You dont have javascript enabled! Please enable it!

খন্দকার আসাদুজ্জামান (সিএসপি ১৯৬০)

জানা যায়, “..জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান..ছিলেন,.মুজিবনগর কর্মাচারী সমিতির ..প্রেসিডেন্ট।”১২  স্বভাবত অনুমেয় সেই সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীকূলে তার গ্রহণযােগ্যতা এবং অপরিহার্যতা। ১৯৬৫ সাল ব্যাচের সিএসপি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সৈয়দ আব্দুস সামাদ (প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মুখ্যসচিব ও চেয়ারম্যান, বিনিয়ােগ বাের্ড) এর সম্বন্ধে লিখেছেনঃ “খন্দকার আসাদুজ্জামান (১৯৬০ এর সি.এস.পি) সর্বজ্যেষ্ঠ সচিব। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। অসীম ধৈর্যশালী। শত শত লােক প্রতিদিন তার দপ্তরে ভিড় করতেন। ভাতা চাকরি ইত্যাদির জন্য। আমি যে কয়েকবার তার অফিসে যাওয়ার সুযােগ পাই তার প্রতিটি বারেই তিনি একই স্টাইলে তার প্রায় ধন্যবাদহীন দায়িত্ব পালনে রত ছিলেন। হাসিমুখে প্রতিটি দর্শনার্থিকে (দর্শনার্থীকে) তিনি বলতেনঃ আপনার ছােটো জীবন বৃত্তান্ত আর এখানে যােগাযােগের ঠিকানা রেখে যান। আমরা সময় মতাে আপনাকে ডাকবাে। তারপর তিনি তাদের প্রাপ্য এককালীন ‘সাবসিসটেন্স বা কায়ক্লেশ ভাতা’ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তিনি এক চিলেকোঠায় (আনােয়ারুল করিম চৌধুরির বাড়ির) তাবু খাটিয়ে সেখানে সপরিবার থাকতেন! এটা ভাবতেও অবাক লাগে। কিন্তু কখনও কোনাে অভিযােগ শুনিনি। বরং বলতেনঃ চাকরি আর আরাম করতে তাে এখানে আসি নি। এসেছি যুদ্ধ করতে। যুদ্ধের সময় কিছুটা অসুবিধা যদি নাই হলাে তাহলে সেটা কোন ধরনের অংশগ্রহণ? দেশ স্বাধীন হলে এগুলাে সব ভুলে যাবে।”১৩

আব্দুল খালেকের পূর্বোক্ত আত্মজবানিসূত্রে জানা যায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কলকাতাস্থ হাই কমিশনে পৌঁছে সেখানকার ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হােসেন আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান, নুরুল কাদের খান ও আরও কয়েকজনের। তাঁর কথায়: খন্দকার আসাদুজ্জামান, নুরুল কাদের ও আমি একসঙ্গে নেতাদের সঙ্গে দেখা করে একটি প্রবাসী প্রশাসন গড়ে তােলার উপদেশ দেই। আমাদের মতে স্বাধীনতা ঘােষণা করে ঘরে বসে দিশেহারা হয়ে থাকলে চলবে না। আমাদেরকে সংঘবদ্ধ হতে হবে এবং যুদ্ধের জন্য সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং সে জন্যে চাই একটি প্রশাসন যন্ত্র। আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমাদেরকেই যথােচিত বিধিব্যবস্থা তৈরী করার ভার দেয়া হলাে।”১৪

কোনো সচিবের  মাঠপরিদর্শনজনিত কাৰ্যসূত্রে সদর দপ্তরে অনুপস্থিতিকালে তিনি সমপর্যায়ের অন্যদের দায়িত্বভাগও কখনও কখনও ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। স্বভাবতই  বােধগম্য তার কাজের চাপ কী পরিমাণ ছিল! রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী লিখেছেন:    “১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ সোমবার ৩১ মে ১৯৭১/.. শ্রীজয় গোবিন্দ ভৌমি, (ঢাকা  জেলা ও দায়রা জজ) কে, বাংলাদেশ সরকার সচিব পদ মর্যাদায় রিলিফ কমিশনার হিসেবে নিয়ােগ করেন। জনাব নূরুল কাদের খান, সংস্থাপন সচিব পূর্বাঞ্চল সেক্টরের প্রশাশ(স)নিক ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়াদি সরেজমিনে দেখার জন্য সফরে আগরতলা ছিলেন। অর্থ ও স্বরাষ্ট্র সচিব খোন্দকার আসাদুজ্জামান সংস্থাপন বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।”১৫

স্বয়ং খন্দকার আসাদুজ্জামান তদীয় মার্চ, ১৯৮৪ সালের এক আত্মবিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন (প্রাসঙ্গিক অংশ উৎকলিত): “আমি সে সময় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ছিলাম। জানুয়ারীর পরে আমাকে প্রাদেশিক সরকারের অর্থ-বিভাগের যুগ্ম সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আমি ঢাকায় এসে সার্কিট হাউসে উঠি এবং চারদিকে খোজ খবর রাখতে থাকি।……./  আমি ২৩ তারিখে আমার গ্রামের বাড়ী টাংগাইলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে আলাপ হয়। ২৪ তারিখে আমার শ্যালিকা ঢাকা ছেড়ে আসে এবং আমাদের জানায় যে, ঢাকা এখন একটা ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। ২৫ তারিখে আলােচনা (বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার) ভেংগে যায়। ২৬ তারিখে ঢাকার ঘটনা আমরা জানতে পাই। এই ঘটনা শােনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা একত্রিত হন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন আগামী কর্মসূচীর। আমাকেও এই সভায় যােগদান করতে আহ্বান করা হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আমি উক্ত পরিষদের পরামর্শদাতা হিসেবে যােগদান করি। জনাব বদিউজ্জামান এই সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হন। ঘােষণা করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এই স্বাধীনতা রক্ষার্থে আমরা সর্বাত্মকভাবে লড়বাে ।/., (১৬ই এপ্রিলের পরে) রাত ১২ কি ১টার দিকে আমরা (জয়পুরহাটের হিলি) সীমান্ত পার হই। আমার মানসিক অবস্থা যে কি ছিল তা বলার নয়। এভাবে যে দেশ ছাড়তে হবে তা কোনদিন ভাবিনি। তাছাড়া মুজিবনগর সরকারের কোন সংবাদ আমি তখনও জানতাম না।/ মালদহ পৌছে ডি,সি-র সাথে দেখা করি। শুনলাম অন্য কয়েকজনও এসেছেন এই পথ দিয়ে। তার কাছে কোন নির্দেশ আসেনি তবে তিনি আমাকে মুজিবনগর সরকারের সংবাদ দিলেন। পরের দিন মুকুল (এম, আর, আখতার মুকুল) সাহেবের সাথে কোলকাতায় উপস্থিত হই এবং জনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামরুজ্জামানের সাথে দেখা করি। তাদের সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে আলাপ আলােচনা হয়। জনাব নুরুল কাদের খানের সাথে কথা হয় এবং আমাদের দুজনকে একটি সরকারের কাঠামাে তৈরী করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিছুদিন পর আমাদেরকে  সচিব হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। এর কয়েক দিন পরই জনাব হােসেন আলী মুজিবনগর সরকারের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমি অর্থ সচিব নিয়ােজিত হই এবং দূতাবাসের একটি কক্ষে আমার দপ্তর স্থাপন করি।/  আমাদের অর্থের মূল উৎস ছিল বিভিন্ন ট্রেজারী থেকে লব্ধ টাকা। এর সঙ্গে যোগ  হয় হােসেন আলী সাহেবের নিয়ন্ত্রণাধীন দূতাবাসের টাকাগুলাে । একাউন্ট রক্ষা করা এবং সরকারী অর্থের অডিট করা আমার বিভাগের প্রধান কাজ ছি। /  মজিবনগর সরকারের কাজ ছিল প্রধানত দুটি- এক. যুদ্ধ করা ; দুই শরণার্থীদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এই সাহায্য ছিল প্রধানত ভারতীয়। কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পগুলো ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের  হাতে।/ আমরা মাঝে মাঝে এই শরণার্থী শিবিরগুলােতে যেতাম।…./ উপসংহারে বলা যায় সময়টা ছিল একেবারেই বিশেষ ধরনের। নিজেদের শুধুমাত্র সরকারি চাকুরে বলে কখনও মনে হয়নি। আমরা ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। কোন কষ্টই বড় ছিলনা। কোন ত্যাগের প্রশ্নে ছিলনা দ্বিধা। কখনও ভাবিনি আমাদের কি হবে। একটা কথাই কেবল মনে হতাে- কাজটা যে করেই হােক সমাধা করতে হবে। তার জন্য যা করার দরকার সবই করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম অন্য সবার মত।”১৬

Source: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!