জেলাখানায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা – কর্নেল (অব.) শামসুল আলম
ছােটকাল থেকেই ব্রিটিশকে তাড়ানাের জন্য সূর্যসেন। প্রীতিলতা প্রমুখের সংগ্রামী কাহিনী পড়তাম এবং এরকম একটা স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বাদ গ্রহণের জন্য উদগ্রীব ছিলাম। ৪৮ সালে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলে বিপুল জনসমাগম হয়। তাঁর বক্তৃতা শােনার জন্য অন্যদের মতাে আমি এবং খুরশিদ উদ্দিন রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে চরম হতাশ হই। তাঁর উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এমন বক্তব্য শুনে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন জ্বলে উঠে। সেদিন ক্ষোভে সঙ্গে সঙ্গে সভা থেকে চলে আসি। সেই থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সময় তাঁদের বিমাতাসুলভ আচরণ দেখে আমি পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই- যে করেই হােক। পাকিস্তানিদের এদেশ থেকে তাড়াতে হবে।’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের মতাে কঠিন সংগ্রামের ঝুঁকি নেওয়ার প্রেক্ষাপট এভাবেই বর্ণনা করলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, আগরতলা মামলার ২৪নং আসামি মুক্তিযােদ্ধা। ডা. শামসুল আলম। শামসুল আলমের আদি বাড়ি রংপুর জেলায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তার বাবা ড. শামসুদ্দোহা কলকাতায় মারা যাওয়ার পর থেকে পুরােনাে ঢাকার লালবাগ এলাকার নানার বাড়ি খাজে দেওয়ান-এ থেকে বড় হয়েছেন তিনি। শামসুল আলম ১৯৪৮ সালে ঢাকার আরমানিটোলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি এবং ৫৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
দেশের জন্য কিছু করার সংকল্প নিয়ে তিনি ১৯৫৯ সালে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যােগ দেন ক্যাপ্টেন পদে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের আবােটাবাদে সামরিক প্রশিক্ষণ ও করাচিতে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষে রাওয়ালপিন্ডির মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কোয়েটা এবং পেশােয়ারের নওশেরায় দায়িত্ব পালন করেন। মামলার ৩৪ নং আসামি ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. খুরশিদ উদ্দিন শামসুল আলমের মেডিকেল কলেজের শিক্ষাজীবনের বন্ধু। ১৯৬২-৬৩ সালে ডা. খুরশিদের মাধ্যমে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমের সঙ্গে করাচিতে প্রথম পরিচয় হয় শামসুল আলমের। তবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার গােপন প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত হন ৬৫ সাল থেকে। ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি রাত আটটায় তার গুলশান বারিধারায় অবস্থিত বাসায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বিস্তারিত। কুমিল্লা সেনানিবাসে সদস্য সংগ্রহ সেনাবাহিনীতে যােগ দেওয়ার পর থেকে পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের নানাদিক, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের পটভূমি বর্ণনা করেছেন তিনি এভাবে: “চাকরিতে যােগ দেওয়ার অল্প কদিনের মধ্যে দেখি পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের প্রতি যখন তখন, অমানবিকঅবমাননাকর আচরণ করছে। নিয়ম ছিল মেসে কেউ এমন কথা বলবে না বা ব্যবহার করবে না যাতে অনন্যর বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে। একদিন আমি ও আমার এক সহকর্মী চক্ষু বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (পরে কর্নেল) সালাম বাংলায় আলাপ করছিলাম। অন্যদিকে দুজন পাঞ্জাবি অফিসার তাদের ভাষায় কথা বলছিলেন। তারা হঠাৎ আমাদের তীরস্কারের সুরে বললেন, “মেসে কী ভাষায় কথা বলতে হয় জান না!’ আমি বললাম, “তােমরা যে ভাষায় বলছাে সেটা কোন ভাষা? তােমাদের পাঞ্জাবি ভাষা নিশ্চয়ই পাকিস্ত েিনর জাতীয় ভাষা নয়।’ তখন তারা চুপ হয়ে যান। কিন্তু এভাবে কটাক্ষমূলক কথায় পরস্পরের মধ্যে মতবিরােধ ও স্নায়ুযুদ্ধ বাড়তে থাকে।
৬২-৬৩ সালে আমি পেশােয়ারের নওশেরায় কমান্ডাে ব্যাটেলিয়নের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সে সময় একদিন ছুটি নিয়ে করাচিতে ক্যাপ্টেন খুরশিদের বাসায় যাই। উদ্দেশ্য ছিল তাদের জায়গায় পরিবেশ যাচাই করা। খুরশিদ আমাকে এক বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে কথায় কথায় পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং বাঙালিদের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে এসব বিষয় উঠে আসে। তাদের কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা না বললেও মনে হয়েছে তারা কিছু একটা করার চিন্তা করছেন এবং এ ব্যাপারে আমাকে যাচাই করে দেখছেন। ৬৪ সালে আমি বদলি হয়ে ঢাকায় আসি। ৬৫ সালের শেষ দিকে রিক্রুটিং মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়ােগ পেয়ে পরিবারসহ কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থান করি। সে সময় একদিন খুরশিদ চিঠি দিয়ে আমাকে জানায় লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম আসবেন, আমি যেন তাকে প্রয়ােজনীয় সাহায্য করি। ইতিমধ্যে মােয়াজ্জেম বাংলাদেশে এসে চট্টগ্রামে যােগ দিয়ে আমাকে ফোন করে তার কাছে যাওয়ার অনুরােধ করেন। আমি বিভিন্ন জায়গায় রিক্রুটিংট্যুরে যেতাম। সে হিসেবে। চট্টগ্রামেও চিটাগাং স্যুটিং ক্লাবে (রাইফেল ক্লাব) গেলে মােয়াজ্জেম সেখানে আসেন। কিন্তু সেখানে কথা বলা নিরাপদ হবে না ভেবে আমার এক আত্মীয়ের (সড়ক ও জনপথ বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ারিং মশিউর রহমান) বাসায় গিয়ে কথা বলি। ওই সময় তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘এই পরিকল্পনার সাথে সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্স, আহমদ ফজলুর রহমান, খুরশিদসহ অনেকে আছেন। করাচিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। তবে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন, তিনি যেহেতু সংসদীয় রাজনীতি করেন, তাই সরাসরি জড়িত থাকতে পারবেন না।
তবে আমাদের কাজে তার সব রকম সমর্থন সহযােগিতা থাকবে। সব কথা শুনে আমি স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হই। বঙ্গবন্ধু কীভাবে, কি কি সাহায্য করেছেন সে ব্যাপারে আমি তেমন কিছু না জানলেও খুরশিদ এবং আমার আর এক বন্ধু কামাল বলেছিলেন যে তিনি (বঙ্গবন্ধু) অর্থসহ নানাভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করছেন। আমারও মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু না থাকলে রুহুল কুদুস, আহমদ ফজলুর রহমান, শামসুর রহমান- এঁরা জড়িত হতেন না। মােয়াজ্জেমের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আমি কুমিল্লা সেনানিবাসে সমমনাদের সাথে আলাপ করে সমর্থক সংগ্রহের কাজ শুরু করি। প্রথমে ক্যাপ্টেন শওকত আলীর সঙ্গে কথা বলি এবং দুজনেই একই লক্ষ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। শওকতের মাধ্যমে অর্ডিন্যান্স এর আলীম ইয়া (রাজশাহী), আমার মাধ্যমে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) মােতালেবসহ আরও কয়েকজন আমাদের সদস্য হয়। জুনিয়র একজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলে মনে হলাে, তাঁর সঙ্গে। মােয়াজ্জেমের আগে থেকে যােগাযােগ ছিল। সেও তার মতাে কিছু লােক সংগ্রহ করে। ওই সময় মাহবুবুর রহমানকেও (পরে সেনা প্রধান) আগ্রহী দেখা যায়। আমাদের গ্রুপে প্রধানত আমি, শওকত, মােতালেব ও আলীম ভূঁইয়া ছিলাম প্রধান। এক পর্যায়ে দেখি নূরুজ্জামান এবং নাজমুল হুদাও এ তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন। তারা দাউদকান্দিতে এলে আমরা এদিক থেকে গিয়ে আলাপ করতাম। আমার বাসায়ও কয়েকটা বৈঠক হয়েছে। মােয়াজ্জেম, স্টুয়ার্ড মুজিব, এবি খুরশিদ এরাও কয়েকবার এসেছে। রমিজের মােহাম্মদপুরের বাসায় একটা বৈঠকে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে খান শামসুর রহমানও ছিলেন। ওই বৈঠকে আমরা কোনাে সিনিয়র অফিসার বিশেষ করে ওসমানী সাহেবের মতাে যােগ্য ব্যক্তিকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাখার প্রস্তাব করি। এভাবে অত্যন্ত গােপনে সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে আমাদের সদস্য ও সমর্থক বাড়ানাের চেষ্টা চলছিল।
কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানাের আগেই আমাদের পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যায়।” যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর গ্রেপ্তার ও মামলায় জড়ানাের অভিজ্ঞতার কথা জানান কর্নেল (অব.) শামসুল আলম বলেন, “ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান ছিলেন গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এর সঙ্গে যুক্ত। তিনি সেখান থেকে কিছু গােপনীয় খবরাখবর নিতে পারতেন। ৬৭ সালের কোনাে একসময় কর্নেল জামিল অথবা ব্রিগেডিয়ার রউফ এদের কেউ নূরুজ্জামানের মাধ্যমে এই বলে খবর পাঠান যে, তােমাদেরই কেউ গােপন তৎপরতার খবর ফাঁস করে দিয়েছে। কাজেই তােমরা কিছুদিনের জন্য চুপ হয়ে যাও। আপাতত কোনাে সভা করাে।’ এতে আমরা বেশ সাবধান হয়ে যাই। সদস্যদের কেউ কী খবর, কাজ কেমন এগােচ্ছে’ এ জাতীয় প্রশ্ন করতেই কৌশলগত কারণে না শােনার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিই। কিন্তু মােয়াজ্জেম সাহেব এসব ভালভাবে না নিয়ে নিজের মতাে করে চলতে লাগলেন। এরমধ্যে একদিন ঢাকা মেডিকেলে আমার মেয়ের জন্মের পর আমি তাকে দেখতে গেলে সেখান থেকে খুরশিদ আমাকে মােয়াজ্জেমের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার ভায়রার ধানমন্ডি ২নং সড়কের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে মােয়াজ্জেমের কথাবার্তায় মনে হলাে তিনি কিছুটা উচ্চাভিলাষ পােষণ করেন। এর অল্পদিন পর আমি স্বাস্থ্যের ওপর প্রশিক্ষণ নিতে রাওয়ালপিণ্ডি যাওয়ার জন্য মনােনীত হই। যাওয়ার কয়েকদিন আগে ৬৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা এসে আমার শ্বাশুরের শান্তি নগরের বাসায় উঠি। একদিন সকালে এক মেজর এসে বললেন, আপনি নাকি আমেরিকা যাচ্ছেন কোর্স করতে, আমি আমার এক আত্মীয়ের জন্য কিছু জিনিস পাঠাতে চাই। আমি আমেরিকা নয়-পিণ্ডি যাওয়ার কথা বললে তিনি ‘সরি’ বলে চলে যান। প্রসঙ্গত ইতিমধ্যে আমি মেজর পদে উন্নীত হয়েছি। এদিকে পিণ্ডিতে গিয়ে খবর পাই, মােয়াজ্জেম ও কামাল উদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
৬৮ সালের ৬ অথবা ৭ জানুয়ারি আমি কোর্স শেষ করে বাসায় এসে বিশ্রাম নেওয়ার সময় একজন মেজর এসে আমাকে কোনাে এক অজ্ঞাত মেসে নিয়ে যায়। সেখান থেকে নেওয়া হয় ইন্টারােগেশন সেলে। ওই সেলে ছিল অত্যন্ত ভীতিকর পরিবেশ- যা দেখে ভয়ে যে কারাে গা শিউরে ওঠার কথা। আমার এক খালু ছিলেন পদস্থ সেনা কর্মকর্তা। আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন না করলেও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে স্বীকারােক্তি আদায় করার জন্য। এর আগে দেশে থাকতে কোথায়, কখন, কার কার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, কী ধরনের পরিকল্পনা আমাদের ছিল, এমনকি হাসপাতালে মেয়েকে দেখতে গিয়ে সেখান থেকে যে মােয়াজ্জেমের কাছে গিয়েছি সবই তারা বলে দিচ্ছিল জিজ্ঞাসাবাদের সময়। এরপর নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে পিণ্ডির এক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে তাঁদের মতাে তৈরি একটি জবানবন্দিতে সই দিতে বলা হয়। আমি জানতাম এরকম জোর করে নেওয়া জবানবন্দির তেমন মূল্য বিচারিক আদালতে নেই। তাই সই দিয়ে দিই। সপ্তাহখানেক পর আমি এবং শওকত (অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, পরে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার) কে একই বিমানে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। তবে কারাে সঙ্গে কেউ কথা বলিনি। ঢাকায় এনে প্রথমে সেনানিবাসের একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয় আমাকে। পরে দেখি পাশের কক্ষে খুরশিদ। কয়েকদিন পরই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি ঢাকা থেকে রাওয়ালপিণ্ডি যাওয়ার আগে আমার শ্বশুর বাড়িতে আমেরিকায় জিনিস পাঠানাের নাম করে যে দ্রলােক গিয়েছিলেন তিনি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপাইর কাছে জানা গেল তিনি গােয়েন্দা বিভাগের এক বাঙালি সদস্য। কিছুদিন পর আমাকে পাঞ্জাবি মেসে এবং আরাে পরে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে স্থানান্তর করা হয়।”
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বন্দি জীবন বন্দি জীবনের স্মৃতিচারণ করে কর্নেল (অব.) শামসুল আলম বলেন, “আমার কক্ষ ছিল নিম্নমানের কাপড়-চোপড় বিছানা- সবই ছিল সাধারণ ও নােংড়া। বঙ্গবন্ধুর কক্ষ ছিল মােটামুটি উন্নত। সােফা-চেয়ারের ব্যবস্থাও ছিল সেখানে। এই প্রথম আমি বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখি এবং তার আচরণে মুগ্ধ হই। তিনি আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি তাে জেলখানায় নতুন এসেছেন, কাপড়-চোপড়ও ময়লা। আমাকে তাে প্রায় সময় আসতে হয়। তাই সব তৈরি থাকে। তিনি একটি ট্যাংক দেখিয়ে বলেন, ‘ওই ট্যাংকে বিছানার চাদর, লুঙ্গি সবই দেয়া আছে, নিয়ে আপনারগুলাে বদলে ফেলুন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আমাকে অতি আপনজনের মতাে আপনি থেকে তুমি, তারপর তুমি থেকে তুই সম্বােধন করতে শুরু করেন। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন তিনি। সেখানে। আমি দেখেছি তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বগুণ। পাকিস্তান গােয়েন্দা বিভাগের (আইএসআইপি) প্রধান প্রায় এসে ওনাকে বােঝাতেন স্বীকারােক্তির ব্যাপারে রাজি হওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সকালে যখন হাঁটতেন তখন তাঁকে বােঝানাের জন্য আইএসআই প্রধান তার পেছনে পেছনে এমনভাবে হাঁটতেন যেন জমিদারের পেছনে পেছনে পেয়াদা যায় মাথা নিচু করে । পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী সাহাবুদ্দিন এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলে মুক্তি নিয়ে আলােচনার জন্য লাহোের যাওয়ার প্রস্তাব দিতে। মনে হলাে কিছু আওয়ামী লীগ নেতাও এ ব্যাপারে তাকে বুঝিয়ে নিমরাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু একদিন সকালে তার স্ত্রী বেগম মুজিব) এসে বললেন, তুমি নাকি প্যারােলে যাচ্ছ আলােচনার জন্য। তা করলে ছাত্রজনতাকে নিয়ে আমি তােমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামব।’ তখনই বঙ্গবন্ধু সরাসরি বলে দেন, না আমি প্যারােলে যাব না। মামলা তুলে নিয়ে সবাইকে মুক্তি দিলে তারপরই আমি আলােচনায় যাব। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছিল ধনে ধানে পুষ্পে ভরা, আমাদেরই বসুন্ধরা’ গানটি। গানটি গেয়ে | শােনাননার জন্য তিনি আমাকে প্রায় বলতেন। আমি আগে থেকেই সংস্কৃতিমনা ছিলাম।
মাঝে মাঝে গানটি গেয়ে শােনাতাম তাকে। এক সময় জেলখানা এলাকায় বাইরের লােকজনের যাতায়াতে একটু শিথিলতা এলে আমার আত্মীয়দের দিয়ে একটি টেপ রেকর্ডার আনাই । পরে সেটিতে গানটি বাজিয়ে তাকে শােনাতাম ” জেলখানায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝােলানাে সম্ভব হবে না-পাকিস্তানিরা সম্ভবত এটা | মামলা চলাকালে রাজপথের আন্দোলন দেখে বুঝতে পেরেছিল। আর তাই তাকে সেখানে কৌশলে হত্যার চক্রান্ত করেছিল তারা। আজাদ কাশ্মীরের অধিবাসী এক তরুণ নিরাপত্তা কর্মকর্তার আগাম হুশিয়ারি পেয়ে বঙ্গবন্ধু সতর্ক হয়ে গেলে সে চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের বন্দি জীবনের সঙ্গী শামসুল আলম বললেন সেই চক্রান্তের কথা: “সার্জেন্ট জহুরকে যেমন তুচ্ছ অজুহাত তুলে হত্যা করা হয়েছে সেরকম বঙ্গবন্ধুকে পালানাের চেষ্টার অজুহাতে গুলি করে হত্যার একটি চক্রান্ত হয়েছিল। তাকে অনেক সময় একা হাঁটতে দেওয়া হতাে।
আমাদের থাকার যে মেস তার পাশে দেয়াল এবং তারপরে ছিল ছােট্ট একটি রাস্তা। কিছু বেসামরিক লােকজনও ওই পথ দিয়ে অনেক সময় চলাচল করতাে। বঙ্গবন্ধু অনেক সময় ওই পথ পর্যন্ত হেঁটে আসতেন। সার্জেন্ট জহুরকে হত্যার আগে একদিন নিরাপত্তা কর্মকর্তাটি এসে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, স্যার আপনি হাঁটতে গেলে মেসের পাশের ওই দেয়ালের বাইরে যাবেন না, খারাপ খবর আছে।’ পরদিন দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে অন্যদিনের মতাে হাঁটার জন্য নিতে এলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। ওরা বিশেষভাবে অনুরােধ জানালে বঙ্গবন্ধু তাদের বললেন, দেখাে, ওইদিক দিয়ে এখন সিভিলিয়ানরাও যাওয়া আসা করছে। ওরা আমাকে চিনে ফেলবে এবং কথা বলতে চাইবে। কাজেই ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করি।’ সতর্ককারী তরুণ নিরাপত্তা কর্মকর্তাটি বঙ্গবন্ধুকে খুবই ভালবেসে ফেলেছিলেন এবং সম্মান করতেন। তিনি শহরের দিকে গেলে আমাদের জন্য মাঝে মাঝে পাউরুটি-কাবাব নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করার দুএকদিন পর এসে তিনি বিদায় জানিয়ে বললেন, ছুটিতে যাচ্ছেন। পরে খবর এল লােকটি মারা গেছেন। আমরা অবাক হলাম। নতুন নিযুক্ত এক নিরাপত্তা কর্মী জানায়, রাইফেল থেকে মিস ফায়ারে ওই অফিসারটি মারা গেছেন। তবে আমাদের ধারণা, চক্রান্তকারীরা হয়তাে বুঝতে পেরেছিল, উনিই বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাই কৌশলে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।” মুক্তির সুসংবাদ কর্নেল (অব.) শামসুল আলমের কাছ থেকে জানা যায়, মামলা প্রত্যাহার এবং ২২ ফেব্রুয়ারি যে সবাই মুক্তি পাচ্ছেন সে কথা বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে জানতে পারেন। ওইদিন কয়েকজন কর্মকর্তা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি তাদের সঙ্গে বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় শামসুল আলমকে বলে যান, ‘আমি একটা মিটিংয়ে যাচ্ছি। সম্ভবত মামলা উঠে যাবে। তুই আমার জামাটা স্ত্রী করে রাখিস।’ কয়েক ঘণ্টা পর রাতেই তিনি ফিরে এসে বহু প্রতিক্ষীত মুক্তির সুসংবাদটা দেন শামসুল আলমকে। সেই আনন্দঘন সময়টার স্মৃতি হাতরে শামসুল আলম বললেন, “বঙ্গবন্ধু যাওয়ার পর মনটা অস্থির হয়ে উঠছিল । কিন্তু রাতেই ফিরে আসায় উৎকণ্ঠা কেটে যায়। এসেই তিনি বললেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। মামলা উঠে যাবে। আমাকে খুব সকালেই নিয়ে যাবে এখান থেকে। কারণ বাইরে ব্যাপক লােকসমাগম হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। তাই সবাইকে আমি বলতে পারব না। তুই সকালে সবাইকে বলে দিস। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসা সেনা কৌসুলি এবং আমাকে তিনি অভিনন্দিত করলেন। খুব সকালেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর কথামতাে আমি অন্যদের মুক্তির সুসংবাদটা জানিয়ে দিই। মুক্তির ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়াগুলাে সারতে একটু সময় লাগে। অবশেষে ওইদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ১৩-১৪ মাসের বন্দি জীবনের অবসান ঘটলে সংশ্লিষ্ট সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।” বিশ্বসের প্রতিফলন একাত্তরে শামসুল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। বললেন, ‘আমাদের বিশ্বাস ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই দেশ স্বাধীন হবে।
শেষ পর্যন্ত একাত্তরে এসে তাই হয়েছে। সেই যুদ্ধেও নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরেছি এটাও একটা সান্ত্বনা।’ এভাবেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা শামসুল আলম জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্ত নি সেনারা। তার বড় ভাই চট্টগ্রাম টিঅ্যান্ডটির কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে এপ্রিলেই একটি সভায় যােগ দিতে নেওয়ার কথা বলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। স্ত্রীর বড় বােনের স্বামী চট্টগ্রাম বন্দরের একজন কর্মকর্তা কাজী গােলাম আনসারী সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের বিরােধিতা করছিলেন বলে তাকে হত্যা করে পাকসেনারা। খালাতাে বােনের স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মুকতাদিরকে অন্তঃসত্তা স্ত্রীর সামনে গুলি করে মেরে চারতলা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। এসব বেদনাদায়ক ঘটনায় শামসুল আলমের মাসহ সবাই ছিলেন দিশেহারা অবস্থায়। সবকিছু সামলে যুদ্ধে যেতে তার কিছুটা দেরি হয়ে | যায়। আগস্ট মাসে তিনি ২নং সেক্টরে গিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানাে হয় আগরতলা। সেখানে মেডিকেল সার্ভিস বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাসহ শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবায় দায়িত্ব পালন করেন। পরে কলকাতা সদর দপ্তরে বদলি হন। স্বাধীনতার পর তাকে ‘৬৯ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সময়কালের আর্থিক সুবিধা বাদ দিয়ে সিনিয়রিটি বজায় রেখে সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল রাখা | হয়। পরে কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে | হত্যার পর থেকে সেনাবাহিনীতে অস্থির পরিবেশ দেখা দেয়। এতে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ‘৭৬ এর এপ্রিলে অবসর নেন শামসুল আলম।
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক