You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৮শে ডিসেম্বর, শুক্রবার, ১২ই পৌষ, ১৩৮০

চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী

চোর কোন দিনই ধর্মের কাহিনী শুনতে চায় না। এটা বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত প্রবাদ। কিন্তু এ প্রবাদের গোড়ায় কুঠারাঘাত করা হয় তখনই যখন দেখতে পাওয়া যায় কোন নেতা, উপনেতা বা মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের অধিক হারে মুনাফা না করতে অনুরোধ করেন। যেন অনুরোধ করলেই সমাজের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি মুনাফা অর্জনের সনাতনী চরিত্রটি বদলে ফেলে একেবারে সাধুতে রূপান্তরিত হবেন। এটা যে হয় না তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি উপদেশ বা অনুরোধে কাজ হতো তাহলে এক টাকার মাল একশ’ টাকায় বিক্রি হতো না। ব্যবসায়ীরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ন্যায্যমূল্যেই জিনিসপত্র বিক্রি করতো। কিন্তু বাস্তবে তো তা হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই বিষয়টিকে বাস্তবতার আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সিগারেটের কোন অভাব নেই। প্রয়োজনীয় হারে সিগারেট তৈরি হচ্ছে। অথচ বাজারে সিগারেট কিনতে গেলে ১.৭০ টাকার ক্যাপষ্টান সিগারেটের জন্য খদ্দেরদের দিতে হয় ২.৫০ টাকা থেকে ৩.০০ টাকা পর্যন্ত। অন্যান্য ব্র্যান্ডের সিগারেটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
গতকালই স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, বর্তমানে সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় মজুতদার ও ভূয়া ডিলার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টোবাকো কোম্পানির একজন পরিবেশক বলেছেন যে, সারাদেশে অসংখ্য ভুয়া ডিলার রয়েছে। এরাই সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগায়। ছোট ছোট সিগারেটের দোকানদাররা অভিযোগ করেছে যে, তারা কোন দিনই ন্যায্যমূল্যে সিগারেট পায় না। ষ্টার ও ক্যাপষ্টান সিগারেটের ন্যায্যমূল্য হলো প্রতি হাজার যথাক্রমে ৬২.১৫ টাকা ও ১৬৬.৩০ টাকা অথচ তাদের কিনতে হয় ষ্টার সিগারেট ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় এবং ক্যাপষ্টান সিগারেট ২৩৫ টাকা থেকে ২৪০ টাকায়। তারা আরো অভিযোগ করে যে পাইকারি বিক্রেতারা অনেক সময়ে সিগারেট মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং তাঁরই বদৌলতে বাজারে দাম বৃদ্ধি পায়।
উল্লেখিত সংবাদ থেকে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, উপদেশ বা অনুরোধ করে ভুয়া ডিলারের সংখ্যা কমানো যাবে না বা সিগারেটের বাজারের আগুনকে নেভানো যাবে না। এ জন্য চাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। ডিলারশিপ বাতিল থেকে আরম্ভ করে যত রকমের প্রয়োজনীয় পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন তাই এক্ষেত্রে করতে হবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শুধু সিগারেট নয় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যাপারেও একথা প্রযোজ্য। ইধার কা মাল উধার করে টু পাইস কামাবার যে প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তাকে শত্রু হাতে দমন করা প্রয়োজন। ওসব ছেঁদো কথায় ভবু যে ভুলবে না তাতো বোঝাই যাচ্ছে।

বেতন কমিশনের রিপোর্টটি কি তাহলে প্রহসন ছিল!

আমাদের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ গত মঙ্গলবার ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে এক ভাষণ দান করেছেন। উক্ত ভাষণে জবাব তাজউদ্দীন বহুদিনের থেকে একটি ভিন্ন ধর্মী বক্তব্য রেখেছেন। প্রয়োজনবোধে বেতন কমিশনের রিপোর্ট পুনঃবিবেচনা করা যেতে পারে বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বলেছেন- কোন রিপোর্টই ঐশী গ্রন্থের মত অপরিবর্তনীয় লিখন নয়- অতএব বেতন কমিশনের রিপোর্টও পরিবর্তন হতে পারে। অর্থমন্ত্রী সাহেব তার ভাষণে আরো বিস্তারিতভাবে বলতে গিয়ে অনেক কিছুই ব্যক্ত করে ফেলেছেন। চাকুরি পুনর্বিন্যাস ও বেতন কমিশন রিপোর্ট প্রণয়নে বিভিন্ন বাধা বিপত্তি নাকি ছিল এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে প্রণয়ন করতে হয়েছে। ফলে উক্ত রিপোর্টে কিছু কিছু অসামঞ্জস্য বাধার সৃষ্টি হয়েছে বলেও তিনি স্বীকারোক্তি করেছেন।
আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এই ভাষণটি অতীতের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী বলে আমাদের মনে হয়েছে। বেতন কমিশন রিপোর্ট যখন প্রকাশ করা হয়েছিল তখন তার স্বপক্ষে কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়েছিলেন। মন্ত্রী সাহেবও তার থেকে বাদ ছিলেন না। চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিটি করে তখন সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে নিজে নিজেই অনেক বাহবা নিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রের সঙ্গে আমরাও সেদিন খুব সহজে তাদের এ কৃতিত্ব ঢালাও ভাবে মেনে নিতে পারিনি। আমরা সেদিনও বলেছিলাম চাকুরি পুনর্বিন্যাস ও নতুন বেতন কমিশনের রিপোর্ট কতটুকু বাস্তবানুগ হয়েছে তা দেশের কর্মজীবী মানুষই নির্ণয় করবে। বাস্তবতার সঙ্গে যদি নতুন বেতন কমিশনের রিপোর্ট সঙ্গতিপূর্ণ হয় তাহলে কমিশনের কর্তাদের সার্থকতা। তাছাড়া কোন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত করার পূর্বে জনমতের উপর অবশ্যই নির্ভরশীল হতে হয়। তাড়াহুড়ো করে এধরনের একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনা হলে বাস্তবে যেয়ে তা বাধা পেতে বাধ্য। অতএব বেতন কমিশনের রিপোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই সময় ও জনমতের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। মাননীয় অর্থমন্ত্রী সাহেব আজ যে ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্যটি রেখেছেন তাও নিঃসন্দেহে জনমতের চাপের কাছে নতিস্বীকার ছাড়া আর কিছুই নয়। তাড়াহুড়ো করে একটি বেতন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছেন তা আজ আর অর্থমন্ত্রী সাহেবও অস্বীকার করতে পারছেন না। যার দরুন বেতন কমিশনের রিপোর্টের স্বপক্ষে তো দূরের কথা- রিপোর্ট পরিবর্তন করার জন্যেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ আজ প্রস্তুত।
এমন কি তারা এ রিপোর্টকে আজ আর ঐশী গ্রন্থ মনে করেন না। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট, তাহলো- সরকারি কোন পদক্ষেপই এমন হওয়া উচিত নয় যা কি না জনমতের পরিপন্থী। একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরে জনমতের চাপের কাছে আবার পরাজয় মেনে নিয়ে সুর নরম করার কোন অর্থ আছে বলে আমরা মনে করি না। বিশেষ করে এ দেশের লক্ষ লক্ষ চাকুরিজীবীর ভাগ্য নিয়ে এহেন প্রহসন মোটেই সুস্থ মস্তিষ্ক প্রসূত বলে আমরা মেনে নিতে পারি না। আমাদের তাই অভিমত- বেতন কমিশনের রিপোর্ট পুনর্বিবেচনা করা হোক এবং জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যতদূর সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হোক। যেহেতু দেশে বিভিন্ন প্রকার বেতন স্কেল ও চাকুরির প্রকৃতি রয়েছে সেহেতু সকল শ্রেণির ও বেতনের চাকুরিজীবীদের দাবী-দাওয়া বিবেচনা করে এর পরিবর্তন অত্যাবশ্যক বলে আমরা মনে করি।

চা-শিল্পের ভবিষৎ

আমাদের দেশে প্রধান যে দুটি জিনিস দিয়ে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকি, চা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি। সেই চা-শিল্প সম্পদ আজ আমরা হারাতে বসেছি। অবস্থা দৃষ্টে অন্ততঃ তাই প্রতীয়মান হচ্ছে। পরিবহন ধরেই চা শিল্প নানাবিধ ঝামেলার সম্মুখীন। পত্রিকান্তরে এ সম্পর্কিত খবরও প্রকাশিত হয়েছে। বাক্স, প্যাকিং ও পরিবহন ইত্যাদির অভাবে লক্ষ লক্ষ টাকার উৎপাদিত চা নষ্ট হয়ে যাবার সংবাদও ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত সংবাদগুলির পরিপ্রেক্ষিতে চা শিল্প সম্বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা সজাগ ও সক্রিয় হবেন এটাই স্বাভাবিকভাবে আশা করার কথা। কিন্তু এখনও শুধু উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে এবং সে আলোচনায় কয়লার বদলে গ্যাস ব্যবহার করার বিকল্প পন্থা গ্রহণ করার সম্ভাব্যতা পরখ করে দেখার আহ্বান জানানো হচ্ছে। পরখ করার কাজ কখন শুরু হবে তার কোন নির্দেশ বা সম্ভাব্য সময়সীমাও উল্লেখ করা হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়- স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে যখন যুগপৎ পাকিস্তানের বাজার হারিয়েছে তখন অন্যদিকে চা উৎপাদনের খরচ অনেকাংশে বেড়েছে। তার উপর সংশ্লিষ্ট নানাবিধ গাফিলতি, খামখেয়ালিপনা ও ঔদাসীন্যের জন্য চা শিল্প ক্রমশঃ অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে চা শিল্প সঙ্কট চক্রাকারে বাড়ছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তা উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাব বিস্তার করছে। জাতির জন্য যা সত্যিই অশুভ। প্রাসঙ্গিকভাবে আরও বলা যায়, ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে বাংলাদেশ ২৪ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল। যদি চা শিল্পের দিকে নজর না দেওয়া হয় তাহলে এই অংক দেশের বর্তমান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষে নেমে ১২ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। চা শিল্প সম্পর্কে আলোচনার প্রেক্ষিতে যে সকল পরিকল্পনা নেওয়া হয, তাতে কোন বিশেষ দিকনির্দেশ না করেই চা উৎপাদন মূল্য কমিয়ে চা-এর মান উন্নয়নের কথা বলা হয়। এবং বলা হয় ও ১৯৭৭-৭৮ সালের মধ্যে ৬ কোটি পাউন্ড চা রফতানি করে প্রায় ১২ কোটি টাকা আয় করা হবে। নিঃসন্দেহে এসবই আশার কথা কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে তার কতটুকু সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং কবে হবে তা প্রণিধানযোগ্য। শুধু তাই নয়, একটি সমস্যা অন্য সহস্র সমস্যার সঙ্গে জড়িত থাকে। তাই চা শিল্পের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার শ্রমিক এবং তাদের উপর নির্ভরশীল প্রায় পাঁচ লাখ জনসংখ্যা দুর্ভাগ্যও জড়িত হয়েই রয়েছে। সেদিকটাও যে উপেক্ষণীয় নয়- সে কথা বলাই বাহুল্য। পরিশেষে, পরিকল্পনা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ইত্যাদি যা-ই হোক না কেন জাতীয় সম্পদ হিসেবে ধরে নিয়ে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র শিল্পকে আজ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর শপথ নিতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের কোনরকম গাফিলতি, চিলানীতি, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের উপদেশ ইত্যাদি শুনে আমাদের লাভ নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!