You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.12.29 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | দুর্নীতি দমনে সুনির্দিষ্ট আইন চাই | বেলুচিস্তানে ভুট্টোর চণ্ডনীতির চালচিত্র | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৯শে ডিসেম্বর, শনিবার, ১৩ই পৌষ, ১৩৮০

দুর্নীতি দমনে সুনির্দিষ্ট আইন চাই

দুর্নীতিতে দেশ ভরে গেছে। দুর্নীতিবাজদের জন্য কোন কাজকর্ম চলছেনা৷ দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ না ঘটালে জাতীয় উৎপাদন আর উন্নয়ন সর্বাংশে ব্যাহত হতে বাধ্য। এমন সব কথাবার্তা হর-হামেশাই বিরোধীদলীয় তো বটেই, সরকার দলীয় নেতাদের মুখেই শোনা যাচ্ছে। সরকারও দুর্নীতি দমনের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছেন- নিচ্ছেন। জাতির জনক ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতিতেও দূর্নীতিকে একটা সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে একদিকে যেমন এটার সমাধানের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছেন, অন্য দিকে দুর্নীতিবাজদেরও সিধাপথে আসার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন, জানাচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার এবং দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের। কেননা একদিকে যে সর্ষে দিয়ে তিনি ভূত তাড়াতে চাইছেন অনেক সময় সেই সর্ষেই ভুত কবলিত হয়ে পড়ে অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের দমনের জন্য যাদের নিয়োজিত করা হয়, অনেক সময় তাদের অনেকেই আবার দুর্নীতিবাজদের কবলিত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী তথা যাদের তিনি সিধা পথে আসতে বলছেন তারা তার সেই কথায় কর্ণপাত করছেন- এমন কোন লক্ষণও দেখা যায় না। আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দুর্নীতির জয়যাত্রা যেন অব্যাহতভাবেই চলে।
দুর্নীতি ক্ষেত্রে সব চাইতে আজকের দিনে টপে রয়েছে বিভিন্ন সরকারি এবং আধাসরকারি সংস্থা। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা সম্ভবতঃ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থায় দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য এযাবৎ দুর্নীতিদমন ব্যুরো, প্রধান মন্ত্রীর ভিজিলেল টিম ছাড়াও কমপক্ষে আরো ৮টি সংস্থা রয়েছে। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে দেখা গেছে যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানার আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য আর একটি কমিশন গঠনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গঠিতব্য কমিশনের কথা বাদ দিলেও আগের দশটি ব্যুরো বা সংস্থা এবং তার সাথে সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এযাবৎকাল দুর্নীতি দমনের প্রশ্ন কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে, খোলা চোখেও তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছেনা। কেননা যখন দেখা যায় আদমজী মিলের কর্তৃপক্ষের কাজ-কারবার চোখে দেখার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই ওই মিলে সারপ্রাইজ ভিজিট করতে হয় চট্টগ্রাম বন্দরের হাল-হকিকত জানার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকা থেকে ছুটে যেতে হয় তখন ওই সংস্থাগুলোর অস্তিত্বের সারবত্তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠাটা কি স্বাভাবিক নয়? এমতাবস্থায় আরেকটি সংস্থা কতদূর ফলপ্রসূ হতে পারে- নাকি এতে কেবল এ জাতীয় সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধিই ঘটবে এ প্রশ্ন আসাটাও স্বাভাবিক নয় কি?
অন্যদিকে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এযাবৎকাল প্রধানমন্ত্রীর সারপ্রাইজ ভিজিট ও অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে বেশ কিছুসংখ্যক সরকারি আমলা বা তাদের ভিন্ন পেশার দোসর দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। কিন্তু কেবলমাত্র চাকুরী থেকে সাসপেন্ড বা এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় বদলি ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দুর্নীতিবাজরা তাদের এই গর্হিত কর্মের ব্যাপারে থোড়াই কেয়ার করে। কেননা একজন দুর্নীতিবাজ আমলা বা লোক যদি দুর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড হন, তাতে তিনি খুশিই হন। কারণ বাকি জীবন চলে যাবার মত ব্যবস্থা বা চাকুরি না করে আরো উন্নত জীবন যাপনের ব্যবস্থা তিনি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, দুর্নীতিবাজ আমলাকে একই স্থান থেকে অন্য স্থানে পদোন্নতি দিয়ে বদলিও করা হয়েছে।
এমতাবস্থায় আমরা মনে করি যদি দেশ থেকে দুর্নীতিকে সত্যিকারভাবে বিদূরিত করতে হয় তবে তার জন্য সংস্থা বৃদ্ধির কোন দরকার হয়না- একটি বা দু’টি সংস্থার মাধ্যমেই তা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি বাজদের সাথে যতদূর সম্ভব কঠোর ব্যবহার করতে হবে। দুর্নীতিবাজ, তারা যে বা যারাই হোন না কেন, যখন হাতে-নাতে সাক্ষাৎ প্রমাণে ধরা পড়বেন, তখন কেবল থাকে সাসপেন্ড, অপসারণ বা বদলি নয়, বরং সংক্ষিপ্ত আদালতে বিচার করে তার অপরাধ অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড দিতে হবে- তাঁর আয়ের অনুপাতে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব করে বাড়তি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। আর এজন্য সুনির্দিষ্ট আলাদা আইন প্রচলিত আছে, এই আইনের ফাঁকে এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার দরুন অনেক সময় দুর্নীতিবাজ খালাস পেয়ে যায়। কাজেই সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজের কঠোর শাস্তিদানের সুসংহত ব্যবস্থা না করতে পারলে দুর্নীতির মত জাতীয় হ্রিদরোগের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

বেলুচিস্তানে ভুট্টোর চণ্ডনীতির চালচিত্র

চমন থেকে যুয়ানি আর সিবি থেকে লাসবেলা বেলুচিস্তানের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বর্তমানে এক চরম নারকীয় তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো সাহেব তার সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে নিরীহ বালুচ জনসাধারণের ওপর যে নির্যাতনী চণ্ডনীতি পরিচালনা করেছে, তার একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছেন বেলুচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল। গ্রেফতার হওয়ার আগে জনাব মেঙ্গল করাচীর এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করে বলেছেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বর্বরোচিতভাবে মারী ও মেঙ্গল উপজাতীয়দের পানীয় জল ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। মারী ও মেঙ্গল উপজাতীয়দের নারী, শিশু, বৃদ্ধ সকলেই এই বর্বর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছে। প্রচন্ড ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবৃত্তি করতে না পেরে বহু উপজাতীয় নর নারী, শিশু-বৃদ্ধ মর্মান্তিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। অভিযোগে জানা গেছে, বেলুচিস্তানের পর্বত সংকুল সিবি জেলায় পাকিস্তানী সৈন্যরা সবরকম জলাশয় ও ঝরণাগুলোকে ঘিরে রেখেছে, একটি মানুষও যাতে তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে একফোটা জল না পায়। একটি মানুষকেও তারা পানীয় জলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিচ্ছেনা। ফলে, জলপান করতে না পেরে চৌদ্দজন আদম সন্তান মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল যখন বেলুচিস্তান পরিদর্শনে এসেছিলেন ঠিক তখনই মর্মবিদারী মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে। উপজাতীয়রা তাদের দারুণ ক্ষুধা ও অপরিমেয় তৃষ্ণার কথা ওই জাতীয় পরিষদ প্রতিনিধিদের কাছে ব্যক্ত করতে পারেনি। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাধা দিয়েছে। এমনকি জাতীয় পরিষদ প্রতিনিধিদের উপজাতীয়দের অবস্থা পরিদর্শনেরও এতোটুকু সুযোগ তারা দেয়নি। অর্থাৎ, পাকিস্তানি সৈন্যরা উপজাতীয় অঞ্চলে এক নিষিদ্ধ দূর্গ খাড়া করে রেখেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা মাকরানে খাদ্যশস্য ও পানীয় জলের সরবরাহ একদম বন্ধ করে দিয়েছে। মাকরান থেকে করাচি যাতায়াতের পথটিতে প্রতিটি পথযাত্রীকে তল্লাশি করার জন্য সর্বমোট চৌদ্দটি সামরিক চেক পোস্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বেলুচিস্তানের ৪ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে করা হয়েছে গ্রেফতার। বেলুচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল ভুট্টো সরকারের এই নির্যাতন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, মুক্তিকামী বালুচ জনসাধারণের মধ্যে এই চণ্ডনীতির প্রতিক্রিয়া প্রবল ভাবে দেখা দেবে এবং দেশকে চরম ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য ভুট্টো সাহেব জেনেশুনেই এই বেপরোয়া পন্থা বেছে নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো সাহেব পাকিস্তানে বালুচদের দুর্বার বিদ্রোহী অগ্নিগিরির মুখে ছাই চাপা দেয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। পিন্ডিতে অনুষ্ঠিত বালুচ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে গেছে। গোপনে ভুট্টো সাহেব বালুচ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যে বৈঠকে বসেছিলেন, তা পুরোপুরি বানচাল হওয়াতে ভুট্টো সাহেবের খেলা জমে উঠতে পারছে না। বরং বালুচ বিদ্রোহ দিন দিন আরো তুঙ্গে উঠছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, ভুট্টো সাহেবের এখন মাথা গরম হয়ে গেছে। তিনি ক্ষমতার দম্ভে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে কোন বিরোধী দলকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভুট্টো সাহেবের নিজস্ব দল পিপল পার্টিতেও দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। সিন্ধু, পাঞ্জাব এবং সীমান্তে ভুট্টো সাহেবের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশঃ। সম্ভবতঃ এ জন্যেই কিছুদিন আগে পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতা জনাব ভুট্টোকে সতর্কবাণী শুনিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, দেয়ালে যদি পিঠ ঠেকে যায়, তাহলে চরমপন্থা নিতে বাধ্য হব। ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান প্রকৃত প্রস্তাবে ভুট্টো সাহেবকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, নির্যাতন যদি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ভুট্টো সাহেবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার নীতিই গ্রহণ করতে হবে৷ পাঠানদের গর্জে ওঠার ঐতিহ্য রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলেও পাঠানরা কখনো নতি স্বীকার করেনি, ভুট্টোর জমানায়ও তারা নতজানু হবে না, পাঠানরা তাদের ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রাখতে বদ্ধপরিকর। সীমান্তে যে প্রতিরোধ আন্দোলন দুর্বার গতি লাভ করেছে, তা দেখে ভুট্টো সাহেব জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের কাছে স্বীকার করেই ফেলেছেন যে, বেলুচিস্তানে মিনি বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এতেও ভুট্টোর চৈতনোদয় হবে বলে আশা করা যায় না। কারণ, জনাব ভুট্টো বরাবরই এক চক্ষু হরিণের নীতি অনুসরণ করতে অভ্যস্ত।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন