You dont have javascript enabled! Please enable it!

আইউব বুঝতে চাননি বাঙালিদের মনের কথা – সৈয়দ ইলিয়াছ ধামী

অবিচার অনাচার আর বৈষম্যের শিকার বাঙালিরাই শুধু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীকে ঘৃণা করতেন তাই নয়, প্রতিবেশী মুসলিম দেশের অনেকেও ওদের অপছন্দ করতেন। বিশেষ করে এদেশে থেকে যারা পাকিস্তানিদের কীর্তিকাণ্ড দেখেছেন তাঁদেরও বিশ্বাস জমেছিল, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এভাবে বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান আলাদা। হয়ে একদিন স্বাধীন হয়ে যাবে। এমন উপলব্ধিকারী। ব্যক্তিদের একজন অধ্যাপক সৈয়দ ইলিয়াছ ধামী। ১৯৬৭সালের শেষ এবং ৬৮সালের মাঝামাঝি সময়ে কথিত আগরতলা মামলার ১ নম্বর আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহধর্মীনি বেগম ফজিলতুন্নেছার মধ্যে কৌশলে চিঠি চালাচালি করে পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ ও তথ্যের আদান প্রদানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন তিনি। পাকিস্তানের অতি কাছের তথা সীমান্ত সংলগ্ন আফগানিস্তানের বাসিন্দা কানাডা প্রবাসী ড. শফিক ধামীর ছেলে ইলিয়াস ধামী ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় আসেন পড়ালেখার জন্য। ৬৮ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ছিলেন এদেশে। এখানে থাকার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি বা বন্ধ হলে বাঙালি ছাত্র বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেতেন বিভিন্ন গ্রামে। সেখানে নৌকায় করে ঘুরতেন, নদীতে বা পুকুরে স্নান করতেন, মুগ্ধ হতেন বাঙালিদের বৈচিত্রময় জীবনাচার ও সংগ্রামী চেতনা দেখে। আবার পাকিস্তানি অনেকের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কারণে ভেতর থেকে উপলব্ধি করার সুযােগ হয়েছে তাদের আচার-আচরণ ও মন মানসিকতা সম্পর্কে, যা তার ভাষায় অত্যন্ত বাজে।

তিনি দেখেছেন পাকিস্তানিরা কীভাবে বাঙালিদের ওপর শােষণ বৈষম্য আর অবহেলার স্টিম রােলার চালিয়েছিল। আবার বাঙালি ছাত্র-জনতা ও তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে এসে দেখেছেন তাঁর দেশপ্রেম, সাহস আর জেনেছেন তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কথা। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি বুঝেছিলাম বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের কোনাে অনুভূতি ছিল না, তাদের দূরদৃষ্টি ছিল না যে, বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর কী হতে পারে। আইউব বুঝতে চাননি বাঙালিদের মনের কথা এবং পাকিস্তান কীভাবে টিকবে। তিনি লাঠি-বন্দুক। দিয়ে সবকিছু বােঝাতে চেয়েছিলেন। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এভাবে বাঙালিদের বশে রাখা যাবে না।’ তারুণ্যের সময় সুদর্শন, স্মার্ট আফগান ইলিয়াছ ধামীর সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্ব ছিল পাকিস্তানি এক সেনা কর্মকর্তার (জিওসি) মেয়ের সঙ্গে। সেই সূত্রে মেয়ে বন্ধুটির সঙ্গে কিংবা একলা সেনানিবাস এলাকায় তার ছিল নির্বিঘ্ন যাতায়াতের সুযােগ। আর সে সুযােগের সদ্ব্যবহার করে কৌশলে তিনি চিঠি চালাচালি করতেন কারাবন্দি শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিবের মধ্যে। ইলিয়াছ ধামী জানান, পড়ালেখা শেষে ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি চলে যান আমেরিকা। সেখানে আমেরিকার আইন অনুয়ায়ী বাধ্য হয়ে যােগ দেন সেনাবাহিনীতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেন মার্কিনীদের পক্ষে। ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মার্কিন জেনারেল এরেকসনের কাছে যখন জানতে পারেন পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়ানরা ঢুকে পড়েছে, তখন মনে খুব খারাপ লেগেছিল তাঁর-কেন এমন হলাে? ওই সময় তিনি মালয়েশিয়া বদলি হন। ভাবেন, তিনি যা মনে করছেন অর্থাৎ ইন্ডিয়ান বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে তা তাে হবার নয়।

বরং তার মনে হলাে পাকিস্তানিরাই বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছেন। বললেন, ‘আমি অনুতপ্ত হলাম। ভাবলাম আমার তাে আমেরিকান বাহিনীতে যােগ না দিয়ে বাঙালিদের সঙ্গে থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রয়ােজন ছিল। কারণ বাংলাদেশ ও বাঙালিদের জন্য আমার আলাদা একটা অনুভূতি ছিল।’ সৈয়দ ইলিয়াছ ধামী বাংলাদেশে ফিরে আসেন ২০০৪ সালে বিয়ে করেন এক বাংলাদেশী, মাইজদী জেলার বাসিন্দা সাংবাদিক কামাল উদ্দিনের মেয়েকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী, একে ফায়েজ, ড. শমশের আলীসহ অনেকেই তার সহপার্টি বন্ধু। ২০০৭ সালের ২০ মার্চ বিকেলে ঢাকার ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কে অবস্থিত বেসরকারি স্টেটস ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের কার্যালয়ে বসে আমি তার সাক্ষাৎকার নিই। ওই সময় তিনি স্টেটস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই লেখা প্রেসে দেওয়ার সময় জানা যায়, তিনি আমেরিকা চলে গেছেন সপরিবারে। সাক্ষাৎকারে তার দেওয়া বক্তব্যে উঠে এসেছে তৎকালীন পাকিস্তানিদের আচার-আচরণ, অহংবোেধ আর বাঙালিদের দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার যােগাযােগের নেপথ্য কথা। বিস্তারিত জানা যাক তাঁর বক্তব্যে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মনের মিল হতাে না। ‘১৯৬২, ৬৩, ৬৪ সালে আমি থাকতাম ঢাকা হলের তৃতীয় তলায় ৩০৯ নং কক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিলাম বায়োেকমিস্ট্রির। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (এনএসএফ) ছিল একটি শক্তিশালী সংগঠন। যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর মােনায়েম খানের এক ছেলে। ডাক নাম সম্ভবত খােকা। পুরাে নাম মনে নেই। তিনি খুব টাকা পয়সা খরচ করতেন সে সময়। এনএসএফের পাঁচ সদস্য ছিল খােকার সঙ্গী। খােকা থাকতেন আমার পাশের কক্ষে। সেখানে যাতায়াতকারী এনএসএফের সদস্য জাহাঙ্গীর ও তােফায়েল আহমদের (আওয়ামী লীগের তােফায়েল নন) কথা এখনাে মনে আছে। ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি কিছু ছাত্রও। তখন থেকেই কেন জানি না পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমার কখনাে মনের মিল হতাে। আমি সব সময় পছন্দ করতাম বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে।

প্রায় ৪০ বছর আগের দিনের অনেক স্মৃতি এতদিনে মন থেকে মুছে গেলেও বাঙালিদের ভালােবাসা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কিছু স্মৃতি আজো ভুলতে পারিনি। ঢাকায় পড়ালেখার জন্য এসে আমার উপলব্ধি হয় যে, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করছে। তাদের ব্যবহার, মনমানসিকতা ছিল খুবই বাজে ধরনের। নিজেদের যেন সবকিছুতেই বড় মনে করতাে। সবকিছুতে অগ্রাধিকার পেতাে উর্দুওয়ালারা। আর্মির ভেতর বাঙালি খুব একটা ছিল না। প্রায়ই দেখতাম পাঞ্জাবি পাঠান। সিপাই থেকে অফিসার প্রায় সেখানকার । ভাবতাম, বাঙালিদের মধ্য থেকে লােকজন নেওয়া হতাে না কেন?’

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইলিয়াছ ধামী আরাে দেখলেন, পাকিস্তানি ছাত্র যারা এখানে ছিল তাদের জন্য রান্না বা খাওয়া-দাওয়ায় বিশেষ ব্যবস্থা হতাে। তবে তিনি। (ইলিয়াছ ধামী) বাঙালিদের সঙ্গে মিলে মিশে মাছভাত পরটা ইত্যাদি খেতে পছন্দ করতেন। ঢাকার খাজা বিরিয়ানি, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের পপুলার রেস্টুরেন্ট, গুলিস্তান রেস্টুরেন্ট, রেকস রেস্টুরেন্ট, রমনা রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিতে গিয়ে বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, মজা করতেন। এক পর্যায়ে এখানকার সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে মিশে যান তিনি। বাঙালি সৌখিন ছাত্র গায়কদের সঙ্গে সুর মিলয়ে গাইতেন ‘ও মাঝিরে…।’ বাঙালি সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক অনুষ্ঠানে পশ্চিমা এক জেলা প্রশাসকের বাধা দেওয়ার একটি ঘটনার কথা জানালেন ইলিয়াছ ধামী এভাবে “১৯৬৪ সালে একবার ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যােগ দেওয়ার জন্য। সেখানকার জেলাপ্রশাসক ছিলেন অবাঙালি। তিনি অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন, ‘এখানে এ ধরনের অনুষ্ঠান হবে না।’ আমি জোর গলায় বলে উঠলাম, ‘অনুষ্ঠান হবে।’ জেলাপ্রশাসক অনেকটা আশ্চর্য হয়েই জানতে চান, ‘কে-কে বললাে অনুষ্ঠান হবে। আমাদের সঙ্গী বন্ধুরা বললেন, এখানে একজন আফগানী আছেন, তিনি বলছেন।’ পাকিস্তানিরা আফগানদের ভয় করতাে। জেলাপ্রশাসক আমার কথা শুনে চুপ মেরে চলে যান। সেদিন আমরা অনুষ্ঠান করেই। ছাড়লাম।” জিওসির মেয়ের সঙ্গে সেনানিবাসে সুন্দর সুঠামদেহী আফগান যুবক ইলিয়াছ ধামীকে বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানি অনেকে। সেই সুযােগটা কাজে লাগান তিনি বাঙালির জননেতাকে সাহায্য করার কৌশল হিসেবে। এ প্রসঙ্গে জানা যাক তার জবানবন্দি; “সম্ভবত ৬৬-৬৭ সালে ঢাকার জিওসি ছিলেন ফজলে মতিন। তার এক মেয়ে ‘তাহসিন পড়তাে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মেডিকেলে আসতাে ফ্লাগ গার্ডসহ বড় জিপ গাড়ি নিয়ে। যে কোনােভাবেই হােক তার সঙ্গে আমার আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে আমাকে প্রায় সময় নিয়ে যেতাে তার বাসায়ও। এক সঙ্গে হতাে খাওয়া দাওয়া । তবে তার সঙ্গে প্রকৃত ভালােবাসার সম্পর্ক ছিল ইপিআরের পাকিস্তানি এক পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে।

কিন্তু সে বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ঘােরাফেরার সময় আমাকে সঙ্গে রাখতাে, নিয়ে যেতাে। অন্যকে পরিচয় করিয়ে দিতাে ফ্রেন্ড হিসেবে। সেই সুবাদে অনেক সময় সেনানিবাস এলাকায় ঘুরতে যেতাম তার সঙ্গে, জিওসির গাড়িতে করে। এসব দেখে সেখানে অনেকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকাতাে আমার দিকে। সম্ভবত ৬৭ সালের শেষ দিকে কিংবা ৬৮ সালের প্রথম দিকে এক সময় শুনলাম ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে একটি মামলা হয়েছে। বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। শেখ সাহেবের গ্রেপ্তারের খবরে আমি কিছুটা বিচলিত হই। মনে হলাে পাকিস্তানিরা এটি নাটক সাজাচ্ছে বাঙালিদের ফাঁসানাের জন্য। আমার তখন চিন্তা ঢুকলে কি করা যায়। কারণ তার আগেই শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপে, তার ব্যবহারে তাঁর প্রতি আমার এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। পরে তাঁর সঙ্গে জেলখানায় বেগম মুজিবের চিঠি চালাচালির মাধ্যমে একটা যােগাযােগ স্থাপন করে দিই। ওই ঘটনা আমার কাছে খুবই অনন্দের ঘটনা, সৌভাগ্যের ঘটনা বলে মনে হয়। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় আটক নেতাআসামিদের সঙ্গে তাদের নিকট আত্মীয়রা পর্যন্ত দেখা করার অনুমতি পাওয়া অসাধ্য ছিল?” ইলিয়াছ ধামী বলেন, “এ ঘটনার বেশ আগেই ছাত্র লীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক সম্পর্ক না হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানে এবং কখনাে কখনাে মজা করার জন্য আমি তাদের সঙ্গে যােগ দিতাম মিছিল সমাবেশে। এরকম সম্পর্কের সূত্র ধরে ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমদ (পরবর্তী আওয়ামী লীগ নেতা) এবং অন্য দু’একজন ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে শেখ সাহেবের ধানমন্ডীর বাসভবনে যাওয়ার সুযােগ হয় আমার। তার মতাে নেতার সঙ্গে কথা বলার সুযােগ পেয়ে আমার খুব ভালাে লাগে। তিনিও দেখি আমাকে স্নেহ করতেন, পছন্দ করতেন। অন্যদের সঙ্গে একাধিকবার যাওয়ার পর এক সময় তিনি আমাকে তার সঙ্গে একা দেখা করার কথা বলেন। আমার কৌতুহল জাগে, ভালােও লাগে।

এরপর ওপরে দোতলায় গিয়ে তার সঙ্গে কয়েকবার একাকী দেখা করি। ওনার ছেলেরা মিউজিক করতেন। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ধমক দিয়ে ছেলেদের মিউজিক করা থামিয়ে দিতেন। শেখ সাহেবের সাথে কথা বলে মনে হয়েছিল তিনি পাকিস্তানিদের ওপর ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিলেন। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আমি বাংলাদেশে ছিলাম। দেখি যুদ্ধ তাে পশ্চিম ফ্রন্টেই হয়েছিল। মনে হয়েছে আইউব খান ভুল করেছেন। যুদ্ধ শুরুর আগে অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার কথাটি একবার ভাবা উচিৎ ছিল তাঁর। এখানে মাত্র ছয়টি যুদ্ধ বিমান ও এক ডিভিশন সৈন্য ছিল। সে সময় ভারত যদি সিদ্ধান্ত নিত যে, সে এখানে ঢুকে যাবে তাহলে অনায়াসেই তা পারতাে। এত দুর্বল ছিল সবকিছু।” বুঝে যাই ছয় দফার মানে কী ছয় দফার প্রসঙ্গ টেনে ইলিয়াছ ধামী বললেন, “৬৫ সালের যুদ্ধের পরই ছয়দফা সামনে আসে। শেখ সাহেব বলছিলেন, “তুমি (পাকিস্তান সরকার/আইউব খান) আমাদের অরক্ষিত রেখে ওখানে (পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে) যুদ্ধ শুরু করেছে। লাহাের ফ্রন্টে পাকিস্তানিদের যে আক্রমণ সেটা ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদের কৃতিত্ব। তাঁরাই লাহাের রক্ষা করেছে। বাঙালিরা না হলে লাহােরও দ্রুত চলে যেত, যেভাবে সেখানে ভারতীয়রা বিমান হামলা শুরু করে। ওই সময় আমার মনে হয়েছে আইউব খান একজন বাজে ফিল্ড মার্শাল। এরপর শেখ সাহেব ছয় দফা ঘােষণা করলে আমি বুঝে যাই এর মানে কী! যদিও তিনি সেপারেশনের কথা নয়, কনফেডারেশনের কথা ভাবছিলেন। ওনার সঙ্গে (শেখ মুজিবের সঙ্গে) কথা বলে মনে হয়েছিল উনি ভেতরে ভেতরে চেয়েছিলেন তােমরা ওখানে থাক, আমরা এখানে থাকি। এটা ভালাে লেগেছিল আমারও। আগরতলা মামলার আগে একবার আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি আসলে কি চান? তিনি আমার কাছে। পাল্টা প্রশ্ন করেন, “তােমার কি মনে হয় আমরা একসাথে থাকতে পারব? আমি তখন বলেছিলাম, আমি ছাত্র মানুষ, আপনি নেতা, আপনিই ভালাে বুঝবেন।” মুজিব-বেগম মুজিবের চিঠি চালাচালি যেভাবে এদিকে আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলে তার সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইলিয়াছ ধামীর।

তবে যােগাযােগ বজায় ছিল বেগম মুজিবের সঙ্গে। সে সময় রাষ্ট্রদ্রোহের মতাে অভিযােগের শিকার হওয়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তিনি রাখলেন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ব্যাপারে ইলিয়াছ ধামী বলেন, “একদিন বিষন্ন মনে বেগম মুজিব বললেন, ‘কী করবাে বুঝতে পারছি না। তার সঙ্গে (শেখ মুজিবের সঙ্গে) যােগাযােগ করতে পারছি না, খবর ও পাচ্ছি না।’ আমি বললাম, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি এখানে এলে কিংবা জেলখানায় গেলে কেউ কিছু বলবে না।’ শেখ সাহেবের বাসা এবং আশেপাশে বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থার লােকজনের নজরদারি ছিল। কিন্তু আমি ভয় পেতাম না। এরপর বেগম মুজিব আমাকে বিশ্বাস করে শেখ সাহেবকে দেওয়ার জন্য চিঠি দিতেন। আমি সেগুলাে নিয়ে সেনানিবাসে তাকে দিয়ে আসতাম। এদিক সেদিক ঘােরাফেরার ছলে সুযােগ পেলেই ঢুকে পড়তাম ওনার কক্ষে। বালিশের কভারের ভেতর কৌশলে গুঁজে দিতাম চিঠিগুলাে। আবার সেখানে রাখা শেখ সাহেবের পাল্টা চিঠি নিয়ে পৌছে দিতাম বেগম মুজিবকে। সেনানিবাস এলাকায় দায়িত্বশীলদের প্রায় সবাই আমাকে ভালাে জানতেন, বিশ্বাস করতেন। জিওসির মেয়ের বন্ধু হওয়ায় তেমন সন্দেহ করতেন না কেউ। কিছু বলতেন। অনেকে এটাও জানতেন যে, আমি এক আফগান। জিওসির মেয়ের সঙ্গে কয়েকবার যাওয়া আসার এক পর্যায়ে কারাগারের ইনচার্জ এক মেজরের সঙ্গে আমি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলি। তার জন্য মাঝে মাঝে মিষ্টি, মােগলাই পরটা, কাবাব ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। তিনি খুব পছন্দ করতেন এসব। দুজন বসে এক সঙ্গে খেতাম। ওদিকে শেখ সাহেব তার কক্ষের ভেতর থেকে আমাকে দেখলেই গার্ডকে অনুরােধ করতেন তাকে বারান্দায় হাঁটতে দেওয়ার জন্য। আর উনি বারান্দায় হাঁটাহাটি করার সময় আমি ঘােরাঘুরির ছলে কক্ষে ঢুকে বেগম মুজিবের চিঠি দিয়ে শেখ সাহেবের রাখা চিঠি নিয়ে চলে যেতাম। এ রকম চার পাঁচ বার যাওয়া আসার পর একদিন মনে হলাে এক অফিসার আমাকে সন্দেহ করছেন। তিনি আমার কাছে পরিচয় জানতে চাইলেন।

আমি একজন আফগান ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়ে সেখানকার দায়িত্বে নিয়ােজিত মেজরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা জানাই। পরে তিনি আমাদের মধ্যে মেলামেশা দেখে আর কিছু বলেননি। প্রসঙ্গত ওই মেজরের পরিবার সেখানে ছিল না। মেসে তিনি থাকতেন একা। আমার জন্য সুবিধা ছিল যে, শেখ সাহেবের কক্ষের কাছেই ছিল মেজরের কক্ষটি। জেলখানা এলাকায় যাওয়া আসার সময় সার্জেন্ট জহুরুল হক, ডা. ছৈয়দুর রহমানসহ আরাে কয়েকজনকে দুএকবার দেখেছি। জেনেছি তারাও আগরতলা মামলার আসামি। অবশ্য তাদের কারাে সঙ্গে সে সময় আমার কথা হয়নি। গার্ডের কাছে জেনেছি ওদের নাম। আমাদের কাজের কথা আসলে অন্য কেউ জানতেন না। শেখ সাহেব, বেগম মুজিব এবং আমি বুদ্ধি করে কৌশলে নিরবে ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করেছিলাম। অবশ্য আমি বাংলা পড়তে পারতাম না। ওইসব চিঠিতে কী লেখা থাকতাে তাও সঠিক জানতাম না। এসব নিয়ে কিংবা মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে শেখ সাহেবের কাছেও কিছু জানতে চাইনি কখননা। তবে বেগম মুজিবের কথাবার্তায় আঁচ করতে পারতাম চিঠিগুলােতে তাঁরা মামলার গতি-প্রকৃতি, বাইরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জেলের ভেতরকার অবস্থা এবং কার কী। করণীয় এ জাতীয় তথ্য পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া করতেন। আসলে সে সময় শেখ সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও দেশপ্রেম আমাকে এমনভাবে আকর্ষণ করেছিল যে, তাঁর জন্য কিছু করতে পারা আমার কাছে আনন্দ ও গৌরবের মনে হয়েছিল। দেশের তখনকার পরিস্থিতি দেখে আমার বিশ্বাস জম্মেছিল যে, বাংলাদেশ একদিন সত্যিই স্বাধীন হয়ে যাবে। কারণ এভাবে পরস্পর অবিশ্বাস-শশাষণের মধ্যে তাে দুই পাকিস্তান এক থাকা যায় না।” ইলিয়াছ ধামী ৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায় জানতে পারেন তার সে বিশ্বাস সত্যে পরিণত হয়েছে। বাঙালিরা ‘পূর্ব পাকিস্তানের নাম মুছে দিয়ে এদেশের নামকরণ করেছে বাংলাদেশ’ এবং বিশ্বদরবারে আত্মপ্রকাশ করেছে স্বাধীন জাতি হিসেবে।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!