খাবারের সময় এবং পায়খানা প্রশ্রাবের সময় কিল, ঘুষি, লাথি ইত্যাদি খেতে হতো।
যশোরের চৌগাছায় পাকসেনাদের হাতে আমরা ধরা পড়ি। পাকসেনারা চৌগাছার হাইস্কুলে আমাদেরকে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদের ঘড়ি টাকা পয়সা সব কিছু নিয়ে নেয়। তারপর প্রথমে আমাকে, জামা ও প্যান্ট খুলে, দু’জন পাকসেনা বাঁশের লাঠি দিয়ে সারা শরীরের প্রহার করতে থাকে। এই ভাবে প্রায় এক ঘণ্টা প্রহার করার পর আমার দুপা বেঁধে একটা আকড়ার সাথে পা উপর দিয়ে ঝুলিয়ে লাঠি দিতে সমস্ত শরীরের প্রহার করতে থাকে মেজর তখন চেয়ার পেতে বসে আছে। আর একদল আমাকে প্রহার করতে থাকে, আর একদল আমাকে প্রহার করা দেখে হাসতে থাকে, আর বলতে থাকে বল মাদার চোদ, টিক্কা খাঁন জিন্দাবাদ। আমারর সমস্ত শরীরে বেয়োনেট দিয়ে মারতে থাকে আর চাকু দিয়ে প্রতিটি নখ ফেড়ে দেয়। আমার সমস্ত শরীর হতে রক্ত ঝরতে থাকে তারপর যে কী হয় আমি বলতে পারি না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পাই আমার পাশে আমার দুই বন্ধু ইলিয়াছ ও সুনিল কুমার বসু পড়ে আছে। তাদের শরীর হতে আমার শরীরের ন্যায় রক্ত ঝরছে। প্রহারের দরুন তাদের ও আমার শরীর ফুলে যায়। আমরা পানি খেতে চাইলে প্রশ্রাব এনে সামনে দিত। তার গন্ধ পেয়ে আমরা মুখ বন্ধ করতে থাকলে ইট দিয়ে এসে মুখে মারতো। সন্ধ্যার পর আমাদেরকে স্কুলের পিলারের নিকট নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে তিনজনকে তিনটা পিলারে পিঠমুড়া করে জড়িয়ে চেপে বাঁধে। আর মাজার সাথে পিলারে বেস্টন দিয়ে বেঁধে ফেলে আবার প্রহার করতে থাকে। আমরা পিপাসায় পানি পানি করে চিৎকার করতে থাকি। তখন বৃষ্টি নামে। উক্ত বৃষ্টির পানি আমাদের মাথায় পড়ে থাকে। উহা আমাদের শরীরর বেয়ে পড়তে থাকে উক্ত পানি খেয়ে আমরা পিপাসা মিটাই। তারপর দিন, হাত পায়ের রশি খুলে দেয় এবং আবার পিটাতে থাকে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, তোমরা মুক্তিবাহিনী কিনা? এবং ট্রেনিং জানো কি না? তখন আমরা বলি, না, আমরা ট্রেনিং জানিনা ও আমরা মুক্তিবাহিনীও নই। তারপর মারা বাদ দিয়ে পাকসেনারা ৩/৪ জন আমাদেরকে ধরাধরি করে তাদের গাড়িতে তুলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখে। তার ১০/১৫ মিনিট পর একজন হাবিলদার ও ৭/৮ জন মিলিটারী আমাদের নিকট আসে এবং আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, সত্যি করে বল, ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-এ যেতে ছিলে কিনা এবং অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। তারপর আমরা তাদের কারো কোন জবাব দেই নি। তারপর আমাদের হাত আবার পিঠমুরা করে পিলারের সাথে বেধেঁ ১০/১৫ মিনিট সময় দিয়ে বলে যে এরমধ্যে যদি সত্য কথা না বলো তা হলে গুলি করে হত্যা করবো এই বলে আমাদের দিকে বন্দকু ধরে রাখে। আমরা জবাব দেই যে আমরা সত্যি বলছি আমাদের লোক হারিয়ে গিয়েছি তাদের খোঁজে আমরা এখানে এসেছি। আমরা ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে এখানে আসি নাই। তারপর আমাদের তিনজনকে একটা ঘরের মধ্যে ১৫ দিন রেখে দেয়। ঐ কয় দিনের প্রত্যেক দিনই খাবারের সময় এবং পায়খানা প্রশ্রাবের সময় কিল, ঘুষি, লাথি ইত্যাদি খেতে হতো। তারপর সেখান হতে যশোর কোতয়ালী থানায় পাঠিয়ে দেয়। ওখানে এক রাত্রি থাকার পরদিন কোর্টে ৫৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে যশোর সেন্ট্রাল জেলে হাসপাতালে রেখে দেয়।
সেখানে বাঙ্গালী চিকিৎসক ছিলেন তারা আমাদেরকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। সেখানে ১২ দিন থাকার পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে মুক্তিলাভ করি। তারপর বাড়ী এসে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে উঠি। জুন মাসের ২০ তারিখে আমরা ধরা পড়ি এবং সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে যশোরের প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ আবদুল্লা সাহেবের কোর্ট থেকে মুক্তি পাই।
স্বাক্ষর/-
শ্রী সংকর প্রসাদ ঘোষ
গ্রাম-আউড়িয়া, পোষ্ট-হাট বাড়ীয়া
থানা-নড়াইল, জেলা-যশোর
৬-৬-৭৩