You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.05 | আন্তর্জাতিক প্রচার অভিযান দরকার | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

আন্তর্জাতিক প্রচার অভিযান দরকার

ইয়াহিয়ার প্রচারযন্ত্র আবার পুরানাে সুরে গান ধরেছে। তার ভারত বিদ্বেষী জিগীর চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। গত কদিন ধরে ইসলামাবাদের প্রচারকরা হস্তক্ষেপ বলছেন, ভারত নয়াদিল্লী বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সক্রিয় সাহায্য দিচ্ছে। ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজগুলাে উন্মুক্ত দড়িয়ায় পাক-জাহাজগুলােকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বেতার প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে শীঘ্রই শুরু হবে কূটনৈতিক অভিযান। হয়ত তা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। একথা সত্য যে, নয়াদিল্লীর উপর জনতার চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সাধারণ মানুষ বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থনে সক্রিয় ব্যবস্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী। তা সত্বেও নয়াদিল্লী ঘটনার গতি পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। তার কার্যকলাপ এখন পর্যন্ত মানবতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। সীমান্তের ওপারে হাজার হাজার অসামরিক নরনারী নিহত হচ্ছেন। তাদের উপর পাক বিমান বহরের বােমা পড়ছে। পশ্চিমা সৈন্যদলের বেপরােয়া হত্যাকান্ড থেকে বাঁচবার জন্য অসহায় নরনারী ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে কোন প্রতিবেশী সভ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চুপ করে বসে থাকতে পারে না। যদি থাকে তবে তা হবে মানবতার দুরপনেয় অপমান। এ কলঙ্কের ডালি নিজের মাথায় টেনে নেয়া ভারতের পক্ষে অসম্ভব। তাতে যদি ইসলামাবাদের দানবেরা চটেন, চটুন। তাতে কিছু আসে যায় না।
পাকিস্তানের চালাকি ছকবাঁধা পথে চলে। শান্তির সময় সে মুখে বলে, তার পররাষ্ট্রনীতি প্রায় জোটনিরপেক্ষ। আর আপকালে পাক-সামরিক নেতারা ধর্ণা দেন সেন্টোর দরজায়। পাকিস্তান এখন প্রমাণ করতে চাচ্ছে।
যে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুযােগ নিয়ে ভারত পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণে কিম্বা তাকে নাজেহাল করতে উদ্যত। সেন্টোর চুক্তি অনুযায়ী অন্যান্য শরিক বিপদাপন্ন পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য। ইরান এবং তুরস্কের সমর নায়কদের সঙ্গে চলছে ইয়াহিয়ার সলা-পরামর্শ। পাক-ডিটেটর এখন বুঝতে পারছেন যে, নিজের জোরে তিনি বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের ঘায়েল করতে পারবেন না। তার সৈন্যদল গােটা কয় শহরে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। যতদিন যাবে তাদের অবস্থা তত সঙ্গীন হয়ে উঠবে। বর্ষ এলে তাদের উৎখাত প্রায় অনিবার্য। লড়াই দীর্ঘদিন চলবে। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার অদূর ভবিষ্যতে দখলদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বেন। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতিও হয়ত তারা পাবেন। এ সম্ভাবনাকে এড়াতে হলে ইয়াহিয়ার দরকার আরও সৈন্য, পরিবহন বিমান এবং সমর সম্ভার ।। তুরস্ক এবং ইরানের কাছে তার নিম্নরূপ প্রত্যাশা। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম ব্লক ইয়াহিয়ার আর একটি আশ্রয় কেন্দ্র। মালয়েশিয়া এবং সৌদী আরব ঐস্লামিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। মালয়েশিয়া এবং সৌদী আরব ইতিমধ্যে হাত গুটিয়েছে। তাদের চোখে, বাঙলাদেশের ঘটনা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। পাইকারী হারে বাঙালী মুসলিম হননের নারকীয় অভিযান এদের মনে কোন দাগ কাটছে না। কিন্তু এই ধরনের হত্যাকান্ড যদি ইস্রাইল অধিকৃত আরবভূমিতে ঘটত তবে তারা কি করত? এ প্রশ্ন মনে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। জর্ডানের আভ্যন্তরীণ সমস্যার হস্তক্ষেপের অভিযােগ একমাত্র বাদশা হুসেন ছাড়া সেদিন অন্য কেউ করে নি। আজ ইয়াহিয়া তুলছেন পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় ভারতীয় হস্তক্ষেপের অভিযােগ। তিনি চান, পাকসৈন্যদল নির্বিচারে অসামরিক বাঙালী হত্যা করবে, আর সারা বিশ্ব তা দূরে দাঁড়িয়ে দেখবে।
নয়াদিল্লীর পাল্টা প্রচার অভিযান চালানাে অবশ্য দরকার। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তাকে হতে হবে বেশী পরিমাণে সক্রিয়। বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যা পূর্বে বিবরণ বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসগুলােকে এবং বিশ্ববাসীকে জানানাে নয়াদিল্লীর আবশ্যকীয় কর্তব্যের অঙ্গ। ইয়াহিয়ার হাতে যদি রক্তচিহ্ন না থেকে থাকে তবে আন্তর্জাতিক রেডক্রশকে বাঙলাদেশে যেতে দিতে তার আপত্তি কেন? এই সংস্থাতত কোন রাজনৈতিক প্রচারের যন্ত্র নয়। আর্তত্রাণ তাদের মৌল ধর্ম। এদের কাজে বাধা সৃষ্টি ইসলামাবাদের শয়তানি মতলবের অকাট্য প্রমাণ। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ কমিশনও রয়েছেন। তারাও যান বাঙলাদেশে। দেখে আসুন, নারী, শিশু এবং খেটে খাওয়া মানুষের শবাকীর্ণ জনপদগুলাে। সফর শেষে তারাই বলুন মিথ্যাবাদী কে? নয়াদিল্লী না ইসলামাবাদঃ ইয়াহিয়ার গণহত্যা মুসলিম দুনিয়া এবং ইউরােপের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের বিশালতা সবার সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব নয়াদিল্লীর। কারণ বাঙলাদেশ তার প্রতিবেশী। এখানকার রক্তের ঢেউ ভারতের সাধারণ মানুষের বিবেকে আঘাত হানতে বাধ্য। যে নাটকের আজ তারা সমব্যর্থ দর্শক, কাল হয়ত তারা হবেন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সহযােগী। এই সম্ভাবনা আছে বলেই নয়াদিল্লীর আশু প্রয়ােজন পাল্টা প্রচার অভিযান।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৫ এপ্রিল ১৯৭১