বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি হতাশাজনক
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাঃ) পলিট ব্যুরাের বিবৃতি
কলকাতা, ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ও সােভিয়েত সম্প্রতি যে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র পলিটব্যুরাে ২ অক্টোবর এক বিবৃতিতে যুক্ত বিবৃতিকে হতাশাজনক অবিহিত করেছে। পলিটব্যুরাের বিবৃতিতে বলা হয়েছে:
জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের কঠোর সংগ্রাম, প্রচণ্ড বাধা বিপদের বিরুদ্ধে গেরিলাদের সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান ঐক্য ও দৃঢ় সংকল্প- এই পটভূমিতে ভারত সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে ব্যাঙ্গালােরে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির গৃহীত প্রস্তাবে, কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছিলেন। চুক্তির দু’দিন পরে দু’জন বৈদেশিক মন্ত্রীর প্রচারিত যুক্ত ইস্তেহার কিছুটা আশঙ্কা জাগায় যে, বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে এ আশঙ্কা সত্য হয়েছে। সরকারের চকাবাজকরা যে আত্মসন্তুষ্টির মনােভাব গড়ে তুলতে চাইছে পলিটব্যুরাে সে সম্পর্কে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন। যুক্ত বিবৃতি পশ্চাদপসরণকে বাগাড়ম্বরের আড়ালে সযত্নে লুকিয়ে রাখছে যাতে জনগণকে বিপথচালিত করে তাদের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা যায় যে ঠিক পথেই মােড় ঘুরেছে।
প্রচুর বাগজাল ও পারস্পরিক প্রশংসার মধ্যে যুক্ত বিবৃতি বাংলাদেশের জনগণকে একেবারে পথে বসিয়েছে। তাদের গৌরবময় সংগ্রাম সম্পর্কে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্মগত অধিকার সম্পর্কে কোনাে উল্লেখ নেই। অথচ ইয়াহিয়া খা-কে অনুরােধ-উপরােধ করে, যাকে বলা হয় রাজনৈতিক সমাধান, সেই সমাধানে আসার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের মাতৃভূমির পূর্ণ স্বাধীনতা ও দখলদারী বাহিনীর সম্পূর্ণ অপসারণের দাবি ঘােষণা করে লড়াইকে এমন একটা মুখে নিয়ে এসেছেন, যেখানে ইয়াহিয়া শাসনের সঙ্গে আপস-মীমাংসার কোনাে স্থান নেই। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা, যার জন্য হাজার হাজার মানুষ ইতিমধ্যে তাদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছেন, সেই সুনির্দিষ্ট অধিকারের কথা না বলে, যুক্ত বিবৃতি শুধু অস্পষ্টভাবে বলছে, সেখানে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে, বাংলাদেশের জনগণের জন্মগত অধিকারের আকাক্ষা ও আইনসঙ্গত স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে ইত্যাদি।” জনগণের জন্মগত অধিকার অর্জনের জন্য ব্যবস্থা নিতে এ হলাে জল্লাদ ইয়াহিয়া খা’র কাছে প্রত্যক্ষ আবেদন। যদি কেউ দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট থিউর কাছে আবেদন করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের জনগণের জন্মগত অধিকার আদায়ের জন্য ব্যবস্থা নিতে ব্যাপারটা তখন কেমন দেখাবে? প্রকাশের পদ্ধতি তথা ইয়াহিয়া খাঁর কাছে আবেদন জঙ্গিশাহীর সঙ্গে একটি আপসরফারই পরিচায়ক এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার দাবি বা বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের পরিপন্থী।
মনে হয়েছিল, ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে সরকারকে তার দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কিন্তু অবস্থা অন্য রূপ নিয়েছে। এটা তাই মােটেই আকস্মিক নয় যে, ইউ এন ও’র সামনে ভাষণে ভারতের বৈদেশিক মন্ত্রী স্মরণ সিং বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করেননি এমনকি স্বীকার করেননি বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্বটুকু পর্যন্ত। পূর্বে যদি রাজনৈতিক মীমাংসার অর্থ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এখন বৈদেশিক মন্ত্রীর প্রস্তাব হলাে, পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, এই আপসরফা ইয়াহিয়া সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেই হতে হবে, এমন কোনাে কথা নেই।
এটা অবিশ্বাস্য যে, বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খার জঙ্গিশাহী যে অমানুষিক অত্যাচার করেছে, যুক্ত বিবৃতিতে সে সম্পর্কে একটি কথাও নেই। বিবৃতি থেকে মনে হবে, ভারতে শরণার্থী আগমন ছাড়া বাংলাদেশে গুরুতর তেমন কোনাে পরিণতি ঘটেনি। এটা সীমাহীন ঔদাসীন্য। পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী আগমনের ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে ভাষণে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সােভিয়েত পক্ষ উপলব্ধি করেছে, পূর্ববঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে যে বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে উভয়পক্ষ সে জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উভয় স্বাক্ষরকারীর মতে বাংলাদেশের গণহত্যা যা নিয়ে বহু বুর্জোয়া সাংবাদিক অনেক কিছু লিখেছেন তা একটা সাম্প্রতিক ঘটনা মাত্র। তাই এই বিবৃতিতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ইয়াহিয়া শাসনকেই দায়ী করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই। কারণ বিবৃতির অন্তর্নিহিত সুর হলাে ইয়াহিয়া চক্রের সাহায্যে বাংলাদেশের ঘটনাগুলাের একটা রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা।
প্রধান প্রশ্ন, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তার পরিবর্তে বলা হয়েছে প্রধান প্রশ্ন হলাে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে পরিস্থিতি যেন আরও পেকে না ওঠে, সেটা বন্ধ করা। এটা ইয়াহিয়া খারই ঠিক মনমতাে।
লক্ষণীয় এই যে, ইন্দিরা গান্ধী কার্যত এই অবস্থাটা মেনে নিয়েছেন, অবশ্য সরকার এ যাবত প্রকাশ্যে তা বলেনি, যদিও তারা সঠিকভাবেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, কোনাে মীমাংসা হলে তা হতে হবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। এখন ভারত সরকারকে একমাত্র শরণার্থী সমস্যা নিয়েই মাথা ঘামাতে বলা হচ্ছে। এর ভাবার্থ হলাে, ভারতকে বলা হচ্ছে সে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের জন্য সমস্ত সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে ভারতীয় সংসদ ও রাজ্য আইনসভাগুলাে প্রস্তাব পাস করেছে। ভারত সরকারকে এখন ধাপে ধাপে সেই সংগ্রামের সমর্থন থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। যুক্ত বিবৃতি কার্যত এসব প্রতিশ্রুতি থেকে ছুটে এসেছে এবং প্রকাশ করছে যে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে ভারত সরকারের আন্তরিক কোনাে ইচ্ছে নেই।
এই পিছু হঠাকে লুকোবার জন্য যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সংগ্রামের স্বাধীনতার বিষয়টিকে চাপা দিয়ে এটাকে উপমহাদেশের শান্তি বজায় রাখার প্রশ্ন হিসেবে দেখানাে হয়েছে। আমাদের পার্টি দু’দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার উপর খুব বেশি গুরুত্ব দেয় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কার যারা তােলে, তাদের সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছে কিন্তু উপমহাদেশে শান্তি রাখার অজুহাতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গলা টিপে মারায় শরিক আমরা হতে পারি না।
ভারতীয় উপমহাদেশে দাবানলের মতাে উত্তেজক এই পরিস্থিতির নিরসন ঘটাতে, আবেদনে জল্লাদ ইয়াহিয়ার কাছে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অনুরােধ জানানাে হয়েছে। বিবৃতির জনগণের আইনসঙ্গত স্বার্থকে অধিকার দিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার দাবি সম্পর্কে কোনাে উল্লেখ নেই।
সূত্র: দেশের ডাক
০৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১