You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তর-ফিরে দেখা | শাহ সাঈদ কামাল - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তর-ফিরে দেখা

শাহ সাঈদ কামাল

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কথা লিখতে গিয়ে যার কথা মনে পড়ে তিনি হলেন প্ৰয়াত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। সম্পর্কে আমার চাচাশ্বশুর। উনার উপস্থিতিতে সবসময়েই একটু অস্বস্থি অনুভব করতাম, কখনও না জানি জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলাপ করতে বসেন। সুখের বিষয় তিনি যার সাথে আলাপ করতেন তার বিষয়ের উপরই আলোচনা করতেন। আর সবার মতো মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার বিরাট দুর্বলতা। আমি মুক্তিযোদ্ধা তাই আমার সাথে এ বিষয়েই বেশি আলাপ করতেন। সে সময়ের আমার ছোটোখাটো যেসব অভিজ্ঞতা তা শুনে প্রায়ই ওনার স্বভাবসিদ্ধ স্থানীয় ভাষায় বলতেন, “বাবা, এইগুলো তোমাগো একটু লেইখা রাখনের দরকার, না আইলে ভবিষ্যৎ ছেলেপুলারা জানবো কেমনে?” অথচ তিনি নিজে কিন্তু লেখালিখিতে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। সেদিক থেকে আমরা নিজেদের বঞ্চিতই ভাববো। লিখতে গিয়ে তাই উনার কথাই মনে পড়ছে। কিছুদিন আগে (ডিসেম্বর, ২০০৮) আমি ঢাকা ক্লাবের মাসিক ম্যাগাজিন ‘Ramna Green’ এ লিখেছিলাম। আমার এ লেখাটি তারই সংস্করণ। লেখালেখিতে আমার প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা এবং প্রায় ৩৭/৩৮ বছরের স্মৃতির দুর্বলতা স্বীকার করেই লিখতে বসলাম। মূলত দুইটি কারণে, এক, নিজের ভেতরের দায়বোধ থেকে এবং নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস জানানোর জন্য। দ্বিতীয়ত এবং সম্ভবত প্ৰধান কারণ যে বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতি একটা মহাসংকটময় সময় পার করছে, স্বাধীনতার অনেকপরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির পরিচয় এই সংকটকালে প্রকট হয়ে উঠছে। অতএব আমার প্রয়াস সেই দিনগুলিতে নিজের দেখা ঘটনাগুলি তুলে ধরা।

একাত্তরের আমার বয়স ১৭-১৮র মাঝামাঝি- সব সম্ভবের এক বয়সী। মোমেনশাহী, বর্তমানে মির্জাপুরে ক্যাডেট কলেজের এইচএসসি প্রথম বছরের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের এই কয়েক মাসে ছোটো বড় অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে, তবে এই লেখায় যে ঘটনাগুলি তুলে ধরবো, তা সরাসরি কোনো যুদ্ধের ঘটনা নয়, যুদ্ধের পেছনের ঘটনা, সে সময়ের বাঙালি অনুভূতির ঘটনা, আবেগের ঘটনা। আমি নিজে একটু আবেগপ্রবণ মানুষ। ঘটনাগুলি আমাকে তখন যেমন নাড়া দিয়েছিল, আজো তেমনি দেয়। মনে হতো এতো মনের জোর, এতো সাহস, এতো দেশপ্ৰেম যে জাতির, সে জাতির স্বাধীনতা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

মেলাঘর হয়ে সীমান্ত পথে   ট্রেনিং নিয়ে ফিরছি। ট্রেনিং হয়েছে বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে সি-ইন-সি স্পেশাল এর দ্বিতীয় ব্যাচ-এ। আমি ঢাকার ছেলে, তাই ঢাকার আশে পাশে যুদ্ধ করার ইচ্ছা। কোলকাতা থেকে ট্রেনে আসাম, তারপর আগরতলায় ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘরে উপস্থিত। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ যুদ্ধে আহত, আমাদের যোগাযোগ ক্যাপ্টেন হায়দার, আমাদের হায়দার ভাইয়ের সাথে। চমৎকার এক মানুষ। ক্যাডেট কলেজে ক্যাপ্টেন পদবীর অফিসাররা আমাদের এ্যাডজুডেন্ট হতেন। ওনাদের দূরের মানুষ মনে হতো, কিন্তু হায়দার ভাইকে সে রকম কখনো মনে হয়নি। কী করলে এই অতি সাধারণ যোদ্ধাদের ভালো হবে, স্বল্প ট্রেনিংপ্ৰাপ্ত, এই যোদ্ধাদের অস্ত্রের যোগান দেয়া সম্ভব হবে এবং নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে অনুপ্ৰবেশ করানো যাবে, সেই চিন্তায় হায়দার ভাই মগ্ন। অথচ সদা সপ্রতিভ, অমায়িক কিন্তু কাজের বেলায় কঠোর (এমন মানুষের অপমৃত্যু আমরা কতো সহজভাবে মেনে নিলাম)। বলে রাখা ভালো, আমার দেখা মুক্তিযোদ্ধারা শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ গ্রামের অতি সাধারণ ছেলে। এই সব ছেলেদের নিয়েই একটি দল গঠন করতে হবে, তারপর অস্ত্রের যোগান এবং বাংলাদেশে প্ৰবেশ। এই কাজে আমি পেলাম, একই সাথে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আব্বাস ভাই (তৎকালীন ঢাকা কলেজের ভিপি ও ছাত্রলীগ নেতা), আঙ্গুর ভাই ও ফেলু ভাইকে। আব্বাস ভাই কমান্ডার আমি টুআইসি অর্থাৎ উপ-অধিনায়ক। ৩০-৩৫ জনের দল গঠন সমাপ্ত, এখন অপেক্ষা অস্ত্রের। কিছুটা দেরি হচ্ছে, ২-৪ দিনের অবসর। আব্বাস ভাই একদিন বললেন, ‘চল আগরতলা শহর ঘুরে আসি’। ঘুরতে যাবো বললেই তো আর যাওয়া যায় না, দুরু দুরু বুকে হায়দার ভাইয়ের কাছে আবেদন এবং আশ্চর্যজনকভাবে আবেদন সাথে সাথে অনুমোদন। মেলাঘর থেকে বাসে আগরতলায়, আমি ও আব্বাস ভাই। ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে আব্বাস ভাইয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ ভালো, তখনকার নামি-দামি নেতাদের ভাই বলে ডাকেন, আমি অবাক হই। যাদের দূর থেকে নাম শুনেছি, তারা তার কতো কাছের। আগরতলার রাস্তায় হঠাৎ তখনকার তুখোড় ছাত্র নেতা আব্দুল কুদ্দুছ মাখনের সাথে দেখা, আব্বাস ভাইয়ের সাথে ভালো পরিচয়। আমরা তিন জন আগরতলার স্বল্প পরিসর রাস্তায় হাঁটছি, নিজেকে কেমন জানি বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছে। একেতো ট্রেনিংপ্ৰাপ্ত তার উপর বিখ্যাত ছাত্র নেতার পাশে হাটছি, মনে হচ্ছিল সবাই বোধহয় বুঝতে পারছে যে আমরা অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাইন ইত্যাদিতে দক্ষ। রাস্তায় শরনার্থী ও যুব শিবিরের ছেলেদের বেশ ভিড়। এমন সময় কোত্থেকে ৫৫/৬০ বছরের এক বৃদ্ধের আগমন, সরাসরি আমাদের তিন জনের সামনে। সম্ভবত জানতে পেরেছে ছাত্রনেতাদের পরিচয়। তার আকুতি, “আমারে একটা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা কইরা দে” । ট্রেনিং পাবার ব্যাপারটা যত সহজ মনে হতো, ততো সহজ ছিল না। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যুবশিবিরগুলিতে ছেলে-যুবাদের প্রচণ্ড ভিড়। ট্রেনিংক্যাম্পের স্বল্পতা অতএব বৃদ্ধের ধারণা ক্ষমতাবান ছাত্র নেতারাই পারবে তার ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে। তার আকুতিতে আমরা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। আমাদের প্রশ্ন, বাবা এ বয়সে

ট্রেনিং নিয়ে কী করবেন? বৃদ্ধের উত্তর, ‘আমারে শুধু ব্যবস্থাটা কইরা দে, তারপর দেখ আমি কেমনে পাকিস্তানি জল্লাদদের শেষ করি’।

“আপনার বাড়িতে কে কে আছেন”? আমাদের প্রশ্ন।

বৃদ্ধের উত্তর, “কেউ নাই। তিন ছেলে, সবটিরে যুদ্ধে পাঠাইছি, বুড়িটারে এক আত্মীয়ের কাছে রাইখা আইছি, আমার আর কোনো পিছটান নাই। তোরা শুধু আমার ট্রেনিং এর ব্যবস্থাটা কইরা দে”। কী বিরাট বাস্তবতার মুখোমুখি আমি, এই আমি, আমার সামনে আমার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বয়সের বৃদ্ধ, বাড়িতে তার বৃদ্ধা স্ত্রী, তিন ছেলের যুদ্ধে গমন এবং সর্বোপরি তার নিজের বয়স, কোনোকিছুই তার মুক্তিযুদ্ধে যাবার বাসনা প্ৰতিহত করতে পারছে না, কী অসীম তেজ, কী অসাধারণ প্ৰত্যয়। এই দেশ স্বাধীন হবে না তো হবে কোনদেশ?

ক্যাপ্টেন হায়দারকে ঘিরে স্মৃতিঃ আমাদের দল গঠন সমাপ্ত, অস্ত্রের যোগানও শেষ, এখন সময় বুঝে বাংলাদেশে অনুপ্ৰবেশ। এই উদ্দেশ্যে মেলাঘর থেকে অস্ত্ৰ, গোলাবারুদ নিয়ে মনতলী যেতে হবে। মনতলী ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের ভেতর অনুপ্রবেশ করতে হবে, এমনই ব্যবস্থা। ক্যাম্পের দায়িত্বে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন। আগস্টের মাঝামাঝি কোনো একদিন। আমাদের দলটি সকাল থেকেই প্ৰস্তত। যার যার অস্ত্ৰ বুঝিয়ে দেওয়া হলো। অস্ত্রের মাঝে আছে ৩০৩ রাইফেল, ৭.৬২ মি. মি. এসএলআর, ৯ মি.মি. স্টেন, সাথে গুলি, গ্রেনেড, বিস্ফোরক, বিভিন্ন ধরনের মাইন। সবার মাঝে একটা উৎসবের ভাব, সবাই উৎফুল্ল-বাংলাদেশ নিজ ভূমিতে ফিরে যাবো বলে। লে. মালেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, হায়দার ভাই মাঝে মাঝে এসে তদারকী করছেন। উপ-অধিনায়ক হিসেবে তদারকীর তার কিছুটা আমার উপরও। আমাদের মনতলীতে নেবার জন্য ট্রাক প্ৰস্তত। পুরো দলটি লাইন করে দাঁড় করানো, হায়দার ভাই রওয়ানা হবার আগে ব্রিফিং করলেন। যে যার ব্যক্তিগত অস্ত্র পরীক্ষা করে নিচ্ছে, ঠিক এমন সময় ঠা’ করে গুলির শব্দ। সবাই হতচকিত, বুঝে উঠতে পারছি না কী হলো। হায়দার ভাই দলের মাঝ থেকে বের করলেন রফিক নামে ১৬/১৭ বছরের গ্রামের এক ছেলেকে। ঘটনা হলো, ভুলবশত সে তার ৩০৩ রাইফেল গুলি ভর্তি ম্যাগাজিন লাগিয়েছিল। অস্ত্র পরীক্ষার সময় ট্রিগারে চাপ দিলে গুলি বেরিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে আমাদের কারও গায়ে লাগেনি, হায়দার ভাই রেগে আগুন, এমনিই কমান্ডো হিসাবে তাকে বেশ কঠিন লাগে, রেগে গিয়ে আরও কঠিন হয়ে গেলেন। ছেলেটির অস্ত্ৰ কেড়ে নিলেন এবং দল থেকে বের করে দিলেন। তার কথা, এখনই যদি এত অদায়িত্বশীল হয় তবে এই ছেলে ভবিষ্যতে পুরো দলকে বিপদে ফেলবে, অর্থাৎ সেই রফিকের আর আমাদের সাথে যাওয়া হবে না। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি আমার কাছে হাজির, তার হয়ে হায়দার ভায়ের কাছে ওকালতি করতে হবে যাতে সে যেতে পারে। রফিকের চোখে জল ও প্রচণ্ড আকুতি, যেনো এই যাবার উপরই তার জীবন নির্ভর করছে। অতএব আমি আমাদের কমান্ডার আব্বাস ভাইকে নিয়ে গুটি গুটি করে হায়দার ভায়ের কাছে উপস্থিত এবং রফিককে ক্ষমা করে আমাদের সাথে যাবার অনুমতির জন্য অনুরোধ করি। বেশ অনেকবার অনুরোধের পর হায়দার ভাই নরম হলেন এবং অনুমতি দিলেন। রওয়ানা হবার আগে নানা প্রসঙ্গে আমাদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছেন, এবার বিদায়ের পালা, হায়দার ভাই আমদের বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কথা বলছেন কিন্তু ভারী গলায়, তাকিয়ে দেখি তার চোখে জল। বললেন, তোমরা নিজেরাও জানো না তোমরা কতো বিপদের মাঝে যাচ্ছো। বাংলাদেশের ভেতরে শুধু পাকিস্তানি শত্রুরা তোমাদের চারিপাশে থাকবে না শত্রু তোমাদের ভেতরেও থাকবে। এইসব ছেলেরা যারা তিন অথবা চার সপ্তাহের ট্রেনিংপ্ৰাপ্ত, তাদের নিজ অস্ত্ৰ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে মানসিক শৃঙ্খলা প্রয়োজন, সেটা এতো অল্প সময়ে হয়ে ওঠে না। এদের সঠিক নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে তোমাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ তার ওপর আছে বিশ্বাঘাতক বাঙালিরা।

আমরা বেশ উৎফুল্প, বাংলাদেশের পথে রওয়ানা দেবো বলে, কিন্তু বিদায় বেলায় এই কঠিন হৃদয়ের মানুষের চোখে জল ও কথা শুনে আমাদের মনটাও ভারাক্লান্ত হয়ে এল। তাৎক্ষণিকভাবে অনভিজ্ঞতার কারণে তার কথা উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্ত পরে বাস্তবতায় এসে বেশ অনেকবারই কঠিনভাবে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। হায়দার ভাইয়ের সাথে আমার তখনকার মেলাঘর ক্যাম্পে পরিচয়ের ব্যাপ্তি ৭-১০ দিনের। চাকুলিয়া থেকে ট্রেনিং শেষে কলকাতা হয়ে আসা (আমরা কলকাতা থেকে ট্রেনে করে কুচবিহার, আসাম হয়ে বাংলাদেশের পশ্চিম-উত্তর ঘুরে ত্রিপুরা আসি। সময় লাগে ৭ দিনের বেশি)। এই অল্প সময়ে হায়দার ভাইকে যে খুব বেশি কাছ থেকে দেখতে পেরেছি তা নয়। শুনেছি উনি কমান্ডো ছিলেন। চলা ফেরায়, আচার আচরণে সব সময় বেশ কঠিন মনে হতো। অথচ এই অল্প সময়ের পরিচয়ে বিদায়ের সময় কঠিন মানুষটার অত্যন্ত কোমল দিকটার পরিচয় আমরা পেলাম। কী অসাধারণ মমত্ববোধ। বিজয়ের ঠিক আগে সম্ভবত ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে মুগদাপাড়ায় অবস্থিত এক জুট মিলে হায়দার ভাইয়ের সাথে মিটিং এ দেখা হয়েছিল। বিজয়ের পরে দেখা হয়েছে ঢাকায় বহুবার, তখন এই কঠিন এবং কোমল মানুষটার পরিচয় আরো পেয়েছি। যুদ্ধ মানব চরিত্রের কতো দিকই না চেনায়।

সীমান্ত পার হওয়ার অভিজ্ঞতা আগস্টের শেষ অথবা সেপ্টেম্বর প্রথম। আমাদের ৩০-৩৫ জনের গ্রুপটি মনতলী (আগরতলা) ক্যাম্প থেকে হাতিমারা (সম্ভবত কুমিল্লার উল্টো দিকের কোনো জায়গা) দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি। সময় সন্ধ্যার পর, উদ্দেশ্য, মাঝ রাতে পাকিস্তান আর্মির দুটি প্রধান বাধা, ঢাকা-চিটাগাং রেল লাইন এবং সিএন্ডবি রোড (বোধ হয় বর্তমানের কুমিল্লা-ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া সড়ক), পাড়ি দেওয়া। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে তারপর নৌকায় যেতে হয়। আমাদের প্ৰত্যেকের কাছে ব্যক্তিগত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নিজস্ব প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র, বিছানার চাদরে বোচকার মতো করে বেধে পিঠের উপর-ওজন আধমান বা বেশি। পিঠে বাধা গোলাবারুদ, মাইন এর সাথে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক জিনিষপত্র। কিছুক্ষণ পিঠে থাকার পর বুঝলাম যথেষ্ট ভার। তার সাথে আছে অসুস্থ সহোযোদ্ধাদের বোঝা ভাগ করে নেওয়া (৩০-৩৫ জনের গ্রুপে ৩-৪ জন অসুস্থ থাকাই স্বাভাবিক)। এ যেন “বোঝার উপর শাকের আটি”। আমাদের লক্ষ্য ঢাকার পূর্বে রূপগঞ্জ থানায় বালু নদীর পাড়ে হরদি বাজার (ইছাপুর বাজারের প্রায় ২ কি. মি. উত্তরে) যা বর্তমানে রাজউকের উপ-শহর প্রকল্প “পূর্বাচল”। আমাদের সাথে একজন গাইড, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। আমাদের গ্রুপটা অনুপ্রবেশের জন্য বিশেষ সতর্কতা অনুসরণ করা হয় এবং দুই বার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। কারণ আমাদের ঠিক আগের গ্রুপটা সিএন্ডবি রোডে ব্রিজ পার হবার সময় পাকিস্তান আর্মির এম্বুসে পড়ে এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়। অতএব, ঠিক কখন রওয়ানা হবো তা আগে থেকে বলা হচ্ছে না। পাকিস্তান আমি কোনোভাবে আগের থেকে খবর পেলে আমাদের পরিণতি একই হতে পারে এই আশঙ্কায়। যুক্তিও আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধারা খুব মূল্যবান, আরও মূল্যবান অন্ত্রশস্ত্র ও গোলা বারুদ। ঘটনাক্রমে আমাদের আগের গ্রুপে যারা আহত তাদের দেখার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগের ঘটনায়। ছাত্র নেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখনের সাথে দেখা হওয়ার এক পর্যায়ে তিনি বললেন যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা আহত অবস্থায় বিশ্রামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে আছে। তাদের দেখতে যাবার জন্য, তার জিপে যেতে হবে। আমরা বিশ্রামগঞ্জের বাংলাদেশ হাসপাতালে পৌছালাম। তরুণ ডাক্তার জাফরুল্লা চৌধুরী হাসপাতালটির তত্ত্বাবধানে। ওখানেই তাকে প্রথম দেখি। ঘন্টাখানেক ওখানে ছিলাম, সে এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। সদ্য আহত কারও হাত কেটে ফেলা হয়েছে, কারও পা কেটে ফেলা হয়েছে, করুণ স্বরে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে, অসহায় ডাক্তাররা। প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র, সরঞ্জামের অভাব। এ হাসপাতালকে আবার প্রকৃত হাসপাতাল ভাবার কোনো অবকাশ নেই। মোটামুটি জঙ্গল কেটে টিলার উপর বাঁশের তৈরি ঘর। বিছানাগুলি বাঁশের মাচা, এই অবস্থা। মনে হলো, এদের আপনজনেরা কেউই জানে না এরা কোথায় কী অবস্থায় আছে। তাদের আদরের, ভালোবাসার, স্নেহের পরশটুকু ও পাচ্ছে না এই সময়। নিজেকে এদের অবস্থানে ভেবে মনটা হু/হু করে উঠলো। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরলাম। জানা ছিল সীমান্ত পাড়ির সময় ওরা আহত হয় কিন্তু যেটা জানা ছিল না সেটা হলো যে আমাদেরই একই পথে যেতে হবে। ফিরে আসি আমাদের স্বদেশ যাত্রায়। হাতিমারা থেকে রাত ৯টা -১০ টার দিকে হেটে রওনা হলাম। গ্রামে বেশ গভীর রাত। বেশ কিছু সময় হেঁটে তারপর নৌকায় উঠলাম। বর্ষার শেষ, গ্রামের পরিবেশে শীতের হাতছানি, মনে টান টান উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা। দুই মাস পরে ফিরছি। যে আমি ভারতে এসেছিলাম আর যে আমি ফেরত যাচ্ছি তার মাঝে বিরাট ব্যবধান। এসেছিলাম বালক, এখন এই দুই মাসে কৈশোর ছাড়িয়ে যুবক, মানসিকভাবে আরও বেশি ঋজু। দলনেতা হিসেবে আমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে আমার সহযোদ্ধাদের জীবন-মরণ। তারা বয়সে অধিকাংশই আমার চেয়ে বড়। অতি সাধারণ গ্রামের ছেলে অথচ কী সরল, সুন্দর চোখে মুখে দেশপ্রেমের ছাপ। সামনে জীবন মৃত্যুর দোলাচল “হয় মারো নয় মরো”। মনটা কেমন করে উঠে। জীবনের অনেকটাই তো দেখা হলো না, কেন এমন হলো? কেন এমন হয়? কিছু মানুষের কথা বহির্ভূত ক্ষমতার লোভের জন্য এতো মানুষের এত ভোগান্তি? সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। মনটা উদাস হয়ে উঠে। মনে হয়, আহা জীবনটা কতো সুন্দর, বেঁচে থাকাটা আরও সুন্দর। দুটি নৌকা ঠিক হলো, একেকটিতে ১৫-১৬ জন করে। একটির ভর আমার ওপর, আরেকটির ভার আব্বাস ভাইয়ের ওপর। মাঝরাত, বেশ আধার, ঘোর আমাবশ্যার রাত। আমাদের সুবিধা অন্ধকারে আমাদের দেখা যাবে না। নৌকার পাটাতনের উপর পিঠের বোচকা রেখে চারিদিকে দৃষ্টি রেখে এগুচ্ছি। মোটামুটি নির্বিম্নে সামনে এগিয়ে চলছি। মাঝরাত, সবার মাঝে সাংঘাতিক এক অব্যক্ত উত্তেজনা। প্ৰথমে পার হতে হবে রেল লাইনের ব্রিজ। ব্রিজের উপর পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের বাংকার, তবে আশার বিষয় রাতের বেলায় ওরা বাংকার থেকে সাধারণত বেরোয় না। রেল ব্রিজের কাছাকাছি গিয়ে অপেক্ষা রাজাকারদের সংকেতের। ভয় হয় আবার না এম্বুশে পড়ি। আমরা মোটামুটি গাইডের উপর নির্ভরশীল। গাইড অপরিচিত আর যুদ্ধের সময় এমন যে, কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের বাঙালিরাইতো জামায়াত এ ইসলামী, রাজাকার, আলবদর। অবশেষে নির্বিঘ্নে রেল ব্রিজ পার হলাম, দুইটি নৌকাই পাশাপাশি। এখন কিছুটা নিশ্চিত অন্তত সিএন্ডবি রাস্তা পর্যন্ত। নৌকার সহযোদ্ধাদেরকে উপর নজর রাখতে হচ্ছে, কেউ যেন আবার বিড়ি সিগারেট না ধরায়। যুদ্ধক্ষেত্রে এটা একেবারেই মানা, শত্রুর গুলির নিশানা হওয়ার খুব সহজ উপায়। দূর থেকে সিএন্ডবি রোড দেখা যাচ্ছে, আরও দেখা যাচ্ছে বাতি নিভিয়ে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর গাড়ির কনভয়ের আনাগোনা। আমরা সতর্কতার সাথে এগুচ্ছি সবচেয়ে বিজপজ্জনক বাধা অতিক্রম করার জন্য। দূর থেকে ব্রিজটিকে আবছা দেখা যাচ্ছে, যার নিচ দিয়ে যেতে হবে। মনে হচ্ছে মৃত্যুফাঁদ। রাতের নিকষ আধারেরও একটা আলো থাকে, তাতেই অনুমান করছি ব্রিজটার অবস্থান। আমাদের গাইডের একই অনুমান। এমন সময় হঠাৎ মনে হলো আমাদের আরেকটি নৌকা পাশে নেই। এই অন্ধকারে দূরে একটা আলো আলো ভাব থাকে অথচ কাছের জিনিষ দেখা যায় না। নৌকাটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শুরু হলো খোজা, ওরাও হয়ত খুঁজছে, আমরাও খুঁজছি। মাঝি চালাচ্ছে খুব সাবধানে, বৈঠার শব্দ ও যেন না হয়। প্ৰায় ঘন্টা দুয়েক পার হলো, সময়টা আরও দীর্ঘ মনে হচ্ছে। রাত প্রায় শেষ, কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটা নৌকা না পেলে ফিরতে হবে। দিনের আলোয় পানির ওপর নৌকায় আমরা একেবারে অসহায়। আমাদের থেকে রাস্তায় পাকিস্তান আর্মির অবস্থান গুলির দূরত্বও ভেতর। দিনের আলো ফুটে উঠেলে শত্রুর গুলিতে মারা যাওয়া ব্যতিত আর কোনো উপায় নাই। কিন্তু ফিরি কী করে? অন্য নৌকা কোথায়? প্ৰচণ্ড দোটানা। ঠিক সেই সময় পাশ থেকে চাপা স্বরে ডাক শুনলাম। পাশের নৌকার অনুযোগ আমরা কোথায় ছিলাম, আমাদেরও একই অনুযোগ। দ্রুত অভিযোগ, অনুযোগ শেষ করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের তাড়াতাড়ি পার হতে হবে সময় খুব অল্প। কিছুক্ষণের মাঝে ফজরের আজান পড়বে, বেশ শীত শীত লাগছে। ঠিক এই সময় মনে হলো পানিতে কিছু একটা নড়ছে। আমরা সতর্ক; কী ওটা? দেখি কিছু একটা সাঁতরে আমাদের নীেকার দিকে আসছে। খুব কাছে আসলে দেখি একটা মানুষ, আমরা আশ্বৰ্য, কিছুটা হতবিহবল। মানুষটাকে টেনে আমাদের নৌকায় উঠানো হলো, নানারকম শঙ্কা মনের মাঝে কাজ করছে। নৌকায় উঠানোর পর দেখলাম মাঝবয়সী এক লোক (৪০-৪৫), গায়ের রং বেশ কালো, মুখে দাড়ি, অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, শীতে কাঁপছে। আমাদের সাবধানী গলায় জিজ্ঞাসা “কে তুমি”?

উত্তরে সে তার ভাষায় বলে “তোরা যাইছ না, ফিরা যা, তোরা যে আইবি এই খবর ওরা জানে, গেলে ঠাইত (একেবারে) মারা পরবি, ব্রিজের ওপর ওৎ পাইতা (এম্বুসি)আছে।” আমরা বিশ্বাস করি না, আগেই বলেছি। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা খুব কঠিন এবার জিজ্ঞাসা করি তার পরিচয়। সে পরিচয় দেয় না, বরং বার বার ফিরে যেতে বলে। আমাদের হাতে সময় কম, সকাল হয়ে আসছে পার হতে হলে এখনই শেষ সময়। নৌকার জন্য সহযোদ্ধারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। এক পর্যায়ে আমরা বেশ কঠিন হয়ে উঠি এবং ধমক দিয়ে বলি যে আমাদের আসার খবর সে কী ভাবে জানলো? আরও ভয় দেখলাম, পরিচয় না দিলে আমরা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো। উত্তরে সে যা বললো, তা শোনার জন্য অন্তত আমি প্ৰস্তুত ছিলাম না। সে বললো যে সে এখানকার রাজাকার কমান্ডার এবং আমাদের আসার খবর সে পাকিস্তান আর্মির কাছ থেকে পেয়েছে। পেয়েই সে এই বিলের মাঝে গ্রামে (অনেকটা দ্বীপের মতো) অপেক্ষা করছে। স্থানীয় হিসাবে সে জানে যে ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে হলে এই পথ দিয়েই যেতে হবে। তার পরের ঘটনা আমাদের জানা। আমরা বিস্মিত, কিছুটা বিচলিত। জিজ্ঞাসা করলাম। এতোক্ষণ পরিচয় না দেয়ার কারণ, উত্তরে সে যা বললো, সেটা আরো বিস্ময়কর। সে বললো কিছুদিন আগ পর্যন্ত তার বড়ভাই এখানকার রাজাকার কামান্ডার ছিল। একইভাবে খবর পেয়ে কয়েকদিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপকে বাধা দিতে এসেছিল। গ্রুপটি তার কথা শোনেনি বরং যখন তার পরিচয় পেয়ে সেই গ্রুপেরই একটি ছেলে উত্তেজিত হয়ে গুলি করে এবং তার বড় ভাই মারা যায়। সেই গ্রুপটি ব্রিজ অতিক্রম করার সময় এম্বুসে পড়ে এবং অনেক যোদ্ধা হতাহত হয়। আমি তার বর্ণনা শুনছি আর হিসেব করছি। আমার হিসেব মিলে যায়। এই গ্রুপকেইতো আমরা দেখে আসলাম বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে। অবিশ্বাস থেকে লোকটার উপর বিশ্বাস জন্মালো। আমি দাঁড়িয়ে আছি এমন এক মানুষের সামনে যার বড় ভাইকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে মেরেছে মাত্র ৭/৮ দিন আগে । তার অপরাধ ছিল যে সে সেই দলটিকে বাঁচাতে চেয়েছিল। ব্যাপারটি যদিও ঘটেছিল ভুল বুঝাবুঝির কারণে। আজ তারই ছোটভাই একইভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাঁচাতে এসেছে। নিজের মাঝে নেই কোনো রাগ, ক্ষোভ, এটাই যেন তার কর্তব্য। এ কোন স্তরের মানুষ? এ কেমন দেশপ্ৰেম?

আমরা নৌকা ঘুরাই, ফিরে আসি। ভাবনায় মনটা ভারাক্রান্ত। দেশ একদিন স্বাধীন হবে হয়তো। এ মানুষটার পরিচয় রাজাকার হিসাবে থাকবে, অথবা কোনো মুক্তিযোদ্ধার হাতে মারাও পড়তে পারে। কিন্তু সে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য, দেশের জন্য আজ যা করলো, তাকে আমি কিসের সাথে তুলনা করবো? যুদ্ধ বড় জটিল জিনিষ এবং কারও কাম্য হতে পারে না। কিন্তু এ ধরনের সংকট প্রকৃত মানুষ চেনায়। এই মানুষ চেনাটাই আমার মুক্তিযুদ্ধের বিরাট অর্জন। যে প্রশ্নটির মিমাংসা আমি আজও করতে পারিনি, সেটা হল, সেই রাজাকার কমান্ডার আর আমার মাঝে, কে বড় মুক্তিযোদ্ধা? সে না আমি?

প্রায় মৃত্যু ফাঁদেঃ বাংলাদেশ অনুপ্রবেশের প্রথম ব্যর্থতার পর দ্বিতীয়বার অন্য পথে ঢুকি। এবারের অনুপ্রবেশটা মোটামুটি নির্বিঘ্ন ছিল। সিএন্ডবি রাস্তা পার হবার পর আমাদের সবার মাঝেই স্বস্তিভাব ফিরে আসে। তখন মাঝরাত, নৌকার মাঝে চলাচলের পথ দিয়ে নিঃশব্দে এগুচ্ছে। আমাদের গাইডকে আমাদের অবস্থান জিজ্ঞাস করলাম। সে বললো কিছুক্ষণের মাঝে আমরা একটি নদী পার হব, তারপর হেঁটে ভোরের আগে আমাদের কুমিল্লার কোনো এক গ্রামে দিনের মতো আশ্রয় নিতে হবে। আবার সেই পিঠের উপর বোঝা নিয়ে হাঁটা, নৌকাই তো ভালো ছিল। উপায় নেই, সংকটকালের পথ তার নিজের নিয়মে চলে।

মাঝরাতের পর অন্ধকার নদীর পাড়ে আমরা কোনো এক জায়গায় নামলাম। নৌকার ভাড়া চুকিয়ে গাইড এর পিছনে পিছনে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছি, গাইডের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। পথ ঘাট আমরা কিছুই চিনি না। আমাদের এই নৌকার মাঝি সম্বন্ধে কিছু না বললে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা অনেকটাই বলা হবে না। নৌকায় করে যখনই আমরা কোনো ব্রিজ বা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো বাংকার অতিক্রম করছি তখন স্বাভাবিক কারণেই সবাই বেশ উৎকণ্ঠায় থাকতাম। কোথায় মাঝিকে আমরা সাহস যোগাব, উল্টো সে আমাদের অভয় দিয়ে বলতো “আপনারা একটুও চিন্তা কইরেন না, মিলিটারিরা রাতে বাইর অয় না, আমি ঠিকই আপনাগো যায়গা মতো লইয়া যামু।” এই হলো আমাদের অতি সাধারণ মানুষের সাহস এবং আমাদের জনযুদ্ধে সম্পৃক্ততা। নৌকা ভাড়ার টাকাটা না নিলেই নয়, তাই নেয়া।

বর্ষার ক্ষেতের আইল তার উপর পিঠে ভারী বোঝা নিয়ে হাঁটা বেশ কঠিন ব্যাপার। আমরা যারা অভ্যস্ত নই, তারা থেকে থেকেই ক্ষেতের চিকন আইল থেকে কাদায় পড়ে যাচ্ছি। এভাবে চলতে চলতে কখণ যে সকাল হয়ে গেছে টের পাইনি। আমরা তখন এক বিরাট ক্ষেতের মাঝে, দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। রাতের আঁধারের মাঝে গ্রামে পৌঁছতে না পারলে বিরাট বিপদ, দিনের আলোয় আশে পাশের সবাই দেখে ফেলতে পারে যে একটি ৩০-৩৫ জনের মুক্তিযোদ্ধা দল যাচ্ছে। এই সংবাদ শত্রুর কাছে পৌঁছতে কতোক্ষণ? আমরা যতই তাড়াহুড়া করি, গ্রামগুলি আরও দূর মনে হয়। এরই মাঝে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। যে ভোরের সূর্য সবার কাছে কাঙ্খিত তা তখন আমাদের কাছে সব চাইতে অনাকাঙ্কিত। দু, চার জন করে কৃষক মাঠে আসছে আর বিস্ময়ে আমাদেরকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দেখছে। আমাদের কাঁধের রাইফেলগুলি আমাদের বিশ্বাসঘাতকা করে ভরের আলোয় লম্বা ছায়া ফেলে এগিয়ে চলছে। গাইডের উপর আমাদের সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছে। তা হলে কি ও আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? আমাদের ভুল পথে নিয়ে ধরিয়ে দেয়ার জন্য? কিছু ছেলে তো গাইডের প্রতি মারমুখী, পারলে ওখানেই গুলি করে মারে। অবশেষে, মোটামুটি আলোর মাঝেই আমরা গ্রামে পৌঁছালাম। গ্রামের লোকজন এগিয়ে এসে যা বললো তা মোটেই স্বস্তিকর নয়। মাত্র দু-দিন আগে পাকিস্তান মিলিটারিরা এই গ্রাম তছনছ করে গেছে। গ্রামের অবস্থানটাও বিপদজনক একদিকে ময়নামতি কেন্টনমেন্ট, আরেকদিকে ঢাকা-চিটাগাং রোড, অন্যদিকে থানা। মোটামুটি চারিদিকেই আমরা শত্রু পরিবেষ্টিত। উপায় নেই, তাই এই গ্রামেই দিনটা কাটাতে হবে। দুই দিন আগে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া এক বাড়িতে আমরা অবস্থান নিলাম। বন্দোবস্ত করতে বললাম। তারাও শঙ্কিত, মিলিটারি খবর পেলে আবারও বড় ঝাপটা তাদের উপর দিয়েই যাবে। এদিকে আমরা নজর রাখছি আমাদের গাইড যেনো কোনো অবস্থাতেই আমাদের চোখের আড়াল না হয়। যেই গাইডের হাতে আমাদের জীবন মরণ নির্ভর করে তাকে কতো অবিশ্বাস, এটাই বাস্তবতা। গ্রামের লোকদের বলা হলো তারা যেন চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে এবং সন্দেহজনক কিছু দেখলে আমাদের খবর দেয়। এদিকে সারা রাতের নির্ঘুম পথচলার ক্লান্তি ও উত্তেজনায় একে একে সবাই বাড়ির উঠানে বসে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। পিঠের বোঝাটা খুলে নেবার ফুরসত নাই। কাত হয়ে বোচকার উপরই ঘুমিয়ে গেছে। জেগে আছি দুজন, আমি ও আরেকটি গ্রামের ছেলে। আমার জন্য চোখ খোলা রাখা দায়। কিন্তু এই অবস্থায় সবাই ঘুমালো, শত্রু এলে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে মারবে, একটি গুলিও খরচ করতে হবে না। অগত্যা অনেক কষ্টে, চোখে পানি দিয়ে নিজেকে জাগিয়ে রাখছি। বেলা সকাল ৯টা-১০টা হবে, এমন সময় গ্রামের লোক খবর নিয়ে এল কিছু মিলিটারি এই গ্রামের দিকে আসছে। পরিস্থিতির কারণে আমি নিশ্চিত যে তারা খবর পেয়েই আসছে। খবরটা দিয়ে লোকজন গ্রামের অপর প্রান্তে চলে গেল। দু-চারজন সাহসী লোক আমাদের সাথে রইলো। এখন বাড়ির অবস্থানটা সম্বন্ধে একটু ধারণা দেওয়া যাক। বাড়িটি গ্রামের শুরু দিকে, একদিকে ফসলের মাঠ, পিছন দিকে গ্রামের অন্যান্য বাড়ি, রাস্তার পাশে একটু ঢালু যায়গা তারপর বাগান, বিভিন্ন ফলজ গাছ, তারপর বাড়িটি। এই বাগানে এসে গাছের আড়াল থেকে আমি দেখবার চেষ্টা করলাম। মিলিটারির অবস্থান তখন বেশ দূরে। আনুমানিক ১০-১২ জনের গ্রুপ এক লাইনে মার্চ করে গ্রামের দিকে আসছে। আমি ও আমার সাথের ছেলেটি ফিরে এসে ঘুমন্ত সহযোদ্ধাদের কাউকে ধাক্কা দিয়ে কাউকে পানি ঢেলে জাগিয়ে তুলি। সবাই সজাগ হলে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি। তাড়াতাড়ি করণীয় ঠিক করে আমি ১০ জন ছেলে নিয়ে সামনে বাগানে গাছের আড়ালে অবস্থান নেই। সিদ্ধান্ত, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চলবে গুলি না করার কারণ এই শত্রুর ১০-১২ জনের দলটিকে ঘায়েল করতে হয়তো অসুবিধা হবে না, কিন্তু গোলাগুলি আরম্ভ হলেই আমরা পুরো ফাঁদে আটকে যাবো। কেন্টনমেন্ট এবং থানা থেকে ওদের শক্তিবৃদ্ধি করতে পেতে দেরি হবে না। এই অচেনা যায়গায় এতবড় যুদ্ধের ঝক্কির সামর্থ আমাদের নেই। অর্থাৎ গুলি হওয়া মানেই আমাদের পুরো দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, চারদিকে থেকে আমরা অবরুদ্ধ হয়ে যাবো।

এদিকে শত্রু এগিয়ে আসছে ২০০ গজ, ১০০ গজ, দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে। তাদের একেকটি কদম যেন আমার বুকের উপর এসে পড়ছে। কড়া নির্দেশ, আমি গুলি করার সাথে সাথে অন্যরা গুলি করবে। তার আগে নয়। চরম উত্তেজনা, শত্রু ৩০-৩৫ গজের মাঝে চলে এসেছে। গুলি করলে পুরো দলটিকেই শেষ করা যাবে। সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আর দেরি করা সম্ভব না। এবার শত্রু আমাদের দেখে ফেলবে। আমি ট্রিগারে হাত রেখে গুলি করার নির্দেশ দেবো। ঠিক তখনই মিলিটারির দলটা থমকে দাড়ালো, কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক তাকালো তারপর উল্টো ঘুরে যেদিকে থেকে এসেছিল সেদিকে রওয়ানা হলো। আমাদের সবার যেনো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ালো। এরপর সারাদিন যে কীভাবে আমার মনে নেই। কখন উঠেছি-কখন খেয়েছি। কিছু মনে নেই। একেবারে সন্ধ্যায় উঠে আবার ঢাকার পথে রাতের যাত্রা শুরু। বেঁচে থাকার আনন্দটাই অন্যরকম।

দেশপ্ৰেমী মা ঠা-ঠা-ঠা, কানের কাছে গুলির আওয়াজে, লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। কয়েক মুহুর্ত স্থির থেকে বুঝার চেষ্টা করছি কী হচ্ছে। ইতোমধ্যে সহযোদ্ধাদের অনেকেই আমার মতো জেগে উঠেছে। গুলির শব্দ শুনে মনে হলো পাকিস্তান আর্মির আক্রমণ। ব্যক্তিগত অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে এলাম। ঘর মানে, মাটির ঘর, দেয়ালটা খুব পুরো। ভিতর থেকে ঠিক কোন দিক থেকে শব্দটা আসছে বোঝা কঠিন। আমার সাথের যোদ্ধারাও বেরিয়ে এসেছে। গ্রামের দু/চারজন উদ্বিগ্ন মানুষ আমাদের ক্যাম্পের পাশে জড়ো হতে শুরু করেছে। প্ৰথমে যে আশংকা করেছিলাম যে আমাদেরও ক্যাম্পের উপর আক্রমণ হয়েছে, এখন মনে হচ্ছে একটু দূরে, ২-৩ মাইল হতে পারে। রাতের নিস্তব্ধতার জন্য এত কাছে মনে হয়েছিল। অনবরত চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি-র গুলির শব্দ আসছে।

যে দিনের ঘটনা সেটা হলো রোজার ঈদের দিন-পেরিয়ে যে রাত সেই দিবাগত রাতের। গুলির শব্দ আসছে দক্ষিণ দিক অর্থাৎ ইছাপুর বাজারের দিক থেকে। ঐ দিকটায় মায়া ভাই এবং আরও দুই একজনের ক্যাম্প। আমাদের ক্যাম্প হরদি বাজারে। সরাসরি আমাদের ক্যাম্পে আক্রান্ত না হওয়ায় সাময়িক স্বস্তি। এই সময় গ্রামের কিছু লোক এসে খবর দিলো যে ইছাপুরেই আক্রমণ হয়েছে। বর্তমানে যে বিমানবন্দর, সে দিক থেকে একটা কাঁচা রাস্তা সোজা পূর্বদিকে (উত্তরখান-দক্ষিণখানের মাঝ দিয়ে ৪-৫ মাইল আনুমানিক) ইছাপুরার দিকে এসেছে। পাকিস্তান আর্মি সেই রাস্তা ধরেই এদিকটায় এসেছে। আগেই বলেছি, এই এলাকাটাই বর্তমানে পূর্বাচল প্রকল্প। এর মধ্যেই আব্বাস ভাই, ফেলু ভাই ও আঙ্গুর ভাই এসে উপস্থিত, আমরা চারজন ও গ্রুপের বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে আমাদের করণীয় কী সে ব্যাপারে আলোচনায় বসলাম সংক্ষিপ্ত আলোচনা, দ্রুত সিদ্ধান্ত হলোঃ

১। আমাদের ক্যাম্পের গোলাবারুদ সব জঙ্গলের বিভিন্ন যায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে। যদি কোনো কারণে আমাদের পিছু হঠতে হয় তবে এই গোলাবারুদ যেনো পাকিস্তান আর্মির হাতে না পড়ে। এই সংকট কাটার পর ঐ সব গোলাবারুদ উদ্ধার করা যাবে। কিছু লোককে এই দায়িত্ব দেওয়া হলো।

আমাদের গ্রুপে তখন লোক সংখ্যা ৩০-৩৫ থেকে প্ৰায় ১০০ এর কাছাকাছি। অধিকাংশই স্থানীয় ছেলে ও যুবক নতুন যারা সংযোজিত, তাদের আমরা শুধু কিছু নুন্যতম প্রশিক্ষণ এবং গ্রেনেড, রাইফেল চালানো কিছু কিছু শিখিয়েছি কিন্তু তাদের অস্ত্র দেওয়া সম্ভব ছিল না। মূলত তাদেরই এই দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিছু ছেলে রাজাকার বাহিনী থেকে পালিয়ে অস্ত্রসহ আমাদের সাথে যোগ দেয়, সংখ্যা ৩/৪ জন, তাদেরও এই দায়িত্বে সম্পৃক্ত করা হলো।

২। ৭-৮ জন করে ৪টি ভাগে ভাগ হয়ে আমরা গুলির শব্দের উৎসের দিকে রওয়ানা দেবো, এবং গ্রুপ কমান্ডারের সিদ্ধান্তে, যেখানে যেরকম প্রয়োজন সেভাবে পাকিস্তান আর্মির মোকাবেলা করবো ।

৩। কিছু ছেলে ক্যাম্পে থাকবে, বিকল্প ক্যাম্প হিসেবে আরও ২টি জায়গা নির্ধারিত করা হলো। যদি কোনো কারণে আমাদের ক্যাম্পটি হাতছাড়া হয় তবে বিকল্প ক্যাম্প গুলিতে আমরা জড়ো হবো।

৪ । গ্রামবাসীদের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে বলা হলো এবং শত্রুর ব্যাপারে কোনো তথ্য পেলে সবচেয়ে কাছের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপকে জানানোর জন্য বলা হলো।

মুক্তিযোদ্ধারা, যারা বাংলাদেশের ভিতরে, শত্রুর বেষ্টনির মাঝে থেকে যুদ্ধ করছে, তাদের মূলত গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। এই ট্রেনিং এর মূল উদ্দেশ্য হলো “Hit and Run” অর্থাৎ শত্রুকে তরিৎ আঘাত করে দূরে সরে যাওয়া। শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই যার মূল লক্ষ্য। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো শত্রুর মনোবলকে ভেঙে ফেলা। আমাদের অস্ত্রের যোগান ও সেভাবেই দেয়া, স্টেনগান যার গুলির কার্যকরী দূরত্ব ৫০ মিটার, শহরের ভেতর, স্বল্প দূরত্বে যুদ্ধের জন্য খুব উপযোগী। এস এল আর যা সিঙ্গল শট অটোমেটিক রাইফেল-যার গুলির কার্যকরী দূরত্ব ৩০০ মিটার তার সাথে যথেষ্ট পরিমাণে গ্রেনেড, বিভিন্ন ধরণের বিস্ফোরক, নানা প্রকার মাইন দেওয়া হয়েছিল যা মূলত বিস্ফোরণের কাজে যেমন গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্রিজ, কালভার্ট অথবা এমন স্থাপনা যেটা শত্রু পক্ষকে বিপর্যস্ত করবে তা ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করার জন্য। তাছাড়া আমাদের ট্রেনিং এর স্থায়ীত্ব ৩,৪ বা ৫ সপ্তাহ। এতো অল্প সময়ে অস্ত্ৰ, গোলাবারুদ সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায় মাত্র। অতএব অস্ত্র ও ট্রেনিং এর অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আসল পুঁজি ছিল নিরেট দেশপ্ৰেম, সাহস এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সমর্থন ও সাহায্য। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মূল সরবরাহ লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে জনগণই তাদের থাকা, খাওয়া ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যাপারে আসর ভরসাস্থল ছিল।

অপরদিকে পাকিস্তান আর্মি একটি নিয়মিত, প্ৰশিক্ষণপ্ৰাপ্ত ও অভিজ্ঞ সেনাবাহিনী ট্রেনিং এবং অস্ত্র এই দুই দিকেই তারা একটি যেকোনো আধুনিক সেনাবাহিনীর সমকক্ষ। তাদের দুর্বলতা ছিল নৈতিকতা তথা আদর্শগত দিক ও মনোবল।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি ৮ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে ইছাপুরা বাজারের দিকে রওয়ানা হলাম। ভোরের সূর্যের আলো ফুটে উঠছে। শত্রু মোকাবেলায় আমরা সড়ক পথে এগুচ্ছি। মা এর মুখটা ভেসে উঠল, নিশ্চয়ই এখন ফজরের নামাজ শেষে আমার জন্য দোয়া করছেন। মনে মনে বললাম ‘মা আরও বেশি দেয়া করো’। তোমার দোয়াই আমাদের সকলের খুব বেশি দরকার। আমাদের ৮ জনের মধ্যে ৫ জনের হাতে এসএলআর। বাকিদের হাতে স্টেনগান, যা দূরের লক্ষ্যবস্তুর উপর গুলি করার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবে না। পুরো জায়গাটা জঙ্গল, মাঝে মাঝে ছোট ছোট টিলা। আমরা এগুচ্ছি বালু নদীকে হাতের ডানে রেখে। ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা নদীর বাঁকে এমন যায়গায় পৌঁছলাম যেখানে নদীর ওপারে ইছাপুরার দিকে যাবার রাস্তা। থেকে থেকে খুব কাছ থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে অর্থাৎ শত্রু খুব কাছে। আমাদের অবস্থান থেকে রাস্তার দূরত্ব আনুমানিক ৭৫ গজের মতো, অর্থাৎ আমাদের রাইফেলের রেঞ্জের মাঝে রাস্তাটা গ্ৰাম থেকে বের হয়ে চারদিকে নিচু জায়গার মাঝ দিয়ে নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেছে। নিচু জায়গাটায় বর্ষার পানি। মাটি ফেলার রাস্তাটা প্রায় ৬/৭ ফুট উচু। উপর দিকে এক সাথে ৩/৪ জনের হাঁটার মতো প্রশস্থ। আমরা জঙ্গলের গাছের আড়ালে একটি টিবির পাশে পজিশন নিয়ে প্রস্তুত। এমন সময় শত্রুর দেখা মিললো। দূর থেকে দেখলাম ১৫/২০ জনের পাকিস্তান আর্মির একটি দল মাটির রাস্তার উপর দিয়ে না হেঁটে রাস্তার দুপাশে ঢালু জায়গা দিয়ে অস্ত্ৰ হাতে অনেকটা কুঁজো হয়ে এগুচ্ছে। দূর থেকে মনে হলো ওদের হাতে চীনা এলএমজি এবং রাইফেল। আমার ছেলেদের কাছে কড়া নির্দেশ, আমি প্ৰথম গুলি করলে তারপর অন্যরা গুলি শুরু করবে। মনে বেশ উত্তেজনা, এই শীতের সকালেও ঘামছি। আমাদের কারও পরনে লুঙ্গি, গেঞ্জি বা হাফ প্যান্ট গেঞ্জি, কোমরে গামছা দিয়ে গুলি বা ম্যাগজিন বাধা। পাকিস্তানি গ্রুপের অর্ধেক সৈন্য আমাদের গুলির আওতায়, বাকি অর্ধেক চালুর রাস্তার অপর পারে হওয়ায়, আওতার বাইরে।

টান টান উত্তেজনা। সহযোদ্ধাদের মুখের দিকে একবার চোখ বোলালাম শত্রু নিধনের দৃঢ় প্রত্যয়, মনে মনে বললাম ‘সাবাশ’। এর পরই প্ৰথমগুলি আমার। সাথে সাথে আমাদের অন্য অস্ত্রগুলি গর্জে উঠল। এসএলআর সিঙ্গল শট ফায়ার করে, কিন্তু কী কারণে জানি না আমারটা পুরোপুরি অটোমেটিক হয়ে গেল। গুলির সাথে সাথে দেখলাম ৩/৪ জন লাফ দিয়ে পড়ে গেল, বাকিরা শুয়ে ক্রলিং করে রাস্তার অপর পারে ঢালুতে চলে গেল। কতজন হতাহত হলো বোঝা গেল না (পরে গ্রামবাসীর কাছে শুনেছি যে ৪/৫ জনকে কাঁধে করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।) আমরা গুলি করে কিছুক্ষণ থেমে আছি। কারণ অনবরত গুলি চালানোর মতো গুলি আমাদের নেই। এর পরেই শুরু হলো শত্রুর পাল্টা গুলি বৃষ্টির মতো আমাদের মাথার উপর দিয়ে শিষ দিয়ে যেতে লাগলো। আমি কিছুটা আশংকায় কেন না এ ধরণের সম্মুখ সমরে আমাদের ছেলেরা অভ্যস্থ নয়, আতংকিত না হয়ে যায়। দেখলাম গ্রামের এই সাধারণ ছেলেগুলি দেশপ্রেমে ও মনের জোরে নিজেদের ছাড়িয়ে নিজেরাই অনেক উপরে উঠে গেছে। তারপরই আমার আপন ভাবনায়ই আমার নিজের ভুল ভাঙলো। এরাতো সাধারণ কোনো যোদ্ধা নয়, এরা মুক্তিযোদ্ধা। অসাধারণ দেশপ্রেম ও দায়বোধ থেকে এরা খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ করছে। দেশমাতার ঋণ শোধ করতে গিয়ে দেশকেই ঋণী করছে। প্ৰত্যাশা স্বাধীনতা, সাধারণ জনগণের না রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা। অন্য কোনো কিছু প্ৰত্যাশায় নয়। ব্যক্তিগত কোনো প্ৰত্যাশার তো প্রশ্নই উঠে না। আজ, স্বাধীনতার এতোদিন পর এসব ভাবলে ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আবার মূল প্রসঙ্গে, থেকে থেকে গুলি পাল্টা গুলি চলছে। এক সময় বুঝলাম শত্রু পক্ষ ক্রলিং করে পিছন হটে গ্রামে ঢুকে পড়েছে, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। আমরা কিছুক্ষণ পজিশনে থেকে ক্রলিং করে পিছনে টিবির আড়ালে নিরাপদ জায়গায় এসে বসলাম। বুঝিনি এতটা সময় পার হয়ে গেছে। বেলা প্ৰায় ১০/১১ টার মতো হবে। অপর দিকে পাকিস্তান আর্মিও ছোট ছোট গ্রুপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রামের ভিতরে আছে। পরে শুনিছি ওরা সংখ্যায় প্রায় ১০০ জনের মতো ছিল। শুরু হলো ইদুর বিড়াল খেলা। আড়াল আবডাল থেকে কখনও আমরা গুলি করছি কখনও ওরা গুলি করছে।

তখন দুপুর ২টা বা ৩টা। ক্লান্ত, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, যুদ্ধের উত্তেজনায় মনেই ছিল না। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয় নাই। গাছের নিচে বসে আমরা কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছি। কিছুক্ষণের জন্য আত্মচিন্তায় মগ্ন, ভাবছি মায়ের কথা, বাবার কথা, ভাইবোনের কথা, আমার চার বছরের কনিষ্ঠ সবচেয়ে ছোট বোন নমিতার কথা সম্ভবত তখন ক্লাস সেভেন এর ছাত্রী। ভাবছি, সব বারের মতো কি এবার ঈদের রান্না হয়েছে? আমার মা কি আমার প্রিয় ডিমের হালুয়া রান্না করেছেন? রান্না করলে নিশ্চয়ই চোখের জলে আমার জন্য আলাদা করে তুলে রাখবেন, কখনও খাব বলে। আমার মতো তো অন্য সব সহযোদ্ধাদের একই অবস্থা। বাঙালির জীবনে এতো নিরানন্দের ঈদ আর একটিও হয়েছে কীনা বা হবে কীনা জানি না। কয়েক মূহুর্ত। হঠাৎ করে এক বৃদ্ধর ডাকে ফিরে এলাম বর্তমানে। যে ঘটনা বলার জন্য এত কিছুর অবতারণা। আমার অলৌকিকতায় বিশ্বাস বরাবরই কম কিন্তু এ ঘটনাটি আমার কাছে এখনও অলৌকিক মনে হয়। বৃদ্ধার বয়স সম্ভবত ৫০ এর কোঠায়, গ্রামের মহিলা, আরও বয়স্ক হতে পারে। দৌড়ে আমার দিকে আসছেন আর বলছেন “বাজানরা তোরা একটু খাইয়া ল, খাইয়া যুদ্ধ করা”। একি? যেখানে গোলাগুলি চলছে, যেখানে অন্য কোনো মানুষ নেই, সেখানে ইনি হঠাৎ কোথা থেকে? জানি, কিছু বসতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই বনের মাঝে আছে, কিন্তু সবার তো নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার কথা। বৃদ্ধ কীভাবে বুঝলো আমরা এতো ক্ষুধার্থ? কীভাবে আমাদের অবস্থান জানলো? আঁচলের নীচ থেকে দুটো গামলা বের করলো, একটাতে ভাত ও আরেকটাতে রান্না করা মুরগি (তার নিজের ঘরের মুররি রান্না করে নিয়ে এসেছেন)। নিজেই ভাতের মাঝে মুরগি ঢেলে মাখিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন, আমরা চরম ক্ষুধার্থ কয়েকজন, পরম তৃপ্তির সাথে ভাগাভাগি করে খেলাম। ভাবছি, বিধাতা এই অল্প বয়সে তুমি আর কত বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা আমাকে দেবে? আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও বৃদ্ধ আমার স্মৃতিতে এখনও অম্লান। স্বাধীনতা কি তাকে কিছু দিতে পেরেছিল? এসকল অসাধারণ মানবিক গুণাবলি দেখে, মানবিক অভিজ্ঞতার মখোমুখি হয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো আমারও মনে হয়েছে “সাথৰ্ক জনম আমার জনেছি। এই দেশে ।”

ঢাকা শহর, কিশোরী বোন – আমি ও আমার এক বন্ধু

ঢাকা শহরে অপারেশনের ইচ্ছা। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন অস্ত্ৰ-যা আমাকে আমাদের মূল ক্যাম্প হরদি বাজার থেকে আনতে হবে। এই উদ্দেশ্যে আমি ঢাকা শহর বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছি। ঢাকা শহরে আসার জন্য আমি দুটি পথ ব্যবহার করতাম একটি গুলশান ২ নং মার্কেট দিয়ে বর্তমান বারিধারায় যাবার পথ, আরেকটি গোড়ান বাজারের। পথ প্রথমটিতে, অর্থাৎ তখন গুলশান লেকের উপর ব্রিজ ছিল না। ছিল খেয়াঘাট। ওপারে বাডডা গ্রাম, ছাড়া ছাড়া বাড়ি, লেক পাড় হতে হতো নৌকা করে। লেকটা বেশ বড়, পার হবার পর মোটামুটি মুক্ত এলাকা অর্থাৎ পাকিস্তান আর্মির দখলের বাইরে। যতদূর মনে পড়ে, পায়ে হেঁটে বেশ কিছুদূর যেতে হতো তার পর খালে নৌকা ধরে হরদি বাজার।

কিন্তু গুলশানের দিকটায় নৌকা ঘাট পেরিয়ে উপরে উঠলে পাকিস্তান আর্মির চেক পোষ্ট। গুলশান ২ নম্বর মার্কেটটি তখন একতলা ছিল। গুদারা ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে ৩/৪ টি বাড়ির পর একটি আধা নির্মিত বাড়িতে আর্মি ক্যাম্পের অবস্থান। বাড়িঘর বেশির ভাগ খালি(গুলশান মূলত অবাঙালিরা থাকতো)। লেক পার হবার একটিই রাস্তা। এই ক্যাম্পে আমাকে একবার পাকিস্তান আর্মি সন্দেহ করে বেশ কিছুক্ষণের জন্য আটকিয়ে রেখেছিল। অনেক দোহাই/অজুহাত দিয়ে (বাংলা, উর্দু মিলিয়ে) পকেটে রাখা জাল আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে (আর্মির ভাষায় ‘ডান্ডি’ কার্ড) এবং যথারীতি মুছলমানিত্বের প্রমাণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছিল। তার ওপর অনেকখানি হাঁটা পথ। সংগত কারণেই অস্ত্র নিয়ে এ পথে ঢাকায় আসাটা আমার যুক্তিসংগত মনে হয়নি। অপরদিকে, গোরান বাজারের দিকে নৌকা নিয়ে ঘাট পর্যন্ত পাওয়া যায়। ঘাটে না ভিড়ে অন্য যে কোনো বাড়ির পিছনের আঙিনায় নৌকা ভেড়ানো যায়। শত্রুর একটি ক্যাম্প আছে, তবে কিছুটা পথ ঘুরে গেলে সেটা পরিহার করা যায়। আরেকটি ক্যাম্প হলো মালিবাগ মোড়ের কাছাকাছি। গোড়ান বাজার থেকে বেরোনোর পথ তখনকার সেন্ট্রাল গর্ভনমেন্ট স্কুলের সামনে দিয়ে। সব কিছুর বিবেচনায় এই পথটাই আমার কাছে শ্রেয়।

এই পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছি, তখন খবর পেলাম আমার ক্যাডেট কলেজের বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু সফিকুর রহমান কোনো কারণে পাকিস্তানে মিলিটারি একাডেমী থেকে পালিয়ে এসেছেন। ভাবলাম আমাদের এরকম ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকজনের প্রয়োজন। তার সাথে পল্টনে তার বাসায় গিয়ে যোগাযোগ করে একথা সেকথার পর আমাদের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করলাম। উনি ওনার কিছু ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে আমাদের দলে পুরোপুরি যোগ দিতে পারলেন না তবে ঢাকায় যে কোনোরকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন, সেটাও কম মনে হলো না। আমার অস্ত্র আনার কাজে গোড়ান থেকে গন্তব্য স্থানে যাবার জন্য একটি গাড়ি প্রয়োজন। তিনি গাড়ি চলাতে পারেন, তবে তিনি একদিন সময় চেয়ে নিলেন। পরের দিন দুজন ছেলে, ১৯-২০ বছরের হবে, সাথে নিয়ে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত স্থানে এলেন। পরিচয় পেলাম ওরা দুই জমজ ভাই। সফিকুর ভাইয়ের পড়শী এবং গাড়িটি ওদের তবে সফিকুর ভাই চালাবেন। আমার জন্য বিরাট এক সহায় হলো। আমি আশ্চর্য যে এতো বড় একটা ঝুকিপূর্ণ কাজে সহায়ক হতে ওদের কারও কোনো দ্বিধা নাই। মনে মনে দিন তারিখ ঠিক করে আমি পর পর ৩ দিনের সময় দিলাম। বললাম এই ৩দিনের যে কোনোদিন আমি আসতে পারি এবং ওরা অবশ্যই যেনো কথামতো প্ৰস্তুত থাকে। ফিরে এলাম ক্যাম্পে। শুরু হলো গোছ গাছ, পুরো কাজটা আমি একার দায়িত্বে করছি। অস্ত্র গোলাবারুদের একটি লিষ্ট তৈরি করে ফেললাম। অস্ত্র বিস্ফোরক এবং মাইনের তালিকা এমনভাবে বানালাম যা ঢাকা গরম করার জন্য যথেষ্ট। নির্ধারিত দিনে খুব সকালে বিছানার চাদরে বোচকার মতো করে বেঁধে রাওয়ান হলাম যাতে সকাল ৯টা-১০টার মাঝে গোড়ান পৌঁছতে পারি। নৌকা ঘাটে না ভিড়িয়ে অন্যদিকে এক বাড়ির পিছনে ভিড়ালাম। কিছুটা ডাকাডাকির পর মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক এলেন, সম্ভবত বাড়ির কর্তা। বললাম বোচকাটা কিছুক্ষণের জন্য তার বাসায় রাখতে হবে। বোচকার ভিতর কী আছে বললাম না, উনিও জিজ্ঞাসা করলেন না। ওনার যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন, সাগ্রহে বললেন, কোনো চিন্তা করার জন্য এবং আমি যখন আসবো ততক্ষণ উনি থাকবেন আমাকে আমার বোচকা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। বোচকাটা বেশ ভারি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা খুব এক আশ্চর্যের ব্যাপার। কোনো পূর্ব পরিচয় নেই, পূর্ব সুত্র নেই। নির্দ্বিধায় উনি এই মারাত্মক ঝুঁকি নিলেন আর আমরাও নিশ্চিত যে এই সহায়তা আমরা পাবো। এটাই গেরিলা যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য, মানুষের মাঝে থেকে তাদের সম্পৃক্ততায় তাদের জন্য যুদ্ধ করা। এইটাই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ, এরই নাম জনযুদ্ধ।

একটি রিক্সা নিয়ে রওয়ানা হলাম পল্টনের উদ্দেশ্যে সফিকুর ভাইয়ের খোজে। প্রথমে হোঁচট খেলাম মূল রাস্তায় এসে, দেখি সেন্ট্রাল গভ: স্কুলের মুখে আর্মি একটি নতুন চেক পোস্ট বসিয়েছে। ২/৩ জন আর্মি ও ২/৩ জন মিলিশিয়া নিয়ে। মাঝেমাঝে গাড়ি থামিয়ে পরীক্ষা করছে। গোড়ান বাজার থেকে বের হবার এই একটাই পথ, রিক্সা চলছে আর আমার মাথায় দ্রুত ভাবনা কী করি, ফিরে যাবো? না, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। ফেরা যাবে না, পরিকল্পনা অনুযায়ী সফিকুর ভাই প্ৰস্তুত ছিলেন। সেই দুই ভাইয়ের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে সফিকুর ভাইকে নিয়ে আমি বাসায় (মগবাজার) চলে এলাম, বাসায় ঢুকেই আমার ছোটবোন নমিতাকে (বর্তমানে স্কুল শিক্ষিকা ও ডাক্তার গিন্নি)- যার কথা আগে প্রাসঙ্গিকভাবে বলেছি- বললাম একটি শাড়ি পরে আসতে, আমার সাথে যেতে হবে। তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী, বয়স ১১-১২ হবে। আমার উদ্দেশ্য শাড়ি পরিয়ে, মহিলা বানিয়ে যদি গাড়িতে ওকে নিয়ে যাই তবে হয়তো পাকিস্তান আর্মি চেক পোষ্টে না-ও থামাতে পারে। বলার সাথে সাথে কোনো রকম প্রশ্ন না করে সে শাড়ি পরতে গেল। একবারও জিজ্ঞেস করলো না কেন এবং কোথায় যাবে। ঐ ছোট বয়সে ও দেশপ্রেমের কী বুঝতো? তবে কি এই মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমাদের দেশের কিশোর, কিশোরী থেকে বৃদ্ধ সবাই একটি অন্য স্তরে চলে গিয়েছিল? এ প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধুর উক্তি আমার খুব মনে ধরেছিল, উক্তিটি এরকম “মুক্তিযুদ্ধের সময়টা এমন ছিল যে আমাদেরও কেউ কেউ নিজেদের মহামানবে পরিণত করেছিল আবার কেউ কেউ দানবে পরিণত হয়েছিল।” খুবই সঠিক উক্তি। দানব বলতে এখানে বাঙালি বিশ্বাসঘাতকদের বুঝিয়েছিল। ফিরে আসি ঘটনায়, ইতোমধ্যেই আমার মা চলে এসেছেন। উনি ধারণা করে ফেলেছেন যে নিশ্চয়ই আমি সাংঘাতিক কোনো বিপদজনক কাজে যাচ্ছি, তার প্রবল আপত্তি, কিছুতেই রাজী করানো যাচ্ছে না, কীভাবে রাজী হবেন? নিজের ছেলেকে নিয়ে সব সময় শঙ্কা ও আতংক, তার উপর তার বাচ্চা মেয়েকে কীভাবে দেবেন। শত হলেও মা। এর মাঝেই আমার গলা শুনে আমার মেঝো বোন, আমার বড়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ১ম বর্ষের ছাত্রী (দুরারোগ্য ব্যধিতে উনি প্ৰয়াত, আমার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব)। গড়নে এবং চেহারায় চোখে পড়ার মতো সুন্দরী । উনি এসে বললেন যে নমিতা নয়। উনি যাবেন আমার সাথে। একি বিপদ আমার জন্য। ক্রান্তিকালে দেশের জন্য কি জীবনের মায়া এতই তুচ্ছ হয়ে যায়? সঙ্গত কারণেই বড় বোনকে সাথে নেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। এর মাঝে আমার ছোটবোন শাড়ি পড়ে হাজির। বড়বোন আসাতে আমার সুবিধা হলো যে মা আর ছোট বোনের ব্যাপারে বেশি আপত্তি করলেননা। আমরা এসে রাস্তায় অপেক্ষারত গাড়িতে উঠলাম এবং সোজা গোড়ান বাজার। এর মাঝেই প্ৰায় ৩ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। আমার বোন ও সফিকুর ভাইকে মূল রাস্তায় রেখে আমি আমার বোচকা সংগ্ৰহ করতে গেলাম। রাস্তা থেকে দূরত্ব প্রায় আধা মাইল। গিয়ে দেখি ভদ্রলোক আমার জন্য একইভাবে অপেক্ষা করছেন। যেহেতু বোচকাটা ভারী সাথে একজনকে দিলেন গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।

গাড়ির পিছনে মাল রাখার জায়গার বোচকা বিছিয়ে রাখলাম, শুধু ১টি স্টেন গান সাথে ২টি ম্যাগজিন আমার পায়ের কাছে রাখলাম, সফিকুর ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন, উত্তেজনায় প্রচুর ঘামছেন, সামনে শাড়ি পরিহিত আমার ছোট বোন পিছনে স্টেনও আমি । ধীরে ধীরে আমরা চেক পোষ্টের দিকে এগুচ্ছি। ঢাকার বাইরে প্রবেশের চেক পোস্টগুলিতে কড়াকড়ি একটু বেশি, শহরের ভিতরে তত নয়। যত আমরা চেক পোস্টের কাছাকাছি হচ্ছি তত আমার উত্তেজনা বাড়ছে। আমি স্টেন গানটা ‘কক’ করে নিলাম, যদি বাধা আসে তবে এসপার ওসপার কিছু একটা করতে হবে। জীবিত কিছুতেই ধরা পরা যাবেনা। আমার ছোট বোন সামনে, হয়তো এর কিছুই বুঝছে না। তারপর এল সেই সময়, আমরা তাদের সন্দেহে পারলামনা, উকি দিয়ে আমাদের দেখলো কিন্তু কিছু বলল না। মাথার থেকে বিরাট ভার নেমে গেল। আমার ‘মা’ কে তার মেয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আমরা চলে এলাম পল্টনে গাড়ির মালিক দু’ভাইয়ের কাছে। এখন সমস্যা, জিনিসগুলি কোথায় রাখি। দু’ভাই নিজেদের মাঝে কী আলাপ করে আমাকে অবলীলাক্রমে বললো কোনো চিন্তা না করতে। গাড়িটাকে এভাবেই গেরেজে ঢুকিয়ে রাখবে, তাদের আরেকটা গাড়ি আছে এবং এ গাড়িটা কেউ ব্যবহার করে না এবং আমি যখনই আসবো, তখনই আমার জিনিস নিয়ে যেতে পারবো। আপাতত সমস্যার সমাধান, ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। এখন মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি এরা পায়নি, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে কোনো অংশে এরা কম? দেশপ্রেমে এরা অনেকেই আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। (অন্ত্র যখন ঢাকায় এনে রাখি সেটা নভেম্বরের শেষ দিক। দুর্ভাগ্যক্রমে সেগুলি ব্যবহার করার সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। ৩রা ডিসেম্বর থেকে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যায়।

কলম ধরার আগে ভেবেছিলাম লেখার ব্যাপারটা কঠিন, লিখতে গিয়ে দেখলাম আরও কঠিন। ৩৮/৩৯ বছরের আগের ঘটনা বেশ মনে আছে, কিন্তু নাম, সময়, পরিসংখ্যান এগুলিতে গোল বাধে। কিছুটা ত্রুটি বিচ্যুতি হতে পারে। সেই ইছাপুরার যুদ্ধে আমরা এক সহযোদ্ধাকে হারিয়ে ছিলাম। খবরটা আমি সে দিনই সন্ধ্যায় জানতে পারি। বাংলাদেশের ভেতর থেকে সে যোগ দিয়েছিল, অসম সাহসী ছেলে। আমার এ লেখাটি আমি আমার সেই সহযোদ্ধার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করছি। আরও উৎসর্গ করছি ভবিষ্যৎ প্ৰজন্মকে যাদের উদ্দেশ্যে এই লেখা। মনে রেখো এই বাংলাদেশটা আমাদের, মুক্তিযোদ্ধাদের, যেখানে গোটা বাঙালি জাতি যোদ্ধা, গুটিকয়েক বাদে। ধর্মের বাণিজ্যের জন্য, ব্যক্তি স্বার্থের জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি, দেশ স্বাধীন করিনি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এই চেতনা নিয়ে তোমরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবেই আমাদের এই যুদ্ধ, একটা জাতির এই অপরিসীম ত্যাগ সার্থক হবে।