You dont have javascript enabled! Please enable it! 1968 | ক্ষোভ ও অনাস্থার কারণ বৈষম্য - ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল - সংগ্রামের নোটবুক

ক্ষোভ ও অনাস্থার কারণ বৈষম্য – ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল

নরসিংদীর খাদ্যশষ্য ও পাট ব্যবসায়ী আবদুল কাদেরের পুত্র আবদুল জলিল বিপ্লবী দলের অন্যতম সদস্য এবং আগরতলা মামলার ২৯ নং আসামি। জন্ম ১৯৩৫ সালের ২০ মার্চ নরসিংদী জেলার সরাবাদ হাজি বাড়িতে। বর্তমানে থাকেন ঢাকার ১২, সিদ্ধেশ্বরী লেনের একটি ফ্লাটে। বেলাবাের সররাবাদ দক্ষিণ পাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ও নারায়নপুর শরাফত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা নিলেও ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৫১ সালে। বাগেরহাট মুসলিম হাই স্কুলে থেকে। তাঁর চাচা বাগেরহাট পিসি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন ওই কলেজে। ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়ে নেতৃত্ব দেন বাগেরহাট অঞ্চলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। আর পড়ালেখা চলাকালেই যােগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। ৫২ সালে করাচি শিক্ষা বাের্ডের অধীনে প্রাইভেটে এইচএসসি পাশ করে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। ওই অবস্থায় ১৯৬০ সালে যান আমেরিকায় প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে গান্টার এয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাইভেটে সম্পন্ন করেন এক বছরের রেডিও টক অ্যাডভান্স ইলেকট্রনিক্স এ ডিপ্লোমা কোর্স। ১৯৬১ সালে দেশে (করাচি) ফিরে এসে কর্মস্থলেপাকিস্তানিদের বৈষম্যের শিকার হয়ে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন জলিল। জড়িয়ে পড়েন সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের গােপন বিপ্লবী তৎপরতায়। আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে ভােগ করেন চরম নির্যাতন। ৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলা প্রত্যাহারের পর অন্য আসামিদের মতাে মুক্তি পান তিনিও। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ৬ নং সেক্টরে এয়ার কমােডর এম কে বাশারের অধীনে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে তিনি তেজগাঁওয়ে সরকারি মােটর ভেহেইক্যাল ওয়ার্কশপে ব্যবস্থাপক হিসেবে যােগ দেন এবং ৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ওই পদে নিয়ােজিত ছিলেন।

আবদুল জলিল ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন আত্মীয় পরিমন্ডল এবং শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে নিজেও হয়ে ওঠেন রাজনীতি সচেতন। ২০০৭ সালের ১২ মার্চ অপরাহ্নে তার রামকৃষ্ণ মিশন সড়কের ব্যবসায়িক সংগঠনের কার্যালয়ে এ লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান তিনি। প্রশ্নোত্তরে বেরিয়ে এসেছে গােপন আন্দোলনে তাঁর জড়িত হওয়া, তার জানামতে অন্য সঙ্গীদের কার্যক্রম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের যােগসূত্র, কারাগারে নির্যাতনের কাহিনী। প্রকাশ পেয়েছে স্বাধীনতার এত বছর পরও কোনাে সরকারের পক্ষ থেকে কোনাে রকম স্বীকৃতি না পাওয় বা মূল্যায়ন না হওয়ায় ক্ষোভের কথাও। ‘পাকিস্তান ২০ বছরের বেশি টিকবে না’ শৈশব থেকে নিজের মধ্যে রাজনীতির ধারা প্রবাহ এবং পাকিস্তানিদের প্রতি ক্ষোভবিদ্রোহের উৎপত্তি সম্পর্কে আবদুল জলিল বলেন, ‘আমার এলাকা তখন একটি অজ পাড়াগাঁ হলেও ১৯৪০-৪১ সাল থেকেই আমাদের বাড়িতে বয়ে যেত রাজনৈতিক আলােচনার ঝড়। আমার আপন জেঠা পন্ডিত আবদুস সােবহান এবং এলাকারই একজন শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ, (উভয় প্রয়াত) এ দুজনই বিভিন্ন পত্র পত্রিকা সংগ্রহ করতেন, পড়তেন এবং রাজনৈতিক আলােচনায় মজে থাকতেন। তাদের সেই আলােচনা শুনতে আসতেন আশেপাশের উৎসাহী অন্য কয়েকজনও। আবদুল হামিদ এক সময় গণমুক্তি পার্টি করতেন এবং ওই পার্টির সভাপতি ছিলেন। আলােচনাস্থল বাংলােঘরটি একই সাথে ছিল আমার পড়ার ঘরও। তাঁদের সেই আলােচনা সমালােচনা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে আমিও রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। পাকিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় ৪৬ সালের নির্বাচনে এলাকার মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ।

ওই সময় এক ঘরােয়া আলােচনায় তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান (প্রস্তাবিত) একটি অবাস্তব কল্পনা। এটি জম্মগ্রহণ করলেও বিশ বছরের বেশি ঠিকবে না। তার এই। কথাটা তখনই আমার মনে দাগ কাটে। আবদুল জলিল জানান, তিনি বাগেরহাট থাকার সময় ৫১ সালের ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনে তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন লাল, লালের বড় ভাই বামপন্থী ‘গােরাইদা’ সহ অনেকে। ৫২ সালে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে বাগেরহাটে তাঁরা মিছিলের আয়ােজন করেন। স্মৃতিচারণ করে জনাব জলিল বলেন, “আমাদের মিছিলের শুরুতে বক্তব্য দেন ইতিহাসের অধ্যাপক জেবি বিষ্ণু। তিনি পাকিস্তানিদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘অত্যাচারী তার অত্যাচারের মাত্রা যতই বাড়বে, মুক্তি তত দ্রুত ধেয়ে আসবে। তার এই কথাগুলােও আমার মনে রেখাপাত করে। অনেক তালবাহানার পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান একটি রচিত হয়ে গেলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে অধ্যক্ষ হামিদ সাহেব যে বলেছিলেন, পাকিস্তান টিকবে না, তা কি মিথ্যা হয়ে গেল? ওই বছর একদিন ছুটিতে এসে অধ্যক্ষ হামিদকে বললাম, “আপনি তাে বলেছিলেন পাকিস্তান টিকবে না। এখনতাে সংবিধান রচিত হয়ে গেছে। এতে তাে মনে হয় পাকিস্তান টিকে গেছে।’ তিনি তখন বলেছিলেন, “দেখাে জলিল,প্রােগ্রেসকে আমি এক্সিসটেন্স বলি না, পাকিস্তান উইল ব্রেক ইনটু টুয়েন্টি ইয়ারস। ১৯৬৪ সালে আইউব খানের আমলে যে নির্বাচন হয় এতে অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ এমপি নির্যাচিত হন।

এরপর করাচিতে শপথ নেওয়ার সময়ও তার সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি শপথ শুরু করেন বাংলায়, শেষ করেন ইংরেজিতে। এ নিয়ে আলােচনাও হয় বেশ। এরপর আর একবার ছুটিতে এলে এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেখ, আমি বাংলায় শুরু করেছিলাম পাকিস্তানের ঐক্য ও ঐতিহ্যকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য। সেই ঐক্যতাে শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পারবাে না। আর বিধাতা যদি তখন শপথ ভঙ্গের প্রশ্ন তােলেন সঠিক জবাবও দিতে পারবাে না, তাই ইংরেজি অংশ থেকে বলেছি “উই উইল প্রিজার্ভ দি ইনটিগ্রিটি অব পাকিস্তান।’ প্রিজার্ভ, ইন্টিগ্রেশন, শব্দগুলাের নানা অর্থ আছে। প্রশ্ন উঠলে সেভাবে জবাব দেবাে।’অধ্যক্ষ হামিদের এরকম দূরদর্শিতা, পাকিস্তানের প্রতি এরকম অনাস্থা-এসবও আমাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি গভীর আন্তরিক হতে উদ্বুদ্ধ করে।” বিমান বাহিনীতে স্বাধীনতা পছী গ্রুপ চাকরিস্থলে ক্ষোভের কারণ এবং বিমান বাহিনীতে স্বাধীনতাপন্থী গ্রুপ তৈরির পটভূমি বর্ণনা করে আবদুল জলিল জানান, ১৯৫২ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যােগ দিয়ে করাচিতে গিয়ে তিনি দেখেন বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিরা বৈষ্যমূলক আচরণ করছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং বেসামরিক পর্যায়ে পদোন্নতিতে করা হচ্ছে বিমাতাসূলভ আচরণ। এমনকি পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে বাঙালি কোটা থেকে। বাঙালি কর্মকর্তা পর্যায়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন খুবই কম, হাতে গােনা কয়েকজন।

বাঙালিদের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বলা হলে পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হতাে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হলেই পূর্ব পাকিস্তানও রক্ষা পাবে। ঈদসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ছুটির দিনে পশ্চিমারা চলে যেতাে ছুটি কাটাতে, আর বাঙালিদের বাধ্য করা হতাে কাজ করতে বাধ্য করা হতাে ভাতের বদলে রুটি খেতে। এসব নির্যাতনবৈষম্যের চিত্র দেখে তার অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ ও অধ্যাপক জেবি বিষ্ণুর কথাগুলাে বারবার মনে পড়ছিল। আর তখন থেকে অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি তার ক্ষোভ ও অনাস্থা আরাে বেড়ে যায়। এপর্যায়ে তিনিসহ অন্যান্য সহকর্মীদের মাথায় ঢুকে স্বাধীনতার চিন্তা এবং সৃষ্টি হয় একটি স্বতন্ত্র গ্রুপ। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাক সার্জেন্ট জলিলের ভাষায়, ‘আমি লক্ষ্য করি যে, পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে সমসাময়িক বেশ কজন বাঙালি সহকর্মীর মাঝে ক্ষোভ ও অনাস্থাভাব বিস্তৃত হয়েছে। আলােচনার মধ্য দিয়ে আমরা একমত হই যে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে এক সাথে বসবাস করা হয়তাে আর সম্ভব হবে না। ভাবতে থাকি কীভাবে দেশকে স্বাধীন করা যায়। এ বিষয়ে সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা ও সমর্থক বাড়ানাের লক্ষ্যে প্রয়াত ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজউল্লাহ ও আমিসহ আরাে কয়েকজন মিলে ১৯৬০-৬১ সালে বিমান বাহিনীর ভেতর একটি গ্রুপ তৈরি করি।

গুপ্তচরদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমরা আলােচনার জন্য চলে যেতাম কোথাও কোনাে পিকনিক স্পটে। বাঙালি সৈনিকদের মাঝে এরকম আরও গ্রুপ আছে কিংবা কথিত আগরতলা মামলায় শেখ সাহেবসহ অন্য যাঁরা আসামি হয়েছেন তাঁরাও যে গােপনে একই। রকম উদ্দেশ্য ও চিন্তা ভাবনা নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন তা তখনাে আমার জানা ছিল না।’ শেখ মুজিবের সঙ্গে যােগাযােগ ৫৭ থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে যােগাযােগ প্রসঙ্গে সার্জেন্ট জলিল বলেন, “৬২-৬৩ সালের দিকে মফিজউল্লাহ (আগরতলা মামলার ৭নং আসামি)। এক পর্যায়ে জানান যে, আমরা যে রকম চিন্তা-ভাবনা করছি, তেমন চিন্তার লােক নৌ ও। সেনাবাহিনীতেও অনেক আছে। তারাও এ রকম একটা কিছুর জন্য অগ্রসর হচ্ছেন চলুন।

আমরা তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে একত্রে কিছু করার চেষ্টা করি।’ ১৯৬৪ সালের দিকে। তিনি আবার জানালেন যে, ‘নৌ-বাহিনীর যে গ্রুপটা কাজ করছে, তাদের সঙ্গে শেখ। সাহেবও যুক্ত আছেন। তাঁদের কার্যক্রমে তার (শেখ মুজিবের) সম্মতি আছে।’ এ পর্যায়ে মফিজউল্লাহর কথাবার্তায় বুঝতে পারি যে, নৌবাহিনীর ওই দলটির সঙ্গে তাঁর। অনেক আগে থেকেই যােগাযােগ ছিল। কিন্তু আমাকে বলা যাবে কি না এটা পর্যবেক্ষণের জন্যই এতদিন সরাসরি মুখ খুলতে চাচ্ছিলেন না। আমাদের এই গােপন তৎপরতার আগেও ৫৬-৫৭ সালের দিকে একজন সাহসী বাঙালি। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কথা বলার জন্য শেখ সাহেবের সঙ্গে আমাদের অনেকে দেখা। করেছেন। করাচিতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মেয়ের বাসা লাকামা হাউস থেকে আমার বাসার দূরত্ব তেমন বেশি ছিল না। হেঁটে যাওয়া যেতাে। আমরা জানতাম, তিনি। করাচি এলে লাকামা হাউসে উঠতেন। আর তখনই আমরা তার সঙ্গে দেখা করে দেশের। ভালমন্দ নানা দিক, আমাদের সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতাম। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী থাকাকালে একদিন আমরা, বিহারীরা আমাদের ওপরে যে অবিচার ও অসৌজন্যমূলক আচার-আচরণ করছে যে সম্পর্কে। তাঁর কাছে অভিযােগ জানাই। তিনি আমাদের কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে চল দেখি। কোথায় কী হচ্ছে। কোনাে প্রটোকল ছাড়াই তিনি আমাদের সঙ্গে ওই এলাকা পরিদর্শন। করেন। তিনি বিহারীদের সরাসরি কিছু না বললেও তাঁর যাওয়ার পর দেখি বিহারীরা চুপ হয়ে গেছে। এভাবে তার সঙ্গে দেখা বা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় নিয়ে সরাসরি কোনাে কথা তখনাে বলা হয়নি। তবে বাঙালির স্বার্থ। সংরক্ষণ কীভাবে করা যায়, করাচিতে এ নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে কী ধরনের কথাবার্তা হয়। কিংবা বাঙালিদের স্বার্থ নিয়ে বাঙালি সৈনিকদের ভেতরের মনােভাব ইত্যাদি তিনি জানতে। চাইতেন। এতে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি আমাদের ক্ষোভের কথা বুঝতেন, এসব।

নিয়ে ভাবতেন। স্বাধীনতার জন্য গােপন সাংগঠনিক ও অন্যান্য পরিকল্পনা তৈরির প্রয়ােজন দেখা দিলে নিজেদের মধ্যে আলােচনা হয় যে, যেহেতু আমরা সৈনিক, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যােগাযােগ নেই, সংগঠন নেই। এ অবস্থায় চাইলেও তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। দেশ পরিচালনার মতাে শক্তি সামর্থ্য আমাদের নেই। এ জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিশেষ বিশেষ নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করি। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে সাহস করে এগিয়ে আসেননি। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাদের কথায় একমত হয়ে সাহস দিয়েছিলেন। আন্দোলনের স্বার্থে বহু টাকা পয়সাও সাহায্য করেছেন। আমাদের মধ্যে কথা হয়-সব প্রস্তুতি শেষে একটি দিন ঠিক করে আচমকা হানা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলি অস্ত্রাগার দখল করে নেব। পশ্চিমা সৈন্যদের বন্দি করে দেশকে স্বাধীন যােষণা করব। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট হবেন এবং আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে।” সার্জেন্ট জলিলের বর্ণনা অনুযায়ী এ পর্যায়ে তারা লে. মতিউর রহমানের মাধ্যমে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমের দলের সঙ্গে যুক্ত হন। জলিল তখনাে মােয়াজ্জেম সাহেবকে সরাসরি দেখেননি। লে. মতিউর রহমান ও মফিজ উল্লাহ বলেছিলেন নিরাপত্তার স্বার্থে মােয়াজ্জেমের পরিচয় গােপন রাখা হয়। কারণ যে কেউ গুপ্তচর হয়ে দলের ভেতর ঢুকে চরম ক্ষতি করতে পারে। মােয়াজ্জেমকে সার্জেন্ট জলিল প্রথম দেখেন মামলা চলাকালে আদালতে। মফিজউল্লাহ-জলিলরা দায়িত্ব নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে গিয়ে এ প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবের জড়িত থাকার ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য পান। জানা যাক সে কথা জলিলের কাছ থেকে: ‘মফিজউল্লাহ এবং আমিসহ কয়েকজন সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে ৬৪ সালের প্রথম দিকে এক বৈঠক জানতে পারি যে, ইতিমধ্যে মােয়াজ্জেম সাহেবদের সঙ্গে শেখ সাহেবের দুটি বৈঠক করাচির পার্ক সােসাইটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া এই প্রক্রিয়া যারা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম, স্টুয়ার্ড মুজিব, ক্যাপ্টেন সুলতান উদ্দিন এবং নূর মােহাম্মদ বাবুলের (বিপ্লবী কাউন্সিলের একমাত্র জীবিত সদস্য) সঙ্গে অনেক আগে থেকেই সরাসরি যােগাযােগ ছিল বঙ্গবন্ধুর । জলিলের বাসায় প্রশিক্ষণ সার্জেন্ট জলিলের বাসা ছিল শহরের মধ্যে জাহাঙ্গীর সড়ক (পূর্ব) ও মার্টিন সড়কের মধ্যবর্তী এলাকায় ক্লেটন কোয়ার্টারে। সেখান থেকে প্রায় এক কিলােমিটার দূরে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর কবর। জলিলের বাসা পাবলিক এরিয়া’ হওয়ায় সেখানে গুপ্তচর বৃত্তির সম্ভাবনা ছিল কম। সব দিক বিবেচনায় তাঁর বাসাকেই আলােচনা ও প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়। সার্জেন্ট জহুর ও দলের অন্য সদস্যেরা প্রতি রােববার ছুটির দিন জলিলের বাসায় আসতেন।

অস্ত্রপ্রশিক্ষণসহ অন্যান্য বিষয়ে আলােচনা হতাে নিজেদের মধ্যে। যারা নতুন যুক্ত হতেন তাদের গ্রেনেড, পিস্তলসহ অন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতেন সার্জেন্ট জহুর। পরবর্তী সময়ে জলিলকে গ্রেপ্তারের পর তার বাসা তল্লাশী করে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত একটি নমুনা গ্রেনেড উদ্ধার করা হয় এবং মামলার আলামত হিসেবে সেটি আদালতে দাখিল করা হয়। এটি বর্তমানে ক্যান্টেনমেন্টের ভেতর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ‘বিজয় কেতনে সংরক্ষিত আছে। স্বাধীনতার ব্যাপারে গণভােটের প্রস্তাব বাঙালিরা যে স্বাধীনতা চান, পশ্চিমাদের সঙ্গে থাকতে চান না তা প্রমাণের জন্য গণভােট দেওয়ার প্রস্তাব তােলা হয় ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর নারায়নপুর গ্রামের এক সভা থেকে। ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার অভিযােগ থেকে ছাড়া পেয়ে সরাসরি গ্রামে চলে যান সার্জেন্ট আবদুল জলিল। ওই দিন (শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়ার আগের দিন) নরসিংদীর নারায়নপুর গ্রামে পূর্ব নির্ধারিত এক সভায় জলিলকে নিয়ে যান অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ। ওই সভা থেকেই প্রস্তাব তােলা হয় বাঙালিরা স্বাধীনতা চায় কি না তা গণভােটের মাধ্যমে যাচাই করা হােক। সার্জেন্ট জলিল বলেন, ওই সভায় অধ্যক্ষ হামিদ তার ‘জাতীয় ভূখন্ড’ নামে একটি বই থেকে কিছু অংশ জনগনের উদ্দেশ্যে পড়ে শােনান। এর মূল বক্তব্য ছিল শুধু ধর্মের ভিত্তিতে কোনাে রাষ্ট্র হতে পারে না। একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য যেসব শর্তের প্রয়ােজন তার মধ্যে আমরা পড়ি না। যদি কেবল ধর্মের ভিত্তিতে একটা রাষ্ট্র হতাে তাহলে এক ধর্ম, এক ভাষার লােকদের এতগুলাে রাষ্ট্র হতাে না। সভায় বলা হয়, পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অজুহাতে অভিযােগপত্র দিয়ে ভেবেছিল, বাঙালিরা অভিযুক্তদের ফাঁসি চেয়ে রাজপথে মিছিল করবে। কিন্তু বাস্তবে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে অভিযুক্তদের মুক্ত করে।

এনেছে এবং বীরের মর্যাদা দিয়েছে। কাজেই বাঙালিরা স্বাধীনতা চায় কি না-তা গণভােটের মাধ্যমে যাচাই করা হােক। ভৈরব টেলিগ্রাফ অফিস থেকে এই প্রস্তাব প্রতিটি পত্রিকা অফিস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতা এবং প্রেসিডেন্ট আইউব খানের কাছে। পাঠানাে হয়। মুক্তিযুদ্ধে জলিল। ষাটের দশকের শুরুতে স্বাধীনতার যে চেতনা বুকে ধারণ করেছিলেন সেই চেতনার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগে তিনি একটি ব্রিটিশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২৬ মার্চ ছিলেন কিশােরগঞ্জের গ্রামের বাড়ি। যুদ্ধ শুরুর খবর পেয়ে সকালেই তার এক মামাতাে ভাই মাে. আতিককে নিয়ে মােটর সাইকেলে করে কিশােরগঞ্জ শহরে পৌঁছেন। তার সেই মামাতাে ভাই আতিক পরে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে ভৈরবেই শহীদ হন। কিশােরগঞ্জে আওয়ামী লীগসহ স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার নানাদিক দিয়ে আলােচনা করেন এবং স্থানীয়ভাবে লােকজনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় তিনি প্রথম জিয়াউর রহমান নামে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার নাম শুনতে পান। বললেন, “ওই সময়ের সঠিক তারিখ আমার মনে নেই, শুনেছি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেতারে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু তাঁদের সঙ্গে আছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে আমি এলাকায় কিছু লােককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলাম, এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা কিশােরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতে চলে যাই। পরে কোলকাতায় গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনছুর আলী প্রমুখের সঙ্গে দেখা করি। তারা আলােচনা করে আমাকে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে ৬নং সেক্টরে কাজ করার জন্য বলেন। এর আগেই আমি তাদের কাছে অনুরােধ করেছিলাম আমাকে যেন আমার নিজ এলাকার দায়িত্ব না দেন। কারণ ওই সময় এলাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটলে স্বাধীনতা অর্জনের পর এলাকাবাসীর সঙ্গে পরস্পর শক্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। আমাকে তখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নরসিংদীর রায়পুর এলাকায়। দেশ শত্রুমুক্ত না। হওয়া পর্যন্ত ওই এলাকায় প্রতিরােধ আন্দোলনে নিয়ােজিত ছিলাম।”

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক