You dont have javascript enabled! Please enable it!

শহীদ চরিত্রের অজানা দিক

সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা

যুগে যুগে দেশে দেশে জাতির কর্ণধাররূপে জাতীয় ইতিহাসে যুগমানবরূপে যাদের আবির্ভাব হয়, সেই যুগস্রষ্টা মহর্ষিদের কর্মময় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ জাতীয় জীবনে বিরাট পাথেয় হয়ে বিরাজ করে। ব্যক্তি হিসাবে তারা সাধারণ মানুষ নন, তারা অতিমানব। তাদের গােটা জীবনের নিরলস সাধনা জাতির অমূল্য সম্পদ। চলার পথের মন্ত্রণা। জাতীয়তাবােধের প্রেরণা। এক কথায়, তারা জাতির গৌরব। অনুন্নত, পশ্চাদপদ বা উপনিবেশবাদের যাতাকলে নিষ্পেষিত সর্বহারাদের এঁরা মুক্তিত্রাতা মহামানব। দেশে দেশে এঁদেরই ব্যক্তিজীবনের ত্যাগ ও বিরামহীন সংগ্রাম ছিন্ন করেছে পরাধীনতার কঠিন শৃঙখল, অবসান ঘটিয়েছে স্বৈরাচারী বিধি-ব্যবস্থার নাগপাশের। এঁরা সবাই বিশ্বের সর্বহারাদের অতি আপনজন আর প্রতিক্রিয়াশীলদের ত্রাস। লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অপবাদকে তারা বরণ করেছেন আশীর্বাদ হিসেবেই। আমি আজ এমন এক মহান নেতার কর্মময় জীবনের কিছু অংশ এই ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্ত করার প্রয়াস পাচ্ছি, যার নিরলস পরিশ্রম ও কঠোর সাধনায় আমরাও পরাধীনতার বেড়ি ছিন্ন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। তিনি আমাদের মহান নেতা মরহুম জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। আজ হতে দুছর আগে এই মহান নেতা জাতির এক মহা দুর্দিনে এ দেশের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষকে শােক ও হতাশার মহাসাগরে ভাসিয়ে মহাপ্রয়াণ করেছেন। তাঁর প্রিয় দেশবাসী জাতির সেই মহাসঙ্কট মুহর্তে যখন একান্তভাবেই মাতৃভূমির বুকে তার উপস্থিতি কামনায় আকুল আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে, ঠিকই সেই মুহূর্তেই বিনা মেঘে, বজ্রাঘাতের মতাে তাঁর মহাপ্রয়াণের সংবাদে গােটা জাতি হতাশায় মুষড়ে পড়ে। লক্ষকোটি মানুষের বুকফাটা কান্নায় সেদিন দেশের আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। নেতার মহাপ্রয়াণে জাতি মুড়িয়ে পড়লেও তার সংগ্রামী জীবন জাতিকে ফিরিয়ে দেয় সম্বিৎ- নতুন করে তারা শপথ নেয় মরহুম নেতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলবার। সােহরাওয়ার্দীতে ছিল বহুমুখী প্রতিভার এক অপূর্ব সমন্বয়। দেশপ্রেম, মানব-প্রেম আর জাতি-প্রেমই ছিল তাঁর জীবনদর্শন। যাঁরা তাঁকে দূর হতে দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে সােহরাওয়ার্দী-চরিত্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমি জীবনের একটানা সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর নেতার সংস্পর্শে ছিলাম। তাঁর ব্যক্তিজীবনের বহু ঘটনা আছে, যেগুলি থেকে তার জীবনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গভীরভাবে জানবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সােহরাওয়ার্দী এমন এক মানুষ ছিলেন যার প্রকৃত জীবন-চরিত লিখলে সে হবে এক মহাগ্রন্থ। আমি শুধু তাঁর জীবনের একটা দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলােচনা করব। দাতা সােহরাওয়ার্দীকে সমাজে কয়জন জানেন? অথচ এটাই ছিল রাজনীতিক বলে পরিচিত সােহরাওয়ার্দী চরিত্রের একটা অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য। তিনি যা দান করতেন, তা কারও গােচরে করতেন না, এমনকি তার একান্ত ঘনিষ্ঠ সহরচদের অনেকেও তা জানতেন না। তার একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে তাঁর এই দানের ছিটে-ফোটা পরিচয় পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সে ছিটেফোটা থেকে প্রকৃত সমুদ্রের আঁচ করা কঠিন নয়।

পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত ব্যারিস্টার হিসেবে সােহরাওয়ার্দী প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। সঞ্চয়ের আসক্তি তার জীবনে কোনকালেই ছিল না। কোন অসহায় মানুষ তাঁর কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়ে শূন্য হাতে ফিরে এসেছে- এমনটা কখনও দেখি নি। জাতি-ধর্মবর্ণের কোন ভেদাভেদ তার কাছে ছিল না। মানুষকে তিনি দেখেছেন মানুষ হিসেবেই। তাই, পরিচারক হয়েও শিবুর স্থান ছিল তার সংসারে অনেক উচ্চে। শিবুর বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়। সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছর শিবু শহীদ সাহেবের সেবা করেছে। শহীদ পরিবারে শিবুর প্রভাব ছিল অসামান্য। শহীদ সাহেব যখন কলকাতা হতে পাকিস্তানে চলে আসেন, তখন নিজ আসবাবপত্র ছাড়াও শিবুকে প্রচুর অর্থ দিয়ে আসেন। কলকাতায় থাকাকালীন তার ড্রাইভার বার্ধক্য হেতু চাকরি হতে বিদায় নিলে শহীদ সাহেব তাকে নিয়মিত পেনসন দিতেন। তার বাড়ি ছিল বিহারের আরা জেলায়। শহীদ সােহরাওয়ার্দী যখন অবিভক্ত বাংলার সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী, তখনকার একটি ঘটনা। নিজ ডেস্কে বসে একদিন তিনি ওই দিনের ডাক দেখছেন। এক খানা পােস্টকার্ড তুলে নিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ দেখি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আমাকে এক্ষুণি একবার বেরুতে হবে খিদিরপুরের দিকে। কথা শেষ না হতেই ডেস্ক ছেড়ে সােজা উঠলেন গিয়ে গাড়িতে। মুখটা তার স্নান। কিছুই বুঝছি না। থিয়েটার রােড থেকে বেরিয়ে কলকাতার বিভিন্ন রাজপথ মাড়িয়ে আমরা খিদিরপুর পৌছলাম। নেতা নিজেই ড্রাইভ করছেন। হঠাৎ দেখি, গাড়িটা মােড় নিচ্ছে একটা গলির দিকে। ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক ঠেকছে। কিছুক্ষণ পরই দেখি আমরা ওয়ার্ডগঞ্জ শ্রমিক বস্তিতে। শহীদ সাহেবকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই সারা বস্তি যেন ভেঙে পড়ল নিমেষে। জনারণ্যে তিনি হারিয়ে গেলেন। ওদের শত কথার মধ্যেও শহীদ সাহেব কেমন যেন অন্যমনস্ক। একটা লােকের নাম করে উনি জানতে চাইলেন, তার ঘরটা’ কোথায়। সারা বস্তির লােক এবার শহীদ সাহেবকে যেন স্রোতের মতাে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। একটা অতি নােংরা ঝুপড়ির কাছে এসে সবাই আমরা থামলাম। বস্তিবাসীদের বাইরে দাঁড়াতে বলে শহীদ সাহেব মাথা নিচু করে ঢুকলেন সেই ঝুপড়িতে। সামনেই মাটিতে পাতা মাদুরের উপর রােগ-জর্জরিত এক বৃদ্ধকে দেখে ব্যাপারটা আমার কাছে এবার অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এলাে। কিন্তু আমার মনের এতক্ষণকার সব প্রশ্ন যেন ভিড় করল সকল বস্তিবাসীর মনে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তারা দাড়িয়ে রইল বাইরে। শহীদ সাহেব জানতে চাইলেন, কবে থেকে বৃদ্ধের এই অবস্থা, এতদিন কেন তাকে জানান হয় নি, প্রভৃতি। আর বেশি কথা না বলে লােকটিকে তিনি গাড়িতে তুলে নিলেন। ভৎর্সনা করলেন বস্তিবাসীদের, কেন তারা বৃদ্ধের এই অবস্থার কথা তাকে জানায় নি। বস্তিবাসী সলজ্জবদনে দাড়িয়ে রইল আর শহীদ সাহেব বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে পড়লেন বস্তি থেকে। এবার আমাদের গন্তব্যস্থল যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতাল। হাসপাতালে গিয়ে বুদ্ধকে শুধু ভর্তি করাই নয়, তার চিকিৎসার যাতে কোন রকমের ত্রুটি না হয়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কড়া নির্দেশ দিয়ে বৃদ্ধের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। তার পর ফিরে এলেন থিয়েটার রােডে নিজ বাড়িতে। গাড়ি থেকে নেমে এই প্রথম তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন, ‘মুজিব, তুমি যেন কি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে।’ জবাব দিলাম, কখন স্যার! বললেন, আমি যখন ডেস্কে। ডাক দেখছিলাম।’ বললাম, একখান পােস্টকার্ড পড়তে পড়তে আপনি হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন কি-না, তাই তার কারণ জানতে চেয়েছিলাম। বহুদূরের কোন চিন্তারাজ্য থেকে যেন তিনি জবাব দিলেন, ‘ওই বৃদ্ধ আমার কাছে তার চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা চেয়েছিল। কিন্তু শুধু টাকায় কি ওর চিকিৎসা হয়!’ বলা বাহুল্য, তখনকার দিনে যাদবপুর হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ রােগীকেই বহন করতে হতাে। বৃদ্ধের চিকিৎসার ভার তাই শহীদ সাহেব নিজেই নিয়েছিলেন, আর তার রােগমুক্তি হওয়া পর্যন্ত সে খরচ তিনি বরাবর বহন করে এসেছিলেন। বস্তুত, শহীদের মানসিকতার সত্যিকার পরিচয় এইখানেই। উচ্চ-নিচ ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থেকে সমাজের নিচতলার মানুষের প্রত্যক্ষ সেবায়, বিপদের দিনে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানাের এ ধরনের ঘটনা শহীদ সাহেবের জীবনে এই নতুন নয়। এমন হাজারাে ঘটনায় তার জীবন সমৃদ্ধ।

১৯৪৩ সালের কথা। শহীদ সাহেবের ঘরে বসে আছি। বিছানার ওপর একটা ‘কালাে খাতা’ নজরে পড়ল। এমনিতেই সেটা নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছি। দেখি, কেবল কতকগুলাে লােকের নাম আর ঠিকানা। আর তার পাশে একটা করে টাকার অঙ্ক লেখা। একুনে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতাে। প্রশ্নের জবাবে নেতা জানালেন, ওরা অত্যন্ত বিপন্ন, তাই ওদেরকে মাসে মাসে ‘পেনসন’ দিয়ে উনি বাঁচিয়ে রাখছেন। বললাম, মাসে মাসে নিয়মিতভাবে এতটাকা আপনি যাকে-তাকে পেনসন দিয়ে যাচ্ছেন, তার কারণ? সােজা জবাব না দিয়ে করুণ একটা হাসি হেসে বললেন, দেশের অবস্থা তাে জান না। ও তালিকা তাে আমার দিন দিন বাড়ছে। ভাবছি, কবে ওদের একটা হিল্লা করতে পারব। এমন একটা মারাত্মক বােঝাকেও তিনি অত সহজ করে দেখছেন কি করে, ভেবে অবাক হলাম। বুঝলাম, এ কেবল শহীদ সাহেবেই সম্ভব। অনেকেই হয়ত জানেন না যে, শহীদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়েছিল শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। সােনার চামচ মুখে নিয়ে বিরাট ঐতিহ্যমণ্ডিত সােহরাওয়ার্দী পরিবারে যার জন্ম, সমাজের উপর তলার মানুষদের মধ্যেই তাঁর আনাগােনা হওয়ার কথা। কিন্তু শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিল তার ব্যতিক্রম। তাই, ব্যারিস্টারি পাস করে কলকাতায় ফিরে এসেই তিনি আরামের জীবন বেছে না নিয়ে সমাজের নিচু তলার মানুষের সেবায়ই নিজেকে নিয়ােজিত করেন। কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি করে যা কিছু উপার্জন করতেন, ব্যয় করতেন তা বস্তি এলাকার সহায়-সম্বলহীন অধিকারহারা শ্রমিকদের পিছনে। বলা বাহুল্য, ব্রিটিশ শাসনের ভরা যৌবনে ভারতের কোথাও শ্রমিক সংগঠন দানা বাঁধতে পারে নি সুযােগ্য নেতৃতুের অভাবে। অবিভক্ত বাংলায়ও এই অবস্থার ব্যতিক্রম ছিল না। তথাকথিত নেতৃত্বের নামে এক শ্রেণীর স্বার্থ সন্ধানী মানুষ তখন অসহায় শ্রমিকদের স্বার্থের বিনিময়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ে চলেছিল। কলকারখানার শ্বেতাঙ্গ মালিকদের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের কোন আন্দোলন করা, অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা অথবা ধর্মঘট করার অধিকার ছিল না। শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন বলতে কিছুই তখন ছিল না, যার ফলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সামান্যতম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার তুচ্ছ অজুহাতে ছাঁটাই চলত নির্বিচারে। মিথ্যা মামলায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে হতাে পাইকারি হারে। এই সব কারণে দীনতার বােঝায় পিষ্ট শ্রমজীবীরা শত লাঞ্ছনা ভােগ করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে সাহস করত না।

শ্রমিক সমাজের সেই ঘাের দুর্দিনে তরুণ ব্যারিস্টার সােহরাওয়ার্দী শ্রমিক আন্দোলনে আত্মনিয়ােগ করেন। প্রথম দফায় তিনি “ঘােড়াগাড়ি ইউনিয়ন”, “গরুর গাড়ি ইউনিয়ন”, “খানসামা ইউনিয়ন”, “সি মেনস ইউনিয়ন”, “বাস ড্রাইভার ইউনিয়ন”, “ট্যাক্সি ড্রাইভার ইউনিয়ন”, “জুট শ্রমিক ইউনিয়নসহ কতিপয় শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে তার পরিচালনাভার গ্রহণ করেন। এই সব শ্রমিক সংস্থার অফিস ছিল শহীদ সাহেবের বাসায়। শ্রমিক সদস্যদের গতিবিধি ছিল সেখানে অবাধ। শ্রমিকদের তিনি এমনই আপনজন বলে মনে করেছেন যে, তাদের কোন ব্যাপারেই কখনাে তিনি বিরক্ত প্রকাশ করেন নি। শ্রমিকদের সাথে তিনি সকাল-দুপুর-রাত্রি নির্বিশেষে সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলাপআলােচনা করেছেন। শুধু তাই নয়, শ্রমিক-মালিক বিরােধে ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের তিনি নিজে আর্থিক সাহায্য যুগিয়েছেন। শ্রমিকদের কাছ থেকে কোনরূপ চাঁদা গ্রহণ না করে নিজ উপার্জিত অর্থেই তিনি শ্রমিক আন্দোলন চালিয়েছেন। ব্যারিস্টারি করে উপার্জিত অর্থ এই পথে খরচ করার মধ্যে তিনি অপার আনন্দের সন্ধান পেতেন। রাজনৈতিক জীবনের প্রারম্ভে শ্রমিক আন্দোলনে এভাবে জড়িত ছিলেন বলেই শহীদ সাহেব শ্রমিকদের অভাব-অভিযােগ এবং তার প্রতিকারের আইনসম্মত বিধি-ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেন সর্বাধিক। তারপর ১৯৩৮ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী হিসাবে শ্রমমন্ত্রীর কার্যভার গ্রহণের পর প্রথম সুযােগে শহীদ সােহরাওয়ার্দীই সর্বপ্রথম শ্রমিক আইন পাস করেন। সে আইন আজ বলবৎ আছে। বলা বাহুল্য, সেই হতেই এদেশে শ্রমিক সংস্থার রেজিস্ট্রেশন কার্যকরী হয়। শহীদ সাহেবকে অনেকে অনেক সময় হিন্দুবিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ কথা কেবল তাঁর রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীরাই প্রচার করতেন। প্রকৃত পক্ষে শহীদ সাহেব কখনও কোন সম্প্রদায়-বিদ্বেষী ছিলেন না। তার রাজনৈতিক জীবনে হিন্দুবিদ্বেষের নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহীদ সাহেব ছিলেন মানুষের নেতা। তিনি যেভাবে সাবইকে সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন, এমনটা আর কারও মধ্যে দেখি নি। মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবেই দেখেছেন। বিভিন্ন সময়কার সাম্প্রদায়িক গােলযােগের সময় তিনি যেমন মুসলমান দুর্গতদের উদ্ধার করেছেন, তেমনি তিনি হিন্দু দুর্গতদেরও উদ্ধার করেছেন। বহু ধরনের বহু ঘটনা আমার জানা আছে। শহীদ সাহেবের এমন অনেক ব্যক্তিগত হিন্দু বন্ধু ছিলেন বা আছেন যারা তার ব্যক্তিসত্তার আসল রূপ জানতেন। শহীদ সাহেব যদি সত্যই হিন্দুবিদ্বেষী হতেন তাহলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সকলকে ছেড়ে তাকে তার রাজনৈতিক সহকর্মী করতেন না, হিন্দু-মুসলিম চুক্তিও স্বাক্ষরিত হতাে না এবং কলকাতা করপােরেশনের ডেপুটি মেয়রের পদে শহীদ সাহেব নির্বাচিত হতে পারতেন না। সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে শহীদ সাহেবের হৃদ্যতাও কারও অজানা নেই। কলকাতার রক্তক্ষয়ী দাঙ্গাকে উপলক্ষ করে কেউ কেউ শহীদ চরিত্রে এই কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের এ অপপ্রচার যে কত মিথ্যা, তার পরিচয় মহাত্মা গান্ধী নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। বিভাগােত্তর যুগে সমগ্র পাক-ভারত উপমহাদেশে যে ব্যক্তির স্কন্ধে ভর করে গান্ধীজী তার সাম্প্রদায়িক শান্তি মিশন চালিয়েছেন, সে ব্যক্তিটি কোনও হিন্দু ছিলেন না, সে ব্যক্তি ছিলেন জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। দিল্লির বিড়লা ভবনের যে আততায়ীর গুলিতে গান্ধীজী নিহত হন, তাদের লক্ষ্য যে শহীদ সাহেবও ছিলেন, গান্ধীহত্যা মামলার রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যেই তার প্রমাণ মিলে। বস্তুত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে গান্ধীজীর আন্তরিকতায় যারা বিশ্বাসী, তাদের প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন যে, সাম্প্রদায়িক শান্তি মিশনে গান্ধীজী যদি কায়া হন, তবে শহীদ সাহেব ছিলেন তার ছায়া। যে সমস্ত মহৎ গুণে মহান ব্যক্তিদের জীবন মহিমান্বিত, সেই সব গুণেরই অধিকারী ছিলেন শহীদ সাহেব। রাজনৈতিক জীবনে প্রতিপক্ষের প্রত্যক্ষ দুশমনদের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রতিশােধ গ্রহণ করতে দেখা যায় নি তাকে। বরং, প্রতিপক্ষকে ক্ষমা প্রদর্শনই ছিল তার ধর্ম। তিনি ছিলেন স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী, গণতন্ত্র আর ব্যক্তি-স্বাধীনতার তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সাধক। তাঁর জীবনাদর্শের মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। সােহরাওয়ার্দী যদি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতেন, তাহলে তিনি পাকিস্তানে একচ্ছত্র শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারতেন। এই অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহাপুরুষ যদি ইউরােপের মতাে স্বচ্ছ রাজনীতির দেশে জন্ম নিতেন, তাহলে আজীবন তিনি সে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে দেশের সেবা করতে পারতেন।

জাতি যখন তার নেতৃত্ব কামনায় মন-প্রাণ দিয়ে উন্মুখ, ঠিক সেই সময়েই আমরা তাকে হারালাম। সে মুহূর্তে জাতির অবিসর্জন ছাড়া আর কি-ই বা করণীয় ছিল! এদেশ, এদেশের মানুষ, এদেশের আকাশ-বাতাস শহীদ সাহেব তার জীবনের চেয়েও ভালােবাসতেন। শহীদ সাহেব বাংলার মাটিতে জন্মিয়েছেন। বাংলাই ছিল তার প্রিয় জন্মভূমি। তাই, মৃত্যুর পর এই মাটির মায়া তিনি কাটাতে পারেন নি। আর মহাপ্রয়াণের পর তাই এই মাটির বুকেই তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে। অভিমানভরে দূরে-বৈরুতের মাটিতে সরে থাকতে তিনি পারেন নি। তাঁর মাজার আজ আমাদের পবিত্র তীর্থ। প্রাচুর্যের মােহ সােহরাওয়ার্দীর কোনদিনই ছিল না। ইচ্ছা করলে তিনি একমাত্র আইন ব্যবসায়েই অগাধ সম্পত্তির মালিক হতে পারতেন। তিনি তা চান নি। হনও নি। তার মহাপ্রয়াণের পর জাতি দেখেছে সারা জাতির চিত্ত জুড়ে যার বাস, মৃত্যুকালে তিনি ১৩ হাজার টাকা ঋণ রেখে গিয়েছেন। শহীদ সাহেব দুবার কঠিন রােগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে ইউরােপে গিয়েছেন। বলতে আপত্তি নেই, এই প্রতিবারেই তার চিকিৎসার ব্যয়ের মােটা অংশই চাদা থেকে সংগ্রহ করা হয়। শহীদ সাহেব ইচ্ছা করলে তার একমাত্র পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দীকে শিল্পপতি করে রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু আজ রাশেদের পড়ার খরচ শহীদ সাহেবের কন্যাকে বহন করতে হয়। জাতির দুর্ভাগ্য যে, এহেন অনন্যসাধারণ মহাপুরুষকেও রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। হয়ত সেই অভিমানেই জীবদ্দশায় তিনি আর দেশে ফিরে আসতে চান নি- আসেনও নি। আজ শহীদ সাহেব আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু আছে তার আদর্শ, আছে তার বাণী, আর আছে তার দেওয়া পথ-নির্দেশ। তাঁর রাজনৈতিক জীবনদর্শন আমাদের জাতীয় জীবনের মহা সম্পদ। তার আদর্শ আমাদের মুক্তির প্রেরণা। শহীদ সাহেব দশ বছর আগে যা কিছু বলে গেছেন, তা তখনও সত্য ছিল, আজও সত্য, ভবিষ্যতেও সত্য হয়ে থাকবে। তার সে বক্তব্য হলাে জনগণের সার্বভৌমত্ব, নির্ভেজাল গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। জাতীয় জীবনে এ সত্যের বাস্তবায়নের দায়িত্ব এ দেশবাসীর।

সূত্র : ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৫

আরও পড়ুন – নেতাকে যেমন দেখিয়াছি – হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এর লেখা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!