You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দাও

বাঙালীর জনমানস থেকে পূর্ব পাকিস্তান মুছে গেছে। তার জায়গায় জন্ম নিয়েছে গণতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার সদস্যের নাম ঘােষণা করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ইসলামাবাদের সামরিক শাসকরা এই নবীন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধরত। ওদের ভাড়াটিয়া বাহিনী মুজিবুরের বাংলাদেশকে গলা টিপে মারার সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে। আগামী ক’দিনের মধ্যেই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে। কারণ পশ্চিমারা এখন বেপরােয়া। তাদের অস্ত্রশস্ত্র অত্যাধুনিক। যারা এগুলাে ব্যবহার করছে তারা সুশিক্ষিত সৈন্যদল। এদের প্রতিপক্ষ গণতান্ত্রিক মুক্তিফৌজ। সংখ্যায় বেশী কিন্তু অস্ত্র শক্তিতে দুর্বল। একমাত্র সম্বল মনােবল এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অকুণ্ঠ সমর্থন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল মুজিব বাহিনীর দখলে। বড় বড় শহরের প্রায় সর কটিই পশ্চিমাদের করতলগত। ওরা এখন মরণ কামড় দিতে উদ্যত। ইতিমধ্যেই স্ট্রটেজিক ঘাটিগুলােতে নিজেদের অধিকার কায়েম করতে উৎসুক। লড়াই সহজে শেষ হবে না। মুজিববাহিনী অবশ্যই গেরিলা লড়াই চালাবে। যতদিন যাবে দখলদার সৈন্যরা ততই হীনবল হয়ে পড়বে। ওদের সরবরাহে দেখা দেবে বিপর্যয়। আসন্ন বর্ষাকাল পশ্চিমাদের মৃত্যু ফাঁদ। গ্রামাঞ্চলে ইয়াহিয়ার শাসন অসম্ভব। যে শহরগুলাে আজ তার হাতে আছে কাল তা নাও থাকতে পারে। একটা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলাের হতবদল সাধারণ ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রেই তার বাস্তব মূল্য সাময়িক।
ভারতের সামনে এসে পড়েছে যুগান্তরকারী সিদ্ধান্তের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার দাবী উঠেছে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে জানিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি। এখন দরকার নব রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতী। তা হলেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর হবে সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা। এতদিন এ পথে যেসব বাধা ছিল তা এখন নেই। মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্যান্য মন্ত্রীও পেয়েছেন বিভিন্ন দপ্তর। প্রায় গােটা গ্রামাঞ্চলে চলছে তাদের শাসন। মুজিবর পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার মত ভূইফোড় ডিকটেটর নন। তাঁর সরকারের পিছনে রয়েছে জনসাধারণ এবং তাদের নির্বাচিত সদস্যদের পূর্ণ সহযােগিতা। ভুট্টো-ইয়াহিয়া বিশ্বাসঘাতকতা না করলে মুজিবর রহমান এবং তার মনােনীত মন্ত্রীসভাই হতেন গােটা পাকিস্তানের সরকার। পশ্চিমের সামরিক দাপট এবং পাঞ্জাবী স্বার্থচক্র শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। একদিকে গণতন্ত্রী মুজিবর সরকার এবং অপরদিকে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকার। এই বিপরীত ধর্মী দুই সরকারের বাহিনীর মধ্যে শুরু হয়েছে লড়াই। ভারত চায় বাংলাদেশে পশ্চিমাদের গণহত্যার অবসান। বাঞ্ছিত অবসানের একমাত্র উপায় অবিলম্বে মুজিব সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদান। তা হলেই বাংলাদেশে অস্ত্র পাঠাতে থাকবে না কোন আন্তর্জাতিক বাধা। দখলদার বাহিনীর পরাজয় হবে ত্বরাণিত। রক্ষা পাবে লক্ষ লক্ষ নরনারী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত সাফল্যের সঙ্গে জড়িত ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বহু চেষ্টা করেছেন নয়াদিল্লী। প্রতিদানে পেয়েছেন পশ্চিমা ডিকটেটরদের কাছে গলা ধাক্কা। ভারত বিদ্বেষী ভুট্টো-ইয়াহিয়া কবলিত পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষ করে শক্তিশালী পাঞ্জাবী চক্র কোনদিনই নয়াদিল্লীকে স্বস্তি দেয় নি, দেবেও না। বাংলাদেশের একছত্র নায়ক মুজিবর ভারতের বন্ধুত্ব প্রয়াসী। বর্তমান সঙ্কট সৃষ্টির ক’বছর আগে থেকেই জোরাল ভাষায় প্রচার করে এসেছেন তার যৌক্তিকতা। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই সৌহার্দের রাখী পরাবেন ভারতের হাতে। আর যদি ভুট্টো-ইয়াহিয়া আবার দখলে নিতে পারে বাংলাদেশ তবে ভারত উত্তর-পশ্চিমে পাবে চিরশত্রু পশ্চিম পাকিস্তানকে এবং পূর্বে পাবে নূতন শত্রু পূর্ব পাকিস্তানকে। ইসলামাবাদের স্বৈরাচারীদের বাধা দেবার কেউ থাকবেন না গােটা পাকিস্তানে। সুযােগ সন্ধানী চীন নেবে সম্ভাব্য অবস্থার পূর্ণ সুযােগ। গণতন্ত্র মানবতা এবং নিরাপত্তার প্রশ্নের একমাত্র সমাধান বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতদান এবং তাদের সংগ্রাম জয়যুক্ত করার জন্য সবরকমের সাহায্যের আশু ব্যবস্থ। সােভিয়েট রাশিয়ারও আর বসে থাকার সময় নেই। গণহত্যা বন্ধের প্রাথমিক চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদগাের্ণি। দ্বিতীয় পর্যায়ের পথ খুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার। ভারত এবং সােভিয়েট রাশিয়া একযােগে এ সরকারকে আপাততঃ ডি ফ্যাটো স্বীকৃতি দিলে বিশ্বের অন্যান্য আদর্শনিষ্ঠ রাষ্ট্র তাদের অনুসরণ করবে। ইতিহাসের পাতায় সংযােজিত হবে লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তপূত একটি নবীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাম। আর দেরী নয়। মুক্তিকামী বাংলাদেশ ডাকছে। তার আহ্বানে সাড়া দিতেই হবে। এটা ন্যায়ের দাবী, এটা মনুষ্যত্বের দাবী এবং এটা গণতন্ত্রের দাবী। ভারতের মর্মস্থল নবযাত্রার পদধ্বনিতে আন্দোলিত। নয়াদিল্লী জেগে উঠুন। ইয়াহিয়ার বুটের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশকে বলুন—আমরা আছি। ভয় নেই। তােমরা জীবন-মরণ সংগ্রাম আমাদের সংগ্রাম। আমাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি তােমাদের জয় টিকা। এ টিকা আমরা তােমাদের ললাটে পড়ব। তােমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইব—আমার সােনার বাংলা। আমি তােমায় ভালবাসি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!