You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের অবহেলা, ঘৃণা আমাকে বিতৃষ্ণ করে– লে. জে. (অব.) মাে. মাহবুবুর রহমান

স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় জড়িত থেকেও মামলার আসামি হওয়া এবং নির্যাতন থেকে বেঁচে গেছেন এমন একজন সেনা কর্মকর্তা তল্কালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মাে. মাহবুবুর রহমান। পরবর্তী সময়ে | সৌভাগ্যক্রমে তিনিই হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের লে. জেনারেল এবং সেনাবাহিনী প্রধান। কর্ণেল (অব.) শামসুল আলম, ব্রিগেডিয়ার (অব.) খুরশিদ উদ্দিন, কর্নেল (অব.) শওকত আলীর কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তারা কুমিল্লা সেনানিবাসে তাদের গ্রুপের সঙ্গে মাে. মাহবুবুর রহমানের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বিস্তারিত জানার জন্য ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। বনানীর ওল্ড ডিওএইচএস এ তার বাসভবনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, বিপ্লবী দলে যােগ দেওয়ার পটভূমি এবং কীভাবে গ্রেপ্তার বা নির্যাতন থেকে বেঁচে গেলেন তার বিস্তারিত। সাবেক এই সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৪ ডিসেম্বর দিনাজপুরের বিরল থানার জগতপুর গ্রামে। তিনি ১৯৬৫ সালে দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক। এবং ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকাকালে তিনি সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরই নিয়ােগ পেয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের কাফরুল যান এবং ৬৪ সালের অক্টোবরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে নিয়ােগ পেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে যােগ দেন। সেনাবাহিনীতে আসার কারণ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সেনাবাহিনীতে যােগ দিলেন কেন জানতে চাইলে লে, জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমি কিশােরকাল থেকে রাজনীতি সচেতন ছিলাম। কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তির সংগ্রামী কাহিনী আমাকে রাজনীতি সচেতন হতে সাহায্য করে।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী আমার ভাল লাগতাে। তাঁর ছবি আমার সঙ্গে থাকতাে সবসময়। তিনি যে ইনডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ তৈরি করেন এবং বলতেন, ‘যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে, আমাকে অস্ত্র দাও, আমি তােমাদের স্বাধীনতা দেব’। এসব কথা পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হই। ষাটের দশকের শুরু থেকে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের অবহেলা, ঘৃণা, বঞ্চনা এসব কিছুই আমাকে পাকিস্তানের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তােলে। তাদের অগণতান্ত্রিক দুশাসন এবং শশাষণের ফলে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, আমার মনে হয়েছিল পাকিস্তানের পশ্চিমা কেন্দ্রে ক্ষমতাটা কেন্দ্রীভূত থাকার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর এর মূল শক্তি পাঞ্জাবি সেনাদের আধিপত্য। বাঙালিদের সংখ্যা সেখানে খুবই নগণ্য। কাজেই আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে হবে।” যেভাবে বিপ্লবী দলে এলেন দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গােপন বিপ্লবী সংগঠনে যুক্ত হওয়া এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থার পটভূমি তুলে ধরে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘৬৩ সালেই আমি মনে মনে ভাবি, আমাদের স্বাধীন হতে হলে সেনাবাহিনীতে গিয়ে বাঙালি সেনা সদস্য বাড়াতে হবে ধীরে ধীরে। উপযুক্ত পদে যেতে হবে। মূলত এ রকম চিন্তাভাবনা থেকে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকাকালেই আমি সেনাবাহিনীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানিদের অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ আরও কাছে থেকে দেখার সুযােগ হয়। কাফরুল থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা সেনানিবাসে এসেও বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের মধ্যে বৈষম্যের চিত্র দেখে পাঞ্জাবিদের প্রতি ক্ষোভটা আরও তীব্র হয়।

এ অবস্থায় কুমিল্লা সেনানিবাসের বাঙালি অফিসার অর্ডিন্যান্স এর ক্যাপ্টেন শওকত আলী এবং আরএমও ডা. ক্যাপ্টেন শামসুল আলমের সঙ্গে আমার যােগাযােগ ও পরিচয় হয়। তারা আমাকে নবীন অফিসার হিসেবে খুব স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। আমিও তাঁদেরকে বড় ভাইয়ের মতাে জানতাম। তারা বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে কথা বলতেন। মূলত তাদের কাছ থেকেই আমি এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হই। তখন আমারও মনে হয়েছে নেতাজী সুভাষ বসু ইংরেজদের কাছ থেকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আনতে না পারলেও আমরা সেনাবাহিনীর মধ্যে সংগঠিত হয়ে চেষ্টা করলে হয়তাে পারবাে। মত বিনিময়ের এক পর্যায়ে আমি বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হয়ে যাই। শওকত ভাইয়ের সঙ্গে কুমিল্লা শহরের বাইরে কয়েকটি বৈঠকেও আমি অংশ নিয়েছি। গােপনীয়তা রক্ষা হতাে বলে বৈঠকস্থল সম্পর্কে তখন তেমন কিছু জানতে চাইনি। অনেক কিছু এতদিনে মনেও নেই, সম্ভবত কান্দিরপাড় এলাকায় কারও বাসায় বৈঠকগুলাে হতাে।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আস্থা তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার কখনাে দেখা না হলেও নানাভাবে তার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কথা জেনে তার ওপর আমি আস্থাবান হয়ে উঠি। ক্যাপ্টেন শওকত ভাই বলেছিলেন এই আন্দোলনের পেছনে শেখ সাহেব আছেন। কুমিল্লায় সম্ভবত ৬৬ সালের দিকে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমের উপস্থিতিতে একটা বৈঠকেও। মােয়াজ্জেম সাহেব বলেছিলেন দেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার পেছনে শেখ মুজিব নেতৃত্বে আছেন। এ ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ভারতীয় সাহায্য-সহযােগিতাও পাওয়া যাবে। এখন বিভিন্ন সেনানিবাসে আমাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা দরকার। আমিও পুরােপুরি। আস্থাবান ছিলাম যে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব। তার মধ্যে যে সাহস, বাঙালি জাতিসত্তার প্রকাশ ও নেতৃত্বগুণ ছিল তাতে দূর থেকেই আমি তাঁর। অনুরাগী হয়ে পড়েছিলাম। তাঁর প্রতি অনুরাগী ছিলাম বলেই আমি দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রামী প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম। তিনি যে অবিসংবাদিত নেতা তা এখনও স্বীকার করি। কুমিল্লায় থাকাকালে আমি আমার মতাে করে বেশ কজন সেনা সদস্যকে। স্বাধীনতা সগ্রামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করি যাতে তারা প্রয়ােজনে ডাক এলে কাজে নেমে পড়তে। পারেন। বিপ্লব তথা লড়াই শুরু হলে তার দায়িত্ব কী হতাে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত সাবেক এই সেনা প্রধান বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য থাকতাে। কোথাও। মাইন লাগানাে, সেতু ধ্বংস করা বা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রুর যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। করার মতাে কাজগুলাে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লােকেরা করতাে। আমার পরিকল্পনা ছিল।

সেনাবাহিনীর অন্য যারা আমাদের সদস্য হবেন তাদেরকে বিস্ফোরকের ব্যবহার সম্পর্কে গােপনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব, যাতে তারা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে সেগুলাের সঠিক ব্যবহার করতে পারে। দিন তারিখ বা সময় ঠিক হলে বিস্ফোরক দিয়ে। আমার দায়িত্ব আমি যথাযথভাবে পালন করব এ ব্যাপারে আমার ওয়াদা ছিল।’ বেঁচে গেলেন যেভাবে এরকম একটা ঝুঁকিপূর্ণ বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকেও আগরতলা মামলা এবং নির্যাতন। থেকে রক্ষা পেলেন কিভাবে জানতে চাইলে জনাব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমার তখনও ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের বেসিক কোর্স সম্পন্ন হয়নি। ওই কোর্স হতাে করাচির রিসালপুরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সম্ভবত ৬৭ সালের প্রথম দিকেই ওই কোর্স শেষ করার জন্য আমাকে রিসালপুর পাঠানাে হয়। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়ােগ দেওয়া হয় পাঞ্জাবের ঝেলাম-সেনানিবাসে।

ওই সময়ে আমার বিয়ে ঠিক হলে ছুটি নিয়ে দেশে আসি। এসেই বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি যে, শওকত সাহেব গ্রেপ্তার হয়েছেন। কাজেই আমাকেও হয়তাে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এ অবস্থায় বিবাহিত জীবনে যাতে কোনাে প্রশ্ন না আসে সেজন্য আমি বিষয়টি হবু স্ত্রীকে জানাই। সে ছিল শিক্ষিত এবং আমার পূর্ব পরিচিত। আমার সব কথা শুনে সে বরং  আমাকে অনুপ্রাণিত করে বলে যে, যা হয় হােক। বিয়ে হতেও কোনাে সমস্যা নেই। এরপর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমি আবার ঝেলামে চলে যাই। পরে আমি শুনেছি যে, একজন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লােক, এ প্রক্রিয়ার (স্বাধীনতার) সঙ্গে যুক্ত এবং সে কোথায় আছে, নাম কী ইত্যাদি জানার জন্য শওকত ভাইদের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা শত অত্যাচার সত্ত্বেও আমার নাম বলেননি। ফলে শেষ পর্যন্ত সাক্ষী প্রমাণ না পাওয়ায় আমার নাম আসামি হিসেবে আসেনি। মামলা পুরােপুরি শেষ হয়ে গেলে আমি শঙ্কামুক্ত হই। পরবর্তীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রী-সন্তানসহ আমি পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পরে যাওয়ায় যুদ্ধে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে মনে কষ্টও ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরি এবং চাকরির ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার গৌরব অর্জন করি। আমি বিশেষ করে শওকত সাহেব ও শামসুল আলম সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদেরকে বড় ভাই হিসেবে সম্মান করি।

তারা সে সময় জিজ্ঞাসাবাদে আমার নাম বলে দিলে আমি আর এ পর্যায়ে আসতে পারতাম কি না সন্দেহ। সেনানিবাসেবিজয় কেতন মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি সেনাপ্রধান থাকার সময় ১৯৯৬ সালে ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা মামলা পরিচালনার জন্য গঠিত বিশেষ আদালত কক্ষটিকে যাদুঘর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর আগে তিনি ক্যাপ্টেন শওকত (পরবর্তীতে কর্নেল) এবং (কর্নেল অব.) শামসুল আলমকে সেনানিবাসে আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল (অব.) মাহবুব বলেন, ‘আমি তাদেরকে আগরতলা মামলার বিষয়বস্তু অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য গােপন আন্দোলন এবং এতে বঙ্গবন্ধুসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যক্রম ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তাদের সঙ্গে আলােচনার ভিত্তিতে সেনানিবাসে আদালত হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষটিকে যাদুঘর হিসেবে তৈরির উদ্যোগ নিই। বিজয় কেতন নামে ওই যাদুঘরে ৬৮-৬৯ সালে আদালত চলাকালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য আসামিদের যেভাবে আসন বিন্যাস এবং এজলাস ছিল সেভাবেই সাজানাে হয়েছে। সেখানে আদালত চলাকালে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসগুলােও রাখা হয়েছে।’ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমার মনের সান্তনা এই যে, স্বাধীনতার ২৫ বছর পর হলেও ঐতিহাসিক ঘটনাটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা ভূমিকা রাখতে পেরেছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই যাদুঘরের উদ্বোধন করেন।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!