পাকিস্তানিরা আমাদের ভাত দিতে চাইতাে না – এবিএম আবদুস সামাদ
স্বাধীনতা সংগ্রামের গােপন প্রক্রিয়ায় জড়িতদের অন্যতম ৮নং অভিযুক্ত এবিএম এ সামাদ (আবুল বাশার মােহাম্মদ আবদুস সামাদ) করপােরাল সামাদ নামেই বেশি পরিচিত। বাবার নাম এন্তে আলী মিয়া। ১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর পিরােজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানাধীন মিঠাখালী গ্রামে তার জন্ম। লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের সঙ্গে সামাদের পরিচয় ছাত্রজীবন থেকে। উভয়ে একই বছর ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪৭ সালে বাগেরহাট কচুয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে। ১৯৪৯ সালে জগন্নাথ কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালে সামাদ অয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে যােগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে নৌ-বাহিনীতে যােগ দেন মােয়াজ্জেম হােসেন। চাকরি জীবনের প্রথম দিক থেকেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের নানা বৈষম্য ও নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডের শিকার সামাদ চাকরিস্থলেই প্রতিবাদী ছিলেন। প্রথম থেকে মােয়াজ্জেমদের সঙ্গে যােগাযােগ থাকলেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শুরু হওয়া গােপন আন্দোলনে তিনি সরাসরি যুক্ত হন ১৯৬৫ সালে। ঢাকার একটি পেট্রোল পাম্পে চাকরির আড়ালে থেকে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ, মােয়াজ্জেমকে নিয়ে দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারির সঙ্গে বৈঠক এবং আগরতলায় দুই সদস্যের প্রতিনিধিকে সীমান্তে পৌঁছে দেওয়াসহ নানা কর্মকাণ্ডের সাক্ষী তিনি। ২০০৭ সালের ২১ মার্চ বিকেলে ঢাকার মতিঝিলে স্টক এক্সচেঞ্জ কার্যালয় সংলগ্ন তার কর্মস্থল একটি শেয়ার ব্রোকারেজ হাউজে বসে তার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি।
আলাপকালে জানা যায়, এবিএম সামাদ হতে চেয়েছিলেন পাইলট। কিন্তু মেডিকেল টেস্টে পায়ের উচ্চতা প্রয়ােজনের তুলনায় এক ইঞ্চি কম হওয়ায় বিকল্প হিসেবে অয়্যারলেস বিভাগেই যােগ দেন। তারপর প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান পেশােয়ারের রিসালপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ‘পাকিস্তানিরা ভাত দিতে চাইতাে না। যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার আন্তরিক ইচ্ছা নিয়ে নিজ প্রদেশ পূর্ব বাংলা ছেড়ে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান পাড়ি জমালেন এবিএম সামাদ, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের সম্পর্কে লাভ করেন তিক্ত অভিজ্ঞতা। তাকিয়ে আমি বললাম, “যেভাবে উনি ইংরেজিতে কথাবার্তা বলছেন, প্রশ্ন করছেন মনে হয় মেয়ের জামাই দেখতে এসেছেন।’ শামসুদ্দোহা কথাটা শুনে মাথা ঘুরিয়ে বাংলায় বললেন, “কি হয়েছে? আপনাদের সমস্যার কথা আমাকে খুলে বলুন। আমরা তাকে বললাম ‘পাকিস্তানিরা আমাদের অভিযােগের কথা বুঝতে পারলে আপনি যাওয়ার পর আমাদের সঙ্গে আগের চাইতে খারাপ ব্যবহার ওরা করবে। সেজন্য বাংলায় প্রশ্ন করার জন্য আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ এরপর আমরা তাকে আমাদের কিছু কিছু সমস্যার কথা জানাই। কিছু কিছু ব্যাপারে পরে সমাধানও হয়েছিল।” এবিএম সামাদ করাচির মৌরিপুরে দায়িত্ব পালনকালেও দেখেছেন বাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা ও কষ্ট দেওয়ার নানা চিত্র। সেখানে-পশ্চিমা কর্মকর্তারা বাঙালিদেরকে জোর করে মেসের ভেতর ঢুকিয়ে রুটি খেয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিত। কিন্তু বাঙালিরা তা প্রায়ই খেতেন না। এ পর্যায়ে একবার এক নাগারে তিনদিন উপােস থাকেন (প্রতিবাদী অনশন) তারা। কেউ কেউ ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে কিছু শুকনাে রুটি লুকিয়ে কাগজে মুড়িয়ে নিয়ে নিজ নিজ ট্র্যাঙ্কের ভেতর রেখে দেন, পরে লুকিয়ে খেয়ে নেয়। অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে সেই অনশন ভেঙে যায়।
সামাদ জানান, তখনাে তাদের চাকরিকাল ছিল মােট ১৮ বছর। এরমধ্যে ১২ বছর একটিভ সার্ভিস, আর ছয় বছর রিজার্ভ। মােট ১৮ বছর পূর্ণ হলে পেনশনে যাওয়ার কথা। চাকরিতে যােগ দেওয়ার সময় তারা এমনটাই জেনেছেন। কিন্তু মৌরিপুরের অনশনের ঘটনার পর জানতে পারেন নতুন এক নিয়মের কথা। এতে বলা হয় ১২ বছর একটিভ সার্ভিসের পর আরও ১২ বছর চাকরি করতে হবে। পেনশন হবে ২৪ বছর পর। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এ রকম সিদ্ধান্ত এবং অন্যান্য বৈষম্যমূলক আচরণ মেনে নিতে না পেরে সামাদ সাহেবসহ আরও অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে শুধু গ্র্যাচুইটি নিয়ে তিনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসেন। বিপ্লবী দলে সম্পৃক্ততা এবিএম সামাদ দেশে এসে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের আশায় ছােটখাটো ব্যবসায় মনােনিবেশ করেন ঢাকায়। এরমধ্যে ৬৪ সালের শেষ দিকে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের একটি চিঠি আসে তার কাছে। চিঠিতে মােয়াজ্জেম সামাদকে জানান, “আমি ছুটিতে এলে তােমাকে কিছু কথা বলবাে। বড়াে একটা কাজে হাত দিয়েছি। সে কাজে তােমাকেও আমার সঙ্গে থাকতে হবে। এর আগে দুতিন বছরে একাধিকবার যােগাযােগ ও কথাবার্তা হলেও এ জাতীয় অস্পষ্ট কথা মােয়াজ্জেম বলেননি। তাই খানিকটা কৌতুহলী হয়ে ওঠেন সামাদ। এদিকে ১৯৬৫ সালে লেগে যায় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ।
ওই সময় সরকার দেশের সব সাবেক সৈনিক, পুলিশ, আনসারকে নিজ নিজ সাবেক কর্মস্থলে যােগ দেওয়ার নির্দেশ দেয় (রিকল)। একই রকম ডাক আসে সামাদের কাছেও। এরপরের কাহিনী জানা যাক সামাদের জবানীতে: “আমি করাচি গিয়ে পুনরায় চাকরিতে যােগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে মােয়াজ্জেমের সঙ্গে দেখা করি। সে আমাকে জানায়, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য আমরা সংগঠিত হচ্ছি। এতে তুমিও থাকবে। আমি এতে সম্মতি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের পেছনে আর কে আছে জানতে চাইলে সে বলে, এর। পেছনে শেখ সাহেব আছেন।’ শেখ সাহেবের নাম শুনে আমি বেশ সাহস পাই। রহুল কুন্দুসের বাসায় বৈঠক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমার হায়দরাবাদে পােস্টিং হয়। সেখানে একদিন মােয়াজ্জেম আমাকে ফোন করে জানায়, ১২ অক্টোবর (৬৫ সালে) একটি জরুরি মিটিং আছে, আমি যেন দুএকদিনের মধ্যে করাচি যাই। করাচিতে আমার এক ঘনিষ্ঠজন রােগীকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে আমার আডজুট্যান্টের কাছে দুদিনের ছুটি চাইলে তিনি ছুটি দিতে রাজি হননি। আমি যেকোনােভাবে করাচি যেতে উদগ্রীব হয়ে তাকে বললাম, ‘স্যার, রােগী আমার ঘনিষ্ঠ, আপনি ছুটি না দিলেও আমাকে যে কোনােভাবে যেতে হবে। দরকার হলে আপনি পরে ব্যবস্থা নেবেন।তখন আমি হায়দারবাদে বিমান বাহিনীর করপােরাল, নন কমিশন অফিসার । আমি জানতাম, আমি বিনা অনুমতিতে গেলেও আমাকে গ্রেপ্তার করা। হতাে না। বড়জোর হাজিরা খাতায় লালকালি দিয়ে রাখা হতাে আর কিছু বকাঝকা করা হতাে। আমার অনমনীয়ভাব দেখে অফিসার নমনীয় হন। প্রধান সহকারীকে (হেড ক্লার্ককে) ডেকে আমাকে মৌখিক ছুটি দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, সাদাকাগজে নাম ঠিকানা লিখে রাখতে। এও বলে দিলেন, আমি ফিরে আসার পর যাতে ওই কাগজ ছিড়ে ফেলা হয়।
আজ উল্লেখ করতে হয়, সেদিনের ছুটি মৌখিক হওয়ায় তা আগরতলা মামলার সময় আমার জন্য উপকারই হয়েছিল। সে কথা একটু পরে বলছি। মৌখিক ছুটি পেয়ে পরদিন করাচি এসে মােয়াজ্জেমের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে জানতে পারি সেটি সিএসপি অফিসার রুহুল কুদুসের বাসা। হায়দরাবাদ থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫০ মাইল। সেখানে আহমেদ ফজলুর রহমানসহ আরও কয়েকজন মিলে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের শােষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য থেকে বাঁচতে হলে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করি। প্রস্তাব করা হয়, আমার কাছে যােগাযােগের জন্য একটা ট্রান্সমিটার থাকবে, যােগাড় করে দেবেন রুহুল কুন্দুস সাহেব। সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে, নেতৃত্বে থাকবেন শেখ মুজিবুর রহমান। বৈঠক থেকে ফিরে গিয়ে যথারীতি কাজে যােগ দিই হায়দরাবাদের কর্মস্থলে। গিয়েই হাজিরা খাতায় ছুটির দিনগুলােসহ উপস্থিত দেখিয়ে দস্তখত দিয়ে দিই। মামলা চলাকালে আমি যে দুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে চাকরিস্থল থেকে চলে গিয়েছিলাম সে প্রসঙ্গটি তােলা হয়েছিল। আমি সেটা অস্বীকার করে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলাম, সেই সময়ের রেকর্ড যাচাই করা হােক আমি কোনাে ছুটি ওই সময় নিয়েছি কী না!’ কিন্তু সেরকম কোনাে তথ্য না পাওয়ায় আমাদের আইনজীবী প্রশ্ন তুললেন, ‘কোনাে ছুটি না নিয়ে সামাদ ২৫০ মাইল দূরে কোনাে সভায় যােগ দিলেন কি করে?’ আদালত যুক্তিটি গ্রহণ করেছিল। ওপরে চাকরি, আড়ালে ওঝার সঙ্গে যােগাযােগ এবিএম সামাদ জানান, রুহুল কুদুসের বাসা থেকে হায়দরাবাদে ফিরে চাকরিতে যােগ দেওয়ার কিছুদিন পর ছুটির সময় হলে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। আসার সময় মােয়াজ্জেম তাকে বলেছিলেন, ঢাকার গ্রিণ রােডে সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিপরীতে আহমদ ফজলুর রহমানের পেট্রোল পাম্প গ্রিন ভিউতে যােগ দিতে। আহমদ ফজলুর রহমান সেখানে তাঁকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দেন।
একটা গাড়িও দেন বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসার জন্য। এই পেট্রোল পাম্পে শেখ মুজিব মাঝে-মধ্যে আসতেন। কিন্তু তার সঙ্গে সামাদের সরাসরি কোনাে আলাপ হয়নি। একদিন মিজানুর চৌধুরী এসেছিলেন আহমদ ফজলুর রহমানকে খোজ করতে। তিনি না থাকায় তার জন্য একটা চিঠি দিয়ে যান সামাদকে। সেটি তার পকেটে ছিল। পাকিস্তানি সেনারা চিঠিটি পেয়ে বলেছিল, “তােমাদের নেতারা যে এখানে আসতেন এই চিঠি তাে তার প্রমাণ। সামাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রিণ ভিউতে চট্টগ্রামের ভূপতিভূষণ চৌধুরী (১২নং আসামি) ও ভারতীয় দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারি মি. পিএন ওঝাসহ সংশ্লিষ্ট আরও কেউ কেউ আসতেন পরস্পরের দেখা সাক্ষাৎ ও খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। সামাদের কাজ ছিল। সংশ্লিষ্টদের মাঝে নির্দেশমতাে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়া। ১৯৬৬ সালে মােয়াজ্জেম চট্টগ্রাম বিআইডাব্লিউটিএর (অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ) দায়িত্বে থাকার সময় ঢাকায় এসে দেখা করতেন সামাদের সাথে। তিনি সামাদকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে ভারতের সহযােগিতার বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার জন্য। তার পরামর্শ অনুযায়ী সামাদ ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে প্রস্তাব দেন বাঙালিদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য।
সামাদের ভাষায়, “ভারতীয় দূতাবাসের তকালীন দুজন সচিব প্রায় সময় আমার এখান থেকে পেট্রোল নিতেন; তাঁদের একজন মি. জর্জ। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরের ঘটনা। মােয়াজ্জেমের পরামর্শ অনুযায়ী একদিন আমি মি. জর্জকে আমার অফিসের ভেতরে যাওয়ার অনুরােধ জানিয়ে তাঁর সঙ্গে কিছু জরুরি ও গােপনীয় কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তিনি কথা বলতে রাজি হলে তাকে বললাম, “আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চাই, এ ব্যাপারে আপনাদের সহযােগিতা দরকার।’ তিনি বললেন, ‘এখানে এসব কথাবার্তা বলা সুবিধের হবে না। বরং আপনি অমুক দিন (দিনটি মনে নেই) বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের ধানমন্ডি ৮নং সড়কের বাসায় আসুন, সেখানেই কথা হবে। নির্দিষ্ট সময়ে আমি তার বাসায় গিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্যাপারে আমাদের ইচ্ছের কথা জানাই এবং এতে ভারতের সহযােগিতার প্রয়ােজনের কথা বলি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কেন কোন যুক্তিতে ভারত বাঙালিদের সহযােগিতা দেবে?’ আমি মােয়াজ্জেমের কথামত বলেছিলাম, “দেখুন, আমরা পাকিস্তানের একাংশ আছি পূর্ব দিকে, ওরা আছে পশ্চিমে। আর আপনারা (ভারত-পাকিস্তান) একে অপরকে শত্রু ভাবেন। আপনাদের দুদিকেই সব সময় পাহারায় থাকতে হয়। কিন্তু পূর্বদিকে যদি আমাদের নিয়ে আপনাদের একটি বন্ধু রাষ্ট্র হয় তাহলে আপনাদের আর দুশ্চিন্তা থাকে না। ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা এর পেছনে কারা আছে। জানতে চাইলে আমি তাকে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরের চলমাম তৎপরতার কথা জানাই।
মি. জর্জ আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন, আপনার কথাতাে ভাল। আমরাও বুঝিআমাদের একটা কিছু করা উচিৎ। তবে আমাদের দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফার্স্ট সেক্রেটারি । মি. পিএন ওঝা সপ্তাহখানেক পর ছুটি থেকে এলেই তাকেই বিষয়টি বলবেন।’ সপ্তাহখানেক পর মি. জর্জ পেট্রোল পাম্পে এসে ‘মি, ওঝার আসার খবর দিয়ে তার সেগুন। বাগিচার কার্যালয়ে যেতে বলেন। দুজনের মধ্যে পরামর্শক্রমে ঠিক হলাে, কেউ কখনও। প্রশ্ন তুললে বলতে হবে যে, ভারতীয় দূতাবাসের গাড়ির জন্য নেওয়া তেলের বিলের। লেনদেনের হিসাবের মধ্যে কিছু ত্রুটি আছে। তা ঠিক করার জন্যই আমি সেখানে (দূতাবাস। কার্যালয়ে গিয়েছি। সে অনুযায়ী হিসাবের একটি খাতাও তৈরি করে নিলাম। মি. জর্জ আমাকে একটি চিঠি লিখে দেন যাতে দূতাবাসের ভেতর ওঝার কাছে যেতে আমার অসুবিধা হয়। এরপর একদিন নির্দিষ্ট সময়ে আমি সেগুনবাগিচায় ভারতীয় দূতাবাস কার্যালয়ে গিয়ে মি. ওঝার সঙ্গে দেখা করে আমাদের পরিকল্পনার কথা বলি। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, “এরকম একটা সিদ্ধান্তের বিষয়টি আগে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ করে নিতে হবে।’ যােগাযােগ করে পরদিনই ভালমন্দ জানাবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। কথামতাে। পরদিন আমি আবার মি. ওঝার কার্যালয়ে গেলে তিনি প্রাথমিক একটা বৈঠকের জন্য। আমাদের পক্ষে কে কে থাকবেন তার একটা তালিকা দিতে বলেন। পরদিন আমি। মােয়াজ্জেমের সঙ্গে কথা বলে আমরা দুজন (আমি এবং মােয়াজ্জেম) থাকবাে বলে সিদ্ধান্ত নিই। তার পরদিন সকালে মি, ওঝা তেল নেওয়ার জন্য পেট্রোল পাম্পে এলে আমি তাকে। আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করি। ইতিমধ্যে। মােয়াজ্জেমও ঢাকা এসে পৌঁছেন। মােয়াজ্জেম বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে শেখ মুজিব আছেন কথা হলাে বৈঠক হবে মি. ওঝার বাসায়। কিন্তু সেখানে যেতে হবে যাতে কেউ কোনাে।
কিছু বুঝতে বা ধারণা করতে না পারে। তখন ফার্মগেট সড়কটি ছিল ছােট। রাস্তার পাশে। কিছু ফার্ম (খামার) ছিল। সেখান থেকে শ্যামলীর দিকে একটি সড়ক চলে গেছে। ঠিক। হলাে আমরা সেই সড়কমােড়ে সন্ধ্যা ছয়টার পর অবস্থান করব। সেখান থেকে আমাদের। নিয়ে যাওয়া হবে। আমি আর মােয়াজ্জেম ঠিক সােয়া ছয়টায় সেখানে পৌছার একটু পরই। একটা গাড়ি এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। ভেতরে লাইট নেই। আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে অন্য একদিকে ঘুরে গাড়িটি ধানমন্ডির ২নং সড়কে মি, ওঝার বাসায় পৌঁছে। তার। তৃতীয় তলার বাসায় আমাদের একটি কক্ষে বসানাে হয়। সেখানে দেখি, একটা টেবিলে । কতগুলাে গরম মশলা, দারুচিনি, এলাচি, কিসমিস ইত্যাদি রাখা আছে। কুশল বিনিময়ের। ফাঁকে অল্পক্ষণের মধ্যে চা-পান করতে করতেই কথা শুরু হয়। মি, ওঝা আমাদের পরিকল্পনা। এবং ভারতের কাছে কী ধরনের সাহায্য চাই জানতে চান। আমাদের পক্ষে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম বললাে, আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চাই। আমরা একটা। নির্দিষ্ট সময়ে পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলায়) ক্যান্টনমেন্ট, গভর্নর হাউস সবকিছু দখল করে নেব। সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবাে। তার আগে প্রাথমিকভাবে কিছু ছােট অস্ত্র দরকার লােকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। আমাদের প্রস্তুতি শেষ হলেই আমরা আক্রমণ শুরু করবাে। আপনাদের দেখতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাতে অস্ত্র ও সৈন্য আসতে না পারে। সেজন্য আকাশ ও নৌপথ বন্ধ করে দিতে হবে।
রাজনৈতিক শক্তির অবস্থানের ব্যাপারে মি, ওঝা জানতে চাইলে মােয়াজ্জেম তাঁকে জানান, ‘আমাদের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে করাচিতে আমাদের কথা হয়েছে।’ সব কথা শুনে মি, ওঝা জানান, বাংলাদেশের পক্ষে একটা প্রতিনিধি দল ভারতের আগরতলা যেতে হবে। সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা থাকবেন। ওই বৈঠকে উভয়পক্ষের লােকজন বসে বাংলাদেশের কী কী সাহায্য দরকার, ভারতীয়রা কী কী সাহায্য দিতে পারেন আলােচনা করে ঠিক করতে হবে।” ভারতের সীমান্তে গিয়ে সমস্যায় না পড়ার জন্য দুটি পাসওয়ার্ড দেওয়া হয় দূতাবাস থেকে। এর একটি হলাে বাস্কেট’ । ফেনী থেকে সীমান্তে গিয়ে চেকপােস্টে প্রহরীদের ‘বাস্কেট’ বললেই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। অপরটি হলাে ফ্লাওয়ার’। ভেতরে যাওয়ার পর সেনা কর্মকর্তারা কে পাঠিয়েছেন জানতে চাইবেন। তখন ফ্লাওয়ার বললেই তারা বুঝবেন সঠিক লােকই গেছেন এবং আলােচনায় রাজি হবেন। সামাদ জানান, এই বৈঠক থেকে আসার কয়েকদিন পরই আগরতলায় যাওয়ার জন্য তিনজন প্রতিনিধি ঠিক করা হয়। একজন আলী রেজা (তখনকার ইন্সট্রাক্টর পিএসপি) আর একজন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান ও অন্যজন নৌবাহিনীর লে, মতিউর রহমান। খবর পেয়ে তিনি (লে, মতিউর) করাচি থেকে এসে বললেন, “আমরা যদি ওখানে (সীমান্তে বা ভারতে) কোনাে কারণে মারা পড়ি তাহলে আমাদের পরিবারের অবস্থা কি হবে? কাজেই আমাদের একটা গ্যারেন্টি দিতে হবে। মােয়াজ্জেমের বক্তব্য ছিল, এটাতাে অলিখিত-অঘােষিত সংগ্রামের পথ।
এখানে তাে গ্যারান্টি দিয়ে কিছু হতে পারে না। এরপর লে, মতিউর রহমান অগ্রিম আর্থিক সাহায্যের কথা বললে সেরকম আর্থিক ক্ষমতাও নেই বলে জানান মােয়াজ্জেম। এ অবস্থায় মতিউর রহমান আগরতলা যেতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত আলী রেজা ও স্টুয়ার্ড মুজিবকে আগরতলা পাঠানাে হয়। সামাদের ওপর দায়িত্ব ছিল তাদেরকে ফেনী চেক পোেস্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসা।। কথামত সামাদ আলী রেজা ও স্টুয়ার্ড মুজিবকে চেক পােস্টের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন। সেখান থেকে এসে আলী রেজা ও স্টুয়ার্ড মুজিব জানান, বিস্তারিত আলােচনার জন্য পরে আরও বৈঠকের প্রয়ােজন আছে। সামাদের মতে, আগরতলায় ওই বৈঠকের সূত্র ধরেই পাকিস্তান সরকার মামলাটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে সাজিয়েছিল।
সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক