লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন-এর লিখিত জবানবন্দি
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম (২নং) আসামি লেফটেন্যান্ট মােয়াজ্জেম হােসেন ১৯৬৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সামনে ইংরেজিতে লিখিত জবানবন্দি দেন। এর বাংলা অনুবাদ নিচে দেওয়া হলাে এই জবানবন্দিতে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযােগ অস্বীকার করেন। এছাড়া এতে তার ওপর বন্দী অবস্থায় চালানাে চরম নির্যাতনের চিত্রটিও ফুটে উঠেছে। “পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কোনাে এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমি জড়িত বলে আমার বিরুদ্ধে যে অভিযােগ আনা হয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যা। আমার বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও ভিত্তিহীন অভিযােগ আনা হয়েছে আমি সেসব সুনির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। ১৯৫০ সালে আমি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগদান করি। ওই বছরই আমি বৃটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হই এবং বৃটেনে চলে যাই। এই প্রশিক্ষণে তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক উভয় বিষয়ে শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি নম্বর পেয়ে রাজকীয় নৌবাহিনীর নিয়মানুযায়ী কমিশন পাই। বৃটিশ নৌবাহিনীর অনুমােদনক্রমে আমি পাকিস্তান নৌবাহিনীতেও কমিশন পাই এবং পরবর্তী প্রশিক্ষণের জন্য পুনরায় বৃটেনে চলে যাই। ১৯৭৫ সালে আমি পাকিস্তানে ফিরে আসি এবং এক বছর পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কাজ করার পর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিশেষজ্ঞের কোর্স করার জন্য নির্বাচিত হয়ে আবারও বৃটেনে যাই। এই কোর্স শেষ করে ১৯৬০ সালের মে মাসে আমি পাকিস্তান ফিরে আসি।’
বৃটেন থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নির্ধারিত কোর্স এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিশেষজ্ঞের কোর্স সাফল্যের সঙ্গে শেষ করার ফলে আমি নিম্নোক্ত ডিগ্রিসমূহ অর্জন করি(ক) গ্রাজুয়েট অব দি ইনস্টিটিউট অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারস (যুক্তরাজ্য), (খ) অ্যাসােসিয়েট মেম্বার অব দি ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ারস (যুক্তরাজ্য), (গ) মেম্বার অব দি বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং সােসাইটি, (ঘ) যুক্তরাজ্যের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রথম শ্রেণীর ইঞ্জিনিয়ারিং হিসেবে সার্টিফিকেট, (ঙ) মেম্বার অব দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ারস (যুক্তরাজ্য)। ১৯৬৭ সালের শুরুতে আমি আমার বর্তমান পদে উন্নীত হই। আমি চাকরিতে যােগ দেওয়ার পর থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কখনাে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার সুযােগ পাইনি। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে আমি চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হই এবং সেখান থেকে পূর্ব পাকিস্ত নি অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থায় ডেপুটেশনে যাই। ১৯৬৭ সালের ১১ মার্চ আমি ওই সংস্থায় যােগ দেই এবং বরিশালে নিয়োেগ লাভ করি।’ ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসের কোনাে এক সময় আই ডব্লিউ টি এ-র সচিব আমাকে ঢাকায় পাঠান এবং জানান যে, একটি গােপন মিশনে আমাকে রাওয়ালপিন্ডি যেতে বলা হয়েছে। ননী হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানাে একটি গােপন তারবার্তার কপি তিনি আমার হাতে দিলেন। ওই সাংকেতিক গােপন কপিটি প্রমাণপত্র হিসেবে এখানে উপস্থাপন করেছি। বােধহয় এর পরের দিন আরেকটি তারবার্তা আসে যাতে আমাকে ১৯৬৭ সালের ৪ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডি পৌছতে বলা হয়। আমি ৩ ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করি এবং ওইদিন বিকেল সাড়ে চারটায় পিন্ডি পৌছি। আই ডব্লিউ টি এ কর্তৃপক্ষ নৌ সদর দপ্তরে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আমার পিন্ডি পেীছার সময় জানিয়ে দিয়েছিলেন। ওই টেলিগ্রামের কপিও এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ ‘প্রেরিত তারবার্তা অনুযায়ী পিন্ডি বিমান বন্দরে সাদা পােশাক পরিহিত দুজন লোেক আমাকে স্বাগত জানায়। পরে বন্দী অবস্থায় এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় জানতে পারি যে, ওই দু’জন ছিলেন লে. কর্ণেল আমীর এবং লে. কর্ণেল হাসান। বিমান বন্দর থেকে আমাকে কোনাে সামরিক ব্যারাকের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। জায়গাটি দেখে কোনাে সামরিক এলাকা বলেই মনে হচ্ছিলাে, পরে আমি জানতে পারি যে, সেটি ছিল আর্মি ইন্টারােগেশন সেন্টার’। ওই অফিসে নিয়ে আমার দেহ তল্লাশি করা হয় এবং আমার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে নেওয়া হয়।’
ইতিমধ্যে আরেক ব্যক্তি দুই কর্ণেলের সঙ্গে যােগ দেন। এরপর তারা আমাকে আমার পূর্ববর্তী অবস্থা, পারিবারিক পূর্ব পরিচয়াদি, আমার আত্নীয়-স্বজন, যােগ্যতা, যুক্তরাজ্যে আমার নাবিক জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। আমি পুরােপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারবার্তায় বলা ছিল যে, আমাকে একটি সভায় যােগ দিতে হবে। আর আমাকে কিনা ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেছে। এ সময় তারা জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই নৌবাহিনী থেকে আমার অবসর নেবার কারণ জানতে চান। কিছুক্ষণ পরই তারা পুনরায় বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে রাজনৈতিক প্রসঙ্গে চলে আসেন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে সে সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিমত জানাতে বলা হয়। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে চিনি কি না। আরও জানতে চাওয়া হয়, পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি মি, মাের্শেদ, মি, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ড. মালিক, মি. শামসুল হক, মি, এ. এফ. রহমান সি এস পি, মি, রুহুল কুদুস সি এস পি, মি. কে.এ, শামসুর রহমান সি এস পি, মি, শফিউল আযম সি এস পি এদেরকে আমি চিনি কি না। এছাড়া আরও অনেকের নাম তারা বলেন যেগুলাে আমি এখন মনে করতে পারছি না। তারা একটি তালিকা থেকে এই নামগুলাে পড়ছিলেন এবং ওই তালিকায় অন্তত ৫০ জনের নাম ছিল। আমি তাদেরকে বললাম যে, আমি প্রায় ১০ বছর দেশের বাইরে ছিলাম এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে ছিলাম প্রায় ১৭ বছর। তাই এদের মধ্যে আহমেদ ফজলুর রহমান সি এস পি। ছাড়া অন্য কাউকে আমি চিনি না। এর পরবর্তী আলােচনায় কর্ণেল হাসান আমাকে বললেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যা ধারণা করছেন সে ব্যাপারে আমরাও নিশ্চিত যে, শেখ মুজিবের রাজনীতি পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা এবং অখণ্ডতার বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবকে যদি এই রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত করা না যায় তাহলে পাকিস্তানের বর্তমান অগ্রগতি অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব নয়। এই পর্যায়ে কর্ণেল আমীর টেবিল চাপড়ে বলে উঠলেন, “আমরা শেখ মুজিবর রহমান এবং তাঁর সমর্থকদেরকে ধ্বংস করে দেব।” কর্নেল হাসান আলােচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
তিনি আমার প্রতি নমনীয় এবং সুন্দর ব্যবহার করার চেষ্টা করলেন। আমাকে নিশ্চয়তা দেওয়া হলাে যে, অবসর গ্রহণের জন্য আমার আবেদন নৌবাহিনী গ্রহণ করবেন, আমাকে। পূর্ণ পেনশন দেওয়া হবে এবং অবসর গ্রহণের পরও যাতে আমি ভাল কোনাে পদে চাকরি পাই সে ব্যাপারে সরকার দেখবেন। এর বিনিময়ে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সহকর্মী বন্ধু এবং পার্টি কর্মীদের নিঃশেষ করার জন্য তাদেরকে (গােয়েন্দাদের) সহযােগিতা করার জন্য আমাকে বলা হলাে। দেশের জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন কর্মকর্তার কর্তব্য সম্পর্কে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলাে। কমিশন না পাওয়ার সময় প্রত্যেক অফিসারকে যে শপথবাক্য পাঠ করতে হয় তার কথাও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলাে এবং আমার কাছে তা ব্যাখ্যা করে বলা হলাে, দেশকে রক্ষা করা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ জন্য তিনি প্রয়ােজনীয় যে কোনাে পথ ও পদ্ধতি গ্রহণের কথা বিবেচনা করতে পারেন। সেখানে আমার মতাে সামরিক কর্মকর্তার সহায়তা একান্ত প্রয়ােজন। আমাকে একথাও বলা হলাে যে, এ সম্পর্কিত যে কোনাে ব্যাপারে আমি তাকে আমার ওপরস্থ কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত বিবেচনা করতে পারি এবং তার আদেশ আমার মেনে চলা উচিৎ। এরপর আমাকে পরামর্শ দেওয়া হলাে যে, একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে প্রদত্ত জবানবন্দীতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাদের নির্দেশমত কয়েকজনের নামে উল্লেখ করে আমাকে বলতে হবে যে, আমি তাদেরকে চিনি। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার যােগাযােগ আছে। তিনি আমাকে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এবং প্রাক্তন লােকদেরকে তার পার্টির সমর্থনে সংগঠিত করতে বলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে আমার নেতৃত্বে এই সংগঠন চলবে এবং এই সংগঠনের জন্য ভারত থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া যাবে। শেখ মুজিব আমাকে একথাও বলেন যে, যথাসময়ে ভারত থেকে অস্ত্র-শস্ত্র প্রভৃতি সামরিক সাহায্যও পাওয়া যাবে।
আমাকে আরও বলতে বলা হয় যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনের যােগাযােগ আছে এবং শেখ মুজিবের প্রতি উল্লেখযােগ্য সংখ্যক জনপ্রতিনিধি, জননেতাসহ সামরিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর এবং সিভিল সার্ভিসের বড় বড় কর্মকর্তাদের সমর্থন রয়েছে, আমি তাদের পরামর্শ মতাে কোনাে কিছুই করতে রাজি হইনি। কারণ, আমি এ সমস্ত বিষয়ে কিছুই জানতাম না, যদি তাঁদের কথামতাে কাজ করতাম তাহলে এটা হতাে সম্পূর্ণ একটি মিথ্যার বেসাতি এবং তারা যেসব লােকের কথা বলছিলেন তাদের কাউকেই আমি চিনতাম না।’ এরপর আলােচনা শুরু করলেন কর্নেল আমীর। তিনি বললেন যে, যদি আমি তাদেরকে সহায়তা করতে রাজি হই তাহলে কর্নেল হাসান যেসব সুযােগ সুবিধার কথা বলেছেন। সেগুলাে তাে পাবই, তাছাড়াও সরকারের কাছ থেকে একটা পুরস্কার পাবাে। কর্নেল আমীর আমাকে এতদূর পর্যন্ত বললেন যে, যেসব লােকের বিরুদ্ধে আমাকে বলতে হবে তাদেরকে যদি আমি ভয় পাই তাহলে সরকার আমার পুরাে পরিবারকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারে এবং সরকারি খরচেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমি সব সময়েই তাদের প্রস্তাবে রাজি হতে অস্বীকার করি । রাত ১০ টা পর্যন্ত এই আলাপআলােচনা চলে। এরপর তারা বলেন যে, তাদেরকে সহযােগিতা করার জন্য অনেক বাছাই করার পর আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছিলাে। এখন আমি যদি তাদেরকে সহায়তা করতে রাজি না হই তাহলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তাতে সরকারি পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই আমাকে তাদের দুর্ব্যবহারের মুখােমুখি হতে হবে। হয় আমাকে তাদের প্রস্তাবে রাজি হতে হবে, না হয় কোর্টে যেতে হবে। তারা সরকারের অসীম ক্ষমতার কথা ব্যাখ্যা করলেন এবং বললেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান অনতিবিলম্বেই একটি ষড়যন্ত্রের অভিযােগে অভিযুক্ত হবেন। তারা পুনরায় বললেন যে, আমি যদি তাদের সঙ্গে সহযােগিতা করতে রাজি না হই তাহলে আমার নামও কাউকে দিয়ে ওই ষড়যন্ত্রকারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা তাদের পক্ষে কোনাে কঠিন কাজ হবে না। আমাকে সার্ভিস অ্যাক্ট’-এর সাম্প্রতিক সংশােধনীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হলাে যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে আমাকেও ফায়ারিং স্কোয়াডে যেতে হেব।’
এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম যে কি হতে যাচ্ছে বা তারা কি করতে চাচ্ছেন। এবারে আমি প্রথম কর্নেলয়কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমি গ্রেপ্তার হয়েছি কিনা এবং হলে তা কোন কর্তৃপক্ষের অধীনে? তারা বললেন যে, আমাকে নৌবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ-এর অধীনস্থ বিশেষ কর্তৃপক্ষের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখন আমি সেই গ্রেপ্তারি পরােয়ানা দেখাতে বললাম এবং আইনানুযায়ী আমাকে তার লিখিত কপি দিতে বললাম। এতে কর্নেদ্বয় চরমভাবে রেগে উঠলেন। কর্নেল হাসান অত্যন্ত নােংরা ভাষায় আমাকে গালি দিতে শুরু করলেন আর কর্নেল আমীর তার কোমরের বেল্ট খুলে তা দিয়ে আমাকে আঘাত করতে শুরু করলেন। এরপর তারা পাশের কক্ষ থেকে একজন লােক ডেকে তাকে নির্দেশ। দিলেন আমাকে একটি সেলে বন্দী করে রাখার জন্য। সেই সেলটি ছিল একটি ছােট্ট কক্ষ। ঢােকার পথে দুটি দরজা। বাইরের দিকেরটি ইস্পাতের পাত দিয়ে তৈরি আর ভিতরের দিকেরটি লােহার রডের গ্রিল দিয়ে তৈরি। এই কক্ষে কোনাে জানালা বা ভেনটিলেটর ছিল না, ছিল না কোনাে বাতি। এই সেলে ঢােকানাের আগে আমাকে সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলতে বলা হলাে। পিন্ডিতে তখন শৈত্য প্রবাহ বইছিলাে এবং আমার সমস্ত অনুভূতি বলছিল সব কাপড়-চোপড় দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে। ‘রাত প্রায় ৪টার সময় দুই কর্নেল আমাকে দেখতে এলেন। তারা আমাকে অফিস কক্ষে নিয়ে পুনরায় আগের মতাে আলােচনা শুরু করলেন। সেদিন ছিল প্রথম রমজান। আলাপআলােচনার এই পর্যায়ে আমি সেহরির জন্য বললাম। এই কথা বলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করা হল যে, বাঙালি মুসলমানদের জন্য রােজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। কারণ আসলে তারা হিন্দুদের জারজ সন্তান। এরপর কর্নেল হাসান বললেন, আমি প্রকৃত মুসলমান কিনা সে বিষয়ে তাদের নিশ্চিত হওয়া প্রয়ােজন এবং কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আমাকে জোরপূর্বক উলঙ্গ করা হয়। রাতের প্রথমভাগে যেসব বিষয়ে রাজি হবার জন্য আমার ওপর চাপ প্রয়ােগ করা হয়েছিল এখনও সেগুলােরই পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছিল।
প্রায় দু’ঘন্টা ধরে এই জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব চলে এবং এই পুরাে সময়টাই আমাকে হার্টুতে ভর দিয়ে দু’হাত ওপর দিকে তুলে থাকতে হয়েছে। তাদের প্রস্তাবে আমার যে কোনাে রকম অস্বীকৃতি এবং আমার অবস্থার একটু নড়চড় হলেই তারা কিল-চড়, লাথি-ঘুষি এবং লাঠি দিয়ে আঘাত করছিল। এরপর আমাকে পুনরায় সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ‘এই দুই কর্নেল প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় দু’বার আমার ওপর নির্যাতন চালাতেন। জিজ্ঞাসাবাদের ধরন ও প্রশ্ন ছিল প্রায় একই। একদিন নির্যাতনের সময় তারা আমাকে চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে চোখের সামনে খুবই উজ্জ্বল ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে দেয়। আমি তাদেরকে অনুরােধ করলাম এই পদ্ধতিটি বাদ দিতে। কারণ আমার চোখে সমস্যা ছিল এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছিল উজ্জ্বল রােদেও খালি চোখে না যাবার। তারা আমার অনুরােধ উপেক্ষা করলেন। ওপরন্থ কর্নেল হাসান আমার চুলের মুঠি ধরে মাথা সােজা করে রাখেন যাতে আমার চোখে-মুখে পুরােপুরি আলাে পড়ে। আমি যখনই চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছেন। এই অবস্থায় তারা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে বললাে কতগুলাে বিষয়ে স্বীকারােক্তি দেবার জন্য। যেমন, আমি ভারতে গিয়েছিলাম, আমি ঢাকায় কয়েকটি অনুষ্ঠানে জনৈক পি. এন. ওঝাকে দেখেছি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণ করে। আরও অনেক বিষয় তারা আমাকে আরও চাপ দিচ্ছিল অভিযুক্ত পার্টি আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা প্রকাশ করার জন্য, তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডারের খোজ দেবার জন্য ইত্যাদি। যেহেতু এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না সেহেতু সবকিছুই অস্বীকার করছিলাম। এ সময়টা ছিল আমার পিণ্ডি পৌছার ৩৬ ঘন্টা এবং আমি কোনাে কিছু না খাওয়ার ৪০ ঘন্টারও বেশি সময় পরে। আমি খুবই পরিশ্রান্ত, নিঃশেষিত ও দুর্বল পয়ে পড়ছিলাম, তাঁর ওপর এই অমানুষিক নির্যাতনে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি এবং কে কখন, কিভাবে আমাকে চেয়ার থেকে মুক্ত করেছিল তা আমি বলতে পারব না। পিণ্ডিতে আটক থাকা অবস্থায় এ ধরনের ঘটনা আরাে একবার ঘটেছিল। এইভাবে অবিরাম নির্যাতন এবং না খাওয়ার ফলে আমি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ি।
এই অবস্থায় এক পর্যায়ে আমি তাদেরকে সহায়তা করতে রাজি হই। এরপর আমার ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়। আমাকে কম্বল ও বিছানা দেওয়া হয় এবং খেতে দেওয়া হয়। এর কয়েক ঘন্টা পরে কর্নেল আমীর এসে আমাকে জানান যে, আমার জবানবন্দী পিণ্ডিতে নয়, ঢাকায় রেকর্ড করা হবে। এও বলা হয়, ওই দুই কর্নেলও ঢাকায় আসবেন এবং আমাকে সহায়তা ও দেখাশুনা করবেন। আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৭ সালের ৭ ডিসেম্বর আমাকে ঢাকায় আনা হয় এবং ইন্টারােগেশন সেন্টারের একটি সেলে বন্দী করে রাখা হয়। আমার ঢাকায় পৌছানাের পর সন্ধ্যাবেলা কর্নেলদ্বয় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং একটি লিখিত বিবৃতি আমার হাতে দেন যেটি তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। আমাকে দিয়ে পাঠ করাতে চান। আমাকে বলা হয় যে, যে রকম লেখা রয়েছে সে রকমভাবেই পরের দিন সকালে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ওটা পাঠ করার জন্য যেন নিজেকে প্রস্তুত করি। আমার সেলে যেহেতু কোনাে আলাে ছিল না সেহেতু ওই বিবৃতি পড়ে দেখার জন্য আমাকে এ ভবনেরই একটি অফিস কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। পড়ে দেখলাম, বিবৃতির বিষয়বস্তু তারা ইতিপূর্বে পিণ্ডিতে নির্যাতন করে সে সব বিষয় আমাকে দিয়ে বলাতে চেয়েছেন সে রকমই। এ ধরনের একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার অর্থ হচ্ছে আমার মৃত্যু পরােয়ানায় স্বাক্ষর করা। শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, আরও কয়েকজন লােকের জন্য ব্যাপারটি একই রকম, যাদেরকে আমি জীবনে কখনও দেখিনি আর দেখবাে না। সুতরাং আমি জবানবন্দি না দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম।’ পরের দিন সকালে দু’জন কর্নেল এলে আমি তাদেরকে আমার সিদ্ধান্ত জানাই। এরপর থেকে ১৯৬৭ সালের ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার ওপর একটানা নির্যাতন চালানাে হয়। একদিন আমাকে অন্য দু’জন লােকের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় যাদেরকে আগেই আই এস আই অধিদপ্তরের ব্রিগেডিয়ার আকবর এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের মি. রিজভী বলে চিনেছিলাম। এই প্রথমবার আমাকে কোনাে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সামনে আনা হলাে।
ফলে আমি তাদেরকে জানালাম যে, আমার ওপর গত ৩ ডিসেম্বর থেকে অবিরাম নির্যাতন চালানাে হচ্ছে। কিন্তু তারা আমার কথায় কোনাে আমল দিলেন না বরং ওই কর্নেলের মতাে একই কৌশল প্রয়ােগ করতে শুরু করলেন। তারা আমাকে বললেন যে, আমি যদি কয়েকটি চিঠি লিখতে রাজি হই তাহলে আর আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দী দেবার জন্য চাপ দেওয়া হবে না এবং বাড়িতে যেতে দেওয়া হবে। তাদের কথাবার্তায় আমি বুঝলাম যে, অন্য কারুর বিরুদ্ধে অভিযোেগ গঠন করার জন্য আমার লেখা চিঠিকে তারা ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। এই পর্যায়ে আমি চিঠি লিখতে রাজি হলাম। এতে ব্রিগেডিয়ার সাহেব এতােই খুশি হলেন যে, আমাকে কোনাে অফিসার্স মেসে রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ মােতাবেক আমাকে তৃতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। “ওই দিন দুই কর্নেল এসে আমাকে সেনানিবাসে ভি আই পি মেসে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি আরেক জনের দেখা পাই। পরে জেনেছিলাম, তিনি মেজর নাসের। সেখানে আমাকে ইংরেজিতে টাইপ করা কয়েকটি কাগজ দেওয়া হয় এবং বলা হয় যে, চিঠির ফরমে হুবহু ইংরেজি এবং তার বাংলা অনুবাদ লিখতে হবে। সেই টাইপ করা খসড়া চিঠিগুলাে পড়ে দেখলাম, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনের দেবার জন্য যে বিবৃতির কপি আমাকে দেওয়া হয়েছিল এই চিঠির ভাষাও ঠিক সেই রকম। আমি খুব হতাশ হয়ে পড়লাম। মুক্তি পাবার সকল আশা আমার মাথা থেকে মুহুর্তে উবে গেলাে। আমি কর্নেলদের বললাম যে, এ ধরনের চিঠি আমি লিখবাে না। ফলে, তারা পুনরায় আমার ওপর নির্যাতন শুরু করেন। ১২ ডিসেম্বর আমার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে না পড়া পর্যন্ত এই নির্যাতন চলতে থাকে। এ সময় আমার অবস্থা এতােই খারাপ হয়ে পড়ে যে আমাকে মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিন রাতে কর্নেল আমীরের ঘুষিতে আমার একটি দাঁত পড়ে যায়।
সেই দাঁতটিও এখানে উপস্থাপন করার ইচ্ছা আমার ছিল। ওইদিন মেজর নাসের আমাকে মেসে নিয়ে গেলে আমি তাকে আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের কথা বলি। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে ওই কক্ষ ত্যাগ করতে দেখােনি? আমি একটা পশুর ওপরও অমন নির্যাতনের কথা ভাবতে পারি না। মেজর নাসেরের এই কথায়ই আমার ওপর পরিচালিত অকথ্য নির্যাতনের প্রকৃতি বুঝা যায়।” ‘মেসে নেবার পর আমাকে দেখার জন্য একজন ডাক্তার এলেন। আমাকে পরীক্ষা করার পর তিনি কর্তব্যরত অফিসারকে বললেন যে, আমার হাঁটা-চলা বা নড়াচড়া করা চলবে । প্রচণ্ড জ্বর ছিল আমার শরীরে, মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে গিয়েছিল এবং সমস্ত শরীর ফুলে উঠেছিল। ডাক্তার কয়েকটি ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন। তারপর প্রায় এক মাসের মধ্যে আমি কোনাে ডাক্তারের দেখা পাইনি। আমার উপর্যুপরি অনুরােধ সত্ত্বেও ১২ ডিসেম্বর ‘৬৭ থেকে ১৯৬৮ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনাে ডাক্তার আমাকে দেখতে আসেননি। এরপর হয়তাে ডাক্তারের পরামর্শে, কিংবা কি কারণে জানি না, ওই কর্নেলদ্বয় বা অন্য কেউ আমাকে বিরক্ত করতে আসেননি।’ ‘একদিন মেজর নাসের লে. কর্নেল শাহ আলী বাজ নামক এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন। এই অফিসারটি আমার সঙ্গে কিছু অভাবিতপূর্ব বিষয় নিয়ে আলােচনা করেন। ‘১৯৬৮ সালের ১২ জানুয়রি পাকিস্তান নৌবাহিনীর জনৈক লেফটেন্যান্ট শরীফ এসে। আমাকে জানালেন যে, আই ডব্লিউ টি এ-তে আমার ডেপুটেশন তুলে নেয়া হয়েছে এবং তার সঙ্গে ওই দিনই আমাকে চট্টগ্রামে যেতে হবে। তার কথা অনুযায়ী আমার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক বিরাট দুর্যোগের পর আমি তার সঙ্গে চট্টগ্রাম চলে এলাম। ‘চট্টগ্রামে আমাকে ছােট্ট একটি গুদাম কক্ষে আটকে রাখা হলাে। এই কক্ষেও কোনাে আলাে কিংবা ভেনটিলেটর ছিল না। নৌবাহিনীর একজন অফিসারকে এই ধরনের কক্ষে আটকে রাখা ছিল আইন বিরুদ্ধ। এমতাবস্থায় আমার প্রতিবাদ কর্তৃপক্ষের বধির কর্ণে প্রবেশ করলাে। এরপর প্রায় সাত দিন নৌবাহিনীর সঙ্গে ছিলাম। এ সময়ও তারা ম্যাজিস্ট্রিটের সামনে আমার একটি জবানবন্দী রেকর্ড করানাের চেষ্টা করেছেন।
এ সময় আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, সামরিক বাহিনী আমাকে অভিযুক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করার জন্য নৌবাহিনীর সামনে একটি উপায় আছে। তাহলে আমি যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কথিত জবানবন্দীটি দেই তাহলে সেটিসহ প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করে অভিযােগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। নৌবাহিনীর সঙ্গে থাকা অবস্থায় যদিও আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন হয়নি কিন্তু মানসিক নির্যাতন হয়েছে প্রচুর। আলােচনা করার অজুহাতে তারা প্রত্যেক রাতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতাে।’ ১৯৬৮ সালের ২০ জানুয়ারি আমাকে পুনরায় সামরিক হেফাজতে পাঠানাে হয়। আমাকে দ্বিতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার্স মেসের ১ নং কক্ষে আটক করা হয়। যেখানে আমি এখনও অবস্থান করছি। এখানে আটকের তিন দিন পর থেকে আমার জন্য যে প্রহরার ব্যবস্থা করা হয় তা ছিল সামরিক রীতিবিরুদ্ধ। প্রহরায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিল আমার চেয়ে নিম্নপদস্থ। তারা আমার সঙ্গে একই কক্ষে থাকতাে এবং খাওয়া-দাওয়া করতাে। অনেক সময়ই তারা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতাে। এসব নিয়ে অভিযােগ জানিয়েছি। কিন্তু এসব ব্যাপারে কখনও কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পরে আমি বুঝে নেই যে, আমাকে অপমান ও অপদস্থ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব করানাে হচ্ছে। ১৯৬৮ সালের মে মাস পর্যন্ত যেহেতু আমার জন্য কোনাে লেখার সামগ্রী বরাদ্দ ছিল না সেহেতু এসব অভিযােগ আমি লিখিতভাবে কোথাও জানাতে পারিনি। ১৯৬৮ সালের মে মাসে আমার জন্য লেখার সামগ্রী বরাদ্দ হবার পরই আমি দ্বিতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারকে লিখিতভাবে আমার অভিযােগগুলাে জানিয়েছি। ‘১৯৬৮ সালের মার্চ মাস নাগাদ আবারও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দী দেবার জন্য আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এ সময় কোনাে নির্দিষ্ট ব্যক্তি আমাকে উত্যক্ষ করেনি। আমাকে ওই সময় প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হতাে সিগনাল অফিসার্স মেসে, যেখানে মেজর হাসানের অফিস অফিস ছিল কিংবা নিয়ে যেতাে মেজর নাসেরের অফিসে এবং একটি অস্থায়ী ‘ইন্টারােগেশন সেন্টার’- ১৬ এফ এফ লাইনে। এসব স্থানে নিয়ে যাবার রুটিনও। ছিল একই ধরনের।
আমাকে নেবার জন্য যাদেরকে পাঠানাে হতাে তারা অত্যন্ত ব্যস্ততা। দেখাতাে। আমাকে বসিয়ে রাখা হতাে লনের মধ্যে কিংবা কোনাে ভােলা জায়গায়। প্রায় ঘন্টাখানেক একাকী বসে থাকার পর নির্ধারিত অফিসার আসতেন এবং বলতেন আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। তিনি আমাকে কয়েকটি সামান্য প্রশ্ন করার পর আবার ফেরৎ পাঠাতেন। যখন আমি কথা বলতে বলতে হাঁটতাম তখন বারান্দা থেকে অনেকগুলাে চোখ আমাকে দেখতাে। পরে বিচারকাজ চলাকালে কয়েকজন সাক্ষী আমাকে চিহ্নিত করেছিলেন। যাদেরকে আমি জীবনে কখনও দেখিনি। তাদের সাক্ষ্য রেকর্ড করার সময় বুঝা গেছে যে, আমি যখন লনে বা খােলা জায়গায় বসে থাকতাম কিংবা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতাম তখন এই লােকগুলােই আমাকে ভাল করে দেখতে। এই সময় কর্নেল শের আলী বাজ অসুস্থ হয়ে সমন্বিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসের কোনাে একদিন আমাকে হাসপাতালে তার শয্যাপাশে নেওয়া হয়। কর্নেল পুনরায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দী দেবার জন্য আমাকে চাপ দিতে থাকেন। তিনি আমাকে বলেন যে, তিনি ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাহায্য পাবার জন্য আশ্বাস পেয়েছেন। সুতরাং আমি জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করে বােকামি করছি। এখনও ভুল শুধরানাের সময় আছে। এখনও জবানবন্দী দিয়ে আমি নিজেকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু পুনরায় জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করলাম। এরপর একই উদ্দেশ্যে আমাকে বহুবার হাসপাতালে কর্নেলের কাছে নেওয়া হয়। অতঃপর হঠাৎ এক সময় আমাকে হাসপাতালে নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর কয়েকদিন পরে লেফটেন্যান্ট শরীফ আমার কাছে এসে জানান যে, আমার স্ত্রী অসুস্থ। কিন্তু কি ধরনের অসুস্থ তা তিনি বলেননি। পরবর্তীতে কর্নেলও আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে ওই একই সংবাদ জানান এবং আমার স্ত্রী কি ধরনের অসুস্থ তা জেনে আমাকে জানানাের জন্য তিনি কথা দেন। আমি আমার স্ত্রীকে দেখতে যাবার অনুমতি দেওয়ার জন্য কর্নেলকে অনুরােধ করলাম। কিন্তু তিনি এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করলেন যে, আমি যেহতুে তাদেরকে সহায়তা করতে রাজি হইনি সেহেতু আমাকে সাহায্য করার কোনাে উপায় তার নেই।
আমাকে বলা হলাে যে, জবানবন্দী দিয়ে আমি নিজেই কেবল আমার অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে যেতে পারি, অন্যথায় নয়। দু’একদিন আবারও কর্নেল আমাকে ডেকে পাঠান এবং জানান যে, আমার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। আমি স্ত্রীকে দেখতে যাবার জন্য কর্নেলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। কিন্তু তিনি আমার কথায়। কর্ণপাতই করলেন না। অবশেষে আমি তার ইচ্ছামতাে কাজ করতে রাজি হলাম এবং বললাম যে, যত শিগগিরই সম্ভব তিনি যেন আমার স্ত্রীকে দেখতে যেতে দেবার ব্যবস্থা করেন। তিনি আমার একথাও প্রত্যাখ্যান করলেন এই বলে যে, আমি বার বার এরকমভাবে জবানবন্দী দেবার কথা বলে আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। সুতরাং যত শিগগিরই সম্ভব জবানবন্দী দিয়ে আমি নিজেকে মুক্ত করতে এবং অসুস্থ স্ত্রী দেখতে যেতে পারি। এরপর আমাকে লেফটেন্যান্ট শরীফের সঙ্গে মেজর হাসানের অফিসে পাঠানাে হলাে এবং নির্দেশ দেয়া হলাে যে, মেজর সাহেব যত শিগগিরই সম্ভব আমার জবানবন্দী তৈরি করবেন। মেজর হাসান আমাকে বললেন যে, সম্পূর্ণ কাজের জন্য দু’একদিন সময় লাগবে। যখন আমি তাকে একদিনের মধ্যে বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য অনুরােধ করলাম তখন তিনি এতাে জরুরির কারণ জানতে চাইলেন। আমি তখন তাকে আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বললাম। মেজর সাহেব তখন আমার প্রতি সহানুভূতি জানালেন এবং আমার জবানবন্দী তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন যে, যদি আমার জানাশােনা ফোন থাকে তাহলে মেজর সাহেবের ফোন ব্যবহার করে সেখান থেকে আমার স্ত্রীর সর্বশেষ অবস্থা জেনে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে আমার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে তিনিই। লাইনটি ধরে দিলেন। ফোনে কথা বলতে গিয়ে শুনলাম, আমাকে বিস্মিত এবং হতবাক করে দিয়ে, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমার স্ত্রী কথা বলছেন। তিনি আমাকে বললেন যে, যদিও দীর্ঘ ৫ মাস যাবৎ আমার কোনাে খবরাখবর না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কিন্তু তিনি এর মধ্যে কখনও অসুস্থ হননি। এবার আমি আমার সঙ্গে এদের খেলাটা বুঝতে পারলাম।
আসলে কর্নেল সাহেব মেজর সাহেবের দয়াপরবশতার বিষয়টি হিসাবেই আনেননি যা আমাকে একটি মিথ্যা স্বীকারােক্তি প্রদান থেকে মুক্তি দিয়েছিলাে। এরপর আমি এমন ভাব দেখাতে থাকি যেন মনে হয় যে আমি জবানবন্দী দেবার জন্য খুবই উদগ্রীব। আসলে সব সময়ই আমি উপায় খুঁজতে থাকি কিভাবে কোর্টে উপস্থাপনের আগেই জবানবন্দীর একটি কপি হস্তগত করা যায় এবং শেষ পর্যন্ত জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করা যায়। জবানবন্দীটি তৈরি হবার পর আমি তাতে নানা রকম পরিবর্তনের দাবি করতে থাকি যা মেজর সাহেব এবং লেফটেন্যান্ট শরীফ মিলে করছিলেন। শেষ পর্যন্ত জবানবন্দীটি আমাকে দিয়ে বলা হয় যে, এতে আর কোনাে পরিবর্তন করা যাবে না। এরপর আমি জবানবন্দীতে উল্লিখিত বিষয়গুলাে সম্পর্কে ভেবে দেখার জন্য কিছু সময় চাই। মেজর সাহেব চলে যাবার পরে আমি জবানবন্দীটির কপিটি আমার কক্ষের লম্বা গদিওয়ালা বেঞ্চির নিচে লুকিয়ে রাখি এবং অন্য কয়েকটি টুকরা কাগজ পুড়িয়ে মেঝেতে ছাই ফেলে রাখি। ওই জবানবন্দীর একটি কপি এখানে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এরপর মেজর সাহেব যখন জবানবন্দীটি ফেরৎ নিতে আসেন তখন তাকে আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা জানাই এবং জবানবন্দীটি পুড়ে ফেলার কথা বলি। মেজর সাহেব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে ফিরে যান। ১৯৬৮ সালের ১০ মে আমাকে পুনরায় ডিভিশনাল মেসে নিয়ে কর্নেল শাহ আলী বাজের সামনে হাজির করা হয়। মেজর নাসেরও আসেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। কর্নেল সাহেব, তার ভাষায়, জবানবন্দী দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমাকে শেষ সুযােগ দেন। কিন্তু আমি এবারও যখন তা দিতে অস্বীকার করি তখন তিনি আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানাের অঙ্গীকার করেন। ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত আটক থাকাকালীন সময়ে আমাকে নিদারুণ একাকীত্বে ভুগতে হয়েছে। আমাকে কারাে সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এমনকি, আমার প্রহরীদের সঙ্গেও নয়। প্রতিদিন মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য আমাকে ঘরের বাইরে নেওয়া হতাে। ১৯৬৮ সালের মে মাস পর্যন্ত পড়া বা লেখার জন্য কোনােকিছু দেওয়া হয়নি। এমনকি তখন একটি চিঠি লেখার জন্যও আমাকে অনুমতি নিতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালের ১৮ মে পর্যন্ত আমার কোনাে আত্নীয়-স্বজন কিংবা আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। আটক থাকাকালীন সময়ে আমি মারাত্মক চোখের সমস্যায় ভুগেছি। কিন্তু এজন্য কোনাে যত্ন নেওয়া হয়নি। ফলে এখন আমার চোখের অবস্থা খুব খারাপ। আটক থাকা অবস্থায় আমার ওপর এমন নির্যাতন চালানাে হয় যার দীর্ঘমেয়াদী কুফলে ১৯৬৮ সালের জুলাই এবং নভেম্বর মাসে দু’বার আমি আমার সম্পূর্ণ কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখনও স্পাইনাল কডে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য আমি সােজা হয়ে হাঁটতে পারি না। অথচ পূর্ববর্তী মেডিক্যাল রেকর্ড অনুযায়ী আমি সব সময় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম।’ ‘এই মাননীয় ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষীগণ আমার সম্পর্কিত মিথ্যা জবানবন্দী দিয়েছেন। আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে নিম্নোক্ত বক্তব্য উত্থাপন করে তাদের জবানবন্দী মিথ্যা প্রমাণ করতে চাই।’
আমার সম্পর্কে অভিযোেগ বলা হয়েছে যে, ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি লেফটেন্যান্ট মুজাম্মিলের পি এন এস হিমালয়া বাসভবনে একটি সভায় যােগ দিয়েছি। উল্লেখ্য যে, একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। সরকারিভাবেও আমি কোনােদিন ওই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করিনি। আগেই বলেছি, আমি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বাইরে ছিলাম। তাই এসব অফিসারদের দেখিওনি। পি এন এস হিমালয়া অবস্থিত মনােরা দ্বীপে। আর ১৯৬৩ সালে আমি একটি জাহাজে কাজ করতাম এবং আমার বাসা ছিল কেডি স্কিম-১’ এ যা পি এন এস হিমালয়া থেকে ১৪ মাইল বিপরীত দূরত্বে অবস্থিত। আমি কখনও লেফটেন্যান্ট মুজাম্মিলের বাসভবনে যাইনি। তিনিও কখনও আমার বাসভবনে আসেননি। আমার চাকরি জীবনে আমি কখনও এল/এস সুলতান উদ্দিন, এল/এস নূর মুহাম্মদকেও দেখিনি। স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে বলা যায়, ১৯৬৬ সালের মে মাসে আমি যখন পি এন এস বখতিয়ারের যােগদান করি তখন তিনি অফিসার্স মেসে কর্মরত ছিলেন এবং ওই সময়ই তাকে প্রথম দেখি । আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারীকে আমি কখনােই আমার বাসায় ডিনারের দাওয়াত করিনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি আমার বাসা চেনেনও না। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় এইভাবে যে, তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আমার বাসা সম্পর্কে একটি সন্দেহজনক বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে তিনি আমার সঙ্গে ডিনার খেতে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, আমার বিরুদ্ধে অভিযােগে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে ওই সময়কালে কারসায এলাকায় আমার পােস্টিং কিংবা বাসা কোনােটাই ছিল।’ আমার বিরুদ্ধে অভিযোেগ বলা হয়েছে যে, ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি জনৈক কামালুদ্দিনের বাসায় একটি সভায় যােগ দিয়েছি। আমি আমার জীবনে এই কামালুদ্দিনকে দেখিনি এবং তার বাসায় যাইনি। করাচিতে যে এরকম একজন কামালুদ্দিন থাকেন তাও আমার জানা ছিল না। উপরন্তু ওই সময়ে আমার জাহাজ দীর্ঘকালীন মেরামতে ছিল এবং আমি তখন জাহাজে তদন্তকারী আদালতে ফেস করছিলাম। এই বিষয়টি প্রমাণের জন্য প্রাসঙ্গিক রেকর্ডপত্র কোর্টে আনা যেতে পারে। এই আদালতে দেখার আগে পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা এ.এফ. রহমান সিএসপি-কেও চিনতাম না। ‘অভিযােগে বলা হয়েছে যে, ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমার কারসাযের বাসভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ওই সময়ে কারসায এলাকায় আমার পােস্টিং কিংবা বাসা কোনােটাই ছিল না। আর পােস্টিং না থাকলে একটি প্রতিষ্ঠানের কোয়ার্টার কেউ ব্যবহার করতে পারে না। আমার চাকরির রেকর্ডপত্র দেখলে দেখা যাবে, কারসায এলাকায় আমার পােস্টিং হয় ১৯৬৫ সালের মে মাসে এবং ওই বছরের জুন/ জুলাই মাসে আমি সেখানে বাসা পাই। এই আদালতে দেখার আগে আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজ উল্লাহ কিংবা হাবিলদার দলিল উদ্দিনকে চিনতাম না বা কোনােদিন দেখিনি।’ অভিযোেগ আনা হয়েছে যে, ১৯৬৫ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকাস্থ শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আমি ছুটি না নিয়েই করাচি থেকে আমীর হােসেনকে সঙ্গে করে সেই সভায় যােগ দেই। এটা মিথ্যা। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ওই সময়ে কাশ্মীরে মুজাহিদরা যুদ্ধ করছিল এবং পাকিস্তানের সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীকে তখন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছিল। ছুটি-ছাটা ছিল সংরক্ষিত। এই অবস্থায় অনুমতি ছাড়া স্টেশন ত্যাগ করলে আমার কোর্ট মার্শাল হতাে।
আমি কখনাে ঢাকা এসে এ ধরনের সভায় যােগ দেইনি। আর এই আদালতে উপস্থিত হবার আগে আমি রুহুল কুদ্স সিএসপিকে কখনও দেখিনি বা চিনতাম না।’ অভিযােগে বলা হয়েছে যে, আমার কাছে কিছু লােক অভিযুক্ত পার্টির জন্য টাকা জমা রাখতেন এবং আমি সময়ে সময়ে কিছু লােককে সেই তহবিল থেকে টাকা দিতাম। এই অভিযােগ আমি সুনির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করি। আমি কখনাে কারাে কাছ থেকে এ ধরনের কোনাে তহবিল গ্রহণ করিনি এবং কোনাে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তা দিইনি। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুদ্ধের সময় বিদেশে বিশেষ দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলাম। এরমধ্যে কোনাে একদিনও আমি বাড়িতে আসিনি। সুতরাং মি, আমীর হােসেন ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার কাছে কিছু টাকা দিয়েছেন বলে যে অভিযােগ করেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা বলে। প্রমাণিত হয় । ‘অভিযােগে বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে দু’টি সভা অনুষ্ঠিত হয়। একটি আমার বাসায় এবং অন্যটি মি. এ. এফ. রহমান সিএসপি সাহেবের বাসায়।। এই অভিযােগ মিথ্যা। ‘৬৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় ছিলাম এবং তারপর দুই সপ্তাহ ছিলাম অসুস্থতাজনিত ছুটিতে। আমি ডান চোখের মারাত্মক অসুখে ভুগছিলাম এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পূর্ণ বিশ্রামে ছিলাম। সুতরাং এ. এফ. রহমান সিএসপি সাহেবের বাসায় কোনাে সভায় যােগ দেওয়ার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। আমি জীবনে কোনােদিন উল্লিখিত বাসায় যাইনি। আমার বাসায় অনুষ্ঠিত সভার কথাও মিথ্যা।’ ‘আরেকটি অভিযােগে বলা হয়েছে যে, ১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ ঢাকায় জনৈক তাজউদ্দিনের বাসায় অনুষ্ঠিত একটি সভায় আমি যােগ দেই। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ৬৫ সালের ১২ মার্চ ছিল শনিবার অর্থাৎ ছুটির দিন নয়। স্বাভাবিক কর্মদিবসে প্রতিরক্ষা বিভাগের চাকরিতে কোনাে ব্যক্তি কর্মদিবসে পূর্বানুমতি ছাড়া তার প্রতিষ্ঠান বা জাহাজ ত্যাগ করে অন্য কোথাও যেতে পারে না। মাননীয় আদালত আমার ছুটির রেকর্ডপত্র দেখলেই স্পষ্ট হবে যে আমি ওই দিন ছুটি নেইনি। অর্থাৎ কর্মস্থলেই ছিলাম। আর এ ধরনের কোনাে সভায় যােগ দেবার জন্য আমি কখনও ঢাকায় আসিনি।
‘অভিযােগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জনৈক ডা. সাইদুর রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত কয়েকটি সভায় আমি যােগ দিয়েছি। এই আদালতে উপস্থিত হবার আগে এ ব্যক্তিটিকে আমি কখনও দেখিনি এবং আমি বিস্মিত হয়েছি এই দেখে যে, তিনি আমাকে চিহ্নিত করেছেন। আদালতে প্রদর্শিত রেকর্ডপত্র অনুযায়ী ১৯৬৬ সালের ৯ জুন আমার পরিবারবর্গ আমার কাছে চলে আসেন। প্রকৃতপক্ষে এ সময় আমি আমার এক সহকর্মীর ফ্লাটে অবস্থান করছিলাম, যার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়ে চট্টগ্রামে শ্বশুর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের মে মাস পর্যন্ত আমি ওই বাড়িতে থাকার পর ১ জুন নাসিরাবাদে বাসা নেই। ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ্যাংকরেজ-এ আমি আমার বাসা স্থানান্তর করি। এ সমস্ত প্রাসঙ্গিক প্রমাণাদি কোর্টে তলব করা যেতে পারে। অভিযােগে উল্লেখিত ধরনের কোনাে সভায় আমি যােগ দেইনি। এই আদালতে উপস্থিত হবার আগে আমি এ, বি, খুরশিদ কিংবা মানিক চৌধুরীকে কখনাে দেখিনি বা চিনতাম না।’ ‘অভিযােগে বলা হয়েছে যে, ১৯৬৬ সালের মে মাসে মি. রমিজ আমার নাসিরাবাদের বাসায় যান এবং জুন মাসে তার বাসায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। আগেই বলা হয়েছে যে, ১৯৬৬ সালের মে মাসে আমার বাসা নাসিরাবাদে ছিল না। মি. রমিজ চট্টগ্রামে কখনও আমার বাসায় যাননি। আমিও কখনাে তার বাসায় যাইনি। মি, রমিজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল নিতান্তই আনুষ্ঠানিক । প্রকৃতপক্ষে মি. রমিজের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৬৬ সালের জুলাই বা আগস্ট মাসে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে। ১৯৬৬ সালের ১১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত আমি ঢাকায় ছিলাম। এই আদালতে উপস্থিত হবার আগে হাবিলদার আজিজুল হক কিংবা রিসালদার শামসুল হককে কখনও দেখিনি। আমার বক্তব্য অনুযায়ী আমি যে ঢাকা গিয়েছিলাম এবং অভিযােগে উল্লিখিত ধরনের কোনাে সভায় উপস্থিত হইনি তা প্রমাণ করার জন্য প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র আমি আদালতে হাজির করতে আগ্রহী। অভিযােগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমি মি. রমিজের সঙ্গে কুমিল্লা যাই এবং সেখানে লােকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।
আরও বলা হয়েছে যে, ১৯৬৬ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে মি. রমিজের বাসায় অনুষ্ঠিত কয়েকটি সভায় আমি যােগ দিয়েছি। এগুলাে সবই মিথ্যা। অভিযােগে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে আমি কখনােই সেভাবে কুমিল্লা যাইনি। বস্তুতঃপক্ষে ঢাকাতে আসা-যাওয়ার পথে কুমিল্লা অতিক্রম করা ছাড়া আমি জীবনে আদৌ কখনও কুমিল্লা যাইনি। একমাত্র ক্যাপটেন কেইউ আহমেদ কিছুদিন নৌবাহিনীতে ছিলেন এবং ১৯৬২ সালে আমরা একই জাহাজে ছিলাম। ক্যাপটেন আলীম নামে কাউকে আমি কখনও দেখিনি বা চিনি না। অভিযােগে যেভাবে বলা হয়েছে সে রকম কোনাে সভায় আমি কখনও যােগ দেইনি। ‘আমি মি. রমিজের ঢাকাস্থ বাসায় গিয়েছি বলে অভিযােগে যে উল্লেখ করা হয়েছে তা। সম্পূর্ণ মিথ্যা। আসলে ঢাকায় কোথায় তার বাসা তাও আমি জানি না। জনৈক কর্নেল ওসমানী আমার বাসায় এসেছেন এবং সভায় যােগ দিয়েছেন বলে অভিযােগে যা বলা হয়েছেও তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই মামলা শুরু হবার আগে আমি এই অফিসারের নামও কখনাে শুনিনি। অভিযােগে উল্লিখিত এ কথাও মিথ্যা যে, আমি গাড়ি কেনার জন্য রমিজকে টাকা দিয়েছি। ‘জনৈক পি.এন,ওঝার সঙ্গে ঢাকায় আমার বৈঠক সম্পর্কে যে অভিযােগ আনা হয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যা। বলা হয়েছে যে, ওই ওঝার সঙ্গে আমি ১৯৬৭ সালের ১০ ও ৩১ মার্চ বৈঠক করি। অভিযােগে উল্লিখিত ওঝার সঙ্গে আমার অর্ধ ডজন সভার মধ্যে মাত্র দুটি সভার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। একাজ করা হয়েছে আই ডব্লিউ টি থেকে আমার টি এ/ডি এ ফরমগুলাে দেখার পর। ঘটনাটি আরও পরিস্কার হবে যখন দেখা যাবে যে, ‘৬৭ সালের ১০ মার্চ আমি চট্টগ্রামে আমার অফিসে কর্মরত ছিলাম এবং বিকেলে অফিস থেকে বের হয়েছি। আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে আমি আমার পে-বুক এবং সার্ভিস রেকর্ডস আদালতে দেখাতে চাই। ওই দিন আমি নৌবাহিনী ত্যাগ করে তিন বছরের জন্য আই ডব্লিউ টি এ-তে ডেপুটেশনে যাচ্ছিলাম এবং আমাকে আমার জিনিসপত্র সব স্থানান্তরের কাজ করতে হচ্ছিল। প্রকৃত ঘটনা হলাে, ওই দিন (১০ মার্চ ৬৭) অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমি আমার জিনিসপত্র সব পাঠিয়ে দেই এবং পরদিন, ১১ মার্চ ‘৬৭ সকাল ৭টার ট্রেনে আমার পরিবারবর্গসহ চট্টগ্রাম ত্যাগ করি। ১১ মার্চ বিকেলে আমি আই ডব্লিউ টি এতে যােগ দিই। কিন্তু যেহেতু আমি নৌবাহিনী থেকে পূর্ববর্তী অপরাহ্নে রিলিজ হই সেহেতু চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং একদিনের বেতন নিয়ে কোনাে জটিলতা এড়াবার জন্য যােগদানের রিপাের্টে আমার অপরাহ্নে যােগদানের কথা বলা হয়েছে। এখানে একজন সাক্ষী বলেছেন যে, আমার মৌখিক নির্দেশমতাে তিনি আমার টিএ বিল প্রস্তুত করেছেন। যেহেতু ১০ মার্চ আমি আমার চট্টগ্রামের অফিসে কর্মরত ছিলাম সেহেতু টি এ ফরমে একথা বলা অবশ্যই ভুল যে, আমি ১০ মার্চ সকাল ৭ টায় চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছি। আসলে ওই সাক্ষী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত টিএ বিল পুন:পরীক্ষা না করেই আমি তাতে স্বাক্ষর করেছিলাম। একইভাবে ৩০ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল ‘৬৭ সময়কালের টিএ বিলেও ভুলক্রমে স্বাক্ষর করে আমি ৩১ মার্চ তারিখে ডিএ বিলটি হারাই। আসলে আমি চট্টগ্রাম থেকে যে সব ভারী জিনিসপত্র পাঠিয়েছিলাম, সেগুলােও এই টিএ বিল অনুযায়ীই পরীক্ষিত হওয়া উচিত ছিল।
আমার এই সময়কালের টিএ বিলগুলাে ঘেঁটে ৩১ মার্চের কল্পিত বৈঠকটির অভিযােগ তােলা হয়েছে। অভিযােগে বর্ণিত ধরনের কোনাে সভায় আসলে আমি যােগ দেইনি। ‘আমি মি, রমিজকে ২৫ হাজার টাকা গিয়েছিলাম বলে অভিযােগে বলা হয়েছে তা মিথ্যা। আমি কোনাে দিন কাউকে এ ধরনের টাকা দেইনি। অভিযােগ বর্ণিত এসব কথাও মিথ্যা যে, আমি ১৩ গ্রিন স্কোয়ার ঠিকানায় একটি স্থান পরিদর্শন করেছি কিংবা সেখানে অনুষ্ঠিত কোনাে সভায় যােগ গিয়েছি। এই জায়গাটি কোথায় আমি তাও জানি না। একথাও মিথ্যা। যে, আমি ওই জায়গায় একটি হিলম্যান গাড়ি রেখেছিলাম যেটি অভিযুক্ত দলের লােকেরা তাদের কাজ-কর্মে ১৯৬৭ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। উল্লেখ্য যে, এ ধরনের কোনাে গাড়ির মালিকও আমি ছিলাম না। যানবাহন রেজিস্ট্রেশন বইয়ের তথ্য অনুযায়ী একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার পর এই গাড়িটি ১৯৬৭ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত মেরামতের জন্য একটি গ্যারেজে ছিল।’ “অভিযােগে বর্ণিত একথাও সর্বৈব মিথ্যা যে, আমি আগরতলা গিয়ে কিছু লােকের সঙ্গে দেখা করেছি। এ ধরনের কোনাে ঘটনা আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আমি কোনাে দিন কোনাে স্থানে লুতুল হুদা, জালাল উদ্দিন আহমেদ কিংবা আননায়ার হােসেন নামে কোনাে লােকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি। এ কথাও মিথ্যা যে, আমি মি. রমিজের চট্টগ্রামের বাসায় একটি ডিনার পার্টিতে যােগ দিয়েছি এবং সেখানে জনৈক ক্যাপটেন নুরুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। এই আদালতে আসার আগে আমি কখনও ক্যাপটেন নূরুজ্জামানকে দেখিনি।’ ‘অভিযােগে বর্ণিত এ কথাও মিথ্যা যে, তথাকথিত পার্টি তহবিল দিয়ে একটি গাড়ি। কিনেছি। এ কথা সত্য যে, করাচি থাকাকালে আমার একটি ভ্যাসপা স্কুটার ছিল যেটি পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হবার আগে আমি বিক্রি করে দেই। আমি যখন করাচিতে ছিলাম তখন একটি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেই এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে আবেদন। করলে পাঁচ হাজার টাকার একটি ওভারড্রাফট আমার নামে অনুমােদিত হয়। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই ওভারড্রাফটি অনুমােদিত হয়। এ বিষয়ে ব্যাংকের প্রদত্ত চিঠি এখানে রেকর্ড হিসাবে দেওয়া হয়েছে।
এক হাতে এই ওভারড্রাফট এবং অন্য হাতে আই| ডব্লিউ টি এ-র চেয়ারম্যানের চিঠি পাবার পর আমি স্কুটারটি বিক্রি করার জন্য একজন খরিদ্দার খুঁজতে থাকি এবং অন্যদিকে গাড়ি কেনার আগেই আমার পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্ত রের বিষয়ে লিখিত সর্বশেষ চিঠির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর | হবার সময় দুই হাজার ৫০০ টাকায় আমি আমার স্কুটারটি বিক্রি করি এবং অন্যান্য অ্যালাউন্স বাবদ প্রায় চার হাজার টাকা পাই যার প্রমাণপত্র এখানে দাখিল করা হয়েছে। এরপর ১৯৬৬ সনের জুন মাসে চট্টগ্রাম থেকে কর্তব্য কর্মের উদ্দেশ্যে ঢাকা গিয়ে আমি হিলম্যান আই এম পি গাড়িটি কিনি। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে আমি মস্কোভিচ গাড়ির জন্য সরকারি কোটা থেকে পারমিট পাই। এ সময় আমার ভাই, যিনি একজন চিত্রকর, একটি গাড়ি খুঁজছিলেন। আমি তখন তার কাছে আমার হিলম্যান বিক্রি করে একটি মস্কোভিচ কিনি। ‘এ কথাও সম্পূর্ণ মিথ্যা যে, আমি আমীর হােসেন মিয়ার কাছে কয়েকটি চিঠি লিখেছি, যা আদালতেও প্রদর্শন করা হয়েছে। আমি কখনাে তার কাছে কোনাে চিঠি লিখিনি। আমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে এই ঘটনাটির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যে, ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আমার লেটারহেডের চারটি লেটার ছাপানাে হয়। যখন আমি জানতে পারলাম যে, আমি আই ডব্লিউ টি এ-তে ডেপুটেশনে যাচ্ছি তখন আমি এই লেটারহেড ছাপানাে বন্ধ রাখি। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রমাণাদি হাজির করার জন্য ঢাকাস্থ একটি প্রেসকে নির্দেশ পাঠাতে অনুরােধ করি। ওই প্রেসটি আমার লেটারহেড তৈরি করেছিল কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা সরবরাহ করেনি। আমি যখন পিন্ডি যাই তখন এই লেটারহেডগুলাে আমার ব্রিফকেসে ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফ উদ্দিন কর্তৃক আমার হস্তাক্ষরের যে লিপি কোর্টে দাখিল করা হয়েছে তাও ঠিক নয়। কারণ ম্যাজিস্ট্রেট কখনাে আমার হস্তাক্ষর নেননি।’
১৯৬৬ সালে করাচি বসে আমি আমীর হােসেন মিয়ার কাছে কয়েকটি ডায়রি এবং অন্যান্য প্রমাণপত্রাদি দিয়েছিলাম বলে অভিযােগে যা বলা হয়েছে তাও মিথ্যা। আমার কোনােদিন ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল না। যে ডায়রি কোর্টে দাখিল করা হয়েছে তা ১৯৬৪ সালে আমার জাহাজ যখন বড় ধরনের মেরামতের জন্য ডকে যায় তখন একটি এজেন্সি আমাকে। উপহার দিয়েছিল। আমি যে কোনােদিন ডায়রি লিখি না তার প্রমাণ-ওই ডায়রিগুলাে সবই ছিল ফাঁকা।
অভিযুক্ত রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে অনেক প্রমাণ পত্রাদিই প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু আমার বাসা তল্লাশি করে এ সবের কোনােকিছু কোনােদিন পায়নি। আমাকে দোষি সাব্যস্ত করার জন্য পুরাে ঘটনাটাই সাজানাে হয়েছে। আদালতে প্রদর্শিত ডায়রিগুলাে পুরনাে বইপত্রের সঙ্গে বাক্স বােঝাই হয়ে ঢাকায় আমার বাবার বাসায় ছিল। আমি যখন বরিশালে স্থানান্তর হই তখন এগুলাে রেখে যাই। ১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর সামরিক বাহিনীর অফিসারসহ পুলিশ ওই বাসায় তল্লাশি চালায়। এই তল্লাশি চালানাের সময় সামরিক বাহিনীর একজন মেজর আমার স্ত্রীকে দু’ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং মাঝে মাঝে হুমকি দেন।’ উল্লেখ্য, এই মামলায় প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, অভিযােগ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্ত েিনর বিভিন্ন স্থানে বিশেষত, ঢাকায় কতগুলাে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভাগুলােতে তথাকথিত অভিযুক্ত সংগঠনের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মি. রুহুল কুদ্স সি এস পি এবং মি, এ. এফ. রহমান সি এস পি-এর তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি যদিও তারা উভয় ওই সময়কালে ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন। বস্তুতঃপক্ষে আমি যতােদিন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছি ততদিনের মধ্যে তথাকথিত অভিযুক্ত সংগঠনের ওই দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমার কোনাে সংস্পর্শ দেখানাে হয়নি। এছাড়া আরও উল্লেখ্য যে, যদিও এই মামলায় প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, কয়েকজন লােককে গ্রেপ্তার করার পূর্ব পর্যন্ত তথাকথিত সংগঠনটির কাজ-কর্ম নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছে তথাপি ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসের পরে আমার কাজকর্ম সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। অথচ অভিযােগে আছে যে, এই সময়েই কয়েক ব্যক্তি ভারতে গিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আমার নিরবচ্ছিন্ন এবং অসাধারণ কাজ-কর্মের বিষয়ে অভিযােগে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপর হঠাৎ আমাকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত রাখা হয়েছে।
অবশ্য এর অর্থ এও হতে পারে যে, ইতিমধ্যেই কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে।’ ‘অভিযােগে বর্ণিত এ কথাও মিথ্যা যে, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আমার আই ডব্লিউ টি এ-তে ডেপুটেশনে যাবার কথা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমার এই ডেপুটেশনের প্রশ্নই ওঠেনি, যখন বর্তমান সি-ইন-সি আই ডব্লিউ টি এর চেয়ারম্যান ছিলেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়েছিল। এ বিষয়ে দু’খানা চিঠি রেকর্ড হিসেবে আমি আদালতে উপস্থাপন করতে চাই।’ উপরােক্ত ঘটনাবলীদৃষ্টে এ কথা বলা যায় যে, এই মামলায় কর্তৃপক্ষ এবং নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে জড়িয়েছেন তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়ােজন, দীর্ঘদিন বৃটিশ নৌবাহিনীর সংস্পর্শে থাকা এবং তাদের দেওয়া প্রশিক্ষণের ফলে আমি সকল প্রকার অন্যায়-অনিয়ম-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে অতিশয় নিষ্ঠা প্রদর্শনের একটা অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার এই অভ্যাসের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সময়ে আমার ওপরন্থ অফিসারদের বিরুদ্ধে আমাকে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। তাদের অনেক অন্যায় অনিয়মের আমি প্রতিবাদ করেছি। আমার এই অভ্যাসের কথা আমার জাহাজ থেকে অন্যান্য জাহাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে তা আমার ওপর বিন্নি পর্যায়ের অফিসারদের কানে পৌঁছেছে। তাদের প্রায় সবাই ছিলেন পাকিস্তানি। তাই তারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অফিসারগণও আমার এই অভ্যাসের কথা শুনেছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার সি-ইন-সি সাহেবের কানেও এ বিষয়টি গিয়েছে। ফলে আমি তাদের বিরাগভাজন হয়েছি। ‘নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত অনমনীয় মনােভাবাপন্ন একজন হিসেবে আমার বহুল পরিচিতি ছিল।
এই কারণে আমার অনেক কামান্ডিং অফিসারের সঙ্গে অনেক ঝগড়াবিবাদও আমার হয়েছে। কেননা, আমি তাদের কৃত কিছু অনিয়মের প্রতিকার করার চেষ্টা করতাম অফিসার হিসাবে আমার ক্ষমতা দিয়ে। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার একবার মারাত্মক বিবাদ বেধেছিল। কারণ, আমি পরিবহনের কয়েকটি নির্দিষ্ট অপব্যবহার বন্ধ করার কথা বলেছিলাম এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে তদন্ত করার কথা বলেছিলাম। এটা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, যখন পূর্ব পাকিস্তানিদের কোনাে ন্যায্য বিষয় নিয়েও আমি ফয়সালার উদ্যোগ নিতাম তখনই আমাকে বলা হতাে প্রাদেশিকতাবাদী এবং কখনাে কখনাে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে আমাকে হুমকি দেওয়া হতাে। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গে তুলনা করলে তা বেশিই মনে হবে বটে।’ একজন অফিসার হিসেবে নৌবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সমস্ত রকম অসন্তোষ ও ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে অধঃস্তনদের মনােবল উন্নত রাখার জন্য আমার যে প্রচেষ্টা তার ফলে বিভিন্ন সময়ে আমি আর্থিকভাবে, নিয়ােগ দান ও অন্যান্য অনেক বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অনেক অন্যায় আচরণের শিকার হয়েছি। এই সমস্ত কারণেই আমাকে তথাকথিত এই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানাে হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এ ধরনের আচরণের বিষয় আমি উদাহরণ হিসাবে এখানে তুলে ধরতে চাই।’ যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর তৎকালীন সি-ইন-সি আমাকে ‘ফ্যামিলি পাসেস’ দিতে অস্বীকার করেন যদিও আইন ও নিয়মনুযায়ী আমার তা প্রাপ্য ছিল। পাশাপাশি, কমান্ডার জমির এবং আবদুল্লাহ খান দুজন অফিসারকে এ সুযােগ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত সি-ইন-সি সাহেবের একটি চিঠি, এই চিঠির জবাবে প্রায় এক বছর পরে লেখা পরিচালক, বেতন-পেনশন ও একাউন্টস সাহেবের একখানা চিঠি এবং নৌসদর দফতরে নৌপ্রশিক্ষণ পরিচালক সাহেবের একখানা চিঠি আদালতে দাখিল করতে চাই।’ ‘আমাকে পি এন এস আলমগীর নামক জাহাজে একটানা চার বছর চার মাসের জন্য নিয়ােগ করা হয়েছিল অথচ সাধারণভাবে একজন অফিসারকে কোনাে জাহাজে দুই থেকে আড়াই বছরের বেশি মেয়াদে নিয়ােগ করা হয় না, বিশেষ করে সমুদ্রে। কারণ, একটি জাহাজ সপ্তাহে তিন-চার দিন সমুদ্রেই থাকে। ফলে অফিসারদের পারিবারিক জীবন বিঘ্নিত হয়।’ ‘কোনাে জাহাজের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার অধঃস্তনদের রেটিং সার্টিফিকেট দেবার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিলাে ওই জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ওপর। আমার জাহাজে আমি যখন তিন জন পূর্ব পাকিস্তানির রেটিং গ্রান্ট করলাম তখনই এই নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ওই তিন জনের পদোন্নতি আটকে ছিল একমাত্র রেটিং সার্টিফিকেটের অভাবে।’ ১৯৬৪ সালে আমার জাহাজ মেরামতে যাওয়ার পর জাহাজের মেইন প্রােপালশান মেশিনারিতে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। এজন্য আমাকে হয়রানি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষা এবং পুরনাে রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেলাে যে, ওই ক্রটি ১৯৫২ সালে জাহাজটি যখন বৃটিশ নৌবাহিনীতে ছিল তখনকার এবং যে অফিসার বৃটিশ নৌবাহিনীর কাছ থেকে জাহাজটি বুঝে নিয়েছিলেন তিনি জাহাজের এই ক্রটি ধরতে পারেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওই অফিসারটি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। ফলে বিষয়টি চাপা পড়ে এবং আমি রেহাই পেয়ে যাই। এই ঘটনায় আমার দেওয়া বক্তব্যের সমর্থনে আমি কিছু রেকর্ডপত্র চেয়ে আবেদন করেছিলাম কর্তৃপক্ষের কাছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত তা এখানে পাঠানাে হয়নি। ১৯৬৪ সালেই বিনা দোষে আরও একবার আমাকে হয়রানি হতে হয়। ওই সময় আমার জাহাজ মেরামতে থাকা অবস্থায় জাহাজের বয়লারে কিছুক্রটি ধরা পড়ে। এ জন্য নৌসদর দপ্তর থেকে একটি তদন্ত টিম করা হয়। এই তদন্তে দু’মাসেরও বেশি সময় চলে যায়। শেষ পর্যন্ত আমি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এবং ডকইয়ার্ড বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার এই উভয়পক্ষ থেকেই অভিযােগমুক্ত হই। কিন্তু সর্বাধিনায়ক আমার নামে একটি চিঠি ইস্যু করে আমার কাজের প্রতি তার অসন্তুষ্টির কথা জানান। আমি এখন আমার প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও গবেষণাগারের সার্টিফিকেট প্রদর্শন করতে চাই। সর্বাধিনায়কের ওই চিঠি দেখানাের জন্য আমি আমার ব্যক্তিগত ফাইল আদালতে পাঠানাের অনুরােধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তা এখনও পাঠানাে হয়নি। এখানে আমি জাহাজের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ওই জাহাজটি মেরামতের সময় বয়লারে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। এ জন্য ডকইয়ার্ড বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ওই জাহাজের প্রধান প্রকৌশলীকে দায়ী করেন। আমি এখানে সেই চিঠির কপিও উপস্থাপন করেছি। কিন্তু ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনােরূপ। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ, তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি এবং সর্বাধিনায়কের আত্নীয়।’ সাবমেরিন সার্ভিসে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য যেসব প্রকৌশলী অফিসার সর্বপ্রথম নাম দিয়েছিলেন আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। ১৯৬২ সালে বিষয়টি অত্যন্ত গােপন রাখার উদ্দেশ্যে এ ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে অনুমােদন দেওয়া হতাে আমি সে অনুমােদন পেয়েছিলাম। পরবর্তীকালে লিখিতভাবেও অনুমােদন পেয়েছিলাম সাবমেরিন সার্ভিসে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করার। এ সম্পর্কে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চিঠি এখানে উপস্থাপন করেছি। কিন্তু আমাকে কখনােই ওই সার্ভিসে অংশগ্রহণ করার জন্য ডাকা হয়নি। ১৯৬৫ সালে আমি প্রকাশ্যে বলতে শুরু করলাম যে, আমি একজন পূর্ব পাকিস্তানি বলেই আমাকে ডাকা হচ্ছে না। তার আগে পর্যন্ত কোনাে পূর্ব পাকিস্তানিকে ওই সার্ভিসে অংশগ্রহণ করার জন্য আসলেই ডাকা হয়নি। অথচ অনেক পাকিস্তানি অফিসারকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই সার্ভিসে ডাকা হয়েছে।’ খুলনার চালনাতে ডেপুটেশন দেওয়ার ঘটনায় আমার প্রতি আরও একবার অবিচার করা।
হয়। নানা রকম হয়রানি ও অবিচারের ফলে অতিষ্ঠ হয়ে আমি তখন পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের কথা ভাবছিলাম’ এই মর্মে সর্বাধিনায়কের কাছে আবেদন করেছিলাম। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে আবেদনটি অনুমােদন করে এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। এ সম্পর্কিত প্রমাণপত্রাদি আমি আদালতে দাখিল করেছি। কিন্তু ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আমাকে জানানাে হয় যে, আমাকে চালনায় ডেপুটেশনে পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে না। এরপর ১৯৬৪ সালের ১০ জুন নেী সদর দপ্তর থেকে একটি তারবার্তার মাধ্যমে খুলনায় পােস্টিংয়ের জন্য প্রকৌশল শাখার ব্রাঞ্চ লিস্ট’ অফিসার চাওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, তখন পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে কেউ প্রকৌশল শাখায় ব্রাঞ্চ লিস্ট অফিসার ছিলেন না। খুলনায় পােস্টিংয়ের জন্য এ ধরনের অফিসার চাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যাতে কোনাে পূর্ব পাকিস্তানি তার প্রদেশে উচ্চপদে আসীন হয়ে চাকরি করার সুযােগ না পান। ১৯৬৪ সালে আমার মারাত্মক মাথা ব্যথা দেখা দেয়। ফলে আমাকে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করাতে হয়। আমি তখন পাকিস্তান এবং যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল শাখার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছি। কিন্তু রােগের কোনাে উপশম হচ্ছিল না। অবশেষে ১৯৬৭ সালে রােগ নির্ণয় হলে দেখা গেলাে যে এটির উৎস এলার্জি। চিকিৎসকেরা আমাকে কয়েকটি বিষয় পরিহার করতে বলেন। যেমন, কঠিন পড়াশুনা, গভীর মনােনিবেশ করতে হয় এমন কোনাে কাজ ইত্যাদি। ফলে উপায়ান্তর না দেখে আমি সর্বাধিনায়কের বরাবরে এই মর্মে একটি আবেদন করি যে, আমার মারাত্মক অসুস্থতা এবং পড়াশুনা অতীত রেকর্ডসমূহ বিবেচনা করে এখন আমাকে পদোন্নতির জন্য সকল ধরনের পেশাগত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেওয়া হােক। নৌ কর্তৃপক্ষ আমার সে আবেদন এই বলে ছুড়ে ফেলে দিলেন যে, নৌবাহিনীর মেডিক্যাল ক্যাটগরিতে আমার স্থান ‘এ’ ক্যাটগরিতে। সুতরাং এ ধরনের কোনাে আবেদন বিবেচনা করা সম্ভব নয়। তখন আমি আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটি মেডিক্যাল বাের্ড গঠনের আবেদন জানালাম। সেটিও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় (আমার প্রথম আবেদনটির জবাব দিয়ে চট্টগ্রামের নৌবাহিনীর অফিসার-ইন-সার্জ যে চিঠি দিয়েছিলেন তার একটি কপি আমি আদালতে উপস্থাপন করেছি)। আর কোনাে পথ না দেখে এবং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনােরূপ সুবিচার পাবার আশা নেই বুঝে আমি নৌবাহিনী থেকে ‘অকালে অবসর চেয়ে একটি আবেদন করি। এই আবেদনের একটি কপিও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই আবেদনপত্র আমি সর্বাধিনায়কের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোেগ উপস্থাপন করেছিলাম যেগুলাে তথ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল। ওই সর্বাধিনায়ক বর্তমানে প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত মন্ত্রী। ‘আমার ধারণা যে, আমার আপােসহীন ও অনমনীয় প্রকৃতির কথা জেনে এবং তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযােগ উপস্থাপন করায় উক্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সঙ্গে যােগাযােগ করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে এই মিথ্যা, তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়েছেন। দীর্ঘকাল আটক থাকা ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমাকে বলা হয়েছে যে, সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের কিছু লােককে সরিয়ে দিতে। চান। এখন আমার কাছে এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে গেছে যে, একটি পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে আমাকে সরকার স্তব্ধ করে দিতে চান যাতে আমি ভবিষ্যতে কখনও ন্যায্য দাবি করতে ও ন্যায্য কথা বলতে না পারি। এর বিরুদ্ধে প্রয়ােজন হলে আমি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যন্ত যাবাে।’ “আমার চাকরি জীবনে আমি সর্বদাই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করেছি। আমি । সর্বদাই আমার কর্তব্যকে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছি। পাক-ভারত যুদ্ধকালে। আমাকে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়েছিলাে এবং আমি সে দায়িত্ব পালনের জন্য আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্য ব্যবহার করেছি। আগেও একবার বলেছি। যে, আমি একটানা ৩৫ দিন, একবারও বাড়িতে না এসে চাকরিস্থলে পড়ে থেকেছি। আমি সর্বদাই চাকরির মাধ্যমে দেশের সর্বোত্তম সেবায় নিজেকে নিয়ােজিত রেখেছি। দেশ সেবার এই ধারা অনুসরণ করতে গিয়েই আমি পাকিস্তান নৌবাহিনী এবং আই ডব্লিউ টিকে (যখন সেখানে কর্মরত ছিলাম) অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছি। আমার এ সকল পরামর্শ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করেই দেওয়া হয়েছে, কেবলমাত্র আমার নিজের পেশাকে সংরক্ষণ করার জন্য নয়। এই প্রেক্ষিতে আমি নৌ-কর্তৃপক্ষকে দেওয়া। একটি পরামর্শ এখানে উপস্থাপন করতে চাই। সেই সঙ্গে উপস্থাপন করতে চাই আই। ডব্লিউ টি এ-র চেয়ারম্যানের স্বহস্তে লেখা একখানা চিঠি, আই ডব্লিউ টি এ-র চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের সচিবের এবং সচিবের নিজের পক্ষ থেকে লেখা একখানা করে। চিঠি এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর বর্তমান সর্বাধিনায়কের একখানা চিঠি। আমি আরও উপস্থাপন করতে চাই আই ডব্লিউ টি এ-র অফিস অর্ডারের একটি কপি, আমি যখন আই ডব্লিউ টি এ-তে কর্মরত ছিলাম তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে যেসব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার একটি কপি এবং আই ডব্লিউ টি এ-র অফিসের সময় সূচির একটি কপি।
আমি আই ডব্লিউ টি এ-র চেয়ারম্যানের কক্ষে অনুষ্ঠিত একটি সভার কার্যবিবরণীও এখানে উপস্থাপন করতে চাই, সে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলাে যে, আমার অফিস বরিশাল থেকে নারায়ণগঞ্জে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাকে পিন্ডিতে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করার কারণে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়নি। এইসব প্রমাণপত্র ও ঘটনাবলী এ কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় যে, তথাকথিত এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমার কোনাে যােগ ছিল না। ‘আমার ১৯ বছরের চাকরি জীবনে সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানবশতঃ আমি এমন কোনাে কাজ করিনি যাতে আমার সামরিক পােশাকের কোনােরূপ অবমাননা হতে পারে। বরং এই সামরিক পােশাকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বাড়ানাের জন্য সব সময় চেষ্টা করেছি। আমি আরও একবার বলতে চাই যে, আমি নির্দোষ। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে তথাকথিত এই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানাে হয়েছে।’
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক