুযােগ পেয়েছেন গণপরিষদে ও সংসদে বিচার বিভাগের পক্ষে কথা বলেছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি সবসময় উচ্চকিতভাবে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন ও নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া যে মানুষের জান, মাল ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান সম্ভব নয় এই অভিজ্ঞতা তিনি বহু আগে অর্জন করেছিলেন। তাই গণপরিষদে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছেন :
Sir, while supporting the amendment that the Judiciary be separated from the Executive, I submit that as you are already aware, people are not getting justice, because the executive is controlling the Judiciary.
We see that even in petty cases the Judiciary is sometimes influenced by the Executive to pass their verdict in their favor. I cannot understand why the Government side should refuse to accept the amendment of Mr. Abul Mansur Ahmed. The Government side’s argument, I can anticipate, will be that it is up to the Provincial Government to decide when they can be able to separate judiciary from the Executive. It can also be argued by the other side that separation requires time. We accept it and they have also accepted that the Judiciary must be separated from the Executive.
Now, they say that we shall do that in future, and we have been told as soon as possible. Sir, this statement is absolutely vague. It may be that the new Government will come and say the same thing that they will endeavor to separate the Judiciary from the Executive in five to ten year’s time. Why do they not give a definite time, say, two years? If any Provincial Government cannot separate Judiciary from Executive within two years, Such a government must immediately resign. People will not have confidence in that government, because it is not an efficient government.
I say it should be easy and possible for them to separate the Judiciary from the Executive in two years time. In seven years time if you can achieve Pakistan, You can very well effect the separation in two years. Two years’ time is not a matter of joke, but this will depend if they are sincerely trying to achieve it. If we can make a country prosper in seven years time, if we can throw off the yoke of British Imperialism, it is not difficult for us to separate Judiciary from the Executive in a very short span of time. People can respect the Constitution when they can get justice. If the people do not get Justice, they will revolt against the Government.
Therefore, in order to do justice to the people, the Judiciary must be separated from the Executive. With these words I shall request that phrases like ‘we shall endeavor’, ‘we will do everything that is possible’,’as soon as possible in the future’, ‘It will be done by the next government’, ‘steps will be taken’, ‘endeavors will be made’ and so on, will not
১৩১

do. A definite time must be given, make it one year or more, but give a definite date within which period you have got to do it. It will be alright if they say after five years, but a vague statement will be of no avail. The next government may say we will do it after five years and this will continue indefinitely for ever. You are making this Constitution for the people…and the people should get justice. I, therefore, request the Law Minister to think over the matter and see whether he can limit a time, within which the Government will have to separate the Judiciary from the Executive. (P. 164-65, Karachi, Monday, the 6th February, 1956, 3.00 P.M.).
পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতার লােভে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করেছে ধর্মকে। ধর্মের নামে তারা সবসময় নিরীহ জনগণকে ধোকা দিতে চেয়েছে, যেন ক্ষমতাসীনদের অযােগ্যতা, ব্যর্থতা ও অন্যায় কর্ম কারাে চোখে না পড়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত এহেন রাষ্ট্রকাঠামাে কোনােদিন স্থায়ী ও কার্যকর হতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য আইনের দৃষ্টিতে সমতা এক অপরিহার্য পূর্বশর্ত :
…that we want equality before the law for all citizen. That is the first and fundamental point. …every citizen of [the country] has got equal rights. In a democratic country, in a democratic Constitution, every citizen has equal rights before the law, except when there is a monarchy or a dictatorial government, when of course no questi rights arises.
What, Sir, we fear, and why we put forward this amendment is because we are seeing in this Draft constitution that in some places we are curtailing some rights of some citizens of Pakistan whether they be Muslims, Hindus, Sikhs, Buddhists or any others must get equal rights and equal citizenship and they must get equality before the law. That is our point of view.
… It might be that today they are in power; tomorrow somebody else may come into power. We are giving a Constitution to 7. 1/2 crores people and there should be no question of Muslims or Hindus about that; all are Pakistanis. We all feel strongly about this and that is the reason why everyone of us has given this amendment, because we are giving a Constitution to our people now.
ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকে নাগরিকে বৈষম্য কোনাে সভ্য রাষ্ট্রের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এজন্য তিনি পাকিস্তান সংবিধানে নিমােক্ত সংশােধনী প্রস্তাব করেছিলেন :
…I hope that we can at least appeal to him to accept our this simple amendment that : “The state shall not discriminate against any citizen on account only of religion, race, caste, sex or place of birth.”
If you like you can add another sub-clause to the same effect and we will accept it. At least we can expect that democratic attitude from the Law Minister. Even though the
১৩২

Constitution may be undemocratic in other respects, if he accepts our amendment we will still accept it. We hope that he will accept our amendment. (P. 139-40 Karachi, Thursday, the 2nd February, 1956, 3.00 P.M.).
মুসলিম লীগ সরকার তাদের সব অন্যায়-অপকর্মকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ঢাকতে চাইতাে। তাদের এ ধরনের দ্বিমুখী ও আত্ম-প্রবঞ্চনামূলক ব্যবহারের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু বলেন :
Today the position is that if you go to a court for getting justice, we have to pay bribe. If you go to shop for buying something, you have to pay black-market prices, and if you go to a pleader there also you have to pay money for telling lies. When they will- I mean when the next generation will see all these things happening in Pakistan, they will at once turn away from it and they will not care for Islam. (P.234, Karachi, Tuesday, the 21st February, 1956, 3.00 P.M.).
বঙ্গবন্ধু এলএলবি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পরপরই ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ফলে গ্রেপ্তারবরণ; চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পক্ষে আন্দোলনে যােগদান, পরিণতিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ইত্যাদি কারণে তাঁর আইন পাস করা হয়নি। তবে, গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণসমূহ বিশ্লেষণ করলে বােঝা যায় আইন, বিচার ও বিচারপ্রক্রিয়া বিষয়ে তাঁর খুবই স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁর বাগ্মিতা, যুক্তি উপস্থাপনের ধরন ও নিজস্ব যুক্তি প্রমাণের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য পরিবেশনের স্টাইল দেখলে বােঝা যায় একজন দক্ষ আইনজীবীর সব গুণই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। ১৯৫৫ সালে গণপরিষদে বক্তৃতার এক পর্যায়ে বিচারাধীন একটি মামলা বিষয়ে তিনি বলেন :
I would not be allowed to speak about him because it may be ruled by you that it is sub judice while he was going to address a public meeting in Baluchistan. I will not go into the merits of the case but I will only point out this much that, is this democracy that you are talking about? Will it bring free elections in the country and restore confidence in the people? I am sorry to say that this is not the way in which democracy can be established in a country; you are not allowing the free-will of the people to be expressed. (P.20, Karachi, Wednesday, the 21st September, 1955, 10 A.M.).
বঙ্গবন্ধু খুব স্পষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর এই স্বভাব সম্বন্ধে সংসদে তিনি নিজেই একবার মন্তব্য করেন :
I am not a Philosopher, nor am I a good lawyer and therefore I am putting all these things in a direct way. I am a direct man myself. (P. 117, Karachi, Saturday, the 21st January, 1956, 3.00 P.M.). তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছেন : … [P]lease do justice. If you fail to do, a time will come when the consequences may be disastrous.
তাঁর এই আহ্বান শাশ্বত, আমােঘ ও অবশ্যম্ভাবী। এই অনুভূতি ও ভবিষ্যৎ-দৃষ্টির কারণেই তিনি নিছক রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতি-দার্শনিক।
(P. 153, Karachi, Saturday, the 4th February, 1956, 3.00 P.M.).
১৩৩

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণ(২৩৬)
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২

মাননীয় প্রধান বিচারপতি, মাননীয় বিচারপতিগণ, সুধীবৃন্দ, বারের সদস্যবৃন্দ, উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী ও ভদ্রমহিলাগণ, মহিলা আছেন তাই বলতে হলাে, আপনারা আমাকে সুযােগ দিয়েছেন আপনাদের সঙ্গে দেখা করার। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনাদের সঙ্গে মিশার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার অনেক বাল্যকালের সহকর্মী এখানে আছেন, যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছি, পড়েছি, খেলেছি, তারা অনেকেই উপস্থিত আছেন।
আজ সত্যিই আনন্দ প্রকাশ করতে হয় এজন্য যে, স্বাধীন বাংলার মাটিতে আজ আমাদের স্বাধীন সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন জাতি হিসাবে যদি স্বাধীন সুপ্রীম কোর্ট না থাকে তাহলে সে জাতি পরি রপর্ণতা লাভ করতে পারে না। আমাকে স্মরণ করতে হয় আপনাদের এই বারের অনেক সদস্য-যারা জালেম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর কাছে শহীদ হয়েছেন। আপনাদের অনেক সহকর্মী, মরহুম মশিউর রহমান, মরহুম আমিনউদ্দিন, আরাে অনেকে শহীদ হয়েছেন। অনেক বারের সদস্য তাদের কালাে কোট ত্যাগ করে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র নিয়ে বাংলার মধ্যে ঢুকেছিল যুদ্ধ করার জন্য-বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে।
আপনাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। আমি জানি, তারা অনেকেই আমার সহকর্মী, তাদের কথা স্মরণ না করলে অন্যায় করা হবে। আজ এই শুভদিনে স্মরণ করতে হবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ, লক্ষ লক্ষ কৃষক ভাই, যারা শহীদ হয়েছেন এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে, যারা জীবন দিয়েছে, যারা পঙ্গু হয়ে ঘরে আছে, তাদের কথা স্মরণ করতে হয়। যদি তাদের কথা আমরা ভুলে যাই, তাহলে স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের জাতীয় পতাকা উঠাতে পেরেছি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের সুপ্রীম কোর্ট, আজ আমাদের দেশে আইনের শাসন হতে চলেছে, তাদের আমাদের স্মরণ করা প্রয়ােজন।
আমি নিশ্চয়ই সুখী হতাম, যেমন আমি পি.জি হসপিটালে গিয়ে দেখি যে, এতজন ডাক্তারের নাম, যারা শহীদ হয়েছে। তাদের নাম লিখে ফলক করে রাখা হয়েছে। আমি সুখী হতাম বারের সদস্য ভাইয়েরা-যে যে সহকর্মীরা, যারা শহীদ হয়েছেন। এই সুপ্রীম কোর্টের গেটে এসে দেখতে পেতাম যে শহীদের নাম সেখানে লেখা রয়েছে, আমি সুখী হতাম। বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনাদের আমি অভিযােগ করছি না। আজ, জনাব আমাদের মাননীয় বিচারপতি তার কথা তুলেছেন, বারের প্রেসিডেন্ট আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আমরা সংগ্রাম করেছি এবং এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই অনেক মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে।
—————
২৩৬ বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৪৫-১৫০।
—————-
১৩৫

সেজন্যই শাসনতন্ত্র এত তাড়াতাড়ি দিয়েছিলাম। যদি ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা, যদি রাজনীতি করতাম আপনারা নিশ্চয়ই আমার পাশে যারা বসে আছেন জানেন যে, তালে তাল মিলিয়ে গালে গাল মিলিয়ে বহুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। কিন্তু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই, রাজনীতি করেছিলাম মানুষের মুক্তির জন্য। সে মানুষের মুক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে, যদি মানুষ তার শাসনতন্ত্র না পায়। আইনের শাসন না পায়। দেশের অবস্থা আপনারা ভালাে করে জানেন, আপনারা বুদ্ধিজীবী মানুষ, আপনারা লেখাপড়া করেন। আপনারা আইন নিয়া আলােচনা করেন। দেশের সমস্যা আপনাদের সামনে আসে। দেশের অবস্থা আপনারা ভালাে করে জানেন।
অনেকেই আপনারা এখানে ছিলেন। অনেকেই রাত্রে ঘুমাতে পারেন নাই, রাত্রে ইয়া নাফসি-ইয়া নাফসি করে আপনাদের দিন কাটাতে হয়েছে। অনেকের দেশত্যাগ করে মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল। অনেকেই আত্মগােপন করেছিলেন। আপনারা জানেন যে, কী পৈশাচিক তাণ্ডবলীলা আমার বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে। পুরা অর্থনীতি ভেঙ্গে চুরমার করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে, পুলিশ বাহিনী, বিডিআরকে ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে নষ্ট করা হয়েছে। কোর্টও সব ধ্বংস করা হয়েছে। একটা ভস্মীভূত দেশের উপরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তারপরেও যাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সেই দিক দিয়ে আমরা নজর দেবার চেষ্টা করেছি, যাতে আপনাদের অসুবিধা না হয়।
আপনারা নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে শােকর করবেন, যে বেতন আপনারা পান, কোর্টে আপনারা আসেন, গাড়ি আপনারা চড়েন, পেট্রোল আপনারা পান, রাত্রে ঘুমাতে পারেন, আপনাদের শােকর করা প্রয়ােজন। কারণ কী ছিল আপনাদের, আপনারা ভালাে করে জানেন। কী দিয়ে এই দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছি সে অবস্থা আপনারা ভালাে করে জানেন। আমি এই বিষয়ে আলােচনা করতে আপনাদের কাছে চাই না। কিন্তু আমরা চ যে, আইনের শাসন হউক। বহুদিন আমরা দাবি করেছি যে, আজকে শাসনতন্ত্র হয়ে গেছে। শাসনতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে আমরা কীভাবে কাজ করি তার উপর নির্ভর করে।
কাগজে অনেক ভালাে ভালাে কথা লেখা থাকে। দুনিয়ার কোনাে শাসনতন্ত্রেই খারাপ কথা লেখা নাই। কিন্তু সেটা যদি আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে কাজ করে এগিয়ে না যাই তাহলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আমাদের শাসনতন্ত্রে আমাদের আদর্শ আছে। যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। যেমন চারটা স্তম্ভের উপরে এই দেশের, আমরা তাকে ফান্ডামেন্টাল রাষ্ট্র-আদর্শ বলি। চারটা রাষ্ট্রীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই দেশ চলবে। এইটাই হইল মূল কথা। এইটাকেই যদি ধ্বংস করতে কেউ না পারে, যেমন এক্সিকিউটিভ, যেমন আইনসভা তেমনি আপনাদের সুপ্রীম কোর্টেরও অধিকার রয়েছে যাতে এর উপরে কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে। আপনারা যখন বলেন, আমরাও তখন বলেছি এবং আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, জুডিসিয়ারি সেপারেট হবে এক্সিকিউটিভ থেকে। অনেকে বলেন, কমপ্লিট সেপারেশন। কোনাে রাষ্ট্রে কোনাে কিছু কমপ্লিট সেপারেশন হয় না। একই সঙ্গে একটা অন্যটার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একই রাষ্ট্রের কাঠামাের মধ্যে যে অরগানগুলি থাকে যেমন জুডিসিয়ারি একটি অরগান, যেমন এক্সিকিউটিভ একটি অরগান। এর মধ্যে যদি কোঅপারেশন না থাকে, তাহলে সে দেশের মধ্যে কেওয়াজ সৃষ্টি হয়, যে কেওয়াজের ফলে শেষ পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালের পর থেকে আপনাদের যে দশা হয়েছিল সে দশাই হবে। একটার সঙ্গে অন্যটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু যার যার যেখানে ক্ষমতা রয়েছে সেটাকে নিশ্চয়ই প্রতিপালন করবেন।
আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। আপনারা আইনের শাসন পরিচালনা করবেন। আইনের মধ্যে যদি গােলমাল হয়, সেখানে আপনাদের সংশােধন করার ক্ষমতা রয়েছে। মনে করেন তাতে পরিপূর্ণতা হচ্ছে না। আপনাদের ক্ষমতা রয়েছে নতুন আইন পাস করার। এমন আইন পাস করা উচিত হবে না দেশের মধ্যে রেষারেষি সৃষ্টি হয়।।
১৩৬

সেজন্য আইনের শাসন করতে হলে, দেশের যে আমাদের শাসনতন্ত্রের মধ্যে যে মৌলিক জিনিস রয়েছে সেটাকে মেনে নিয়েই করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি আইনজীবী নই, আপনারা আইনজীবী আপনারা ভালাে বুঝেন, আপনারা বুদ্ধিজীবী, আপনারা ভালাে বুঝেন। আমি আইনজীবী কোনাে দিন হতে পারি নাই, তবে আসামি হওয়ার সৌভাগ্য আমার যথেষ্ট হয়েছে জীবনে। আপনাদের কাছে সেটি আমার অনুরােধ থাকবে দেশের শাসনতন্ত্রকে যাতে উপযুক্ত ব্যবহার করা হয়, সেদিকে আপনারা নজর রাখবেন। কারণ সে ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে আপনাদের দেওয়া হয়েছে। যে আইন শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে হবে তার সম্বন্ধে মতামত দেবার অধিকার আপনাদের রয়েছে, নাকচ করার অধিকার আপনাদের রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে যায়। সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। আমি আপনাদের অ্যাডভাইজ দিতে চাই না, আপনারা এ জিনিসটা আমার চেয়ে অনেক ভালাে বুঝেন, আপনারা করবেন, আপনাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ কোনােদিন হস্তক্ষেপ করবে না আপনাদের অধিকারের উপরে। সে সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এবং যতটা তাড়াতাড়ি হয় আমরা চেষ্টা করব যাতে জুডিসিয়ারি সেপারেটভাবে কাজ করতে পারে।
দ্বিতীয় কথা, আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যে ইংরেজি ভাষায় অনেক কিছু আমাদের চলছে। ইংরেজি ভাষা আমাদের রক্তের মধ্যে কিছু কিছু আছর করেছে সন্দেহ নাই এবং ইংরেজি ভাষা আমাদের পরিভাষার প্রয়ােজন সেটাও বুঝি, কিন্তু এ পরিভাষার জন্য যদি চিন্তা করি, হয়ত বাংলা ভাষা হবে না। সেজন্যই আমরা শাসনতন্ত্রে কোনাে ভায়া মিডিয়া রাখি নাই, যে পাঁচ বৎসরে, দশ বৎসরের মধ্যে বাংলা থেকে ইংরেজিতে পৌঁছতে হবে। আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করুন। এভাবেই যা শেষ পর্যন্ত ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে। আমরা আর পরিভাষা কমিটি করার কথা চিন্তা করছি না। তাহলে জীবনে আর ভাষা হয় নাই। অনেক পরিভাষার ইতিহাস রয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি সাহেব, বেয়াদবি মাফ করবেন। এইটা আমাদের, যা আমি দেখেছি, অনেক দেশে ঘুরেছি যারা তাদের অক্ষর পর্যন্ত নাই, তারা নিজের ভাষায় কথা বলে, নিজের ভাষায় লেখে এবং জাজমেন্ট দেয়।।
অল্প কথায় লিখুন, যতটুকু পারা যায়, লেখা যায়, আমরাও চেষ্টা করতেছি, আমাদেরও অসুবিধা হয়ে যায়, আমরাও মাঝে মধ্যে অসুবিধা ফিল করি, এই যে ফিল করি বলে বললাম, হয়ে যায়, আমাদেরও হয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতেছি আর কিছু না পারি যখন ইংরেজি লেইখা নিয়া আসে এইটা বাংলায় সাইন করে দেই। যে বাবা বদলায় নিয়া আসাে, ঐটা আমরা করছি, তাই আমরাও আশা করব যে, আপনাদের হাইকোর্টে, সুপ্রীম কোর্টের যেখানে আপনারা লেখতে আরম্ভ করেছেন। অফিস-আদালতে বলেছি যতগুলি টাইপ রাইটিং মেশিন দরকার চেষ্টা করব আপনাদের পৌঁছাবার জন্য।
সহযােগীদের জন্য আমরা কাজ করতেছি, শিগগির কাজ শেষ করে যত তাড়াতাড়ি হয় তা আপনারা পাবেন। আপনাদের অসুবিধা আছে সে আমরা বুঝি, সে অসুবিধা দূর করতে যতটা সাহায্যের প্রয়ােজন, পয়সা নাই, অর্থ নাই তাহলে কোনাে কৃপণতা করবাে না, আশ্বাস আপনাদেরকে দেবার পারি। কিন্তু কমিশন করে আর সময় নষ্ট করতে চাই না, এ কাজটা করব।
কমিশন শুনলে মাঝে মাঝে নিজের কাছে ভয় পাই। বহু কমিশন ২৫ বছরে শুনেছি, এটার জন্য আমরা নিজের কাছে একটু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। যদিও আমাকে মাঝে মাঝে করতে হয়। কমিশন করতে হয়, পে-কমিশন করতে হয় তাহলে আমিও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আর আপনাদের এখানে আসার সময় বিচারপতি সাহেব বারবার দেখিয়েছেন, বারের বিল্ডিংটা আমার ঐটা এখনও হয় নাই। কাজ শুরু হইয়া নাকি বন্ধ হয়েছে। যাক, এটা যেন বন্ধ না হয়; চেষ্টা করে দেখব, কাজ যেন শুরু হয় সেটা দেখব। শিগগিরই কাজ শুরু হয়ে যাবে। খতম কবে হবে বলতে আমি পারি না। তবে সময় একটু লাগবে, তবে শিগগিরই শুরু হবে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকেন। আমরা
১৩৭

চাই সেটাকে ঠিক করার জন্য, যেমন ধরেন, আমাদের কাছে যখন আমরা এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বারের থেকে বলল যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা লাগবে বই কিনার জন্য। আমাদের কিছু ছিল না কিন্তু যেইটা চেয়েছেন, সেইটা আমরা আপনাদের দিয়া দিয়াছি। বৈদেশিক মুদ্রা দিয়া দিছি, বই কিনা নিয়া আসেন-এই বারের লাইব্রেরির জন্য। বৈদেশিক মুদ্রা চেয়েছেন দেরি করি নাই। যা চেয়েছেন তাই দিয়েছি। যদি এরকম কোনাে জিনিসের প্রয়ােজন হয়, যখন চাবেন যতটুকু আমরা পারি নিশ্চয়ই করব। আমি একটু ওয়াদা কম করি আপনারা জানেন। কারণ বাংলাদেশের মানুষকে দাঁড়ায়ে প্রথমেই বলেছিলাম তিন বৎসর আমি কিছু দিবার পারব না। যদি কিছু পারি ভালাে কথা, দেবার পারব না বলেই আমি শুরু করি। কারণ মিথ্যা ধোকা দিয়া লাভ নাই কিছু। নাই দেশের মধ্যে কিছু। যারা বড় বড় কথা বলেন তারা ভেতরে ঢুকলে বুঝতে পারতেন, বােধ হয় পাগল হয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকেরই যেতে হতাে। আপনাদের পাবনাতে যেতে হতাে অনেকেরই। এ দেশের কী অবস্থা ছিল! যাই হউক, আপনারা আমার বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনারা যে আমায় সুযােগ দিয়েছেন, আজ আমার স্বাধীন দেশের সুপ্রীম কোটে আসার যে সৌভাগ্য হয়েছে সেজন্য আপনাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।।
আইনের শাসন এ দেশে হবে এবং আমাদের শাসনতন্ত্র যে হয়েছে, আমরা চেষ্টা করব সকলে মিলে চেষ্টা করব যাতে এটার যে আদর্শ দেওয়া হয়েছে আদর্শকে রক্ষা করা এবং এখানে সুপ্রীম কোর্টের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এবং আপনাদের যে সাহায্য সহযােগিতা প্রয়ােজন, আপনারা সেটা পাবেন। আপনাদের কোনাে কাজে আমরা ইন্টারফেয়ার করতে চাই না। আমরা চাই যে, দেশে আইনের শাসন কায়েম হউক। তবে একটা কথা আছে, দেশের অবস্থা আপনাদের বিবেচনা করে চলা উচিত। অনেক সময় যদি বেশি আপনারা করতে যান তবে দেশের মধ্যে আইনশৃঙ্খলার খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়, তবে যেমন আমিও কষ্ট ভােগ করব, আপনিও কষ্ট ভােগ করবেন, সেদিকে আপনাদের খেয়াল রাখারও প্রয়ােজন আছে।
বেয়াদবি মাফ করবেন, যদি একটা গল্প আপনাকে বলি, ধরেন আমরা একটা আসামি ধরলাম, আপনাদের ক্ষমতা আছে, পাওয়ার আছে হয়তাে এটা পারবেন। কিন্তু সে ডাকাত, তিনটা মার্ডার করছে, এখানে হাইজ্যাক করতেছে, গাড়ি ধরতেছে, লুট করতেছে, তাকে ধরে আনা হলাে, বন্দুকসহ ধরে নিয়ে আসা হলাে। পরের দিন যে লােক খবর দিল, তাহলে তাকে আমরা গ্রেফতার করে আমরা ছেড়ে দিলাম জেলখানা থেকে। তিনি বেল পাইয়া গেলেন, যাইয়া যে খবর দিলেন তাকে গিয়ে মার্ডার করলেন, আমরা তাকে জামিন দিয়ে দিলাম, তারপরের দিন যদি আইসা হাইকোর্টের জজ সাহেবকে বাড়ির থেকে আবার হাইজ্যাক করে নিয়া যাবে তখন আইনের অবস্থা কী হয়।
সেই জন্যই আমি বলি আমাদের ওতপ্রােতভাবে সবকিছু জড়িত। কিন্তু দেশের অবস্থা, দেশের মানসিকতা, দেশের আবহাওয়া বিবেচনা করেও চলতে হবে। তা না হলে শুধু আইন করে চলে না কোনাে কিছুই। স্বাধীন দেশের প্রত্যেকটি অরগানের সাথে অন্যান্য অরগান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা চলতে পারে না, চললেও কষ্ট হয়।
সেজন্য যখন বলেন কমপ্লিট ইন্ডিপেন্ডেট, সেখানে আমি বলি না ইন্ডিপেডেন্ট। কারণ রাষ্ট্রের কাঠামাের মধ্যেই এবং শাসনতন্ত্রের ভেদ কাঠামাের মধ্যেই আমাদের সবকিছুতেই চলতে হবে। এজন্যই আমাদের যার যা কর্তব্য আমাদের পালন করতে হবে।
সেজন্য আমি আবার আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে, যে সুযােগ দিয়েছেন সেজন্য আপনাদের আবার আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনাদের যদি কোনাে ব্যাপারে কোনাে অসুবিধা হয় আপনারাও এ দেশের সন্তান। আমি সেজন্য নির্বাচনও দিয়ে দিয়েছি। যদি আবার জনসাধারণ যাদের ভােট দিবেন তারা আসবেন, তবে শাসনতন্ত্র যা দেওয়া হয়েছে এ শাসনতন্ত্র দুনিয়ায় এত তাড়াতাড়ি কেহ দিবার পারেন নাই। এত বিপদ-আপদ, এত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের
১৩৮

মধ্যে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এত তাড়াতাড়ি এজন্য দিয়েছি যে আইনের শাসনে বিশ্বাস করি এবং সেজন্যে শাসনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে। আশা করি, আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক; আজ আমাদের শাসনতন্ত্র হয়েছে যার জন্য বহু রক্ত গেছে এ দেশের। আজ আমাদের সুপ্রীম কোর্ট হয়েছে। যার কাছে মানুষ বিচার আশা করে। সেই কথা বলে আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে, বারকে ধন্যবাদ দিয়ে, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে বিচারপতিগণকে এবং যারা উপস্থিত আমার মুরুব্বি আছেন তাদেরকে, যারা আমার সহকর্মী আছেন তাদেরকে, যারা উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী, ভদ্রমহিলা আছেন তাদেরকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
জয় বাংলা।

১৩৯

বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে প্রণীত আইনসমূহ
১৯৭১-১৯৭৫
বঙ্গবন্ধুর সময়ে প্রণীত আইনসমূহ
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন ও বিচার কাঠামাের গােড়াপত্তন হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বিষয়ক কোনাে আলােচনা সম্ভব নয়। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে প্রণীত আদেশ, অধ্যাদেশ ও আইনসমূহের একটি তালিকা (১৯৭১-১৯৭৫) এখানে প্রদান করা হলাে। এই তালিকায় দৃষ্টিপাত করলে বােঝা যাবে কী অসম্ভব দূরদর্শিতা নিয়ে আইনের শূন্যতা পূরণে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয়, আন্তর্জাতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামষ্টিক, রাষ্ট্রায়ত্তকরণসহ প্রাণ, পরিবেশ, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, সমুদ্র, পতাকা, যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচার ইত্যাদি এমন কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নেই যে বিষয়ে তিনি আইনি কাঠামাে প্রণয়ন করেননি।
এই তালিকা বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি আইনের শিরােনামের শেষে তারিখ ও পৃষ্ঠা নম্বরসহ রেফারেন্স প্রদান করা হয়েছে।

সাংবিধানিক প্রকৃতির আইনসমূহ

26 March 1971
The Declaration of Independence [বাংলাদেশের রাষ্ট্রের প্রথম সাংবিধানিক দলিল]।

10 April 1971
The Proclamation of Independence [বাংলাদেশের রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সাংবিধানিক দলিল] see Bangladesh Gazette (BG) dated 23 May 1972, p. 909.

10 April 1971
Laws Continuance Enforcement Order, 1971 [Search got a foto atala angall see BG dated 2 May 1971, p. 912.

11 January 1972 .
Provisional Constitution of Bangladesh Order, 1972. [বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জারিকৃত প্রথম সাংবিধানিক আদেশ], see BG dated 11 January 1972, p. 47.

১৪১

বঙ্গবন্ধুর সময়ে প্রণীত রাষ্ট্রপতির আদেশসমূহ (প্রেসিডেন্ট’স অর্ডার) (পূর্ণাঙ্গ
তালিকা)

1971
The Bangladesh (Collection of Taxes) Order, 1971, (Acting President’s Order [A.P.O.] No. 1 of 1971), see BG dated 26 December 1971; (BG), p. 9.
The Bangladesh Bank (Temporary) Order, 1971, (A.P.O. No. 2 of 1971), see BG dated 26 December 1971; (BG), p. 11.
The Bangladesh (Administration of Banks) Order, 1971, (A.P.O. No. 3 of 1971), see BG dated 29 December 1971; (BG), p. 23.
The Bangladesh (Industrial Development Bank) Order, 1971, (A.P.O. No. 4 of 1971), see BG dated 30 December 1971; (BG), p. 25.
The Bangladesh (Regulation of Payment of Remuneration of Private Employees) Order, 1971, (A.P.O. No. 5 of 1971), see BG dated 31 December 1971; (BG), p. 37.

1972
The Bangladesh (Taking Over of Control and Management of Industrial and Commercial Concerns) Order, 1972, (P.O. No. 1 of 1972), see BG dated 3 January 1972; (BG), p. 7.
The Air Bangladesh International (Temporary) Order, 1972, (P.O. No. 2 of 1972), see BG dated 4 January 1972; (BG), p. 21.
The Bangladesh (Administration of Financial Institutions) Order (P.O. No. 3 of 1972), see BG dated 7 January 1972; (BG), p. 35..
The Bangladesh (Adaption of Central Board of Revenue Act) Order (P.O. No. 4 of 1972), see BG dated 7 January 1972; p. 37.
The High Court of Bangladesh Order (P.O. No. 5 of 1972), see BG dated 17 January 1972; p. 77.
Bangladesh Law Officers Order, 1972 (P.O. No. 6 of 1972), see BG dated 20 January 1972; (BG), p. 95.
The Bangladesh Local Council and Municipal Committees (Dissolution and Administration) Order (P.O. No. 7 of 1972), see BG dated 20 January’ (BG). p. 103.
The Bangladesh Collaboration (Special Tribunal) Order (P.O. No. 8 of 1972), see BG dated 24 January 1972; p. 177.
১৪২

Government of Bangladesh (Service) Order (P.O. No. 9 of 1972), see BG dated 24 January 1972; (BG), p. 125.
The Bangladesh Shipping Corporation Order, 1972 (P.O. No. 10 of 1972), see BG dated 5 February 1972; (BG), p. 151.
The Bangladesh Collaboration (Special Tribunal) (Amendment) Order (P.O. No. 11 of 1972), see BG dated 24 January 1972; (BG), p. 161.
The Bangladesh (Legal Proceedings) Order, 1972 (P.O. No. 12 of 1972), see BG dated 7 February 1972: (BG), p. 163.
The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) Order, 1972 (P.O. No. 13 of 1972), see BG dated 18 February 1972: (BG), p. 211.
The Bangladesh Public Service (Retirement) Order, 1972 (P.O. No. 14 of 1972), see BG dated 14 February 1972: (BG), p. 253.
The Bangladesh (Comptroller and Auditor-General) Order, 1972 (P.O. No. 15 of 1972), see BG dated 28 February 1972: (BG), p. 261.
The Bangladesh Abandoned Property (Control, Management and Disposal) Order, 1972 (P.O. No. 16 of 1972), see BG dated 28 February 1972; (BG). p. 265.
The Bangladesh Local Council and Municipal Committees (Dissolution and Administration) (Amendment) Order, (P.O. No. 17 of 1972), see BG dated 29 February 1972; (BG). p. 327.
The Bangladesh Insurance Corporation Order, (P.O. No. 18 of 1972), see BG dated 1 March 1972; (BG). p. 343.
The Bangladesh (Adaptation of Insurance Act) Order, 1972, (P.O. No. 19 of 1972). see BG dated 1 March 1972; (BG). p. 357.
The Bangladesh Bank (Demonetisation of Currency Notes) Order, 1972 (P.O. No. 20 of 1972), see BG dated 4 March 1972; (BG), pp. 361.
The Jatiya Rakkhi Banini Order, 1972 (P.O. No. 21 of 1972), see BG dated 8 March 1972; (BG), pp. 483.
The Constituent Assembly of Bangladesh Order, 1972 (P.O. No. 22 of 1972), see BG dated 23 March 1972; (BG), pp. 473.
The Bangladesh Constituent Assembly Members (Cessation of Membership Order, 1972 (P.O. No. 23 of 1972), see BG dated 23 March 1972; (BG), p. 479.
The member of the Constituent Assembly (Salaries and Allowances) Order, 1972 (P.O. No. 24 of 1972), see BG dated 23 March 1972, (BG), pp. 481.
১৪৩

The Bangladesh Election Commission Order, 1972 (P.O. No. 25 of 1972), see BG dated 25 March 1972, (BG), pp. 485.
The Bangladesh Banks (Nationalization) Order, 1972 (P.O. No. 26 of 1972), see BG dated 26 March 1972; (BG) pp. 499.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) Order No. 27 of 1972), see BG dated 26 March 1972; (BG), pp. 511.
The Bangladesh Inland Water Transport Corporation Order, No. 28 of 1972) see BG dated 26 March 1972; pp. 521.
The Bangladesh (Vesting of Property and Assets) Order, 1972 (P.O. No. 29 of 1972), see BG dated 26 March 1972; (BG), p. 529.
Bangladesh Insurance (Emergency Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 30 of 1972), see BG dated 26 March 1972; (BG), pp. 531.
The Air Bangladesh International (Temporary) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 31 of 1972), see BG dated 30 March 1972: (BG). p. 561.
The Constituent Assembly of Bangladesh (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 32 of 1972), see BG dated 23 March 1972, (BG), pp. 485
The Bangladesh Shipping Corporation (Amendment) Order No. 33 of 1972), see BG dated 7 April 1972; (BG), p. 575.
The Bangladesh Public Service Commission Order No. 34 of 1972), see BG dated 8 April 1972; (BG), p. 577.
The Bangladesh (Resumption of Easement Lands) Order No. 35 of 1972), see BG dated 18 April 1972; (BG), p. 619.
The Bangladesh (Adaptation of East Pakistan Intermediate and Secondary Education Ordinance) Order, 1972 (P.O. No. 36 of 1972) see BG April 1972; (BG), p. 635.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 37 of 1972), see BG dated 25 April 1972, (BG), pp. 651.
The Bangladesh Banks (Nationalization) (Amendment) Order, 1972 P.O No. 38 of 1972), see BG dated 29 April 1972; (BG), p. 665
The Bangladesh Industrial Development Corporation Order, 1972 (P.O. NO. 39 of 1972), see BG dated 9 May 1972; (BG), pp. 771.
The Cinematograph (Bangladesh Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 40 of 1972), see BG dated 16 May 1972; (BG), p. 797.
১৪৪

The Censorship of Films (Bangladesh Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 41 of 1972), see BG dated 16 May 1972: (BG), pp. 799.
The Speaker and Deputy Speaker (Remuneration and Privileges) Order, 1972 (P.O. No, 42 of 1972), see BG dated 16 May 1972, (BG) p. 803.
The East Pakistan Madrasah Education Ordinance (Repeal) Order. 1972 (P.O. No. 43 of 1972), see BG dated 17 May 1972; (BG) p. 809.
The Bangla Academy Order, 1972 (P.O. No. 44 of 1972), see BG dated 17 May 1972: (BG). pp. 811.
The Bangladesh Names and Emblems (Prevention of Unauthorized Order, 1972 (P.O. No. 45 of 1972), see BG dated 17 May 1972: (BG). pp. 823.
Bangladesh Legal Practitioner and Bar Council Order, 1972 (P.O. No. 46 of 1972), see BG dated 18 May 1972; (BG). pp. 831.
The Bangladesh Consumer Supplies Corporation Order, 1972 (P.O. No. 47 of 1972), see BG dated 19 May 1972; (BG), pp. 845.
The Bangladesh (Adaptation of Existing Bangladesh Laws) Order, 1972 (P.O. No. 48 of 1972), see BG dated 22 May 1972; (BG), pp. 865.
Bangladesh Special (Remuneration and Privileges) Order, 1972 (P.O. No. 49 of 1972), see BG dated 22 May 1972; (BG), pp. 869.
The Bangladesh Scheduled Offenses (Special Tribunal) ) Order, 1972 (P.O. No. 50 of 1972), see BG dated 22 May 1972; (BG), pp. 873.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Second Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 51 of 1972), see BG dated 23 May 1972; (BG), p. 903.
The Finance (1971-1972) Order, 1972 (P.O. No. 52 of 1972), see BG dated 24 May 1972. (BG), p. 921. Practitioners and Bar Council (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 53 of 1972), see BG dated 26 May 1972. (BG), p. 963.
The Bangladesh Nationalized and Private Organizations (Regulation of Salary of Employees) Order (P.O. No. 54 of 1972), BG dated 26 May 1972; (BG), p. 965.
The Bangladesh Nationalized Enterprises and Statutory Corporations (Prohibition of Strikes and Unfair Labor Practices) Order (P.O.No.55 of 1972), BG dated 29 May 1972; (BG), p. 969.
The Bangladesh Railways (Transport of Goods) Order (P.O. No. 56 of 1972), BG dated 30 May 1972; (BG), p. 917.
১৪৫

The Bangladesh Jute Export Corporation Order (P.O. No. 57 of 1972), BG dated 30 May 1972; (BG), p. 977.
The Bangladesh (Transaction of Government Business) Order (P.O. No. 58 of 1972), BG dated 31 May 1972; (BG), p. 991.
The Bangladesh Water and Power Development Boards Order (P.O. No. 59 of 1972), BG dated 31 May 1972; (BG), p. 995.
The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) (Second Amendment) Order (P.O. No. 60 of 1972), BG dated 02 June 1972; (BG), p. 1011.
The Bangladesh (Demonetisation of Bank Notes) Order, (P.O. No. 61 of 1977), see BG dated 8 June 1972; (BG), pp. 1017.
The Bangladesh Taxation Laws (Adaptation) Order, 1972 (P.O. No. 62 of 1972), see BG dated 8 June 1972; (BG), pp. 1025.
The Bangladesh College of Physicians and Surgeons Order, (P.O. No. 63 of 1972), see BG dated 8 June 1972: (BG), pp. 1033.
The Bangladesh (Whips) Order, 1972 (P.O. No. 64 of 1972), dated 8 June 1972; (BG), pp. 1039
The Tea Ordinance (Amendment) Order, (P.O. No. 65 of 1972), see BG dated 8 June 1972; (BG) pp. 1041.
The Bangladesh (Demonetisation of Bank Notes) (Amendment) Order, 1972. (P.O. No. 66 of 1972), see BG dated 10 June 1972; (BG) pp. 1049.
The Government of Bangladesh (Service Screening) Order, (P.O. No. 67 of 1972), see BG dated 13 June 1972; (BG), pp. 1063.
The Trading Corporation of Bangladesh Order, 1972 (P.O. No. 68 of 1972), see BG dated 14 June 1972; (BG), pp. 1067.
The Bangladesh (Legal Proceedings) (Second) Order, 1972 (P.O. No. 69 1972), see BG dated 16 June 1972; (BG), pp. 1079.
The Census Order, 1972 (P.O. No. 70 of 1972), see BG dated 22 June 1972, (BG), pp. 1121.
The Government Educational and Training Institutions (Adaptation) Order, P.O. No. 71 of 1972), see BG dated 24 June 1972; (BG), p. 1133.
The State Acquisition and Tenancy (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 72 1972), see BG dated 28 June 1972; (BG), p. 1139.
The Bangladesh Government Hats and Bazaars (Management) Order, 1972 (P.O. No. 73 of 1972), see BG dated 28 June 1972; (BG). pp. 1141.
১৪৬

The Bangladesh (Budgetary Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 74 of 1972), see BG dated 29 June 1972; (BG). pp. 1151.
The Finance (1971-1972) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 75 of 1972), see BG dated 30 June 1972; (BG), pp. 1161.
The National Board of Revenue Order, 1972 (P.O. No. 76 of 1972), see BG dated 30 June 1972; (BG), pp. 1169.
The Finance Order, 1972 (P.O. No. 77 of 1972), see BG dated 30 June 1972. P. (BG), p. 1179.
The Bangladesh Industrial Development Corporation (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 78 of 1972), see BG dated 4 July 1972; (BG), p. 1363.
The Bangladesh Government and Semi-Autonomous Organisation (Regulation of Salary of Employees) Order, 1972 (P.O. No. 79 of 1972), see BG dated 06 July 1972; (BG), pp. 1373.
The Water Supply and Sewerage Authority (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 80 of 1972), see BG dated 13 July 1972; (BG), pp. 1409.
The Printing Corporation (Vesting) Order, 1972 (P.O. No. 81 of 1972), see BG dated 17 July 1972; (BG), pp. 1419.
The Bangladesh (Whips) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 82 of 1972), see BG dated 24 July 1972; (BG), p. 1447.
The Bangladesh Coinage Order, 1972 (P.O. No. 83 of 1972), see BG dated 24 July 1972; (BG), pp. 1449.
The Bangladesh Currency Order, 1972 (P.O. No. 84 of 1972), see BG dated 24 July 1972; (BG), pp. 1455.
The Bangladesh Government and Local Authority lands and Buildings (Recovery of Possession) Order, 1972 (P.O. No. 85 of 1972), see BG dated 29 July 1972; (BG), p. 1471.
The International Financial Organisations Order, 1972, (P.O. No. 86 of 1972), see BG dated 31 July 1972; (BG), pp. 1667.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalisation) (Third Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 87 of 1972), see BG dated 2 August 1972 (BG), p. 1655.
The State Acquisition and Tenancy (Second Amendment) Order, P.O. No. 88 of 1972), see BG dated 3 August 1972; (BG), pp. 1667.
The Cadet College Ordinance (Amendment) Order, 1972 (P.O. No 89 of 1972), see BG dated 3 August 1972; (BG), pp. 1669.
১৪৭

The Bangladesh (Legal Proceedings) (Third) Order, 1972 (P.O. No. 90 of 1972), see BG dated 3 August 1972; (BG), p. 1673.
The High Court of Bangladesh (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 91 of 1972), see BG dated 3 August 1972; (BG), p. 1675.
The Emergency Requisition of Property (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 92 of 1972), see BG dated 5 August 1972; (BG), p. 1683.
The Government of Bangladesh (Service Screening) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 93 of 1972), see BG dated 5 August 1972; (BG), p. 1685.
The Bangladesh (Freedom Fighters) Welfare Trust Order, 1972 (P.O. No 94 of 1972), see BG dated 1972; (BG), pp. 1689.
The Bangladesh Insurance (Nationalization) Order, 1972 (P.O. No. 95 of 1972), see BG dated 8 August 1972; (BG), pp. 1701.
The State Acquisition and Tenancy (Third Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 96 of 1972), see BG dated 15 August 1972; (BG), pp. 1819
The Bangladesh (Legal Proceedings) (Second) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 97 of 1972), see BG dated 15 August 1972; (BG), pp. 1823.
The Bangladesh Land Holding (Limitation) Order, 1972 (P.O. No. 98 of 24 see BG dated 15 August 1972; (BG), pp. 1825.
The Bangladesh Malaria Eradication Board Order, 1972 (P.O. No. 99 of 24 see BG dated 18 August 1972; (BG), pp. 1865.
Employment of Labor (Standing Orders) (Amendment) Order, 1972 PO No. 100 of 1972), see BG dated 21 August 1972; (BG). p. 1883.
The Chittagong Port (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 101 of 1972), see BG dated 28 August 1972; (BG), pp. 1921.
The Telegraph (Bangladesh Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 102 of 1972), see BG dated 28 August 1972; (BG), pp. 1923.
The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) (Third Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 103 of 1972), see BG dated 29 August 1972; (BG), pp. 1931.
The Bangladesh Electoral Rolls Order, 1972 (P.O. No. 104 of 1972), see BG dated 29 August 1972; (BG), pp. 1939.
The Bangladesh Scheduled Offenses (Special Tribunals) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 105 of 1972), see BG dated 2 September 1972; (BG), pp. 1973.
১৪৮

The Members of The Constitution Assembly (Salaries and Allowances) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 106 of 1972), see BG dated 7 September 1972; (BG), pp. 2009.
The Employment (Record of Service) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 107 of 1972), see BG dated 8 September 1972; (BG), pp. 2041.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Fourth Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 108 of 1972), see September 1972; (BG), p. 2043.
The Small Industries Corporation (Amendment) Order, 1972 (P. O. No 109 of 1972), see BG dated 9 September 1972; (BG), pp. 2049.
The Bangladesh Local Council and Municipal Committees (Dissolution and Administration) (Second Amendment) Order, 1972 (P.O. No 110 of 1972), see BG dated 11 September 1972; (BG), pp. 2057.
The Bangladesh Boy Scouts Samity Order, 1972 (P.O. No 111 of 1972), see BG 11 September dated 1972; (BG), pp. 2059.
The Bangladesh Local Council and Municipal Committees (Dissolution and Administration) (Third Amendment) Order, 1972 (P.O. No 112 of 1972), see BG dated 11 September 1972; (BG), pp. 2061.
The Dacca High Court Judges (Retirement, Emoluments and Benefits Order, 1972 (P.O. No. 113 of 1972), see BG dated 11 September 1972; (BS). p. 2063.
The High Court of Bangladesh (Second Amendment) Order, 1972 (P.O.NO 114 of 1972), see BG dated 11 September 1972; (BG), pp. 2065.
The Pakistan Television Corporation (Taking Over) Order, 1972 (P.O.NO 115 of 1972), see BG dated 15 September 1972; (BG), pp. 2173.
The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council (Second Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 116 of 1972), see BG dated 15 September 1972: (BG), p. 2177.
The Bangladesh Committee of Management (Temporary Arrangement) Order, 1972 (P.O. No. 117 of 1972), see BG dated 1972; (BG), PP. 2231.
The Bangladesh Bank (Demonetisation of Currency Notes) (Amendment) Order. 1972 (P.O. No. 118 of 1972), see BG dated 21 September 1972; (BG), p. 2235.
The Bangladesh Bank (Demonetisation of Currency Notes) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 119 of 1972), see BG dated 21 September 1972; (BG), p. 2237.
The Bangladesh Mineral Exploration and Development Corporation Order, 1972 (P.O. No. 120 of 1972), see BG dated 26 September 1972: (BG), p. 2299.
The Bangladesh Public Services’ (Retirement) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 121 of 1972), see BG dated 9 October 1972; (BG), p. 2429.
১৪৯

The Customs (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 122 of 1972), see BG dated 25 October 1972: (BG), p. 2851.
The Bangladesh Scheduled Officers (Special Tribunal) (Second Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 123 of 1972), see BG dated 25 October 1972; (BG), p. 2853.
The Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 124 of 1972), see BG dated 25 October 1972; (BG), p. 2857.
The Bangladesh Abandoned Property (Control, Management and Disposal) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 125 of 1972), see BG dated 28 October 1972; (BG), pp. 2887.
The Bangladesh Biman Order, 1972 (P.O. No. 126 of 1972), see BG dated October 1972; (BG), pp. 2889.
The Bangladesh Bank Order, 1972 (P.O. No. 127 of 1972), see BG dated October 1972; (BG), pp. 2933.
The Bangladesh Shilpa Rin Sangstha Order, 1972 (P.O. No. 128 of 1072), see BG dated 31 October 1972; (BG), pp. 2965.
The Bangladesh Shilpa Bank Order, 1972 (P.O. No. 129 of 1972), see BG dated 31 October 1972 (BG), pp. 2985.
The Bangladesh National Anthem, Flag and Emblem Order 1972 P.O. No. 130 of 1972), see BG dated 31 October 1972, pp 3005.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Fifth Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 131 of 1972), see BG dated 1 November (BG), pp. 3023.
The Bangladesh Banks (Nationalization) (Second Amendment) Order (P.O. No. 132 of 1972), see BG dated 1 November 1972; (BG), pp. 3027.
The Bangladesh Insurance (Nationalization) (Amendment) Order 1972 (P.O. No. 133 of 1972), see BG dated 1 November 1972; (BG), p. 3031.
The Bangladesh (Vesting of Property and Assets) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 134 of 1972), see BG dated 2 November 1972; (BG), p. 3039.
The State Acquisition and Tenancy (Fourth Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 135 of 1972), see BG dated 4 November 1972; (BG), p. 3045.
The State Acquisition and Tenancy (Fifth Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 136 of 1972), see BG dated 4 November 1972; (BG). p. 3049.
The State Acquisition and Tenancy (Sixth Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 137 of 1972), see BG dated 4 November 1972; (BG). pp. 3051.
১৫০

The Bangladesh Land Holding (Limitation) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 138 of 1972), see BG dated 4 November 1972; (BG), pp. 3053.
The Member of the Constitution Assembly (Salaries and Allowances) (Second Amendment) Order, (P.O. No. 139 of 1973) see BG dated 13 November 1972; (BG), pp. 3099.
The Bangladesh Industrial Development Corporation (Dissolution) Order, (P.O. No. 140 of 1973) see BG dated 15 November 1972; (BG), pp. 3109.
The Bangladesh National and Private Organizations (Regulation of Salary of Employees) (Amendment) Order, (P.O. No. 141 of 1973) see BG dated 20 November 1972; (BG), pp. 3151.
The Bangladesh Transfer of Immovable Property (Temporary Provisions) Oder, 1972 (P.O. No. 142 of 1972), see BG dated 20 November 1972; (BS). pp. 3153.
Bangladesh Parjatan Corporation Order, 1972 (P.O. No. 143 of 1972), see BG dated 27 November 1972; (BG), pp. 3251.
The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council (Third Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 144 of 1972), see BG dated 27 November 1972; (BG), p. 3257.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Sixth Amendment) Onder, 1972 (P.O. No. 145 of 1972), see BG dated 27 November 1972; (BS). pp. 3259.
The Railway Servants Group Insurance (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 146 of 1972), see BG dated 9 December 1972; (BG), p. 3371. The General Clauses (Amendment) Order. 1972 (P.O. No. 147 of 1972), see BG dated 15 December 1972; (BG), pp. 47-52.
The Bangladesh Rifles Order, 1972 (P.O. No. 148 of 1972), see BG dated 15 December 1972; (BG), pp. 3579.
The Bangladesh Citizenship (Temporary Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 149 of 1972), 456 see BG dated 15 December 1972; (BG), p. 3585.
The Bangladesh Adaptation of Existing Laws (Amendment) (P.O. No. 150 of 1972), see BG dated 15 December 1972; (BG), pp. 3587.
The Bangladesh (Taking Over of Control and Management of Industrial and Commercial Concerns) (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 151 of 1972), see BG dated 15 December 1972; (BG) p. 3589.
The Bangladesh Law Officers (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 152 of 1972), see BG dated 15 December 1972; (BG), p. 3591.
১৫১

The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Seventh Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 153 of 1972), see BG dated 15 December 1972; BG), p. 3593.
The Bangladesh Land Holding (Limitation) (Second Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 154 of 1972), see BG dated 15 December 1972; (BG), p. 3595
The Representation of The People Order, 1972 (P.O. No. 155 of 1972), see BG dated 26 December 1972; (BG), p. 3703.
The Small Industries Corporation (Second Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 156 of 1972), see BG dated 29 December 1972; (BG), p. 3817
The State Acquisition and Tenancy (Seventh Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 157 of 1972), see BG dated 30 December 1972; (BG), p. 3821.
The Premises Rent Control (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 158 of 1972), see BG dated 30 December 1972; (BG), p. 3823.
The Bangladesh (Freedom Fighters) Welfare Foundation (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 159 of 1972), see BG dated 30 December 1972; (BG), p. 3825.
The Tea (Control of Prices Distribution and Movement) Ordinance (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 160 of 1972), see BG dated 30 December 1972; (BG), p. 3827.
The Bangladesh Insurance Corporation (Dissolution) Order, 1972 (P.O. No. 161 of 1972), see BG dated 30 December 1972; (BG), p. 3829.
1973
The Code of Criminal Procedure (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 1 of 1973), see BG dated 4 January 1973, (BG), p. 35.
The Bangladesh Chartered Accountants Order, 1973 (P.O. No. 2 of 1973), see BG dated 6 January 1973, (BG), p. 227.
The Asian Development Bank Order, 1973 (P.O. No. 3 of 1973), see BG dated 24 January 1973, (BG), p. 365.
The Water Pollution Control (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 4 of 1973), see BG dated 27 January 1973, (BG), p. 379. The State Acquisition and Tenancy (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 5 of 1973), see BG dated 2 February 1973, (BG), p.3113.
The Bangladesh Land Holdings (Limitation) Order, 1973 (P.O. No. 6 of 1973), see BG dated 2 February 1973, (BG), p. 3115.
The Bangladesh House Building Finance Corporation Order, 1973(P.O. No. 7 of 1973) see BG dated 3 February 1973; (BG), p. 3123.
১৫২

The Representation of the People (Supplementary) Order, 1973 (P.O. No. 8 of 1973), see BG dated 3 February 1973; (BG), p. 3137.
The Bangladesh Passport Order, 1973 (P.O. No. 9 of 1974), see BG dated 8 February 1973, (BG), p. 3177
The University Grants Commission of Bangladesh Order, 1973 (P.O. No. 10 of 1973), see BG 15 February dated 1973, (BS) pp. 3223.
The Dhaka University Order, 1973 (P.O. No. 11 of 1973), see 15 February 1973, (BG), pp. 3229.
The Bangladesh Laws (Repealing and Amending) Order. 1973 (P. O. No. 12 of 1973), see BG dated 19 February 1973, (BG), pp. 3341.
The Pilotage (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 13 of 1973), see BG dated 19 February 1973, (BG), p. 3353.
The Excise (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 14 of 1973), see BG dated 20 February 1973; (BG), p. 3395.
The Bangladesh Atomic Energy Commission Order, 1973 (P.O. No. 15 of 1973), see BG dated 27 19 February 1973, p. 3391.
The Bangladesh National Liberation Struggle (Indemnity) Order. 1973 (P.O. No. 16 of 1973), see BG dated 28 February 1973, (BG), pp. 3399.
The Representation of the People (Seats for Women Members) Order, 1973 17 (P.O. No. 17 of 1973). see BG dated 10 March 1973, (BG). p. 3481.
The Bangladesh Offences (Special Tribunal) (Third Amendment) Order, 1973 17 (P.O. No. 18 of 1973). see BG dated 10 March 1973; (BG), p. 3489.
The Trade Marks (Invalidation and Summary Registration) Order. 1973 No. 19 of 1973) see BG dated 15 March 1973, (BG), p. 3585.
The Bangladesh Public Servant’s (Retirement) (Amendment) Order. 1973 No. 20 of 1973) see BG dated 22 March 1973; (BG), p. 3673.
The Supreme Court Judge (Terms and Condition of Service) Order. 1973 P.O. No. 21 of 1973) see BG dated 22 March 1973; (BG), p. 3675.
The Bangladesh Local Government (Union Parished and Purashava) Order. 1973 P.O. No. 22 of 1973) see BG dated 22 March 1973; (BG), p. 1
The Bangladesh Wild Life (Preservation) Order, 1973 (P.O. No. 23 of 1973), see BG dated 28 March 1973; (BG), p. 33723.
The State Acquisition and Tenancy (Second Amendment) Order. 1973 (P.O. No. 24 of 1973), see BG dated 29 March 1973; p. 3767.
১৫৩।

The Bangladesh Public Service Commission Order. 1973 (P.O. No. 25 of 1973), see BG dated 30 March 1973; p. 3769.
The Bangladesh Red Crescent Society Order, 1973 (P.O. No. 26 of 1973), see BG dated 31 March 1973, (BG), p.3895.
The Bangladesh Krishi Bank Order, 1973 See BG (P.O. No. 27 of 10 dated 1 April 1973, (BG), p.3777.
The Members of Parliament (Remuneration and Allowances) Order, 1973; (P.O. No. 28 of 1973), see BG dated 4 April 1973, (BG) p. 4011.
The Bangabondhu Award Fund Order, 1973; (P.O. No. 29 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 4023.
The Speaker and Deputy Speaker (Remuneration and Privileges) Order, 1973 (P.O. No. 30 of 1972), see BG dated 5 April 1973; p. 4027.
The Warehousing Corporation (Amendment) Order, 1972 (P.O. No. 31 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 4029.
The Bangladesh Agriculture Research Council Order, 1972 (P.O. No. 32 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 4033.
The General Clauses (Second Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 33 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 4039.
The Betterment Fees (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 34 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 4041.
The Speaker and Deputy Speaker (Remuneration and Privileges) (Second Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 35 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 4045.
The Municipal, Administration (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 36 of 1973), see BG dated 5 April 1973; p. 1047.
The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) (Amendment) Order, 1973 (P.O. No. 37 of 1973), see BG dated 6 April 1973; p. 4049.
১৫৪

বঙ্গবন্ধুর সময়ে জাতীয় সংসদে প্রণীত আইনসমূহ (স্ট্যাটিউট) (পূর্ণাঙ্গ তালিকা)

1973
The Representation of the People (Supplementary) (Amendment) Act 1973, (Act No. I of 1973), see BG dated 8 June 1973; (BG).
The Bangladesh Government Hats and Bazaars (Management) (Amendment) Act 1973, (Act No. II of 1973), see BG dated 8 June 1973; (BG).
Prime Minister’s (Remuneration and Privileges) Act 1973, (Act No. III of 1973), see BG dated 12 June 1973; (BG), p. 4847.
The Prime Ministers, Ministers of State and Deputy Ministers (Remuneration and Privileges) Act 1973, (Act No. IV of 1973), see BG dated 15 June 1973; (BG), p. 5209.
The Bangladesh Citizenship (Temporary Provision) (Amendment) Act 1973, (Act No. V of 1973), see BG dated 22 June 1973; (BG), p. 5471.
The Insurance Corporation Act 1973, (Act No. VI of 1973), see BG dated 23 June 1973; (BG), p. 5527. The Appropriation (Vote on Account) Act 1973, (Act No. VII of 1973), see BG dated 29 June 1973; (BG), p. 5661.
The Bangladesh Laws (Revision and Declaration) Act 1973, (Act No. VIII of 1973), see BG dated 30 June 1973; (BG), p. 5695.
The Bangladesh Local Government (Union Parishad and Paurashava) Act 1973, (Act No. IX of 1973), see BG dated 30 June 1973; (BG), p. 5633.
The Bangladesh Rice Research Institute Act 1973, (Act No. X of 1973), see BG dated 30 June 1973; (BG), p. 5637.
The Finance Act 1973, (Act No. XI of 1973), see BG dated 30 June 1973; (BG), p. 5743.
The Appropriation (Railways) Act 1973, (Act No. XII of 1973), see BG dated 30 June 1973; (BG), p. 5771.
The Bangladesh Inland Water Transport Corporation (Amendment) Act 1973, (Act No. XIII of 1973), see BG dated 9 July 1973; (BG), p. 5859.
The Jute (Amendment) Act 1973, (Act No. XIV of 1973), see BG dated 10 July 1973; (BG), p. 5863.
১৫৫

সংবিধান (প্রথম সংশােধন) আইন, ১৯৭৩, আইন নং ১৫। দেখুন বাংলাদেশ গেজেট ১৫ জুলাই ১৯৭৩; (1167), 3. đồoo
The Constitution (First Amendment) Act 1973, (Act No. XV of 1973), see BG dated 15 July 1973; (BG), p. 5909.
The Appropriation Act, 1973. (Act No. XVI of 1973), see BG dated 15 July 1973; (BG), p. 5911.
The Bangladesh Wild Life (Preservation) (Amendment) Act, 1973. (Act No. XVII of 1973), see BG dated 17 July 1973; (BG), p. 5951.
The Bangladesh Shipping Corporation (Amendment) Act, 1973. (Act No. XVIII of 1973), see BG dated 17 July 1973; (BG), p. 5987.
The International Crimes (Tribunal) Act, 1973. (Act No. XIX of 1973), see BG dated 20 July 1973; (BG), p. 5952.
The Cadet College (Amendment) Act, 1973. (Act No. XX of 1973), see BG dated 19 September 1973; (BG), p. 6913.
The Bangladesh Rifles (Amendment) Act, 1973. (Act No. XXI of 1973), see BG dated 19 September 1973; (BG), p. 6914.
The Bangladesh Fisheries Development Corporation Act, 1973. (Act No. XXII of 1973), see BG dated 21 September 1973; (BG), p. 6925.
The Printing Presses and Publications (Declaration and Registration) Act, 1973. (Act No. XXIII of 1973), see BG dated 22 September 1973; (BG), p. 6941.
The Constitution (Second Amendment) Act, 1973. (Act No. XXIV of 1973), see BG dated 22 September 1973; (BG), p. 6937.
The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) (Amendment) Act, 1973. (Act No. XXV of 1973), see BG dated 24 September 1973; (BG), p. 7041.
The Rajshahi University Act, 1973. (Act No. XXVI of 1973), see BG dated 25 September 1973; (BG), p. 7061.
The Jute Corporation Act, 1973. (Act No. XXVII of 1973), see BG dated 25 September 1973; (BG), p. 7097.
The Bangladesh Cottage Industries Corporation Act, 1973. (Act No. XXVIII of 1973), see BG dated 2 October 1973; (BG), p. 7169.
The Bangladesh Committee of Management (Temporary Arrangement) (Amendment) Act, 1973. (Act No. XXIX of 1973), see BG dated 2 October 1973; (BG), p. 7177.
১৫৬

The Medical Council Act, 1973. (Act No. XXX of 1973), see BG dated 3 October 1973; (BG), p. 7195.
The Bangladesh Girl Guides Association Act, 1973. (Act No. XXXI of 1973), see BG dated 3 October 1973; (BG), p. 7195.
The Warehousing Corporation (Amendment) Act, 1973. (Act No. XXXII of 1973), see BG dated 4 October 1973; (BG), p. 7203.
The Chittagong University Act, 1973. (Act No. XXXIII of 1973), see BG dated 4 October 1973; (BG), p. 7213.
The Jahangirnagar University Act, 1973. (Act No. XXXIV of 1973), see BG dated 8 October 1973; (BG), p. 7245.

1974
Anti-Corruption (Amendment) Act, 1974. (Act No. I of 1974), see BG dated 22 January 1974; (BG), p. 367.
The Special Police Establishment (Repeal) (Act No. II of 1974), see BG dated 22 January 1974; (BG), p. 368.
The The Pilotage (Amendment) (Act No. III of 1974), see BG dated 22 January 1974; (BG), p. 368.
The Transfer of Railways (Repeal) Act, 1974. (Act No. IV of 1974), see BG dated 1 February 1974; (BG), p. 1389.
The Bangladesh Red Crosse Society (Amendment) Act, 1974. (Act No. V of 1974), see BG dated 1 February 1974; (BG), p. 1389.
The Trading Corporation of Bangladesh (Amendment) Act, 1974. (Act No. VI of 1974), see BG dated 1 February 1974; (BG), p. 1392.
The President’s Remuneration and Privilege Act, 1974. (Act No. VII of 1974), see BG dated 5 February 1974; (BG), p. 1521.
The Primary Schools (Taking Over) Act, 1974. (Act No. VIII of 1974), see BG dated 5 February 1974; (BG), p. 1525.
The Bidi (Restriction of Manufacture) (Repeal) Act, 1974. (Act No. IX of 1974), see BG dated 5 February 1974; (BG), p. 1527.
The State-owned Manufacturing Industries Workers (Terms and Conditions of Service) Act, 1974. (Act No. X of 1974), see BG dated 6 February 1974; (BG), p. 1627.
১৫৭

The Jatiyo Rakkhi Bahini (Amendment) Act, 1974. (Act No. XI of 1974), see BG dated 6 February 1974; (BG), p. 1629.
The Public Servants (Retirement) Act, 1974. (Act No. XIII of 1974), see BG dated 6 February 1974; (BG), p. 1630.
The Jute Research Institute Act, 1974. (Act No. XIII of 1974), see BG dated 6 February 1974; (BG), p. 1633.
The Special Power Act, 1974. (Act No. XIV of 1974), see BG dated 9 February 1974; (BG),p. 5911.
The Bangladesh Rifles (Amendment) Act, 1974. (Act No. XV of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2131.
The Refugees Rehabilitation Finance Corporation (Repeal) Act, 1974. (Act No. XVI of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2137.
The Bangladesh WildLife (Preservation) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XVII of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2139.
The Agricultural Income-tax Act, 1974. (Act No. XVIII of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2143.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XIX of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2143.
The Bangladesh Banks ((Nationalization) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XX of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2145.
The Members of the Public Service Commissions (Terms and Conditions of Service) Act, 1974. (Act No. XXI of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2146.
The Member of Parliament (Salaries and Allowances) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXII of 1974), see BG dated 12 February 1974; (BG), p. 2148.
The Bangladesh Nationalized and Private Organization (Regulation of Salary of Employees Act, 1974. (Act No. XXIII of 1974), see BG dated 13 February 1974; (BG), p. 2231.
The Comptroller and Auditor-General (Additional Function) Act, 1974. (Act No. XXIV of 1974), see BG dated 13 February 1974; (BG), p. 2232.
The Press Council Act, 1974. (Act No. XXV of 1974), see BG dated 14 February 1974; (BG), p. 2327
The Territorial Waters and Maritime Zones Act, 1974. (Act No. XXVI of 1974), see BG dated 14 February 1974; (BG), p. 2334.
১৫৮

The Bangladesh College of Physicians and Surgeons (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXVII of 1974), see BG dated 14 February 1974; (BG), p. 2337.
The Bangladesh Government and Semi-Autonomous Organization (Regulation of Salary of Employees) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXVIII of 1974), see BG dated 16 February 1974; (BG), p. 2555.
The Bangladesh Institute of Development Studies Act, 1974. (Act No. XXIX of 1974), see BG dated 16 February 1974; (BG), p. 2556.
The Newspaper Employees (Conditions of Service) Act, 1974. (Act No. XXX of 1974), see BG dated 19 February 1974; (BG), p. 2791.
Bangladesh ShilpaKala Academy Act, 1974. (Act No. XXXI of 1974), see BG dated 19 February 1974; (BG), p. 2796.
The Trade Marks (Invalidation and Summary Registration) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXII of 1974), see BG dated 12 June 1974; (BG), p. 4417.
The Road Transport Corporation (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXIII of 1974), see BG dated 12 June 1974; (BG), p. 4418.
The Bangabandhu Award Fund (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXIV of 1974), see BG dated 12 June 1974; (BG), p. 4418.
The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXV of 1974), see BG dated 12 June 1974; (BG), p. 4419.
The Essential Service Laws (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXVI of 1974), see BG dated 15 June 1974; (BG), p. 4433.
The Bangladesh (Freedom Fighters) Welfare Trust (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXVII of 1974), see BG dated 15 June 1974; (BG), p. 4435.
The Government of Bangladesh (Services Screening) (Amendment) Act, 1974. (Act No. XXXVIII of 1974), see BG dated 15 June 1974; (BG), p. 4436.
The Children Act, 1974. (Act No. XXXIX of 1974), see BG dated 22 June 1974; (BG), p. 4695.
The Co-Operative Societies (Amendment) Act, 1974. (Act No. XL of 1974), see BG dated 25 June 1974; (BG), p. 4721.
The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council (Amendment) Act, 1974. (Act No. XLI of 1974), see BG dated 25 June 1974; (BG), p. 4724.
The Appropriation (Supplementary) Act, 1974. (Act No. XLII of 1974), see BG dated 28 June 1974; (BG), p. 4755.
১৫৯

The Appropriation (Vote on Account) Act, 1974. (Act No. XLIII of 1974), see BG dated 29 June 1974; (BG), p. 4759.
The Finance Act, 1974. (Act No. XLIV of 1974), see BG dated 29 June 1974; (BG), p. 4769.
The Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) (Repeal) Act, 1974. (Act No. XLV of 1974), see BG dated 1 July 1974; (BG), p. 4807.
The Vested and Non-Resident Property (Administration) Act, 1974. (Act No. XLVI of 1974), see BG dated 1 July 1974; (BG), p. 4807.
The Central and Salt (Amendment) Act, 1974. (Act No. XLVII of 1974), see BG dated 2 July 1974; (BG), p. 4815.
The Speaker and Deputy Speaker (Remuneration and Privileges) Act, 1974. (Act No. XLVIII of 1974), see BG dated 2 July 1974; (BG), p. 5135.
The Jute (Amendment) Act, 1974. (Act No. XLIX of 1974), see BG dated 22 July 1974; (BG), p. 5136.
The Appropriation Act, 1974. (Act No. L of 1974), see BG dated 24 July 1974; (BG), p. 5331.
The Bangladesh Women’s Rehabilitation and Welfare Foundation Act, 1974. (Act No. LI of 1974), see BG dated 24 July 1974; (BG), p. 5343.
The Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974. (Act No. LII of 1974), see BG dated 24 July 1974; (BG), p. 5349.
The Bangladesh Laws (Revision and Declaration) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LIII of 1974), see BG dated 25 July 1974; (BG), p. 5553.
The Copyright (Amendment) Act, 1974. (Act No. LIV of 1974), see BG dated 25 July 1974; (BG), p. 5711.
The Primary Education Laws (Repeal) Act, 1974. (Act No. LV of 1974), see BG dated 26 July 1974; (BG), p. 5719.
The Dacca Municipal Corporation Act, 1974. (Act No. LVI of 1974), see BG dated 29 July 1974; (BG), p. 5727.
The Bangladesh Sports Council Act, 1974. (Act No. LVII of 1974), see BG dated 30 July 1974; (BG), p. 5783.
The Extradition Act, 1974. (Act No. LVIII of 1974), see BG dated 30 July 1974; (BG), p. 5783.
The Special Powers (Amendment) (Act, 1974. Act No. LIX of 1974), see BG dated 30 July 1974; (BG), p. 5798.
১৬০

The Legal Practitioners and Bar Council (Second Amendment) Act, 1974. (Act No. LX of 1974), see BG dated 30 July 1974; (BG), p. 5802.
The State Acquisition and Tenancy (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXI of 1974), see BG dated 31 July 1974; (BG), p. 5813.
The Fire Service (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXII of 1974), see BG dated 31 July 1974; (BG), p. 5814.
The Maternity Benefit (Tea Estates) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXIII of 1974), see BG dated 30 July 1974; (BG), p. 2814.
The Pharmacy (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXIV of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6255.
The Member of the Public Service Commission (Terms and Conditions of Service) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXV of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6256.
The Printing Presses and Publication (Declaration and Registration) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXVI of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6256.
The Public Servants (Retirement) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXVII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6257.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Second Amendment) Act, 1974. (Act No. LXVIII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6258.
The Bangladesh Petroleum Act, 1974. (Act No. LXIX of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6259.
The Oil and Gas Development Corporation (Repeal) Act, 1974. (Act No. LXX of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6262.
The Stamp Duties (Additional Modes of Payment) Act, 1974. (Act No. LXXI of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6263.
The Bangladesh Bank (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXXII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6264.
The Special Powers (Second Amendment) Act, 1974. (Act No. LXXIII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6265.
The Pharmacy (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXIV of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6255.
The Member of the Public Service Commissions (Terms and Condition of Service) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXV of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6255.
১৬১

The Printing Presses and Publication (Declaration and Registration) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXVI of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6256.
The Public Servants (Retirement) (Amendment) Act, 1974. (Act No. LXVII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6257.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Second Amendment) Act, 1974. (Act No. LXVIII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6258.
The Bangladesh Petroleum Act, 1974. (Act No. LXIX of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6258.
The Oil and Gas Development) Corporation (Repeal) (Act No. LXX of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6262.
The Stamp Duties (Additional Modes of Payment) (Act No. LXXI of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6263.
The Bangladesh Bank (Amendment) (Act No. LXXII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6264.
The Special Powers (Second Amendment) (Act No. LXXIII of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6265.
The Constitution (Third Amendment) (Act No. LXXIV of 1974), see BG dated 28 November 1974; (BG), p. 6273.
The Water Pollution Control (Amendment) (Act No. LXXV of 1974), see BG dated 29 November 1974; (BG), p. 6281.
The Record of Jute Growers (Border Areas) (Act No. LXXVI of 1974), see BG dated 29 November 1974; (BG), p. 6282.

1975
The Emergency Powers Act, 1975. (Act No. I of 1975), see BG dated 25 January 1975; (BG), p. 379.
The Constitution (Fourth Amendment) Act, 1975. (Act No. II of 1975), see BG dated 25 January 1975; (BG), p. 397.
The Finance Act, 1975. (Act No. III of 1975), see BG dated 30 June 1975; (BG), p. 1409.
The Appropriation (Supplementary) Act, 1975. (Act No. IV of 1975), see BG dated 30 June 1975; (BG), p. 1441.
১৬২

The Appropriation (Vote on Account) Act, 1975. (Act No. V of 1975), see BG dated 30 June 1975; (BG), p. 1447.
The District Administration Act, 1975. (Act No. VI of 1975), see BG dated 10 July 1975; (BG), p. 1859.
The President’s (Remuneration and Privileges) Act, 1975. (Act No. VII of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2103.
The Vice President’s (Remuneration and Privileges) Act, 1975. (Act No. VIII of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2106.
Prime Minister’s (Remuneration and Privileges) Act, 1975. (Act No. XI of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2109.
The Speaker and Deputy Speaker (Remuneration and Privileges) Act, 1975. (Act No. X of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2112.
The Ministers, of State and Deputy Ministers (Remuneration and Privileges) Act, 1975. (Act No. XI of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2112.
The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council (Amendment) Act, 1975. (Act No. XII of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 211.
The Bangladesh Laws (Amendment) Act, 1975. (Act No. XIII of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2117.
The Comptroller and Auditor-General (Additional Functions) (Amendment) Act, 1975. (Act No. XVI of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2118.
The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) (Effect of Expiry) Act, 1975. (Act No. XV of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2119.
The ESSO Undertakings Acquisition Act, 1975. (Act No. XVI of 1975), see BG dated 14 July 1975; (BG), p. 2127.
The Islamic Foundation Act, 1975. (Act No. XVII of 1975), see BG dated 12 July 1975; (BG), p. 2132.
The Jatiya Rakkhi Bahini (Amendment) Act, 1975. (Act No. XVIII of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2149.
The Bangladesh Inland Water Transport Corporation (Amendment) Act, 1975. (Act No. XIX of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2155.
The Railways (Amendment) Act, 1975. (Act No. XX of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2156.
‘১৬৩

The Bangladesh Jute Corporation Act, 1975. (Act No. XXI of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2156.
The Imports and Exports (Control) Act, 1975. (Act No. XXII of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2112.
The Bangladesh Small and Cottage Industries Corporation (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXIII of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2159.
The Bangladesh Local Government (Union Parishad and Paurashava) (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXIV of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2161.
The Blind Relief (Donation of Eye) Act, 1975. (Act No. XXV of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2163.
The Survey (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXVI of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2165.
The Bangladesh House Building Finance Corporation (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXVII of 1975), see BG dated 17 July 1975; (BG), p. 2167.
The Islamic Development Bank Act, 1975. (Act No. XXVIII of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2169.
The Bangladesh Krishi Bank (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXIX of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2173.
The Record of Jute Growers (Border Areas) (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXX of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2174.
The Finance (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXXI of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2174.
The Services (Reorganization and Conditions) Act, 1975. (Act No. XXXII of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2175.
The Bangladesh Bank (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXXIII of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2177.
The Nationalized Banks (Transfer to Business) Act, 1975. (Act No. XXXIV of 1975), see BG dated 18 July 1975; (BG), p. 2197.
The Hundred-Taka Demonetised Note (Mode of Payment and Recovery of Taxes) Act, 1975. (Act No. XXXV of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2195.
The Bangladesh Nationalized and Private Organization (Regulation of Salary of Employees) (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXXVI of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2197.
১৬৪

The Finance (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXXVII of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2198.
The Bangladesh Government and Semi-Autonomous Organization (Regulation of Salary of Employees (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXXVIII of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2199.
The Members of Parliament (Salaries and Allowances) (Amendment) Act, 1975. (Act No. XXXIX of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2200.
The Bangladesh Rifles (Amendment) Act, 1975. (Act No. XL of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2201.
The Government-owned Newspapers (Management) Act, 1975. (Act No. XLI of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2202.
The Newspapers (Annulment of Declaration) Act, 1975. (Act No. XLII of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2205.
The Excises and Salt (Amendment) Act, 1975. (Act No. XLIII of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2210.
The Appropriation Act, 1975. (Act No. XLIV of 1975), see BG dated 21 July 1975; (BG), p. 2211.
১৬৫

বঙ্গবন্ধুর সময়ে প্রণীত অধ্যাদেশসমূহ
(পূর্ণাঙ্গ তালিকা)

1973
The Representation of The People (Supplementary) (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. I of 1973), see BG dated 23 April 1973; (BG), p. 4173.
The Prime Minister’s (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1973, (Ordinance No. II of 1973), see BG dated 30 April 1973; (BG), p. 4251.
The Prime Minister’s (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1973, (Ordinance No. III of 1973), see BG dated 30 April 1973; (BG), p. 4257.
The Deputy Minister’s (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1973, (Ordinance No. IV of 1973), see BG dated 30 April 1973; (BG), p. 4273.
The Ministers of State (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1973, (Ordinance No. V of 1973), see BG dated 30 April 1973; (BG), p. 4283.
Bangladesh Rice Research Institute Ordinance, 1973, (Ordinance No. VI of 1973), see BG dated 5 May 1973; (BG), p. 4401.
The Insurance Corporation Ordinance, 1973, (Ordinance No. VII of 1973), see BG dated 14 May 1973; (BG), p. 4455.
The Bangladesh Government Hats and Bazars (Management) (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. VIII of 1973), see BG dated 15 May 1973; (BG), p. 4471.
The Bangladesh Local Government (Union Parishad and Paurashava) (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. IX of 1973), see BG dated 15 May 1973; (BG), p. 4473.
The Bangladesh Citizenship (Temporary Provision) (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. X of 1973), see BG dated 23 May 1973; (BG), p. 4687.
The Rajshahi University, Ordinance, 1973, (Ordinance No. XI of 1973), see BG dated 31 July 1973; (BG), p. 6185.
The Bangladesh Jute Corporation Ordinance, 1973. (Ordinance No. XII of 1973), see BG dated 20 August; (BG), p.6415.
The Bangladesh Committee of Management (Temporary Arrangement), 1973, (Amendment) (Ordinance No. XIII of 1973), see BG dated 31 May 1973; (BG), p. 6429.
The Cadet College (Amendment) (Ordinance No: XIV of 1973), see BG dated 23 August 1973; (BG), p. 6445.
১৬৬

The Bangladesh Rifles (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XV of 1973), see BG dated 23 August 1973; (BG), p. 6447.
The Printing Presses and Publication (Declaration and Registration) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XVI of 1973), see BG dated 28 August 1973; (BG), p. 6531.
The Bangladesh Fisheries Development Corporation Ordinance, 1973, (Ordinance No. XVII of 1973), see BG dated 28 August 1973; (BG), p. 6525.
The Bangladesh Cottage Industries Corporation Ordinance, 1973, (Ordinance No. XVIII of 1973), see BG dated 3 September 1973; (BG), p. 6597.
The Anti-Corruption (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No: XIX of 1973), see BG dated 17 October 1973; (BG), p. 7417.
The Special Police Establishment (Repeal) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XX of 1973), see BG dated 17 October 1973; (BG), p. 7419.
The Jatiya Rakkhi Bahini (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXI of 1973), see BG dated 22 October 1973; (BG), p. 7493.
The Primary Schools (Taking Over) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXII of 1973), see BG dated 31 October 1973; (BG), p. 7557.
The State-Owned Manufacturing Industries Workers (Terms and Condition of Service) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXIII of 1973), see BG dated 6 November 1973; (BG), p. 7675.
The Jute Research Institute Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXIV of 1973), see BG dated 10 November 1973; (BG), p. 7713.
The Transfer of Railways Repeal Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXV of 1973), see BG dated 16 November 1973; (BG), p. 7781.
The Public Servants (Retirement) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXVI of 1973), see BG dated 23 November 1973; (BG), p. 7829. The Bangladesh Red Cross Society (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXVII of 1973), see BG dated 3 December 1973; (BG), p. 7777.
The Pilotage (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXVIII of 1973), see BG dated 10 December 1973; (BG), p. 7925.
The Public Servants (Retirement) (Amendment), Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXIX of 1973), see BG dated 12 December 1973; (BG), p. 7939.
১৬৭

The Comptroller and Auditor-General (Additional Function) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXX of 1973), see BG dated 14 December 1973; (BG), p. 7949.
The Trading Corporation of Bangladesh (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXXI of 1973), see BG dated 26 December 1973; (BG), p. 8035.
The Bangladesh Scheduled Offenses (Special Tribunal) (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXXII of 1973), see BG dated 29 December 1973; (BG), p. 8071.
The Bangladesh Banks (Nationalization) (Amendment) Ordinance, 1973, (Ordinance No. XXXIII of 1973), see BG dated 31 December 1973; (BG), p. 8083.

1974
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. I of 1974), see BG dated 1 January 1974; (BG), p. 1974.
The Essential Services Law Amendment Ordinance, 1974, (Ordinance No. II of 1974), see BG dated 28 February 1974; (BG), p. 3501.
The Trade Marks (Invalidation and Summary Registration) (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. III of 1974), see BG dated 13 March 1974; (BG), p. 74.
The Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) (Repeal) Ordinance, 1974, (Ordinance No. IV of 1974), see BG dated 23 March 1974; (BG), p. 3925.
The Vested and Non-Resident Property (Administration) Ordinance, 1974, (Ordinance No. V of 1974), see BG dated 23 March 1974; (BG), p. 3927
The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. VI of 1974), see BG dated 25 March 1974; (BG), p. 3943.
The Central Excises and Salt Act (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. VII of 1974), see BG dated 9 April 1974; (BG), p. 4085.
The Central Excises and Salt Act (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. VIII of 1974), see BG dated 12 April 1974; (BG), p. 4109.
The Co-Operative Societies (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. IX of 1974), see BG dated 12 April 1974; (BG), p. 4159.
The Bangabandhu Award Fund (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. X of 1974), see BG dated 3 May 1974; (BG), p. 4223.
The Public Servants (Retirement) (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XI of 1974), see BG dated 12 August 1974; (BG), p. 5861.
১৬৮

The Printing Presses and Publication (Declaration and Registration) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XII of 1974), see BG dated 14 August 1974; (BG), p. 5866.
The Exit From Bangladesh (Restriction) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XIII of 1974), see BG dated 14 August 1974; (BG), p. 5867.
The Record of Jute Growers (Border Areas) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XIX of 1974), see BG dated 21 August 1974; (BG), p. 5925.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Second Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XV of 1974), see BG dated 22 August 1974; (BG), p. 5932.
The Petroleum Ordinance, 1974, (Ordinance No. XVI of 1974), see BG dated 22 August 1974; (BG), p. 5933.
The Oil and Gas Development Corporation (Repeal) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XVII of 1974), see BG dated 22 August 1974; (BG), p. 5937.
The Dacca Metropolitan Development Authority Ordinance, 1974, (Ordinance No. XVIII of 1974), see BG dated 29 August 1974; (BG), p. 5965.
The Pharmacy (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XIX of 1974), see BG dated 30 August 1974; (BG), p. 5987.
The Member of the Public Service Commissions (Terms and Condition of Service) (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XX of 1974), see BG dated 21 September 1974; (BG), p. 6046.
The Water Pollution Control (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXI of 1974), see BG dated 9 October 1974; (BG), p. 6099.
The Exit from Bangladesh (Restriction) (Repeal) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXII of 1974), see BG dated 22 October 1974; (BG), p. 6121.
The Stamp Duties (Additional Modes of Payment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXIII of 1974), see BG dated 4 November 1974; (BG), p. 6142.
The Special Power (Second Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXIV of 1974), see BG dated 9 November 1974; (BG), p. 6157.
The Electricity Duty (Amendment) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXV of 1974), see BG dated 2 December 1974; (BG), p. 6295.
The Service (Reorganization and Condition) Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXVI of 1974), see BG dated 11 December 1974; (BG), p. 6358.
The Emergency Power Ordinance, 1974, (Ordinance No. XXVII of 1974), see BG dated 28 December 1974; (BG), p. 6442.
১৬৯

1975
The Islamic Development Bank Ordinance, 1975. (Ordinance No. I of 1975), see BG dated 29 January 1975; (BG), p. 486.
The Bangladesh House Building Finance Corporation (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. II of 1975), see BG dated 1 February 1975; (BG), p. 499.
The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. III of 1975), see BG dated 5 February1975; (BG), p. 518.
The Bangladesh Krishi Bank (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. IV of 1975), see BG dated 6 February1975; (BG), p. 522.
The Blind Relief (Donation of Eye) Ordinance, 1975. (Ordinance No. V of 1975), see BG dated 11 February1975; (BG), p. 545.
The Bangladesh Bank (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. VI of 1975), see BG dated 11 February1975; (BG), p. 548.
The Vice-President’s (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1975. (Ordinance No. VII of 1975), see BG dated 14 February1975; (BG), p. 569.
The Prime Minister’s (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1975. (Ordinance No. VIII of 1975), see BG dated 14 February1975; (BG), p. 573.
The Jatiya Rakkhi Bahini (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. IX of 1975), see BG dated 17 February1975; (BG), p. 581.
The President’s (Remuneration and Privileges) Ordinance, 1975. (Ordinance No. X of 1975), see BG dated 19 February1975; (BG), p. 605.
The Nationalised Banks (Transfer of Business) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XI of 1975), see BG dated 27 February1975; (BG), p. 641.
The Ministers, Ministers of State and Deputy Ministers (Remuneration and Privileges) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XII of 1975), see BG dated 28 February1975; (BG), p. 647.
The Bangladesh Laws (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XIII of 1975), see BG dated 11 March; (BG), p. 683.
The Esso Undertaking Acquisition Ordinance, 1975. (Ordinance No. XIV of 1975), see BG dated 14 March 1975; (BG), p. 699.
The Record of Jute Growers (Border Areas) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XV of 1975), see BG dated 21 March; (BG), p. 643.
১৭০

The Bangladesh (Restoration of Evacuee Property) (Effect of Expiry) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XVI of 1975), see BG dated 24 March; (BG), p. 748.
The Islamic Foundation Ordinance, 1975. (Ordinance No. XVII of 1975), see BG dated 28 March; (BG), p. 761.
The Comptroller and Auditor-General (Additional Functions) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XVIII of 1975), see BG dated 5 April; (BG), p. 855.
The Bangladesh Inland Water Transport Corporation (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XIX of 1975), see BG dated 8 April; (BG), p. 861.
The Bangladesh Jute Corporation (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XX of 1975), see BG dated 8 April; (BG), p. 862. The Finance (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXI of 1975), see BG dated 11 April; (BG), p. 871.
The Services (Reorganization and Conditions) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXII of 1975), see BG dated 11 April; (BG), p. 872.
The Railways Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXIII of 1975), see BG dated 12 April; (BG), p. 879.
The Imports and Exports (Control) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXIV of 1975), see BG dated 17 April; (BG), p. 893.
The Hundred-Taka Demonetised Notes (Mode of Payment and Recovery of Taxes) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXV of 1975), see BG dated 14 May; (BG), p. 1055.
The Bangladesh Nationalized and Private Organizations (Regulation of Salary of Employees) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXVI of 1975), see BG dated 19 May; (BG), p. 1073.
The Bangladesh Small and Cottage Industries Corporation (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXVII of 1975), see BG dated 19 May; (BG), p. 1074.
The Finance (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXVIII of 1975), see BG dated 19 May; (BG), p. 1076. The Bangladesh Local Government (Union Parishad and Paurashava) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXIX of 1975), see BG dated 22 May; (BG), p. 1089.
The Finance (Second Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXX of 1975), see BG dated 2 June; (BG), p. 1179.
The Bangladesh Government and Semi-Autonomous Organizations (Regulation of Salary of Employees) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXI of 1975), see BG dated 3 June; (BG), p. 1081.
১৭১

The Bangladesh Nationalized and Private Organizations (Regulation of Salary of Employees) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXII of 1975), see BG dated 3 June; (BG), p. 1082.
The Newspapers (Annulment of Declaration) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXIII of 1975), see BG dated 13 June; (BG), p. 1233.
The Government-Owned Newspapers (Management) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXIV of 1975), see BG dated 13 June; (BG), p. 1239.
The Bangladesh Industrial Enterprises (Nationalization) (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXV of 1975), see BG dated 23 June; (BG), p. 2227.
The Jute Companies (Acquisition of Shares) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXVI of 1975), see BG dated 31 June; (BG), p. 2307.
The Ports (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXVII of 1975), see BG dated 7 August; (BG), p. 2347.
The Statutory Corporations (Delegation of Powers) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXVIII of 1975), see BG dated 7 August; (BG), p. 2348.
The Emergency Requisition of Property (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XXXIX of 1975), see BG dated 8 August; (BG), p. 2363.
The Agricultural Development Corporation (Amendment) Ordinance, 1975. (Ordinance No. XL of 1975), see BG dated 8 August; (BG), p. 2364.
১৭২

দ্বিতীয় অংশ

[১]
শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, (১৯৬০ সালের ৬২২ ও ৬২৩ নম্বর ক্রিমিনাল আপিল)
রায়টির সারাংশ

ঘটনার (ফ্যাক্টস) সারসংক্ষেপ
এটি ছিল ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির পর শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত চতুর্থ দুর্নীতি মামলা। এর আগের তিনটি মামলায় তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
অভিযােগনামায় বলা হয়, ১৯৫৫ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার মেসার্স হাসান আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানিকে ভারত থেকে প্রতি মাসে তিন হাজার টন সফট কোক সংগ্রহের জন্য এজেন্ট নিয়ােগ করা হয়। উক্ত ফার্ম সরকারের সঙ্গে কমিশনের ভিত্তিতে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। প্রাদেশিক বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প দফতরের মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বিভাগীয় সেক্রেটারির আপত্তি অগ্রাহ্য করে উক্ত এজেন্সি বাতিল করেন এবং কোনাে টেন্ডার গ্রহণ না করে নারায়ণগঞ্জের মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড কোম্পানিকে ভারত থেকে সফট কোক আনয়নের জন্য নিয়ােগ করেন এবং দর্শনায় একটি নতুন কারখানা স্থাপনের অনুমােদন প্রদান করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাঁর পদমর্যাদার অপব্যবহার করে অসদাচরণ এবং অপর আসামি কোল মাইনিং কোম্পানির ম্যানেজিং এজেন্ট কাজী নাসেরের বিরুদ্ধে উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররােচিত করার অভিযােগ আনা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সিনিয়র স্পেশাল জজ জনাব আবদুল মওদুদ অসদাচরণ ও তাতে সহায়তার অভিযােগে সাবেক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও কোল মাইনিং কোম্পানির ম্যানেজিং এজেন্ট কাজী আবু নাসেরকে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরাে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আসামিরা সংক্ষুব্ধ হয়ে এই দণ্ডাদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আপিল করেন।

আদালতের রায়
বিচারপতি আসির ও বিচারপতি আলীর ডিভিশন বেঞ্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী আবু নাসেরকে যথাক্রমে ফৌজদারি অসদাচরণ (অপরাধমূলক অসদাচরণ) ও তাতে সহায়তা করার অভিযােগে স্পেশাল জজ কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাদেশ থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন।
১৭৭

রায়টির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ
পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট

শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য
………………আপিলকারী
বনাম
রাষ্ট্র
…………….রেসপনডেন্ট
(১৯৬০ সালের ৬২২ ও ৬২৩ নম্বর ক্রিমিনাল আপিল০১ )

রায়ের তারিখ : ৫ জুলাই ১৯৬১

বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি আসির
বিচারপতি আলী

আপিলকারী পক্ষের আইনজীবীবৃন্দ
এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী
এইচ. কবির চৌধুরী
(১৯৬০ সালের ৬২২ নম্বর ক্রিমিনাল আপিলে)
আ. সালাম খান ও সিরাজুল হক

(১৯৬০ সালের ৬২৩ নম্বর ক্রিমিনাল আপিলে) রেসপনডেন্ট পক্ষের আইনজীবীবৃন্দ (উভয় আপিলে) আজিজুদ্দীন আহমেদ ও এ. ডব্লিউ. মল্লিক
…………………………………………………..
1. Sheik Mujibur Rahman and another vs. The State. 15 DLR (1963) 549.
১৭৮

রায়

বিচারপতি আসির :
এই দুইটি আপিল ১৯৫৯ সালের ৭২ নম্বর বিশেষ মামলায় ঢাকার বিজ্ঞ সিনিয়র স্পেশাল জজ কর্তৃক প্রদত্ত দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ (কনভিকশন ও সেন্টেন্স) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দুটি মামলা একসঙ্গে শুনানি করা হয়েছে এবং একই রায়ের দ্বারা এই দুটি আপিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
১. ১৯৬০ সালের ৬২২ নম্বর ক্রিমিনাল আপিলের আবেদনকারী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৯৬০ সালের ৬২৩ নম্বর ক্রিমিনাল আপিলের আবেদনকারী জনাব কাজী আবু নাসের। দুই আপিলকারীর বিচার একসঙ্গে হয়েছে। ১৯৬০ সালের ৬২২ নম্বর ক্রিমিনাল আপিলের আবেদনকারী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫,০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরাে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দণ্ডিত হয়েছেন। জনাব কাজী আবু নাসের ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা, সঙ্গে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১০৯ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫,০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরাে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
২. প্রসিকিউশনের ভাষ্য অনুযায়ী, জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত ৪৬৫৭ নম্বর নােটিফিকেশনের মাধ্যমে গভর্নর কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। তিনি বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প এবং সমাজকল্যাণ-যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল আরবান কমিনিউটি প্রজেক্ট ও ভিলেজ এইড, খাদ্য ও কৃষি দপ্তরের সমবায় শাখা ও দুর্নীতি দমন- মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তবে ১৯৫৭ সালের ৭ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন। অন্য আপিল আবেদনকারী জনাব কাজী আবু নাসের ছিলেন একজন ভারতীয় নাগরিক এবং মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি (পাকিস্তান) লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত অফিস ছিল প্রথমে ৮৫, পরবর্তীকালে ১১২, দেলাইসলে রােড (DeLisle Road), নারায়ণগঞ্জ। দুই আবেদনকারী ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং জনাব মুজিবুর রহমান তার বন্ধু জনাব আবু নাসের ও তার এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন। ডিরেক্টর অব কনজুমার গুডস অ্যান্ড ফুয়েলস কর্তৃক জারিকৃত ১৯৫৫ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখ সম্বলিত এক নােটিশের পরিপ্রেক্ষিতে টেন্ডার আহ্বান করা হয় এবং বহু আবেদনকারীর মধ্যে উপরােক্ত প্রতিষ্ঠান এবং মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড দুটি পক্ষ ছিল। সব মিলিয়ে এরকম ২১টি পক্ষ ছিল। টেন্ডার কমিটি হাসান আহমেদ লিমিটেডকে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পক্ষ হিসেবে নির্বাচন করেন। তারা এই প্রদেশের জন্য সরকারের পক্ষে কয়লা ও কোক-কয়লা উত্তোলনের এজেন্সি পায়। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড যথাসম্ভব তাদের কাজ করে যাচ্ছিলেন। প্রসিকিউশনে বলা হয়, কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের কাজী আবু নাসের এজেন্সি পেতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলীর সঙ্গে দেখা করেন এবং প্রস্তাব করেন যে তারা শেয়ারে ব্যবসা করতে পারেন।
৩. জনাব মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজী আবু নাসেরের অনুরােধে ও তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সচিবের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও তিনি হঠাৎ ও স্বেচ্ছাচারীভাবে ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিল
১৭৯

তারিখের এক আদেশের মাধ্যমে মেসার্স হাসান লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল করে দেন। সেদিনই জনাব মুজিবুর রহমান মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে একই টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনে এজেন্ট নিযুক্ত করেন। কিন্তু কোনাে টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। এই সবকিছুই করা হয়েছে এজেন্ট নিয়ােগের আর্থিক নীতিমালা ও অফিসিয়াল নিয়মকানুনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন করে এবং কাজী আবু নাসের কিংবা মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে কোনাে আবেদনপত্র গ্রহণ ছাড়া। প্রসিকিউশনে আবার বলা হয়, জনাব মুজিবুর রহমান মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় শক্ত কয়লাকে নরম কোক-কয়লায় রূপান্তরিত করার অনুমােদনসহ একটি কয়লা খনি স্থাপন এবং নতুন খনি শুরু করার জন্য ভারত থেকে ৫০০ টন শক্ত কয়লা আমদানির অনুমােদন দেন। এই আদেশও জারি করা হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সচিবের তীব্র আপত্তি কর্ণপাত না করে এবং আর্থিক নীতিমালা ও বিভাগীয় নিয়মনীতি অনুসরণ না করে। প্রসিকিউশনের ভাষ্য অনুযায়ী, আপিলকারী জনাব মুজিবুর রহমান তার বন্ধু অন্য আপিলকারী কাজী আবু নাসের ও তার ফার্মকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার অবস্থানের অপব্যবহার করে এসব কাজ করেছেন। এবং এভাবে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের (দুর্নীতি দমন আইন) ৫(১) ধারার অধীনে ফৌজদারি | অপরাধ করেছেন।
৪. অপর আপিলকারী কাজী আবু নাসেরের বিপক্ষে প্রসিকিউশনের বক্তব্য হলাে : তিনি এই ফৌজদারি | অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে জনাব মুজিবুর রহমানকে সহায়তা (এবেটেড) করেছেন।
৫. এসব অভিযােগের ভিত্তিতে ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন ব্যুরাে, ঢাকা-এর পরিদর্শক জনাব এ.
জলিল খান, যাকে এই মামলায় ১২ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, একটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দাখিল করেন। নিয়ম অনুযায়ী ১৫ নম্বর সাক্ষী ফজলুর রহমান প্রয়ােজনীয় অনুমােদন নিয়ে মামলাটি তদন্ত করার আবেদন করেন। সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট (দক্ষিণ), ঢাকা ১৯৫৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখ সম্বলিত এক আদেশে সেই অনুমােদন প্রদান করেন। প্রয়ােজনীয় তদন্ত শেষে ১৯৫৯ সালের ১ ডিসেম্বর তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগপত্র দাখিল করা হয়। এর মধ্যে ১৯৫৯ সালের ২৫ জুন Pakistan Criminal Law Amendment Act-এর ৬ ধারার (৫) উপধারা অনুযায়ী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত কিছু প্রয়ােজনীয় স্যাংশন নেওয়া হয়। যেহেতু স্যাংশন (মঞ্জুরি) আদেশ বিস্তারিতভাবে বিবেচনা করা আমাদের জন্য জরুরি, সেহেতু এই পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত স্যাংশন আদেশের শর্তাদি থেকে উদ্ধৃত করা যথার্থ হবে-
“বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পোন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত সাবেক মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী দায়েরকৃত ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ তারিখ সম্বলিত রমনা (ঢাকা) পি. এস. কেইস নম্বর-৩-সংক্রান্ত ব্যাপারে গভর্নরের কাছে পেশকৃত প্রতিবেদন ও রেকর্ডস থেকে গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ উপায়ে কিংবা মন্ত্রী হিসেবে নিজের অবস্থানের অপব্যবহার করে অন্য কোনােভাবে তার নিজের বা মেসার্স কোন মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের জন্য মূল্যবান জিনিসপত্র কিংবা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা, উপরােক্ত কোম্পানিকে ভারত থেকে কমিশন ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ সফট কোক উত্তোলন ও হস্তান্তরের জন্য প্রাদেশিক সরকারের এজেন্ট নিয়ােগ করা এবং কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় শক্ত কয়লাকে নরম কোক-কয়লায় রূপান্তরিত করার
১৮০

অনুমােদনসহ একটি কয়লা খনি স্থাপন এবং নতুন খনি শুরু করার জন্য ভারত থেকে ৫০০ টন শক্ত কয়লা আমদানির জন্য অনুমােদন প্রদান করার অভিযােগে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি অসদাচরণের প্রাইমা ফেসি অভিযােগে মামলা দায়ের করার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে;
“যেহেতু কথিত জনাব শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পোন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত মন্ত্রী থাকাকালীন আচমকা ও স্বেচ্ছাচারীভাবে এবং কোনাে কারণ রেকর্ড না করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সচিবের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ৭ এপ্রিল ১৯৫৭ তারিখ উপরােক্ত ফার্মের এজেন্সি বাতিল করে আদেশ জারি করেন এবং একই দিন কোনাে নতুন টেন্ডার আহ্বান না করে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ-কে- যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আবু নাসের একজন ভারতীয় নাগরিক- একই উদ্দেশ্যে একই শর্তে এজেন্ট নিয়ােগের আর্থিক নীতিমালা ও দাপ্তরিক নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন করে এজেন্ট নিয়ােগ করেন, যদিও দ্বিতীয় ফার্ম সেই এজেন্সির জন্য কোনাে আবেদন করেনি কিংবা কোনাে দরপত্র দাখিল করেনি;
“যেহেতু কথিত জনাব শেখ মুজিবুর রহমান মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় শক্ত কয়লাকে নরম কোক-কয়লায় রূপান্তরিত করার অনুমােদনসহ একটি কয়লা খনি স্থাপন এবং নতুন খনি শুরু করার জন্য ভারত থেকে ৫০০ টন শক্ত কয়লা আমদানির জন্য সম্মতি প্রদান করার অনুমােদন দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সচিবের বিরােধিতা সত্ত্বেও সাবেক দায়িতরত মন্ত্রী সেই অনুমােদন করে আদেশ জারি করেছেন, আর্থিক নীতিমালা ও বিভাগীয় নিয়মকানুন (প্রসিডিউর) অনুযায়ী অন্যান্য শিল্প-কারখানা স্থাপন করার ক্ষেত্রে যেমন হয়, নতুন প্রকল্প ও এজেন্সি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল; “যেহেতু কথিত জনাব শেখ মুজিবুর রহমান- যিনি কাজী আবু নাসেরের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছিলেন- যিনি কালক্রমে আবার মেসার্স গ্রিন হােয়াইট লিমিটেডের একজন পরিচালক ছিলেন, যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত ছিল- সাধারণ নিয়মকানুন তােয়াক্কা না করে সেই কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কো. লিমিটেডকে কয়লার লাইসেন্স দিয়ে তাদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টতা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দর্শনায় খনি স্থাপন করা ছিল কেবল একটি অজুহাত, যেটাকে প্রাক্তন মন্ত্রী তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য সেই কাজী আবু নাসেরের প্রতি অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার জন্য কাজে লাগিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সেই প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবিত খনি কখনােই স্থাপন করেনি। “যেহেতু জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযােগ্য ফৌজদারি অপরাধ করেছেন এবং জনাব কাজী আবু নাসের ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা এবং তার সঙ্গে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযােগ্য ‘সহযােগিতার অপরাধ করেছেন।
“ফলে, পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮-এর ৬ ধারার (৫) উপধারা অনুযায়ী গভর্নর, কথিত জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা কিংবা প্রাসঙ্গিক অন্য কোনাে আইনের অধীনে অভিযােগ গঠনের অনুমােদন দিতে সন্তুষ্ট হয়েছেন।”
১৮১

৬. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ২৪২ ধারা অনুযায়ী আপিলকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে অভিযােগের সারবত্তা সম্পর্কে যা উদ্ধার করা যায় তা হলাে –
জনাব মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযােগ :
“পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অব কনজুমার গুডস অ্যান্ড ফুয়েলস কর্তৃক জারিকৃত ১৯৫৫ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখ সম্বলিত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ভারত থেকে সফট কোল/কোক প্রকিউরমেন্ট ও হ্যান্ডলিং করার জন্য এজেন্ট নিয়ােগের দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং ২১টি দরপত্র গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ছিল মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড অপর অভিযুক্ত কাজী আবু নাসের যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মেসার্স হাসান আহমেদ। চূড়ান্তভাবে দরপত্র কমিটির সুপারিশে মেসার্স হাসান আহমেদকে ১৯৫৫ সালের ১৬ মার্চ তারিখ সম্বলিত আদেশের মাধ্যমে কমিশন ভিত্তিতে এজেন্ট নিয়ােগ করা হয় এবং মেসার্স হাসান আহমেদ নামের প্রতিষ্ঠান নিম্নলিখিত লিখিত শর্তাবলি অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছিলেন :
“যেহেতু আপনি অপর অভিযুক্ত কাজী আবু নাসেরের বন্ধু বলে কথিত এবং সেজন্য তার ফার্ম মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কো. পাক. লি.-এর সঙ্গে আপনার স্বার্থ জড়িত;
“যেহেতু আপনি ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখ সম্বলিত ৮৬৭-সিএ নম্বর নােটিফিকেশনের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন এবং ১৯৫৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখ সম্বলিত ৮৬৯-সিএ নম্বর নােটিফিকেশনের মাধ্যমে আপনাকে বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পবিষয়ক দপ্তর বণ্টন করা হয়েছে; এবং এই দায়িত্ব পালনকালে আপনি এই সরকারের অধীনে সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করছিলেন;
“যেহেতু সেই দপ্তরের দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনি ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিল তারিখে এক আদেশ জারি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সচিবের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও আচমকা ও স্বেচ্ছাচারীভাবে মেসার্স হাসান আহমেদ-এর নিয়ােগ বাতিল করেছেন এবং আপনি তা করেছেন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে আপনার ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেবল আপনার বন্ধু অভিযুক্ত কাজী আবু নাসের ও তার এজেন্সিকে যে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আপনি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী ছিলেন- সুবিধা দেওয়ার জন্য।
“যেহেতু আপনি এরপর সেই মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে শক্ত কয়লা থেকে সফট কোক-এ রূপান্তরিত করার জন্য কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় একটি প্ল্যান্ট স্থাপন এবং সেই কারখানা চালু করার জন্য ভারত থেকে ৫০০ টন শক্ত কয়লা আমদানি করার অনুমােদন প্রদান করেছেন, এবং আপনি তা করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সচিবের তীব্র আপত্তি না শুনে এবং আর্থিক নীতিমালা ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সরাসরি লঙ্ঘন করে আপনার সেই বন্ধু ও তার এজেন্সি যাতে আপনি আগ্রহী ছিলেন সেই এজেন্সিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
“সেহেতু, আপনি আপনার পদমর্যাদার অপব্যবহার করে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযােগ্য ফৌজদারি অপরাধ করেছেন।”
“এ সমস্ত আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ। আপনার জবাব কী? উত্তর। আমি নিরপরাধ, স্যার। এই সকল অভিযােগ মিথ্যে।”
১৮২

কাজী আবু নাসেরের বিরুদ্ধে অভিযােগ :
“আপনি ভারতীয় নাগরিক এবং পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা, মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি, পাকিস্তান, লি.-এর ম্যানেজিং এজেন্ট, যার নিবন্ধিত অফিস নারায়ণগঞ্জে;
“এবং আপনি ১৯৫৫ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখ সম্বলিত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কনজুমার গুডস অ্যান্ড ফুয়েলস্-এর সহকারী পরিচালক কর্তৃক জারিকৃত নােটিশের পরিপ্রেক্ষিতে এজেন্ট হিসেবে নিয়ােগের জন্য আবেদনকারী ২১টি পক্ষের- যার মধ্যে মেসার্স হাসান আহমেদ একজন ছিলেন। এবং ১৯৫৫ সালের ১৬ মার্চ তারিখ সম্বলিত আদেশের মাধ্যমে টেন্ডার কমিটি মেসার্স হাসান আহমেদ লিঃ-কে কমিশন ভিত্তিতে এজেন্ট নিয়ােগ করা হয়;
“এবং অপর অভিযুক্ত জনাব শেখ মুজিবুর রহমান আপনার বন্ধু এবং তিনি আপনি ও আপনার এজেন্সি ফার্মের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন;
“এবং আপনার বন্ধু অপর অভিযুক্ত জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখ সম্বলিত ৮৬৭-সিএ নম্বর নােটিফিকেশনের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন এবং ১৯৫৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখ সম্বলিত ৮৬৯-সিএ নম্বর নােটিফিকেশনের মাধ্যমে তাঁকে বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পবিষয়ক দপ্তর বণ্টন করা হয়েছে; এবং তিনি যখন এই দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন আপনি এই ব্যাপারে জ্ঞাত ও সচেতন ছিলেন যে, তিনি এই সরকারের অধীনে সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করছিলেন;
“এবং সেই দপ্তরের দায়িত্ব পালনকালে অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিল তারিখে এক আদেশ জারি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সচিবের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও আচমকা ও স্বেচ্ছাচারীভাবে মেসার্স হাসান আহমেদ-এর নিয়ােগ বাতিল করেছেন এবং তিনি তা করেছেন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেবল আপনি ও আপনার এজেন্সিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং তিনি তা করেছেন আপনার প্ররােচনায়;
“এবং আপনার বন্ধু অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান আপনি ও আপনার এজেন্সিকে কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় শক্ত কয়লাকে সফট কোকে রূপান্তরিত করার কারখানা স্থাপন এবং সেখানে কারখানা শুরু করার জন্য ভারত থেকে ৫০০ টন শক্ত কয়লা আমদানি করার অনুমােদন প্রদান করেছেন এবং এই অভিযুক্ত ব্যক্তি তা করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সচিবের আপত্তি না শুনে এবং আর্থিক নীতিমালা ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সরাসরি লঙ্ন করে, আপনাকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং তিনি তা করেছেন আপনার সক্রিয় প্ররােচনায় ( এবেটমেন্ট);
“এবং আপনার বন্ধু অভিযুক্ত জনাব মুজিবুর রহমান সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার অবস্থানের অপব্যবহার করে আপনার প্ররােচনায় (এবেটমেন্ট) ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযােগ্য ফৌজদারি অপরাধ করেছেন এবং আপনি ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারার, যার সঙ্গে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা মিলিয়ে পড়তে হবে, অধীনে অপরাধ করেছেন।”
“এ সমস্ত আপনার বিরুদ্ধে অভিযােগ। আপনার জবাব কী? উত্তর : আমি নিরপরাধ, স্যার।”
৭. বিবাদিপক্ষ, অন্যান্য কিছুর মধ্যে, সমস্ত অভিযােগ অস্বীকার করেছেন। বিশেষত আপিলকারী জনাব মুজিবুর রহমানের পক্ষে দাবি করা হয় যে, উল্লিখিত সময়ে তিনি যে কর্মকাণ্ডই করেছেন তা করেছেন
১৮৩

সদুদ্দেশ্যে এবং জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ মন্ত্রী হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থে। অপর আপিলকারীর ডিফেন্স ছিল এই যে, ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিলের আদেশের সঙ্গে তার কোনাে সংযােগ ছিল না এবং টেন্ডার কমিটি কর্তৃক এজেন্সি পাওয়ার চেষ্টা করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আর কখনাে এজেন্সির জন্য চেষ্টা করেননি। সফট কোক উৎপাদনের ব্যাপারে জনাব আবু নাসেরের যুক্তি ছিল যে, তিনি কারখানা স্থাপন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ব্যাপারে সিরিয়াস ও আন্তরিক ছিলেন।
৮. বিজ্ঞ স্পেশাল জজ রেকর্ডকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখতে পান যে, আদেশের মাধ্যমে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন এবং গােপালগঞ্জ মহকুমায় পিট খননের জন্য ইজারা অনুমােদন করা হয়েছে একই কোম্পানিকে এবং যে আদেশের মাধ্যমে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল এবং কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে তা কেবল অবৈধই ছিল না, বরং জনাব মুজিবুর রহমান তা করেছেন মন্ত্রী হিসেবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজী আবু নাসেরকে কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ফলে বিজ্ঞ স্পেশাল জজ এই মত পােষণ করেন যে, জনাব মুজিবুর রহমান ফৌজদারি অপরাধে (মিসকন্ডাক্ট) দোষী এবং কাজী আবু নাসের সেই কাজের প্ররােচনা দেওয়ার অপরাধে দোষী এবং সেই প্ররােচনার অপরাধে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের (দুর্নীতি দমন আইন) ৫(২) ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হতে দায়বদ্ধ। বিজ্ঞ বিচারক আরাে দেখতে পান, ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ৭ এপ্রিল তারিখের আদেশে যে নিয়ােগ প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তা অবৈধ ও অসন্তোষজনক এবং জনাব মুজিবুর রহমান মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বরখাস্ত এবং মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে নিয়ােগ দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। দেখা যায় যে, জনাব মুজিবুর রহমান যে সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন দিয়েছেন তা রাষ্ট্রের স্বার্থে সহজাত কোনাে সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং এটা ছিল কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে নিয়ােগ দেওয়ার জন্য … (ক্যামােফ্লোজ) এবং এটাই ছিল পক্ষসমূহের মূল উদ্দেশ্য। তিনি আরাে দেখতে পান যে, সফট কোক উৎপাদনের জন্য কোনাে কারখানাই নির্মাণ করা হয়নি। বরং সফট কোক উৎপাদনের গল্পটা ছিল ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সফট কোক প্রকিউর ও হ্যান্ডল করার এজেন্সির আড়ালে একটা কৌশল। বিজ্ঞ বিচারক বলেন, কাজী আবু নাসের এজেন্সি পেতে ব্যর্থ হয়ে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হয়ে তিনি সেই এজেন্সি পাওয়ার একটা সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন। বিচারকের মতে, সফট কোক উৎপাদন করা ছিল একটি সূক্ষ্ম কৌশল আর কাজী আবু নাসের ছিলেন নেপথ্যের প্রধান কুশীলব, যিনি জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে প্ররােচনা ও সহায়তা দিয়েছিলেন মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল করে তা নিজ আয়ত্তে রাখার জন্য।
৯. জনাব মুজিবুর রহমানের পক্ষে জনাব সােহরাওয়ার্দী যুক্তি দেন যে, মুজিবুর রহমান যা করেছেন তা তিনি মন্ত্রী হিসেবে সদুদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে করেছেন এবং তা করেছেন দেশের কল্যাণ অগ্রগামী করার লক্ষ্যে। বিজ্ঞ স্পেশাল জজের সিদ্ধান্তসমূহ প্রধানত কিছু অনুমাননির্ভর এবং রেকর্ডকৃত সমগ্র সাক্ষ্য-প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনা না করে তা গৃহীত। তার (আপিলকারী মুজিবুর রহমান) দিক থেকে কিছু আইনি আপত্তিও তুলে ধরা হয়েছে। তার মতে, অনুমােদনটি আইনের শর্তানুযায়ী যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি এবং তা প্রয়ােজনীয় তথ্য-উপাত্ত জমা দিয়ে যথাযথভাবে অর্জন করা হয়নি। এই প্রসঙ্গে তিনি আরাে যুক্তি দেখান যে, জনাব মজিবর রহমান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সরকারি কর্মচারী (পাবলিক সার্ভেন্ট) ছিলেন না। তিনি যদি সরকারি কর্মচারী হয়েও থাকেন, তাহলে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮-এর ৬ ধারার (৫) উপধারার শর্তানুযায়ী আইনানুগভাবে
১৮৪

স্যাংশন নেওয়া হয়নি। ফলে, বিজ্ঞ স্পেশাল জজ কর্তৃক ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধ আমলে নেওয়া কিংবা এখতিয়ার প্রয়ােগে অপরিহার্য পূর্বশর্তই তৈরি হয়নি। এর ফলে, পুরাে বিচার অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত।
১০. কাজী আবু নাসেরের পক্ষে জনাব আবদুস সালাম খান যুক্তি দেখান যে, কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই নাসেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার মতে, কোনাে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল না এবং যে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল তাও ছিল অবস্থাগত সাক্ষ্য। তিনি আরাে যুক্তি দেখান যে, আপিলকারী কাজী আবু নাসেরকে অভিযােগের পূঢ় তথ্য সম্পর্কে কোনাে নােটিশ দেওয়া হয়নি, বিশেষত কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ২৪২ ধারার অধীনে স্টেটমেন্ট আকারে।।
১১. জনাব সােহরাওয়ার্দী ও জনাব সালাম খান দুজনই কিছু নজিরের উপর নির্ভর করেছেন যা পরে উল্লেখ
করা হবে।
১২. জনাব আজিজুদ্দীনের মতে, আইনানুগভাবে অনুমােদন নেওয়া উচিত ছিল এবং তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে। তিনি যুক্তি দেখান যে, জনাব মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সংশ্লিষ্ট আইনানুযায়ী পাবলিক সার্ভেন্ট ছিলেন। এছাড়া যদি এই যুক্তি অস্বীকারও করা হয় যে, তিনি পাবলিক সার্ভেন্ট ছিলেন, তবু তিনি স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচারের অধীন। কারণ এই ধরনের মামলার উপর একচ্ছত্র এখতিয়ার স্পেশাল জজের রয়েছে। শুধু অনুমােদন সম্বলিত আদেশ আকারে কোনাে কিছুর অভাব তার এখতিয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। তিনি আরাে বলেন যে, হতে পারে তদন্তকারী কর্মকর্তা দুয়েকটা ছােটখাটো তথ্য যথাযথভাবে উত্থাপন করতে পারেননি। কিন্তু অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপিত অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের আলােকে এটা বলা যাবে না যে, অনুমােদন আদেশ অযথার্থ কিংবা এখতিয়ারবহির্ভূত ছিল। তাঁর মতে, ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর ৬ ধারার (৫) উপধারায় প্রদত্ত ব্যখ্যা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে, স্যাংশন বা অনুমােদন যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে অনুমােদনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলার কোনাে সুযােগ থাকে না।
১৩. মামলার মেরিট প্রশ্নে, জনাব আজিজুদ্দীনের যুক্তি হলাে, উভয় আপিলকারীকে সঠিকভাবেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আমাদের নিমােক্ত পয়েন্টসমূহ নির্ধারণ করতে হবে :
“(১) ২১ মার্চ ১৯৫৭ ও ৭ এপ্রিল ১৯৫৭ তারিখ বা কাছাকাছি সময়ে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান পাবলিক সার্ভেন্ট ছিলেন কিনা। যদি তাই হয়, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড কোম্পানির এজেন্সি বাতিল এবং তার স্থলে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়ােগ দেওয়া এবং তাদের স্টিম কোল থেকে সফট কোক উৎপাদনের জন্য কারখানা খােলার অনুমােদন দিয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(১)(ডি) অনুযায়ী ফৌজদারি অসদাচরণের অপরাধ করেছেন কিনা;
“(২) জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠনের অনুমােদন যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেওয়া হয়েছে কিনা।
“(৩) জনাব শেখ মুজিবুর রহমান যদি ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধ করে থাকেন, তার প্ররােচনার কাজী আবু নাসের দোষী কিনা।”
১৮৫

১৪. বিবেচ্য পয়েন্টগুলাে নিয়ে আলােচনার পূর্বে এটা উল্লেখ্য যে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রত্যক্ষভাবে জনাব কাজী আবু নাসেরের এজেন্সির ব্যাপারে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিলেন-অভিযােগের এই অংশটুকু কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়। বিজ্ঞ সরকারি উকিলও আমাদের সামনে এই বিষয়টি উত্থাপন করেননি। এর ফলে আমরা মনে করি, তিনি যথার্থভাবেই মামলার এই বিষয়টির উপর জোর দেননি।
১৫. মামলার গুণাগুণ প্রশ্নে প্রবেশের পূর্বে আমাদের প্রথমে স্যাংশনের প্রশ্নটি এবং জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ‘সরকারি কর্মকর্তা’ কিনা সেই প্রশ্নের মীমাংসা করা যথার্থ বলে মনে করি।।
১৬. দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(১)(ডি) ধারা নিম্নরূপ :
“5(1) A public servant is said to commit the offense of criminal misconduct;
(b) If he, by corrupt and illegal means or by otherwise abusing his position as public servant obtains for himself or for any other person any valuable think
or pecuniary advantage.”
১৭. পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮-এর ৬ ধারার (৫) উপধারাটি এখানে উদ্ধৃত করা যায়-
“Notwithstanding anything contained in the Code of Criminal Procedure, 1898, or in any other law, previous sanction of the appropriate Government shall be required for the prosecution of a public servant for an offence under this Act, and such sanction shall be sufficient for the prosecution of a public servant for an offence triable under this Act;
“Provided that in case where the complaint or report referred to in sub-section (1) of sec 4 is not accompanied by such sanction, the Special Judge shall, immediately on receipt of the complaint or report, address by latter, the appropriate Government in the matter, and if the required sanction is neither received nor refused within sixty days of receipt if the letter by the appropriate Government, such sanction shall be deemed to have been duly accorded;
“Provided further that no such sanction shall be required in respect of a case transferred under the proviso to sub-section (2) of section 4 or by virtue of sub-section (3) or sub-section (4) of section 5, if such sanction in respect thereof has been duly accorded or deemed to have been so accorded before the case is so transferred.”
“Explanation-For the purpose of this sub-section, `appropriate Government shall mean the Government which at the time of the commission of the offense was the appropriate Government.”
১৮. এই দুটি ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের প্রণেতাদের মনে এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, এই প্রকৃতির সরকারি কর্মকর্তা দ্বারা ফৌজদারি অসদাচরণের অপরাধ সংঘটিত হতে পারে।
১৮৬

১৯. ফলে, “পাবলিক সার্ভেন্ট” অভিব্যক্তি দিয়ে কী বােঝায় এবং ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(১) (ডি) ধারা অনুযায়ী ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধ বিবেচনার সময় কাকে ‘পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে
বিবেচনা বা গণ্য করা যায় তা অনুধাবন করা প্রয়ােজন।
২০. আপিলকারীদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানাে হয় যে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীর পদে আসীন এ থাকাকালীন সুদূরপ্রসারী কল্পনার আশ্রয় নিয়েও তাঁকে ‘সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
২১. মূল রায় যা ১৫ ডিএলআর ১৯৬৩-এ রিপাের্টেড হয়েছে তাতে প্যারাগ্রাফ ২১ নেই।
২২. তবে জনাব আজিজুদ্দীন ১৯৫৮ সালের ৪০ নম্বর আইনের ২(বি) ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞার উপর নির্ভর করেছেন। এই ২(বি) ধারায় বলা হয়েছে :
“পাবলিক সার্ভেন্ট’ মানে হলাে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ২১ নম্বর ধারায় সংজ্ঞায়িত পাবলিক সার্ভেন্ট।” তিনি এ-প্রসঙ্গে ২১ ধারার ৯ নম্বর দফার উপর নির্ভর করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে-
“প্রত্যেক কর্মকর্তা, যার কর্তব্য হলাে সেই কর্মকর্তা হিসেবে রাজার পক্ষে কোনাে সম্পত্তি নেওয়া, গ্রহণ, সংরক্ষণ; কিংবা ব্যয় করা কিংবা রাজার পক্ষে কোনাে জরিপ, মূল্যায়ন বা চুক্তি করা; কিংবা রাজার অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন কোনাে রাজস্ব প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, তদন্ত বা রিপাের্ট করা; কিংবা রাজার অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন কোনাে দলিল তৈরি, সত্যতা যাচাই করা কিংবা সংরক্ষণ করা; কিংবা রাজার অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার জন্য কোনাে আইনের লঙ্ঘন রােধ করা এবং “every officer in the service or pay of the Crown or remunerated by fees of commission for the performance of any public duty.”
তিনি এই দফার শেষাংশের উপর জোর দিয়েছেন যা পুনরায় উদ্ধৃত করা যায়-
“every officer in the service or pay of the Crown or remunerated by fees of
commission for the performance of any public duty.”
২৩. জনাব সােহরাওয়ার্দীর মতে, এই ধারায় উল্লিখিত ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ কথাটা বুঝতে হলে ১৮৬০ সালে প্রণীত পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার ৯ নম্বর দফাটি পুরােটা মাথায় রাখতে হবে। তার যুক্তি হলাে, কোন ক্যাটাগরির ব্যক্তিকে ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ বিবেচনা করা যাবে তার একটা সাধারণ ধারণা এই দফার প্রথম অংশে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরাে যুক্তি দেন যে, এই দফার শেষাংশ, যার উপর জনাব আজিজুদ্দীন জোর দিয়েছেন, সেখানে একই দফার আগের অংশে উল্লিখিত ক্যাটাগরির থেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র কোনাে ক্যাটাগরি প্রস্তাব করা হয়েছে বলে বিবেচনা করা যাবে না। তাঁর মতে, দ্বিতীয় অংশ প্রথম অংশ থেকে উদ্ভূত এবং এটাকে ejusdem generis নীতিমালার মতাে একইভাবে বুঝতে হবে। তিনি ম্যাক্সওয়েলের বিখ্যাত গ্রন্থ Maxcell on Interpretation of Statutes, দশম সংস্করণের ৩৩৭ পৃষ্ঠা থেকে কিছু পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেছেন। সংশ্লিষ্ট অংশগুলাে নিম্নরূপ :
“But the general word which follows particular and specific words of the same nature as itself takes meaning from them, and is presumed to be restricted to the same genus as those words.”
১৮৭

তাঁর মতে, পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার নবম দফায় উল্লিখিত বিভিন্ন ক্যাটাগরির ব্যক্তিদের সরকারের সম্পত্তি বা অর্থনৈতিক স্বার্থের দেখাশােনার দায়িত্বে নিয়ােজিত হিসেবে বর্ণনা করা যাবে এবং একজন মন্ত্রী সেই ক্যাটাগরিতে পড়েন না।
২৪. তবে জনাব আজিজুদ্দীনের যুক্তি হলাে, উপরে উদ্ধৃত পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার নবম দফার শেষ অংশটুকু আলাদা একটি ক্যাটাগরি সৃষ্টি করে, এবং তা এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে প্রথম অংশের কোনাে রেফারেন্স ছাড়াই সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সম্পর্কযুক্ত করা যাবে। তিনি আরাে দাবি করেন, কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা পাবলিক সার্ভেন্ট কিনা তা নির্ধারণের নিক্তি হলাে তিনি সরকারের সার্ভিসে আছেন কিনা এবং
if Mr. Sheikh Mujibur Rahman answered this description, he
would contend that Mr. Mujibur Rahman should be regarded as a public servant.
২৫. ম্যাক্সওয়েলের একই বই Maxwell on Interpretation of Statutes, দশম সংস্করণের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, অন্য আরাে পর্যবেক্ষণ রয়েছে যা এই বিষয়ের প্রতি আলােকপাত করতে পারে।
৩৩৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
“In other words, it is to be read as comprehending only things of the same kind as those designated by them, unless, of course, there be something to
show that a wider sense was intended.”
আবার ৩৩৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
“Unless there is a genus or category there is no room for the application of the ejusdem generis
২৬. পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার নবম দফার কাঠামাে বিশ্লেষণ করে আমাদের কাছে মনে হয়, সেখানে এক নয় অনেকগুলাে ক্যাটাগরি বােঝানাে হয়েছে to answer the definition therein। একই নবম দফার প্রথমাংশ থেকে যেরকম অনুধাবন করা যায়, এই দফার শেষাংশ একই রকম ধারণা দেয় না। আমাদের কাছে এটাও মনে হয় না যে, দুই অংশ, যদি বলতে হয়, কম-বেশি সহাবস্থানমূলক। কিংবা এই দফার শেষাংশ প্রথমাংশ থেকে উদ্ভূত হতে পারে। every officer in the service or pay of the Crown or remunerated by fees of commission for the performance of any public duty, makes the field a little wider than what can be said to have been indicated in the first part of the clause by reference to the different kinds of persons described therein. পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার নবম দফার প্রথম অংশে কিছু সুনির্দিষ্ট সরকারি দায়িত্বের কথা নির্দেশ করা হয়েছে। তা হলাে : …whereas any public duty seems to be the range of activities for the purpose of an officer described in the second part of said clause, ফলে, আমরা জনাব সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে একমত হতে পারছি না যে, তার উত্থাপিত ejusdem generis নীতিমালার উপর নির্ভর করে এই সিদ্ধান্তে পৌছানা যায় যে, … that they come under the same head of genus with respect to persons who may be charged with looking after the property or pecuniary interest of the Government alone। এটা হতেই পারে যে, সরকারের সার্ভিসে কর্মরত কিংবা সরকারের বেতনভুক্ত একজন কর্মকর্তা সম্পত্তি বা অর্থনৈতিক স্বার্থ দেখাশােনার
১৮৮

জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি অফিসার হিসেবে পাবলিক ডিউটি পালন করাকালীন তার পদমর্যাদা অনুযায়ী আরাে কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত হতে পারেন।
২৭. এরপর যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, একজন প্রাদেশিক মন্ত্রীকে গভর্নরের অধীনস্থ কর্মকর্তা বলা যাবে না।
46769 Emperor v. Hemendra Prasad Ghosh, ILR 1939 (2) Cal. 411 710013 Tootalot হাইকোর্টের রায়ের উপর নির্ভর করা হয়েছে। তবে জনাব আজিজুদ্দীন বলেন, Hemendra Prasad Ghosh মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের মত Emperor v.Sibnath Banerji and others, AIR 1945 PC 156 মামলায় প্রিভি কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত হয়নি। সরাসরি মামলার মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, তবু দেয়ার লর্ডশিপ অব প্রিভি কাউন্সিল প্রসঙ্গক্রমে এই প্রশ্নটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন-এর ৪৯(১) ধারার অধীনে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গভর্নরের অধীনস্থ কর্মকর্তা কি না।
ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫-এর ৪৯(১) ধারায় বলা হয়েছে :
“প্রদেশের নির্বাহী অথরিটি গভর্নর কর্তৃক প্রয়ােগকৃত হবে (এক্সারসাইজড), প্রত্যক্ষভাবে কিংবা তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।”
ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫-এর ৫১ ধারার দিকে লক্ষ করলেও প্রতীয়মান হয় যে, গভর্নরের সন্তুষ্টিক্রমেই একজন মন্ত্রী তাঁর পদে আসীন থাকেন এবং গভর্নর যথাযথ ক্ষেত্রে একজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার পূর্ণ
অধিকার রাখেন।
[ মূল ডকুমেন্টে ২৮নং ক্রমিক উল্লেখ নেই]।
২৯. আমাদের পুরনাে সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদের দফা (৪)-এর দিকে তাকালে আমরা মন্ত্রীর নিয়ােগ ও বরখাস্তকরণ সম্পর্কে একই রকম বিধান (করেসপন্ডিং) পাই। ৭১ অনুচ্ছেদের দফা (৪) নিম্নরূপ :
“অন্যান্য মন্ত্রী, ডেপুটি মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিগণ গভর্নর কর্তৃক নিয়ােগ কিংবা বরখাস্ত হবেন, কিন্তু কোনাে ব্যক্তিই ডেপুটি মন্ত্রী কিংবা পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি হতে পারবেন না, যদি না তিনি প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হন।”
ফলে, প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের পুরনাে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান থেকেও এই তাৎপর্য নিহিত হয় যে, একজন মন্ত্রী তার পদে নিযুক্ত কিংবা তা থেকে বরখাস্ত হন গভর্নর কর্তক
৩০. পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার নবম দফার শেষাংশে ব্যবহৃত ভাষা নির্দেশ করে যে, ইন সার্ভিস অর পে অব ক্রাউন অর, রেমুনারেটেড বাই ফিজ অর কমিশন ফর দ্য পারফরম্যান্স অব পাবলিক ডিউটি করেন এমন প্রত্যেক কর্মকর্তা সরকারি কর্মকর্তা। এখানে যেটি দেখতে হবে তা হলাে অফিসারকে অবশ্যই ইন সার্ভিস অর পে অব দ্য গভর্নমেন্ট হতে হবে এবং এটা স্বীকৃত নীতি যে, যদি কেউ ইন সার্ভিস অর পে অব গভর্নমেন্ট হন, তাহলে সরকার তাকে সার্ভিস থেকে বাদ দিতেও সক্ষম। এই নীতির উপর নির্ভর করে এটা নিরাপদে বলা যায় যে, কোনাে ব্যক্তি যাকে একজন অফিসার হিসেবে নিয়ােগ ও বেতন দেওয়া যায় এবং তাকে তার চাকরি থেকে বরখাস্তও করা যায়, যেহেতু তিনি সরকারি দায়িত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। Emperor v. Harendra Prasad Ghosh, ILR 1939 (2) Cal. 411 মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করতে গিয়ে দেয়ার লর্ডশিপ অব প্রিভি কাউন্সিল যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা অন্যান্য আদালত কর্তৃক গৃহীত ও অনুসৃত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। Sibnath (2) মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের রায়ের প্রাসঙ্গিক অংশ নিম্নরূপ :
১৮৯

“বর্তমান মামলার সঙ্গে যতটুকু প্রাসঙ্গিক, দেয়ার লর্ডশিপ রেসপন্ডেন্টদের আইনজীবীর এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হতে অক্ষম যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৯(১) ধারার অর্থ অনুযায়ী গভর্নরের অধীনস্থ কর্মকর্তা নন এবং ILR 1939) 2 Ca] 411 মামলায় প্রদত্ত রায়ে যেখানে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে যে, একজন মন্ত্রী একজন কর্মকর্তা নন, সেই অংশটুকুর সঙ্গে একমত হতে অক্ষম। মন্ত্রীরা আইনসভার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করলেও তাদের নিয়ােগ, বেতন-ভাতা ও বরখাস্তকরণ-সংক্রান্ত ১৯৩৫ সালের আইনের ৫১ ধারা এবং ৫৯(৩) ও ৫৯(৪) ধারা এবং ৫৯ ধারা অনুযায়ী প্রণীত দ্য বিজনেস রুলস থেকে এটা নিঃসন্দেহ যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গভর্নরের অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা।” Singh and another v. The State of Vindhya Pradesh, AIR 1953 SC (India) 394 1167127 ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টও একই যুক্তি গ্রহণ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
৩১. সুতরাং, আমাদের মতে, কোনাে ব্যক্তি যাকে গভর্নর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত করেছেন এবং সরকারি কোষাগার থেকে তাঁর বেতন-ভাতা পরিশােধ করা হয় এবং যিনি গভর্নর কর্তৃক বরখাস্তকরণের অধীন, তিনি পাকিস্তান পেনাল কোডের ২১ ধারার নবম দফার শেষাংশে নির্দেশিত সংজ্ঞায় পড়েন এবং এর ফলে, ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের সঙ্গে ১৯৫৮ সালের ৪০ নম্বর আইন একত্রে মিলিয়ে পড়লে, একজন মন্ত্রী কেবল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবেই বিবেচিত হবেন।
৩২. ফলে, এখন প্রশ্ন হলাে, বিজ্ঞ স্পেশাল জজ কর্তৃক ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে এখতিয়ার প্রয়ােগ এবং অভিযােগ গঠনের জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে যে অনুমােদন প্রয়ােজন তা উপরে উল্লিখিত পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮-এর ৬ ধারার শর্ত অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে কিনা এবং যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তা নেওয়া হয়েছে কিনা।
৩৩. আপিলকারীর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে, ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট অপরাধ করার সময় অবস্থান যা-ই হােক না কেন, প্রসিকিউশন শুরু হওয়ার সময় যেহেতু জনাব মুজিবুর রহমান মন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন না, ফলে তিনি আর পাবলিক সার্ভেন্ট’ নন। তাই তাঁকে পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮-এর ৬ ধারা অনুযায়ী স্যাংশন বা অনুমােদনের লক্ষ্য বানানাে উচিত নয়। এই যুক্তির পক্ষে Haines Ghulam Sadiq v. Pakistan and others (1961) 13 DLR (SC) 126 মামলায় আমাদের সুপ্রীম কোর্টের রায়ের উপর নির্ভর করা হয়েছে। মামলাটির অস্বাভাবিক (পিকুলিয়ার) ঘটনা ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞ বিচারকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রসিকিউশনের স্যাংশন এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই দেওয়া যাবে যিনি স্যাংশন দেওয়ার সময় “প্রকৃতপক্ষে চাকুরিরত ছিলেন। সেই মামলায় যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠন করার কথা হচ্ছিল তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এবং পেনশনভােগী হয়ে পড়েছেন। বিচারকদের মতে, তার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া মামলার প্রসিডিং যথাযথ ছিল না, এই কারণে যে, অনুমােদনটি যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি। তিনি আর চাকরিরত নন কিংবা কোনাে বিশেষ সুবিধা দাবি করার মতাে অবস্থানেও ছিলেন না, যদি না যথাযথ সরকার স্যাংশন দিতে নিয়ে তাকে সুরক্ষা না দিতে চায়। যা হােক, এই মামলা ১৯৬০ সালের ৩০ মে নিষ্পত্তিকৃত হলেও পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর সংশােধনী দ্বারা সংযুক্ত ব্যাখ্যা বিচারকগণ বিবেচনায় নেননি। আসলে সেই মামলায় আপিলকারী হামেদ গােলাম সাদেক কর্তৃক কৃত অপরাধ সংশােধনী কার্যকর হওয়ার কিছুদিন পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। আমরা মনে করি না যে, নতুন সংশােধিত আইন অর্থাৎ, পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ কার্যকর হওয়ার আইনি পরিস্থিতি
১৯০

অপরিবর্তিত থাকে। উপরে উদ্ধৃত পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর ৬ ধারার (৫) উপধারার মর্মার্থ বলে যে, “যথাযথ গভর্নমেন্ট” বলতে অপরাধ সংঘটনের সময় ক্ষমতাসীন সরকারকে বােঝানাে হয়েছে। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আইনটির প্রণেতাদের মনে এটা ছিল যে, অপরাধ সংঘটনের সময় সংশ্লিষ্ট অপরাধী পদাসীন থাকতে পারেন এবং তিনি যখন পদাসীন থাকবেন না তখনও অভিযােগ গঠনের প্রশ্ন উঠতে পারে। এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ব্যাখ্যা যুক্ত করার পরেও পরিস্থিতির প্রভূত পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাবে না। কারণ, এমনও হতে পারে যে, কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা একটি সুনির্দিষ্ট সরকার, ধরা যাক, প্রাদেশিক সরকারের অধীনে চাকরি করার সময় একটি ‘ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট’-এর অপরাধ করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠন করতে চাওয়া। তিনি অন্য একটি সরকারের ধরুন, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকুরিরত। এই যুক্তিও দেওয়া হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত যদি সম্পূর্ণভাবে তার সরকারি পদ বা চাকরি ছেড়ে দেন তখন এরকম ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাটি কাজে আসবে না। আমরা মনে করি না যে, ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত ভাষা এত সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে অনুমােদন করে। আমাদের মতে, ব্যাখ্যার ভাষা সম্ভাব্য উভয় ক্ষেত্রকেই ধারণ করার মতাে পর্যাপ্তভাবে বিস্তৃত এবং এই ব্যাখ্যায় এমন কিছু নেই যা এটি নির্দেশ করে যে, আইনসভা বা আইনটির প্রণেতাদের মনে কেবল আপিলকারী কর্তৃক প্রস্তাবিত ক্যাটাগরির মামলার কথাই ছিল। আমাদের মতে, যদিও অপরাধটি এমন সময় সংঘটিত হয়েছে যখন শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে পদাসীন ছিলেন এবং এমন সময় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠন করতে চাওয়া হয়েছে যখন তিনি আর মন্ত্রী পদে বহাল নেই। তবু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠনের জন্য যথাযথ সরকারের নিকট থেকে অনুমােদন নেওয়া প্রয়ােজন। যদি অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মনে করে যে, এটা অভিযােগ গঠন কিংবা বাদ দেওয়ার জন্য যথাযথ মামলা, তখন মামলার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী যেভাবে সবচেয়ে ভালাে হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। Abul Mansur Ahmed vs. Azizur Rahman v. The State, (1961) 13 DLR 335 মামলায় আমাদের বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি বাকের তুলে ধরেছেন যে, গােলাম সাদিকের মামলার আগে এই ব্যাখ্যা [সংশােধনীর মাধ্যমে যুক্ত ব্যাখ্যা] সুপ্রীম কোর্টের নিকট বিবেচনার জন্য উত্থাপন করা হয়নি। আবুল মনসুর আহমদ মামলায় দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠনের জন্য অনুমােদন যথাযথভাবে নেওয়া হয়েছিল। প্রতীয়মান হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান গভর্নরের অধীন একজন মন্ত্রী ছিলেন এবং আরও প্রতীয়মান হয় যে, প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক অনুমােদন দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটা দেখানাের কিছু নেই যে, ‘অনুমােদন’ যথাযথ সরকার কর্তৃক দেওয়া হয়নি। আমাদের মতে পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৮-এর ৬(৫) ধারার বিধান অনুযায়ী যথাযথ সরকার কর্তৃক ‘অনুমােদন দেওয়া হয়েছে।
৩৪. পরবর্তী প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই অনুমােদন যথাযথভাবে নেওয়া হয়েছে কিনা কিংবা এ ধরনের অনুমােদনকে যথাযথ অনুমােদন বলা যায় কিনা।
৩৫. আপিলকারীর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, এক্সিবিট-৩, অর্থাৎ, অনুমােদন আদেশ দেখলে প্রতীয়মান হয়
যে, অনুমােদন দেওয়া হয়েছে কমবেশি তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। আরও বলা হয় যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত ছিল কিংবা তারা মামলার ফ্যাক্টের ব্যাপারে তাদের বিবেচনা প্রয়ােগ করেছেন তা মনে করা কঠিন। এ-প্রসঙ্গে অনুমােদন-আদেশের কিছু অংশের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ :
১৯১

“১. যেহেতু কথিত জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কোনাে কারণ লিপিবদ্ধ না করে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের মারাত্মক আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিল এক আদেশ জারি করে আচমকা এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে উপরােক্ত ফার্মের এজেন্সি বাতিল করেছেন…।
“২. বস্তুত, প্রস্তাবিত কারখানাটি ফার্ম কর্তৃক কখনােই স্থাপিত হয়নি।” এসব অংশ এবং অনুমােদন-আদেশের, প্রদ.-৩, অন্যান্য অংশের ইঙ্গিত করে যুক্তি দেখানাে হয় যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের মতে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল করা এবং কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে তার স্থলে নিয়ােগদানের ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান কোনাে কারণ দেখাননি। যদিও রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান কিছু কারণ দেখিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। অপর পয়েন্ট সম্পর্কে যুক্তি দেখানাে হয়েছে যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের মতে কাজী আবু নাসের কর্তৃক সফট কোক উৎপাদনের জন্য কখনাে কোনাে কারখানা তৈরি করা হয়নি। কিন্তু রেকর্ডে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, উল্লিখিত সময়ে এরকম কারখানা তৈরি বা প্রস্তুতি চলমান ছিল এবং পরবর্তীকালে তা প্রকৃতপক্ষেই স্থাপিত হয়েছে। আপিলকারীর বিজ্ঞ আইনজীবী এই প্রসঙ্গে এটাও বলেছেন যে, যদি মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল এবং তার পরিবর্তে কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে নিয়ােগের পেছনে শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত কারণসমূহ অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপন করা হতাে কিংবা তা বিবেচনা করতাে এবং সংশ্লিষ্ট সময়ে কারখানা নির্মাণ প্রকৃতপক্ষে চলমান ছিল কিংবা সংশ্লিষ্ট পক্ষ তা নির্মাণের ব্যাপারে সত্যি সত্যিই সিরিয়াস ছিল এবং যখন অনুমােদন দেওয়া হচ্ছিল তখন অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ যদি এটি জানতেন যে তা সত্যি সত্যি নির্মিত হয়ে গিয়েছে, তাহলে সম্ভবত এই অনুমােদন কখনাে দেওয়া হতাে না। এসব অনুমানের ভিত্তিতে এই যুক্তিও দেওয়া হয় যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ কেবল তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সময়ে কোনাে কারখানা তৈরি হয়নি এবং পূর্ববর্তী এজেন্সি বাতিল ও তার পরিবর্তে কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে নিয়ােগের ব্যাপারে কোনাে সুস্পষ্ট কারণ এখানে দেখাননি।
৩৬. তবে জনাব আজিজুদ্দীনের যুক্তি হলাে, the law does not require that any particular form
should be followed while giving or making an order of sanction, and he also contends that the only test as to the validity of a sanction is as to whether proper materials other than those which might have been submitted by the Investigating Officer were placed before the sanctioning authority had applied its mind thereto. After getting such materials and considering them the sanctioning authority came to an erroneous view that by itself could not vitiate the validity of the sanction order.
৩৭. জনাব সালাম খান Tufail Muhatiad 0. The Croon (1954) 6 DLR (WP) Lah. 143 মামলার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেছেন। সেখানে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের সামনে উপস্থাপিত মামলার ফ্যাক্টস ও পরিপ্রেক্ষিতসমূহ বিবেচনায় নেওয়া এবং সংগৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে আপাতদৃষ্টিতে কোনাে অপরাধ উদঘাটিত হলেও তারা অভিযােগ গঠনের অনুমােদন দিতে বাধ্য নয়, যদি না তারা এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তা করা সমীচীন হবে। সকল
১৯২

তথ্য-উপাত্ত বিবেচনার পরই কেবল এরকম অনুমােদন দেওয়া উচিত। যেখানে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি সেক্ষেত্রে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠনের জন্য প্রদত্ত অনুমােদন অবৈধ।
৩৮. বিজ্ঞ বিচারক রায় নিষ্পত্তি করার সময় Gokulchand Morarka v.The King, AIR 1948 PC 82 মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের রায়ের উপর নির্ভর করেছেন। সেখানে একটি অনুমােদন-আদেশ, যা মামলাটিতে অভিযােগ গঠনের পূর্বশর্ত ছিল, তা বিবেচনা করতে গিয়ে বিজ্ঞ বিচারকগণ নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেন :
“যদি অপরাধের উপাদান সংক্রান্ত ফ্যাক্টস অনুমােদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়নি বলে মনে। হয়, [আর নট শােন অন দ্য ফেইস অব অব দ্য স্যাংশন] প্রসিকিউশনকে তখন বহিরাগত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করতে হবে যে, এসব তথ্য অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে। অভিযােগ গঠনের অনুমােদন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি অভিযােগ গঠনের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে এবং তা অনুমােদন বা বাতিল করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্ণ স্বেচ্ছাক্ষমতা আছে। হাইকোর্ট যেরকম মনে করেছে, এই অনুমােদন কেবল এটা দেখার জন্য নয় যে, সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে যে অভিযােগ গঠন করতে যাচ্ছে তার আলােকে এরকম ব্যক্তির বিরুদ্ধে আপাতদৃষ্টে মামলার অভিযােগ প্রতিভাত হয় কিনা। তারা তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হয় এরকম যে, কোনাে গ্রাউন্ডে অনুমােদন দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে তারা কোনাে অনুমােদনকে অসমীচীন মনে করতে পারেন। মৌলিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করে এটা পরিষ্কার যে, সরকার মামলার ফ্যাক্ট বিষয়ে কোনাে ধরনের জ্ঞান বা ধারণা ছাড়া অনুমােদন দেওয়া বা তা বাতিল করার দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করতে পারে না।” ফলে দেখা যাচ্ছে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তার সামনে উপস্থাপিত ফ্যাক্টস আমলে আনার সুযােগ দিতে হবে এবং সেই সুযােগ তারা পেয়েছেন তা অনুমােদন আদেশ কিংবা রেকর্ডের অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকে প্রতীয়মান হতে হবে।
৩৯. Galla antigamala Muhammad Jaffer v. The State PLD 1959 WP Kar. 585 এ. এস. ফারুকীর কিছু পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেছেন। মনে হয় উপরােক্ত দুটি রায়ই বর্তমান মামলায় [বিচারিক আদালতে] বিবেচনা করা হয়েছে। এসব রায় বিশ্লেষণের পর বিজ্ঞ বিচারক নিমােক্ত ভাষায় একটি প্রস্তাব বিধৃত করেছেন :
“যা হােক, এটা অত্যাবশ্যকীয় যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযােগ গঠনের কথা হচ্ছে সেই অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য অবশ্যই হয় অনুমােদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে বলে মনে হতে হবে কিংবা এই মর্মে বহিরাগত সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকতে হবে যা অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি আরও বলতে চাই যে, অনুমােদন-আদেশের ভাষাতেই [অন দ্য ফেইস] যদি তা প্রতীয়মান হয়, তাহলে অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য বিবেচনায় নিয়েছে তা প্রমাণ করার জন্য প্রসিকিউশনকে এর চেয়ে বেশিদুর অগ্রসর হওয়ার প্রয়ােজন নেই।”
৪০. অনুমােদন-আদেশ, এক্সিবিট-৩,-এর দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, গভর্নরের কাছে প্রতিবেদন ও রেকর্ড উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং আদেশের প্রস্তাবনায় তা বলা হয় :
“বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পোন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত সাবেক মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী দায়েরকৃত ২ ফেব্রুয়ারি
১৯৩

১৯৫৯ তারিখ সম্বলিত রমনা (ঢাকা) পি.এস. কেইস নম্বর ৩-সংক্রান্ত ব্যাপারে গভর্নরের কাছে পেশকৃত প্রতিবেদন ও রেকর্ডস থেকে গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ উপায়ে কিংবা মন্ত্রী হিসেবে নিজের অবস্থানের অপব্যবহার করে অন্য কোনােভাবে তাঁর নিজের বা মেসার্স মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের জন্য মূল্যবান জিনিসপত্র কিংবা অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা, উপরােক্ত কোম্পানিকে ভারত থেকে কমিশন ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ সফট কোক উত্তোলন ও হস্তান্তরের জন্য প্রাদেশিক সরকারের এজেন্ট নিয়ােগ করা এবং কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় শক্ত কয়লাকে নরম কোক-কয়লায় রূপান্তরিত করার অনুমােদনসহ একটি কয়লা খনি স্থাপন এবং নতুন খনি শুরু করার জন্য ভারত থেকে ৫০০ টন শক্ত কয়লা আমদানির জন্য অনুমােদন প্রদান করার অভিযােগে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধের প্রাইমা ফেসি মামলা দায়ের করার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে।”
৪১. এটা নির্দেশ করে যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের সামনে কিছু নথিপত্র ও প্রতিবেদন ছিল। তবে একই আদেশের শেষাংশ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ সেসব তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, প্রস্তাবিত কারখানা সেই ফার্ম কর্তৃক কখনােই স্থাপিত হয়নি। সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তের বিচারকার্য চলাকালে মামলার সংশ্লিষ্ট তথ্যসমূহ সম্পর্কে অধিকতর বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই দুটি মতামত ভুল কিংবা সঠিক মনে হতে পারে। কিন্তু কেবল এসব মতামতের ভিত্তিতেই এটা বলা প্রায় অসম্ভব যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়ােজনীয় তথ্য-উপাত্ত ছিল না। আপিলকারীর পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট যেমন বলেছেন, হতে পারে অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কিন্তু তা এই ইঙ্গিত করে না যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ তাদের বিবে করেননি। অন্যদিকে, আদেশের ভাষা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, শেখ মুজিবুর রহমান যে ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন সেই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণের পরই অনুমােদনকারী কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। অফিসিয়াল নথিপত্র থেকে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর/মন্ত্রণালয়ের সচিব কিছু আপত্তি জানিয়েছিলেন। অনুমােদন-আদেশ’ থেকে এ-ও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এরকম আপত্তি সত্ত্বেও মন্ত্রী তর্কিত আদেশসমূহ জারি করেছিলেন। এটা নিশ্চিতভাবে ইঙ্গিত করে যে, অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ ফ্যাক্টস সম্পর্কে তাদের বিবেচনা প্রয়ােগ করেছেন এবং মামলাসংক্রান্ত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টস জানার মতাে অবস্থানে ছিলেন। এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিবেচনা করে অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। যদি তথ্য-উপাত্ত বিবেচনার পর অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ মনে করতেন। বিষয়টি নিয়ে এগুনাের দরকার নেই তবে তারা তা করতে পারতেন। এটা বলা খুব কঠিন যে, যথাযথ তথ্য-উপাত্তের অভাবে অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষ সেই আলােকে মামলাটি বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং, আমাদের মতে, প্রদর্শনী-৩ অনুযায়ী অনুমােদন-আদেশটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে। মামলার ফ্যাক্টস বিবেচনা করে বলা যায় না যে, তাদের বিবেচনা কেবল তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বরং তা অনুমােদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপিত অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত
ও নথিপত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।।
৪২. এবার আমরা আপিল দুটির মেরিট বিবেচনা করবাে।
৪৩. উপরে যেসব অভিযােগের কথা বলা হয়েছে সেগুলাের সারকথা হলাে মন্ত্রী থাকার সময় শেখ মুজিবুর রহমান কিছু ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর বন্ধু কাজী আবু নাসেরকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন, যা সেই বন্ধুকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করেছে।।
১৯৪

৪৪. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ২৪২ ধারা অনুযায়ী আপিলকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে যেসব অভিযােগের কথা জানা যায় তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কেবল দুটি ছাড় দিয়েছেন বলে অভিযােগ করা হয়েছে এবং আরেকটি সুবিধা প্রদানের কনসেশনের কথা অভিযােগ গঠনের সময় যােগ করা হয়েছে। প্রদত্ত এসব সুবিধা বা কনসেশনের ধরন কেমন ছিল তা নীচের উদ্ধৃতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে :
“(১) কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে প্রথম যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা হলাে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও একই বছরের ৭ এপ্রিলের আদেশের মাধ্যমে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল করেন এবং একই আদেশের মাধ্যমে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে নিয়ােগ দেন যেখানে তার বন্ধু কাজী আবু নাসেরের স্বার্থ জড়িত ছিল।।
“(২) একই আদেশসমূহের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান তার বন্ধু কাজী আবু নাসের, রেদার টু, কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি কোকিং প্ল্যান্ট তৈরির অনুমােদন দিয়েছেন এই অজুহাতে যে, তা বৈদেশিক মুদ্রা সেভ করবে।
“(৩) শেখ মুজিবুর রহমান পিট মাইনিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গােপালগঞ্জ মহকুমার ফরিদপুর জেলায় ইজারা অনুমােদন দিয়ে আদেশ প্রদান করেছেন।” এখানে শুরুতেই এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তৃতীয় ধরনের কনসেশনের কথা এমনকি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আপিলকারীদের পরীক্ষার সময়ও উত্থাপন করা হয়নি। কিন্তু বার-এর পক্ষ থেকে উত্থাপিত যুক্তিতে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের এই কাজ সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যাবে কেবল এটা দেখানাের জন্য যে, তিনি তার বন্ধু কাজী আবু নাসেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।
৪৫. মামলার এই পরিপ্রেক্ষিতে উপরােক্ত প্রতিটি পক্ষপাত (ফেভার) কিংবা কনসেশন মাথায় নিয়ে তর্কিত আদেশসমূহের গুণাগুণ ও যৌক্তিকতা বিবেচনা যথাযথ হবে।।
৪৬. সাক্ষ্য-প্রমাণে রয়েছে এবং বিজ্ঞ স্পেশাল জজও পেয়েছেন যে, কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড স্বাধীনতার সময় থেকে পাকিস্তানের এই অংশে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল। এরকম কোনাে প্রমাণ নেই যে, ১৯৫৫ সালের আগে এই কোম্পানি কখনাে অযােগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বস্তুত এই ব্যাপারে বিজ্ঞ স্পেশাল জজের ফাইন্ডিংস নিয়ে কোনাে পক্ষই প্রশ্ন তােলেনি। এটা নিয়েও আপত্তি করা হয়নি যে, কাজী আবু নাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কমবেশি জড়িত ছিলেন। উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের শেষ দিকে ভারত থেকে সফট কোক আমদানি এবং পূর্ব পাকিস্তানে তা বিতরণ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড এবং প্রকিউর ও হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন জনাব আমজাদ খান নামক এক ব্যক্তি। তার কাজ ছিল খুবই অসন্তোষজনক এবং ১৯৫৪ সালের ২৬ নভেম্বর তারিখে ইস্যুকৃত এক চিঠির, এক্সিবিট-২০, মাধ্যমে ডিরেক্টরেট অব কনজুমার গুডস, ফুয়েলস অ্যান্ড টেক্সটাইলস থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর প্রশ্ন উঠে একই উদ্দেশ্যে এজেন্ট হিসেবে কাকে নিয়ােগ দেওয়া হবে। প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৫৫ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে (প্রদর্শনী-৫) এজন্য বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে কয়লা বাণিজ্য চুক্তির জন্য অন্যান্য পালনীয় শর্তাদি প্রদর্শনী-৫(ক)-তে নির্দেশিত
১৯৫

হয়েছে। শর্ত ছিল যে, দরপত্রে বিভিন্ন স্বতন্ত্র কাজের জন্য প্রতি টন কয়লার সর্বনিম্ন দর উল্লেখ থাকতে হবে, যা ঈশ্বরদী পর্যন্ত রেলে এবং/কিংবা নৌপথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বুকিং নেওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় হতে পারে। ডিস্ট্রিবিউশনের ধরন এবং কাজের অন্যান্য শর্তাদি প্রদর্শনী-৫(ক)-তে নির্দেশিত হয়েছে।
৪৭. উপযুক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার কর্তৃত্ব ছিল তিনজন ভদ্রলােক সমন্বিত টেন্ডার কমিটির উপর। এই তিনজন ব্যক্তি ছিলেন : ১. জনাব এফ. এইচ. চৌধুরী, ডেপুটি ডিরেক্টর অব কনজুমার গুডস, ফুয়েলস অ্যান্ড টেক্সটাইলস, ২. জনাব এস. হাশেম আলী, সাক্ষী ৩, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন সেক্রেটারি, এবং ৩. জনাব এম. মুয়িদ খান, সাক্ষী ৪, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা। প্রতীয়মান হয় যে, সকল আবেদনপত্রের মেরিট ও ডিমেরিট বিবেচনার পর দরপত্র কমিটি মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে এই উদ্দেশ্যে এজেন্ট হিসেবে। নিয়ােগ দেওয়া যথাযথ মনে করেন। ১৯৫৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখের রিপাের্টে, এক্সিবিট ৬, ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ক্রমান্বয়ে অন্য পক্ষগুলােকে কীভাবে এবং কোন কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে। রিপাের্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, টেন্ডার কমিটি কর্তৃক প্রত্যেক আইটেমের ন্যূনতম দর নির্ধারণ করা হয়, এবং প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাদ দেওয়ার পর তাদের সামনে বিবেচনার জন্য ছিল সাতটি পক্ষ, যার মধ্যে ছিল মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড ও এস. এম. হানিফ (ঢাকা) লিমিটেড। সংশ্লিষ্ট টেন্ডারের মেরিট ও ডিজায়েরিবিলিটি মূল্যায়ন করার জন্য আনুমানিক ১,০০০ হাজার টন পরিমাণের উপর নিমােক্ত উপায়ে ফিগার ঠিক করা হয় :
“The Tender Committee proceeded on the footing that 60 percent of the coal … Of the 60 percent that might come via Shirdi, 80 percent would be rebooked and 20 percent would be dumped at Ishurdi, that is to say, 480 tons might be rebooked straightway from Ishurdi and 120 tons might be dumped and again rebooked from there whenever necessary and 400 tons of soft coke would be expected to come to Dacca directly.”
৪৮. এই হিসেবে দেখা যায়, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড প্রস্তাবিত শর্তাদি গ্রহণের জন্য সবচেয়ে উপযােগী ছিল। সেই অনুযায়ী অন্যান্য পক্ষের টেন্ডার বাতিল করা হয় এবং মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে এজেন্সি দেওয়া হয়। তবে এই ব্যাপারে কোনাে ইঙ্গিত পাওয়া যায় না যে, এসব টেন্ডারের মেরিট বিবেচনার ক্ষেত্রে পূর্ব-অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা হয়েছিল কিনা। কিন্তু এক্সিবিট-৮ থেকে প্রতীয়মান হয় যে,
সান আহমেদ লিমিটেডের পূর্বের রেকর্ড বিভাগীয় তদন্ত করতে বলা হয়। দুই পক্ষই এক্সিবিট ৮-এর উপর মন্তব্য করেছে। আপিলকারীদের পক্ষে বলা হয়, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫ তারিখসম্বলিত এই এক্সিবিটে ইঙ্গিত করা হয় যে, বাস্তবিকপক্ষে জনাব ডেপুটি ডিরেক্টর অব কনজুমার গুডস, ফুয়েলস অ্যান্ড টেক্সটাইলস এফ. এইচ. চৌধুরী মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে এজেন্সি দেওয়ার ব্যাপারে তার মনস্থির করে ফেলেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ১৯৫৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখ কমবেশি ছিল ভুল। অবশ্য নথিপত্রে এরকম কিছু নেই যে, ১৯৫৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখটি ভুল কিনা কিংবা জনাব এফ. এইচ. চৌধুরী কর্তৃক সেই তারিখেই রিকুইজিশনটি সাইন করেছেন কিনা এসব ব্যাপারে কোনাে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আমরা মূল নথিপত্র দেখেছি এবং এটা পরিষ্কার যে, জনাব এফ. এইচ. চৌধুরী কর্তৃক ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ তারিখটিই খােদাই করা হয়েছে এবং এর আসলত্ব নিয়ে কোনাে
১৯৬

সন্দেহের অবকাশ নেই। এই বিষয়ে আলাে ফেলার জন্য জনাব এফ. এইচ. চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি কিংবা এক্সিবিট-৮ অনুযায়ী এই রিকুইজিশন যাকে দেওয়া হয়েছে তাকেও এ বিষয়ে তার প্রয়ােজনীয় মন্তব্যের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আপিলকারী শেখ মুজিবুর রহমানের বিজ্ঞ আইনজীবী যুক্তি দেন যে, এই এক্সিবিট-৮ই নির্দেশ করে যে, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর মেসার্স হাসান লিমিটেডকে এজেন্সি দেওয়ার ব্যাপারটি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। এটাও বলা হয় যে, চলনসই দর ও অন্যান্য ডাটা প্রস্তুত করার ধরন থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, প্রধান আইটেমের ব্যাপারে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের দর অনেক বেশি হলেও সেটাকে যৌক্তিক হিসেবে দেখানাে হয়েছে। তা করা হয়েছে এটা দেখিয়ে যে, সম্ভাব্য আমদানির উল্লেখযােগ্য পরিমাণ হবে ঢাকাসংক্রান্ত এবং ফলে, সার্বিকভাবে খরচ অনেক রিজনেবল এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় এটাকে সর্বনিম্ন দর হিসেবেও বিবেচনা করা যাবে। এই যুক্তির সারবত্তা যা-ই থাকুক না কেন, আপিলকারীর আইনজীবী এই যুক্তি দেননি যে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের এরকম কোনাে ধারণা ছিল যে, মেসার্স হাসান আহমেদকে এজেন্সি দেওয়ার কারণে প্রকৃতপক্ষে সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল। মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড যতদূর কাজ করেছেন তার মােট মূল্য ধরে গাণিতিকভাবে দেখানাে হয়েছে যে, যদি একই কাজ এস. এম. হানিফ (ঢাকা) লি. কিংবা মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে দেওয়া হতাে তাহলে সরকারের ৪০,০০০ রুপি সাশ্রয় হতে পারতাে। যদি তাই হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, এজেন্সি দেওয়া হয়েছে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে, যারা নিজেদের মতাে করে কাজটির দায়িত্ব নিয়েছিল। এক্সিবিট ৪, যেখানে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে কী কী শর্তাদি পালন করতে হবে তা বিধৃত আছে, থেকে দেখা যাবে, যথাসময়ে ডেপুটি ডিরেক্টর, কনজুমার গুডস, ফুয়েল অ্যান্ড টেক্সটাইলস দ্বারা তারা নিয়ােগকৃত হবেন। তবে ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে দেখা যায়, আমদানিকৃত ও সরবরাহকৃত সফট কোকের স্বল্পতা ও নিম্নমান নিয়ে অভিযােগ উঠতে শুরু করে যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গােচরে আসে। মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড কর্তৃক এ বিষয়ে ব্যাখা দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, নির্বিবাদ ও যথাযথ সরবরাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কিছু লােক সমস্যা সৃষ্টি করছে। ঈশ্বরদীতে দায়িত্বরত চিফ ইন্সপেক্টর অব কনজুমার ফুডস অ্যান্ড ফুয়েলস এই কোম্পানির সাপ্লাইয়ের নিম্নমান ও স্বল্পতা নিয়ে তীব অভিযােগ করেন। ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখসম্বলিত এক্সিবিট ১৭(২)(ক), যেটা ছিল এই প্রসঙ্গে চিফ ইন্সপেক্টর কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদন। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ স্পেশাল জজ পয়েন্ট আউট করেন যে, পরবর্তী পর্যায়ে যখন কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে এজেন্ট হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয় তখন তারাও একই সমস্যার মুখােমুখি হয়েছেন যা ১৯৫৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখসম্বলিত এক্সিবিট ১৭(ক)-এ প্রদত্ত তাদের ব্যাখ্যা থেকে বােঝা যায়। এ-প্রসঙ্গে বিজ্ঞ স্পেশাল জজের মন্তব্য হলাে, প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটা সহজাত গলদ রয়েছে। সরবরাহকৃত জিনিসের নিম্নমান বা স্বল্পতার কারণ যা-ই হােক না কেন আসল কথা হলাে, এই পক্ষ অর্থাৎ মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড সন্তোষজনকভাবে তাদের কাজ করতে পারেনি।
৪৯. সাক্ষী-২ নবাবজাদা হাসান আলী তার নিজ সাক্ষ্যে স্বীকার করেছেন যে, এর আগে তাদের কয়লা প্রকিউর ও হ্যান্ডলিং করার কোনাে ব্যবসা ছিল না এবং এই লাইনে তাদের কোনাে অভিজ্ঞতা ছিল না। দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে এটা ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার একটা শর্ত। সাক্ষী-৩ হাশেম আলী, যিনি টেন্ডার কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনি তার সাক্ষ্যে জানান, তারা অভিজ্ঞতার শর্ত এড়িয়ে গিয়েছেন। অন্যদিকে, সাক্ষী-৪ জনাব মুয়িদ খান একদম নিশ্চিত যে, অতীত অভিজ্ঞতা অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত ছিল। তিনি অবশ্য এটাও বলেন যে, অতীত অভিজ্ঞতা নবাগতের জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারে না। তাদের কোনাে পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল
১৯৭

না- এই মর্মে সাক্ষী-২ নবাবজাদা হাসান আলীর নিজের সাক্ষ্য সাপেক্ষে সাক্ষী-৩ ও ৪ প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথ পর্যালােচনায় এটি মনে হয়, সাক্ষী-২, ৩ ও ৪-সহ দরপত্র কমিটি পূর্ব-অভিজ্ঞতা প্রশ্নে তাদের বিবেচনা প্রয়ােগ করেননি। অভিজ্ঞতার অভাব কিংবা অন্য কোনাে কিছু সরবরাহের স্বল্পতা ও নিম্নমানের কারণ যা-ই হােক না কেন, এরকম সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে, সাক্ষী ২ যেমন স্বীকার করেছেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে ৮টি অভিযােগ এসেছে। সাক্ষী ৩ ও ৪-এর সাক্ষ্য থেকেও দেখা যায়, এজেন্ট নিয়ােগের ক্ষেত্রে তারা কমবেশি জনাব এফ. এইচ. চৌধুরী দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। ১১ নম্বর সাক্ষী জনাব ডব্লিউ. বি. কাদরী তখন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি বলেন, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের বিপক্ষে আনীত কোনাে অভিযােগ তার গােচরে আনা হয়নি। ২ নম্বর সাক্ষীর স্বীকারােক্তি দষ্টে মনে হয় এক্ষেত্রে জনাব কাদরীর সাক্ষ্য থেকে আমাদের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযােগ নেই যে, এই ফার্মের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল। ১৫ নম্বর সাক্ষী ছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ফজলুর রহমান। তার মতে, অভিযােগের কথা অনুমােদনের আবেদনের সময় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে বােঝা যায় যে, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড কাজটি প্রত্যাশা অনুযায়ী সফলভাবে সম্পন্ন করছিলেন কিনা তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই সাক্ষী তার বিবেচনা প্রয়ােগ করেননি কিংবা তার সামনে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ছিল না। আমাদের মতে, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে নিয়ােগ দেওয়ার অন্তর্নিহিত মেরিট যা-ই হােক না কেন, তাদের কাজের ধরন সন্তোষজনক ছিল না।
৫০. এই এজেন্সি বাতিল প্রসঙ্গে ২ নম্বর সাক্ষী নবাবজাদা হাসান আলীর সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, তাদের এজেন্সি বাতিল করা হয় আনুমানিক ১৯৫৭ সালের ১০ এপ্রিল। ৫ নম্বর সাক্ষী জনাব এ. খায়ের তখন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সহকারী সেক্রেটারি ছিলেন। তার মতে, এজেন্সি বাতিল করা কিংবা মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে এজেন্সি দেওয়ার কোনাে ইঙ্গিত ছিল না। হাসান আহমেদের এজেন্সি বাতিল এবং ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিলের একই আদেশে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে এজেন্সি দেওয়ার সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অব ট্রেড অ্যান্ড কমার্স ছিলেন ৭ নম্বর সাক্ষী জনাব মােনায়েম। তার সাক্ষ্য অনুযায়ী, জনাব খায়ের তখন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, as a via media that both parties, namely, Hasan Ahmed Limited and Coal Mining and Trading Company might be given work in the proportion of half and half. এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৫৭ সালের শুরুর দিকে প্রাদেশিক সরকার পর্যায়ে স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের কথা ডিপার্টমেন্ট পর্যায়ে তুলেছিলেন ৬ নম্বর সাক্ষী জনাব রুহুল কুদ্স, ১৯৫৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির নােটে। তিনি তখন ছিলেন ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ। এই প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের আইডিয়া দিয়েছে কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে, এক্সিবিট-ক (১৬) অনুযায়ী, পাকিস্তান সরকারের
ল কমিশনারের কাছে পাঠানাে এক প্রস্তাবে। তবে প্রাদেশিক পর্যায়ে শুরু হওয়া ফাইলটি আলাদা বলে মনে হয়। জনাব রুহুল কুদুস তার ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ তারিখের নােটে, এক্সিবিট-৯, সুপারিশ করেন যে, স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের আইডিয়াকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত ইঙ্গিতও দিয়েছেন। এই আইডিয়া বিভিন্ন কর্মকর্তার মনােযােগ আকর্ষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে উত্থাপন করা হয়। ১৯৫৭ সালের ১২ মার্চের এক নােটের মাধ্যমে জনাব কাদরী প্রস্তাব করেন যে, এই বিষয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত এবং এজেন্সি নির্বাচন ও তারপর প্রকল্প চূড়ান্ত করা উচিত। এই নােটের উপর দায়িত্বরত মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিমােক্ত নােট দেন :
১৯৮

“আমি মনে করি না অন্য যেসব শিল্পের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এই প্রস্তাব সেই একই ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে। ক্যাপিটাল মেশিনারি ও বৈদেশিক মুদ্রার কোনাে দরকার নেই। “আমার আইডিয়া হলাে সফট কোক আমদানি আচমকা বন্ধ করা নয় বরং প্রদেশের সম্পর্ণ ; পূরণ করার জন্য কারখানায় কঠিন কয়লাকে সফট কোকে রূপান্তরিত করা। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সফট কোক আমদানির দায়িত্বপ্রাপ্ত বর্তমান এজেন্সিকে বাতিল করা উচিত এবং আবেদনকারী মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি (পাকিস্তান) লিমিটেডকে এই সুনির্দিষ্ট শর্তে এজেন্ট হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া উচিত যে, তিনি অবশ্যই আমদানিকৃত কঠিন কয়লাকে সফট কোকে রূপান্তরিত করার যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করে এক বছরের মধ্যে সফট কোকের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করবেন। এতে ব্যর্থ হলে সরকার পুরাে বিষয়টি পর্যালােচনা করবে।”
“শিল্প ইউনিট চালু করার জন্য তাদের পাঁচশ টন কঠিন কয়লা আমদানির অনুমতি দেওয়া হােক। “দশ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হােক।
শেখ মুজিবুর রহমান
২১.৩.৫৭

এরপর জনাব কাদরী ১৯৫৭ সালের ২ এপ্রিল এক নােটে আরাে কিছু বিষয় বিস্তারিত উল্লেখ করেন এবং প্রস্তাব করেন যে, ২৫০০ টন মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড এবং ২৫০০ টন কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড আমদানি করতে পারে। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তারিখের মন্ত্রীর মাইনিউট ইঙ্গিত করে যে, হাসান আহমেদ লিমিটেডের নিয়ােগসংক্রান্ত ফাইল চেয়ে পাঠানাে হয়। ৭ এপ্রিল ১৯৫৭ তারিখের পরবর্তী মাইনিউটে শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের বিপক্ষে অভিযােগ পেয়েছেন এবং তাদের কাজের ধরন নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। আরাে উল্লেখ করা হয় যে, দরপত্র কমিটিসংক্রান্ত কাগজপত্র ফাইলে ছিল না। সংশ্লিষ্ট মাইনিউট নীচে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করা হলাে :
“সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখেছি।
“(১) আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান এজেন্ট সম্পর্কে বেশ কয়েকবার অভিযােগ পেয়েছি। আদি এজেন্সিকে বাদ দিয়ে ১৯৫৫ সালে যেভাবে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে এজেন্ট নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। সেখানে দরপত্র ও দরপত্র কমিটি সম্পর্কে উল্লেখ আছে। কিন্তু সে-সংক্রান্ত কাগজপত্র নথিতে নেই। সরকার সেই কথিত দরপত্র কমিটির সিদ্ধান্তের একটি কপির জন্য নথিতে অনুসন্ধান করেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সেসব কাগজপত্র সরকারের কাছে পাঠানাে হয়নি এবং সেগুলাে আজও নথিতে নেই।
“তাছাড়া, নিয়ােগপত্রে সরকার তার খুশিমতাে নিয়ােগ বাতিলের অধিকার সংরক্ষণ করেছিলাে এবং আমি চাই সেই অনুযায়ী এই নিয়ােগ বাতিল করা হােক।”
“(২) মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের ক্ষেত্রে থাকা একই শর্তাদিতে তাদের স্থলে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে এজেন্ট হিসেবে নিয়ােগের প্রস্তাব করা হয়। শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠান একটি কারখানা তৈরিতে বিনিয়ােগ করতে উদ্যোগ নিয়েছে যাতে আমরা
১৯৯

বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারব এবং শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আমরা তাদের এজেন্সি দেব। কারণ, কারখানায় উৎপাদন যত বৃদ্ধি পাবে, আমাদের আমদানির পরিমাণও ক্রমান্বয়ে তত কমতে থাকবে। আশা করা যায় যে, বছরখানেকের মধ্যে সফট কোক আমদানির প্রয়ােজনীয়তা থাকবে না। তাছাড়া, কঠিন কয়লা ও সফট কোকের মধ্যে অ্যাডজাস্টমেন্টের পরিমাণ অবিরত পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং একই পার্টি ব্যাপারটি ডিল করলে এটা সম্ভব হবে। “(৩) যদি আমাদের ২,০০০ টন বাড়তি পরিমাণ দেওয়া হয়, তাহলে তখন আমরা সেই পরিমাণের জন্য আরেকজন এজেন্ট নিয়ােগ দেওয়ার কথা বিবেচনা করবাে।
“(৪) যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কোল কমিশনারকে অবগত করতে হবে।”
৫১. প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ্য যে, এই নথিপত্র কিংবা অন্য কোনাে নথিপত্র বা সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এটা প্রতীয়মান হয় না যে, ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে আদি প্রতিষ্ঠানের এজেন্সি পর্যালােচনাধীন থাকার সময় কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে দরপত্রে দেওয়া তাদের নিজেদের শর্তে নিয়ােগ দেওয়ার
ব্যাপারে কোনাে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
৫২. বিজ্ঞ স্পেশাল জজ এই মত দিয়েছেন যে, উপরে উদ্ধৃত ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ১৯৫৭ সালের ৭ এপ্রিল তারিখের আদেশদ্বয়ের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বন্ধু আবু নাসেরের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ (অ্যাক্ট অব ফেবার) করেছেন। তিনি তার বন্ধুকে এজেন্সি দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের ব্যাপারটি বন্ধু আবু নাসেরকে আর্থিক সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে তৈরি করা নকশা বা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। এই প্রসঙ্গে সরাসরি যে প্রশ্ন উঠে তা হলাে, শেখ মুজিবুর রহমান সত্যি সত্যি তার কথিত বন্ধু আবু নাসেরকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কিনা।
৫৩. এ প্রসঙ্গে গােপালগঞ্জ মহকুমায় পিট খনি কার্যক্রম সংক্রান্ত ইজারা প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। এছাড়া, স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের ধারণা যখন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে মনােযােগ পাচ্ছিল, একই সময়ে গােপালগঞ্জ মহকুমায় পিট খনন কার্যক্রমের কথাও সরকারের মনােযােগ আকর্ষণ করছিলাে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের ১৯৫৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির মাইনিউট থেকে মনে হয়, মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড গােপালগঞ্জ মহকুমায় পিট খননের জন্য ১০ বর্গমাইল জায়গা ইজারা নেওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করে। সংশ্লিষ্ট মাইনিউট নিম্নরূপ :
“মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি (পাক.) লি., নারায়ণগঞ্জ গােপালগঞ্জ মহকুমায় পিট খননের জন্য ১০ বর্গমাইল জায়গা ইজারা নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে যােগাযােগ করে। আমি আপকালীনভাবে তাদের এই ইজারা দিতে আগ্রহী যাতে তারা সেই অঞ্চলে খনন কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ নিতে পারে। পার্টিকে তা যথাযথভাবে অবগত করতে হবে।
“প্রস্তাবিত মাইনিং বিল পাস এবং তার অধীনে বিধিমালা প্রণীত হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা হবে এবং সেই অনুযায়ী চুক্তিপত্র তৈরি হবে।
“গােপালগঞ্জের পিট এলাকা এখন থেকে ঘােষিত মাইনিং এরিয়া এবং এই এলাকায় খনন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।”
২০০

Next