You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নতুন পরিস্থিতি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্প্রতি এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটেছে: আওয়ামী লীগ পরিচালিত স্বাধীন অস্থায়ী সরকারকে সাহায্য করার জন্য একটি কনসালটেটিভ কমিটি গঠিত হয়েছে এবং তাতে আছেন বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নেতা মওলানা ভাসানী।
মওলানা ভাসানী পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীরা সম্প্রতি এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। তারা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির কর্মসূচীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আপােষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, মওলানা ভাসানী এখনাে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোেগ পাচ্ছেন না। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য মার্কসবাদী নেতারা এখনাে নবগঠিত ‘কনসালটেটিভি কমিটিতে স্থান পান নাই। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে আরাে গণভিত্তিক করার স্বার্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা সকলে একটি শিবিরে এসে দাঁড়াবেন তার সম্ভাবনা এখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
* * *
কিন্তু এ কথা মনে করা ভুল হবে যে, মাকর্সবাদীদের সাথে এক শিবিরে দাঁড়িয়ে লড়াই করার পথে সব বাধা অতিক্রান্ত হয়েছে। মােটেই তা নয়। শিক্ষণ শিবিরগুলােতে এখনাে ‘বাছাই’ চলছে, কে বঙ্গবন্ধু পন্থী এবং কে মার্কসপন্থী তার ভিত্তিতে। এ বাছাই শুধু ট্রেনিং শিবিরে সীমাবদ্ধ নাই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও এর ঢেউ পড়েছে এবং তার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করছে খুনি ইয়াহিয়া হানাদার ও তাদের সাকরেদরা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও গত কয়েকদিনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে দখলদারদের শাসন পদ্ধতিতে। টিক্কাখানের স্থান নিয়েছেন ডা. মালেক। দশজন তাঁবেদারকে নিয়ে গঠিত হয়েছে তথাকথিত মন্ত্রিসভা।
‘শান্তি কমিটির দালালদের অধিকাংশ হালাল করার পর, প্রতিটি ইউনিয়নে গঠিত হচ্ছে কুখ্যাত রাজাকার বাহিনী।
এই রাজাকার বাহিনী তৈরি করা হচ্ছে কাদের নিয়ে। গ্রামের বেকার যুবক, বেকার মধ্যবিত্ত, বন্ধ কারখানার বেকার শ্রমিক। এদের বেতন ৮০.০০ টাকা থেকে ১০০.০০ টাকা। কোনাে ইউনিফর্ম নেই। হাতে রাইফেল। যেমন খুশি লুটপাট, মারধর এবং ঘরবাড়ি পােড়ানাের পূর্ণ ক্ষমতা এদের দেয়া আছে। তাই এখন পশ্চিমী সৈন্যদের এক অংশের স্থান নিচ্ছে এই ‘রাজাকার’রা। বাঙালি দিয়ে বাঙালি দমন কর’ ভিয়েতনামের এ মার্কিনী পরীক্ষাকে দস্যু ইয়াহিয়া কাজে লাগাতে চাচ্ছে বাংলাদেশে।
* * *
এই নতুন পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য শুধু সীমান্তের গ্রামগুলােতে কমান্ডাে অভিযান চালানাে যথেষ্ট নয়। প্রয়ােজন শক্রর কলজাতে গিয়ে অসংখ্য গেরিলা ঘাঁটি তৈরি করা, শত্রুর মুখ যখন ভারত সীমান্তের দিকে, ঠিক সে সময়ে তার পেছন থেকে তাকে আঘাত করা। তার জন্যই চাই অস্ত্র, আরাে অস্ত্র, যে অস্ত্র গ্রামের কৃষকদের হাতকে শক্ত করবে। তার জন্য চাই, ইন্দিরা সরকারের স্বীকৃতি। কিন্তু স্বীকৃতির পরিবর্তে ইন্দিরা সরকার দেশে ও বিদেশে শুধুই রাজনীতির বুঝা পড়ার কথা বলে বেড়াচ্ছেন। বুঝাপড়ার জন্য ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছেন সােভিয়েত দেশে, যাচ্ছেন আমেরিকা, প্রয়ােজন হলে যাবেন চীনে।
এই রাজনীতিক বুঝা পড়ার আওয়াজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এখনাে যারা দুর্বলচিত্ত এই দাবি তাদের নিশ্চয় বিভ্রান্ত করবে। বাংলাদেশের সংগ্রামী নেতাদেরই প্রয়ােজন এই বুঝা পড়ার আওয়াজের বিরুদ্ধে আরাে সােচ্চার হওয়া; পাক-সরকারকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করা, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামরত সকল শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে প্রধানত নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে জয়যুক্ত করা। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা যত বেশি সকল প্রকার বিভেদ-নীতি পরাস্ত করে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন, যত বেশি নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করতে তৈরি হবেন, তত বেশি বিশ্বের জনগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

সূত্র: দেশের ডাক
২০ আগস্ট, ১৯৭১
০৩ ভাদ্র, ১৩৭৮