You dont have javascript enabled! Please enable it!
কর্ণেল (অব.) মােস্তাফিজও নির্যাতন করেছিলেন- মাহফুজুল বারী
কথিত আগরতলা মামলার ২২ নং আসামি মাহফুজুল বারী পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যােগ দেন ১৯৫৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর করাচির স্কুল অব এরােনটিকস থেকে বিমানের যন্ত্রপাতি (ইন্সট্রুমেন্ট) বিভাগে তিন বছর লেখাপড়া শেষ করে করাচিতে আইউব খানের ভাইস কাউন্ট ডিভিশনে যােগ দেন। করাচিতে অবস্থানকালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচার-আচরণ দেখে ওই রাষ্ট্রের প্রতি তার অনাস্থা এসে যায়। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে তিনি দুই মাসের ছুটিতে চট্টগ্রাম আসেন। ওই সময় কোনাে একদিন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের এক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এতে শেখ মুজিব পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের যে চিত্র তুলে ধরেন তা মাহফুজুল বারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি মনে করেন এতে তার অন্তরে গুঞ্জরিত কথারই প্রতিধ্বনি ঘটেছে। ওই বক্তৃতা শুনেই তিনি শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। মাহফুজুল বারী স্বাধীনতার পর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপ-প্রধান হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি কানাডা চলে যান। ২০০৯ সালে মাঝামাঝি সময়ে তাঁর ছােট ভাই চট্টগ্রামের বিশিষ্ট চিকিৎসক এমএম বারীর মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য জানতে চাই।
ওই বছরের শেষ দিকেই তিনি চট্টগ্রাম আসেন। মাসখানেক পর ২০১০ সালে ১৫ জানুয়ারি এমএম বারীর রহমতগঞ্জস্থ বাসভবনে বসে এ লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাহফুজ জানান বিপ্লবী সংগঠনে যােগদানের প্রেক্ষাপটসহ বিস্তারিত। তার বক্তব্যের সার কথা : পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মস্থলে থাকার সময় দেখি সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি চাকরিজীবীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, লাঞ্ছনা, সামান্য কারণে চাকরিচ্যুতি এবং পদোন্নতি বৈষম্যের ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমরা জানতে পারি কেন্দ্রীয় সরকারে সচিব পর্যায়ে একজন বাঙালিও ছিলেন না। বিদেশের ১২৬টি দূতাবাসে বাঙালি রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ পেয়েছিলেন মাত্র একজন। সহকর্মী-বন্ধুমহলে আলােচনা হতাে কীভাবে এসব অত্যাচার ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ১৯৬৫ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান করাচি আসছেন জানতে পেরে বিমান বন্দরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি আমার বিমান বাহিনীর দুই বন্ধু সদস্য হাবিবুর রহমান এবং বেলায়েত হােসেনকে নিয়ে। সেখানে সিন্ধান্ত অনুযায়ী একান্ত আলাপের জন্য পরে আমরা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বড় মেয়ে আখতার সােলায়মানের বাসভবন লাকামা হাউসে যাই। আমাদের ওপর পাকিস্তানিদের শােষণ-বঞ্চনার কথা শুনে শেখ সাহেব বললেন, ‘দেশের প্রতিনিধি হয়ে যাঁরা আসেন তারা পাকিস্তানি শিল্পপতিদের টাকার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কাজেই অত্যাচার-বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।’ সেদিন তার কথাবার্তায় দেশপ্রেমের যে পরিচয় পাই তাতে স্বাধীনতা সগ্রামের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতায় যুক্ত হতে সাহস ও অণুপ্রেরণা পাই।
ইতিমধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক হয় বিমান বাহিনীর করপােরাল সিরাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজ উল্লাহ, সার্জেন্ট জহুরুল হক, নৌবাহিনীর লে. মতিউর রহমান, কমান্ডার আবদুর রউফ, টেক্সটাইল কোম্পানির ব্যবস্থাপক মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে। লে. মতিউর রহমান এবং সার্জেন্ট জলিলের বাসায় বিভিন্ন সময় আলােচনায় দেশকে স্বাধীন করার ব্যাপারে আমরা একমত হই। পরে জানতে পারি লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমের নেতৃত্বে এ ব্যাপারে কার্যক্রম আগেই শুরু হয়েছে এবং এতে জনগণের পক্ষে নেতা হিসেবে বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান সব রকম সাহায্য করবেন। ইতিমধ্যে মাওলানা ভাসানী, মশিউর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মশিউর রহমান, সবুর খান, ফরিদ আহমদ, ইউসুফ আলী প্রমুখ নেতার সঙ্গে যােগাযােগ করা হলেও তারা কেউ আমাদের এ কাজে সহযােগিতা করতে রাজি হননি। এরমধ্যে নৌ, বিমান এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিশ্বস্ত লােকজন নিয়ে পৃথক দল সৃষ্টি করেন। আমি নিজে আমাদের একজন সদস্যের মাধ্যমে তখনকার মৌরিপুর (করাচি) বিমান বাহিনীর রেকর্ড কার্যালয় থেকে ব্যক্তিগত ফাইল সরিয়ে ফেলি যাতে অন্য কোথাও বদলি না হয়ে করাচিতে থেকেই সংগঠনের কাজ চালিয়ে যেতে পারি। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, দেশ স্বাধীন করার জন্য সশন্ত্র সংগ্রামের কথা সবাই জানলেও এর বাস্তবায়নের কৌশল সবার পুরােপুরি জানা ছিল না। দুঃখের বিষয়, বিমান বাহিনীর বাঙালি সদস্য করপােরালআমীর হােসেন সব পরিকল্পনা ফাঁস করে দিলে আমাদের ওপর দুর্যোগ নেমে আসে। শেখ সাহেবসহ আমাদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের হয়।
 
গ্রেপ্তার ও নির্যাতন পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ। হয়ে পড়েন মাহফুজুল বারী। তারপর চোখের পানি মুচতে মুচতে বলেন, “বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িতদের ধরপাকড় শুরু হলে অন্যদের মতাে আমাকেও করাচি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয়। এরপর শুরু করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। আমার আত্মীয়স্বজন জানতাে না আমি কোথায় আছি, জীবিত না মৃত। টর্চার সেলে নিয়ে পা বেধে উপুড় করে ঝুলিয়ে পায়ের তালুতে পেটানাে, গুহ্যদ্বারে বরফ ঢােকানাে, কক্ষে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদাতিক বাতি জ্বালিয়ে ঘুমােত না দেওয়াসহ নানা রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানাে হয় আমার ওপর। মামলা শুরু হওয়ার পর নির্যাতন বন্ধ এবং আসামিদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের কিঞ্চিৎ সুযােগ মেলে। বিচার চলাকালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মানিক চৌধুরী খ্যাত ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ও বিধান কৃষ্ণ সেনের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। অবস্থা দেখে এবং জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম আমাদের অনেকের তুলনায় মানিক চৌধুরী, মােয়াজ্জেম হােসেন, বিধান সেন ও স্টুয়ার্ড মুজিবের ওপর নির্যাতনের মাত্রা ছিল সীমাহীন।’ কর্ণেল (অব.) মােস্তাফিজ প্রসঙ্গ আগরতলা মামলার কথিত আসামিদের ওপর জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনকারী পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের কথা বলতে গিয়ে কর্ণেল (অব.) মােস্তাফিজুর রহমানের (৯১ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী) ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন মাহফুজুল বারী বলেন, তিনি একমাত্র বাঙালি সেনা কর্মকর্তা যিনি আগরতলা মামলায় বন্দী অবস্থায় আমাদের জেরা এবং শারীরিক নির্যাতনকারীদের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
মন্ত্রীত্ব পাওয়ার সম্ভবত এটাই ছিল তার যােগ্যতা। মাহফুজুল বারী জানান, মামলা চলাকালে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনার স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়া তৎকালীন ডাকসু নেতা তােফায়েল আহমদকে নিয়ে আত্মীয় পরিচয়ে কারাগারে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তারা বঙ্গবন্ধুসহ আসামিদের মুক্তির আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপে তার পরিকল্পনার একটা বিশেষ দিক আমি বুঝতে পেরেছিলাম-সেটা হলাে তিনি যারা অস্ত্র ধরার পক্ষে তাদেরকে অস্ত্রের মাধ্যমে এবং যারা রাজপথের আন্দোলনে আগ্রহী তাদেরকে সেভাবে স্বাধীনতার জন্য তৈরি হতে উৎসাহিত করেছিলেন। এদিকে আগরতলা মামলাকে ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যায়িত করে রাজপথে ছাত্রজনতার আন্দোলন শুরু হয়। এরমধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে। হত্যা করা হলে আন্দোলন আরাে তীব্র হয়। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার বিনা শর্তে। মামলা প্রত্যাহার করলে সবাই মুক্ত হন। সারা দেশে বয়ে আয় আনন্দের বন্যা। মুক্তি পাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে অভিযুক্তদের মধ্যে তিনি (মাহফুজ), মানিক চৌধুরী ও বিধান সেনকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
 
মুক্তিযুদ্ধে মাহফুজ ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অল্প কিছুদিন পর মাহফুজ ভারত চলে যান যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, “৬৯ এর গণআন্দোলনের পর আমাদের বিপ্লবী কর্মকান্ড স্থগিত হলেও পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধ যে একটা হবে সেটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। মনে পড়ে, ৭০ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের পর বঙ্গবন্ধু ত্রাণ বিতরণের জন্য হাতিয়া এসেছিলেন। আমি সেখানে সমম্বয়ের কাজ করছিলাম। আমার এখনাে কানে বাজে, বঙ্গবন্ধু সেদিন আমার হাতে এক টাকার দুইশটি নােটের একটি বান্ডিল দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, “তােরা তৈরি থাকিস। সময়মতাে দেশ স্বাধীন করবাে। তােরা তােদের কাজ চালিয়ে যাবি।’ যুদ্ধ চলাকালে আমি প্রথমে সাবরুমে গিয়ে আতাউর রহমান খান কায়সার ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। পরে ত্রিপুরার উদয়পুরে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিংয়ের অধীনে থেকে মেজর রফিক ও খালেদ মােশাররফের এক ও দুই নম্বর সেক্টরের সমর্থনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গােয়েন্দা কাজে নিয়ােজিত হই। এই কাজে সাবেক সিংয়ের কার্যালয়ে গিয়ে সেখানে একদিন হঠাৎ দেখি মানিক চৌধুরী। আমি তাকে উচ্ছসিত হয়ে সম্বােধন করি ফাইন্যান্স মিনিস্টার হিসেবে। কারণ পাকিস্তান আমলে আমাদের সশস্ত্র প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড চালাতে যে অর্থ খরচ হতাে তার অন্যতম উৎস ছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বললেন, দেশ স্বাধীন হবে। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু জাতির শত্রুরা হয়তাে অচিরেই তাঁর ওপর আঘাত হানবে। প্রায় একই কথা বলেছিলেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রামের মরসরাইয়ের নিজাম উদ্দিন।”
মাহফুজ বলেন, ‘আমার জানামতে, একাত্তরে গ্রেপ্তার হবার আগেই বঙ্গবন্ধু মানিক চৌধুরী এবং বরিশালের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য চিত্তরঞ্জন সূতারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভারতে অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজ করার জন্য। সে সময় দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িও ভাড়া করা হয় দাপ্তরিক কাজের জন্য। এরকম পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে ভারতের মাটিতে থেকে তাদের সাহায্য না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চালানাে এবং দেশ স্বাধীন করা এতাে সহজ ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপ-প্রধান নিযুক্ত করেন। মাহফুজুল বারীর পৈত্রিক বাড়ি নােয়াখালী জেলার রামগতি হাটের চরলক্ষ্মী গ্রামে। তার বাবা এ কে মােমাজ্জাদ ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। থাকতেন চট্টগ্রামের জয়নগর এলাকায়। আতাউর রহমান খান কায়সার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বেলাল বেগ প্রমুখ ছিলেন তার সহপাঠী। ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল ছাত্র-রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। ১৯৫৬-৫৮ শিক্ষাবর্ষে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ৫৯ সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যােগ দেন।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!