You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৩শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, মঙ্গলবার, ৯ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

বঙ্গবন্ধুর লাল ঘোড়া

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম জাতীয় সম্মেলন সমাপ্ত হয়ে গেলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা এই সম্মেলনে যোগদান করেছেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণের একাংশে এসে বঙ্গবন্ধু সমাগত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেছেন—‘এরা আমার লাল ঘোড়া। যারা লাল ঘোড়া চিনতে পারেন নি তারা দেখে যান, এই লক্ষ লক্ষ লাল ঘোড়াকে।’ উল্লেখযোগ্য, প্রথম বিজয় দিবস ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমুদ্রে যে লাল ঘোড়া দাবড়ানোর কথা বলেছিলেন তা নিয়ে বিরোধী শিবির থেকে নানা প্রকার মন্তব্য পেশ করা হয়েছিলো। লাল ঘোড়া বলতে বঙ্গবন্ধু পুলিশ-রক্ষী না অন্য কিছু বুঝিয়েছিলেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন প্রকার কানাঘুষা হয়েছে। বিরোধী দলগুলো বঙ্গবন্ধুর লাল ঘোড়া দাবড়ানোর কথাকে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এবং নিজেদের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে তাদের প্রতিই যেন বঙ্গবন্ধু ঐ মন্তব্য করেছেন বলে বক্তৃতা বক্তব্য রেখেছেন। দেশবাসীর নিশ্চয়ই মনে রয়েছে, বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে লাল ঘোড়া দাবড়ানোর কথা বলেছিলেন তা ছিলো দেশের স্বাধীনতা নস্যাৎকারী শক্তি, দুষ্কৃতিকারী, ডাকাত, গুন্ডা, হাইজাকার, কালোবাজারী প্রভৃতি গণদুশমনদের প্রতি। যদি এই সকল সামাজিক শত্রুদের তৎপরতা বন্ধ না হয় তবেই বঙ্গবন্ধু এদের বিরুদ্ধে লাল ঘোড়া ছেড়ে দমন করার হুমকি দিয়েছিলেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিজয় দিবসের পর থেকে বিরোধী শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধুর সেই হুমকিকে তাদের নিজেদের প্রতি হুমকি বলে বিশ্লেষণ করলেন। গত পরশুদিন তাই বঙ্গবন্ধু পুনরায় সেই সকল তথাকথিত বিরোধী শিবিরগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন—‘আমার লালঘোড়াকে যারা চেনেন নি তারা এসে দেখ যান আমার লালঘোড়া কারা।’ বঙ্গবন্ধু সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শপথ করান যে, তারা দেশে ফিরে গিয়ে সমাজে যারা অশান্তি সৃষ্টি করে, যারা রাতের বেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে দেশের মানুষের নিদ্রা কেড়ে নেয়—যারা গুপ্ত হত্যার হোতা, যারা ঘুষখোর, দালাল, তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এবং যে কোন সংগ্রামের জন্যে ডাক দেবার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো এগিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংঘবদ্ধ হয়ে সোনার বাংলা গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
বস্তুতঃপক্ষে গত পরশুদিনের মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় সম্মেলনে যে দুই লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা যোগদান করেছিলেন তার স্বতঃস্ফূর্ততা ও সংঘবদ্ধতা ঢাকার মানুষকে নিঃসন্দেহে বিস্মিত করেছে। যে মুক্তিযোদ্ধা একদিন মৃত্যুকে ভ্রুকুটি হেনে দেশমাতার স্বাধীনতার জন্যে নিরলসভাবে সংগ্রাম করেছে, যারা একদিন দেশে প্রথম প্রবেশ করলে বাংলার মানুষের চোখের কৌতূহলের বিষয় ছিলো তারা বর্তমানের নানা দুঃখকষ্ট অভাব-অভিযোগকে তুচ্ছ করে সম্মেলনে যোগদান করতে এসে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছিলো। সত্যি বলতে কি এদের দৃপ্ত পদভারে সেদিন ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়েছে—জয়বাংলা আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার শ্লোগানে ঢাকা নগরীকে প্রকম্পিত করে তুলেছে। এই বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতঃস্ফূর্ত ঢাকা আগমনই তাদের সম্মেলনের সার্থকতা।
মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও দেশের গোটা মুক্তি বাহিনীই বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্ব ও আদর্শে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ও নির্দেশই তাদের চলার পথের পাথেয়। এদেরকে যথার্থভাবে সংঘবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী জাতি গঠনের বাহিনী হিসেবে কাজে লাগানো যায়। মহাবিপদের দিনের এরা বহু পরীক্ষিত তরুণ। দেশের যে কোন উন্নয়নমূলক কাজে এরা যত বেশী নিবেদিত ও আত্মোৎসর্গিত হতে পারবে অন্য কেউ তা পারবে না। বঙ্গবন্ধু চান এদের অভাব অভিযোগ পূরণের সঙ্গে সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে। আর সে জন্যে যারা হবে অন্তরায়, যারা শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতি হবে হুমকিস্বরূপ তাদেরকে দমন করার কাজে এই মুক্তিযোদ্ধারাই হবে বঙ্গবন্ধুর লাল ঘোড়া। এরাই সমাজকে নতুন করে গড়বে। বঙ্গবন্ধুর চির স্বপ্ন সোনার বাংলার জন্যেই এরা হবে আত্মোৎসর্গিত তাজা প্রাণ।
০০০

আসল ইচ্ছেটা কি তার?

আসলে তিনি কি চান? গণতন্ত্র না গুন্ডামী, সমাজতন্ত্র না সন্ত্রাস। জনসাধারণের মনে আজ নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সবচাইতে প্রবীণ বয়ঃজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা তিনি। স্বাধীনতা উত্তরকালে তাই স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের আগ্রহী দৃষ্টি তার উপর ছিলো। রাজনীতির ঝানু থেকে দাবাড়ে নন কিন্তু সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ চিন্তা-চেতনা থেকে তিনি জাতির অগ্রগতিতে গঠনমূলক এবং সৃজনশীল ভূমিকা গ্রহণ করবেন এমন আশা করা জনগণের অন্যায় কিছু ছিলো না। অথচ তা হলো না। আধারি রাজনীতির শলাপরামর্শ রাতারাতি তাকে নোংরামির চরম গহ্বরে নিক্ষেপ করলো। খুনোখুনি, গুপ্তহত্যা, বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টি এমনকি ত্রিশ লক্ষ লোকের আত্মত্যাগে অর্জিত দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি জড়িত হয়ে পড়লেন।
গত পরশু তিনি হুঙ্কার ছেড়েছেন পল্টনে। নির্বাচন আর ‘মারামারি’ পাশাপাশি চালিয়ে যাবে তার দল। নির্দেশ দিয়েছেন তার কর্মীদের গোলাগুলি-বন্দুক-রিভলভার-দা-কুড়াল নিয়ে জোরদার সংগঠন গড়ে তুলতে। এই সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়েও কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের কথাই বলেছেন, পেড়েছেন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দোহাই। বলেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তিনি তার রাজনীতিকে কোন্ ধারায় বহিয়ে দিতে চান তা তিনিই ভালো জানেন। কিন্তু তার সেই হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি দেশের কোন্ কল্যাণ সাধন করবে তা আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলেন নি বলেননি যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে কোন্ সোনার কাঠির পরশে তিনি দুধের নহর বহিয়ে দেবেন। অথচ রক্তের সাগর বহাবার প্রেরণা তিনি বোধ করেন এই বৃদ্ধ বয়সেও। মানুষ মানবিক গুণের অধিকারী বলেই মানুষ। এই বিশেষ গুণের অভাব ঘটলে তিনি আর মানুষ বিবেচিত হতে পারেননা। সারা বাংলায় মানুষের চিরন্তন দুঃখ-দুর্দশা লেগেই আছে। এক বছর অতীত হয়েছে দুর্ভাগা বাংলার লক্ষ কোটি মানুষ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে তাদের আত্মীয় পরিজন, তাদের অতি আপনজনদের হারিয়েছে। সেই স্বজন হারানোর বেদনা আজও বোবা কান্নার মত গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তরে, বাতাসে ভেড়ে বেড়ায়। একটু কান পাতলে সে কান্নার আওয়াজ এই বয়ঃবৃদ্ধ রাজনীতিক মহোদয়ও শুনতে পেতেন বৈকি!
কিন্তু সে অনুভূতি নিয়ে বাংলাকে, তার মানুষকে ভালোবাসার সুকুমার প্রবৃত্তি লোপ পেয়েছে এই ভদ্রলোকের বহুদিন। রক্তের স্রোত বহমান বাংলাকে প্রত্যক্ষ করবার অবসর তার হয়নি। দিল্লীর প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসে দৈনিক কাগজেই যিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা উপাখ্যান পড়েছেন তারিই সাজে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অস্ত্রের নুপুর পায়ে দানব নৃত্যে অংশ গ্রহণের। আমরা তার এই প্রেতনৃত্যে রুনুঝুনু আওয়াজে শঙ্কিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উষালগ্নে অস্ত্রের ঝনঝনানি সর্বহারা রিক্ত মজলুম মানুষের মনে যে ক্ষোভ আর তীব্র ধিক্কারের সৃষ্টি করেছে তাকে অবহেলা করবার নয়। দেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র তুলে ধরবার পাঁয়তারা চলছে তার প্রতি আমাদেরও সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। সর্বহারা মেহনতী মানুষ যদি সেই প্রতিবিপ্লবী প্রতিক্রিয়াশীলদের হস্তস্থিত অস্ত্র কেড়ে কোনদিন এই বেঈমান দুশমনদের বাংলার মাটির থেকে নিশ্চিহ্ন করবার তীব্র তাগাদা অনুভব করে, তবে সেদিন এই রাজনীতিকরূপী দুশমনদের ভাগ্য ভেবে দুঃখিত হওয়ার ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকবে কি?
আমরা অস্ত্রের রাজনীতিকে বিশ্বাসী নই। অস্ত্রে মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায়না এর ভুরি ভুরি প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। জনগণের শক্তির উপর বিশ্বাসী আওয়ামী লীগও তাই গণতান্ত্রিক রায়ের মাধ্যমে জাতির অগ্রগতি সাধনে ওয়াদাবদ্ধ। আমরা সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে ঐ একই মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবার আহ্বান জানাচ্ছি। সবার কাছে আমাদের আবেদন—জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, তাদের চিন্তা ও চেতনার সঙ্গে একাত্ম হউন—অস্ত্র ধার দেওয়া ‘মহাশক্তিশালী’ মহাজনদের দ্বারে ধর্ণা দিয়ে আর যাই হোক জনগণের কোন কল্যাণ সাধিত হবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!