লন্ডন ও ওয়াশিংটনের করুণা কে চায়?
বৃটিশ পার্লামেন্টে সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব এবং ওয়শিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে মােটামুটি একই সুরে কথা বলছেন। তাদের বলার ভঙ্গীটা এই, পূর্ব পাকিস্তানে যে রক্তক্ষয় হচ্ছে তাতে লন্ডন ও ওয়াশিংটনের সরকার বড়ই ব্যথা পাচ্ছেন এবং সেখানে মানুষের যে দুর্গতি হচ্ছে তা থেকে তাদের ত্রাণ করার জন্য তারা বড়ই উৎসুক হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাে তার আন্তর্জাতিক উন্নয়ণ সংস্থার একটি শাখাকে তৈরি করে রেখেছে যাতে সময়মত তারা এই ত্রাণকার্যে লেগে যেতে পারে। সংস্থার এই শাখাটির কাজ হচ্ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সাহায্য দেওয়া। শুধু এইটুকু বললেই বােঝা যাবে, ওয়াশিংটনের শাসকরা পূর্ব বঙ্গের জন্য পরিস্থিতিকে কি দৃষ্টিতে দেখছেন। আজ বাংলাদেশে যা হচ্ছে সেটা কি একটা ঘূর্ণিঝড় বা সামুদ্রিক জলােচ্ছাসের মতাে ঘটনা? এইসব দুর্যোগের মতােই এটা কি স্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে একটা সাময়িক ব্যতিক্রম? সেখানকার মানুষ আজ যে মার খাচ্ছেন সেটা কি প্রকৃতির মার? কিন্তু সে সব প্রশ্ন শিকায় তুলে রেখেও জিজ্ঞাসা করতে পারা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আতঁত্রাণের কাজ আরম্ভ করতে বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এতই উৎসুক তাহলে তাদের আটকাচ্ছে না কে? তাদের জবাব হচ্ছে, কি করা যাবে, ইসলামাবাদ থেকে তাে কোন অনুরােধ আসছে না। পাকিস্তান সরকার সরকারিভাবে অনুরােধ না জানালে তারা তাে বাংলাদেশের ক্ষতস্থানে একফোঁটা টিংচার আয়ােডিনও ঢালতে পারে না। অর্থাৎ যে ঘাতকেরা বিমান, ট্যাঙ্ক, কামান ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে তারা যদি আক্রন্তদের সেবা করার অনুমতি দেয় তবেই বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু করতে পারে, অন্যথা নয়। পাকিস্তানের মতাে একটি দেশ, যাকে তার অস্তিত্বের জন্য পদে পদে বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে হয় তার সামনে বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতাে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের সরকার এমন। অসহায়, একথা কে স্বীকার করবে? মহারাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকার অথবা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসনের সরকার আর্ত মানুষের প্রতি খৃস্টীয় করুণা বর্ষণ করতে চাইছেন; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সম্মতির অভাবে পারছেন না, এই কাহিনী যতটা করুণ ততটা বিশ্বাসযােগ্য নয়। গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত বায়াফ্রার মানুষকে পশ্চিমা দেশগুলাে থেকে যখন সাহায্য পৌছে দেওয়া হয়েছিল তখন কি নাইজিরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করা হয়েছিল?
কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, লন্ডন-ওয়াশিংটনের এই করুণা কে চাইছে? বাংলাদেশের মানুষ একটা পশুশক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে নিজেদের মুক্তি অর্জন করতে চাইছে। আর তাদের পাশে গিয়ে বড় জোর তুলাে আর ব্যান্ডেজ নিয়ে দাঁড়াতে চাইছে সেইসব রাষ্ট্র যারা তামাম দুনিয়ায় সদাসর্বদা অভিভাবকত্ব করে বেড়াচ্ছে। এই ধরনের করুণা আজকের পরিস্থিতিতে একটা নিষ্ঠুর বিদ্রুপ। সােভিয়েট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পডগাের্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে যে আবেদন পাঠিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের দমন করা হচ্ছে। কিন্তু বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্রদের এমন কথা বলতে জিভ আটকে যাচ্ছে। পূর্ব বাংলার যে রক্তপাত হচ্ছে, সেটা অত্যাচারিতের রক্ত একথা বলার নৈতিক সাহস যাদের নেই তাদের চুপ করে থাকা বরং ভাল। মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘােষণার দোহাই তুলে রাশিয়া এই রক্তপাত বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের প্রতি যে আবেদন করেছে সেই আবেদনটুকুও কিন্তু বৃটেন বা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে তবু বাস্তব সত্যের এই স্বীকৃতিতিটুকু আছে যে, বাংলা দেশের ঢাকা ও অন্যান্য কয়েকটি শহরাঞ্চল বাদে অন্য সর্বটুকুও ছিল না। বলা হয়েছিল যে, ঢাকাস্থিত মার্কিন মার্কিন প্রতিনিধি তার ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে যতটুকু দেখেছেন তার চেয়ে বেশী খবর মার্কিন সরকারের কাছে নেই। এখন ওয়াশিংটন যদি বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালভাবে বুঝে থাকে তাহলে আশা করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশকে করুণার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু দেওয়ার জন্যও তারা প্রস্তুত হবে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর দল আজ বাংলাদেশে যে কত নির্বান্ধব হয়ে পড়েছে তার আর একটি প্রমাণ পাওয়া গেল নয়াদিল্লীর পাকিস্তানি হাইকমিশনার অফিসের দুজন কূটনৈতিক কর্মীর স্বাধীন বাংলা দেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণার খবর পেয়ে। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, কে এম সাহাবাদ্দিন ও আমাজাদুল হকের মতাে আরও অনেক কূটনৈতিক কর্মী স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। নূতন একটি স্বাধীন দেশের অভূদয়ের বাস্তব সত্যকে পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি তবুও আর কতদিন অস্বীকার করে চলবে?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ এপ্রিল ১৯৭১