পাক গােলাবর্ষণে সীমান্ত রাজ্য ত্রিপুরায় ভয়াবহ পরিস্থিতি
(আসাম-ত্রিপুরা সীমান্ত রাজ্য সফরান্তে প্রত্যাগত বিশেষ প্রতিনিধি)
অবিশ্রান্ত পাকিস্তানি গােলাবর্ষণের ফলে সীমান্তরাজ্য ত্রিপুরায় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যথাযােগ্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অবশ্য করা হয়েছে, তবু সর্বত্র একটা ত্রাসের ভাব। প্রায় একপক্ষ কাল ধরে গােলাবর্ষণ অব্যাহত আছে, অথচ অসামরিক প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত বিশেষ কিছুই হয়নি। সরকারি প্রশাসন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আধুনিক যুদ্ধে অস্ত্রবল আর মনােবল তুল্যমূল্য। কিন্তু অসামরিক প্রশাসন জনসাধারণের মনােবল অক্ষুন্ন রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে জিনিসপত্রের ঠেলে ওঠা দামকে স্থিতিশীল করতে। কংগ্রেসী অন্তর্দ্বন্দ্ব অবস্থাকে আরও জোরালাে করে তুলেছে। এমত অবস্থায় সীমান্তের এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তাই, … নভেম্বর সন্ধ্যায় যখন রাষ্ট্রপতির শাসন কায়েম হলাে তখন সকলেই প্রায় একবাক্যে তাকে অভিনন্দন জানাল।
আমি গৌহাটি থেকে আগরতলা রওনা হই ৩১ অক্টোবর। আগরতলা ফ্লাইটে যাত্রী-সংখ্যা ছিল মাত্র ১২-১৪ জন। তার মধ্যে আমি, সেলইয়ের কলের জনৈক সেলসম্যান এবং একজন ইনকাম ট্যাকস অফিসার ছাড়া আর সকলেই আগরতলার লােক। গৌহাটিতে কাজে এসেছিলেন, এখন অনিচ্ছা সত্বেও উপায় নেই বলে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। সেলসম্যান এবং ইনকাম ট্যাকসের দ্রলােক সারাক্ষণ প্রার্থনা করছিলেন, আজ যেন ফ্লাইট বাতিল হয়। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে কলকাতার ফ্লাইট বাতিল হলেও আগরতলা ফ্লাইট যথাসময়েই বিমান বন্দর ছাড়ল।
আগরতলার লােকেদের পরামর্শ অনুসারে কিছু সিগারেট এবং দেশলই কিনে নিয়েছিলাম। আগরতলা পৌঁছে দেখলাম তারা সুপরামর্শই দিয়েছিলেন। আগরতলাতে সিগারেট, দেশলাই দুই-ই দুষ্প্রাপ্য এবং দামও অনেক বেশি। কথাটা অবশ্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় সব দ্রব্যাদি সম্পর্কেই প্রযােজ্য। কোন কিছুই সহজলভ্য নয় এবং সবকিছুরই দাম অগ্নিমূল্য।
সত্যকথা বলতে কি, প্রায় ফাঁকা ‘ফ্রেণ্ডশিপ’ বিমানের আরামদায়ক আসনে গা এলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে একটু ভয়ই হয়েছিল। আগরতলা বিমান বন্দর পাক-সীমান্ত থেকে মাত্র দু মাইল দূরে অবস্থিত। ইতিমধ্যে একদিন পাক-গােলাবর্ষণের ফলে এখানে বিমান অবতরণ করতে পারেনি। কী জানি আজও যদি তেমনটা হয়।
সৌভাগ্যক্রমে সেরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটল না। আগরতলা নির্বিঘ্নেই পৌছনাে গেল।
তবে পৌছেই শুনতে পেলাম, গত রাত্রে, অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর রাত্রে সারা রাত ধরে গােলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে। সকলের মুখেই এই আলােচনা। কিন্তু ত্রাসের প্রকৃত রূপটা দেখা গেল যখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হলাে। অন্ধকার হতে না হতেই দোকান-পাট বন্ধ, রাস্তাঘাট জনশূন্য। বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেলা ৩ট থেকেই। অথচ সাধারণ সময়ে নাকি রাত্রি দশটা এগারােটা পর্যন্ত রাস্তা লােকেলােকারণ্য থাকে। রাত সাড়ে আটটার সময় শহরের জনবহুল কেন্দ্রস্থল কামান চৌমােহানিতে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। হােটেলে ফেরার মতাে একটা রিকশা জোগাড় করা রীতিমত দুরূহ হলাে।
অতিকষ্টে হােটেলে ফিরে দেখলাম, সেখানে নিম্প্রদীপ অবস্থা। না, অসামরিক প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে এই নিষ্প্রদীপ নয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিকল হওয়া এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পাকিস্তানের দূরপাল্লার ফামানের পরিধির মধ্যে অবস্থিত একটি সীমান্ত রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের মতাে একটি জরুরি ব্যবস্থার যদি এই হাল হয় তাহলে সেখানকার জনসাধারণের মনে আস্থার ভাব জাগবে কী করে?
আগরতলা শহরের কয়েকটি স্থানে দু-একটি ট্রেঞ্চ চোখে পড়ল, দেখলাম দু-একটি বাড়ির সামনে কিছু বালুর বস্তা সাজানাে রয়েছে। কিন্তু খোজ নিয়ে জানা গেল ও সবই হয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, ওতে সরকারের কোন ভূমিকা নেই। সরকার ফরমান জারি করেই কর্তব্য সেরেছেন।
এদিকে মুশকিল হচ্ছে, আগরতলার মাটি এমন যে হাতখানেক খুঁড়লেই জল ওঠে। এক সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন, ৩০ অক্টোবর রাত্রে টিপ টিপ বৃষ্টি আর অর্ধেক জলে ডােবা ট্রেঞ্চের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে ডােবা ট্রেঞ্চের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে তাঁকেও রাত কাটাতে হয়েছে। ফলে গােলার হাত থেকে বাঁচলেও নিউমােনিয়ার মরবার সম্ভাবনা। কোনাে কোনাে ভাগ্যবান অবশ্য সিমেন্ট দিয়ে বাঙ্কার বানিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নগণ্য। বালুর বস্তা দিয়ে আশ্রয়স্থল নির্মাণও যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য। খালি সিমেন্টের বস্তার দাম ইতিমধ্যেই এক টাকা থেকে দু টাকা হয়েছে। এক গাড়ি বালুর দাম আগে ছিল ত্রিশ টাকা, এখন দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা। অতএব অনেকেই ভাগ্যের উপর বরাত দিয়ে বসে আছেন।
আগরতলা শহরে পাকিস্তানি গােলায় এ-পর্যন্ত পাঁচ জন নিহত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা কমলপুরেই সবচেয়ে বেশি সরকারি হিসাব অনুসারে ২৫ জন, বেসরকারি হিসেবে ৪৮ জন কিংবা ততােধিক। সীমান্তবর্তী সব কটি শহরই পাকিস্তানি গােলার লক্ষ্যবস্থল। এর মধ্যে ক্ষতি হয়েছে কমলপুর মহকুমাতেই সবচেয়ে। বেশি। বিলােনিয়া, ব্রুম, সােনা মুড়াও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব অঞ্চলের অনেক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত থেকে দূরবর্তী এলাকায় চলে গেছেন। কেউ কেউ অবশ্য গৌহাটি এমনকি কলকাতাও চলে গেছেন।
এর ফলে আর এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাঙলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ত্রিপুরায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন। নানাস্থানে নানা ত্রাণ শিবিরে এঁদের ঠাই দেওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নতুন শরণার্থীদের অনেক জায়গায় এইসব শিবিরের পাশেই কোন রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। কিন্তু এই নতুন শরণার্থীদের জন্য এখনও কোন ত্রাণ ব্যবস্থা হয়নি। ফলে বাঙলাদেশ শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় এই শরণার্থীদের ভুল বােঝাবুঝির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
একদল সুচতরভাবে প্রচার চালাচ্ছে, বাঙলাদেশের শরণার্থীরা বিপুল সংখ্যায় ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছে বলেই এই রাজ্যের উপর পাকিস্তানিদের এত রাগ। এই প্রচারে একেবারেই কোন কাজ হচ্ছে না এমন কথা বলা যায় না। | অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম শুধু প্রচারই সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয়। নাশকতামূলক কাজকর্মও বেশ
পকভাবেই চলছে। কদিন আগে আগরতলা শহরে কংগ্রেস আপিসের সামনে কারা যেন একটা শক্তিশালী ‘মাইন’ পেতে রেখে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে বিস্ফোরণের আগেই সেই ধরা পড়ে। একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সেতু কিন্তু মাইন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলােতে সশস্ত্র প্রহরার ব্যবস্থা হয়েছে।
নাশকতামূলক কাজকর্ম বিশেষ করে ধর্মনগর অঞ্চলে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে ধর্মনগরের একটি সংকীণ সড়ক পথে ত্রিপুরার যােগাযােগ। পাকিস্তানের লক্ষ্য সম্ভবত এই পথটিকে অকেজো করে দিয়ে ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে ত্রিপুরাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
পাক গােলাবর্ষণ, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, শরণার্থীর চাপ, অন্তর্ঘাত মূলক কার্যকলাপ ইত্যাদির ফলে ত্রিপুরার যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত দল ও মতের মানুষ এক হয়ে দাঁড়ালেই তার মােকাবিলা করা অসম্ভব। সি পি আইয়ের পক্ষ থেকে রাজ্যের দুই বড় পার্টি শাসক কংগ্রেস ও সিপি এমের কাছে এই মর্মে আবেদন জানাননাও হয়েছিল কিন্তু রাজ্যের কংগ্রেস কোন দলের সঙ্গেই ঐক্য গড়তে রাজী নয়। সি পি এম কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়তে রাজী। তাদের ইচ্ছা নানা কারণে জনসাধারণের মধ্যে যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে তাকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এবং নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা। অর্থাৎ দেশে যে একটা প্রায় জরুরি অবস্থা চলছে, যে কোন মুহুর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হতে পরে এই চেতনা না কংগ্রেস, না সি পি আই এম কারাের মধ্যেই নেই। সি পি আই এ রাজ্যে অপেক্ষাকৃত ছােট পার্টি, তাদের সদিচ্ছা আছে, কিন্তু কর্মক্ষমতা এখনও কম। ফলে জনসাধারণের মনােবল অটুট রাখার সংগ্রাম একনও শুরুই হয়নি। যদি রাষ্ট্রপতির শাসনে তা শুরু হয় তাহলেই তার কার্যকরতা প্রমাণিত হবে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১২ নভেম্বর ১৯৭১