You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৪শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, বুধবার, ১০ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

রক্তঝরা সেই দিনগুলি

আজ ঐতিহাসিক ২৪শে জানুয়ারী। ১৯৬৯ সালের সেই মহা গণবিস্ফোরণের দিন। বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ বা বহিঃপ্রকাশ হয়েছিলো ২৪শে জানুয়ারীতে। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় তাই এইদিনের একটি পরম মূল্য রয়েছে। এদেশের আজকের স্বাধীনতা মূলতঃ শুধু একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ থেকে শুরু হয়নি। পাকিস্তান হাসিলের পর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের জন্মের ঘটনা থেকেই এর সূত্রপাত। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বীজ সত্যিকার অর্থে রোপিত হয়েছিলো। বিভিন্ন প্রকার আন্দোলনের ঘটনাকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য যেমন সম্ভব হয়নি তেমনি সম্ভব হয়নি অতীতের আন্দোলন ছাড়া গোটা জাতিকে সংঘবদ্ধ করা। প্রতিটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা সত্য হয়ে উঠেছিলো। আর সেই সকল আন্দোলনের একটি পরিপূর্ণ বিকাশ ছিলো ঊনসত্তরের গণজাগরণ। এই গণজাগরণই সেদিন পাকিস্তানী নিগড় থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করেছিলো। এই মহাআন্দোলনের মধ্য দিয়েই সেদিন বাঙালী জাতি সত্যিকার অর্থে তাদের কিসে মুক্তি তা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলো। ঊনসত্তর সালের ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিই জাতিকে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামের সোপানে নিয়ে গিয়েছিলো। আজকের এই ২৪শে জানুয়ারীতেই মনে পড়ে সেদিনের ঊনসত্তরের ২৪শে জানুয়ারীর কথা। এই বিখ্যাত দিনেই সর্বপ্রথম সারা দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। প্রতিবাদের ভাষায় গোটা দেশ মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। এদেশের সব ক’টি রাজনৈতিক ও ছাত্র দল সেদিন আইয়ুব খান ও তার দলের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দিয়েছিলো এ হরতালের। সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক আইয়ুব খান সেদিনই প্রথম বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ এক ও অভিন্নমত তার বিরুদ্ধে। ২৪শে জানুয়ারীর হরতালে সারা বাংলাদেশ বন্ধ হয়েছিলো। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিলের উপর আইয়ুবশাহীর বর্বর সেনারা গুলিবর্ষণ করেছিলো। এদিনই ঢাকাতে স্কুলের ছোট্ট ছেলে মতিউর শহীদ হয়। বাংলাদেশ ব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার এই দিনটি তাই মতিউরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেকখানি বিখ্যাত। গণ-আন্দোলনের শুরুতেই আসাদ শহীদ হয় এবং সে থেকেই আন্দোলন একটি ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করে। এই ব্যাপকতাই সপ্রমাণ হয় চব্বিশে জানুয়ারীতে। ইতিমধ্যে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে ছাত্র সংগঠনগুলো একটি ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচী প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলো। বিখ্যাত এগারো দফা দাবী এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তবায়নের পথে একটি ঐতিহাসিক কর্মসূচী। মূলতঃ ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এগারো দফার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়েছিলো। প্রসঙ্গতঃ বলা চলে—ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন গণমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের পূর্বেই বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্রের চাপে পড়ে যে স্তিমিত হবার উপক্রম হয়েছিল তা ঊনসত্তরের এগারো দফা আন্দোলনের ব্যাপক ও বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে নব জন্মলাভ করে। বস্তুতঃপক্ষে এগারো দফার মূল বিষয়ের মধ্যেই ছিলো ছয় দফা। বাংলাদেশের বাঁচা-মরার দাবী ছিলো সেদিনের ছয় দফা। গোটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি ছিলো ছয় দফাতে। এই ছয় দফা এগারো দফার মধ্যে সন্নিবেশিত হওয়াতেই ঊনসত্তরের আন্দোলনকে আরো বেশী ব্যাপক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো। এছাড়া এগারো দফার অন্য যে প্রধান দফা তা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের। মিথ্যা আগরতলা মামলা তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী সেদিন গণ-আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবী ছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবুর রহমান এই সময় বাংলার অসহায় মানুষের একমাত্র কন্ঠস্বর। তাঁকে বন্দী করে রেখে এদেশের দাবী উত্থাপনের পথ রুদ্ধ করা আইয়ুবী চক্রের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। চব্বিশে জানুয়ারীর পর থেকে বাংলাদেশ গণ-অভ্যূত্থান নিত্যনৈমিত্তিকে পরিণত হয়েছিলো। সারাদেশে নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়েও আইয়ুবশাহী তার শেষ রক্ষা করতে পারেনি ঊনসত্তরের চব্বিশে জানুয়ারী ঢাকার জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে আইয়ুব শোষকের অপসারণের দাবীতে। এইদিনই ঢাকার ক্ষুব্ধ জনতা সকল মারণাস্ত্রকে উপেক্ষা করে, ১৪৪ ধারা শেষে কারফিউও ভেদ করে রাস্তায় নেমে তাদের প্রতিবাদ জানায়। আইয়ুব শোষক চক্রের সেদিনের গণবিরোধী মুখপত্র দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ কার্যালয়ে ঢাকার বিক্ষুব্ধ জনতা এইদিনই আগুন ধরিয়ে দেয়। দেশের প্রতিটি মানুষের মনে যে আইয়ুব শাসনবিরোধী ক্ষোভ এতদিন পুঞ্জ পুঞ্জ ভাবে জমা হয়েছিলো তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে ঊনসত্তরের চব্বিশে জানুয়ারী থেকে। মূলতঃ তাই ঊনসত্তরের আন্দোলনই আমাদের পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলো। গোটা জাতিকে একটি মাত্র আদর্শে উদ্বোধিত করা সম্ভব হয়েছিলো, তাহলো—হয় মুক্তি না হয় মৃত্যু। আমরা এই ঐতিহাসিক দিনে যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ঊনসত্তরের সকল মৃত্যুহীন শহীদ প্রাণকে তেমনি বিশেষভাবে স্মরণ করি শহীদ আসাদ, মতিউর ও ডঃ জোহাকে। সেদিনের সেই অমরা শ্লোগান ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, যা আজ ও পরবর্তী কালেও জাতিকে উজ্জীবিত করবে।
কোনদিন জাতি এসব অমর শ্লোগান ভুলবেনা—কোনদিন বিস্মৃত হবেনা সেই ‘জেলের তালা ভাঙবে শেখ মুজিবকে আনবো’ শ্লোগানকে। আজকের দিনে সেদিনের ছয় দফা এগারো দফা যেমন সত্য তেমনি সত্য সেদিনের মহান ছাত্রনেতাদের অবদানের কথা। তারাই সেদিন সত্যিকার অর্থেই বুঝতে পেরেছিলো কে এ জাতির মুক্তিদাতা বন্ধু,—কিসে এ জাতির সত্যিকার অর্থে মুক্তি। আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আজ স্মরণ করি সেই অমর চব্বিশে জানুয়ারীকে। সেইসব অমর শহীদী আত্মাকে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!