You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.28 | একাত্তরের যুদ্ধঃ কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ | মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম, পিএসসি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ মার্চ ১৯৮৫ - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের যুদ্ধঃ কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ | মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম, পিএসসি
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ মার্চ ১৯৮৫

মুক্তিযোদ্ধের সূচনাপর্বে কুষ্টিয়ায় সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। কুষ্টিয়ার উত্তাল জনতার গণবিদ্রোহ যারা সেদিন স্বচক্ষে দেখেছেন -তারা আমার সাথে একমত হবেন -এত বিদ্রোহ কেউ কখনো দেখেনি। হাজার হাজার জনতা ঢাল, সড়কি, বল্লম নিয়ে যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিলো। গগনবিদারী জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী তরুণেরা ও বাঙালি সৈনিকেরা অমিত মেজে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ধরে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানের মহান প্রত্যয়ে – সুমহান দেশপ্রেমের অঙ্গীকারে সংগ্রামী মানুষের কাতারে শামিল হয়েছিলেন -ইতিহাসে তাদের অনেকের নামই কখনো উল্লেখ থাকবে না -তবু সেই মহাজাগরণের অবিস্মরণীয় মুহূর্তে -জাতির ক্রান্তিলগ্নে দেশের চরম দু’র্দিনে অস্ত্র হাতে যারা লড়াই করেছিলেন -ইতিহাস ব্যর্থ হলেও -তারা অনাদিকাল পর্যন্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুসারে ২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানির সৈন্য কুষ্টিয়া শহরে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকবাহিনী কুষ্টিয়া শহরে ৩০ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে এবং টহল দিতে থাকে।
পাকসেনাদের অধিনায়ক ছিল মেজর শোয়েব। ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ মেজর শোয়েবের অধীনস্থ অফিসার হিসেবে কোম্পানির সাথে কুষ্টিয়ায় অবস্থান করছিল। পাকবাহিনীর সঙ্গে ছিল ১০৬ এম এম জি আরোহিত রিকয়েলেস রাইফেল, ভারী ও হালকা চাইনিজ মেশিন গান,স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, শক্তিশালী বেতার যন্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ। ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী কর্তৃক ইপিআর বাহিনীর পিলখানাস্থ সদর দপ্তর ও রাজার বাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের খবর এবং কুষ্টিয়ায় পাকসেনাদের আগমনের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ইপি আর (বর্তমানে বিডিআর)-এর যশোর সেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীনে ৪ নং -উইং এর সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা শহরে। মেজর এম, এ, ওসমান চৌধুরী (বাঙালি বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বদলি হয়ে উইং কমান্ডারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন এ, আর আজম চৌধুরী (বাঙালি -বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ও ক্যাপ্টেন সাদেক (পাঞ্জাবি) সহকারি অধিনায়ক ছিলেন। পাঁচটি কোম্পানি ও একটি সাপোর্ট প্লাটুনের সমন্বয়ে গঠিত ছিল চার নম্বর -উয়ং। প্রত্যেকটি কোম্পানি প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। একটি কোম্পানিতে পাঁচটি হালকা ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, সাতটি হালকা মেশিনগান, একটি মেশিনগান এবং বাকি .৩০৩ রাইফেল ছিল। উইং সদরদপ্তরে এক কোম্পানি সৈন্য ছাড়াও ছয়টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ২০০ চাইনিজ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ছিল। এছাড়া একটি ব্যাটালিয়ন যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য গোলাবারুদ ও যানবাহন ৪ নং -উইং এ ছিল।
৪ নং উইংয়ের পাঁচটি কোম্পানির অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃ –
একঃ প্রাগপুর এলাকা -‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার -সুবেদার মোজাফফর আহমদ।
দুইঃ ধোপখালী এলাকা -‘বি’ কোম্পানি -কমান্ডার -সুবেদার খায়রুল বাশার খান ।
তিনঃ বৈদ্যনাথতলা (মুজিবনগর) -‘সি’ কোম্পানি- কমান্ডার- সুবেদার মুকিদ।
চারঃ যাদবপুর এলাকা -‘ডি’ কোম্পানি -কমান্ডার -সুবেদার মজিদ মোল্লা।
পাঁচঃ উইং সদরদপ্তর -‘ই’ কোম্পানি -কমান্ডার -সুবেদার রাজ্জাক। এছাড়া সিগন্যাল প্লাটুন হাবিলদার মোসলেম উদ্দিনের অধীনে উইং সদর দপ্তরে অবস্থান করছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে উইং কমান্ডার মেজর -এম এ, ওসমান চৌধুরী সহকারি উইং কমান্ডার -ক্যাপ্টেন এ,আর, আযম চৌধুরী, পাঁচজন কোম্পানি কমান্ডার, সিগন্যাল প্লাটুন কমান্ডার ও প্লাটুন কমান্ডার সবাই ছিলেন বাঙালি। সাধারণ সৈনিকরাও প্রায় সবাই বাঙ্গালী ছিলেন।
মেজর ওসমান চৌধুরী ২৫ মার্চ রাতে সস্ত্রীক কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। ২৬শে মার্চ সকাল দশটায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতার থেকে নতুন নতুন সামরিক বিধি জারি করতে থাকে। অবিলম্বে মেজর ওসমান ঝিনাইদহ চুয়াডাঙ্গার পথে যাত্রা শুরু করেন। তিনি বেলা সাড়ে ১১ টা নাগাদ ঝিনাইদহ পৌঁছালে উত্তাল জনতা তাঁর জীপ ঘিরে ধরে। জনতাকে সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হন। মেজর ওসমান চৌধুরী বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া পিলখানায় মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ জানতে পারলাম মুজিবুর রহমান (শহীদ) এর আগে কোন নির্দেশ ছাড়াই কৌশলে সদর দপ্তরে কর্মরত সকল অবাঙালি ই,পি,আর সদস্যদের বন্দী করেছিলেন এবং সমস্ত অস্ত্র অস্ত্রাগার থেকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রেখেছিলেন। শহরের ছাত্র, শ্রমিক ও মেহনতি জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। ইপিআর এর বাঙালি সৈনিকেরা সচেতন বাঙালি হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি ছিল। স্বদেশেরর জন্য জীবন দেয়ার উন্মাদনা সৈনিক ও জনতার মধ্যে সৃষ্টি করেছিল এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র।
মেজর ওসমান চৌধুরী পরিস্থিতির মুখোমুখি করে ২৬শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা পৌছেই এক জরুরি সভা ডাকলেন। ক্যাপ্টেন এ, আর, আজম চৌধুরী, ডক্টর আশরাফুল হক , স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ কর্মকর্তাগণ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার পরিস্থিতি, হানাদার বাহিনীর অঘোষিত যুদ্ধ ও গণহত্যা পর্যালোচনা করে এই সভায় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। ঐদিন বেলা আড়াইটার সময় হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে মেজর ওসমান চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ই পি আর-এর বাঙালি সৈনিকেরা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশের পতাকাকে সামরিক অভিবাদন জানায়।
ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী সকল বিওপিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার নির্দেশ দেন। চুয়াডাঙ্গা-যশোর সড়ক দামুড়হুদা-চুয়াডাঙ্গা সড়ক ও চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর সড়কে ব্যারিকেড তৈরি করা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করা হয়।
২৭ শে মার্চ সকালে যাদবপুর অবস্থানরত কোম্পানি- কমান্ডা- সুবেদার আব্দুল মজিদ মোল্লা ওয়ারলেসে মেজর ওসমান চৌধুরীকে জানালেন যে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন সাদেক মাসলিয়া বি ও পিতে এসেছে। মেজর ওসমান ক্যাপ্টেন সাদেকের প্রতি দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন সাদেক বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের নিরস্ত্র করার জন্য মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেন। ক্যাপ্টেন সাদেকের সাথে কয়েকজন অবাঙালি সৈনিক ছিল কিন্তু তার ড্রাইভার ছিল বাঙালি। ক্যাপ্টেন সাদেক যাদবপুর কোম্পানির সদর দপ্তরে এসে বাঙালি গার্ডের সাথে অশোভন আচরণ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সহযোগীরা সকলেই নিহত হয়। এই আকস্মিক সংঘর্ষের পরে মেজর ওসমান প্রশাসনিক বিষয়ে সামরিক ও বেসামরিক সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন ও রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। ডক্টর আসহাবুল হক সংসদ সদস্য, অ্যাডভোকেট ইউনুস আলী ও ব্যারিস্টার বাদল শরীফ উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের সাথে আলোচনা ক্রমে কুষ্টিয়া জেলা শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মেজর ওসমান সীমান্তে অবস্থানরত সব ইপিআর সৈনিকদেরকে চুয়াডাঙ্গা সদর দপ্তর সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রাগপুরের কোম্পানি কমান্ডার -সুবেদার মোজাফফরকে কুষ্টিয়ার পথে অভিযান শুরু করার আদেশ দিলেন।
কুষ্টিয়া শহরে পাকবাহিনী তখন তিন জায়গায় অবস্থান করছিল কুষ্টিয়া জেলা স্কু,ল পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস স্টেশনে। তিন দিক থেকে একই সময়ে যুগপৎ তিনটি পাক ঘাঁটির উপর প্রবল ভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীকে জেলা স্কুলে অবস্থিত পাকিস্তান অবস্থান আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়। সুবেদার মোজাফফরকে পুলিশ লাইনে অবস্থিত পাকঘাটি আক্রমণ করতে বলা হয় এবং নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (শহীদ) ওয়ারলেস স্টেশন আক্রমণ করতে আদেশ দেওয়া হয়।
মেজর ওসমান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীনে আনুমানিক ৭০০ বাঙালি ই পি আর সৈন্য ছিল। সহস্রাধিক আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ তার বাহিনীর সাথে যোগ দিল। যোগাযোগ রক্ষার জন্য পোড়াদহের খোলা মাঠে একটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কুষ্টিয়া যুদ্ধক্ষেত্র ও চুয়াডাঙ্গা সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হল। ডাক্তার আসহাবুল হক ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ব্যবস্থা করলেন।
২৮ শে মার্চ কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি কোম্পানির ঝিনাইদহ পৌঁছে গেল এবং যশোর ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করল। যশোর সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়ার পাক ঘাঁটিতে পাকবাহিনী আসতে চাইলে তা প্রতিহত করাই ছিল এই অবরোধের উদ্দেশ্য। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী নির্দেশ মোতাবেক এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে চুয়াডাঙ্গা পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা ধরে অগ্রসর হতে লাগলো। সুবেদার মোজাফফরকে তাঁর কোম্পানিসহ ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়া শহরের উপকন্ঠে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা বিশখালীতে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করলো। সুবেদার মজিদ মোল্লা দুই প্লাটুন নিয়ে কোর্ট চাঁদপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিলেন। কালিগঞ্জ প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা ঝিনাইদহের এসডিপি ও মাহবুবউদ্দিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিলো। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক শফিউল্লাহ (বর্তমান লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ঝিনাইদহে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন।
২৯ শে মার্চ ভোর চারটায় আক্রমণ করার কথা ছিল। গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য সুবেদার মোজাফফরের কোম্পানি যথাসময়ে এসে পৌঁছাতে না পারায় ৩০ শে মার্চ ভোর চারটায় তিন দিক থেকে পাক ঘাঁটিগুলো সংযুক্তভাবে আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের সাথে সাথে জনগণ গগনবিদারী জয়ধ্বনি দিতে থাকে।
৩০শে মার্চ ভোর চারটায় -প্রথম সুবেদার মোজাফফরের অধীনস্থ কোম্পানি পুলিশ লাইনের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে একটি বাড়ির তিনতলা থেকে পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পাক সেনাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। মেহেরপুর থেকে আগত এক কোম্পানি আনসার ও এক কোম্পানি মুজাহিদ এ যুদ্ধে যোগ। হাজার হাজার মানুষ আক্রমণের সাথে সাথে মুহুর্মুহু জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকে সারাদিন যুদ্ধের পর বিকেল পাঁচটার দিকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে জেলা স্কুলে অবস্থানরত পাক সেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান (শহীদ) মোহিনী মিলের দিক থেকে অয়ারলেস স্টেশন এর উপর আক্রমন অব্যাহত রাখে।
তিন দিকের যুগপৎ আক্রমণ ও গগনবিদারী জয় বাংলা’ স্লোগানে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়। আতঙ্কগ্রস্থ ঘেরাও অবস্থায় পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে। সারাদিন যুদ্ধ চলার পর মাত্র ৪০থেকে ৫০ জন পাকসেনা জীবিত ছিল। জীবিত পাকসেনারা জেলাস্কুলে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করে। পালাবার সময় অনেক পাকসেনা নিহত হয়।
বিকেল নাগাদ শুধুমাত্র জেলা স্কুল ছাড়া সমস্ত শহর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। বিজয়ের আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল শক্তিতে জেলা স্কুল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম আঘাত হানতে থাকে।
রাতের অন্ধকারে জীবিত পাকসেনারা ২টি দীপ ও ২ টি ডজ গাড়িতে করে ঝিনাইদহের পথে পালানোর চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী পলায়নপর পাকসেনাদের শৈলকুপা সেতুর সন্নিকটে এ্যামবুশ করে মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপা সেতুটি ধ্বংস করে শূন্যস্থানে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে আলকাতরা দিয়ে রং করে পিচঢালা রাস্তার মত করে রাখে। পলায়নরত পাকসেনাদের গাড়ি দুটি গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে। এখানে মেজর শোয়েবসহ বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা আহত অবস্থায় আশেপাশের গ্রামের পালিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা এসব পাকসেনাদের পিটিয়ে হত্যা করে।
৩১ শে মার্চ আহত অবস্থায় লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। ২রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান চৌধুরী তার জবানবন্দি নেন। এ যুদ্ধে মাত্র ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও কয়েকজন আহত হন। কুষ্টিয়া বিজয়ের পরে দখল করা সকল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ চুয়াডাঙ্গা সদর দপ্তরে নিয়ে আসা হয়। ৩রা এপ্রিল ফরাসি টেলিভিশন কর্পোরেশনের একটি ভ্রাম্যমান দল চুয়াডাঙ্গা আসেন। তারা যুদ্ধবন্দী পাক অফিসার লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ-এর ছবি সহ সকল অস্ত্রশস্ত্রের ছবি তোলেন। তেজোদীপ্ত যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিও তারা তোলেন এবং মেজর ওসমান চৌধুরী সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই দিনেই পাকিস্তান বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় নিলাম বোমা নিক্ষেপ করে। ফরাসি টেলিভিশন কর্পোরেশনের সদস্যরা বোমা নিক্ষেপের জীবন্ত ছবি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এসবই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে টেলিভিশনে দেখানো হয় এবং এর চিত্র প্রদর্শন বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (বর্তমানে যুগ্ম সচিব অর্থ মন্ত্রণালয়) মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। ২৫ শে মার্চেই তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। ২৯ শে মার্চ জনতা তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী নদীয়ার জেলা প্রশাসক ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর অধিনায়কের সাথে বেতাই সীমান্তে মিলিত হন। সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্য, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের বিষয়টি আলোচিত হয়। এই সময় আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন (ঝিনাইদহের এসডিপিও) বিএসএফ-এর কর্মকর্তার সাথে আলোচনা ক্রমে নেতৃদ্বয়ের ভারতে যাবার ব্যবস্থা করেন। পরে দমদম বিমানবন্দরে সামরিক বিমানে চড়ে নেতৃদ্বয় নয়াদিল্লি চলে যান।
এখানে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নটি ২৭শে মার্চ লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের (বাঙালি) নেতৃত্বে চৌগাছায় অবস্থান করছিলেন। মেজর ওসমান চৌধুরী এ সময় দুইবার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিলকে বিদ্রোহ করে তার ব্যাটালিয়নসহ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল মুক্তিযুদ্ধের যোগদান না করে ২৯শে মার্চে যশোর সেনানিবাসে ব্যাটালিয়ন নিয়ে ফিরে যান এবং অস্ত্র জমা দেন। ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানি প্রথম ইস্টবেঙ্গলের অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তর করেন এবং সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টে স্থানান্তরের আদেশ দেন। প্রথম ইস্টবেঙ্গলকে নিরস্ত্র করার আদেশ সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এক তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ৩০ শে মার্চ সকাল আটটার সময় প্রথম বেঙ্গলের সৈনিকরা বিদ্রোহ করে এবং অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দখল করে। ৭ম ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙালি সৈনিকেরাও এদের সাথে যোগ দেয়। সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে এবং ৩০ থেকে ৪০ জন বাঙালি সৈনিক নিহত হয়। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় লেঃ আনোয়ার শহীদ হন। লেফটেন্যান্ট আব্দুল হাফিজ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর) অবশিষ্ট সৈনিকদের নিয়ে বীরবিক্রমে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মেজর ওসমান চৌধুরীর সাথে যোগ দেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই শোচনীয় পরাজয়ের পর কুষ্টিয়া পুনর্দখলের জন্য সচেষ্ট হয়। আকাশ জলপথের যশোর সেনানিবাসে ব্যাপক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এই সময় পাকবাহিনীর একটি দল আরিচা থেকে জলপথে গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকবাহিনীর অপর একটি দল নগরবাড়ি ঘাটে অবতরণের চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে কিন্তু সীমিত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শেষ রক্ষা করা যায়নি। ১৪ই এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাট পাক বাহিনীর দখলে চলে যায়। ১১ই এপ্রিল ভেড়ামারায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মুক্তি বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। কিন্তু পাকবাহিনী ভেড়ামারা দখল করে নেয়। একই সময় ঝিনাইদহের পতন ঘটে। মেজর ওসমান তার সদরদপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরের স্থানান্তর করেন। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর তীরে ইছাখালী সীমান্ত এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হয়।
বাঙালি জাতির জীবনে ১৭ই এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বহু দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করেন। পলাশীর আম্রকাননে একদিন যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো – আবার সেই সূর্য উদিত হল আর এক আম্রকাননে। এই ঐতিহাসিক স্থান থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করে এর নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ঐতিহাসিক কারণেই কুষ্টিয়া জেলার ‘মুজিবনগর স্মৃতিময় হয়ে আছে।
কুষ্টিয়া যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বড় ধরনের বিজয়। এ যুদ্ধ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে। প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ও যানবাহন মুক্তি বাহিনীর দখলে আসে। অপরদিকে পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে কুষ্টিয়া বিজয় জনগণের সাহস, আত্মবিশ্বাস, উদ্দীপনা, আকাশচুম্বী রূপ নেয়। সুদৃঢ় মনোবলের সাথে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের মোকাবেলা করেছে বীরত্বের সঙ্গে। এই এলাকার সাহসী জনগণের নির্ভীক ভূমিকা যুগে যুগে জাতির প্রেরণা যোগাবে। ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে বিজয়ের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।