মােয়াজ্জেমের লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি এবং স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষোভ
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গােপন বিপ্লবী তৎপরতায় সামিল হয়ে ভাগ্যচক্রে হােক দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্রে হােক অভিযুক্তদের যে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে জীবন যাবার উপক্রম হয়েছিল তা অনস্বীকার্য। আর সরকার এ মামলা কোনাে না কোনােভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ওইসব অভিযুক্ত ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনও বিপন্ন হতাে। আন্দোলন পড়ে থাকতাে মুখ থুবড়ে। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে অভিযুক্তদের সবার দৃঢ় অস্বীকৃতি এবং এই মামলাকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যায়িত করে। সৃষ্ট গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মুক্তি পান। তবে তারা যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশপ্রেম ও ত্যাগের মহিমা সৃষ্টি করেছেন, সশস্ত্রবাহিনীর অন্য বাঙালি সদস্যদের মধ্যে স্বাধীনতার মন্ত্রবীজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন তা পরবর্তীতে সেসব বাঙালি সৈন্যকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উজ্জীবিত করেছে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অধ্যায়টুকু ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যােগ্য। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী কোনাে সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ অনুসন্ধান কিংবা মূল্যায়ন ও সঠিক ইতিহাস রচনার উদ্যোগ নেয়নি। বেসরকারি পর্যায়েও সমসাময়িক লেখালেখিতে মামলার কার্যক্রম, অভিযােগ এবং অভিযুক্তদের তৎপরতা সম্পর্কে ভাসা ভাসা কিছু লেখালেখি হলেও তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে বসে অনুসন্ধানমূলক বা তথ্য নির্ভর লেখা কোনাে ইতিহাস রচনা চোখে পড়েনি।
এ নিয়ে অনেকের মধ্যে দুঃখ ও ক্ষোভ জমা হয়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল বলেন, “আমরা যে গােপন আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম তাতে আমাদের নিজেদের কোনাে স্বার্থ চিন্তা ছিল না। পাকিস্তানিদের শােষণ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার পুরাে বাঙালির স্বার্থই আমরা চিন্তা করেছিলাম। আমাদের যে আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যে সশস্ত্র প্রস্ততিমূলক তৎপরতা তার কোনাে কিছুই। মিথ্যা ছিল না। যদিও আত্মরক্ষার্থে সেদিন আমরা তা অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর কি আওয়ামী লীগ, কি বিএনপি কোনাে সরকারই আমাদের কার্যক্রমের সরকারি স্বীকৃতি দিল না এটাই আমাদের বড় দুঃখ। সার্জেন্ট জলিল ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের অনেকের দেখা হয়েছে, নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। সমস্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। তবে আমাদের কাজের স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে কথা হয়নি। আমরাও এনিয়ে তার কাছে কোনাে কথা তুলিনি। কারণ, তখন আমরা ভেবেছি দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র, চারদিকে নানা সমস্যা। এটা কোনাে কিছু চাওয়ার সময় না । তবে বঙ্গবন্ধু সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে না ভাবলেও আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি ভাবতেন-একথা উল্লেখ করে জনাব জলিল বলেন, বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে বললেন, তুমি তাে এয়ারফোর্স থেকে চলে এসেছাে, এখন কি করতে চাও, কোথায় যেতে চাও।’ আমি বললাম, আপনি যদি বিশ্বাস করতে পারেন-আমার কথা শেষ করতে না করতেই তিনি আমাকে তেজগাঁও সরকারি মােটর ভ্যাহেইকল ওয়ার্কশপে ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়ােগ দেওয়ার কথা জানান। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি সেখানে ওই পদে ছিলাম।
সারাদেশের সরকারি গাড়ি এখান থেকে রক্ষণাবেক্ষণ হতাে। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও পরবর্তী কোনাে সরকারই আমাদের স্বীকৃতির বিষয়টি আমলে নেয়নি।” তিনি জানান, ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আগরতলা মামলার আসামিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি তুলে ধরে আওয়ামী লীগের সাংসদ হাদিউজ্জমান দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব তােলেন। কিন্তু সরকারিভাবে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। পরে সাংসদ কর্ণেল (অব.) শওকত আলী হাদিউজ্জামানকে দিয়ে সংসদে একটি বিল উত্থাপনের চেষ্টা করলেও অজানা কারণে তা আর হয়নি। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ৬৯র গণআন্দোলনের সূচনা। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতেও সরকারিভাবে কোনাে কর্মসূচি থাকে না। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে বিমানবাহিনীর সদস্যরা এসে তার কবরে ফুল দিতেন। গার্ড অব অনার দিয়ে সম্মান জানাতেন। বর্তমানে আসামিদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা, প্রয়াতের পরিবারের সদস্যরা এবং জহুরুল হক হলের ছাত্ররা ছাড়া আর কেউ তাঁর কবরস্থানে যান। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল করা হয়। পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা সগ্রামের ইতিহাসের ধারাবহিকতায় আগরতলা মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে একটা অধ্যায় থাকা উচিৎ বলে অভিমত দেন সার্জেন্ট জলিল। মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খুরশিদ উদ্দিনের বিভিন্ন সময় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতি নিয়ে কথা হয়নি। তিনি বলেন, ‘মামলা শেষে আমরা চাকরি বা ব্যবসা যার যেটা দরকার সেভাবে জড়িয়ে পড়ি। পরে আমাদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি তাদের মধ্যে যারা সেনাবাহিনীতে থাকতে চেয়েছেন তাদেরকে চাকরিতে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে অন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে চাওয়া পাওয়া নিয়ে তেমন কথা প্রকাশ্যে হয়নি। তবে কোনাে সরকার গৌরবময় বিষয়টিকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি না দেওয়ায় অনেকের মধ্যে কিছু ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
কমান্ডার আবদুর রউফ বলেন, “মামলা থেকে রক্ষা ও জীবন বাঁচানাের তাগিদ থেকে। আমরা সবকিছু অস্বীকার করি। কিন্তু পরবর্তী সময়েও আমরা যে বিষয়টি স্বীকার করিনি তার কারণ রাজনৈতিক। সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপে এবং অন্যান্য জায়গায় অবস্থানকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক কিছু মতভেদ সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে আমরা একমত ও একত্রিত হয়েছিলাম। গ্রুপের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজে আমাদের আদর-স্নেহ সহানুভূতি যা দেওয়ার যথেষ্ট দিয়েছেন। ‘৭৬ সালে আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কোনাে পাওনা না দিয়ে আমার চাকরি যাওয়ার ২১ বছর পর শেখ হাসিনা আমার পদমর্যাদা ও সার্ভিস বেনিফিট সব ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেকে আমাদেরকে যথার্থ মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন কিংবা খাটো করে দেখার চেষ্টা করেছেন। এর প্রমাণ, এখনাে মামলাটিকে অনেকে ‘তথাকথিত’ বলে উল্লেখ করেন। ধারণা করা হয়, দলের নেতা-কর্মীদের আবেগের কারণে গ্রুপ হিসেবে তখন আমাদের যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। পরবর্তীতেও আওয়ামী লীগ সরকার কোনাে পদক্ষেপ না নেওয়ায় কিছু দুঃখ তাে সবার মনে থাকতেই পারে।” লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের স্ত্রী কোহিনুর বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বােঝা গেছে মামলা চলাকাল থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে মােয়াজ্জেম পরিবারের কিছু ভুল বােঝাবুঝি। তৈরি হয়েছিল। ৬৯ সালে আইউব খান দেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আলােচনার জন্য রাওয়ালপিণ্ডিতে গােলটেবিল বৈঠক ডাকলে মাওলানা ভাসানীসহ অনেকে সেই বৈঠকে যেতে অস্বীকৃতি জানান। বাইরে প্রকাশ পায় যে, সে সময় শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যােগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তাতে সম্মত হন।
অনেকেই তখন শেখ সাহেবের সমালােচনা করেন, তিনি হয়তাে আইউবের ফাদে পা দিয়ে কোনাে রকম সমঝােতা করবেন এই আশঙ্কায়। এমন সমালােচনামূলক কথাবার্তা শুনে তা বিবেচনায় নেন মিসেস মােয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘আমি শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলেছিলান প্যারােলে না যাওয়ার জন্য। কারণ উনি (শেখ মুজিব) প্যারােলে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে কেউ কেউ বলেছিলেন, উনি হয়তাে সেখানে গিয়ে সরকারকে কিছু একটা বুঝিয়ে বের হয়ে যাবেন, আর এদিকে এদের (মােয়াজ্জেম ও অন্যদের) জেল-টেল কিছু একটা শাস্তি হয়ে যাবে। বিষয়টি আমার মাথায়ও ঢুকলাে। আমি তখন শেখ সাহেবকে গিয়ে বলি, “আপনি এভাবে প্যারােলে মুক্তি নিয়ে যেতে পারেন না। গেলে এদের সবাইকে। নিয়েই বেরােতে হবে।’ উনি তখন আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাকে বললাম, “দেখুন আপনি যেমন ফরিদপুরের মানুষ, আমিও ফরিদপুরের মেয়ে। কিছু একটা হলে আমি ছাড়ব না।’ উনি তখন বলেছিলেন, “আরে মেয়ে বলে কী? আমি সবাইকে নিয়েই বেরােবাে। পরে আমার স্বামী মুক্তি পেয়ে আমাকে বলেছিলেন, শেখ সাহেব নাকি বলছেন, “তােমার স্ত্রী তাে বাঘের বাচ্চা বাঘিনী।
এদিকে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পুরােপুরি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার মন্ত্রে মানুষকে উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেন। একজন এক ভােটের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ছয় দফার ব্যাপারে ম্যান্ডেট আদায়ের দিকে এগিয়ে যান তিনি। তাঁর উপলব্ধি ছিল ছয় দফা পাকিস্তানিরা মানবে না। ছয় দফা না মানলে তার ভিত্তিতে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করা যাবে। সংশ্লিষ্ট সেনা সদস্যদের কয়েকজন জানিয়েছেন, কমাণ্ডার মােয়াজ্জেমের মন সেদিকে তখন সায় দেয়নি। তিনি লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন পরিষদ’ নামে নতুন একটি সংগঠন তৈরি করেন। যদিও সেটি তেমন একটা গ্রহনযােগ্যতা পায়নি। মিসেস মােয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি শুনেছি মামলা থেকে বের হয়ে আসার পর ওনার সঙ্গে (বঙ্গবন্ধুর) আমার স্বামীর কোনাে কারণে হয়তাে বিরােধ দেখা দিয়েছিল। শেখ সাহেব নাকি একদিন তাকে বলেছিলেন ‘মােয়াজ্জেম, দেশটাকে স্বাধীন করতে পারলে তােমাকে দেশের রাষ্ট্রদূত করে দেব।’ মােয়াজ্জেম নাকি বলেছিল আমার ওসব কিছুর লােভ নেই। দরকারও নেই। মার্কিনীরাও নাকি তাকে বলেছিল, সেন্ট মার্টিনটা আমাদের দিয়ে দিলে আমরা তােমাদের সাহায্য করব।’ কিন্তু মােয়াজ্জেম দেশের কথা ভেবেছিলেন। কোনাে লােভ তার ছিল না। সে লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন পরিষদ গঠন করে ৭০ সালে। এ নিয়ে কিছু ক্যাম্পেইনও করে। তখনকার আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের বেশ কিছু নেতা-কর্মী মােয়াজ্জেমকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অনেকেই তাকে একটি নতুন পার্টি করার প্রস্তাব দেন।
তাই মার্চেই সে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী দল’ নামে একটি পার্টি গঠনের ঘােষণা দেয়, যেটার অনুসরণে পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংগ্রহ করে রাখিনি। এ ছাড়া কোনাে কিছুতে সামনে থাকতাম না বলে সংশ্লিষ্ট কারাে চেহারা বা নামও মনে রাখতে পারিনি।” স্বাধীনতার পর থেকে মােয়াজ্জেমকে সরকারিভাবে মূল্যায়ন বা পরিবারের প্রতি কেউ খোঁজখবর রাখেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করে মিসেস মােয়াজ্জেম। আগরতলা মামলা উঠে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ও কমাণ্ডার মােয়াজ্জেমের মধ্যে দূরত্ব প্রসঙ্গে মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “জেলে থাকা অবস্থায় কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের চিন্তা ছিল আমাদের যে চিন্তাধারা অর্থাৎ সশস্ত্র উপায়ে দেশকে স্বাধীন করা এবং জেল থেকে বের হওয়ার পর আবার সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে জনগণকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে জাতীয় নেতায় পরিণত হন। অপরদিকে কমাণ্ডার মােয়াজ্জেমের রাজনৈতিক কোনাে অভিজ্ঞতা বা অর্জন ছিল না। পরে তিনি লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে পৃথকভাবে অগ্রসর হতে চাইলেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তা তেমন গুরুত্ব পায়নি। সম্ভবত এনিয়ে উভয়ের মধ্যে কিছুটা ভুল বােঝাবুঝি এবং দূরত্ব তৈরি হয়।
লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি “লে, কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম যে লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি করেন তাতে সুলতান উদ্দিন, এবিএম সামাদসহ কয়েকজন প্রথম দিকে যােগ দিয়েছিলেন। তবে অনেকে এতে সম্মতি দেননি। আলী নওয়াজের মতে, “আমি তখনই বুঝেছিলাম, এটা করে কোনাে লাভ হবে না, জনগণের মাঝে কোন প্রভাবও ফেলা যাবে না। বিষয়টি আমি মােয়াজ্জেম ভাইকে বুঝিয়েছিও। আলী রেজা ভাইও তাকে বুঝিয়েছেন যে, “দেখুন এসবের দরকার নেই। কারণ শেখ সাহেবকে এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দিকে যেতেই হবে। দেশের জনগণ ও অন্যান্য নেতা-কর্মীরা সেদিকে অনেক অগ্রসর হয়েছে। শেখ সাহেব যদি সেদিকে না এগােন তাহলে তিনিই পিছিয়ে পড়বেন। ভাইও (আলী রেজা) বলছিলেন, শেখ সাহেবের সঙ্গে আমাদের কিছু বিষয়ে পার্থক্য হয়তাে রয়েছে। কিন্তু এক দফাকে তাে তিনি অনুমােদন করেছেন, বলেছেন এক দফা ছাড়া উপায় নেই। এ ছাড়া তার সঙ্গে যেরকম জনতা ও ছাত্র নেতা-কর্মী রয়েছে, সে রকম তাে আর কারও নেই। কাজেই এগুলাে করে লাভ হবে না। তারা কিছুদিন বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা সভা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওটা তেমন কার্যকরী হয়নি।” এ প্রসঙ্গে মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী আইউব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগে যােগ দেওয়া বঙ্গবন্ধুর তকালীন আস্থাভাজন মােয়াজ্জেম মাহমুদ চৌধুরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মােয়াজ্জেম মাহমুদের একাধিকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু মােয়াজ্জেম সাহেবের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের খোজখবর না নেওয়ায় তিনি বঙ্গবন্ধুর ওপর কিছুটা অভিমান করেন।
মােয়াজ্জেম সাহেব একদিন মাহবুব উদ্দিন চৌধুরীকে বললেন, আমি তার জন্য এতকিছু করলাম, অথচ তিনি আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন না যে আমার ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে। আমিও নিজ থেকেও কিছু বলিনি।’ স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দুনীতি বেড়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর আগরতলা মামলাখ্যাত সহযােদ্ধাদের অনেকের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা বিচ্ছিন্ন এই পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলােচনা করছিলেন পরিস্থিতি উত্তরণে কী করা যায়। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কীভাবে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে নিজেদের মনের কথা তারা মন খুলে বলতে পারবেন সে চিন্তা তারা করছিলেন। মাহবুব চৌধুরীর ভাষায়, দেশের যে পরিস্থিতি, জনগণের কষ্ট যেভাবে বাড়ছিল, এমন বাংলাদেশ তাে আমরা চাইনি।’ প্রসঙ্গত মাহবুব চৌধুরী ইতিমধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ৭৪ এর জুলাইয়ের আগে তার আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি। এদিকে, কোনাে না কোনাে সূত্রে তাদের হতাশা ও অসন্তোষের কথা বঙ্গবন্ধুর কানে পৌছে যায়। তিনি একদিন সংশ্লিষ্টদের গণভবনে ডেকে পাঠান তাঁদের কথা শােনার জন্য। মাহবুব চৌধুরী জানান, “তখন আগরতলা মামলার আসামি চট্টগ্রামের মাহফুজুল বারী ছিলেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপপ্রধান। শেখ সাহেবের কাছে তার যাতায়াত ছিল। ৭৪ সালের জুলাই মাসে তিনি আমাদের বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের গণভবনে ডেকেছেন। আমাদের মধ্যে যারা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে ছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গােপন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে ১৮ জন ২৬ জুলাই গণভবনে যাই। যাওয়ার সময় আমরা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবরণসহ একটা প্রস্তাবনাও তৈরি করে নিই এবং সেটি তাঁকে দিই। বঙ্গবন্ধু সেটি পড়ার আগেই কথার ফাকে বললেন, “দেখ, দুর্নীতি দেখার জন্য বাইরে যেতে হবে না। আমি ৩২ নং বাড়ি থেকে গণভবনে আসি সকাল আটটায়। আর বাড়িতে ফিরি রাত আটটা-নয়টায়।
মাঝে মাঝে প্রয়ােজন হলে ঢাকার বাইরে যাই। আমার গাড়ির বিলটা তােমরা গিয়ে চেক করাে তাহলেই বুঝতে পারবে দেশে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়। কিন্তু কী করব। যাকে যেখানে দায়িত্ব দিই সে-ই। বেইমানি করে। যাকে বিশ্বাস করি সে-ই পেছনে চুরি মারে। দুর্নীতি সম্পর্কে তার এরকম কথা শুনে মনে হলাে আসলে সবকিছুই তার নখদর্পণে আছে। কিন্তু নানা কারণে সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। এ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, বর্তমান অবস্থায় বিরাজমান পরিস্থিতি বদলানাে যাবে না। এর পরিবর্তন করতে হলে সমাজতন্ত্র আনতে হবে এবং সেপথে এগুতে হবে। মনে আছে আমি তখন বলেছিলাম ‘এটা যদি সত্যি সত্যি মিন করেন, তাহলে প্রয়ােজনে গুলি এলে আমি আগে আমার বুকে গুলি নেওয়ার চেষ্টা করব।’ প্রসঙ্গত ১৯৭৪ এর জুলাইয়ে বঙ্গবন্ধু যে পরিবর্তনের কথা বললেন, তার মাত্র ছয় মাসের মাথায় অর্থাৎ ৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাকশাল পদ্ধতি চালুর ঘােষণা দেন।” আলী নওয়াজ স্মৃতিচারণ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর অনেক মানবিক গুণাবলী ছিল। তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালাে হওয়ায় নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে দ্বিধা করতাম না। অনেক সময় তিনি তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাইয়েছেন। কখনাে কোনাে কথায় ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, কিংবা ওনার কথায় অভিমান করে বলেছি, ঠিক আছে আমি খাব না।’ উনি তখন জোর করে আমার মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন।’ বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ফেলেন আলী নওয়াজ। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, “আজ আমাদের কোনাে মূল্যায়ন নেই। আমরা যেন কেউ না। এটাই বড় দুঃখ। আরও একটা দুঃখ আমাদের মধ্যে রয়েছে।
সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার পর দেশের দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে ডেকে কোনাে পরামর্শ করেননি। তিনি যদি আমাদের সবাইকে ডেকে বলতেন, “দেখ দেশের আজ এই অবস্থা, তােরা কিছু একটা কর। আমরা তখনই তার ডাকে সাড়া দিতাম। তিনি হয়তাে ডাকার সুযােগই পাননি। ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে কোনােদিকে মনযােগ দিতে দেননি। এ ছাড়া তিনি অনেক সময় বাস্তবতাও বুঝতে চাননি। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের অনেক আগেই আমরা তাকে বুঝিয়েছি, স্যার আপনি নিরাপদে থাকুন, সতর্ক থাকুন। কারণ আপনাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে। তিনি এসবে পাত্তা না দিয়ে বলতেন, ‘আমাকে কে মারবে। আবার? আমি একবার মুখের ওপর বলেছিলাম, বাঙালিরাই মারবে।” ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় মনােনয়নকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলী রেজার মননামালিন্য দেখা দেয়। আলী নওয়াজের দেওয়া তথ্য মতে, ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনােনয়ন বাের্ড আলী রেজাকে প্রাদেশিক পরিষদের একটি আসনে মনােনয়ন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আলী রেজা চেয়েছিলেন জাতীয় পরিষদের আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। এ ব্যাপারে তিনি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বললে বঙ্গবন্ধু তাকে ভবিষ্যতে পররাষ্ট্র বা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মতাে জায়গায় কাজে লাগানাের প্রয়ােজনের কথা বলেন। কিন্তু তাতে তিনি (আলী রেজা) সন্তুষ্ট হতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে পুরােনাে সম্পর্কের সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাতায়াত-যােগাযােগ থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হলে এর যৌথভাবে আহ্বায়ক হন আবদুল আউয়াল ও আলী রেজা।
এর আগে আউয়াল সাহেব ছিলেন আদমজি শিল্প গােষ্ঠীর শ্রম বিষয়ক উপদেষ্টা। কিন্তু আলী নওয়াজের ভাষায় ‘এক পর্যায়ে জাসদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক তৎপরতার প্রবণতা দেখা দেওয়ায় তিনি সেখানে থাকেননি।’ জয়নাল আবেদীন খান বলেন, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের সামগ্রিক অবস্থা ভালাে ছিল না। নিজেরও ছিল না কর্মসংস্থান। একদিন আমি লে, মতিউর রহমানের সাথে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। অনুরােধ করি আমাদের কোনাে রকম কর্মসংস্থান করা যায় কী। তিনি স্বাধীনতার জন্য আমাদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছিলেন, “দেখুন সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হল। এই মুহূর্তে চারদিকে নানা ঝামেলা, সংকট। একটু অপেক্ষা করুন। সামনে দেখি কী করা যায়। এরপর আর কখনাে তার কাছে যাইনি, অন্য কাউকেও কিছু বলিনি। মনের কষ্ট মনে চেপে রেখেছি। আজ এতদিন পর স্বাধীনতার জন্য আমাদের ভূমিকার কথা শুনে অনেকে হয়তাে ভাববেন, আমরা এসব বানিয়ে বলছি। কারণ স্বাধীনতার আগে আমাদের প্রথম দিকের কার্যক্রমকে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করা হয়েছে এবং সেভাবেই তা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমার মনে হয় এ কারণেই পরবর্তী সময়ে এভাবে আমরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছি।’ কর্নেল (অব.) শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। সেটা পেয়েছি এবং এর চাইতে বড় পাওনা হতে পারে না। তবে সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলে সবাই মানসিকভাবে শান্তি পেতেন।
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক