You dont have javascript enabled! Please enable it!
অভিযােগ অস্বীকারের কারণ
আগরতলা মামলার আসামিদের কাছ থেকে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য তাদের ওপর প্রচণ্ড রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তানিরা। সেই মরণ যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেউ কেউ কিছু কিছু ফাঁক-ফোকর রেখে হলেও অভিযােগ স্বীকার করতে রাজি হন। আবার কেউ কেউ রাজি হন, “আমরা সত্যিই স্বাধীনতা চাই’ একথার সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে দেশপ্রেম প্রমাণ করার জন্য। এ পর্যায়ে কেউ কেউ রাজসাক্ষী হয়ে যান। পরে আবার পরবর্তী অবস্থা ও শেষ পরিণতির কথা ভেবে তাদের কেউ কেউ হয়ে যান বৈরি সাক্ষী। এ প্রসঙ্গে সার্জেন্টজলিলের বক্তব্য আমাদের আইনজীবীরা আমাদের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন যে, এটা একটা ক্রিমিনাল (ফৌজদারি অপরাধ) মামলা। এখানে যদি আমরা সবকিছু স্বীকার করে নিই, তাহলে বঙ্গবন্ধুসহ আমরা সবাই ফাঁসিতে মারা যাব। কারণ চার্জশিট (অভিযােগপত্র) ছিল সবার জন্য একটা। শুধু নাম ঠিকানাগুলাে ছিল ভিন্ন। সবার বিরুদ্ধে অভিযোেগ প্রায় একই, উদ্দেশ্যও একই। আন্দোলনের সামরিক বিভাগের শীর্ষ নেতা লে. কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনও একই যুক্তি স্বীকার করে আমাদের বললেন, হ্যা আমরা যদি এখন সব কিছু স্বীকার করে নিই, তাহলে আমরা তাে মারা যাবােই, আমাদের নেতা শেখ সাহেবও রক্ষা পাবেন না। আর পাকিস্তান সরকারও প্রকৃতপক্ষে এটাই চাচ্ছেন যে শেখ সাহেবসহ সবাইকে শেষ করা গেলে পুরাে আন্দোলনটাই শেষ হয়ে যাবে। কাজেই সমস্ত অভিযােগই আমরা অস্বীকার করবাে।’ ব্রিগেডিয়ার অব. খুরশিদ উদ্দিন বলেন, “মামলা চলাকালে প্রথম দিকে আমরা নিজেদের মধ্যে আলােচনায় ঠিক করি যে, আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেব। অনেকে নির্যাতনের স্মৃতি এবং জ্বালা মন থেকে মুছতে পারছিল না তখনাে।
কিন্তু আইনজীবীরা বললেন, “তােমাদের সবকিছু সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে হবে। কারণ স্বীকার করলে এক মুহূর্তও দেরি না করে যেনতেন ট্রায়াল শেষে সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হবে। এ ছাড়া যে উদ্দেশ্যে তােমরা গােপন সংগ্রাম শুরু করেছ, সেই উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে। আর তােমরা অস্বীকার করলে তােমাদের পক্ষে জনমত তৈরি হবে। তােমরা যা চাইছে তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে এবং তােমরা না পারলেও অন্যরা এগিয়ে যাবে। এ পরিকল্পনা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত আদালতে সব কিছু অস্বীকার করি আমরা।” বিধান কৃষ্ণ সেন বলেন, “একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একাংশকে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্ত এবং এতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদদ রয়েছে এমন একটি বিশ্বাস। জনমনে ঢুকিয়ে দিতে পারলে স্বাধীনতার পক্ষের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জনমত কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত হতে পারতাে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও তা গ্রহণযােগ্য হতাে না। ভবিষ্যতের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হতে পারতাে নানাভাবে। তাই ‘কিল খেয়ে কিল হজম করার মতাে এরকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিষয়বস্তু গােপন রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।’ মুপিরও স্বীকার না করার কারণ মামলা চলাকালে জীবন রক্ষার প্রয়ােজনে ঘটনা অঙ্গীকার করলেও মামলা থেকে মুক্তির পরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ থেকে কেন বিরত থাকলেন এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের কাছে। জবাবে এবিএম সামাদ বললেন, “যেদিন আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে সেদিন আমাদের সবার সামনে শেখ সাহেব এলেন। প্রত্যেককেই বললেন, ‘তােমরা জেনে রাখ । আমাদের আন্দোলন চলবে। তােমরাও থাকবে আন্দোলনে।
কিন্তু আপাতত বাইরে কেউ কোনােরকম বক্তব্য দেবে না। এখন যার যার জায়গায় চলে যাও। সময় মতাে আমিই আবার যােগাযােগ করবাে।’ ফলে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আর তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। এ ছাড়া, স্বাধীনতা পরবর্তী। সময়ে বিভিন্নজন নিজ নিজ চাকরি-ব্যবসা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন ঘাটাঘাটি না করায় ধীরে ধীরে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।” একই রকম কারণ উল্লেখ করেন বিধান সেন, নূর মােহাম্মদ বাবুল এবং এসএ সামাদসহ অন্যরা। কর্নেল (অব.) শওকত আলী বলেন, “পাকিস্তান আমলে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ বাস্তবতার কারণে আমরা ঘটনাটা অস্বীকার করি। তখন সীদ্ধান্ত হয়েছিল স্বীকার
করার ব্যাপারে। কিন্তু স্বাধীনতার পর এটা অস্বীকার করার কোনাে কারণ বা অর্থ আমি খুঁজে পাইনি। পরে বিভিন্ন বৈঠকে বঙ্গবন্ধুও এরকম ঘটনা ঘটার কথা স্বীকার করেছেন। কাজেই পাকিস্তান আমলে যা অস্বীকার করা হয়েছে এখনও তাই করতে হবে তা তাে ঠিক। নয়। বরং আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, পাকিস্তান আমলে আগরতলা মামলাকে মিথ্যা বা ‘ষড়যন্ত্র মামলা’ বলাটা ছিল একটা স্লোগান। আসলে ওই মামলায় আমাদের দিয়ে যা। বলানাে হয়েছে বা বলানাের চেষ্টা করা হয়েছে বলে আমরা অভিযোেগ করি তার সবটাই সত্য ছিল।”

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!