You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.02 | রাজশাহী শহরে পাক সেনাবাহিনীর তাণ্ডব | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

রাজশাহী শহরে পাক সেনাবাহিনীর তাণ্ডব

জঙ্গি পাক সরকারের পৈশাচিকতায় বহু ঐতিহ্যময় রাজশাহী শহরটি আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে।
যাঁরা ওপারের বাংলার সংবাদ রাখেন তারা স্বীকার করবেন যে, ঢাকার পরেই উত্তরবঙ্গের এই শহরটি বঙ্গসংস্কৃতি বিকাশের একটি অন্যতম প্রধান প্রাণকেন্দ্র রূপে গড়ে উঠেছিল বিগত বছরে।
সীমান্তের ওপার থেকে সম্প্রতি যে দু-চার জন মুক্তিযােদ্ধা এপারে এসেছেন তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় যে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে নিয়ে খুন করে চলেছে। বিশেষ করে যেসব হিন্দু নেতা জনপ্রিয় এবং জঙ্গি শাসনের বিরােধী তারাই আক্রমণের লক্ষ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, বড় বড় পাঠাগার, যে কোনাে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এমনকি ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র স্মৃতি বিজড়িত বিখ্যাত বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এই আক্রমণের হাত থেকে অব্যাহতি পায়নি।
মুষ্টিমেয় পাঞ্জাবি বুদ্ধিজীবী ও কিছু ব্যবসাদার শাসকগােষ্ঠীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে চলেছে। ইস্টার্ন রাইফেলসের পশ্চিম পাকিস্তানি লােকেরাও এদের সঙ্গে যােগ দিয়েছে।
অধ্যাপক, ব্যবহারজীবী, ডাক্তার, শিক্ষক এবং ছাত্ররা পাকবাহিনীর শিকার হয়েছে। কতজন মারা গেছেন তার সংখ্যা সঠিকভাবে জানা এখন সম্ভব নয়।
জঙ্গি শাসকের আক্রমণ অত্যন্ত আকস্মিকভাবে এলেও ওখানকার সাধারণ মানুষ কিন্তু নীরবে তা মেনে নেয়নি। প্রথম আক্রমণে সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত কলেজের সর্বশ্রেণীর শিক্ষার্থী হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের সংগঠিত করে প্রতিরােধের জন্য এগিয়ে এসেছে।
যুবক, ছাত্র, পুলিশ বাহিনী বিশেষ করে সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের সর্বশ্রেণীর শিক্ষার্থী ও কর্মচারী এবং ইস্টার্ন রাইফেলসের লােকেরা বর্তমানে মুক্তিফৌজের প্রধান অংশ শহরাঞ্চলে। গ্রামে গ্রামে কৃষকরা বিশেষ করে সাঁওতাল অধিবাসীরা মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন।
পাক বেতার যতই প্রচার করুক না কেন এ কথা আজ পরিষ্কার যে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগের জন্য পাক বাহিনীকে একমাত্র আকাশ পথের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
পাকা সড়ক, রেলপথ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। নদীপথে যােগাযােগ করাও পাকবাহিনীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। শহরের টেলিফোন ব্যবস্থাও অচল।
বেতার কেন্দ্রে কোনাে কর্মচারী উপস্থিত না হওয়ায় মাঝে মাঝে করাচির সংবাদ প্রচারেই এর কর্মসূচি সীমাবদ্ধ।
সন্ধ্যা ছটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকে। সে সময় বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায় পাকবাহিনী এবং নেতৃস্থানীয় কাউকে পেলেই গুলি করে।
নিজেদের জন্য খাদ্যগুদাম লুট করা, গরু ভেড়া ছাগল যেখানে যা পায় তাই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করাই পাকবাহিনীর নিয়মিত কাজ।
নতুন গড়ে ওঠা সপুরা শহরতলীতে পাকবাহিনী এখন আশ্রয় নিয়েছে। কিছু ধনী পশ্চিমা ব্যবসাদারও তাদের সঙ্গে আছে।
মাঝে মাঝে নির্বিচারে বিমান থেকে গুলি চালিয়ে অসামরিক লােকদের মনােবল ভাঙার চেষ্টাও চলেছে।
নারীর সম্রম ও শিশুর নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য মুক্তি ফৌজের নির্দেশে তাদের গ্রামাঞ্চলে অথবা ভারত সীমান্তে সরিয়ে আনা হয়েছে।
সব চাইতে উল্লেখযােগ্য, মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে অন্য সবাই নানাভাবে এগিয়ে এসেছেন। বাড়ি বাড়ি খাবার রান্না হচ্ছে এবং রিকশা ও সাইকেল করে পৌছিয়ে দেয়া হচ্ছে যােদ্ধাদের হাতে। জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে সেদিকেও নজর আছে।
চিকিৎসা ও অস্ত্রের সমস্যা আছে, কিন্তু সবাই একমনে একপ্রাণে লড়াই করে চলেছেন এই ভরসায় যে, এ বাধা কাটিয়ে উঠবেন তারা সহজেই। ইতিমধ্যে জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা এদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় জয় সম্পর্কে এরা খুবই নিশ্চিন্ত।

সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১