নেতাকে যেমন দেখিয়াছি
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এর লেখা
জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে এত বেশি বিরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল যে, তাহার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গেলে কয়েক খণ্ড পুস্তক রচনার প্রয়ােজন। সুদীর্ঘ প্রায় এক চতুর্থ শতাব্দীকাল তাহার সংস্পর্শে থাকার ফলে আমার মনের কোণে তাহার যে ছবিটি অঙ্কিত হইয়াছে, প্রকৃতপক্ষে তাহা কোন সাধারণ মানুষের নহে, একজন প্রায় অতিমানবের। তাহার মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের মহৎ গুণের যে সমাবেশ ঘটিয়াছিল, তাহাই তাহাকে একজন বিরাট ব্যক্তিত্বশালী মানুষে পরিণত করিয়াছিল। জনাব সােহরাওয়ার্দীর অন্যতম বিশিষ্ট চারিত্রিক গুণ ছিল এই যে, তিনি কোন ব্যাপারেই ধানাই-পানাই বা লুকোচুরিতে বিশ্বাস করিতেন না। প্রত্যেকটি জাতীয় সমস্যাকেই তিনি সরল সােজা দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করিতেন। ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইলেও তিনি উচ্চনৈতিক আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতেন না, বরং যে-কোন অবস্থাতেই তিনি নিজ নীতিতেই অবিচল থাকিতেন। জনাব সােহরাওয়ার্দীর জীবনে এরূপ ঘটনার অভাব নাই। নিম্নবর্ণিত ঘটনা হইতেই পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যাইবে যে, ব্যক্তিগত লাভ-লােকসানের চাইতে নীতি তাঁহার নিকট কত বড় ছিল।
১৯৪৭ সালের জুন মাস। সিলেট গণভােটের ঠিক অব্যবহিত পরের ঘটনা। নবগঠিত পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন করার জন্য মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা কাহাকে নির্বাচন করা হইবে, উহা লইয়া তােড়জোড় চলিতেছে। ওই সময় জনাব সােহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী। সিলেটের ১৭ জন পরিষদ সদস্য মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিতে যােগ দিলেন। তাহারা জনাব সােহরাওয়ার্দীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে জানাইলেন যে, তাঁহাদেরকে তিনটি মন্ত্রিত্ব ও তিনটি পার্লামেন্টারি সেক্রেটারির পদ দান করা হইলে নেতা নির্বাচনে তাঁহারা তাহাকেই সমর্থন করিবেন। বরাবরের ন্যায় এক্ষেত্রেও জনাব সােহরাওয়ার্দী তাহার নীতিতে অবিচল রহিলেন এবং সিলেটি সদস্যদের জানাইয়া দিলেন যে, পূর্বাহ্নে তিনি কাহাকেও অনুরূপ কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারিবেন না। বিফল মনােরথ হইয়া তাহারা নেতৃত্বের অপর প্রার্থী খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট গমন করিয়া উক্ত প্রতিশ্রুতি দাবি করিলেন। খাজা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উহাতে রাজি হইয়া গেলেন এবং নিজের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পথ নিশ্চিত করিলেন। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচনে খাজা সাহেব বিজয়ী হইয়া পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার (বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম মুখ্যমন্ত্রী পদে সমাসীন হইলেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী দেশ বিভাগের পর ভারতে ফেলিয়া আসা অসহায় মুসলমানদের জন্য যাহা করিয়াছেন, তাহা একদিকে যেমন তাহার উচ্চমানের কর্তব্যবােধের পরিচায়ক, অন্যদিকে তেমনি অপরিসীম ত্যাগের প্রমাণ। অসহায় মুসলমানদের রক্ষা করার মহান উদ্দেশ্য সাধন করিতে যাইয়া তাহাকে কায়েদে আজমের একটি নয়, দুইটি নয়, পাঁচ-পাঁচটি উচ্চপদ গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিতে হয়। কায়েদে আজম তাঁহাকে ১, ভারতে পাকিস্তানি হাইকমিশনার, ২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব, ৩.পাঞ্জাবের গভর্নর পদ, ৪. জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির পদ এবং সর্বশেষ ৫. বিদেশে কায়েদে আজমের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূতের পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়াছিলেন। কিন্তু ভারতের অসহায় মুসলমানদের রক্ষার চাইতে তিনি কোন উচ্চ-পদকেই বড় মনে করেন নাই। তাই, কোন পদ গ্রহণে অসম্মতি জানাইয়া তিনি ভারতে থাকিয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গডিয়া তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করিলেন এবং একে একে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার লীলাভূমি কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থান, পূর্ব পাঞ্জাব, আলওয়ার, ভরতপুর, দিল্লি ও যুক্ত প্রদেশ সফর করিলেন। এই সকল স্থানের কোন কোনটায় তিনি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে গিয়েছিলেন, আবার কোন কোন স্থানে একাকীই গিয়াছিলেন। তবে সব জায়গাতেই তাহার জীবন বিপন্ন ছিল। শুধু ভারতে নহে, তিনি পূর্ব বাংলাও সফর করিলেন এবং বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতি করিয়া মানুষের নিকট পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের স্বার্থেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করিলেন। এই শান্তি মিশনে জনগণের অভ্যার্থনা, অভিনন্দন ও সাড়ার মাধ্যমে তাহার অচিন্তনীয় জনপ্রিয়তার যে চিত্র ফুটিয়া উঠিল, তদ্দষ্টে ক্ষমতাসীনদের বুক কাপিয়া উঠিল। তাই, তাহারা তাড়াতাড়ি স্টিমারযােগে টাঙ্গাইল রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে বাদামতলী ঘাটে তাহার উপর বহিষ্কার আদেশ জারি করিলেন। এ সময় পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। জনাব সােহরাওয়ার্দীকে কলকাতা ফিরিয়া যাইতে হইল এবং সেখানে গিয়া তিনি পুনরায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়ােগ করিলেন। গান্ধীজীর সহায়তায় তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কলকাতাসহ পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন অংশ, আসাম ও ভারতের পাকিস্তান সন্নিহিত বিভিন্ন প্রদেশ হইতে মুসলমানদের পাকিস্তান পাড়ি রােধ করিতে সক্ষম হইলেন। এইভাবে তিনি এই নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে কোটি কোটি মােহাজেরের চাপজনিত গুরুতর বিপর্যয় হইতে রক্ষা করিলেন। অন্যথায় এই নবীন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি এবং অসংগঠিত ও টলটলায়মান অর্থনীতি এবং প্রশাসন ব্যবস্থা সেই সময়েই চুরমার হইয়া যাইত। সুতরাং, জনাব সােহরাওয়ার্দীর দূরদৃষ্টি এমন এক সময় পাকিস্তানকে রক্ষা করিল, যখন কেন্দ্র ও এখনকার সরকার তাহাকে একজন অবাঞ্চিত ব্যক্তি হিসাবে প্রচার করিতে ব্যস্ত। একজন দুঃসাহসিক মানুষ জনাব সােহরাওয়ার্দীর সাহসের কথা সর্বজনবিদিত। শত বিপদ-আপদেও তিনি অটল ছিলেন, অথচ ইহার যে-কোনটিতে তাহার জীবন খতম হইতে পারিত। কিন্তু কোন পরােয়া নাই! তাহার খােদা ভীরুতাই ইহার একমাত্র কারণ। শুক্র-অধ্যুষিত এলাকায় রওয়ানা হইলে আমরা যখন বাধা দিতাম, তখন তিনি বলিতেন, “খােদা তায়ালা যে সময় নির্ধারণ করিয়াছে তৎপূর্বে। কেহই আমাকে হত্যা করিতে পারিবে না।” এই প্রসঙ্গে আমি তাহার জীবন-প্রদীপ নির্বাপণ প্রচেষ্টার কতিপয় ঘটনার উল্লেখ করিতেছি। ১৯২৬ সালে কলকাতার সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সময় কিভাবে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছিলেন, জনাব সােহরাওয়ার্দীর নিজ মুখেই আমি তাহা শুনিয়াছি। একবার তিনি শুদ্ধি-আন্দোলনের নেতা স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। কিভাবে রক্তক্ষয় বন্ধ করা যায়, এ-সম্পর্কে তাহাৱা দুইজন রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া আলাপ-আলােচনা করিতে ছিলেন। ঠিক এই সময় একব্যক্তি পিছন হইতে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে ছুরিকাঘাত করিতে উদ্যত হয়। জনাব সােহরাওয়ার্দী ইহা লক্ষ্য করেন নাই। আততায়ী তাহাকে ছুরিকাঘাত করিবে-ঠিক সেই মুহর্তে স্বামীজী উহা দেখিতে পাইয়া জড়াইয়া ধরিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীকে একপাশে ঠেলিয়া দেন, আততায়ীর লক্ষ্যচ্যুতি ঘটিল। স্বামীজ জনাব সােহরাওয়ার্দীকে মুহর্ত বিলম্ব না করিয়া ওই স্থান ত্যাগ করিতে বলিলেন এবং জনাব সােহরাওয়ার্দীও একাকী গাড়ি চালাইয়া চলিয়া গেলেন।
আরেকটি ঘটনা। ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার সময় গাড়িতে চড়িয়া একাকী জনাব সােহরাওয়ার্দী এক স্থান হইতে অন্য স্থানে গিয়া অসহায় লােকদের সাহায্য ও সাম্প্রদায়িক শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ এক সময় তাহার গাড়িতে একটি বােমা নিক্ষিপ্ত হইল এবং উহার বিস্ফোরণও ঘটিল। সামান্য আহত হইলেও তাহাতে জনাব সােহরাওয়ার্দীর বিশেষ কোন ক্ষতি হইল না। তিনি লাফ দিয়া গাড়ির বাহিরে আসিয়া প্রাণে বাঁচিলেন। দেশ বিভাগের পর কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােজিত থাকার সময় জনাব সােহরাওয়ার্দী গান্ধীজীর সঙ্গে বেলিয়াঘাটার একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে অবস্থান করিতেন। তখনও কলকাতার মুসলিম-নিধনযজ্ঞ পুরাদমে চলিতেছিল। একদিন প্রায় বিশ সহস্র লােকের একটি জনতা তাঁহাকে হত্যা করিতে আসিল। কিন্তু ভয় পাওয়ার পাত্র তিনি নন। তাই, তিনিও বুক ফুলাইয়া তাহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং তাহাদিগকে সম্বােধন করিয়া বলিলেন, “তােমরা যদি আমাকে হত্যা করিতে চাও, তবে এখনই কর। কিন্তু তৎপূর্বে আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে হইবে যে, আমার পরে তােমরা আর কোনও মুসলমানকে হত্যা করিবে না।” সােরগােল শুনিয়া গান্ধীজীও বাহির হইয়া আসিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীর পাশে দাড়াইলেন এবং উন্মত্ত জনতাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “তােমরা যদি শহীদকে খুন করিতে চাও, তাহা হইলে প্রথমে আমাকে খুন কর।” একথা জনতার উপর যাদুমন্ত্রের ন্যায় কাজ করিল এবং তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া চলিয়া গেল । তাঁহার জীবনের উপর আঘাত হানার আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে দিল্লিতে। তখন জনাব সােহরাওয়ার্দী গান্ধীজীর সহিত নয়াদিল্লিতে বিড়লা ভবনে অবস্থান করিতেছিলেন। তাঁহাকে হত্যা করার কাজে নিয়ােজিত জনৈক ব্যক্তি গৃহের ভেন্টিলেটরের মধ্য দিয়ে তাঁহার প্রতি পিস্তলের লক্ষ্য স্থির করে; কিন্তু বিছানায় জনাব সােহরাওয়ার্দীর স্থলে একজন কানা লােককে শায়িত দেখিয়া একটু পরে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসে। প্রকৃত ব্যাপার হইল এই যে, কোন ব্যাপারে চিন্তামগ্ন থাকার সময় জনাব সােহরাওয়ার্দী সর্বদা একচোখ বন্ধ করিয়া রাখিতেন। পরে লােকটি তাহার অপরাপর সহযােগীর গালমন্দ শােনে। সৌভাগ্যবশত জনাব সােহরাওয়ার্দী পরের দিনই কলকাতার উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন। এই সমগ্র ঘটনাটি বিবৃত করিয়াছিল গান্ধী হত্যা মামলার বিচারকারী আদালতে একজন রাজসাক্ষী (Approver) তাহার সাক্ষে। সে আরও প্রকাশ করিয়াছিল যে, তাহাদের লক্ষ্য ছিল তিনজনকে হত্যা করাগান্ধীজী, জনাব সােহরাওয়ার্দী ও মি, জওয়াহেরলাল নেহরু। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর ভারত সরকার জনাব সােহরাওয়ার্দীর উপর বিপুল পরিমাণ আয়কর ধার্য করিলেন এবং তাহার কিছুদিন পর তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিলেন। সেই সময়ভারতের সাম্প্রদায়িক দিগন্তের শান্তি বিরাজ করিতেছিল। তাই, জনাব সােহরাওয়ার্দী বসবাসের উদ্দেশ্যে করাচি চলিয়া আসিলেন এবং তাহার শ্বশুর মরহুম স্যার আবদুর রহিমের ১৩, করাচি রােডস্থ বাড়িতে বসবাস করিতে শুরু করেন। ইহা ছিল একতলা একখানা দালান। সেখানেও একদিন রাত্রে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে হত্যা করার জন্য জনৈক ব্যক্তি উক্ত তরবারী হস্তে তাহার শয্যা কক্ষে প্রবেশ করে। সৌভাগ্যবশত জনাব সােহরাওয়ার্দী তখনও ঘুমাইয়া পড়েন নাই। লােকটি তাঁহাকে ছুরিকাঘাত করিতে যাইবে, ঠিক এই সময় জনাব সােহরাওয়ার্দী বিছানা হইতে লাফাই উঠিয়া লােকটির উপর ঝাপাইয়া পড়েন এবং তাহার হাতের কজা ধরিয়া ফেলেন। জনাব সােহরাওয়ার্দীর চীৎকারে গৃহে চাকর-বাকর আসিয়া লােকটিকে পাকড়াও করিয়া আটক করে। তখন লােকটি কাঁদিয়া কাঁদিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিতে থাকে। তাঁহার কান্নায় দয়ার সাগর সােহরাওয়ার্দীর মন গলিয়া গেল। তিনি লােকটিকে বিচারের জন্য পুলিশের হাতে সােপর্দ করার পরিবর্তে সেই গভীর রাত্রেই মুক্ত করিয়া দিলেন। তাহার জীবনের উপর সর্বশেষ হামলা হয় ১৯৬২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের সময় গুজরানওয়ালা রেল স্টেশনে। আমি নিজে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। জনাব সােহরাওয়ার্দীকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য প্লাটফরমে প্রায় ৫ শত লােকের সমাগম হইয়াছিল। জনাব সােহরাওয়ার্দী গাড়ির কামরা হইতে বাহিরে আসা মাত্র রিভলবারের একটি গুলি। তাহারই পার্শ্বে দণ্ডায়মান চেরাগ আলী নামক একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে বিদ্ধ করে। বিভলবারের এই গুলির লক্ষ্যস্থল যে জনাব সােহরাওয়ার্দী ছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু কিভাবে ঘটনাটি চাপা দেওয়া হইয়াছে, তাহা অনেকের নিকটই অজ্ঞাত নহে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই অলৌকিক উপায়ে আল্লাহতায়ালা তাহাকে রক্ষা করিয়াছিলেন। সাধারণ মানব নহে আমি কোনদিনও তাহাকে কাহারও উপর এমনকি তাহার রাজনৈতিক শত্রুর উপরও ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা রাজনৈতিক কারণে প্রতিশােধ নিতে দেখি নাই।
সুদূর বৈরুতে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করিয়াছেন কিনা, তাহা একমাত্র আল্লাহতায়ালাই জানেন। তবে, তিনি আর আমাদের মধ্যে নাই; কিন্তু একজন সাধারণ কর্মী, অনুসারী ও ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে দীর্ঘ তেইশ বৎসরকাল আমি তাহার মধ্যে যে মানুষটির পরিচয় পাইয়াছি, সে সাধারণ মানব নহেঅতিমানব। দানশীল সােহরাওয়ার্দী একজন দীপ্তিমান আইনজীবী হিসাবে জনাব সােহরাওয়ার্দী লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করিতেন; কিন্তু আবার ব্যয়ও করিতেন দরাজ হস্তে। তাঁহার নিকট হইতে সাহায্য চাইতে আসিয়া কোনদিনও কেহ খালি হাতে ফিরিয়া যাইত না। তবে, তাহার দানের বিরল-বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি কোন সময় অন্য কাহারও নিকট নিজের দানের কথা অথবা দান প্রাপ্তদের কথা প্রকাশ করিতেন না। আমি জানি, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু ছাত্র তাঁহার অর্থে লেখাপড়া শিখিত। এ প্রসঙ্গে আমি আমার নেতার দানশীলতার একটি নজির উল্লেখ করিতেছি। আমাদের দলের অনেকেই জানেন যে, জনাব সােহওয়ার্দী যখনই ঢাকা আসিতেন, তখনই চল্লিশাের্ধ বয়সের জনৈক ব্যক্তি ঢাকা আসিয়া উপনীত হইত এবং জনাব সােহরাওয়ার্দীর অবস্থান কালে সব সময় সে তাহার ব্যক্তিগত পরিচারক হিসাবে কাজ করিত। একদিন আমি ও জনাব সােহরাওয়ার্দী বাহিরে গেলাম। রুমে রাখিয়া গেলাম কেবলমাত্র সেই লােকটিকে। সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসিয়া দেখা গেল, জনাব সােহরাওয়ার্দীর তহবিলে ৩,০০০ টাকা নাই। সেই লােকটিই যে এ কাজ করিয়াছে, তাহা বুঝিতে আমাদের মােটেই কষ্ট হইল না। জনাব সােহরাওয়ার্দীও তাহাতে নিঃসন্দেহে ছিলেন। আমি থানায় টেলিফোন করিয়া লােকটিকে পুলিশের হাতে সােপর্দ করিলাম । আমি চলিয়া যাওয়ার পর রাত্রে জনাব সােহরাওয়ার্দী থানায় টেলিফোন করিয়া জানাইলেন যে, তাঁহার কোনরূপ অভিযােগ নাই। সুতরাং, পুলিশ লােকটিকে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইল। পরের দিন সকালে দেখা গেল লােকটি পূর্ববৎ জনাব সােহরাওয়ার্দীর সেবায় নিয়ােজিত। আমি ও মানিক ভাই (ইত্তেফাক সম্পাদক) লােকটিকে চলিয়া যাইতে এবং কোনদিনও আর সেখানে না আসিতে বলিলাম। তারপর হইতে লােকটি প্রত্যেকদিনই আমাদের অনুপস্থিতির সময়ে জনাব সােহরাওয়ার্দীর নিকট আসিত এবং প্রতিদিন জনাব সােহরাওয়ার্দী তাহাকে কিছু না কিছু টাকা দিতেন। একদিন আমরা লােকটিকে জনাব সােহরাওয়ার্দীর নিকট দেখিয়া ফেলিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সােহরাওয়ার্দী আমাদের শুনাইয়া তাহাকে আর না আসিতে বলিলেন। আমাদের খুশি করা ও নাজুক অবস্থা হইতে রেহাই পাওয়ার জন্যেই যে জনাব সােহরাওয়ার্দী লােকটিকে আর আসিতে নিষেধ করিলেন, তাহা বুঝিতে আমাদের বাকি রহিল না। ইহার পর একদিন ওই লােকটির হাতেই জনাব সােহাওয়ার্দীকে ৮০০ টাকা দিতে দেখিয়া আমি রীতিমত স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম। আমার কিছু বলার আগেই জনাব সােহরাওয়ৰ্দী বলিতে শুরু করিলেন যে, গরিব লােকটির একটি নিজস্ব গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে তিনি তাহাকে এই শেষ দান করিলেন। ইহা জনাব সােহরাওয়র্দীর জীবনের অনুরূপ শত শত ঘটনার মধ্যে একটি মাত্র।
দেশ বিভাগের পূর্বে আমি ঘটনাক্রমে একদিন নেতার ৪০, থিয়েটার রােডস্থ বাসভবনে একটি ‘কালােখাতা’ দেখিয়া ফেলিলাম। ওই খাতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কতকগুলি পেনসনভােগী লােকের একটি তালিকা ছিল। তাহাদের তিনি মাসিক সর্বমােট ৩,০০০ টাকা পেনসন দিতেন। তালিকাভুক্ত এই লােকদের মধ্যে ছিল জাতিধর্ম নির্বিশেষে পুরাতন চাকর-বাকর, নাপিত, শ্রমিক, কর্মী, কিছু সংখ্যক প্রবীণ লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী। এই খাতাটি তিনি কোনদিনও কাহাকে দেখাইতেন না। আমার প্রতি তাঁহার অগাধ বিশ্বাস ছিল বলিয়াই এই খাতাটি দেখার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। অসংখ্যবার মফস্বল সফরের সময়ও আমি তাহাকে অনেক মানুষকে সাহায্য করিতে দেখিয়াছি। একথা বলার প্রয়ােজন রাখে না যে, দেশ বিভাগের পূর্বে ও পরে নিজ দলের অধিকাংশ ব্যয়ই তিনি নিজে একাই বহন করিতেন। গুজরানওয়ালার জনসভা ব্যতীত জীবনের আর কোন সময় কেহ তাহাকে শত শত্রুতার মুখেও কোন কাজ হইতে বিরত করিতে পারে নাই। তিনি কোন বিপদকেই গ্রাহ্য করিতেন না। শত্রুদল যত সুসংগঠিতই হউক না কেন, জনাব সােহরাওয়ার্দী কোনদিনও তাহার নির্ধারিত জনসভায় বক্তৃতাদান হইতে পিছপাও হইতেন না। বরং, অসীম সাহসের সহিত তিনি পরিস্থিতির মােকাবিলা করিতেন এবং তাহার মােহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে যাদুমন্ত্রের ন্যায় শত্রুদেরকেও বশিভূত করিয়া ফেলিতেন। কুচক্রীদের শিকার কেন হইলেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী তাঁহার সারা জীবনে কোনদিন রাজনৈতিক বা জনসাধারণকে ধাপ্পা দিয়াছেন তাহার বিরুদ্ধে এমন অপবাদ তাহার শত্রুরাও দিতে পারিবেন না। সম্ভবত এই কারণেই তিনি পাকিস্তানে রাজনৈতিক কুচক্রের শিকারে পরিণত হইয়াছেন। তিনি কোন দিনও গুজগুজ রাজনীতি, গােপন কারসাজি, ধাপ্পাবাজি ও চক্রান্তে বিশ্বাস করিতেন না। তিনি কেবল আইনের অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করিতেন। তিনি খােলাখুলি রাজনীতিতে বিশ্বাস করিতেন। তিনি কোনদিনও কাহাকে মিথ্যা আশা দেন নাই। বরং, কাহাকেও সাহায্য করার প্রয়ােজন বােধ করিলে তিনি নির্ধারিত গণ্ডি অতিক্রম করিতেও কুষ্ঠিত হইতেন না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের খোজ-খবর ও কাজ-কর্মের তত্ত্বতালাশ করিতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবেই কর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতেন এবং তাহাদের পরিবারের খরচ প্রদান করিতেন। আমি কলকাতা ও ঢাকা- এই উভয় স্থানেই তাঁহাকে কিছু সংখ্যক যক্ষ্মা আক্রান্ত রাজনৈতিক কর্মীর চিকিৎসা ও তাহাদের পরিবারের খরচা প্রদান করিতে দেখিয়াছি। অদ্বিতীয় পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে সম্ভবত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাজপ্রাসাদ হইতে গরিবের কুটির পর্যন্ত সর্বত্র নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া নিতে পারিতেন। প্রয়ােজনবােধে তিনি মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটিতে ও দিনের পর দিন ছােট নৌকায় চলিতে পারিতেন। অনেক সময় মফস্বল সফরের সময় তাহাকে রাতদিন কিছু না খাইয়াই কাটাইতে দেখা গিয়াছে। তিনি কোন দিনও ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশকে রাজনৈতিক, সামাজিক বা রিলিফ কাজের চাইতে বেশি গুরুত্ব দিতেন না। কাজই ছিল জীবনে তাহার নিকট সবচেয়ে বড় জিনিস।
এখানে আমি একটিমাত্র নজির উল্লেখ করিতে চাই। ১৯৪৫ সাল। আমাদিগকে সিন্দিয়াঘাট হইতে দেশি নৌকায় গােপালগঞ্জে যাইতে হইবে- দূরত্ব প্রায় ২০ মাইল। সঙ্গে আমাদের কোনও খাবার দ্রব্য নাই। রাত্রেই আমাদের গােপালগঞ্জ পেীছার কথা। কারণ, সকালে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনােনয়নের উদ্দেশ্যে জনমত যাচাই করিতে হইবে। আমাদের যাত্রা শুরু হইয়াছে পূর্ব নির্ধারিত তারিখের ১ দিন পরে। দলে আমরা প্রায় ১৫ জন কর্মী। তাড়াতাড়ি গন্তব্যস্থলে পৌছার জন্য মাঝিদের কেহ কেহ নৌকার গুণ টানিতে ছিল আর বাকি মাঝিদের লইয়া আমরা দাঁড় টানিতেছিলাম। সাতপাড় বাজারে (একটি ক্ষুদ্র গ্রাম্য বাজার) পৌছার পর জনাব সােহরাওয়ার্দী আমাদিগকে অল্পক্ষণের জন্য নৌকা থামাইতে বলিয়া নিজে নিচে নামিয়া গেলেন এবং নিজ হাতেই কিছু চিড়া ও খেজুরের গুড় কিনিয়া আনিলেন। অথচ আমরা কেহ তাহাকে খাবার জিনিস কিনার কোন কথা বলি নাই। তারপর তিনি মাঝি ও আমাদের মধ্যে ওই চিড়া বিতরণ করিয়া দিলেন এবং নিজেও অত্যন্ত তৃপ্তি সহিত উহা খাইলেন। ওইদিন সারারাত্র তিনি ও আমরা আর কোন খাবারের মুখ দেখি নাই। অনুরূপ শত শত ঘটনার কথা আমার জানা আছে।
কাজের মানুষ সােহরাওয়ার্দী। কাজই ছিল জনাব সােহরাওয়ার্দীর মূলমন্ত্র। কঠোর পরিশ্রম করাই ছিল তাহার অভ্যাস। সাধারণত তিনি দৈনিক ১৮ হইতে ২০ ঘন্টা খাটিতেন। জরুরি অবস্থার সময়ে সামান্য টিফিন খাইয়া তাহাকে দিবারাত্র বিনা নিদ্রাতেই কাজ করিতে দেখা যাইত। এই সময় দিনের পর দিন তিনি দাড়ি কাটারও সময় পাইতেন না। যুক্ত বাংলার সরবরাহমন্ত্রী এবং যুক্ত বাংলার ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আমি তাহাকে অনুরূপভাবেই খাটিতে দেখিয়াছি। সবচেয়ে বেশি জটিল প্রশাসনিক সমস্যাও তাহাকে বিচলিত করিতে পরিত না এবং তিনি মুহর্তের মধ্যেই ওই সকল সমস্যার সঠিক সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি ফাইল পুখানুপুঙ্খরূপে দেখিতেন, কোনদিনও অন্ধের ন্যায় অফিসারদের নােটিং-এর উপর ‘ডিটো’ মারিতেন না। তিনিই বাংলার প্রথম শ্রমমন্ত্রী যিনি শ্রমিকদের সর্বমুখী স্বার্থ সংরক্ষণে উপযােগী উন্নতমানের শ্রম আইন প্রবর্তন করেন। তাঁহার এই সকল আইন পরবর্তীকালে সমগ্র ভারতে প্রচলিত হয়। ১৯৪২-৪৩ সালের সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর পরই জনাব সােরাওয়ার্দী বাংলার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় টাকা দিয়াও খাদ্য পাওয়া যাইত না। বাংলার চাউলের বেশি অংশ আসিত বার্মা হইতে। সেই বার্মা জাপানি দখলে চলিয়া যাওয়ার ফলে পরিস্থিতি অধিকতর জটিল হইয়া পড়ে। একদিকে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ নীতির প্রত্যক্ষ ফল আন্তঃজেলা কর্ডন প্রথা অপরদিকে স্যার আজিজুল হকের স্থলে সদ্য নিযুক্ত ভারতীয় খাদ্যমন্ত্রী শ্রী নিবাসের অসহযােগিতামূলক মনােভাব সােহরাওয়ার্দীর খাদ্য সংগ্রহের পথে আরও প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইল। সামরিক লােকজনের জন্য ইতােমধ্যেই বিপুল পরিমাণ খাদ্য গুদামজাত করা হইয়াছিল। জাহাজের অভাব ও বােমা ভীতির ফলে খাদ্য সংগ্রহ দুরূহ হইয়া উঠিল। সামরিক কর্তৃপক্ষের ‘ডিনায়েল পলিসি’ অনুসারে সমগ্র প্রদেশের, বিশেষভাবে সীমান্ত অঞ্চলের সমস্ত দেশি নৌকা ও অন্যান্য যানবাহন হয় নষ্ট করা হইয়াছে, নতুবা সৈন্য বাহিনীর জন্য রিকুইজিশন করা হইয়াছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমার নেতা পরিস্থিতির নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন না; করার মতাে লােকও তিনি ছিলেন না। তিনি কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া তাহাদিগকে সরকারি গুদাম ও অন্যান্য প্রদেশ হইতে বেসরকারি জনগণের জন্য খাদ্য দিতে বাধ্য করিলেন। আর নিজে শাসনতন্ত্রকে সংগঠন করিলেন, দেশব্যাপী রেশনশপ খুলিলেন, সর্বত্র খিচুড়িখানা চালু করিলেন ও অতিরিক্ত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করিলেন। এইভাবে তিনি সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষের মােকাবিলা করিয়াছিলেন। তাঁহার চরম সমালােচকও স্বীকার করিবেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর সুযােগ্য ও সুনিপুণ পরিচালনা না হইলে বাংলার সেই দুর্ভিক্ষে অনেক বেশি লােক প্রাণ হারাইত। নিয়মিতভাবে কলকাতা ক্লাবে যাওয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীর একটি ‘হবি’ ছিল। কিন্তু কাজের চাপে দুর্ভিক্ষের সময় দীর্ঘ ১৬ মাসকালের মধ্যে তিনি একদিনও কলকাতা ক্লাবে যান নাই। আমি কোনদিন তাহাকে রাত্রি ১১টার পূর্বে অফিস হইতে বাসায় ফিরিতে দেখি নাই। কোন সময়ে আমরা তাঁহার সহিত দেখা করিতে চাহিলেই তিনি বলিতেন, “রাত্রিতে এসাে, তার আগে আমার সময় হবে না।”
১৯৪৬ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন আমি তাঁহাকে বিখ্যাত নাটোর ও বালুরঘাট উপনির্বাচনে কাজ করিতে দেখিয়াছি। তাহার সংগ্রাম-নিপুণতাই ওই সকল নির্বাচনে জয়লাভের কারণ। আমি তাহাকে পাকিস্তান ইস্যুতে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনেও কাজ করিতে দেখিয়াছি। এমন কোন স্থান বা জায়গা ছিল না যেখানে তিনি যান নাই। তিনি প্রদেশব্যাপী জনমত সংগঠন করেন এবং নির্বাচনী অভিযান এমনভাবে পরিচালিত করেন যাহাতে সর্বাধিক দক্ষতা হইতে সর্বাধিক ফল পাওয়া যায় । সমগ্র ভারতের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলিম লীগ’ শতকরা ৯৭টি আসল লাভ করিয়াছিল। তাহার ঝটিকা সফর, কর্মী ও ছাত্রদের সহিত তাহার ব্যক্তিগত সংযােগ ও উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ােগের ফলেই এই অভাবিতপূর্ব বিজয় সম্ভব হইয়াছিল। ১৯৫৪ সনে পূর্ববাংলার সাধারণ নির্বাচনকালে তিনি কিভাবে কাজ করিয়াছিলেন তাহা আমাদের অনেকেরই জানা আছে। ওই সময়ে তিনি যুক্তফ্রন্টের ‘সিমসন রােডস্থ অফিসে অবস্থান করিতেন। সেখানে তিনি একজন সাধারণ লােকের মতাে খাটিয়ার উপর রাত্রি যাপন করিতেন। সময় সময় হেটেল হইতে তাহার খাবার আসিত। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আমি প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি’ জনাব এ এ শাহকে রাত্রি ১১টার সময় ফাইল পত্র লইয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীর কক্ষে প্রবেশ করিয়া রাত্রি তিনটার সময় বাহির হইতে দেখিয়াছি। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলিকে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দেওয়া হইলেও জনাব সােহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বের সম্মুখে কিছুই দাড়াইতে পারিত না। একবার কোন এক বিভাগীয় সেক্রেটারি’ জনৈক সিনিয়র আই.সি.এস. অফিসার কি নােট’সহ একটি ফাইল লইয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীর কাছে আসিলেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী উক্ত নােটগুলি, বিশেষভাবে নােটে’র ভাষা অনুমােদন করিলেন না এবং অনুরূপ নােট’ লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসারকে তিরস্কার করিলেন। তিনি বিষয়টি গভর্নরের গােচরে আনিলেন এবং গভর্নর একদিন আলাপ প্রসঙ্গে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে বলিলেন যে, অফিসারটি শুধু সিনিয়র আই,সি,এস, অফিসারই নহেন, অক্সফোর্ডের একজন এম.এ.ও। উত্তরে জনাব সােহরাওয়ার্দী বলিলেন, “আমিও অক্সফোর্ডের একজন এম. এ. এবং প্রত্যেক ইংরেজ ভালাে ইংরেজি জানেনা।” ইহার পর গভর্নর বলার কিছু পাইলেন না।
কলকাতার দাঙ্গা
প্রত্যক্ষ কর্ম-পন্থার পর কলকাতা রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লীলাক্ষেত্রে পরিণত হইল। মুসলমানরা শহরের মােট জনসংখ্যার শতকরা ২৩ ভাগ মাত্র এবং তাহাদের অধিকাংশ ছিল বস্তিবাসী। পরিস্থিতির মােকাবিলার পক্ষে কলকাতা পুলিশের শক্তি যথেষ্ট ছিল না। তৎকালীন যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব সােহরাওয়ার্দী জনৈক ইউরােপীয় অফিসারের নিকট হইতে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন এবং সেখানে বসিয়া দাঙ্গা দমনে সব ব্যবস্থা নিজেই পরিচালনা করেন। অসহায়দের রক্ষা করার জন্য যে তিনি স্বয়ং দাঙ্গাপ্রীড়িত এলাকায় দৌড়াইয়া গিয়াছিলেন, এমন নজির শত শত আছে। কেহ সাহায্য চাহিলে তাহাদের উদ্ধারের ব্যাপারে তিনি সাহায্যকারী পুলিশ পাঠান নাই এমন অভিযােগ কেহই করিতে পারিবেন না। এ-ব্যাপারে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোন পার্থক্য করিতেন না। এই প্রসঙ্গে আমি একটি ঘটনা বিবৃত করিতেছি। একবার শত্রুভাবাপন্ন একদল মুসলমান কর্তৃক নারিকেলডাঙ্গা এলাকায় একটি হিন্দু মহল্লা পরিবেষ্টিত হইয়া পড়ে। টেলিফোনকল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনাব সােহরাওয়ার্দী গাড়ি চালাইয়া ঘটনার স্থলে চলিয়া গেলেন। সঙ্গে সাধারণ বা সশস্ত্র রক্ষীদের কাহাকেও নিলেন না। তিনি উত্তেজিত মুসলমান জনতার সম্মুখীন হইলেন এবং তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ হইতে বাধ্য করিলেন। তারপর নিজে সেখানে থাকিয়া সমস্ত হিন্দু অধিবাসীকে অন্যত্র নিরাপদ স্থলে অপসারণের যাবতীয় ব্যবস্থা করিলেন। দুঃখের বিষয় এই যে, ওই দাঙ্গায় নেতার ভূমিকা সম্পর্কে অমুসলমানদের মধ্যে আজও বিতর্কমূলক মনােভাব পরিলক্ষিত হয়। একজন শাসন পরিচালক ও পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে তাঁহার যে অসীম দক্ষতা ছিল তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। পার্লামেন্টে তাঁহার বাচনভঙ্গী ছিল অতি চমৎকার। শাসনযন্ত্রের সমস্ত সমস্যা ছিল তাহার নখ দর্পণে। ১৯৫৬ সালে আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করি, তখন চাউলের মূল্য ছিল মণ প্রতি ৭০ টাকা। এখানে সেখানে মানুষ না খাইয়া মরিতে ছিল। সরকারি গুদামে খাদ্যদ্রব্য ছিল না বলিলেই চলে। জনাব সােহরাওয়ার্দী কালবিলম্ব না করিয়া ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ হইতে খাদ্যদ্রব্য আনয়নের ব্যবস্থা করিলেন এবং সুদূর পল্লি অঞ্চলেও খাদ্যদ্রব্য পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য বিশেষ বিমান বহরের ব্যবস্থা করিলেন। প্রদেশের সামগ্রিক খাদ্যনীতি ছিল তাঁহারই পরিকল্পনা প্রসূত। তিনি ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে হাজার হাজার লােক অনাহারে মারা যাইত। তিনি টেস্ট রিলিফ কাজেরও উদ্যোগ গ্রহণ করিলেন এবং তজ্জন্য প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে কোটি কোটি টাকা প্রদান করিলেন। তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে তিনি পাকিস্তানের উপেক্ষিত অঞ্চলসমূহের ন্যায়সঙ্গত দাবি দাওয়া পূরণ করিতে চাহিয়াছিলেন এবং এই জন্যই কতিপয় শক্তিশালী আমলাতন্ত্রীসহ দেশের কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাঁহার বিরুদ্ধে উঠিয়া পড়িয়া লাগে। তিনি যখন যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে দেশে সত্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন কায়েমী স্বার্থবাদীরা ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ হইতে অপসারিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তাঁহার স্থলাভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী জনাব ফিরােজ খান নুনকে মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের কোন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি ব্যতীতই কেবল ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত নির্বাচন প্রথায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের শর্তে সমর্থনদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিলে পুনরায় সেই কায়েমী স্বার্থী মহলের অন্তর কাপিয়া উঠে এবং তাহারা তৎপর হন। তাঁহারা দেশে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়া সামরিক আইন জারি করেন।
কেবলমাত্র তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই সমস্ত রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং কাহাকেও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতিত করা হয় নাই। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সমানহারে উন্নত করিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি বিশ্বের অনেক জাতির মনেই পাকিস্তানের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের ভাব সৃষ্টি করিয়াছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট চীন, তারপরে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সফরে যান। তিনি রাশিয়াসহ বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে বাণিজ্য প্রতিনিধিদল প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং চীন ও রাশিয়ায় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করিয়াছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অপর ব্লক অর্থাৎ আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত ব্লকের সহিতও বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রাখিতে কম তৎপর ছিলেন না। তাঁহার আমন্ত্রণক্রমেই চীনের প্রধানমন্ত্রী মি. চৌ এন লাই পাকিস্তান সফরে আসেন। এ ভাবেই জনাব সােহরাওয়ার্দী তাহার বিঘােষিত পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সহিত বন্ধুত্ব এবং কাহারাে প্রতি বৈরিতা নয়’-এর বাস্তব রূপ দান করেন। মুসলিম লীগ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা পাকিস্তান চায় কি-না এই প্রশ্নের ভিত্তিতে ১৯৪৬ সনে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহাতে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলিম লীগ শতকরা ৯৭টি মুসলিম আসন দখল করে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ অথবা বেলুচিস্তানের কোথাও মুসলিম লীগ সংখ্যাধিক্য আসন লাভ করিতে পারে নাই। যে ক্ষেত্রে সিন্ধুর মােট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ জন ছিল মুসলমান সেখানে মুসলিম লীগ মাত্র একটি আসনের সংখ্যাধিক্য লাভ করিয়াছিল। বাংলার এই নির্বাচন-সাফল্যর কৃতিত্ব কাহার? একমাত্র জনাব সােহরাওয়ার্দীর সংগঠনী প্রতিভার জন্যই ইহা সম্ভব হইয়াছিল। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া পাকিস্তানের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করিয়াছিলেন, মুসলমান জনসাধারণকে সুসংগঠিত করিয়াছিলেন এবং একদল একনিষ্ঠ কর্মী গড়িয়ে তুলিয়াছিলেন, যাহার ফলে এই যুদ্ধ জয় সম্ভব হইয়াছিল। তিনি কয়েকটি সফরে কোন বিশ্রাম গ্রহণ না করিয়াই পর্যায়ক্রমে ২৫/৩০টি জনসভায় বক্তৃতা করিতেন এবং এছাড়াও তিনি রাত্রে কর্মীসভায় বক্তৃতা করিতেন।
আওয়ামী লীগ
আমার পরিষ্কার মনে আছে, ১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগ সংগঠনে বাহির হইয়া তিনি এক সফরে একাধারে ২৭টি সভায় বক্তৃতা করিয়াছিলেন, মাঝখানে তিনি একদিনের জন্যও বিশ্রাম গ্রহণ করেন নাই। তকালীন সরকার যে, তাহার প্রতি কত বৈরী ভাবাপন্ন ছিল, জনাব সােহরাওয়ার্দীর নির্ধারিত বহু জনসভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করা হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। তাঁহার অবিশ্বাস্য সাংগঠনিক দক্ষতাই ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের এবং ১৯৫৪ সনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ ছিল। দুটি ঘটনা ১৯৫৪ সালে আমার পল্লিভবন হইতে প্রায় আড়াই মাইল দূরে জনাব সােহরাওয়ার্দী এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। জনসভার শেষে আমরা পদব্রজে আমাদের বাড়ি যাই। তখন পথিমধ্যে আমাদিগকে একটি খাল অতিক্রম করিতে হয়। তখন উহা শুষ্ক ছিল। শহীদ সাহেব আমাকে খালটির কথা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং আমি তাহাকে বলিলাম যে, খালটিতে পানি না থাকায় মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পােহাতেই হয়। ১৯৫৭ সালে আমি যখন প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য, তখন একদিন হঠাৎ শহীদ সহেব আমাকে বলিলেন, “মুজিব ১৯৫৪ সালে তােমার বাড়ির কাছে আমি যে শুকনা খালটি দেখিয়াছি, তাহার তুমি কতদূর ঠিক করিয়াছ? তুমি এখন ক্ষমতাসীন। মানুষ কি এখনাে পানির অভাবে কষ্ট পাইতেছে?” আমি সানন্দে। তাঁহাকে বলিলাম যে, আমি সেই খালটি পুনঃখননের ব্যবস্থা করাইয়াছি। ইহা শুনিয়া তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, তাহার স্মরণশক্তি কত প্রখর ছিল এবং মানুষের কথা তিনি কত ভাবিতেন । আর একটি ঘটনা। ১৯৪৫ সাল। আমরা প্রায় ৩০০ প্রতিনিধি নিখিল ভারত মুসলিম কনভেনশনে যোগদানের জন্য দিল্লি যাইতেছিলাম। আমাদের জন্য স্পেশ্যাল ট্রেন রিজার্ভ করা হইয়াছিল। আমাদের বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য স্টেশনে সমাগত ৫০ জনেরও বেশি ছাত্র টিকিটের প্রয়ােজন নাই দেখিয়া আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠিয়া দিল্লি রওয়ানা দিলেন। দিল্লি পৌছার পর এই অতিরিক্ত লােকের থাকা-খাওয়া, আশ্রয়ের সমস্যা প্রকট হইয়া দেখা দিল। পরনের কাপড়-চোপড় ছাড়া তাহাদের কাছে আর কিছুই ছিল না। টাকা-পয়সার কথা তাে না বলিলেই চলে। আমরা বিষয়টি জনাব সােহরাওয়ার্দীকে জানাইলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মরহুম জনাব লিয়াকত আলীর সঙ্গে আলােচনা করিয়া তাহাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করিলেন। কনভেনশনে জনাব সোহরাওয়ার্দী যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তাহা আজও আমার কানে বাজে। কনভেনশন শেষে জনাব সোহরাওয়ার্দী তাহার দিল্লির কতিপয় বন্ধুর নিকট হইতে টাকা কর্জ করিয়া ছাত্রদের প্রত্যেককে কলকাতা প্রত্যাবর্তনের জন্য ২৫ টাকা করিয়া দেন। কর্মী ও ছাত্রদের স্থান যে জনাব সােহরাওয়ার্দীর অন্তরে কত উচ্চ ছিল, এ ঘটনা হইতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। ধনীর দুলাল হইয়াও গরিবের বন্ধু একটি কৃষ্টিবান ও ধনী পরিবারের জন্ম গ্রহণ করা সত্ত্বেও জনাব সােহরাওয়ার্দী এদেশের দরিদ্র জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া তাহার নিজ সম্প্রদায়ের পশ্চাদপদ জনগণের স্বার্থে ব্যক্তিগত আরাম আয়েশ ত্যাগ করিয়া রাজনীতিতে নামিয়া পড়েন। তবে সংখ্যাগুরু অমুসলিম সম্প্রদায়ের সহিত তিনি সর্বদা বন্ধুত্বপূর্ণ মীমাংসায় আসিতে চেষ্টা করিতেন। কলকাতা করপােরেশনের নির্বাচন সম্পর্কে পরলােকগত মি. এস. আর. দাসের সঙ্গে জনাব সােহরাওয়ার্দী যে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব করিয়াছিলেন, তাহা এবং সােহরাওয়ার্দী-দসচুক্তি আজও একটি গৌরবের বস্তু হিসাবে পরিগণিত। দেশবন্ধুর জীবিতকালে এই চুক্তি একবারও ভঙ্গ করা হয় নাই। তাহার মৃত্যুর পর মি. সুভাষচন্দ্র বসু ও জনাব সােহরাওয়ার্দী উহা রিনিউ করেন। ইহাই সােহরাওয়ার্দী-বােস চুক্তি নামে পরিচিত। প্রথমােক্ত চুক্তি অনুযায়ী দেশবন্ধু কলকাতা করপােরেশনের মেয়র ও শহীদ সাহেব ডেপুটি মেয়র হন। এই চুক্তি অনুসাৱেই প্রতি তিন বছরে একবারের জন্য করপােরেশনের মেয়র পর মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত করা হয়।
তিনি মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা প্রত্যাখ্যান করিয়া আসন সংরক্ষণের ভিত্তিতে যুক্ত নির্বাচন প্রথার নীতিতে প্রণীত ‘নেহরু ফর্মুলা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় সৃষ্টি করিয়াছিলেন। মরহুম মওলানা মুহম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী ও ড. আনসারীসহ তৎকালীন আর অন্য কোন মুসলিম নেতা নেহরু ফর্মুলার বিরােধিতা করেন নাই । সেদিন যদি জনাব সােহব্রাওয়ার্দী নেহরু ফর্মুলার বিরােধিতা না করিতেন আর যদি তাহা গৃহীত হইয়া। যাইত, তাহা হইলে উহা মুসলমানদের ভবিষ্যৎ তথা পাকিস্তান আন্দোলনের মূলেই কুঠারাঘাত করিত। আবার তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি খণ্ডিত পাকিস্তানে খণ্ডিত বাংলার কুফল উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। তাহার ফলে উদ্ভব হইয়াছিল বৃহত্তর বাংলার সােহরাওয়ার্দী-বসু চুক্তি’ (জনাব সােহরাওয়ার্দী ও মি. শরৎচন্দ্র বসুর নাম অনুসারে)। এই পরিকল্পনার প্রতি কায়েদে আজমেরও আশীর্বাদ ছিল। কিন্তু মি. বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে পরিচালিত চরমপন্থীকংগ্রেস মহল এবং মি. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর ন্যায় সাম্প্রদায়িকতাবাদিগণ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করিতে দেয় নাই। দুঃখের বিষয়, জনাব সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক প্রতিবাদীরা পরিকল্পনাটিতে ভিন্ন উদ্দেশ্য আরােপ করিয়া উহা জনাব সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে মূলধন হিসাবে লাগাইতে এখনও চেষ্টা করেন। আমি নিশ্চিত যে, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হইলে তাহা কত ভালাে হইত, জনগণ আজ তাহা উপলব্ধি করিতে পারিতেছে। এই স্বল্পপরিসর জায়গায় পরিকল্পনাটি বিস্তারিতভাবে আলােচনা সম্ভব নহে। আমি শুধু এইটুকুই বলিতে চাই যে, এই পরিকল্পনায় উভয় সম্প্রদায়ের প্রতি ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়াও অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ পৃষ্ঠপােষকতার বিধান ছিল। সর্বোপরি বাংলা, আসাম এবং বিহার, উড়িষ্যার বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলিকে লইয়া প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি গঠিত হইলে উহা সম্পদের দিক দিয়া বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ধনী ও সম্পদশালী রাষ্ট্র হইত। জনাব সােহরাওয়ার্দীর বিরাট ব্যক্তিত্ব ও অতি-মানবীয় দক্ষতাকে অনেকেই ভয় করিতেন। সেই জন্যই অবিভক্ত ভারতে এবং পাকিস্তানে বিশেষ করিয়া মুসলিম লীগ মহলের অনেকেই তাহার প্রতি ঈর্ষান্বিত ও তাহার বিরুদ্ধে সদা-সর্বদা চক্রান্তের খেলায় লিপ্ত ছিলেন। জনগণের জন্য সর্বস্ব ত্যাগী নেতার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানাইবার মতাে ভাষা আমার নাই। মৃত্যুকালে তিনি ব্যাংকে ১৩ হাজার টাকা ঋণ রাখিয়া গিয়াছেন। তাহার উত্তরাধিকারীদের ইহা শােধ করিতে হইবে। অথচ তিনি শুধুমাত্র আইন ব্যবসায়ের দ্বারাই অতি সহজে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়িতে পারিতেন। যদি তাহার মতাে এত বড় ব্যক্তিশালী ও যােগ্যতাসম্পন্ন নেতা কোন উন্নত দেশে জন্ম গ্রহণ করিতেন, তাহা হইলে তিনি যুগের পর যুগ ক্ষমতার উচ্চতর শিখরে অধিষ্ঠিত থাকিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি যে এ-দুর্ভাগা দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।
সূত্র – ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, মার্চ ১৯৬৪, ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ইত্তেফাকে এই লেখাটি পুনঃমুদ্রিত হয়।
আরও পড়ুন – শহীদ চরিত্রের অজানা দিক | সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2020/05/নেতাকে-যেমন-দেখিয়াছি.pdf” title=”নেতাকে যেমন দেখিয়াছি”]