You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969 | সামরিক-বেসামরিক সবার অবদান ছিল - আবদুর রাজ্জাক | আগরতলা মামলা - সংগ্রামের নোটবুক

সামরিক-বেসামরিক সবার অবদান ছিল – আবদুর রাজ্জাক

ষাটের দশকের স্বাধীনতাপন্থী প্রগতিশীল ছাত্র নেতা হিসেবে খ্যাত ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রথম সারির সংগঠকদের অন্যতম ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। ওই সময়ে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজকে নিয়ে পরিচালিত প্রকাশ্য ও গােপন কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুর সাক্ষী তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনেও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তার। স্বাধীনতার পর তিনি । জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান, একাধিকবার সাংসদ ও মন্ত্রীত্বসহ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত  ছিলেন। ২০০৭ সালের ২২ মার্চ সকালে রাজধানীর নাখালপাড়া এমপি হােস্টেলে গিয়ে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এসময় তিনি তুলে ধরেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি, এতে প্রগতিশীল প্রবীণ-নবীন রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, ছাত্রসমাজ ও সশস্ত্রবাহিনীর তৎকালীন বাঙালি সদস্যদের ভূমিকার ব্যাপারে তার জানা নানা কথা। আবদুর রাজ্জাক বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ছাত্র-যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ যে ‘ স্বত:স্ফুর্তভাবে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার সূচনা ও প্রস্তুতি ছিল | দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অনেক রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবদান এ প্রস্তুতিতে ছিল।

শেরে বাংলা  একে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীসহ আরও অনেকে স্বায়ত্বশাসন, স্বাধিকার ইত্যাদির স্বপ্ন মানুষের মনে জাগিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জনে অটল থেকে পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুর মতাে কেউ এগিয়ে যেতে পারেননি। পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস, ছয় দফা, পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করা সবই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। এক একটি পদক্ষেপ। সব কিছুতেই ছিল তাঁর নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা।’ বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘তখনকার দিনে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি বিবেচনার মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দল করা কঠিন হবে ভেবে বঙ্গবন্ধু ৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সংগঠন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে শেরে বাংলা, সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম প্রমুখ নেতা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, পাকিস্তানিদের শাসন-শােষণের চিত্র দেখে বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিন্তা করেন। গােপন তৎপরতা ও স্বাধঅন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠনের পটভূমি স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাত্রলীগকে সংগঠিত ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠনের পটভূমি ব্যাখ্যা করে সাবেক ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, “স্বাধীনতার স্বপ্নকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে আন্দোলনের যথাযথ সুযােগ ও ক্ষেত্র খুঁজেন। ভাষার দাবি, ভাষার জন্য রক্তপাত ইত্যাদির মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রােপিত হয়।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর বাঙালিদের নেতৃত্বে সরকার গঠন এবং ৫৬ সালে একটি সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে বাঙালিদের কিছু দাবি দাওয়া পূরণের সম্ভাবনা দেখা দিলেও নানা কারণে তা হয়নি। ৫৮ সালে আইউব খানের সামরিক শাসন জারির ফলে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযােগ বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে গােপনভাবে সংগঠিত করার মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ ব্যাপারে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনসহ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রনেতার সঙ্গেও পরামর্শ করেন তিনি। শাহ মােয়াজ্জেমকে সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬১ সালে গঠিত ছাত্রলীগের কমিটিতে সিরাজুল আলম খান এবং আমিসহ আরাে কয়েকজন বিভিন্ন পদে ছিলাম। ৬২তে সােহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তি, সামরিক আইন প্রত্যাহার, হামিদুর রহমান শিক্ষা। কমিশনের রিপাের্ট বাতিল ইত্যাদি দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সংগঠিত হতে থাকি। এ পর্যায়ে সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা বাড়ানাের দাবি উঠে। আইউব খান বলেছিলেন বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না। এরা জানে শুধু জুতাে সাফ করতে। তাই তাদের আর্মিতে নেওয়া যাবে না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ কথা জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। মনে আছে আমি এবং সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) আলাপ করছিলাম পেছনের দিকে বসে। সিরাজ ভাইকে বললাম, এভাবে আর থাকা যায় না। আসুন একটা কিছু করি। তিনি বলেন, হ্যা আমিও চিন্তা করছি, কিছু একটা করতে হবে।’ এর আগে থেকে সিরাজ ভাই, শেখ মনি, ওবায়দুর রহমানরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন।

তিনিই তাদেরকে বলেছিলেন কিছু একটা করা দরকার। সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুকে সবসময় ‘লিডার’ সম্বােধন করতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয় ৬৩ সাল। থেকে। ইতিমধ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আন্দোলন পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক করে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়। শুরু থেকে এর সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আমি এবং কাজী আরেফ আহমেদ। এই নিউক্লিয়াসই ছিল মূলত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের অন্যরূপ। ৬৪ সালে আমাদের কার্যক্রমের একটি রূপরেখা তৈরি হয়। আমরা সাইক্লোস্টাইল মেসিনে এ সংক্রান্ত একটি প্রচারপত্র বের করি। পরে একটি ট্রেডল মেসিন (মুদ্রণযন্ত্র) কিনে মােহাম্মদপুরের একটা বাড়ির চিলেকোটায় সেটি বসানাে হয়। বাড়িটি ঠিক করেন কাজী আরেফ আহমদ। প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির আবুল কালাম আজাদ ছিলেন। পরে তাকে বাদ দেওয়া হয়। প্রেসটিও বিক্রি করে দেওয়া হয়। নিউক্লিয়াসের কাজে তখন তাত্ত্বিক সহযােগিতা দিতেন অ্যাডভােকেট কমরুদ্দিন। তিনি সােহরাওয়ার্দীর আমলে বার্মায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার ছিলেন। হিসট্রি অব বেঙ্গল’ | নামে একটা অধ্যায় আমাদের এই লাইনের ক্যাডারদের জন্য তিনি পাঠ্য করেছিলেন। চেগুয়েভারা, মাও সেতুং এবং আলজিরিয়ার ওপর একটি বইসহ আরও বেশ কিছু বই। আমাদের পাঠ্য ছিল। এসব কিছুই হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুমতিক্রমে। স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি এবং হয় দফা স্বাধীনতার জন্য ছাত্রলীগের তৎপরতা এবং ছয় দফা প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক বলেন, “৬৬সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘােষণা করেন।

ছাত্র ও শ্রমিকদের সংগঠিত করার পাশাপাশি ছয় দফার পক্ষে প্রচারের কাজও আমরা চালিয়ে যাই। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি- আবার ছয় দফা কেন- জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ওপারে যাওয়ার সাঁকো তৈরি করে দিলাম। লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য বঙ্গবন্ধুর অনুমতি সাপেক্ষ আমরা একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। সে অনুযায়ী প্রতিটি থানায় যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে একজনকে প্রধান করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট গ্রুপ তৈরি করা হয়। প্রথম দিকে তারা ছয় দফা, স্বায়ত্বশাসন ইত্যাদি নিয়ে জনগণের সঙ্গে কাজ করতেন। কিছুদিন গ্রুপে থাকার পর রক্ত শপথের মাধ্যমে তাদেরকে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টি জানানাে হতাে। গ্রুপের সদস্যদের একটি প্রচারপত্র দেওয়া হতাে, যাতে থাকতাে আমাদের লক্ষ্য, কর্মসূচি, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ইত্যাদি। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে পুলিশ তথা গােয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কিত কেউ আছে কী না যাচাই করা হতাে। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটি ছােট ট্রানজিস্টার খুলে রাখতেন যাতে বাইরের কোনাে মহল আমাদের পরিকল্পনার কথা ধরতে না পারে। আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার হবার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় । ৬৯ সালে তিনি জেল থেকে বের হওয়ার পর আমাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি জানতে চান। ইতিমধ্যে আমাদের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, মানিকগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার তিনশ সংসদীয় থানার প্রায় ২০০ থানায় কমিটি হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে শক্তিশালী ছিল চট্টগ্রামের গ্রুপটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতেও শক্ত দল ছিল আমাদের।

এ মুহূর্তে আমার চট্টগ্রামের এমএ মান্নান, আদমজীর এক শ্রমিক নেতা মান্নান, অ্যাডভােকেট আবুল কালাম আজাদ, এসএম ইউসুফ, মােকতার আহমদ। প্রমুখের কথা মনে পড়ছে। আরও অনেকে ছিলেন সারাদেশে-যারা স্বাধীনতার জন্য শপথ নিয়ে আমাদের দলভুক্ত হয়েছিল। আমাদের অগ্রগতি জানার পর সবকিছুই বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক অনুমােদন করেন। আমাদের কার্যক্রমে যুক্তদের নিয়েই পরবর্তীতে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রচারণা ‘৬১-তে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার মধ্যে মন্ত্রবীজ ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৬১ সালে প্রচারিত একটি গােপন প্রচারপত্র বিলি করার অভিজ্ঞতার কথা জানান আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, “আমাদের জানার বাইরেও বঙ্গবন্ধু অনেককে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন। ৬১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের কথা। একদিন মনিভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) আমাকে ডেকে কাগজে মােড়ানাে কতগুলাে প্রচারপত্র দিয়ে বললেন, ‘এগুলাে রাত তিনটার দিকে ভার্সিটি এলাকার হলে হলে, ঘরে ঘরে খুবই সাবধানে বিলি করতে হবে।’ তিনি চলে যাওয়ার পর সেগুলাে খুলে দেখে প্রথমে আমি ঘাবড়ে যাই। কারণ সেখানে যা লেখা-ধরা পড়লে ১৪ বছর জেল নির্ঘাত। শিরােনাম ছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর। নিচে লেখা ছিল ‘সংগ্রামী জনতা। সেখানে বাঙালিদের ওপর পশ্চিমাদের শাসনশশাষণ এবং সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনীতিতে কীভাবে বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তার বিবরণ দেওয়া ছিল। এসব শােষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য বাঙালি ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানাে হয় ওই প্রচারপত্রে।

আমার মনের ভেতর যেহেতু স্বাধীনতার চেতনাটা ছিল, তাই সাহস করে রাতের মধ্যে ফজলুল হক হলের বিভিন্ন ঘরে গিয়ে দরজার নিচ দিয়ে প্রচারপত্র ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসি। বাকিটুকু একটি টয়লেটের বেসিনের ওপর রেখে রুমে এসে শুয়ে থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি। সকালে আমার রুমমেট বাইরে। গিয়ে ফিরে এসে বললাে, বাইরে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের লিফলেট পাওয়া গেছে। আমি কিছু না জানার ভান করে বললাম, এগুলাে বিপজ্জনক, বাইরে ফেলে দে, কাউকে কিছু বলিস না।’ এই প্রচারপত্রও আমাদেরকে স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৬২তে নিউক্লিয়াস গঠনের সময় বিষয়টি আলােচনায় এসেছিল। মনি ভাই বলেছিলেন, এটা বঙ্গবন্ধু করিয়েছেন। মানিক মিয়াও (তােফাজ্জল হােসেন মানিক, ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) এতে যুক্ত আছেন।’ পরে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও বিষয়টি জেনেছি। ৬৭ সালে মানিক মিয়াও এটি স্বীকার করেন। ছয় দফা আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (পিডিএফ) গঠিত হলে সেখানে ছয় দফা বিরােধী নেতারা সব অংশ নেন। মানিক মিয়াও ছিলেন সেখানে। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে আমার কাছে জানতে চান, এখন আমরা কী করছি। আমরা আমাদের আন্দোলন কর্মসূচির চিন্তা ভাবনার কথা বললে তিনি বললেন, এগুলাে করে লাভ হবে না। ঐক্য ছাড়া শেখ মুজিব জেল থেকে আসতে পারবে না। সবাই জেলে মারা যাবে। তখন কি হবে? আমি স্বাধীনতার জন্য চারদিকে যে আলােচনা হচ্ছে সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন,‌ ‌‘কিসের‌ ‌স্বাধীনতা?’‌ ‌আমি‌ ‌তাঁকে‌ ‌১৯৬১‌ ‌তে‌ ‌বিলি‌ ‌করা‌ ‌প্রচারপত্রে‌ ‌তিনি‌ ‌এবং‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌যে‌ ‌স্বাধীনতার‌ ‌কথা‌ ‌বলেছেন‌ ‌তা‌ ‌ স্মরণ‌ ‌করিয়ে‌ ‌দিলে‌ ‌তিনি‌ ‌বলেন,‌ ‌“দেখ‌ ‌ওসব‌ ‌এখন‌ ‌বাদ‌ ‌দাও।‌ ‌বর্তমানে‌ ‌টোটাল‌ ‌কৌশল‌ ‌পরিবর্তন‌ ‌হয়ে‌ ‌গেছে,‌ ‌গ্লোবাল‌ ‌স্ট্যাটেজি‌ ‌ চেঞ্জ‌ ‌হয়ে‌ ‌গেছে।’‌ ‌ওই‌ ‌সময়‌ ‌ছয়‌ ‌দফার‌ ‌প্রশ্নে‌ ‌আওয়ামী‌ ‌লীগে‌ ‌বিভক্তি‌ ‌আসে।‌ ‌শেষ‌ ‌পর্যন্ত‌ ‌ছয়‌ ‌দফা‌ ‌পন্থীরা‌ ‌জয়ী‌ ‌হয়।‌ ‌এরপর‌ ‌ আগরতলা‌ ‌মামলা‌ ‌প্রত্যাহারসহ‌ ‌সংশ্লিষ্ট‌ ‌সবার‌ ‌মুক্তি‌ ‌দাবি‌ ‌এবং‌ ‌ছয়‌ ‌দফা‌ ‌ও‌ ‌১১‌ ‌দফার‌ ‌আন্দোলনের‌ ‌ধারাবাহিকতায়‌ ‌সত্তরের‌ ‌নির্বাচন‌ ‌ এবং‌ ‌১৯৭১‌ ‌মুক্তিযুদ্ধের‌ ‌মাধ্যমে‌ ‌সৃষ্টি‌ ‌হয়‌ ‌বাংলাদেশের।‌ ‌বাঙালি‌ ‌সেনা‌ ‌সদস্যদের‌ ‌ভূমিকা‌ ‌প্রসঙ্গে‌ ‌ছাত্র‌ ‌সংগঠনের‌ ‌বাইরে‌ ‌অর্থাৎ‌ ‌সশস্ত্র‌ ‌বাহিনীর‌ ‌বাঙালি‌ ‌সদস্য‌ ‌ও‌ ‌সরকারি‌ ‌কর্মকর্তাদের‌ ‌গােপন‌ ‌বিপ্লবী‌ ‌কর্মকাণ্ড‌ ‌সম্পর্কে‌ ‌আবদুর‌ ‌রাজ্জাক‌ ‌বলেন,‌ ‌’আমাদের‌ ‌ কর্মকাণ্ড‌ ‌ছাড়াও‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌গােপনে‌ ‌নানা‌ ‌কৌশলে‌ ‌ভিন্ন‌ ‌গ্রুিপ‌ ‌তৈরি‌ ‌করে‌ ‌স্বাধীনতা‌ ‌সংগ্রামের‌ ‌ক্ষেত্র‌ ‌প্রস্তুত‌ ‌করছিলেন।‌ ‌

সােহরাওয়ার্দী‌ ‌সাহেব‌ ‌থাকতেই‌ ‌তার‌ ‌অগােচরে‌ ‌এসব‌ ‌শুরু‌ ‌করেন‌ ‌বঙ্গবন্ধু।‌ ‌নেতা‌ ‌হিসেবে‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌সােহরাওয়াদাকে‌ ‌ভক্তি‌ ‌শ্রদ্ধা‌ ‌ করলেও‌ ‌১৯৫৬‌ ‌সালের‌ ‌সংবিধান‌ ‌রচিত‌ ‌হওয়ার‌ ‌পর‌ ‌সােহরাওয়ার্দী‌ ‌‘৯৮‌ ‌ভাগ‌ ‌স্বায়ত্বশাসন‌ ‌হয়ে‌ ‌গেছে‌ ‌বলে‌ ‌মন্তব্য‌ ‌করলে‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌ তা‌ ‌মেনে‌ ‌নিতে‌ ‌পারেননি।‌ ‌তখনই‌ ‌তিনি‌ ‌ভেতরে‌ ‌ভেতরে‌ ‌অন্য‌ ‌পথ‌ ‌ধরেন।‌ ‌সােহরাওয়ার্দীর‌ ‌ছত্রছায়ায়‌ ‌থেকেই‌ ‌তিনি‌ ‌সিএসপি‌ ‌রুহুল‌ ‌ কুদুস,‌ ‌আহমদ‌ ‌ফজলুর‌ ‌রহমান,‌ ‌খান‌ ‌শামসুর‌ ‌রহমানদের‌ ‌সঙ্গে‌ ‌গােপনে‌ ‌পরামর্শক্রমে‌ ‌প্রস্তুতিমূলক‌ ‌কাজ‌ ‌শুরু‌ ‌করেন।‌ ‌একই‌ ‌ সঙ্গে‌ ‌জাতীয়‌ ‌সংসদের‌ ‌কাজে‌ ‌করাচি‌ ‌গেলে‌ ‌সেখানে‌ ‌সশস্ত্র‌ ‌বাহিনীর‌ ‌বঞ্চিত‌ ‌ও‌ ‌হতাশ‌ ‌দেশপ্রেমিক‌ ‌বাঙালি‌ ‌সদস্য-যারা‌ ‌পরে‌ ‌ আগরতলা‌ ‌মামলার‌ ‌আসামি‌ ‌হন‌ ‌তাদেরকে‌ ‌সংগঠিত‌ ‌করেন।‌ ‌ওই‌ ‌সময়‌ ‌এত‌ ‌গভীরে‌ ‌আমরা‌ ‌যাইনি।‌ ‌তাই‌ ‌তাঁদের‌ ‌কার্যক্রম‌ ‌সম্পর্কে‌ ‌ ভালাে‌ ‌করে‌ ‌জানতাম‌ ‌না।‌ ‌তবে‌ ‌মনিভাই,‌ ‌সিরাজ‌ ‌ভাই‌ ‌কিছু‌ ‌কিছু‌ ‌জানতেন।‌ ‌আমি‌ ‌জানতে‌ ‌পারি‌ ‌মামলা‌ ‌শুরু‌ ‌হওয়ার‌ ‌পর।‌ ‌এর‌ ‌ আগে‌ ‌তাদের‌ ‌কাছে‌ ‌জেনেছিলাম‌ ‌৬২-৬৩‌ ‌সালে‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌আগরতলা‌ ‌গিয়েছিলেন‌ ‌প্রয়ােজনীয়‌ ‌সাহায্য‌ ‌সহযােগিতা‌ ‌নিয়ে‌ ‌ আলােচনার‌ ‌জন্য।‌ ‌আমাদের‌ ‌আন্দোলনের‌ ‌প্রস্তুতি‌ ‌প্রক্রিয়া‌ ‌চলার‌ ‌সময়‌ ‌দু-একজন‌ ‌বাঙালি‌ ‌সেনা‌ ‌সদস্য‌ ‌মাঝে‌ ‌মধ্যে‌ ‌যােগাযােগ‌ ‌ করে‌ ‌আমাদের‌ ‌আন্দোলন‌ ‌নিয়ে‌ ‌কথা‌ ‌বলছিলেন।‌ ‌কিন্তু‌ ‌তখন‌ ‌তাদের‌ ‌পরিচয়‌ ‌পাইনি।‌ ‌মামলা‌ ‌চলাকালে‌ ‌জেলখানায়‌ ‌গিয়ে‌ ‌তাদের‌ ‌ আসল‌ ‌পরিচয়‌ ‌জানতে‌ ‌পারি।‌ ‌আগরতলা‌ ‌মামলা‌ ‌থেকে‌ ‌বঙ্গবন্ধুর‌ ‌মুক্তির‌ ‌পর‌ ‌পরিষ্কার‌ ‌জানতে‌ ‌পারলাম‌ ‌যে‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌ষাটের‌ ‌ দশকের‌ ‌শুরু‌ ‌থেকেই‌ ‌এসব‌ ‌কাজ‌ ‌ভেতরে‌ ‌ভেতরে‌ ‌চালাচ্ছিলেন।‌ ‌মুক্তিযুদ্ধে‌ ‌ভারতের‌ ‌সহযােগিতা‌ ‌প্রসঙ্গে‌ ‌আবদুর‌ ‌রাজ্জাক‌ ‌বলেন,‌ ‌ একাত্তরের‌ ‌১৮‌ ‌ফেব্রুয়ারি‌ ‌কি‌ ‌২১‌ ‌ফেব্রুয়ারি‌ ‌বঙ্গবন্ধু‌ ‌আমাদের‌ ‌ডেকে‌ ‌বললেন,‌ ‌ভবিষ্যতের‌ ‌জন্য‌ ‌তৈরি‌ ‌হয়ে‌ ‌যা।‌

যুদ্ধ‌ ‌শুরু‌ ‌হলে‌ ‌ ভারতের‌ ‌সহযােগিতা‌ ‌পাওয়া‌ ‌যাবে।‌ ‌আমেরিকা‌ ‌ও‌ ‌চীন‌ ‌সমর্থন‌ ‌দেবে‌ ‌না।‌ ‌তবে‌ ‌রাশিয়ার‌ ‌সমর্থন‌ ‌এক‌ ‌পর্যায়ে‌ ‌আসবে।‌ ‌ভারতে‌ ‌গিয়ে‌ ‌যাদের‌ ‌সঙ্গে‌ ‌যােগাযােগ‌ ‌করতে‌ ‌হবে‌ ‌তাদের‌ ‌তালিকা‌ ‌এবং‌ ‌ঠিকানাও‌ ‌দেন‌ ‌তিনি।‌ ‌এসব‌ ‌কিছুই‌ ‌স্বাধীনতা‌ ‌সংগ্রামের‌ ‌জন্য‌ ‌বঙ্গবন্ধুর‌ ‌ প্রস্তুতির‌ ‌প্রমাণ‌ ‌বহন‌ ‌করে।’‌ ‌বললেন, ‘কিসের স্বাধীনতা?’ আমি তাঁকে ১৯৬১ তে বিলি করা প্রচারপত্রে তিনি এবং বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন তা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, “দেখ ওসব এখন বাদ দাও। বর্তমানে টোটাল কৌশল পরিবর্তন হয়ে গেছে, গ্লোবাল স্ট্যাটেজি চেঞ্জ হয়ে গেছে।’ ওই সময় ছয় দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগে বিভক্তি আসে। শেষ পর্যন্ত ছয় দফা পন্থীরা জয়ী হয়। এরপর আগরতলা মামলা প্রত্যাহারসহ সংশ্লিষ্ট সবার মুক্তি দাবি এবং ছয় দফা ও ১১ দফার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সত্তরের নির্বাচন এবং ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের। বাঙালি সেনা সদস্যদের ভূমিকা প্রসঙ্গে ছাত্র সংগঠনের বাইরে অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের গােপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের কর্মকাণ্ড ছাড়াও বঙ্গবন্ধু গােপনে নানা কৌশলে ভিন্ন গ্রুিপ তৈরি করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিলেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব থাকতেই তার অগােচরে এসব শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সােহরাওয়াদাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করলেও ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হওয়ার পর সােহরাওয়ার্দী ‘৯৮ ভাগ স্বায়ত্বশাসন হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করলে বঙ্গবন্ধু তা মেনে নিতে পারেননি। তখনই তিনি ভেতরে ভেতরে অন্য পথ ধরেন। সােহরাওয়ার্দীর ছত্রছায়ায় থেকেই তিনি সিএসপি রুহুল কুদুস, আহমদ ফজলুর রহমান, খান শামসুর রহমানদের সঙ্গে গােপনে পরামর্শক্রমে প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের কাজে করাচি গেলে সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত ও হতাশ দেশপ্রেমিক বাঙালি সদস্য-যারা পরে আগরতলা মামলার আসামি হন তাদেরকে সংগঠিত করেন। ওই সময় এত গভীরে আমরা যাইনি। তাই তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে ভালাে করে জানতাম না। তবে মনিভাই, সিরাজ ভাই কিছু কিছু জানতেন।

আমি জানতে পারি মামলা শুরু হওয়ার পর। এর আগে তাদের কাছে জেনেছিলাম ৬২-৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়েছিলেন প্রয়ােজনীয় সাহায্য সহযােগিতা নিয়ে আলােচনার জন্য। আমাদের আন্দোলনের প্রস্তুতি প্রক্রিয়া চলার সময় দু-একজন বাঙালি সেনা সদস্য মাঝে মধ্যে যােগাযােগ করে আমাদের আন্দোলন নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু তখন তাদের পরিচয় পাইনি। মামলা চলাকালে জেলখানায় গিয়ে তাদের আসল পরিচয় জানতে পারি। আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর পরিষ্কার জানতে পারলাম যে বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের শুরু থেকেই এসব কাজ ভেতরে ভেতরে চালাচ্ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযােগিতা প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক বলেন, একাত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কি ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাদের ডেকে বললেন, ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়ে যা। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের সহযােগিতা পাওয়া যাবে। আমেরিকা ও চীন সমর্থন দেবে না। তবে রাশিয়ার সমর্থন এক পর্যায়ে আসবে। ভারতে গিয়ে যাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে তাদের তালিকা এবং ঠিকানাও দেন তিনি। এসব কিছুই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রস্তুতির প্রমাণ বহন করে।’

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক