You dont have javascript enabled! Please enable it!
আইউবের চালটা ভুল ছিল- খান এম শামসুর রহমান
আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সরকারের পদস্থ আমলাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত সদস্য ১৯ নং আসামি সিএসপি অফিসার খান এম শামসুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মূখ্যমন্ত্রী (যুক্তফ্রন্ট আমলে), তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের প্রধান মন্ত্রী (১৯৮৫-৮৬) খান আতাউর রহমানের ছােট ভাই। তিনি। বাবার নাম ইমতিয়াজ উদ্দিন খান। ১৯২৭ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার বালিয়া গ্রামে তার জন্ম। খান শামসুর রহমান নিজ বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার পর ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক, ৪৪ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং ৪৮ সালে এমএ পাশ করেন। শামসুর রহমান জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তৎকালীন ছাত্র ও যুবনেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একজন প্রতিবাদী দৃঢ়চেতা ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। শামসুর রহমান ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫১ সালে। তিনি সিএসপি অফিসার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে সহকারী কমিশনার পদে যােগ দেন। পরবর্তীতে তিনি পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় মহকুমা প্রশাসক (এসডিও), জেলা প্রশাসক (ডিস্ট্রিকট ম্যাজিস্ট্রেড) উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে চাকরি করেন।
ষাঠের দশকের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িত অন্যদের সঙ্গে তার দু-একটি বৈঠক হলেও এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ সম্পর্কের বিষয় তিনি জানলেও তিনি নিজে বড় কোনাে ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করেন না। আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তারের আগে তিনি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়া-পাকিস্তান ইকোনােমিক্যাল কালচারাল অর্গানাইজেশন’ এর উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখান থেকে ৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে একটি বিভাগীয় সভায় যােগ দেওয়ার কথা বলে করাচিতে ডেকে এনে গ্রেপ্তার করা হয়। করাচিতে কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাঁকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ করেন। ১৯৭৫ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত ও ইতালীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। খান শামসুর রহমানকে প্রথমে চাপ দেওয়া হয় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি তাতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আসামি হিসেবে তার নাম চার্জশিটভুক্ত করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর বিকেল পাঁচটায় তার ধানমন্ডির ৮নং সড়কের বাড়ি বাতায়ন’ এ বসে দেওয়া সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন তিনি।
স্বাধীনতার জন্য একটি গােপন বিপ্লবী আন্দোলন প্রক্রিয়া এবং এতে নিজের ও বঙ্গবন্ধুর জড়িত থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে খান শামসুর রহমান বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির অল্প কিছু দিন পর থেকেই বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমা শাসকদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বিভিন্ন স্তরের বাঙালিদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়। আমরা নিজেরাও বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে বসলে আলাপচারিতায় বলাবলি করতাম ওদের সঙ্গে (পাকিস্তানের সঙ্গে) আর থাকা। যায় না। একটা কিছু উপায় বের করতে হবে। কিন্তু প্রকাশ্যে এ জাতীয় কথা বলার সাহস  তখন ছিল না কারও। শেখ মুজিবের কথাবার্তায় বােঝা যেত তার ভেতরেও স্বাধীনতার আকাক্ষা কাজ করে । ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শুনতে পাই, পশ্চিম পাকিস্তানে নৌ ও বিমান বাহিনীতে কর্মরত কিছু বাঙালি সদস্যের মধ্যে অসন্তোষ চলছে। তারাও কিছু একটা করার কথা ভাবছে। কমান্ডার মােয়াজেমের নেতৃত্বে একটা গ্রুপ সংগঠিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনাে রকম গােপন বা প্রকাশ্য বিপ্লবী প্রক্রিয়া সফল হতে পারে না। তাই তাঁরা মােয়াজ্জেমের নেতৃত্বে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা | করে তার সাহায্য চান। শেখ মুজিবও তাদের সঙ্গে ঠিক সময়ে যােগ দেওয়া ও প্রয়ােজনীয় সাহায্যের আশ্বাস দেন। তবে এ সম্পর্কে শেখ সাহেব আমাকে বিস্তারিত কিছু বলেননি।’| অপরিপক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ছাপ খান শামসুর রহমান জানান, বঙ্গবন্ধু ও বিপ্লবীদের সঙ্গে তার যােগাযোেগ থাকলেও তিনি ওই বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। প্রয়ােজন হলে প্রশাসনকে কাজে লাগানাে এবং বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনসহ খুটিনাটি বিষয়ে পরামর্শ বিনিময় করতেন।
বললেন, হয়তাে বয়সের কারণে অনেক কথা মনেও নেই।’ স্মৃতি হাতরে তিনি বলেন, ‘পুরােনাে বন্ধুত্বের সূত্রে শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রশাসনের ভেতর চলমান নানা বিষয়ে আলাপ | হতাে। লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেমের সঙ্গে পরিচয় ও বৈঠক হয় ১৯৬৬ সালের শেষ দিকে বিমান বাহিনীর রমিজের পাঁচলাইশস্থ বাসায়। সেখানে কমান্ডার মােয়াজ্জেম তাঁদের পরিকল্পনার কথা বলেন। মােয়াজ্জেম জানান, শেখ মুজিব তাঁদের কাজের প্রশংসা করেছেন। এবং কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। মােয়াজ্জেম তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষে আলাপ  করার জন্য আমাকে ভারতে যাওয়ার অনুরােধ জানান। কিন্তু আমি এটা সময়ােচিত এবং যথার্থ বলে মনে করিনি।’ শামসুর রহমান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে কাজটিতে যথেষ্ট পরিপক্কতা ও অনভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। প্রথম দিকে আমি এটাকে ছেলেমি মনে করেছি। আমি না যাওয়ায় তারা আলী রেজা ও স্টুয়ার্ড মুজিবকে আগরতলা পাঠান। কিন্তু তাঁরা দুজনই নিজ নিজ এবং প্রতিপক্ষের ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা কথা বলেছেন একজন ভারতীয় লে. কর্নেল ও মেজরের সঙ্গে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি সাধারণ অস্ত্র বের করতেও সর্বোচ পর্যায় অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি প্রয়ােজন ছিল। সেই পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রয়ােজন ছিল উভয় দেশের আরও অনেক উচ্চ পর্যায়ের লােকদের সম্পৃক্ততা। কিন্তু যে সময়ে যেভাবে তারা এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। সে সময়টি এবং প্রস্তুতিতে ছিল অপরিপক্কতা ও অনভিজ্ঞতার ছাপ।
ভাসানীর চাইতে বিপদজ্জনক শেখ মুজিব। বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে খান শামসুর রহমান বলেন, “শেখ মুজিব আমাকে এ ব্যাপারে সরাসরি কোনাে কথা বলেননি। তাঁর কথায় আমার মনে হয়েছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে তিনি নানাভাবে কাজ করেছেন। আর এ লক্ষে যারা যেখানে ভাবছেন বলে শুনেছেন সেখানে গিয়ে তাদেরকে তিনি উৎসাহিত করেছেন। একটা সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন যাতে প্রয়ােজনে ডাক দিলে প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে পারে। শেখ মুজিবের যে নেতৃত্বগুণ ও মানুষকে উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা ছিল সেটা আইউব খানকে ভীত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। কারণ দেখা গেছে, মাওলানা ভাসানী জনপ্রিয় নেতা এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও তাঁকে প্রভাবিত করে চালাতে পারতেন শেখ মুজিব। আমার বড় ভাই খান আতাউর রহমান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বা মূখ্যমন্ত্রীর মতাে পদে থাকলেও তাঁকেও বিপদজ্জনক মনে করতেন না আইউব খান। কিন্তু শেখ মুজিব সেই সময় থেকেই আইউব খানের কাছে ভাসানী বা অন্যদের চাইতে ক্ষমতাশালী ও বিপদজ্জনক মনে হয়েছে। তাই বিক্ষুব্ধ সেনা সদস্যদের সাথে যােগাযােগ এবং তাঁদেরকে সহযােগিতা দিয়ে উদ্দীপ্ত করার বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে আইউব শেখকে আগরতলা মামলার প্রধান আসামি করে তিনি ও তাঁর দলকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন বাঙালিদের ভেতরের জাগরণী শক্তিকে। আমার এক পরিচিত পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তাও মামলা চলাকালে আমাকে বলেছিলেন, ‘আইউব খানের মনে শেখের ব্যাপারে ভীতি আছে। তাই তিনি শেখকে শেষ করে দিয়ে মানুষের মন থেকে আন্দোলনের স্পৃহা মুছে দিতে চেয়েছেন।” শামসুর রহমানের মতে, ‘আইউবের চালটা ভুল ছিল। জনগণের মনে শেখ মুজিবের সম্পর্কে আস্থা এত গভীর ছিল যে, তাঁরা পুরাে মামলার বিষয়বস্তু এবং এতে শেখ মুজিবের জড়িত থাকার কথা অবিশ্বাস করেছে। বরং এই মামলায় কিছু লােক গ্রেপ্তার ও নির্যাতন ভােগ করলেও পরবর্তীতে এই ঘটনা স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্য সাধনে বড় ধরণের সহায়ক।
 
হয়েছে। আগে যে স্বাধীনতার কথা মানুষ প্রকাশ্যে বলার সাহস পেত না, এই মামলায় শেখ মুজিব ও অন্য আসামিরা খালাস পাওয়ার পরে পাকিস্তানের বিরােধিতা তথা স্বাধীনতা। অর্জনের দাবিটা সরাসরি তােলার সাহস জন্মে বাঙালিদের মনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবন বাজি রেখে সাহস করে সবার যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়াটাই এর বড় প্রমাণ। ‘পাকিস্তান আর এক থাকবে না’ ‘শেখ মুজিব আদৌ স্বাধীনতা চান নি’ কারও কারও এমন অভিমত সম্পর্কে খান শামসুর রহমান বলেন, ‘এটা ভুল ধারণা। ভাল করে না জেনেই কিংবা রাজনৈতিক কারণে কেউ কেউ এরকম মন্তব্য করে থাকতে পারেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সময় থেকেই আমি তাকে চিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছর জুনিয়র হলেও বয়সে আমার চাইতে সাত বছরের বড়। কলকাতা ইসলামীয়া কলেজে থাকতেই তিনি নেতা হন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমার এক বন্ধু (পরে হাইকোর্টের বিচারপতি আবদুর রহমান) কলকাতা থেকে আসা তরুণ নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার বড় ভাই খান আতাউর রহমানের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রেও তিনি আমাদের বাসায় প্রায় আসতেন।
তাঁর সঙ্গে মিশে আমি জেনেছি, তিনি দেশকে খুবই ভালবাসতেন। আগরতলা মামলায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার পরও তার ভেতর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বজায় ছিল তার প্রমাণ আমি নিজেই পেয়েছি।’ খান শামসুর রহমান উদাহরণ টেনে বলেন, “১৯৬৯ সালের শেষ দিকে একদিন আমি এবং আমার এক বন্ধু লেবু মিয়া বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাই। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তাে আমার পার্টিতে এলে না, কিন্তু আমার কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত ছাড়া পাবে না। তুমি আমার প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান হবে।’ লেবু মিয়া বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন, সে কেন্দ্রীয় সরকারের না প্রাদেশিক সরকারের? বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দূর বেটা, পাকিস্তান তাে আর এক থাকবে না। তাে প্রাদেশিক সরকারের হবে কেন? কেন্দ্রীয় সরকারের কমিশনের চেয়ারম্যান হবে’। তার এমন কথাবার্তায় কোনাে সন্দেহ থাকে না যে তিনি স্বাধীনতা চেয়েছেন এবং সে লক্ষ্যেই যখন যে রকম দরকার সে রকম কৌশলে এগিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে ছাড়েননি। স্বাধীনতার পর আমাকে প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান না করলেও রাষ্ট্রদূত বানিয়ে ছেড়েছেন।”

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!