You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : বৃহস্পতিবার ১৮ই মাঘ, ১৩৭১ ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

রাজধানীতে বসন্তরোগের প্রাদুর্ভাব

কোকিলের কন্ঠসঙ্গীত মুখরিত ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী পরধ্বনির সঙ্গেই রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল দাপট শুরু হয়েছে। বসন্তরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমণঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যুর হারও রীতিমতো আশঙ্কাজনক। প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলের কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র ঢাকায় গত এক মাসে বসন্তরোগে মৃত্যুর সংখ্যা চারশ’। মাত্র একদিনে আজিমপুর গোরস্থানে ২৯ জনকে দাফন করা হয়েছে বলে প্রকাশ। যে সমস্ত এলাকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে সেগুলো হলো নীলক্ষেত, বাবুপুরা রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, করিমুল্লাহবাদ, লালবাগ, জাফরাবাদ, সোনাটাঙ্গুর ও জয়পাড়া বস্তিসমূহ। এ ছাড়াও নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, বাবুবাজার সহ পুরাতন ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে প্রতিদিন বসন্তরোগে মানুষ মারা যাচ্ছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার পর পরই বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। তাঁদের মতে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২০ জন। তবে তারা একথাও স্বীকার করেন যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা প্রকৃত সংবাদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি। প্রতিষেধক গ্রহণের ভয়ে অনেক বস্তিতেই মৃত্যু অথবা রোগাক্রান্ত হবার খবর প্রকাশ করা হয়না। তবে অনুমান করা যাচ্ছে যে বসন্তে মৃত্যের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ২৫ জনের কম নয়। রাজধানীতে বসন্তরোগের বিস্তৃতি ঘটেছে তাতে সকলেই যে আতঙ্কিত হবেন এতে কোন সন্দেহ নেই।

কথায় বলে আরোগ্য লাভের চেয়ে প্রতিষেধকই অধিকতর শ্রেয়। অথচ ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এ সহজ সরল কথাটিকে যেন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। অতীতেও দেখা গেছে এবং এখনো দেখা যাচ্ছে যে, সংক্রামক রোগ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার পরই কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। শুরু হয় টাকা অথবা ইনজেকশন অভিযান। পত্র-পত্রিকায় এতদসংশ্লিষ্ট সংবাদাদি পরিবেশনের প্রতিযোগিতা। তারপর আবার থে-কে সেই! নট নড়ন চড়ন নট কিছু।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি মাত্র প্রশ্ন পৌর কর্তৃপক্ষকে করতে চাই যে,  অবস্থার অবনতি তো একদিনে ঘটেনি-ঘটতে সময় লেগেছে। আর এ সময়ের মধ্যে পৌর কর্তৃপক্ষ কি করেছেন? অবশ্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে কর্তৃপক্ষ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় টিকাদান সম্পর্কিত যত সংবাদ পরিবেশন করেছেন তাতে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষেধক টিকা-ইনজেকশন দান কর্মসূচী অনুযায়ী ঢাকা শহরে ১লক্ষ ২৫হাজার ৯শত ৪৭জনকে বসন্তের টিকা, ৬লক্ষ ৩৬হাজার ৩শত ১৫জনকে টি এ বি সি ইনজেকশন সহ কলেরা ইনজেকশন দেয়া হয়। এছাড়া আরও ৮ লক্ষ ব্যক্তিকে কলেরা ও বসন্ত প্রতিষেধক টিকা-ইনজেকশন দেয়া হয়েছে।

কর্তপক্ষের ঘোষণা মোতাবেক যদি প্রতিষেধক টিকা বা ইনজেকশন দেয়া হয়ে থাকে তাহলে বসন্তরোগের বিস্তৃতি এতটা মারাত্মক আকার ধারণ করে কি ভাবে? এই প্রশ্নটাও স্বাভাবিক ভাবে উথাপিত হবে। তাছাড়া যতজন মানুষকে টিকা-ইনজেকশন দেয়া হয়েছে তার তুলনায় রাজধানীর লোকের সংখ্যা অনেক বেশী। এক বছর সময়ের মধ্যে তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলোনা কেন?

বসন্তরোগ প্রথমে যেসব এলাকায় প্রথম শুরু হয় সেগুলো হলো বস্তি এলাকা ঢাকায় বস্তির সংখ্যা কম নয়। এবং ক্রমশঃ তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পৌরসভার জৈনিক মুখপাত্র বলেছেন, প্রতিষেধক টিকা-ইনজেকশন দিতে গিয়ে প্রায় বস্তিতেই বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। ভয়ে কিংবা বিভিন্ন কারণে বস্তিবাসীরা টিকা-ইনজেকশনকে এড়িয়ে চলে। অনেক বস্তিতেই রোগের কথা গোপন করা হয় এমন কি গুরুতররূপে আক্রান্ত ব্যক্তিকেও চৌকির তলায় লুকিয়ে রাখা হয়।

দেশে নিরক্ষরের সংখ্যা যেখানে বেশী সেখানে এহেন সমস্যা ও সংকটের সৃষ্ট হবেই। তাই বলে যদি কর্তৃপক্ষ হাল ছেড়ে দিয়ে বসেন তাহলে অবস্থা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে। তাছাড়া বস্তি এলাকায় অধিবাসীরা টিকা-ইনজেকশন গ্রহণে ইচ্ছুক নন বলেই প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলোনা এমন যুক্তিও ঠুনকো যুক্তি। যে ক্ষেত্রে রোগীকে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন সেক্ষেত্রে রোগীর আতচীৎকার ধ্বনি শোনার পর চিকিৎসক হাল ছেড়ে দিয়েছেন এমন কোন ঘটনার কথা আমাদের জানা নেই। রোগীর মঙ্গলের কথা জন্যই অস্ত্রোপচার করতে হয় চিকিৎসকে। টিকা বা ইনজেকশন প্রদানের ক্ষেত্রেও সে কথা প্রযোজ্য। প্রয়োজনে পুলিশ, রক্ষাবাহিনী অথবা স্থানীয় সমাজকল্যাণ কর্মীদের সাহায্য নিয়ে টিকাদান অভিযানকে সাফল্যমন্ডিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নেয়না-নিতে চায় না এমন যুক্তি অচল। রাজধানীর সকল নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার জন্যই  তা করতে হবে।

পরিশেষে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিপর্যের প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। পৌরসভার যেসব কর্মচারী যাদের উপর টিকা বা ইনজেকশন দেওয়ার দায়িত্বভার অপিত তাদের মধ্যে অনেকেই টিকা বা ইনজেকশন না দিয়েই ভূয়া নাম-ঠিকানা খাতায় লিখে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন। কর্তৃপক্ষকে এদিকে সম্পূর্ণ সজাগ হতে হবে। নাগরিকদের দায়িত্ব যে সংক্রামক ব্যাধিকে রোধ করার ব্যাপারে একবারেই নেই-এমন নয়। নাগরিকদেরও এগিয়ে আসা উচিৎ বসন্তের মত সংক্রামক ব্যাধিকে প্রতিরোধ করার জন্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!