সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্য
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীলদের সুগভীর চক্রান্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সি রাজশ্বের রাও এর সাক্ষাতকার
(বিশেষ প্রতিনিধি)
প্রশ্ন-ভারতের আসন্ন লােক সভা নির্বাচনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যে হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ চালাচ্ছে তার প্রমাণ ক্রমশই বেশি পরিমাণে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
কমরেড রাও- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া সৃষ্টি করার সুগভীর চক্রান্ত করেছে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনকালে আসল সমস্যাগুলি থেকে ভারতীয় জনগণের মনােযােগ সরিয়ে দেওয়া এবং ভােটকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে স্পষ্ট ভাগ করে (পােলারাইজেশন) দেওয়া এই চক্রান্তের উদ্দেশ্য। এছাড়া পাকিস্তানের, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল শক্তিকে দুর্বল করা এবং সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী হওয়ার পরও তাদের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করার উদ্দেশ্যও নিহিত রয়েছে।
পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান ছিনতাই এবং পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশে প্রতিক্রিয়ার শক্তিরা যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলছে তারই ফলস্বরূপ আমেদাবাদ ও বরােদার দাঙ্গা। এই ঘটনা দুটি এ চক্রান্তের
স্পষ্ট প্রমাণ। চেষ্টার বােলজের অনধিক প্রচারিত ভারত সফর ও এদেশে সুদীর্ঘ অবস্থান এবং শেরম্যান কুপারের আগমন ঐ চক্রান্তই প্রমাণ করে। কারণ বােজ কুপার উভয়েই এদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন এবং প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে দু জনেরই বেশ দহরম-মহরম আছে। এই সূত্রে পি এল ৪৮০ চুক্তির ফলে যে বিপুল অর্থ এদেশে ব্যয় করার জন্য মার্কিন দূতাবাসের কাছে থাকে তার কুখ্যাত ভূমিকাও স্মরণ রাখতে হবে।
নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে জিততে সাহায্য করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের এই চক্রান্ত সম্পর্কে ভারতের প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে গুরুত্বের সঙ্গে অবহিত থাকতে হবে এবং জনগণকে এর সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতির সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিতে হবে। এই চক্রান্তের গুরুত্ব খাটো করে দেখলে সর্বনাশা ফল হবে।
প্রশ্ন ও ‘স্টেটসম্যান’ এর বিশেষ প্রতিনিধির কাছে ১০ ফেব্রুয়ারি সি পি এম এর জনৈক মুখপাত্র জানান যে, সি পি এম পশ্চিমবঙ্গে চলমান সশস্ত্র স্কোয়াড গঠন করছে। এই কর্মসূচী নেওয়ার কারণ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
কমরেড রাওঃ এটা ঘটনা যে, দীর্ঘদিন ধরেই সি পি এম দলের নেতারা বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ ধরেছে। সি পি এম-এর যুক্তফ্রন্ট-বিরােধী সংকীর্ণ ও সুবিধাবাদী নীতির ব্যর্থতাই এর কারণ। সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক খুনের প্রধান দায়িত্ব সমাজবিরােধী পরিবৃত সি পি এম নেতৃত্বকেই নিতে হবে।
এবারের নির্বাচনে ভীতিপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্টি করার জন্য সি পি এম নেতৃত্ব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে একটি প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কারণ ঐ নেতাদের আশা, ভীতিপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্ট হলে পশ্চিমবঙ্গে সি পি এম সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। এটা সকলেরই জানা কথা যে, তারা বােমা, পিস্তল, স্টেনগান প্রভৃতিসহ সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বেশ কিছুদিন ধরেই সংগ্রহ করছে। অন্য দলের সঙ্গে সংঘর্ষে এই সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রচারিত হয় যে, সি-পি-এম তাঁদের তথাকথিত ঘাঁটিতে অন্য দলগুলােকে উচ্ছেদ করতে চায় এবং যে সব কেন্দ্রে বাম ও গণতান্ত্রিক দলের শক্তি বেশি সেই সমস্ত নির্বাচন। ক্ষেত্রে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাবে। অবশ্যই তঁারা এধরনের হামলা সম্পূর্ণ প্রকাশ্যেই চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ১৭ জানুয়ারি চন্দননগরের এক জনসভায় প্রমােদ দাশগুপ্ত তাঁর দলের লােকদের অন্য দলকে মারার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য যে আহ্বান দিয়েছেন একথা পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রগুলিতে ব্যাপক প্রচারিত হয়।
ইতােমধ্যেই তারা সন্ত্রাসবাদী স্কোয়াড গঠন করেছেন এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেও মেতে উঠেছেন। এখন শুধু তা প্রকাশ্যে বলা হয়েছে।
যদি স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হয় তবে সন্ত্রাসবাদ চালানাে এবং খুন করার সি পি এর পরিকল্পনা অবশ্যই ব্যর্থ করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলিকে একতাবদ্ধ হয়ে সি পি এম নেতৃত্বের এই খুনের খেলার বিরুদ্ধে জনগণকে জমায়েত করতে হবে।
প্রশ্ন দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলি ভােটারদের সন্ত্রস্ত করার জন্য হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
কমরেড রাও নিশ্চয়ই, যে সব এলাকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দুর্বল এবং প্রতিক্রিয়ার শক্তি সবল সেখানে এই বিপদ আছে। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, ওড়িশা এবং বিহার প্রভৃতি রাজ্যের অংশ বিশেষে ঐ বিপদ রয়েছে বলে উল্লেখ করা যায়। প্রতিক্রিয়ার শক্তিরা শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক বিভেদ, উৎকট ভাষাপ্রেম এবং আঞ্চলিকতার জিগির তুলবে না, যেখানে পারবে টাকা পয়সা ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ ব্যবহার করারও চেষ্টা চালাবে। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে প্রয়ােজন হলেই হিংসাত্মক কার্যকলাপের মােকাবিলা করতে হবে।
প্রশ্ন আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের জন্য দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলরা যে প্রচেষ্টা নিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তা ব্যর্থ করতে চায় বলে ঘােষণা করেছে। এই অবস্থায় অনেকগুলি আসনে কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ছে কেন তা ব্যাখ্যা করতে অনুরােধ করছি।
কমরেড রাও – আসলে কংগ্রেসই কমিউনিস্ট পার্টি এবং দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার পরাজয়কামী বামপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধে লড়ছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তার শক্তিশালী এলাকাগুলিতেই নির্বাচন প্রার্থী দিয়েছে। নিজেকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ করার উচ্চাভিলাষ নিয়ে কংগ্রেস সর্বত্র দলীয় প্রার্থী দিয়েছে এবং দক্ষিণ-পন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্যস্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা ভুলে গেছে। তাছাড়াও, ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা রয়েছে এবং তারাই দক্ষিণপন্থী- বিরােধী শক্তির ঐক্য স্থাপনে বাধার সৃষ্টি করেছে। অনেকগুলি আসেন কমিউনিস্ট পার্টি ও ইন্দিরা কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য এই পরিস্থিতিই দায়ী। যাহা হােক, কেরালা ও তামিলনাড়ুর মতাে রাজ্যে ইন্দিরা কংগ্রেসসহ বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলির মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয়েছে এবং উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার, ওড়িশায় কমিউনিস্ট পার্টি ও ইন্দিরা কংগ্রেসের মধ্যে আংশিক সমঝােতা সম্পাদন হয়েছে।
সূত্র: কালান্তর, ১৫.২.১৯৭১