কাঠগড়ায় শেখ মুজিব বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে
আগরতলা মামলা শুরুর প্রথম দিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশ্যে শংকাহীন কণ্ঠে এমন এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যা আদালতে উপস্থিত বিচারক, সরকারি গােয়েন্দা সংস্থার লােক এবং আইনজীবী-সাংবাদিকদের স্তম্ভিত করে দেয়। এ বিষয়ে ওইদিন আদালত কক্ষে উপস্থিত বিশিষ্ট সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, ১৯৬৮ সালের ২০ জুন, সকাল ৯টায় মামলা শুরুর দিন ঢাকা শহর ও সামরিক এলাকায় উত্তেজনাকর উৎকণ্ঠাময় এক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সুস্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে, কুর্মিটোলাস্থ সামরিক ঘাঁটির বাহিনী আর জনগণের অবস্থান পৃথক সত্তায় অবস্থিত। তখন থেকে ডিএফআই (তিন বাহিনীর সংযুক্ত গােয়েন্দা সংস্থা) সামরিক বাহিনীর বাইরে কিছুটা প্রকাশ্য কিছুটা অপ্রকাশ্যভাবে মামলার প্রতিক্রিয়া জানা ও জনগণের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উম্মুক্ত হতে থাকে। এদের প্রধান সহযােগী ছিল প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা বিভাগ। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বিএনপি সরকারের) জনাব মুস্তাফিজুর রহমান তখন অভিযুক্তদের ইন্টারােগেশনের কর্তৃত্ব করতেন বলে সংশ্লিষ্টগণ জানান। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রথমদিকে প্রবেশের সময় মনে হতাে একটি ভীতিকর নির্যাতন কক্ষে অথবা গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করছি। ক্ষুদ্র কক্ষের বিচারকদের ডান পাশে ছিল নির্দিষ্ট কয়েকজন সাংবাদিকের জন্য চেয়ার ও টেবিল। তাঁদেরই ডান পাশে গা ঘেঁষে বক্ষ সমান্তরাল বেড়ি দিয়ে অভিযুক্তদের (আসামী) জন্য স্থান করা হয়েছিল। উঁচু এজলাসের মুখােমুখি অতি নিকটে ছিল দুই পক্ষের কৌসুলিদের বসার স্থান। তাদের পেছনে ছিল দর্শকদের জন্য নির্ধারিত চেয়ার। সাক্ষীর কাঠগড়া এজলাসের বাঁ হাতের কোণায়। নটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে বিচার কক্ষের ডানদিকের দরজা দিয়ে অভিযুক্তদের নির্দিষ্ট এলাকায় উপস্থিত করা শুরু হয়। সমগ্র কক্ষ নিস্তব্ধ।
পিন পতনের শব্দও যেন শােনা যাবে। ন’টা প্রায় বাজে বাজে। বিচারকগণ পেছনের দরজা দিয়ে এজলাসে স্ব-স্ব আসন গ্রহণ করবেন। বিচারপতিগণ আগমনের পূর্বে উৎকণ্ঠিত আইনজীবীগণ এবং অতিকষ্টে অনুমতিপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের মা-বাবা সন্তান ও আত্মীয়স্বজন দর্শকরূপে নির্বাক হয়ে পাশের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রথমেই অভিযুক্তদের অভিযােগের গুরুত্ব অনুযায়ী প্রদত্ত আসন নম্বর আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। প্রথম যিনি পাশের দরজা দিয়ে ট্রাইবুনাল কক্ষে প্রবেশ করলেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে অভিযুক্ত এক নম্বর ব্যক্তি, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত দীর্ঘকায় শঙ্কাহীন মানুষটি দৃঢ় পদক্ষেপে নির্দিষ্ট আসনের দিকে এগিয়ে এলেন। প্রবেশের পরেই তিনি সমগ্র কক্ষটির ওপর চোখ বুলিয়ে গেলেন। খালি উঁচু এজলাসের দিকে তাকালেন। মৃদু হাসি, বলিষ্ঠ মনােভাব ও অকুতােভয় মানুষটিকে দেখার সাথে সাথে দর্শক ও আইনজীবীদের মধ্যে একটি গুঞ্জন শােনা গেল। তিনি যেন ভুলেই গেছেন যে ফাঁসি দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের কোনাে মামলায় তাকে আনা হয়েছে। তার পাশেই ছিলেন দু’নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তি বিদ্রোহের প্রধান পরিকল্পনাকারী লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন ও তৃতীয় ব্যক্তি তেজী স্টুয়ার্ট মুজিবর রহমান এবং তার পরেই সুলতান উদ্দিন। শেখ মুজিব চিরাচরিত অভ্যাসমতাে পা বাড়িয়ে প্রথম সারির কোণায় প্রথম আসনে অতি স্বাভাবিকভাবে পা ক্রস করে বসলেন। তখনি আমি তার পাশাপাশি হয়ে গেলাম। মাঝখানে কাঠ ও লােহার রডের বিভাজন মাত্র। আমি রিপাের্টারদের সারিতে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বসা ছিলাম বলে আমার ও তার মধ্যে মাত্র হাত দুয়েক ব্যবধান ছিল। এমনটি ঘটবে তা আগে ভাবিনি। একবার তার মুখের দিকে চাইবার সাথে সাথে ঘােষণা হলে বিচারকগণ প্রবেশ করছেন। প্রধান বিচারপতি এসএ রহমানের আসন গ্রহণের সাথে সাথে দুপাশে দুজন বিচারপতি আসন অলঙ্কৃত করলেন। এখন বিচার শুরু। স্বাভাবিকভাবেই সরকারপক্ষ থেকে অভিযােগ।
উত্থাপিত হচ্ছে মঞ্জুর কাদের দাড়িয়ে মৃদু ও সুসভ্য কণ্ঠে আনুষ্ঠানিক দিক ব্যাখ্যা করছেন। আমি এবং অন্য সমস্ত রিপাের্টারই ফাঁসির আসামী এক নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সারাজীবনই মুজিব ভাই বলতাম। ফলে সবার মনেই একদিকে যেমন তার সম্পর্কে উৎকণ্ঠা, অপরদিকে তাঁর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য নানা প্রশ্ন জাগছিল। এমন কি এতাে সতর্কতার মধ্যেও কথা বলা যায় কি না সেই ফাক আমরা স্ব-স্ব পদ্ধতিতে ভাবছিলাম। কিন্তু যমের মতাে জাদরেল কালাে গাউন পরিহিত তিনজন বিচারপতি এবং সতর্কতাদানকারী বহুসংখ্যক ডিএফআই এবং আইবির লােক ক্ষুদ্র কক্ষটিতে শ্যেনদৃষ্টিতে শেখ সাহেবের দিকে চেয়ে আছেন। ভাবলাম, ডানদিকে বাঁকা করলেই গর্দান যাবে। এমন সময় আকস্মিক ডাক, ফয়েজ, ফয়েজ, এই ফয়েজ!’ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মূর্তির মতাে বিচারকদের দিকে চেয়ে রইলাম। একটু পরেই আমার ডান উরুতে শেখ সাহেব হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন। দেখলাম তার সেই বিখ্যাত পাইপের আঘাত। নিশ্চয়ই তিনি অভ্যাসের দাবিতে (তামাকহীন) পাইপ আনতে অনুমতি পেয়েছিলেন। সাধারণত কোর্টে এ সমস্ত অনুমতি দেয়া হয় না। এবার কি করি! আমি দুই পক্ষের কৌসুলিদের সামান্য তর্ক-বিতর্কের ফঁাকে পূর্বের ন্যায় প্রস্তর মূর্তির মতাে অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললাম, ‘মুজিব ভাই, কথা বলা মানা। মাথা ঘােরাতে পারছি না। বের করে দেবে।’ তক্ষুনি উত্তর আসলাে যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে, ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে।’ তার এই কথা ছিল রাজনৈতিক ও প্রতীক ধৰ্মী। স্তম্ভিত কোর্ট, সমস্ত আইনজীবী ও দর্শকগণসহ সরকারি অফিসাররা তার এই সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। প্রধান বিচারপতি একবার ডানদিকে ঘাড় বাঁকা করে শেখ মুজিব ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দিকে তাকালেন। কিছুই বললেন না। কোনাে সতর্ক উচ্চারণ ছিল না।
তিনি হয়তাে কোর্টের আভিজাত্য বােধ থেকে এই দৃষ্টিপাতকেই যথেষ্ট সতর্কতা। প্রদান বলেই মনে করেছিলেন এবং বােধহয় নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে, শেখ মুজিব এমন। কারাগার, ভয়ভীতি, শঙ্কা ও ট্রাইবুনালের বিচারের মধ্যেও শেখ মুজিবই রয়ে গেছেন। তবে কিসের সমর্থনে শেখ মুজিবের এই মনােবল, তা তিনি এমন সুউচ্চ অবস্থান থেকে। অনুমান করতে পারেননি। তখন তিনি জানতেন না যে, শেখ মুজিবের এই প্রতীকী। উচ্চারণ একজনের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জনগণের মধ্যে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের বাণীস্বরূপ। -(ফয়েজ আহমদ, ‘আগরতলা মামলা’, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ’)
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক
ছবি – স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের।