You dont have javascript enabled! Please enable it!

বন্দিদের ওপর নির্যাতনের বীভৎস কাহিনী

বিবস্ত্র করে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হতাে : খুরশিদ উদ্দিন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের লেলিয়ে দেওয়া সেনা কর্মকর্তারা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের | ওপর ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগেও যে কী অমানবিক, নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানা যাক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. খুরশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে: ‘৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি আমাকে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে দুসপ্তাহ ধরে চালানাে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একজন অফিসার আর একজন অফিসারকে লাঠি দিয়ে কীভাবে এমন নির্দয়ভাবে প্রহার করতে পারে তা এর আগে কখনাে ভাবতেও পারিনি। এভাবে নির্যাতন করতাে মূলত অবাঙালিরা। অনেক সময় সমস্ত চক্ষুলজ্জা ছেড়ে প্রায় ন্যাংটো (বিবস্ত্র করে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হতাে। আবার কখনাে একপায়ে দাঁড় করিয়ে প্রচণ্ড মারধর করতাে যতক্ষণ না মুখ দিয়ে কথা বের হতাে। জানতে চাইতাে শেখ সাহেবকে চিনি কি না? মােয়াজ্জেমসহ আর কার সঙ্গে যােগাযােগ ছিল। তাদের নানা জিজ্ঞাসাবাদের ধরণেই বুঝতে পারি তারা আমাদের অনেক কথাই জেনে গেছে।

কিন্তু এত নির্যাতনের পরও কিছুই স্বীকার করিনি। কারণ আমরা। কোনাে প্রমাণ জানামতে রাখতাম না। আমি মােয়াজ্জেমকে যেসব চিঠি লিখতাম, সেগুলাে সে নষ্ট করে ফেলতাে। একটি চিঠি শেষ পর্যন্ত তার একটা বইয়ের মধ্যে পেয়েছিল পাকিস্তানি গােয়েন্দারা। মামলা চলাকালে সেটি প্রমাণ হিসেবে আদালতে দাখিল করা হয়। ওই চিঠির মূল কথা ছিল, ‘আমরা তাে তৈরি, কিন্তু দেশ কখন স্বাধীন হবে, আমাদের পরিকল্পনা কেন পিছিয়ে যাচ্ছে? মা সন্তান-সম্ভাবা হলে যেমন দেরি করা যায় না। আমিও সেরকম সহ্য করতে পারছি না। আশা করি এবার আর গর্ভপাত হবে না ইত্যাদি। ওই চিঠির সূত্র ধরে আমাকে নির্যাতন করে কথা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। অবশ্য ঢাকায় আনার পর আর শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি। সার্জেন্ট জহুরুল হক, ফজলুল হক-এরা ছিলেন কমান্ডাে গ্রুপের সদস্য। পাকিস্তানিরা তাদেরকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। কারাগার এলাকায় যেসব চাকর, ভিক্ষুক ইত্যাদি আসতাে তাদের প্রতি জঘন্য দুর্ব্যবহার করতে পাকিস্তানিরা। এ ব্যাপারে প্রতিবাদমুখর ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। আর এটাকে অজুহাত করে তিনি বাথরুমে যাওয়ার সময় পেছন থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।”

শরীর এখনাে অবশ হয়ে যায় : আবদুল জলিল আগরতলা মামলার বিভিন্ন জনকে গ্রেপ্তার অভিযান চলাকালে সার্জেন্ট আবদুল জলিল ছিলেন ছুটিতে, পরিবারসহ বাংলাদেশে। ওই সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য সংশ্লিষ্টরা তার করাচির বাসায় গিয়ে জানতে পারেন তিনি দেশের বাড়িতে। এদিকে ছুটি শেষ হয়ে এলে তিনি আবার চলে যান করাচির বাসায়। অতপর তার দেশের বাড়িতে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা এলে জানা যায়, তিনি এরইমধ্যে করাচি চলে গেছেন। এভাবে পরােয়ানা তামিল করতে দেরি হওয়ায় তিনি একটু দেরিতেই গ্রেপ্তার হন করাচিতে, ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে। সার্জেন্ট জহুরুল। হক এবং মফিজুল্লাহও গ্রেপ্তার হন করাচিতে। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের কিছু স্মৃতি শােনা যাক জলিলের ভাষায়-“আমি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিলাম, যে কোনাে সময় গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারি। কিন্তু ছেলেমেয়ে স্ত্রী-সংসার ফেলে কোথাও চলে যেতেও পারছিলাম না। একদিন বাসায় খাচ্ছিলাম এমন সময় ওরা বাড়ি ঘেরাও করে দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলে দেখি গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা ওসমানী (পশ্চিম পাকিস্তানি)সহ বেশ কিছু পুলিশ। বুঝে গেলাম আমাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে। তাদের সঙ্গে বাইরে গিয়েই আবার অনুমতি নিয়ে বাসার ভেতরে যাই। আমার সঙ্গে থাকা ঘরের চাবি স্ত্রীকে দিয়ে নিজের পােশাক নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। পুলিশ হেড কোয়ার্টারে নিয়েই তারা প্রথমে আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করে। যেসব কক্ষে তারা নির্যাতন চালায় সেসব কক্ষে নিয়ে নির্যাতনের নানা নিদর্শন আমাকে দেখানাে হয়। এরপর আমাকে একটি সেলে রাখা হয়। সেখানে পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর, কক্ষ জুড়ে ঘুরঘুর করছিল মশা।

মশার কামড়ে ঘুম না আসায় একটা মশারি চাইলে তাও তারা দেয়নি। প্রথম দিন শারীরিক নির্যাতন না করলেও দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয় নানা অবর্ণনীয় নির্যাতন। কখনাে বরফের মধ্যে শুইয়ে রাখা, কখনাে বায়ুপথে বরফ ঢুকিয়ে দেওয়া, নখের ভেতর উঁচ ঢোকানাে, টায়ারের রাবার দিয়ে হাতের হাঁড়ে আঘাত করা থেকে শুরু করে এমন সব অমানবিক অত্যাচার তিনদিন ধরে করা হয়েছে যা এখনাে মনে উঠলে সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে উঠে। তিনদিন পর পর দেখি আমি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ (৭নং আসামি, প্রয়াত) এবং মাহফুজুল বারী (২২নং আসামি) আমাদের তিন জনকে একই কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। একই উদ্দেশে কাজ করা তিন। সঙ্গী একত্র হতে পেরে কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। তিনজনের জন্য একটা শৌচাগারও ঠিক করে দেওয়া হয়। ওরা দুজনও আমার মতাে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এর আগে । এক পর্যায়ে আমরা তিনজনের সঙ্গে সার্জেন্ট শামসুল হককে একই বিমানে বাংলাদেশে এনে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। বিমানের ভেতর এবং বিমান বন্দরের টারমাক থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত বাইরের কাউকে বুঝতে দেওয়া হয়নি যে আমরা কোনাে বন্দি। ক্যান্টনমেন্টে আমাদের রাখা হয় পাশাপাশি। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে দেখা করার সুযােগ ছিল না। এমনকি বাথরুমে গেলেও সেখানে এবং আমাদের কক্ষের সামনে পাহারাদার নিয়ােজিত থাকতাে। এক পর্যায়ে বুদ্ধি করে আমরা যে সেখানে আছি সেটা পরস্পরকে জানানাের জন্য বাথরুমের ভেতরের দেওয়ালে নাম লিখে রাখি।

কিছুক্ষণের মধ্যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি : শওকত আলী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে কর্নেল (অব.) শওকত আলী বলেন, গ্রেপ্তারের পর আমাকে প্রচণ্ড রকম নির্যাতন করা হয় যা ভাষায় বর্ণণা করা সম্ভব নয়। এক কথায় যত রকম নির্যাতন করলে সত্য-মিথ্যা সব স্বীকার করিয়ে সই নেওয়া যায় সেরকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আমার ওপর চালানাে হয়েছে। অনেকে নির্যাতন সইতে না পেরে রাজস্বাক্ষী হয়েছেন। কিন্তু আদালতে গিয়ে সব অস্বীকার করেছেন। ফলে তাদেরকে বৈরি ঘােষণা করা হয়েছে।’ “জেনারেল হেড কোয়ার্টারের নির্যাতন কক্ষে এসে মেজর মঞ্জুর আমার শার্টের কলার চেপে | ধরে আমাকে চড় মারতে থাকে। মেজর হক নেওয়াজ আমাকে একটা ব্যাটন দিয়ে পিটাতে শুরু করে। আমি প্রতিবাদ করলে বলা হয়, তুমি একটা বাঙালি কুত্তা-তােমাকে মেরে ফেলা উচিৎ। কিছুক্ষণ মারধােরের পর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তখন হক নেওয়াজ আমাকে লাথি মারতে থাকে। আমাকে ছয়দিন এই প্রকোষ্টে বন্দী রাখা হয়। ইতিমধ্যে আমাকে কোনাে উপযুক্ত খাদ্য দেওয়া হয়নি। কোনাে বিছানাপত্রও না। খালি মেঝেতে পড়ে থাকতে হতাে। একদিন সন্ধ্যায় আন্ডারওয়ার ছাড়া আমার গায়ের সব কাপড় খুলে  নিয়ে আমাকে ভােলা জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ঠাণ্ডায় আমি প্রায় জমে গিয়েছিলাম। আমি কাঁপতে শুরু করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি তিন দিন আমার ওপর বর্বরােচিত ও নির্দয় অত্যাচার চলে। লে. শরীফ আমার সিদ্ধান্ত জানতে আসে (স্বীকারােক্তি দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে)। আমি  মিথ্যা স্বাক্ষী দেব না বলাতে শরীফ বলে; ‘আমি ৫ মিনিটের মধ্যেই তােমাকে রাজি করাতে | পারি।’ এরপর হুমকি দেয় যে আগামী দিনের মধ্যে রাজি না হলে আমাকে প্রহার করা হবে।

পরের দিনও যখন আমি অসম্মতি জানালাম সে আমাকে বাঙালির জারজ সন্তান’ || ‘হিন্দুকা বাচ্চা’ বলে গালাগাল করতে থাকে এবং বলে যে, সমস্ত বাঙালির জন্য একটা  ডাক্তারের প্রয়ােজন। সে আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা জিপে তােলে এবং চতুর্দশ ডিভিশনের মেসের ভিআইপি হাউসে নিয়ে উঠায়। এখানে তিনজন লােক অপেক্ষা করছিল, সকলে মিলে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। শরীফ আমাকে আবার গালাগাল দিতে থাকে। পরে কয়েকটি চড় মারে। তিনজন ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। এদের একজন। ব্যাটন নিয়ে আমার সর্বাঙ্গে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আমি মাটিতে পড়ে যাই। তারা চুলের মুঠি ধরে মাটি থেকে তুলে আমাকে দাঁড় করায়। দুহাত ওপরের দিকে তুলে হাঁটু বাঁকিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ব্যাটন দিয়ে দেহের প্রতি গ্রন্থিতে আঘাত করতে থাকে আমি প্রায়শঃ মেঝেতে পড়ে। যাচ্ছিলাম। আর ওরা আমাকে চুলের মুঠি ধরে তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখছিল।  সারাক্ষণ আমাকে জঘন্য গালি দিচ্ছিল আর হুমকি দিচ্ছিল ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে  মারা হবে।’ মেস থেকে দুপুরে খানা পাঠান হয় এবং তা আমার সামনে একটা টিপয়ের ওপর রাখা হয়। কিন্তু সেটা আমাকে দেওয়া হয়নি। রাতেও আমাকে খাবার খেতে দেওয়া  হয়নি। আমি পানি চাইলে আমার মুখে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। একবার আমার মুখ তােয়ালে দিয়ে বেঁধে আমাকে চিৎ করে শুয়ে দেয়। এরপর আমার হাত পা বেঁধে রেখে আমার আবদ্ধ মুখে পানি ঢালতে থাকে। এতে আমার শ্বাসরােধ অবস্থা হয় এবং আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ২৪ জানুয়ারি আমাকে ঢাকায় এনে চতুর্দশ ডিভিশনের ৮-এ- কক্ষে আটক রাখা হয়। বেডের ওপর একটি অত্যধিক আলাে বিশিষ্ট বা সারা দিনরাত জ্বালিয়ে রাখা হতাে।

সেই দিনগুলাের কথা চিন্তা করতেও আমি ভয় পাই।” সুচগুলাে ডুকে যেত নখের ভেতর : আবদুর রাজ্জাক সুবেদার রাজ্জাকের স্ত্রী রিজিয়া ও ছেলে তরিকুল ইসলাম রাজ্জাকের উদ্ধৃতি দিয়ে তার ওপর পশ্চিমা সেনাকর্মকর্তাদের নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরেন এভাবে, “গ্রেপ্তারের পর থেকেই কথিত ষড়যন্ত্রের তথ্য প্রকাশ করার জন্য তাঁর ওপর নানান রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করা হয়। ওরা জানায়, (পাকিস্তানি কর্মকর্তারা) শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে। তা ছাড়া সাক্ষী দেওয়ার বিনিময়ে পদোন্নতি ও জমি দেওয়াসহ নানান রকম প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি (রাজ্জাক) প্রতিবারই নির্যাতনের সময় বলতেন, ‘দেশ, জাতি ও শেখ মুজিবের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারবাে না।’ ফলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি তার ওপর অসহ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, তাঁকে প্রথমে বরফের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখা হতাে। তখন একজন চিকিৎসক দাঁড়ানাে থাকতেন। চিকিৎসক যখন বলতেন যে, এখনই বরফ থেকে বের না করলে উনি মারা যাবে, তখন বরফ থেকে বের করে গরম পানি ভর্তি ব্যাগ দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হতাে। চিকিৎসকের কথামত আবার গরম পানির নিচ থেকে তােলা হতাে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় হাতের কবজি ও হাঁটুতে লােহার রড দিয়ে প্রহার করা হতাে নির্দয়ভাবে। রাতে দু হাত দুদিকে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হতাে এবং হাতের প্রতিটি আঙুলের মাথায় একটি করে বৈদ্যুতিক সুচ লাগানাে থাকতাে। ঘুম এলে হাতের সামান্য নড়াচড়ায় সূচগুলাে ঢুকে যেত নখের ভেতর। এ সময় জোরে কান্না এলে তিন জন পাকসেনা কর্মকর্তা এসে বলতাে বল, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবি কি না। তিনি বলতেন, ‘ফাসির দড়িতে ঝুললেও সাক্ষী দেব না।’

তাকে সব সময় অন্ধকার ঘরে রাখা হতাে। কারও সাথে দেখা করতে দেওয়া হতাে না। তিনি যখন ঢাকা সেনানিবাসের বন্দি হন তখন তার কোনাে খোঁজ না পেয়ে স্ত্রী পরিজন দিশেহারা হয়ে পড়েন। তার ছােট ভাই প্রয়াত আব্দুস সাত্তার সরকার তাঁকে খুঁজতে রংপুর সেনানিবাসে গেলে সেখান থেকে কেউ তাকে এ বিষয়ে কিছু জানাতে রাজি হননি। কেউ মুখ খােলার সাহস পর্যন্ত দেখাননি। অনেক চেষ্টার পর একজন বাঙালি সেনা সদস্য অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে জানান, ‘সুবেদার রাজ্জাক কুর্মিটোলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি। কিন্তু একথা আমি আপনাকে বলেছি জানলে আমার চাকরি থাকবে না। এ ছাড়া আমিও জেলে যাবাে।’ আগরতলা মামলার বিচারকাজ শুরু হবার পর থেকে অভিযুক্তদের তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়। বন্দি অবস্থায় অভিযুক্তদের পাশাপাশি কক্ষে রাখা হতাে। আগরতলা মামলা শেষ হলে ১৯৬৯ সালে রাজ্জাককে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়। বাথরুমে যেতেও হাতকড়া থাকতাে : কমান্ডার আবদুর রউফ আবদুর রউফ তার ছুটিকালীন মিশন শেষ করে ৬৭ সালের ১০ ডিসেম্বর করাচির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ভেবেছিলেন সেখানে গিয়ে নিজেদের লােকজনদেরকে চাকরি ছেড়ে অথবা পালিয়ে দেশে আসার পরামর্শ দেবেন। তিনিও চলে আসবেন ঢাকায়। এরপর সবাই মিলে দেশেই শুরু করবেন স্বাধীন বাংলার জন্য জনমত গঠনের কাজ। তবে দোদুল্যমানতাও ছিল এই ভেবে যে, যেভাবে সব ওপেন সিক্রেট হয়ে যাচ্ছে তাতে বেশি সময় পাওয়া যাবে কী না। কারণ করাচি যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরে যাওয়ার সময়ই খবর পান লে. কমাণ্ডার মােয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই করাচি পেীছে রউফ চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন। ইতিমধ্যে ধরপাকড়ের খবর করাচি পৌছলে আন্দোলনের সহকর্মীদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা নজরদারি ও কড়াকড়ি। ডিসেম্বরের শেষ দিকে লে. মতিউর রহমানের গ্রেপ্তারের খবর শুনে রউফ বুঝে নিলেন এবার নিজের ধরা পড়ার পালা। গ্রেপ্তারের সময়কার স্মৃতিচারণ করে জনাব রউফ বলেন, “এতদিন আমার কর্মকাণ্ডের কথা পরিবারের কাউকে বলিনি। কিন্তু গ্রেপ্তার ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে স্ত্রীকে সান্তনা দিয়ে বললাম যেন বিচলিত না হয়ে আসবাবপত্র ও গাড়িখানা বেচে দেয় এবং সন্তানদের নিয়ে দেশে চলে যায়। সে অসহায়ের মতাে জিজ্ঞেস করলাে তারপর কী হবে?’ তার উত্তর আমার জানা ছিল না। আমার মানসপটে একদিকে তিন কন্যা, পাঁচ মাস বয়েসী ছেলে, স্ত্রী এবং অন্যদিকে বিভীষিকাময় এক অজানা অধ্যায়ের কথা ভেসে উঠছিল। নানা উৎকণ্ঠার মধ্যে ঈদের দিনটা কাটিয়ে পরদিন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কয়েকজন বন্ধুর বাড়ি ঘুরে বেলা দুটোর দিকে বাসায় ফিরে আসি।

দারােয়ান জানালাে নৌবাহিনী অফিস থেকে চারজন লােক এসে দুবার আমাকে খুঁজে গেছে। এরপর আমি চুল কাটতে গিয়ে ফিরে এসে দেখি আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য বাসার সামনে হাজির আমারই দুই সহকর্মী নেভাল একডেমির লে, সাঈদ ও লে, এম ইউ হক। তারা আমাকে ডিউটি থাকার কথা বলে তাদের সঙ্গে একরকম জোর করে নিয়ে যেতে চান। আমি গােসল করার জন্য সময় চেয়ে ঘরে ঢুকে দেখি সেখানে আমার জন্য সস্ত্রীক বসে আছেন বাঙালি অফিসার লে. কমাণ্ডার কেএমজে আকবর। আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য আসা পশ্চিমা দুই অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি এসেছেন কি-না জানতাম না। তবে পরে শুনেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছেন এবং দেশ মুক্ত হবার সময় পাকিস্তান চলে যান। ৭৩ সালে আবার প্রত্যাবাসিত হয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যােগ দিয়ে পরে কমােডর হয়েছিলেন। যা হােক সেদিন ওরা আমাকে প্রথমে নৌঘাটি পিএনএস বাহাদুরে পরে সেখান থেকে সদর দপ্তরের গােয়েন্দা শাখায় নিয়ে একটি কক্ষে রাখে। সেখানে এক ভয়ানক ভীতিকর পরিবেশ দেখে খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। রাতে লে. কমাণ্ডার আল্লাদিত্তা কয়েকটি কাগজ দিয়ে তাতে সই দিতে বলেন। আমি রাজি না হওয়ায় লে. কমাণ্ডার আসলাম ও অন্য একজন অফিসার আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তারা একটি জিপে করে আমাকে শহরতলীর কোনাে এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে শীতের রাতে লেপ তােষকহীন একটি ঘরে আটকে রাখে। রাতে একটি প্লেটে দেওয়া হয় কিছু রুটি ও তরকারি। একজন কমিশন পাওয়া কর্মকর্তা হিসেবে এসব কিছুই ছিল আমার জন্য চরম অবমাননাকর। আমি কিছুই খাইনি। রাতে ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে কখন জানি না ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝরাতে হঠাৎ কে একজন এসে আমাকে জাগিয়ে তুলে জানতে চায় পাকিস্তান কোয়ার্টারস টেক্সটাইল মিলের প্রডাকশন ম্যানেজার মাহবুবকে চিনি কি না।

আচমকা ঘুম থেকে উঠে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমি তাকে (মাহবুবকে) চেনার কথা স্বীকার করি। পরে মনে হলাে ওরা আচমকা ঘুম থেকে উঠিয়ে আমার মুখ থেকে সত্য কথাগুলাে বের করতে চায়। কিন্তু আমি সতর্ক হয়ে যাই। জানালাবিহীন অজ্ঞাত বন্দীশিবিরে আমাকে প্রায় সাতদিন আটক রেখে নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উচ্চ ক্ষমতার বাতি জ্বালিয়ে রাখা হতাে রাতদিন। একদিন বাথরুমে গিয়ে পাশের কক্ষের বাথরুম থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে শুনতে পাই ‘ধনে ধানে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা…’ গানটি। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে কণ্ঠ মেলালে ওদিকের কন্ঠ কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। বলেন, অমি ইন্সট্রাক্টর মতিউর রহমান, আপনি কে? আমি বাথরুমের ভেতর থেকেই তাকে পরিচয় দিই। কয়েকদিন পর অবশ্য তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর আমাকে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামের নৌঘাটি বিএনএস বখতিয়ারের মেসে। স্বাধীনতার পর এর নামকরণ করা হয় বিএনএস ঈসা খাঁ। এখানে এসে বয়-বেয়ারাদের কাছে জানতে পারি লে.মতিউর রহমান, লে.কমাণ্ডার মােয়াজ্জেমসহ শ দেড়েকের মতাে বাঙালি নাবিক ও অফিসার এখানকার মেসে বন্দি আছেন। সম্ভবত ২০ জানুয়ারি আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শীতের দিনে একটা কক্ষে সাধারণ খাটের ওপর পাতলা কম্বল ও বালিশ নিয়ে অষ্টপ্রহর পাহারার মধ্যে থেকে অতি নিম্নমানের খাবার খেয়ে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে। কয়েদীসুলভ যে আচরণ করা হয়েছে তা ছিল সভ্য দেশের রীতিনীতির বাইরে। বাথরুমে যেতেও হাত কড়া থাকতাে। হাতকড়ার সাথে লম্বা দড়ি ধরে রাখতে পাহারাদার। এদিকে দীর্ঘদিন থেকে পরিবারের কারও কোনাে খবরও পাচ্ছিলাম না। এক পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত উনত পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে নেওয়া হয় এবং কিছুটা ভালাে খাবার দাবার ও ভালাে ব্যবহার হতে থাকে। এ সময় বিচারের পালা শুরু হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে তৃতীয় পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে নেওয়ার পর দেখা হয় লে. কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম ও লে, মতিউর রহমানের সাথে।

তাদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে সবচেয়ে সাহসী মানুষটিও এখানে বন্দি ও অভিযুক্ত হিসেবে আছেন জানতে পেরে অনেকটা সাহসী হয়ে উঠি নিজেও। আলাপকালে মনে হয়েছে মােয়াজ্জেম সাহেব বন্দী অবস্থায় ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, অনেকটা ভেঙেপড়েছিলেন। কারও ওপর যেন ভরসা করতে পারছিলেন না। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকতেন, নামাজ পড়তেন, মােনাজাত করতেন। আমাকে বলতেন, “এইসব করে লাভ নেই। ভাই । তদবির করেন। তদবিরের পথ হলাে নামাজ, দোয়া-কালাম।’ পাশের কক্ষে ক্যাপ্টেন শওকত, ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান ও মেজর মােতালেব থাকতেন। উভয় কক্ষের বাথরুম ছিল লাগােয়া একটা কাঠের পাঠাতন দিয়ে ভাগ করা। আমরা পরস্পর বাথরুমের ভেতরে থেকে কুশল বিনিময় করতাম। অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখেছিল : ডা. ছৈয়দুর রহমান। “চট্টগ্রাম থেকে আমি এবং মানিক চৌধুরী গ্রেপ্তার হই নিজ নিজ বাড়ি থেকে। মেজর মােস্তাফিজ নামে এক সামরিক কর্মকর্তা লোেক নিয়ে এসেছিল আমাকে ধরার জন্য। চৈতন্যগলিতে আমার বাড়ির আশপাশের সব গলিপথ বন্ধ করে ঘেরাও করে রাত দুটায় আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ অফিসে। সেখানে দেখা হয় মানিক চৌধুরীর সঙ্গে। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথম দফায় মারধর করে সমস্ত শরীরে রক্তাক্ত করে ওরা (আর্মিরা) বলেছিল, ‘অঢ়ঢ়ষু ভরৎংঃ ফবমত্বব সবঃযড়ফ’, এর মানে এমন ভয়াবহ হবে তা আগে জানতাম না। কিন্তু নির্যাতনের নির্মমতাই বুঝিয়ে দিয়েছিল এর মানেটা কি? উপর্যুপরি ১৮ দিন ধরে অমানুষিক নির্যাতন চলেছে। লাঠি-লােহার আঘাত থেকে বৈদ্যুতিক শক কোনাে কিছুই বাদ যায়নি। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। এরপর মাথায় পানি। ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে আনত, কোনাে রকমে বসাত।

চোখ মেলতে পারলে, সামান্য কথা বলতে পারলে আবার শুরু হতাে নির্যাতন। ১৮ দিনের মধ্যে একদিনও রেহাই পাইনি। শেষ পর্যন্ত অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখেছিল, হাঁটতে পারছিলাম না। শক্তি ছিল বলে কোনাে রকমে বেঁচেছিলাম। এ অবস্থায় আমাকে যখন জেলে ফেরত পাঠানাে হয় তখন জেলার আমাকে দেখে বলেছিলেন, “আমি তাে ওনাকে এভাবে দিইনি। ওনার শরীর তাে এরকম ছিল না। এ অবস্থায় ওনাকে আমি নেব না।’ বিকেলে আমাকে যখন ওনার (জেলারের) অফিসে নিয়ে রাখা হয়, উনি আমাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত গভর্নর মােনায়েম খানের নির্দেশে তিনি আমাকে রিসিভ করেন। মানিক চৌধুরীসহ অন্যদেরও নির্যাতন করা হয়েছিল প্রায় একই কায়দায়।” এভাবেই পাকিস্তানি সৈনিকদের বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন ডা. ছৈয়দুর রহমান। এরপর বলেন, “পরবর্তী সময়ে শারীরিক অবস্থার এত অবনতি হয়েছিল যে ভালােমত হাঁটাচলা করতে পারতাম না। হার্ট ডিজিজ ডেভেলপ করেছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যােগাযোেগ থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম না। মামলা প্রত্যহারের পরের বছর উনি আমাকে ওনার কাছে নিয়ে গিয়ে খুবই দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলাম তােমার ওপর যা অত্যাচার হয়েছে আমি সব জানি। আমার অবস্থা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেনও তিনি। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি।”

মানিক চৌধুরীর গােপন অঙ্গে অমানবিক আঘাত : সবিতা চৌধুরী মামলা চলাকালে মানিক চৌধুরী আদালতে দেওয়া জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে বিধান সেন। এবং সবিতা চৌধুরী নির্যাতনের যে চিত্র তুলে ধরেন তা শুনলে যে কোনাে লােকই হতবাক হয়ে পারেন না। মেজর মুস্তাফিজুর রহমান (বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ১৯৯১৯৬) নির্যাতনকারীদের অন্যতম সদস্য ছিলেন বলে জবানবন্দিতে জানা যায়। রাজনৈতিক দলের নেতা, সামরিক কর্মকর্তা এবং ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা পিএন ওঝার নাম পরিচয় দিয়ে তাঁদের সঙ্গে মানিক চৌধুরীর সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়ার জন্য প্রথমে তাকে নানা প্রলােভন দেওয়া হয়। পরে চরম নির্যাতন করা হয়। শরীরের নানা স্থানে আঘাত করা ছাড়াও জোর করে উলঙ্গ করে বরফের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে থাকতে বাধ্য করা হতাে। বরফখণ্ডসহ পানিভর্তি ড্রামে বুক পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখা, শরীরের গােপন অঙ্গে অমানবিকভাবে আঘাত করা হয়। মেজর মুস্তাফিজ, ক্যাপ্টেন সুলতান হােসেন। শাহ, কর্নেল আমির হােসেন, স্কোয়াড্রন লিডার সামসুর রহমান নির্যাতনে অংশ নেন এবং জোর করে একটি বিবৃতিতে টিপসই নেন। পরে নির্যাতনের ব্যাপারে মানিক চৌধুরী উধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযােগ জানানাের পর মেজর মুস্তাফিজসহ অন্য দুই সেনা কর্মকর্তা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা আবার নির্যাতন। চালায় মানিক চৌধুরীর ওপর। মুখােশ পড়া লােকজন এসে ডিমের মতাে একটি জিনিসে। আগুন ধরিয়ে তার নাকে চোখে ধােয়া ছুড়ে দিলে তার নাক কান ক্ষত্যিস্ত হয়। ওই অবস্থায়। কিল ঘুষি ও লাথি মারা হয়। এক পর্যায়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং ১১ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর দীর্ঘদিন চিকিৎসার মাধ্যমে নির্যাতনের ক্ষতিচিহ্ন এবং নাক কানের স্বাভাবিকতা কিছুটা ফিরে আসে।

মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখা হতাে : জয়নাল আবেদীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সদস্য-সমর্থকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার এক পর্যায়ে। গােপন পরিকল্পনার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে অন্য অনেকের মতাে জয়নাল আবেদীন। খানের জীবনেও নেমে আসে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা ও নির্যাতনের খড়গ। ৬৭ সালের শেষ। দিকে তিনি দেশে এসেছিলেন ছুটিতে। ছুটি শেষ হওয়ার ১০-১২ দিন আগেই করাচি। থেকে টেলিগ্রামে খবর আসে ছুটি বাতিল হয়েছে। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় অতি সত্তর। চট্টগ্রাম নেভাল বেইসে যােগ দেওয়ার জন্য। নির্দেশ অনুযায়ী নেভাল বেইসের ফটকে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন পাকিস্তানি সৈন্য এসে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে। ফেলে। এরপরের কাহিনী শােনা যাক তার ভাষায়, “ঘেরাও অবস্থা দেখে বুঝে নিলাম। আমি ধরা পড়েছি। তারা ভেতরে খবর দিলে লেফটেন্যান্ট পর্যায়ের একজন অফিসার। এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে এক জায়গায় বসান। মাঝ রাতের দিকে আমাকে স্টেডিয়ামের পাশাপাশি (সার্কিট হাউসের দক্ষিণ দিকে) নেভাল বেইসের ক্যাম্পের কাছে কোনাে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থাকার মতাে জায়গা ছিল। সেখানে চার পাঁচদিন আটকে রেখে সম্ভবত ৬৮ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ ও হালকা নির্যাতন। ১০-১১ দিন পর থেকে দেখা যায় ওদের ভয়ঙ্কর রূপ। জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে শুরু হয় নানা রকম অমানুষিক নির্যাতন। এক নাগারে তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত ঘুমােতে দিত

ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে লাঠি কিংবা বেত দিয়ে বেধড়ক প্রহার করা হতাে। কখনাে কখনাে রশি দিয়ে পা বেঁধে নিচের দিকে মাথা ঝুলিয়ে রাখাসহ নানারকম নির্যাতনে কাহিল হয়ে পড়লে জানতে চাইতাে আমাদের দলে আর কারা আছে, কাকে কাকে চিনি, কোথায় কোথায় বৈঠক হয়েছে, বৈঠকে কারা থাকতাে ইত্যাদি। আরও জানতে চাইতাে কমান্ডার মােয়াজ্জেমসহ অন্যদের সঙ্গে আমার কোথায় দেখা-পরিচয় হয়েছে। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে কী না; কোন কোন পদের লােকজন এতে যুক্ত আছেন, বিপ্লবী কাউন্সিল কখন করা হয়েছে এতে কারা রয়েছে, দেশ স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের কারণ ইত্যাদিও জানতে চাইতাে আমার কাছে। সব প্রশ্নের উত্তরে শুধু উচ্চারণ করতাম জানি না’। দু-এক জায়গায় বড়জোর বলেছি, এক জায়গায় চাকরি করার সুবাদে কাউকে কাউকে চিনি কিন্তু তাঁদের বাইরের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ স্বীকার করলে আরও ভয়ঙ্কর বিপদ এবং আমাদের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে এই আশঙ্কায় কিছুই স্বীকার করিনি। জেড এ খান জানান, বন্দি অবস্থায় প্রায় এক বছর তাকে চট্টগ্রাম রাখা হয়। মাঝখানে একবার ঢাকা আনা হয় কয়েকজন আসামি যেমন কর্নেল শওকত, সার্জেন্ট জহুর প্রমুখকে সামনাসামনি শনাক্ত করার জন্য। তিনি চিনেও না চেনার ভান করে বলতেন ‘তাদেরকে চিনতাম, কিন্তু এরা তাে সেই সব লােক বলে মনে হয় না। অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে রিপাের্ট দেওয়া হয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি জানান, তাঁর কাছে একটি ডায়েরি ছিল, তাতে কোথায় কখন, কার বাসায় বৈঠক হয়েছে, কারা কারা সেখানে ছিলেন সব লেখা ছিল।

কিন্তু ছুটি বাতিলের নােটিশ পেয়ে তার সন্দেহ জাগে কোনাে একটা বিপদ হতে পারে। তাই তিনি ডায়েরিটা পুড়ে সম্ভাব্য প্রমাণ নষ্ট করে ফেলেন। বলতে গেলে কষ্ট আরাে বাড়ে : মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী জানান, স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা তৎপরতা, এতে শেখ মুজিবের জড়িত থাকা, আন্দোলনের পরিকল্পনা ইত্যাদি জানার জন্য অন্য বন্দিদের মতাে তাঁর ওপরও প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। প্রথমেই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি আসামি হবেন না সাক্ষী হবেন। তিনি সাক্ষী হতে না চাইলে তাকে বেদম মারধর করা হয়। তাতেও কোনাে কথা বের করতে না পেরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক শক। বলেন, ‘অনেক রকম নির্যাতনই তাে করা হয়েছে। সবকিছু বলতে গেলে কষ্ট আরাে বাড়ে।” পেটের পর্দা ফেটে গিয়েছিল মােয়াজ্জেমের লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমের বন্দিজীবন ও নির্যাতনের কাহিনী জানা যাক মিসেস মােয়াজ্জেমের ভাষায়, “আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পরদিন নূরুল ইসলাম শিশু এসে মােয়াজ্জেম। সাহেব ভাল আছেন জানিয়ে তার জন্য কিছু শীতের কাপড় চাইলেন। আমি রেগে গিয়ে। কিছু না দিয়েই তাদের ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, আপনারা তাঁকে কোথায় নিয়ে গেছেন, সে এলে আমি কিছু দেব না।’ পরদিন তারা আবার এসে আমার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে কিছু কাপড় ছােপড় নিয়ে যান। এদিকে আমার উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে দুদিন পরও কোথাও। স্বামীর খোঁজ না পেয়ে। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাসায় গেলে তিনি বলেন, ‘কুর্মিটোলা। দিয়ে হয়তাে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর এপ্রিল কি মে মাসে। মেজর মােস্তাফিজুর রহমান (পরে বিএনপির মন্ত্রী) আমার শ্বশুরের বাসায় এসে জানান, মােয়াজ্জেম ক্যান্টনমেন্টে আছেন। আমাকে ও আমার শ্বশুরকে তিনি সেখানে নিয়ে যান। ওর চেহারা দেখে সেদিন মুখ থেকে আমার কথা বের হয়নি। আমাদের পাশে মােস্তাফিজ। সাহেব বসা থাকায় তেমন কথা বলতে পারেনি ও। মামলা শুরু হওয়ার পর প্রায় সময় আদালতে যাওয়ার সুযােগ হয়।

তারপর ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, তার ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, নির্যাতন হয়েছে। সে এক অমানুষিক নির্যাতন। মামলা শেষে সে বাড়ি। আসার পর নির্যাতনের চিহ্ন দেখে আমি আঁৎকে উঠি। ঘুষি ও লাথির আঘাতে তার পেটের একটা পর্দা (লেয়ার) ফেটে গিয়েছিল। দাঁত ভেঙে গিয়েছিল একটা। হাঁটতে পারতাে না। স্বাভাবিকভাবে। পেটে জ্বালাপােড়া ছিল অনেকদিন। বাসায় রেখে চিকিৎসা করিয়েছি। মামলা চলাকালে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার পর অনেককে চিনতে পারি। মিসেস রুহুল কুদুস, মিসেস ফজলুর রহমান ও অন্যদের সঙ্গে পরিচয় এবং কথা হয়েছে। তাদের কাছেও তাদের স্বামীদের ওপর নানা নির্যাতনের কথা শুনেছি। সেই মােয়াজ্জেমকে পাকিস্তানি। বাহিনী একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতে ২৬ মার্চ নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।” লাঠিপেটা করে বরফের ওপর বসিয়ে রাখা হতাে : নুর মােহাম্মদ বাবুল নূর মােহাম্মদ বাবুল ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরের দিকে ছুটিতে ছিলেন। ৯ ডিসেম্বর থেকে। কামাল উদ্দিন, সুলতান উদ্দিন ও স্টুয়ার্ড মুজিব, মােহাম্মদ আলীসহ বেশ কজন গ্রেপ্তার। হওয়ার খবর পেয়ে তিনিও বুঝেছিলেন, যে কোনাে সময় গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন। ৬৮ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমুরিং নেভাল বেইসের কর্মস্থলে যােগ দেওয়ার পর পরই। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর জিজ্ঞাসাবাদের সময় চালানোে হয় নির্মম। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সে সব কাহিনী শােনা যাক নূর মােহাম্মদের ভাষায়, “ধরে নিয়েই আমাদের কার্যক্রমের নানা বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। প্রশ্নের মধ্যে প্রধান বিষয় ছিল, শেখ সাহেবকে চিনি কী না, মােয়াজ্জেমের সঙ্গে এক সাথে। চাকরি করেছি কী না, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করার চেস্টা করেছি কী না, আর কারা কারা এতে জড়িত ইত্যাদি। আর এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পাওয়ায়। চালাতে নির্যাতন। নির্যাতনের মধ্যে বেদম লাঠিপেটা থেকে শুরু করে বরফের ওপর।

বসিয়ে রাখা পর্যন্ত সব কিছু করা হয়েছে। রাতে ঘুমােতে দিত না। চট্টগ্রামে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লে. শরীফ নামে এক পাঞ্জাবি অফিসার ছিলেন। তিনি এবং তার লােকজনই বেশি নির্যাতন করেছে। এভাবে নির্যাতনের এক পর্যায়ে কারাগারের এক চিকিৎসক এসে মন্তব্য করেন, এভাবে নির্যাতন চালালে আমি মারা যাব। এরপর নির্যাতন একটু কমানাে হয়। উল্লেখ্য, ওই চিকিৎসক ছিলেন বাঙালি। বাঙালি ইন্টেলিজেন্সের লােকজন আমাদের ওপর নির্যাতন করেননি বরং কৌশলে সাহায্য করেছেন। পাঞ্জাবিরা ঘুমােতে দিত না। বাঙালি। কেউ দায়িত্বে থাকলে বলতেন, আপনারা ঘুমােন, কোনাে অসুবিধা হবে না। ৬৮র ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে বাইরে নিয়ে আবার গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে জেল থেকে বের করার সময় ক্যাপ্টেন আরিফ মমতাজ নামে এক সেনা কর্মকর্তা আমাকে ভয় দেখিয়ে বললেন, “দেখ শেখ মুজিবকে নিয়ে যাচ্ছি। তােমরা তার সঙ্গে জড়িত ছিলে, দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছ। সব কিছুর প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এখনাে সময় আছে, সব কিছু স্বীকার কর।’ এর আগে চট্টগ্রামে চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি একবার আমার কাছে যান। জানতে চান, কোনাে সমস্যা হলে আপনি কীভাবে বন্দরকে রক্ষা করবেন। বন্দরে বিদেশি সাবমেরিন প্রবেশ করতে না পারার জন্য কী কী করা প্রয়ােজন সে ব্যাপারে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন আরিফের কাছে আমি তা অস্বীকার করি।

বলি যে, আমি ক্ষুদ্র মানুষ পানির নিচের বিশেষজ্ঞ, বন্দর রক্ষার মতাে জ্ঞান নেই। আমার মনে হয়েছিল, তিনি আমার কাছ থেকে কথা বের করতে এসেছিলেন।” মাথার ওপর ছিল উচ্চ ক্ষমতার বাতি : এবিএম সামাদ মামলার প্রতিটি আসামিকে যেভাবে চরম নির্যাতন করা হতাে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য, তা থেকে বাদ যাননি এবিএম সামাদও। সেই নির্যাতনের কাহিনী জানা যাক তার ভাষায়; “অন্যদের মতাে আমাকেও ছােট্ট একটি কক্ষে রাখা হয়। স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য প্রথম দিন থেকে নানা নির্যাতন শুরু হয়। শীতের সময় জামা-কাপড় ছাড়া খালি গায়ে থাকতে হতাে। অনেক সময় শুধু একটা জাঙ্গিয়া পড়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হতাে। মাথার ওপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাতি জ্বালিয়ে অস্থির করে তোেলা হতাে। এভাবে সেনা কর্তারা নির্যাতনের মাধ্যমে এক একটা প্রশ্ন করতেন আর উত্তর মনপূত না হলে অমানুষিকভাবে পেটাতে লাঠি দিয়ে। প্রথম দিকে নির্যাতন শুরুর দুদিন পর, একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা এসে আমাকে বললেন, “দেখুন, এত মার খাচ্ছেন, পিটুনীতে রক্ত ঝরছে শরীর থেকে, আরও পড়বে। কিন্তু কেন এভাবে অযথা হয়রানি হবেন? কষ্ট পাবেন? আমি তাকে বললাম, “ওরা শুধু শুধু নির্যাতন করলে, মারলে আমার কী করার আছে! উনি বললেন, ‘ওরা যা বলছে, আপনি যা দেখেছেন, যা জানেন সব স্বীকার করে নেন। পরে দরকার হলে কোর্টে গিয়ে বলবেন আমাকে মারধর করে স্বীকার করানাে হয়েছে। তাহলেই তাদের চার্জ বা স্বীকারােক্তির কথা আদালতে গ্রহণযােগ্য হবে না।’  তিন দিন তিন রাত একাধারে নির্যাতনের পর বাঙালি সেনা কর্মকর্তাটির কথামত এক আধটু কথাবার্তা স্বীকার করি। এরপর নির্যাতনও একটু কমে। মাঝে মাঝে একটু পানি, সামান্য খাবার দেওয়া হয়েছে।

এ অবস্থায় বলা হয় কাগজে স্বীকারােক্তি লিখে দেওয়ার জন্য। জানালাম, আমার লেখার শক্তি নেই। হাত-পা কাঁপে। আমাকে আগে ঘুমােতে দিন। কিছুক্ষণ ঘুমােতে দিয়ে আবার ঘুম থেকে উঠিয়ে প্রশ্ন শুরু করে এলােপাথারি। কোথায় কোথায় গিয়েছি, কোন কোন মিটিংয়ে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, ফেনী হয়ে আগরতলা যাওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে তারা প্রশ্ন করে, দিন তারিখসহ জানতে চায়। আমি কিছু ঘটনা স্বীকার করলেও সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ স্মরণে নেই বলে জানাই। ইতিমধ্যে নির্যাতন করে যে সব বিষয়ে স্বীকারােক্তি আদায় করা হয়েছে, আদালতে গিয়ে তার সবগুলােই অস্বীকার করি। এক পর্যায়ে মামলা বাতিল হলে অন্যদের সঙ্গে মুক্তি পাই।”

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!