ভাসানী বললেন, তােরা শেখ মুজিবকে ধরে নেয – আলী নওয়াজ
মামলার অভিযােগপত্রে নাম আছে, অন্যদের মত গােপন কর্মকান্ডে সক্রিয় ভূমিকাও ছিল অথচ কৌশলে গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন এমন একজন আলী নওয়াজ। তিনি মামলার ৩৩ নং আসামি আলী রেজার ছােট ভাই। ১৯৬১ সাল থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ এবং স্বাধীনতার জন্য কিছু একটা করার ব্যাপারে কানাঘুষার কথা জানতে পারেন তিনি। এক পর্যায়ে নিজেও যুক্ত হন এ প্রক্রিয়ায় । তবে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখেন ৬৬ সালের শুরুর দিক থেকে। এছাড়া তাঁর বড় ভাই আলী রেজাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে অনেক কিছু জানার কথা তার। তাই তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রাসঙ্গিক মনে করি। ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর বিকেলে তার ঢাকার উত্তরায় ১১ নং সেক্টরের ১১ নং সড়কের ৪৪ নং বাসায় (সবুজছায়া) তিনি এ সাক্ষাৎকার দেন। আলী নওয়াজের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৬ অক্টোবর। বাবা জহুর আলী ছিলেন ডিএসপি (জেলা পুলিশ সুপার)। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলা সদরের লাহিনী গ্রামে। বাড়িতেই প্রাথমিক শিক্ষা নেন। ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি পাস করেন। অবশ্য পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই তিনি বিমান বাহিনীতে যােগ দিয়ে পাকিস্তানের করাচি চলে যান এবং ৬১ সালের শুরুর দিকে ক্যাডেট হিসেবে কমিশন পান। এর আগে ১৯৬০ সালের শেষের দিকে করাচির রিসালপুরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণে থাকার সময় প্রশিক্ষক সার্জেন্ট জহুরুল হকের সঙ্গে আলী নওয়াজের পরিচয়। প্রথম ধারণা দেন সার্জেন্ট জহুর পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে বাঙালিদের প্রতি বঞ্চনা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গােপন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলী নওয়াজ বলেন, ‘করাচিতে বিমান বাহিনীতে থাকার সময় বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমাদের নানা রকম বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে আমি মনে মনে ক্ষুব্ধ হই । অন্য বাঙালি সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনায় সময়ও সংশ্লিষ্টদের ক্ষুব্ধ মনােভাবের বিষয়টি জানতে পারি ।
বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষণে থাকার সময় লক্ষ্য করি সার্জেন্ট জহুরুল হক বাঙালি প্রশিক্ষণার্থীদের দিনের প্রশিক্ষণ শেষেও একটা বিশেষ সময় দিতেন এবং নিজেদেরকে বিশেষভাবে যােগ্য হিসেবে গড়ে তােলার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন। সার্জেন্ট জহুর আমাকে পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং ওদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন। সাংগঠনিক তৎপরতা আলী নওয়াজ জানান, দেশে থাকতেই তিনি খেলাধূলার প্রতি আসক্ত ছিলেন। করাচি গিয়েও কমিশন পাওয়ার পর থেকে কাজের ফাঁকে সঙ্গীদের নিয়ে খেলাধূলা ও আলাপআলােচনার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তােলেন। এসময় চাকরিস্থলে নানা সমস্যা ও পরিণতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে পরস্পর মতবিনিময় করতেন। সংশ্লিষ্টদের মনােভাব বুঝে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার প্রসঙ্গটিও আসতাে আলােচনায়। এভাবে উদ্বুদ্ধ। করার মাধ্যমে কয়েকজন সহকর্মীকে নিজেদের দলভুক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে বিষয়টি শুনে অনেকে ভয় পেতেন। তবে এক পর্যায়ে সবকিছু গােপন থাকবে বলে আস্থা এলে স্বতস্ফূর্তভাবে দলে যােগ দিতেন। যেমন জাকারিয়া নামে একজন কারিগরি কর্মকর্তা (টেকনিক্যাল অফিসার) ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। তার বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। আমি আমাদের গােপন কর্মকান্ডের কথা জানিয়ে তাঁকে আমাদের দলভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানালে ‘বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে প্রথমদিকে তিনি তা এড়িয়ে যান। অবশ্য কিছুদিন পরেই তিনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। বিমান বাহিনীর ইন্সট্রাকটর (প্রশিক্ষক) সার্জেন্ট ফজলুল হক এবং স্পাের্টস অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রুস্তমও আমার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত। এভাবে পর্যায়ক্রমে একজনের মাধ্যমে আর একজন করে অনেকেই জড়িত হন বিপ্লবী সংগঠনে।
শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রথম দেখা করাচি আলী নওয়াজ জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে তিনি বিমান বাহিনীর চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। এ সময় বরিশাল আইডব্লিউটিতে (অভ্যন্তরীণ জল-পরিবহন সংস্থা) টেপুটেশনে দায়িত্ব পালন করছিলেন লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য আলী নওয়াজের প্রতি অনুরােধ জানান। নওয়াজের পারিবারিক কারণে চাকরির প্রয়ােজন থাকায় মােয়াজ্জেম তাকে ইস্টার্ণ ফেডারেল ইস্যুরেন্স নামে একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কিছুদিন পর তিনি যােগ দেন গ্রেট ইস্টার্ণ ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে। গ্রেট ইস্টার্ণ ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে কাজ করার সুবাদে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত এবং পদস্থ লােকদের সঙ্গে মেলামেশা ও সম্পর্ক গড়ে তােলার সুযােগ হয় আলী নেওয়াজের। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও তাজ উদ্দীন আহমদের সঙ্গে তার সরাসরি যােগাযােগ ঘটে। এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লােকজনের মনােভাব জানা ও প্রয়ােজনীয় তথ্য সগ্রহ করে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম
ও বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন তিনি। ইতিপূর্বে শেখ মুজিবের কথা নানাভাবে শুনলেও এবং করাচির একটি বৈঠকে তাকে দেখলেও ঢাকায়ই তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা হয় আলী নওয়াজের। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “করাচিতে থাকার সময় আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে কিছু একটা করার জন্য দলে লােক ভেড়ানাে ছাড়া বিশেষ কোনাে দায়িত্ব আমার ওপর ছিল না। তবে সশস্ত্র প্রস্তুতির বিষয়টি স্পষ্ট হয় তখন থেকে। ঢাকায় এসে একাধিক জায়গায় বৈঠকের সমম্বয়কের দায়িত্ব পালন করতে হয় আমাকে। সেই সুবাদে আমার গাড়িতে করে শেখ সাহেবকে নিয়ে কয়েক জায়গায় গিয়েছি। সঠিক তারিখ মনে নেই। কারণ তিনি (শেখ মুজিব) মাঝে মাঝে ধরা পড়তেন আবার ছাড়াও পেতেন। এরকম ৬৬ সালের শেষ অথবা ৬৭ সালের প্রথম দিকে হবে। শেখ সাহেব এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযােগী তাজউদ্দিন আহমদকে নিয়ে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। ওই সময় তাঁরা দুজন পাকিস্তান- বাংলাদেশের নানা সমস্যা প্রসঙ্গে আলােচনার এক পর্যায়ে আমিও যােগ দিই তাতে। তিনি (বঙ্গবন্ধু) হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আপনারা তাহলে বাংলাদেশ করেই ছাড়বেন’। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করি- স্যার, আপনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিন্নি বাহিনীর মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে তাতে সমতা আনতে পারবেন?’ তাঁর উত্তর ছিল- “এটাতাে সম্ভব হবে না।’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘এটা না হলে আমাদের বাংলাদেশ হওয়া দরকার।” আলী নওয়াজ এর আগে করাচিতে একটি বৈঠকে শেখ মুজিবের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘৬৬ সালের কথা। করাচিতে পাকিস্তান বিমানের (পিআইএ) ক্যাপ্টেন নাজিমের বাসায় একটি বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। নাজিম সাহেবের বাড়ি ছিল সিলেট।
আমাদেরকে জানানাে হয়েছিল, বৈঠকে একজন দ্রলােক অতিথি হিসেবে আসবেন এবং তিনি কিছু কথা বলবেন। বৈঠক শুরুর সময় দেখি সেখানে যে দ্রলােক অতিথি হিসেবে এসেছেন তিনি শেখ সাহেব। সেই বৈঠকেই তাকে আমি প্রথম সরাসরি দেখি। বৈঠকে মূলত বিমানের লােকজনই ছিলেন। তখন পাকিস্তানে বােয়িং বিমান ছিল চারটি। ঘটনাক্রমে এর মধ্যে তিনটির ক্যাপ্টেন ছিলেন বাঙালি। বৈঠকে আমাদের মধ্যে বােঝাপড়া হয় যে, পরিকল্পনা সফল হলে তাঁরা বিমান নিয়ে কৌশলে বাংলাদেশে চলে আসবেন।’ ঢাকার কয়েকটি বৈঠকস্থল আলী নওয়াজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৬৬-৬৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বেশ। কয়েকটি বৈঠক হয় ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর তত্ত্বাবধানে। এরমধ্যে গ্রিন স্কোয়ারের একটি জায়গায় বৈঠকে আলী রেজা, লে, কমান্ডার মােয়াজ্জেম, আহমদ ফজলুর রহমান, খান শামসুর রহমান, রিসালদার শামসুল হক প্রমুখ ছিলেন। ওই বৈঠকে আলী নওয়াজ রিসালদার শামসুল হককে প্রথম চেনেন মােয়াজ্জেম সাহেবের মাধ্যমে। ১৯৬৫ সালে। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় শামসুল হক একাই ১৬টি ভারতীয় ট্যাংক ধ্বংস করেন পশ্চিমা সীমান্তে।
মহাখালীর একটি জায়গায় অপর এক বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আলী নওয়াজসহ সার্জেন্ট ফজলুল হক, রুস্তম এবং আমির হােসেন। কিন্তু সেই বৈঠকের ব্যাপারে কেউ গােয়েন্দাগিরি করছে বলে সন্দেহ হলে নওয়াজের পরামর্শে বৈঠকের স্থান পরিবর্তন করে গুলশান এলাকার একটি নৌকার ভেতর বৈঠকটি করা হয়। মূলত বিমান বাহিনীর সদস্যদের পক্ষ থেকে এই বৈঠক ডাকা হয়। রেসকোর্স ময়দানেও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আজ্ঞাচ্ছলে বাদাম খেতে খেতে এতে সংশ্লিষ্টরা কথা বলেন পরস্পর বিপরীতমুখী হয়ে বসে। এতে নওয়াজ ছাড়াও এবি খুরশিদ, সুলতান উদ্দিন, স্টুয়ার্ড মুজিব এবং অন্য দুজন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকগুলােতে মূলত কোন গ্রুপের কাজ কোথায় কতদূর এগিয়েছে, নতুন করে কারা যুক্ত হয়েছে, গােয়েন্দা বিভাগকে এড়িয়ে আরাে দ্রুততার সঙ্গে কীভাবে সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে নেওয়া যায় এসব বিষয়ে আলােচনা হতাে। আলী নওয়াজের দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ১০-১২টি বাড়ি ঠিক করা হয়েছিল সভা করার জন্য। এর মধ্য গ্রিন স্কোয়ার, ধানমন্ডি ১৯ নং এবং দিলু সড়কের কয়েকটি বাড়ি ব্যবহার করা হতাে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। সে সব বাড়ির এখন চিহ্ন নেই। হাত বদল হয়ে ভেঙে নতুন বাড়িঘর কিংবা অন্য স্থাপনা তৈরি হয়েছে সেখানে। এর আগে (আন্দোলন সংগঠনের সময়) ওই সব বাড়িতে আগরতলা মামলার আসামিদের মধ্য থেকে সুলতান উদ্দিন, নূর মােহাম্মদ, সার্জেন্ট শামসুল হকসহ আরও অনেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অবশ্য এসব প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়েছে সিভিল ডিফেন্সের ছত্রছায়ায়। সিভিল ডিফেন্সের তঙ্কালীন পরিচালক কর্ণেল হাসেম এসব কাজে যথেষ্ট সহযােগিতা দিয়েছেন, সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
এসব কার্যক্রম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগে আলােচনা হতাে। কাজ শেষেও তাকে অগ্রগতির বিষয়ে জানানাে হতাে। তােরা শেখ মুজিবকে ধরে নেয় : ভাসানী বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক কখন থেকে জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে আলী নওয়াজ বলেন, “আমার মনে হয় একেবারে প্রথম দিক থেকেই তিনি জড়িত ছিলেন। কারণ তাঁর মতাে নেতার সহায়তা ছাড়া এ ধরণের কাজের সাহস করা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে আমরা যারা এই কাজে জড়িত হয়েছিলাম আমরা ষড়যন্ত্র বা অন্য যা কিছু করি না কেন আমরা জানতাম, উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতার সমর্থন ছাড়া কেউ আমাদের স্বীকৃতি বা সমর্থন দেবে না। আমি জেনেছি যে, আমাদের লােকদের মধ্যে আলােচনায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম দিকে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়। তিনি বলেছিলেন, “একটা লােকই এটা করতে পারবে এবং সে হলাে শেখ মুজিব। তােরা তাকে ধরে নেয়। কারণ তাঁর সব জায়গায় গ্রহণযােগ্যতা আছে, নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা আছে।’ শেখ সাহেবের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে তিনি সাহস দিয়ে বলেছিলেন, “তােমাদের মতাে আমিও চাই দেশটা স্বাধীন হােক। তােমরা কাজ করাে। আমি সব রকম সহায়তা দেব।” তিনি তা করেছেনও। আমার জানামতে, তিনি পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামের ডা. ছৈয়দুর রহমান, মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেনকে যুক্ত করেছিলেন লিয়াজো রক্ষার জন্য। বিধান সেন একাধিকবার আমার বাসায়ও এসেছিলেন। আর এ বিষয়ে ভাল করেই জানতেন তাজ উদ্দিন আহমদও।” যে কারণে গ্রেপ্তার হননি।
১৯৬৮ সালে বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িতরা যখন একে একে গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন, পত্রপত্রিকায়ও কিছু খবর বের হচ্ছিল তখনই আলী নওয়াজ সতর্ক হয়ে যান। বিমান বাহিনীর পরিচিত কয়েকজন বন্ধুও তাকে সতর্ক করে দেন। আলী নওয়াজ বলেন, “একদিন এক বন্ধু এসে। খবর দেন, “তােমার বাসা চিহ্নিত হয়েছে তুমি তাড়াতাড়ি সরে পড়।’ প্রতিবেশী এক সামরিক কর্মকর্তা কর্ণেল ডা. চোধুরীর পরামর্শে আমি আমার আর এক বন্ধুকে লং ড্রাইভের কথা বলে তার গাড়িটা বদল করে বারান্দায় এনে রাখি। সন্ধ্যায় দেখি দুজন পাকিস্তানি সৈন্য এসে টর্চলাইট দিয়ে গাড়ির নম্বর দেখছেন। কর্ণেল চোধুরী এগিয়ে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কি যেন কথা বলার পর ওরা ফিরে যান। এর আধঘন্টার মধ্যেই আমি কুষ্টিয়া রওনা দিই। কয়েকদিন পর এসে দেখি কর্ণেল চোধুরীও সেই বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর থেকে আমি সতর্কভাবে চলাফেরা করি। পরে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি, যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযােগপত্র দেওয়া হয়েছে তাতে আমার নাম নেই। আসামিরা সবাই সেনানিবাসে আছেন। এরপর মামলার শুনানি শুরু হলে আমি আদালতে যাওয়া শুরু করি।
সেনাবাহিনীতে পরিচিত বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে জেলখানায় আসামিদের কিছু খবরাখবর এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাদের কিছু কথাবার্তা থাকলে তা আইনজীবিদের কাছে জানাতাম। প্রায় সন্ধ্যায় খান আতাউর রহমানের বাসায় আইনজীবিরা বসে শলাপরামর্শ করতেন। সেখানেও যেতাম মাঝে মধ্যে। আদালতে অভিযােগপত্র শুনানির শুরুর দিন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। প্রথমেই ধরা হয় শেখ মুজিবের নাম। অভিযােগের বিবরণ পড়া শুরু হলে শুনি ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় আমার নাম। অভিযােগপত্রের অনুচ্ছেদ ২৭ এ তিন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে লেখা হয়েছে তদন্ত চলাকালে এসব ব্যক্তির পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেখানে আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল আমার পদের নাম লেখা হয়েছে এলএসি (সেনাবাহিনীতে একটি পদের নাম)। কিন্তু আমি এলএসি ছিলাম না। আমার দুপাশে ছিলেন দুজন সেনা কর্মকর্তা। অ্যাডভােকেট সালাম সাহেব আলী নওয়াজ নাম শুনে চোখ বাঁকা করে আমার দিকে তাকান। কিন্তু কিছু বলেননি। আমিও চুপ থাকি। সেনা কর্মকর্তারা তখনও বুঝতে পারেননি যে আমিই সেই আলী নওয়াজ। এক পর্যায়ে তারা জানতে চান আমি কখনাে ফোর্সে চাকরি করেছি কী না। পাল্টা আমি ফোর্স কী জিনিস জানতে চেয়ে উত্তর দিই, ‘আমি ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করি।’ বিরতির সময় সালাম সাহেব আমাকে বকা দিয়ে বললেন, তুমি সব কিছু জেনেশুনে এখানে কোন সাহসে ঢুকলে?
এর আগে প্রথম দিন আদালতে গিয়ে বড় ভাই আলী রেজার সঙ্গে কথা বলার সময় আমাকে দেখে শেখ সাহেব জানতে চান আমি কেন সেখানে গিয়েছি। তাকে আমি আমার সঙ্গে কথা না বলা এবং আমাকে না চেনার ভান করার জন্য অনুরােধ করি। এভাবে নানা ফাঁকতালের মধ্য দিয়ে এক পর্যায়ে মামলাই শেষ হয়ে যায়। আলী নওয়াজ জানান, এ রকম আরও অনেকে অনেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। গােপনীয়তার কারণে কেউ কাউকে চিনতে পারেননি এবং ধরাও পড়েননি। মুক্তিযুদ্ধে আলী নওয়াজ আলী নওয়াজ জানান, তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতা গিয়ে সেখানে তাজউদ্দিন আহমদ ও জেনারেল ওসমানীর মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া তিনি শরণার্থী শিবিরগুলাের তত্ত্বাবধানের জন্য গঠিত সহায়ক কমিটিতে কাজ করেন। তিনি বলেন, “ওই কমিটিতে ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময় বহু শরণার্থী শিবিরে ঘুরতে হয়েছে। সেখানে ভালমন্দ নানা অভিজ্ঞতার মুখখামুখিও হয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত বাঙালি-ভারতীয় উভয় দেশের লােকদের কেউ কেউ শরণার্থীদের রেশন কার্ডের পণ্য আত্মসাৎ করে বিক্রির অভিযােগও শুনেছি। কিছু ঘটনা নিজে দেখেছিও।
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক