You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের নতুন পর্যায়ে ভারতের দায়িত্ব

বর্ষা শেষ হতে না হতেই বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নতুন জোয়ার এসেছে। মুক্তিবাহিনী এবং গেরিলা যযাদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা আজ নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত। ইতিমধ্যেই বাঙলাদেশের ১২০০ বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছে ; আরাে ১৮০০০ বর্গমাইল এলাকায় কার্যত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে মুক্তিবাহিনীর। মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্য প্রমাণ করছে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পূর্ণ এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সাফল্য আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত নয়। বরং অতীত অভিজ্ঞতা, দীর্ঘ প্রস্তুতি, অভূতপূর্ব দেশপ্রেম এবং অতুলনীয় সাহস আজকের এই সাফল্যের পথ ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছিল আগে থেকেই।
মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্যে দেশবিদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যেমন আনন্দিত, তেমনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ এবং তাদের পৃষ্ঠপােষকের দল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চর ও অনুচরদের মারফত মুক্তি আন্দোলনে ভাঙন ধরাবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি বাঙলাদেশ সরকারের এবং মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বের দৃঢ়তার ফলে। মুজিবুর রহমানকে পণ রেখে ইয়াহিয়া খা যে খেলা খেলবার চক্রান্ত করেছিলেন তা আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানি নেতারা তাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে একটা যুদ্ধ বাধাবার জন্য। পশ্চিমসীমান্ত অঞ্চল জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও অস্ত্র শস্ত্র সমাবেশের যেসব সংবাদ আসছে তাতে ভারতের উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাঙলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে বর্বর লড়াই চালাতে গিয়ে পাকিস্তানি অর্থনীতি আজ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ বাধালে পাকিস্তানের পক্ষেও সেটা মারাত্মক হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কোন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন রাষ্ট্রই এই অবস্থার মধ্যে যেচে নিজেকে যুদ্ধের মধ্যে জড়াতে চায় না। কিন্তু পকিস্তানী রাষ্ট্রনেতাদের আজ সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞানও লােপ পেয়েছে বলে মনে হয় ; তা যদি না হতাে তবে অনেক আগেই তারা পূর্ববঙ্গের মানুষের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক দাবি মেনে নিত। সে পথে না গিয়ে পাকিস্তানি নেতারা যে পথ ধরে চলেছে তাতে একটা মারাত্মক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ যদি তারা শুরু করে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রাজনৈতিক উন্মত্ততা যখন কোন রাষ্ট্রকে পেয়ে বসে তখন তার কার্যকলাপের মধ্যে যুক্তির কোন বালাই থাকে না।
স্বভাবতই এই অবস্থায় ভারতকেও আত্মরক্ষার জন্য তৎপর হতে হয়েছে। ভারতবর্ষ কোন দিন যুদ্ধ চায়নি ; আজও পাকিস্তানের অসংখ্য প্ররােচনা সত্ত্বেও বাঙলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের সমস্যা বাহুবলে মীমাংসা করার কোন চেষ্টা ভার করেনি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক বিদেশ সফর আর একবার প্রমাণ করেছে যে বাঙলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই ভারতের কাম্য। বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে কোন রকম ব্যস্ততা দেখাতে ভারত সরকার সম্ভবত এই কারণেই রাজি হননি।
কিন্তু পাকিস্তান যদি বাঙলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে আগ্রহী না হয় (এবং সে আগ্রহ এপর্যন্ত বিন্দুমাত্র দেখা যায়নি তা বলাই বাহুল্য) তবে বাংলাদেশকে স্বীকৃীত দানের প্রশ্ন। আর কতকাল ঠেকিয়ে রাখা যাবে? প্রায় এক কোটি শরণার্থীর বােঝা ঘাড়ে নিয়ে অনন্তকাল পাকিস্তানের সদিচ্ছা-উদ্রেকের আশায় অপেক্ষা করা নিশ্চয় ভারতের মতাে ধৈর্যশীল রাষ্ট্রের পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ, শরণার্থী সমস্যা ভারতের অর্থনীতির উপরও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাবার উপযুক্ত পরিস্থিতি বাঙলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হলে ভারতের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে। সেই উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়িত্ব পালনে পাকিস্তান অনিচ্ছুক। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে যদি ব্যর্থ হন তবে নিজের স্বার্থেই ভারতের পক্ষে সে দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা দেখা দেবে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নতুন পর্যায়, তাই বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নকে আজ জরুরি করে তুলেছে।

সূত্র: সপ্তাহ, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!