You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.04 | সােভিয়েট রাশিয়া কি সক্রিয় হবে? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সােভিয়েট রাশিয়া কি সক্রিয় হবে?

ঘুমন্ত বিশ্ববিবেক আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। বাংলাদেশের রক্ত নদীর ঢেউ সাগরের পারের রাষ্ট্রগুলােকে দোলা দিচ্ছে। আগামী ক’দিনের মধ্যেই হয়ত সর্বাত্মক নিন্দার ভাষা রাজনৈতিক রূপ নেবে। ইয়াহিয়ার গণহত্যার অভিযান থামে নি। আসন্ন পরাজয়ের মুখে তার ঘাতক বাহিনী হয়ত বাঙালীর উপর নির্মম প্রতিশােধ নেবে। সােভিয়েট রাশিয়া এত দিন ছিল নির্বাক। তার প্রচারযন্ত্র পায় নি লক্ষ লক্ষ ক্ষরিত শােণিতের উঞ্চ তাপ। আজ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। বাংলাদেশের আর্তনাদ পৌছেছে সােভিয়েট রাশিয়ায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে সম্পাদকীয় মন্তব্য। তারা ইয়াহিয়ার নরমেধ যজ্ঞের বীভৎসতায় শিউরে উঠছেন। জানাচ্ছেন সােভিয়েট রাশিয়া আলােচনা শুরু করেছে ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের সঙ্গে। বাংলা দেশের হত্যালীলা বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টিই নাকি তার প্রধান উদ্দেশ্য। এর সাফল্যের সম্ভাবনা কতখানি তা নিশ্চয় করে বলা মুশকিল। বাংলা দেশের দেয় তবে রাতারাতি অবস্থা পাল্টে যাবে। ইয়াহিয়ার নিরেট মাথা নিমেষের মধ্যে মাটিতে থুবড়ে পড়বে। বৃহৎ শক্তিগুলাের বাজনৈতিক চাল আন্তর্জাতিক প্রভাব সৃষ্টির ছকে বাঁধা। মানবতার প্রশ্ন সেখানে গৌণ । সােভিয়েট রাশিয়ার ট্রেড ইউনিয়নগুলাের মুখপাত্র স্ট্রড এবং যুব কমিউনিস্টদের মুখপাত্র কমসােমােলস্কারা প্রাভদায় ইয়াহিয়ার বর্বরতার কাহিনী প্রকাশ বিশ্ববিবেকের ঘুম ভাঙ্গার হয়ত প্রাথমিক ইঙ্গিত। মার্কিন নৈশব্দে আঘাত হেনেছেন সিনেটের এডােয়ার্ড কেনেডি। বাংলা দেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদে তার কণ্ঠ রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব ছাপিয়ে উঠেছে। ইসলামাবাদের বর্বর শাসকদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযােগ এনেছেন তিনি। মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের শর্ত ভেঙ্গে ফেলেছেন ইয়াহিয়া খান। প্রতিরক্ষার অস্ত্রসম্ভার লাগন হচ্ছে বাংলাদেশের গণহত্যায়। হাজার হাজার আহত নরনারী সাহায্যের জন্য আর্ত মিনতি জানাচ্ছেন সারা বিশ্বের কাছে। আর ইসলামাবাদের নরপশুর দল আন্তর্জাতিক রেডক্রশের ত্রাণ বিমান যেতে দিচ্ছে না পাক বাহিনীর বুলেটজর্জরিত পূর্ব বাংলায়। মানবদ্রোহীদের নারকীয় তান্ডব যাতে বাইরের লােক দেখতে না পায় তার জন্যই এই শয়তানি ব্যবস্থা। সিনেটের কেনেডি বেদনায় আর্তনাদ করে উঠেছেন। তিনি চাচ্ছেন মার্কিন সরকারের কাছে প্রতিকার। তাদের আরােপিত অস্ত্র ব্যবহারের শর্ত মানেন নি ইয়াহিয়া খান। তা মানাবার দায়িত্ব এখন মার্কিন কর্তৃপক্ষের। কানাডায়ও গড়ে উঠেছে বাংলা বন্ধু সঙ্। তাঁদেরও মানবতাবােধ আর ইসলামাবাদের কুটির পরােয়া করছে না।
এক দিকে সােভিয়েট রাশিয়ার এবং অপর দিকে যদি মার্কিন জনগণের অন্তরাত্মা জেগে ওঠে তবে ইয়াহিয়ার পাশবিক বাহু শিথিল হতে দেরী লাগবে না। মার্কিন জনমত সরকারি শাসন মানতে অভ্যস্ত নয়। ভিয়েৎনামে মার্কিন সৈন্য দলের নারকীয় হত্যায়ও তারা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যা ইতিহাসের সাম্প্রতিক নজিরগুলােকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক পাথর চাপা দিয়ে মানুষের বিবেককে আর কতদিন নির্বাক রাখা যাবে? সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম অধিবেশন চলাকালে ইয়াহিয়ার গণহত্যা সম্পর্কে সােভিয়েট পত্রিকার মন্তব্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সিনেটর কেনেডির স্পষ্ট বাচন বহুদিন স্মরণে রাখলেন দুনিয়ার শান্তিকামী জনসাধারণ। নিরস্ত্র বাংলা দেশের দুর্জয় সগ্রাম অনন্য সাধারণ। বাইরের কোন অস্ত্র সাহায্য তারা পাননি। শুধুমাত্র জনবল এবং মনােবল নিয়ে দিনের পর দিন লড়েছেন তারা আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ঘাতকের বিরুদ্ধে। দলে দলে মরছেন। তবু নতি স্বীকার করছেন না। মৃত্যুঞ্জয়ী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জয় অনিবার্য। বিশ্ব মানচিত্রের পৃষ্ঠায় স্বাধীন বাংলা দেশের নাম অবশ্যই সংযােজিত হবে। বিশ্ববিবেক যদি প্রারম্ভেই তাকে অভিনন্দন জানায় এবং নরঘাতী ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠে তবে নিদারুণ লজ্জা থেকে রেহাই পাবে বিশ্বমানব। দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ এবং সগ্রামী জনতা শত নৈরাশ্যের মধ্যেও দেখবেন আশার আলাে। জয় বাংলা এবং তার নবসূর্য তাঁদের জোগাবে অনন্ত প্রেরণা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ এপ্রিল ১৯৭১