দেউলিয়ার পথে পাকিস্তান
বাঙালীর রক্তের দাম এত বেশী তা আগে বােঝে নি ইয়াহিয়া খান। চার সপ্তাহ ধরে বাঙলাদেশে চলছে। গণহত্যা। পাক সৈন্যদের চাহিদা মেটাতে ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে প্রায় পনের কোটি টাক। লড়াই যদি বেশী দিন চলে তবে প্রতিমাসে বাঙালী হত্যায় ইসলামাবাদের খরচ পড়বে মাসে প্রায় ষােল কোটি টাকার মত। বাঙলাদেশ ছিল পাকিস্তানের সােনার খনি। বাঙালীর অর্জিত বিদেশী মুদ্রার নবাবী করত পশ্চিমের অবাঙালীরা। খুশ মেজাজে তারা অস্ত্র কিনত এবং যাকে তাকে চোখ রাঙ্গাত। যে যে বুলেটগুলাে আজ বাঙালাদেশের বুক চিরে ফেলছে তার অধিকাংশই কেনা হয়েছিল বাঙালীর টাকায়। বাঙলাদেশের রপ্তানী পণ্য এখন যায় না বিদেশী বিদেশী মুদ্রা অর্জনে পড়েছে ভাটা। মজুত বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ যাচ্ছে কমে। আর কিছুদিন লড়াই চললে ওটা পৌছবে শুন্যের কোঠায়। চোখে এখন সরষের ফুল দেখেছেন। ইসলামাবাদের মুখের দল। ধারের জন্য তারা দিচ্ছেন দেশ-বিদেশের দরজায় দরজায়।
বিপদ যখন আসে তখন সব একসঙ্গে আসে। বিশ্বব্যাঙ্ক নাকি কান দিচ্ছে না ইসলামাবাদের কাতর আর্জিতে। যেসব দেশ বিভিন্নভাবে পাকিস্তানের উন্নয়নে সাহায্যে করতে প্রতিশ্রুত তারাও নাকি একে একে হাত গুটাচ্ছে। ঋণের প্রতিশ্রুতি নাকি কিছু দিনের জন্য তারা ঠাণ্ডা ঘরে রেখে দিতে উৎসুক। এ সংবাদ যদি সত্যি হয় তবে পাকিস্তানের দেউলিয়া হতে বেশী দেরী লাগবে না। টাকার মূল্যমান হ্রাস করলেও শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া কুল রক্ষা করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। আমেরিকা, জাপান এবং পশ্চিম ইউরােপ পড়েছে মহাসংশয়ের মধ্যে। বাঙলাদেশে যেসব উন্নয়ন ব্যবস্থা তাদের নেবার কথা তা আপাতত স্থগিত রাখা ছাড়া উপায় নেই। ইয়াহিয়ার হাতে পৌছবে না বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের প্রতিশ্রুত এই টাকা। তাছাড়া অন্যান্য খাতের ঋণ দিলেও তা শােধ করার ক্ষমতা পাকিস্তানের থাকবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে গভীর সন্দেহ। অনেকের ধারণা, আগের ঋণের বার্ষিক সুদও ইসলামাবাদ দিতে পারবে না। এ অবস্থায় সবাই নাকি হাত গুটাবার কথা ভাবছে। এটা বাঙলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য ইয়াহিয়ার উপর পরােক্ষ চাপ কিনা বলা মুস্কিল। ১৯৫৬ সালে আমেরিকা ফাঁদে ফেলেছিল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ইডেনকে। তখন চলছিল সুয়েজ অভিযান। মার্কিন আপত্তি গ্রাহ্য করেন নি তিনি। আমেরিকার সমর্থন হারাবার সঙ্গে সঙ্গেই পাউন্ডের উপর পড়ল অসম্ভর চাপ। মার্কিন ইঙ্গিতে বিশ্বব্যাঙ্ক বেকে বসল। চোখে অন্ধকার দেখলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী। মাঝপথেই থেমে গেল সুয়েজের লড়াই। লেজেগােবরে একাকার হয়ে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় নিলেন ইডেন। আমেরিকা যদি সত্যিই বাঙলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করতে চায় তবে ইয়াহিয়াকে আর্থিক চাপে একেবারে গুড়িয়ে ফেলতে তার বেশী সময় লাগার কথা নয়। আসল প্রশ্ন সে আন্তরিকতা মার্কিন কর্তৃপক্ষের আছে কিনা।
পাকিস্তানের বৈদেশিক মজুত মুদ্রার পরিমাণ এখন বিপদসীমার বহু নীচে নেমে গেছে। দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ইয়াহিয়া ক্রমেই হারিয়ে ফেলেছেন। হামাগুড়ির পর্যায় কিছুদিনের জন্য এড়াতে হলে তাঁকে অবশ্যই বিদেশী পণ্য আমদানী কমাতে হবে। এর মধ্যে পড়বে কল-কারখানাগুলাের কাঁচামাল। বাঙলাদেশের পণ্যও যাচ্ছে না পাকিস্তানে। ওদের কল-কারখানাগুলাে চালু রাখার জন্য এসব পণ্য দরকার। ওদের শিল্পজাত পণ্যও আসছে না বাঙলাদেশে। সুতরাং ভবিষ্যতে উৎপাদন হ্রাস হতে বাধ্য। বাঙলাদেশের বাজার অচল হবার ফলে গুদামে জমে উঠেছে হরেক রকমের পণ্য। বাজার নেই। বিক্রী হবে কোথায়? ফলে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে কল-কারখানাগুলাের কাজ। শুরু হবে কর্মী ছাটাই এবং ক্রমবর্ধমান বেকারী। পাকিস্তানের উপর আর্থিক সঙ্কটের কালাে মেঘ ঘনীভূত। সামরিক ডিকটেটর ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর উপদেষ্টারা বাঙলাদেশে সর্বাত্মক অভিযান আরম্ভের আগে অর্থনৈতিক দিকটা ভেবে দেখেন নি। ন্যায়ের অমােঘ দণ্ড ক্রমে ক্রমে নেমে আসছে তাদের উপর। বুদ্ধিতে ওরা নিজেরা দেউলিয়া এবং পাকিস্তানকেও করছেন দেউলিয়া। হাড়ে-হাড়ে এখন বুঝছেন বাঙালীর রক্তের দাম বড় চড়া।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ এপ্রিল ১৯৭১