You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ষড়যন্ত্র
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে রণাঙ্গণে অবস্থানরত ডা. খুরশিদ। উদ্দিন উপলব্ধি করেন বেসামরিক সরকার বা প্রশাসনের সঙ্গে কতিপয় সামরিক মুক্তিযােদ্ধা তথা সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। উভয় পক্ষের মধ্যে রয়েছে নীতির পার্থক্য। এ বিষয়ে ডা. খুরশিদের জবানবন্দি; “আমরা জানি ইতিপূর্বে স্বাধীনতার ঘােষণার মধ্য দিয়ে একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছে। কেবিনেটেও সব বেসামরিক রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু কয়েকমাস পর দেখা গেল কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার এই ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না। আগস্ট মাসে সেক্টর কমান্ডারদের এক সভা হয় ৮নং থিয়েটার রােডে। সেখানে একটি মিলিটারি কমান্ড কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব দিয়ে কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার বলেন, তাহলেই আমরা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যাব। সেখানে তারা যুক্তি দেখান যে, বেসামরিক নেতারা এখানে-ওখানে বক্তৃতা করতে করতে ঘুরে ফিরে সময় নষ্ট করেন।
তারা জেনারেল ওসমানী বৃদ্ধ হয়ে গেছেন উল্লেখ করে মিলিটারি কমান্ড কাউন্সিলে তাকে না রাখার কথাও বলেন। প্রস্তাবকারীদের মধ্যে ছিলেন ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এবং মেজর জিয়াউর রহমান। বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে ক্ষুব্ধ হন এবং মিলিটারি কমাণ্ড কাউন্সিলের প্রস্ত বিকদের উদ্দেশে বলেন, যারা এরকম আলাদা কাউন্সিল করতে চায় তাদের ভারত থেকে বের করে দেওয়া হবে।’ তারা এও বলেন যে, আমরা মিলিটারিদের সঙ্গে কোনাে ডিল (চুক্তি) করবাে না। কারণ বেসামরিক সরকারের লােকজন বিশ্বের কাছে বলতে পারবেন তাঁদের লােকদের ওপর পাকিস্তানিরা অবিচার, নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদি চালাচ্ছে তাই তারা বিশ্বের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। এ ছাড়া জনগণের কাছে তাদের যেতে হয় বা যেতে পারবে যুদ্ধের ব্যাপারে জনমত গঠন করার জন্য। কিন্তু তােমাদের তাে (মিলিটারিদের)। কেউ সাহায্য করবে না। বিষয়টি তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বিষয়টি তারা তাজউদ্দিন আহমদসহ সংশ্লিষ্ট নেতাদের জানিয়ে সতর্ক করে দেন। অবশ্য ওসমানী সাহেব তার বিরুদ্ধে জিয়াসহ যারা যারা ছিলেন তাঁদের সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। পরে জানা গেছে, ওই ধরনের বিরােধপূর্ণ কাজের নীতিটা তৈরি করেছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে আগস্টের সেই সভার খবর জানতে পারেন। এ ছাড়া নানাজনের কাছ থেকে তিনি খবর নিতেন। সব জেনে সম্ভবত তিনি ভালােভাবে আস্থায়। নিতে পারেননি বিরােধিতাকারীদের।”
পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব জলিলের আগরতলা মামলার অন্য আসামিদের মতাে এবিএম সামাদও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ। নেন। তিনি কাজ করেন ৯নং সেক্টরে মেজর (অব.) আবদুল জলিলের অধীনে (পরবর্তীতে জাসদ সভাপতি, আরও পরে ইসলামী মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি)। নবম সেক্টরের রাইফেল কর্মকর্তা ছিলেন আগরতলা মামলার আর এক আসামি ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) ফজলুল হক । আর আসামি সুলতান উদ্দিন ছিলেন টাকি ক্যাম্পের ইনচার্জ। সেই ক্যাম্পে জমা থাকতাে অস্ত্রশস্ত্র। মেজর জলিলের অধীনে কাজ করতে গিয়ে সামাদ একদিন আবিষ্কার করেন মেজর জলিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও ভেতরে ভেতরে তিনি পাকিস্তান-বাংলাদেশ কনফেডারেশনের লক্ষ্যে কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে সামাদ বলেন, “আমাদের দলেরই একজন সুবেদার তাজুল ইসলাম এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার । আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকের ঘটনা এটি। একদিন মেজর জলিল আমাদের নিয়ে এক বিশেষ ঘরােয়া বৈঠক ডাকেন। সেখানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ক্যাপ্টেন ফজলুল হক, সুলতান উদ্দিন, স্টুয়ার্ড মুজিব, সুবেদার তাজুল ইসলামসহ আরাে কয়েকজন। বৈঠকে মেজর জলিল বললেন, দেখুন আমাদের এই যে আন্দোলন, এই আন্দোলন এখানেই শেষ হবে না। এরপরেও আমাদের আন্দোলন চলবে। কিন্তু আপনাদের মূল্যায়ন করার কেউ নেই। শেখ মুজিবও মুক্তি পাবেন না। তবে আমি আপনাদের মূল্যায়ন করবাে।’ বক্তব্যের এক ফাকে তিনি বললেন, দরকার হলে আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে পাকিস্তানের সঙ্গে যােগাযােগ করব, তাদের সঙ্গে কনফেডারেশন করব। কিন্তু ভারতের। আধিপত্য আমরা মেনে নেব না।” এবিএম সামাদ আরও জানান, মেজর জলিল সে সময় ভারতীয় সৈন্যদের আদৌ সহযােগিতা করতেন না। তাঁর এ ধরনের কাজকর্মে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার কারণেই শেষ পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। যদিও বিষয়টি শৃঙ্খলার কারণে তারা কখনাে প্রকাশ করেননি।
সামাদ ওই ঘটনার পর বাঘেরহাট চলে যান এবং যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তিনি মনে করেন, কিছু কিছু লােক যুদ্ধে গেলেও তারা দেশের স্বাধীনতা আদৌ চাননি, মেজর জলিল ছিলেন তাদেরই একজন। উল্লেখ্য, মেজর জলিল স্বাধীনতার পর নতুন গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি ছিলেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকেই মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য তিনি। তরুণ-যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। একই সঙ্গে ভারত বিরােধিতার নামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সদ্য গঠিত বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক চালান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হওয়ার পর এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে জলিল গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে মুক্তি পেয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তার আন্দোলন ভুল ছিল মন্তব্য করে ইসলামী মুক্তি আন্দোলন নামে মৌলবাদী চরিত্রের আদলে একটি দল গঠন করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানেই মারা যান।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!