You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.12 | করাচীতে বাঙালী হত্যা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

করাচীতে বাঙালী হত্যা

পশ্চিম পাকিস্তানে পাইকারী হারে চলছে বাঙালী বিতাড়ন এবং নিধন। টাইমস অব ইন্ডিয়া দিয়েছেন ভয়াবহ সংবাদ। করাচী এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনশ বাঙালীকে খুন করেছে পশ্চিমারা। ঘটনাটা ঘটেছে ভুট্টোইয়াহিয়ার বাংলাদেশ অভিযানের পর। অবাক হবার কিছু নেই। যারা নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচারে আকাশ থেকে বােমা ফেলতে পারে, যারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে, যারা ঘরের মেয়েদের টেনে নিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মাততে পারে এবং যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে পারে তাদের দ্বারা সবই সম্ভব। পশ্চিম পাকিস্তানে টিকতে পারছে না বাঙালীরা। সরকারি এবং বেসরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হচ্ছেন তারা। তাদের সর্বস্ব লুঠ করে রাস্তায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে গুন্ডারা। পুলিশ এবং সরকার উচ্ছঙ্খল জনতার মদৎদার। কে বাচাবে এই সব অসহায় নরনারীদের? যাদের বরাত ভাল তারা কোনমতে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতে। যারা এ সুযােগ পান নি তারা প্রাণ দিচ্ছেন পশ্চিমা ঘাতকদের হাতে। বাঙালীর অপরাধ? তারা চান বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন এবং শােষণের অবসান। তারা চান, সংখ্যাধিক্যের গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠা। এই মৌল দাবীর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলার গণ আন্দোলন। ইয়াহিয়ার আসুরিক দাপট বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে স্বাধীনতার পথে । পূর্বে অবাঙ্গালী জল্লাদরা চালাচ্ছে গণহত্যা, আর পশ্চিমে সরকারি উস্কানীতে বাঙালীদের পিটিয়ে মারছে অবাঙালী জনতা। এই নারকীয় দৃশ্যে শিউরে উঠছেন বিশ্বে শান্তিকামী মানুষ।
বাংলাদেশের অবস্থা আলাদা। সেখানে পশ্চিমা পশু শিকারের জন্য রাস্তায় নেমেছেন মুজিব বাহিনী। নিজেরাও মরছেন আর ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়াদেরও মারছেন। শহীদের রক্ত এবং কঙ্কালের উপর মুক্তিযােদ্ধারা তৈরী করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের বুনিয়াদ। এমন একদিন আসবে যখন বর্বরতার চরম মূল্য দিয়ে পালাতে হবে পশ্চিমা সৈন্যদের। যে পথ দিয়ে তারা এসেছিল বাংলাদেশে, সে পথ দিয়ে তাদের অনেকেই ফিরবে না। নরপশুদের বিকৃত শস সাক্ষ্য দেবে স্বৈরাচারের শােচনীয় পরিণাম। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের তাই হবে একমাত্র সান্তনা। অত্যাচারীকে তারা ক্ষমা করেন নি। মানবদ্রোহীদের পাওনা শাস্তি কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন পূর্বের বাঙালী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের অসহায় বাঙালীদের সান্তনা কোথায়? প্রাবাসে বেঘােরে মরছেন তারা। হেস্টেজ হিসাবে রেখেছে তাদের পশ্চিমারা। ইয়াহিয়ার হানাদাররা পূর্বের বাঙালীর হাতে মরলে জান দিতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রবাসী বাঙালীকে। করাচীতে শুরু হয়েছে তার প্রাথমিক পর্ব। পাকিস্তানি সংবাদের উপর চলছে কড়া সেন্সর ব্যবস্থা। বিদেশী সাংবাদিকেরা বিতাড়িত। সরকারি প্রচারযন্ত্র মিথ্যা সৃষ্টির তান্ডব কারখানা। পশ্চিম পাকিস্ত বনে বাঙালীদের ভাগ্য নিয়ে যে বিড়ম্বনা চলছে তার ছিটেফুটো মাত্র প্রকাশ হচ্ছে ভারতে। ইয়াহিয়া নিজে সেজেছেন হিটলার। তাঁর দৃষ্টিতে বাঙ্গালীরা ইহুদী। জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর সমূল উচ্ছেদ পশ্চিমা ডিকটেটরের ঐকান্তিক বাসনা। তার ধারণা যতদিন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মেরুদ্বন্ড সােজা থাকবে ততদিন পশ্চিমা আধিপত্য নিরঙ্কুশ হবে না। তাই পূবে এবং পশ্চিমে চলছে পাইকারী হারে বাঙ্গালী নিধন। কোথায় আজ সিন্ধুর শকুনি ভুট্টো? রবীন্দ্রনাথের কবিতা আওফিরে একদিন তিনি পুবের বাঙ্গালীকে থােকা দিতে চেয়েছিলেন। করাচিতে তিনশ বাঙ্গালীকে পিটিয়ে মারলাে উন্মত্ত অবাঙ্গালী জনতা। ভুট্টোর বাঙ্গালী প্রেমে একটুও দোলা লাগল না। এই বিশ্বাসঘাতক শয়তানের দল আজ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠীর ‘পদলেহনকারী ঘূণিত পাশ্বচর। এরাই চায় বাংলাদেশ শাসনের অধিকার।
সম্প্রতি পাক বেতার তুলেছে ধর্মের জিগীর। ইসলামের নামে জানাচ্ছে তারা ঐক্যের আহ্বান। নরঘাতীদের জিহবা দুষিত। ওদের মুখে ধর্মের কথা ধর্মের অপমান। শান্তির ধর্ম ইসলাম কি গণহত্যার প্রশ্রয় দেয়? প্রেমের ধর্ম ইসলাম কি অসহায় নরনারীকে পিটিয়ে মারে? সাম্যের ধর্ম ইসলাম কি সংখ্যাধিক্যের উপর শােষণ ভিত্তিক ঔপনিবেশিক শাসনা চালায়? বাংলাদেশে যে নারী ধর্ষন চলছে তার পিছনে কি ধর্মের সমর্থন আছে? পূবের বাঙ্গালীদের অধিকাংশ মুসলমান। তাদের হত্যা করছে কারা? পশ্চিমা ঘাতক দল। ঘাতকের কোন ধর্ম নেই। তারা মানবদ্রোহী এবং ধর্মদ্রোহী। এদের মুখে ধর্মের জিগীর শয়তানি প্রলাপ। ইয়াহিয়া এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা গােটা মানবজাতির কলঙ্ক। পবিত্র ইসলাম ধর্মকে তারা অপবিত্র করার অপচেষ্টায় মত্ত। তাদেরর ক্ত কলঙ্কিত হাহে কোরান স্পর্শের অধিকার নেই। বাংলাদেশের জাগ্রত জনতার মােহভঙ্গ ঘটেছে। ধর্মের নামে অধর্মের আফিং খাইয়ে তাদের আবার ঘুম পাড়ানাে যাবে না। ইয়াহিয়া নিজের অজ্ঞাতসারে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করেছেন। ঢাকা এবং ইসলামাবাদ আজ যুদ্ধরত । তাই হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ে চার লক্ষ বাঙ্গালী ইয়াহিয়ার হােষ্টেজ। যুদ্ধের সময় শত্রু রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই ভাগ্য বিপর্যয় চিরাচরিত রীতি। ইসলামাবাদের শাসকদের কাছে বাংলাদেশ শত্রু রাষ্ট্র। তার নাগরিকদের মৃত্যু যন্ত্রণা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সুখের একটা আন্তর্জাতিক নিয়ম আছে। তা মানছেন না ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশের জয় অনিবার্য। ইসলামাবাদের স্বৈরাচারীদের জন্য অপেক্ষা করছে যুদ্ধাপরাধির বিচার। মানবতার শত্রু কোনদিন ক্ষমতা পায় নি, ভবিষ্যতেও পাবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ এপ্রিল ১৯৭১