রক্তের বদলে রক্ত চাই
আবার ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চলে ঢুকেছিল পাক-সৈন্যরা। ঘটনাটি ঘটেছিল শনিবার সকালে। দিনাজপুরের রাধিকাপুরে হানাদারী চালিয়েছিল ইয়াহিয়ার ঘাতকদল। করেছিল বেপরােয়া গুলীবর্ষণ। তাদের আক্রমণে মারা গেছে একটি বালিকা। আহত হয়েছেন চৌদ্দজন নারী-পুরুষ। শরণার্থীরা বাদ যান নি। ওদের শিবিরে পড়েছিল পাক-গােলা। রেলষ্টেশনে কাজে ব্যস্ত ছিলেন একজন ইঞ্জিন ড্রাইভার। আহত অবস্থায় তাকেও পাঠানাে হয়েছে হাসপাতালে। ভারতীয় এলাকায় পাক-হামলা নূতন কিছু নয়। এর আগেও এধরনের ঘটনা ঘটেছে। গত ঊনত্রিশে এপ্রিল উত্তর বাংলায় ভারতীয় ছিটমহল বাশপচাইএ নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে ইসলামাবাদের নেকড়ের দল। বাড়ীঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে। নির্বিচারে নারী-পুরুষ এবং শিশুকে হত্যা করেছে। হতাহতের সংখ্যা একশাের কোঠা ছাড়িয়ে গিয়েছে। মাত্র কদিন আগে চব্বিশ পরগণার বয়রা অঞ্চলে ঢুকে ওরা পাঁচজন ভারতীয় নাগরিককে গুলী করে মেরেছে। কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন নয়াদিল্লী। অভিযােগ অস্বীকার করেছেন ইসলামাবাদ। এতে অবাক হবার কিছু নেই। মিথ্যা নিয়ে যাদের কারবার সত্য। তাদের কাছে হারাম। আসল জবাব মিলেছে রাধিকাপুরে। বুলেটের ভাষায় উত্তর দিয়েছে পাকিস্তান। প্রতিপক্ষ মন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম সদম্ভে বলেছিলেন, ভারতীয় পাক-হামলা বরদাস্ত করা হবে না। রাধিকাপুরে তা বরদাস্ত করা হল কেন? রান্নায় ব্যস্ত ভারতীয় রক্ষীবাহিনীর পাচকও রেহাই পান নি। আহত অবস্থায় তাকেও আশ্রয় নিতে হয়েছে হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শরণার্থীরা থাকবেন সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে। কিন্তু সেখানেও তাদের নিরাপত্তা কোথায়? আক্রান্ত রাধিকাপুর রক্ষায় সীমান্তরক্ষীরা কিম্বা সৈন্যদল কি করেছিলেন তা আমাদের জানা নেই। অন্ততঃ সংবাদে তার প্রকাশ নেই। পাকহানাদাররা হামলা চালিয়ে কি অক্ষত অবস্থায় সরে পড়েছিল? কামান বন্দুক এবং গােলাগুলীর অভাব মুক্তিযােদ্ধা থাকতে পারে। ভারতেরও কি এগুলাের অভাব ঘটেছে? নয়াদিল্লী এখন কি করবেন? যথারীতি কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে চুপচাপ বসে থাকবেন? পাক কামানের গােলা দিল্লী না পৌঁছানাে পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কি টনক নড়বে না? একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌম মর্যাদায় আঘাত হেনে বিনা শাস্তিতে দুষ্কৃতকারীরা ফিরে যাবে—এটা কল্পনাতীত। অন্য কোন রাষ্ট্র যদি এমনতর ঘটনার সম্মুখীন হত তবে দস্যুদের ধড় এবং মাথা এক সঙ্গে থাকত না। কড়ায় গন্ডায় আদায় করত সে ক্ষতিপূরণ। ইয়াহিয়ার কাছে কেন ক্ষতিপূরণ দাবী করছেন না নয়াদিল্লী। একথা সত্য যে, ইসলামাবাদ গ্রাহ্য করবেন না ভারতের দাবী। দ্বিগুণ বিক্রমে পাকবেতার চালাবে ভারত বিদ্বেষ। জড় হবে নয়াদিল্লীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযােগের পাহাড়। কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজে নিষ্ক্রিয় থাকাটা শক্তিমানের লক্ষণ নয়। ওটা অপনিণামঙ্গশিতা। ওতে ঘেউ ঘেউ আওয়াজ বাড়বে ছাড়া কমবে না। নয়াদিল্লীর ভয়—প্রতিশােধ নিলে ভুট্টো-ইয়াহিয়া মৌকা পাবেন। তারা প্রচার করতে পারবেন— বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা চালাচ্ছেন জীবন-মরণ লড়াই। এই ছুৎমাগীয় মনেবৃত্তি পেয়ে বসেছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। পাক-হানাদারদের পিটুনি খেয়েও তারা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তাতে কি ইয়াহিয়ার প্রচারের উত্তাপ কমেছে? কমে নি এবং কমবেও না। আসন্ন বর্ষায় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ যত তীব্র হবে ভারত বিরােধী পাক প্রচারের উত্তাপও তত বাড়বে। ভাল মানুষ সেজে রেহাই পাবেন না নয়াদিল্লী। অধীর হয়ে উঠেছেন এপারের ভারতীয় জনতা। তাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ওপারের হত্যাকান্ডে বিষিয়ে গেছে সবার মন। দশ লক্ষ শরণার্থীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে তাদের অন্তর। ওদের লাঞ্ছনার কোন প্রতিকার করতে পারেন নি তারা। বাঙলাদেশ ভিন্ন রাষ্ট্র। এখনও পায় নি সে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনী তাদের পাইকারীহারে হত্যা করছে। ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। ওপারে গিয়ে মানবদ্রোহীদের শাস্তি দেবার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। এপারে যারা এসেছেন তারাও কি রেহাই পাবেন না পাক বর্বরতা থেকে? তাদের সঙ্গে কি একতরফা মার খাবেন ভারতীয় নাগরিক? কোথায় ভারতীয় সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীরা? কোথায় নয়াদিল্লীর প্রতিশ্রুতি? কোথায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সদম্ভ আস্ফালন? জওয়ানদের তাত অজানা নেই ভারতীয়দের। দেখেছেন তাঁরা বীর সৈনিকদের কজির জোর লাহাের রণাঙ্গনে। ক্ষেমকরণ এবং শিয়ালকোর্টে প্যাটন ট্যাঙ্কের মহাশ্মশান যারা সৃষ্টি করেছিলেন তারা অনায়াসেই পাক-দস্যুদের টুটি ছিড়ে ফেলতে পারেন। দরকার শুধু নয়াদিল্লীর সুদৃঢ় সঙ্কল্প। জওয়ানদের তারা বলুন ইয়াহিয়ার ঘাতকেরা ভারতের মাটি স্পর্শ করলে তাদের প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকবে ভারতের মাটিতে। যেখান থেকে তারা হামলা চালাবে ধাওয়া করতে হবে তাদের সেখানে। মানবতার চিকিৎসায় পাগলা কুকুরের পাগলামী সারে না। তাকে সাবাড় করাই আসল দাওয়াই। এ দাওয়াই এর প্রয়ােগ যতদিন না হবে ততদিন পাক সৈন্যদের দুঃসাহসে ভাটা পড়বে না। ভারতীয় এলাকায় ওদের হানাদারীর সংবাদ শুনতে চান না কোন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভারতীয়। তাঁরা চান প্রতিকার, প্রতিশােধ এবং রক্তের বদলে রক্ত।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ মে ১৯৭১