ভাষা সৈনিক শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
আজ ২৯ মার্চ
১৯৭১-এর এই দিনেই পাক হানাদার বাহিনী তাদের সমস্ত অপকর্মের দোসর রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে, রাত দেড়টায় ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-র কুমিল্লার বাড়িতে হানা দিয়ে, তাঁকে এবং তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে স্থানীয় সেনা নিবাসে নিয়ে যায় । সেখানে অকথ্য অত্যাচার করে তাদের হত্যা করা হয় । ৮৫ বছরের বৃদ্ধপিতা এবং তাঁর পুত্রের লাশেরও কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কিন্তু কী অপরাধ ছিল অজাতশত্রু এই মানুষটির ?
গান্ধিজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি প্রচার করেছেন স্বাধীনতার বাণী । বাংলা ভাগের সময় আইন সভায় তিনি ছিলেন কংগ্রেসের উপনেতা । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও জন্মভূমি ত্যাগ না করে, তিনি পূর্ব বাংলায় থেকে যান । যদিও তিনি জানতেন, পাকিস্তানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে রাষ্ট্রীয় নিগ্রহ, অন্যদিকে ভারতে এলে পেতেন সম্মান . . . ।
পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে, করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের সভায়,১৯৪৮-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ভাষা বিষয়ে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে, উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলাকেও গ্রহণ করার আবেদন জানান ।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সহ পূর্ব বাংলার মুসলিম লিগ সদস্যরা একযোগে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-র ওই ন্যায্য এবং গণতান্ত্রিক দাবির বিরোধিতা করে, একমাত্র উর্দুর পক্ষে সওয়াল করেন । পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট করার উদ্দেশে এই প্রস্তাব আনা হয়েছে . . . ।
নব গঠিত পাকিস্তানের ৫৬% মানুষের ভাষা ছিল বাংলা । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যদি বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষার দাবি জানাতেন, তাও তা হতো ন্যায্য এবং গণতান্ত্রিক । কিন্তু তিনি তা করেননি , তিনি ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানিয়ে ছিলেন । যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করে ছিলেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যার বিচারে উর্দুর অবস্থান ছিল ৭ % । মানে নবগঠিত পাকিস্তানের মাত্র সাত শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু । অন্যদিকে বাংলা ছিল ছাপান্ন শতাংশ মানুষের ভাষা । যদিও বাংলা ভাষার পক্ষে দাবি উত্থাপনের অপরাধে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে হতে হয়েছিল লাঞ্ছনার শিকার, অপবাদ জুটেছিল, ভারতের চর, পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টকারি ইত্যাদি ।
করাচির গণপরিষদে বাংলা ভাষার বিরোধিতার সংবাদ ঢাকায় পৌঁছলে গণমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় । বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮ ) পালিত হয় প্রতিবাদ। ২ মার্চ (১৯৪৮ ) গঠিত হয় “রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ” এবং ১১ মার্চ (১৯৪৮ )বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার দাবিতে হরতাল বা বন্ধ পালন করা হয় । পরিস্থিতির চাপে মুসলিম লিগ নেতা এবং পূর্ব বাংলার (পাকিস্তান ) মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়ে, রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন । যদিও পরবর্তীতে ওই চুক্তিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করতে তার কিছুমাত্র দ্বিধা হয়নি ।
পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-র কন্ঠে, ওই দাবি উচ্চারিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এই ভাবেই শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন । যা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৫২-র ২১ফেব্রুয়ারি ।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরে, পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে , ১৯৭১-এর ১ মার্চ নিদ্ধিরিত গণপরদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে, গোটা পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে । বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আন্দোলনে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-ও ছিলেন, প্রথম সারিতে । ১৯৭১-এর মার্চের প্রথম সপ্তাহে তিনি কুমিল্লার বাড়িতে নিজ হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলেন ।
১৯৭১-এর ২৯ মার্চকে স্মরণ করে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্ত-র প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ।
নিচে ধীরেন্দনাথ দত্ত-র প্রতিকৃতিটি ‘স্বাধীন বাংলা’ পত্রিকা থেকে নেওয়া । প্রতিকৃতিটি স্বাধীন বাংলা পত্রিকার জন্য এঁকে ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী বিজন চৌধুরী । এই সূত্রে উল্লেখ করা যায়, স্বাধীন বাংলা-র ওই সংখ্যার প্রচ্ছদটিও (ঢাকার শহিদ মিনার ) এঁকে ছিলেন শিল্পী বিজন চৌধুরী
জামালপুরের রাজাকার মাইনুর রহমানের বয়ান –
ভারত সীমান্ত। ১২ নভেম্বর শীতের রাতের কথা বলছি। হিন্দুস্তান আর্মির গেরিলা আক্রমণের জবাব দেয়ার জন্য পাক বাহিনীর ২০০ সিপাহি ও আলবদরের ৪০ জন ক্যাডেট নিয়ে গঠিত একটি আক্রমণকারী দল গারো পাহাড়ের দিকে যাত্রা করল। রাত ১১ টার দিকে আমাদের গ্রুপ পাহাড়ি রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌছাল। ঘোর শীত ছিলো। দ্বিতীয়ত অন্ধকার। তার উপর বৃষ্টি হচ্ছিলো। রাইফেলের ওজন বেড়ে পাথরে পরিণত হয়েছিলো। এ অবস্থায় পথ চলতে চলতে আমরা রাত সাড়ে তিনটার সময় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়লাম। তাদের একটি ফাঁড়ি ঘেরাও করে ফেললাম। এক ঘণ্টা অনবরত লড়াইয়ের পর দুশমন যুদ্ধাস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেলো। ভারতীয় ফৌজের সাহায্যকারী দল আসতে আসতে আমরা পাকিস্তানি পর্বতমালায় এসে গেলাম।
– সূত্র – আলবদর গ্রন্থ।
– এই তথ্য থেকে জানা যায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ভারতে প্রবেশ করেও আক্রমণ করেছে।