You dont have javascript enabled! Please enable it!

তুমি আমার সােনার বাংলা

একদিন বৃটিশ শাসিত ভারতে বিদেশী শাসক বর্গের চক্রান্তে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করার ব্যবস্থা হলে, বঙ্গভূমি তথা বঙ্গ সংস্কৃতির অখণ্ডতা ঘােষণা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর প্রসিদ্ধ রাখী-বন্ধন সঙ্গীত, তুমি আমার সােনার বাংলা। ইতিহাসের কি আশ্চর্য চক্রবর্তন। ৬৫ বছর পরে ত বাংলাদেশ যখন সত্যি সত্যি বিশ্বখণ্ডিত এবং তার তার পূর্বাংশ যখন স্বাধীকার লাভের সংগ্রামে অকাতরে রক্ত দিচ্ছে, তখন সেই সােনার বাংলা গানই পূর্ব বাংলায়, যার আজকের নাম বঙ্গদেশ, হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত এবং দুই বাংলাকে তা বেধেছে এক অচ্ছেদ্য আত্মিকবন্ধনে।
স্বাধীনতার জন্যে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা একদিন অনেক মূল্য দিয়েছে। অনেক অঞ ও রক্তের বিনিময়ে যখন স্বাধীনতা এল, তখন কিন্তু অখণ্ড বাংলা পূর্ব ও পশ্চিম দুদিক থেকে দুটি হাত বাড়িয়ে একই স্বাধীনতাকে স্বাগত করতে পারল না। রাজনীতির অবুদ্ধির খেলা তাদের দ্বিধা বিভক্ত করে ফেলল। আর মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়ল বাইরে থেকে আরােপিত এক দূরত্বের পাচীর। বাস্তুচ্যুত হতগৌরব হয়ে একদল মানুষ ছিটকে পড়লেন সীমান্তের এদিকে। তাদের নাম হল উদ্বাস্তু। আজো পায়ের তলায় মাটি জোগাড় হয়নি তাদের অনেকের। কিন্তু যারা রইলেন পূর্বে, তাদেরই কি কিছু মাত্র সুখশান্তি হল? হল কি মর্যাদা লাভ?
বলা বহুল্য তাও হল না। আস্তে আস্তে তারা অনুভব করলেন, ধর্মীয় একাত্মতার নামে অসলে বাঙালীকে তাঁবেদার বানান হয়েছে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের। শিল্পবাণিজ্য, ধনাধিকার, রাষ্ট্র কর্তৃত্ব, সব করতলগত করেছেন তারা এবং বাঙালী অবস্থা গতিকেই হয়ে পড়েছেন তাদের হুকুম বরদার। তখনই জাগল বাঙালীর বঙপ্রেম, যার ভিত্ত স্থাপন করলেন তারা উর্দু হঠিয়ে বাংলা মাতৃভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হয়ে। ভূমির সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক চোখের সঙ্গে দষ্টির সম্পর্কের মত। ঐ সংগ্রামের সাফল্যই তাদের ক্রমে অনুপ্রেরণা দিল সার্বিক স্বাধিকার লাভের প্রয়াসে। আজকের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সেই প্রয়াসেরই সর্বাত্মক রূপ। এ মহাযজ্ঞের পিছনে আছে তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতি।
সমুচিতভাবেই তারা নির্বাচন করেছেন মহাকবীর অপরূপ রচনাটি জাতীয় সঙ্গীত রূপে। সমগ্র বাংলা প্রকৃতি, বঙ্গ সংস্কৃতি ও বাঙালী জীবন বােধ যেন বাজয় হয়েছে এই গানে। এই গান মুখে নিয়ে অখণ্ড বঙ্গ দেশের অগ্রনেতারা একদিন দুর্যোগের স্রোতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তাঁদের সুযােগ্য সন্ততিরা পূর্বাঙ্গানে আজ জীবনমৃত্যুর মােকাবিলায় অগ্রসর হয়েছেন একই গান মুখে নিয়ে। পদ্মা, মেঘনার তীর থেকে সেই গানের রেশ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে গঙ্গা, দামােদর, রূপনারায়নের কূলে। কোন বঙ্গ ভাষাভাষী নরনারী এই ডাকে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারেন কি?
চরম দুঃখের দিনে দুর্যোগের রক্তরাঙা রাখীই আজ দুই বাংলাকে ভাবের পথে আবার মিলিত করুক।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ এপ্রিল ১৯৭১

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!