You dont have javascript enabled! Please enable it! 1968 | তােমাদেরও লাথি মেরে তাড়ানাে হবে- সার্জেন্ট জহুরুল হক - সংগ্রামের নোটবুক
তােমাদেরও লাথি মেরে তাড়ানাে হবে- সার্জেন্ট জহুরুল হক
বাংলাদেশকে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করার অদম্য আকাক্ষা ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সাহসী সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হক। আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ফাঁসির হুমকি মাথায় নিয়েও তিনি স্বাধীনতার ব্যাপারে অবিচল ছিলেন এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে সব ঘটনা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু জীবন বিপন্নের পাশাপাশি ভবিষ্যতে স্বাধীনতার সংগ্রামের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবার আশঙ্কার ব্যাপারে আইনজীবী, বঙ্গবন্ধু ও অন্য সহকর্মীদের যুক্তি মেনে নিয়ে তিনি ক্ষান্ত হন। ননায়াখালীর সুধারামপুর থানার সােনাপুর গ্রামের বাসিন্দা কাজী মুজিবুল হকের ছেলে। সার্জেন্ট জহুরুল হক আগরতলা মামলার ১৭ নং আসামি। তিনি ছিলেন করাচিতে বিমান বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষক। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আটক অবস্থায় টয়লেটে যাবার সময় একজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা রক্ষী তাকে সামনাসামনি গুলি। করে হত্যা করে। ব্রিগেডিয়ার (অব.) খুরশিদ উদ্দিনের কাছে জানা যায়, সার্জেন্ট জহুর ও সার্জেন্ট ফজলুল হক ছিলেন কমান্ডাে গ্রুপের সদস্য। কারাগার এলাকায় আসা ভিক্ষুক ও স্থানীয় চাকরদের ওপর পাকিস্তানিদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করতেন তারা। এতে তারা পাকিস্তানিদের রােষানলে পড়েন। এবিএম সামাদ জানান, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা কর্ণেল মন্জুর এক বাঙালি ভিক্ষুক ছেলের পেটে লাথি মেরে ফটকের বাইরে পাঠিয়ে দেন। এতে উত্তেজিত হয়ে সার্জেন্ট জহুর ওই কর্ণেলকে বলেছিলেন, “আজ যে ছেলেটাকে তুমি লাধি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছ, সেরকম তােমাদেরও একদিন বাংলাদেশ থেকে লাথি মেরে তাড়ানাে হবে।’ এই ঘটনার পরদিন তাঁকে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বেয়নেট চার্জ। করা হয় তার শরীরে। পরে তিনি সিএমএইচে মারা যান। তার মৃত্যু সংবাদ অল্পক্ষণের  মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজপথের  আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ও অন্য বন্দীদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান সমাবেশ মুখর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটে। আদালত ১০ মার্চ পর্যন্ত মামলার শুনানি স্থগিত রাখে। তবে তার আগে অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার মামলা প্রত্যাহারের ঘােষণা দেয়। তিনি এবং সার্জেন্ট জলিল একই বেসের হওয়ায় এবং জলিলের বাসা একাধিক গােপন বৈঠক ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুবাদে জহুরুল হক সম্পর্কে অনেক কিছুই জানার কথা ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) জলিলের।
তিনি বলেন, মনে হয়েছিল সাংগঠনিক তৎপরতার এক পর্যায়ে আলােচনার মাধ্যমে সার্জেন্ট জহুর আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু আসল ঘটনা হল তিনি অনেক আগে থেকেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন যা আমি জানতাম না, জানতেন মফিজুল্লাহ। এতে বােঝা যায় এক একজন সদস্য আর একজন সদস্যের কাছে পরিচয় প্রকাশের আগে কী রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। তবে সার্জেন্ট জহুর দৃশ্যত আমাদের দলভুক্ত হওয়ার আগে আমাদেরকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় (রিফ্রেশার ট্রেনিং) তার কিছু কর্মকাণ্ড আমার নজরে আসে। যেমন প্রশিক্ষণ চলতাে বিকেলে অফিস সময়ের পর। অনেকেই চাইতেন কীভাবে প্রশিক্ষণ এড়িয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা যায়। কিন্তু সার্জেন্ট জহুর অবাঙালিদের ছুটি দিলেও বাঙালিদের দিতেন না। আমাদের সঙ্গে খােলামেলা হওয়ার পরই তার কাছ থেকে জানা যায়, তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক বাঙালিকেই অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী হতে হবে যাতে ডাক এলেই তারা ঠিকমতাে কাজ করতে পারেন। সার্জেন্ট জহুরের দায়িত্ব ছিল গােপন দলে অন্তর্ভুক্তদের হ্যান্ড গ্রেনেড’ চালানাের প্রশিক্ষণ দেওয়ার। এ জন্য এমন এক বাসা খোজা হচ্ছিল যা গুপ্তচরদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকবে। শেষে আমার বাসাটাই প্রশিক্ষণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ নামকরণ করা হয়েছে। ঢাকায় সার্জেন্ট জহুরের স্মৃতি রক্ষায় গঠিত ‘শহীদ সার্জেন্ট জহুর স্মৃতি সংসদ’ প্রতিবছর তাঁর স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক