You dont have javascript enabled! Please enable it!

মিথ্যাবাদী ইয়াহিয়া

ইয়াহিয়া খান মিথ্যাবাদী। দিনের পর দিন তিনি দাবী করছেন—পূর্ব বাংলা শান্ত। তাঁর পশ্চিমা বাহিনী অবস্থা আয়ত্তে নেই। আন্তর্জাতিক রেডক্রশের আর্ত সেবার দরকার নেই। কারণ পূর্ব বাংলায় কোন আর্ত নেই। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সৃষ্ট নরকের উপর ইসলামাবাদের প্রচারকরা টেনে দিয়েছিলেন একটি কালাে পরদা। এই মিথ্যার আচ্ছাদন ক্রমে ক্রমে সরে যাচ্ছে। বিশ্ববাসী দেখছেন আদিম যুগের বীভৎসতা। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত। অন্যের কাছে যা বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া সংবাদ, ভারতের কাছে তা চাক্ষুচ দর্শন। হাজার হাজার আতঙ্কিত নরনারীর প্রতিদিন সীমান্ত অতিক্রম এবং তাদের কাছে শােনা পশ্চিমাদের অত্যাচারের লােমহর্ষক কাহিনী ইয়াহিয়ার পক্ষে চেপে রাখা অসম্ভব। বড় বড় দু-চারটি শহর ছাড়া আর সব মুক্তিফৌজের দখলে। নিরস্ত্র জনতার উপর চলছে নির্বিচারে বােমাবর্ষণ। আহতেরা ভিড় জমাচ্ছেন ভারতের হাসপাতালগুলােতে। শুরু থেকেই নয়াদিল্লী ডেকেছেন গােটা দুনিয়াকে। গণহত্যার প্রতিবাদে প্রথমে মেলেনি কোন সাড়া। এখন উল্টো সুর বইছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। পত্র-পত্রিকাগুলাে ইয়াহিয়ার নৃশংসতার প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে উঠেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর মুখ খুলেছেন। বাংলাদেশের রক্তপাত বন্ধের জন্য তারা ইসলামাবাদের কাছে দাবী জানিয়েছেন। মার্কিন অস্ত্রে স্বৈরাচারীরা হত্যা করছে পূবের বাঙালীকে। নরঘাতীদের দেহের বল জুগিয়েছে মার্কিন আর্থিক সাহায্য। বিবেকের দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন আমেরিকর সাধারণ মানুষ দিকে দিকে আওয়াজ উঠছে—পশ্চিম পাকিস্তানে অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য বন্ধ কর। প্রভাবশালী সেনেটরা তাতে সুর মেলাচ্ছেন। সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগেৰ্ণী কদিন আগেই বাংলাদেশের গণহত্যা থামাবার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খানকে। রাষ্ট্রসঙ্ প্রকাশ করেছেন, এই চিঠি। ইসলামাবাদ যা মনে করে ঘরােয়া সমস্যা, তা ক্রমেই রূপ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক সমস্যায়।
আসল ঘটনা থেকে দুনিয়ার চোখ অন্যত্র সরিয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ইয়াহিয়া। তাঁর অভিযােগ, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলাচ্ছে ভারত। সীমান্তে সমাবেশ করছে সে বিরাট সৈন্যদল । একমাত্র চীন ছাড়া কেউ কান দেয়নি তাঁর কথায়। ভারতীয় সংসদ বাংলাদেশের লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত এবং নিপীড়িত সাধারণ মানুষের চরম দুর্দশায় মর্মাহত। যারা ইস্পাতের মনােবল নিয়ে দানবীয় শক্তির সঙ্গে লড়াই করছেন, তাঁদের জয় সম্পর্কে ভারতের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। বাংলাদেশের নিখুঁত চিত্র নয়াদিল্লীই প্রথম তুলে ধরেছেন গােটা দুনিয়ার সামনে। ইয়াহিয়ার প্রচারযন্ত্র ব্যর্থ। মিথ্যার কুয়াশায় ঢাকা পড়েনি সত্য। মার্কিন-সােভিয়েট পদক্ষেপ সতর্ক এবং কম্পমান। রাষ্ট্রসঙ্ঘকে করেনি তারা সক্রিয়। আন্তর্জাতিক রেডক্রশকে বাংলাদেশের আর্ত সেবার অধিকার দেবার দাবী করতে পারেনি তারা। এই সংস্থা যদি বাংলাদেশের নিগৃহীত অঞ্চলে যেতে পারতেন, তবে দেখতে পেতেন পশু-শক্তির তৈরী মহাশ্মশান। ইয়াহিয়ার বিরাট থাবা এগিয়ে চলেছে নিরস্ত্র বাঙালীর দিকে। তাকে টেনে ধরার সাহস পাচ্ছে না বৃহৎ শক্তিগুলাে। জনা-কয় ফ্যাসিস্ত টুপি চেপে ধরতে চায় একটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশকে। কাপুরুষের মত নতি স্বীকার করছেন না বাঙালী মুক্তিফৌজ। যত দিন যাবে লড়াই-এর প্রচণ্ডতা তত বাড়বে। রক্তপাত বন্ধ করবেন না ইয়াহিয়া খান। স্পষ্টই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগাের্ণীকে। তার অজুহাত বাংলাদেশে ঘটনা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। আমেরিকা হয়ত পাবে অনুরূপ উত্তর। কিন্তু তারপর?
মুক্তিপাগল বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মিক এবং রাজনৈতিক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। সামান্য যা অবশিষ্ট ছিল তা পশ্চিমাদের ব্যাপক নরহত্যা এবং আকাশ থেকে বেপরােয়া বােমাবর্ষণে একেবারে মুছে গেছে। এখন চলছে বুলেটের সম্পর্ক। এ-অবস্থার আপােষ আলােচনার মাধ্যমে বােঝাপড়া অসম্ভব। মার্কিনসােভিয়েটের আবেদন-নিবেদনের পালা সমাপ্ত । শুরু হবার কথা কূটনৈতিক হুমকী, বয়কট এবং বলপ্রয়ােগ। এই বাঞ্ছিত পথে পা দিতে বহৎ শক্তিগুলাের আর কতদিন লাগবে? বৃটেনের কথা আলাদা। তার নিজস্ব মতামতের কোন গুরুত্ব নেই। ফ্রান্স নীরব কেন? সেও ইয়াহিয়ার অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারক। দ্য গলের শাসনভার গ্রহণের আগে আলজেরিয়ায় নাৎসী বর্বরতা চালিয়েছিল ফ্রান্স। সেই লজ্জাতেই কি সে আজ ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদ করতে পারছে না? আর দেরী করার সময় নেই। আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়াকে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামাবাদের স্বৈরাচারা বাংলাদেশে আরও সৈন্য পাঠাবার উদ্যোগ আয়ােজন করছেন। থাইল্যান্ড থেকে তারা বাংলাদেশের নরমেধ যজ্ঞের অহুতির তেল সংগ্রহের ফিকিরে আছেন। এ-অপচেষ্টা বানচাল করতে পারে একমাত্র আমেরিকা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সহজে শেষ হবে না। বাইরের সাহায্য না পেলে ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ ইতিহাসের চূড়ান্ত রায়। তার সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন আগত। ভারত অবশ্যই পিছু-পা হবে না। আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার বলিষ্ঠ মনােভাব আশু দরকার। তা না হলে ইয়াহিয়ার সম্বিত ফিরবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!