You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.02.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | এতিম-ছিন্নমূল শিশুদের কল্যাণে এগিয়ে আসুন | লোক গণনার গুরুত্ব | “কোম্পানি কা মাল-” | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১২ই ফেব্রুয়ারী, মঙ্গলবার, ২৯শে মাঘ, ১৩৮০

এতিম-ছিন্নমূল শিশুদের কল্যাণে এগিয়ে আসুন

রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদ উল্লাহ বাংলাদেশের প্রথম এস, ও এস, শিশু পল্লীর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছেন গত পরশুদিন। এই উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় মন্ত্রী পরিষদের সদস্য সহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের এতিম শিশুদের কল্যাণের জন্য দেশের বিত্তবান সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন- ‘এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের পরিপূরক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সর্বাত্মক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুরা যদিও জাতির ভবিষ্যৎ সম্পদ তবুও বাংলাদেশের মতো অনেক গরীব ও উন্নয়নশীল দেশে এখনও শিশুদের পুরোপুরি দায়িত্বভার সরকার গ্রহণ করতে পারেননি। এব্যাপারে সম্পদের অপ্রতুলতা, বিত্তবান মানুষের অনীহা ও চেতনার অভাব দেশের দরিদ্র শিশুদের, বিশেষ করে নিরাশ্রয় এতিমদের জীবন গড়ার প্রচেষ্টায় আজও রয়ে গেছে।’ রাষ্ট্রপতি আরো বলেছেন-বহুযুগের শোষণে ও অবহেলায় বাংলাদেশের জনজীবন দারিদ্র্যের করালগ্রাসে কবলিত হয়েছে। গত মুক্তিযুদ্ধের লাখো লাখো কর্মজীবনের অকাল পরিসমাপ্তির সাথে সাথে অগণিত শিশু হারিয়েছে তাদের পিতৃ-মাতৃ স্নেহ, আশ্রয় ও নিরাপত্তার নীড়। সে কারণে দেশের নিরাশ্রয় শিশুদের মানুষ করার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি এস, ও, এস, আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি দুঃস্থ অসহায় ও ছিন্নমূল শিশুদের লালন পালন ও শিক্ষার ভার নিয়ে যে অমূল্য অবদান রেখেছেন তা স্মরণ করার দাবি রাখে। জানা গেছে এস, ও, এস, আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশে মোট পনেরোটি শিশুকলি গঠনের প্রকল্পের মধ্যে ইতিমধ্যেই বারোটি গঠনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এস, ও ,এস, ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক সংস্থা। গত পঁচিশ বছর ধরে এ সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী অসহায় শিশুদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশের ছিন্নমূল শিশুদের লালন পালন করার দায়িত্ব এস, ও, এস, সংস্থা গ্রহণ করেছে তার জন্য তারা আমাদের গোটা জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন। আমাদের দরিদ্র দেশে শিশুদেরকে গঠন করা একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিশেষতঃ এদেশের দুঃস্থ এতিম শিশুদের লালন পালন করে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত কষ্টকর। গোটা জাতিকে যখন এক নিদারুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করতে হচ্ছে তখন শুধু শিশুদের ব্যাপারে কোনো বিশেষ দৃষ্টি কতৃপক্ষ দিতে পারছেন না। অথচ দেশের অসংখ্য এতিম শিশু আজ আশ্রয়ের অভাবে ছিন্নমূল হয়ে পড়েছে। এদেরকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা ও তাদের লালন-পালন করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। যে সকল শিশু আজ এতিম, যারা দুঃস্থ, অসহায় তাদেরকে অবশ্যই মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে সরকারকে। এজন্য প্রয়োজন একটি পরিকল্পিত কার্যক্রম। যার অধীনে বিভিন্ন এলাকার শিশুরা ন্যূনতম মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।
আমাদের দেশের অসহায় শিশুদেরকে লালন পালন করার আংশিক দায়িত্ব নিয়েছে এস, ও, এস, আন্তর্জাতিক সংস্থা। এস, ও, এস, এর কর্মোদ্যমকে আমরা স্বাগত জানাই। সঙ্গে সঙ্গে দেশের সরকারকেও আমরা অনুরোধ করি- দুঃস্থ, অসহায় ও এতিম শিশুদের লালন করার বাস্তব কর্মসূচি প্রণয়ন করুন। মুক্তিযোদ্ধা ক্ষতিগ্রস্থ শিশুদের বাঁচবার নিশ্চয়তা প্রদান করুন।

লোক গণনার গুরুত্ব

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বেসরকারি বাসভবনে এক অনাড়ম্বর ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি উদ্বোধন সূচিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে আলোচনা প্রসঙ্গে সঠিক লোক গণনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, নির্ভুল গণনার উপরে জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির পরিকল্পনার সামগ্রিক সাফল্য নির্ভর করবে। লোক গণনার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে তিনি আশা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি উদ্বেগ সহকারে বলেন যে, ৫৪ হাজার বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির উন্নতি- অগ্রগতির পথে একটি ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির স্বার্থে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সারাদেশে এক লক্ষেরও বেশি লোক গণনাকারী গত রোববার থেকে সারা দেশে ১৯ দিনব্যাপী আদমশুমারি কার্যক্রম শুরু করেছেন। আগামী পহেলা মার্চের সকাল ছয়টা পর্যন্ত লোক গণনা চলবে। লোক গণনা সুবিধার জন্য সারা দেশকে ৬৬ টি আদমশুমারি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। ১০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী গণনার সামগ্রীক তদারক করবেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশের প্রথম আদমশুমারি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ এর অপেক্ষা রাখে না। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের কোনদিনই আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানি আমলে ১৯৬১ সালে যে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা ছিল নামকাওয়াস্তে লোকদেখানো ব্যাপার। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কোন বিশেষ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের আওতায় এনে আদমশুমারির কাজ চালায় নি।
সেই আদমশুমারি যে নির্ভুল বা সঠিক ছিল তা কোন অবস্থাতে বলা চলে না। ভুল তথ্য নিয়ে আর যাই হোক দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে যে সার্থক করে তোলা যায় না এটা সর্বজনবিদিত সত্য। যদিও নিয়মমাফিক প্রতি দশ বছর অন্তর দেশের লোক সংখ্যা গণনা করা উচিত তবুও তা হয়নি। একাত্তর সাল ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রান্তিলগ্ন। বাহাত্তর বা তিয়াত্তর সালে বর্তমান সরকারের পক্ষে আদমশুমারির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। কেননা এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রস্তুতি।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে, সেন্সার্স কমিশন সবরকম প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমেই লোক গণনার কাজ শুরু করেছেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশের জনসম্পদের সঠিক তথ্য ও মূল্যায়ন ছাড়া আগামী দিনের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনাকে সার্থক করে তোলা সম্ভব নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের লোকসংখ্যা কি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তারা সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে আদমশুমারির মাধ্যমে। সুতরাং এ কাজকে সার্থক করে তোলার দায়িত্ব যেমন একদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অন্যদিকে তেমনি দেশের জনসাধারণের। দু’য়ের মিলিত উদ্যোগে দেশের প্রথম আদমশুমারি সফল হোক, সার্থক হোক এই কামনাই আমরা করছি।

“কোম্পানি কা মাল-”

কথায় বলে, “কোম্পানি কা মাল, দরিয়ামে ঢাল।” টিসিবি’র আমদানি করা মোটর বাস চ্যাসিস নিয়েও সে রকম অবস্থার উদ্রেক হয়েছে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে টিসিবি ভারত থেকে যেসব মোটর বাস চ্যাসিস আমদানি করেছিল তা বিক্রি করতে না পারায় বাংলাদেশকে প্রায় ১০ লক্ষ ২০ হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। দীর্ঘ ১৩টি মাস ধরে ভারত থেকে আমদানি করা টিসিবি-র বাসগুলো যশোরের উন্মুক্ত আকাশের নিচে রোদে পুড়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে অথচ একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি ছিল যে, চেসিস একটি ছাউনির নিচে সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। এবং এ বাবদে দেশ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকাও দিয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী কাজ কিছুই হয়নি। উপরন্তু ভারত থেকে আমদানি করা ১২০টি চেসিস যশোর বিমানবন্দরের পাশে মাতৃ-পিতৃ হীন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, টিসিবি প্রতিটি চেসিস এর মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৫৭ হাজার ৪৯ টাকা এবং নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি চেসিসে একটি করে অতিরিক্ত টায়ার-টিউব থাকার কথা। প্রকৃত প্রস্তাবে, কোন চেসিসের সঙ্গেই টায়ার-টিউব নেই। এছাড়াও টিসিবি আমদানিকৃত চেসিসগুলো নাকি বেডফোর্ডের চেয়েও নিম্নমানের বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে । এসব অভিযোগের আলোকেই টিসিবি আমদানি করা মোটর বাস চেচিস গুলো বিক্রি হয়নি। কাজের অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি নির্ধারিত মূল্য থেকে প্রতি চেসিসের জন্য ৭ হাজার ৪৯ টাকা কমিয়ে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ফলে, সরকারকে ৮ লক্ষ ৪৫ হাজার ৮শ’ ৮০ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে লোকসানের পরিমাণ ১০ লক্ষ ২০ হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে।
এখন প্রশ্ন হলো, টিসিবি আমদানি করা অধিকাংশ দ্রব্য সম্পর্কে কেন নানা রকম অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। শীতবস্ত্র আমদানির ব্যাপারে টিসিবি’র কারচুপি ওষুধ আমদানির ব্যাপারে মূল্য নিয়ে অসঙ্গতি ইত্যাদি ধরনের অভিযোগের আর অন্ত নেই। একটি রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিসিবি-র বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগের অবসান না হওয়া পর্যন্ত, এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে স্বস্তির আশা করা বাতুলতা মাত্র। নিম্নমানের জিনিসপত্র বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময়ে আমদানি করে টিসিবি ইতিমধ্যেই এক রেকর্ড স্থাপন করেছে। মোটর বাস চ্যাসিস নিয়েও নিম্নমানের অভিযোগ উঠেছে। চেসিস তাই অবিক্রিত থাকায় টিসিবি লোকসান দিয়ে তা বিক্রির জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ সরকারি অর্থ এভাবে আর কত গচ্চা যাবে? সরকারকে টিসিবি সম্পর্কে নতুন করে কিছু ভাবনা চিন্তা করছেন না? জনসাধারণ টিসিবি-র কান্ড কারখানা দেখে দিন-দিন রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছে। জনসাধারণের মনে টিসিবি সম্পর্কে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে টিসিবি সম্পর্কে সুচিন্তিত একটি পদক্ষেপ নেয়া একান্তই জরুরী হয়ে পড়েছে বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন