You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৬ পুলিশ সুপার ও ১৩ জেলা প্রশাসকের সমর্থন ছিল- কমান্ডার (অব.) আব্দুর রউফ।

ছাত্রাবস্থা থেকেই স্বাধীনতাপ্রিয় ও প্রতিবাদী চরিত্রের অধিকারী অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর কমাণ্ডার আবদুর রউফের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১১ নভেম্বর কিশােরগঞ্জ জেলার ভৈরব পৌর এলাকায়। তার বাবা আলহাজ আবদুল লতিফ ছিলেন স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান। আবদুর রউফ ভৈরব কেবি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক, ৫৩ সালে ঢাকা। সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ৫৫ সালে ঢাকা সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং ৬১ সালে ঢাকা শিক্ষক প্রশিক্ষণালয় থেকে বিএড পাস করে উপাধ্যক্ষ পদে ঢাকার শাহীন স্কুলে যােগ দেন। মূলত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে মাথায় রেখেই ১৯৬২ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে তিনি যােগ দেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। নৌবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গােপন আন্দোলনে যুক্ত হন এবং ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি (ঈদের পরদিন) করাচির বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। তিনি ছিলেন আগরতলা মামলার ৩৫ নম্বর আসামি। দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাস কারাবাস ও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ভােগ করার পর উনসত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি অন্য বন্দিদের সঙ্গে মুক্তি পান। পরবর্তী সময়ে (স্বাধীনতার আগে) তিনি নরসিংদী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭২ সালের আগস্টে স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে যােগ দিয়ে নৌবাহিনী পুনর্গঠনে অবদান রাখেন এবং ৭৩ সালে কমাণ্ডার পদে উন্নীত হন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। ৭৬ সালে মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যােগ দিয়ে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। জনাব আবদুর রউফ ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক সংগঠন ‘গণফোরাম গঠনে ভূমিকা পালন করেন এবং দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। ঘাত-প্রতিঘাতময় নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কমাণ্ডার রউফের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি ২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি বিকেল পাঁচটায়, ঢাকার উত্তরায় তাঁর ১৩ নম্বর সেক্টরের বাড়ি ‘আনন্দ ভৈরব’এ বসে।

যে কারণে নৌবাহিনীতে যােগ দেন উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষকতার মতাে মহান পেশা ছেড়ে নৌবাহিনীতে যােগ দেওয়ার পটভূমি। ব্যাখ্যা করে কমাণ্ডার (অব.) আবদুর রউফ জানান, ছাত্রাবস্থায় তিনি তার এক চাচা জিন্নাত আলী (পরবর্তীতে যুগ্ম সচিব) সহ তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত প্রগতিশীল ছাত্রদের সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন কর্মীর সংস্পর্শে আসেন। অন্যদিকে তার (রউফের) বাবা ছিলেন মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। বাবা-চাচাসহ স্থানীয় কিছু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির মধ্যে অবিভক্ত ভারতে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব গ্রহণ না করা যে যুক্তিযুক্ত হয়নি, এ নিয়ে অনুষ্ঠিত যুক্তিতর্ক তিনি মনােযােগ দিয়ে উপভােগ করতেন। কিশাের বয়সে পাঠ্যবইয়ে শিবাজীর স্বাধীনতা যুদ্ধ, খণ্ড খণ্ড স্বাধীনতা যুদ্ধ ও অন্যান্য ছােটখাটো আন্দোলনের কথা পড়ে নিজের মধ্যেও দেশের জন্য কিছু একটা করার প্রত্যয় জাগে তার। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের ক্রীড়া সম্পাদক এবং বিএ পড়ার সময় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হন। ভৈরব অঞ্চলে আওয়ামী লীগের গােড়াপত্তনের পর আবদুর রউফের এক বন্ধু জহিরুল হক নবগঠিত আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল আওয়ামী লীগই বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে। তার সঙ্গে সে সময় একমত পােষণ করেন কিশাের আবদুর রউফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের প্রতি আবদুর রউফের আকর্ষণ সৃষ্টি হয় ১৯৫০ সালে। বললেন, “১৯৫০ সাল। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। ভৈরবে আওয়ামী লীগের জনসভায় মাওলানা ভাসানীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা আসবেন। তাই আমরা সবাই দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে প্রস্তুতিমূলক কাজ করছি। আমাদের কাজের প্রধান কেন্দ্র ছিল কলেজ হােস্টেল।

পােস্টার লেখা, প্ল্যাকার্ড বানানােসহ প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের আলােচনার মুহূর্তে কক্ষে ঢুকলেন এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবক। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। প্রথম দর্শনেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অল্পক্ষণের মধ্যে এই আগন্তুকের সঙ্গে আমাদের সবারই আলাপ হয়ে গেল। সভার স্থান, স্টেজের অবস্থা, মাইক, পােস্টার ফেস্টুন, নেতাদের অভ্যর্থনাসহ কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং টাকা পয়সা কী রকম যােগাড় হয়েছে ইত্যাদি আলাপের মধ্য দিয়ে আমাদের একজনে পরিণত হন তিনি। তরুণ নেতা মুজিব ভাইকে কাছে পেয়ে আমাদের কাজের উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। এক পর্যায়ে তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রকর্মী হায়দারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, “তােরা কিছু খেয়ে নিস।’ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীত্ব লাভ, পরে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ ইত্যাদি ঘটনা আমি সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান এবডাের (Elective Bodies Disqualification Order EBDO) মাধ্যমে যখন প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতার মাথা নিচু করে ফেলেছিলেন, তখন অধিকারহারাদের পক্ষে আইউবের অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এবডাে বিরােধী মামলা করে তিনি জয়ী হন। তখন থেকে আমার মনে স্পষ্ট ধারণা জন্মে, এই আপসহীন নেতাই একদিন বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবেন। ৫৭-৬১ সালের দিকে রেজা আলী, কম্যুনিস্ট পার্টির মর্তুজা খান প্রমুখ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় আমি একাধিকবার বলেছি ‘দেখাে ইস্ট পাকিস্তান একদিন স্বাধীন হবে। আর এর নেতৃত্ব দেবেন শেখ মুজিব। কিশাের বয়সেই আমার মনে হয়েছিল বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সামরিক বাহিনীতে যােগ দেওয়াই হবে উৎকৃষ্ট কাজ। এ ভাবনা থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পরই আমি | সেনাবাহিনীতে যােগ দেওয়ার জন্য পরীক্ষা দিই।

কিন্তু অকৃতকার্য হই। পরে শিক্ষকতা পেশায় গিয়ে পরিতৃপ্ত হতে না পেরে আবারও নৌ-বাহিনীর এডুকেশন কোরে যােগ দিই।” প্রতিবাদী রউফ আবদুর রউফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী নৌবাহিনীতে যােগ দেওয়ার পরপর তাঁকে করাচিতে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে পাঠানাে হয় প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য। করাচির মনােরা দ্বীপে পিএনএস হিমালয়াতে শুরু হয় তার নাবিক জীবন। সেখানে কাজ করতে গিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি অন্যান্য বাঙালিদের মতােই শিকার হন নানা অপ্রীতিকর আচরণের। অভ্যাসমতাে ভাতের ব্যবস্থা না হওয়ায় প্রথম দিকেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে, শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ভাতের ব্যবস্থা করেন। হিমালয়ার পর বিএনএস কারসাযে প্রশিক্ষণ চলাকালে বাঙালিদের উদ্দেশে এক পশ্চিমা কর্মকর্তার বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অবসরপ্রাপ্ত কমাণ্ডার রউফ বলেন, “পিএনএস কারসায মূলত টেকনিক্যাল অফিসারদের ট্রেনিং স্টাবলিশমেন্ট। সেখানে ট্রেনিং কমাণ্ডারের নেতৃত্বে প্রতি বৃহস্পতিবার এক আলােচনা সভার আয়ােজন করা হতাে। এরকম একটি আলােচনার বিষয় বস্তু ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা।’ ওই দিনের মূখ্য আলােচক ছিলেন একজন বাঙালি লেফুটেন্যান্ট জোহা। ট্রেনিং ইউনিটের কমাণ্ডার, অন্যসব ইউনিটের বড় কর্তা ও নাবিকসহ প্রায় চার শ ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। লে. জোহার প্রাথমিক আলােচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে পশ্চিমা কর্মকর্তারা পূর্ব পাকিস্তানের ভেড়ামারা মালটিপারপাজ প্রজেক্টের ওপর কিছু প্রশ্ন করলে লে. জোহা তার সঠিক উত্তর দিতে পারছিলেন না।

এতে পশ্চিমাদের মধ্যে হাসাহাসি ও কানাঘুষা শুরু হয়। অন্যদিকে আমরা প্রশিক্ষণাধীন কর্মকর্তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল keep your Eyes, ears open and Bloody mouth shut’. জোহা সাহেবের অপারগতায় লজ্জা ও রাগে আমার মন খুব খারাপ হয়ে ওঠে। আমি তার হয়ে কিছু বলার অনুমতি চাইলে কমাণ্ডার আশরাফ অনুমতি দেন। ভেড়ামারা হাইড্রোইলেকট্রিক প্রকল্প এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার হারসহ টুকিটাকি আমার জানা ছিল এবং এ সম্পর্কে প্রশ্নের সহজেই উত্তর দিই। এমন সময় এক দাড়িঅলা লে. কমাণ্ডার প্রশ্ন করেন In East Pakistan which port is most interesting from a sailors point of vew, who is coming ashore after months of sea voyage?’ অর্থাৎ মাসের পর মাস সমুদ্র যাত্রা করে তটে আসার পর একজন নাবিকের দৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের কোন বন্দর সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তাঁর প্রশ্নে কিছু শ্লেষ ও অশালীন ইঙ্গিত আছে বলে আমার মনে হওয়ায় আমি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি ‘Gay girl? you mean woman? একটু সময় নিয়ে গম্ভীরভাবে বললাম, ‘East Pakistan is a place where you cannot parchase women like here’ আমার কথা শুনে উপস্থিত অনেকে ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে আমার দিকে চোখ বড় করে তাকায়। এ সময় আমি চাকরির কথা ভুলে গিয়ে নাবিকদের সামনেই বলে ফেলি পূর্ব-পাকিস্তান জাতিগতভাবে শােষিত হচ্ছে, আর শােষণ চালাচ্ছে পাঞ্জাবিরা। শুধু পূর্ব পাকিস্তানই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলকেও এরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে। অথচ এই পাঞ্জাবিরা বৃটিশ আমলে নিষ্ঠার সঙ্গে ইংরেজ শাসকগােষ্ঠীর গােলামি করেছে।

আমি একটু থামতেই একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি মনে করেন এ ধরনের ক্ষোভ আর হতাশার কারণে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে? আমি বললাম, না, সেটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ পূর্বপাকিস্তানের জনগণ বেশ ধর্মভীরু। তবে বর্তমানে আপনারা যেভাবে চালাচ্ছেন এরকম চলতে থাকলে পাকিস্তান শিগগিরই বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এটা নিশ্চিত।’ সেদিন আমার বক্তব্য শুনে বাঙালি শুভাকাক্ষী কয়েকজন অফিসার ও নাবিক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন আমার কোর্ট মার্শালে শাস্তি অথবা চাকরি চলে যাবার আশঙ্কায়। বাঙালি অফিসার লে. কর্নেল ফারুক আমাকে অভিনন্দন জানানাের পাশাপাশি সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন ‘এত রূঢ় সত্য কথা সব সময় বলা যায় না।’ আলােচনার অল্পক্ষণ পর এডুকেশন ব্রাঞ্চের কমাণ্ডার শুকুরুদ্দিনের কক্ষে আমাকে ডেকে নিয়ে কমাণ্ডার ডা. পল। নানা প্রশ্ন ও বকাঝকা করেন।” কমাণ্ডার আবদুর রউফ জানান, তিনি করাচিতে অবস্থানকালে আরও বহু ঘটনার কথা জানেন, যাতে বলা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালিদের ওপর যে জাতিগত নিপীড়ন চালানাে হচ্ছিল তা প্রকট আকারে দেখা গিয়েছিল সশস্ত্র বাহিনীতেও। সঙ্গত কারণেই বৈষম্যের শিকার বাঙালি নাবিকেরা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতাে। রউফের প্রতিবাদী কণ্ঠ সেদিন অনেকের কাছে তাই প্রশংসিত হয়েছিল। পশ্চিমাদের নিপীড়ন প্রশিক্ষণ শেষে কমাণ্ডার রউফ নিয়ােগ পান মনােরা দ্বীপেরই আরেকটি নৌ-ঘাঁটি পিএনএস বাহাদুরে। সেখানে অনেকের মধ্যে বাঙালি অফিসার ছিলেন মাত্র চারজন। সংখ্যায় কম হওয়ায় নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা জমছিল বেশ। দিনের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে তারা পাকিস্তানিদের নানা অন্যায় আচরণ এবং এ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নিয়ে আলােচনা করতেন। লে. মতিউর রহমান ও আবদুর রউফ একই কক্ষে পাশাপাশি কাজ করার সুবাদে তাঁদের মধ্যে আলােচনা হতাে সবচেয়ে বেশি।

৬৪ সালে কমাণ্ডার রউফের বাবা মারা যাওয়ার পর ছােট ভাই বােনদের কথা চিন্তা করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বদলি চেয়ে আবেদন করেন এবং মার্চেই করাচি থেকে এসে চট্টগ্রামের পিএনএস বখতিয়ার ঘাটিতে ট্রেনিং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যােগ দেন। যদিও এখানে ট্রেনিং দেওয়ার মতাে কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। তাই তিনি ঘাটিতে থাকা গ্রন্থাগারটি মানসম্মত বইয়ে সমৃদ্ধ করার দিকে মনােনিবেশ করেন। কিন্তু এখানেও কিছুদিনের মধ্যে দেখেন বাঙালি নাবিকদের ওপর অত্যাচারের নানা চিত্র। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ােগ পাওয়া নাবিকদের কিছুদিন চট্টগ্রামে রেখে পরে জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হতাে। ওইসব তরুণ নাবিকদের দেখাশােনার দায়িত্ব ছিল রউফের ওপর। কমাণ্ডার রউফ তরুণ নাবিকদের ওপর পশ্চিমাদের অন্যায় নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “ওদের সুবিধা অসুবিধা দেখতে গিয়ে আমি দেখি বাঙালি নাবিকদের ওপর অমানবিক এবং অযৌক্তিক উৎপীড়ন চালাতে নৌবাহিনীর উর্ধ্বতন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। তাদের (নাবিকদের) যা কাজ নয় তা তাদেরকে দিয়ে করানাে হতাে। কারণে-অকারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও অহেতুক শাস্তি দেওয়া হতাে। অনেক সময় তাদের আচরণ এমন অমানবিক হতাে যে ভাষায় প্রকাশ করার মতাে নয়। তখন আমার কান্না পেত। একদিন আমি এসব সহ্য করতে না পেরে নির্বাহী কর্মকর্তা লে. কমাণ্ডার সাইদের কাছে বিষয়টি জানালে তিনি তা সুরাহার ব্যবস্থা তাে করলেন না, উল্টো আমার সাথেও দুর্ব্যবহার শুরু করেন। এরপর আমি বাঙালি নাবিকদের সান্তনা দিয়ে বলেছিলাম, “তােমরা নিজেরা নিজেদের দাবি বা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারা কেউ কিছু করে দিতে পারবে না। দৃঢ় মনােবল নিয়ে আমাদের অবশ্যই পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে হবে। একদিন লে. কমাণ্ডার সাইদ আমার পােশাকের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমি তার পােশাকের চাইতে আমার পােশাক অধিক পরিষ্কার বলে মন্তব্য করি।

এতে শাস্তি হিসেবে আমাকে তিনদিন ঘাঁটির বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। চাকরিতে দুবছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমি নিশ্চিত হলাম পশ্চিমাদের সঙ্গে কোননাক্রমে বেশিদিন থাকা যাবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর বিকল্প নেই।” হয় দফায় আলােকিত ১৯৬৫ সালের মার্চ থেকে ৬৬ সালের জুন পর্যন্ত কমাণ্ডার রউফ ঢাকায় নেভাল রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি দেখেছেন কিভাবে অবাঙালি ডাক্তারেরা বাঙালিদের শারীরিকভাবে অযােগ্য ঘােষণা করে সশস্ত্র বাহিনীতে যােগদান থেকে বিরত রাখতেন। এ সময় ঢাকায় থাকার সুবাদে তিনি নৌবাহিনীর বাইরের জগতের ঘনিষ্ঠ কিছু লােকের সঙ্গে যােগাযােগের সুযােগ পেতেন। বিভিন্ন জনের কাছে এমনকি মুসলিম লীগ ঘরানার কোনাে কোনাে নেতৃস্থানীয় লােকজনের কাছেও তিনি প্রশ্নের সুরে শুনতে পান, পূর্ব পাকিস্তান নাকি পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে।’ কমাণ্ডার রউফ বলেন, ‘১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার অরক্ষিত অবস্থার কথা ভেবে অন্য অনেকের মতাে আমিও শেষ সিদ্ধান্তে পৌছি যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর নিরাপত্তার স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা অবস্থান নিতে হবে। ৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের লাহােরে ঘােষিত ছয় দফা বাঙালিদের প্রাণের দাবি বলে বিবেচিত হয় এবং আমাকে ব্যাপকভাবে আলােড়িত করে। এতদিন ধরে এগিয়ে চলার মতাে, কিংবা দেশ সঠিকপথে চলতে পারে তেমন কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি বহুল আলােচিত ‘আসসালামু আলাইকুম আমার মধ্যে আলােড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। এতে ভাসানী কতটা স্বায়ত্বশাসন বা স্বাধীনতা বুঝিয়েছেন স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু শেখ মুজিবের ছয় দফাকে পূর্ব বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং পশ্চিমাদের শাসন শােষণ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় বলে আমার মনে হয়েছে। শেখ মুজিবের মধ্যে জন্মভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার আলােকবর্তিকা বহনকারীর নিশানা আমি দেখতে পাই।

এ পর্যায়ে রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে বাঙালি তরুণদের আমি বােঝাতাম বাঙালি হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু করতে চাইলে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে যােগ দিয়ে সংখ্যা বাড়ানাে প্রয়ােজন। সম্ভবত এসব কথা কোনাে না কোনােভাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কানে গিয়ে থাকবে। এক দফার জন্য তৎপরতা ৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে ঢাকার সেনা ও নৌবাহিনীর রিক্রুটিং অফিস থেকে। করাচির কারসাযে বদলি করা হয়। সপরিবারে উঠার মতাে জায়গা না থাকায় বন্ধুবর লে, মতিউর রহমান তার বাসার অর্ধেক আমাকে ছেড়ে দেন। তিন মাস তাঁর সঙ্গে থাকি। লে, মতিউর রহমান আর আমি একই অফিসে বসতাম। সেখানে তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা। গড়ে ওঠে। তবে এক পর্যায়ে তাকে প্রায় সময় আনমনা, চিন্তামগ্ন, কখনাে কখনাে বিষন্ন মনে হতাে। কৌতুহল দমন করতে না পেরে একদিন কি হয়েছে জানতে চাইলে বললেন, ‘পেটে কথা রাখতে পারলে বলবাে। তবে কয়েকদিন চেপে গেলেন। শেষে আমার চাপাচাপিতে বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুতর। এক দফার দাবি উঠেছে। অনেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা করতে চায়। করাচিতেও এর সপক্ষে কাজ চলছে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কিছু সামরিক-বেসামরিক লােক ঘনিষ্ঠভাবে যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছেন। এই মুহূর্তে নাম বলবাে না, তবে আমিও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি।’ তার এসব কথা শুনে আমি আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ি। সশস্ত্র বাহিনীতে এমন এক ঘটনা চলছে, আমি জানি না। অথচ এ সবই আমারও প্রাণের কথা। আমার নীরবতা দেখে লে. রহমান নীরবতার কারণ জানতে চান। বললাম, কথাগুলাে তাে শুনলাম, একটু ভেবে নিই।’ এর কিছুদিনের মধ্যে আমিও তার সঙ্গে মিলে আসল কাজ তথা এক দফার কাজে তৎপর হই। কমাণ্ডার (অব.) আবদুর রউফ জানান, ৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লে. মতিউর রহমানের সঙ্গে করাচির মার্টিন কোয়ার্টার্স-এ গিয়ে এক গােপন বৈঠকে যােগ দেন। সেখানে বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর দশ-বারাে জন লােক উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন একটি টেক্সটাইল মিলের প্রােডাকশন ম্যানেজার মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী, লিডিং সী-ম্যান সুলতান, বিমান বাহিনীর কপােল সিরাজ ও ফ্লাইট সার্জেন্ট জলিল। আলােচনার মূল বিষয় ছিল পশ্চিমাদের শাসন শােষণ থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করা। তাদের কারাে কারাে বক্তব্য ছিল জ্বালাময়ী, যেন পারলে তারা দেশটা মুহূর্তের মধ্যে স্বাধীন করে ফেলবেন।

ওই বৈঠকে করপােরাল সিরাজ বলেছিলেন, এই আন্দোলনের সবচেয়ে কঠিন কাজটা যেন তাঁকে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত সিরাজ আগরতলা মামলায় সরকারি পক্ষে সাক্ষী। হয়েছিলেন। কমাণ্ডার রউফের মতে, বৈঠকে উপস্থিত সবার মধ্যে দেশের জন্য মহৎ কিছু করার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকলেও অনেককেই আবেগতাড়িত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন মনে হয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কেও তাদের তেমন ধারণা ছিল না। পরিণতি সম্পর্কেও তাঁরা সচেতন নন। এ ধরনের সভায় নতুন আগন্তুক হিসেবে নিজে সব কিছু বােঝার চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে তিনি এ ঘটনা কর্তৃপক্ষ জানলে, চাকরি যাওয়াসহ পরিবারের ক্ষতি হতে পারে এমন কথা বললে, সবাই ক্ষেপে যান। সংশ্লিষ্টদের আবেগের কথা ভেবে তিনি সেখানে আর কোনাে বক্তব্য রাখেননি। তবে পরে আজ হােক কাল হােক ধরা যে পড়তে হবে সে কথাটি লে. রহমানকে স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, একজন অফিসার হিসেবে আমার দায়িত্ব-এ সম্পর্কে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। কিন্তু আমি যেহেতু স্বাধীন। বাংলা আন্দোলনকে সমর্থন করি এবং এর পেছনের কারণগুলােও যথার্থ মনে করি তাই সেটা আমি করবাে না।’ কমাণ্ডার রউফ বললেন, এ পর্যায়ে লে, রহমান কী করা যায় জানতে চাইলে, আমি তাকে বলি যে, সূর্যসেনের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা আসেনি। তবে এ ঘটনা যেভাবে সকলকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল, জনমনে সচেতনতা এসেছিল, আমাদের আন্দোলনের ফলেও তাই হবে। আমি তার কাছ থেকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পরিচয় জেনে নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে তাদের মনােভাব জেনে নিই।

লে. রহমানের কাছেই জেনেছিলাম, করাচির মনােরা দ্বীপের হিমালয়াতে বাঙালি নাবিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৬২ সালের দিকে গঠিত একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যদের মাধ্যমে সেখানে স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের স্বপ্ন সঞ্চারিত হয়। সেই সংগঠনের সদস্যেরা যাকে আপনজন ভেবেছে তাকে সদস্য করে নিয়েছে। ক্ষুব্ধ সদস্যদের মধ্যে প্রথম দিকে ছিলেন, লিডিং সী-ম্যান সুলতান, স্টুয়ার্ড মুজিব, নূর মােহাম্মদ প্রমুখ। বাঙালি-অবাঙালি বিভাজনের বিষয়টি সামনে আসায় এতে একাত্ম হন এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে আসেন, লে. মােয়াজ্জেম, লে. মােজাম্মেল প্রমুখ। পরে করাচিতে পিএনএস কারসাযে কর্মরত থাকার সময় লে, রহমান মােয়াজ্জেমের সঙ্গে পরিচিত হন এবং এ সংগঠনে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে তারা পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। শেখ সাহেব তাদেরকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলেন এবং প্রয়ােজনীয় সহযােগিতার আশ্বাস দেন। তিনি তাদেরকে স্বাধীনতার আন্দোলন সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলায় গিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন। নাবিকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের সদস্যেরা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলন তথা ছয় দফার সাথে একাত্ম হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সূত্রে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে, নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট, সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এবং নিচের দিকে সেপাই হাবিলদার পর্যন্ত লােকজন এ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। অন্যদিকে প্রবীণ, সিনিয়র, পরিপক্ক কর্মকর্তারা তেমন উৎসাহ দেখাননি সঙ্গত কারণে। বয়স ও অভিজ্ঞতায় নবীন হওয়ায় সম্ভবত স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের চিন্তা-চেতনা ও পরিকল্পনায় অপরিপক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার ছাপ দেখা গেছে। অন্যদিকে করাচির নেভাল একাডেমিতে চাকরির সময় নিজেও পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ভসনার শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসে অপমানকর পরিবেশ। থেকে বাঁচা ও আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা পােষণ করি। এ কাজ নির্বিঘ্নে করার সুবিধার জন্য চাকরি থেকে অব্যাহতি চাই। তবে আবেদনে উল্লেখ করি পারিবারিক সমস্যার কথা।

কর্তৃপক্ষ আমাকে চাকরি না ছেড়ে ছুটি নিয়ে এসে পারিবারিক সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দেন। ছুটি দেওয়ার সময় আমার কমাণ্ডার আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন, আমি সর্বনাশের দিকে যাচ্ছি। ৬৭ সালের ডিসেম্বরে দশ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসি মূলত আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন বিভাগে কর্মরত লে. কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম ও অন্য কয়েকজন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক মহলের মনােভাব জানার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় এসে বুঝতে পারি ঘটনা ওপেন সিক্রেট। অর্থাৎ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটা প্রক্রিয়া যে চলছে তা অনেকের মধ্যে আলােচনা হচ্ছিল। শুনেছি ১৭ জেলার মধ্যে ১৬ জন পুলিশ সুপার ও ১৩ জন জেলা প্রশাসক এ আন্দোলনকে গােপনে সমর্থন দিচ্ছেন। মামলার অভিযুক্ত লিডিং সী-ম্যান সুলতান উদ্দিনের ভগ্নিপতি কামাল উদ্দিনের (বৈরি সাক্ষী) বাসায় মােয়াজ্জেম সাহেবের সঙ্গে দেখা করে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনার চেষ্টা করি। কিন্তু যে লােকটিকে ঘিরে পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি সৈনিকদের মাঝে এত উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গেছে, তার সঙ্গে কথা বলে আমি তেমন স্বস্থি পেলাম না। এরপর কয়েকদিনে কয়েকজন সহপাটি বন্ধু রাজনৈতিক নেতা ও দুএকজন আমলার সঙ্গে কথা বলে বােঝা গেল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য কিছু একটা শুরু করলে সমর্থন দেওয়ার মতাে লােকের অভাব হবে না। তবে নিরীহ, শান্তিপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমানের কাছে গিয়ে মনে হলাে তিনি এসব কথা শুনে সমূহ বিপদের আশঙ্কায় ভয় পেয়েছিলেন। এভাবে নানা তৎপরতার মধ্য দিয়ে আমি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি এবং শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ি।’ মুক্তিযুদ্ধে কমান্ডার রউফ একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র প্রস্তুতি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হলেও পরবর্তীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন কমাণ্ডার (অব.) আবদুর রউফ। সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল হলেও তিনি আওয়ামী লীগ করতেন না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সংগঠনের কাজ করেন। ৬৯ সালের শেষ দিকে নংসিংদী কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত ছিল না। লে, কমাণ্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন জনাব রউফকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের বিজয় দেখে আমরা যাতে মনে না করি পাকিস্তানিরা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। বরং পাঞ্জাবিরা পূর্ব বাংলায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তানি সামরিক গােয়েন্দারা ইতিমধ্যে বাঙালিদের হত্যার জন্য তালিকাও তৈরি করেছে। তিনি চোখ-কান খােলা রেখে সাবধানে থাকতে রউফকে সতর্ক করে দেন। ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশের উত্তাল দিনগুলােতে যখন বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি শ্লোগানে চারদিক মুখরিত তখনই রউফ আসন্ন আর একটি মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের একাংশের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে কিছুটা বিরক্তও হয়েছিলেন। দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভৈরবে থেকে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য সংগঠিত করা ও জনমত গঠনের মাধ্যমে প্রতিরােধ আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ভৈরবের পতনের পর কিছুদিন গ্রামাঞ্চলে কাটিয়ে পরে আগরতলা যান। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়া তরুণদের আশ্রয় ও যুদ্ধে যােগ দেওয়ার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে গঠিত গেরিলা দল পরিচালনার কাজ করেন মােহাম্মদ ফরহাদ ও চৌধুরী হারুন অর রশিদের সঙ্গে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চৌধুরী হারুণ অর রশিদের সঙ্গে একটি গেরিলা দল নিয়ে তিনি বিলােনিয়া সীমান্ত দিয়ে দেশে (চৌদ্দগ্রাম) ঢােকার সময় তাঁদের দলটি।

পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভৈরবের পৈত্রিক বাড়ি হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীন দেশের নৌ-কমাণ্ডার। স্বাধীনতার পর কমাণ্ডার (অব.) আবদুর রউফ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ৭২ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সম্পাদক হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু কয়েকমাস পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ৭২ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে যােগ দেন এবং অল্প কয়েক মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম নৌঘাটিতে অধিনায়কের দায়িত্ব পান। একটি সদ্য অগােছালাে, স্বল্প সংখ্যক নাবিক ও নৌযান নিয়ে গঠিত নৌবাহিনীকে পুনর্গঠনে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন এবং কমাণ্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানান, ৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাঙালি সৈন্যদের প্রত্যাবর্তনের পর মুক্তিযোেদ্ধা অফিসাররা নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর সেই ষড়যন্ত্র আরও গভীর হয়। নভেম্বরে নৌবাহিনীতে সংঘটিত এক বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থতার অভিযােগ এনে প্রথমে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিরাপােষ স্বাধীনতাকামী এই মুক্তিযােদ্ধাকে স্বাধীন দেশেই প্রায় তিন মাস কারাবন্দি রাখার পর ৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অকালে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের নির্দেশ ‘তােরা গান গা বন্দী জীবনের কিছু সুখকর স্মৃতির কথাও সাক্ষাৎকারে জানালেন অবসরপ্রাপ্ত কমাণ্ডার আবদুর রউফ। অভিযুক্তদের অনেককে এক সঙ্গে কাছাকাছি পেয়ে সবার মধ্যে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছিল।

বিশেষ করে বিচারকাজ শুরুর প্রাক্কালে বন্দীদের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ, কথা বলা, পত্র-পত্রিকা পাঠ, বিকেলে আধঘণ্টার জন্য একসঙ্গে হাঁটাহাঁটি ইত্যাদির সুযােগ দেওয়া হয়। ১৯ জুন সেনানিবাসের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে প্রথমবারের মতাে বন্দীদের নেওয়ার সময়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে রউফ বলেন, ‘ওই দিন সকালে লােহার জাল দিয়ে ঘেরা কয়েদী ভ্যানে আমাদের তােলা হয় ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য। অনেকদিন পর এই প্রথমবার সব আসামি একত্রিত হয়ে জানলাম এ মামলায় আরও কে কে আসামি হয়েছি। একে অপরকে পেয়ে হাসি কান্না মিশিয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছি। বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে বঙ্গবন্ধুও এসে বাসের পেছনের দরজার পাশে বসেন। বাস সামনের দিকে এগুতেই আমরা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি। বাসের সবাই একসাথে কণ্ঠ মেলান তাতে। এমন সময় সশস্ত্র সেন্ট্রি বাসে গান গাওয়া নিষেধ বলে গান থামাতে বলে। আমরাও গান গাওয়া বন্ধ করে দিই। গান বন্ধ হয়ে গেছে দেখে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন ‘গান থামিয়েছিস কেন?” আমরা বললাম, “সেন্ট্রি গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।’ শুনে বঙ্গবন্ধু উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন আমি শেখ মুজিব নির্দেশ দিচ্ছি, তােরা গান গা।’ এরপর আমরা আবার গান গাওয়া শুরু করলে সেন্ট্রি চুপ হয়ে যায়। ওইদিন থেকে মেস ক্যাম্পাসে সবাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে থাকি। স্ত্রী বােনসহ আত্মীয় স্বজনদের আমাদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। আমার ধূমপানের অভ্যাস ছিল। আমার বােন ধুমপানের খরচ কমানাের জন্য একটি হুকা দিয়েছিলেন। হুকা খাওয়ার জন্য অনেকে আমাদের কক্ষে আসতেন। বঙ্গবন্ধুও আসতেন মাঝে মাঝে। আহমদ ফজলুর রহমানের হাতের রান্না আর আমার হুকা খেয়ে তিনি বেশ তৃপ্তি পেতেন। কক্ষে এসেই দরাজ কণ্ঠে বলতেন, এই রউফ, হুকা সাজা।

ভেতরে যা বলেন বাইরেও তাই হয় ট্রাইবুনালে মামলার শুনানি চলাকালে বন্দীরা এক পর্যায়ে জানতে পারেন, বাইরে ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক দলের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এ আন্দোলনের দাবিগুলাের অন্যতম ছিল তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। অন্যদিকে অফিসার্স মেসের বন্দীরা মাঝে মাঝে বৈকালিক আড্ডায় বসতেন মেসের সামনে সবুজ ঘাসের ওপর বসে। মাঝে মাঝে সেখানে যােগ দিতেন বঙ্গবন্ধু। কিভাবে এগােলে আন্দোলন আরও জোরদার হতে পারে তাও স্থান পেত আলােচনায়। আর সংশ্লিষ্টরা অনেক সময় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছেন আন্দোলনে করণীয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যে রকম বক্তব্য দিতেন বাইরের আন্দোলনকারীরা ঠিক সেভাবেই কাজ করতেন। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে কমাণ্ডার রউফ বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যে বৈকালিক আজ্ঞা হতাে সেখানে, বাইরের অবস্থা সম্পর্কে যেসব খবরাখবর পেতাম সেগুলাে পর্যালােচনা করতাম। ভবিষ্যতে কি হতে পারে, কি করা উচিৎ এসব নিয়ে আলােচনাকালে লক্ষ্য করতাম, বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের জন্য এরপর কি করা উচিৎ এ নিয়ে কোনাে বক্তব্য রাখলেন। আজ বিকেলে হয়তাে বললেন, অমুক কাজটা করলেই ভালাে হয়। পরে দেখা গেল বাইরের আন্দোলনকারীরা ঠিক সে কাজটিই করছেন। এরকম কয়েকটি ঘটনা থেকে বােঝা যায় বঙ্গবন্ধু বন্দী হলেও তার সাথে চলমান আন্দোলনের একটা যােগসূত্র আছে। তাঁর আইনজীবী এবং স্ত্রী-আত্মীয় কেউ হয়তাে এতে ভূমিকা রাখতে পারেন। অবশেষে আন্দোলনের ঢেউ এত বেশি তীব্র হয় যে, প্রেসিডেন্ট আইউব খান ৬৯ এর ২১ ফেব্রুয়ারি কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন এবং আমরা সবাই এক অনিশ্চিত অনাকাক্ষিত পরিবেশ-পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি পাই।’

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!