You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানিদের নিয়ে একসঙ্গে থাকা যায় না – লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন

ষাটের দশকের শুরু থেকে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে বাঙালি সৈনিকদের ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও নিগ্রহের |প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতার যে চেতনা জেগে ওঠে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সেনা সদস্যদের নিয়ে যে বিপ্লবী সংগঠনের সূচনা হয় তার সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলার (তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) ২নং অভিযুক্ত আসামি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মােয়াজ্জেম হােসেনকে তার বাসা থেকে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিরত এই সেনা কর্মকর্তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম, সাংগঠনিক তৎপরতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চাভিলাসী সম্পর্কে তাঁর সহযােগী নানা জনের কাছ থেকে নানা তথ্য পাওয়া গেছে যা সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তার স্ত্রী হিসেবে কোহিনুর হােসেনের অনেক কিছু জানার কথা স্বামী মােয়াজ্জেমের কর্মতৎপরতার নানা দিক সম্পর্কে। তাই তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় তাঁর ধানমন্ডির বাসায় বসে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে মিসেস মােয়াজ্জেমের কণ্ঠে বেরিয়ে এসেছে অনেক অজানা তথ্য।

ছােট বেলায় মােয়াজ্জেম হােসেনের ডাক নাম ছিল মনু হােসেন। জন্ম ১৯৩১ সালে গ্রামের বাড়ি পিরােজপুর জেলার ধুসরিতাল গ্রামে। বাবার নাম মৌলভি মােফাজ্জল আলী। ১৯৪৭ সালে পিরােজপুর কচুয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫০ সালে বরিশাল বিএম কলেজে আইএসসি পড়ার সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগ দেন মােয়াজ্জেম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে লন্ডন পাঠানাে হয় রাজকীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। ৫৭ সালের ডিসেম্বরে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন পেয়ে করাচির কর্মস্থলে ফিরে যান তিনি। ৫৮ সালের প্রথম দিকে দেশে এসে ১১ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ির পাংশা গ্রামের ১৬ বছরের তরুণী স্কুল ছাত্রী কোহিনুর বেগমকে। ৫৯ সালের এপ্রিলে আবারও লন্ডনে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্পেশাল কোর্স করে ৬০ সালের মে মাসে দেশে (করাচি) ফেরেন। মিসেস মােয়াজ্জেম স্ত্রী হিসেবে প্রায় সময় (৫৯-৬০ সাল থেকে) খেয়াল করতেন তার স্বামীর মনের ভেতর কী যেন একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনাে কখনাে মুখ ফুটে কিছু একটা বলতে চাইলেও পরক্ষণে আবার লুকোতে চাইতেন। কথার ফাকে কথা, বিভিন্ন লােকজনের যাওয়া-আসা, গতিবিধি এবং দু একজন সহকর্মীর সঙ্গে মােয়াজ্জেমের আলাপের সূত্র ধরে মিসেস কোহিনুর বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী কোনাে না কোনাে কারণে পাকিশনিদের ওপর ক্ষুব্ধ এবং এ নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ পরামর্শ করছেন। তবে ‘আগরতলা মামলা শুরু বিশেষ করে মােয়াজ্জেমের গ্রেপ্তারের আগে পর্যন্ত স্পষ্ট জানতেন না যে তার স্বামী বা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির মতাে বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। অবশ্য তিনি মামলার অনেক আগেই শুনেছেন শেখ মুজিবসহ মামলার আসামিদের বেশ কজন তাদের করাচির বাসায় গিয়েছেন অতিথি হিসেবে। চট্টগ্রামে থাকাকালে বাসায় তার স্বামী কথা বলেছেন কর্নেল (অব.) ওসমানীর সঙ্গে। বরিশালের বাসায়ও যাতায়াত ছিল বিভিন্ন জনের।

মিসেস কোহিনুর ‘অতিথিদের জন্য কখনাে চা-নাস্তা, কখনাে ভাতের আয়ােজন করেছেন স্বামীর নির্দেশে। তবে সামনে আসেননি কখনাে। পর্দার আড়ালে থেকে ভাসা ভাসা অস্পষ্ট কথা শুনলেও এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘৫৯-৬০ সালে লন্ডনে বিশেষ কোর্স করার সময় মােয়াজ্জেম মাঝে মাঝে দাপ্তরিক কাজে করাচির কর্মস্থলে যাওয়া আসা করতাে। লন্ডনে কিংবা করাচিতে কর্মস্থল নিয়ে কখনাে কথা উঠলেই তার (মােয়াজ্জেমের) কণ্ঠ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতাে। গালাগাল দিতে পাকিস্তানি-পাঞ্জাবিদের। বলতে ‘বেটারা আমাদের দেখতে পারে না।’ মাঝে মাঝে দেখতাম, বাসায় বসে আনমনে কী যেন ভাবছে সে। আমার বয়স তখনাে কম হওয়ায় আমি তেমন কিছু বুঝতাম না বা বুঝতে চাইতাম না। কখনাে কিছু জানতে চাইলেও বলতাে না সে। হয়তাে সে মনে করতাে মেয়েদের পেটে কথা থাকে না, কখনাে কোথাও যদি বলে দিই। ১৯৬০ সালে লন্ডনে আমার বড় ছেলের জন্মের পর আমরা দেশে (করাচিতে) ফিরি। এরপর থেকে পাকিস্তানিদের ব্যাপারে তার বিতৃষ্ণা আরাে বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে দেখি বাসায় বিভিন্ন লােকজন আসতে শুরু করে। পদস্থ অফিসারদের চাইতে জুনিয়র অফিসার ও সিপাই শ্রেণীর লােকজন বেশি আসতেন। সেও কারাে কারাে বাসায় যেতাে। আমি কখনাে কখনাে বিরক্ত হতাম, ওসব লােকের জন্য বিভিন্ন আয়ােজন করার ঝামেলার জন্য। সে (মােয়াজ্জেম) বলতাে, পাকিস্তানিদের নিয়ে এক সঙ্গে থাকা যায় না, ভাত রুটি খাওয়া যায় না। ওরা বাঙালিদের সঙ্গে প্রায় সময় খারাপ ব্যবহার করে। কাজেই আমাদের লােজন এলে যেন কিছু না খেয়ে না যায়। সামান্য ডাল ভাতও যদি এদের খাওয়াও তাতেই তারা খুশি হবে। পাকিস্তানিদের আচরণ যদি তুমি দেখতে তাহলে বুঝতে।’ সে কোথায় কার কাছে যেতাে কিংবা আমাদের বাসায় কারা আসতেন এসব আমি জানতে চাইতাম না, তাঁদের কোনাে কথা বুঝতামও না।

আমি শুধু ভেতর থেকে চা-নাস্তা বা খাবার পাঠাতাম। পরে যখন দু একটা ঘটনা ঘটে তখনই বুঝতে পারি, মােয়াজ্জেম ওদের সিপাই কর্মকর্তাদের সংগঠিত করার কাজ করছিল। মােয়ালেমের বাসায় শেখ মুজিব মিসেস মােয়াজ্জেম জানিয়েছেন, ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে পাকিস্তান নৌবাহিনীর তৎকালীন একজন কর্মকর্তা ডা. খুরশিদ উদ্দিন (৩৪নং আসামি) প্রায় সপ্তাহে রাতে তাদের বাসায় যেতেন। তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রােববার। মােয়াজ্জেম সাহেব মাঝে মাঝে শনিবার ঢাকা আসতেন। রােববার এখানে থেকে সােমবার সকালের ফ্লাইটে করাচি ফিরে গিয়ে অফিস করতেন। ডা. খুরশিদ কখনাে কখনাে তাঁর স্কুটার দিয়ে মােয়াজ্জেম সাহেবকে বিমান বন্দরে পৌছে দিতেন ঢাকা আসার সময়। আর মিসেস মােয়াজ্জেমকে বলতেন ‘কেউ খোঁজ করলে বলাে, বাইরে গেছে।’ মিসেস মােয়াজ্জেমের স্মৃতি থেকে; “আমার জানা মতে, শেখ সাহেব আমাদের করাচির বাসায় গিয়েছিলেন সম্ভবত ১৯৬৪ সালের জুন-জুলাই মাসের কোনাে এক রাতে। ওই দিন বিকেলে মােয়াজ্জেম অফিস থেকে এসে আমাকে বললাে, একটু ভাল নাস্তা তৈরি করাে, কয়েকজন অতিথি আসবেন।’ আমি যথারীতি চা-নাস্তা তৈরি করেছি। রাতে অতিথি কয়েকজনও এসে চা-নাস্তা খেয়ে কথাবার্তা বলে চলে গেছেন। কিন্তু কারাে সামনে না যাওয়ায় কাউকে সরাসরি চিনতে পারিনি। পরে একদিন মােয়াজ্জেমই বলেছিল, ওইদিন বাসায় শেখ সাহেব ও আহমদ ফজলুর রহমানরা এসেছিলেন।’ আহমদ ফজলুর রহমান তখন করাচিতে থাকতেন।

এমনিতে শেখ সাহেব ছিলেন আমার বড় ভাই ডা. একেএম আশরাফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বড় ভাই মুসলিম লীগের প্রভাবশালী সদস্য হলেও তাঁর সঙ্গে তুই-তােকারি সম্পর্ক ছিল শেখ সাহেবের। আমার আব্বাকে পায়ে ধরে সালাম করতেন তিনি। অবশ্য বড় ভাই পরে ‘তকমায়ে খেদমত পার্টি করেছেন। স্বাধীনতার পর ৮৩/৮৪ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যােগ দেন তিনি। আমাদের পরিবারের সাথে শেখ সাহেবের সম্পর্কের বিষয়টি জানা থাকলেও মােয়াজ্জেমের সঙ্গে গােপন সম্পর্কের বিষয়ে কিছুটা জেনেছি আগরতলা মামলা উদ্ভবের পর। মােয়াজ্জেম জানিয়েছিল, তাদের সংগঠিত হওয়া ও আন্দোলন (বিদ্রোহ) সফল করার জন্য টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সমর্থন প্রয়ােজন ছিল। সিএসপি রুহুল কুদ্স ও আহমদ ফজলুর রহমানরা মােয়াজ্জেমদের বলেছিলেন, “তােমরা শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করাে, তিনি সব ঠিক করে দেবেন। এরপর মােয়াজ্জেম শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি প্রয়ােজনীয় সাহায্যের আশ্বাস দেন। এরপর আমার বাসায় তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। পরে শেখ সাহেব তাকে (মােয়াজ্জেমকে) ওঝার সঙ্গে (ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি) পরিচয় করিয়ে দেন।” শেখ মুজিবের সঙ্গে মােয়াজ্জেমের যােগাযােগের প্রমাণ হিসেবে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন মিসেস মােয়াজ্জেম। বললেন, “গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বরিশাল থাকতে সে (মােয়াজ্জেম) আমার শাড়ির একটি প্যাকেটের ভেতর কিছু কাগজ বেঁধে রেখে আমাকে বলেছিল, ‘যদি কখনাে আমার কিছু হয়, তাহলে এই কাগজগুলাে পুড়ে ফেলবে।’ সেখানে একটা পিস্তলও ছিল। আর একটা মানি ব্যাগ দিয়ে বলেছিল, এই ব্যাগটার ভেতর একটা জিনিস আছে, সেটিও নষ্ট করে ফেলবে।’ ওর কী হবে জানতে চাইলে বলেছিল, না যদি কিছু হয় আর কি?’

তার যে কী বিপদ হতে পারে তা আমার মাথায় তখনাে আসছিল না। গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে দেখি ওর মানি ব্যাগে শেখ সাহেবের কিছু কাগজপত্র ছিল। সেখানে বেগম মুজিব কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছিলেন সেরকম কিছু হিসাবও ছিল। তবে কারাে নামধাম আমি মনে রাখিনি। তাঁকে (মােয়াজ্জেমকে) নিয়ে যাওয়ার পর সকালে আমি বাথরুমে গিয়ে ম্যাচের কাঠি দিয়ে সেই মানি ব্যাগটা পুড়ে ফেলি। পিস্তলটা ওরা নিয়ে গিয়েছিল গ্রেপ্তারের সময়। করাচির বাসায় মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম মােয়াজ্জেম রাত জেগে একাকী কী যেন লিখতাে। পরে জেনেছি সে দেশের জন্য ম্যানিফ্যাস্টো লিখতাে।” মিসেস মােয়াজ্জেম জানান, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মােয়াজ্জেমকে সাবমেরিনে নিয়ােগের জন্য মনােনীত করেছিল। কিন্তু তিনি নানাভাবে চেষ্টা চালান ঢাকায় বদলি হয়ে আসার জন্য। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশােনার প্রয়ােজন ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশে বদলি হয়ে আসেন। প্রথমেই পােস্টিং হয় অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থার চট্টগ্রাম অফিসে। ৬৭ সালে যান বরিশালে। চট্টগ্রামের বাসায় ওসমানী চট্টগ্রামে মােয়াজ্জেম সাহেবের বাসা ছিল জুবিলি রােডের বিপরীতে নৌ বাহিনী অফিসার্স মেস কোয়ার্টারে। সেখানেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহের পরিকল্পনা বাস্বায়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল মােয়াজ্জেমের। এরকম একদিন মিসেস মােয়াজ্জেম দেখেন কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীসহ আরও কয়েকজন চট্টগ্রামে মােয়াজ্জেমের বাসায় এসেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে (ওসমানী- মােয়াজ্জেম) কি কথা হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারেননি। এ ব্যাপারে মিসেস মােয়াজ্জেম বলেন, “আমি তখন জানতাম না ওসমানী সাহেব কেন এসেছেন। পরে জেনেছি তাদের বিদ্রোহের পরিকল্পনা নিয়ে ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ওসমানী সাহেব তখন সিনিয়র অফিসার। মােয়াজ্জেম জুনিয়র।

সে নাকি তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ওসমানী সাহেবকে বলেছিল, ‘স্যার, আপনারা যদি উৎসাহ দেন তাহলে আমরা সফল হবাে।’ তবে ওসমানী সাহেব নাকি তখন খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। বলেছিলেন, ‘এখন এ ধরনের বিদ্রোহ করার সময় নয়। যা হয় ভেবে চিন্তে করতে হবে।’ বরিশাল থাকতেও কখনাে কখনাে বিভিন্ন জন আসতেন আমাদের বাসায়। আমি রান্নাবাড় করে টেবিলে রাখতাম। ওরা আলাপ সালাপ করে খেয়ে দেয়ে কখন চলে যেতাে জানতাম । হয়তাে ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। সম্ভবত ১৯৬৬ সালের জুন-জুলাই মাস হবে। বরিশালের বাসায় একদিন মাঝরাতে হঠাৎ | ঘুম ভেঙে গেলে দেখি মােয়াজ্জেম কোরান শরীফ পড়ছে। এক পর্যায়ে ঘড়ি দেখে বলে উঠলাে, ‘ওরা যদি এতক্ষণে যায়, এখন অমুক গ্রামের অমুক জায়গায় (জায়গার নাম মনে নেই) পৌছেছে। আমি ওরা কারা জানতে চাইলেই সে চুপ করে থাকে। কিছু বলে না, পরে জেনেছিলাম ওই সময় স্টুয়ার্ড মুজিব ও আলী রেজার আগরতলা যাওয়ার কথা। তখননা। বাঙালি কর্মকর্তাদের কেউ উচ্চ পর্যায়ের ছিলেন না। বেশিরভাগই নিম্ন পর্যায়ের হওয়ায় ভারতীয়রা খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। আলাপ-আলােচনাও তেমন একটা সফল হয়নি। আগরতলা মামলার পর আবার দিল্লী যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাে সব শেষ হয়ে যায়। তাদের দলে আমির হােসেন নামে একজন লােক ছিলেন। শুনেছি সে টাকা পয়সা নিয়ে কিছু গণ্ডগােল করেছে। তাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে সে ঘটনা ফাঁস করে দেয়।”

মােয়ামেকে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম শিশু মিসেস মােয়াজ্জেম জানান, আগরতলা মামলা উদ্ভব হওয়ার প্রাক্কালে কমান্ডার মােয়াজ্জেম সপরিবারে ছিলেন বরিশাল। নভেম্বরে ঢাকা আসেন। এ সময় করাচি থেকে চিঠি দিয়ে তাঁকে রাওয়ালপিণ্ডি ডেকে পাঠানাে হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তিনি পিণ্ডি গিয়ে বাঙালি সহকর্মীদের মাধ্যমে ইঙ্গিত পান যে, তাকে সেখানে যে কোনাে সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তাই তিনি কৌশলে সরে গিয়ে তিন দিনের মাথায় ঢাকা ফিরে আসেন। মিসেস মােয়াজ্জেম তখন ছিলেন শান্তিনগরে দেবরের বাসায়। স্বামীর দ্রুত ফিরে আসার ঘটনায় তিনি প্রথমে কিছুটা অবাক হন। সেখান থেকে চলে যান শান্তিনগরেরই মিসেস মােয়াজ্জেমের বােনের বাসায়। সেখান থেকে ৯ ডিসেম্বর রাতে গ্রেপ্তার হন মােয়াজ্জেম। তখন তাঁর শরীরে প্রচণ্ড জ্বর ছিল। রাতে ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম শিশু (পরে বিএনপি নেতা), আমির হােসেন (রাজসাক্ষী) এবং অন্য কিছু সংখ্যক লােক এসে তাঁকে নিয়ে যান। নূরুল ইসলাম বলেছিলেন, একটা মিটিংয়ে যেতে হবে, ঘণ্টাখানেক পর দিয়ে। যাবাে।’ কিন্তু পরে আর দিয়ে যাননি। পরদিন সকাল বেলা পুলিশ এসে ঘরের ভেতর থেকে মােয়াজ্জেমের বই, কাগজপত্র যা পেয়েছেন খুঁজে নিয়ে যায়। অবশ্য মােয়াজ্জেম তার লিখিত জবানবন্দিতে ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি। এতে তিনি ৩ ডিসেম্বর বিকেলে পিণ্ডি পৌঁছার পর সাদা পােশাক পরা দুজন লােক তাকে ইন্টারােগেশন সেলে নিয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন। ধারণা করা হয়, ঢাকায় পালিয়ে আসার বিষয় আদালতে স্বীকার করলে তা ক্ষতিকর হতে পারে এই। আশঙ্কায় মােয়াজ্জেম কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

সূত্র : আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দী – মুহাম্মদ শামসুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!